মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পাখির চোখ

 

 

উত্তর কলকাতার এই পাড়াতে সব বাড়িই একশ-দেড়শ বছরের পুরোনোঅধিকাংশ বাড়িগুলোরই ওপরতলায় বাড়িওয়ালা নিজে থাকেন। নিচের ঘরগুলোতে ভাড়াটে। ভাড়াটেরা অর্থ কৌলীন্য অনুযায়ী একঘর, দুঘর নিয়ে ভাড়া থাকে। এজমালির পাইখানা, চানের ঘর। বারন্দায় তোলা উনুনে রান্না। টাইম কলে দিনে তিনবার জল আসে। সেসময় জলের ভাগ নিয়ে ভাড়াটেদের মধ্যে নিত্য আকচাআকচি। ভাড়াটে মানেই যেন চালচুলোহীন, গাঁঞি-গোত্রহীন কিছু মানুষ। এদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিৎ নয়, মাসের শুরুতে ভাড়ার টাকাটা হাতে এলে সংসারের কিছুটা সুসার হয় বলেই, বাধ্য হয়ে ভাড়াটে বসানো। বনেদি উত্তর কলকাতার বাড়িওয়ালাদের মুখের উচ্চারণেও এই তাচ্ছিল্য ভাবটা বেশ বোঝা যায়, “ভাড়াট্যে”। তাঁদের এই কথাতেই বোঝা যায় এক পাড়া এবং এক বাড়িতে থাকলেও ভাড়াটে আর বাড়িওয়ালার সামাজিক অবস্থানে আসমান –জমিন ফারাক!         

“ভাড়াট্যে” বসা এই বাড়িগুলির নিয়মিত মেরামতি হয় বলে অবস্থা কিছুটা ভালই। কিছু বাড়ি আছে যাদের বহুদিন মেরামতি হয় না, হানাবাড়ির দশা, সেই বাড়িগুলি মেস। গ্রাম –মফস্বল থেকে আসা মেসের বোর্ডাররা এই বাড়িগুলিতে থাকে। শনি-রবিবার অথবা ছুটির দিনগুলিতে ফাঁকা থাকলেও, সপ্তাহের অন্যদিনগুলিতে মেস বাড়িগুলোতে বেশ চেঁচামেচি আর হৈচৈ শোনা যায়। মেসের ছোকরা চাকর, তাদের নাম কার্তিক, অথবা শ্যামল, কিংবা ভোলা বা পচাসন্ধেবেলা অফিস ফেরা বাবুদের বারবার হাঁক শোনা যায়। “অ্যাই, ভোলা আমার ঘরে দুটো চা দিয়ে যা”“কেতো, তোকে যে বললাম, ধনেরচাল দেওয়া দুটো পান আনতে”! “অ্যাই হারামজাদা শ্যামলা, এক প্যাকেট কাঁচি আনতে কতবার বললাম, কথা কানে যাচ্ছে না, নাকি?” তাদের উচ্চস্বরের উওরও শোনা যায়, “এই যাচ্ছি, বাবু”।

 অচ্যুত যে বাড়ির একতলায়, বাসা নিয়েছে, সেটার ওপর তলাতেও ভাড়াটেই থাকে - বাড়িওয়ালা নয়। বাড়িওয়ালা থাকে এখান থেকে সামান্য দূরে অন্য বাড়িতে। বাড়িওয়ালা নিজে ডাক্তার, বেশ বড়োলোক, নিজের গাড়ি আছে! বাড়িতে ফোন আছে! তিনি কেন ভাড়াটেদের সঙ্গে থাকতে যাবেন? একবাড়িতে দুটো মাত্র ভাড়াটে পরিবার, সেদিক থেকে ঝুট-ঝামেলা বেশ কম। যদিও উপরের ভাড়াটেরা বাঙাল! খাইসে বলে, ইসে বলে। এ পাড়ায় ভাড়াটেদের মধ্যে আরো কয়েকটি বাঙাল পরিবার আছে। পাড়ায় সকলের সঙ্গে সকলের মেলামেশা, আলাপ-পরিচয় আছে, কিন্তু তার মধ্যেও আছে অদ্ভূত কিছু গণ্ডি! ভাড়া না দেওয়া স্বচ্ছল ঘটি বাড়িওয়ালা এবং ভাড়া দেওয়া হীনমন্য ঘটি বাড়িওয়ালা। দেশের গ্রামে জমিভিটেওয়ালা ঘটি ভাড়াটে। শিকড় ছিঁড়ে আসা উদ্বাস্তু বাঙাল ভাড়াটে। প্রত্যেকের মনে মনে আর্থ সামাজিক সূক্ষ্ম পর্দার একটা আড়াল রয়েই গেছে, যদিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে সকলেই একে অপরের পরিপূরক!       

 এসব সত্ত্বেও গ্রাম থেকে সদ্য আসা নতুন পাতা সংসারের পক্ষে পাড়াটা মন্দ নয়, ভালোই এখান থেকে পায়ে হাঁটা পথে অজস্র স্কুল, কলেজ। মেডিক্যাল কলেজ, ইউনিভার্সিটি। শেয়ালদা স্টেশনও পায়ে হাঁটা দূরত্বে। ট্রামে চড়লে হাওড়া স্টেশন পৌঁছোতে মিনিট কুড়ি লাগে। অচ্যুতের কলকাতার এই বাসায় দুটো ঘর, আর ছোট্ট একটা রান্নার জায়গা। দক্ষিণে রাস্তার দিকে লম্বা বারান্দায় কোমর ভর পাঁচিলের ওপর লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। স্নানঘর, পাইখানা একতলাতেই, ওপরের ভাড়াটের সঙ্গে ভাগাভাগিএই বাড়ির বাইরের দিকে আরেকটা ঘর আছে। সে ঘরের লাগোয়া পানের দোকান। সেটা ভাড়া নিয়েছে শম্ভুচরণ, সেই পানের দোকানটা চালায় দোকানের পিছনের ছোট্ট ঘরটাতে সন্ধের পর বসে তাসের আড্ডা। একটু কান পাতলে তখন শোনা যায় “টু ক্লাব্‌স্‌”, “থ্রি হার্ট্‌স্‌”-এর ডাক।  সকাল আট-সাড়ে আটটা থেকে বেলা দেড়টা কি দুটো, আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা অব্দি পানের দোকান খোলা থাকে। শম্ভুদার দোকান খোলার সময় থেকে, রেডিও চলতে থাকে নিরন্তরভেসে আসে বাংলা গান, হিন্দি গানঅনুরোধের আসর, রম্যগীতি, ভুলে বিসরে গীত...। দোকানে কত লোকের যে আনাগোনা। কেউ পান-বিড়ি-সিগারেট কিনে চলে যায়কেউ কেউ পান মুখে নিয়ে সিগারেট টানতে টানতে, ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয়। রাজনীতি, খেলাধুলো, সিনেমার আলোচনা আর রেডিওর গানে, প্রায় সারাদিন জমজমাট পানের দোকান।

বেলা সাড়ে নটায় ভাত খেয়ে অচ্যুত অফিসে বেরোনোর পর, সোনা পান্নাকে কোলে নিয়ে, হীরুকে পড়াতে বসেনদিন পনের পর স্কুলের অ্যাডমিশান টেস্ট। “অ্যাডমিশন”, “টেস্ট” এই শব্দগুলো সোনার কাছে একদম আনকোরা। দাদু কিংবা জ্যাঠামশাই অথবা বাবা, কেউ গিয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে, ছেলে-মেয়েকে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে এলেই, ছেলে মেয়েদের স্কুল শুরু হয়ে যায়, এমনই তিনি দেখেছেন বাপেরবাড়ি কিংবা শ্বশুরবাড়ির গ্রামে। বিশাল এই শহরের নিয়ম তেমন নয়। তিরিশজন ছেলে নেবে, অ্যাডমিশন টেস্ট দেবে অন্ততঃ তিনশ জন। যে স্কুলের যত নাম, তত বেশি কম্পিটিশান। এই “কম্পিটিশন” কথাটাও তাঁর কাছে নতুন। হীরুর ষোলো ঘর অব্দি মোটামুটি মুখস্থ হয়েছে, কিন্তু সতের, আঠের আর ঊণিশের ঘরের নামতা প্রায় কিছুই পারছে না। এরপরে আছে চার সংখ্যার যোগ। তিনসংখ্যার বিয়োগ। গুণ, ভাগ। এরপর আছে ভার্বের প্রেজেন্ট, পাস্ট, পাস্টপারফেক্ট টেন্‌স্‌-এর চার্ট – গো ওয়েন্ট গন, ডু ডিড ডান, রিড রেড রেড, টিচ টট টট। বাংলা বানান, বিভীষিকা, মুমূর্ষু, বিজীগিষা...। সোনা নিজেও মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেন, এইটুকু ছোট ছেলের পক্ষে এত কিছু মনে রাখা সম্ভব? আর এখনই যদি সব শিখে ফেলে, তাহলে অ্যাডমিশন পাওয়ার পর স্কুলে কী পড়বে?

 

 

বঙ্কিম চাটুজ্জ্যে স্ট্রিটে পাশাপাশি দুটো সরকারি স্কুলেরই খুব সুনাম। হিন্দুস্কুল আর সংস্কৃত স্কুল। তাদের ঘিরে চারপাশেই বইয়ের দোকান, পরিবেশও ভালো। অচ্যুত ছেলে হীরুকে সঙ্গে নিয়ে এক রোববার দুটো স্কুলেই নিয়ে গেছিলেন। তাঁদের বাসা থেকে স্কুলদুটো খুব দূরে নয়, পায়ে হাঁটা পথে মিনিট দশেকের দূরত্ব সেদিন রোববার, তাই স্কুলের ভেতরে ঢুকতে পারেননি, কিন্তু স্কুলের উঠোন থেকে থেকে ঘাড় উঁচু করে স্কুলের বাড়ি দেখে হীরু অবাক হয়েছিল খুব। এত্তো বড়ো বাড়ি! কত্তো জানালা, দরজা, লম্বা টানা বারান্দা, সারি সারি ঘর। এইসব স্কুলে কতো ছেলে পড়ে?

গ্রামের একতলা বাড়ির ছোট্ট স্কুলে দিন কয়েক যাওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই স্কুলকে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না হীরু। স্কুলের সামনে কোন মাঠ নেই। শান বাঁধানো উঠোনের ধারে ধারে কিছু গাছপালা আছে, কিন্তু সে কেমন যেন সাজানো গোছানো। সোজা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সব গাছ। সে গাছের ডালে ঝুলে দোল খাওয়া যাবে না, যেমন দোল খাওয়া যেত তাদের গ্রামের বটের ঝুড়ি ধরে, কিংবা আম বা তেঁতুলের ডাল ধরে। স্কুলে জলখাবারের কিংবা ছুটির ঘন্টা পড়লে, ছেলেরা ক্লাস ছেড়ে দৌড়ে মাঠে যাবে না? দৌড়োদৌড়ি করে খেলবে কোথায়?

হীরুর অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে অচ্যুত খুব তৃপ্তি পান, পথ চলতে চলতে তিনি বলতে থাকেন, এই স্কুল থেকে পাশ করা অনেক ছেলে বড়ো হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে...হীরু শুনছে, কিন্তু সবটুকু তার চেতনায় ঢুকছে না...তার নিজের গ্রাম, মামারবাড়ির গ্রাম, আর এই কিছুদিন আগে আসা অদ্ভূত অচেনা এই শহর, এর বাইরে দেশ আবার কী বস্তু? সেটা কী এর থেকেও বড়ো কিছু? তার মুখটা কেমন? তাদের বাসায় সে দেখেছে, কালো কালো গোল সুইচ, যার তলার দিকটা সাদা। সুইচ টিপলেই আলো জ্বলে ওঠে, ঘর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে এই স্কুলে পড়তে হবে কেন? দেশের কী বিজলি বাতি নেই? নাকি সুইচ নেই?

স্কুল দেখা হয়ে গেলে, অচ্যুত ছেলেকে নিয়ে বাঁদিকে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ওই দ্যাখ, রাস্তার ওপারে প্রেসিডেন্সি কলেজ, আর ওইটা হল হেয়ার স্কুল। ডেভিড হেয়ার বলে একজন সায়েব ছিলেন, তার কথা তোকে বাড়ি গিয়ে বলবো। ওই দ্যাখ, সেই হেয়ার সায়েবের মূর্তি। ওই হেয়ার সায়েবই এই স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কত বিখ্যাত বিখ্যাত মনীষীরা এই স্কুল থেকে আর ওই কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছেন তার আর শেষ নেই”

হীরু জিজ্ঞাসা করল, “মনীষী মানে?”

“মনীষী মানে...খুব বিদ্বান, লেখাপড়া জানা মানুষতবে শুধু লেখাপড়া জানলেই মনীষী হয় না – সেই মানুষকে দেশের ও দশের মঙ্গলের জন্যে কাজ করতে হয়। তবেই তাঁরা মনীষী হন।  এই স্কুলে পড়তে হবে, হীরু। বড়ো হয়ে তোকেও ওই রকম বিরাট মানুষ হতে হবে। লোকে দেখে বলবে, হ্যাঁ হীরু, সত্যিই হীরের টুকরো”

হেয়ার স্কুলের উল্টোদিকের গেট দিয়ে কলেজ স্কোয়ারে ঢুকলেন। জলের ধারে বুকভর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। পার্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অচ্যুত কলকাতা ইউনিভার্সিটির গুরুগম্ভীর বিশাল প্রাসাদ দেখিয়ে বললেন, “স্কুল দেখলি, ওই প্রেসিডেন্সি কলেজ দেখলি আর এই হচ্ছে কলকাতা ইউনিভার্সিটিদেশের মধ্যে অন্যতম সেরা লেখাপড়ার জায়গা”

কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর হীরু দেখল, বড়ো একটা চত্বরে সাদা পাথরে বানানো একটি বসে থাকা মূর্তি। রেলিং ঘিরে সুন্দর করে সাজানো। মূর্তিটি দেখিয়ে অচ্যুত পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, “চিনতে পারছিস? কে বলতো?”

“বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয়ে ছবি দেখেছি”।  

“গুড, ঠিক বলেছিস। ছোটদের জন্যে বর্ণপরিচয় লিখেছেন, কিন্তু ওঁর মতো পণ্ডিত দেশে আর তেমন খুব একটা নেই। দেশের জন্যে, কত যে বড়ো বড়ো কাজ করে গেছেন, সে সব বড়ো হয়ে জানতে পারবি। নমস্কার কর”। হীরুর সঙ্গে অচ্যুত নিজেও জোড়হাতে নমস্কার করলেন। কথা বলতে বলতে জলের ধারের রাস্তা দিয়ে আরো এগিয়ে গেলেন। গাছপালার আড়ালে আরেকটি দাঁড়ানো মূর্তি। মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “এঁনাকে এখন চিনবি না, আরেকটু বড়ো হয়ে চিনবি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। খুব বড়ো বিজ্ঞানী ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন, কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন, পড়িয়েছেন। ওঁদের মতো হতে হবে – অন্ততঃ চেষ্টা তো করতে হবে! নমস্কার কর”।

আরেকটু এগিয়ে ছোট্ট গেট দিয়ে বেরিয়ে, কলেজস্কোয়ারের বাইরে এলেন অচ্যুত। সামনে মির্জাপুর স্ট্রিট। ওপারে পুঁটিরামের মিষ্টির দোকান। ঠিক কোনায় ইস্ট বেঙ্গল এম্পোরিয়াম, কাপড়ের দোকান।

রাস্তা পার হয়ে, মির্জাপুর আর কলেজস্ট্রীটের মোড় থেকে সোজা দক্ষিণে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ওপারে ওই দ্যাখ, উঁচু পাঁচিল ঘেরা ওই লাল রঙের বাড়িগুলো? ওটা মেডিকেল কলেজ। আমাদের দেশের প্রথম মেডিকেল কলেজ। ওখানে ডাক্তারি পড়ানো হয়। খুব ভালো ভালো ছেলেরা ওখানে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পায়। এখান থেকে পাশ করে তারা ডাক্তার হয়। সাধারণ মানুষ ডাক্তারকে ভগবান মনে করে। অসুস্থ মানুষেরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভরসা পায়আমার স্বপ্ন তুইও ওই কলেজে পড়বি, বড়ো ডাক্তার হবি। পারবি না? ঘাড়ে স্টেথিস্কোপ দুলিয়ে গটমট করে হেঁটে যাবি হাসপাতালের লম্বা বারান্দা ধরেগায়ে থাকবে ধবধবে সাদা অ্যাপ্রন। রোগীর আত্মীয়-পরিজনেরা তোকে ঘিরে ধরবে, উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞাসা করবে, “ডাক্তারবাবু, রুগী সেরে উঠবে তো?” তুই তাদের আশ্বাস দিবি, ভারিক্কি গলায় বলবি “ভাববেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে”“নিজের কল্পনার আনন্দে অচ্যুত নিজেই হাসতে হাসতে হীরুর মুখের দিকে তাকালেন। হীরু বাবার সবকথা ঠিকঠাক না বুঝলেও, তার মধ্যে সঞ্চারিত হতে লাগল বাবার স্বপ্ন আর আবেগ। 

 

অজস্র কলপাইপ আর স্যানিটারি দোকান, আরপুলি লেনের মোড় পার হয়ে, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মোড়ে এসে থামলেন, অচ্যুত। ছেলেকে বললেন, “ওপারে দেখ, সেই কোথায় শুরু হয়েছিল, আর এইখানে ওই মেডিকেলের পাঁচিল শেষ হল। কত্তো বড়ো কলেজ দেখলি? এখানে ডাক্তারি পড়াও হয় আবার রুগীদের চিকিৎসাও হয়। এখানে কিন্তু তোকে ঢুকতেই হবে, হীরু। তার জন্যে খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করতে হবে। চল, ওপারে অঞ্জনদার চেম্বারে যাই। উনিও ডাক্তার, ডাক্তার অঞ্জন সামন্ত, এমবিআমাদের পাশের গাঁয়ের লোক। আমার থেকে বছর চার-পাঁচের বড়ো। জ্যাঠামশাই বলবি, কেমন? জ্যাঠামশাই বললাম বলে হুট করে প্রণাম করতে যাস না যেন। ওরা আগুড়ি, আর আমরা বামুন”।

 

এপারে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের ঠিক কোনায় শিবমন্দির আর কলেজস্ট্রিট পার হয়ে, উল্টোদিকেই “বাঙালী পাঁঠার দোকান”দোকানের মধ্যে মা কালীর প্রতিমা। তার দুটো তিনটে দোকান পরে আরোগ্য ফার্মেসি। কাঠের পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই দুপাশে কাঠের বেঞ্চ বেঞ্চে দুজন বসে আছে, চেহারা দেখেই বোঝা যায়, তারা অসুস্থ। তার ওপাশে ওষুধের আলমারিঅন্যপাশে টেবিলের ওধারে চেয়ারে ডাক্তারবাবু বসে রয়েছেন। তাঁর চেয়ারের পেছনে পর্দা ঝোলানো একটা ঘর। তাঁর পাশের চেয়ারে বসে আছে আরো একজন রোগীডাক্তারবাবু কানে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে তার বুক পিঠ পরীক্ষা করতে করতে, দুবার বললেন, “নিঃশ্বাস, জোরে জোরে”লোকটি জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। অচ্যুতকে দেখে ডাক্তারবাবু চোখ আর হাতের ইশারায় বললেন, বসো। বুকপিঠ দেখা হয়ে গেলে, ডাক্তারবাবু গলার কাছে টিপে ধরে বললেন, “হাঁ করুন, অ্যা...”। ডাক্তারবাবুর দেখানো মতো লোকটি জিভ বের করে “অ্যা...” করল। তারপর ডাক্তারবাবু লোকটির দু চোখের তলায় টান দিয়ে দেখলেন, তারপর ঘুরে বসে হাতে পেন নিয়ে কাগজে খসখস করে লিখতে লিখতে জিজ্ঞাসা করলেন, “সকাল থেকে কবার বমি হয়েছে?”

“আজ্ঞে তিনবার, যা খাচ্ছি সবই বেরিয়ে যাচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণাকাশি হচ্ছে খুব”

“পায়খানা পরিষ্কার হয়েছে?”

“আজ্ঞে না, বারবার বেগ আসছে, কিন্তু পুরো হচ্ছে না”।

“হুঁ। নিতাই!” ডাক্তারবাবুর ডাক শুনে, পিছনের পর্দা সরিয়ে একজন লোক বেরিয়ে এল, ডাক্তারবাবুর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে আবার চলে গেল পর্দার আড়ালে। ডাক্তারবাবু চেয়ারে বসা রোগীকে বললেন, “যান, একটু অপেক্ষা করুন। নিতাই ওষুধ বানিয়ে, সব বুঝিয়ে দেবে। তারপর কী খবর তোমার অচ্যুত? এটি কে, পুত্র? ভেরি গুড। কী নাম রে, তোর?”

অচ্যুত ছেলেকে বললেন, “নাম বলো, জ্যাঠামশাইকে”।

“আজ্ঞে হীরকরঞ্জন মুখার্জি” হীরু বলল, তার উত্তরের পর অচ্যুত একগাল হেসে বললেন, “বাড়িতে আমরা হীরু বলে ডাকি”।

ডাক্তারবাবুও একটু হাসলেন, ভুরু নাচিয়ে বললেন, “কলকাতা কেমন লাগছে রে, হীরু?” তারপর হীরুর উত্তরের প্রতীক্ষা না করে অচ্যুতকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাসা গুছিয়ে ফেলেছো? একদিন যাবো তোমার বাসা দেখতে, গোপাল মল্লিকের গলিতে তো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, দাদা। সময় করে একদিন এসে নিয়ে যাবো আপনাকে, আরেকটু গুছিয়ে নিই”।

“বেশ, বেশ সেই ভালো। আর এদিকের কী খবর? ছেলেকে কোন স্কুলে ভর্তি করাচ্ছো”?

“দেখি। কোথায় চান্স পায়। হিন্দু, সংস্কৃত, হেয়ার...”।

“খুব শক্ত হে। শুনেছি ছেলেপুলেদের একেবারে নিংড়ে নেয়। যদি না পারে, একটা বছর নষ্ট হবে। ও ছাড়াও অন্য দু একটা স্কুলেও চেষ্টা রেখো”।

“তা ঠিক”।

নিতাই নামের লোকটি পর্দা সরিয়ে বের হয়ে এল, তার হাতে কাচের চ্যাপ্টা বোতল, গোলাপীরঙের ওষুধ ভরা। তার গায়ে সাদা কাগজের খাঁজকাটা শেকল চিপকানো। বেঞ্চে বসে থাকা রোগীকে ডেকে ওষুধ বুঝিয়ে দিল খাঁজকাটা শেকলের খাঁজে খাঁজে আঙুল রেখে সে বলল, “একদাগ সকালে, একদাগ দুপুরে আর একদাগ রাত্রে, খাবার পর। সঙ্গে দিল কয়েকটা কাগজের পুরিয়া। দুপুরে একটা, রাত্রে একটা। সামান্য খাবার জলে গুলে, ঢুক করে খেয়ে নিতে হবে। তিনদিন চলুক। তারপর কেমন থাকেন জানাবেন। চারটাকা চল্লিশ পয়সা”লোকটি টাকাপয়সা গুনে দিয়ে, ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। নিতাই পরের রোগীকে ডাকল, “পরাণ মণ্ডল”। বেঞ্চ থেকে উঠে পরাণ ডাক্তারবাবুর পাশের চেয়ারে বসল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় কষ্ট?”

অচ্যুত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি এখন তবে আসি দাদা, আপনি ব্যস্ত রয়েছেন”।

“ঠিক আছে। মাঝে মাঝে এসো হে সময় করে, দেশ ঘরের গল্প করা যাবে!”

“আসবো দাদা, নিশ্চয়ই আসবো”।

 

“সব দেখিয়ে আনলাম, জানো?” ঘরে ঢুকে গায়ের জামা ছাড়তে ছাড়তে অচ্যুত স্ত্রীকে বললেন। সোনা ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী সব দেখিয়ে আনলে, ছেলেকে?”

“ওদের স্কুল, মেডিকেল কলেজ। কলকাতা ইউনিভার্সিটি। কলেজ স্কোয়ার। অঞ্জন ডাক্তারের চেম্বার”।

“ডাক্তারের চেম্বার কেন?” সোনা অবাক হলেন, কিছুটা ভয়ও পেলেন।

“ওই যে গো, তোমায় বলেছিলাম না, আমাদের পাশের গ্রামের অঞ্জনদা ডাক্তার। তার চেম্বার আছে বউবাজারের কাছে। তার সঙ্গে দেখা করে এলাম একবার। হীরুর স্বচক্ষে একজন ডাক্তার দেখা হল”।

“ডাক্তার ডাক্তার করে অত উতলা হয়ো না তো? ওসব এখন ঢের দেরি। আগে তো স্কুলে ভর্তি হোক”।

“সে হোক না, কিন্তু লক্ষ্যটা ঠিক করতে না পারলে সবটাই বৃথা। সেই পাখির চোখের মতো!”

“পাখির চোখ কী, বাবা?”

হীরু বাবার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল। অচ্যুত ছেলের পিঠে হাত রেখে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “এ সব হচ্ছে, মহাভারতের কথা। আচার্য দ্রোণ, হস্তিনাপুরের সব রাজপুত্রদের অস্ত্রবিদ্যা শেখাতেন। অস্ত্রবিদ্যা মানে তির ছোঁড়া, তলোয়ার চালিয়ে যুদ্ধ করা এই সব আর কি। সবাই শিখছে। বেশ কিছুদিন শেখার পর, একদিন গুরু দ্রোণাচার্য ঠিক করলেন, তাঁর সব শিষ্যদের পরীক্ষা নেবেন। করলেন কী, বড়ো একটা গাছের অনেক উঁচু ডালে মাটির একটা পাখি রেখে দিয়ে বললেন, ওটাকে তির দিয়ে বিঁধতে হবে। এক এক করে সবাইকে ডাকলেন, বললেন মাটির ওই পাখিকে তিরে বিঁধতে হবে। তোমরা সবাই মনঃসংযোগ করো”।

“মনঃসংযোগ মানে?” হীরু জিজ্ঞাসা করল।

অচ্যুত বললেন, “মনঃসংযোগ মানে, ইয়ে...খুব মন দেওয়া...খুব মন দিয়ে কোন একটা কাজ করা। মনঃসংযোগ না হলে কোন কাজই ঠিকঠাক করা যায় না। গুরু দ্রোণাচার্য বললেন, তোমরা মনঃসংযোগ করো, তারপর তোমরা কে কী দেখছো বলো। কেউ বলল, পাখিতো দেখছিই, কিন্তু তার সঙ্গে আপনাকে দেখছি। আমাদের সব ভাইদের দেখছি। আকাশ দেখছি, গাছপালা দেখছি। গাছের ডালপালা দেখছি, পাতা দেখছি। তাদের উত্তরে দ্রোণাচার্য খুশি হলেন না। সবার শেষে এলেন অর্জুন। তাঁকে গুরু দ্রোণাচার্য জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী দেখছো, অর্জুন? অর্জুন বললেন, পাখির চোখ ছাড়া আর কিচ্‌ছু দেখছি না, গুরুদেব! দ্রোণাচার্য বললেন, সে কি? আর কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছো না? অর্জুন বললেন, আজ্ঞে না, গুরুদেব, কই আর তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দ্রোণাচার্য বললেন, মাটির ওই পাখিটিকে তির মেরে নামিয়ে আনতে পারো? তাঁর কথা শেষ হবার আগেই মাটির পাখিটি মাটিতে এসে পড়ল, তার চোখে বিঁধে আছে অর্জুনের তির। দ্রোণাচার্য আনন্দে শিষ্য অর্জুনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তুমিই আমার শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করেছো, অর্জুন। সেই জন্যেই বলছিলাম, আসল কথাটা হচ্ছে লক্ষ্য - পাখির চোখপ্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য যদি স্থির না করা যায়, পুরো কাজটাই এলোমেলো হয়ে যায়”।

এতক্ষণ বাপ আর ছেলের কথা শুনছিলেন সোনা। তাঁর কোলে শুয়ে পান্নাও চুপ করে বাবা আর দাদার কথা শুনছিল। ছেলেটা কী বোঝে কে জানে, কিন্তু চুপ করে সব কিছু শোনেসোনা কোলে ছেলেকে নাচাতে নাচাতে বললেন, “স্কুলটা কেমন দেখলি, হীরু? ভালো? তোদের সেই গাঁয়ের স্কুলের থেকে ভালো?” হীরু এতক্ষণ বাবার উপদেশের চাপে কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করছিল, এখন মায়ের প্রশ্নে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে, দু হাত ছড়িয়ে বলল, “বিরাআআআট স্কুলগো, মাকত্তো ঘর। কত্তো লম্বা বারান্দা! এক...দুই...তিন...চার তলা বাড়ি”। আঙুলের কড়গুণে সে তলার হিসেব দিল মাকে, বলল, “এই এত্তো চওড়া সিঁড়ি। বারান্দার একধারে ধাপি বানানো, তার ওপর খাবার জলের কল। পরপর কত্তোগুলো কল! ওমা, ছেলেরা কী সারাদিন জলই খায়, নাকি? তাহলে পড়ে কখন?”

সোনা স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে হীরুর কথা শুনছিলেন, এখন হেসে ফেললেন, বললেন, “ভালো লাগল, স্কুলটা?” বড়ো করে সম্মতির ঘাড় নাড়ল হীরু, তারপর বলল, “জানো তো মা, একজন লোক স্কুলের উঠোনে বসে পেতলের ঘটি মাজছিল, তার এত্তোবড়ো ভুঁড়ি। আমাকে দেখে বলল, কী দেখছো খোখা? খোখা কী মা?”

সোনা একটু অবাক হলেন, অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে গো?”

“স্কুলের দারোয়ান-টারোয়ান হবে, স্কুলের ভেতরেই ওরা থাকে তোখোখা মানে খোকা, হিন্দুস্থানী তো, ওরা ওইরকমই উচ্চারণ করে”।  সোনা কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা, স্কুলে দারোয়ান আছে?”

“বা রে, থাকবে না? অতবড়ো স্কুল। একজন নাকি, অনেক দারোয়ান আছে। তা নাহলে এতো ছেলেদের সামলাবে কী করে? ওদের কত কাজ জানো? স্কুলের ঘন্টা দেওয়া, স্কুলের গেট সামলানো। আরো কত কী!”

সোনা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যারে, তোর স্কুল পছন্দ হয়েছে?” বিশাল ঘাড় হেলিয়ে হীরু বলল।

“হ্যাঁ”।

“ওই স্কুলেই পড়বি?”

“হ্যাঁ”।

“খুব শক্ত হবে নিশ্চয়ই, ভর্তি হতে পারবি?” মায়ের চোখে চোখ রেখে হীরু বলল, “পারবো, মা।” তারপর মায়ের কাছে সরে গিয়ে ভাইয়ের পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল, “পান্নাও ওই স্কুলে পড়বে, মা?”

সোনা পান্নার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে, দাদার সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলে যাবি?” মায়ের কোলে শুয়ে থাকা পান্না কি বুঝলো কে জানে? দাদার সুড়সুড়ি আর মায়ের কথায় হেসে উঠল কলকল করে।

অচ্যুত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁর এই ছোট্ট পরিবারের দিকে। তাঁর দুচোখে এখন স্বপ্ন, তাঁর স্থির লক্ষ্য এখন পাখির নির্দিষ্ট চোখে।

 ..০০..

[এর আগের পর্ব - "বিদায় বেলার মালাখানি" - এই সূত্রে পড়া যাবে - বিদায়বেলার মালাখানি ]

  

সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ১/৪

 [এর আগের পর্ব পড়তে  হলে এই সুত্রে প্রবেশ করুন - ধর্মাধর্ম -১/৩]


প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৪র্থ পর্বাংশ

১.৩.৩ সংঘাত – সংযোগ - মৈত্রী                 

ওঁদের বিশ্রামের ফাঁকে আর ঊষি খাবার জল আনার আগে, মিত্তিকা আর গিরিজের পরিচয়টা সেরে ফেলা যাক।

মাস তিনেক আগে, পিতা পশুপতির দলটি যখন তাদের এই বসতির দিকেই আবার ফিরে আসছিল, জঙ্গলের পথে এক নদীর ধারে এই মিত্তিকার দলটির সঙ্গে তাঁদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ও পরিচয় ঘটেছিল।

মানুষের এই বিচ্ছিন্ন পারিবারিক দলগুলি ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কারণ একই জঙ্গলে সারাবছর যথেষ্ট খাবার, শিকার ও জলের সংস্থান থাকে না। বনের তৃণভোজী পশুরাও খাবার আর জলের সন্ধানে ঋতু অনুযায়ী এমনই জঙ্গল থেকে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পিছনে ঘুরে বেড়ায় মাংসাশী পশুরা এবং মানুষ ও মানবের গোষ্ঠীগুলিও। কোন ক্যালেণ্ডার নেই, কোন ট্র্যাভেল-গাইড নেই। তবুও জঙ্গলের সব অধিবাসীই টের পেয়ে যায়, কোন সময় তাদের পরিচিত জঙ্গল ছেড়ে অন্য জঙ্গলে চলে যেতে হবে। আবার কখন ফিরে আসতে হবে তাদের ছেড়ে যাওয়া পুরোনো বসতিতেই।

এমনই যাওয়া আসার পথে, মাঝে মাঝেই অন্য মানুষ এবং মানব গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে যায়। সাধারণতঃ তারা একে অপরকে এড়িয়ে চলে, তবে কখনো কখনো ভয়ংকর সংঘাতও ঘটে যায়। সংঘাতটা ঘটে এলাকা দখলের বিবাদ থেকে। একই অঞ্চলে একাধিক দলের উপযোগী খাদ্যের সংস্থান হওয়া দুঃসাধ্য, অতএব একদল অন্যদলকে তাড়িয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই সংঘাতের পথে যেতে বাধ্য হয়।

বছর পাঁচেক আগের প্রথম সাক্ষাতে মিত্তিকার দলটির সঙ্গে পিতা পশুপতির দলের এমনই এক সংঘাত ঘটেছিল, এখান থেকে বহুদূরের এক জঙ্গলে। সেই সংঘাতে পিতা পশুপতির দলেরই ক্ষতি হয়েছিল বেশি। তাঁর দলের তিনজন মারা গিয়েছিল, এবং আহত হয়েছিল আটজন। মিত্তিকাদের দুর্দান্ত দলের হাতে পরাজিত হয়ে পিতা পশুপতির দল অন্য জঙ্গলে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এইবারের ঋতুকালীন পর্যটন সেরে পিতা পশুপতির দলটি যখন আবার এই বসতিতে ফিরছিলেন, তখন মিত্তিকাদের দলটির সঙ্গে হঠাৎ সাক্ষাৎ হয়ে গেল, একটি নদীর ধারে। সে নদীতে সারা বছরই জল থাকে, যার ফলে তার দুপাশেই রয়েছে গভীর সবুজ জঙ্গল আর সবুজ তৃণক্ষেত্র। অতীতের সংঘাতের কথা দু দলের কেউই ভোলেনি। দূর থেকে দু দলই একে অপরকে সতর্ক লক্ষ্য করতে লাগল। পিতা পশুপতি লক্ষ্য করলেন, ওদের দলটির লোকসংখ্যা বেশ কম, মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন, তার মধ্যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর বাচ্চাদের সংখ্যাই বেশি, যুবক-যুবতীরা সাকুল্যে আট-দশ জন। তারাও কেমন যেন মনমরা, আগেকার সেই সাহস বা শক্তির কিছুই যেন আর অবশিষ্ট নেই।

দুটো দিন সতর্ক লক্ষ্য রাখার পর পিতা পশুপতি তাঁর দলের সবাইকে এক সকালে ডেকে বললেন, “আমি ওই দলের কাছে যাবো, আমার সঙ্গে কেউ একজন চল”। এ দলের সকলেই ভীষণ অবাক হল, জিগ্যেস করল, “কেন? আপনারা শুধু দুজন যাবেন, ওদের সঙ্গে লড়াই করতে? পাগল হয়েছেন?” পিতা পশুপতি বললেন, “লড়াই করতে নয়। দেখছিস না, ওদের দলে লোক কম, ওরা এখন দুর্বল, আমাদেরই ভয় পাচ্ছে। অন্য কোন দলের খপ্পরে পড়লে তো ওরা শেষ হয়ে যাবে। কিংবা বাঘ, সিংহ বা হাতির কবলে পড়ে যদি আরও কয়েকজন আহত হয়, তাহলে ওদের আর থাকবেটা কী? আমি যাবো ওদের সঙ্গে কথা বলতে, বর্শা নিয়ে শুধু একজন চল আমার সঙ্গে, আর তোরা এখানেই থাক, গতিক সুবিধের নয় মনে হলে, তোরাও তাড়াতাড়ি চলে আসবি”। এমন একটা প্রস্তাব দলের কারও ঠিক পছন্দ হল না। পিতা পশুপতি সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার মনে যে নির্দেশ এসেছে, আমি তা পালন করছি মাত্র। আমাদের দু’দলেই রয়েছি যারা, তারা সবাই তো মানুষ। আমি বুঝতে পারছি, ওরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। এসময় ওদের পাশে দাঁড়ালে ভবিষ্যতে আমাদের দুপক্ষেরই মঙ্গল হতে পারে”। পিতা পশুপতির দলের সকলেই জানে, তিনি তাঁর অন্তরে তাঁর বড়োবাবার নির্দেশ পান, সেই আত্মার নির্দেশেই তিনি কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

এরপর আর কিছু বলার ছিল না, পিতা পশুপতি একজন সশস্ত্র যুবককে সঙ্গে নিয়ে অন্য দলের দিকে হাঁটা দিলেন। অন্য দলের লোকেরাও তাঁদের দেখছিল, যুবক-যুবতীরা সতর্ক হয়ে উঠল তাদের বল্লম আর পাথরের অস্ত্র নিয়ে। ও দলের এক বৃদ্ধ তাদের সতর্ক থাকতে বললেন, কিন্তু উত্তেজিত হতে নিষেধ করলেন। তাদের কাছে এ এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। একদলের ওপর অন্যদল আচমকা হামলা করে, এমন তারা বেশ কয়েকবার দেখেছে। কিন্তু এভাবে একজন বৃদ্ধ একটিমাত্র যুবকের সঙ্গে শান্তভাবে, তাদের দিকেই হেঁটে আসছেন, এ দৃশ্য বিরল। তারা কোনদিন দেখেনি। তাদেরও কৌতূহল বাড়তে লাগল।

বৃদ্ধ যে মানুষটিকে ওই দলের নেতা বলে মনে হচ্ছিল, পিতা পশুপতি তাঁকে জোড়হাতে নমস্কার করলেন।  ইশারা করলেন, তাঁর সঙ্গের যুবকটিকে। যুবকটি অবাক হলেও, মেনে নিল এবং জোড় হাতে নমস্কার করল। এতদিন সে এবং তার দলের সকলে পাথর-আত্মার সামনে নমস্কার করেছে, কিন্তু এখন অজানা এই লোকগুলোকে সে কেন নমস্কার করল, বুঝল না। পিতা পশুপতির চোখে এবং অধরে হাল্কা হাসির ছোঁয়া। তিনি ওই দলের নেতার সামনে মাটিতেই বসলেন। শান্ত দৃষ্টিতে দলের কৌতূহলী এবং সন্দিগ্ধ সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর দলনেতার চোখে চোখ রেখে বললেন, “কবছর আগে আপনার এই দলের সঙ্গে আমাদের যে লড়াই হয়েছিল, তাতে আমাদেরই হার হয়েছিল। মনে আছে? কিন্তু এবার আপনাদের দলটিকে বেশ ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে যেন, এর কারণ বলবেন কি?”

তাঁর ভাষা অন্যদলের ভাষার থেকে অনেকটাই আলাদা। ও দলের বৃদ্ধ সব কথা না বুঝলেও বক্তব্য বুঝতে অসুবিধে হল না। তিনি এতক্ষণ পিতা পশুপতির অভিনব ও অভূতপূর্ব আচরণ মন দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি ভীষণ আশ্চর্য হচ্ছিলেন, কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিলেন আগন্তুক এই বৃদ্ধ এবং ওই যুবকের মনে কোন অশুভ উদ্দেশ্য নেই। তা যদি হত, ওদের শক্তিশালী দল নিয়ে আচমকা আক্রমণ করতে পারত এবং গতবারের পরাজয়ের শোধ তুলতে পারত অনায়াসে।

কোন উত্তর না দিয়ে তিনি পিতা পশুপতির স্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব শান্ত স্বরেই বললেন, “কয়েক মাস আগেই আমাদের দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছিল সে এক বৃদ্ধ দাঁতাল হাতি – খ্যাপা, মনে হয় নিজের দল থেকে সে ছিল বিতাড়িত। তার সারা গায়ে ছিল ভয়ানক লড়াইয়ের ক্ষত। সে হাতিকে আমরা গভীর জঙ্গলে বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম। দলছুট সেই হাতি গভীর এক রাত্রে আমাদের বসতির কাছাকাছিই নিঃশব্দে লুকিয়েছিল। আমরা বুঝতেও পারিনি। আমাদের উঠোনে যতক্ষণ আগুন জ্বলছিল, সবাই কথাবার্তা বলছিলাম, খাওয়াদাওয়া করছিলাম, তখন সে আসেনি। গভীর রাতে আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কোন এক সময় নিভে গেছে চর্বির মশাল, চারিদিক নিবিড় অন্ধকার। সে নিঃশব্দ মৃত্যুর মতো এগিয়ে এল আমাদের বাসার দিকে। উঠোনে যারা ঘুমোচ্ছিল – তাদের সাতজনকে পিষে দিল পায়ের তলায়। বাকিরা যারা ঘুমভাঙা চোখে অন্ধকার পাহাড়ের মতো হাতিটাকে বল্লম দিয়ে আঘাত করছিল বারবার। তাদের শুঁড়ে জড়িয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। তারপর আরও কিছুক্ষণ আমাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে থেকে, যেমন নিঃশব্দে সে এসেছিল, তেমনই চলে গেল – গভীর জঙ্গলের দিকে। আমরা কয়েকজন এবং বাচ্চারা নিরাপদেই ছিলাম, কিন্তু ভীষণ আতঙ্কে সেই রাতে মশাল জ্বেলে বের হবার কথা মনেও হয়নি। সূর্যোদয়ের পর, আমরা আমাদের আহত মানুষগুলোকে তুলে আনলাম, তাদের সেবা শুশ্রূষা শুরু করলাম। কিন্তু তাদের মধ্যেও পাঁচজন, দুদিনের মধ্যে মারা গেল”।

দলের অধিকাংশ মানুষ মাথা নীচু করে শুনছিল। তাদের প্রত্যেকের চোখেই জল, একজন প্রৌঢ়া মহিলা পাথরের মূর্তির মতো উদাসীন চোখে তাকিয়ে ছিলেন দূর জঙ্গলের দিকে। গিরিজ তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও আমার মেয়ে, মিত্তিকা। হাতির পায়ের তলায়, ও হারিয়েছে ওর দুই পুত্র আর নিজের সঙ্গীকে...”। গভীর হতাশায় আর দুঃখে বৃদ্ধ মাথা নাড়তে লাগলেন বারবার, তাঁরও দুই চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে।

পিতা পশুপতি থমথমে মুখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধের মুখের দিকে, তারপর উঠে গিয়ে হাত রাখলেন তাঁর কাঁধে। অদ্ভূত এক অনুভূতি নিয়ে বৃদ্ধ মুখ তুলে তাকালেন পিতা পশুপতির চোখে চোখ রাখলেন কিছুক্ষণ। তারপর দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরলেন পিতা পশুপতিকে, তাঁর কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন, বিকৃত স্বরে বলতে লাগলেন, “আমার সব গেল, সব...তিন ছেলে, দুই নাতি, দুই ভাইপো...যাদের ওপর আমাদের ভরসা ছিল খুব। আমাদের বুকের পাঁজরগুলোও যেন ভেঙে দিয়ে গেল ওই শয়তান দাঁতালটা...”।

দুঃখ ও শোকের ভারি বাতাবরণের মধ্যেও দলের সব্বাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুই বৃদ্ধের দিকে, অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। অজানা, অচেনা, সম্পর্কহীন দুই বৃদ্ধের এমন অন্তরঙ্গ দৃশ্য তাদের কেউ কখনও দেখেনি। নিজেদের দলের পুরুষ মহিলার মধ্যে এমন আচরণ তারা বহুবার দেখেছে, সে দৃশ্যে তারা অভ্যস্ত, কিন্তু এমন দৃশ্য অভাবিত, তারা তাকিয়ে রইল দুই বৃদ্ধের দিকে। তাঁদের আবেগ ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হতে লাগল সকলের মনে। এ আবেগ তারা আগে কোনদিনই টের পায়নি, মানুষের ইতিহাসেও এই হয়তো প্রথম। এ আবেগ মৈত্রীর, এ আবেগ সখ্যতার।

একটু পরে বৃদ্ধ নিজেকে অনেকটা সামলে নিলেন, কর্কশ হাতে চোখের জল মুছে, পিতা পশুপতির চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি গিরিজ, এই দলের নেতা। আমরা সবাই কৃতজ্ঞ আপনার কাছে, আপনার দলের সবার কাছে। আমাদের দুর্বল বুঝেও আপনারা প্রতিশোধ নিলেন না। আপনার এমন আন্তরিক ব্যবহার আমরা কল্পনাও করিনি”।

পিতা পশুপতি কিছু বললেন না, তাঁর গভীর বলিচিহ্নিত চোখের কোলে আস্থার হাসি, বৃদ্ধের দুই কাঁধে হাত রাখলেন কিছুক্ষণ, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাদের দলের কোন একজন অথবা কয়েকজন মানুষের কৃতকর্মের জন্যে আপনি কখনও অনুশোচনা করেন কি? এমন কোন কাজ, যা করা উচিৎ হয়নি, এমন কি মনে হয়?” পিতা পশুপতি মাথা নীচু করে অস্ফুট স্বরে আবার বললেন, “অকারণ কোন হত্যা, প্রকৃতির নিয়মে যার কোন প্রয়োজনই ছিল না – এমন কোন অপরাধ?”

এই কথা শুনে গিরিজ এবং সঙ্গী-পুত্র হারা মিত্তিকা শিউরে উঠলেন যেন। অদ্ভূত আতঙ্কে তাঁরা তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের দিকে। এই বৃদ্ধ কি অন্তর্যামী, সব কিছু দেখতে পান? তা নাহলে এমন প্রশ্ন করলেন কী করে?

 বৃদ্ধ গিরিজ মুখ তুলে তাঁর অভাগী কন্যার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আছে বৈ কি! এই শীতের আগের শীতে আমরা তখন ফিরে গিয়েছি আমাদের পুরোনো এলাকায়। গিয়ে দেখি, সেখানে আমাদের আগেই অন্য একটি দল আস্তানা গেড়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের বেধে গেল ভয়ংকর লড়াই, আমাদের একজন মারা গেল, আহত হল চার-পাঁচজন। কিন্তু অন্য দলটির ক্ষতি হয়েছিল অনেক বেশি। তাদের পাঁচজন মাটি নিয়েছিল, আর অন্ততঃ আটজন গুরুতর আহত হয়েছিল। ওরা হার স্বীকার করে নিয়েছিল। ওরা আমাদের এলাকা ছেড়ে আরও পশ্চিমের জঙ্গলে চলে যাচ্ছিল। আমরাও জয়ের আনন্দে পুরোনো এলাকায় জাঁকিয়ে বসার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আহত মানুষদের জন্যে ওদের দলটা খুব দ্রুত পালাতে পারেনি। তিনদিন পরেও আমাদের কয়েকজন তাদের দেখতে পেল, পশ্চিমে জঙ্গলের গভীরে। আমাদের ছেলেরা, ওদের এতটুকুও সুযোগ না দিয়ে, আবার আক্রমণ করল সেই হীনবল দলটাকে। এবার সবাইকেই হত্যা করল নির্দ্বিধায়, মহিলাদের এমনকি বাচ্চাদেরও...”!        

পিতা পশুপতি থমথমে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন, অস্ফুট স্বরে বললেন, “এ যে অনর্থক গণহত্যা! এ তো প্রকৃতির নিয়ম নয়, এ যে মহা অপরাধ! পাপ!” তাঁর মুখের অজস্র বলিরেখায় এখন বিরক্তি! 

পিতা পশুপতি হঠাৎই উঠে দাঁড়ালেন, সঙ্গের যুবকটিকেও ফেরার ইশারা করলেন। গিরিজ উঠে দাঁড়িয়ে পিতা পশুপতির দুই হাত ধরে বললেন, “আপনি কী চলে যাচ্ছেন?”

হ্যাঁ”।

আবার আসবেন তো?”

তার কি কোন প্রয়োজন আছে?”

নেই?” বৃদ্ধের স্বরে অদ্ভূত আকুতি। পিতা পশুপতি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সঙ্গী যুবককে নিয়ে ফেরার পথে এগিয়ে চললেন দ্রুত। তিনি পিছন ফিরে আর তাকালেন না। তাকালে দেখতে পেতেন, সেই বৃদ্ধ এবং দলের অন্য সবাই, এমনকি সেই সঙ্গী-পুত্রহারা মিত্তিকাও জোড়হাতে দাঁড়িয়ে আছে এবং একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তাঁর পথচলার দিকে।

পিতা পশুপতির দলটি পরের দিন সকালেই তাদের পুরোনো এলাকায় ফেরার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। প্রস্তুত হবার ছিলটাই বা কী? শুকনো লতার ঝুলিতে পাথরের অস্ত্রগুলো, হাতে হাতে কাঠের বা বাঁশের বল্লম, আর কিছু পশুর চামড়া – বুনো ছাগল, ভেড়া আর শুয়োরের। গতদিনের শিকার করা কিছু খরগোশ, মেঠো ইঁদুর আর সংগ্রহ করা কিছু খাম-আলু ছিল, সেগুলো ঝলসে বা পুড়িয়ে খেয়ে দলটি যখন রওনা হতে যাচ্ছে, সে সময় পিতা পশুপতির কাছে এসে উপস্থিত হলেন, গিরিজ ও মিত্তিকা। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দুজনেই জোড়হাতে নমস্কার করলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কী আজই চলে যাচ্ছেন?”

নিজের দলের সবার দিকে একবার তাকিয়ে পিতা পশুপতি বললেন, “হ্যাঁ”।

এবার মিত্তিকা সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমরা কী আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি?”

পিতা পশুপতি মাথা নেড়ে দৃঢ়স্বরে বললেন, “না। আমাদের দলের সকলের খাদ্য-সংস্থান করাই আমাদের কাছে কখনও কখনও দুরূহ হয়ে ওঠে, তার ওপর আপনাদের দলে প্রায় পঁয়ত্রিশ জন। অসম্ভব। তাছাড়া আপনাদের দল অত্যন্ত উদ্ধত এবং নিষ্ঠুর। আমাদের দলকে একবার পরাস্ত করেছিলেন, তারপরে আরও একটি দলকে আপনারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন! অতএব, আমার উত্তর একটাই “না”।”

কিন্তু আপনি তো গতকাল নিজেই গিয়েছিলেন সহমর্মীতার বার্তা নিয়ে, তাহলে আজ আমাদের প্রত্যাখ্যান করছেন কেন?”

স্মিত হাস্যে পিতা পশুপতি বললেন, “প্রত্যাখ্যান তো করিনি মা, যেটা সত্য সেটাই বললাম। এখনকার দুর্বলতা থেকে তোমাদের দলকে বের করে আনতে হবে, তোমাকেই। আমরা তোমাদের বড়ো জোর সাহায্য করতে পারি, কিন্তু বহন তো করতে পারি না। তাছাড়া...”।

বৃদ্ধ গিরিজ অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাছাড়া?”

হাসিমুখে পিতা পশুপতি বললেন, “আমরা কোনদিন, কোনখানে আবার হয়তো মিলিত হব। কিন্তু সেই সাক্ষাতে আমরা গণ-হত্যার লড়াইতে সামিল হব, নাকি মৈত্রীর গণ-আলিঙ্গনে আবদ্ধ হব - সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনার দলের আচরণের ওপর”।

দলের সকলেই তখন রওনা হওয়ার অপেক্ষায়, পিতা পশুপতি ওঁদের দুজনকে নমস্কার করে, দলের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁর দলের অন্য সকলেও জোড়হাতে নমস্কার করল তাঁদের দুজনকে। গিরিজ ও তাঁর কন্যা জোড়হাতে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির দিকে এবং তাঁর দলটির দিকে। মিত্তিকার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এল অশ্রুতে, তিনি অস্ফুটে বললেন, “খুব শিগ্‌গিরি আমাদের আবার দেখা হবে, বাবা, আমাদের বড়ো প্রয়োজন আপনাকে”।

 

আজ সকালে সেই গিরিজ আর মিত্তিকা হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন? কী বলতে চান ওঁরা?

 

১.৪.১ বিশ্বাসের বার্তা 

ঊষি খাবার জল, আর শালপাতায় মুড়ে কিছু শুকনো ফল এনে দিল দুই অতিথির জন্যে। কিশোরী মেয়েটির আন্তরিক আতিথ্যে মুগ্ধ হলেন, গিরিজ ও মিত্তিকা।

কিছুক্ষণ পর গিরিজ বললেন, “আপনারা রওনা হওয়ার কিছুদিন পরেই আমরাও আপনাদের অনুসরণ করে বেরিয়ে পড়লাম। মাসখানেক হল সামনের ওই পাহাড়ের উত্তরে আমরা স্থিতু হয়েছি। আমাদের ছোট দল, তাই নিরিবিলি নিরাপদ ছোট এলাকাই খাদ্য-সংস্থানের পক্ষে যথেষ্ট। আপনাদের এলাকা এপাশে, পাহাড়ের দক্ষিণে, কাজেই আপনাদের এলাকায় আমাদের অনধিকার অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আমাদের অভিপ্রায় ছিল, আপনাদের ওপর কোন উপদ্রব না করেও, আপনাদের কাছাকাছি থাকা। কাছেই আছি, আমরা সূর্যোদয়ের আগেই রওনা হয়েছিলাম, পৌঁছলাম এখন”।

বৃদ্ধের কথায় পিতা পশুপতি মনে মনে খুশিই হলেন। তিনি হাসলেন, বললেন, “বেশ করেছেন। আজকাল আমি আর দলের সঙ্গে জঙ্গলে যাই না। ছেলেমেয়েরা, নাতিনাতনিরাও যেতে দেয় না। সারাদিন অলস বসে থাকি। অন্যদিন আমি এরকম সময়ে কাছাকাছির জঙ্গলে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। গাছগাছড়া, লতাগুল্ম, শাকপাতা খুঁজি, দেখি। আজকে এই নাতনিটির পাল্লায় পড়ে সেও আর হল না। এর মধ্যে আপনারা এসে পড়ায় ভালই হয়েছে। বাইরের অনেক কথাই জানা যাবে, শোনা যাবে। আমারও সময় কাটবে”।

মিত্তিকা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়ান? আপনার ভয় করে না?”

মিত্তিকার দিকে স্মিতমুখে তাকিয়ে পিতা পশুপতি বললেন, “ভয় তো করেই, সর্বদাই করে। দলের সঙ্গে জঙ্গলে শিকার করতে ভয় করে। মাটি খুঁড়ে কন্দ বের করার সময় ভয় করে, পেছনে কেউ ওঁৎ পেতে বসে নেই তো? রাত্রে গভীর ঘুমের মধ্যেও অচেনা শব্দে ভয় করে। ভয়, আতঙ্ক, বিপদের আশঙ্কা এবং দুশ্চিন্তা নিয়েই আমাদের নিত্য জীবনধারণ – জন্মের রোমাঞ্চ, জীবনের দুঃখ-সুখ এবং অবশেষে উদাসীন মৃত্যু!”

মিত্তিকা এবং গিরিজ দুজনেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের দিকে। অদ্ভূত আর আশ্চর্য কথা বলেন এই মানুষটি, মন দিয়ে শুনতেই হয়। ওঁর কথাবার্তা এবং আচরণে রয়েছে আশ্চর্য এক প্রত্যয়, নিশ্চিন্ত এক ভরসা।

মিত্তিকা জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু আপনি একলা একলা ওই জঙ্গলে কী খোঁজেন?”

পিতা পশুপতি একটু লাজুক হাসলেন এবার, বললেন, “জঙ্গলে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই। গাছগাছড়া খুঁজি। সন্ধের পর এই গাছতলাতেই বসে আকাশ-পাতাল ভাবি। আকাশ দেখি। চাঁদ আর অজস্র তারা, নক্ষত্রে ভরা বিশাল আকাশ। সেখানেও খুঁজে বেড়াই, আমাকে, আমাদেরকে!” মিত্তিকা অদ্ভূত এই মানুষটির থেকে তাঁর নতুন ভাবনার কথা শুনতে চাইছিলেন, খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু কী খুঁজে পেলেন”?

কিছু কিছু পেয়েছি, কিছু কিছু পাচ্ছি, তবে বেশির ভাগই মনে হচ্ছে না-পাওয়া থেকে যাবে, এক জীবনে সবটা পেয়ে যাব, এমন তো হতে পারে না, মা। এই গাছ-গাছড়ার কথাই ধর না। প্রত্যেকদিনের জীবনে আমাদের ছোটছোট চোট-আঘাত, রোগ-বালাই, লেগেই থাকে, অন্য পশুদেরও থাকে, কিন্তু তারা আমাদের মতো চট করে কাহিল হয়ে যায় কি? যায় না। এই অরণ্যই লুকিয়ে রেখেছে তার উপশম, আমরা জানি না, কিন্তু পশুরা জানে। আমি ওদের লক্ষ্য করি, ছোটখাটো রোগভোগের আরোগ্য”।

গিরিজ বললেন, “ছোট-খাটো ক্ষত-আঘাতের উপশমে কোন কোন গাছের পাতা, গাছের রস তো আমরাও ব্যবহার করি, এমন আরও আছে নাকি?”

পিতা পশুপতি বললেন, “আছে বৈকি, অনেক আছে, আপনারা কিছু জানেন, আমরা কিছু জানি, অন্যান্য দলের মানুষরাও জানে। এই সব জানা যদি একত্র করা যায়! আমরা দেখা মাত্র বিবাদ না করে, আলাদা থেকেও যদি একে অন্যকে সাহায্য করি, তাহলে মঙ্গল সবার – আমার, আপনার, সকলের...”।

গিরিজ বললেন, “তা কী সম্ভব? আপনি কত মানুষকে বোঝাতে পারবেন, আর বুঝবেই বা কেন? আমরাই কী আপনার কথা শুনতাম, ঘটনাচক্রে আমরা যদি দুর্বল না হয়ে পড়তাম?”

পিতা পশুপতি বললেন, “ঠিক কথা, ক্ষমতার অহংকারে মানুষ উন্মত্ত হয়ে যায়। তখন সে ভাবে, সে যা করছে, ঠিকই করছে। আসলে সে যে কিছুই করছে না, পেছন থেকে কেউ একজন তাকে চালনা করছে, সেটা সে ভুলে যায়। খুব বড়ো কোন মাশুল গুনে দেবার পর তার ভুল ভাঙে”।

গিরিজ ভারি অবাক হলেন, বললেন, “সে আবার কী? আমাদের পেছনে কে আছেন, যিনি আমাদের চালনা করছেন? এই যে আমি এবং আমার মেয়ে আপনার কাছে আজ এসেছি, অথবা আপনি যে অসুস্থ মানুষের উপশম খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আকাশ দেখছেন। এসব অন্য কেউ করাচ্ছে? কে? কই আপনার পিছনে কাউকে দেখছি না তো?”

পিতা পশুপতি স্মিত হাসলেন, বললেন, “তাঁকে তো দেখা যায় না। যাঁকে দেখা যায়, তাঁকে আমরা নিজের লোকের মতো কখনো আদর করি, কখনো রাগ করি, কখনো বা অবহেলা করি। আর যাঁকে দেখা যায় না, তাঁকে আমরা ভালবাসতে পারি, ভয় পেতে পারি কিংবা শ্রদ্ধা করতে পারি। কিন্তু কখনও অবহেলা করতে পারি না”।

গিরিজ হতবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, মিত্তিকা জিজ্ঞাসা করলেন, “যাঁকে দেখতেই পান না, তাঁকে আপনি ভয় বা শ্রদ্ধা করবেন কী করে? তিনি যে আছেন সেটা বুঝছেন কী করে?”

পিতা পশুপতি শান্ত ধীর স্বরে বললেন, “তিনি আছেন, আমাদের অন্তরে, আমাদের চিন্তায়, তাঁকে শুধু অনুভবই করা যায়”! গিরিজ এবং মিত্তিকা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের দিকে, এমন আশ্চর্য বার্তা তাঁরা কেউ কোনদিন শোনেননি। তাঁদের সমস্ত শরীর শিউরে উঠল, তাঁদের মনের ভেতরে এমন কী কেউ সত্যি বসে আছেন? যাঁকে দেখা না গেলেও, তিনি সব কিছু দেখছেন? তিনিই আমাদের হাসাচ্ছেন, কাঁদাচ্ছেন, সব কাজ করাচ্ছেন! মিত্তিকা অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাঁকে শুধু অনুভবই করা যায়? কিন্তু কী ভাবে অনুভব করব?”

পিতা পশুপতি স্মিত মুখে বললেন, “বিশ্বাস। যে বিশ্বাস করে, তিনি তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেন না”!

ওঁনারা সকলেই এখন আলাপে মগ্ন রয়েছেন। ততক্ষণ আমরা, কোন পরিস্থিতিতে মানুষের মনে অধরা এই ধারণা - যার নাম বিশ্বাস - সৃষ্টি হল, সেটা একটু ভেবে দেখা যাক।

...চলবে...


রবিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৫

রতনে রতন চেনে

 

বেকার যুবকের কথা বা গল্প অনেক হয়ে গেছে এরপরেও আরো হয়তো হতে থাকবে। কিন্তু বেকার বালকের কথা আমি অন্ততঃ কোনদিন শুনিনি তবে প্রায় মাস তিনেক বেকার জীবনের আস্বাদ উপভোগ করেছিলাম আমার বালক বয়সেই।

আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত মর্নিং সেসন ছিল - ক্লাস সিক্স থেকে ডে। কাজেই ক্লাস ফাইভের সিনিয়ার মোস্ট বাচ্চারা, ক্লাস সিক্সে উঠলেই হয়ে যেত জুনিয়ার-মোস্ট বড়। এই বড় হবার একটা আলাদা আমেজ সঞ্চারিত হচ্ছিল আমার মধ্যে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে স্কুল ড্রেস পরে বাচ্চাদের মত বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে সারাটা দিন বাচ্চাদের মত মায়ের সঙ্গে ঘুর ঘুর করা। আমার ঘুম না আসা দুপুরে মায়ের হাতের মিঠে চাপড়ি খেয়ে ঘুমের অভিনয় করা। মা ঘুমিয়ে পড়লেই সারাটা দুপুর চুপিচুপি বিস্তর উনখুটে কাজ সারা - হোমিওপ্যাথির মিষ্টি মিষ্টি গুলি, শুকনো হরলিকস, ডবল বিস্কুটের মাঝে মাখন চেপে বিস্কুটের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসা মাখন লেহন... অর্থাৎ মকখন চোর, নন্দকিশোর হয়ে থাকাটা আর ভাল লাগছিল না।

ক্লাস সিক্সে উঠলে দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বসে ভাত খেয়ে বড়দের মতো বেরিয়ে যাবো। যেমন বাবাও একটু আগে অফিস বেরোন। বিকেল বেলা বিদ্যের বোঝা নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফিরব, যেমন বাবাও সারাদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে ফেরেন একটু সন্ধ্যের পর। মনে হত - বড় হতে এমন কি আর দেরি, কতটাই বা বাকি আর?

 সে স্বপ্নে বাদ সাধল, যেদিন আমরা ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রুটিন নিতে স্কুলে গেলাম। সেটা সত্তর সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তা হবে। রুটিন নিয়েই আমাদের ছুটি হয়ে যাবে সাতদিনের জন্যে - পড়ার ছুটি। তারপর পরীক্ষা, আবার ছুটি, পরের বছর জানুয়ারির দশ এগারো করে রেজাল্ট বেরিয়ে গেলেই নতুন ক্লাস, নতুন বই আর নতুন ধরনের এক বড়সড়ো জীবনের সূত্রপাত।

 অন্যদিন স্কুলের বেশ কিছুদূর থেকেই ছেলেদের চেঁচামেচি আর হৈচৈতে স্কুলকে স্কুল বলে মনে হত। সেদিন একদম চুপচাপ - থমথমে ভাব। শোলে রিলিজ হতে তখনো অনেক দেরি, নাহলে বলা যেত ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায়, ভাইইই?  স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকেই সিঁড়ির মুখে একটা ব্ল্যাকবোর্ড – চার ঠ্যাং সাপোর্টে দাঁড় করানো, তাতে লেখা

বিশেষ বিজ্ঞপ্তি

এতদ্বারা সকল অভিভাবকবৃন্দ ও ছাত্রগণকে জানানো যাইতেছে যে অনিবার্য কারণবশতঃ এবং পঃ বঃ সরকারের মাননীয় শিক্ষা অধিকর্তার নির্দেশ অনুসারে বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণীর পঠনপাঠন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকিবে। সকল শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষাও আপাততঃ স্থগিত থাকিবেবিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হইবার তারিখ পঃ বঃ শিক্ষা দপ্তরকর্তৃক সংবাদপত্র ও বেতার মাধ্যমে পরিজ্ঞাত হইবে এবং তদনুসারে স্থগিত সকল বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচী বিদ্যালয় হইতে সংগ্রহ করিতে হইবে।

অনুমত্যনুসারে

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ

 

আমরা মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে নোটিসটা বেশ বার কয়েক পড়ে ফেললাম। যেটুকু বোধগম্য হতে বাকি ছিল অভিভাবকদের আলাপ আলোচনা ও কথাবার্তা থেকে সেটাও বুঝে ফেলা গেল। কিন্তু আমাদের হতভম্ব ভাবটা কাটাতে ভাস্করদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সদাহাস্যমুখ উৎকলবাসী ভাস্করদার আমাদের স্কুলের মেন গেট সামলানোর দায়িত্ব ছিল। বছরের পর বছর আমাদের মতো ছেলেপুলেদের বেয়ারা বায়নাই হোক অথবা বাইরের লোকের উটকো হম্বিতম্বিই হোক ভাস্করদা সবকিছুই সামলাত হাসিমুখে এবং স্কুল চলাকালীন ভাস্করদা ছিল নিশ্ছিদ্র প্রহরী - হেডস্যারের বিনা অনুমতিতে ভেতরের জিনিষ বাইরে অথবা বাইরের জিনিষ ভেতরে আসতে পারত না।

 কিছুটা বাংলা আর অনেকটা ওড়িয়া ভাষায় ভাস্করদা বলেছিল গতকাল স্কুল ছুটির পর - প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, কয়েকজন ছোকরা হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করতে চায়।  কি দরকার জিগ্যেস করাতে তারা কোন এক কলেজের নাম বলেছিল। এমন তো আসেই অনেকে - অন্য স্কুল থেকে, কলেজ থেকে ভাস্করদা গেট খুলে দিয়েছিল। ছেলেগুলো হেডস্যারের ঘরের দিকে না গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠেছিল সিঁড়িতে। হতচকিত ভাস্করদা তাদেরকে ডেকে কিছু বলার আগেই তারা উঠে গেছে ওপরে। ভাস্করদার সন্দেহ হতে অন্য সবাইকে নিয়ে যখন ওপরে খুঁজতে যায় তাদের সে সময়ে ভিতরের উঠোনের দিক থেকে পর পর দুটো বোমা ফাটার বীভৎস আওয়াজ শুনতে পায়। ওরা বুঝতে পারে আমাদের স্কুল সত্তরের ছাত্র আন্দোলনে আক্রান্ত।

এতদিন আমরা জানতাম না, কোন ঘরে আমাদের পরীক্ষার কোয়েশ্চেন ছাপা হয়ে সংরক্ষিত হতো। সেদিন জানলাম। কারণ সেই ঘরের দরজাটা ভাঙা এক কব্জায় ঝুলছে। ঘরের ভিতরে বাইরে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে পোড়া কাগজের ছাই, আধপোড়া প্রশ্নপত্রের প্যাকেট। ঘরের ভিতরের দেওয়ালে, সিলিংয়ে আগুনের আঁচে কালো কালো ঝলসানো দাগ। ওপরের বারান্দা থেকে ছোঁড়া বোমা ফেটে উঠোনের ঝলসে যাওয়া দাগ দুটোও দেখলাম।

 রোজ স্কুলে এসে বা টিফিনের সময় আমরা ওই উঠোনে লেম-ম্যান খেলতাম। লেম-ম্যান এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদেরকে ধরার চেষ্টা করবে। একটা গন্ডির মধ্যে সীমিত থাকত সেই খেলা। গন্ডির বাইরে চলে গেলে বা লেম-ম্যান ছুঁয়ে দিলে যে আউট  হতো সেই হতো পরবর্তী লেম-ম্যান। ছাত্র আন্দোলনের একটা বোমা ফেটেছে আমাদের সেই গন্ডির মাঝখানেই প্রায়।

বারান্দায় ঘরের বাইরের দেওয়ালে স্লোগান লিখে গিয়েছিল তারা। সেখানে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার ছিল। ছিল চীনের চেয়ারম্যানকে আপন করে নেবার দায়িত্বপূর্ণ আব্দার। বন্দুকের নলই যে শক্তির একমাত্র উৎস আমাদের সে তথ্য দিতেও তারা ভুল করেনি সেখানে। বিপ্লবের দীর্ঘজীবনের প্রতিও সংশয়ের অবকাশ রাখেনি তারা। সবশেষে তারা লিখে গিয়েছিল একটি ধাঁধা – ‘রতনে রতন চেনে / বিড়লা চেনে জ্যোতি

 কলকাতায় তখন দারুণ টালমাটাল পরিস্থিতি। রোজ শেষ রাত্রে পাড়ায় পুলিশ আসে। তাদের পায়ের ভারি বুটের শব্দে ঘুম ভাঙা চোখে আর ঘুম আসে না। সকালে দুঃসংবাদ কানে আসে। কোন কোন তরুণ কোন কোন যুবক আন্দোলনে যুক্ত সন্দেহে ধৃত। অনেক সময়েই তাদের কোনভাবেই আর হদিশ মেলে না। আমার বাবা আর মা পরামর্শ করে ঠিক করলেন আমাদের বর্ধমানের গ্রামে মামারবাড়িতে পাঠিয়ে দেবার। মাও থাকবেন আমাদের সঙ্গে। বাবা আমাদের পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় ফিরবেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাবা খবর দেবেন এবং আমাদের আবার নিয়ে আসবেন কলকাতায়।

 প্রায় মাস তিনেক থাকতে হয়েছিল মামার বাড়িতেবইখাতার বোঝা নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে, কিন্তু সমস্ত রকমের লেখাপড়াহীন এক বেকার জীবন কাটিয়েছিলাম গ্রাম বাংলায়।    

 একদিন খুব ভোরে আমরা হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরে রওনা দিলাম বর্ধমান। পিছনে পড়ে রইল তপ্ত কলকাতা আর শান্ত শীতল আমার স্কুল। হিন্দু স্কুল। স্থগিত হয়ে গেল আমার চটজলদি বেড়ে ওঠার স্বপ্ন


তখন বুঝিনি আজ বুঝি - অনেক বড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিদিন, প্রতিটি ঘটনায় ঋদ্ধ হচ্ছিল অভিজ্ঞতা। যে পাঠ কোন স্কুলের সিলেবাসে নেই, সেই পাঠ যেন নিজে এসে মেলে ধরছিল তার রহস্য রূপ, শব্দ আর গন্ধ দিয়ে। যে রতন নেই কোনো জহুরির ঘরে, সেই রতন চিনে নেবার দায় এসে পড়ল আমার ছোট্ট দুই কাঁধে।

  -০০-

 

নতুন পোস্টগুলি

দাঁতের পোকা

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...