বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫

কমপ্লেক্স

 

সাইকেলে বাজার থেকে ফিরে নিশীথবাবু রান্নাঘরের দুয়োরের পাশে থলেটা নামিয়ে হাঁক দিলেন, “কোথায় গেলে সব - হ্যারে তনু, এক কাপ চা খাওয়াবি মা?” উঠোনের ধারের কলঘর থেকে মণিকা সাড়া দিলেন, “থলে থেকে মাছগুলো বের করে, ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখ, তনু। ইল্লুতে বেড়ালগুলো ছুঁকছুঁক করে বেড়াচ্ছে… হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু, দীনবন্ধু জগৎপতে, গোপেশ গোপীকাকান্ত ...”। মণিকাদেবী স্নান সেরে গামছা দিয়ে চুলের খোঁপা বেঁধে বের হলেন। তারপর উঠোনের দড়িতে ডিং মেরে ভেজা কাপড় মেলতে মেলতে বললেন, “পুরোনো তেঁতুল আনতে বলেছিলাম, ভুলে যাওনি তো?” নিশীথবাবু বারান্দাতেই বসেছিলেন, বললেন, “কিচ্ছু ভুলিনি, পুরোন তেঁতুল দিয়ে মৌরলা মাছের অম্বল…”।

তনু বাবার হাতে চিনি ছাড়া লিকার চায়ের কাপ ধরিয়ে বলল, “কোথায়? আমি তো মৌরলামাছ, পুরোন তেঁতুল কিছুই দেখলাম না, বাবা? চিংড়ি আর ভেটকি মাছ দেখলাম”। চায়ের কাপ হাতে নিশীথবাবু অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলছিস?” “দেখবে?” দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দুটো থালা নিয়ে বারান্দায় এল তনু, “এই দ্যাখো”। নিশীথবাবুর হাত কেঁপে উঠল। অবোধ অসহায় চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বারান্দা পেরিয়ে শোবার ঘরের কোনায় রাখা ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে যেতে যেতে মণিকা আড়চোখে মেয়ের হাতের থালাদুটো দেখে মন্তব্য করলেন, “বিয়ের পর থেকে পয়লা মাসেও কোনদিন তোমাকে চিংড়ি-ভেটকি একসঙ্গে আনতে দেখিনি। আজ মাসের ছাব্বিশ তারিখ… লক্ষ্মীস্তং সর্বদেবানাং যথাসম্ভব নিত্যশঃ। স্থিরাভব তথা দেবী মম জন্মনি জন্মনি...”। আসনে বসে দুই চোখ বন্ধ করে মণিকা অতি দ্রুত মন্ত্রোচ্চারণ করলেন। তারপর ঘাড়ে আঁচল জড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করলেন সিংহাসনের ঠাকুরসমূহকে। তারপর দ্রুতপায়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

রান্নাঘরের মেঝেয় বসেছিলেন নিশীথবাবু, সামনে কন্যা তনুজা আর দুজনের মাঝখানে মেঝেয় ঢালা আনাজের বিস্ময়। কেজি দুয়েক কড়াইশুঁটি, টোমাটো, দুটো নারকেল, ‘হাতিরমাথা’ দুটো ফুলকপি...। নিশীথবাবু অবাক হয়ে মেয়েকে বলছিলেন, “হ্যারে, আমি তো পুঁই-কুমড়ো, বাঁধাকপি, আড়াইশ কড়াইশুঁটি, একটা ছোটসাইজের ফুলকপি কিনেছিলাম। আর ছিল মৌরলামাছের প্যাকেটটা...সে সব এমন বদলে গেল কী করে বল তো, মা? এমনও নয় যে বাজারের থলি বদলাবদলি হয়ে গেছে...এই ব্যাগটা আমাদেরই তো...”।

তনুজা ফিক করে হাসল, বলল, “দশকর্মার দোকানে এমন নকশার থলে অনেক ঝোলানো থাকে বাবা, বদলে যে গিয়েছে, তাতে তো সন্দেহ নেই। কিন্তু কার সঙ্গে হতে পারে, সেটা মনে করার চেষ্টা করো”

নিশীথবাবু বললেন, “এই বাজারের বদলে, আমার থলেটা যে বাড়ি নিয়ে গেল, সে যে আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দেবে – সে তো বেশ বুঝতে পারছি”।

এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে মণিকা বাপ-বেটির কাণ্ড দেখে বললেন, “গবেষণা করে করবে কী, শুনি? এক কাজ তো করতে পার – পাড়ায় যত বাড়ি আছে, যত ফ্ল্যাটবাড়ি আছে – তাদের দুয়োরে দুয়োরে গিয়ে শুধিয়ে দেখতে পার...মৌরলার বদলে চিংড়ি-ভেটকি নেবে গো...”।

পত্নীর কথায় নিশীথবাবু খুবই ক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, “কী যে বলো না, তার ঠিক নেই”।

মণিকা বললেন, “সে কথাই তো বলছি...ভেবে আর লাভ কি? তনু, আনাজগুলো যেমন ছিল থলেতে ভরে রাখ, মাছের থালাদুটো ফ্রিজে তুলে দে। তুমি বাইরে গিয়ে বসো, আমি জলখাবার নিয়ে আসছি। তনু, হাত চালা মা, অনেক বেলা হল...”।

 


সাততলায় উঠে ফ্ল্যাটের দরজায় বেল দিলেন সোমেশ্বরবাবু। কাজের দিদি সুলতা দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকে বাজারের থলিটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “দিদি আজ দারুণ চিংড়ি পেয়েছি, বেশ গুছিয়ে মালাইকারি করো তো। তাছাড়া ভেটকি আছে – ফুলকপি দিয়ে জমিয়ে ঝোল...ওঃ আজ দুপুরের খাওয়াটা জমে যাবে”।

সুলতাদিদি হেসে ফেলে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করলেন, “চা খাবে তো”?

“জলখাবার হয়নি?”

“হয়ে গেছে। লুচিকটা ভাজতেই যা দেরি...”।

“তাহলে আর চা নয়, জলখাবারই দাও”। সোমেশ্বরবাবু বসার ঘরের সোফায় বসে নিশ্চিন্তে খবরের কাগজটা খুললেন।

সোমেশ্বরবাবুর স্ত্রী সুলগ্না ছেলেকে নিয়ে ক্রিকেট-কোচিং করাতে নিয়ে গিয়েছেন। কোচিং সেরে ফিরতে ফিরতে ওদের একটা-দেড়টা হয়েই যাবে। অন্য রোববারগুলো ছেলেকে নিয়ে সোমেশ্বরবাবুকেই দৌড়তে হয়। আজ সুলগ্না গিয়েছেন। ওঁর কোন এক বান্ধবীর বাড়ি বিবেকানন্দ পার্কের আশেপাশেই। সে বান্ধবী কেনটাকিতে থাকেন – দিন কয়েকের জন্যে কলকাতায় এসেছেন। ছেলেকে কোচিংয়ে দিয়ে সুলগ্না তার বাড়িতে যাবেন, সুখ-দুঃখের গল্প করতে। রবিবারের এমন নিশ্চিন্ত-নিরিবিলি সকালটাকে বৃথা যেতে দেওয়ার মানে হয় না, অতএব সোমেশ্বরবাবুর ইচ্ছে, জলখাবার সেরেই ভদকা নিয়ে বসবেন।

খবরের কাগজের প্রথম চারটে পাতার বিজ্ঞাপনে চোখ বোলাতে বোলাতেই সুলতাদিদি প্লেটে চারটে লুচি আর আলুর তরকারি নিয়ে হাজির হলেন। গরমগরম ফুলকো লুচির চেহারা দেখেই সোমেশ্বরবাবুর খিদেটা চাগিয়ে উঠল, বললেন, “ওফ দিদি, তোমার জবাব নেই...। বৌদিকে বলতে যেও না, যেন। জিগ্‌গেস করলে বলবে, ওটের খিচুড়ি খেয়েছি”।

সুলতাদিদি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে বললেন, “আরো দুটো দেব, দাদা, তারপর আর নয়, ব্যস। চা খাবে না কফি?”

“আর কিচ্ছু না। সে অন্য ব্যবস্থা আছে”।

“বুজেছি। তাহলে দু পিস মাছ ভেজে দিই?” সুলতাদিদি হাসলেন।

বড়ো তৃপ্তি করে ছটা লুচি শেষ করে সোমেশ্বরবাবু বেসিনে মুখহাত ধুয়ে নিজের ঘরে গেলেন। সেলার থেকে ভদকার বোতল, গেলাস বের করে, ডাইনিং হলে গেলেন, জলের বোতল নিতে।

সুলতাদিদি বাজারের থলি হাতে নিয়ে সামনে এসে বললেন, “এসব কী এনেছ, দাদাবাবু? কোথায় তোমার চিংড়ি আর ভেটকি? এই পুঁই আর কুমড়ো দেখলে বৌদিমণি কিন্তু খুব রেগে যাবেন। সঙ্গে আবার মৌরলা মাছ!”

“তার মানে? কী বলছো?” সোমেশ্বরবাবু থলিটা হাতে নিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে দেখতে দেখতে বললেন, “কী সর্বনাশ। তার মানে থলি বদল হয়ে গেছে”।

বসার ঘরের সোফায় ধপ করে বসে, হতভম্ব সোমেশ্বরবাবু চিন্তা করতে লাগলেন, কী করে এমন হল? তিনি মাত্র একবারই থলিটা নামিয়েছিলেন। তিনটে পান আর সিগারেট কিনতে গিয়ে, সেই পানের দোকানের পাশে। মনে পড়ল সেখানে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দোকানীর সঙ্গে কথা বলছিল। দোকানী নিতাই সোমেশ্বরবাবুর চেনা।  ওর থেকে তিনি নিয়মিত সিগারেটের বড়ো প্যাকেট নেন, তার সঙ্গে আজ নিয়েছেন তিনটে পান। দোকানী পান সাজা শুরু করতে সেই ভদ্রলোক বলেছিল, “আমি এখন তাহলে চলিরে নিতাই, দুপ্যাকেট বিড়ি আর দেশলাইটা খাতায় লিখে রাখিস”।

সোমেশ্বরবাবু মনে মনে অশ্রাব্য কিছু গালাগাল দিয়ে চিন্তা করলেন, ওই লোকটাই নির্ঘাৎ ব্যাগটা হাতিয়েছে। শালা চোর-চোট্টায় দেশ ছেয়ে গেল? একটু আনমন হয়েছ কি, ব্যাটারা চোখের কাজলটা পর্যন্ত ঝেড়ে দিচ্ছে! গুম হয়ে বসে সোমেশ্বরবাবু আরও কিছুক্ষণ ভাবলেন, নিতাইয়ের দোকানে ওই বিড়িখোর লোকটার খাতা আছে। তার মানে নিতাই ওকে ভালোভাবেই চেনে। নিতাইকে গিয়ে চেপে ধরলেই ওই পুঁই-কুমড়োখোর ছোটলোকের হদিস পাওয়া যাবে। সোমেশ্বরবাবু সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “দিদি থলেতে যা যা ছিল, কিছু বের করোনি তো?”

সুলতা বললেন, “তা করিনি, কিন্তু যে নিয়েছে তাকে তুমি এখন খুঁজবে কোথায়?” সোমেশ্বরবাবু লুচির আনন্দ এবং ভদকার স্বপ্ন ফেলে দরজা খুলে লিফ্‌টের দিকে ধেয়ে যেতে যেতে বললেন, “হতভাগাকে আমি খুঁজে বের করবই, দেখো না”।

 

নিতাইয়ের কাছে সত্যিই হদিস পাওয়া গেল। সোমেশ্বরবাবুর রাগ এবং উত্তেজনা দেখে নিতাই বলল, “উনি তো নিশীথস্যার। উনি আপনার ব্যাগ চুরি করেছেন? না দাদা, হতে পারে ভুল করে তুলে নিয়ে গেছেন, কিন্তু চুরি? অসম্ভব। উনি এ পাড়ার বহুদিনের বাসিন্দা, ওঁনাকে আমরা ছোটবেলা থেকে চিনি। এ বাজারের সবাই চেনে। আপনি ওই জিতেনদার রিকশয় যান - জিতেনদা, ও জিতেনদা, এঁনাকে নিশীথস্যারের বাড়ি নিয়ে যাও তো। যান জিতেনদাই আপনাকে স্যারের বাড়ি নিয়ে যাবে”।

জিতেনের সাইকেল রিকশায় চড়ে সোমেশ্বরবাবু দুপায়ের ফাঁকে পুঁই আর মৌরলার থলি নিয়ে গুম হয়ে বসে রইলেন। নানান অলিগলির প্যাঁচ বেয়ে সাইকেল রিকশ চালাতে চালাতে জিতেন জিজ্ঞাসা করল, “নিশীথস্যার কী করেছেন, দাদা?” সোমেশ্বরবাবু নিতাইকে যে উত্তেজনা নিয়ে তাঁর থলি চুরির কথা বলেছিলেন, এখন আর সেটা বলতে পারলেন না। একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, “ইয়ে মানে, মনে হচ্ছে, একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে, ওঁনার সঙ্গে আমার বাজারের থলিটা বদলাবদলি হয়ে গেছে...”।

জিতেন হাসল, বলল, “তাই? বোঝো কাণ্ড। ও নিয়ে ভাববেন না, থলি আপনি পেয়ে যাবেন”।  

সোমেশ্বরবাবুর গনগনে রাগটা ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসছিল। মৌরলা-পুঁই-কুমড়ো খাওয়া লোকটাকে এ পাড়ায় সবাই চেনে! আশ্চর্য! তার ওপর পানওয়ালা থেকে রিকশওয়ালা সবারই এত বিশ্বাস! তাঁর সোয়া দুকোটির ফ্ল্যাট, বত্রিশ লাখি গাড়ি। ছেলে বিখ্যাত স্কুলে পড়ে, ক্রিকেটের কোচিং নেয়। তাঁকে তাঁর কমপ্লেক্সেও তেমন কেউ চেনে না। কমপ্লেক্স তো অনেক বড়ো ব্যাপার, তাঁর নিজের অ্যাপার্টমেন্টের ছতলা কিংবা আটতলার বাসিন্দাদের, তিনিই কি চেনেন? লিফটে ওঠানামার সময় অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, হাই, হেলো, গুড মর্নিং, গুড ইভনিং – ব্যস ওইটুকুই!

নোনাধরা দেওয়ালে সবুজ রঙের দরজার সামনে রিকশ থামিয়ে, জিতেন বলল, “এই যে নিশীথস্যারের বাড়ি”। তারপর ভেজানো দরজা ঠেলে উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকতে শুরু করল, “তনু, এই তনু, স্যার কোথায় রে? এই দাদা স্যারকে খুঁজছে”।

রিকশ থেকে নেমে সোমেশ্বরবাবু বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। সিমেন্ট বাঁধানো ছোট্ট উঠোন। একধারে তুলসীমঞ্চ। উঠোন ঘিরে ছোট ছোট ফুলগাছ, গাঁদা, টগর, জবা...। সামনে লোহার গ্রিল দেওয়া লম্বা বারান্দাওয়ালা একতলা বাড়ি – বিবর্ণ, নোনাধরা…।  

নিশীথবাবু ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন, “কী ব্যাপার, বাবা জীতেন?”

সোমেশ্বরবাবু বললেন, “ইয়ে মানে, আজ নিতাইয়ের দোকানে আপনার থলির সঙ্গে আমার বাজারের থলিটা মনে হয় ...”। সোমেশ্বরবাবুর কথা শেষ করতে দিলেন না নিশীথবাবু, উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “ওফ, আপনি আমায় বাঁচালেন, ভাই...বাড়ি এসে বাজারের থলি আজার করে যা আতান্তরে পড়েছিলাম...ভেতরে আসুন, ভাই, ভেতরে আসুন, হ্যাগো শুনছ, ওঁনার থলিটা গুছিয়ে দিয়ে দাও...”।

তনুজা থলিটা নিয়ে উঠোনে এল, মুচকি হেসে বলল, “কাকু, এই যে আপনার থলে”।

নিশীথবাবু সোমেশ্বরবাবুর হাত থেকে নিজের থলিটা নিয়ে তনুজাকে বললেন, “যা মা, মাকে গিয়ে বল, সব সমস্যার মীমাংসা হয়ে গেছে”।

সোমেশ্বরবাবু বললেন, “থলিটা একবার চেক করে নিন ...”।

নিশীথবাবু উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে বললেন, “ধুর মশাই, পুঁই-কুমড়ো আর মৌরলা বুঝি চেক করা যায়? মৌরলা কেউ কোনদিন গুনেগুনে কেনে নাকি? বরং আপনার চিংড়ি আর ভেটকির পিস গোনাগুনতি...”।

সোমেশ্বরবাবু হাত তুলে কোনরকমে নমস্কারের ইশারা করে বললেন, “আচ্ছা, এখন তাহলে চলি?”

“আপনাকে নাহক হয়রান হতে হল...”

 

জিতেনের রিকশায় উঠে সোমেশ্বরবাবু পায়ের কাছে রাখা থলি থেকে চিংড়ি আর ভেটকির প্যাকেটদুটো হাতে নিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলেন…পনের পিস চিংড়ি আর ভেটকির পিস ছিল ষোলটা। জিতেন হঠাৎই রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে রিকশাটা দাঁড় করাল, ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “দেখে নিন, সব ঠিকঠাক আছে তো?” সোমেশ্বরবাবু একটু ইতস্ততঃ করেও প্যাকেট খুলে গুনলেন। তারপর মুখে বোদা হাসি ফুটিয়ে বললেন, “ঠিকই আছে। জিতেন আবার রিকশা চালাতে শুরু করে জিগ্‌গেস করল, “আপনার কোন কমপ্লেক্স?”

“আকাশপথ”।

“ওঃ ও তো বিশাল কমপ্লেক্স… কমপ্লেক্স মানে অনেক বাড়ি বা মনের জটিল কারবার, তাই না দাদা? নিশীথস্যারের কাছে পড়েছিলাম, উনিই আমাদের স্কুলে ইংরিজি পড়াতেন…ইলেভেনে বাবা মারা গেলেন, তারপর থেকেই এই রিকশ…”।

অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নেমে, সোমেশ্বরবাবুর মনে হল - তাঁর আড়াইহাজারি বাজারের থলিটা দেওয়ার সময় ওই মাস্টার চেক করতে বলল না। কিন্তু দেড়শটাকার বাজারের জন্যে চেক করার কথা কেন তিনি ওই মাস্টারকে বলতে গেলেন? আসলে তিনি যে শুধু মস্তো এক কমপ্লেক্সেই থাকেন তা নয়, তাঁর মনের মধ্যেও গড়ে তুলেছেন গভীর কিছু কমপ্লেক্স, যে কথা মনে করিয়ে দিল জিতেন নামক রিকশাওয়ালাটাও!  

 

--০০--

সোমবার, ৯ জুন, ২০২৫

হরিহর আত্মা

 

 

 

কদিন ধরে টানা নিম্নচাপের দরুণ খুব বৃষ্টি আর মেঘলা গেল। আজ সকালটা ঝকঝক করছে পরিষ্কার। আড়ালবাবু এখনো নিচেয় নামেননি, নামলে, এমন দিনে বলতেন, “আজ সকালটা বেশ চকচক করছে, দেখেছেন? নীল আকাশটাকে আজ যেন পালিশ দিয়ে, আয়না করে ছেড়ে দিয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে, এই পৃথিবীর ছায়াও হয়তো দেখা যাবে আকাশের গায়। আর ওদিকে স্যাঁকরার দোকান থেকে সদ্য গড়িয়ে আনা সোনার থালার মতো ঝকঝকে সূর্যটার আলো, চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। গাছের পাতায় ঝিলমিল করছে সোনা রোদ্দুর। গাছের পাতায় পাতায় আজ জবরদস্ত ভোজবাড়ির মতো ব্যস্ততাহাওয়ায় দুলতে থাকা পাতারা বাতাস থেকে হুস হুস করে কার্বন ডায়ক্সাইড টেনে নিচ্ছে, আর ওদিকে শেকড়-বাকড় ভেজামাটি থেকে চোঁ চোঁ করে জল টেনে, পৌঁছে দিচ্ছে পাতায়, পাতায়তারপর সূর্যের আলোর সঙ্গে সবুজ পাতায় সালোকসংশ্লেষ ঘটিয়ে, বাতাসে কয়লার উনুনের ধোঁয়ার মতো ছাড়ছে অক্সিজেন আর বাষ্পআজ গাছের আশপাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বুক ভরে শ্বাস নিতে কী আরাম, কী আরাম! গাছের ছাড়া ওই বাষ্পের জন্যে দরদরিয়ে ঘামটা হয় ঠিকই, কিন্তু বাস ট্যাক্সি অটোর ধোঁয়ার জন্যে, ফুসফুসের কেলটে তেলচিটে ন্যাতা-ন্যাকড়া ব্যাপারটা যে কমে যায়, সেটা বেশ টের পাই”   

আড়ালবাবুর কথাবার্তার এরকমই ধরন। রোজ সকাল সকাল আমরা একসঙ্গে হাঁটতে যাই। আড়ালবাবু আর আমি। আড়াল রয়আড়ালবাবুর নাম আসলে রঙ্গলাল রয়, প্রথম পরিচয়ের দিনই আমাকে মজা করে বলেছিলেন, “আমি হচ্ছি রঙ্গলাল রায়, সংক্ষেপে আর এল রয়, তার মানে, আড়াল রয়, আমি আড়ালেই তো থাকি মশাই, প্রকাশ্যে বড়ো আসি না, হে হে হে হে”।

আড়ালবাবু আর আমি একই অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা। উনি থাকেন চারতলায়, আমি আটতলায়। এ নিয়েও উনি মজা করে আমাকে বলেন, “আপনারা সব উঁচু তলার বাসিন্দা”সারাদিন নিজের নিজের কাজ কর্মে আমরা ব্যস্ত থাকি, তাই দেখা সাক্ষাৎ কমই হয় তবে মর্নিং ওয়াকের সময় উনি আমার নিত্যসঙ্গীআর ছুটির দিনগুলোতে দিনের বেশ কিছুটা সময়, হয় আমি ওঁনার ফ্ল্যাটে কাটাই, নয়তো উনি আমার ফ্ল্যাটে। তার কারণও আছে, আমি ব্যাচিলর আর আড়ালবাবু বিপত্নীক তাঁর একমাত্র কন্যা বিয়ে থা করে সুদূর সিয়াটেল শহরের স্থায়ি বাসিন্দা। তিনি ফ্ল্যাটে একলাই থাকেন। অবরে সবরে কন্যা-জামাই-নাতি-নাতনীদের কলকাতায় আবির্ভাব হলে, কয়েকটা দিন আড়ালবাবু ব্যতিব্যস্ত থাকেন। “আবির্ভাব” আর “ব্যতিব্যস্ত” কথাগুলো উনিই বলেন। একবার জিগ্যেস করেছিলাম, “ওদের আসাকে হঠাৎ আবির্ভাব বলেন কেন”?

“কী বলছেন মশাই, আবির্ভাব নয়? এঁনারা সকলেই এনারাই, মানে এন আর আই। প্রবাসী। যতদিন এখানে থাকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকি। এই যেমন ধরুন টয়লেট শুকনো নয়। টয়লেট কোনদিন শুকনো হয় শুনেছেন? আমি তো শুনিনি মশাই। আমাদের ছোটবেলায় দেশের বাড়ির কলতলায় টিউকল ছিল, সেখানেই আমাদের চান, হাত-পা ধোয়া, মুখধোয়া, আঁচানো, ছোঁচানো সবই চলত। গরমের নির্জন দুপুরেও টিউকলের তলায় বালতি রাখার গাব্বুতে জল খেতে আসত কাকের দল। হাগু করতে যেতাম ঘর থেকে একটু দূরে, এক টেরে। এখন “হাগু” বলুন না, রে রে করে সবাই তেড়ে আসবে। পটি বলতে হয়। পটি বললেই যেন জিনিষটা শুদ্ধ হয়ে গেল। আমার বাপু অত সব মাথায় থাকেও না, মাঝে মধ্যেই এমন সব বদখৎ কথা বলে ফেলি। আমার কিছু হয় না, আমার মেয়ে অপ্রস্তত হয়। আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বলে, “বাপি, তুমি আর শুধরোলে না”নাতি আর নাতনীদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতে হয়। অফিসে মাঝে মধ্যে ইংরিজিতে কথাবার্তা বলতে হত, বুঝলেন? তা সে সব কথা অফিসিয়াল কথা, তার এক বাঁধাধরা গৎ আছে, কিন্তু ঘরোয়া কথাবার্তায় ইংরিজি কী বলি বলুন দেখি” আমিও সমর্থন না করে পারি না।

“তা ঠিক, সাদা বাংলার কথাবার্তা ইংরিজিতে বলতে গেলে, বেশ খটমটো হয়ে যায় ব্যাপারটা”

“হয় না? বলুন দেখি। এই তো গেলবার যখন এসেছিল। একদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর, ভাবলাম নাতি-নাতনী দুটোকে ঠাকুমার ঝুলির গল্প শোনাই। প্রথমেই এক বেমক্কা হোঁচট খেলামবললাম গ্র্যাণ্ডমামা’স ব্যাগ। নাতি জিগ্যেস করে বসল, হোয়াট টাইপ অফ ব্যাগ? লেদার অর সিন্থেটিক? কটন অর জুট? যতো তাকে বোঝাতে যাই ইটস নট লাইক দ্যাট, ইটস সিম্বলিক। ইউ মে থিংক অফ কালেকশান অফ গ্র্যাণ্ডমামা’স স্টোরিসসে মশাই, তাদের ঝুলি বোঝাতেই আমার সময় কেটে গেল, গল্প আর শুরুই করা হল না। ওদিকে মেয়ে আর জামাই নিজেদের মধ্যে অনর্গল ইংরিজিতে বকে চলেছে, জামাই বলছে ওর কলেজের বন্ধুদের গেট টুগেদারে যেতেই হবে, মেয়ে বলছে তার কলেজের বন্ধুদের...”                             

 

 

আমাদের ব্লকের একপাশে ছোটছোট চারাগাছে ফুল এসেছে বিস্তর। দোপাটি, নয়নতারা, বেলি। লতায় লতায় মাধবীলতা, জুঁই আর ঝুমকো কুরুপাণ্ডব। মিনিট দশেক ঘুরে ঘুরে ফুল-টুল দেখার পর আমাদের ব্লকের সিকিউরিটি অনাদি পোল্লেকে জিগ্যেস করলাম, “রঙ্গলালবাবু নামেন নি এখনো?”

সিকিউরিটি অনাদি পোল্লে উত্তর দিল, “না স্যার, এখনো তো দেখিনি ওঁনাকে”

“এত দেরি তো করেন না, শরীর-টরীর খারাপ করল নাকি?”

আমি আমার মোবাইল থেকে আড়ালবাবুকে কল করলাম। চারবার রিং হ’য়ে কেটে গেল। তার মানে আড়ালবাবু আসছেন বোধ হয়। এদিকে আমাদের ব্লকের লিফ্‌ট্‌টাও নেমে আসছে দেখলামনিচেয় এসে লিফ্‌ট্‌টা দাঁড়াতে, দরজা খুলে আড়ালবাবুই এগিয়ে এলেন, বললেন, “আমার একটু দেরি হয়ে গেল। আপনার কল পেয়েই বুঝলাম আপনি অপেক্ষা করছেন। আজকের রোদ্দুরটা দেখেছেন, মশাই? কদিন মেঘলার জন্যে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছিল ওয়েদারটা, আজ একেবারে বকেয়া গরম যেন ঢেলে দিচ্ছে হুড় হুড় করে। সকালেই এই, বেলায় দেখবেন, রোদ্দুরে বেরোনো যাবে না; ঘাড় পিঠ, মুখ একেবারে ড্রাগনের নিশ্বাসের মতো জ্বালিয়ে দেবে। চলুন, রোদ্দুরটা ঝাঁঝালো হবার আগেই হেঁটে আসি। ভাদুরে ভ্যাপসা গরমে একটু হাঁটাচলা করলেই ঘাম! একটু ছায়া ছায়া দেখে হাঁটবো মশাই, অকারণ পিঠ পুড়িয়ে, মুখ পুড়িয়ে লাভ নেই।”

“সেই ভালো, আর দেরি না করে, চলুন ঘুরে আসি”আমাদের আবাসনের মধ্যেই ইঁট সাজানো সুন্দর পথের ওপর নেমে আমি বললাম। পিছন থেকে সিকিউরিটি অনাদি পোল্লে হঠাৎ পিছু ডাকল, “স্যার, স্যার”

আমি ও আড়ালবাবু দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। 

“কিছু বলবে, অনাদি?” আমি জিগ্যেস করলাম।

“আচ্ছা, এখন থাক স্যার। ফিরে আসুন, এলে বলব”

সিকিউরিটি অনাদির আচরণে আমি একটু বিরক্তই হলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। হাঁটতে শুরু করলাম, আমার পাশে পাশে আড়ালবাবুও হাঁটতে আরম্ভ করলেন।

 

অন্যদিন আড়ালবাবু অনর্গল বকবক করেন, অথচ আজ মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেও উনি কথা বলছেন না দেখে আমি বেশ আশ্চর্যই হলাম। ওঁকে কথা বলানোর জন্যে আমিই কথা শুরু করলাম, “অনাদি পিছু ডেকে কী বলতে চাইছিল, বলুন তো? আমি তো ওর সামনে মিনিট দশেকের ওপর দাঁড়িয়েই ছিলাম, ফুলগাছ দেখছিলাম, তখন কিছু বলল না।”

“যা বলেছেন, সকাল সকাল পিছু ডাকলে মাথাটা খুব গরম হয়ে যায়, জানেন? খনার বচন জানেন তো “ভরা থেকে খালি ভালো, যদি ভরতে যায়; আগে থেকে পিছে ভালো, যদি ডাকে মায়”

“তার মানে? বুঝলাম না ঠিক” আমি হেসে বললাম।

“বুঝলেন না? ছড়ায় বলছে, একমাত্র মা যদি পিছু ডাকেন তাহলে খুব শুভ, অন্য কেউ ডাকলে নয়”

“তাই? আর ওই ভরা-টরা নিয়ে যেটা বললেন?” হো হো করে খানিক হাসলেন আড়ালবাবু, তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “এগুলো সব দিদিমার থেকে শোনা, বুজেছেন? সে সব অন্যরকম দিন ছিল, ভালো কি মন্দ সে তর্কে যাচ্ছি না, তবে একদম অন্যরকম। দিদিমা বলতেন, কোথাও যাত্রার সময়, ভরা কুম্ভ, মানে জলভরা কলসী দেখা শুভ, আর খালি কলসী খুব অশুভ। কিন্তু শূণ্য কুম্ভ নিয়ে কেউ নদীতে বা পুকুরে জল ভরতে যাচ্ছে, এই দৃশ্য নাকি দারুণ শুভ”

“বাঃ”আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, “আপনার থেকে পুরনো দিনের অনেক কিছু জানা যায়”

“আরো আছে, অনেক আছে। দিদিমার যা স্টক ছিল, ভাবা যায় না। সে যাকগে ওই পিছু ডাকা নিয়ে খামোখা ভাববেন না। হে হে হে হে, ও হচ্ছে অনাদি অনন্ত। ওর অভিযোগের আর শেষ নেই। কিছু একটা অভিযোগের কথা বলতো, হয়তো ওর ঘরের ফ্যানটা চলছে না, কাল রাতে ঘুমোতে পারেনি”

“রাতে ঘুমোবে কেন? রাতের ডিউটি না করে, ঘরে ঘুমোবে”?

“এ কি আর সেই আগেকার দিনের রাতের পাহারাওয়ালা পেয়েছেন? “জাগতে রহো” হেঁকে হেঁকে পাড়ায় ঘুরে বেড়াবে? ফ্ল্যাটের সবাই ফিরে এলে, রাত্রে ও সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে, নিজের ঘরে ফ্যান চালিয়ে ঘুমোয়। সে অবশ্য একদিকে ভালো। আগেকার দিনের পাহারাদাররা পাড়ার লোককে জাগিয়ে অশান্তি বাড়াত। অনাদি নিজেও শান্তিতে ঘুমোয়, আমাদেরও অশান্তি করে নাকালই দেখুন না, এমন ঘুমিয়েছি, ঘুম ভাঙতেই চায় না। আপনার মিস কল পেয়ে দৌড়তে দৌড়তে নেমে এলাম”

“সে কি? আমার মিস কল পাওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই তো আপনি নেমে এলেন। ফ্রেস হতে বাথরুমও যাননি”?

আড়ালবাবু হেসে বললেন, “হে হে, এমন সুন্দর ফ্রেস সকালে, আবার কী ফ্রেস হবো? তার ওপর আপনার ওই মিস কল। এই কল ব্যাপারাটা নেহাত কম গোলমেলে নয়, জানেন? ইংরিজিতে কল মানে ডাক। আবার বাংলায় দেখুন কল মানে যন্ত্রপাতি, কল-কারখানাকল মানে জলের কল। ছোটবেলায় আমরা উত্তর কলকাতায় থাকতাম, বুজেছেন? একবার ছোট ভাইয়ের খুব জ্বর হয়েছিল, আমাদের পাড়াতেই থাকতেন ডাক্তারজ্যেঠু। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ তাঁর বাড়ি গেছি, জ্যেঠিমা বললেন, “তোর জ্যেঠু কলে গেছেন”“আচ্ছা” বলে আমি দাঁড়িয়ে আছি, বাড়ির সদরের সামনে। তা বেশ অনেকক্ষণ হবে। কি কাজে জ্যেঠিমা আবার বাইরে এসে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “দাঁড়িয়ে আছিস যে, বললাম না কলে গেছে, ফিরতে দেরি হবে। ফিরলে বলে দেব, তোদের বাড়ি যেতে”বুজুন। ডাক্তার বাবু কলে গিয়েছেন, মানে পেশেন্ট দেখতে বাইরে গেছেন। অথচ  আগেকার দিনে কলঘরে যাওয়া মানে স্নান করাও বোঝাতো, সেও এক ফ্রেস হওয়ার ব্যাপার। ফ্রেস মানে পরিষ্কার। পরিষ্কার মানে সাফ সুতরো, স্বচ্ছ ভারত। তার মানে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা”

“আপনি পারেন বটে, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে চলে এলেন”আমি হাঁটতে হাঁটতে হাসলাম।

“না, না, অনলবাবু, আপনি চিন্তা করে দেখুন এই ফ্রেস কথাটা কত সুদূরপ্রসারী। ঝেঁটিয়ে সাফ করা নিয়ে একটা বিখ্যাত গানও আছে, “মার ঝাড়ু মার, ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর”। তার মানে, সাফ করা মানে বিদেয় করাও হয়বিদায় করা নিয়েও খুব দুঃখের গান আছে, “বিদায় করেছ যারে নয়ন জলে, এখন ফিরাবে তারে কিসের ছলে?” মানে যে একবার বিদায় নেয় এই পৃথিবী থেকে, তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায়? যায় না। তাছাড়া ফিরিয়ে আনবেই বা কে? আর নয়নজল ফেলবেই বা কে? আমার স্ত্রীর জন্যে আমি নয়ন জল ফেলেছিলাম, কিন্তু আমার জন্যে মেয়ে কী আর নয়ন জল ফেলার সময় পাবে? আমার বিদায়ের খবর পেয়েই তাকে ছুটির জন্যে দরখাস্ত করতে হবে, কলকাতা আসার টিকিট বুক করতে হবেসেই সিয়াটেল থেকে কলকাতায় আসা কী চাট্টিখানি হ্যাপা? ওই ভয়ে তো গেলামই না কোনদিন, মেয়ে-জামাই কতবার বলেছে। ওরাই সব করে দিত, ভিসা, যাওয়ার টিকিট, ফেরার টিকিট, কিন্তু ওই ঝামেলা! ঝামেলার কথা ভেবে আর যাওয়াই হল না, আর হবেও না কোনদিন”

আড়ালবাবুর এই বিদায় নেওয়ার দুঃখু-দুঃখু কথার মোড় ঘোরাতে আমি বললাম, “না হওয়ার কী আছে? আপনার মেয়ে জামাই, এর পরে আবার কবে আসছে, নভেম্বরে তো? ওদের সঙ্গেই চলে যান, ঘুরে আসুন কয়েকমাসের জন্যেনতুন দেশ দেখাও হবে, কলকাতার একঘেয়ে জীবন থেকে একটা চেঞ্জও হবে”

“অ্যাই, খুব ভাল বলেছেন, এই চেঞ্জ কথাটাই ধরুন। চেঞ্জ মানে বদলও হয়, আবার খুচরো টাকাও হয়। হলুদ ট্যাক্সিওয়ালাদের কাছে সকাল, বিকেল, সন্ধ্যে কোন সময়েই চেঞ্জ থাকে না। পঁয়তাল্লিশ টাকা মিটারে পঞ্চাশ টাকা নেবে, বাহাত্তর টাকার মিটারে আশিটাকা নেবে, ওরাও বলে “চেঞ্জ নেই, দাদা”, মানে খুচরো টাকা নেই তবে ওদের কাছে ওই চেঞ্জ না থাকার ব্যাপারটা কোনদিনই চেঞ্জ হবে না। কিন্তু খুচরো কিছু কাজ বাকি রয়ে গেল, সেগুলো শেষ করতে পারলে ভালো হতো”

“এখন তো সবে আগষ্ট মাস, আপনার মেয়ে-জামাই আসতে অনেক দেরি, এর মধ্যে আপনার খুচরো কাজগুলো আস্তে আস্তে সেরে ফেলুন”

“আপনি ব্যাপারটা বুঝছেন না, অনলবাবু, কাজগুলো আস্তে আস্তে সেরে ফেলার সময়ও আর রইল না যে। আমার মেয়ের আসতে আসতে খুব জোর দিন দুই তিনের বেশী বাকি নেই! ওই, আবার দেখুন, আস্তে আস্তে আর আসতে আসতে। একই উচ্চারণ, কিন্তু মানেটা আলাদা। লিখতে গেলে আমরা একটু আলাদা লিখি ঠিকই কিন্তু বলার সময়? ধরুন বললাম, আমি আসতে আসতে দেখলাম, দরজাটা বন্ধ। এর মানে কী। আমি ধীরে ধীরে দেখলাম, নাকি আসার পথে দেখলাম। হে হে হে হে। দেখবেন, আজকে ফেরার সময় খেয়াল করে দেখবেন। আমার ফ্ল্যাটের দরজাটা আস্তে আস্তে দেখবেন! নাকি আসতে আসতে দেখবেন? যে ভাবেই হোক দেখতে আপনাকে হবেই”

“দু একদিনের মধ্যেই আপনার মেয়ে আসছে? বাঃ খুব ভালো খবর তো! কালকেও কিছু বলেন নি, হঠাৎ ঠিক হল বুঝি?”

“হঠাৎ? হ্যাঁ, তা হঠাৎই বলতে পারেন। মেয়েও এখনও জানে না, যে তাকে আসতে হবে, আস্তে আস্তে জানবে। আর জানলেই দৌড়ে আসতে হবে, তখন আর আস্তে আস্তে আসতে পারবে না”

আমি খুব হাসলাম, তারপর বললাম, “হে হে হে হে, আজ আপনি খুব হেঁয়ালি করে কথা বলছেন, হে হে। আপনার মেয়ে জানে না, যে তাকে দু তিনদিনের মধ্যে আসতে হবে, অথচ আপনি জানেন? এ আপনার ভারি অন্যায় আড়ালবাবু। আপনার মেয়ে-জামাই বিদেশ বিভুঁইয়ে বড়ো বড়ো পদে কাজ করে, তাদের একটু সময় দেবেন তো, গুছিয়ে নিতে? তারপর ছেলেমেয়েদের স্কুল আছে, সেখানেও বলে আসতে হবেহুট বললেই কী চলে আসতে পারবে? একটু আস্তে, ধীরে সুস্থেই আসতে পারবে। হে হে হে হে, এই দেখুন, আমিও আপনার মতোই কথা বলা শুরু করে দিয়েছি”

আড়ালবাবু হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, বললেন, “নেহাত কম হাঁটা হল না, কিন্তু! চলুন কথায় কথায় অনেকটা চলে এসেছি, এবার ফিরি”

“কই আর তেমন হাঁটা হল, অন্যদিন তো এর থেকে আমরা বেশিই হাঁটি। তবে আজ বেরোতেও একটু দেরি হল, তার ওপর আমায় আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিসে বেরোতে হতচলুন ফিরেই যাই। সকালে অফিসে ঢুকেই আজ একটা মিটিং ছিল, কিন্তু...।”

“খুব জরুরি মিটিং? মানে, না গেলেই নয়?”

“তা একটু জরুরি, প্রতি মাসে এই সময়ই হয়। এমাসে কলকাতায় কত টাকার ব্যবসা হল, তার হিসেব পাঠাতে হয় মুম্বাইয়ের হেড অফিসে, সেই নিয়েই মিটিং আর কি। সে এমন কিছু নয়, কিন্তু আপনার শরীর-টরীর খারাপ লাগছে নাকি?”

“কেন বলুন তো?”

“ওই যে বললেন, মেয়েকে দু তিনদিনের মধ্যে আসতে হতে পারে। তাহলে আজই মেয়েকে আসতে বলে দিন” 

“শরীর খারাপের এখনই হয়েছে কী, কিছুই হয় নি। এই তো সবে শুরু। হে হে হে হে। শরীরটা নিয়ে ভাবছি না, বুঝেছেন। ঘরের কোণে পড়ে আছে যেমন পড়ে থাক, আমার কী? হে হে হে হে। আর মেয়েকে বলার লোকেরও অভাব হবে না। ঠিক ঠিক সময় মতো সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আজকের এই সুন্দর সকালে এই যে আপনার সঙ্গে হাঁটছি, আর বকে বকে আপনার মাথা খারাপ করে দিচ্ছি, এতেই আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, জানেন?”

আড়ালবাবু আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মিচকে হাসলেন। আমিও এই কথায় মজাই পেলাম, বললাম “আমার মাথা খারাপ করতে আপনার আনন্দ হচ্ছে?”

“হবে না, অনলবাবু? আজকে অফিসের মিটিংয়ে বসে আপনি যখন সকালের এই কথাগুলো ভাববেন, দেখবেন বিরক্তিকর মিটিংয়ে বসেও আপনি মিটিমিটি হাসছেন। মুখে না হাসলেও মনে মনে হাসবেন। মিটিমিটি হাসি পায় বলেই তো নাম মিটিং। আমাদের আপিসেও যখন এরকম মিটিং হত, আমার হাসিই পেত, কিন্তু গম্ভীর মুখ করে বসে শুনতে হত। কি জ্বালাতন বলুন তো। বড়ো কর্তারা এমন সব টার্গেট দেবে, কোন মাসেই করা যাবে না। তবু সেই নিয়ে তুলকালাম বকাবকি। পরের মাসের জন্যে আবার একটা অসম্ভব টার্গেট, হে হে হে হে, হাসি পাবে না? তবে হ্যাঁ, আমার আর এখন কোন টার্গেট নেই”

“আমারও মনে হয় আজ থেকে আর টার্গেট থাকবে না। আপনার মতো ঝাড়া হাতপা, নিশ্চিন্ত। ভাবলেই কী যে মজা হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারবো না”

 

 

আমাদের ব্লকের লবিতে ফিরে এলাম যখন, দেখি অনাদি গোল গোল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন অদ্ভূত লাগল। অনাদির সঙ্গে আমার ভালই আলাপ আছে, কোনদিনই ওর মধ্যে বেচাল কিছু দেখিনি। তবে আজকে যাবার সময়, ওর সেই পিছু ডাক, আর এখন এই ড্যাবডেবিয়ে আমাদের দিকে তাকানো দেখে বেশ বিরক্তই হলাম।

লিফটটা নিচেয় ছিল না, লিফটের সুইচ টিপে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। কি মনে হতে অনাদিকে আমি জিগ্যেস করলাম, “অনাদি, তখন পিছু ডাকছিলে, কিছু বলবে”?

অনাদি থতমত খেয়ে ঢোঁক গিলে বলল, “আজ্ঞে স্যার, একটা ক-কথা ছিল, আ-আপনার সঙ্গে, মানে ইয়ে...”

আড়ালবাবু আমার দিকে চোখ টিপে বললেন, “আপনার সঙ্গে প্রাইভেট টক করতে চায়, মশাই, টক করে সবার সামনে বলতে পারছে না, বেচারা। আপনি ওর সঙ্গে টকটা সেরেই নিন, টক না মিষ্টি দেখুন না, কী বলেআমি বরং ওপরে চললাম”

“সেই ভাল, আপনি এগোন। আমি দেখি কী বলতে চায়”

লিফটা নিচেয় এসে পড়েছিল, আড়ালবাবু লিফটে উঠে যেতে, অনাদি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে আমার দিকে এগিয়ে এল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, লিফটা দোতলা ছাড়িয়ে উঠে গেছে। আমি বললাম, “কি হয়েছে কী, কী ব্যাপার বলো তো”?

অনাদি আগের মতোই তোতলাতে তোতলাতে বলল, “কি-কিছু বুঝতে পারেননি, স্যার? আমার মনে হচ্ছে, র-রঙ্গলালবাবু আমাদের মধ্যে আর নেই!”

আমার খুব রাগ হয়ে গেল, মাথা থেকে পা অব্দি জ্বলে উঠল। স্পষ্ট বুঝলাম ব্যাটা আজকাল নির্ঘাৎ গাঁজা টানছে। সিকিউরিটি এজেন্সির মালিক, নিরাপদবাবুকে এখনই ফোন করতে হবে, এমন লোক আমরা চাই নাখুব কড়া গলায় বললাম, “সারারাত ক পুরিয়া ঘাস টেনেছো, অনাদি? তার রেশ এখনো রয়ে গেল”?

একহাত জিভ বের করে প্রথমে জিভ কাটল, তারপর দুই কানে হাত রেখে অনাদি হাউমাউ করে উঠল, “মা কালীর দিব্বি, স্যার। চা আর গুটখা ছাড়া জীবনে কোন নেশা নেই। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, স্যার। আপনি আর রঙ্গলালবাবু যাবার সময় যখন, ওই যে, ওইখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ওদিকটা পুবদিক। আপনাদের সামনে সূর্য ছিল, আর পিছনে ছিল লম্বা ছায়া। মানে, ইয়ে...আপনার ছায়া ছিল, ওঁনার ছিল না”

ওর এই অদ্ভূত কথায় আমি এমন অবাক হলাম যে, এটিএম থেকে দশহাজার তোলার সময়, আটটা পাঁচশ আর ষাটটা একশর নোট পেলেও হতাম না। বললাম, “আমার ছায়া ছিল, ওঁনার ছায়া নেই মানে”?

“হ্যাঁ স্যার। সত্যি বলছি। আরো আছে, স্যার। ওঁনার দুটো গোড়ালিই উলটো দিকে...”

“গোড়ালি? উলটো? অনাদি, নিরাপদবাবুকে আমি তোমার নামে কমপ্লেন করবোই, আমি চাই না, তোমার মতো নেশাখোর এক লোকের হাতে, আমাদের এই বাড়ির এতগুলো লোকের সিকিউরিটি জলাঞ্জলি যাক”আমি রাগে গনগনে গলায় বললাম।

“স্যার, আপনি খামোখা আমার মতো গরিবের ওপর রেগে যাচ্ছেন। আমি বলছি স্যার, রঙ্গলালবাবু আমাদের মধ্যে আর নেই”

আমার ঝাঁজালো ধমকানিতেও ওর কোন হেলদোল না হওয়াতে, আমিই কেমন দমে গেলাম, জিগ্যেস করলাম, “তাহলে, এতক্ষণ আমার সঙ্গে যে ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি কে”?

“স্যার, উনিই তো তিনি! ইয়ে, মানে...তিনিই কিন্তু তিনি নন, তাঁর অশরীরি ছায়া। ছায়ার কী আর ছায়া হয়, স্যার? সূর্যের দিকে টর্চ মারলে কী আর বেশি আলো হয়, স্যার? আর গোড়ালি উলটে যাওয়া মানে, আসছে না যাচ্ছে, বোঝা যাবে না। অশরীরি স্যার, হাওয়ার মতো, সব জায়গাতেই আছে, তার আবার আসা যাওয়া কী”?

আমি খুব সন্দেহের চোখে অনাদিকে দেখতে দেখতে বললাম, “এসব তোমাকে কে শেখালো বল দেখি?”

“আজ্ঞে ছোটবেলায়, মা, ঠাকুমাদের কাছে শুনেছি, তখন বিশ্বাস করিনি, আজ নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস হল”

“বোঝো। তোমারও রঙ্গলালবাবুর মতো সবজান্তা দিদিমা-ঠাকুমা ছিলেন বুঝি”?

“হ্যাঁ স্যার। তাতো থাকতেই হবে, তা না হলে, আমরা হলাম কী করে? ঠাকুমার মুখে শুনেছি, মারা যাবার ঘন্টা ছয়েক পরে আত্মা দেখা দিতে পারে, তবে দেখা দিলেও, তার ছায়া হয় না, গোড়ালি উলটে যায়”

“তাই বুঝি? আর তার চেয়ে কম সময় হলে”? আমি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম অনাদিকে। 

“সে আরো ভয়ংকর, স্যার। সে আত্মা দেখা দিলে, অবিকল মানুষের মতো মনে হয়। চট করে চেনা যায় না। কিন্তু ওই ঘন্টা ছয়েক – ব্যস, তারপর আর তার জারিজুরি খাটে না”   

নিখিলবাবু, অমরবাবু, সামন্তবাবু আরো জনা পাঁচেক সেই সময় বাজার থেকে ফিরছিলেন, আমাদের কথা বলতে দেখে, ওঁনারাও আমাদের ঘিরে ধরে সব কথা শুনতে লাগলেন। ওঁনাদের কৌতূহলের উত্তরে অনাদিকেও বারবার একই কথা বলতে হচ্ছিল। আমার ভালো লাগছিল না, আমি ভিড়ের থেকে আস্তে আস্তে সরে আসতে আসতে লিফটের সামনে গেলাম। লিফটে উঠে গেটটা বন্ধ করে, আট নম্বর বোতামটা টিপতেই লিফটটা উঠতে শুরু করল।

 


সামন্তবাবু এই আবাসনের সেক্রেটারি। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ, সামন্তবাবুর ড্রইংরুমে নিখিলবাবু, অমরবাবু এবং আরো জনা দশেক আবাসিক, চা খেতে খেতে কথাবার্তা বলছিলেন। সেখানে সিকিউরিটি এজেন্সির নিরাপদবাবুও ছিলেন। সকালেই থানায় খবর দেওয়া হয়েছিল, পুলিশ এসে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে লাশ বের করেছেতারপর সারাদিন ধরে, ফ্ল্যাটের প্রায় সবাইকে পুলিশের লোকজন জেরা করেছেসারাটাদিন যা ধকল গেল, সে আর বলার নয়। বেচারা অনাদির অবস্থাই সবথেকে খারাপ। আবাসনের সবাই, তারপর পুলিশের লোকরা সারাদিন এসে তাকে জেরা করে করে জেরবার করে দিয়েছে। ভয়ে আর আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে, দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে সে দেশে যাবার জন্যে নিরাপদবাবুকে রিকোয়েস্ট করেছিল। নিরাপদবাবু অনুমতি দিলেও পুলিশের অফিসাররা দেননি। তাঁরা বলেছেন, তদন্ত শুরু হয়েছে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত, অনাদি কলকাতার বাইরে যেতে পারবে না।

নিরাপদবাবু চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে, খালি কাপটা টেবিলের নিচেয় রাখতে রাখতে বললেন, “একেই বোধহয় হরিহর আত্তাঁ বলে, মশাই!”

সামন্তবাবু তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, “ওফ। নিরাপদবাবু, ওই আত্মার কথা আর উচ্চারণও করবেন না। এমনিতেই বাড়ির মেয়েরা আর ছোটরা খুব ভয় পেয়েছে। ওদের সামনে এসব কথা আর না তোলাই ভালো”

“আমরাও কী কম চমকে গেছি, সামন্তমশাই? আজকাল লোডশেডিং হয় না তাই, নইলে রাতের অন্ধকারে টয়লেটে একলা পেচ্ছাপ করতে যাওয়াও এখন দুষ্কর হয়ে উঠত”নিখিলবাবু বললেন।

“যা বলেছেন”অনেকেই নিখিলবাবুর কথার সমর্থন করলেন, আর অমরবাবু কিছুটা আপনমনেই বললেন, “তবে নিরাপদবাবু কথাটা মন্দ বলেননি। দুই বন্ধুর মিলটাও দেখার মতো। রঙ্গলালবাবু দেহ রাখলেন রাত বারোটা নাগাদ আর অনলবাবু ভোরের দিকে। একজনের সেরিব্রাল, তো আর একজনের হার্ট অ্যাটাক।  দুজনে আবার মর্নিং ওয়াকেও গেলেন একই সঙ্গে। এ একেবারে সত্যিই হরিহর...”।

আঁতকে উঠে, দুই কান চেপে সামন্তবাবু বলে উঠলেন, “রাম রাম রাম রাম, শেষ কথাটি আর নাই বা বললেন অমরবাবু!”

 

----০০---

শনিবার, ৭ জুন, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ২

 

 

এইসময় বাইরের উঠোনে, বারান্দায়, তিনতলা স্কুলবাড়ির ঘরে ঘরে নানান বয়সের মেয়েরা দৌড়োদৌড়ি করে, খেলা করে, হৈ চৈ করে। খাওয়ার সময়টুকু যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে নিয়ে ওরা টিফিন ব্রেক থেকে খেলার অবসরটুকু বাড়িয়ে নেয়। লাগামমুক্ত বাচ্চাগুলো স্কুলটাকে এমন মাতিয়ে রাখে, স্কুল নয়, মনে হয় যেন বিশাল কোন মেলা বসেছে – আনন্দের হাট

আর সেই সময় শুভময়ীদেবী টিচার্স রুমে তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে এককাপ লিকার চা আর সঙ্গে চারটে বিস্কুট নেন, ব্যস আর কিছু নয়। এ তাঁর দীর্ঘদিনের বরাদ্দ। অন্য সহকর্ম্মীরা বাড়ি থেকে আনা ছোট-বড়ো বক্স বের করে টিফিন সারে। যার যেমন পছন্দ, যার যেমন প্রয়োজন। টিফিনের সঙ্গে সঙ্গে কথাবার্তাও চলে। সংসারের কথা, এরিয়ার ডিএর কথা, ক্লাস নেওয়ার কথা, অবাধ্য মেয়েদের দুষ্টুমির কথা। সবচেয়ে বেশি চলে নিজেদের ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার এবং বড় হয়ে ওঠার নিত্য চিন্তা আর কাল্পনিক দুশ্চিন্তা নিয়ে কথা – অনুযোগ, অভিযোগ।

“কালকে কি হয়েছে জানেন, দিদি, কিটু রাতে খাওয়া দাওয়ার আগে পিসিতে ফেসবুক খুলে বসেছে। আর ওর বাবা গ্যাছে ভীঈষঅণ রেগেবলে – “সামনে তোমার ভাইট্যাল পরীক্ষা আর তুমি এখন ফেসবুকে টাইম ওয়েস্ট করছো”? - ওইটুকুনি ছেলে বাবার সঙ্গে কি তক্কো বাবা, কি তক্কো। শেষে রাগ করে দুজনেই বলে - রাত্রে কিছু খাবো না। আমার হয়েছে যতো জ্বালা, জানেন দিদি! ছেলেকে সামলাবো নাকি ছেলের বাবাকে। দুজনকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে অনেক রাত্রে তারপর আমাদের খাওয়া হল...”

একটু পৃথুলা জিয়োগ্রাফির টিচার সীমার ছেলে কিটু - এবার এইচ এস দেবে – সঙ্গে আছে আই আই টি, মেডিকেল, ইঞ্জিনীয়ারিং এন্ট্রান্সের জয়েন্ট পরীক্ষাসমূহ। কাজেই বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক।

অনেকটা কমবয়সী হিস্ট্রির টিচার ছিপছিপে লম্বা সরমারও অভিযোগের শেষ নেই তার কন্যা টুকলিকে নিয়ে, “তোমার তো তাও ভালো, দিদি। তোমার ছেলে তো জুয়েল  – লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট। মাধ্যমিকে কি রেজাল্ট, বাব্বাঃ, ভাবা যায় না। আর আমার মেয়ে দেখ, এই সবে ক্লাস নাইনেই তার পাখনা গজিয়ে গেছে। ওর লাস্ট বার্থডেতে, ওর ছোট মামা ২০জিবির আইপড গিফট করেছে। দিন রাত কানে গুঁজে গান শুনে চলেছে। ওর বাবা ওকে কত বোঝায় “হিয়ারিংএ প্রবলেমস আসবে, টুকলি, অমন সারাক্ষণ গান শুনতে হয় না”মেয়ে শুনলে তো? পড়তে বসেও কানে নিয়ে গান শোনে, আমি বারণ করলে কি বলে জানো, দিদি? বলে, গান শুনতে শুনতে পড়লে নাকি কনসেনট্রেসান বাড়ে। এই পাকা মেয়েকে নিয়ে কি করি বলো দেখি?”। 

শুভময়ীদেবী এই টিচার্স রুমে সবচেয়ে সিনিয়র। তিনি ম্যাথস পড়ান - সিনিয়ার টিচার  – এই বছরেই হয়তো অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিস্ট্রেস হয়ে যাবেন। সেরকমই শোনা যাচ্ছে। তাঁর চেহারায়, ব্যবহারে এবং সদাস্মিত মুখে এক অনবদ্য ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করছেন এই স্কুলেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার থেকে আজ তিনি সিনিয়ার টিচার। তাঁর শিক্ষকতা জীবনে কোনদিন উঁচু স্বরে কথা বলেননি। আজ পর্যন্ত তাঁর কাছে কোন ছাত্রীকেই কানমলা, নীলডাউন তো দূরের কথা – বকুনিও খেতে হয়নি কোনদিনঅথচ ছাত্রী এবং সহকর্ম্মী - সকলের থেকে তিনি পেয়েছেন যথোচিত সম্ভ্রম ও ভালোবাসা

শুভময়ী দেবী সকলের কথা স্মিতমুখে মন দিয়ে শোনেন। তিনি জানেন, এরা কেউই তাঁর কাছে কোন সমাধান প্রত্যাশা করছে না। নিজের নিজের সন্তানের জন্যে মাতৃসুলভ দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ ব্যক্ত করে, ওরা হাল্কা করে নিচ্ছে নিজেদের মানসিক চাপ  কিন্তু এর চেয়েও তিনি খুব মন দিয়ে শোনেন এই রুমের বাইরে, বারান্দায়, উঠোনে বাচ্চাদের দাপাদাপি আর হট্টগোলের শব্দ। এতগুলি শিশু, বালিকা এবং কিশোরীর সম্মিলিত জীবনের উচ্ছল প্রাণশক্তি তাঁকে মুগ্ধ করে রাখে। মাঝে মাঝে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখেন ওদের। স্নেহে আর মায়ায় তাঁর দৃষ্টি নরম হয়ে আসে তাঁকে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েরা কিছুটা সংযত হয় – শুভময়ীদেবী সরে আসেন। আহা, খেলুক ওরা খেলুক, আনন্দ করুক। এই তো বয়েস ওদের – ভবিষ্য কার জন্যে কি রেখেছে কে জানে? এই আনন্দটুকুই হয়তো সঞ্চয় হয়ে থাকবে ওদের সারাজীবনের স্মৃতিতে।

টিফিন ব্রেকের সময় শেষ হয়ে আসে। নীচের বারান্দায় ফার্স্ট বেল দেয় সুধাকর। শুভময়ীদেবী লক্ষ্য করেছেন প্রথম বেল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা অনেক সংযত হয়ে আসে। তাদের সম্মিলিত ধ্বনি কমে আসে। সকলেই কি এক উচ্ছ্বাসে যেন মেতে ছিল, এখন আবার সবাই নিজের মধ্যে ফিরে আসতে থাকে। সেকেন্ড বেল পড়ার আগেই অধিকাংশ মেয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ে, সেকেন্ড বেল পড়ে গেলে একটাও মেয়েকে আর বাইরে দেখা যায় না।

সেকেণ্ড বেল পড়ার পর টিচার্স রুমও খালি হয়ে যায়। চক–ডাস্টার নিয়ে দিদিমণিরা ক্লাস নিতে বেরিয়ে যান। টিফিন ব্রেকের পর দুটো পিরিয়ড শুভময়ীদেবীর সাধারণতঃ অফই থাকে। এই সময়টায় তিনি অফিসের বেশ কিছু কাজ সেরে নেন। সব কাজই তিনি সেরে ফেলেন সময়মতো। আজকের কাজ কালকের জন্যে তুলে রাখা তাঁর স্বভাব নয়। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটা দিন খুব সন্তর্পণে আসে। কারণ আগামীকাল কী হবে তিনি জানেন না। হয়তো কাল – বেশ কয়েকদিন, সপ্তাহ, মাস...তিনি আসতে পারলেন না। এমন হতেই পারে। সদাপ্রসন্ন উদাসীন স্বভাবের আড়ালে তিনি চেপে রাখেন দীর্ঘশ্বাস। কাজ - একমাত্র কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেই তিনি স্বস্তি অনুভব করেন – ভুলে থাকতে পারেন এক আপাত সরল অঙ্ক – যা আজও তিনি সমাধান করতে পারেন নি। প্রতিনিয়ত তিনি নিঃশেষ হয়ে চলেছেন এই মারাত্মক অঙ্কের দাহে।  তত্ত্বনির্ভর অঙ্কের সমাধান তাঁর আয়ত্তে – কিন্তু এ অঙ্ক জীবনের অঙ্ক - এক জটিল বাস্তব – এর সমাধান তাঁর আয়ত্তের অতীত।  

তখন বিতানের বয়েস ছিল মাত্র সাড়ে তিন। হাসিমাখা মুখে সারাদিন দস্যিপনায় ভরিয়ে রেখে দিত ঘরবাড়ি, সংসার, তাঁর জীবন। শুভময়ীদেবী স্কুল থেকে ঘরে ফেরার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতেন, কতক্ষণে ঘরে ফিরে ওকে কোলে নেবেন। স্কুল থেকে ফিরে দুহাতে জড়িয়ে, ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দীর্ঘ শ্বাসে ভরে নিতেন ওর ঘামে ভেজা চুলের ঘ্রাণ। সারাটা দিনে বিতানের হাজার দস্যিপনার খবর, তিনি মন দিয়ে শুনতেন তাঁর শ্বাশুড়ি আর কাজের মেয়ে ফুলকির থেকে। আর স্কুলছুটির দিনগুলো, সারাটা দিন কোথা দিয়ে যেন কেটে যেত ওর দৌরাত্ম্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে।  তখন সমস্ত চেতনা জুড়েই বিরাজ করত আত্মজ বিতান। সেই বিতান বেশ কদিনের জ্বর, গলায় এবং  সারা গায়ে ব্যথা, বমি, মাথা ব্যথা, সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ নিয়ে অসুস্থ হয়েছিল। কিন্তু আর কোন দিনই সে সুস্থ হয়নি। তাঁর বিতান, তাঁর আদরের বিট্টু এখন, আ চাইল্ড উইথ টোটাল স্প্যাসটিসিটি।

...পরের পর্ব আসবে সামনের শনিবার

নতুন পোস্টগুলি

শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

  ৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের ...