সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ২/৬ (শেষাংশ)

 

                    [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে 

                                            "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।

এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লেস্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে

ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]


দ্বিতীয় পর্ব - ষষ্ঠ ও শেষ পর্বাংশ

(১২,০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই)

 [এর আগের পর্বাংশ পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 - ধর্মাধর্ম - ২/৫ ]


২.৬.২ গণসঙ্ঘী জনপদ ও মহাজনপদ

গণসঙ্ঘী মহাজনপদগুলির ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিপরীত। এই শাসনব্যবস্থা প্রাচীন পদ্ধতিরই নবীন রূপ।  আদিম সমাজে আমরা যেমন দেখেছি, পরিবার ভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রধান হত পরিবারের বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ কোন পুরুষ। গণসঙ্ঘ শাসন ব্যবস্থাও মূলত একই রকম। এখানে তফাৎটা হল, অনেকগুলি গোষ্ঠীর মৈত্রী জোট নিয়ে যে মহাজনপদ গড়ে উঠেছিল, তার প্রশাসনে থাকত, সবকটি গোষ্ঠীর এক বা একাধিক প্রধানেরা। এই কারণেই, বৃজি মহাজনপদে ৭৭০৭ জন এবং মল্ল মহাজনপদে ৫০০ জন রাজা(? আসলে প্রধান)-র উল্লেখ পাওয়া যায়, পরবর্তী কালের জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে। এরকম গণসঙ্ঘী প্রশাসনের কথাই আমরা আলোচনা করেছি ২.৩.৭ অধ্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে। এই মহাজনপদগুলির প্রশাসনিক স্তরে বেশ কিছু অনার্য গোষ্ঠীও যে সামিল ছিল, সে কথা অনুমান করতে, আমার কোন দ্বিধা নেই। বহু গোষ্ঠী মিলে পরমত-সহিষ্ণু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ধারণা আর্যদের মস্তিষ্কে হঠাৎ করেই উদয় হয়েছিল, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। যেখানে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, আর্যরা আসার অন্ততঃ দুহাজার বছর আগে থেকেই অনার্যরা এই প্রশাসন পদ্ধতি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছে।   

যাই হোক, সকল গোষ্ঠীর সব প্রধানদের নিয়ে গড়ে তোলা হত বিধানসভা। এই বিধানসভাতেই রাজ্যের শাসন পদ্ধতি এবং রাজ্য পরিচালনার বিধি-বিধান স্থির হত। সভাতে সকল প্রতিনিধি সহমত হয়ে গেলে কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু মতবিরোধ দেখা দিলে, ভোট নেওয়া হত। যে মতে অধিকাংশের সমর্থন, বলা বাহুল্য, সে মতই বিধানসভার অনুমোদন পেত। তাই বলে, এটিকে গণতন্ত্র মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ এই বিধানসভাতে দেশের সাধারণ জন সমাজের কোন প্রতিনিধি থাকত না, এবং তাদের সে অধিকার দেওয়াও হত না।

অনেক গোষ্ঠীর মৈত্রী জোট নিয়ে গণসঙ্ঘ যেমন ছিল, তেমনই ছিল একটিমাত্র গোষ্ঠীর গণসঙ্ঘও। স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলির আয়তন খুবই ছোট, অতএব সেগুলি মহাজনপদ নয়, সেগুলিকে বলা হত জনপদ, যেমন শাক্য, কোলিয়া, লিচ্ছবি, মোরিয় ইত্যাদি।

আর্য-অনার্য সম্মিলিত এই ধরনের মহাজনপদগুলিতে সামাজিক গঠন ছিল সরল এবং যথেষ্ট যুক্তিসম্মত। শাসক গোষ্ঠীগুলিতে - সে আর্য বা অনার্য যেই হোক, চতুর্বর্ণের কোন বিন্যাস ছিল না। যদিও জনপদ-প্রধান নিজেকে ক্ষত্রিয় বলেই পরিচয় দিত। এই গণসঙ্ঘী সমাজেও ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতদের সম্মান ছিল, কিন্তু আধিপত্য ছিল সীমিত। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য না থাকায় এই সমাজ বিপুল আড়ম্বরে যজ্ঞের আয়োজন করত না। অতএব ব্রাহ্মণ্য সমাজের কটাক্ষে এই গণসঙ্ঘী সমাজ “বেদ-বিমুখ” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এবং এই কারণেই ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ও মহাকাব্যগুলিতে এই সমাজগুলি ছিল অপাংক্তেয় এবং সে ভাবে কোন গুরুত্বই পায়নি।  যদিও আমরা পরবর্তী পর্বে দেখব, গণসঙ্ঘী সমাজের শিক্ষিত ও অভিজাত পরিবারগুলিতে বেদচর্চা আবশ্যিক ছিল।  

এই সমাজের আর্য এবং অনার্য মানুষরা নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী, নানান কাজে নিযুক্ত থাকত। গণসঙ্ঘী সমাজে এই কর্মী মানুষদের বলা হত কর্মকার, যারা বাণিজ্য করত তাদের বলা হত বণিক বা শ্রেষ্ঠী। ব্রাহ্মণ্য সমাজের মতো সম্পন্ন কৃষক, বণিক বা শিল্পীদের বৈশ্য বানিয়ে তাদের সামাজিকভাবে গুরুত্বহীন তৃতীয় স্তরে নামিয়ে দেওয়া হয়নি। প্রশাসনিক স্তরেও তাদের যথেষ্ট সম্মান ও গুরুত্ব দেওয়া হত। ভূমিহীন ও অদক্ষ শ্রমজীবি মানুষদের বলা হত দাস – তাদের মধ্যে স্বাধীন শ্রমিক যেমন ছিল তেমনি ক্রীতদাসও ছিল। ক্রীতদাসরা সাধারণতঃ গার্হস্থ্য কাজেই নিযুক্ত হত। আর কৃষি ও পশুপালনের কাজে সাধারণ স্বাধীন শ্রমিকদের নিয়োগ করা হত। 

অবস্থানের দিক থেকে গণসঙঘ মহাজনপদগুলি কিছুটা দুর্বলই ছিল বলা চলে। গাঙ্গেয় সমভূমির অত্যন্ত উর্বর অঞ্চলের ব্রাহ্মণ্য মহাজনপদগুলি থেকে তাদের অবস্থান ছিল কিছুটা দূরে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম উর্বর অঞ্চলে। এর কারণ হতে পারে, তারা শক্তিশালী ও আগ্রাসী আর্যগোষ্ঠীদের থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে নিরিবিলি শান্তিতেই থাকতে চেয়েছিল। অথবা ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য বিষয়ে, প্রধান আর্যগোষ্ঠীদের সঙ্গে তাদের মতভেদ হওয়াতে, তারা ওই সব অঞ্চলে সরে গিয়েছিল।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে দ্বারকার কোথাও কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু দ্বারকাও সম্ভবতঃ এমনই আরেক গণসঙ্ঘী জনপদ ছিল। মথুরায় কংস নিধনের পর, কংসের শ্বশুর প্রবল পরাক্রমী চেদিরাজ জরাসন্ধের সঙ্গে বারংবার সম্মুখ সমরের বিপদ এড়াতে, শ্রীকৃষ্ণ সুদূর দ্বারকায় সরে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল, যদু, বৃষ্ণি, শূরসেন, ভোজ[1] ও অন্ধক গোষ্ঠী। যদিও দ্বারকাধীশ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, কিন্তু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে তাঁকে বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতে হত বলে, দ্বারকা জনপদের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন, তাঁর পিতা বসুদেব এবং মাতামহ উগ্রসেন। এই গোষ্ঠীগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হল, শ্রীকৃষ্ণ-পিতা বসুদেব হলেন বৃষ্ণি বা শূর বংশীয়। শ্রীকৃষ্ণ-মাতা দেবকী হলেন, যদু[2], ভোজ ও অন্ধকদের অধিপতি উগ্রসেনের কন্যা। এই উগ্রসেনের পুত্র অর্থাৎ মাতা-দেবকীর ভাই কংস – একটি দৈববাণী শুনেছিলেন, বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। অতএব, তিনি নিজের মৃত্যু রোধ করতে বোন দেবকী ও ভগ্নীপতিকে কারারুদ্ধ করলেন। কিন্তু পিতা উগ্রসেন কংসের এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করাতে, তিনি পিতাকেও বন্দী করে, নিজেই সব কটি গোষ্ঠীর অধিপতি হয়ে বসেছিলেন। কংসের দুই পত্নী – অস্তি ও প্রাপ্তি ছিলেন চেদি (মগধ) -র অধিপতি জরাসন্ধের কন্যা এবং কংসের মিত্ররা ছিল বাণ ও ভৌম নামে দুই রাক্ষস(অনার্য)-রাজ। [শ্রীমদ্ভাগবত/ দশম স্কন্ধ/প্রথম অধ্যায়।]   

যাই হোক, আর্য-অনার্য সহাবস্থান এবং পরমতসহিষ্ণু উদারনীতির জন্যেই গণসঙ্ঘী মহাজনপদ ও জনপদগুলির মানুষরা অনেকটাই মুক্তচিন্তার অবকাশ পেয়েছিল। আর সেই কারণেই সে যুগে যে দুজন যুগন্ধর মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল, তাঁরা দুজনেই এমনই দুই গণসঙ্ঘী জনপদের বাসিন্দা ছিলেন। বৃজি গণসঙ্ঘ থেকে এসেছিলেন মহাবীর এবং শাক্য গণসঙ্ঘ থেকে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। দুজনেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধী দুই ধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভিতকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। তাঁদের, বিশেষ করে গৌতমবুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে, প্রায় এক হাজার বছর রাজশক্তি থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে। পরবর্তীকালে তারা আবার যখন হারানো আধিপত্য ফিরে পেল, দেখা গেল, ততদিনে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নিজেদের ধর্মভাবনাকে আমূল বদলে জনমুখী নতুন এক ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে, যার নাম হিন্দু ধর্ম। কিন্তু সেই আলোচনা আসবে যথা সময়ে, এখন নয়। এখন সমকালীন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধ মতগুলির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

 

২.৬.৩ প্রতিবাদী কণ্ঠ, বিরোধী মতামত

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় - এই বর্ণযুগলের দাপটে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অদ্ভূত সামাজিক সংস্কৃতি মেনে নিল আমাদের মতোই ভীত ছাপোষা সাধারণ মানুষ। কিন্তু কখনোই মনে নেয়নি, সেকথা বলাই বাহুল্য। তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা গেছে বারবার। সেই কণ্ঠস্বর তেমন দুর্বলও যে নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সমকালীন ও পরবর্তী সময়ের সংস্কৃত শাস্ত্রগুলিতে এবং মহাকাব্যে। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থে তাদের সমালোচনা, নিন্দা, আক্ষরিক অর্থে গালাগাল, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ থেমে থাকেনি, বহুদিন পর্যন্ত। এমনকি অসামান্য প্রতিভাবান পণ্ডিত শঙ্করাচার্যকেও (যাঁর সময়কাল ৭৮৮-৮২০ খ্রীষ্টাব্দ) এ বিষয়ে বেশ কড়া করে দুচার কথা শোনাতে হয়েছিল। অতএব সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়, বিরুদ্ধ এই কণ্ঠস্বরগুলি ব্রাহ্মণদের পক্ষে যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ছিল।

খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের বেদ-বিরোধী প্রতিবাদী মানুষগুলিকে “নাস্তিক” অর্থাৎ নিরীশ্বর বলা হয়েছে। শুধু নাস্তিকই নয়, তাদের বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি ও নিষ্ঠুরকর্মা বলা হয়েছে। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল  তপস্বী, কিন্তু ক্রোধে এবং বিদ্বেষে রাক্ষস বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবাদী মানুষগুলিকে ব্রাহ্মণেরা কতখানি ভয় পেত, তার কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হবে।

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ষোড়শ অধ্যায় (দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ)-এর ৬, , ৮ ও ৯ সংখ্যক শ্লোকে তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে বলালেন,

দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেঽস্মিন্‌ দৈব আসুর এব চ।

দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।। ১৬/৬

[সন্ধি-সমাসের বিচ্ছেদে শ্লোকটি বুঝতে কিছুটা সুবিধে হয় –

দ্বৌ ভূত-সর্গৌ লোকে অস্মিন্‌ দৈবঃ আসুরঃ এব চ। দৈবঃ বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুর[3]ম্‌ পার্থ মে শৃণু।।]

সরলার্থ - হে পার্থ, এই জগতে দৈব এবং আসুর, এই দুই প্রকার স্বভাবেরই জীব ও মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দেবসুলভ মানুষের কথা তোমাকে আগেই সবিস্তারে আমি বলেছি, এখন, অসুরসুলভ মানুষের কথা বলছি, শোন।

 

প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ।

ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে।। ১৬/৭

[প্রবৃত্তিম্‌ চ নিবৃত্তিম্‌ চ জনা ন বিদুঃ আসুরাঃ। ন শৌচম্‌ ন অপি চ আচারঃ ন সত্যম্‌ তেষু বিদ্যতে।।]

সরলার্থ - আসু্রী মানুষের না ধর্মে প্রবৃত্তি থাকে, না অধর্মের নিবৃত্তি জানে। তাদের শুচিতা থাকে না, সদাচার থাকে না, এমনকি সত্যও থাকে না।

 

অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্‌।

অপরস্পরসম্ভূতংকিমন্যৎ কামহৈতুকম্‌।। ১৬/৮

[অসত্যম্‌ অপ্রতিষ্ঠম্‌ তে জগৎ আহুঃ অনীশ্বরম্‌। অপরঃ-পর-সম্ভূতম্‌ কিম্‌ অন্যৎ কামহৈতুকম্‌।।]

সরলার্থ - তারা বলে, জগৎ মিথ্যা, এখানে ধর্ম বা অধর্মের কোন সংস্থান নেই এবং ঈশ্বরও নেই। এই জগৎ সৃষ্টিতে স্ত্রী ও পুরুষের পারষ্পরিক কাম সংযোগ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?

 

এতাংদৃষ্টিমবষ্টভ্যনষ্টাত্মানোঽল্পবুদ্ধয়ঃ।

প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মণঃক্ষয়ায়জগতোঽহিতাঃ।। ১৬/৯

[এতাম্‌ দৃষ্টিম্‌ অবষ্টভ্য নষ্ট-আত্মানঃ-অল্পবুদ্ধয়ঃ। প্রভবন্তি-উগ্রকর্মণঃ ক্ষয়ায় জগতঃ-অহিতাঃ।।]

সরলার্থ - বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি ও নিষ্ঠুরকর্মা এই ব্যক্তিরা, এই দর্শন অনুসরণ ক’রে, জগতের অমঙ্গল ও বিনাশের জন্যেই জন্মগ্রহণ করে। (শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলায় অনুবাদ- লেখক)

 

এই বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি ও নিষ্ঠুরকর্মা লোকগুলি কারা, যাদের কথা প্রিয়বন্ধু, পিসতুতো ভাই ও ভক্ত অর্জুনকে বললেন, স্বয়ং ভগবান?

আরেকটি উদাহরণ দিই রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডের ১০৮ সর্গ থেকে, যেখানে জাবালি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে বলছেন, “...পিতার অনুরোধে পৈতৃক রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া দুঃখজনক দুর্গম সঙ্কটপূর্ণ অরণ্য আশ্রয় করা তোমার কর্তব্য হইতেছে না। এক্ষণে তুমি সুসমৃদ্ধ অযোধ্যায় প্রতিগমন কর। সেই একবেণীধরা[4] নগরী তোমার প্রতীক্ষা করিতেছে। তুমি তথায় রাজভোগে কালক্ষেপ করিয়া দেবলোকে সুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় পরমসুখে বিহার করিবে। দশরথ তোমার কেহ নহেন, তুমিও তাঁহার কেহ নও, তিনি অন্য তুমিও অন্য, সুতরাং আমি যেরূপ কহিতেছি তুমি তাহারই অনুষ্ঠান কর। দেখ, জন্মবিষয়ে পিতা নিমিত্তমাত্র বলিয়া নির্দিষ্ট হন, বস্তুতঃ মাতা ঋতুকালে গর্ভে যে শুক্রশোণিত ধারণ করেন, তাহাই জীবোৎপত্তির উপাদান। এখন দশরথ যেস্থানে যাইবার গিয়াছেন, ইহাই মনুষ্যের স্বভাব। কিন্তু বৎস! তুমি স্ববুদ্ধিদোষে বৃথা নষ্ট হইতেছ। যাহারা প্রত্যক্ষসিদ্ধ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল ধর্ম লইয়া থাকে, আমি তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাকুল হইতেছি, তাহারা ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয়। লোকে পিতৃদেবতার উদ্দেশে অষ্টকা শ্রাদ্ধ করিয়া থাকে। দেখ, ইহাতে কেবল অন্ন অনর্থক নষ্ট করা হয়, কারণ কে কোথায় শুনিয়াছে যে, মৃত ব্যক্তি আহার করিতে পারে? যদি একজন ভোজন করিলে অন্যের শরীরে উহার সঞ্চার হয়, তবে প্রবাসীর উদ্দেশে এক ব্যক্তিকে যদি আহার করাও, উহাতে কি ঐ প্রবাসীর তৃপ্তিলাভ হইবে? কখনই না। যে-সমস্ত শাস্ত্রে দেবপূজা, যজ্ঞ, দান ও তপস্যা প্রভৃতি কার্যের বিধান আছে, ধীমান মনুষ্যেরা কেবল লোকদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত সেই সকল শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছেন। অতএব, রাম! পরলোক-সাধন-ধর্ম নামে কোন পদার্থই নাই, তোমার এইরূপ বুদ্ধি উপস্থিত হউক। তুমি প্রত্যক্ষের অনুষ্ঠান এবং পরোক্ষের অননুসন্ধানে প্রবৃত্ত হও। ভরত তোমাকে অনুরোধ করিতেছেন, তুমি সর্বসম্মত বুদ্ধির অনুসরণপূর্বক রাজ্যভার গ্রহণ কর”।

জাবালির এই প্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হয়ে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে তীব্র ভাষায় ধিক্কার এবং তিরষ্কার করেছিলেন, কিন্তু জাবালিকে তিনি “তপোধন” বলে সম্বোধনও করেছিলেন। তপোধন কথার অর্থ তপস্বী, মুনি বা ঋষি! অতএব জাবালি বড়ো সামান্য লোক নন, তিনি ভগবান রামচন্দ্রকেও মুখের ওপর এমন সব কথা বলার ক্ষমতা রাখতেন! ভগবান রামচন্দ্র এবং জাবালির মধ্যে এমন কোন কথোপকথন যদি সত্যিই হয়ে থাকে, মহাকবি বাল্মীকি সেটুকু অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারতেন। তাতে রামায়ণের কাহিনী বা কাব্যের এতটুকুও হানি হত না। কিন্তু তিনি তা করেননি, তাঁর মনে হয়েছিল, রামায়ণের মতো জনপ্রিয় কাব্যে এই ঘটনার উল্লেখ থাকলে, ব্রাহ্মণ্য-বিরোধীদের বিরুদ্ধে জনগণকে সজাগ করা যাবে। তাদের খুব স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যাবে, দেখ, ওই দুষ্ট তপস্বীকে ভগবান রামচন্দ্রও কীভাবে ধিক্কৃত করেছিলেন।

আরেক জন মুনির কথা পাওয়া যায় মহাভারতে, তাঁর নাম চার্বাক। চার্বাক সম্বন্ধে আর কিছু না জানলেও, বাঙালী তাঁর নামে প্রচলিত “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” প্রবচনটি খুব ভালোভাবেই জানে এবং সর্বদাই বিদ্রূপ অর্থে ব্যবহার করে থাকে।

মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজা যুধিষ্ঠির যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধজয় করে রাজধানীতে ফিরছেন, “...সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতি প্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুর্য্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্ব্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণ করিয়া অবস্থান করিতেছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলে তাঁহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়াই নির্ভীক চিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্ব্বিত বাক্যে[5] যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূর্বক কহিল, “মহারাজ! এই ব্রাহ্মণগণ আপনাকে জ্ঞাতিঘাতী ও অতি কুৎসিত রাজা বলিয়া ধিক্কার প্রদান করিতেছেন। ফলতঃ এইরূপ জ্ঞাতি-সংক্ষয় ও গুরুজনদিগের বিনাশসাধন করিয়া আপনার কি লাভ হইল? এক্ষণে আপনার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ। জীবন ধারণ করিবার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই”।

এই কথা শুনে উপস্থিত ব্রাহ্মণেরা ক্রোধে, দুঃখে লজ্জায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তাদের চুপ করে থাকতে দেখে, রাজা যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, ব্রাহ্মণেরা যেন তাঁর প্রতি প্রসন্ন হন, কারণ তিনি তখনই প্রাণ ত্যাগ করবেন। রাজা যুধিষ্ঠিরের কথায় ব্রাহ্মণেরা সম্বিৎ ফিরে পেল, বলল, “ধর্মরাজ! আমরা আপনাকে ধিক্কার প্রদান করি নাই। আপনার মঙ্গল হউক।...মহারাজ, যে ব্যক্তি আপনার প্রতি কটূক্তি করিল, ঐ দুরাত্মা, দুর্য্যোধনের পরম বন্ধু চার্ব্বাক নামক রাক্ষস। ঐ পাপাত্মা দুর্য্যোধনের হিতকামনায় আপনার প্রতি কুবাক্য প্রয়োগ করিয়াছে, আমরা কোন কথাই কহি নাই। অতএব আপনার কিছুমাত্র শঙ্কা করিবার প্রয়োজন নাই। আপনি ভ্রাতৃগণের সহিত কল্যাণভাজন হউন”।

এরপরে সমবেত ব্রাহ্মণেরা চার্ব্বাকের ওপর ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ-শাপান্ত এবং হুংকার ধ্বনি করতে লাগল এবং অচিরেই চার্ব্বাক বাজে-পড়া গাছের মতো ঝলসে মারা গেল। এই সব কিছু মিটে যাওয়ার পর ভগবান জনার্দন আসল রহস্যটি ফাঁস করলেন, বললেন, “সত্য যুগে চার্ব্বাক নামে এক রাক্ষস বদরী-তপোবনে বহুকাল অত্যন্ত কঠোর তপস্যা করেছিল। তার কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা তাকে বর দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন রাক্ষস বলেছিল, হে ভগবন, প্রসন্ন যখন হয়েছেন, তখন এমন বর দিন যে, কোন প্রাণীর থেকেই আমার কোনদিন যেন মৃত্যু না হয়। ভগবান ব্রহ্মা বলেছিলেন, তথাস্তু। কিন্তু তুমি কখনও ব্রাহ্মণদের অপমান করো না, ব্রাহ্মণের অপমান করলেই তুমি বিপদগ্রস্ত হবে”। অতএব সত্য যুগের কঠোর তপস্বী রাক্ষস দ্বাপরে এসে ব্রাহ্মণদের ক্রুদ্ধ অভিশাপে মারা গেল – ব্রাহ্মণদের কেউ মারেওনি, ধরেওনি, কিন্তু তাও মারা গেল, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সামনেই! এই বার্তাটি বেদ-বিমুখ মানুষদের পক্ষে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, তাতে আর সন্দেহ কি?

রামায়ণে রামচন্দ্র-জাবালি ঘটনার মতো, যুধিষ্ঠির-চার্বাকের এই কাহিনীও সমান গুরুত্বহীন। অর্থাৎ এই ঘটনাটির উল্লেখ না থাকলে – মহাভারতের মূল কাহিনীর কোন ইতরবিশেষ ঘটত না। কিন্তু এই কাহিনীর উপস্থাপনা করার উদ্দেশ্য – বেদ-বিরোধী মতাবলম্বীদের হুমকি দেওয়া। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপস্থিতিতে বেদ-বিরোধী চার্বাককে ব্রাহ্মণদের ক্রোধাগ্নি(?)তে ঝলসে মরতে হল।

অবশ্য অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে মহাভারতের সমস্ত প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে অদ্ভূত দুই মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে ধর্ম-সংস্থাপক অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্ত-অনুরাগীবৃন্দ, যেমন পঞ্চপাণ্ডব, বিরাট, দ্রুপদ প্রমুখ রাজন্যবর্গ এবং অন্যদিকে চার্বাক মিত্র দুর্যোধনাদি কৌরব পক্ষ ও তার সহযোগী রাজন্যবর্গ। কোথাও স্পষ্ট উল্লেখ নেই, তবুও সহজেই অনুমান করা যায়, মথুরার রাজা কংস, চেদিরাজ জরাসন্ধ প্রমুখের বিনাশও বেদ-বিরোধী তথা বিষ্ণু-বিরোধী তথা ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিরোধী মতামতকে সমূলে উচ্ছেদ করা।             

 

২.৬.৪ ভারতীয় দর্শনের সূচনা

যে কোন দর্শনের মূলকথা হল মানব-মঙ্গল। ভারতীয় দর্শনের উদ্দেশ্য একই – এবং আমাদের দর্শনের ধারণা আরও সঠিক বললে মোক্ষ অর্থাৎ পরমমুক্তি। কোথা থেকে মুক্তি, না পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি। ভারতীয় দর্শনের বক্তব্য মানুষের জীবন মানেই কিছুটা সুখ আর অনেকটা দুঃখ-শোক এবং ইহকাল ও পরকাল। একজন মানুষ সারা জীবনে এই যে সুখ-আনন্দ, দুঃখ-শোক ভোগ করে, তার কারণ, তার পূর্বজন্মের সুকৃতি এবং দুষ্কৃতি। গতজন্মের যত দুষ্কৃতি এই জন্মে দুঃখ-শোক-যন্ত্রণা হয়ে ফিরে আসে। অতএব ইহকালে অর্থাৎ এই জীবনে যদি নিশ্ছিদ্র সুকৃতি করা যায়, তাহলে পরকালে অর্থাৎ পরজন্মে বড়ো সুখের সময় আসে। যেমন এই জীবনে আপনি শূদ্র হয়ে নিখুঁত আনন্দে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের সেবা যদি করতে পারেন, মৃত্যুর পর পরজন্মে আপনি অবশ্যই ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয় হয়ে পুনর্জন্ম নেবেন – অন্ততঃ বৈশ্য তো হবেনই! আর সব থেকে ভালো হল পুনর্জন্মের চক্করে না গিয়ে, সরাসরি মোক্ষ পেয়ে যাওয়া। একবার মোক্ষ পেয়ে গেলে, জন্ম-মৃত্যুর এই চক্র থেকে বেরিয়ে আপনি পিতৃলোক, দেবলোক, স্বর্গলোক, বৈকুণ্ঠলোক বা কৈলাসলোকে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু এই লোকগুলোতে গিয়েও কোন স্থায়ী সমাধান হবে না। কারণ এই প্রত্যেকটি লোকের সুখ ভোগ করার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, সেই সময় শেষ হলেই আবার আপনাকে মর্তলোকে ফিরে আসতে হবে। অনেকটা আমাদের আজকালকার ছুটি কাটানোর মতো, তিনদিনের উইকেণ্ড বা একমাসের পূজা ভ্যাকেশন, তারপর তো সেই কাজে ফিরতেই হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যেটা আছে, সেটাই হল পরমমোক্ষ–পরমমুক্তি – এর পরে আর মানুষকে মরজগতে ফিরে আসতে হয় না। তবে ব্যাপারাটা ভারি শক্ত, বিগত প্রায় আড়াই হাজার বছরে কজন মানুষ পরমমোক্ষ পেয়েছেন, সেটা কেউই সঠিক বলতে পারে না। কারণ পরমমুক্তি ব্যাপারটা হল পরম ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যাওয়া। সাধনার যে উচ্চতম স্তরে পরম ঈশ্বরে লীন হওয়া যায়, সেই স্তরে সাধক আর কিছু বলার অবস্থায় থাকেন না। নদী যখন নিজেকে সমুদ্রের জলে মিশিয়ে দেয়, তখন সে তো আর নদী থাকে না, সে তখন সমুদ্রই হয়ে যায়। তেমনি সাধক যখন ঈশ্বরে লীন হন, তিনি ঈশ্বরই হয়ে যান। তাঁর পক্ষে সেই পরমমুক্তির আস্বাদ জাগতিক মানুষের কাছে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।

ভারতীয় দর্শনের ভিত্তি অবশ্যই বেদ, বেদের সংহিতা এবং উপনিষদসমূহ। ভারতীয় দর্শনের প্রধান তত্ত্ব ছয়টি - সাংখ্য, পাতঞ্জল, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত। একত্রে ষড়দর্শন বলা হয়ে থাকে। আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি, মোটামুটি ৬০০ বি.সি.ই পর্যন্ত, তার মোটামুটি শত খানেক বছর পরের কোন সময়ে দর্শন শাস্ত্রের সূত্রপাত হয়েছিল সাংখ্য দর্শনে। মহর্ষি কপিল এই সাংখ্যদর্শনের প্রবর্তক। মহর্ষি বা কপিল মুনি, ভগবান বিষ্ণুর অংশ-অবতার। শ্রীমদ্ভাগবত গীতার “বিভূতি যোগে” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন,

অশ্বত্থঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাঞ্চ নারদঃ।

গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ।। ১০/২৬[6]

সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমিই অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমিই নারদ, গন্ধর্বগণের মধ্যে আমিই চিত্ররথ, সিদ্ধযোগীগণের মধ্যে আমিই কপিল মুনি। (শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলায় অনুবাদ- লেখক)

পণ্ডিতেরা বলেন সাংখ্য দর্শনের রচনাকাল ৫০০ বি.সি.ই-র কিছু আগে এবং তার কিছুদিন পরেই পাতঞ্জল দর্শনের রচনাকাল, এবং তারও কয়েকশ বছর পরে মোটামুটি ৩০০-২০০ বি.সি.ই-তে ন্যায়দর্শনের রচনাকাল। অতএব আমাদের আলোচ্য সময়কালের কিছু পরেই সাংখ্য এবং পাতঞ্জল দর্শন রচনা হয়েছে। সে প্রসঙ্গের একত্র আলোচনা আসবে এই গ্রন্থের অন্তিম পর্বে।  

 

২.৬.৫ ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী মতাদর্শ বা লোকায়ত দর্শন

লোকায়ত দর্শনের মূলকথা হল, তারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জড়জগৎ ছাড়া অন্য কোন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। অতএব তাদের কাছে পার্থিব সুখ-দুঃখ ছাড়া অন্য আর কিছু পুরুষার্থ থাকতে পারে না। তাদের দর্শনে ঈশ্বর বা দেবতা নেই, পরলোক বা পরজন্ম নেই, মৃত্যুর পর মানুষের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই দর্শনকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে চূড়ান্ত অবিশ্বাসবাদও বলা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ বৌদ্ধগ্রন্থ “সামান্য ফলসূত্ত”-এর বর্ণনা অনুযায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অবিশ্বাসী অজিত কেশকম্বলীর কথাগুলি, এই দর্শনের ধারণাটিকে স্পষ্ট করে। এই দর্শনের সঙ্গে রামায়ণের তপোধন জাবালির মতের বিশেষ পার্থক্য পাওয়া যায় না।  

দান যজ্ঞ হোম এবং সুকৃত ও দুষ্কৃত কর্মসমূহের কোন ফলবিপাক নাই। ইহলোকও নাই, পরলোকও নাই। মাতা নাই, পিতা নাই, উপপত্তিক (যৌক্তিক বা প্রামাণিক) কোনো সত্তাও নাই। ইহলোকে সম্মগ-গতো (সম্যকজ্ঞানগত?) কোনো শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ নাই – যাঁহারা সম্যক গমন করেন, যাঁহারা স্বয়ং অভিন্ন সাক্ষ্য দ্বারা ইহলোক এবং পরলোকগুলিকে অনুধাবন করিতে পারেন এবং নিজেদের জ্ঞান অপরের কাছে বিতরণ করিতেও পারেন।

চারি মহাভূত-বিশিষ্ট পুরুষ যখন মারা যায় তখন তার কায়ার পৃথিবী পৃথিবীতে প্রবেশ করে, কায়ার জল জলে প্রবেশ করে, কায়ার তেজ তেজে প্রবেশ করে, কায়ার বায়ু বায়ুতে প্রবেশ করে এবং ইন্দ্রিয়গুলি শূণ্যে বিলীন হয়। চারজন শববাহী– এবং শবাধার হল পঞ্চম – তাহার মৃতদেহকে লইয়া যায় এবং সৎকার স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত মানুষরা তাহার গৌরব কীর্তন করে। তাহার অস্থিগুলি কপোতের ন্যায় হইয়া যায় (পুড়িয়া ছাই হইয়া যায়) এবং তাহার আহুতিগুলি ভস্মে পরিণত হয়। ভিক্ষা অথবা দান – যাহারা এইরূপ তুচ্ছ মিথ্যা প্রলাপ বকে তাহাদিগকে আস্তিক্যবাদী বলা হয়। মৃত্যুর পর মূর্খ ও পণ্ডিতের মধ্যে প্রভেদ ছিন্ন হয় এবং মরণের পর আর কিছুই থাকে না”।

আগেই বলেছি, লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের আজ পর্যন্ত কোন গ্রন্থ বা পুঁথি পাওয়া যায়নি, নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। লোকায়ত দর্শন বলতে সংস্কৃত ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতেরা বলেছেন, এটি সাধারণ লোকের দর্শন– জনসাধারণের দর্শন। লোকেষু আয়তো-লোকায়তঃ। অর্থাৎ সাধারণ লোকের মধ্যে এই দর্শন ব্যাপ্ত বলেই লোকায়ত। লোকায়ত দর্শনের এই ব্যাখ্যায় ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ যেন লুকিয়ে আছে। সাধারণ লোক মানেই তারা মূর্খ এবং মূঢ়, বেদ ও উপনিষদের মহান জ্ঞান থেকে তারা বঞ্চিত। কিন্তু লোকায়তের আরও একটা অর্থ হয়। লোকায়ত হল ইহলোকের দর্শন। যারা পরলোক মানে না, আত্মা মানে না, ধর্ম মানে না, মোক্ষ মানে না, তাদের বলা হয় লোকায়তিক। তারা মনে করে মাটি-জল-আগুন আর বায়ু দিয়ে গড়া এই মানব দেহ এবং এই পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য। দেহ যতদিন আছে, ইহলোক আছে, এই পৃথিবী আছে, দেহ না থাকলে অর্থাৎ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ।

এখনও পর্যন্ত লোকায়ত দর্শনে এমন কী দেখা গেল, যার জন্যে ব্রাহ্মণ্য আস্তিকরা এতটা বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল? প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুব প্রচ্ছন্ন কিন্তু ভয়ংকর। ব্রাহ্মণ্য দর্শন নীচু স্তরের মানুষদের স্বপ্নের কথা শোনাচ্ছে। এই জন্মের শুদ্রত্ব বা দাসত্ব ভুলে গিয়ে তারা যদি উচ্চবর্ণের একনিষ্ঠ সেবা করে, তাহলে পরজন্মে তাদের উত্তরণ সুনিশ্চিত। উচ্চবর্ণে উত্তরণ তো সামান্য কথা, ঈশ্বরে প্রগাঢ় বিশ্বাস রেখে একনিষ্ঠ সেবা করলে মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে চলে যাওয়াও অসম্ভব নয়। আর স্বর্গ মানেই তো, চূড়ান্ত আনন্দ এবং সুখভোগ– তৃষ্ণা নিবারণে সুধা, ক্ষুধায় পর্যাপ্ত সুস্বাদু খাদ্য, চিরবসন্ত ঋতু, স্থিরযৌবনা অপ্সরাদের নৃত্য-গীত এবং সঙ্গ। এ সব কিছুই পাওয়া যেতে পারে দাসত্ব এবং শূদ্রত্ব ভুলে একনিষ্ঠ সেবায়।

লোকায়ত দর্শনের এখানেই আপত্তি। তাদের বক্তব্য এটা প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বর্গ কে দেখেছে, পরজন্ম কে জেনেছে? ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কিছু স্বার্থপর ব্রাহ্মণ এই মোহ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সাধারণের কাছে যা কিছু প্রত্যক্ষ তার প্রমাণকে স্বীকার করাই, তাদের এই বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার একমাত্র নিরাপদ রাস্তা। শুধু তাই নয় লোকায়ত দার্শনিকদের আরও একটা আশঙ্কা ছিল, এই স্বপ্নে নিবিড় আস্থা রাখলে, দাস ভুলে যাবে তার দাসত্ব, দরিদ্র ভুলে যাবে তার দারিদ্র। ব্যাপারটা হয়ে উঠবে, মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়ার মতো। কারণ এক অবস্থা থেকে উচ্চতর অবস্থায় উত্তরণের প্রচেষ্টা মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক ধর্ম। বর্ণাশ্রমের বিধি অনুযায়ী একজন দাস বা শূদ্র জন্মসূত্রেই সে শূদ্র বা দাস। তার সন্তানাদিও দাসই থাকবে।

ধরা যাক আমি একজন দাস। সারা জীবন মন দিয়ে সেবা করতে লাগলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও উপদেশ দিয়ে গেলাম, আমার মতো সেবা করতে থাক, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের আবার স্বর্গে দেখা হবে। স্বর্গে গিয়ে দেখা হচ্ছিল কিনা জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু এই বিশ্বাসে বিভোর দাসেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসই থেকে যাবে! তারা অন্য আর কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টাই করবে না। এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া। আর এখানেই ব্রাহ্মণ্য দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত দর্শনের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব। এবং বলা বাহুল্য এই দ্বন্দ্ব উচ্চস্তরীয় পরমমোক্ষ লাভের জন্যে নয়, খুবই নীচুস্তরের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, এই লোকায়ত দর্শনের অনেক প্রবক্তাই ক্রীতদাস ছিলেন। যেমন বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে অজিত কেশকম্বলী ছিলেন একজন ক্রীতদাস।

লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রায় শুরুর থেকেই সমান্তরাল পথে চলতে থাকলেও - নিরন্তর বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া খুব মারাত্মক কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মনীষী পণ্ডিত প্রবক্তারাও কোনদিনই সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁরা লোকায়ত দর্শনকে বারবার শাপ-শাপান্ত করেছেন এবং প্ররোচিত করেছেন লোকায়তিক মানুষদের বিনাশ করতে। তার সব থেকে বড়ো উদাহরণ চার্বাক মুনির হত্যাকে মহাভারতের অকুণ্ঠ প্রশ্রয়।

লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলতে না পারলেও, দুটি নতুন দর্শন তাদের যথেষ্ট বিপদে ফেলেছিল। এই দুই দর্শনের প্রবল ধাক্কায় বদলে ফেলতে হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের খোল নলচে। সে দুটি হল জৈন এবং বৌদ্ধ দর্শন। সে আলোচনা আসবে পরবর্তী পর্বে।   



[1] এই ভোজ গোষ্ঠীপতির কন্যা মাতা কুন্তী, অতএব তিনি শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কিত পিসিমা, এবং পঞ্চপাণ্ডব তাঁর পিসতুতো ভাই। 

[2] যদু গোষ্ঠী আমাদের কাছে যাদব গোষ্ঠী নামেই সুপরিচিত, যাঁর প্রধান ছিলেন রাজা নন্দ, তাঁর পত্নী মা যশোদা ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পালিকা মাতা।

[3] বেদ না মানা মানুষরা – আসুর – অর্থাৎ অসুর ভাবাপন্ন – তাদের রাক্ষস বা অসুর বলাই চলে – যেখানে স্বয়ং শ্রীশ্রী গীতার অনুমোদন রয়েছে!

[4] সংস্কৃত সাহিত্যে প্রায়শঃ দেখা যায় প্রবাসী পতির বিরহিণী পত্নীরা একবেণী-তে চুল বাঁধতেন। এর অর্থ পতি-সঙ্গে তাঁরা সাধারণতঃ দুই বেণী বা মনোহারি কবরীতে কেশ সজ্জা করতেন। এখানে অযোধ্যাপতি শ্রীরামচন্দ্রের বিরহে, অযোধ্যা নগরীই যেন বিরহিনী পত্নী। উপমা মাধুর্যে সংস্কৃত কাব্যের জুড়ি মেলা ভার।

[5] নির্ভীক চিত্তে, উচ্চৈঃস্বরে, গর্ব্বিত বাক্যে” চার্বাকের প্রতি এই তিনটি বিশেষণ ব্যবহার করে মহাভারত রচয়িতা প্রচ্ছন্ন একটু প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত করলেন কি? কুচক্রী এক রাক্ষসের সম্পর্কে অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ধরনের ভাষা সচরাচর আমরা পড়ে থাকি, তার তুলনায় এই বিশেষণগুলি ঠিক যেন মানাচ্ছে না।

[6] কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় কাল ৯০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন সময়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শ্রীশ্রীগীতা উপদেশ শুনিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে। তিনি তখন কপিলমুনির প্রসঙ্গ কী করে আনলেন? কপিল মুনি ও তাঁর সাংখ্য দর্শনের সময় কাল, ৫০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ না হয় ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, ভবিষ্যতের কোন কথাই তাঁর অজানা নয়। কিন্তু অর্জুন কেন কৌতূহলী হলেন না, বিখ্যাত এই কপিল মুনি কে? তাঁর নাম তো কোনদিন শুনিনি। অতএব, এমন সিদ্ধান্ত করাই যায়, মহাভারতে শ্রীশ্রীগীতা সংকলিত হয়েছে বহুযুগ পরে।

_______________________________________________________________________

এই পর্বের মানচিত্র ঋণঃ

১) https://cdn1.byjus.com/wp-content/uploads/2020/08/16-Mahajanapadas-768x591.png

২) https://www.harappa.com

এই পর্বের গ্রন্থ ঋণঃ

১) The penguin history of Early India – Romila Thapar

২) বাঙ্গালীর ইতিহাস (প্রথম পর্ব) –ডঃ নীহাররঞ্জন রায়।

৩) বেদ ও ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য – স্বামী সমর্পণানন্দরামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়বেলুড়মঠ।

৪) The wonder that was India – A. L. Basham.

৫) মহাভারত (মূল সংস্কৃত থেকে বঙ্গানুবাদ)–মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ।

৬) The Decline of Harappans – A research report (1966) - Mr. George F Dales (উৎসাহী

    পাঠকেরা এই লিংক থেকে পুরো রিসার্চ রিপোর্টটি পড়ে নিতে পারেন,

 https://www.harappa.com/content/decline-harappans

৭) Ancient Gold Mining Activities in India - An Overview: An Article published in

    Iranian Journal of Earth Sciences 7 (2015) – by A.K. Grover and M.K. Pandit

৮) The wonder that was India – A. L. Basham.

৯) মহাভারতের সমাজ - শ্রীযুক্ত সুখময় শর্মা।

১০) শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলা অনুবাদ (চিরসখা হে) – কিশোর ঘোষাল

১১) লোকায়ত দর্শন–শ্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

১২) শ্রীমদ্ভাগবত (পুরাণ) – বাংলা গদ্যানুবাদ শ্রীযুক্ত তারাকান্ত কাব্যতীর্থ।

১৩) বাল্মীকি রামায়ণ – বাংলায় গদ্যানুবাদ– শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য।  


ধর্মাধর্ম দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত 

 


রবিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশের হৃদয় হতে

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]

 

তখনও কলকাতাকে যেন ঠিক নিজের জায়গা বলে মনে হত না। কর্মসূত্রে বাবার কলকাতায় থাকাটা সুবিধেজনক। উপরন্তু কলকাতায় লেখাপড়া করার সুযোগসুবিধেও অনেক বেশী। সেই কারণেই যেন আমাদের কলকাতায় থাকা। সেই সময়ে বাবা ও মায়ের পরিকল্পনা ছিল বাবার রিটায়ারমেন্টের পর বর্ধমানেই আবার ফিরে যাবেনগ্রামের বাড়িতে নয়, তবে বর্ধমান শহরেসেই মতো বর্ধমান শহরের নীলপুরে বাবা একফালি বাস্তুজমিও কিনে ফেললেন, আর অবসর সময়ে বাবা ও মা সেই বাড়ির পরিকল্পনা করতে লাগলেন 

মায়ের গা ঘেঁষ্টে বসে আমি বহুদিন দিন শুনেছি মায়ের স্বপ্নসমূহ। কোনখানে তুলসীমঞ্চ বসবেবারান্দায় উঠতে সিঁড়ির দুপাশের দেওয়ালটা হবে ঘোরানো মত, লাল টুকটুকে সিমেন্ট দিয়ে মাজা হবে সেই দেয়াল। সিঁড়ি উঠতে ঘোরানো দেয়ালের মধ্যে মাটি দিয়ে দুপাশে বসানো হবে সাদা আর রক্ত গোলাপের ঝাড়। বাড়িটা হবে এল প্যাটার্নের। একতলায় থাকবে বৈঠকখানা, দুটো শোবার ঘর, রান্নাঘর আর সিঁড়ির ঘর, টানা বারন্দার ওপাশে একটু তফাতে বাথরুম টয়লেট। বাথরুমের সামনে সিমেণ্ট বাঁধানো চত্বরে বাসনমাজা, কাপড়কাচার জায়গা আর টিউবওয়েল। গ্লোব নার্শারি থেকে নিয়ে যাওয়া হবে নারকেল গাছ, যে গাছে পাঁচবছরের মাথায় ফল ধরে। তারমধ্যে অন্ততঃ দুটো থাকবে সোনামুখী নারকেল। বুকউঁচু পাঁচিলের কোল ঘেঁষে থাকবে ফুলগাছের সারি- টগর, কামিনী, কাঞ্চন, জবা, রঙ্গন, চাঁপা, নয়নতারা। মায়ের নিত্যপুজোয় ফুলের অভাব থাকবে না। প্রাঙ্গণের ছোট্ট বেডে ফুটবে মরশুমী ফুল, বেলী, রজনীগন্ধা, দোপাটি, অথবা ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ক্যালেনডুলা।

ওই সময়েই বাবার অফিস কলিগরা অনেকে মিলে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যান্ডের অনতিদূরে একলপ্তে অনেকটা জমি কিনলেন। বাবাকেও বহুবার তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন, ওইখানে কিছুটা জমি নিতে, একসঙ্গে সকলে থাকলে সবদিকেই অনেক সুবিধে হয়। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। প্রথমতঃ আগেই বলেছি আমাদের কাছে কলকাতা তখনও ‘আমচি’ শহর হয়ে ওঠে নি। দ্বিতীয়তঃ যাদবপুরের ওই অঞ্চল তখনও ছিল নগর সুবিধের আওতার অনেকটাই বাইরে, অনুন্নত, সেখানে সন্ধের পর শৃগাল ও মশার চরম আধিপত্যতৃতীয়তঃ ওই অঞ্চলের প্রতিবেশি এবং বাবার কলিগদের সকলেই ছিলেন ওপার বাংলার লোক, অর্থাৎ বাঙাল। বাঙাল অধ্যুষিত অঞ্চলে একক ঘটির পক্ষে সারাজীবন বসবাস নাকি আদৌ সুখপ্রদ হতে পারে না। কাজেই যাদবপুরের পরিবর্তে বর্ধমানে ঘটি পরিবেষ্টিত বসবাসের স্বপ্নেই আমাদের দিন কাটতে লাগল।

আমার ক্লাশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রায় সকলেই ছিল পুরাতনী বাঙাল, এমনকি আমরা যে শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বিশিষ্ট ঘটি পাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম, সেখানেও পাড়ার বন্ধুদের অধিকাংশই ছিল ভাড়াটে এবং বাঙাল। ওপাড়ার ক্ষয়িষ্ণু ঘটি পরিবারগুলি অধিকাংশই বাড়ি ভাড়ার টাকার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন, কিন্তু ভাড়াটে হিসেবে আমরা ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে ছিলাম একটু অবজ্ঞার পাত্র! আমাদের মধ্যে বাঙাল-ঘটি সংক্রান্ত ঠাট্টা-ফাজলামোর চলন ছিল ঠিকই, কিন্তু কোন সংকট না আমার মধ্যে ছিল, না পেয়েছি কোনদিন কোন বন্ধুর থেকে।

এই রকম সময়েই, ৭১-এর ২৬শে মার্চ শুরু হল পূর্বপাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ। ওইদিন ঘোষণা হল, প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। অবিসংবাদিত জননেতা জনাব মুজিবুর রহমান বন্দী হলেন পাকসেনাদের হাতে। কিন্তু রুদ্ধ করা গেল না তাঁর কণ্ঠস্বর, সেই স্বরের বজ্রনির্ঘোষ ওপারের বাঙালী জনগণের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিলএ পারে আমার বন্ধুরাও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল এবং আশ্চর্য আমরা, সনাতনী ঘটি হওয়া সত্ত্বেও, সেই উত্তেজনায় সমান সামিল হতে পেরেছিলাম।

রেডিওয় রাত আটটার সংবাদ ও সংবাদ পরিক্রমার একমাত্র আকর্ষণ তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় রোজই সংবাদ পরিবেশন করতেন শ্রীযুক্ত বিভূতি চৌধুরি ও শ্রীযুক্ত দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়বিভূতিবাবু গম্ভীর কণ্ঠে যেদিন রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর পতনের, মুক্তিযোদ্ধাবাহিনীদের সাফল্যের সংবাদ দিতেন সেদিন অদ্ভূত এক আনন্দ অনুভব করতাম। তাঁর কণ্ঠে জয়ের প্রত্যেকটি সন্দেশ আমাকে রোমাঞ্চিত করে তুলত। আর দেবদুলালবাবু তাঁর রোমান্টিক কাব্যিক কণ্ঠে জাগিয়ে দিতেন আমার আবেগ। সংবাদের পরে প্রচার করা হতো রেডিও কার্টুন। পাকিস্তান সরকারকে বিদ্রূপ করে সেই সব নকশায় থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন। 

সেই সময় ‘সোনার বাংলা’ বলে একটা রেডিও স্টেশনও খুব শুনতাম। সেই স্টেশন প্রচার করা হতো ঢাকা থেকে, যদিও সেটি আদতে ভারত থেকেই গোপনে প্রচার হতো, ঢাকার নাম দিয়ে সেই বেতার কেন্দ্রের শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। আর একটি গান শুনতাম –

“বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,

জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেই কো শেষ...বাংলাদেশ”।

মাঝে মাঝেই সেখানে প্রচার করা হত বঙ্গবন্ধুর সেই বিপ্লবের ডাক –

“বন্ধুগণ, তোমাদের কাসে যার যা অস্ত্র আসে লইয়া ঝাপায়ে পড়। আমাদের যদি হত্যা করা হয়, আমরাও সেড়ে কতা কইব না...”আর অনুষ্ঠানের শেষে বাজতো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত – “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। 

দীর্ঘ ন’ মাস ধরে চলতেই থাকল বীভৎস রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। কলকাতা শহরের আশেপাশে এবং সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি ভরে উঠল সর্বস্বহারা বাস্তুচ্যুত মানুষে। শোনা যায়, ওই কমাসে এককোটির উপর উদ্বাস্ত আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গে। অবশেষে একাত্তরের তেসরা ডিসেম্বর, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, আক্রমণ হানল পশ্চিম সীমান্তে। এতদিন ছিল পরোক্ষ সমর্থন, এবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ভারতও জড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে। 

সেই সময়, এই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আমার বালকমনে অদ্ভূত এক আলোড়ন তুলেছিল। তার ওপর এই যুদ্ধে কলকাতার পরিস্থিতিও আমার মনে ভীষণ এক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলশহরে তখন ব্ল্যাক আউট ঘোষণা হয়েছে। সন্ধের পর ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ করে আলো জ্বালতে হত রাস্তার সমস্ত বিজলিবাতিতে ঠুলি লাগানো হয়েছিল আলোর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্যে। সমস্ত গাড়ির হেডলাইটের উপরের অর্ধেকটা কালো রং দিয়ে ঢেকে ফেলতে হয়েছিল, যাতে রাত্রের আলো কোনভাবেই বোমারু বিমানের চোখে না পড়ে। পুরো কলকাতা শহর সতর্ক হয়ে থাকত বোমা পড়ার আশংকায়। আমাদের স্কুলের মেন গেটের সামনে ও ভেতরের বারান্দাগুলি্র সামনে গার্ড ওয়াল তুলে দেওয়া হল পোক্ত ইটের গাঁথনিতে। যদি কোন সময় বোমা পড়েও, স্পিলন্টার যেন বেশী ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের নিরাপত্তার কারণে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ছুটির আগের দিন স্কুলের উঠোনে আমাদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হল, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ। বোমা পড়ার সময়, দুই হাঁটু ও কনুইয়ে ভর দিয়ে কিভাবে শুয়ে থাকতে হবে মেঝেয়। বুঝিয়ে দেওয়া হল সাইরেনের বিভিন্ন সংকেতের তাৎপর্য।

সন্ধের পর বাবা অফিস থেকে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমরা চরম উৎকণ্ঠায় থাকতামবাবা বাড়ি ফিরলেই সবাই মিলে একসঙ্গে রেডিওর সংবাদ শোনা হতফেরার পথে বাবা নিয়ে আসতেন তাজা সংবাদ নিয়ে সান্ধ্য পত্রিকার সংস্করণ। তখন রেডিওতে বার বার প্রচার করা হতো ‘কোন রকম গুজবে কান দেবেন না’। তা সত্ত্বেও অজস্র গুজব ছড়িয়ে পড়ত পাড়ায় পাড়ায়। শোনা যেত বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানী সেনা ঢুকে পড়ছে। এক ঝাঁক চিলের মতো বোমারু বিমানও নাকি দেখেছে কেউ কেউ। সেই পরিস্থিতিতে কে বলে দেবে কোনটা গুজব আর কোনটা তথ্য! 

এই উত্তেজনার আঁচ অবিশ্যি বেশীদিন রইল না, মাত্র বারোদিনের যুদ্ধে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনা সমর্পণ করতে বাধ্য হল বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সেনা বাহিনীর কাছে। দিনটা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১অবসান হল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। জন্ম নিল একটি স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র - বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে রচনা হয়ে গেল এক ইতিহাস। আর আমার মনের মধ্যে সঞ্চয় হয়ে রইল দেশ সম্পর্কে অদ্ভূত আবেগময় এক অভিজ্ঞতা।

১৯০৫ সালে অতিধূর্ত বৃটিশরাজ নিজেদের স্বার্থে বাংলাকে ভেঙে দু টুকরো করেছিল । সার্বিক আন্দোলনে ভাঙাবাংলা আবার জোড়া লেগেছিল ১৯১০-এ। ১৯৪৭ সালে দেশীয় নেতাদের ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ভারত ভেঙে দুটি রাষ্ট্র হয়েছিল - ভারত আর পাকিস্তান  বাংলাকেও আরেকবার ভেঙে ফেলে গড়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তান। প্রতিবেশী এই দুটি দেশের আম জনগণের ভাষা এক, সংস্কৃতি, চালচলন, আচার ব্যবহারও এক। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে এক ধর্ম ছাড়া অন্য কোন সাযুজ্য না থাকলেও, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল পাকিস্তানের অংশ! এসব ঘটনা আমরা জানছিলাম ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে আবার টুকরো হয়ে গেল, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া একটি নবীন দেশ। তবে কি ধর্ম ধরে রাখতে পারে না মানুষকে? পারে, নিশ্চয়ই পারে, যদি না সেই ধর্মের আড়ালে থাকে আঞ্চলিক স্বার্থ আর ক্ষমতা আয়ত্ত্বে রাখার আগ্রাসী মনোভাব। আর যদি থাকে এক সহমর্মী মানবিক মন।

এবারে আর বইপড়া ইতিহাস নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের তীব্র আঁচ লাগা অভিজ্ঞতায় সাক্ষী হয়ে রইলাম। ১৯৫২-র রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন, সার্থক হল দেশের পূর্ণ স্বাধীনতায়। আর কিছু না পারলেও, আমার আন্তরিক সমর্থনটুকুতো দিতে পেরেছিলাম।   



বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

যদি হও স্বজন

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]

 

[এর আগের পর্ব "ধরে রাখাই ধর্ম" - 👈সূত্রটি ক্লিক করলেই পড়া যাবে।] 


মাস দুয়েকের মধ্যে আমাদের উপনয়ন অনুষ্ঠান সমাধা হয়ে গেল, পঞ্জিকা অনুসারে নির্দিষ্ট নির্বাচিত দিনটিতে।

সূর্যোদয় থেকে একের পর এক বিধিসম্মত আচার-অনুষ্ঠান, সুদীর্ঘ শাস্ত্রীয় পদ্ধতি ও একটানা যজ্ঞ শেষে ব্রহ্মচারীত্বে উত্তরণ হল সেই বালকের। সৌম্য ভিক্ষু বালক - মুণ্ডিত মস্তক, সূচ-বিদ্ধ কর্ণপরনে গৈরিক বসন, পায়ে কাঠের পাদুকা, হাতে অদ্ভূত আঁকাবাঁকা বেউল বাঁশের দণ্ড, কাঁধে গেরুয়া কাপড়ে বানানো বিশেষ ঝোলা। ভিক্ষুর বেশ, কিন্তু ভিক্ষা বৃত্তি করতে হবে না বরং একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আর সকলে আসবেন সেই ব্রহ্মচারী বালককে ভিক্ষা দেবার জন্যে। এই ভিক্ষা দান পুণ্যকর্মপ্রথম ভিক্ষা দেবেন মাতৃসমা কোন নারী, পরবর্তী জীবনে তিনিই হবেন ব্রহ্মচারী সেই বালকের সারাজীবনের দ্বিতীয় মা - ভিক্ষুমা। এক নারী জাগতিক জন্ম দিয়েছেন, উদ্ভাসিত করেছেন প্রাণ, আর এক নারীর হাতে দ্বিতীয় জন্ম হয়ে, উদ্ভাসিত হবে আত্মা। প্রথম নারী আমার মা, দ্বিতীয় নারী হলেন ভিক্ষুমা – আমার পূর্বাশ্রমে যিনি ছিলেন আমার বড়োমামীমা। 

“ভবতী ভিক্ষাং দেহি” এবং “ভবান ভিক্ষাং দেহি” বাক্য উচ্চারণ করে ভিক্ষা চেয়েছিল সেই বালক ব্রাহ্মণ, আর কাঁধের ঝোলা ফাঁক করে ভিক্ষা গ্রহণের পর “ওঁ স্বস্তি” উচ্চারণে ও হাতের বিশেষ ভঙ্গীতে সকলের মঙ্গল কামনা করেছিল এই সমগ্র অনুষ্ঠান সুদূর অতীতের বর্ণাশ্রম বিভাজিত সমাজের আনুষ্ঠানিক রীতিপ্রকরণের অনুসরণ। আজকের আধুনিক পরিস্থিতিতে বাস্তব অর্থে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু এই অনুসরণ বারবার ফিরিয়ে আনে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যের স্মরণ।

এসব কথা সে সময় আমার মোটেই মনে হয়নি। বরং আমার তীক্ষ্ণ লক্ষ্য ছিল ভরে উঠতে থাকা ভিক্ষার ঝুলির দিকে। চাল, আলু আর কিছু আনাজের সঙ্গে জমে উঠছিল সোনার আংটি আর বেশ কিছু নগদ টাকা। অন্য কিছু নয়, আমি তখন মনে মনে হিসেব করছিলাম কত টাকা জমা হল, আর এই টাকা দিয়ে কতগুলি বই কেনা যাবে।

আসলে প্রত্যেক বছর জন্মদিনে মা আমাদের হাতে টাকা দিতেন একটি করে বই কিনতে, আর সেই টাকা নিয়ে চলে যেতাম বঙ্কিম চাটুজ্জ্যে স্ট্রীটে দেব সাহিত্য কুটিরের দোকানে। যেখানে রয়েছে সুধীন্দ্রনাথ রাহার বাংলা অনুবাদে বিদেশী ক্ল্যাসিক উপন্যাসসমূহএভাবেই দশ-বারো টাকা দরে কিনে ফেলেছিলাম হাঞ্চব্যাক অফ নৎরদাম, ট্রেজার আইল্যান্ড, টয়লার্স অব দি সি... প্রত্যেকটি বইয়ের পিছনে থাকত আরো অনেক অনেক বইয়ের তালিকা, মনে হত বড় হয়ে যখন চাকরি করব, প্রথম মাসের টাকায় সব বই কিনে নেব, সব – থ্রী মাস্কেটিয়ার্স, রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ, লাস্ট ডেজ অব পম্পেই, দি কানেকটিকাট ইয়াংকি, ডা: জেকিল এন্ড মিঃ হাইড... কাজেই ভিক্ষার ঝুলি ঝেড়ে, হিসেব করে যখন তিনশ ছাপান্ন টাকা পেলাম, তখন আনন্দের সীমা ছিল না, গোটা দেব সাহিত্য কুটিরটিকে কিনে ফেলার আশ্চর্য স্পর্ধায় চনমনে হয়ে উঠেছিলাম সেদিন

সব মিলিয়ে সীমিত সাধ্য আর অপ্রয়োজনীয় বলেই, খুব ধুমধাম-জাঁকজমক হল না ঠিকই, কিন্তু মজার কোনো কমতি, আমি অন্ততঃ অনুভব করিনি। ঘনিষ্ঠ বৃত্তের আত্মীয়স্বজন সকলেই এসেছিলেন। কিন্তু একটু বহির্বৃত্তের স্বজনরা আমাদের বয়কট করে ফেললেন, আমাদের এই অধার্মিক অনাচারের জন্যে। তাঁরা পত্রদ্বারা বাবাকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন আধুনিক কালের এই হাল্কা চালের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে এমন অপকর্ম চাক্ষুষ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই তাঁরা আসবেন না তাঁদের না আসার কথায় মন খারাপ করে মা ও বাবা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তখন আর নতুন ভাবে ভাবার সময় ছিল না, আর সঙ্গে মেজদাদুর স্থিত আশ্বাস থাকায় নতুন কোন ভাবনাও দানা বাঁধতে পারেনি। 

আমাদের উপনয়ন উপলক্ষে যেদিন প্রীতিভোজ ছিল, শুধু সেদিনই - মাত্র একদিনের জন্যেই রান্নার ঠাকুর ডাকা হয়েছিল। বাকি দিনগুলিতে মামীমা, মাসিমাদের সঙ্গে পিসিমা, কাকিমারা হাতে হাত মিলিয়ে সব কাজ করেছিলেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁদের কাজের অন্ত ছিল না, অথচ সারাটাক্ষণ তাঁদের মধ্যে চলছিল একে অন্যের পিছনে লাগা খুনসুটি। হাসি, হাসি আর আনন্দ, কোন ভুল বোঝাবুঝি ছিল না। মাসিমারা বাবার শ্যালিকা, কাজেই তাঁরা জামাইবাবু হিসেবে বাবার পিছনে লাগছিলেন খুব, আর আড়াল থেকে মাসিমাদের এই প্রগলভতা রীতিমতো উপভোগ করতে দেখেছিলাম কাকীমাদের – কারণ ভ্রাতৃবধূ হিসেবে তাঁরা বাবার সামনে আসতেন খুবই কমকোন কোন সময় এমনও দেখেছি কাকীমারাই মাসিমাদের প্ররোচিত করছেন বাবার পিছনে লাগার জন্যে! ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও মেজদাদু ও ঠাকুমা নীরবে উপভোগ করছিলেন সমস্ত পরিস্থিতি, দিদিমার অধরেও লাগাতার মৃদু হাসি – যদিও দু একবার দুর্বলভাবে আপত্তি জানাচ্ছিলেন তাঁর মেয়েদের বাচালতায় এর মধ্যে ভীষণ অভাব অনুভব হচ্ছিল অনুপস্থিত বড়োমামা আর বন্নিদিদির। বড়োমামা কী করে আসবেন, সব্বাই মিলে ঘরবাড়ি ফেলে আসা যায় - গরু-বাছুর, খেতখামার, কাজকর্ম কে সামলাবে? আর বন্নিদিদি চলে এলে বড়োমামার খাওয়াদাওয়া চলবে কী করে? কাজেই, ওরা নাচার, আসতে পারলেন না।

তবু সে যাই হোক, সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভূত মধুর আত্মীয়তা। যার প্রতিটি পরতে আনন্দ এবং আনন্দ। তখন মনে হয়েছিল যাঁরা আমাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে অনুপস্থিত রইলেন, তাঁরা ধর্মের ধ্বজা হয়তো ধারণ করে রইলেন, কিন্তু অনুভব করতে পারলেন না – আত্মীয়তার অনবদ্য সহজ স্বভাবধর্ম।  

আমরা ছেলেরা ও বড়োরা যখন রাত্রে ম্যারাপ বাঁধা ছাদে শুতে যেতাম, তখন নীচেয় মহিলারা খেতে বসতেনতাঁদের গল্প আর হাসির আওয়াজ শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম, আবার সকাল সকাল ছোট মাসিমা বড়ো ট্রেতে করে অনেক খালি কাপ আর বিস্কুট আর ঢাউস কেটলিতে চা নিয়ে ছাদে আসতেন – বেড টি দিয়ে বড়োদের ঘুম ভাঙাতে। আর আমাদের তুলে দিতেন মুখ ধুয়ে চটপট রেডি হয়ে নিতে – জল খাবার রেডি। বড়োদের অনেক কাজ – সমস্ত অনুষ্ঠান সুষ্ঠু সম্পন্নের জন্য যোগাড় যন্ত্র করতে হবে - ব্যবস্থা করতে হবে। সক্কাল সক্কাল উঠে সবাই বেরিয়ে পড়লেন বাজার করতেআজ সারাটা দিনে সমস্ত কাঁচা বাজার সেরে রাখতে হবে, কালকে সকালে বেরিয়ে শুধু মাছ, আর একটু বেলায় দই আর মিষ্টিকাজেই সারাটাদিন সকলের চরম ব্যস্ততা, বারবার বাজার যাওয়া আর আসা। বস্তা বস্তা মাল উঠে আসছে বাড়ির ছাদে। আলু থেকে শুরু করে কলাপাতা, মায় মাটির গেলাস পর্যন্ত - থরে থরে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে ছাদের একধারে আর অন্য এক ধারে কয়লা, জ্বালানি কাঠ, ঘুঁটে, কেরোসিন আর বেশ কিছু ইঁট আর মাটি।

রান্নার ঠাকুর বিকেলে এসে ছাদের এক কোণে মাটি আর ইঁটের গাঁথনিতে বানিয়ে তুলল দু-দুটো উনুন, তার ভিতরে লোহার শিক দেওয়া। আজ সারারাতে মাটি শুকিয়ে উনুন রেডি হয়ে থাকবে – কালকে সকালে ঘুঁটে আর কয়লা পেটে নিয়ে, তারা জ্বলে উঠবে প্রায় শদেড়েক লোকের রান্নার আয়োজনে। সারাটা দিনের দৌড়োদৌড়ির পর রাত আটটা নাগাদ বড়োদের মিটিং বসল ছাদে, ফর্দ অনুযায়ী সব মাল এসেছে কি না, না এসে থাকলে এক প্রস্থ হৈ চৈ, নীচে মহিলামহলে চায়ের হুকুম, তারপর আবার নতুন ফর্দ বাকি জিনিষের, কাল সক্কালেই আবার বেরোতে হবে বকেয়া মাল কিনতে।

এদিকে নীচেয় রাত্রে বাড়ির লোকেদের রান্নায় ব্যস্ত মাসিমা আর কাকিমারা। দিদিমা আর মেজ ঠাকুমা পা ছড়িয়ে বসেছেন সবুজ পানপাতার জঙ্গল নিয়েকালকের নিমন্ত্রিতদের জন্যে পান বানাচ্ছেন। চারপাশে চূণের ডাব্বা, সুপুরির স্তূপ আর যাঁতি, তরল খয়েরের পাত্র, ধনের চাল, লাল-নীল রঙীন চিনির মোড়কে মৌরীআমার এক মাস্তুতো দিদি আর এক পিস্তুতো দিদি - খুব ভাব হয়ে গেছে দুজনে – গায়ে গা ঘেঁষে বসে, খোসা ছাড়িয়ে বের করছে ছোট এলাচের দানা। দুজনে নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কি কথা বলছে কে জানে, ক্ষণে ক্ষণে হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে অন্যের গায়ে...। দিদিমা স্নেহ মাখা কণ্ঠে তাদের বলছেন, ‘দ্যাকোদিকি কাণ্ডখানা, এ মেয়েদুটো যে হেসে একেবারে গড়াগড়ি, এত হাসির কি হল, বাছা’? মেয়েদুটি দিদিমার কথায় কিছুক্ষণ চুপচাপ এলাচ ভাঙল ঠিকই, কিন্তু সে আর কতক্ষণ – সামলে থাকা যায় নাকি? তারা আবার হেসে হেসে লুটিয়ে পড়তে লাগল আগের মতোই।

সবাই ব্যস্ত, একমাত্র আমি ছাড়া। একে আমি সদ্য পৈতে হওয়া বামুন – অন্যদিকে খুব একটা বড়োও নই আবার খুব একটা ছোটও নই। কাজেই কিছু কাজ করতে গেলেই কেউ না কেউ দৌড়ে আসছেন আমাকে আটকাতে, ‘এ হে হে হে, তুই কী করছিস এখানে, রাখ রাখ, এই কি তোর কাজ করার সময়’? কাজেই আমি সব মহলেই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সব কিছু, দেখতে লাগলাম এই আয়োজন। সকলের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ পরিশ্রম, পারষ্পরিক সম্পর্কের অদ্ভূত সংমিশ্রণ   

দুটি মাত্র ঘর, একটি মাত্র টয়লেট, অনেকটা খোলা ছাদে বাঁশ, তেরপল আর কাপড়ের ম্যারাপ আর বেশ কয়েকজন সজ্জন প্রতিবেশীর উদার সাহায্যে প্রায় জনা তিরিশেক স্বজনের দিব্ব্যি সংকুলান হয়ে গেল চার-পাঁচদিনের জন্যে। কিভাবে হয়েছিল ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে, কারণ আজকাল সব শহরেই বাজেট অনুসারি ছোটবড় উৎসববাড়ির অভাব নেই, আর দুঘরের বাসায় এমন অনুষ্ঠান করার কথা আজ আর কেউ স্বপ্নেও ভাবেন না। এসব হতে পেরেছিল কারণ - অনলস কাজের মধ্যে, ছোট বড় সবার প্রতি সমান নজর রাখতে রাখতে, বড়মামীমাকে অনেকবার বলতে শুনেছিলাম – “যদি হও স্বজন, তেঁতুল পাতায় নজন”

ঋণ করে সাধ্যাতীত ব্যয়ে অনেক বড়োসড়ো আয়োজন করাই যেত, কিন্তু সমানুপাতে আনন্দ বেশী হত, এমনটা মনে হয় না। বরং ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তার পিছুটান একটা থাকত অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্তেই, সেটাতে আনন্দের রং অনেকটাই ফিকে হয়ে যেতে পারত।

মহাভারতে বকবেশী ধর্মরাজ, যুধিষ্ঠিরকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল – বিশ্বে সবচেয়ে সুখী কারা? স্থিতপ্রজ্ঞ যুধিষ্ঠির জবাবে বলেছিলেন যিনি অঋণী আর যিনি অপ্রবাসী – তাঁরাই সবচেয়ে সুখী। আমাদের মেজদাদু তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রায়োগিক প্রত্যয় দিয়ে আমাদের সুখী এবং বিপন্মুক্ত করেছিলেন। কারণ আমাদের এই উপনয়ন অনুষ্ঠানের প্রায় মাস সাত-আটেক পরেই, কোনদিন অসুস্থ না হওয়া আমার মা, হঠাৎই কঠিন অসুখে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন এবং সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছিলেন সুদীর্ঘ চিকিৎসার পর। কাজেই ঋণ করে আনন্দ অনুষ্ঠান, আমাদের এক চরম অনায়ত্ত বিপদের দিকে টেনে নিতে পারত। তা ঘটেনি, আমরা অঋণী ছিলাম বলে। তখন বারবার মনে হয়েছিল প্রকৃত গুরুজন হয়ে ওঠা বড়ো সহজ কাজ নয় – শুধু বয়েস নয় দরকার আরো অনেক কিছুর – সবচেয়ে বেশী দরকার প্রকৃত স্বজন হয়ে ওঠা।


--০০--

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

গীতা - ১ম পর্ব


 [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]


প্রথম অধ্যায়ঃ অর্জুনের বিষাদযোগ

 

এই সেই প্রান্তর, যেখানে প্রাচীন কালে মহারাজ কুরু, যিনি কুরুবংশের গোত্র রাজা, বহু যজ্ঞ পবিত্রভাবে সম্পন্ন করেছিলেন বলেই, তাঁর নাম অনুসারে এই প্রান্তরের নাম কুরুক্ষেত্র। বহু যজ্ঞের সুষ্ঠু আয়োজনে এই প্রান্তর ধর্মক্ষেত্রও বটে।

কুরুক্ষেত্রের এই প্রান্তরে যুদ্ধ শুরুর আয়োজন। কুরুবংশের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এই যুদ্ধ, একদিকে দুর্যোধনের নেতৃত্বে কৌরববাহিনী এবং অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরের নেতৃত্বে পাণ্ডববাহিনী। সমসাময়িক ভারতের প্রায় সমস্ত মহাবীর রাজন্যবর্গও বিরোধী দুই পক্ষকে সমর্থন করার জন্যে এসে মিলিত হয়েছেন এই যুদ্ধের প্রান্তরে। সবার উপরে আছেন দ্বারকাধীশ ভগবান শ্রীকৃষ্ণতিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, আসন্ন এই যুদ্ধে নিজহাতে অস্ত্র ধরবেন না, অর্জুনের রথের সারথি হয়েই তিনি পরিচালনা করবেন পাণ্ডবপক্ষের সকল রণকৌশল।

অবশেষে, দীর্ঘ প্রস্তুতির পর সেদিন যুদ্ধ শুরু করার জন্য কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে দুইপক্ষই সমবেত হয়েছে। চির অন্ধ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের পরিস্থিতি কি জানার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে তাঁর দিব্যদৃষ্টিধারী মন্ত্রী সঞ্জয়কে বললেন,

 

১/১

ধৃতরাষ্ট্র বললেন - আমাদের বাহিনী আর পাণ্ডবের সৈন্যসামন্ত, যুদ্ধ করার জন্যে পবিত্র এই কুরুক্ষেত্রে একত্র হয়ে এখন কে কী করছে, আমায় বিস্তারিত বলো, সঞ্জয়

 

১/২

সঞ্জয় বললেন – হে মহারাজ, রাজা দুর্যোধন যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডবের কুশলী সেনাবিন্যাস দেখে আচার্য্য দ্রোণের কাছে গিয়ে বলছেন -

 

১/৩

পাণ্ডবদের এই বিশাল সেনাবিন্যাস দেখছেন, গুরুদেব? আপনারই যোগ্য শিষ্য রাজা দ্রুপদের পুত্র বুদ্ধিমান ধৃষ্টদ্যুম্ন এটির পরিচালনা করছেন।

 

১/৪-৬

এই সেনাবাহিনীর মধ্যে ভীম ও অর্জুনের মতো মহাবীর যেমন আছে, তেমনই আছেন মহাবীর সাত্যকি, মৎস্যরাজ বিরাট, মহাযোদ্ধা দ্রুপদআরো রয়েছেন শিশুপাল পুত্র ধৃষ্টকেতু, যদুবংশের সেরা বীর চেকিতান, বীর শ্রেষ্ঠ কাশীরাজ, কুন্তিভোজের পুত্র পুরুজিৎ, শিবিদেশের রাজা শ্রেষ্ঠ বীর শৈব্য, পাঞ্চালদেশের মহা পরাক্রমশালী যুধামন্যু ও উত্তমৌজা। এছাড়াও রয়েছে সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, এরাও কিন্তু বীরত্বে কম যায় না।

 

১/৭

আমাদের পক্ষে যাঁরা প্রধান এবং আমাদের বাহিনীর যাঁরা সেনানায়ক, তাঁদের কথাও আপনাকে বলে রাখি, গুরুদেব। তাঁদের সকলের নাম আপনার জেনে রাখা ভাল।

 

১/৮

আপনি নিজে আছেন, আর আছেন ভীষ্ম, কর্ণ, রণবিজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা এবং সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ।

 

১/৯

এছাড়াও অনেক বীর আছেন যাঁরা আমার জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, তাঁরা সকলেই নানান অস্ত্রশস্ত্র চালনায় খুবই পারদর্শী এবং যুদ্ধবিদ্যাতে খুবই দক্ষ।

 

১/১০

হে আচার্য, পিতামহ ভীষ্মের বিশেষ পরিচালনায় আমাদের বিশাল সৈন্যবাহিনী অপরাজেয়, আমাদের বিরুদ্ধে ভীমের অধীনে থাকা পাণ্ডবের সৈন্যদল কিন্তু আদৌ যথেষ্ট নয়।

 

১/১১

অতএব আপনারা সকলেই প্রতিটি সেনাব্যূহে প্রবেশের দরজায়, নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী দায়িত্ব নিন এবং সব দিক থেকে ভীষ্মকে রক্ষা করুন    

 

১/১২

এই কথা শুনে, কুরুকুলের মহাপ্রতাপশালী বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেন, আর দুর্যোধনকে খুশি করার জন্যে বজ্রস্বরে শাঁখ বাজাতে শুরু করলেন।       

 

১/১৩

সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে বেজে উঠল অসংখ্য শাঁখ, ভেরী, ঢাক, মৃদঙ্গ, আর রণশিঙাতুমুল শব্দে ভয়ানক হয়ে উঠল রণস্থল।

 

১/১৪

তার ঠিক পরেপরেই অনেকগুলি সাদা ঘোড়ায় টানা একটি মহারথে বসে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন তাঁদের দুজনের অলৌকিক শঙ্খদুটি বাজালেন।

 

১/১৫

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পাঞ্চজন্য, অর্জুন তাঁর দেবদত্ত আর মহাবলশালী ভীম তাঁর পৌণ্ড্র নামক বিখ্যাত শঙ্খের শব্দ তুললেন।                             

 

/১৬

কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির তাঁর অনন্তবিজয়, নকুল তাঁর সুঘোষ ও সহদেব তাঁর মণিপুষ্পক নামক শাঁখও একই সঙ্গে বাজিয়ে দিলেন।        

১/১৭-১৮

হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, মহা তীরন্দাজ কাশীরাজ, মহাবীর শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, রাজা বিরাট, অপরাজেয় বীর সাত্যকি, রাজা দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রেরা, সুভদ্রা পুত্র মহাবীর অভিমন্যু, এঁরা সকলেই নিজের নিজের শাঁখগুলি বাজাতে শুরু করলেন।

১/১৯

সেই সমবেত তুমুল শাঁখের ধ্বনি আকাশে এবং পৃথিবীর চারিদিকে প্রতিধ্বনি তুলে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের হৃদয়ে আলোড়ন তুলে দিল।

১/২০

হে মহারাজ, এরপর আপনার পুত্রদের সকলকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দেখে, অর্জুন তাঁর রথের কপিধ্বজা উড়িয়ে দিলেন এবং তির নিক্ষেপের জন্যে ধনুক হাতে প্রস্তুত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন-                  

১/২১-২৩

অর্জুন বললেন- হে কৃষ্ণ, দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে আমাদের রথ নিয়ে চলো। আমি দেখব। যাঁদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে, তাঁদের সকলকে দেখব। দুষ্ট বুদ্ধি দুর্যোধনের হিতৈষী যে সব রাজা ও বীরগণ এসেছেন, তাঁদেরকেও আমি দেখতে চাই            

১/২৪-২৫

সঞ্জয় বললেন – হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, অতন্দ্র বীর অর্জুনের এই কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের অপেক্ষায় থাকা দুই পক্ষের সেনা বাহিনীর মাঝখানে সবার সেরা তাঁদের সেই সুন্দর রথটি স্থাপনা করলেন ভীষ্ম, দ্রোণ এবং উপস্থিত কৌরবপক্ষের সমস্ত রাজন্যবর্গের সামনে রথ স্থাপনা করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন – হে পার্থ, রণক্ষেত্রে উপস্থিত সমবেত কৌরবগণকে দেখে নাও।

১/২৬

অর্জুন উভয় পক্ষের সেনাবাহিনীর মধ্যে পিতৃস্থানীয়, পিতামহস্থানীয়, আচার্য্য, মাতুল, পুত্র, পৌত্র, বন্ধু, শ্বশুর এবং সুহৃদ্‌ স্থানীয় সকলকেই দেখতে পেলেন।

১/২৭

রণক্ষেত্রে উপস্থিত, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, আদরের পরিজন ও প্রিয়বন্ধুদের দেখে অত্যন্ত কাতর হয়ে বিষণ্ণ অর্জুন বলে উঠলেন -   

১/২৮

অর্জুন বললেন - হে কৃষ্ণ, রণক্ষেত্রে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত আমার এই পরিজনদের দেখে, আমি অত্যন্ত অবসন্ন ও হতাশা বোধ করছি। আমার শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে, আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে

১/২৯

আমার সর্ব অঙ্গ কাঁপছে, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমার অসাড় হয়ে আসা হাত থেকে ধনুক খসে পড়ছে, সর্ব অঙ্গে আমি তীব্র জ্বালা অনুভব করছি।

১/৩০

হে কেশব, আমি এই রণক্ষেত্রে আর থাকতে পারছি না। আমার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। চারদিকে আমি অমঙ্গলের সমস্ত লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি।

১/৩১

এই যুদ্ধে স্বজন হত্যা করে, আমার মনে হচ্ছে না, আমাদের এতটুকুও মঙ্গল হবে। এমন জয় আমি চাই না, হে কৃষ্ণ, রাজ্যলাভের সুখও আমি চাই না। 

১/৩২-৩৩

কি হবে রাজ্য জয় করে, কি হবে রাজ্য ভোগ করে? আর হে গোবিন্দ, বেঁচে থেকেই বা কি লাভ? যাঁদের জন্যে আমরা রাজ্য ভোগের সুখ কামনা করি, সেই গুরু, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক এবং কুটুম্বজনেরা ধন ও প্রাণের মায়া ছেড়ে এখানে যুদ্ধ করার জন্যে সমবেত হয়েছেন।       

১/৩৪

এই পৃথিবী কিংবা তিন ভুবনব্যাপী রাজ্যলাভও আমার কাছে তুচ্ছ, এঁনারা যদি আমাদেরকে আজ হত্যাও করেন, তাও আমি এঁদেরকে নিধন করতে চাই না, হে মধুসূদন

১/৩৫

হে জনার্দ্দন, বলতে পারো, দুর্যোধন ও ধৃতরাষ্ট্রের অন্যান্য পুত্রদের হত্যা করে আমাদের কি ধরনের সুখ মিলবে? এরা সকলেই আততায়ী ঠিকই, কিন্তু এদের হত্যা করলে আমাদেরও তো পাপ হবে!

[যে অন্যের ঘরে আগুন দেয়, যে অন্যকে বিষ দেয়, যে ধন অপহরণ করে, যে পরের স্ত্রীকে অসম্মান করে, আর যে অন্যকে হত্যার জন্যে অস্ত্র ধারণ করে – তারাই আততায়ী। দুর্যোধন ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা এই সব কটি অপরাধেই অপরাধী, অতএব আততায়ী।]


১/৩৬

অতএব ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধনদের ও তাদের আত্মীয় পরিজনদের হত্যা করা আমাদের আদৌ উচিৎ হবে না। হে মাধব, স্বজন হত্যা করে কিভাবে আমাদের সুখ মিলবে?

১/৩৭-৩৮

যদিও এঁনারা সবাই রাজ্যলোভে উন্মত্ত হয়ে, নিজেদের কুলক্ষয়, বংশনাশ ও মিত্র হত্যার মতো ভয়ংকর পাপ দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু আমরা কেন জেনে বুঝেও এমন স্ববংশ ধ্বংসকারী পাপ কাজ থেকে বিরত হবো না, হে জনার্দন?

১/৩৯

কুলক্ষয় হলে সেই বংশের নিজস্ব কুলধর্ম নষ্ট হয়। ধর্ম নাশ হলে অধর্ম এসে কুলকে গ্রাস করে এবং ভবিষ্যৎ বংশধরগণও অধর্মাচারী হয়ে থাকে।                                    

/৪০-৪১

হে কৃষ্ণ, অধর্মের সংস্রবে কুলস্ত্রীরা ব্যাভিচারিণী হয়, কুলনারী ব্যাভিচারিণী হলে বর্ণসংকরের জন্ম হয়। এই বর্ণসংকরের পিতৃকুল, পিণ্ড ও তর্পণের জলাঞ্জলি থেকে বঞ্চিত হয়ে নরকে পতিত হয়ে থাকেন। বর্ণসংকর নিজ কুলের এবং কুলনাশকারীরও নরকের হেতু হয়ে থাকে।

১/৪২-৪৩

অতএব যারা কুলঘাতক তারা সমাজে বর্ণসংকর সৃষ্টি ক’রে সমাজের সনাতন ধর্ম থেকে সমাজকে বিচ্যুত করে। হে জনার্দন, শুনেছি উৎসন্নে যাওয়া কুলধর্মের কারণে মানুষের চিরদিন নরকবাস হয়ে থাকে।

১/৪৪

হায়, আমরা কি ভয়ংকর এক পাপ কাজের আয়োজন করতে চলেছি, সামান্য রাজ্যলাভের জন্য আমরা স্বজন হত্যার পরিকল্পনা করেছি।                                                 

১/৪৫

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা নিরস্ত্র এবং অসহায় পেয়ে যদি আমাকে হত্যাও করে, তাও আমার পক্ষে অনেক বেশী মঙ্গলজনক হবে।  

১/৪৬

সঞ্জয় বললেন – অর্জুন এই কথা বলে ধনুক এবং তির ত্যাগ করে যুদ্ধ থেকে বিরত হলেন ও বিষণ্ণমুখে রথেই বসে রইলেন।   

 

অর্জুনের বিষাদযোগ সমাপ্ত

চলবে...

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/২

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের প্রথম পর্বাংশ  পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/১ " তৃতীয় পর্ব - দ্বিতীয়  পর্...