[এর আগের ২য় পর্ব - সাংখ্যযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে গীতা - ২য় পর্ব ]
তৃতীয় অধ্যায়ঃ কর্মযোগ
|
৩/১ |
অর্জুন বললেন- হে
জনার্দ্দন, তোমার মতে কর্মযোগের থেকে জ্ঞানযোগই যদি শ্রেষ্ঠ পথ হয়, তাহলে হে
কেশব, কেন আমাকে এইরকম ভয়ংকর যুদ্ধ করতে উৎসাহ দিচ্ছ? |
||
|
৩/২ |
কখনো জ্ঞানের, কখনো
কর্মের প্রশংসা করে, তুমি আমার মনকে দ্বিধায় বিভ্রান্ত করে তুলেছ, আমাকে তুমি
এমন একটি পথের সন্ধান দাও, যা আমার পক্ষে নিশ্চিত মঙ্গলকর হবে।
|
||
|
৩/৩ |
শ্রী ভগবান বললেন- হে
সরল মনের অর্জুন, এই সংসারে দুরকম নিষ্ঠার কথা আমি তোমাকে বলছি – সাংখ্য অর্থাৎ
শুদ্ধ চিত্তদের জন্যে জ্ঞানযোগ আর ফলের কামনাহীন কর্মযোগীর জন্য কর্মযোগ। |
||
|
৩/৪ |
কর্মযোগের মাধ্যমে মানুষ
কর্ম না করলে তার মোহমুক্ত শুদ্ধ আত্মজ্ঞান সম্ভব নয়। আবার কর্মত্যাগ করে
শুধুমাত্র জ্ঞানযোগেও সিদ্ধি লাভ হতে পারে না। |
||
|
৩/৫ |
কাজ না করে এক
মূহুর্তের জন্যেও কেউ কখনো থাকতে পারে না। কারণ প্রকৃতির সহজাত সত্ত্ব, রজঃ আর
তমঃ এই তিন গুণের প্রভাবে মানুষ কাজ করতে বাধ্য হয়। |
||
|
৩/৬ |
যে মূর্খ ব্যক্তি কাজ
করার ইন্দ্রিয় হাত, পা ইত্যাদিকে নিষ্ক্রিয় কিংবা সংযত ক’রে, মনে মনে বিষয়ের কথা
চিন্তা করে, সে ভণ্ড এবং মিথ্যাবাদী।
|
||
|
৩/৭ |
হে অর্জুন, যিনি মনের
বিবেক অনুসারে জ্ঞানের পাঁচটি (চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিহ্বা) ইন্দ্রিয়কে সংযত ক’রে,
এবং ফলের প্রত্যাশা না ক’রে কাজের পাঁচটি (হাত, পা ইত্যাদি) ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে
কাজ করতে থাকেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ। |
||
|
৩/৮ |
অতএব হে অর্জুন, সবসময়েই
তোমাকে কাজ করে যেতে হবে, কারণ অলস থাকার চেয়ে কর্মরত থাকা অনেক ভালো। তাছাড়া
কোন কাজ না করলে তোমার শরীরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। |
||
|
৩/৯ |
পরমার্থ লাভের জন্য যে
কাজ তাকে যজ্ঞ বলে, এছাড়া অন্য কাজে মানুষ কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অতএব হে কৌন্তেয়, তুমি
বিষয় বাসনা ত্যাগ করে একনিষ্ঠ মনে কাজ করতে থাকো। |
||
|
৩/১০ |
প্রাচীনকালে সৃষ্টির
আদিতে, প্রজাপতি ব্রহ্মা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে সমস্ত প্রজাদের সৃষ্টি করে বলেছিলেন –
তোমরা যজ্ঞের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠো, এই যজ্ঞই তোমাদের মনের সকল ইচ্ছা পূরণ
করুক। |
||
|
৩/১১ |
এই যজ্ঞ দিয়েই তোমরা
দেবতাদের আপ্যায়ন করো, দেবতারাও এই যজ্ঞের মাধ্যমেই তোমাদের মঙ্গল বিধান করুন।
পারষ্পরিক ভাবনার এই আদান প্রদানের মধ্যে দিয়েই সকলের মঙ্গল ঘটতে থাকবে। |
||
|
৩/১২ |
যজ্ঞের আরাধনায়
সন্তুষ্ট দেবতাগণ তোমাদেরকে মনোমত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। সুতরাং দেবতার দেওয়া
এই ভোগ্য, দেবতাকে নিবেদন না করে যে ব্যক্তি নিজেই সম্পূর্ণ ভোগ করে, সে একজন
চোর।
|
||
|
৩/১৩ |
দেবতাকে নিবদনের পর যে
ব্যক্তি যজ্ঞের প্রসাদ ভোগ করেন, তিনি সদাচারী ও সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন।
কিন্তু যে ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের জন্যে রান্না করে, সে দুরাচারী এবং আসলে সে পাপই
ভোজন করে থাকে। |
||
|
৩/১৪ |
অন্ন সমস্ত ভূতের
অর্থাৎ জীবের জীবন ধারণ করায়। মেঘের বৃষ্টি থেকেই অন্নশস্য বেড়ে ওঠে। যজ্ঞে
সন্তুষ্ট হয়ে আদিত্য মেঘের সৃষ্টি করেন এবং একনিষ্ঠ কর্মথেকেই যজ্ঞ সফল হয়ে ওঠে। |
||
|
৩/১৫ |
আরো জেনে রাখো, ব্রহ্ম
থেকেই সকল কর্মের উৎপত্তি এবং পরমেশ্বর থেকে ব্রহ্মের। অতএব সর্বব্যাপী পরমেশ্বর
ও ব্রহ্ম সর্বদাই যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত থাকেন।
|
||
|
৩/১৬ |
হে পার্থ, পরমেশ্বরের
গড়ে তোলা এই আবর্তনশীল কর্মচক্রের অনুসরণ না করে, যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়ের আরামের
জন্যে অলস পাপে জীবন কাটায়, সেই ব্যক্তির বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই। |
||
|
৩/১৭ |
কিন্তু যে ব্যক্তির
অন্তরে ঈশ্বর উপলব্ধি হয়েছে, সে আত্মাতেই প্রীত হয়, আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকে, সেই
ব্যক্তির কর্ম অনুষ্ঠানের প্রয়োজন শেষ হয়েছে। |
||
|
৩/১৮ |
যে ব্যক্তির আত্মজ্ঞান হয়েছে, তাঁর এই জীবনে আর কর্ম না করলেও চলে যায়। কর্ম না করলেও তাঁর কোন অনাচার হয় না। কারণ, পৃথিবীতে কোন প্রাণীর সঙ্গেই তাঁর আর কোন সম্পর্কের দায় থাকে না।
|
||
|
৩/১৯ |
অতএব তুমিও কামনাহীন
হয়ে সবসময় কর্তব্য কর্ম করতে থাকো। কারণ মন থেকে সমস্ত আসক্তি মুছে, একনিষ্ঠ কাজ
করলেই পরমব্রহ্ম লাভ হয়।
|
||
|
৩/২০ |
জনক, অশ্বপতির মতো
রাজর্ষিরা মনে কোন কামনা না রেখে কাজ করতেন বলেই তাঁরা সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সকল
কর্ম লোকহিতের জন্যেই করা উচিৎ। |
||
|
৩/২১ |
যে কোন সম্প্রদায়ের
নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যেমন আচরণ করেন, সাধারণ জনগণও তাঁর অনুসরণে একই রকম আচরণ
করে থাকে। মহৎ ব্যক্তিরা যেমন দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, সাধারণে তাকেই আদর্শ মনে
করে। |
||
|
৩/২২ |
হে পার্থ, এই তিন লোকে
আমার করার মতো কোন কাজই আর অবশিষ্ট নেই। এই ত্রিভুবন থেকে এমন কিছু নেই যা আমি
পেতে পারি, না আমার কিছু পাওয়ার আছে। তা সত্ত্বেও আমি কাজে ব্যস্ত থাকি।
|
||
|
৩/২৩ |
হে পার্থ, আমি যদি
সর্বদা অনলস কাজে ব্যস্ত না থাকি, সাধারণ মানুষ আমার দেখানো পথই অনুসরণ করবে,
অর্থাৎ কাজ না করে অলস হয়ে যাবে। |
||
|
৩/২৪ |
আমার কাজ না করার
অনুসরণ করে, সাধারণ লোক তাদের কর্তব্য কর্ম না করলে সামাজিক পতন শুরু হয়ে যাবে।
সেক্ষেত্রে আমিই হবো, এই সমাজের বিশৃঙ্খলা এবং প্রজাদের বিনাশের একমাত্র কারণ। |
||
|
৩/২৫ |
হে পার্থ, অজ্ঞানীরা
ফলের প্রত্যাশায় যে উৎসাহে কাজ করে, জ্ঞানীব্যক্তিদের কোন প্রত্যাশা না করে
শুধুমাত্র জনহিতের জন্যে, একই ভাবে কাজ করা উচিৎ। |
||
|
৩/২৬ |
কামনায় আসক্ত অজ্ঞানী
লোকের মনে কাজ নিয়ে কোন বিভ্রান্তি যেন তৈরি না হয়। জ্ঞানীদের উচিৎ সঠিক পন্থায়
কাজ করে, অজ্ঞানীদের সামনে তার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করা। |
||
|
৩/২৭ |
সত্ত, রজঃ ও তমঃ
প্রকৃতির এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে সকল কাজ সম্পন্ন হয়। অহংকারে যে অজ্ঞানীর মন
আচ্ছন্ন, সে মনে করে ‘আমিই সব কাজের কর্তা’। |
||
|
৩/২৮ |
হে মহাবীর, সকল কর্মের
ভাগ ও প্রবৃত্তি, দেহের তিনটি গুণ অনুসারে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু আত্মার কোন গুণ
নেই বলেই, জ্ঞানী ব্যক্তিরা কর্তৃত্বের অহংকার করেন না।
|
||
|
৩/২৯ |
প্রকৃতির এই তিনগুণে
আচ্ছন্ন ব্যক্তিরা, কর্ম অনুযায়ী ফলের কামনায় আসক্ত হয়। সর্বজ্ঞ ব্যক্তিরা এই
অজ্ঞানীদের যেন বিচলিত না করেন বা বিপথে পরিচালনা না করেন। |
||
|
৩/৩০ |
তোমার বিবেক ও
আত্মবুদ্ধি অনুসারে করা সমস্ত কর্তব্য কর্ম তুমি আমাকে সমর্পণ করো। পরিণামের আশা
ত্যাগ করে, নির্বিকার ও উদাসীন মনে তুমি যুদ্ধ করো। |
||
|
৩/৩১ |
প্রকৃত শ্রদ্ধার সঙ্গে,
কাউকে কোন দোষারোপ না করে, আমার মত অনুযায়ী যিনি অনাসক্ত কর্মের অনুষ্ঠান করেন,
তিনি ধর্ম এবং অধর্মের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হন। |
||
|
৩/৩২ |
এটাও জেনে রাখো, যারা
আমার এই মতের নিন্দা করে এবং আমার এই নির্দেশ পালন না করে, সেই বুদ্ধিহীন
ব্যক্তিরা কখনো জ্ঞান লাভ করতে পারে না এবং তাদের মুক্তিরও কোন আশা নেই। |
||
|
৩/৩৩ |
সাধারণ মানুষ তো বটেই,
জ্ঞানী ব্যক্তিরাও তাঁদের নিজেদের স্বভাব অনুসারে কাজ করে থাকেন, কাজেই তাদের
শাসন করে বা নিষেধ করে কি হবে?
|
||
|
৩/৩৪ |
মানুষের সকল ইন্দ্রিয়ের
মধ্যেই প্রিয় বস্তুতে আসক্তি ও অপ্রিয় বস্তুতে বিদ্বেষ স্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই
আসক্তি কিংবা বিদ্বেষের বশীভূত হয়ো না, কারণ পরমজ্ঞান লাভের পথে এরাই বিশেষ বাধা
সৃষ্টি করে। |
||
|
৩/৩৫ |
নিজের ধর্ম পালনে
ত্রুটি হলেও, পরের ধর্ম খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেয়ে, তা অনেক ভাল। নিজের
স্বভাবধর্মে মৃত্যু বরণ করাও মঙ্গলকর, কিন্তু পরের ধর্ম ভয়ংকর। |
||
|
৩/৩৬ |
অর্জুন বললেন- হে
কৃষ্ণ, তাহলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে কে দুষ্কর্ম করতে পরিচালিত করে, আর কেই বা
তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করায়? |
||
|
৩/৩৭ |
শ্রী ভগবান বললেন –
মহাশক্তিধর কামনা এবং উগ্র ক্রোধ মানুষের মনের রজঃগুণ থেকে আসে। জেনে রাখো, জগতে
এরাই তোমার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। |
||
|
৩/৩৮ |
ধোঁয়া যেমন আগুনকে, ধুলো
যেমন আয়নাকে, জরায়ু যেমন গর্ভকে আচ্ছন্ন করে থাকে, ঠিক তেমনই মানুষের
বিবেকবুদ্ধি ও জ্ঞান, কামনায় আচ্ছন্ন থাকে।
|
||
|
৩/৩৯ |
হে কুন্তীপুত্র অর্জুন,
এই কামনা ও আসক্তি জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তাই এরা জ্ঞানীব্যক্তিদের
চিরশত্রু। কামনা আগুনের মতোই তীব্র দহনশীল। |
||
|
৩/৪০ |
মানুষের সমস্ত
ইন্দ্রিয়, মন ও বিবেকবুদ্ধিতেই কামনার বাসা। মানুষ বিভ্রান্ত হয় কামনায় আচ্ছন্ন বুদ্ধির
দোষে। |
||
|
৩/৪১ |
হে ভরতকুলতিলক, তুমি
আগে তোমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সংযত করো, নিয়ন্ত্রণ করো, তারপর তোমার বুদ্ধি ও
পরমতত্ত্ব জ্ঞানের চিরশত্রু, এই কামনাকে ত্যাগ করো। |
||
|
৩/৪২ |
স্থূল শরীরের চেয়ে
ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষের মন। মনের থেকেও বুদ্ধি
শ্রেষ্ঠ। আর এই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন যে আত্মা, তিনি বুদ্ধির অতীত এবং
সর্বশ্রেষ্ঠ।
|
||
|
৩/৪৩ |
হে মহাবীর, শুদ্ধ
বুদ্ধির থেকেও শ্রেষ্ঠ, নিজের অবিচলিত আত্মার এই স্বরূপ উপলব্ধি ক’রে, কামনার
মতো ভয়ংকর শত্রুকে নির্বিকারভাবে জয় করো।
|
কর্মযোগ সমাপ্ত
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন