বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০২৫

মেকি মেডেল

 

 

অশীতিপর নীলিমা দুধে ভেজানো মুড়ির বাটিটা শেষ করে, দাওয়া থেকে উঠোনে নামলেন। চৈত্রের উজ্জ্বল রৌদ্রের ওমমাখা সকালে, কাঁপা-কাঁপা পায়ে উঠোনটা পেরোতে ভালই লাগছিল। সুষি থাকলে তাঁকে এভাবে হাঁটতে দিত না, হয় হাত থেকে এঁটো বাটিটা কেড়ে নিয়ে নিজেই কলতলায় যেত। টেপাকল টিপে বাটিটা ধুয়ে ফেরার সময় বাটি ভরে জল আনত তাঁর মুখটা কুলকুচি করে ধোয়ার জন্যে এবং জলেভেজা হাতে মুখ মুছিয়ে দিত নিজের হাতে। অথবা খুব জোরজার করলে, হাত ধরে পাশে পাশে হেঁটে যেত কলতলা অব্দি।

মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হন নীলিমা, তাঁর বয়েস হয়েছে ঠিকই কিন্তু এতটা অথর্বও তিনি হননি, যে নিজের এইটুকু কাজও তিনি করে উঠতে পারবেন না। কিন্তু এখন উঠোনটুকু পার হতে হতে তাঁর মনে হল, দাওয়া থেকে কলতলা পর্যন্ত উঠোনটা বিস্তর পথতাঁর দুর্বল পায়ের মন্থর গতিতে মনে হচ্ছে যেন অনন্ত পথযাত্রা। গত চল্লিশ বছর ধরে বয়স্ক হয়ে উঠতে উঠতে, তিনি বুঝতেই পারেননি, সেই ছোট্ট উঠোনটাই কোন জাদুতে এমন বিস্তীর্ণ মাঠ হয়ে উঠল!

সুষিটা তাঁকে খুব বকাবকি করে, বেশি হাঁটাচলা করতে দেয় না, তাঁকে কোন কাজই প্রায় করতে দেয় না। এখন এই উঠোন পার হতে হতে মনে হল, সুষি ঠিকই করে। প্রায় বছর তিরিশেক ধরে এই সুষি তাঁর নিত্য ছায়াসঙ্গী। সুষি তাঁকে যতটা বোঝে এবং চেনে, ততটা তিনি নিজেও বোঝেন না – চেনেন না নিজেকে। কলতলায় পৌঁছে তিনি টিউবওয়েল টেপার চেষ্টাও করলেন না। চারটে বালতিতে জল ভরে রেখে গেছে, সুষি। তার একটা থেকে মগে জল তুলে বাটি ধুলেন, কুলকুচি করে মুখ ধুলেন। জলভরা বালতিগুলোর দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, এখন চানটাও সেরে নিলে হত। নয়তো আবার এতটা হাঁটতে হবে চান করতে আসার সময়। কিন্তু তিনি তো গামছা, তেল, সাবান, শুকনো কাপড় কিছুই আনেননি...উজ্জ্বল আলো থেকে তিনি ছায়াঢাকা দাওয়ার দিকে তাকালেন একবার – সুষির ভাইঝির আজ পাকাদেখা, না গেলেই নয়, তাই দাদার বাড়ি গেছেতার ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে...হয়তো সন্ধে...। সুষিটা না থাকায় তিনি অসহায়বোধ করলেন খুব। সুষির ব্যবস্থায় অবিশ্যি কোন ফাঁক নেই, পাশের বাড়ির ঊষাকে বলে গেছে, হাতের কাজকম্ম সেরে সে চলে আসবে, যে কোন সময়। এতক্ষণ একলা এই বাড়িতে...সুষিটা তাঁর অভ্যেসটাও খারাপ করে দিয়েছে...একটা কথা বলার লোকও কেউ নেই?

“নীলিমাদেবী, বাড়ি আছেন?”

নিজের নাম শুনে অবাক চোখে তাকালেন নীলিমা, উঠোনের ওই কোণে সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কেউ ডাকছে তাঁর নাম ধরে। তাঁর কাছে অনেকেই আসে, কিন্তু বহুদিন কেউ তো এভাবে তাঁকে ডাকে না। কেউ বলে, মায়ী, কেউ বলে দিদি, কেউ বলে দিদা। নিজের এই নামটা তিনি যেন ভুলেই গেছিলেন। নীলিমা তাকিয়ে রইলেন অচেনা লোকটির দিকে। লোকটি তাঁকে দেখতে পেয়ে জিগ্যেস করল, “নীলিমাদেবী? আপনিই কী নীলিমাদেবী?” নীলিমা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন, কিছু বললেন না, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, অপেক্ষায় রইলেন, ভদ্রলোক কেন এসেছেন জানার কৌতূহলে।

ভদ্রলোক আরও ভেতরে ঢুকে এলেন, সঙ্গে আরও তিনজন। হাত তুলে আধো নমস্কার করে বললেন, “আমি সঞ্জয় দত্ত। আমরা ডিএম অফিস থেকে আসছি, আপনার জন্যে একটা সুখবর নিয়ে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এবছরের “শ্রীময়ী” অ্যাওয়ার্ডটা আপনাকেই দেওয়া হবে, কনগ্র্যাচুলেশন্‌স্‌” নীলিমা কিছু বললেন না, টিউবওয়েলের মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভদ্রলোক মুখে হাসি নিয়ে এগিয়ে এলেন, নীলিমার দিকে খাঁকি রঙের একটি লম্বা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই যে এর মধ্যে আপনার অ্যাওয়ার্ড কনফার্মেশনের চিঠি” হাত বাড়িয়ে নীলিমা খামটা নিলেন, তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলেন, হ্যাঁ তাঁর নামই লেখা আছে, নীলিমা সেনগুপ্ত। খামটাও যে সরকারি, তাতেও বোধহয় সন্দেহ নেই, খামের ওপরেই বড়ো করে ছাপা আছে, অন ইণ্ডিয়া গভর্নমেন্ট সার্ভিস। ভদ্রলোক এবার একটা সাদা কাগজে ছাপানো চিঠি আর একটা পেন এগিয়ে দিলেন নীলিমার দিকে,  বললেন, “এ্‌এই, এখানটায় রিসিভ্‌ড্‌ লিখে একটা সই করে দেবেন প্লিজ। অ্যাকনলেজমেন্ট আর কি, বুঝতেই তো পারছেন, সরকারি ব্যাপার, একটু এদিক-সেদিক হবার জো নেই...!”

নীলিমা পেনটা আর সাদা কাগজের চিঠিটা হাতে নিলেন। চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, ছোট ছোট অক্ষরগুলো একেবারেই ঝাপসা, চোখে চশমা নেই যে। সুষিটা থাকলে, এখনই ছুট্টে গিয়ে চশমাটা আনতে পারতনীলিমা একটু দ্বিধা নিয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, “চোখে চশমাটা নেই তো...ঘরে আছে...ভেতরে আসুন...” নীলিমা দাওয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করেই বুঝলেন, ব্যাপারটা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। সরকারি অফিসাররা তাঁর হাঁটা দেখলেই, তাঁর দুর্বলতার কথা বুঝে ফেলবে। অধৈর্য হয়ে উঠবে, বিরক্ত হবে, যেন তাদের সময়ের খুবই অভাব। নীলিমাদেবী আমাদের কত কাজ, আপনার হাতে চিঠি পৌঁছে দেওয়াটাই আমাদের একমাত্র কাজ নয়নীলিমা জানেন, যতদিন শরীরে শক্তি থাকে, মানুষ অশক্তদের অবজ্ঞা মেশানো সহানুভূতি বোঝাতে কসুর করে না। হলও তাই।

চারজনের মধ্যে তিনজন তাদের ঘড়ি দেখল। সঞ্জয়বাবু বললেন, “আপনি বুঝি একলাই থাকেন? সঙ্গে কেউ নেই? এই বয়সে এমন একা, একা...! এই হয়, জানেন? আপনি সারাজীবন কত আর্ত-অসহায়কে সাহায্য করেছেন, এখানকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন, অসুখ-বিসুখে বুক দিয়ে সেবা করেছেন...আর দেখুন, আজ শেষ বয়সে আপনাকেই দেখার কেউ নেই? এরা এমনই হয়, জানেন?”

নীলিমা দাওয়ায় ওঠার সিঁড়িতে পা রেখে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে, বেশ ঝাঁজালো স্বরে বললেন, “এরা কেমন হয়, আপনি কী করে জানলেন? থাকেন তো সদর শহরে, এদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে।”

“ন্‌না...মানে ইয়ে...কথার কথা...বললাম আর কী?” ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে বললেন। নীলিমা ততক্ষণে ঘরের ভেতর ঢুকে গেছেন। দাওয়ার সামনে, সঞ্জয়বাবুর সঙ্গী রজতবাবু বললেন, “বাপরে বুড়ি হেভি টেঁটিয়া তো! এই বয়সেও কী তেজ?”। সঞ্জয়বাবু চোখের থেকে চশমাটা হাতে নিয়ে উঠোনের চারদিক দেখতে দেখতে বললেন, “কিছুটা হলেও আমি জানি, সারাটা জীবন এ অঞ্চলের মানুষদের জন্যে নীলিমাদেবী কী করেছেন। আর এই অঞ্চলে ওঁর কতখানি জনপ্রিয়তা! আপনাদের মন্ত্রিমশাইও সে কথা ভালোভাবেই জানেন, রজতবাবু, তা নইলে কি আর রাতারাতি উনি এই প্রাইজ পেয়ে যান? নাকি নিজে এসে ওঁনার হাতে অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়ার গরজ দেখান?”

রজতবাবু রুলিং পার্টির লোক, স্থানীয় নেতা, তিনি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনারা মানে প্রশাসনের লোকেরা, সব কিছুই ব্যাঁকা চোখে দেখেন, কিন্তু এসময় আপনার একথাটা এভাবে বলাটা ঠিক হচ্ছে না, স্যার। আমাদের পার্টি সবসময় গুণীজনের সম্মান করে সেটা তো মানবেন?” সঞ্জয়বাবু ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললেন, “সে কথা না মেনে উপায় আছে? আপনারা গুণীজনের সম্মানের সঙ্গে ভালোভাবেই জানেন ভোট গুনতে...”।

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় এলেন, হাত বাড়িয়ে পেন আর কাগজটা সঞ্জয়বাবুর হাতে ফেরত দিয়ে জিগ্যেস করলেন, “প্রাইজ আনতে কোথায় যেতে হবে? আমার অবস্থা তো দেখছেন, কোথাও যাবার কথা চিন্তা করলেই আজকাল গায়ে জ্বর আসে”। সঞ্জয়বাবু কিছু বলার আগেই, রজতবাবু বলে উঠলেন, “আমরা রয়েছি কী করতে, ঠাক্‌মা? আপনাকে কোত্থাও যেতে হবে না। পরশুদিন সকালে মিনিস্টারস্যার নিজে আসছেন আপনার বাড়ি! তিনি নিজে এসে আপনার হাতে প্রাইজ তুলে দেবেন। আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি নিজে। তিনি বলেছেন, আপনি আমাদের সকলের মায়ের মতন। তিনি নিজেও আপনার ছেলের মতো”। প্রত্যেকবার “তিনি নিজে” কথাটা বলছিলেন বড়ো জোরের সঙ্গে, যেন ওটাই আসল কথা!

খুব অবাক এবং ভয় পাওয়া সুরে নীলিমা বললেন, “আমার এই বাড়িতে আসবেন, মিনিস্টার? কবে?”

সঞ্জয়বাবু বললেন, “হ্যাঁ, নীলিমাদেবী, আমাদের কাছে সেরকমই ইন্সট্রাকশন এসেছে। মিনিস্টারস্যার পরশুদিন আপনার বাড়ি আসবেন। চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। তাছাড়া রজতবাবুরা তো আছেনই - যা কিছু করার সব ওঁরাই করবেন”

নীলিমা বললেন, “কী করবেন?”

রজতবাবু বললেন, “ঠাক্‌মা, বুঝতেই তো পারছেন, মিনিস্টার মানে ভিআইপি। তাঁর আসার মতো এই বাড়িটাকে সাজিয়ে তুলতে হবে। তাছাড়া তাঁর সিকিউরিটির ব্যাপার আছে, অনেক বডিগার্ড থাকবে। বাড়ির চারপাশটা ঠিকঠাক করতে হবে...”

নীলিমা আতঙ্কিত সুরে বললেন, “বাড়ির চারপাশ ঠিকঠাক মানে?”

রজতবাবু খুব সাবলীল সুরে বললেন, “আশেপাশের বাড়িগুলো সব খালি করতে হবে যে, ঠাক্‌মা। মিনিস্টার স্যারের নিরাপত্তা নিয়ে তো আর ছেলেখেলা করা যায় না! কার মনে কী আছে, কোন ঝুঁকি নেওয়াটা  ঠিক হবে না! তাছাড়া এই উঠোনটাকেও গুছিয়ে নিতে হবে, ওই, ওই দিকের ঝোপঝাড়গুলো সাফ করতে হবে...”

নীলিমা আরো অবাক হয়ে বললেন, “ওদিকে ঝোপঝাড় কোথায়? ওগুলো তো ফুলগাছ, টগর, কাঞ্চন, জবা, শিউলি...”।

রজতবাবু নিশ্চিন্ত সুরে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ওই...ওইগুলোই...ওগুলোকে সাফ না করলে মিনিস্টারের সঙ্গে যে সব গেস্ট আসবেন, প্রেসের লোকজন আসবে, আমাদের ছেলেরা আসবে, সিকিউরিটি, পুলিশ, প্রশাসনের লোকজন...তারা সব দাঁড়াবে কোথায়? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না, ঠাক্‌মা, যা করার আমি আর আমার ছেলেরা করে নেব...”।

নীলিমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দাওয়ার খুঁটি আঁকড়ে, একটা কথাও বলতে পারলেন নাসঞ্জয়বাবু আবার আধা নমস্কার করে বললেন, “আজ আমরা তাহলে চলি, নীলিমাদেবী? হাতে খুব বেশি সময়ও নেই, মাঝে মাত্র একটাই দিন। মিনিস্টারের ভিজিট বলে কথা, এ কী সামান্য ঝক্কি?” নীলিমার উত্তরের অপেক্ষা না  করে চারজনেই বেরিয়ে গেলেন, বাড়ির বাইরে। যাওয়ার সময় টেনে দিয়ে গেলেন সদর দরজাটা।

 

 

ওরা চারজন চলে যাওয়ার পর তিনি দাওয়াতেই বসেছিলেন। ভাবছিলেন, সরকারি অফিসার আর পার্টির নেতার কথাগুলো। তাঁর অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটা কী এতই আনন্দের ব্যাপার! যে আনন্দের জন্যে ঘর ছাড়তে হবে তাঁর এতদিনের পড়শীদের? বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ওরা যাবে কোথায়? অনেকেরই আবার তাঁর মতোই বয়স্ক বাপ-মা আছে। তাদের নিয়ে? আর তাঁর নিজের হাতে লাগানো ওই ফুলগাছগুলো? যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলে, হাসে। ফুল ফুটিয়ে তোলে অজস্র। ফুটে ওঠা প্রত্যেকটি ফুল কি তাদের ভালোবাসার হাসি নয়?  কত বছর ধরে, ওরা রয়েছে তাঁর সঙ্গেওদের ওরা সাফ করে ফেলবে? কেটে ফেলবে? ভিআইপি মিনিস্টারের পক্ষে ওরা মোটেই নিরাপদ নয়? ওদের সরিয়ে কিছু উটকো লোক এসে ওখানে দাঁড়াবে নিরাপত্তার কারণে?

বহুদিনের পুরোন সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার কথাও এখন তাঁর মনে পড়ে গেল। সেদিন সেই দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর সন্তান এবং সেই সন্তানের পিতাকে। সেই ভয়ংকর স্মৃতি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বহুদূরের এই নির্বান্ধব জগতে। প্রথমদিকে এই গ্রামে তাঁর হঠাৎ উড়ে এসে বসা এবং গায়ে পড়ে প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া, এখানকার কেউই ভাল চোখে দেখেনি। তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে সকলেই সন্দিহান ছিল। কিন্তু তিনিও পিছিয়ে যাননি, হাল ছেড়ে ফিরে যাননি তাঁর বাবা-মা দাদার সংসারে। তাঁকে বোঝানোর অনেক চেষ্টাই করেছিলেন তাঁরা – বাবা, মা, দাদা-বৌদি, তাদের ছেলে-মেয়ে। কোন কিছুই তাঁকে আবার শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি, না তাঁর মায়ের চোখের জল, না এখানকার মানুষগুলোর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি!

ঠিক কী ভাবে এবং কবে থেকে তিনি এই গ্রামেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন, সে কথা খেয়াল করে মনে রাখেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি একদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, এরা তাঁকে মেনে নিয়েছে। এদের দুঃখেসুখে, আধি-ব্যাধিতে তিনি এদের পাশে থাকবার স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পেরেছেন। তাঁর কাছে লেখাপড়া শুরু করে, অনেক ছেলেমেয়েই শহরের স্কুলে, কলেজে গিয়ে এখন উচ্চশিক্ষিত - অনেকেই এখন শহরের শিক্ষিত সমাজে জায়গা করে নিয়েছে সসম্মানে। বেশ কবছর হল, শুধু এই গ্রামেই নয়, আশেপাশের অনেক-অনেক গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলির সময়ে-অসময়ে অন্যতম তিনিই সহায়।

এই মানুষগুলির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত তাঁর এই দীর্ঘ সম্পর্কের স্বীকৃতি এই অ্যাওয়ার্ড! তাঁর এই অ্যাওয়ার্ড জয়ের বিরল সম্মানে ঘরছাড়া হবে, তাঁর আশেপাশের এই পড়শি মানুষগুলি? তিনি বরাবর যাদের সহায় থাকতেন চেয়েছেন, তাদের তিনি বিপন্ন করবেন, হঠাৎ কপাল খুলে পেয়ে যাওয়া এই অ্যাওয়ার্ডের জন্যে? কিন্তু এই বয়সে পাওয়া এই অ্যাওয়ার্ড তাঁকে কী দেবে? দেশ জোড়া খ্যাতি? এই অ্যাওয়ার্ডের মেডেল গলায় দুলিয়ে, আর কোন নতুন শক্তি তিনি ফিরে পাবেন, যার বিনিময়ে এতগুলো লোককে অকারণ বিরক্ত করা চলে?

 বেশ শব্দ করে খুলে গেল সদর দরজার পাল্লাটা! নীলিমা চমকে উঠলেন। আবার কে এল? ওরা কী এসে গেল, তাঁর আশেপাশের ঘরগুলি খালি করতে? অথবা তাঁর ফুলের গাছগুলিকে উৎখাত করতে? দরজার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন নীলিমা, কে এল? দরজা দিয়ে ঢুকে এল ঊষা, তার পেছনে এপাড়ার অনেকগুলি মেয়ে-বউ। ঊষার আসার কথা ছিল অনেক আগেই। সুষি ব্যবস্থা করে গিয়েছিল, সে দাদার বাড়ি থেকে না ফেরা পর্যন্ত ঊষা এসে থাকবে নীলিমার সঙ্গে। ঘরের কাজ-টাজ সেরে আসতে দেরি করেছে হয়তো। এখন একমুখ হাসি নিয়ে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল নীলিমাকে। বলল, “ও দিদা, তুমারে নাকি সরকার পেরাইজ দিবে! গাঁয়ের সক্কলে বলতিছে! সত্যি বটে গো? তুমার কাছে কারা সব এয়েছিল, তারা নাকি সরকারি লোক?” ঊষার পিছন পিছন এসে দাঁড়ানো মেয়েবউগুলোর চোখেও আনন্দ কৌতূহল। নীলিমা ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের ওরা কিছু বলেনি?”

“কারা?”

“ওই যে সরকারি লোক আর পার্টির নেতারা?”

“কই, না তো! আমাদিকে আবার কী কইবে, উয়ারা আমাদিকে মানুষ বলে গণ্যি করে নাকি?”

“বলেনি? পরশু মিনিস্টার আসবে, আমাকে প্রাইজ দিতে?”

সকলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে অবাক আনন্দে, ওদের মধ্যে গণার মা বলল, “বলো কী, মায়ি, মিনস্টর? সেই যে গলায় মালা লিয়ে সভায় খুব বক্তিমে দেয়? হাতজোড় করে বারবার নমস্কার করে? আমি দেকিচি একবার, সেবার গণার বাপের সঙ্গেরে সদরে গেচলম, ওকেনে মিটিং ছ্যালো। আমি দেকিচি। সেই মিনস্টর?”     

নীলিমা ম্লান মুখে বললেন, “মিনিস্টার আসছে বলল, কোন মিনিস্টার সে আর আমি জিগ্যেস করিনি”।

ঊষা ভীষণ খুশি হয়ে বলে উঠল, “সে যাই হোক দিদা, আমাদের গাঁয়ের পেস্টিজটা কোথায় দাঁড়াবে একবার কওদিনি? এ দিগরে কোন গাঁয়ে কোন মিনস্টার এয়েচে, বলো?”

“মিনিস্টার এলে, তোদের সক্কলকে যে ঘর ছেড়ে দিতে হবে, মা। কদিনের জন্যে জানি না, হয়তো দুদিন, অথবা আরও বেশি...”।

গণার মা অবাক হয়ে বলে উঠল, “ক্যানে? তুমি পেরাইজ পেলে, আমাদিগে ঘর ছাড়তি হবে ক্যানে?”

“ওই যে বললি, মিনিস্টার আসছে। সে তো একজন কেউকেটা বটে। তাকে তোরা যদি মেরে ফেলিস?”

উপস্থিত সকলের কণ্ঠ থেকে বের হল আতঙ্কের সুর। ঊষা বলল, “আমরা মেরে ফেলাব? মিনস্টারকে?”

“আহা যদি মেরে ফেলিস? তাইতো ওরা বলল, তোদের ঘর থেকে বের করে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে। মিনিস্টারের জীবন নিয়ে তো আর ছেলেখেলা করা যায় না। তার সঙ্গে কত বড়ো বড়ো লোক আসবে, পুলিশ আসবে। ওদের সঙ্গে টিভির লোকেরাও আসবে ছবি তুলতে। সকলেরই জীবনের দাম আছে! আর আমার ওই ফুলগাছগুলোকেও ওরা কেটে ফেলবে”।

গণার মা গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে বলল, “ওরাও বুজি মিনিস্টারকে মেরে ফেলতে পারে? মিনস্টারের জেবন এতই ঠুনকো যদি থালে সে আসচে ক্যানে, আমাদের গাঁয়”?

নীলিমা মুখ নিচু করে মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমি মানা করে দেব, ওরা আসবে না। আমি প্রাইজ নেব না গণার মা বলল, “পেরাইজ নেবেনি?”

“না, তোদের তাড়িয়ে দিয়ে, আমার কোন প্রাইজের প্রয়োজন নেই”।

 

 

মিনিস্টার সায়েবের বসার ঘরে সকাল সাতটা নাগাদ এসে প্রায় ঘন্টা দুয়েক হতে চলল। রজতবাবু আর সঞ্জয়বাবু ঠায় বসে আছেন। রজতবাবু মাঝে মাঝেই শিউরে উঠছেন, আর চাপা গলায় সঞ্জয়বাবুকে জিগ্যেস করছেন, “কী হবে বলুনতো?” তুমুল ঝাড় যে খেতেই হবে, সেটা নিশ্চিত। কিন্তু কথাটা এখনই না বললেও তো নয়! নীলিমাদেবীকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার খবরটা কাল সন্ধ্যে থেকে সবকটা টিভি চ্যানেলে অনবরত দেখিয়ে চলেছে। এক্সক্লুসিভ, ব্রেকিং নিউজ। একই খবর, বারবার, লাগাতার। আজ সকালে সবকটা পেপারের হেডলাইনে এসে গেছে খবরটা। এদিকে গতকাল একটু সন্ধের পর বুড়ি পার্টির দপ্তরে খবর পাঠিয়েছে, তিনি অ্যাওয়ার্ড নেবেন না। খবরটা পেয়েই রজতবাবু আর সঞ্জয়বাবু পড়িমরি দৌড়ে গিয়েছিলেন ওই ধ্যাদ্ধেড়ে ধুলোওড়া গ্রামে। বুড়িটা হঠাৎ খেপে গেল কেন, সেটা জানতে। বলা যায় না, হতভাগা বিরোধীরা কিছু উস্কানি দিয়েছে, ওদেরই চক্রান্ত হয় তো!

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বুড়ির বাড়ি গিয়ে যা শুনলেন, তাতে দুজনেরই, চক্ষু চড়কগাছ! বুড়ি যে হেব্বি টেঁটিয়া, সেটা রজতবাবু বেশ বুঝেছিলেন, কিন্তু সে যে এতটা, তা বুঝতে পারেননি। বুড়ি অ্যাওয়ার্ড নেবে না! নেব না বললেই হল? মামার বাড়ির আব্দার নাকি? মিনিস্টার ঠিক করেছেন, অ্যাওয়ার্ড দেবেন, তার ওপরে কথা হয়? কেন নেবেন না? পঞ্চাশবার জিগ্যেস করেও তার উওর পাওয়া গেল না। ঘাড়ত্যাড়া বুড়ির একটাই কথা “না”। শেষে অনেক কথা চালাচালি করে বোঝা গেল, বুড়ির পড়শিদের আগামীকালই ঘর খালি করে অন্যত্র যাওয়ার কথা বলাতেই নাকি বুড়ির গোসা! ওরা কেন যাবে, কোথায় যাবে? কোথায় আবার যাবে, জাহান্নমে যাবে। আরে, মিনিস্টার সায়েবের নিরাপত্তা নিয়ে এমন ছেলেমানুষী কথা কেউ কোথাও শুনেছে? বুড়ির ভিমরতি হয়েছে, তা নইলে এমন কথা কেউ বলে? মিনিস্টারের সিকিউরিটির ব্যাপারটা কিছুতেই তার নিরেট মাথায় ঢোকানো গেল না। শুরু থেকে শেষ অব্দি বুড়ির একটাই কথা, “না”!

গতকাল ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছিল, মিনিস্টার সায়েবকে তখনই খবরটা দেওয়া যায়নি। আজ সকালেই তাই দুজনে এসে উপস্থিত হয়েছে মিনিস্টারের ঘরে। অপেক্ষা করছেমিনিস্টার সায়েবের পিএকে সব বলা হয়েছে, কিন্তু পিএ তো পিএই। ঘরের দেওয়ালের মতো, চুপ করে বসে সব শুনল, কিন্তু কোন তাপ-উত্তাপ বা কোন মন্তব্য করল না। সব শোনার পর ঠোঁট উল্টে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “স্যারকে বলে দেখুন, উনি কী বলেন?” রজতবাবুর রাগ হল খুব, সে তো বলবই, কিন্তু তুমি আছ কী করতে? এই সময়ে তোমার স্যারকে একটু ম্যানেজ করতে পার না? তাহলে আর তুমি কিসের পিএ, হে?

সাড় আটটা নাগাদ মিনিস্টার সায়েব বসার ঘরে এসে বললেন, “জীবন বলছিল, আপনারা অনেকক্ষণ এসে বসে আছেন? কালকের অনুষ্ঠানের অ্যারেঞ্জমেন্ট সব রেডি নাকি?” জীবন মিনিস্টার সায়েবের পিএ-র নাম। সঞ্জয়বাবু বললেন, “ইয়ে...মানে এদিকে একটা মুশকিল দেখা দিয়েছে, নীলিমাদেবী বলেছেন...”।

মিনিস্টার সায়েব উল্টোদিকের সোফায় আরাম করে বসে বললেন, “অ্যাওয়ার্ড নেবেন না, তাই তো? ঠিকই তো বলেছেন? আপনারা মাথামোটা, ওঁনার সঙ্গে গেছেন রাজনীতি করতে?” রজতবাবু অবাক হয়েছিলেন খুব, তাঁর ধারণা ছিল, তাঁর মুখে প্রথম শুনে মিনিস্টারসায়েব বোমার মতো ফেটে পড়বেন। কিন্তু সেসব কিছুই হল না, উল্টে তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন, মিনিস্টারসায়েব মোটামুটি খোশমেজাজেই রয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যে থেকে তাঁর মনের মধ্যে অসম্ভব আতঙ্কের যে একটা চাপ ছিল, সেটা অনেক হাল্কা হয়ে এল।

তিনি প্রায় সবকটি দাঁত বের করে বিগলিত হেসে বললেন, “আপনি তো সবই জানেন, স্যার...আমরা জাস্ট ওঁনাকে খবরটা দিতে গিয়েছিলাম...তাতেই উনি একেবারে বিগড়ে গেলেন...”।

মিনিস্টার সায়েব বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন, “ইডিয়েট। খবর দিতে গেছিলেন, নাকি দাদাগিরি করতে গেছিলেন? এতদিন এই লাইনে রয়েছেন, দাদাগিরি ছাড়া অন্য আর কিছু বোঝেন? কে বলেছিল, ওঁনার পাড়ার লোকেদের ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে? কিসের জন্যে?”

এই প্রবল ধমকানিতে রজতবাবুর বুকটা আবার কেঁপে উঠল, কোনরকমে বললেন, “সে তো আপনার সিকিউরিটির জন্যে স্যার। আপনার আর অন্যান্য গেস্টদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। ছোটলোকের গ্রাম তো, স্যার। কার পেটে কী বজ্জাতি লুকিয়ে আছে, বলা তো যায় না, স্যার?”

“রজত, তুমি যে শুধু একটা আস্ত গাধা, তাই নয়, তুমি অত্যন্ত ইতর। দুবেলা ভরপেট খেতে না পাওয়া ওই গ্রামের গরিব মানুষগুলোকে তুমি ছোটলোক বলছো? তোমার মতো ছোটমনের লোককে আমি আমাদের দলে চাই না। কালকের অনুষ্ঠানটা মিটলে, পরশু শহরে গিয়েই আমি তোমার নামে কমপ্লেন করবো। কী ভেবেছো কী? নিজেকে খুব বড়ো নেতা মনে করো?” রাগে আর উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলেন, মিনিস্টার সায়েব। পিএ জীবন একগ্লাস জল এগিয়ে দিলেন, মিনিস্টার সায়েবের দিকে। গেলাস থেকে একচুমুক জল খেয়ে গেলাসটা ফিরিয়ে দিলেন জীবনের হাতে, তারপর বললেন, “সঞ্জয়বাবু, কালরাত্রেই আমার কাছে সব খবর এসেছিল। আমি আমাদের লোকদের স্পেসিফিক্যালি বলে দিয়েছি, কোনরকম বাড়াবাড়ি যেন না হয়। বেশি ভিড়ভাট্টা করে দলবাজিও যেন না হয়। এখানকার দুই কলেজের প্রিন্সিপাল থাকবে, ডিসি, এসি থাকবে। দশ-বারো জনের বেশি পুলিশ ফোর্সের দরকার নেই। আর থাকবে দুটো চ্যানেলের রিপোর্টাররা তাদের সঙ্গে ক্যামেরা-ট্যামেরার তাম্‌ঝাম্‌ নিয়ে, ব্যস্‌আর কেউ না”

সঞ্জয়বাবু খুব বশংবদ স্বরে উত্তর দিলেন, “তাই হবে, স্যার”।

“আপনি এখনই বেরিয়ে পড়ুন, সারাদিন ওখানে থেকে সব ঠিকঠাক অ্যারেঞ্জ করুন, আর লোকাল মানুষদের মনে কোনরকমেই কোন ক্ষোভ, বিরক্তি বা ভয় যেন না আসে, সেটা দেখাও আপনার কর্তব্য”।

সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে রজতবাবুও সোফা ছেড়ে উঠছিলেন। মিনিস্টার সায়েব বললেন, “সঞ্জয়বাবু, আপনি বাইরে পাঁচমিনিট ওয়েট করুন, রজতকে দুটো কথা বলেই আমি ছেড়ে দিচ্ছি”।

সঞ্জয়বাবু নিচু হয়ে নমস্কার করে বললেন, “ও কে, স্যার, নো প্রবলেম, স্যার”। সঞ্জয়বাবু ঘর থেকে বের হতেই মিনিস্টার সায়েব আবার ধমকানির সুরে রজতবাবুকে বললেন, “নীলিমাদেবীকে অ্যাওয়ার্ডটা আমরা কেন দিচ্ছি, তোমার কোন আইডিয়া আছে, রজত?”

“মানে...ইয়ে...যদ্দূর জানি, ওই ভোটের হিসেব আর কি?”

“লাস্ট ইলেকশনে ওই দিকের ব্লকগুলোতে আমরা সাড়ে দশ হাজারে পিছিয়েছিলাম, মনে আছে?”

“হ্যাঁ স্যার, ওটা আমাদের দলের সুখেনের কারসাজি ছিল, স্যার। আমাকে বাঁশ দেওয়ার জন্যে হারামজাদা বিশ্বাসঘাত করেছিল...”।

“তুমি গাড়লের থেকেও আজেবাজে কিছু একটা, রজত। সুখেনের পেছনে পঞ্চাশ-একশর বেশি লোক নেই, সেখানে সাড়ে দশহাজার এল কোত্থেকে? আর সুখেন যদি প্রবলেম করে, তাকে সামলানোর দায়িত্ব কার – তোমার না আমার”? রজত মুখচুণ করে বসে রইল সোফায়। মিনিস্টার সায়েব আবার বললেন, “ওদিকের গরীবগুর্বো মানুষদের ওপর নীলিমাদেবীর খুব প্রভাব। ওঁকে ওদিকের গাঁয়ের লোকেরা ভীষণ মান্যি করে, সেটা জানো? নীলিমাদেবীকে এখন অ্যাওয়ার্ডটা দিলে, ভোটের সময় আমরা পাব রিওয়ার্ড! ওখানকার মানুষগুলোর মনের মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলেই, বাস্‌, কেল্লা ফতে, সব ভোটে এসে জমা হবে আমাদের বাক্সে! নিরেট মাথায় ঢোকাতে পারলাম?”

“হ্যাঁ, স্যার”।

“শুনলাম তুমি কাল, নীলিমাদেবীকে প্রণাম করোনি, একটা নমস্কারও করোনি? বাজারের ষাঁড়ের মতো গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলে? এভাবে তুমি রাজনীতি করবে, রজত? নেতা হয়েছো বলে, মানীর মান রাখবে না? এখন যাও যেমন বললাম, সব রেডি কর। বেশি ছেলেপুলে সঙ্গে নিয়ে যাবে না, বাছাবাছা কিছু ছেলে নিয়ে যাবে। তারা যেন মারমুখো না হয়। আরা তারা কী শ্লোগান দেবে ঠিক করেছো?”

মিনিস্টার সায়েবের এমন সহজ প্রশ্নে রজতবাবু বিস্মিত হলেন খুব, বললেন, “আজ্ঞে... ইয়ে...আপনার নামে...আর পার্টির নামে...জিন্দাবাদ...”।

মিনিস্টার সায়েব বিরক্ত হয়ে মুখ ভেংচে বললেন, “তুমি একটি আস্ত ছাগল। এতক্ষণ কী বোঝালাম? আমার নাম, পার্টির নাম ভুলেও উচ্চারণ করবে না। বলবে, “সবার মা, নীলিমা”“নীলিমায়িকি জয়”মনে থাকবে? গোটা অনুষ্ঠানে কোন রাজনৈতিক রং যেন না লাগে...বোঝা গেল? যাও, এবার বিদেয় হও”।

 

 

অনুষ্ঠানটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেল সকাল দশটার একটু আগেই। এ একদিকে ভালই হয়েছে, চৈত্রের রোদ একটু বেলা হলেই পিঠ পোড়ায়। আকাশে ধুলো উড়িয়ে গোটা দশেক নানান সাইজের গাড়ি বেরিয়ে গেল গ্রাম থেকে, এখন নিশ্চিন্ত। নীলিমার দাওয়ায় অনেকেই রয়েছে, তাঁকে ঘিরে। সকলের মুখই আনন্দে আর খুশিতে উজ্জ্বল। সব থেকে খুশি হয়েছে ঊষা আর সুষি। সুষি অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখছিল মেডেলটা। মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে দু-তিনবার বলেছিল “ম্যাডেল” – যেন বীজমন্ত্র আওড়াচ্ছে! ঊষাতো মেডেলটা নিজের গলায় পরে সকলকে দেখাচ্ছে, “হ্যাদ্দাখ, কেমন লাগতিছে ম্যাডেল পরে!” ওটা রেপ্লিকা, আসলটা আছে ছোট্ট গয়নার বাক্সে নীলিমার হাতে। যে বিশাল মালাটা ওরা নীলিমার গলায় পরিয়েছিল, সেটা খুব যত্ন করে কেউ ঝুলিয়ে দিয়েছে, ঘরের দরজার ডানদিকের হুকে, ওখানে একটা ক্যালেণ্ডার রয়েছে, সেটা এখন ঢাকা পড়ে গেছে। আজকের এই দিনটা নীলিমার জীবনে এবং এই পিছিয়ে থাকা গ্রামগুলোর জীবনেও, অন্য সব দিনকে যেন ঢেকে দিল!

ধোপভাঙা সরুপাড় সাদা শাড়ি আর জামায়, আজ নীলিমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছিল, বেশ স্নিগ্ধ, শুদ্ধ, পবিত্র - যেন দেবী, নীলিমাদেবীএখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর এতদিনের এত কাছের সম্পর্ক, কিন্তু কেউ কোনদিন তাঁকে প্রণাম করেছে এমন মনে পড়ে না তাঁর। এদের সকলের চোখের দৃষ্টিতে থাকে কৃতজ্ঞতা, আর মুখের হাসিতে থাকে আন্তরিক ভালোবাসা, সেখানে প্রণামের কথা কারও মনেই আসেনি। গতকাল এবং আজ শহরের ওই লোকগুলো, এমনকি ওই মিনিস্টার সায়েবও নিচু হয়ে পরম ভক্তি ভরে প্রণাম করল তাঁকে!

ঊষা উঠোনময় নেচে নেচে বারবার মেডেলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল, একসময় হঠাৎ চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল,  “ও দিদা, এ ম্যাডেলখান কী সোনার?”

তাঁকে ঘিরে বসে থাকা উঠোনের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নীলিমা ম্লান হেসে বললেন, “ধুর ক্ষেপি, সবটাই তো মেকি”!

 

..০০..

            

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

রোববার - ২

 

রোববার -২

হিন্দী সিনেমায় প্রায়ই এমন হয়। ভিলেনের সাংঘাতিক ডেরায় এক হিরো ভারি ভারি শিকলে বন্দী, পায়ের তলায় প্লাস্টিকের ভুখা কুমীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য হিরো ঝনঝনিয়ে কাচের জানালা ভেঙে ঢুকে পড়ল অকুস্থলে। ঢুকেই দেখল খেলনা বন্দুক হাতে ঝুড়ি ঝুড়ি কাতিল ভিলেনের সাঙ্গপাঙ্গ সবসেও পড়ে গেল ভিলেনের খপ্পরে। দুই হিরোকে বন্দী করে ভিলেন এবার শুরু করল তার সাত পাতার ডায়ালগ। তার আজীবন করে আসা কুকীর্তির বিশাল ফর্দ। লাস্টে মিচকে হাসি হেসে ঘোষণা করল দুই হিরো আসলে বচপনমে বিখরে হুয়ে দুই ভাই। ভেইয়া চোখে চোখে কথা শুরু দুই ভাইয়ে। তারপর যা হয় সেটা সিনেমায় দেখে নেবেন সবটা বললে আড়াই ঘন্টার হিন্দী সিনেমার জমাট রহস্যটাই মাটি।

কিন্তু সাড়ে চার ঘন্টা উইথ চড় চাপড় চর্চার পর যে ছেলেটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার ভাই হয় শুনে আমি মোটেই আনন্দ পাইনি। মনে হয়েছিল ভাইটা খামোকা ওখানে দাঁড়াল কেন? আর দাঁড়ালই যদি তো আমার ভাই হতে কে ওকে মাথার দিব্বি দিয়েছিল। কারণ ওটাই ছিল আমার ট্রানস্লেসানের লাইন। The boy who stands there is my brother.

লখী বাবুকা সোনা চাঁদি গহনাকা দুকান। আসলি শব্দটা ভিন্ন ভিন্ন শব্দের সামনে বসিয়ে একসময় বেশ কিছু দোকান চালু ছিল। যেমন আসলি লখী বাবুকা..., লখী বাবুকা আসলি সোনা..., লখী বাবুকা সোনা আসলি চাঁদিকা..., লখী বাবুকা সোনা চাঁদিকা আসলি গহনাকা...ইত্যাদি। ঠিক সেই রকম বয়, হু, স্ট্যান্ডস আর ইজ এই চারটে শব্দ স্থানে অস্থানে সামনে পিছনে বহুবার বসিয়েও বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি সেদিন। যেমন   দি ব্রাদার ইজ মাই বয় হু স্ট্যান্ডস দেয়ার, দি হু ইজ মাই দেয়ার স্ট্যান্ডস ব্রাদার বয়... এই রকম সবসত্যি বলতে সেদিন থেকেই আমি সকল বেরাদরির ওপর বিশ্বাস হারিয়েছি।

এরকম আরো কিছু ছিল। স্টেসনে পৌঁছানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আর ডাক্তার পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই রোগী মারা গেল। কোনটা আগের আর কোনটা পরের অতীত। আরো সহজে বললে পুরোনো ভূত আর আনকোরা ভূত খুঁজে বের করার সেই একই বিড়ম্বনা নো সুনার হ্যাড ... । নাঃ - এটা আর ট্রাই করব না। এই বয়সেও ভুল করলে বেইজ্জতের একশেষ হবো।

তখন আমাদের বাড়িতে চিকেনের চল একদম ছিল না। আর হরহপ্তায় মাংসও হতো না এখনকার মতো। মাসের প্রথম রোববারে মাংস হত পাঁঠা বা খাসি সামনের রাঙ বা গর্দান। পাড়ায় সব বাড়ি থেকেই ওই দিনে মাংস রান্নার গন্ধ উঠত।  আরো বড় হয়ে যখন প্রেসার কুকার চালু হল, তখন রবিবারে বারোটা সাড়ে বারোটার সময় কোরাসে কুকারের সিটি বহুবার শুনেছি পাড়ায় সব বাড়ি থেকে।

বিশেষ এই মাংস হওয়ার রবিবারেই পড়ার চাপটা পড়ত বেশী। মাংস কষার সময় থেকে মায়ের রান্নাঘর থেকে গন্ধ এসে ভুলিয়ে দিত ইংরিজির টেনস, ফ্রেজ, ইডিওমস, কগনেট অবজেক্ট, পার্টিসিপল, অ্যাডজেকটিভ, ন্যারেসন, ভয়েস চেঞ্জ... অথবা সংস্কৃত ব্যাকরণ কৌমুদীর শব্দ ও ধাতুরূপ, প্রত্যয়, সমাস, অপিনিহিতি, যোগরূঢি...। সব তালগোল পাকিয়ে একাকার মনে হত।

মাংস সেদ্ধ হয়েছে কিনা আর নুন ঠিক আছে কিনা টেস্ট করে দেখার জন্যে এক এক পিস মাংস সঙ্গে একটু ঝোল আমাদের বরাদ্দ ছিল স্নান করার আগে। এটাকে আজকালকার রেস্তোরাঁর ভাষায় স্টার্টার বা অ্যাপিটাইজার বললেও চলে। ওই স্যাম্পলটা খাওয়ার পর আমার স্নানের সময়টা খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যেত। প্রায়ই মায়ের কাছে বকুনি খেতে হত চান করে বেরিয়ে আসার পরেও কানের পিছনে সাবানের ফেনা আর গোড়ালির পিছনে রাজ্যের ময়লা লেগে থাকার জন্যে।

আমার মাথায় তখন কিচ্ছু ঢুকছে না সে সময় পেরেক ঠুকলেও বেঁকে যেত এমনই নিরেট আমার মাথা। বাবাও ছাড়ার পাত্র নন, জিদ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন - আমাকে দ্বিতীয় নেসফিল্ড বা পি কে দেসরকার এবং ঈশ্বর চন্দ্র দেবশর্ম্মা বানিয়ে তুলতে। আমার এই চরম দুর্গতির সময় মা স্টেজে অবতীর্ণা হতেন মা দুর্গার মতোই। দশ হাত নিয়ে নয়, দুহাতে দুটি - গরম ঝোলের ধোঁয়া ওঠা কাঁসার বাটি নিয়ে। সুগন্ধে জিভে স্যালাইভার বন্যা বইত আর পাকস্থলী থেকে সব কিসিমের পাচক এনজাইম নিঃসৃত হয়ে আমার মাথার নিরেট ভাবটাও বেশ ফিকে হয়ে আসত।

প্রথমে বাবার হাতে বাটি দিয়ে মা বলতেন, দ্যাখোতো নুন টুন সব ঠিক আছে কিনা..."। 

বাবা সুড়ুৎ শব্দে ঝোলে চুমুক দিয়ে বলতেন, ফাসক্লাস হয়েছে ভেরি গুড। 

আমি তখন উবু জ্বলন্ত গরম মাংসের টুকরো মুখে নিয়ে হিমসিম, জিভে গালে ছেঁকা মুখ হাঁ করে হা হা করছি ঠান্ডা হবার জন্যে। বাবার প্রশংসায় প্রসন্ন মা হাসি হাসি মুখে আমার অবস্থা দেখে বলে উঠতেন, দ্যাখো, দ্যাখো বোকা ছেলের কান্ড দ্যাখো, একটু ঠান্ডা হতে দে - কিরে সেদ্দ হয়েছে? আমি হা হা করা হাঁ মুখেই বড়সড় ঘাড় হেলিয়ে মাকে জানাতাম দারুণ।

এতক্ষণ রান্নাঘরের গরমে থাকার কারণে মায়ের স্বেদসিক্ত মুখে তৃপ্তির হাসি, বাবার প্রশংসা পেয়ে আর আমার অত্যাগ্রহ দেখে। দুচোখে স্নেহের অকূল পারাবার। সেই মুখ আর চোখের তুলনা পেতাম দুর্গা পুজোর সময় কলেজ স্কোয়ারে মা দুগগার ঘাম তেল মাখা মুখ আর চোখে। সে সময় প্রতিমা বানাতেন শ্রী রমেশচন্দ্র পাল।

আমার নেসফিল্ড হবার নিষ্ফল ও নিদারুণ প্রচেষ্টার দুর্গতি থেকে মুক্তি দিয়ে আমার মা, বাবাকে নির্দেশ দিতেন তাড়াতাড়ি চান করে নেবার জন্যে, তা না হলে খাবার দাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাবাও চূড়ান্ত হতাশায় আমাকে মুক্তি দিয়ে বলতেন, তোমার এ ছেলের কিসস্যু হবে না, দেখো

আচ্ছা, আচ্ছা, ঘুনু হয়েই থাকবে না হয় চিরটাকাল তুমি এখন যাও তো, চান করে নাও

বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। মায়ের কথাও খেটে গেছে অবিকলবাবা মা কেউই আর নেই এই জীবনে। ঘুনু হয়ে থাকা জীবনের অজস্র দুর্গতির মধ্যেও দুর্গতিনাশিনী সেই দৃষ্টি কিন্তু সঞ্চারিত হয়ে এসেছে পরবর্তী প্রজন্মেও। আজকাল বড় হতে থাকা আত্মজার চোখে মেলে হারিয়ে যাওয়া সেই শান্তির অনুভব - দিনশেষে ঘরে ফেরা হা-ক্লান্ত মনে আর সেই ক্ষণটুকুই হয়ে ওঠে প্রকৃত রোববার।

-- ০০ --

আমার প্রথম গ্রন্থ "বিনিসুতোর মালা"-র একটি অধ্যায়।

বইটি ঘরে বসে অনলাইনে পেয়ে যাবেন "সৃষ্টিসুখ প্রকাশন" এর এই লিংক থেকে - 

https://sristisukh.com/ss_new/product/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE/



রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫

মহাভারতের কথাঃ- রমণীর চোখে রমণীয়া নারী

 সংসারে অজানা, অচেনা রূপসী এবং যুবতী পরিচারিকা ঢোকালে সংসারের কর্ত্রীর কী কী বিপদ ঘটতে পারে? কোন কোন দিক থেকে নেমে আসতে পারে সাংসারিক জটিলতা? এমনকি কপাল এবং মুখ দুটোই পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও যে অমূলক নয়, সে কথা হাড়ে হাড়ে টের পান কমবেশী সকল সংসারের ওয়াকিবহাল গিন্নীরা। বাড়ির পরিচারিকাকে না হয় তাও এড়িয়ে যাওয়া যায়, দাঁতে ছোপধরা, গালে মেচেতার দাগ, নক্কিমাসি কিংবা পদ্দোমাসিকে দিয়ে, কিন্তু সেই নারী যদি হয় অফিসের সুন্দরী সেক্রেটারি? সেক্ষেত্রে বিপদ আরো বেশী। সপ্তাহের পাঁচ থেকে ছদিন, দিনে আট-নঘন্টা একসঙ্গে ওঠাবসা, কথাবার্তা, চোখাচোখি। লাঞ্চ সারতে সারতে কিংবা বাদলা দিনে হালকা মেজাজে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের কথা বলতে বলতে, অনেক বেশী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এবং হয়ও। যে সব গিন্নিরা কত্তাদের চোখে চোখে রাখেন, নিজের মানুষটির চালচলনের চালাকি চটপট ধরে ফেলেন, তাঁদের জন্যে চিন্তা একটু কম। কিন্তু যাঁরা একটু আলবোড্ডে টাইপের, যাঁরা তাঁদের মানুষটিকে প্রাণ ভরে বিশ্বাস করেন, চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন এবং স্বামীর প্রতিটি কথাই বেদবাক্য বলে মনে করেন, তাঁরা কী করবেন?

 
তাঁদের জন্যেই সব শাস্ত্রের সার মহাভারত থেকে তুলে আনা একটি ঘটনার বিবরণ দিলে, সেই সব সরলমতি অবলা গৃহিণীরা কিছুটা বুঝতে পারবেন, যুবতী নারী তুলকালাম সুন্দরী হলে, ঘনিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে রসায়নটা কী দাঁড়াতে পারে!
 
অজ্ঞাতবাসের সময়, পাঞ্চালদুহিতা দ্রৌপদী, পাণ্ডব স্বামীদের সঙ্গে বিরাটরাজের অন্দর মহলে ঢুকলেন পরিচারিকার কাজের সন্ধানে। ইচ্ছে একটা বছর নাম পরিচয় লুকিয়ে রাজপ্রাসাদে কাটিয়ে দেবেন। তাঁরা আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর নাম হবে সৈরিন্ধ্রী, আর বিরাট রাজমহিষীর পরিচারিকা হিসেবেই কাজ করবেন। সেই পরিকল্পনা মতোই প্রস্তুত হয়ে  তিনি এগিয়ে চললেন বিরাট রাজপ্রাসাদের দিকে -

“অসিতলোচনা দ্রৌপদী, মেঘবরণ কেশে সূক্ষ্ম, সুকোমল ও দীর্ঘ বেণী বাঁধলেন, মলিন বসন পরলেন, তারপর সৈরিন্ধ্রী বেশে রাজপ্রাসাদের দিকে হাঁটতে লাগলেন। নগরের পথে স্ত্রী পুরুষেরা দ্রুতপায়ে তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁগা, তুমি কে, গা? কিসের জন্যে এয়েচ এই নগরে?” তারা বারবার এই কথা জিজ্ঞাসা করায়, দ্রৌপদী বললেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী, যদি কেউ আমাকে একটা কাজ দেন, সে কাজ আমি খুব সুন্দর ক’রে করে দেব। কাজের খোঁজে এসেছি, গো, কাজের খোঁজে”। কিন্তু তাঁর অসামান্য রূপ- লাবণ্য, মলিন হলেও পরনের বসনবিন্যাস ও এমন মধুর স্বরে সুস্পষ্ট উচ্চারণের কথা শুনে, তাঁকে দু মুঠি অন্নের কাঙালিনী বলে, কেউ বিশ্বাসই করতে পারল না।
বিরাট রাজমহিষী সুদেষ্ণা সেই সময় প্রাসাদের ছাদে উঠে রাজপথের দিকে তাকিয়ে অলস অবসর যাপন করছিলেন। হঠাৎ রাজপথে মরালগমন ভঙ্গিতে পথচলা পাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীতে তাঁর চোখ আটকে গেল। রাজমহিষী তাঁর অসাধারণ রূপ এবং তাঁকে অনাথা, ও এক-বসনা দেখে, ডেকে পাঠালেন। 
 
জিজ্ঞাসা করলেন, “ভদ্রে, তুমি কে? এবং কী অভিলাষে তুমি এখানে এসেছ”? দ্রৌপদী তাঁকেও একই কথা বললেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী, যদি কেউ আমাকে একটা কাজ দেন, সে কাজ আমি খুব সুন্দর ক’রে করে দেব। হে মহারাজ্ঞি, আমি কাজের খোঁজেই এখানে এসেছি”।
 
সুদেষ্ণা বললেন, “হে ভাবিনি, তুমি যেভাবে বলছো, তোমার মতো কামিনীদের পক্ষে সেরকম কখনোই সম্ভব নয়। বস্তুতঃ, তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমিই অনেক দাসদাসী রাখতে পারো। তোমার গোড়ালি উঁচু নয়, তোমার দুই উরু নিবিড়, তোমার নাভিদেশ অত্যন্ত গভীর, তোমার নাক উন্নত, তোমার নেত্রকোণ, করতল, চরণতল, জিভ ও অধর রক্তিম; তোমার বাক্য রাজহংসীর মতো অস্ফুট গদগদ, কেশবিন্যাস অতি মনোহর, তোমার শ্যামল অঙ্গ, তোমার নিতম্ব ও পয়োধর নিবিড়তম, তোমার আঁখিপক্ষ্ম বক্র, তোমার কটিতট ক্ষীণ, গ্রীবা শঙ্খের মতো, তোমার শরীরের কোন শিরা দেখা যায় না এবং তোমার মুখমণ্ডল পূর্ণিমার চাঁদের মতো রমণীয়। তুমি কাশ্মীরি অশ্বিনীর মতো এবং পদ্মপলাশলোচনা কমলার মতো অপরূপা। হে ভদ্রে, তোমাকে পরিচারিকা বলে মোটেই মনে হচ্ছে না। তুমি যক্ষ রমণী কি দেবকামিনী নও তো? গন্ধর্বী বা অপ্সরা? নাগবনিতা কিংবা এই নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী? বিদ্যাধরী, কিন্নরী কিংবা স্বয়ং রোহিণী? তুমি অলম্বুষা না কি মিশ্রকেশী? পুণ্ডরিকা বা মালিনী? অথবা তুমি কি ইন্দ্রাণী, বারুণী, বিশ্বকর্মার পত্নী, ব্রহ্মাণী কিংবা অন্যান্য দেবকন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা? সে যাই হোক, তুমি কে বল”?
দ্রৌপদী বললেন, “হে মহারানি, আমি দেবী, গন্ধর্বী, অসুরী বা রাক্ষসী নই। সত্যি বলছি, আমি সৈরিন্ধ্রী। আমি কেশসংস্কার, রূপচর্চা, কেশসজ্জা, চন্দন ইত্যাদি বিলেপন এবং মল্লিকা, উৎপল, কমল ও চম্পক প্রভৃতি ফুলের বিচিত্র মাল্য গ্রন্থন করে থাকি। প্রথমে আমি কৃষ্ণপ্রিয়তমা সত্যভামা এবং তারপরে কুরুকুলের একমাত্র সুন্দরী দ্রুপদকুমারীর সেবা করেছিলাম। সেই স্থানে আমি সমুচিত অশন ও বসন সহ পরমসুখে কাল কাটাচ্ছিলাম। স্বয়ং দ্রুপদকুমারী ভালোবেসে আমাকে "মালিনী" নামে ডাকতেন। রাজ্যচ্যুত হয়ে ওঁরা কোথায় অজ্ঞাতবাসে চলে গেছেন, জানি না, তাই কর্মহীনা হয়ে, আজ কর্মের সন্ধানে আপনার আশ্রয়ে এসেছি”।
সুদেষ্ণা বললেন, “আমি তোমাকে মাথায় করে রাখতে পারি। কিন্তু ভয় হয়, পাছে আমার রাজা সর্বান্তঃকরণে তোমার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। পুরুষের কথা দূরে থাক, এই রাজকুল এবং আমার গৃহের যত রমণীরাও মুগ্ধ হয়ে, অনন্যমনে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার প্রাসাদে ও উদ্যানের যত তরু,  তারাও তোমাকে দেখার জন্য মাথা নত করেছে। হে নিবিড়নিতম্বিনি, বিরাটরাজ তোমার অলৌকিক অঙ্গসৌষ্ঠব মন দিয়ে দেখলে, আমাকে ত্যাগ করে, তোমাতেই মন ও প্রাণ সমর্পণ করে দেবেন। হে চঞ্চলায়তলোচনে, অনুরাগের সঙ্গে তুমি যে পুরুষের দিকে দৃষ্টি দেবে অথবা সর্বদা যার চোখের সামনে তুমি থাকবে, সে পুরুষ অবশ্যই অনঙ্গ শরে বশীভূত হবে। মানুষ আত্মহত্যার জন্য যেমন উচ্চ তরুশাখায় চড়ে বসে, আমার পক্ষে তোমাকে রাজপুরীতে স্থান দেওয়াও অনেকটা সেই রকম। ফলে তোমাকে রাজ অন্তঃপুরে স্থান দেওয়া, কাঁকড়ার গর্ভধারণের মতো, আমার পক্ষে মৃত্যুস্বরূপ হয়ে উঠবে”।
দ্রৌপদী বললেন, “হে ভাবিনি, মহারাজ বিরাট বা অন্য কোন পুরুষ আমাকে লাভ করতে সমর্থ হবেন না, কারণ পাঁচজন যুবা গন্ধর্বতনয় আমার স্বামী, তাঁরা মহাসত্ত্ব গন্ধর্বরাজের পুত্র। আমার ঐ পঞ্চ স্বামী আমাকে সর্বদা রক্ষা করে থাকেন। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দান না করেন এবং আমাকে দিয়ে পদ প্রক্ষালন ইত্যাদি পদসেবার কাজ না করান, তাঁর প্রতি গন্ধর্বগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন। যে পুরুষ ইতরকামনায় আমার প্রতি লোভপরবশ হয়, সেই রাত্রেই সেই পুরুষকে শমন সদনে যেতে হয়। কোন পুরুষই আমাকে, আমার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আমার প্রিয়তম গন্ধর্ব স্বামীগণ, এখন দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়েও, প্রচ্ছন্নভাবে আমার কাছাকাছিই থাকেন এবং আমাকে রক্ষা করে থাকেন”।
বিরাট রাজমহিষী সুদেষ্ণা বললেন, “হে আনন্দবর্ধিনি, তোমাকে তোমার মনের মতোই বসন দেব এবং তোমাকে কারও চর্বিত কিংবা উচ্ছিষ্ট খাবারও দেওয়া হবে না”।



শ্রীকৃষ্ণের পত্নী সত্যভামা এবং পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীর রেফারেন্সেই  সৈরিন্ধ্রী - অর্থাৎ বিউটিসিয়ানের কাজটা পেয়ে গেলেন দ্রুপদনন্দিনী । তিনি একবছর রাজমহিষী সুদেষ্ণার পরিচারিকা হিসাবে সাফল্যের সঙ্গেই কাজকম্ম করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে রাজমহলে মারাত্মক এক বিপদও উপস্থিত হয়েছিল। সে বিপদ অবশ্য মহারাজ বিরাটের দিক থেকে নয়, অন্য পক্ষ থেকে। সে আর এক বৃত্তান্ত, অন্য আরেক দিন করা যাবে।
 
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা জরুরি, এই সৈরিন্ধ্রী-সুদেষ্ণা বাক্যালাপ কিন্তু কোন মহিলার লেখা নয়, লিখেছেন এক জবরদস্ত মহাপণ্ডিত বেদজ্ঞ পুরুষ, মহর্ষি বেদব্যাস, কুরু রাজ পরিবারের অন্দরমহলে যাঁর ছিল অতি ঘনিষ্ঠ যাতায়াত। সেই সূত্রেই হয়তো কোনদিন এইরকম কোন অভিজ্ঞতা, তিনি পর্যবেক্ষণ করে থাকবেন। নারীর চোখে নারীদেহ বর্ণনার আড়ালে তাঁকে চট করে পুরুষ বলে চিনে ফেলা যায়। কিন্তু সর্বাঙ্গসুন্দরী এক নারী পরিচারিকার জন্য গৃহকর্ত্রীর মানসিক সংশয় ও দ্বিধার বর্ণনাটি বড়ো নিখুঁত ও অনবদ্য এবং আজও প্রাসঙ্গিক। একথা ভুক্তভোগী নারী ও পুরুষ প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, মনে মনে মেনে নেবেন, সন্দেহ নেই!           

(কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকারঃ মহামতি কালিপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত সম্পূর্ণ মহাভারতের বাংলা গদ্য অনুবাদ থেকে সংগৃহীত। বিরাটপর্ব।)   
 
--০০--

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫

দিনটা হোলি

 সকাল সকাল সদর দরজায় দুমদাম ঘা আর তার সঙ্গে একটি মেয়ের ডাকাডাকি শুনে, অন্বেষাদেবী উঠোনে নামলেন। দরজার দিকে যেতে যেতে বেশ গলা তুলেই বললেন, “ওফ্‌ কি ডাকাতে মেয়ে রে, বাবা। দরজাটাই না ভেঙে পড়ে। দাঁড়া দাঁড়া, আর দরজা বাজাস না মা, খুলছি”। তাঁর আচরণে বা কণ্ঠস্বরে কোথাও বিরক্তির লেশমাত্র নেই, বরং যথেষ্ট প্রশ্রয়ের সুরেই বললেন কথাগুলো।

দরজা খুলতেই দেখলেন, ফুটকি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে গভীর রাগরাগ ভাব, কিন্তু ঠোঁট থেকে হাসির আভাসটা পুরো মুছতে পারেনি। ফুটকি রাগত স্বরে বলল, “তুমি আমাকে ডাকাতে মেয়ে বললে, কাকিমা? এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। একদিন দেখো সত্যিই তোমাদের বাড়ি ডাকাতি করতে আসবো, হ্যাঁ। তখন টেরটি পাবে”।

“বাড়িতে ঢোক তো আগে। তুই ডাকাতি করতে এলে উলু দিয়ে শাঁখবাজিয়ে বরণডালা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। তাতে আবার টের পাওয়ার আছেটা কী, রে পোড়ারমুখি?

“ও, শুধু ডাকাতে মেয়ে বলে হচ্ছিল না, তাই আবার পোড়ারমুখিও হয়ে গেলাম?”

“সব কথা ওভাবে ধরিস কেন? আমরা পুরোনো দিনের লোক। কথায় কথায় তোদের মতো “আই লাভ ইউ”, “আই মিস্‌ ইউ” বলতে পারিনা। ওগুলোই আমাদের স্নেহ, ভালোবাসা আর আদরের কথা। ভেতরে আয় বস। পাখাটা চালিয়ে দিই। দোল পড়তেই কেমন চিড়বিড়ে গরম পড়েছে, দেখেছিস?” 

ঘরে ঢুকেই ফুটকি পিছন থেকে অন্বেষা দেবীর গলা জড়িয়ে ধরে, আদুরে সুরে বলল, “ও কাকিমা, আজ কী খাওয়াবে গো?” 

“তুই আসবি জেনে, নারকেল কুচি দিয়ে নিরিমিষ ঘুগনি আর কিসমিস দেওয়া হালুয়ার বরফি বানিয়ে রেখেছি। ময়দা মাখা আছে – গরম গরম লুচি ভেজে দেব”। 

“বাঃ রে আমি, একা একা খাবো নাকি? কাকু কোথায়? এখনো ওঠেননি?”

“কঅঅঅঅখন উঠে পড়েছে, তোর কাকু। মর্নিং ওয়াক সেরে। চা খেয়ে এখন বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। ওটা মুখস্থ না হলে, উঠবে না”।

“আর তোমার ছেলে?”

অন্বেষাদেবী, আড়চোখে ফুটকির মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “সে খোঁজে তোর কী দরকার? তুই আমার কাছে এসেছিস, নাকি আমার ছেলের কাছে?”

ফুটকি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “দরকার আবার কী? সেদিন ভুবনকাকা আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বউ, ছেলেমেয়ে কেমন আছে ভুবন? গাইগরুটা ঠিকঠাক দুধ দিচ্ছে তো? হাঁসগুলো রোজ পুকুরে যায় তো? ভুবনকাকা আমাদের দেশের জমিজায়গা দেখা শোনা করেন। বাড়িতে কেউ এলে, কিংবা কোথাও গেলে ওরকম জিজ্ঞাসা করতে হয়, তাই করলাম”।

অন্বেষাদেবী এবার খুব জোরে হেসে ফেললেনহাসতে হাসতে বললেন, “বেশ চোপা করতে শিখেছিস তো? তোর সঙ্গে আমার জমবে ভালো”। একটু অবাক হয়ে, ফুটকি জিজ্ঞাসা করল, “তোমার সঙ্গে আমার কী জমবে গো?” 

“তোরা তো আবার সিরিয়াল দেখিস না। দিনরাত হোয়াটসয়্যাপ আর ফেসবুকে মুখ গুঁজে বসে থাকিস। সিরিয়াল দেখলে বুঝতে পারতিস, শাশুড়ি আর বউরা সব পাটভাঙা শাড়ি ব্লাউজ পরে, গয়নায় গা সাজিয়ে সারাক্ষণ কেমন চুলোচুলি, ঢুসঢাস করে। চোখ ঘুরিয়ে, ঘাড় নাড়িয়ে আর নাক-ঠোঁট-ভুরু কচলে তারা এমন সব ব্যায়াম করে না? ওদের কক্‌খনো ছানি পড়বে না। ঘাড় কনকন করবে না। বুড়ো বয়েসেও তাদের নাকের পাশে, ঠোঁটের পাশের চামড়ায় কোঁচ পড়বে না। তোরা  “আন্টি” হওয়ার ভয়ে যেসব অ্যান্টি-এজিং ক্রিম ঘষিস গালে, ওসব কিচ্‌ছু লাগবে না। দেখে নিস”।

অন্বেষা দেবীর কথা শুনে হাসতে হাসতে ফুটকির পেটে খিল ধরে যাওয়ার যোগাড়। হাসির দমক একটু কমলে বলল, “আহা, এত নিন্দে করছো, দেখতেও তো ছাড়ো না”।

“তুই আয়, তখন দেখবি, ঘরে এমন সিরিয়াল জমিয়ে দেব, পাড়ার লোক সিরিয়াল ছেড়ে আমাদেরই দেখতে আসবে”।

ফুটকি লাজুক হেসে বলল, “আহা, আমি বুঝি তাই বললাম? তোমার বাড়ি আসতে আমার বয়েই গেছে”।      

অন্বেষা দেবী বললেন, “আমার কাছে অত লজ্জা আর পেতে হবে না, মা। তুই বরং ওপর থেকে ঘুরে আয়, ততক্ষণ আমি লুচি ভাজার যোগাড় করি”।

এই সময়েই ওপর থেকে নেমে ঘরে ঢুকলেন, অনিমেষবাবু - ফুটকির কাকু। ঘরে পা দিয়েই বললেন, “ফুটকি মায়ের গলা পেলাম, দরজায় গুম গুম কিল মারারও আওয়াজ পেলাম। তারপরেও অনেকক্ষণ কোন সাড়া না পেয়ে নিজেই নেমে এলাম। মনে হল, যা শুনেছি, সে সবই তবে ঝুট কি? আসেনি কি আমাদের ফুটকি?” বলে হা হা করে হেসে উঠলেন, হাসলেন অন্বেষা দেবীও।

ফুটকি অপ্রস্তুত হাসি মুখে নিয়ে বলল, “আমি বরং তোমাদের ছাদটা একবার দেখে আসি। অনেকদিন তোমাদের ছাদটা দেখা হয়নি”।

অনিমেষবাবু নিরীহ মুখে বললেন, “সেই ভালো, ঘুরে আয়। আমগাছ ঝেঁপে কেমন মুকুল এসেছে, ছাদ থেকে দেখতে পাবি। আর কাঁঠাল গাছের সারা গায়ে কেমন মুচি ধরেছে, তাও। আর হ্যাঁ, ভুলেও যেন, বিল্টুর ঘরে যাস না। আমার সঙ্গেই বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। তোর গলা শুনেই নিজের ঘরে গিয়ে ইয়াম্মোটা একখানা বই মুখে নিয়ে বসেছে। পড়ছে কিনা জানি না, তবে ডিস্টার্ব করাটা উচিৎ হবে না”। হাসি চাপতে অন্বেষা দেবী মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

লজ্জায় রাঙা হয়ে ফুটকি বলল, “কাকু, তুমি আর কাকিমা দুজনেই না, একেবারে Zআতা”। তারপর দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়।

 

ফুটকি, ভালো নাম অভীষ্টা আর বিল্টু, ভালো নাম অনময়, ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বন্ধু। দুই পরিবারের মধ্যেও ভীষণ ঘনিষ্ঠতা। দুই পরিবারের এই ঘনিষ্ঠতা এখন নির্দ্বিধায় বৈবাহিক সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছে। সদ্য পিএইচডি করে, অনময় এখন একটি কলেজের লেকচারার। আর অভীষ্টা এম এ পাস করে, অন্য একটি কলেজে পার্টটাইম পড়ায়, তার সঙ্গে পিএইচডিও করছে। দুজনেই যখন কর্মক্ষেত্রে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে, অতএব উভয় পরিবারেরই এখন একটাই লক্ষ্য মুক্ত দুই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর পায়ে শিকলি দিয়ে সংসারের দাঁড়ে বেঁধে ফেলা।

ফুটকি দোতলায় গিয়ে নিঃশব্দে বারান্দা পেরোলো, তারপর কাকু কাকিমাদের ঘর ছাড়িয়ে, পাশের ঘরে উঁকি দিল। সাদা পাজামা আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে বিল্টু টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে। এবং অত্যন্ত মনোযোগে মোটা একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল ফুটকি। নিঃসাড়ে এগিয়ে বিল্টুর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। বিল্টু একবারের জন্যেও এতটুকু নড়াচড়া করল না, ফুটকিরও ধারণা সে অতি গোপনে এ ঘরে ঢুকেছেকিন্তু বিল্টু কী করে টের পেল কে জানে, শরৎবাবুর নভেলে যেমন থাকে, সেভাবে বলল, “এভাবে অসময়ে একলা পুরুষের ঘরে, তোর আসাটা ঠিক হয়নি, ফুটকি। সমাজ, প্রতিবেশীদের কথাটা তোর মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। নিচে বাবা-মাও আছেন। আমাকে নিয়ে তোর নামে কলঙ্ক রটবে, সে আমার সইবে না রে”।

ফুটকি এত অবাক হল, তার সঙ্গে এত চটেও গেল, চট করে কোন উত্তর দিতে পারল না।

একটু সময় নিয়ে, মাথা নিচু করে, মেঝেয় পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে ফুটকি বলল, “আমাকে ভুল বুঝবেন না, বিল্টুবাবু। কারণ, প্রথমতঃ এই ঘরে কোন পুরুষ আছে এ ধারণা আমার ছিল না। দ্বিতীয়তঃ, আমি এক সরলা নারী। শ্বশ্রু মাতা ও পিতার নির্দেশেই আমি আপনার ধ্যান ভাঙাতে এসেছি। আজকে বসন্তোৎসব, দোলের সকাল। আমি যে এসেছি, সেকথা অবগত হওয়া সত্ত্বেও, একখানা গাব্দা বইয়ে মুখে গুঁজে তপস্যার ঢং করার মতো বিড়ম্বনা আর কী হতে পারে?”

বিল্টুর ভেতরে হাসির ফোয়ারা উঠে আসতে চাইছিল। সেটাকে কোন মতে চেপে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুটকিকে দুহাতে বুকে টেনে নিল, তারপর বলল, “এ ঘরে কোন পুরুষ নেই, না? বসন্তোৎসবে আমি বই নিয়ে ঢংয়ের তপস্যা করছি?” বলেই ফুটকির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ফুটকি কোন আপত্তি করল না। বেশ কিছুক্ষণ তার ঠোঁটে বিল্টুর উষ্ণ ও দুষ্টু স্পর্শ উপভোগ করার পর তার মনে হল, বিল্টুকে আর পাত্তা দেওয়া ঠিক হবে না। বিল্টুর দু হাত থেকে ছাড়া পেতে ছটফট করে উঠল, বলল, “ছিঃ, সকাল সকাল এঁটো করে দিলি তো? কাকিমা ঠিক টের পেয়ে যাবেন। ওঁনার সামনে এখন কী করে যাবো?”

ফুটকির আচমকা এই অভিযোগে বিল্টু অপ্রস্তুত হল, ফুটকিকে ছেড়ে দিয়ে, জিজ্ঞাসা করল, “এ রাম তাহলে কী হবে?”

ছাড়া পেতেই ফুটকি এক দৌড়ে দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, মুখ ভেংচে বলল, “কী হ্যাব্যে? তুই একটা বুদ্ধু, আর ভিতুর ডিম...”। বলেই দৌড়ে সিঁড়ির দিকে গিয়ে, উঠে গেল ছাদে। বিল্টু ঘন ঘন ঘটনার মোচড়ে অবাক হল খুব। এমন নয় যে, সে আজই প্রথম ফুটকিকে চুমু খেল। এর আগেও খেয়েছে বহুবার। কিন্তু আজ কী সে কিছু বোকামি করে ফেলল? “অ্যাই, ফুটকি” জোরে ডাকতে গিয়েও ডাকল না, নিচেয় বাবা-মা আছেন, শুনতে পেলে, ব্যাপারটা আরও হাস্যকর হবে।

সেও দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে গেল, দেখল, মুকুল ভরা আমগাছের সামনে আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, ফুটকি গুনগুন করে গান গাইছে। বিল্টু তার পাশে দাঁড়াতে, আড়চোখে দেখল, গান না থামিয়েই লাজুক হাসল। তারপর বিল্টুর একটা হাত নিজের দু হাতে ধরে, গালে ঠেকালো। তারপর বিল্টুর কানে কানে গাওয়ার মতো গাইল,

“দখিন হাওয়ায় কুসুমবনের বুকের কাঁপন থামে না যে।

নীল আকাশে সোনার আলোয় কচি পাতার নূপুর বাজে।

ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ,

মৃদু হাসির অন্তরালে গন্ধজালে শূণ্য ঘিরিস –

তোমার গন্ধ আমার কণ্ঠে আমার হৃদয় টেনে আনে।

লুচির গন্ধ নাকে এলে, আর কি আমার মন মানে”? গানের শেষে এই লাইনটা জুড়ে দিয়ে ফুটকি খিলখিলিয়ে হেসে বলল, “এবার নিচেয় চল, যা অবস্থা করেছিস, গরম লুচি ঠোঁটে ঠেকাতে পারলে হয়”।

বিল্টু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “অমন সুন্দর গানের মুডটা এভাবে সর্বনাশ করতে হয়? রবিঠাকুরের এ গানটা কারো গলায় শুনিনি তো”। 

ফুটকি হাসতে হাসতে বলল, “এতগুলো বছর লক্ষ্মীছেলে হয়ে শুধু বই-মুখেই তো কাটালি। এসব আর শুনবি, কোত্থেকে? অনেকেই গেয়েছেন, কিন্তু আমার ভালো লাগে শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়েরটি। অপূর্ব। এত অনায়াস উদাত্ত গেয়েছেন, আর এতই রাবীন্দ্রিক, বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে। আমার মতো অলক্ষ্মীর সঙ্গে ঘর কর, সব পাবি। রবিঠাকুরের গান, লুচি, নারকেল দেওয়া ঘুগনি, কিসমিস দেওয়া হালুয়ার বরফি।

        

দুপুরের খাওয়ার পর কাকিমার ঘরেই সারাক্ষণ থাকতে হল ফুটকিকে। বার দুয়েক কাকিমার তন্দ্রা এসেছে ভেবে, ফুটকি চুপিচুপি পাশের ঘরে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্ত বিছানা থেকে নামতেই, কাকিমা প্রথমবার গম্ভীর গলায় বললেন, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে? এ ঘরের বাইরে বের হলে, ঠ্যাং খোঁড়া করে ফেলে রাখবো”। আর দ্বিতীয়বার বললেন, “বিছানা থেকে মেঝেয় পা দিয়ে দেখ, তোর পিঠ আমি আস্তো রাখব না”।

দ্বিতীয়বার ধরা পড়ে কাকিমার কাছে বকুনি খেয়ে, ফুটকি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তুমি আর মা, একই তো! খালি ঠ্যাং ভাঙবো, আর পিঠ ফাটাবো। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর একটু আরামে থাকবো, বকাঝকা করার কেউ থাকবে না। নেচে নেচে বেড়াবো। তা নয়, সেই তুমিও বকছো। তাহলে আর বিয়ে-টিয়ে করে লাভ কী?”

কাকিমা উঠে বসলেন, হাসতে হাসতে ফুটকির মাথাটা কোলে নিয়ে, ফুটকির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “এমন উতলা হস না রে, মেয়ে। এখন মনে হচ্ছে কাকিমাটা খুব হিংসুটি ভিলেন, সিনেমার গল্পের মতো তোদের প্রেমে খালি ব্যাগড়া দিচ্ছে। পরে বুঝবি রে, মুখপুড়ি, কোন কিছুতেই রাশ আলগা করতে নেই। তাতে সব কিছুই চট করে সস্তা আর একঘেয়ে হয়ে যায়। অনেকটা চাওয়া, একটু পাওয়া – তাতে আগ্রহ বেড়ে ওঠে। অনেক চাওয়া আর সবটা পাওয়া মানেই তো শেষ হয়ে যাওয়া রে, খেপি। তার পরে আর থাকবে কী? সেটা বুঝতে শিখলেই জীবনে আনন্দের অভাব ঘটে না। এই যে মন্ত্রটা শিখিয়ে দিলাম, কোনদিন ভুলবি না। আজকাল চারদিকেই শুনছি, বিয়ে ভাঙার গল্প। এই বিয়ে সেই ডিভোর্স। আবার বিয়ে, আবারও ডিভোর্স। আমার মতো যেদিন বুড়ি হবি, একদিন এই দিনটার কথা ভাববি, দেখবি খুব মজা পাবি”।

ফুটকি কেঁদে ফেলেছিল, কাকিমা টের পেলেন একটু পরে। শাড়ির আঁচলে ফুটকির চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, “কদিন পরেই তুই আমাদের ঘর আলো করবি। সে জেনেও আজ তোকে কাঁদিয়ে বড়ো আনন্দ পেলাম রে, পাগলি। দুঃখের দিনে ডুকরে কেঁদে ওঠা কিছু না। কিন্তু আনন্দের দিনে যে চুপিচুপি কাঁদতে পারে, তার চোখের কোলে, জানবি, দুঃখের দিনেও থাকে খুশির ছোঁয়া। মুখ তোল, তাকা আমার দিকে। কই? দেখি, মুখখানা। অ্যাই তো, এই না হলে তুই আমার মেয়ে? সোনা মা, আমার। পাঁচটা বাজল, চল চা করি। চা খেয়ে বিল্টু তোকে বাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসুক। দোলের সন্ধে, দিনকাল ভালো নয়। পথে ঘাটে নেশাখোর লোকেদের নানান উপদ্রব”।

ফুটকি কান্না ভেজা চোখ মেলে কাকিমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, “তোমাকে আর মাকে খুব ইচ্ছে করে গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করতে। কিন্তু পারি না, কেন বলো তো? মনে হয় নিজের মাকে ঘট ঘট করে প্রণাম করার মধ্যে কেমন যেন একটা লোক দেখানে-পনা থাকে। শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা যদি ভেতরে থাকে, সে তো আপনিই ঝরে পড়বে মা, তোমার পায়ে। স্যরি, কাকিমা”।

অন্বেষা দেবী হাসলেন, বললেন, “স্যরি, কিসের? আর কটা দিনই তো বাকি। তারপর তো, কাকিমার, মাটুকুই থাকবে, বাকি যাবে সরে। আর মাকে প্রণাম করার কথা বলছিস? বুকের দুধ খাওয়ার সময় সব সন্তানই তার মায়ের গায়ে কতই না লাথি মারে!  তার জন্যে কোন মা কি প্রত্যাশা করেন, তাঁর সন্তান হিসেব করে, তাঁকে সব প্রণাম মিটিয়ে দেবে? তা কক্‌খনো নয় রে”।

একটু বিরতি দিয়ে আবার বললেন, “শাস্ত্রে আছে ছেলেদের দু বার করে জন্ম হয়। শাস্ত্রের নিয়ম আগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য ছেলেদের জন্যে ছিল। এখন শুধু ব্রাহ্মণরা সেই নিয়ম রক্ষা করে। কিন্তু আমি বলি, মানুষের সমাজে যখন থেকে বিয়ের প্রথা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে প্রতিটি কন্যাই দ্বিজা। একজন মা কন্যার জন্ম দেন, অন্য মা সেই কন্যাকে সংসারে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা দেন। উভয় পক্ষ থেকেই এর অন্যথা হলে, সে সংসারে ভাঙন ধরে, আগুন জ্বলে – কেউ শান্তি পায় না”।

এতক্ষণ অন্বেষা দেবী আবেগের মধ্যে ছিলেন, হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল, বললেন, “এই মুখপুড়ি, কোল থেকে নাম, চল চা করি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সন্ধে হয়ে যাবে তোর ফিরতে। ওঠ”।

কুচো নিমকি দিয়ে চা খাওয়া হতে, অন্বেষা দেবীর তাড়াতেই ফুটকিকে বাইকে বসিয়ে বিল্টু বের হল। সোজা রাস্তায় না গিয়ে সে একটু ঘুর পথে নির্জন এক মাঠের ধারে দাঁড় করিয়ে খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, “তোর জন্যে আমি সারাটা দুপুর অপেক্ষায় রইলাম, আর তুই এলিই না। মায়ের ঘরেই ঘুমিয়ে পড়লি? হোলির পুরো দিনটাই তুই মাটি করে দিলি, মাইরি”।

ফুটকি বিল্টুর চোখে চোখ রেখে বলল, “ঘুমোইনি তো। তোর মায়ের কাছে নতুন জন্ম নিলাম। তোর মা বললেন, দ্বিজা”।

“তার মানে?”

“সে সব তুই এখন বুঝবি না। আর দুপুরে তোর কাছে যেতে পারিনি বলে, রাগ করিস না, প্লিজ। তোকে পরে বুঝিয়ে বলবো। আর এখানেই বা আমাকে আনলি কেন? আপনজনকে বুঝি লুকিয়ে চুরিয়ে ভালোবাসতে হয়? আয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবি চল। তোর মা হয়তো, আমার মাকে ফোন করবেন। আমাদের দেরি হলে, দুশ্চিন্তা করবেন দুজনেই”।

ব্যাজার মুখে বাইকে চড়ল বিল্টু, ফুটকি পিছনে বসতে, বাইক স্টার্ট করে বলল, “কী যে তোর হল, কিছুই বুঝলাম না”।

ফুটকি বিল্টুকে জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে বলল, “আজ যে দিনটা হোলি। এইচ ও এল ওয়াই, হোলি। আজকের দিনে যেটুকু হল, তাতেই বসন্তের বাতাস খেলে গেল বুকের মধ্যে! কিছু বুঝলি, বুদ্ধু?”

 

.০০.

নতুন পোস্টগুলি

শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

  ৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের ...