মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ১/৬

 

[এর আগের পর্ব এই সূত্র থেকে পড়া যাবে - ধর্মাধর্ম - ১/৫ ]


প্রথম পর্ব (৭০,০০০ বিসিই থেকে ১২,০০০ বিসিই) - ৬ষ্ঠ পর্বাংশ


১.৪.৫ দুই গোষ্ঠী-পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের সূচনা

মনস্থির করার পর পিতা পশুপতি তাঁর অতি প্রিয় চার কিশোরী নাতনীকে একান্তে ডেকে, প্রথমে তাদের কাছে অদ্ভূত এই প্রস্তাবের কথা উত্থাপন করলেন। স্বাভাবিকভাবেই, চারজনের প্রতিক্রিয়া ছিল সাংঘাতিক প্রতিকূল। তারা সকলেই একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠেছিল।

তাদের সকলের হয়ে ঊষি ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “বড়োবাবা, আমরা কী এমন অপরাধ করেছি, যে তুমি আমাদের দল থেকে বের করে দিতে চাইছ? আমরা কখনও তোমার বা কোন গুরুজনের অবাধ্য হইনি। জঙ্গলে শিকার কিংবা খাদ্য সংগ্রহের কাজে কখনও আলস্য করিনি। অসতর্ক হয়ে আমাদের বা দলের কাউকে বিপদে ফেলিনি। ঘরের কাজেও কখনো কোনদিন অবহেলা করিনি, সকলের সঙ্গে আমরা সমান উৎসাহ এবং আনন্দে সব কাজ করেছি। কখনও পরিবারের কারও সঙ্গে কলহ করিনি। আমাদের দলের বাচ্চাদেরও আদর, ভালোবাসা এবং যত্নের কোনও ত্রুটি করিনি। তুমি এসব জান আর জান বলেই আমরা সকলেই তোমার অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী। নাঃ, হয়তো আমরা ভুল বুঝেছিলাম। আমরা তোমার প্রিয়পাত্রী তো দূরের কথা, এখন মনে হচ্ছে, আমাদের প্রতি তুমি একান্তই বিরক্ত। নচেৎ এমন একটা অদ্ভূত প্রস্তাব তুমি কী করে করতে পারলে, বড়োবাবা? আমাদের ছেড়ে তুমি কী করে থাকবে, অথবা তোমাদের সকলকে ছেড়ে আমরাই বা কী করে থাকব? অন্য একটি পরিবারের অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে”?

পিতা পশুপতি চার কন্যার অভিযোগ মন দিয়েই শুনছিলেন। ওঁদের কথায় তাঁর বুকের ভেতরেও ভীষণ এক কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠছিল বারবার। ওদের চারজনের উত্তেজনা কিছুটা স্তিমিত হলে, তিনি স্মিতমুখে বললেন, “তোরা চারজনই আমার পাঁজরের চারখানি হাড়, তোদের থেকে বেশি প্রিয় এই পরিবারে আমার কাছে আর কেউ নয়। তোরা যে যে কাজ এবং যে যে দায়িত্ব পালনের কথা এতক্ষণ বললি, সে কথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে? আর সেই জন্যেই, অন্য পরিবারে যাওয়ার কঠিন দায়িত্বটা তোদের মধ্যে দুজনকে দিতে চাই। তবে ওদের দলে যাওয়া বা না যাওয়ার ব্যাপারে আমি কখনোই তোদের জোর করবো না। এটুকু নিশ্চিত জানিস। 

চারজনের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে পিতা পশুপতি আরও বললেন, “যে কথা এখন তোদের বলব, তার সবটা এখনই তোরা বুঝবি না। যখন আমি থাকবো না, তোরা আরও বড় হবি, তখন বুঝবি। একই পরিবারের ঘনিষ্ঠ পুরুষের সন্তান ধারণ মোটেই মঙ্গলদায়ক নয়। যদিও এমনটাই চলে আসছে বহু প্রজন্ম ধরে, বহু বহু বছর ধরে। কিন্তু এই প্রথা বহু বছর ধরে চলে আসছে বলেই আজও আমরা তাকে টেনে নিয়ে চলব কেন? সেই প্রথাকে ভাঙার আমাদের কাছে যখন প্রথম একটা সুযোগ এসেছে?

তোরা আমাদের সকলেরই প্রিয়। তোরা যদি অন্য কোন পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হস, সেই পরিবারের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ থাকবে কি? তোরা যদি ওদের পরিবারে গিয়ে সুস্থ সুন্দর সন্তানের জন্ম দিস, তোরাও হয়ে উঠবি ওই পরিবারের নয়নের মণি। সেক্ষেত্রে ওরাও আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা কোনোদিন ভাববেও না। তখন আমরা দুই পরিবার মিলে হয়ে উঠবো একটাই পরিবার – বৃহত্তর পরিবার। বিপদে-আপদে, দুঃখে, শোকে আমরা একে অপরের সহায় হব। আমাদের আনন্দ, সুখ, আমাদের হাসি, সব আমরা একসাথে ভাগ করে নেব।

বয়স্ক গুরুজনদের থেকেই, যে কোন পরিবারের প্রতিটি সদস্য জ্ঞান, আচরণ এবং সংস্কার শেখে। শৈশব থেকেই তারা তাদের বড়োবাবা-দিদিমা, বাবা-মায়ের কথা শুনে, তাদের অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে করতেই বেড়ে ওঠে। কাজেই পরিবারভিত্তিক এই জ্ঞান বা সংস্কারের একটা সংকীর্ণতা আছে। আমাদের পরিবারেই ধর, তোরা সকলেই বিশ্বাস করিস, তোদের বড়োবাবা কত কী জানে। এমনটি আর জগতে কোথাও নেই! কে বলেছে, আমার থেকে অনেক বেশি জানা লোক অন্য দলে নেই? কে বলেছে, মানুষের অন্য দলগুলি আমাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান বা উন্নত নয়? কিন্তু আমরা সেকথা চিন্তা করি না। আমরা মনে করি এই জগতে আমরাই সেরা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দুই পরিবারের এই বন্ধনে, বেড়ে উঠবে আমাদের জ্ঞান, প্রসার ঘটবে আমাদের ভাবনা চিন্তার। হয়তো দুই পরিবারের ভাবনা মিলে উন্নতি এবং মঙ্গলের পথে আমরা অনেক দ্রুত চলতে পারব।

 

তবে যাই বলি না কেন, এ সবই ভবিষ্যতের কথা, আমাদের কথা নয়। তোদেরও পরের প্রজন্ম, তোদের সন্তানদের কথা। সেই অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমি এমন প্রস্তাবে তোদের সম্মত হতে বলছি। আমি শপথ করে বলতে পারি, তোদের হাত ধরেই গড়ে উঠতে পারে মানুষের অনেক বড়ো আর ব্যাপ্ত একটা সমাজ। তারা ছোট্ট একটি এলাকার গণ্ডিতে বন্দী থেকে, পরষ্পরের মধ্যে সর্বদা বিদ্বেষের লড়াইতে মগ্ন না থেকে, একত্রে জয় করবে এই বিশাল জঙ্গল, দূরের ওই পাহাড়, সব…”।

দীর্ঘ বক্তৃতার পর পিতা পশুপতি একটু থামলেন, গভীর দৃষ্টিতে চার নাতনীর নত মুখের দিকে তাকালেন, তারপর আবার বললেন, “আমার কথা যা ছিল, সব তোদের বললাম। এখন চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিবি তোরা। কোন তাড়াহুড়ো নেই, আজ চাঁদের একাদশ দিন, গিরিজ আর মিত্তিকা আসবেন পূর্ণ চন্দ্রে, তার আগে আমাকে জানিয়ে দিস তোদের মতামত”।

শুধু ওই চারকন্যাকেই নয়, সেদিন রাত্রে, মশাল-জ্বলা আধো অন্ধকার অঙ্গনে বসে, পিতা পশুপতি তাঁর দলের সকলের কাছেই তাঁর একই প্রস্তাবের কথা বললেন। প্রথমতঃ সকলেই তাঁর এই অদ্ভূত প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ –আহত হয়ে উঠেছিল, প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল। তারপর এই প্রস্তাবের পেছনে তাঁর ভবিষ্যত লক্ষ্যের যুক্তি শুনে, সকলেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে নীরব হয়ে রইল। তিনি তাদেরও চিন্তাভাবনার সময় দিলেন, চাঁদের চোদ্দ দিন পর্যন্ত।

কিন্তু কেউই পিতা পশুপতির কাছে, তাদের মতামত স্পষ্ট জানাতে পারল না। পূর্ণচন্দ্রের দিন সকালে সকলেই যখন জঙ্গলে শিকার এবং সংগ্রহের জন্যে বেরিয়ে যাচ্ছে, পিতা পশুপতি, চার কন্যাকে নিষেধ করলেন। বললেন, “তাঁদের প্রস্তাবে আমরা সম্মত হই বা না হই, তাঁরা আমাদের সম্মানীয় অতিথি, তাঁদের সাদর আপ্যায়ন হওয়াটা জরুরি”। পিতা পশুপতির কথা মেনে চার কন্যা রইল, তাদের সঙ্গে রইল, ওদের মায়েরাও। পিতা পশুপতি স্মিতমুখে মেনে নিলেন, তিনি বুঝতে পারলেন, মায়েরা চাইছেন, তিনি যেন মিত্তিকাদের সামনে কোনভাবেই কন্যাদের প্রভাবিত করতে না পারেন। তিনি মনে মনে পাথর-আত্মাকে স্মরণ করে হাসলেন। তাঁর যদি এমনই ইচ্ছা হয়, পিতা পশুপতি কিংবা তাঁর পরিবারের সাধ্য কি, তাঁকে আটকানোর? আর যদি তাঁর ইচ্ছা না হয়, যে যতই চেষ্টা করুক, কিছুই হতে পারবে না।

মেয়েরা এবং তাদের মায়েরা থাকায় ভালই হয়েছিল। সেদিন ওই গিরিজ এবং মিত্তিকা ঠিক সময়েই এসেছিলেন এবং ওঁদের সঙ্গে এসেছিল, মিত্তিকার দুই পুত্র। বিহি আর হানো – যারা ওই দুই কন্যার পাণিপ্রার্থী, অতএব যথাসম্ভব আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রইল না।

পিতা পশুপতি আজ গিরিজকে নিয়েই অশ্বত্থ গাছের নিচে বসলেন। আর লক্ষ্য করলেন, তাঁর চার নাতনী, তাদের মায়েরা, মিত্তিকার সঙ্গে আন্তরিক আলাপে মগ্ন। আর মিত্তিকার পিছনেই বসে আছে তাঁর পুত্রদুটি।

পিতা পশুপতি নানান চিন্তায় আজ অন্যমনস্ক, কিন্তু গিরিজ কথা বলছিলেন অনর্গল, “কী সব দিনকাল পড়ল। আগের তুলনায় আবহাওয়া আর জঙ্গলের কত পরিবর্তন হয়ে চলেছে। তাঁর ছোটবেলায় ফুল আর ফলে ভরে থাকত বনের গাছপালা। খাবারের কোন অভাব দেখেননি কোনদিন। যে কোন জঙ্গল থেকে সামান্য সময়েই প্রচুর ফল সংগ্রহ করা যেত অনায়াসে। আর সে ফলের কী স্বাদ আর মিষ্টতা ছিল!  এখন আর তেমন কই, ফলে সেই স্বাদও নেই, সেই রসও নেই। আজকাল এক একটা ফল খেয়ে বোঝাই যায় না, সেটা কোন ফল, সবই কেমন একই রকম স্বাদ আর গন্ধ। আর পশুরা, সেও ছিল বটে সে সময়। প্রত্যেকদিন দু একটা পশু যেন শিকার হওয়ার জন্যে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ত। প্রচুর নরম তুলতুলে মাংস, আর পুরু চর্বির পশু হত সব। পাথরের ছেনি দিয়ে তাদের হাড় ফাটিয়ে মজ্জা খাওয়ার মজা তো আজকালকার ছেলে-মেয়েরা বুঝলই না। আজকালকার পশুর মাংস যেন শুকনো ছিবড়ে, চিবিয়েই চলেছেন, কিছুতেই তাকে বাগে আনা যায় না”।

পিতা পশুপতি স্মিত মুখে গিরিজের কথা শুনছিলেন, মাঝে মাঝে তাঁর কথার সমর্থনে দু-একটি কথা বলছিলেন। কিন্তু তাঁর মন পড়েছিল মেয়েদের আর ওই ছেলেদুটির দিকে। তিনি দেখছিলেন, মেয়েদের সঙ্গে গল্প-গুজবে ছেলেদুটিও এখন যোগ দিয়েছে। তাদের সকলের মুখেই সকালের রোদ্দুরের মতোই উজ্জ্বল হাসি।

মিত্তিকার পরিবারে তাঁদের দুই কন্যা যাবে কিনা এখনো নিশ্চিত নয়, কিন্তু দুই পরিবারের মধ্যে অন্তরঙ্গ এক সম্পর্কের যে সূচনা হচ্ছে, তাতে নিঃসন্দেহ হলেন পিতা পশুপতি।                 

 

১.৫.১ চারি চক্ষুর চোরা-চাহনি

প্রথম আলাপে জোড়হাতে নমস্কার বিনিময়ের পরেও মেয়েরা তেমন সহজ হতে পারেনি। মিত্তিকার দুই পুত্রকে তারা দেখল। তারাই কিনা সেই দুই পুরুষ, যাদের জন্যে ওদের মা এই পরিবারের দুই কন্যাকে চেয়েছেন! সুঠাম পেশিবহুল বলিষ্ঠ চেহারা, তাদের পরনের পাতার পোষাকে আবার লতানে ফুলের কারুকাজ। তাদের মাথার ঝুঁটিতে গাঁথা নানান পাখির রঙচঙে পালক, দুজনের গলাতেই শুকনো লতায় বাঁধা শেয়ালের কয়েকটি নখ। সব মিলিয়ে চেহারার খোলতাই মন্দ নয়। তাদের পরিবারে পুরুষদের এমন সাজুগুজু করতে তারা কোনদিনই দেখেনি। মেয়েরা করে, তবে সে কোন বিশেষ উৎসব বা আনন্দের দিনে। ওদের ছেলেরা কি সর্বদাই এমন সাজুগুজু করে শিকারে যায়? তবেই হয়েছে আর কী! এই রঙচঙে পোষাক দেখলেই ছোট বড়ো শিকারের দল ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে, বহু দূর থেকে। তাদের পিছনে ছুটেও লাভ হবে না।

নাকি ওরা এই পোষাক আর সাজগোজ করেছে, এখানে আসবে বলে? আজ বিশেষ একটা দিন বলে? কিশোরী কন্যাদের মধ্যে অন্ততঃ দুজনের মনে হল, তারাই হয়তো ছেলেদুটির এই সাজের উপলক্ষ্য! প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা কন্যারা জানে, মিলন-ঋতুতে বহু পুরুষ পাখিই চোখ ধাঁধানো বর্ণময় হয়ে ওঠে। মহিলা পাখিদের মন জয় করার উদ্দেশে, প্রকৃতিই তাদের ওই ভাবে সাজিয়ে দেন। এই ছেলে দুটিও কি তাদের মন জয় করার জন্যেই এমন সুন্দর সাজে নিজেদের সাজিয়েছে? এ কথা মনে হতেই, তাদের দুজনের মনে কী যেন এক সুর জেগে উঠল, যে সুর এতদিন ঘুমিয়ে ছিল।

প্রথম দিকে কথাবার্তায় একটু আড়ষ্ট লাগছিল, ওদের ভাষার জন্যে। ওদের ভাষা একটু অন্যরকম, এদলের কথার সঙ্গে পুরোটা মেলে না, যদিও বোঝা যায়। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হলেও, আলাপ চলতে চলতে সড়গড় হয়ে এল। তখন বেশ মজাই লাগছিল ওদের নতুন ভঙ্গির কথা শুনতে। আর ওদের কথায় চমক রয়েছে বৈকি, কারণ সে কথা যে অন্য মানুষের, অন্য এলাকার! বিহি এখন বলছে, ওদের এলাকার কথা, সামনের ওই পাহাড়ের ওপাশে কিছুটা উঁচুনীচু, অনেকটা সমতল তৃণক্ষেত্র আর জঙ্গলের কথা।

ওদের এলাকার পাশেই ছোট্ট একটা নদী আছে। বর্ষার ঘোলা জলের নদীতে, বাপরে কী স্রোত! অথচ শীতে স্বচ্ছ জলের ধীর প্রবাহ। তখন নদীতে হাঁটু ভর জল, জলের তলায় সাঁতরে চলা মাছও পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। তখন বল্লমে গেঁথে কত মাছ শিকার করা যায়, আর সে মাছের তেমনি স্বাদ। আবার এখন এই গ্রীষ্মে নদীতে জল নেই বললেই চলে, পায়ের গোছ ডোবে না। নদী পার হয়ে অনায়াসে চলে যাওয়া যায় ওপারের জঙ্গলে।

আর যদি পাহাড়ে চড়ো, সেও ভারি মজার। জমি থেকে অনেক উঁচু, সেখানে গাছের তলায় একটু বসলে এই গরমেও খুব আরাম হয়। আর ওপর থেকে সামনে নিচের দিকে তাকালে কী যে মজা লাগে, সে আর বলার নয়। জঙ্গলের বিশাল উঁচু গাছগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট সবুজ ঝোপঝাড়, তাদের আলাদা আলাদা গাছ বলে মনেই হয় না। মনে হয় আমাদের পায়ের নিচে ভেসে রয়েছে এক বিশাল বড়ো আর ঘন সবুজ মেঘ। তৃণক্ষেত্রটাকে মনে হয়, ঠিক যেন ছোট্ট এই উঠোনটা, যেখানে বসে আমরা গল্প করছি। আর নদীটা?  সরু সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে দুপাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ওই রোদ্দুরের আলোয় নদীর জল যখন চিকমিক করে, মনে হয় আকাশের বিদ্যুৎ নেমে এসেছে মাটিতে।

আর ওই পাহাড়ের মাথা থেকে পিছনে তাকালে, চোখে পড়বে ছোট্ট ছোট্ট পাহাড় আর বড়ো পাথর ছড়ানো, বেশ রুক্ষ ধূসর জমি। বড়ো কোন গাছ নেই, ছোট ছোট ঝোপঝাড়, কাঁটাগাছে ভরা। আর তারপরে অনেকটা দূরে চোখে পড়ে গভীর সবুজ জঙ্গল। সেটাই এই জঙ্গল, যেখানে তোমরা থাকো।

ওই পাহাড় থেকে তোমরা বুঝি আমাদেরও দেখতে পাও? আমাদের এই বসতি?” চার কন্যার একজন, যার নাম ইশি, উৎসুক হয়ে জানতে চাইল।

হেসে উত্তর দিল হানো, “তাই বুঝি দেখা যায় অতদূর থেকে? সে যে অনেক দূর”।

আমাদের বসতিতে আসতে, তোমরা কী ওই পাথুরে পথেই এলে?” ঊষি জিজ্ঞাসা করল।

না, আমরা আসি সমতলের পথে, অনেকটা ঘুরে। ওই পাথুরে জমি ধরে এলে দূরত্ব হয়তো অনেকটাই কমবে। কিন্তু ওদিকে কোন পথ নেই যে। ঝোপের কাঁটায় পা ক্ষতবিক্ষত হয়। পাথরের আড়ালে আবডালে আছে প্রচুর বিষাক্ত সাপ আর কাঁকড়া বিছের বাসা। তাদের একটা ছোবল খেলে আর রক্ষে নেই। তাছাড়া ও পথে কোথাও এতটুকু ছায়া পাবে না। চলতে চলতে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে যে একটু জিরোবে, তার কোন উপায় নেই”। বিহি উত্তর দিল ঊষির চোখের দিকে তাকিয়ে।         

এই দলের ছেলেরা এমন নতুন এলাকার কথা তো বলতে পারবে না। এই দল যে এলাকায় বিচরণ করে, তার কথা প্রতিটি ছেলের মতো প্রতিটি মেয়েও জানে, চেনে তাদের নিজেদের হাতের তালুর মতো। সে কথায় মনে চমক আসে না। কিন্তু ছেলেদুটোর কথায়, তাদের মনে অচেনা একটা জগতের ছবি ভেসে উঠতে লাগল। পাহাড়, নদী, নদীর স্বচ্ছ জলে খেলে বেড়ানো মাছ, পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা নিচের নিবিড় দৃশ্য – সব মিলিয়ে তাদের মনে এখন অদ্ভূত এক রোমাঞ্চ। নতুন এলাকা, নতুন জীবন, নতুন সব মানুষ...।

 

মনের মধ্যে সদ্য ঘুম ভাঙা সুর এবার যেন বেজে উঠল, অচেনা পাখির সুরেলা ডাকের মতো।

 

তাদের পরিবারের বয়স্ক মানুষেরা, যেমন বড়োবাবা, জন্ম থেকে আজ অব্দি কাটিয়ে দিলেন, একই মানুষজনের গণ্ডিতে। তাঁর শৈশবে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, মা-বাবাকে দেখেছিলেন, বড়ো হয়েছেন অনেক ভাইবোনের সঙ্গে। আরো বড়ো হয়ে তিনি ও তাঁর ভাইবোনেরা বাবা-মা হয়েছেন অনেক সন্তানের, তাঁদের সেই সন্তানদেরই মেয়ে তারা চারজন। বড়োবাবা একদিন চলে যাবেন, চলে যাবেন তাদের বাবা-মা। এই পরিবারে আসবে তাদের সন্তান-সন্ততি... এইভাবেই অনন্তকাল চলতে থাকবে একঘেয়ে গণ্ডিবদ্ধ জীবনের চক্র। এই কথাই কী সেদিন বড়োবাবা তাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন? এই গণ্ডির বেড়া খুলে বেরিয়ে পড়তে বলেছিলেন, তাদের চার বোনের মধ্যে দুজনকে?                            

কিছুক্ষণ পরে, একটু সুযোগ পেয়ে চার বোন একত্র হল নিরিবিলি এক বকুল গাছের নিচে। তাদের নিভৃত আলাপে স্পষ্ট হল ওদের মধ্যে দুই বোন অন্য পরিবারে যাওয়ার ব্যাপারে একেবারেই নারাজ। কিন্তু অন্য দুই বোন, ঊষি আর ইশি – হ্যাঁ বা না, স্পষ্ট কিছুই বলল না। এ নিয়ে তারা কী ভাবছে জিজ্ঞাসা করায়, ঊষি কিছু বললই না, এমন একটা বিরক্তির ভঙ্গি করল, যেন এমন ফালতু আলোচনায় সে নেই। আর ইশি বলল, “ছাড় তো, খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, আমি এখন ওই নিয়ে ভাবতে বসেছি, আর কী?”

দুপুরের কিছু পরে, দলের লোকেরা শিকার ও সংগ্রহ সেরে জঙ্গল থেকে ফিরে এল। অতিথিদের সৌভাগ্যে, আজও তারা মনোমত শিকার পেয়েছে, বেশ বড়োসড়ো দুটি বুনো ভেড়া। সংগ্রহ করতে পেরেছে বেশ কিছু কন্দ-আলু এবং ফল। মহা আনন্দে হৈ চৈ করতে করতে, তারা সব্বাই লেগে পড়ল ভেড়া দুটির ছাল ছাড়িয়ে, আগুনে সেঁকে নেওয়ার প্রস্তুতিতে। মিত্তিকার ছেলেদুটি – বিহি আর হানোও লেগে পড়ল সমান উৎসাহে। এই পরিবারের লোকেরা আপত্তি তুলেছিল, অতিথি কাজ করবে কেন? বিহি হানো সে কথার উত্তরে বলল, “সবার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার আনন্দই আলাদা - বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি?” 

পিতা পশুপতি আর গিরিজ দুজনেই অঙ্গনের একধারে গাছের ছায়ায় বসে দেখছিলেন, ছেলে-ছোকরাদের উৎসাহ আর আনন্দ। তাঁদের দুজনের মুখেই প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি। তাঁর দুই নাতনী, ঊষি আর ইশির সঙ্গে মিত্তিকার দুই ছেলের সলাজ[1] আলাপের দৃশ্যগুলিও পিতা পশুপতির নজরে এড়াল না। কাজে ব্যস্ত থেকেও মেয়েদুটি কোন না কোন অজুহাতে ছেলেদুটির কাছাকাছি থাকতেই যেন পছন্দ করছে। তাঁর অধরের হাসি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর দুই চোখে, গালের কুঞ্চিত ত্বকে। ওই দুই সম্ভাব্য জুটির জন্যে তাঁর দুই চোখে এখন আশীর্বাদ। তিনি মুখ তুলে তাকালেন পাথর-আত্মার দিকে, তাঁর মনে হল, তিনিও হাসছেন।

সকলেই কাজে ব্যস্ত, তাই মিত্তিকা এখন কিছুটা অবসর পেলেন মহিলামহল থেকে, তিনি ধীরে ধীরে এসে বসলেন, পিতা পশুপতির পায়ের কাছে। গভীর আন্তরিকতা নিয়ে বললেন, “এসে থেকে আপনার সঙ্গে তেমন কথা বলার সুযোগই পাইনি, বাবা, আমার প্রস্তাবের কথা কিছু স্থির করলেন?”

পিতা পশুপতি মাথা নাড়লেন, বললেন, “এখনও কিছুই স্থির হয়নি, মা, যিনি স্থির করবেন, তিনি তাঁর কাজ করে চলেছেন, এখন শুধু অপেক্ষা”। গিরিজ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “যা কিছু কাজ করার ওরাই তো করছে, রান্নার যোগাড়-টোগাড়, ওদের মধ্যে কে স্থির করবে?” মিত্তিকা কিছু বললেন না, চোখে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলেন পিতা পশুপতির মুখের দিকে। পিতা পশুপতি মিত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওপরে তাকা, ওই যে, বড়ো ওই পাথরের মধ্যে দেখতে পাবি আমাদের বৃদ্ধ পিতামহের স্নেহমাখা মুখটি। নিবিষ্ট হয়ে, মনে বিশ্বাস এনে দেখ। উনিই আমাদের জীবনের সকল কার্য এবং কারণ নিয়ন্ত্রণ করেন। ওঁনার সহযোগ ছাড়া আমার সম্মতি দেওয়া কিংবা না দেওয়াতে কিছু এসে যাবে না। অপেক্ষা কর, যদি স্থির করার হয়, তিনি নিজেই যথা সময়ে সব স্থির করে দেবেন”।

গিরিজ এবং মিত্তিকা মুখ তুলে তাকালেন পাথরের দিকে, গিরিজ মাথা নেড়ে বললেন, “কই আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, আর পাঁচটা পাথর যেমন হয় তেমনই তো!” মিত্তিকা কিছু বললেন না, অনেকক্ষণ নিবিষ্ট তাকিয়ে থাকার পর চোখ বন্ধ করলেন, বেশ কিছুক্ষণ পরে অস্ফুট স্বরে বললেন, “আপনার পাথর-আত্মাকে আমার প্রণাম দেবেন। তিনি কি আমাদের কথাও শুনবেন, বাবা”?

দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে পিতা পশুপতি স্মিত মুখে বললেন, “আমাদের সঙ্গে তোদের পরিবারও যদি জুড়ে যায়, তিনি সবার কথাই শুনবেন বৈকি”। জোড়হাতে পাথর-আত্মাকে নমস্কার করে, মিত্তিকা বললেন, “আশীর্বাদ করুন, তাঁর কৃপা থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই”।

খাবার প্রস্তুত হয়ে এল, সকলের ডাক পড়েছে, অঙ্গনের মাঝখানে সবাই এসে বসল গোল হয়ে। সামনের বৃত্তে বসে, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, তাদের তর সইছে না। বড়োরাও এবার খাওয়া শুরু করলেন, তার সঙ্গে কথাবার্তা হৈচৈ চলতে লাগল। পিতা পশুপতির একপাশে গিরিজ, অন্যপাশে মিত্তিকা, আর মিত্তিকার পাশে দুই পুত্র বসেছে। পিতা পশুপতি লক্ষ্য করলেন, ঠিক উল্টোদিকেই বসেছে তাঁর দুই নাতনী, ঊষি আর ইশি। তারা অন্যদিন খেতে বসে খুবই কথা বলে, পিতা পশুপতি রোজই ওদের ওই কথা-কাকলি খুবই উপভোগ করেন। কিন্তু আজ তারা দুজনেই বড়ো বেশি শান্ত। তাদের দুজনেরই দৃষ্টি বারবার ঘুরে আসছে, এই দিকে, মিত্তিকার দুই পুত্র, বিহি আর হানোর দিকে। কিশোরী মেয়েদের এমন আচরণ তাঁর চোখেও নতুন। এই আচরণ কিসের ইঙ্গিত সেটা তাঁর কাছে খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু এই বয়সেও এর মাধুর্য তিনি অনুভব করছেন মনে। তাঁর মনে হল, তাঁদের কৈশোরে এমন অনুভবের সুযোগ তিনি পাননি। তাঁর প্রিয় দুই কিশোরী নাতনী এবং মিত্তিকার তরুণ পুত্রেরা এই অনুভবে সিক্ত হোক। পারিবারিক সম্পর্কের বাঁধাধরা নিয়মে নয়, পরবর্তী প্রজন্ম আসুক ভালোবাসা মাখা ওই চোরাচাহনির মিলনে।

 

১.৫.২ দিনশেষের বিদায়  

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে গেলে, সামান্য একটু বিশ্রামের পর, অতিথিদের বিদায় নেবার সময় এল। মিত্তিকা জোড়হাতে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর উপস্থিত সকলকে ডেকে বললেন, “আপনাদের আন্তরিক ব্যবহারে আমি, আমার পিতা এবং আমার দুই পুত্র সকলেই অভিভূত। আমি চাই আপনারাও কোন একদিন আমাদের বসতিতে এসে আমাদেরও এমন সেবার সুযোগ দেবেন। বড়ো আনন্দ পাবো। আপনাদের পিতা, এখন আমারও পিতা, তাঁকে আমিও ভালোবাসি ও শ্রদ্ধা করি। আমাদের দুই পরিবারের এই মৈত্রী যেন চিরকাল থাকে। এই মৈত্রী কথাটাও আমি শিখেছিলাম আপনাদের পিতার থেকেই। তাঁর থেকেই আরও শিখেছি জোড়হাতে মাথা নীচু করে সম্মান জানানোর প্রথা। আপনাদের পিতার কাছে আগের দিন আমি একটি অনুরোধ করেছিলাম। আমার এই দুই পুত্র, বিহি আর হানোর জীবনসঙ্গী হতে, আমি আপনাদের দুই কন্যাকে প্রার্থনা করেছিলাম। আপনাদের পিতা এখনও সম্মতি দেননি, কিন্তু আমি আপনাদের সবার থেকে সম্মতি চাইছি, আপনাদের দুই কন্যাকে...”।

পরিবারের যুবক-যুবতী এবং মধ্যবয়স্ক মেয়ে-পুরুষ বেশ কয়েকজন বলল, “এ হতে পারে না, এ অসম্ভব”। “আমাদের কোন মেয়েই অন্যদলে যেতে চাইছে না”। “আর যাবেই বা কেন, পিতা-পিতামহের দল ছেড়ে?” “একদল ছেড়ে অন্যদলে, কোন পশুও যায় না, আমরা তো মানুষ”। “আপনি এ অনুরোধ আর করবেন না, মিত্তিকাদিদি।”    

মিত্তিকা জোড়হাতে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনলেন। কোন কথা না বলে, তাকিয়ে রইলেন সকলের মুখের দিকে। পিতা পশুপতিও মাথা নীচু করে রইলেন, কোন কথা বললেন না। হঠাৎ তাঁর পায়ের কাছে এসে বসল তাঁর দুই নাতনি, অস্ফুটস্বরে ইশি বলল, “বড়োবাবা, আমাদের বাবা-মাকে বোঝাও না, আমরা তো ‘না’ বলিনি”।

পিতা পশুপতি মুখ তুলে সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। তারপর দুই নাতনীর হাত ধরে পাশে বসিয়ে স্মিতমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “‘না’ বলিসনি, তার মানে কী ‘হ্যাঁ’ বলছিস?” কিশোরী দুই কন্যা, বড়োবাবার প্রশ্নে লজ্জায় মুখ নামাল, বলল, “আমরা আর কিছু জানিনা, বড়োবাবা”।

মিত্তিকা ওদের কাছে এগিয়ে এলেন, দুই হাতে দুই কন্যাকে হাত ধরে তুললেন, দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “আপনারা অনুমতি দিন, আমি এই দুই কন্যাকে, ঊষি আর ইশিকে ভিক্ষা চাইছি”। পিতা পশুপতি সবার মুখের দিকে তাকালেন, মিত্তিকা ও তাঁর দুই নাতনীর দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর দলের সকলের দিকে, কিন্তু কিছু বললেন না। দলের মানুষরা তাদের দুই কন্যার এই আচরণে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। তারাও কেউ কোন কথা বলল না।

মিত্তিকা আবার বললেন, “আগামীকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষের শুরু, এই কাল শুভ অনুষ্ঠানের উপযুক্ত নয়। শুভ শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনে আমরা এখানে এসে, এই দুই কন্যাকে আমরা গ্রহণ করতে চাই। ওই দিন আমার দুই পুত্রের সঙ্গে আসবে আমাদের পরিবারের আরও সাত-আটজন। সপ্তম দিবসের সকালে আমরা কন্যাদের নিয়ে ফিরে যাবো আমাদের বসতিতে। আমার একান্ত অনুরোধ, আপনারা চন্দ্রের অষ্টম দিনে আমাদের বসতিতে আসুন। আপনাদের দুই কন্যার নতুন জীবন এবং নতুন পরিবারের মঙ্গল কামনা করুন। আজ চলি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা অনুমতি দেবেন। তবে আপনাদের সম্মতির কথা যত তাড়াতাড়ি জানতে পারব, অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ততই সুবিধা হবে”।

মিত্তিকা হাসিমুখে সকলকে জোড়হাতে নমস্কার করলেন, তারপর পিতা পশুপতির পায়ের কাছে বসে বললেন, “আজ চলি বাবা”। পিতা পশুপতি মিত্তিকার মাথায় হাত রেখে বললেন, “মঙ্গল হোক মা”। তার পরেই তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ওঁদের সঙ্গে দু-তিনজনকে পাঠানোর ব্যবস্থায়। মিত্তিকার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি, তিনি মানা করলেন, বললেন, “আজ আর প্রয়োজন হবে না, বাবা, সঙ্গে আছে বিহি আর হানো, ওরাই আমাদের নিরাপত্তার জন্যে যথেষ্ট”।

কিন্তু আমি যে খুব চিন্তায় থাকব মা”।

মিত্তিকার দুই পুত্রের মধ্যে হানো বলল, “চিন্তা করবেন না বড়োবাবা, আমরা বসতিতে পৌঁছেই আপনাদের বার্তা পাঠিয়ে দেবো”। ছেলেটির মুখের “বড়োবাবা” ডাকটি বেশ সুন্দর লাগল, উপস্থিত বড়দের কাছে, এমনকি পিতা পশুপতির কাছেও।

পিতা পশুপতির বড় ভাইপো, ঊষির বাবা, বার্তা পাঠানোর কথায় অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোমাদের পৌঁছতে তো অনেক রাত হবে, তারপরে বার্তা কী করে পাঠাবে?”

হানো বলল, “আমাদের কাছে বিশাল একটা ঢাক আছে, তার শব্দ বহু দূর দূরান্ত থেকেও শোনা যায়। রাত্রের দিকে কাছাকাছি পশুদলের উপস্থিতি টের পেলেই আমরা ওই ঢাক বাজাই, তার শব্দে পশুর দলও পালিয়ে যায়”।

সকলেই আশ্চর্য হয়ে শুনছিল, এখন ইশির বাবা, পিতা পশুপতির বোনের ছেলে, জিজ্ঞাসা করল, “ঢাক ব্যাপারটা কী? ঠিক বুঝলাম না তো?” বিহি বলল, “মরা গাছের বড়ো একটা গুঁড়ি কেটে আমরা বানিয়েছি, তার একদিক ছিল বন্ধ আর ভেতরটা ফাঁপা। তার ওপরটা চামড়ার ছাউনি লতা দিয়ে খুব শক্ত টানটান করে বেঁধে, লাঠি দিয়ে পেটালে আওয়াজ ওঠে ধ্বম্‌ম্‌, ধ্বম্‌ম্‌...রাত্রের দিকে সে আওয়াজ শুনলে বুকের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করতে থাকে”।

ওদের বল্লমগুলো দেখেছ, বাবা?” ইশি হানোর হাত থেকে তার বল্লমটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এই দ্যাখ, মোটা বাঁশের বল্লম, লতা দিয়ে তার আগায় বেঁধেছে পাথরের ধারালো ফলা, যেমন হাল্কা আর তেমনি মজবুত। একবার কোন শুয়োরের পাঁজরে এভাবে গেঁথে দিতে পারলে, তার পাঁজর ভেঙে যাবে বাবা”। মেয়েটি অদৃশ্য কোন পশুর গায়ে বল্লমটা গেঁথে দেওয়ার ভঙ্গি করল। পরিবারের সকলেই দেখল, সত্যিই তাদের কাঠের ছুঁচোল বল্লমের থেকে এই বল্লম অনেক বেশি মজবুত আর ধারালো। তাদের কাঠের বল্লমের ছুঁচোলো ফলা প্রায়ই ভেঙে যায়। দৌড়ে চলা পশুর মোটা চামড়া অনেক সময়েই ভেদ করতে পারে না। তারা দেখল নতুন প্রযুক্তি। তারা এও বুঝল, তাদের পরিবারের দুই প্রিয় কন্যাই মজেছে, মিত্তিকার দুই পুত্রে।

মিত্তিকা এবার ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, শেষ দুপুরের রৌদ্র এখন গাছের শীর্ষে, আর বিলম্ব করা মানে, জঙ্গলের দীর্ঘ পথে বিপদকে আমন্ত্রণ জানানো। তিনি পিতা পশুপতির কাছে গিয়ে বিদায়ের নমস্কার করে, সকলকেই নমস্কার করলেন। দলের অন্য সদস্যরাও বিদায়ের নমস্কার করল। বিহি আর হানোর হাতে তুলে দিল দুটি চর্বির মশাল, অন্ধকার পথে ওরা জ্বালিয়ে নেবে চকমকি (flint) পাথর ঘষে। ওদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে গেল, এ দলের চারজন ছেলে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গিরিজ, মিত্তিকা এবং তাঁর পুত্ররা দ্রুত মিলিয়ে গেলেন পায়ে চলা পথের বাঁকে।

ওরা চলে যাওয়ার পরে দলের সবাই ঘিরে বসল পিতা পশুপতিকে। তাদের এখন যত রাগ ঊষি আর ইশির ওপর। ওরা কেন ছেলে দুটোর সামনে অমন ঘোরাঘুরি করছিল। অন্য দলের অন্য পরিবারের অচেনা, অজানা দুটো ছেলে, তাদের সামনে এই পরিবারের যেন মাথা কাটা গেল। এর জন্যে তারা দায়ী করল পিতা পশুপতিকেই। তাঁরই আদরে মেয়েদুটো অসভ্য হয়ে উঠেছে। অন্য পরিবারে যাওয়ার বাজে হুজুগটা, উনিই তো ওদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন! কচি কচি বাচ্চা মেয়ে, ওরা কী জানে? কতটুকু দেখেছে ওরা জীবনের? ভালমন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গলের ধারণা ওদের কতটুকু হয়েছে? ওই দলের ওই বুড়ো আর ওই মহিলার কথায়, বাবার মতো এত বয়স্ক অভিজ্ঞ একজন মানুষের এতটা নেচে ওঠা মোটেই উচিৎ হয়নি।

পিতা পশুপতি মাথা নীচু করে শুনছিলেন, তাঁর ভাই-বোন, তাঁর এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের অভিযোগের কথা। পরিবারের সকলের অভিযোগ আর নিন্দায় মেয়েদুটি কী করবে বুঝতে পারছে না। তারা দুজনেই এসে বসেছে বড়োবাবার পিছনে। মুখ লুকিয়েছে তাঁর পিঠের আড়ালে। দুজনের চোখের জলে ভিজে উঠছিল তাঁর উন্মুক্ত চওড়া পিঠ। মেয়েদুটির প্রতি আরও বেশি স্নেহ ও ভালোবাসায় তিনি আপ্লুত হচ্ছিলেন। তিনি মনে মনে নিশ্চিত হলেন, এই দুই মেয়েই হবে মানুষের নতুন সমাজের জননী। তিনি হৃদয়ে অনুভব করলেন, পাথর-আত্মার এই বার্তা।       

 

১.৫.৩ অন্তরে বাজে ঢাকের বাদ্যি

পরিবারের মানুষগুলোর প্রাথমিক উত্তেজনা এবং আবেগ কিছুটা থিতিয়ে যেতে পিতা পশুপতি খুব শান্ত স্বরে বললেন, “আমাদের মেয়েরা কেন অন্য দলে যাবে, এতেই তোদের এত আপত্তি, তাই না? ঠিক আছে, আমি না করে দেব। আমাদের মেয়েরা আমাদের পরিবারের মধ্যেই থাকুক। ওদের খুড়তুতো বা মাসতুতো দাদার সঙ্গে থেকে সন্তান প্রসব করুক। তাতেই আমাদের পরিবারের মঙ্গল। তাতেই আমাদের পরিবারের সংস্কৃতি অটুট থাকবে। বাইরের দলের হাওয়া তার গায়ে যেন না লাগে, তাই তো?”

পিতা পশুপতির দুই পুত্র এবং কন্যারা সমস্বরে বলল, “একশ বার, উটকো অচেনা দলের রীতি-প্রথা একবার ঢুকে পড়লে, আমাদের পরিবারের সংস্কৃতি চুলোয় যাবে”।

তার মানে, আমাদের পরিবারের সংস্কৃতি খুবই পলকা, গাছের শুকনো ডালের মতো, একটু চাপ পড়লেই ভেঙে যাবে মট্‌ করে”।

তোমার মতো মানুষ, একথা কী করে বলছ বাবা? আমাদের সংস্কৃতি সনাতন, কবে থেকে চলে আসছে? সেই তোমার বাপ-ঠাকুরদাদেরও আগে থেকে। পলকা হতে যাবে কেন, রীতিমত পোক্ত, মজবুত”।

পিতা পশুপতি মৃদু হাসলেন, “আমি তো বলিনি, বলছিস তো তোরা। উটকো দলের প্রথা আমাদের দলের মধ্যে ঢুকল কি না ঢুকল, এরই মধ্যে তোরা ভাবতে শুরু করেছিস, আমাদের সংস্কৃতি চুলোয় যাবে। তাহলে কী আমাদের সংস্কৃতি পলকা নয়?” তাঁর ছেলেমেয়েরা চট করে কোন উত্তর দিতে পারল না, একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, “ঠিক তা নয়, তবে...প্রাচীন একটা প্রথাকে মেনে চলাই তো সঠিক পথ, বাবা। আমরা এতদিন ধরে যা করে এসেছি, তাতে আমাদের তো কোন ক্ষতি হয়নি, বাবা”।

না ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এবার হয়তো হতে থাকবে”।

সে কি, কীভাবে?”

তোরা ওদের দলের ওই বর্শাগুলো হাতে নিয়ে তো দেখলি, কি বুঝলি?”

বেশ ভালই তো। শক্ত-পোক্ত, মোক্ষম অস্ত্র এবং বেশ হাল্কা, ব্যবহার করতে খুব সুবিধে”।

দু’ দলের লড়াইতে ওই বর্শা যদি আমাদের বুকে বা কাঁধে এসে গিঁথে যায়, আমাদের কী হবে?”

বাঃ রে, ওদের সঙ্গে তো আমাদের ভাব হয়ে গেছে। ওই যে মিত্তিকা বলল, তুমিই নাকি তাকে শিখিয়েছ, “মৈত্রী”। সে মৈত্রী তো আমাদের হয়ে গেছে। তাহলে আর আমাদের লড়াই হবে কেন?”

পিতা পশুপতি হাসলেন, “ওদের দল ছাড়া মানুষের আর কোন দল নেই? আমরা এতদিন জানতাম, আমাদের বর্শাগুলো সবার সেরা। একটা দলের সঙ্গে মৈত্রী হতেই আমরা জেনে ফেললাম, আমাদের থেকে অনেক ভালো বর্শা ওরা বানাতে জানে। কিন্তু অন্য দলের বর্শাগুলো? সেগুলো কী আমাদের থেকে খারাপ, নাকি ওদের থেকেও ভালো? সে কথা আমরা জানিই না। এমন কোন দলের সঙ্গে যদি আমাদের লড়াই হয়, আমাদের নিহত শরীরগুলো পড়ে থাকবে জঙ্গলে, হায়না-শেয়াল-শকুনের ভক্ষ্য হয়ে। কিন্তু তাতেও আমাদের সংস্কৃতি থেকে যাবে ঠিকঠাক...”

পিতা পশুপতির বড়োপুত্র বলল, “কী যে বলো না, বাবা? আমরা সব্বাই মরে গেলে, আমাদের সংস্কৃতি থাকবে কী করে?”

পিতা পশুপতি শান্তস্বরে বললেন, “ঠিকই তো, থাকবে না। তার মানে, সংস্কৃতির থেকেও জীবনটা অর্থাৎ বেঁচে থাকাটা বেশি জরুরি। আমরা বাঁচলে তবেই না আমাদের সংস্কৃতি বাঁচবে!” তাঁর এই কথায় কেউই কোন উত্তর দিতে পারল না, তারা পিতা পশুপতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তিনি আবার বললেন, “দুর্ধর্ষ এমন কোন দলের সঙ্গে লড়াইয়ে, তারা হয়তো আমাদের পুরুষদেরই মেরে ফেলল, আর লুঠ করে নিল আমাদের মেয়েদের...”

পিতা পশুপতির দুই কন্যা একযোগে বলে উঠল, “কী বলছ, বাবা, আমরা ছেড়ে দেব নাকি? প্রাণ থাকতে আমাদের কেউ লুঠ করতে পারবে না, আসুক না কেউ!”

পিতা পশুপতি নিষ্ঠুর গলায় বললেন, “তাহলে তারা তোদেরও মেরে ফেলবে! কিন্তু আমাদের ছোটছোট মেয়েরা? তারাও কী পারবে ওদের আটকাতে? পশুদের জগতে এমনটাই হয়ে থাকে, অথর্ব পুরুষ দলপতিকে দল থেকে তাড়িয়ে, নতুন যে পুরুষ দলের প্রধান হয়, সেই সে দলের মেয়েদের অধিকার করে। যে দলের কাছে আমরা চূড়ান্ত পরাস্ত হব, তারাও চেষ্টা করবে আমাদের মেয়েদের অধিকার করতে। তাতে দ্রুত সন্তান-সন্ততি বাড়াতে তাদের সুবিধে হবে। আমাদের দলের সেই অসহায় মেয়েরা তখন কী করবে? সংস্কৃতি রক্ষা না জীবন ধারণ?”

পিতা পশুপতির বড়োপুত্র বলল, “এ তোমার বাড়াবাড়ি, বাবা, বড়ো বেশি দুশ্চিন্তা করছ। কে বলেছে এমন হবেই?”

পিতা পশুপতি মাথা নাড়লেন, বললেন, “কেউ বলেনি, আর বলবেই বা কে? যে দল এমন করবে, তারা কী আমাদের আগে থেকে বলে-কয়ে করবে? গিরিজ আর মিত্তিকাদের দলটা অন্য একটি দলের সমস্ত মানুষকে হত্যা করেছিল, তারা কী বলে কয়ে করেছিল?”

পিতা পশুপতির বড়ো পুত্র বলল, “সেটাই তো আমরাও বলছি, বাবা। এরকম একটা বাজে দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দরকারটা কী”?

স্মিতমুখে পিতা পশুপতি বললেন, “আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে, আমাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই দরকার। যত বেশি দলের সঙ্গে আমরা যুক্ত হতে পারবো, বেঁচে থাকতে আমাদের ততই সুবিধে হবে”।

পিতা পশুপতির ছেলেমেয়েরা বলল, “তার মানে? আমাদের দলের সব মেয়েরা একে একে অন্য দলে চলে যাবে?”

পিতা পশুপতি হাসলেন, বললেন, “তা কেন? আমাদের দলের ছেলেদের জন্যে আমরা অন্য দলের মেয়েদেরও আনতে পারি। আর সব থেকে মঙ্গল হবে, আমাদের পরিবারের মেয়েরা সবাই যাবে অন্য দলে, আর আমাদের সব ছেলেদের জন্যে আসবে অন্য দলের মেয়েরা। একই পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক থাকবেই না”।

পিতা পশুপতির ছোট মেয়ে এতক্ষণ কিছু বলেনি, শুধু শুনছিল, এখন বলল, “বাবা, তোমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আমাদের সবার থেকেই অনেক বেশি। তার থেকেও যেটা অদ্ভূত, সেটা হল তোমার ভাবনা। তোমার কথা শুনে বিশ্বাস হচ্ছে, অন্ততঃ আমার তো হচ্ছেই, তোমার কথাতে লুকিয়ে আছে আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তবুও আমাদের ভয় করছে। এতদিনের সংস্কার ছেড়ে, নতুন পথে যেতে ভয় হচ্ছে। শেষে পুরোটাই আমাদের সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে যাবে না তো?”

পিতা পশুপতি মুখে স্নেহমাখা হাসি নিয়ে, ছোটমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথে চলতে ভয় তো করবেই, মা। নতুন এলাকার সন্ধানে, আমরা যে এই বসতি ছেড়ে প্রতিবার বেরিয়ে পড়ি, আমাদের ভয় করে না? কোন এলাকায় যাবো, সেখানে আমাদের মনোমত পরিবেশ এবং খাবার জুটবে কিনা। সে সময়েও এমন হাজার ভয় থাকে আমাদের মনে। তাও তো আমরা বেরিয়ে পড়ি। কিছু যে বিপদ-আপদ ঘটেনি কোনদিন এমনও তো নয়! তবুও এই বসতির চেনা গণ্ডি ছেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আজ নয়, অনন্তকাল ধরে”।

একটু থেমে আবার বললেন, “এখন সেই ভাবেই পারিবারিক ছোট গণ্ডি ছেড়ে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। যুক্ত হতে হবে আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে। সে পথেও আপদ-বিপদ থাকবে, থাকবে ভুল বোঝাবুঝি এবং সংস্কারের বিরোধ, তবুও চলতে হবে। তা নাহলে অচিরেই শুরু হবে আমাদের অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতির সংকট”।

 পিতা পশুপতি চুপ করলেন, তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও আর কেউ কোন প্রশ্ন করল না, তারা সকলেই এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। যদিও ব্যাপারটা তাদের ঠিক মনে ধরছে না, কিন্তু তাও বাবার কথাগুলোকেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পিতা পশুপতি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন, বেশ কিছুক্ষণ তিনি লক্ষ্য করলেন তাদের মুখগুলো।

তারপর হঠাৎই হাল্কা হাসিতে মুখ ভরে তুলে বলে উঠলেন, “অ্যাই, তোরা দুজন সেই থেকে আমার পিঠের কাছে বসে কী করছিস রে”? ঊষি আর ইশি এতক্ষণ মন দিয়ে তাদের বাবা-কাকা, মা-কাকিমাদের সঙ্গে বড়োবাবার কথা শুনছিল। তাদের বিশ্বাস, তাদের এই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বড়োবাবা ঠিক বের করে আনবেন। এবং এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি পুরোপুরি অনুকূল না হলেও, পরিবারের বড়োরা অন্ততঃ নিমরাজি।

ইশি কিছুটা নিশ্চিন্ত গলায় বড়োবাবাকে বলল, “কী আবার করব, তোমার পিঠে গুচ্ছের ঘামাচি হয়েছিল, গেলে দিচ্ছিলাম”। ইশির কথায় পিতা পশুপতি হো হো করে হেসে উঠলেন, তাদের সামনে টেনে এনে বসালেন তাঁর পাশটিতে, তারপর হাসতে হাসতে বললেন, “বড়োবাবার পিঠের ঘামাচির কথা, আজই তোদের বড্ডো বেশি করে মনে পড়ল, মা?” ঊষি বলল, “বারে, আমরা বুঝি তোমার পিঠে কখনো হাতাপিতি করে দিই না?”

দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পিতা পশুপতি অত্যন্ত স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন, “তাই কী বলেছি মা, বরং দুঃখ পাচ্ছি, ওই পরিবারে চলে গেলে, তোদের মতো কে আমাকে যত্ন-আত্তি করবে”? লজ্জারুণ মুখে ঊষি আর ইশি মাথা রাখলো পিতা পশুপতির দুই কাঁধে। পিতা পশুপতি তাঁর মেয়ে, ভাইঝি এবং ভাগ্নীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা তোরা তো মেয়ে, তোরা কোনদিন এই দুই মেয়ের মতো এমন আচরণ করতে পেরেছিস?”

মেয়ের দল ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, “ছিঃ! অমন অসভ্যতা আমরা কোনদিনই করতে পারব না, বাবা”।

পিতা পশুপতি হাসলেন ওদের কথায়, “কী করে পারবি, মা? তোরা তো কোনদিন ওদের মতো পরিস্থিতিতে পড়িসনি। তোরা শৈশব থেকে বড়ো হতে হতে জেনে গিয়েছিলি কোন খুড়তুতো দাদা, বা পিসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে তোদের জীবন কাটাতে হবে। আমরাই আলোচনা করতাম, আমি, তোদের মা, কাকা-কাকিমারা। একই পরিবারে একই সঙ্গে বড়ো হতে হতে তোদের মধ্যে ওই বোধ আসেইনি। তোরা যখন বড়ো হয়েছিস, আমরা অনুমতি দিয়েছি, শুরু হয়ে গেছে তোদের যুগল-জীবন। ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিক, অনেকটা মায়ের দুধ ছেড়ে বাচ্চাদের অন্য খাবার শুরু করার মত। কিংবা বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে বাচ্চাদের মাটিতে হাঁটার মত। উঠোনের খেলা আর হুল্লোড় ছেড়ে কিশোর-কিশোরীদের জঙ্গলে যাওয়ার মতো”।

মেয়েরা একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “তুমি কী বলতে চাইছ, সেটা ঠিক বুঝলাম না বাবা। তার মানে ওদের থেকে আমরা বোকা-হাঁদা ছিলাম। ওরাও তো নাচছে দুটো ছেলের পেছনেই”।

পিতা পশুপতি হেসে ফেললেন আবার, বললেন, “সত্যিই ওরাও নাচছে দুটি ছেলের পিছনে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ওরা কেউ কাউকে চিনতই না। ওদের ভাষাও এক নয়। ওদের কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি। তবু ওরা দুজনে অচেনা দুটি ছেলেকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। ওরাও মুগ্ধ হয়েছে ছেলেদুটিতে। তোদের মা আমাতে মুগ্ধ বা আমি তোর মায়ের প্রতি মুগ্ধ কিনা, একথা কোনোদিন কেউ ভাবিইনি। দুজনে একসঙ্গেই থেকেছি,  খেলেছি, ঝগড়া করেছি, জঙ্গলে যাওয়া আসা করেছি। একদিন আমাদের বড়োবাবা বললেন, তোরা দুটিতে আজ থেকে একসঙ্গে থাক। ব্যস্‌, আমরাও একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। শৈশব থেকে একসঙ্গেই ছিলাম, একসঙ্গেই রইলাম, তোদের মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু কোনদিন মুগ্ধ হওয়ার কথা মনেও আসেনি। তোদেরও আসে নি। তা নাহলে তোরা ধরে ফেলতে পারতিস, ওদের এই আচরণ অসভ্যতা নয়, এ হল মুগ্ধতা। হঠাৎ আসা এই অনুভূতি নিয়ে ওরা ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ওদের কী করা উচিৎ সেই পরামর্শ দিতে তোরা কেউ ওদের পাশে থাকতে পারলি না। কারণ তোদের কারও জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আদৌ হয়নি।”

পিতা পশুপতি চুপ করলেন। তাঁর ছেলে-মেয়েরা সকলেই তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অবাক চোখে। এতদিনের গতানুগতিক জীবনে যে মস্তিষ্ক আর পাঁচটা পশুর মতোই জীবনধারণের কাজে সদা ব্যাপৃত ছিল, তার ভেতরে আসছে নতুন এক আবেগের জোয়ার। সেদিন ওই আদিম মানুষগুলি প্রথম যে অনুভবে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের বহু প্রজন্ম পরে, এই অনুভূতির নাম দেওয়া হবে, প্রেম, ভালোবাসা। ছেলে ও মেয়ের ভালোবাসার এই অনুভূতি নিয়ে অজস্র কাব্য, কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক লেখা হবে। খুলে যাবে মানব সংস্কৃতির আরেকটি দিক – যার নাম সাহিত্য। আরো পরে, মহান এই প্রেমও বহুল ব্যবহারে সস্তা হয়ে একদিন নেমে আসবে প্রেমহীন যৌনতার চুটকি মজায়।

কথাবার্তায়, তর্কে বিতর্কে রাতের প্রথম প্রহর পার হল। সকলেই মগ্ন রয়েছে নানান চিন্তায়। দিনের উষ্ণতা ঝেড়ে ফেলে স্নিগ্ধ হচ্ছে আকাশ-বাতাস-ভূমি। দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল দু একটা পশুর ডাক। ঊষি আর ইশি পিতা পশুপতির দুপাশে বসে বারবার ঢুলে পড়ছিল ঘুমে। হঠাৎ ইশি ডাকল দিদিকে, “অ্যাই দিদি, শুনতে পাচ্ছিস”।

ঊষি জিজ্ঞাসা করল, “কী?”

কান পেতে শোন”। চুপ করে দুই বোন মগ্ন রইল কিছুক্ষণ।

ঊষি উজ্জ্বল মুখে বলল, “বড়োবাবা, মন দিয়ে শোন, ঢাকের আওয়াজ, গুম, গুম, গুম...”।

শুধু পিতা পশুপতি নয় দলের সকলেই শুনল, খুব মৃদু সেই আওয়াজ আসছে উত্তর থেকে, টানা তিনবার, একটু বিরতি দিয়ে আবার...।

ঊষি আবার বলল, “তার মানে ওরা নিরাপদে পৌঁছে গেছে, বড়োবাবা”।

খুশিতে উজ্জ্বল ইশি বলল, “তুই তো ঢুলছিলি, আমিই তো শোনালাম তোকে”।

তারা দুজনেই এতক্ষণ যেন উদ্বিগ্ন ছিল, এতক্ষণে হল তাদের উদ্বেগের শান্তি। মেয়েদের এই আবেগে পিতা পশুপতি অভিভূত হলেন, চোখ তুলে তাকালেন ওদের মায়েদের দিকে। এখন ওদের মায়েরাও অনেকটা শান্ত, কিছুটা হলেও তারা বুঝতে পারছে দুই মেয়ের আবেগ। ঊষির মা বলল, “আর না, অনেক রাত হল, এবার সবাই শুতে চল”।

ওরা চলে যাওয়ার পর পিতা পশুপতিও উঠলেন, অন্ধকারে পাথর-আত্মার দিকে মুখ তুলে মনে মনে বললেন, “তোমার জয় হোক পিতা, মঙ্গল করো আমাদের সকলের”।

 

১.৫.৪ ধান ভানতে শিবের গীত?

আমি কি এই পর্যায়টিকে অকারণ একঘেয়েমি দিয়ে দীর্ঘায়িত করছি? আপনারা কি ধৈর্য হারাচ্ছেন?

আমার অনুরোধ একটু ধৈর্য ধরুন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা – পারিবারিক দল ভেঙে বহুদলীয় সমাজ গড়ার দিকে যে মানুষ এগিয়েছিল - সে কী এক কথায় শুরু হতে পারে? তার সঙ্গে এসেছে কত না নতুন অনুভব, কত না নতুন ভাবনা, চিন্তা! কত না নতুন প্রথা, রীতি, ব্রত, নিয়ম-কানুন। সেগুলি ছাড়া এমন ঘটনা সম্পূর্ণ হতে পারে না। গড়ে উঠতে পারে না, আমাদের বিশ্বাস – আমাদের ধর্ম। অতএব এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, আমাদের আদিম জীবন, কীভাবে সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলল, সে কথা একটু বিস্তারে না বললে চলবে কেন?

জীবনের সেই পরিবর্তনগুলি বুঝতে, আসুন, ধৈর্য নিয়ে আমরা লক্ষ্য করি ওই আদিম পরিবারদুটির পরবর্তী ক্রিয়াকলাপ।       



[1] সলাজ’ বললাম ঠিকই, তবে পিতা পশুপতি বা তাঁর পরিবারের কারো সেই সময় এই লজ্জা পাওয়া-র ব্যাপারে কোন ধারণাই ছিল না। আজন্ম লালিত পরিবারের মানুষের কাছে লজ্জা নামক অনুভূতির অবকাশ ছিল কি? অপরিচিত লোকের সঙ্গে সদ্য পরিচয়ের পরেই না লজ্জা পাওয়ার সুযোগ ঘটে!      

...চলবে...

জীবন - যাত্রা

 

[এর আগের পর্ব পড়তে পারবেন এই সূত্রে - "লোকশিল্পীর বিলুপ্তি"]


গ্রামের বড়োরা মিলে দুটো যাত্রা করবেন এইবার মকর সংক্রান্তির দিন আর তার পরের দিন। আমাদের মামাবাড়ি ছাড়িয়ে গ্রামের আরো ভিতরে চৌধুরি পাড়া যাবার পথেই শিবমন্দির পড়ে। তার সামনে সিমেন্টের বাঁধানো চাতাল, টিনের চাল দিয়ে ঢাকা। তার ঠিক পাশেই ডালপালা ছড়ানো বিশাল এক ছাতার মতো প্রাচীন বকুলগাছ। ওই চাতালে যাত্রার আসর বসবে দুদিন। গাঁয়ের সবাই জায়গাটাকে শিবতলা বলে।

ওই শিবতলার মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ গৌরীপীঠে বিরাজিত। কুচকুচে কালো পাথরের সেই লিঙ্গ। এর আগে গরমের ছুটিতে এসে দেখেছি, শিকে থেকে ঝোলানো মাটির ফুটো কলসি থেকে সারাটা নির্জন দুপুর ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে পড়ে শিবঠাকুরের মাথায়। গাঁয়ের মেয়ে-বউরা পুকুর থেকে স্নান সেরে ফেরার পথে কাঁসার বা পিতলের ঘটিতে জল বয়ে আনেন । সেই জল শিবঠাকুরের মাথায় ঢেলে পুজো করেন। আর সকালের দিকে শিবতলায় এসে দাঁড়ালে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ত অজস্র বকুল ফুল – ছোট্ট ছোট্ট মাকড়সার মতো। হাতের অঞ্জলি ভরা বকুল ফুলের অপূর্ব ঘ্রাণে ভালো লাগায় আবিষ্ট হয়ে থাকত মন। 

অভিনয় দক্ষতার জন্যে আমার বড়োমামার গ্রামে খুব সুনাম ছিল গ্রামের যে কোন যাত্রায় তিনিই থাকতেন মুখ্য ভূমিকায়। এবারে ঠিক হয়েছে একটি পৌরাণিক পালা – ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর একটি ঐতিহাসিক – ‘ধূলার স্বর্গ’। কদিন ধরেই দাদারা সন্ধ্যের পর রিহার্সাল দেখতে যাচ্ছে। আমিও যাবার জন্যে রোজই বায়না করতাম, কিন্তু মা আমাকে বড়োদের মধ্যে যাওয়ার অনুমতি দেননি। একদিন বড়োমামা রিহার্সালে যাবার সময় শুনে ফেললেন আমার বায়না আর মায়ের বকাবকি, বললেন-

-‘রিহার্সাল দেখতে যাবি তো, চ আমার সঙ্গে। এরজন্যে নাকে কাঁদছিস কেন’? মা বললেন-

-‘না, দাদা, ও গিয়ে তোমাদের অসুবিধে করবে, বিরক্ত করবে’। আমি বলে উঠলাম-

-‘মোটেও না, আমি কাউকে বিরক্ত করব না। একটা কথাও বলব না’। বড়োমামা মাকে বললেন

-‘কিচ্ছু অসুবিধে করবে না, চলুক আমার সঙ্গে, ও তো খুব ভালো ছেলে’। এরপর মা আর কিছু বলতে পারলেন না আর আমিও বড়োমামার হাত ধরে ভালো ছেলের মতো চললাম রিহার্সাল দেখতে।

হাজরাবাড়ির বিশাল হলঘরে রিহার্সালের আসর বসেছিলগোটা তিনেক হ্যারিকেনের আলোয় সে ঘরের অন্ধকারই যেন আরো প্রকট হচ্ছিল। যাত্রার রিহার্সাল যে এত বিরক্তিকর ব্যাপার কে জানত? একজন হ্যারিকেনের সামনে বসে বই থেকে ডায়লগ পড়ছিল - সে হচ্ছে প্রম্পটার আর যার যে পার্ট সে সেই ডায়লগটাই রিপিট করছিল নাটকীয় ভঙ্গীতে।

প্রম্পটার-‘বড়দা, এবার আপনার ডায়লগ -“পরাজয়?-(অট্টহাসি)– পরাজয় নাহি জানি কিরূপে বা হয়, বোমভার বরে আমি অজেয়, ত্রিভুবনময়”।

বড়োমামা-‘ওটা, বোমভা নয় রে, জিতেন, ব্রহ্মা। আরেকবার বল দেখি লাইনটা’।

প্রম্পটার-“পরাজয়?-(অট্টহাসি)– পরাজয় নাহি জানি কিরূপে বা হয়, বোমহার বরে আমি অজেয়, ত্রিভুবনময়”।

বড়োমামা-‘পরাআআজয়? হুহুহাহাহাহাহা – পরাআআজয় নাহি জানি কিরূঊঊপে বা হয়ব্রহ্মার বরে আমি অজেএএএয়, ত্রিভুবনমঅঅঅঅয়’।

জলদমামা-‘বিষ্ণু, ওইখানটা তোমার ঠিক জমল না, ওই যে - “ব্রহ্মার বরে”। ওই জায়গায়টায় তোমার গলাটা একটু নামাতে হবে। মানে একটু নম্র আর কি। যতোই হোক তুমি তো ব্রহ্মার ভক্ত আর তাঁর তপস্যা করেই না তোমার এই শক্তি ...বুয়েচ? বাকি সব জায়গায় তোমার ঔদ্ধত্যটা ঠিকঠাক এয়েচে...’ চৌধুরিবাড়ির জলদমামা এই যাত্রাদুটির ডিরেক্টর, বড়োমামার চেয়ে বয়সে ঢের বড়ো।    

মহিষাসুরের ভূমিকায় চাদর মুড়ি-ধুতি পড়া বড়োমামার এহেন অভিনয় চর্চাতে আমি মজা পাচ্ছিলাম না। ডোরাকাটা পাজামা আর চাদরমুড়ি ঝন্টুমামা এরপর মা দুর্গার ভূমিকায় ডায়লগ বলতে শুরু করল অদ্ভূত মেয়েলি কণ্ঠে আর ঢঙে - কি আশ্চর্য যে মনে হচ্ছিল তাকে!

ঝন্টুমামা -‘ওরে মুডহো মইশাসুর, আজি তোরে পাঠাইব শমন সদন...’

জলদমামা- ওটা মুডহো নয় রে, মূঢ় – মূঢ় – এইদ্যাখ জিভটা আলটাগরায় ঘষে বল –ঢ় -ঢ়আর মইশাসুর কিরে –মঅহিইইষাআআসুর – ঠিক মতো উচ্চারণ না হলে অভিনয় হয় রে, বাপ’?

জলদমামা পারফেকসনে বিশ্বাসী। কাজেই এরপর চলতেই লাগল ঝন্টুমামার জিভের আড় ভাঙানোর প্রচেষ্টাহতাশ হয়ে আমি হ্যারিকেনের আলোয় হলঘরের দেয়ালে নড়ে চড়ে বেড়ানো বিশাল বিশাল ছায়াগুলো দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়েই পড়লাম।

ধান ভেঙে চাল করার হাস্কিং মেসিন তখন চালু হয়ে গেছে। কিন্তু সে মেসিন সেদ্ধ ধান থেকে সেদ্ধ চাল বের করার জন্যে। সেদ্ধ ধান বা চাল মানেই সেটা এঁটো – উচ্ছিষ্ট। কাজেই সে চালে কোন পুজো বা শুভ অনুষ্ঠান হবে না। পুজোপার্বণের জন্যে আতপ চাল বিধেয়। কাজেই কদিন ধরেই ঢেঁকিতে নতুন ধান কোটা চলছিল। নতুন চাল জলে ভিজিয়ে রেখে শিলে বাঁটা চলছিল। সেই বাঁটাচাল পরিষ্কার কাপড়ে বিছিয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে চালের গুঁড়ো হিসেবে যত্ন করে রেখে দেওয়া হচ্ছিল। গাছের থেকে গোটা ত্রিশেক নারকেল পেড়ে ছোবড়া ছাড়িয়ে, ভেঙে, নারকেল কুড়ুনি দিয়ে কুড়ে গুড় দিয়ে রান্না করে নারকেলের ছাঁই বানানো হয়ে গেল। সংক্রান্তিতে নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো হবে সরুচুকলি, পাটিসাপ্টা, সেদ্ধপিঠে, ভাজাপিঠে, ক্ষীরপুলি। পাটিসাপ্টা, সেদ্ধপিঠে আর ভাজাপিঠের মধ্যে পুর হিসেবে ঢুকে পড়বে নারকেলের ছাঁই। ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া, ভিজে চাল বাঁটা, নারকেল কোড়া - এসব কাজে ভামিমাসি, মোক্ষমাসিদের সাহায্য নেওয়া যায়, কিন্তু এরপরের এন্ড প্রোডাক্ট - পিঠেপুলি বানানোটা একান্তভাবেই বাড়ির মহিলাদের কাজ।

আজ পৌষমাসের সংক্রান্তি - মকর সংক্রান্তি আজই রাত্রে শিবতলায় প্রথম যাত্রা মঞ্চস্থ হবে – ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। একটু আগেই একবার ঘুরে এসেছি শিবতলা থেকে। ছ-ছটা হ্যাজাক জ্বলছে, মঞ্চের মাঝখানে মাথার ওপর ডেলাইট। গোটা শিবতলাটা ঝলমল করছে আলোয়। বকুল গাছের নীচে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। দর্শকদের বসার জায়গা টিনের চাল দেওয়া চাতালে এবং মন্দিরের বারান্দায়। শতরঞ্চি বিছিয়ে জায়গা রিজার্ভ করা হয়ে গেছে। আমাদের জায়গা রিজার্ভ করে বসে আছে মামাবাড়ির রাখাল ভুবনমামা আর ভামিমাসি। আমরা রাতের খাওয়া সেরে এসে বসলে ওরা খেতে যাবে। খেয়ে এসে ওরাও বসবে একসঙ্গে।

রান্নাঘরেই একসারিতে সবার সঙ্গে বসে পাল্লা দিয়ে গরম গরম সরুচুকলি, পাটিসাপ্টা, ভাজাপিঠে পরম তৃপ্তির সঙ্গে খেতে খেতে আমাদের যখন হাঁসফাঁস দশা - রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ ঢং করে প্রথম ঘন্টা পড়ল শিবতলায়। আর শুরু হয়ে গেল কনসার্ট – বেহালা, ফ্লুট, হারমোনিয়ম আর তবলার সমবেত বাদ্যধ্বনি আমাদের খাওয়ার পরেই মা-মাসিমারাও বসে পড়লেন। দিদিমা আর মামীমা খাবেন সবার শেষে - ভুবনমামা আর ভামিমাসি এলে। মায়েদের খাওয়া হতে হতে দ্বিতীয় ঘন্টা পড়ল ঢং ঢং।

 আমরা যখন শিবতলায় পৌঁছলাম, শিবতলায় তখন চেঁচামেচি, হট্টগোল, হৈচৈ চলছে। উপস্থিত দর্শকরা নিজেদের মধ্যে নানান কথাবার্তা বলছে, বাচ্চাদের কান্নাকাটি, ছোটদের কলরবলর, তার পিছনে কনসার্টের বাজনা। স্বভাবশান্ত ভাবগম্ভীর শিবতলার চরিত্রই বদলে গেছে। মনে হচ্ছিল শিবঠাকুর বিরক্ত হয়ে মন্দিরের দরজা ঠেলে বেড়িয়ে আসবেন না তো! এইসময়েই তৃতীয় ঘন্টা পড়ল আর কনসার্টের বাজনা খুব দ্রুত লয়ে বেজে উঠে থেমে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।

 মঞ্চের বাইরে থেকে উদাত্ত গলায় গান গাইতে গাইতে ঢুকল বিবেক। এ গান রিহার্সালেও শুনেছি, সুদীর্ঘ সেই গানে আমার কোন কৌতূহল ছিল না। কিন্তু গেরুয়া বসনে, আর গেরুয়া পাগড়িতে কানুমামাকে কি সুন্দর মানিয়েছে! কানুমামা ডাকপিওনের চাকরি করেন আর করেন শখের তন্ত্রচর্চা  গালভর্তি দাড়িগোঁফ, মাথায় ছোট্ট জটা। ধুতি আর খাঁকি জামা পড়ে চিঠি বিলি করেন দিনে দুবার – আর অন্য সময় রক্তাম্বর পরেনকতবার তাঁকে দেখেছি গান গাইতে গাইতে হেঁটে যেতে – ‘ঘরে ঘরে যাব, ভিক্ষা মেগে খাব/ মা বলে আর কোলে যাবো না/ মা মা বলে আর ডাকবো না...’পথে ঘাটে নিজের খেয়ালে গান গেয়ে বেড়ানো সহজিয়া কানুমামাকে সেদিন সেই মঞ্চে যেন বিরাজ করতে দেখেছিলাম। বড়ো হয়ে যখন ‘রক্তকরবী’ পড়লাম – নন্দিনীর বিশুভাইকে চিনে নিতে খুব অসুবিধে হয়নি, বাল্যকালে কানুমামাকে দেখেছিলাম বলে।

 

ঝকমকে জোব্বা, মাথায় বাহারি উষ্ণীষ, পায়ে সুন্দর নকশা করা জুতো আর কোমরে বাঁধা খাপে ঢাকা তলোয়ার। রিহার্সালে দেখা আমার চেনাজানা সাধারণ মানুষগুলো আমূল বদলে গেছে। পোষাক-পরিচ্ছদ যে একটা মানুষের ব্যক্তিত্বকে এবং শরীরী ভাষাকে কতখানি বদলে দিতে পারে – প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম সেদিন। মহিষাসুরকে আমার বড়োমামা বলে একবারও মনে হল না –  এমনকি প্রহরণ আঁকা আটটা কাঠের হাত পিঠে বেঁধে ঝন্টুমামা যখন বড়মামার বুকে ত্রিশূল ঠেকিয়ে, পা তুলে দিল বড়োমামার গায়ে – একটুও রাগ হয় নি ঝন্টুমামার ওপর। উপস্থিত মহিলাদর্শকরা সমস্বরে উলুধবনি দিতে লাগলেন, বেশ কয়েকটা শাঁখও বেজে উঠল, শেষবারের মতো বিবেক প্রবেশ করল শ্রীশ্রী চন্ডীর শ্লোক আবৃত্তি করতে করতেমহিলারা উপুড় হয়ে প্রণাম করতে লাগলেন – মা দুগ্‌গা কর্তৃক মহিষাসুর নিধনের freezed  দৃশ্যে

 মঞ্চে সব কুশীলব যখন বিদায়ী নমস্কার করতে দাঁড়াল তখন ভোর হয় হয়। দর্শকরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়। তার মধ্যেও ঝন্টুমামা বড়োমামার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যাচ্ছিল, ‘বড়দা, একে তুমি বয়সে গুরুজন, তাতে আবার বামুন -’।

বড়ো মামা তার হাত ধরে আটকে দিলেন বললেন, ‘ছি ছি ছি, ঝন্টু, কী করছিস কি তুই? এখন তুই ঝন্টু নাকি? তুই এখন মা দুগগা’

‘শিখে নে ঝন্টু, বিষ্ণুর থেকে শিখে নে। এমন ভাবনা না থাকলে অভিনয় হয় না রে...’বললেন জলদমামা।

 

রাজনীতি ছিল, দলাদলি ছিল, ছিল ঈর্ষার রেষারেষি। ভীষণ স্পষ্টভাবে ছিল ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ও ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার। কিন্তু এসব সত্ত্বেও একটা শান্ত পারম্পরিক এবং পরিপূরক সম্পর্কবোধ সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রবহমাণ ছিল। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও নির্দিষ্ট মাত্রাবোধসম্পন্ন মানসিকতা, যা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত - এক সনাতন সভ্যতার উত্তরণের ধারাবাহিক ইতিহাস থেকে

আজও ভেদাভেদ রয়ে গেছে অন্য নামে অন্য রূপে - সুভদ্র মুখোশের আড়ালে, কিন্তু উপড়ে গেছে সব সম্পর্কের শিকড় এবং যাবতীয় মূল্যবোধ এসে ঠেকেছে তলানিতে। সর্বহারাদের স্বার্থে যাঁরা বিদেশী আদর্শকে অনুকরণ করছিলেন তাঁরা সব হারিয়ে ফেলে এখন দিশাহারা – উপহার দিয়েছেন একটি হযবরল সমাজ, যেখানে হাতের পেন্সিলটুকুও হারিয়ে গেছে বিপ্লবের দমবন্ধ করা ধোঁয়ায় আর তোলাবাজদের পৈশাচিক হুমকিতে।  

ভাঙনটা শুরু হয়েছিল শহরে এবং ছড়িয়ে পড়ল দেশময় সর্বত্র - টের পাচ্ছিলাম পরবর্তী কয়েক বছরে। যে অরূপরতনের সন্ধান পেয়েছিলাম ওই ক’মাসে, সে সব হারিয়ে গেল বিলুপ্ত প্রজাতির মতো। সেসব অন্য কথা – সে অন্য প্রসঙ্গ।

...০০...

...চলবে...


সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পায়রা

 

[গল্পটি শোনাও যাবে "ঋতুযানের অদ্ভূত গল্প" সিরিজ - ইউটিউবের এই চ্যানেলে, পায়রা ]  


ভোর সাড়ে ছটায় মোবাইলের আওয়াজে স্বপনের ঘুম ভেঙে গেলএকটা খবর কভার করে, কাল রাত দেড়টায় ফিরে দুটো নাগাদ শুয়েছিল। সাড়ে ছটায় এই ফোনটা আসাতে বেশ বিরক্ত হল স্বপন। একবার ভাবল, ওঠাবে না। আবার কী ভেবে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল বিশ্বজিৎদা কলিং। বিশ্বজিৎদা স্বপনের টপ বস্‌, “এই বঙ্গ সেই বঙ্গ” পত্রিকার চিফ এডিটার। কানেক্ট করে স্বপন বলল, ‘হ্যালো, বিশ্বজিদ্দা, গুড মর্নিং’

‘গুড মর্নিং। কতবার রিং হল বলতো? এত বেলা অব্দি ঘুমোচ্ছিলি নাকি? শোন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়। হাতের কাছে পেন বা পেন্সিল কিছু আছে? লিখে নে, প্রফেসর নীলমাধব দেবনাথ..”

‘এক মিনিট বিশ্বজিদ্দা’ ফোনটা কানে নিয়ে টেবিলে একটা ডায়রি পেল, পেন...পেন...এ ড্রয়ার...সে ড্রয়ার... পেল না...দরকারের সময় কোথায় যে ঢোকে?  নাঃ পাওয়া যাচ্ছে না।

আশা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন বিশ্বজিদ্দা’।

‘ওফ একটা পেন খুঁজতে এত সময় লাগে? লেখ, প্রফেসার নীলমাধব দেবনাথ, বিদ্যা ভিলা। রাজবাড়ি পাড়া’ স্বপন মনে মনে দু তিনবার আউড়ে নিল ঠিকানাটা, তারপর বলল, ‘কোনো ল্যাণ্ডমার্ক’?

‘প্রফেসার নীলমাধব, নিজেই ল্যাণ্ডমার্ক। এত জায়গায় নিউজ কভার করে বেড়াচ্ছিস, নীলমাধবস্যারকে চিনিস না? না চিনলে, খবর বানানো ছেড়ে, স্টেশনে গিয়ে ঘুগ্নিমুড়ি বানা। যে কোন লোককে জিগ্যেস করলে, নীলমাধবস্যারের বাড়ি চিনিয়ে দেবে। জরুরি ঘটনা। ভদ্রলোক পায়রার ঠোক্করে সাংঘাতিক ইনজিয়োর্ড। ফিজিক্যালি খুব একটা না হলেও, মেন্টালি সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়’।  

ফোনটা কেটে দিলে বিশ্বজিদ্দা, আর সকাল সকাল মেজাজটাও খিঁচড়ে দিল।  নীলমাধবস্যারকে সে চেনে না, তা নয়, ভালই চেনে। এ শহরের বিদ্বজ্জনদের মধ্যে তিনি প্রথম সারিতে। রিটায়ার্ড প্রফেসর, এনবিইউ। এখনও খুব অ্যাক্টিভ এবং অ্যাক্টিভিস্ট।  গত চারদিন ধরে শহরে যে প্রতিবাদী মিছিল এবং ধর্না চলছে সেখানে তিনি নিজেও পার্টিসিপেট করছেন। তাঁকে পায়রা ঠুকরেছে! পায়রা? স্বপন ঠিক শুনল তো? বিশ্বজিদ্দাকে ফোন করে আরেকবার জিগ্যেস করতে ভরসা হল না। অলরেডি ঘুগ্নিমুড়িতে নামিয়ে এনেছে, এর পর হয়তো...।

পাঁচমিনিট বললেই কী আর পাঁচমিনিটে হয়? এর মধ্যে সুমন্তকে ফোন করল, রেডি হবার জন্যে। যাবার সময় ওকেও তুলে নিতে হবে। সুমন্ত ফটোগ্রাফার। সুমন্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। স্বপন বলল, ‘পাঁচমিনিটের মধ্যে যদি বেরোতে না পারিস, তবে স্টেশনে গিয়ে ঝালমুড়ি বেচা শুরু কর। এত আলসে হলে নিউজ লাইনে আসা তোর কম্মো নয়’। ঘুগ্নিমুড়ির পাশে ঝালমুড়ি, জমবে ভালো।

আটমিনিটের মাথায় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্বপন যখন বাইক বের করল, স্বপনের বউ মিতালি জানালায় দাঁড়িয়ে প্যাঁচার মতো মুখ করে, বলল, ‘রাত দেড়টায় বাড়ি ঢুকে, আবার এই সাড়ে ছটায় বেরোচ্ছো? কখন ফিরবে শুনি?’ স্বপন বাইকে আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে কোন ইঙ্গিত দিল, নাকি অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিল বুঝতে পারল না, মিতালি।

সুমন্ত রেডিই ছিল, কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে বাইকের পেছনে বসতেই, স্বপন উড়তে লাগল ভোরের শান্ত নিরিবিলি ডিবিসি রোড ধরে। কিছুটা যাওয়ার পর সুমন্ত জিগ্যেস করল, ‘কেসটা কী? এত এমারজেন্সি? নীলমাধব স্যারের শরীর খারাপ?’ 

‘শরীর নয় মন খারাপ। কিন্তু সেটা খবর নয়। খবর হচ্ছে পায়রা। পায়রা যে একটা হিংস্র পাখি সে বিষয়ে তোর কোন ধারণা আছে?’

‘পায়রা? হিংস্র পাখি? সকাল সকাল কী হেঁয়ালি করছিস, মাইরি’?

‘তোর কী মনে হয়, আমাকেও পাগলা পায়রা কামড়েছে? ভোরবেলা বাইকে চাপিয়ে তোর সঙ্গে হেঁয়ালি করছি?’ সুমন্ত আর কোন কথা বলল না, স্বপনের পিছনে চুপ করে বসে রইল

 পাড়ার লোকের হাঁড়ির খবর যারা রাখে, সেই সব পানের দোকান, মুদির দোকান এখনো বন্ধ। নীলমাধবস্যারের বাড়ির হদিশ পেতে তাই একটু বেগ পেতে হল। তিনজন মর্নিং ওয়াকার বৃদ্ধ ভদ্রলোককে জিগ্যেস করেও তেমন সুবিধে হল না। একজন ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে এ পাড়ায়, সবাই তো স্যার। এই যে দেখছো, সার সার বাড়িতে সকলেই স্যার। তা তোমরা কোন নীলমাধবের কথা বলছ? অ্যাডভোকেট, ডাক্তার না সাহিত্যিক নীলমাধব?’ স্বপন বলল, ‘প্রফেসার নীলমাধব দেবনাথ’।

‘প্রফেসার? প্রফেসার তো আছে সমরজ্যোতি পোদ্দার। সমর ছাড়া আরে কে প্রফেসার, জানা নেই ভাই’। ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন। স্বপন থ্যাংকিউ বলে, আরো এগিয়ে গেল। চার রাস্তার মোড়ে ছোট্ট একটা চায়ের স্টল, দেখে দাঁড়াল। সকালে উঠে চা খাওয়া হয়নি, চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, তার ওপর যদি নীলমাধবস্যারের বাড়ির হদিশটাও পাওয়া যায়। বাইক থামিয়ে, দুজনেই নেমে গিয়ে চা নিল, তারপর চা খেতে খেতে জিগ্যেস করল, নীলমাধব স্যারের বাড়ির ঠিকানা।

চায়ের দোকান থেকে সঠিক হদিশ নিয়ে, তারা যখন নীলমাধবস্যারের বাড়ি পৌঁছলো তখন বাজে সাতটা পাঁচ। কলিং বেল টিপতেই দোতলার বারান্দায় এক ভদ্রমহিলা এসে ঝুঁকে জিগ্যেস করলেন, ‘কাকে চাই?’

‘নীলমাধবস্যার আছেন? ওঁনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই’।

‘কোথা থেকে আসছেন?’

‘ “এই বঙ্গ সেই বঙ্গ” পত্রিকা থেকে, বিশ্বজিৎ সান্যাল পাঠিয়েছেন’।

ভদ্রমহিলা কোন উত্তর না দিয়ে, বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর তাদের সামনের দরজায় ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল ‘খুট’। অন্য এক মহিলা দরজা খুললেন, দেখে মনে হল, কাজের দিদি। বাইক লক করে ওরা দুজনে ভেতরে ঢুকতে, মহিলা দরজাটা আবার বন্ধ করলেন, তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ‘আসুন’। ওরা মহিলার পিছনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় গেল। সামনেই বেশ বড়ো একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে, ওদের বসতে বলে, পাখা চালিয়ে দিলেন মহিলা। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের চারদিক দেখতে দেখতে ওরা অপেক্ষা করতে লাগল। ঘরের তিন দেওয়ালে বুক শেলফ, তাতে ভর্তি শুধু বই আর বই। সোফা, বেতের মোড়া, চা গাছের ডাল দিয়ে বানানো সেন্টার টেবিল। দেওয়ালে টিভি। তার নিচেয় একটা বড়ো ক্যাবিনেট। তার ওপরে সেটটপ বক্স। সাউণ্ড সিস্টেম। ক্যাবিনেটের ভেতরে বেশ কিছু শোপিস।

নীলমাধবস্যার কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকলেন, তাঁর পিছনে সেই ভদ্রমহিলা, যিনি বারান্দায় এসেছিলেন। এই গরমের মধ্যেও স্যারের পোষাক দেখে খুব অবাক হল স্বপন আর সুমন্ত। ভদ্রলোকের মাথা ঠিক আছে তো? প্রফেসর ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘গুড মর্নিং। তোমরা দুজন কী স্বপন আর সুমন্ত?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার’।

‘সকালে আমি যখন ফোন করেছিলাম, বিশ্বজিৎ বলল, তোমাদের ইমিডিয়েটলি পাঠাচ্ছে। স্বপন কে? তুমি? বিশ্বজিৎ বলল, ইউ আর ভেরি স্মার্ট এণ্ড ইন্টেলিজেন্ট ওয়ান টু হ্যান্ডল দা সিচুয়েশন’।

ঘুগ্নিমুড়ি শোনার পর বিশ্বজিদ্দার এমন কমপ্লিমেন্ট, মোটেই কম নয়, বেশ বেশিপ্লিমেন্ট! স্বপন কিছু বলল না, একটু লজ্জা পাওয়ার ভাব করে মাথাটা চুলকে নিল।

প্রফেসর নীলমাধব আবার বললেন, ‘তোমরা দুজনেই রেডি তো? তোমাদের নিয়ে আমি ছাদে যাবো’।

‘আমিও যাবো, বাবা’।

‘জিদ করিস না, মা। সকালে যা হয়েছে, তারপরে আমি মোটেই স্বস্তি পাচ্ছি না। তোকে তো আগেই বলেছি, যেতে হলে, আমার মতো প্রোটেকসন নিতে হবে। আমার কথাটা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না, বুঝছি। না হবারই কথা। অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়’! তারপর স্বপনদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পরিচয় করিয়ে দিই। সম্পর্কে আমার বৌমা, কিন্তু আমার মেয়েই বলতে পারো। আমার ছেলের থেকেও নির্ভরযোগ্য। তোমাদের দুজনেরই নিশ্চয়ই হেলমেট আছে?’

দুজনেই ভদ্রমহিলাকে নমস্কার করল, তারপর স্বপন বলল, ‘আছে’।

‘ফাইন, তাহলে অতটা ভয়ের ব্যাপার হবে বলে মনে হয় না’।

‘পায়রা?’

‘হুঁ পায়রা। বিশ্বজিৎ বলেছে বুঝি? কী বলেছে?’

‘ফেরোসাস, মানে ইয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছে’।

‘ঠিক। এত শান্ত সুন্দর নিরীহ একটা পাখির আচরণ, এভাবে হঠাৎ বদলে যেতে পারে, ভাবা যায় না। এই খবরটা করতে হবে। ছবি, ভিডিও, রিপোর্ট। আমি চাই যত শিগ্‌গির সম্ভব মিডিয়াতে ছড়িয়ে যাক খবরটা। তোমাদের অনলাইন এডিসন রয়েছে না, সেখানেও ব্রেকিং নিউজ টেলিকাস্ট করো’।

স্বপন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা তৈরি স্যার’নীলমাধব স্যারের কথা শুনে স্বপন ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করছে।

‘ভেরি গুড। বাট আবার বলছি, ডোন্ট আণ্ডার এস্টিমেট দেম। বি কশাস’।

‘উই উইল বি, স্যার’।

নিজেও মাথায় একটা হেলমেট পরে, ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে স্যার উঠতে লাগলেন। পিছনে স্বপন আর সুমন্ত। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই সুমন্ত ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে রেডি করতে লাগল।

নীলমাধবস্যার বললেন, ‘ভোরের রাস্তায় আধাঘন্টা মতো হাঁটাহাঁটি করে এসে, ছাদে ওঠা আমার অনেকদিনের অভ্যেস। কয়েকটা টবে ফুল গাছ আছে, জলটল দিই। শুকনো পাতা-টাতা থাকলে তুলে দিই। আর পাখিদের জন্যে দানা দিই, চাল দিই, গম দিই। আমি ছাদে উঠলেই ওরা আমাকে চিনতে পারে। বুঝতে পারে। আকাশ থেকে ওরা দল বেঁধে যখন নেমে আসে কী যে অপূর্ব অনুভূতি হয় সে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আজও উঠেছিলাম’।

বলতে বলতে সিঁড়ি শেষ, নীলমাধবস্যার ছাদের দরজার ছিটকিনি খুললেন, খুট। দরজার পাল্লা খুলতেই সামনে ছাদ। নীলমাধবস্যার ছাদে গেলেন। পিছনে পিছনে স্বপন আর সুমন্ত। সুমন্তর ক্যামেরা রেডি। স্যারকে দেখে সত্যিই পায়রার ঝাঁক নেমে আসছে। তাদের ডানায় আওয়াজ উঠছে ফটফট করে। সত্যিই অপূর্ব দৃশ্য। মানুষের সঙ্গে পাখির এই গড়ে ওঠা সম্পর্ক দেখলে মনে সত্যিই স্বর্গীয় এক আনন্দের অনুভব হয়। এখনও হচ্ছে। ওদের আচরণে কোন হিংস্র ভাব বোঝা যাচ্ছে না তো! ছাদের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে অনেক চাল ও গমের দানা। অন্যদিন পাখির ঝাঁক সেগুলি খুঁটে খুঁটে খায়। ঘুরে ঘুরে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে। মিনিট ছয় সাতের মধ্যে সাফ করে ফেলে সমস্ত শস্য দানা। আজ খায়নি।

কিছু পাখি এসে বসল ছাদের আলসেতে। কিছু জলের ট্যাংকের ছাদে। দু চারটে কাপড় শুকোতে দেওয়ার দড়িতে বসে দোল খেতে লাগল। আর কিছু পাখি এসে নীলমাধব স্যারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠোকরাতে লাগল স্যারের হেলমেটে। হাতে পায়ে। লাল টুকটুকে পায়ের আঙুল দিয়ে খিমচে দিতে লাগল, স্যারের পিঠ, কাঁধ। পাখিদের ঠোঁটে তেমন ধার নেই, কিন্ত তাদের হিংস্রতার ধার তীক্ষ্ণ। স্যার হাতে গ্লাভস, গায়ে ফুল হাতা জ্যাকেট পরেছিলেন। তেমন ক্ষতি হচ্ছে না, কিন্তু গোটা ব্যাপারটা ভয়ংকর, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

‘সকালে এসে রোজ যেমন দিই, আজও চাল আর গমের দানা দিয়েছিলাম – একটাও মুখে তোলেনি। দেখেছো?’ নীলমাধবস্যার বললেন। আলসে আর জলের ট্যাংকে বসে থাকা পাখিরাও এবার নেমে এসে ছেঁকে ধরল স্যারকে। ‘ওরা কিন্তু ক্ষুধার্ত। খাবার চাইছে। কিন্তু সে খাবার শস্যদানা নয়, অন্য কিছু। ’

‘বাবা, তুমি চলে এসো’। স্যারের বৌমা নিঃশব্দে কখন ছাদে এসেছে খেয়াল করেনি কেউ।

‘তুই আসিস না, মা। তোকেও ওরা চেনে। আমার মতো তোকেও ছেঁকে ধরবে। আমি জানি ওরা কী চাইছে!’

স্বপন আতংকের গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী চাইছে স্যার’?

নীলমাধবস্যার পকেট থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করলেন। ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে, একদলা মাংসের কিমা বের করে, ছড়িয়ে দিলেন সামনে। স্যারকে ছেড়ে পায়রার ঝাঁক ঝাঁপিয়ে পড়ল ওই টুকরোগুলোর ওপর।  স্যার আরও ছড়ালেন, সমস্ত পায়রা নেমে এল মেঝেয় ছড়িয়ে থাকা মাংসের টুকরোর লোভে। তারা নিজেদের মধ্যেও মারামারি করছে। পায়ের নখে তুলে নিচ্ছে অন্যের পালক। ঠুকরে আহত করছে অন্য পায়রাকে। স্যারের বৌমা হাত ধরে টেনে আনলেন স্যারকে। স্বপন এবং সুমন্তও আস্তে আস্তে সরে এল। স্যারের বৌমা, ছাদের দরজা বন্ধ করে দিলেন। সুমন্ত ক্যামেরা অফ করল। 

নিচের বৈঠকখানা ঘরে এসে, নীলমাধবস্যার সামনের সোফায় বসলেন, তিনি বিধ্বস্ত। শরীরে নয় মনে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ওদের আচরণে কী বীভৎস পরিবর্তন, চিন্তা করতে পারছো?’

‘এভাবে কী সবাই বদলে যাবে? আমরাও? হিংস্র হয়ে ওঠাই কী আমাদের শেষ পরিণতি?’

‘জানি না, স্বপন। জানি না। আমাদের দিন তো প্রায় শেষ হয়ে এল। কিন্তু তোমাদের, বৌমার? এবং তোমাদেরও পরের প্রজন্মের কী হবে? শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না! সভ্যতা আর টেকনোলজির বিকিরণ, রণক্ষেত্র করে তুলেছে আমাদের চারদিক। কেউ কী পরিত্রাণ পাব? এখন আমাদের বেশ কিছু মানুষ চাই, যারা হবে সত্যিকারের অসভ্য, আর ইয়ে, হ্যাঁ আদিম’। খুব নাটকীয় ভাবে বললেন নীলমাধব স্যার। 

 

..০০..

  

   

                   


রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

লোকশিল্পীর বিলুপ্তি

 

                     [এর আগের পর্ব এই সূত্রে পড়া যাবে - চুরি বিদ্যে মহাবিদ্যে... ]



     “হাঁদির মা চাঁদি খেয়ে নাদি নাদি হাগে।

আর  হাঁদি আহা নিশিভোর বাসরঘরে জাগে”।।

লোকটা উঠোনে বসে গলার শির ফুলিয়ে গান গাইছিল। গানের অন্তরায় ঠোঁটের উপর হাত চেপে অদ্ভূত আওয়াজ তুলছিল মিউজিক হিসেবে। আর নিজেরই পিঠে একটা চেরা কঞ্চি পেটাচ্ছিল সঙ্গৎ হিসেবে - তাল উঠছিল চট চটাস - চট চটাস শব্দে। অদ্ভূত এক ছন্দে একটানা দীর্ঘগানটি সে পরিবেশন করেছিল, যার সবটা তখন বুঝিনি, মনেও নেই। মনে রয়ে গেছে শুধু ঐ দুটি মাত্র লাইন – কারণ গানের ধুয়ো ধরে ওই লাইনদুটিতে সে ফিরে আসছিল বারবার। এ ধরনের গানের নাম নাকি ‘হাপু’।

পরনে ধূসর হয়ে যাওয়া ছাপা লুঙ্গি। পোষের কনকনে শীতেও তার খালি গাপিঠের যেখানে কঞ্চির চোট পড়ছিল, সে জায়গায় লম্বা কালশিটের স্থায়ি দাগ। রুক্ষ খড়ি ওঠা তেলহীন হাড় জিরজিরে শরীর। ঠোঁটের দুকোণায় সাদা ফেকো, চোখের কোণায় পিচুটি। তার সারা শরীরে অপুষ্টি আর নিদারুণ খিদের ছাপ।

 পাড়ার বেশ কিছু ছেলেপুলে আর আমরা তাকে গোল হয়ে ঘিরে দেখছিলাম তার রকম সকম আর শুনছিলাম তার গান গাইবার কেরামতিনাম তার এনামুল, পাড়ার ছেলেপুলেরা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে অভ্যস্ত ও তাকে চেনে। তারা এনামুলকে ঘিরে - গান শোনার চেয়েও - বিরক্ত আর বিদ্রূপ করছিল বারবার। অসহায় এনামুল আমার অচেনা মুখের দিকে চাইছিল বারবার। কি চাইছিল সে আমার থেকে - কোন সাহায্য, নাকি আমার মতো অচেনা ছেলের সামনেও অপদস্থ হতে থাকার জন্যে বাড়তি লজ্জা?

 এমত সময়ে পুকুর থেকে স্নান সেরে আমার দিদিমা এসে উপস্থিত হলেন। বাড়িতে একদল ছেলেছোকরাদের চ্যাংড়ামি আর হট্টগোলে বিরক্ত দিদিমা, থমকে দাঁড়ালেন – বললেন, ‘এটা কি মেছো হাট নাকি রে, হ্যা হ্যা করছিস সব উঠোনে দাঁড়িয়ে? বের হ’ সব বাড়ি থেকে...’। যারা এতক্ষণ এনামুলের পিছনে লাগছিল তারা দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল। দিদিমা উঠোনে বসা এনামুলকে এবার দেখতে পেলেন, বললেন, ‘অ, এনা, কতবার বারণ করেছি, ছোঁড়াদের সামনে তোর ওই হাবিজাবি গান গাসনি...ও সব গান আজকাল কেউ শোনে? নাহক তোর পেছনে লাগে। তার চেয়ে কাজ কম্ম দ্যাখ – পেট ভরবে বাছা...’। 

দূর থেকেই এনামুল মাটিতে উবু হয়ে বসে দিদিমাকে প্রণাম করল। উঠোনের থেকে সামান্য একটু মাটি আঙুলে নিয়ে জিভে ঠেকাল, তারপর একগাল হেসে বলল, ‘পেনাম, মা ঠাকরেন। কতাটা কয়েচেন এক্কেরে নিজ্জলা সত্তি। তবে কি জানেন, বাপ- পিতেমোর থেকে হাপুগানই শিকেচি – আর তো কিচু জানা নেই কাজকাম। লোকে আর এর কদর করে না, কোতাও দুটো পয়সা হয় - কোতাও হয় না, উল্টে মস্করা করে এ গান লিয়ে, আমাকে লিয়ে...’। 

বলতে বলতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে যেন। দিদিমা ভিতর বাড়িতে যেতে যেতে বললেন, ‘বোস বাছা, বোস। না খেয়ে যাবি না কিন্তু -’।

 খাবার কথাতেই হোক অথবা দিদিমার সহৃদয় ব্যবহারেই হোক, এনামুলকে অনেক নিশ্চিন্ত এবং সপ্রতিভ দেখাচ্ছিল এখন। তার সামনে একলা আমিই দাঁড়িয়েছিলাম, আমাকে সে তাই জিগ্যেস করল, ‘তোমারে তো চিনলাম না, খোকাবাবু, মা ঠাকরেন তোমার কে বটেন’?

‘দিদিমা’।

‘অ। মামাবাড়ি এয়েচো, তা কোথায় থাকা হয় বা’ঠাকুর’?

‘কলকাতায়’।

‘অ। কলকেতায় – তার মানে তো তুমি আমাদের নদি’ঠাকরেনের ছেলে, বা, বা, বা.... তা তুমি ছোটটি না বড়টি’?

‘ছোট’।

‘বেশ, বেশ খুব ভাল।’ এই বলেই সে আবার উবু হয়ে বসে, দিদিমাকে যেভাবে প্রণাম করেছিল, ঠিক সেইভাবেই আমাকে নমস্কার করে বসল। অস্বস্তিতে আমি ঠিকরে পিছনে সরে এলাম অনেকটা। 

আমাকে অমন চমকে উঠতে দেখে এনামুল বলল, ‘আহা, হা, হা, ভয় পাও কেন? তুমি মা ঠাকরেনের লাতি, আমরা ওঁনারে অন্নপুন্না মানি, সাক্ষাৎ দেবতা গো, দেবতা। তোমাদের পুরাণের সেই গপ্পোটা জানোতো, শিব ঠাকুর যে শিব ঠাকুর - তিনিও অন্ন ভিক্ষে করেছিলেন একবার অন্নপুন্নার কাচে। বুজেচ বা’ঠাকুর যেমন তেমন দেবতা নয় -’। তার কথার মধ্যেই বন্নিদিদি একটা ছোট ধামায় করে মুড়ি এনে ফেলল অনেকটা, সঙ্গে গুড়ের বাটিবন্নিদিদিকে দেখেই এনামুলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। 

বন্নিদিদি বলল, ‘চাচা, তোমার লেকচার থামিয়ে, যাও একখান কলাপাতা কেটে আনো’। এনামুলচাচা দৌড়ে চলে গেল আমাদেরই বাড়ির খিড়কি দোরের বাইরের কলাগাছ থেকে পাতা আনতে।

বন্নিদিদিকে চেয়ে দুবারে প্রচুর মুড়ি ও গুড়, জল দিয়ে ভিজিয়ে এনামুলচাচা অদ্ভূত তৃপ্তি করে খেল। এত আনন্দ ও যত্ন করে খেতে এর আগে আর কাউকে দেখিনি। একটিও মুড়ি ফেলা গেল না। কলাপাতায় একটুও কিচ্ছু লেগে থাকল না। সেদিন টের পেয়েছিলাম প্রকৃত খিদে কাকে বলে আর সেই খিদে কি, উপলব্ধি না করলে, খাদ্যের প্রতি এমন সমীহ ও সম্মান শেখা যায় না। আমরা সময়মতো অথবা খিদে পাওয়ার আগেই খাবার পেয়ে যাই বলেই খাবারের অপচয় বা অবহেলা করতে দ্বিধা করিনা।

 ঝরঝরে পরিষ্কার এঁটো কলাপাতাটা এনামুলচাচা যখন উঠোন থেকে তুলে নিচ্ছিল বন্নিদিদি তাকে বলল, ‘চাচা, এখন ঘুরে এসো। দুপুরে ঠাম্মা কিন্তু আবার তোমায় আসতে বলেছে’। 

বিশাল ঘাড় নেড়ে এনামুল চাচা বলল, ‘আসব মা, আসব। মাঠাকরেণ ডেকেচেন – না এসে পারি’?

এনামুল চাচা কলাপাতাটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে গেল, আমি বন্নিদিদিকে জিগ্যেস করলাম, ‘দিদিমা আবার কেন ডাকলো ওকে? গান শুনবে বলে?’

‘ধুর বোকা, দুপুরে ও ভাত খাবে না? আমাদের বাড়িতেই খাবে তো...আর গান? গান না ছাই। ওই গান আবার কেউ শোনে নাকি?’

 

আজ মনে হয় বাংলার সেই লোক-সঙ্গীতের পারম্পরিক গায়ককে আমাদের সভ্য সাংস্কৃতিক আঙ্গিনা থেকে অবচেতনে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছিল বিদ্রূপ আর অবহেলার কুলোর বাতাস করে অথবা মমতা  দিয়ে আদরের অন্নদাস বানিয়ে।


...চলবে... 


(পরের পর্ব "জীবন যাত্রা")

নতুন পোস্টগুলি

  তৃতীয় অধ্যায়ঃ কর্মযোগ ৩/১ অর্জুন উবাচ জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দন। তৎ ...