শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫

ঈশোপনিষদ

 প্রাককথা

 এই উপনিষদের প্রথম শব্দ ‘ঈশা’ – ‘ঈশা বাস্যমিদং...’ ইত্যাদি, এই ঈশা শব্দ থেকেই এই উপনিষদের নাম ঈশোপনিষদ্‌।

মূল ঈশোপনিষদ্‌খানি পদ্যের আকারে লেখা এবং অনেক পণ্ডিত এটিকে সবথেকে প্রাচীন বলে অনুমান করেন। মাত্র আঠারোটি মন্ত্রের এই উপনিষদে, মূল তত্ত্বের যে ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাতে পণ্ডিত ব্যক্তিরা এই উপনিষদ্‌টিকে, শ্রেষ্ঠ উপনিষদ্‌গুলির মধ্যে অন্যতম মনে করেন। সুপ্রাচীন কাল থেকে বহু পণ্ডিতজন এই উপনিষদের ব্যাখ্যা এবং ভাষ্য লিখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে সে যুগের আচার্যশংকর, মধ্ব, রামানুজপন্থী নারায়ণ যেমন আছেন, তেমনি আছেন এ যুগের দিকপাল মনস্বী ও বিদগ্ধজনেরাও। ঋষি শ্রীঅরবিন্দ, ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ এঁদের মধ্যে অন্যতম।

এই উপনিষদের প্রথম মন্ত্রঃ

“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্‌”।।

 এই উপনিষদের এই প্রথম শ্লোকটি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মজীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী এই মন্ত্রটি সম্বন্ধে বলেছেন, “...যদি সমস্ত উপনিষদ্‌ ও শাস্ত্র পুড়ে নষ্ট হয়ে, শুধু এই মন্ত্রটি রক্ষা পায়, তাহলে এই একটি মন্ত্রের জন্যই সকল হিন্দুদের মনে হিন্দুধর্ম চিরকাল সজীব থাকবে”। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীও এই উপনিষদের কোন কোন অংশের ব্যাখ্যা করেছিলেন।

 এই বিশ্ব চরাচরের সমস্ত জড় ও জীবে ব্রহ্ম ব্যাপ্ত রয়েছেন – অর্থাৎ তিনি সর্বব্যাপী। তিনি জ্যোতির্ময়, অশরীরি, বিশুদ্ধ, নিষ্পাপ, সর্বদর্শী ও স্বয়ম্ভূ। ব্রহ্মের এই স্বরূপ যিনি অন্তরে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি সর্বভূতে নিজেকেই দেখতে পান, সকলকে একাত্ম অনুভব করেন। অতএব তিনি কাউকে বিদ্বেষ বা ঘৃণা করতে পারেন না।

এই বহুত্বের সঙ্গে একাত্মতার অনুভবকেই বলা হয়েছে ‘বিদ্যা’। আর একাত্মতা অনুভব না করে, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অস্তিত্বের অনুভবকে বলা হয়েছে ‘অবিদ্যা’। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, বা নির্মিত হয়েছে, তাকে বলা হয়েছে ‘সম্ভূতি’, আর যা কিছু শাশ্বত ও সনাতন তাকে বলা হয়েছে ‘অসম্ভূতি’। ‘অহং’ অর্থাৎ আমিত্ব বোধ থেকে মানুষের মনে অহংকার আসে, আর এই প্রকৃতিতে জন্মের বন্ধন আসে মনের অহংকার থেকে। মন থেকে এই অহংবোধ বিনাশ করতে পারলে মানুষ অসম্ভূতি অবস্থা লাভ করে, এই অবস্থাকে তাই ‘বিনাশ’ও বলা হয়েছে।

ব্রহ্ম একদিকে বিদ্যা, অন্য দিকে অবিদ্যা; একদিকে সম্ভূতি, অন্য দিকে অসম্ভূতি। মানুষ তার জন্মগত অহংবোধের বিনাশ করতে পারলে, সে মুক্তি লাভ করে এবং সম্ভূতি অবস্থাতে থেকেও অসম্ভূতি অবস্থার অমৃতত্ব ভোগ করতে পারে।

                                                   শান্তিপাঠ

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

ওঁ পূর্ণম্‌ অদঃ পূর্ণম্‌ ইদং পূর্ণাৎ পূর্ণম্‌ উচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণম্‌ আদায় পূর্ণম্‌ এব অবশিষ্যতে।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

ব্রহ্মাণ্ডে নিরাকার রূপে যিনি পূর্ণ, এই জগতে সাকার রূপেও তিনি পূর্ণ,

পূর্ণ থেকেই পূর্ণের সৃষ্টি, পূর্ণ থেকে পূর্ণ গ্রহণ করলেও, পূর্ণই অবশিষ্ট থাকেন।

সকল বিঘ্নের শান্তি হোক।  

অর্থাৎ ব্রহ্ম এই জগতের ঊর্ধে, আবার এই জগতের সর্বত্রই তিনি ব্যাপ্ত। এই জগতের সৃষ্টি কিংবা বিনাশে তিনি কোনভাবেই প্রভাবিত হন না

[জীবের তিন ধরনের বিঘ্ন, আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক। আধ্যাত্মিক বিঘ্ন বলতে, শারীরিক কিংবা মানসিক রোগ বোঝায়, আধিদৈবিক বিঘ্ন বলতে, প্রাকৃতিক অর্থাৎ ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি বোঝায়, আর আধিভৌতিক বলতে হিংস্র প্রাণী, সাপ, বিছে ইত্যাদির দংশনের বিপদ বোঝায়।]

 

ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্‌।। ১

ঈশা বাস্যম্‌ ইদম্‌ সর্বম্‌ যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিৎ ধনম্‌।।

এই জগতে যা কিছু অনিত্য বিষয় আছে, সর্বত্রই ঈশ্বর ব্যাপ্ত আছেন। এই জাগতিক বিষয়ের আসক্তি ত্যাগ ক’রে আনন্দ করো। ধন-সম্পদের কামনা ক’রো না, কারণ সে ধন-সম্পদ কার? (অর্থাৎ ঈশ্বরের)  

[এই শ্লোকটির সরলার্থ নিয়ে অনেকে তাঁদের সংশয়ের কথা বলেছেন, তাই মনে হল আরেকটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। অতএব এই সংযোজনঃ 

অতুলবাবু বলছেন "তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথা"- অর্থ "ত্যাগের সহিত ভোগ করিবে"। আবার স্বামীজী বলছেন, "উত্তমরূপে ত্যাগের দ্বারা (আত্মাকে) পালন কর"। কিন্তু এই দুটি অর্থের কোনটিই আমার মনঃপূত হয়নি। আমার যেটা মনে হয়েছে সেটা বিস্তারে বলি - 

শ্লোকের প্রথম লাইনে ঋষি বলছেন, এই ব্রহ্মাণ্ডের অনিত্য সব কিছুতেই ঈশ্বর ব্যাপ্ত রয়েছেন। অর্থাৎ তার মধ্যে থেকে খাদ্য, বস্ত্র এবং গৃহ উপাদান আমরা সংগ্রহ করতেই পারি - কারণ সেটা আমাদের প্রাপ্য - আমাদের ভোগ্য - আমাদের জীবনধারণের জন্যে। এ শ্লোকের "ভুঞ্জিথা" শব্দটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। মনে হয় একথাটির অর্থ  সাধারণ "ভোগ" বলতে আমরা যা বুঝি - তার থেকেও অনেক ব্যাপ্ত। ভুঞ্জিথার নিকটতম তৎসম শব্দ আমার মনে হয় ভোজন। সেক্ষেত্রে ভোজন-সীমা বলে একটা ব্যাপার মাথায় আসে - অর্থাৎ ভালো থাকার জন্যে যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করলে আমরা সুস্থ-কুশল থাকি - সেটাই ভুঞ্জিথা - ভোজন বা ভোগের সীমা। তার অতিরিক্ত খাদ্য ত্যাগ করাই কর্তব্য। এখানে খাদ্য কথাটা বললাম একটা উদাহরণ হিসাবে - খাদ্য ছাড়াও  মাত্রাতিরিক্ত অর্থ, মাত্রাতিরিক্ত সম্পদাদি সমান ভাবে প্রযোজ্য।  এই সীমার বাইরে অতিরিক্ত যা কিছু সব ত্যাগ করতে হবে। 

দ্বিতীয় লাইনের "মা গৃধঃ" কথাটিও আমার ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। উল্লিখিত দুটি গ্রন্থেই "মা গৃধঃ" -র অর্থ বলা হয়েছে "লোভ করিও না"। সংস্কৃতে লোভ এবং তার সমার্থক শব্দ বেশ কিছু আছে - কিন্তু "গৃধঃ" কথাটা বেশ অসাধারণ। গৃধঃ শব্দের মূল গৃধ্‌, এই মূল থেকেই গৃধ্র কথাটি এসেছে যার অর্থ শকুনি - আমরা মনে করি "শকুনি" মানে অত্যন্ত লোভী - যে অন্যের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয়। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দ্বিতীয় লাইনটির অর্থ হতে পারে - অত্যন্ত লোভ করো না, (যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি সব কিছু) ত্যাগ করে ভোগ করো - কারণ এই সম্পদ বা ধন কার? ঈশ্বরের।] 

[এই ব্যাখ্যাতে আমি আরেকটি ভয়ানক বিতর্কের অবতারণা করলাম - সেটা ওঠার আগেই মিটিয়ে দিই। শকুনি একধরনের পাখি - বেশ বিপন্ন প্রাণী। মহাভারতের শকুনি মামা, শকুনের চোখ, এমনকি ইংরিজিতেও একটি প্রবাদ শুনেছি - "Vulture is a patient bird" - কারণ মৃতপ্রায় প্রাণীর মৃত্যুর অপেক্ষায় শকুনি বহুক্ষণ বসে থাকতে পারে এবং প্রাচীন কাল থেকেই ধরে নেওয়া হয়েছে - শকুন ওই মৃতপ্রায় প্রাণীর মৃত্যু কামনা করে - সে এতটাই লোভী। একই কথা প্রযোজ্য হিন্‌স্‌ মূল থেকে উৎপন্ন দুটি শব্দ - হিংসা এবং হিংস্র - বাঘ, সিংহের অত্যন্ত হিংসার জন্যেই তাদের আমরা হিংস্র বলি। 

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় শকুনি কিংবা বাঘ-সিংহ চনমনে খিদে না পেলে খাদ্য সংগ্রহে বা শিকারে বের হয় না এবং ভবিষ্যতের জন্যে হরিণের মাংস সঞ্চয় করে রাখার কোন ব্যবস্থা তারা আজ পর্যন্ত গড়ে তুলতে পারেনি।  অর্থাৎ শকুনি, বাঘ, সিংহাদি মাংসাশী প্রাণীর ঘাড়ে বদনাম চাপিয়ে, মানুষই পারে - লক্ষ-কোটি মানুষ ও প্রাণীকে বঞ্চিত করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করতে - সে নামে হোক, বেনামে হোক, স্বদেশে হোক বা বিদেশে হোক। সেক্ষেত্রে আজকের দিনে বসে ঋষিমশাই হয়তো বলতেন "মা মানুষ্যঃ" - মানুষের মতো তীব্র লোভ কর না।] 

এই গভীর তাৎপর্যের কারণেই এই উপনিষদের এই শ্লোকটির এত গুরুত্ব - যেটি পড়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ "মহর্ষি" হয়ে উঠেছিলেন - মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন শুধু এই শ্লোকটি ছাড়া অন্য সব শাস্ত্র পুড়ে গেলেও কোন ক্ষতি নেই - তবু হিন্দু ধর্মের চেতনা অটুট থাকবে।         


কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ।

এবং ত্বয়ি নান্যথেতোঽস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নর।। ২

কুর্বন্‌ এব ইহ কর্মাণি জিজীবিষেৎ শতম্‌ সমাঃ।

এবং ত্বয়ি ন অন্যথা ইতঃ অস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নর।।

কোন ব্যক্তির শতবর্ষ বাঁচার ইচ্ছে হলেও, তাকে সর্বদাই কর্তব্য কর্ম করে যেতে হয়; এ ছাড়া অন্য উপায় নেই, কিন্তু এই কর্তব্য কর্ম যেন তার মনে আসক্তি সৃষ্টি না করে।

 

অসূর্যাঃ নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ।

তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ।। ৩

অসূর্যাঃ নাম তে লোকা অন্ধেন তমসা-আবৃতাঃ।

তান্‌ তে প্রেত্য অভিগচ্ছন্তি যে কে চ আত্মহনঃ জনাঃ।।

আত্মার উপলব্ধি নেই যে সকল ব্যক্তির, তারা মৃত্যুর পর অজ্ঞানের অন্ধকারে, অন্ধের মতো জ্যোতিহীন তমসাচ্ছন্ন অসুরলোকে যাত্রা করে।


অনেজদেকং মনসো জবীয়ো

নৈনদ্দেবা আপ্নুবন্‌ পূর্বমর্ষৎ।

তদ্ধাবতোঽন্যানত্যেতি তিষ্ঠৎ

তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি।। ৪

অনেজৎ একম্‌ মনসঃ জবীয়ঃ

ন এনৎ দেবাঃ আপ্নুবন্‌ পূর্বম্‌ অর্ষৎ।

তৎ ধাবতঃ অন্যান্‌ অতি-এতি তিষ্ঠৎ

তস্মিৎ অপঃ মাতরিশ্বা দধাতি।।

এই আত্মা গতিহীন, অথচ মনের থেকেও দ্রুত গতিশীল। আত্মা অত্যন্ত দ্রুতগামী বলেই ইন্দ্রিয়সমূহ আত্মার সন্ধান পায় না। আত্মা স্থির থেকেও মন ও ইন্দ্রিয়সকলকে অতিক্রম করেন। আত্মার উপস্থিতির কারণেই বায়ু সমস্ত কর্মের বিভাগ করতে পারেন।

[আগুনের দাহিকা, সূর্যের জ্যোতি, মেঘের বর্ষণ ইত্যাদি কর্মের বিভাগ।]

 

তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।

তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।। ৫

তৎ এজতি তৎ ন এজতি তৎ দূরে তৎ উ অন্তিকে।

তৎ অন্তরস্য সর্বস্য তৎ উ সর্বস্য অস্য বাহ্যতঃ।। ৫

আত্মা স্থির, আত্মা চঞ্চল। অজ্ঞানীর থেকে তিনি দূরে থাকেন, কিন্তু জ্ঞানীর খুব কাছেই থাকেন। তিনি সমস্ত জগতের অন্তরে রয়েছেন, আবার বাইরেও তিনিই রয়েছেন

 

যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি।

সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।। ৬

যঃ তু সর্বাণি ভূতানি আত্মনি এব অনুপশ্যতি।

সর্বভূতেষু চ আত্মানং ততঃ ন বিজুগুপ্সতে।।

কিন্তু যে ব্যক্তি জগতের সমস্ত বিষয়কে আত্মস্বরূপে এবং সর্ব বিষয়ের মধ্যে নিজের আত্মাকে দেখতে পান, তিনি কাউকেই বিদ্বেষ করতে পারেন না।

 

যস্মিন্‌ সর্বাণি ভূতান্যাত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।

তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ।। ৭

যস্মিন্‌ সর্বাণি ভূতানি আত্ম এব অভূৎ বিজানতঃ।

তত্র কঃ মোহঃ কঃ শোকঃ একত্বম্‌ অনুপশ্যতঃ।।

জগতের সমস্ত বিষয়ের আত্মা যখন জ্ঞানীর আত্মার সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে যায়, তখন সেই একাত্ম জ্ঞানীর কাছে, মোহই বা কি; শোকই বা কিসের?

 

স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্‌।

কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোঽর্থান্‌ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।। ৮

স পর্যগাৎ শুক্রম্‌ অকায়ম্‌ অব্রণম্‌ অস্নাবিরম্‌ শুদ্ধম্‌ অপাপবিদ্ধম্‌।

কবিঃ মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূঃ যাথা-তথ্যতঃ অর্থান্‌ ব্যদধাৎ শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।

এই আত্মা সর্বব্যাপী, জ্যোতির্ময়, অবয়বহীন, অক্ষত, স্নায়ুশিরাহীন, পবিত্র ও অপাপবিদ্ধ। সর্বদর্শী মনের অধিকারী, সবার শ্রেষ্ঠ এবং স্বয়ম্ভূ এই আত্মা, কর্মফল ও তত্ত্বজ্ঞান অনুযায়ী শাশ্বতকাল ধরে যথাযথ কর্তব্য কর্ম স্থির করে দিয়েছেন।

 

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেঽবিদ্যামুপাসতে।

ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ।। ৯

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে অবিদ্যাম্‌ উপাসতে।

ততঃ ভূয়ঃ ইব তে তমঃ য উ বিদ্যায়াং রতাঃ।।

যাঁরা অবিদ্যা কর্মের উপাসনা করেন, তাঁরা অজ্ঞানের অন্ধকারে প্রবেশ করেনযাঁরা কর্মহীন হয়ে দেবতাদের উপাসনাকে বিদ্যা মনে করেন, তাঁরা আরো বেশি অন্ধকারে নিমজ্জিত হন।

 

অন্যদেবাহুর্বিদ্যয়াঽন্যদাহুরবিদ্যয়া।

ইতি শুক্রম্‌ ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে।। ১০

অন্যৎ এব আহুঃ বিদ্যয়া অন্যৎ আহুঃ অবিদ্যয়া।

ইতি শুক্রম্‌ ধীরাণাং যে নঃ তৎ বিচচক্ষিরে।।

যে সকল জ্ঞানী ব্যক্তি এই অবিদ্যা ও বিদ্যার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁরা বলেছেন, ‘অবিদ্যা ও বিদ্যার ফল আলাদা হয়, আমরা এমনই শুনেছি’

 

বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।

অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াঽমৃতমশ্নুতে।। ১১

বিদ্যাম্‌ চ অবিদ্যাম্‌ চ যঃ তৎ বেদ উভয়ং সহ।

অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়া অমৃতম্‌ অশ্নুতে।।

যিনি অবিদ্যা ও বিদ্যা উভয়ই জানেন, অর্থাৎ অবিদ্যার কর্ম দিয়ে দেবতার উপাসনারূপ বিদ্যার চর্চা করেন, তিনি সেই কর্ম দিয়ে মৃত্যুকে জয় করেন ও বিদ্যা দিয়ে দেবাত্মভাব লাভ করেন।

 

অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেঽসম্ভূতিমুপাসতে।

ততো ভূয় ইব তে তমো য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ।। ১২

অন্ধম্‌ তমঃ প্রবিশন্তি যে অসম্ভূতিম্‌ উপাসতে।

ততঃ ভূয় ইব তে তমঃ য উ সম্ভূত্যাং রতাঃ।।

যাঁরা অসম্ভূতি অর্থাৎ অবিদ্যাস্বরূপ প্রকৃতির উপাসনা করেন, তাঁরা অন্ধকারে অন্ধের মতো প্রবেশ করেন। কিন্তু যাঁরা সম্ভূতি অর্থাৎ প্রকৃতির থেকে উৎপন্ন কার্যব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁরা আরো ঘন অন্ধকারে প্রবেশ করেন।

 

অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ।

ইতি শুশ্রুম্‌ ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে।। ১৩

অন্যৎ এব আহুঃ সম্ভবাৎ অন্যৎ আহুঃ অসম্ভবাৎ।

ইতি শুশ্রুম্‌ ধীরাণাং যে নঃ তৎ বিচচক্ষিরে।।

যাঁরা এই দুই উপাসনায় ফলের ব্যাখ্যা করেছেন, সেই জ্ঞানীদের কাছে আমরা শুনেছি, ‘প্রকৃতির উপাসনার ফল একরকম এবং পরমব্রহ্মের উপাসনার ফল অন্যরকম’।

 


সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।

বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বাঽসম্ভূত্যাঽমৃতমশ্নুতে।। ১৪

সম্ভূতিম্‌ চ বিনাশম্‌ চ যঃ তৎ বেদ অভয়ং সহ।

বিনাশেন মৃত্যুম্‌ তীর্ত্বা অসম্ভূত্যা অমৃতম্‌ অশ্নুতে।।

যিনি সম্ভূতি ও বিনাশ – এই দুই তত্ত্বই উপলব্ধি করেছেন, তিনি বিনাশের সাহায্যে মৃত্যুকে অতিক্রম করে, সম্ভূতিরূপ অমৃতত্ব লাভ করতে পারেন।

 

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্‌।

তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।। ১৫

হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্য অপিহিতং মুখম্‌।

তৎ ত্বম্‌ পূষন্‌ অপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।

হে পূষন, সোনার পাত্রের আড়ালে আপনি যেন সত্যের মুখ ঢেকে রেখেছেন, আমাদের সত্যচেতনার জন্য আপনি তাকে উন্মুক্ত করুন।

 

পূষন্নেকর্ষে যম সূর্য প্রাজাপত্য ব্যূহ রশ্মীন্‌

সমূহ তেজো যত্তে রূপ্নগ কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি।

যোঽসাবসৌ পুরুষঃ সোঽমস্মি।। ১৬

পূষন্‌ এক-ঋষে  যম সূর্য প্রাজাপত্য ব্যূহ রশ্মীন্‌

সমূহ তেজঃ যৎ তে রূপম্‌ 

কল্যাণতমম্‌ তৎ তে  পশ্যামি।

যঃ অসৌ অসৌ পুরুষঃ সঃ অহম্‌ অস্মি।।

  হে পূষন, হে একর্ষি, হে যম, হে সূর্য, হে প্রজাপতিপুত্র, আপনি উজ্জ্বল কিরণ সংযত করুন, আপনার তেজ প্রশমিত করুন, আপনার পরমকল্যাণ রূপ আমি দেখব। ঐ আদিত্যমণ্ডলে অবস্থিত যে পুরুষ রয়েছেন, তিনিই আমি।

[পূষন- যিনি জগতের পোষণ করেন, একর্ষি > এক ঋষি – যিনি একা বিচরণ করেন এবং বহুর মধ্যে যে একের প্রকাশ, তিনি সেই এককে দেখতে পান। সূর্য জগতের পোষণ করেন, অতএব তিনি পূষণ। তিনি আকাশপথে একাই বিচরণ করেন, অতএব তিনি একর্ষি। তিনি ধর্মের নিয়ামক রূপে যম। যজ্ঞের আরেক নাম প্রজাপতি, এই যজ্ঞ সূর্যের জনক এবং ঊষা তাঁর জননী, অতএব সূর্য প্রজাপতির পুত্র।]     

 

বায়ুরনিলমমৃতমেদং  ভস্মান্তং শরীরম্‌।

ওঁ ক্রতো স্মর কৃতং স্মর ক্রতো কৃতং স্মর।। ১৭

বায়ুঃ অনিলম্‌ অমৃতম্‌ ইদম্‌ ভস্ম-অন্তম্‌ শরীরম্‌।

ওঁ ক্রতঃ স্মর কৃতম্‌ স্মর ক্রতঃ কৃতম্‌ স্মর।।

মৃত্যুর সময় আমার এই প্রাণবায়ু চিরন্তনী মহাবায়ুর সঙ্গে মিলিত হোক। আমার এই শরীর ভস্ম হয়ে যাক। হে পরমাত্মন্‌ অগ্নি, আমার মনের সকল সংকল্প স্মরণ করুন, আমি যা কিছু করেছি, সে সবও স্মরণ করুন। আমার সংকল্প স্মরণ করুন, আমার কৃতকর্ম স্মরণ করুন।

 

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্‌

বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্‌।

যুযোধ্যস্মজ্জুহুরাণমেনো ভূয়িষ্ঠাং

তে নম-উক্তিং বিধেম।। ১৮

অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মান্‌

বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্‌।

যুযোধি অস্মৎ জুহুরাণম্‌ এনঃ ভূয়িষ্ঠাং

তে নম-উক্তিং বিধেম।। ১৮

হে অগ্নি, সম্পদ্‌লাভের জন্য আপনি আমাদের সুপথে নিয়ে চলুন। হে দেব, আপনি এই বিশ্বচরাচরে সকলের কর্ম ও প্রবৃত্তির কথা জানেন। অতএব, কুটিল পাপ থেকে আপনি আমাদের মুক্ত করুন। আপনার প্রতি বারবার প্রণাম-বচন উচ্চারণ করি।

  নিরাকার রূপেও তিনি পূর্ণ, সাকার রূপেও তিনি পূর্ণ,

পূর্ণ থেকেই পূর্ণের সৃষ্টি, পূর্ণ থেকে পূর্ণ গ্রহণ করলেও, পূর্ণই অবশিষ্ট থাকেন।

হে পরমাত্মন, সকল বিঘ্নের শান্তি হোক।


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় ও শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র সেন, হরফ প্রকাশণী।

  

-০০-  

রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

বাংলার রেল

 

১. রেলযাত্রার সূচনা

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পর ধীরে ধীরে গোটা দেশটাই গ্রাস করে নিয়ে, আমাদের শাসন করতে লাগল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি নামে ইংল্যাণ্ডের একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। সেই শাসনব্যবস্থার কাঠামোটি কেমন ছিল, সেটা সংক্ষেপে এখানে বলে নিলে, পরের আলোচনাগুলি বুঝতে অসুবিধে হবে না।

সবার ওপরে ছিল - ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে নিযুক্ত একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী।

সেই ক্যাবিনেট মন্ত্রীর অধীনে ছিল একটি বিশেষ বোর্ড। তাদের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় বিষয়ের নীতি নির্ধারণ।

এই বোর্ডের অধীনে ছিল কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টরস। এই ডিরেক্টররা সকলেই লণ্ডনে থাকত।

এই কোর্ট অফ ডিরেক্টারসদের অধীনে থাকত একজন গর্ভনর জেনারেল। যার কাজ ছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে (পরে রাজভবনে) বসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে সামলে কোম্পানির স্বার্থ বজায় রাখা। অর্থাৎ সে সময় আমাদের সামনে, আমাদের দেশের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা ছিল ওই গভর্নর জেনারেল।         

 

  পলাশীর যুদ্ধের সাতাশি বছর পর ভারতীয় রেলপথ নির্মাণের প্রথম প্রস্তাব এসেছিল ১৮৪৪ সালে। সেই প্রস্তাবটি এনেছিলেন রোলাণ্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন নামে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের কোম্পানি। এই স্টিফেনসন সায়েব ছিলেন প্রথম সফল বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কর্তা জর্জ স্টিফেনসনের ভাইপো। এই স্টিফেনসন সায়েবই পরবর্তী সময়ে ইস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছিলেন।

এই প্রস্তাবের সমর্থনে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৮৪৪-১৮৪৮) বলেছিলেন “শুধুমাত্র সৈন্য এবং রণসম্ভার পরিবহনের জন্যেই কলকাতা থেকে দিল্লি রেলপথ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি”। তাঁর এই প্রস্তাবের উত্তরে কোর্ট অফ ডিরেক্টারসরা, লণ্ডনে বসে উত্তর দিয়েছিল, প্রথমেই কলকাতা-দিল্লির মতো দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ না করে সীমিত দৈর্ঘ্যের ছোটছোট প্রকল্প দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। তার সমর্থনে বলেছিল,    

ভারতের বিচিত্র আবহাওয়া এবং অদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য কলকাতা-দিল্লির মতো দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ বেশ ভজকট ব্যাপার হয়ে উঠবে, কারণ -   

১. ঘন ঘন বৃষ্টি ও বন্যা।

২. নিয়মিত ঝড়ো হাওয়া এবং কড়া রৌদ্রের প্রভাব।

৩. নানা ধরনের পোকা (যেমন উইপোকা, ঘূণ) এবং অপকারী প্রাণীর (যেমন ইঁদুর) থেকে কাঠ ও মাটির ভয়ানক ক্ষতির সম্ভাবনা।

৪. কাঠ বা ইঁটের গাঁথনির নিচে ক্ষতিকারক গাছগাছড়া দ্রুত গজিয়ে ওঠা।

৫. দেশের অসংরক্ষিত এবং সুরক্ষাহীন অঞ্চল দিয়ে রেলপথ নির্মাণ করতে হবে।

৬. দক্ষ এবং বিশ্বস্ত ইঞ্জিনিয়ার যোগাড় করতে এবং তাদের ব্যয় বহন করাও কঠিন হবে।

তৎকালীন বিশ্বে সবথেকে উন্নত এবং সুসভ্য লণ্ডনবাসী কোর্ট অফ ডিরেক্টারসরা এদেশের প্রখর রৌদ্র, ইঁদুর ও পোকামাকড়ের উপদ্রব এবং আগাছা গজিয়ে ওঠাকে ভয় পেয়েছিলেন!

তবে কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টারসরা প্রস্তাবিত এই রেলপথের আর্থিক উপযোগিতা বিষয়ে বেশ সুচিন্তিত ও দূরদর্শী মতামত দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই – “এখনও পর্যন্ত এদেশের (গ্রেট ব্রিটেন) অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যাত্রী বহন থেকেই আমাদের অধিকাংশ আয় হয়, পণ্য পরিবহনের আয় যৎসামান্য। ভারতের পরিস্থিতি ইংল্যাণ্ডের ঠিক বিপরীত। এখানকার শহরের জনবহুল ধনী মানুষদের তুলনায় ভারতীয়রা গরিব। এবং ভারতীয় জনগণ বাসকরে বিশাল এক দেশের বিচ্ছিন্ন নানান অঞ্চলে। কিন্তু অন্যদিকে ভারত মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার। সস্তা কিন্ত দ্রুত পরিবহনের অভাবে সেই সম্পদ বিশ্ব-বাজার থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। অতএব, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারতীয় রেলপথ বাণিজ্যিক পণ্যপরিবহন করে বিপুল অর্থ উপার্জন করতে পারবে, কিন্তু যাত্রী পরিবহনে সে আয় হবে নগণ্য”।

ভারতের স্বাধীনতা লাভের সাতাত্তর বছর পরেও এই পরিস্থিতির এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।

 

যাই হোক ১৮৪৪ সালে হাওড়া থেকে দিল্লি রেলপথ বানানোর প্রথম প্রস্তাব উঠলেও, ভারতে প্রথম ট্রেন চালু হয়েছিল, ১৮৫৩ সালে বোম্বাই (মুম্বাই) থেকে থানা। ১৮৫৩ সালে হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া রেললাইন পাতা হয়ে গেলেও, ওই পথে ট্রেন চালু হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। এই বিলম্বের প্রধান তিনটি কারণ ,   

১) এই লাইনে চলার উপযুক্ত কিছু কামরা নমুনা হিসেবে বিলেত থেকে বানিয়ে পাঠানো হয়েছিল “গুডউইল” নামের একটি জাহাজে। তীরে এসে তরী ডোবার মতো, গঙ্গাসাগরের কাছে এসে সে জাহাজ গেল ডুবে। এই দুর্ঘটনার পরে ইস্টার্ন রেলের ইঞ্জিনিয়ার মিঃ হজসন, নিজের নকশামতো কলকাতাতেই রেলের কামরা নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই নির্মাণে অনেকটাই সময় লেগেছিল।

২) কলকাতার জন্যে বিলেত থেকে যে ইঞ্জিন পাঠানো হয়েছিল, সেই জাহাজ ভুল করে চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে অন্য আরেকটি জাহাজে চাপিয়ে সেই ইঞ্জিন ফিরিয়ে আনা হয়েছিল কলকাতায়। অতএব ইঞ্জিন আনতেও অকারণেই অনেকটা বিলম্ব হয়েছিল।

এই ইঞ্জিনটি হাওড়ার রেলযাত্রার শুরু থেকে নিয়মিত ব্যবহার করা হয়েছিল। এবং দীর্ঘদিন এটি হাওড়া রানিগঞ্জের ১২১ মাইল দূরত্ব নিয়মিত  যাওয়া-আসা করত।  ১৮৯৫ সালে এই ইঞ্জিনটির নাম দেওয়া হয়েছিল “ফেয়ারি কুইন”।  ১৯০৯ সালে এই ইঞ্জিনটিকে অবসর দেওয়া হয়। সেই ইঞ্জিনটি দিল্লির রেলওয়ে মিউজিয়ামে আজও সযত্নে রাখা আছে। কখনো কখনো টুরিস্টদের জন্যে এই ইঞ্জিনটিকে আজও চালু করা হয়। অর্থাৎ ফেয়ারি কুইন আজও স্টিম ছাড়ে, ধোঁয়া ছাড়ে এবং সিটি বাজায় এবং টুরিস্ট ট্রেন হিসেবে মাঝে মাঝে যাতায়াত করে দিল্লি থেকে আলওয়ার পর্যন্ত।  দুটি কামরার ছোট্ট ট্রেন - যাত্রী সংখ্যা ৫০ জন। ফেয়ারি কুইন বিশ্বের প্রাচীনতম একমাত্র সচল রেল ইঞ্জিন ও গাড়ি - তার নাম উঠেছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে।  


 তখনকার ও এখনকার ফেয়ারি কুইন ইঞ্জিন 


৩) তৃতীয় কারণটি হল দুই সাম্রাজ্যের সীমানা-সংক্রান্ত বিবাদ। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চন্দননগর ছিল ফরাসী সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া গামী রেলপথ গিয়েছে চন্দননগরের পাশ দিয়ে। সেই সময় সে জায়গাটি ব্রিটিশ না ফরাসী সাম্রাজ্যের অধীন – সেই বিতর্ক সাব্যস্ত হতেও দীর্ঘদিন গড়িয়েছিল।

শেষমেষ অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে, ১৮৫৪ সালের ১৫ই আগষ্ট মঙ্গলবার, কলকাতা থেকে হুগলি পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে রেলের প্রথম যাত্রা শুরু হল। এই উপলক্ষে ইস্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি থেকে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল, সেটির অনুবাদ এখানে দিলাম,

 

ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ে

এমাসের ১৫ তারিখ মঙ্গলবার থেকে ট্রেন হাওড়া ও হুগলি ছাড়বে নিম্নলিখিত সময়ে –

হাওড়া থেকে সকাল ১০-৩০ মিঃ, বিকাল ৫-৩০ মিঃ

হুগলি থেকে       ৮-১০ মিঃ,        ৩-৩৮ মিঃ

ট্রেন থামবে বালী, শ্রীরামপুর ও চন্দননগর স্টেশনে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে ট্রেন হাওড়া ও পাণ্ডুয়ার মধ্যে চলবে আর সব স্টেশনেই দাঁড়াবে।

যাঁরা কম ভাড়ায় মাসিক টিকিট চান, তাঁদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তাঁরা যেন যে কোনো স্টেশনে ফর্মের জন্যে দরখাস্ত করেন ও ফর্মগুলি ভর্তি করে যত শীঘ্র ম্যানেজিং ডিরেক্টার ও এজেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেন। মাসিক টিকিটের ভাড়া পরে ঠিক করা হবে। পরবর্তী ১ জানুয়ারির আগে মাসিক টিকিট দেওয়া হবে না।

আর ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন

১২ই আগস্ট, ১৮৫৪                                                  ২৯ থিয়েটার রোড, কলকাতা

 

ওই সময় হুগলি পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৩ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর ১ টাকা ২ আনা ও তৃতীয় শ্রেণীর ৭ আনা। তখনকার হিসেবে স্টেশনগুলির দূরত্ব এবং সফর-কাল কিরকম ছিল, সেটাও একবার দেখে নেওয়া যাক-

হাওড়া থেকে বালী – ৫.৫ মাইল – ১১ মিনিট, বালী থেকে শ্রীরামপুর ৬.৫ মাইল – ১৪ মিনিট, শ্রীরামপুর থেকে চন্দননগর – ৮.৫ মাইল – ২০ মিনিট। চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া – ৩ মাইল – ৮ মিনিট। সেই সময় চুঁচুড়া আর হুগলিকে একই স্টেশন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। অতএব হাওড়া থেকে চুঁচুড়া পর্যন্ত ২৩.৫ মাইল পথে ট্রেনের চলতি সময় লাগত ৫৩ মিনিট। অর্থাৎ গাড়ির গতি ছিল গড়ে ২৬.৬০ মাইল প্রতি ঘন্টায়। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে গাড়ি স্টেশনে দাঁড়ানোর সময় – মোট ৩৮ মিনিট। তাহলে হাওড়া থেকে চুঁচুড়া পৌঁছতে মোট সময় লেগেছিল ৯১ মিনিট – দেড় ঘন্টাঅর্থাৎ চুঁচুড়া থেকে সকাল ৮-১০ এ ছেড়ে ফেয়ারি কুইন হাওড়া পৌঁছত সকাল ৯-৪০ নাগাদ। সেটি সকাল ১০-৩০টায় হাওড়া ছেড়ে চুঁচুড়া পৌঁছত দুপুর বারোটায়। সেটি আবার চুঁচুড়া ছাড়ত বিকেল ৩-৩৮এ এবং হাওড়া পৌঁছত বিকেল ৫-১০ নাগাদ। তারপর হাওড়া থেকে বিকেল ৫-৩০টায় ছেড়ে সারারাত চুঁচুড়াতেই থেকে যেত।   

এভাবেই আমাদের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক ৯৩ বছর আগে, একই দিনে বাংলায় রেলগাড়ির যাত্রা শুরু হয়েছিল।

 

 

২. রেলপথের জাল বিছানো            

১৮৫৪ সালের ১৫ই আগস্ট রেলযাত্রার উদ্বোধনের মাত্র তিন বছরের মধ্যে – ১০ই মে ১৮৫৭ - শুরু হয়েছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই। উত্তর এবং মধ্যভারতের আচমকা এই সর্বাত্মক লড়াইয়ে বৃটিশ কোম্পানি যেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিল, তেমনই তাদের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল বিস্তর। অবশ্য দেড় বছরের মধ্যে, পয়লা নভেম্বর ১৮৫৮ সালে সর্বশক্তি দিয়ে এই লড়াইকে তারা দমন করতে সক্ষম হয়েছিল।

এই লড়াইয়ের শেষে ভারত থেকে কোম্পানি-রাজ মুছে গেল, শুরু হল ব্রিটিশ রাজ। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে নতুন আইন পাস হল – গভর্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট ১৮৫৮। সেই আইনে তারা সরাসরি ভারতের শাসনভার তুলে নিল নিজেদের হাতে। ইংল্যাণ্ডের তখনকার রানি ভিক্টোরিয়া বিবৃতি দিলেন, “তাঁর ভারতীয় প্রজারাও, একজন বৃটিশ নাগরিকের সমান মর্যাদার অধিকারী”। অবশ্য এই বিবৃতির সঙ্গে বৃটিশ সংবিধানের কোনই সাযুজ্য ছিল না এবং ১৯৪৭ পর্যন্ত বৃটিশ-রাজত্বে রানির বিবৃতিটিকে মিথ্যা প্রলাপ হিসাবেই গণ্য করা উচিৎ

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম লণ্ডনের বৃটিশ শাসকদের মোক্ষম একটা শিক্ষা দিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাঁধতে না পারলে, ব্যাপ্ত এই দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ হয়ে উঠবে। অতএব তারা পূর্ণ উদ্যমে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্মাণে লেগে পড়ল। এই রেলপথ প্রসারে বড়ো বাধা হয়ে উঠেছিল, ভারতের এবং বাংলার বড়ো বড়ো নদীগুলি। অতএব রেল যোগাযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে নদী-সেতু বানানোর ধুম পড়ে গেল। বাংলার রেলপথের সঙ্গে যেহেতু পূর্বভারতের প্রত্যক্ষ সংযোগ অতএব কয়েকটি প্রধান সেতুর কথা এখানে উল্লেখ করছি-

১) বিহারের আরার কাছে শোন নদীর সেতু – ১৮৬৩ সালে চালু হয়েছিল।

২) এলাহাবাদের কাছে যমুনার সেতু – ১৮৬৫ সালে।

৩) দিল্লিতে যমুনার সেতু – ১৮৬৬ সালে।

৪) গঙ্গার ওপর জুবিলি সেতু – ১৮৭৭ সালে – এটি ব্যাণ্ডেল ও নৈহাটি স্টেশনকে যুক্ত করেছে। এই সেতুর নাম জুবিলি, কারণ রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এই ব্রিজটিকে চালু করা হয়েছিল।

৫) অবশ্য বালী ব্রিজ বা উইলিংডন সেতু তৈরি হয়েছিল অনেক পরে – ১৯৩১ সালে।

 রেলপথ নির্মাণের এই ব্যাপক কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গে রেললাইনের মাপ নিয়ে দু চার কথা বলা প্রয়োজন। ব্রিটিশদের নিয়ম অনুযায়ী রেলট্র্যাকে সমান্তরাল দুটি রেললাইন বিছানো হতো তিনটি মাপে – এই তিনটি মাপকে গেজ (Gauge) বলা হয় – ব্রড গেজ, মিটার গেজ এবং ন্যারো গেজ।

ব্রডগেজ – এই মাপে দুটি রেললাইনের মধ্যে দূরত্ব হয় ১.৬৭৬ মি। ব্রডগেজের লাইনগুলিতে দ্রুতগতিতে ট্রেন চালানো অনেক সুবিধেজনক এবং নিরাপদ হয়। তাছাড়া কামরার আকার অনেকটাই বড়ো হওয়ার কারণে অনেকবেশি যাত্রী ও পণ্য বহন করতে পারে।

মিটারগেজ – এই মাপে দুটি রেললাইনের মধ্যে দূরত্ব হয় ১.০০ মি। লাইন ছোট হওয়াতে, খুব স্বাভাবিক কারণেই রেলপথ নির্মাণের এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচও অনেকটাই কম হয়। সেই কারণে এই লাইনগুলি কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় – কিংবা পাহাড়ি জায়গায়, যেখানে ঢালু পথে চলাচল করতে হয়, সেখানেই ব্যবহার করা হত। এই লাইনে ট্রেনের গতি ব্রডগেজের তুলনায় অনেকটাই কম রাখতে হ

ন্যারোগেজ – এই মাপে দুটি রেললাইনের মধ্যে দূরত্ব হয় মাত্র ০.৭৬২ মি। এই ট্রেনগুলি সাধারণতঃ প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক অঞ্চলে খোলা হত। অবশ্য দার্জিলিং ও সিমলার চড়াই-উতরাইয়ের যাত্রা পথে এই লাইন ব্যবহার করা হয়েছিল।

সে সময় ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকরা প্রধান রেলপথগুলি ব্রডগেজ, শাখা লাইনগুলি মিটারগেজ এবং প্রশাখা লাইনগুলি ন্যারোগেজ লাইন বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন এবং সেভাবেই রেললাইন পাতা চালু করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায়ের সময় ভারতে মোট রেলপথ ছিল ৫৪,৫৬৮ কিমি। তার মধ্যে ব্রডগেজ ছিল প্রায় ৪৬.১৪% এবং মিটারগেজ ছিল প্রায় ৪৪.২৮% - প্রায় সমান-সমান। আর ন্যারোগেজ ছিল ৯.৫৮%।    

স্বাধীনতার পর ভারতীয় রেল এই গেজ প্রথার আমূল পরিবর্তন শুরু করে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৬৮,৯০৭ কিমি রেলপথের প্রায় ৯৫.৬৭% লাইন ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়ে গিয়েছে। মিটার গেজ এবং ন্যারোগেজ লাইন অবশিষ্ট আছে যথাক্রমে মাত্র ২.৪৩% ও ১.৯০%।

ব্রিটিশ ভারতে রেলপথ বিছানোর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পণ্য ও প্রয়োজনে সৈন্য পরিবহন আর গৌণ উদ্দেশ্য ছিল যাত্রী পরিবহন। এই যাত্রী পরিবহনের আবার দুটি ভাগ ছিল – প্যাসেঞ্জার ট্রেন এবং মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন। প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলি স্বাভাবিক ভাবেই প্রতি স্টেশনে দাঁড়াত, গতি ছিল অনেকটাই শ্লথ, গয়ংগচ্ছ ভাব। মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেনগুলির কিন্তু তা নয় – তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্টেশনে দাঁড়াত, এবং গতি ছিল সেই সময়কার তুলনায় যথেষ্ট বেশি। কিন্তু এই ট্রেনগুলিও আসলে ব্রিটিশ সরকারের মেল (Mail) অর্থাৎ ডাক-বহনকারী গাড়ি ছিল। তার সঙ্গে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের থেকে তুলনায় বেশী ভাড়াযাত্রী নেওয়া হত ট্রেন চালানোর খরচ তোলার জন্যে। রাজধানী শহর কলকাতা (পরবর্তীকালে দিল্লি) থেকে বার্তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন শহরে চিঠিপত্র-নির্দেশ-রিপোর্ট-অভাব-অভিযোগের সংবাদ আদানপ্রদান, এবং দেশের নানান প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা অর্থ-মণি-রত্ন, সোনার অলঙ্কার রাজধানীর রাজকোষে বহন করাই ছিল এই মেলট্রেনগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য।                 

হাওড়া-হুগলি রেললাইনে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৫/০৮/১৮৫৪ – সে কথা আগেই বলেছি। এরপর ১৮৬৬ সালে প্রথম হাওড়া-দিল্লি মেলট্রেন চালু হয়েছিল – তার নাম ছিল ১ আপ/২ ডাউন মেল ট্রেন। পরে এই ট্রেনটিকেই কালকা মেল নাম দিয়ে হাওড়া থেকে কালকা পর্যন্ত চালানো হত।

হাওড়া থেকে প্রথম রেলযাত্রার ১৭বছর পর আজ ২০২সালে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের রেলপথের বিস্তার গোটা বিশ্বে এখন চতুর্থ স্থানে। অক্টোবর ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতীয় রেলপথের মোট দৈর্ঘ ৬৮,৯০৭ কিমি.। তারমধ্যে ৬০,৮১৩ কিমি বৈদ্যুতিকরণ সম্পন্ন হয়ে গেছে। অর্থাৎ “কু-ঝিক-ঝিক” করে চলা স্টিফেনসনের স্টিম-ইঞ্জিন উঠে গিয়ে,  আমাদের অধিকাংশ ট্রেন এখন চলে বিদ্যুতে এবং কিছু চলে ডিজেল ইঞ্জিনে। তার সঙ্গে বেড়েছে ট্রেনের গতি, সুখস্বাচ্ছন্দ্য, এবং ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ।

  ওপরের ম্যাপ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক রেললাইনের পরিস্থিতি সম্যক বোঝা যাবে।      

৩. দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ

রেলযাত্রা নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার চিরন্তন সমস্যার কথা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। দীর্ঘ সেই সমস্যা এবং তার সাবলীল সমাধানের কথাই এখন বলব।

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে জলপাইগুড়ি/শিলিগুড়ি পর্যন্ত সরাসরি রেলযোগাযোগ শুরু হয়েছিল পদ্মার উপর ১৯১৫ সালে হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের পর। সেতুটির অবস্থান আধুনিক বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ভেরামারা থেকে পাবনার ঈশ্বরদি অঞ্চলে। শেয়ালদা থেকে রাণাঘাট হয়ে কুষ্টিয়ার ট্রেন চালু হয়েছিল ১৯০২ সালে।

তার আগে শিয়ালদা থেকে লালাগোলা (১৯০৭ সালে এই ব্রডগেজ লাইন চালু হয়েছিল) যেতে হত। তারপর গঙ্গার পশ্চিমপাড়ের লালগোলাঘাট থেকে স্টিমারে পদ্মাপার হয়ে নামতে হত পূর্বপারের গোদাগারিঘাটে (এখন বাংলাদেশে)। তারপর ওপাড়ের মিটার গেজ লাইনের ট্রেন ধরে মালদা জংশন হয়ে জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়ি যেতে হত। অতএব সপরিবারে মালপত্র-লটবহর নিয়ে পায়ে হেঁটে নদীর চর ভেঙে স্টিমারে চাপা এবং ওপাড়ে গিয়ে একই ভাবে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেন অব্দি পৌঁছানো – ভয়ংকর কষ্টসাধ্য ছিল। বিশেষতঃ অসুস্থ এবং বয়স্কদের পক্ষে ছিল মারাত্মক। এর সঙ্গে ঋতু অনুযায়ী গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের কষ্ট থাকত উপরি পাওনা।    

হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের পর এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এই পথের অজস্র যাত্রী। কিন্তু এই সৌভাগ্য বেশি দিন সইল না। ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর হার্ডিঞ্জ সেতু রয়ে গেল পূর্বপাকিস্তানে। অতএব উত্তরবঙ্গ যাত্রা আবার দুরূহ হয়ে উঠল গঙ্গা-পার হওয়ার একইরকম যন্ত্রণায়।

মালদার আগে গঙ্গা পার হওয়ার দুটি পথ ছিল। একটি বিহারের সকরিগালঘাট থেকে স্টিমারে মনিহারিঘাট গিয়ে, সেখান থেকে কাটিহারের ট্রেন ধরা। এবং দ্বিতীয়টি হল – ধূলিয়ানে গঙ্গা পার হয়ে ওপাড়ের খেজুরিয়াঘাট থেকে মালদা যাওয়া। দ্বিতীয় পথটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু গঙ্গার ক্রমাগত ভাঙনে কিছুদিনের মধ্যেই ধুলিয়ানঘাট ব্যবহারযোগ্য রইল না। অতএব সেই পথ পরিত্যাগ করে অনেকটাই ঘুরপথ – সকরিগলিঘাট-মনিহারিঘাট হয়ে উঠল উত্তরবঙ্গ যাওয়ার একমাত্র পথ।

১৯৫৯ সালে বিহারে গঙ্গার দক্ষিণে মোকামা জংশন এবং গঙ্গার উত্তরে বারৌনি জংশনকে জুড়ে রাজেন্দ্রসেতু নির্মাণ হওয়াতে স্টিমার বা লঞ্চে গঙ্গা পার হওয়ার ঝামেলা মিটল। কিন্তু কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার দূরত্ব এবং সময় বেড়ে গেল অনেকটাই।

অতএব বিকল্প রাস্তা খোঁজা শুরু হল। ধূলিয়ানঘাটের অদূরে ফরাক্কা নামের একটি গ্রাম পাওয়া গেল, যেখান থেকে সহজে গঙ্গা পার হয়ে খেজুরিয়াঘাট যাওয়া সম্ভব। অতএব ভারতীয় রেল ফরাক্কা অব্দি নতুন রেললাইন পাতার কাজ শুরু করল, এবং খেজুরিয়াঘাট থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত মিটার গেজ লাইন বদলে ব্রডগেজ লাইন পেতে ফেলল ১৯৬০ সাল নাগাদ। কিন্তু এবার আর ছোট স্টিমার নয় গঙ্গা পার করার জন্যে এল বিশাল বিশাল বজরা ও স্টিমার। এগুলিকে বলা হত ওয়াগন ফেরি (Wagon ferry) এক একটি বজরায় ৯ জোড়া লাইন পাতা থাকত এবং প্রতি লাইনে দুটি করে কামরা সেট করা যেত। অর্থাৎ প্রতি বজরা একবারে ১৮টি কামরা নিয়ে নদী পার করতে পারত। এরকম ১০টি বজরা ছিল, অতএব প্রতিবারে ১৮০টি কামরা পারাপার করা সম্ভব ছিল। একদিনে সব থেকে বেশি ৪৫০টি কামরা পারাপার করার রেকর্ডও পাওয়া গেছে। এভাবেই চলছিল প্রায় ১১ বছর।

এরমধ্যেই ফরাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয় এবং তার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে। সেই সময়েই ঠিক হয় ফরাক্কা ব্যারেজের ওপরে রেলপথ এবং তার পাশাপাশি তৈরি হবে গাড়ি চলাচলের সড়ক পরিবহণ। ১৯৭১ সালের ১১ই নভেম্বর উভয় পথই চালু হয়ে গেল। দূর হল দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থার বহুদিনের সমস্যা।        

 

৪. ট্রেন ও আমাদের আবেগ

(ক) তুফান এক্সপ্রেস বা মেল – এই ট্রেনটি হাওড়া-শ্রীগঙ্গানগর রুটে চালু হয়েছিল পয়লা জুন, ১৯৩০। এই ট্রেনটি সেই সময়ে ভারতের দীর্ঘতম রেলপথ ছিল – ১২২৯ মাইল (১৯৭৮ কিমি)। এখনকার হিসেবে, মোট আটটি রাজ্যকে এই ট্রেনটি যুক্ত করেছিল - পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা। এই ট্রেনটির গতি এবং “তুফান” নামে ভারতবাসী এতই উদ্বেল হয়েছিল, যে বম্বের সিনেমা জগতে ১৯৩৪ সালে “তুফান মেল”-নামের একটি সিনেমা রিলিজ করেছিল। এর পর ১৯৪২ সালে আরেকটি সিনেমা “রিটার্ন অফ তুফান মেল” রিলিজ করেছিল। এই সিনেমা সম্বন্ধে আজ আর তেমন কিছু জানা যায় না। কিন্তু বাংলায় “শেষ উত্তর” ও তার হিন্দি ভার্সান “জওয়াব” সিনেমায় আমাদের বাংলার কাননদেবীর কণ্ঠের “তুফান মেল” গানদুটি – আমাদের ছোটবেলাতেও আমাদের গুরুজনদের বহুবার গুনগুন করতে শুনেছি। আজও ইউটিউবে গানদুটি শুনলে তুফানমেল সম্পর্কে জনগণের সমসাময়িক মুগ্ধতার আঁচ পাওয়া যায়।

বাংলা গানের প্রথম পর্বটি এরকম - “তুফান মেল, তুফান মেল যায়। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, ময়নামতীর হাট এড়িয়ে, কাশের বনে ঢেউ খেলিয়ে বংশীবটের ছায়, যায় যায় যায় তুফান মেল...”।  

https://www.youtube.com/watch?v=VQD6Md1BbOM

হিন্দিতে গানের প্রথম স্তবকটি এরকম - “তুফান মেল, দুনিয়া ইয়ে দুনিয়া তুফান মেল। ইসকে পাহিয়ে জোর সে চলতে, অওর আপনা রাস্তা তয় করতে, সয়ানেসে কাম নিকালে, বচ্চে সমঝে খেল। তুফান মেল…”।

https://www.youtube.com/watch?v=kNZS86YYP0g

স্বাধীনতার পরে তুফান মেলের তুলনায় বহুগুণ গতিসম্পন্ন এবং দীর্ঘতর রেলপথে বহু ট্রেন দৌড়ে চলেছে প্রত্যেকদিন – কিন্তু জনমানসে তুফান মেলের মতো এমন বিস্ময়ের আবেগ কেউ জাগাতে পারেনি।

স্বাধীনতার পর এই ট্রেনটির নাম হয়েছিল উদ্যান আভা তুফান এক্সপ্রেস ১৯শে মে ২০২০ সালে এই ট্রেনটি ভারতীয় রেল থেকে তুলে নেওয়া হয়। তুফানের গতি আজ স্তব্ধ।

 

(খ) বাল্যকাল ও রেলগাড়ি

আমাদের ছোটবেলায় মাঝেমধ্যে বর্ধমান জেলার পালসিটে মাসির বাড়ি বেড়াতে যেতাম। পালসিট স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে মাসির বাড়ির চিলেকোঠার জানালা দিয়ে মাঠের ধার দিয়ে রেলগাড়ি যাওয়া দেখতে পেতাম। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের ক্ষেত। সকালের উজ্জ্বল রোদ্দুরে ঝলমলে নীল আকাশ। তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। সে দৃশ্য আজও মনে পড়লে মনটা বড়ো উদাস হয়ে যায়। তবে আমাদের সময় অধিকাংশই ছিল ধোঁয়াহীন ইএমইউ লোকালট্রেন। কিছুকিছু ছিল সামান্য ধোঁয়া ওঠা ডিজেল চালিত দূরপাল্লার ট্রেন।

একটু বড়ো হয়ে জলপাইগুড়িতে প্রায় চারবছর হস্টেলে থাকতে হয়েছিল। আমাদের হস্টেলের পাশেই ছিল নিবিড়-সবুজ বিস্তীর্ণ চা-বাগান। বাগানের ও পাশ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। রাত জেগে সেমেস্টারের পড়া করার সময় মাঝরাতে আমাদের কানে আসত ওই লাইন দিয়ে দৌড়ে চলা তিনসুকিয়া মেলের আওয়াজ। সে আওয়াজে মনটা বড়ো ঘরমুখো হয়ে উঠত। দৌড়ে গিয়ে বারান্দা থেকে দেখতাম সে ট্রেনের আলোকোজ্জ্বল জানালাগুলির দ্রুত সরে সরে যাওয়া। সে দৃশ্য, সে আওয়াজ দূরে চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে এসে আবার বই খুলে বসতাম, কিন্তু মন বসত না, মন তখনও দৌড়ে চলত ওই ট্রেনটির সঙ্গে।        

এ প্রসঙ্গে “পথের পাঁচালি” সিনেমায় কাশবনের ভিতর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে দিদি দুর্গা এবং ভাই অপুর রেলগাড়ি দেখার দৃশ্য অবিস্মরণীয় হয়ে গিয়েছে। বাঙালীর মনে ওই দৃশ্য চিরস্থায়ী আসনে বিরাজ করবে চিরকাল।

 

(গ) রেলগাড়ি-রেলগাড়ি খেলা

আমরা কলকাতার যে সরকারি স্কুলটিতে পড়তাম, সে স্কুলের নিজস্ব কোন মাঠ ছিল না। খেলাধুলো করতে আমাদের যেতে হতো কলেজ স্ট্রিট (এখন বিধান সরণি) পার হয়ে উল্টোদিকে অন্য একটি সরকারি স্কুলে। সে স্কুলে দৌড়ে বেড়ানোর মতো বেশ প্রশস্ত একটি মাঠ ছিল।

সকাল সাড়ে আটটা – নটা নাগাদ আমাদের ক্লাসের তিরিশ জন সারিবদ্ধ বাচ্চাকে নিয়ে দিদিমণিরা রাস্তা পার করতেন। পিঁপড়ের মতো পিছুপিছু সার দিয়ে যেতে যেতে আমাদের মাথায় আসত “রেলগাড়ি-রেলগাড়ি” খেলা। সকলেই সামনের বন্ধুর দুকাঁধে হাত রেখে টুকুরটুকুর দৌড়তাম আর মুখে আওয়াজ করতাম ঝিক-ঝিক – মাঝে মাঝে ডেকে উঠতাম “কু-উ-উ-উ”।  উত্তর আর দক্ষিণ - দু’দিকে দাঁড়িয়ে যেত ট্রাম, বাস, মটর গাড়ি, রিকশ, সাইকেল। ট্রাম-বাসের ড্রাইভার-যাত্রীরা জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে আমাদের দেখতেন। তাঁদের কোনদিন বিরক্তি বা উষ্মা প্রকাশ করতে দেখিনি – বোধহয়, মজাই পেতেন, হয়তো তাঁদেরও ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যেত।

বড়ো হয়ে টিভিতে এই খেলাটি একটি গানের ভিডিওতে দেখেছিলাম। নিজের গলায় “রেলগাড়ি, ছুকছুক-ছুকছুক” গান গেয়ে, বাচ্চাদের একটি “রেলগাড়ি” খেলা পরিচালনা করেছিলেন স্বয়ং দাদামণি অশোককুমার। ১৯৬৮ সালের আশীর্বাদ সিনেমার গান – ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন। গানটির রচয়িতা শ্রী হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (ফেলুদার “সিধুজ্যাঠা” এবং শ্রীমতী পদ্মজা নাইডুর ভাই) - ছোটবেলাটা ফিরিয়ে এনেছিলেন এক লহমায়। 

https://www.youtube.com/watch?v=qn_v5PyhQJE

দাদামণি এই গানটির তাৎপর্যপূর্ণ একটি বড়োদের ভার্সান শুনিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের এক অনুষ্ঠানে – সেটিও হারীনবাবুর লেখা। সে গানটিও ইউটিউবে শুনে নিতে পারেন।


(ঘ) রেলযাত্রা ও রেলযাত্রী

ব্রিটিশ-রেল যুগে, মোটামুটি ১৮৭১ সাল নাগাদ, দূর-পাল্লার ট্রেনে চারটি শ্রেণী থাকত। প্রথম শ্রেণী ছিল প্রধানত উচ্চপদস্থ শ্বেতবর্ণ মানুষদের জন্য। দু’একজন উচ্চ পদস্থ কৃষ্ণবর্ণ মানুষকেও অবশ্য অনুমতি দেওয়া হত, যেমন পেয়েছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই প্রথম শ্রেণীতে রেলযাত্রা নিয়ে একটি মজার গল্প শোনা যায়।

একবার মধুপুর থেকে কলকাতা ফেরার সময়, স্যার আশুতোষ রেলের প্রথম শ্রেণীতে উঠেছিলেন। তাঁর কামরায় ছিল জনৈক ইংরেজ সায়েব একই কামরায় নেটিভ মানুষটিকে তার মোটেই সহ্য হচ্ছিল না। স্যার আশুতোষ অবশ্য সায়েবকে গ্রাহ্য না করে, নিজের নির্দিষ্ট বার্থে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙতে তিনি কামরার মধ্যে তাঁর জুতো জোড়া খুঁজে পেলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন, এ ওই সায়েবের কীর্তি। তাঁর ঘুমের মধ্যে ব্যাটা তাঁর জুতোজোড়া বাইরে ফেলে দিয়েছে। সে সময় সায়েবও তার নিজের বার্থে ঘুমোচ্ছিল, কামরার হুকে ঝুলছিল সায়েবের কোট। স্যার আশুতোষ হুক থেকে কোটটি তুলে নিয়ে, চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন

কিছুক্ষণ পর সায়েব ঘুম ভেঙে উঠে নিজের কোট দেখতে না পেয়ে খুব রেগে গেল, জিজ্ঞাসা করল, “আমার কোট কোথায়?” স্যার আশুতোষ খুব শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই তো, আমার জুতোজোড়াও যে খুঁজে পাচ্ছি না”। সায়েব উদ্ধতভাবে উত্তর দিল, “তোমার জুতোজোড়া গেছে বাইরে হাওয়া খেতে”। স্যার আশুতোষ আরও শান্ত ও নিশ্চিন্ত সুরে বললেন, “তাহলে তো ঠিকই আছে, সায়েব। তোমার কোট গিয়েছে, আমার জুতোজোড়া খুঁজতে”! একজন নেটিভের থেকে এমন শান্ত উত্তর শুনে, কোটের শোক ভুলে, সায়েব নাকি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

 দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল মধ্যবিত্ত শ্বেতবর্ণ এবং উচ্চবিত্ত কৃষ্ণবর্ণ মানুষদের জন্যে। তবে এই শ্রেণীতেও সায়েব- নেটিভের দ্বন্দ্বের কথা বাংলা সাহিত্যে বিরল নয়।

তৃতীয় শ্রেণী ছিল মধ্যবিত্ত নেটিভদের জন্যে। কামরায় কাঠের বেঞ্চ সেট করা থাকত। প্রথম দিকে কামরাতে কোন টয়লেট থাকত না। দীর্ঘ অনুরোধ, আন্দোলন, কর্তৃপক্ষের কাছে লেখালেখির পর ১৮৯১ সাল থেকে কামরায় শৌচাগারের ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল।

তীর্থযাত্রা, পশ্চিমের বিশুদ্ধ জল ও বায়ুতে স্বাস্থ্যোদ্ধার কিংবা চাকরিসূত্রে প্রবাসযাত্রার জন্যে মধ্যবিত্তদের কাছে এই তৃতীয় শ্রেণীর রেলযাত্রা যথেষ্ট আদরণীয় ছিল। তবে তার সাজসরঞ্জাম ও যোগাড়যন্ত্রর কথা শুনলে, এ যুগের রেলযাত্রীরা আঁতকে উঠতে পারে

কর্তা-গিন্নি ও তাঁদের নানানবয়সী চার-পাঁচটি সন্তান। কর্তার একজন ভাই অথবা শ্যালক ও একজন বিধবা ভগিনী অথবা কুমারী শ্যালিকা। একজন ভৃত্য ও একটি কাজের মেয়ে। এই নিয়ে তখনকার দিনে একটি মাঝারি পরিবার হত। অতএব অন্ততঃ তিন-চারটে লোহার ট্রাঙ্ক (তখনকার দিনে পোর্টমান্টো বা Portmanteau বলত) ভরা জামাকাপড়। শতরঞ্চিতে জড়ানো তিন চারটি বেডিং – বিছানার চাদর, বালিশ, বাড়তি কিছু শতরঞ্চিসহ। বড়ো বড়ো বেতের ধামায় শিল-নোড়া, হামানদিস্তা, নানান মশলা, বড়ি, আচারের বয়াম ইত্যাদি। কিছু ভালো চাল, আমসত্ত্ব, ঘিয়ের শিশি। গিন্নিমার হাতের কাছে থাকত ছোট ঝুড়িতে পানের সরঞ্জাম, যাত্রাপথে খাবার জন্যে লুচি, পরোটা, তরকারি, মুড়ি, চিঁড়ে, গুড়। কুঁজোয় খাবার জল। সে জল ফুরিয়ে গেলে স্টেশনে স্টেশনে নেমে কুঁজো ভরে জল আনা ছিল অবশ্য কর্তব্য। এছাড়াও থাকত কাজের লোকেদের নিজস্ব পুঁটলি, তার মধ্যে জামাকাপড় ছাড়াও থাকত চিরুনি, মাথার তেল, দোক্তা, গুড়াখু ইত্যাদি। ও বলতে ভুলেছি, কর্তার হুঁকো-কলকে, তামাক-টিকের দায়িত্ব থাকত ভৃত্যের হাতে। ঠিক ঠিক সময়ে কর্তার হাতে সাজা-হুঁকো তুলে দিতে না পারলে কুরুক্ষেত্র বেধে যাওয়ার উপক্রম হত।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, সে সময় তীর্থযাত্রা এবং বায়ুপরিবর্তন উপলক্ষে অন্তুতঃ মাসতিনেক প্রবাসে থাকতে হত। আর চাকরিসূত্রে অন্ততঃ ছ’মাস। কারণ, দেশে অর্থাৎ নিজের গ্রামে ঘুরে যাওয়ার জন্যে, “মুখপোড়া” সায়েব-কর্তা কবে ছুটি মঞ্জুর করবে, তার ঠিক কি? অতএব বিদেশ-বিভূঁইয়ে কোথায় কী পাওয়া যাবে, কি যাবে না, সেই দূরদর্শীতা থেকেই রেলযাত্রার এই বিপুল আয়োজন করতে হত।   

পরবর্তী কালে শতরঞ্চি বাঁধা বেডিংয়ের পরিবর্তে এল মোটা ক্যম্বিস কাপড়ের তৈরি – বেল্টবাঁধা হোল্ড-অল (Hold-All) এবং সুটকেশ। আমার ছোটবেলায় আমার পিতৃদেবকে কর্মসূত্রে দিন সাত-দশের জন্যে প্রায়ই বাইরে যেতে হত। ছোটবেলায় বাবার হোল্ড-অল গোছানো শিখেছিলাম মন দিয়ে। সে শিক্ষা এবং পৈতৃক হোল্ড-অলটি আমার জীবনে একবারই কাজে লেগেছিল, জলপাইগুড়ির হস্টেলে প্রথমবার যাওয়ার সময়।

চতুর্থ শ্রেণী ছিল নিম্নবিত্ত এবং মজদুর মানুষদের জন্যে। এই কামরাগুলিতে শোয়া-বসার কোন ব্যবস্থা থাকত না। লোহার মেঝেতেই গাদাগাদি করে শুয়ে বা বসে যাত্রা করতে হতে। এক্ষেত্রেও দীর্ঘ আন্দোলনের পর, বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয় ১৮৮৫ সাল থেকে।

আধুনিক দূর পাল্লার ট্রেনে মোট পাঁচটি শ্রেণিতে যাত্রা করা যায়, 1AC, 2AC, 3AC, Second class Sleeper, General (unreserved)। কিছু কিছু ট্রেন Chair car হয়তাতে AC বা NonAC কামরায় চেয়ারে বসে যাত্রা করতে হয়। অবশ্য এই ট্রেনগুলির দূরত্ব সীমা আট-দশ ঘন্টার মধ্যেই সীমিত রাখা হয়।

 

(ঙ) ছড়া ও চাকার ছন্দে রেলগাড়ি

ছোটবেলায় এই ছড়াটি আমরা সকলেই পড়েছি, শুনেছি, আধোআধো উচ্চারণে আবৃত্তি করে, ঘনিষ্ঠ পরিজনের আদর ও হাততালি কুড়িয়েছি,  

“আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি

যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি।

রেলকাম ঝমাঝম            

পা পিছলে আলুর দম”।

কিছুটা “ননসেন্স” প্রকৃতির হলেও, ছড়ার বক্তব্য মনে হয়, যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি যাবেন বলে তাড়াতাড়ি রেলগাড়ি ধরতে চললেন। সঙ্গে ছিলাম আমি (I) এবং ভাই। ঝমঝম শব্দে রেলগাড়ি এল, কিন্তু মাস্টারমশাই তাড়াহুড়োতে পা পিছলে পড়লেন, পায়ের গোছ ফুলে আলু হয়ে উঠল। তখনকার দিনে, প্ল্যাটফর্ম থেকে লোহার সিঁড়ি বেয়ে কামরায় উঠতে হত। পা পিছলে যাওয়া তেমন আশ্চর্যের নয়।

আরও শুনেছি দ্রুতগামী ট্রেনের চাকার শব্দছন্দে নানান বক্তব্য। যেমন আমার ঠাকুমা বলতেন, তিনি নাকি চাকার আওয়াজে, “দিদি কোথা, দাদা কোথা” শুনতে পেতেন। এক সহযাত্রী বৈষ্ণব ভক্তের মুখে শুনেছিলাম, ঈশ্বর সন্ধানের ব্যাকুলতা, “কালা কোথা রাধা কোথা”! শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কোন এক উপন্যাসে পড়েছিলাম, এই চাকার চলার ছন্দে নায়ক শুনেছিল “দিন কাল ভাল নয়” ।         

 

৫. স্টিম ইঞ্জিনের বিস্ময়

আধুনিক টেকনোলজিতে ইঞ্জিন যতই শক্তিশালী এবং সুষমসুন্দর হোক এবং স্টিম-ইঞ্জিন যতই ব্রাত্য হয়ে যাক, স্টিম ইঞ্জিনের প্রাথমিক বিস্ময় মন থেকে বোধহয় কখনও মুছে যাবে না। আমার স্টিমইঞ্জিন-টানা ট্রেনে চড়ার বাল্যের একটিমাত্র স্মৃতিই সম্বল। খুব সংক্ষেপে সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলাম আমার “বিনিসুতোর মালা” গ্রন্থে। সে কথা আরেকবার বলি –

মহাষষ্ঠীর সকালে হাওড়া থেকে বাজারসাউ প্যাসেঞ্জার ছাড়ল। এই ট্রেন আমাদের কালনা পৌঁছে দেবে ঘন্টা চারেকের মধ্যে। বাবার কাছে জানলাম এই ট্রেন ব্যান্ডেল পর্যন্ত দু একটা স্টেশানে দাঁড়াবে। ব্যান্ডেলে ইঞ্জিন বদল হবে। এখন টানছে ডিজেলের ইঞ্জিন, ব্যান্ডেলের পর টানবে কয়লার স্টিম ইঞ্জিন।

এর আগেও বেশ কয়েকবার ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু সেটা ছিল ইলেক্ট্রিক ট্রেনের। ডিজেলের গাড়ি ধ্বক ধ্বক শব্দ করে, দুদ্দাড় দৌড়ে পার হয়ে যেতে লাগল একটার পর একটা ষ্টেশন। বাপরে তার কি শক্তি। এর তুলনায় ইলেক্ট্রিক ট্রেন অনেক শান্ত আর নিরীহ। কিন্তু ব্যাণ্ডেলে স্টিমইঞ্জিন লাগিয়ে ট্রেন যখন যাত্রা শুরু করল, সে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা।

ইঞ্জিন বদলের জন্যে অনেকটা সময় লাগত, তাই বাবা আমাদের নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামলেন, স্টিম ইঞ্জিন কেমন হয় দেখানোর জন্যে। ট্রেনের সামনে থেকে চার পাঁচজন রেলকর্মী খুলে দিলেন ডিজেল ইঞ্জিনের বাঁধন, সে ইঞ্জিন মুক্তির আনন্দে ভোঁ শব্দ করে বেরিয়ে গেল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর কু-উ-উ-উ-উ বাঁশি বাজিয়ে পিছন করে আসতে লাগল স্টিম ইঞ্জিন। মাথার ওপরে তার কালো ধোঁয়া, আর নীচের দিকে ভস ভস করে সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে। আস্তে আস্তে এসে, সে ধড়াম করে ধাক্কা লাগাল ট্রেনের গায়ে, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল। রেলকর্মীরা ট্রেনের সঙ্গে বেঁধে ফেললেন এই ইঞ্জিনকে। যতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল, তীব্র শব্দে সে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল, রাগী মোষের মতো। লোহার বাঁধন শক্ত হতেই, স্টিম ইঞ্জিন বাঁজিয়ে দিল বাঁশি, কু-উ-উ-উ-উ। মাথার ওপরে কালো ধোঁয়ার রাশি ছাড়তে লাগল ভক ভক করে, আর লম্বা লম্বা শ্বাস নেওয়ার মতো ভস ভস করে স্টিম ছাড়তে লাগল ইঞ্জিন। বাবার হাত ধরে আমরা দৌড়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। আমরা উঠতেই ট্রেন গড়াতে লাগল মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন- ‘এত দেরি করলে কেন? যদি ট্রেন ছেড়ে দিত’?...

...অতি উৎসাহে জানালার বাইরে মুখ বাড়াচ্ছিলাম, বাবা মানা করলেন। বললেন, ইঞ্জিনের ধোঁয়ায় কয়লার গুঁড়ো থাকে প্রায়ই, চোখে ঢুকে গেলে ভীষণ কষ্টকর জানালা দিয়ে শরতের প্রকৃতি দেখতে দেখতে মনে হল। ইলেকট্রিক ট্রেন বড্ড কাজের, রসকষহীন কাঠখোট্টা। সকালের যে ডিজেল ট্রেনে এলাম সেটার গায়ে বড্ড জোর, ভয় করে, মনে হয় সামনে কিছু পড়লে ঢুঁ মেরে ঠেলে ফেলে দেবে খ্যাপা হাতির মতো। কিন্তু এই স্টিমের ট্রেন খুব মজার। তেমন তাড়াহুড়ো নেই। একটা স্টেশনে দাঁড়ালে যেন নড়তেই চায় না। ভাবখানা আমার মতো, বেড়াতেই তো যাচ্ছি ভাই, এত তাড়া কিসের? দুপাশে সবকিছু দেখে শুনে, লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত না করে দিব্বি শান্ত, শিষ্ট। স্টেশনে লোকজন উঠছে, নামছে। পান বানিয়ে আনছে দোকান থেকে। কেউ কল টিপে জল খেয়ে আসছে। এই ট্রেনও খুব জল খায়। একটু বড়ো স্টেশনে লাইনের ধারে লম্বা গলা জিরাফের মতো পাইপ ঘুরিয়ে ট্রেনের পেটে ভরে দিচ্ছে জল। বাপরে সে কি জল খাওয়া। জল-টল খাওয়া হলে মিষ্টি করে ডাক দিল- কু-উ-উ-উ। যেন বলতে চায়, এবারে উঠে পড় হে, আর কি, গন্তব্যে পৌঁছতে হবে না?”...

এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে বড়ো হয়ে “শোলে” সিনেমার স্টিমইঞ্জিনের দৃশ্যের যেমন অনেক মিল ছিল, তেমনি অমিলও ছিল বিস্তর। সেখানে বেলচা দিয়ে ফারনেসে কয়লা ঢালছিলেন “বীরু” অর্থাৎ ঝকঝকে সুস্বাস্থ্যবান নায়ক ধর্মেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবে আমি দেখেছিলাম, ফারনেস ও বয়লারের তীব্র গরমে বেলচাওয়ালা শ্রমিকের সারা গা-মুখ ঘামে ও কয়লার ধুলোকালিতে জবজব করছে। ফারনেস ও বয়লারের তীব্র উত্তাপে তাঁর মুখমণ্ডল বিবর্ণ। পরনে অত্যন্ত মলিন বেঢপ জামা-প্যান্ট, মাথায় কালোরঙের একটা টুপি। ইঞ্জিন ড্রাইভার যিনি ছিলেন, যিনি সিনেমার বীরুর মতোই দড়ির লিভার টেনে বাঁশি বাজিয়ে ট্রেনের যাত্রা শুরু করলেন, তাঁর দশাও গরমে, ঘামে, ধুলোময়লাতে একই রকম।

যদিও শোলে সিনেমার সেই স্টিম-ইঞ্জিন-দৃশ্য ছিল স্বপ্নের মতো সাজানো, কিন্তু বাস্তবে ওই ইঞ্জিন-যন্ত্রের সঙ্গে সেই কালে ছিল মানুষের সহ্যশক্তি ও পরিশ্রমের অটুট সমন্বয়। তুলনায় ডিজেল বা ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন চালানো অনেক সহজ হয়েছে – কিন্তু ট্রেনের দ্রুত গতির সঙ্গে বেড়েছে দুশ্চিন্তা আর মানসিক উদ্বেগ।


 --০০--     

 

   তথ্য ঋণঃ

১.  A History of Indian Railways – Mr. G S Khosla, Ministry Of Railway (Rail Board), Government of India. Published in 1988.  

২. কলিকাতা দর্পণ (প্রথম পর্ব) – শ্রীযুক্ত রাধারমণ মিত্র  

 

  

   


শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব ৩

 

 

পোস্টমর্টেম, পুলিশ এবং তার যাবতীয় নিয়ম কানুন সব সামলেছিল মহাজন সাঁপুই। হলধর পোল্লের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম থেকে শ্রাদ্ধশান্তি পর্যন্ত সবকিছুরই দায় সামলে দিয়েছিল মহাজন সাঁপুইবার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অফিসে মালতীর জন্যে একটা কাজ দেবে আর তার মেয়ের স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সমস্ত ব্যয় সে বহন করবে। তাছাড়াও নগদ দুলাখ টাকা দেবে তাদের ভবিষ্যতের সুরাহার জন্যে।

জাগতিক নিয়মে সব শোক সন্তাপই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থিতিয়ে আসে। তাৎক্ষণিক আর্দ্র আবেগ ও মেঘমেদুর সহানুভূতি, বাস্তবের রৌদ্রে শুকিয়ে আসে যত দিন যায়।  মহাজন সাঁপুইয়ের অফিসে কাজের জন্যে ঘুরতে ঘুরতে মালতী হতাশ হতে থাকল দিনকে দিন। আজ নয় কাল। কাল নয় পরশু। এ হপ্তা নয় সামনের হপ্তা। এ মাস নয় পরের মাস। স্কুলের ফিস বাবদ টাকাটা অবিশ্যি দিয়ে দিত ওদের অফিস থেকে। প্রায় সাত আট মাস এভাবে চলার পর একদিন মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে মালতীকে ডেকে একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেইসঙ্গে খুবই স্পষ্ট ভাষায় তারা বলে দিয়েছিল, আর নয়, এই শেষ। মালতী তাও একবার দেখা করতে চেয়েছিল মহাজন সাঁপুইয়ের সঙ্গে, বেশ ঝাঁঝালো উত্তর পেয়েছিল, “ওঁনার কি কাজ-কাম নাই নাকি? বসে বসে তোমার নাকে কান্না শুনলেই ওঁনার দিন চলবে? ফালতু নোকের ব্যাজব্যাজানি শুনার টাইম নেই ওঁনারতুমি এখন আসো তোযা পেয়েচো যতেস্ট – আর কত দোয়ানি করবে বলো দিকি? এদিকে আর আসবে নি কোনোদিন, এ বাবদে কোন লাভ হবে নি আর – এই বলে দিলোম”

 

ভিতরে ভিতরে ভয়ংকর একটা লড়াই চলছিলই, কিন্তু তার ওপরে ছিল একটা আশার প্রলেপ। একটা চাকরি, যেমন তেমন হলেও মাস গেলে কিছু টাকার নিয়মিত সংস্থান। মেয়েটার লেখাপড়াটা তো চালুই থাকল। আর দুলাখ পাওয়া গেলে, ব্যাংকে জমা করে দেবে, সুদে আসলে ওর বিয়ের সুরাহাটাও হয়ে যাবে। কতদিন আরএই তো, এই বোশেখ মাসেই মেয়ে এগারো পার হয়ে বারোয় পা দেবেতার মানে বড় জোর আর বছর সাত কি আটব্যস, মেয়েটার একটা ভালো ঘরে আর মনোমত বরে চারহাত এক করে দিতে পারলেই - মালতী ঝাড়া হাত পা। নিজেরটা বুঝে দেখবে তখন যা হোক।

এই আশার প্রলেপটাও সেদিন মুছে গিয়েছিল মালতীর জীবন থেকে। যেভাবে মালতীর জীবন থেকে মুছে গিয়েছিল সুখ, আহ্লাদ আর স্বপ্ন। সুলক্ষণা এয়োতির সমস্ত ভূষণ। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তার শাড়ির পাড়ের রংমালতীর বাবা চলে গেছেন কয়েক বছর হলো। মা আছেন, কিন্তু তিনিও একান্তই অসহায়, তার দুই ভাইয়ের জ্বলন্ত সংসারে। উপরন্তু, তার দুই ভাইয়ের কেউই এতটাও স্বচ্ছল নয়, আর্থিক বা মানসিক কোন দিক দিয়েই, যে বিধবা বোন এবং তার মেয়ের বাড়তি বোঝার দায় বহন করবে। কাজেই মালতীর সামনে ধূ ধূ ঊষরতা ছাড়া, কিছুই অবশিষ্ট রইল না ঘাড়ের ওপর লড়াইটা এসেই পড়ল, ধারাল নখ দাঁত শানিয়ে - হিংস্র পশুর মতো।

 

মহাজন সাঁপুইয়ের অফিস থেকে ফিরে, ঘরে দোর দিয়ে মালতী হিসেব নিয়ে বসল। ট্রাংক থেকে বের করল তার আর হলধর পোল্লের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের পাস বই। জমা টাকার অংক ছ হাজার তিনশ বত্রিশ। শাড়ির ভাঁজে রাখা নগদ আটশো পঞ্চাশ টাকা। আর তার ব্লাউজে বুকের মধ্যে ছোট্ট পার্সে রাখা আটষট্টি টাকা – নোট আর খুচরো পয়সা মিলিয়ে। এই তার জমা। আর খরচের মধ্যে আছে বাড়ি ভাড়া, মেয়ের স্কুলের ফিস, খাতা-বই, খাওয়া দাওয়া, তেলটা, সাবানটা, রোগ-বিপদ, দায়-ঝক্কি ...শেষ নেই যেন – খরচ, খরচ আর খরচআর এই খরচের কোনটাই এককালীন নয় – মাসে মাসে আসবে – আসবে বছরের পর বছর – এ খরচ কখনও কমবে তো না বরং বেড়েই চলবে।

এত হিসেবপত্র কোনদিন তাকে করতে হয়নি, একে তো সে চাষী ঘরের মেয়ে তার ওপর, বিয়ের পর হলধর পোল্লেও এসব ব্যাপারে তার গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি কোনদিন। কিন্তু মালতী এতটুকুও দিশাহারা হল না নির্দিষ্ট লক্ষ্য তার ছিলই, মেয়েকে বড়ো করা আর তার বিয়ে দেওয়া। তার জন্যে এখন দরকার নিয়মিত উপার্জন আর সম্ভব হলে কিছু সঞ্চয়, ভবিষ্যতের জন্যে। খোলা ট্রাংকের সামনে স্থির হয়ে সে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর সবকিছু গুছিয়ে রেখে ট্রাংক বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, বসে বসে হা হুতাশ করে কপাল চাপড়ানোর সময় আর নেই। চোয়াল শক্ত করে লড়ার দিন এসে গেছে এবং জীবনের এই যুদ্ধ তাকে জিততে হবেই।

...পরের পর্ব আসবে সামনের শনিবার।       

নতুন পোস্টগুলি

উকুন

  ১ ধুলি পাঁচ নম্বর উকুনটা মেরে, ছ নম্বরটাকে চুলের গোড়া থেকে তুলে আনল। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখে রেখে, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে চেপে ...