বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৫

গীতা - ৩য় পর্ব

                     [এর আগের ২য় পর্ব - সাংখ্যযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে গীতা - ২য় পর্ব ]



তৃতীয় অধ্যায়ঃ কর্মযোগ


৩/১

অর্জুন উবাচ

জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দন।

তৎ কিং কর্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব।।

অর্জুন উবাচ

জ্যায়সী চেৎ কর্মণঃ তে মতা বুদ্ধিঃ জনার্দন।

তৎ কিং কর্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব।।

অর্জুন বললেন- হে জনার্দ্দন, তোমার মতে কর্মযোগের থেকে জ্ঞানযোগই যদি শ্রেষ্ঠ পথ হয়, তাহলে হে কেশব, কেন আমাকে এইরকম ভয়ংকর যুদ্ধ করতে উৎসাহ দিচ্ছ?

  

৩/২

ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে।

তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োঽহমাপ্নুয়াম্‌।।

ব্যামিশ্রেণ ইব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সি ইব মে।

তৎ একং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়ঃ অহম্‌ আপ্নুয়াম্‌।।

কখনো জ্ঞানের, কখনো কর্মের প্রশংসা করে, তুমি আমার মনকে দ্বিধায় বিভ্রান্ত করে তুলেছ, আমাকে তুমি এমন একটি পথের সন্ধান দাও, যা আমার পক্ষে নিশ্চিত মঙ্গলকর হবে।

 

৩/৩

শ্রীভগবানুবাচ

লোকেঽস্মিন দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।

জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাম্‌।

শ্রীভগবান্‌ উবাচ

লোকে অস্মিন দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়া অনঘ।

জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাম্‌।

শ্রী ভগবান বললেন- হে সরল মনের অর্জুন, এই সংসারে দুরকম নিষ্ঠার কথা আমি তোমাকে বলছি – সাংখ্য অর্থাৎ শুদ্ধ চিত্তদের জন্যে জ্ঞানযোগ আর ফলের কামনাহীন কর্মযোগীর জন্য কর্মযোগ।

 

৩/৪

ন কর্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোঽশ্নুতে।

ন চ সংন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি।।

ন কর্মণাম্‌ অনারম্ভাৎ নৈষ্কর্ম্যং পুরুষঃ অশ্নুতে।

ন চ সংন্যসনাৎ এব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি।।

কর্মযোগের মাধ্যমে মানুষ কর্ম না করলে তার মোহমুক্ত শুদ্ধ আত্মজ্ঞান সম্ভব নয়। আবার কর্মত্যাগ করে শুধুমাত্র জ্ঞানযোগেও সিদ্ধি লাভ হতে পারে না।

 

৩/৫

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।

কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ।।

ন হি কঃ চিৎ ক্ষণম্‌ অপি জাতু তিষ্ঠতি অকর্মকৃৎ।

কার্যতে হি অবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈঃ গুণৈঃ।।

কাজ না করে এক মূহুর্তের জন্যেও কেউ কখনো থাকতে পারে না। কারণ প্রকৃতির সহজাত সত্ত্ব, রজঃ আর তমঃ এই তিন গুণের প্রভাবে মানুষ কাজ করতে বাধ্য হয়।

 

৩/৬

কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্‌।

ইন্দ্রিয়ার্থান্‌ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে।।

কর্ম-ইন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্‌।

ইন্দ্রিয়-অর্থান্‌ বিমূঢ়-আত্মা মিথ্যা-আচারঃ স উচ্যতে।।

যে মূর্খ ব্যক্তি কাজ করার ইন্দ্রিয় হাত, পা ইত্যাদিকে নিষ্ক্রিয় কিংবা সংযত ক’রে, মনে মনে বিষয়ের কথা চিন্তা করে, সে ভণ্ড এবং মিথ্যাবাদী।

  

৩/৭

যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেঽর্জুন।

কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে।।

যঃ তু ইন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্য আরভতে অর্জুন।

কর্ম-ইন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগম্‌ অসক্তঃ স বিশিষ্যতে।।

হে অর্জুন, যিনি মনের বিবেক অনুসারে জ্ঞানের পাঁচটি (চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিহ্বা) ইন্দ্রিয়কে সংযত ক’রে, এবং ফলের প্রত্যাশা না ক’রে কাজের পাঁচটি (হাত, পা ইত্যাদি) ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কাজ করতে থাকেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ।

 

৩/৮

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।

শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্মণঃ।।

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ঃ হি অকর্মণঃ।

শরীরযাত্রা অপি চ তে ন প্রসিধ্যেৎ অকর্মণঃ।।

অতএব হে অর্জুন, সবসময়েই তোমাকে কাজ করে যেতে হবে, কারণ অলস থাকার চেয়ে কর্মরত থাকা অনেক ভালো। তাছাড়া কোন কাজ না করলে তোমার শরীরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।

 

৩/৯

যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোঽন্যত্র লোকোঽয়ং কর্মবন্ধনঃ।

তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।।

যজ্ঞার্থাৎ কর্মণঃ অন্যত্র লোকঃ অয়ং কর্মবন্ধনঃ।

তৎ-অর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।।

পরমার্থ লাভের জন্য যে কাজ তাকে যজ্ঞ বলে, এছাড়া অন্য কাজে মানুষ কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ হয় অতএব হে কৌন্তেয়, তুমি বিষয় বাসনা ত্যাগ করে একনিষ্ঠ মনে কাজ করতে থাকো।

  

৩/১০

সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ।

অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোঽস্ত্বিষ্টকামধুক্‌।।

সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরা উবাচ প্রজাপতিঃ।

অনেন প্রসবিষ্যধ্বম্‌ এষঃ বঃ অস্তু ইষ্ট-কামধুক্‌।।

প্রাচীনকালে সৃষ্টির আদিতে, প্রজাপতি ব্রহ্মা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে সমস্ত প্রজাদের সৃষ্টি করে বলেছিলেন – তোমরা যজ্ঞের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠো, এই যজ্ঞই তোমাদের মনের সকল ইচ্ছা পূরণ করুক।

 

৩/১১

দেবান্‌ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।

পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ।।

দেবান্‌ ভাবয়ত অনেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।

পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরম্‌ অবাপ্স্যথ।।

এই যজ্ঞ দিয়েই তোমরা দেবতাদের আপ্যায়ন করো, দেবতারাও এই যজ্ঞের মাধ্যমেই তোমাদের মঙ্গল বিধান করুন। পারষ্পরিক ভাবনার এই আদান প্রদানের মধ্যে দিয়েই সকলের মঙ্গল ঘটতে থাকবে।

 

৩/১২

ইষ্টান্‌ ভোগান্‌ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ।

তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্‌ক্তে স্তেন এব সঃ।।

ইষ্টান্‌ ভোগান্‌ হি বঃ দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ।

তৈঃ দত্তান্‌ অপ্রদায় এভ্যঃ যঃ ভুঙ্‌ক্তে স্তেনঃ এব সঃ।।

যজ্ঞের আরাধনায় সন্তুষ্ট দেবতাগণ তোমাদেরকে মনোমত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। সুতরাং দেবতার দেওয়া এই ভোগ্য, দেবতাকে নিবেদন না করে যে ব্যক্তি নিজেই সম্পূর্ণ ভোগ করে, সে একজন চোর।

  

৩/১৩

যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্‌বিষৈঃ।

ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ।।

যজ্ঞশিষ্ট-অশিনঃ সন্তঃ মুচ্যন্তে সর্বকিল্‌বিষৈঃ।

ভুঞ্জতে তে তু অঘং পাপাঃ যে পচন্তি আত্মকারণাৎ।।

দেবতাকে নিবদনের পর যে ব্যক্তি যজ্ঞের প্রসাদ ভোগ করেন, তিনি সদাচারী ও সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন। কিন্তু যে ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের জন্যে রান্না করে, সে দুরাচারী এবং আসলে সে পাপই ভোজন করে থাকে।

 

৩/১৪

অন্নাদ্ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।

যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ।।

অন্নাৎ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাৎ অন্নসম্ভবঃ।

যজ্ঞাৎ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ।।

অন্ন সমস্ত ভূতের অর্থাৎ জীবের জীবন ধারণ করায়। মেঘের বৃষ্টি থেকেই অন্নশস্য বেড়ে ওঠে। যজ্ঞে সন্তুষ্ট হয়ে আদিত্য মেঘের সৃষ্টি করেন এবং একনিষ্ঠ কর্মথেকেই যজ্ঞ সফল হয়ে ওঠে।

  

৩/১৫

কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্‌।

তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্‌।।

কর্ম ব্রহ্ম উদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্ম-অক্ষর-সমুদ্ভবম্‌।

তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্‌।।

আরো জেনে রাখো, ব্রহ্ম থেকেই সকল কর্মের উৎপত্তি এবং পরমেশ্বর থেকে ব্রহ্মের। অতএব সর্বব্যাপী পরমেশ্বর ও ব্রহ্ম সর্বদাই যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত থাকেন।

 

৩/১৬

এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ।

অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি।।

এবং প্রবর্তিতং চক্রং ন অনুবর্তয়তি ইহ যঃ।

অঘ-আয়ুঃ ইন্দ্রিয়-আরামঃ মোঘং পার্থ স জীবতি।।

হে পার্থ, পরমেশ্বরের গড়ে তোলা এই আবর্তনশীল কর্মচক্রের অনুসরণ না করে, যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়ের আরামের জন্যে অলস পাপে জীবন কাটায়, সেই ব্যক্তির বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই।

  

৩/১৭

যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ।

আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্যং ন বিদ্যতে।।

যঃ তু আত্মরতিঃ এব স্যাৎ আত্মতৃপ্তঃ চ মানবঃ।

আত্মনি এব চ সন্তুষ্টঃ তস্য কার্যং ন বিদ্যতে।।

কিন্তু যে ব্যক্তির অন্তরে ঈশ্বর উপলব্ধি হয়েছে, সে আত্মাতেই প্রীত হয়, আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকে, সেই ব্যক্তির কর্ম অনুষ্ঠানের প্রয়োজন শেষ হয়েছে।

 

৩/১৮

নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন।

ন চাস্য সর্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ।।

ন এব তস্য কৃতেন-অর্থঃ ন অকৃতেন ইহ কঃ চন।

ন চ অস্য সর্বভূতেষু কঃ চিৎ অর্থব্যপাশ্রয়ঃ।।

যে ব্যক্তির আত্মজ্ঞান হয়েছে, তাঁর এই জীবনে আর কর্ম না করলেও চলে যায়। কর্ম না করলেও তাঁর কোন অনাচার হয় না। কারণ, পৃথিবীতে কোন প্রাণীর সঙ্গেই তাঁর আর কোন সম্পর্কের দায় থাকে না।

 

৩/১৯

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।

অসক্তো হ্যাচরন্‌ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।।

তস্মাৎ অসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।

অসক্তঃ হি আচরন্‌ কর্ম পরম্‌ আপ্নোতি পুরুষঃ।।

অতএব তুমিও কামনাহীন হয়ে সবসময় কর্তব্য কর্ম করতে থাকো। কারণ মন থেকে সমস্ত আসক্তি মুছে, একনিষ্ঠ কাজ করলেই পরমব্রহ্ম লাভ হয়।

 

৩/২০

কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।

লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্‌ কর্তুমর্হসি।।

কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিম্‌ আস্থিতা জনকাদয়ঃ।

লোক-সংগ্রহম্‌ এব অপি সংপশ্যন্‌ কর্তুম্‌ অর্হসি।।

জনক, অশ্বপতির মতো রাজর্ষিরা মনে কোন কামনা না রেখে কাজ করতেন বলেই তাঁরা সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সকল কর্ম লোকহিতের জন্যেই করা উচিৎ।

    

৩/২১

যদ্‌ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবতরো জনঃ।

স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।।

যৎ যৎ-আচরতি শ্রেষ্ঠঃ তৎ তৎ এব ইতরঃ জনঃ।

স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকঃ তৎ-অনুবর্ততে।।

যে কোন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যেমন আচরণ করেন, সাধারণ জনগণও তাঁর অনুসরণে একই রকম আচরণ করে থাকে। মহৎ ব্যক্তিরা যেমন দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, সাধারণে তাকেই আদর্শ মনে করে।

 

৩/২২

ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।

নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি।।

ন মে পার্থ অস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।

ন অনবাপ্তম্‌-অবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি।।

হে পার্থ, এই তিন লোকে আমার করার মতো কোন কাজই আর অবশিষ্ট নেই। এই ত্রিভুবন থেকে এমন কিছু নেই যা আমি পেতে পারি, না আমার কিছু পাওয়ার আছে। তা সত্ত্বেও আমি কাজে ব্যস্ত থাকি।

 

৩/২৩

যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।

মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।

যদি হি অহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্য-তন্দ্রিতঃ।

মম বর্ত্ম-অনুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।

হে পার্থ, আমি যদি সর্বদা অনলস কাজে ব্যস্ত না থাকি, সাধারণ মানুষ আমার দেখানো পথই অনুসরণ করবে, অর্থাৎ কাজ না করে অলস হয়ে যাবে।

 

৩/২৪

উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্‌।

সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।।

উৎসীদেয়ুঃ ইমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেৎ অহম্‌।

সঙ্করস্য চ কর্তা স্যাম্‌ উপহন্যাম্‌ ইমাঃ প্রজাঃ।।

আমার কাজ না করার অনুসরণ করে, সাধারণ লোক তাদের কর্তব্য কর্ম না করলে সামাজিক পতন শুরু হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমিই হবো, এই সমাজের বিশৃঙ্খলা এবং প্রজাদের বিনাশের একমাত্র কারণ।

     

৩/২৫

সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত।

কুর্যাদ্বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্‌।।

সক্তাঃ কর্মণি অবিদ্বাংসঃ যথা কুর্বন্তি ভারত।

কুর্যাৎ বিদ্বান্‌ তথা অসক্তঃ চিকীর্ষুঃ লোক-সংগ্রহম্‌।।

হে পার্থ, অজ্ঞানীরা ফলের প্রত্যাশায় যে উৎসাহে কাজ করে, জ্ঞানীব্যক্তিদের কোন প্রত্যাশা না করে শুধুমাত্র জনহিতের জন্যে, একই ভাবে কাজ করা উচিৎ।

 

৩/২৬

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্‌।

জোষয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্‌ যুক্তঃ সমাচরন্‌।।

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েৎ অজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্‌।

জোষয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্‌ যুক্তঃ সমাচরন্‌।।

কামনায় আসক্ত অজ্ঞানী লোকের মনে কাজ নিয়ে কোন বিভ্রান্তি যেন তৈরি না হয়। জ্ঞানীদের উচিৎ সঠিক পন্থায় কাজ করে, অজ্ঞানীদের সামনে তার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করা।

 

৩/২৭

প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মানি সর্বশঃ।

অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।

প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মানি সর্বশঃ।

অহঙ্কার-বিমূঢ়-আত্মা কর্তা অহম্‌ ইতি মন্যতে।।

সত্ত, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতির এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে সকল কাজ সম্পন্ন হয়। অহংকারে যে অজ্ঞানীর মন আচ্ছন্ন, সে মনে করে ‘আমিই সব কাজের কর্তা’।

  

৩/২৮

তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্মবিভাগয়োঃ।

গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে।।

তত্ত্ববিৎ তু মহাবাহো গুণ-কর্ম-বিভাগয়োঃ।

গুণা গুণেষু বর্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে।।

হে মহাবীর, সকল কর্মের ভাগ ও প্রবৃত্তি, দেহের তিনটি গুণ অনুসারে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু আত্মার কোন গুণ নেই বলেই, জ্ঞানী ব্যক্তিরা কর্তৃত্বের অহংকার করেন না।

 

৩/২৯

প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়া সজ্জন্তে গুণকর্মেষু।

তানকৃৎস্নবিদো মন্দান কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ।।

প্রকৃতেঃ গুণ-সংমূঢ়া সজ্জন্তে গুণকর্মেষু।

তান্‌ অকৃৎস্ন-বিদঃ মন্দান কৃৎস্নবিৎ ন বিচালয়েৎ।।

প্রকৃতির এই তিনগুণে আচ্ছন্ন ব্যক্তিরা, কর্ম অনুযায়ী ফলের কামনায় আসক্ত হয়। সর্বজ্ঞ ব্যক্তিরা এই অজ্ঞানীদের যেন বিচলিত না করেন বা বিপথে পরিচালনা না করেন।

  

৩/৩০

ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।

নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।।

ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্য অধ্যাত্ম-চেতসা।

নিরাশীঃ নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগত-জ্বরঃ।।

তোমার বিবেক ও আত্মবুদ্ধি অনুসারে করা সমস্ত কর্তব্য কর্ম তুমি আমাকে সমর্পণ করো। পরিণামের আশা ত্যাগ করে, নির্বিকার ও উদাসীন মনে তুমি যুদ্ধ করো।

   

৩/৩১

যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।

শ্রদ্ধাবন্তোঽনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেঽপি কর্মভিঃ।।

যে মে মতম্‌ ইদং নিত্যম্‌ অনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।

শ্রদ্ধাবন্তঃ অনসূয়ন্তঃ মুচ্যন্তে তে অপি কর্মভিঃ।।

প্রকৃত শ্রদ্ধার সঙ্গে, কাউকে কোন দোষারোপ না করে, আমার মত অনুযায়ী যিনি অনাসক্ত কর্মের অনুষ্ঠান করেন, তিনি ধর্ম এবং অধর্মের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হন।

    

৩/৩২

যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্‌।

সর্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্‌ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ।।

যে তু এতৎ অভ্যসূয়ন্তঃ ন অনুতিষ্ঠন্তি মে মতম্‌।

সর্বজ্ঞান-বিমূঢ়ান্‌ তান্‌ বিদ্ধি নষ্টান্‌ অচেতসঃ।।

এটাও জেনে রাখো, যারা আমার এই মতের নিন্দা করে এবং আমার এই নির্দেশ পালন না করে, সেই বুদ্ধিহীন ব্যক্তিরা কখনো জ্ঞান লাভ করতে পারে না এবং তাদের মুক্তিরও কোন আশা নেই।

  

৩/৩৩

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।

প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি।।

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতেঃ জ্ঞানবান্‌ অপি।

প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি।।

সাধারণ মানুষ তো বটেই, জ্ঞানী ব্যক্তিরাও তাঁদের নিজেদের স্বভাব অনুসারে কাজ করে থাকেন, কাজেই তাদের শাসন করে বা নিষেধ করে কি হবে?

 

৩/৩৪

ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ।

তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ।।

ইন্দ্রিয়স্য ইন্দ্রিয়স্য অর্থে রাগ-দ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ।

তয়োঃ ন বশম্‌ আগচ্ছেৎ তৌ হি অস্য পরিপন্থিনৌ।।

মানুষের সকল ইন্দ্রিয়ের মধ্যেই প্রিয় বস্তুতে আসক্তি ও অপ্রিয় বস্তুতে বিদ্বেষ স্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই আসক্তি কিংবা বিদ্বেষের বশীভূত হয়ো না, কারণ পরমজ্ঞান লাভের পথে এরাই বিশেষ বাধা সৃষ্টি করে।

 

৩/৩৫

শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।।

শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মঃ বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মঃ ভয়াবহঃ।।

নিজের ধর্ম পালনে ত্রুটি হলেও, পরের ধর্ম খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেয়ে, তা অনেক ভাল। নিজের স্বভাবধর্মে মৃত্যু বরণ করাও মঙ্গলকর, কিন্তু পরের ধর্ম ভয়ংকর।

 

৩/৩৬

অর্জুন উবাচ

অথ কেন প্রযুক্তোয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ।

অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিযোজিতঃ।।

অর্জুন উবাচ

অথ কেন প্রযুক্তঃ অয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ।

অনিচ্ছন্‌ অপি বার্ষ্ণেয় বলাৎ ইব নিযোজিতঃ।।

অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, তাহলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে কে দুষ্কর্ম করতে পরিচালিত করে, আর কেই বা তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করায়?

 

৩/৩৭

শ্রীভগবানুবাচ

কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ।

মহাশনো মহাপাপ্না বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্‌।।

শ্রীভগবান্‌ উবাচ

কামঃ এষঃ ক্রোধঃ এষঃ রজোগুণসমুদ্ভবঃ।

মহাশনঃ মহাপাপ্না বিদ্ধি এনম্‌ ইহ বৈরিণম্‌।।

শ্রী ভগবান বললেন – মহাশক্তিধর কামনা এবং উগ্র ক্রোধ মানুষের মনের রজঃগুণ থেকে আসে। জেনে রাখো, জগতে এরাই তোমার সবচেয়ে বড়ো শত্রু।

 

৩/৩৮

ধূমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ।

যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্‌।।

ধূমেন আব্রিয়তে বহ্নিঃ যথা আদর্শঃ মলেন চ।

যথা উল্বেন আবৃতঃ গর্ভঃ তথা তেন ইদম্‌ আবৃতম্‌।।

ধোঁয়া যেমন আগুনকে, ধুলো যেমন আয়নাকে, জরায়ু যেমন গর্ভকে আচ্ছন্ন করে থাকে, ঠিক তেমনই মানুষের বিবেকবুদ্ধি ও জ্ঞান, কামনায় আচ্ছন্ন থাকে

 

৩/৩৯

আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা।

কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ।।

আবৃতং জ্ঞানম্‌ এতেন জ্ঞানিনঃ নিত্যবৈরিণা।

কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণ অনলেন চ।।

হে কুন্তীপুত্র অর্জুন, এই কামনা ও আসক্তি জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তাই এরা জ্ঞানীব্যক্তিদের চিরশত্রু। কামনা আগুনের মতোই তীব্র দহনশীল।

 

৩/৪০

ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে।

এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্‌।।

ইন্দ্রিয়াণি মনঃ বুদ্ধিঃ অস্য অধিষ্ঠানম্‌ উচ্যতে।

এতৈঃ বিমোহয়তি এষঃ জ্ঞানম্‌ আবৃত্য দেহিনম্‌।।

মানুষের সমস্ত ইন্দ্রিয়, মন ও বিবেকবুদ্ধিতেই কামনার বাসা। মানুষ বিভ্রান্ত হয় কামনায় আচ্ছন্ন বুদ্ধির দোষে।

 

৩/৪১

তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ।

পাপ্নানং প্রজহি হ্যেন জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্‌।।

তস্মাৎ ত্ত্বম্‌ ইন্দ্রিয়াণি আদৌ নিয়ম্য ভরত-ঋষভ।

পাপ্নানম্‌ প্রজহি হি এন জ্ঞান-বিজ্ঞান-নাশনম্‌।।

হে ভরতকুলতিলক, তুমি আগে তোমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সংযত করো, নিয়ন্ত্রণ করো, তারপর তোমার বুদ্ধি ও পরমতত্ত্ব জ্ঞানের চিরশত্রু, এই কামনাকে ত্যাগ করো।

 

৩/৪২

ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।

মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ।।

ইন্দ্রিয়াণি পরাণি আহুঃ ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।

মনসঃ তু পরা বুদ্ধিঃ যঃ বুদ্ধেঃ পরতঃ তু সঃ।।

স্থূল শরীরের চেয়ে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষের মন। মনের থেকেও বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। আর এই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন যে আত্মা, তিনি বুদ্ধির অতীত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ।

 

৩/৪৩

এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধ সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।

জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্‌।।

এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধ সংস্তভ্য আত্মানম্‌ আত্মনা।

জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্‌।।

হে মহাবীর, শুদ্ধ বুদ্ধির থেকেও শ্রেষ্ঠ, নিজের অবিচলিত আত্মার এই স্বরূপ উপলব্ধি ক’রে, কামনার মতো ভয়ংকর শত্রুকে নির্বিকারভাবে জয় করো।   

 

কর্মযোগ সমাপ্ত


চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

গীতা - ৩য় পর্ব

                          [ এর আগের ২য় পর্ব - সাংখ্যযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে  গীতা - ২য় পর্ব  ] তৃতীয় অধ্যায়ঃ কর্মযোগ ৩/১ ...