রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫

মুখে নেই রা

 

 ২১/৭/২৫ তারিখে প্রকাশিত "লিটিং লিং - শেষ পর্ব"-এর পরে...


প্রথমেই লেবু চিনির সরবৎ, সঙ্গে দুটো দুটো মণ্ডা আর রসগোল্লা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই স্নান করার নির্দেশ এল। সোনার দাদা খুব গোপন কোন কথা বলার মতো, ভগ্নীপতি অচ্যুতকে বললেন, “ভায়া, দুপুর গড়িয়ে চলেছে। কলতলায় তোমার চানের জল ধরা আছে। তেল, সাবান, নতুন গামছাও রাখা আছে, আজকে নমো নমো করে চানটা সেরে ফেল। বেলা থেমে থাকে না ভাই, এরপর খেতে খেতে বিকেল হয়ে যাবে”

এ বাড়ির জামাই অচ্যুত মুকুজ্জে, কথাটা মেনে নিলেন, কারণ, তাঁর অপেক্ষায় সকলে অভুক্ত রয়েছেন। শ্বশুরমশাই, দাদা, বাড়ির মেয়েরা সব্বাই।

টিউবওয়েলের বাংলা নাম টেপাকল। শীতকালে টেপাকলের জলের শীতলতা একটু কমই হয়। তারওপর সারা দিনের রোদ্দুর আর সারা পথের ধুলো মাখা অবস্থায়, সদ্য মোড়ক খোলা সুবাসিত গ্লিসারিন সাবান আপাদমস্তক মেখে চান করে বেশ তৃপ্তিই বোধ করলেন অচ্যুত। নতুন গামছায় গা মুছে, বালিকা ছোট শ্যালিকার বাড়িয়ে দেওয়া কাচা ধুতি, বেনিয়ান আর চাদর গায়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে যখন আবার দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন, শরীরে তেমন আর কোন ক্লান্তি বোধ হচ্ছিল না।        

ভেতরের ঘরের দাওয়ায় সবাই তাঁর অপেক্ষাতেই ছিলেন। শ্বশুরমশাই অনাদি চাটুজ্জে, জামাইকে দেখে রান্নাঘরের দিকে হাঁক দিলেন, “কই গো, তোমাদের হলো? এসো বাবা, এসো। বাবাজীবন কখন থেকে অপেক্ষা করছে, আর কত বেলা করবে?”

দাওয়ায় তিনটে আসন বিছানো। চটের ওপর রঙীন সুতোয় হাতে বোনা আসনসেই আসনের সামনে দাঁড়িয়ে অচ্যুত বললেন, “বাঃ, এই আসনগুলো বেশ তো! কে বুনেছে, দাদা”?

“আসনগুলো? ও সব আমাদের মণি আর সুভোর বোনা। ভাল বুনেছে না? কলু, কটা আসন সোনাকে দিয়ে দিস তো – জামাইবাবু বসবে”

অচ্যুত কিছু বললেন না, একটু হাসলেন। দেয়ালের দিকে তিনটে আসন পাশাপাশি একটু ফাঁক ফাঁক করে পাতা। মাঝের আসনটাই সব থেকে সুন্দর। নীল জমির মাঝখানে সবুজ গা, লাল ঠোঁটের শুক-সারি পাখি, মুখোমুখি বসে। তাদের মাথার ওপরে হলুদে লেখা “শাসন করা তারই সাজে” আর তাদের পায়ের নীচেয় “সোহাগ করে যে”ওপাশের আসনের মাঝখানে তাজমহলওপরে লেখা “তাজমহলের মর্মরে গাঁথা” আর তার ভিতের পাথরে “কবির অশ্রুজল”এ পাশের আসনেও শুকসারি পাখি, ওপরে লেখা “সংসার সুখের হয়” আর পাখিদের পায়ের নীচে “রমণীর গুণে”

বৌদি দুহাতে ধরে সাজানো ভাতের বিশাল কাঁসার থালা নিয়ে, মাঝের আসনের সামনে রেখে বললেন, “ঠাকুরজামাই বসুন, সেই কোন কাকভোরে বেরিয়েছেন, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে খুব”

বৌদির পিছনে সুভা আর কলু, কিশোরী আর বালিকা দুই ননদের হাতেও বড়ো বড়ো সাজানো ভাতের থালা। সুভার হাত থেকে থালা নিয়ে ডান দিকের আসনের সামনে রেখে বললেন, “বাবা, বসুন”তারপর বাঁদিকের আসনের সামনে অন্য থালাটি রেখে কিছু বললেন না, চোখ তুলে তাকালেন দাদার দিকে।

সকলেই নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। অনাদি জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুরু করো বাবা”কাঁসার গেলাসের থেকে হাতে জল নিয়ে গণ্ডুষ করলেন, তারপর বাকি জলে ঘিরে ফেললেন ভোজন পাত্র। অন্ন এবং অন্যান্য ভোজ্যের সামান্য অংশ পাঁচ আঙুলের ডগায় তুলে নিয়ে, মনে মনে মন্ত্র পড়ে থালার ডানদিকে মাটিতে উৎসর্গ করলেন, পঞ্চদেবতা ও পিতৃপুরুষদের। তারপর ভাতের কোল ভেঙে শুরু করলেন আহার।

শাকভাজা মেখে একগ্রাস ভাত মুখে নিয়ে অনাদি বললেন, “এই অবেলায় স্বল্প আহারই ভাল, বুঝেছ বাবা? অনিয়ম হয়ে গেল না? এই তো দেখ না, খেয়ে উঠতে উঠতেই বেলা শেষ হয়ে যাবে। শীতের বেলা, এই আছে এই নেই। আজকাল ডাকের যে কী গণ্ডগোল হয়েছে, কি বলবো বাবা। পাঁচদিন আগে লেখা তোমার চিঠিটা, আমরা হাতে পেলাম সবে কালকে। চিঠিটা পেয়ে কী আনন্দ যে হল, সে আর বলার কথা নয়। কিন্তু চিন্তা করো, চিঠিটা কাল যদি না পেতাম? আজকে তোমাদের কী আতান্তরেই না পড়তে হতো! তোমাদের কী খাওয়াতাম, কী করতাম! কোথায় বসাতাম! যাই বলো আর তাই বলো, বারো-তেরো বছর হতে চলল দেশ স্বাধীন হয়েছে, উন্নতির জায়গায় সবদিকে অবনতিই হয়েছে বলবো। থাকত আজ গোরা সায়েবরা, চাবকে ঠিক সোজা রাখতো আমাদের”।

দাদা এবং অচ্যুত খাচ্ছিলেন, কেউ কোন কথা বললেন না। অনাদি কিছুক্ষণ চুপ করে খাওয়ার পর আবার বললেন, “হ্যারে সুভা, বিকাশ আর তনু কোথায় গেল রে? দেখছি না?” বড়ো থালায় ছটা বাটি - তিনটেয় ভাজা সোনামুগের ডাল, আর তিনটেয় মাছের ঝোল নিয়ে সুভা রান্নাঘর থেকে অতি সন্তর্পণে উঠোন পার হয়ে আসছিল। বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে বলল, “ওরা হাজরা পুকুরে নাইতে গেছে, বাবা”অনাদি আদর করে তাঁর কন্যাদের নিজস্ব নামে ডাকেন, মণিদিদিকে তনু, নদিদির ডাকনাম যদিও সোনা, উনি ডাকেন বিকাশ! 

“বাড়িতে টেপাকল থাকতে, এই অবেলায় আবার পুকুরে গেল নাইতে? এদের কাণ্ডকারখানার বোঝা দায়! হীরুকে নিয়ে যায়নি তো?”

“গেছে তো! হীরু খুব বায়না করছিল, তাই মণিদি বলল, চলুক না, কিচ্ছু হবে না”

“কিচ্ছু হবে না কি রে? ছোট ছেলে, অবেলায় পুকুরে চান করে, জ্বরজারি বাধিয়ে বসলে?”

 

এতক্ষণ রান্নাঘরে আড়ালেই ছিলেন, ষোড়শীবালা, অচ্যুত মুখার্জির শাশুড়িমা। প্রৌঢ়া, একটু পৃথুলা গড়ন, ধবধবে ফর্সা রঙ। সমস্ত শরীরে ও মুখশ্রীতে মাতৃভাব। সামনে জামাই রয়েছে, তাই মাথায় বড়ো ঘোমটা টানা। ছোট্ট পান্নাকে কোলে নিয়ে তিনি উঠোন পেরিয়ে এসে দাওয়ায় বসলেন, বললেন, ““অত ব্যস্ত হয়ো না তো! অ সুভা, জামাইবাবুকে দুটো ভাত দিয়ে যা, মা। কলু, জামাইবাবুকে আর এক টুকরো লেবু দে না, মা। ডাল দিয়ে মেখে খেতে ভালো লাগবে”

শাকভাজা শেষ করে, অনাদি ফুলকপির তরকারি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন, “পান্না কি ঘুমোচ্ছে”?

কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমোনো পান্নার মুখের দিকে তাকিয়ে ষোড়শীবালা বললেন, “হ্যাঁ। কেমন অবাক ছেলে বলো দিকি। অচেনা মুখ, অচেনা জায়গা, অচেনা কোল, তবু এতটুকু কান্না নেই গা”? সুভা আর কলুর কাছে, ছোট্ট এই ছেলে যেন জ্যান্ত এক পুতুল।

কলু খুব উত্তেজিত গলায় বলল, “জানো বাবা, পান্না আজকেই প্রথম ঝিনুকে দুধ খেল। গলায় দুধ নিয়ে গলগল করে আওয়াজ তুলছিল, আর ঢোঁক গিলেই সে কি হাসি!”

“তাই নাকি?” পান্নার দাদামশাই হাসলেন ঘুমন্ত পান্নার দিকে চেয়ে। তাঁর দুচোখে ভালোবাসা আর মায়া।

পান্নার দিদিমা মুচকি হেসে নাতির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, স্নেহার্দ্র স্বরে বললেন, “তাই না তাই, এ যেন সেই “মুখে নেই রা, পব্বতে মারে ঘা”

ফুলকপির তরকারি শেষ করে নতুন ভাত ভাঙলেন অনাদি, তাতে মাছের ঝোল ঢেলে বললেন, “দুটো ভাত দে দেখি সুভা, মা। ঝোলটা বেশি হয়ে গেল। বাবা অচ্যুত, সোনা আমাদের খুব ভেতরবুঝো আর মনটা মায়া-দয়ায় ভরা, জানলে বাবা? তোমার ছেলেদুটি একদম রত্ন হবে, এ আমি তোমায় বলে রাখলাম, পরে মিলিয়ে নিও”বাবাকে বেশ খানিকটা ভাত দিয়ে, সুভা জামাইবাবুকেও ভাত দিতে এসেছিল, জামাইবাবু দু হাতে পাত আড়াল করে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, বললেন, “আর একটাও ভাত নিতে পারবো না, সুভা”

কিশোরী সুভা হেসে বলল, “সে কী, জাঁইবাবু? আপনি তো কিছুই খেলেন না”

ষোড়শীবালা পিছন থেকে বললেন, “থাক থাক, এই অবেলায় আর জোর করিসনি, বাছা। বরং চুনো মাছের অম্বল আর পায়েসটা নিয়ে এসো, বৌমা”

“কী সর্বনাশ, এর পরে আবার পায়েস?”

ষোড়শীবালা অচ্যুতের এই কথায় একটু বিরক্ত হলেন, “ও আবার কী কথা, বাবা? খাওয়াতেও সর্বনাশ? তোমাদের আজকালকার ছেলেছোকরাদের কথাবার্তায় কোন ছিরিছাঁদ নেই বাপু”

অপ্রস্তুত অচ্যুত পাশে বসা দাদার দিকে তাকালেনদাদা চোখের ইশারায় মুচকি হেসে খেতে খেতেই বললেন, “পায়েস না খেলে কী আর আয়েস হয়, ভায়া?”

 

 খাওয়া দাওয়ার পর দাদা নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন অচ্যুতকে। বিছানায় বসে জিজ্ঞেস  করলেন, “পান খাবে নাকি? জোয়ান বা সুপুরি-টুপুরি কিছু”?

“নাঃ”

“কাঁচি চলে?” দাদার হাতে সিজার্স সিগারেটের প্যাকেট।

লাজুক হেসে অচ্যুত বললেন, “কলকাতার মেসে দু একদিন টেনে দেখেছি, তেমন মজা পাইনি”

“আরে নাও, নাও। ব্যাটাছেলের এক আধটা নেশাভাং না হলে ঠিক মানায় না”

“আচ্ছা দিন, বলছেন যখন”

দুজনেরই ঠোঁটে সিগারেট। কেরোসিনের লাইটারে খচ খচ চার পাঁচবার ফ্ল্যাশ দেওয়ার পর জ্বলল। অচ্যুতর সিগারেট জ্বালিয়ে, দাদা নিজেরটা ধরালেন। সিগারেট ধরানো আর প্রথম টানেই বোঝা গেল, অচ্যুত নেশার পথে নেহাতই নাবালক।

সিগারেটে দুটো টান দেওয়ার পর অচ্যুত বললেন, “আচ্ছা, আমার কথায় তখন মা খুব বিরক্ত হয়েছেন, না?”

“কিসের কথায়? অ, ওই “সর্বনাশ”? ছাড়ো না ভায়া, আমাদের কথাবার্তার ধরনে বাবা-মায়েরা অমন প্রায়ই বলেন। “আজকালকার ছোকরাদের কথাবার্তায় কোন মাথামুণ্ডু নেই”। “আমাদের সময় বাপু এমন ছিল না”। “কালে কালে কত যে দেখবো”? হা হা হা হা, সব কথায় কান দিলে চলে?”

“আরেকটা কথা কী যেন বললেন, মুখে নেই রা...”

“হা হা হা হা, ওটা একটা কথার কথা - প্রবাদ। আমার মা হচ্ছেন বাংলা পরিভাষা আর প্রবাদের আকরকথাটা হচ্ছে, “মুখে নেই রা, পর্বতে মারে ঘা”কেউ কেউ কথা কম বলে, কিন্তু কাজে হয় খুব দড়, একদম পাহাড়ে গিয়ে যেন ঘা মারে...হা হা হা হা। কদিন থাকো না ভায়া...”, শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা তোবড়ানো শানকির বাটিতে চেপে নিভিয়ে ফেলে দিলেন, তারপর আবার বললেন, “...আরো অমন কত জেনে যাবে! অসিতবাবু, নীহারবাবু, সুকুমারবাবু আর কটা সংগ্রহ করেছেন? তাঁরা যদি আসতেন আমার মায়ের কাছে”!

অচ্যুত হাসলেন, কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, “আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে, দাদা”

অচ্যুতের বলার ভঙ্গিতে দাদা একটু উদ্বিগ্নই হলেন, বললেন, “কী ব্যাপার বলো, তো?”

“আমি ওদের নিয়ে এবার কলকাতায় যাবো ভাবছি”

“কাদের নিয়ে?”

“ওদের, মানে আপনার বোন, আর ছেলেদের নিয়ে”

“তা সে যাও না, পরিবার নিয়ে কলকাতায় যাবে, সে তো খুবই আনন্দের কথা। মাস খানেক থেকে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, কালীঘাট, ভিক্টোরিয়া, দক্ষিণেশ্বর – সে তো ভালোই হবে। কিন্তু পান্নাটা একেবারেই কচি ছেলে, হীরুই বা কী এমন বড়ো, তোমারও আপিস, সোনা একা সামলাতে পারবে কী”?

“কদিনের জন্যে নয় দাদা। বাসা নিয়ে কলকাতাতেই থাকবো”

দাদা অচ্যুতের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “সে তো আমার বোনের সৌভাগ্য। কিন্তু হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন? তুমি বাড়ির বড়ো ছেলে, গ্রামের বাড়িতে তোমার বিধবা মা রয়েছেন, ভাইয়েরা রয়েছে, জমিজিরেত, চাষবাস রয়েছেকলকাতার বাসায় থেকে এসব সামলাতে পারবে? তাছাড়া, কিছু মনে কোর না, অচ্যুত, বড়দাদা হিসেবেই বলছি, কলকাতায় বাসা ভাড়া দিয়ে সংসার চালানো, দুটো বাচ্চা, দায়দৈব, জ্বরজারি, তাদের লেখাপড়া, বইখাতা, স্কুল। খরচের ব্যাপারটাও ভেবে দেখেছো তো?”

মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন অচ্যুত, তারপর মুখ তুলে বললেন, “ভেবেছি, দাদা। আমাদের এমন কিছু জমিজিরেত নেই, যার জন্যে সব ভাই মিলে গ্রামে পড়ে থাকতে হবে, সে কথা আপনি জানেন, দাদা। আর কলকাতায় বাসা ভাড়া করে সংসার চালাতে খরচ তো হবেই, ঘাটতি যেটুকু হবে, সেটা সকাল বিকেল টিউশনি করে সামলে নিতে পারবো”

“হুঁ, সব দিক চিন্তাভাবনা করেই ফেলেছো? আমার মা বলেন, তাঁর সকল জামাইয়ের মধ্যে, তুমিই নাকি সব থেকে বিচক্ষণ আর জ্ঞানী”মৃদু হেসে দাদা আরো বললেন, “তা তোমার মাথায় হঠাৎ এমন চিন্তা এল কী করে? আমি তো জানতাম, তুমি বেশ মাতৃভক্ত এবং মাকে বেশ ভয়ও পাও। তাঁকে আড়াল করে, এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছ! সোনা জানে, সোনাকে বলেছ?”

“না দাদা, কেউই জানে না। কলকাতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে দু’একজন জানে, তাদেরকেই বলে রেখেছি, একটা বাসা দেখে রাখতে। আত্মীয়দের মধ্যে আপনাকেই প্রথম বললাম। এ বিষয়ে আপনার মতামতটা ভীষণ জরুরিকারণ, ভালো মন্দ যাই হোক না কেন, আপনার বোনের ভবিষ্যত আমার সঙ্গেই তো জড়িয়ে? আর এই সিদ্ধান্তটাও হঠাৎ নয় দাদা, বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি। হীরুর স্কুলে যাবার বয়েস হয়ে এল, দাদা। আমাদের গ্রামের স্কুলে ওকে পড়াতে চাইছি না। কলকাতার ভালো স্কুলে পড়ে, ভালোভাবে মানুষ হয়ে উঠুক, এটাই আমার স্বপ্ন”

“এ কথাটা আমি মানতে পারলাম না, ভায়া। কলকাতায় লেখাপড়ার পরিবেশ ভালো মানছি, কিন্তু গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করে অমানুষ হয়...তুমি আমি কি অমানুষ হয়েছি বলতে চাও”?

অচ্যুত হেসে ফেললেন, মাথা নেড়ে বললেন, “না, না, আমি ওভাবে কথাটা বলিনি, দাদা। আমার স্বপ্ন হীরু ডাক্তার হোক। গ্রামের স্কুল থেকে পড়ে কেউ কোনদিন ডাক্তার হয়নি, তা নয় দাদা। কিন্তু কলকাতার পরিবেশে সেটা অনেক সহজ হয়ে যায়, সেটা তো মানবেন?” দাদা কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন অচ্যুতের দিকে, তাঁর মুখে মৃদু হাসির রেশ।

বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা না বলায় অচ্যুত একটু অধৈর্য হয়ে উঠলেন, হাসতে হাসতে বললেন, “কী হল? হাসি হাসি মুখে কী দেখছেন বলুন তো”?

এ কথার উত্তরে দাদা হাসি মুখে বললেন, “দেখছি হে, দেখছি। মুখে নেই রা, পব্বতে মারো ঘা। কথাটা তোমার পক্ষেও দিব্বি খেটে যায়”

“তার মানে?”

হা হা করে হেসে উঠলেন, দাদা। তারপর বললেন, “বেশি কথা-টথা বলো না, কিন্তু নিজে নিজেই বেশ কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ! আজকালকার ছোঁড়ারা এটাকেই বলে চ্যালেঞ্জ! ওই দ্যাখো, আমিও একাল-সেকাল বলতে আরম্ভ করেছি”একটু থেমে থেকে আবার বললেন, “স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি, অচ্যুত। কিন্তু স্বপ্নটাকে সত্যি করে তোলাটা যে একটা চ্যালেঞ্জ, সেটা ভাবি না। যতটুকু সাধ্য, আমার সাহায্য তুমি চিরদিন পাবে। কিন্তু সবার আগে সোনার সঙ্গে তোমার কথা বলা উচিৎ। যত শিগ্‌গির হয়, সম্ভব হলে আজই। তোমার এই কঠিন ব্রতে ওই হবে তোমার একমাত্র নিত্য সঙ্গী, ওর মতামতকে অবহেলা করো না”

 

..০০..

    

  পরের পর্ব "সংসার সুখের হয়"     

  

    

       

 

     

                  

               

শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ৯

 

 

 

ছবি দেখেছে, ব্যাপারটা হয়ে যাওয়ার পর, প্রত্যেকবারই তার মনে কেমন একটা যেন পাপবোধ আসে। আসলে খুব যে ভাল লাগে ব্যাপারটা তা মোটেই নয় – আবার মন্দও লাগে না। অনেকটা যেন নাছোড় নেশার মতো। নেশা করতে করতে মনে হয় আর কক্‌খনো করব না, কিন্তু আবার সময় এলেই মনে হয় - এইবারটাই শেষবার – এরপরে আর নয়। সত্যি বলতে সে মিঠুদিদিকে ঠিক এড়িয়ে যেতেও পারে না। তার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে, চোখে চোখ রেখে, তার ঠোঁটে যখন মিঠুদিদি ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়, ছবির সব বাঁধন যেন আলগা হয়ে আসে। মিঠুদিদির হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে ছবি তার সমস্ত শরীরে অনুভব করে এক অদ্ভূত আলোড়ন। তখন তার আর মনে থাকে না পাপবোধ, সংস্কার অথবা কোন সামাজিক নীতির ভ্রুকুটি।      

ছবি একটা ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ আর দুটো বিস্কুট নিয়ে এল। মিঠুদিদির হাতে একটা চায়ের কাপ দিল – সামনে রাখল একটা প্লেটে দুটো বিস্কুট। মিঠুদিদির সামনে বসল নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে, এটা অন্য ধরনের কাপ, অনেক সস্তা। সে জানে, যে সম্পর্কই গড়ে উঠুক না কেন মিঠুদিদির সঙ্গে, তাতে তার অবস্থানের কোন পরিবর্তন কোনদিন হবে নাওই সময়টুকু ছাড়া তার আর মিঠুদিদির মধ্যে যে দুস্তর ফারাক, সেটা মুছে যাবার নয়। আর যাই ভুলে যাক, ছবি এ ব্যাপারটা ভুলবে না কিছুতেই।

চায়ে চুমুক দিয়ে মিঠুদিদি আনমনে বলল, “সেই দিনটা আজও আমার ভীষণ মনে পড়ে, জানিস ছবি”?

“কোন দিনটা গো”?

“যেদিন তুই আর তোর মা আমাদের বাড়িতে এলি-সাতসকালে, মনে আছে”?

“বারে মনে থাকবে না কেন? তুমি চান করে স্কুল ড্রেস পরে খেতে বসছিলে আর আমরা ঢুকলাম”।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রতিষ্ঠা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ছবির দিকে। প্রতিষ্ঠার এইভাবে তাকিয়ে দেখাতে ছবি একটু লজ্জা পেল, বলল, “কি দেকচ বলোতো? আর এত কি ভাবচো, সেই থেকে”?

ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির একটা রেখা নিয়ে মিঠুদিদি বলল, “এই কলকাতায় তোর কতবছর হল, বলতো ছবিপ্রায় বছর ছয়েক, না? তুই আমাদের বাড়ি এসেছিলি যখন, একটা ছোট্ট পাখির মতো অসহায় ভিতু, আর কি ইনোসেন্ট ছিলি তুই। সো ইনোসেন্ট অ্যান্ড পিওর – আই জাস্ট কান্ট ইম্যাজিন। সে সময়ে আমিও বয়সে খুব একটা বড়ো ছিলাম না তোর থেকে। কিন্তু তবুও ফিল করেছিলাম আমার ক্লাসমেট বা চেনাজানা কোন মেয়ের  মধ্যে এমন ইনোসেন্স দেখিনি। জানিসনা ছবি, আর তোকে বুঝিয়ে বললেও তুই বুঝবি না। তোকে সেই দেখাটা আমার জীবনে কি এক অসম্ভব রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল”।

“বাব্বাঃদিদি, তুমি বরাবরই দেকেচি আমার সঙ্গে এমন শক্ত শক্ত সব কতা বলো - কেন বলো তো? তোমার সব কতার মানে বুজি না বটে - শুনতে কিন্তু বেশ লাগে”।

অধৈর্যে মাথা নাড়ল মিঠুদিদি, তার ছোট করে ছাঁটা বয়কাট চুলে ঝাঁকুনি তুলে বলল, “ওটাই তো তোর গ্রেটেস্ট প্রবলেম, ছবিকিংবা কে জানে ওই জন্যেই আমাকে তোর কাছে বার বার ফিরে আসতে হয় – এরপরেও আসতে হবে বারবার কিছুই বুঝিস না তুই। অথবা সব কিছু বুঝেও কোন এক অদৃশ্য সীমারেখা তুই টেনে রাখতে পারিস তোর চার দিকে। যার বাইরে তুই নিজে কোনদিন বের হবি না। এবং কাউকে ঢুকতেও দিবি না সেই ঘনিষ্ঠ গন্ডীর ভিতরে। না হলে এতদিন কলকাতার জীবনে অভ্যস্ত হতে হতেও, তুই সেই আগের মতোই রয়ে গেলি কী করে? কি করে তুই তোর আদুড় বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারলি, তোর সেই ফেলে আসা গ্রাম-জীবনের মেঠো গন্ধ! শ্যাম্পু করা চুলের গভীরে শ্বাস নিলে কেন পাওয়া যায় বাসী নারকেল তেলের সোঁদা আঘ্রাণ! একটু থেমে ঘাড় ঝাঁকিয়ে মিঠু বলল, “মাই গড, আজকে জানিনা কেন বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়ছি...। আজ চলি রে, ছবি”

হঠাৎ করেই চেয়ার থেকে উঠে পড়ে, দরজার দিকে এগোলো মিঠুদিদিছবি খুব অবাক হল, মিঠুদিদির এই আকস্মিক ভাব পরিবর্তনে, পিছনে পিছনে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “ওই দ্যাকো, চা-টাও শেষ করলে না। একটা বিস্কুটও দাঁতে কাটলে না – দিদি, তুমি না সেই একই রকম খামখেয়ালি রয়ে গেলেআচ্ছা বেশ, সেই আসবেই যকন, “চলি” নয় - বলো “আসি”“ মিঠুদিদি ফিক করে হেসে ফেলল, খোলা দরজার বাইরে থেকে, ভিতরে দাঁড়ানো ছবির গালটা আলগা করে টিপে দিয়ে, বলল, “আদ্যিকালের পান্তি বুড়ি, আসি রে”

উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখে ছবি বলল, “এসো। আবার আসবে কিন্তু, সময় পেলে”।


মিঠুদিদি হাসল, বলল, “তুই না ডাকলেও আসব, পুরুষরাই বুঝি আজীবন ডাকাতি করে যাবে মেয়েদের ওপর, আমিই বা কম কিসে, শুনি”? 


চলবে...


শুক্রবার, ২৫ জুলাই, ২০২৫

বুনো ওল

 

গতরাত থেকেই অঝোর নিম্নচাপের ধারায় আমাদের এদিকে জলভাসি। সকাল সাড়ে দশটায় অফিস যাওয়ার ইচ্ছেহীন চেষ্টায় ক্ষান্ত দিলাম। কিন্তু ঘরে বসেই বা সারাটাদিন করব কী? এগারোটা নাগাদ রওনা হলাম আমাদের পাড়ার ক্লাবে, কেউ না কেউ নিশ্চই থাকবে। ক্যারাম খেলে আর আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে নিম্নচাপের এই ল্যাদার্ত দিনটা।

 হলও তাই। ক্লাবে গিয়ে দেখি নবা, মিঠু, আর টিটু ক্যারাম বোর্ডে খটখট করছিল, আমাকে দেখেই হৈহৈ করে উঠল ওরা, “অ্যাই ত, শিবে এসে গেছে, ভালই হয়েছে! আরেক পিস ভেজা কাক উড়ে এসে জুটলই যখন জমিয়ে ক্যারাম খেলা যাক”

আমার পরনে ছিল, বারমুডা আর গলাকাটা টিশার্ট। বলাবাহুল্য দুটোই ভিজে গিয়েছিল আসার পথে, কাজেই ভেজা কাক বিশেষণে, আমার যে বিশেষ অসম্মান হল, তেমন নয়। আর হলেই বা কী, এই নিম্ন চাপের দিনে এমনিতেই আমার মিয়োনো মুড়ির মতো অবস্থা। চারজনে ক্যারামে বসে গেলাম তৎক্ষণাৎ। কিন্তু ক্যারামই বা কতক্ষণ খেলা যায়? ঘন্টাখানেক খেলার পর যখন আমরা বোর হয়ে তালগাছ খেলার কথা ভাবছি, ঘরে এসে ঢুকল ভূষিকা ভূষিকা খুব মজার হাঁকডাক করা মানুষ। যেখানে বসেন একেবারে জমিয়ে বসেন, কচিকাঁচা থেকে পাকাবুড়ো সক্কলের সঙ্গেই ওঁনার সমান জমে।

আমরা সব্বাই ক্যারাম খেলা ছেড়ে হামলে পড়লাম, “ওফ, ভূষিকা, আজকের দিনে তুমি ছাড়া আর কাউকে ভাবাই যায় না, মোক্ষম দিনে মোক্ষম সময়ে এসে পড়েছ।”

 

ভূষিকাকার ভাল নাম ব্রজভূষণ সমাদ্দার, তার থেকে ভূষি, আদর করে আমরা ভূষিকা বলি। ভূষিকাকা মেঝেয় পাতা শতরঞ্চিতে বসতে বসতে বলল, “এমন ঘনঘোর বরিষায়, জমিয়ে গল্প বলা যায়...তাই বলছিস তো?”

আমি পাকামি করে, ফোড়ন দিলাম, “ওটা পুরোন এডিশনের গান, নতুন এডিশনে এমন ঘনঘোর নিম্নচাপে, বলা আছে।”

“তার মানে? এটা আবার কবে বের হল?”

ভূষিকাকার এই প্রশ্নে আমি, মাতব্বরের মতো জবাব দিলাম, “বেরোয়নি, খুব শিগ্গিরি বেরোবে। আজকাল বর্ষা আর হয় না। বৃষ্টি হয়, হাল্কা, মাঝারি, ভারি, এমনকি বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিও বিস্তর মেলে, কিন্তু নো বর্ষা। টানা বৃষ্টি মানেই নিম্নচাপ।”

মিঠু বলে উঠল, “ভূষিকা, তুমি শিবের কথায় কান দিও না তো, এতদিন পরে এলে, কোথায় ছিলে, কী করলে সে কথা বলো। অনেকদিন পর এলে, প্রায় ছ-সাত মাস পরে, তাই না?”

মিঠু আমাকে থামিয়ে দিলে কী হবে? আমি থামার পাত্রই নই, বললাম, “ভূষিকা, তোমার গল্পের ঝুলি থেকে ঝুল ঝেড়ে গল্প না বললে, আমরা কিন্তু তোমাকে ঝুলোঝুলি করতেও পিছপা হবো না, এই বলে দিলাম”

ভূষিকা একথায় একটু ত্রস্ত ব্যস্ত হয়ে বলল,  “আরে দাঁড়া, দাঁড়া, আসার পথে বিজুদার সঙ্গে দেখা। কেমন আছো, জিগ্যেস করতেই বিজুদা তার অম্বলের ব্যাখান শুরু করল। অম্বলের থেকে বাঁচতে কোনরকমে ক্লাবে পালিয়ে এলাম। এখানে এসে আবার দেখছি, শিবুর আনকোরা নিম্নচাপের এডিশন!” ভূষিকা অসহায়ের মতো মুখ করে, আমাদের দিকে তাকাল।

আমি বললাম, “ওফ, বিজুকাকার পাল্লায় পড়েছিলে? খুব অল্প সময়ে, পেল্লায় বাঁচা বেঁচে গেছ বলতে হবে। আমরা তো এখন ওঁনাকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াই। ওঁনার অম্বলের কথা যতো কম বলা যায় ততই ভালো। বলতে কী আমরা দিন দিন কমবল, মানে হীনবল হয়ে পড়ছি ওঁনার অম্বলের কথা শুনতে শুনতে।”

ভূষিকাকা আমার দিকে খুব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “শিবু, তোর শরীর খারাপ না কী রে? কেমন সব কথা বলছিস জড়িয়ে মড়িয়ে, মিলিয়ে মিশিয়ে! কী হল কী তোর?”

নবা খুব বিরক্ত মুখে উত্তর দিল, “ভূষিকা, শিবের মাথাটা একদম নষ্ট হয়ে, পচে গেছে। এবার বইমেলা থেকে শিব্রাম সমগ্র কিনে পুরোটা পড়েছে ফলে যা হবার তাই হয়েছে, কথাবার্তার মাথামুণ্ডু ঘুঁচে গেছে।”

ভূষিকা এ কথায় হো হো হাসল খানিক, তারপর বলল, “অ, এই কথা? শিবুর মাথায় শিব্রাম ভর করেছে? তোদের মতো বয়সে আমিও পড়েছিলাম, কিছুদিন আমারও ওই রোগ ধরেছিল, অনেক কষ্টে ছাড়ান পেয়েছি। দাঁড়া আজ বিজুদার অম্বলের ওষুধটা দিই, পরে একদিন শিবুকে নিয়ে পড়ব।”

নবা জিগ্যেস করল, “তুমি কী বিজুকাকাকে ডেকে এলে? উনি আসছেন নাকি, এখন? সেরেছে, আড্ডাটা টকিয়ে ছাড়বে একেবারে।”

ভূষিকাকা মুচকি হেসে বলল, “ঘাবড়াসনি, যা বলার আমিই বলব, তোরা শুধু শুনবি। দেখ না বিজুদার অম্বল যদি না সারাতে পারি, আমার ব্রজভূষণ নামটা তোরা পাল্টে দিস”

আমি বললাম, “আমরা যারা অম্বলে টক নই, এক কথায় যারা না-টক, তারা একদম নো Talk, তাই তো ভূষিকা?”

আমার কথায় সকলেই বিরক্ত হয়ে “ওফ্‌” করে উঠল, শুধু ভূষিকাকা আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বলল, “অসুখটা ভালই বাধিয়েছিস রে, শিবে, সারতে সময় লাগবে। ভাবিয়ে তুললি বেশ।”

 

ভূষিকার কথা শেষ হল কি হল না, বিজুকাকা ক্লাব ঘরে পা রাখলেন এবং ঢুকেই, বিশাল এক ঢেঁকুর তুললেন, “হেউ”

সেই শুনে ভূষিকা বলল, “এ কী করেছ, বিজুদা? শরীরে এতো অম্বল পুষে রেখেছো? এতো ভালো কথা নয়।”

“ভালো কথা নয়ই তো! কি জ্বালায় যে জ্বলছি, সে শুধু আমিই জানি। পেট থেকে গলা অব্দি সারাক্ষণ জ্বলছে। কেউ বুঝতে চায় না, যাকেই বলি, ইয়ার্কি-ফাজলামো করে।” বলেই আবার ঢেঁকুর তুললেন “হেউ”

“হায়, হায়। একদিকে সঙ্গে নেইকো কেউ, ওদিকে ঢেঁকুরের বড়ো বড়ো ঢেউ।” আমি নাtalk থাকতে পারলাম না, বলেই ফেললাম। আমার দিকে বাকিরা কটমট করে তাকাল, কিন্তু ভূষিকার চোখে সহানুভূতি, জ্বরে ভোগা ছেলের দিকে মায়েরা যে চোখে তাকান, অবিকল সেই দৃষ্টি!

ভূষিকা ভীষণ গম্ভীর মুখ করে বলল, “বিজুদা, তোমার এই অম্বল নিয়ে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করবো, সত্যি করে বলবে?”

“কী বল তো? যদি কিছু সুরাহা হয় কেন বলবো না? কী জানতে চাস বল না, ভূষি?”

“ফুচকা আর আলুর চপ কতদিন খাওনি?”

“মনে নেই রে, তা প্রায় বছর পাঁচেক তো বটেই, ফুচকা তো তারও বেশি, তা ধর বছর আষ্টেকআগে তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েরা ফুচকা খাচ্ছে দেখলেই বুক আইঢাই করে, চোঁয়া ঢেঁকুর উঠতো। এদান্তিতে সেটা একটু কমেছে। তবে আজ তোর মুখে ওই সব নাম শুনেই গলার কাছটা চিনচিন করছে।”

ভূষিকা খুব উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “বলো কী, বিজুদা। এখনই কিছু একটা না করলে তো পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে।”

এই কথায় আমি আর থাকতে না পেরে আবারও বলেই ফেললাম, “গালে দেওয়ার মতো কোন খাদ্যই আর পাওয়া যাবে না, তখন সব খাদ্যই নাগালের বাইরে না-গাল হয়ে, গালের বাইরে পড়ে থাকবে।” কিন্তু আমার কথায় কেউ কানই দিল না।

ভূষিকা একই রকম মুখ করে বিজুকাকাকে আবার জিগ্যেস করল, “সকালে উঠে খালি পেটে জল খেলেও কী অম্বল অম্বল লাগে?”

মেয়েরা তেঁতুলের আচার খেয়ে, চোখ ছোট করে, জিভে যেমন টকাস আওয়াজ তোলে, বিজুকাকা সেরকম আওয়াজ তুলে বলল, “লাগে মানে? জল খাবার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মনে হয়, এক পেট কাঁচা আমের সরবৎ গিলেছি। কিংবা পাকা তেঁতুল গোলা জল খেয়েছি। দাঁত ব্রাশ করার সময় দেখি দাঁত টকে গেছে। ছোটবেলায়, নুন ছাড়া কাঁচা আম, গাছ থেকে পেড়ে খেলে, দাঁতের যে অবস্থা হত, সে রকম আর কি!”

ভূষিকা এই কথায় শিউরে উঠল যেন, বলল, “ইসসসস.....তোমার অবস্থা তো বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে গো, বিজুদা”?

আমি ফুট না কেটে পারলাম না, “ভূষিকা ঘোর আলো কী বলছো, এ তো ঘোর অন্ধকার!”

ভূষিকা আমাকে পাত্তাই দিল না, বলল, “তোমার কথা শুনে, আমার সেই বাঘের কথা মনে পড়ছে গো, বিজুদা, একদম তোমার মতো অবস্থা হয়েছিল। বেচারা, তার কথা মনে পড়লেই...” 

বিজুকাকার কথাটা পছন্দ হল না, বিরক্ত মুখে বলল, “আমার অবস্থা বাঘের মতো, কী বলছিস কি, ভূষি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

কিন্তু আমরা সবাই হৈ হৈ করে উঠলাম গল্পে বাঘের গন্ধ পেয়ে। আমি তো বলে়ই ফেললাম, “বিজুকাকার এমন ঘোরালো অম্বলকে বাগে আনতে, বাঘের ধারালো সাহায্য তো নিতেই হবেঘোর আলোর থেকে ধারের আলো এমন আর মন্দ কী? সত্যি বলতে এই অম্বল সারাতে ওই পথই একমাত্র সম্বল। ভূষিকা তুমি ব্যাপারটা খুলে বলো।”

এইবার আমার কথায় সক্কলে হৈ হৈ করে বিপুল সমর্থন করল। খুব সিরিয়াস মুখ করে ভূষিকা বলল, “আমরা কথাটা শোন না বিজুদা, তাহলেই বিষয়ের গুরুত্বটা বুঝে যাবে।”

তারপর একটু চুপ করে থেকে ভূষিকা শুরু করল, “ঘটনাটা বছর তিরিশ আগেকার। আমি তখন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জোয়ান ছোকরা। হিস্ট্রিতে বিএ করে বসে আছি, বেকার। কলকাতায় চাকরি-বাকরির অবস্থা এখনকার থেকেও খুব খারাপবাংলার এমএতে, কলকাতা চিড়িয়াখানার[*] খাঁচাগুলো ভরে গেছে! এ আপিসে, সে আপিসে ঘুরে ঘুরে কলকাতায় কোন কিছুই জুটল না। শেষ অব্দি আমার এক বন্ধুর পিসেমশাইয়ের সুপারিশে সোজা চলে গেলাম নয়াগড়। নয়াগড় তখনও দেশি রাজ্য, সেখানে রাজা ছিল, রাজমন্ত্রী, রাজবদ্যি সব ছিল। ছিল না শুধু সেনাপতি আর সৈন্য সামন্ত। তবে কি না সে নামেই রাজ্য আর রাজা, আসলে তালপুকুর – ঘটি ডোবে না। সেই রাজার ঠাকুরদার আমলে বানানো একটা প্রাইভেট চিড়িয়াখানা ছিল। সেই চিড়িয়াখানায় কিছু শালিক, চড়াই, কাক-টাক গোছের ঘরোয়া পাখি, বেশ কিছু শেয়াল, গুচ্ছের বেড়াল আর এক পাল নেড়িকুকুর ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। বাঘ, সিংহ, ভালুক-টালুক যা ছিল সবই সাজানো!

নবা বলল, “সাজানো বাঘ-ভালুক মানে?”

ভূষিকা হাত তুলে তাকে ধৈর্য ধরার ইঙ্গিত করে বলতে লাগলেন, “বন্ধুর পিসেমশাইয়ের সুপারিশ লেখা চিঠি নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম নয়াগড়ে। কিছুটা কাঠ-খড় পুড়িয়ে দেখা করলাম বৃদ্ধ রাজমন্ত্রীর সঙ্গে। সেই মন্ত্রীমশাইও ছিলেন প্রবাসী বাঙালী, আর বাঙালী ছোকরাদের তিনি খুব ফেবার করতেন, চেষ্টা করতেন যতটা সম্ভব সাহায্য করার।

তাঁর হাতে পিসেমশাইয়ের চিঠিটা তুলে দিতে, তিনি মন দিয়ে চিঠিটা পড়লেন, তারপর বললেন, “ব্রজভূষণ, কটা দিন দেরি করে ফেললে, বাবা, বাঘ তো আর খালি নেই, একটাই ছিল, এই কদিন আগে সামতাবেড়ের একটা ছেলে, তোমার মতোই সুপারিশ নিয়ে এসেছিল, তাকে ঢুকিয়ে নিয়েছি”।

আমি খুব হতাশ হয়ে, বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, মন্ত্রিমশাইয়ের কী মনে হল কে জানে? বললেন, “তুমি বাঙালী, আমারই দেশের ছেলে, তোমাকে হতাশ করে ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছে নাকিন্তু আমাদের চিড়িয়াখানায় একটা যে পোষ্ট খালি রয়েছে, সেটা বাঙালিদের পক্ষে খুব একটা সম্মানের নয়। ওটা আমি এর আগে কোনদিন কোন বাঙালীকেই দিইনি। সত্যি বলতে, আজ পর্যন্ত বাঘ-সিংহটাই বাঙালিদের জন্যে একচেটিয়া রেখেছিলাম, কিন্তু...”

মন্ত্রীমশাই দ্বিধাগ্রস্ত মুখে থেমে গেলেন। কিন্তু আমার তখন চাকরির খুব দরকার, একদিকে মায়ের শরীর খারাপ, ওদিকে ছোট বোনটা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠছে, আর ভাইটাও ছোট, তার লেখাপড়া আছে।

আমি রাজমন্ত্রীমশাইয়ের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, বললাম, “আমি কাউকে বাঙালি বলে পরিচয় দেব না, স্যার। আপনি কাজটা আমাকেই দিন, আমার অবস্থা খুব খারাপ, একটা চাকরি না হলে আমি সপরিবারে মারা পড়বো স্যার। ঘরে মা আছেন, ছোট বোন-ভাই আছে। আপনি না রাখলে, তাদের নিয়ে কোথায় যাবো, স্যার?”

 

শেষমেষ চাকরিটা হয়েই গেল। কাজ কম্মো তেমন কিছু নয়। মাইনেপত্র যা পেতাম, প্রায় পুরোটাই বাড়িতে পাঠাতে পারতাম, কারণ থাকা খাওয়াটা ছিল ফ্রি। খাওয়া দাওয়াও মন্দ নয়। সকালে একথালা ভাত, ডাল আর কাঁকরোল ভাজা, যাকে ওরা বলত ঘিয়াকরেলা। আর রাত্রে ছটা ঘি ছিটানো রুটি আর করেলার সবজি। হপ্তায় ছদিন ডিউটি। সোমবার ছুটি, সেদিন দুপুরে হত তিন পিস মাংস দিয়ে ঝোল আর ভাতসবথেকে কাজের চাপ হতো রবিবার আর ছুটির দিনগুলোতে। আবার কোন সোমবার পাব্লিক হলিডে থাকলে আমাদের হপ্তার ছুটিটা মার যেত। এ ছাড়া আর কোন ছুটি ছিল না, শরীর খারাপ হলেও না। ছমাস পরে বাড়ি আসব বলেছিলাম তাও ছুটি দেয়নি ছুটি পেয়েছিলাম প্রায় সাড়ে আট মাস পরে, সেই বর্ষার সময়। ওই সময় কে আর চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসে, ওই সব দেহাতি রাজ্যে? বর্ষার সময় লোক খেতিবাড়ি করবে, না চিড়িয়াখানা দেখবে?”

“বলিস কী, ভূষি? এ তো অত্যাচার। এই নয়াগড়টাই বা কোথায়, আর তার রাজাটাই বা কে”?

“জায়গাটা তখন ছিল এমপিতে, এখন ছত্তিসগড় হয়েছে, নামেই ছত্তিস, আসলে ছিল বাহাত্তরের চার ডবল। এই টুকু টুকু রাজ্য কিন্তু রাজাদের খুব ধুমধাম। এত্তো বড়ো বড়ো রংচঙে পাগড়ি, আর বাহারের পোষাক। তবে সে সব রাজাও আর নেই। রাজ্যও কী আর আছে, বিজুদা, এই স্বাধীন ভারতে”?

“অ। তা তোর কাজটা কী ছিল, সেটা তো বললি না?”

“সে কথায় পরে আসছি। আমার খাঁচা আর বাঘের খাঁচাটা ছিল পাশাপাশি। বাঘের খাঁচাতেই আমাদের সামতাবেড়ের সুনীল মাইতি ছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার বেশ গলায় গলায় ভাবসাবও হয়ে গেল। তার ডাকনাম ছিল নীলু। তার বাড়ির অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। দর্শকদের ভিড়ভাড় না থাকলে আমরা নিজের নিজের খাঁচার ধারে এসে গল্পসল্প করতাম। আমাদের থাকার জায়গাও ছিল একই জায়গায়। কাজেই সন্ধেয় বাড়ি ফিরেও আমরা একসঙ্গেই থাকতাম।  

 

বছর দেড়েক বেশ ভালোই চলল। ঝামেলা শুরু হল তারপরে। কোথা থেকে এক ব্রিটিশ সায়েব এসে উপস্থিত হল আমাদের চিড়িয়াখানায়। সে ব্যাটা শখের জীব বিজ্ঞানী,  তার সেই সময়ে কী যে শখ চেপেছিল কে জানে? রাজার বিশেষ অনুমতি নিয়ে সে হাজির হল, বাংলার বাঘের ওপর রিসার্চ করার জন্যে। বোঝ কাণ্ড। আমরা নিজের নিজের নির্দিষ্ট ছালচামড়া পরে খাঁচায় ঢোকার আধাঘন্টার মধ্যে সে রোজ এসে উপস্থিত হত, আর নীলুর খাঁচার সামনে একটা চেয়ার আর টেবিল নিয়ে বসে থাকত সারাদিন, সেই বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। বাংলার বাঘ সারাদিন কী করে, কী খায়, কী ভাবে হাঁটে, কী ভাবে হাঁই তোলে, কী ভাবে শোয় – সেই সায়েব বসে বসে সব দেখত আর মস্ত বড়ো একটা ডাইরিতে পাতার পর পাতা কী সব ছাইপাঁশ লিখত।

সত্যিকারের বাঘ তো আর নয়, ও তো আমাদের সামতাবেড়ের নীলু। তার তো অবস্থা সঙ্গীন। দেহাতি লোকের সামনে কিছুক্ষণ বাঘগিরি করা এক জিনিষ, আর জীব বিজ্ঞানী সায়েবের চোখের সামনে সারাটাদিন বাঘত্ব ফলানো অন্য জিনিষ। দেহাতি লোকেদের সামনে হেঁড়ে গলায় এক আধবার হালুম বললে, তারা খুশি হয়ে বাড়ি চলে যায়, সায়েবের তা হবে কেন? দু একদিন দেখে, তার কেন জানি না মনে হল, চিড়িয়াখানার কর্মচারীরা বাঘকে ভালো খেতে দেয় না। আর সেই কারণেই বাঘটা এমন দুর্বল। সেই সায়েব করলে কী, চিড়িয়াখানার কর্মচারীদের ভরসা না করে, একদিন নিজেই চারপাঁচ কিলো মাংস কিনে এনে, থপ থপ করে ফেলে দিল নীলুর খাঁচার ভেতর  সে এক কাণ্ড, সায়েব তো নিষিদ্ধ মাংস এনে দিয়েছে। ছ্যা ছ্যা, চাকরি করতে এসে কী জাত ধর্ম খোয়াতে হবে নাকি?

কর্মচারীরা সায়েবকে যত বোঝায়, “হিন্দু টাইগার সার, ইট নো বিফ সার। ইট অনলি গোট সার”

সায়েব ততো বলে, হতেই পারে না। বাঘ সব খায়, কখনো কখনো মানুষও খায়। ভারতে মানুষখেকো বাঘের কথা, সায়েব নাকি বিস্তর শুনেছে। বাঘের আবার হিন্দু, মুসলমান কীমানুষখেকো বাঘেরা হিন্দু মুসলমান কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না!

যাই হোক শেষমেষ রাজমন্ত্রীমশাই নিজে এসে যখন সায়েবকে বললেন, “নেটিব হিন্দু স্টেট সার। হিন্দু কিং। দিস টাইগার টেক বার্থ ইন জু কেজ সার। ইট ওনলি গোট মিট অ্যাণ্ড ফিস, সার।” তখন সায়েব ক্ষান্ত দিল।

তার পরদিন থেকে চিড়িয়াখানা থেকেই দিনের বেলা কচি কাঁচা পাঁঠার মাংস যোগান দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন রাজমন্ত্রীমশাই। আর সন্ধেবেলা তাঁর চেম্বারে আমাদের ডেকে নিয়ে, নীলুর দুটো হাত ধরে বললেন, “নীলু তোমার ওপরেই এই রাজ্যের সম্মান আর ভাগ্য নির্ভর করছে, বাবা। আমি কচি পাঁঠার কাঁচামাংসের কিমায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিতে বলেছি বাবা, কটা দিন একটু উৎরে দাও। সায়েব চলে গেলেই দিন কয়েকের জন্যে ছুটি দিয়ে দেব, বাড়ি গিয়ে মায়ের রান্না বিউলি ডাল, পটলের তরকারি, কলমির শাক আর পোস্ত খেয়ে পেট শুদ্ধু করে নিও”

 

এই কাণ্ডের পরেও সেই সায়েব প্রায় দিন আষ্টেক রোজ আসত চিড়িয়াখানায়, এক সোমবার দিনটা ছাড়া। আর বুঝে দেখো, বিজুদা, সায়েবকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কিলো দুয়েক কাঁচা মাংসের কিমা নীলুকে রোজ চেঁটেপুটে খেতে হত। হাতও লাগাতে পারত না, বাঘ কী হাত দিয়ে খায়? বেচারা সন্ধেয় ঘরে এসে আর কিছুই খেতে পারত না! ওইদিকের জল-হাওয়ায় শুনেছি লোহা খেলেও নাকি হজম হয়ে যায়! ছাই হয়, তা যদি হত, তাহলে দুকিলো কাঁচা মাংস কী আর হজম হতো না? কয়েক হাজার হজমিগুলি, কয়েকশ বোতল মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া শেষ হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের নীলু কাঁচা মাংস সহ্য করতে পারল না। দিন চারেকের মধ্যে তার এমন অম্বল শুরু হল। অবিকল তোমার মতো। সকালে উঠে শুধু জল খেলেও, বেচারার গলা অব্দি টক হয়ে থাকত সারাদিন সে তোমার মতোই বড়ো বড়ো ঢেঁকুর তুলত, হেউ হেউ। আর বাঘের মুখের আড়াল থেকে সেই আওয়াজ বাঘের গর্জনের মতোই গম্ভীর শোনাতো। সেই আওয়াজ যেদিন যত বেশি হত, সায়েব তত খুশি হত। আর ডাইরিতে পাতার পর পাতা নোট লিখত।

 

নীলুর ঘোরালো অবস্থার কথা আমরা রাজমন্ত্রীমশাইকে জানালাম। তিনি সব শুনে চিন্তিত মুখে রাজবৈদ্যকে ডেকে পাঠালেন। থুত্থুড়ে বুড়ো রাজবৈদ্য সব শুনে, নীলুর সব লক্ষণ দেখে বুঝে, গম্ভীর মুখে দেহাতি হিন্দিতে যা বললেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমি এবং আমার বাপ চোদ্দপুরুষ কেউ কাঁচা মাংস খাওয়া জীবের চিকিৎসা তো করি নি, বেটা! আমরা মানুষ এমন কি গরু মোষের চিকিৎসাও করেছি। কিন্তু আমাদের বংশে বাঘ-ভালুকের চিকিৎসা কেউ কোনদিন করেছে বলে শুনিওনি। কাজেই ধুলো ঝেড়ে অনেক শাস্ত্র-পুঁথি বের করতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে, তারপর দেখি কী করা যায়। তবে এই শেষ, এ চাকরি আর করবো না, বাপু, ছেড়েই দেব। এই বয়েসে এত ধকল সহ্য হয়?”  

তিনি অবিশ্যি করেছিলেন দিন দুয়েক পরে, সন্ধেবেলা তিনি নিজেই এলেন, তাঁর সঙ্গে একজন দেহাতি হাট্টাকাট্টা মানুষ, আর তার কাঁধে বিশাল একখানা ওল”আমাদের  আড্ডার তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল,

“ওল?”

“সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, যে ভূষিকা!” আমিও চুপ করে থাকতে পারলাম না।

বিজুকাকা ভ্রূকুটি কুটিল চোখে আমার দিকে একবার, তারপর ভূষিকাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শিবু ঠিকই বলেছে, বড্ডো বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস, ভূষি”এই বলে বিজুকাকা উঠতে যাচ্ছিলেন।

আমি তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামলে নেওয়ার জন্যে বললাম, “বিজুকাকা, আপনার এই তো, পা বাড়ালেই বাড়ি। একটু বসে বাকিটাও শুনেই যান। নীলুবাবুর অম্বলের ওই বাড়াবাড়ির উপশম কীভাবে হল, বাড়ি গেলে আর জানা যাবে না” 

ভূষিকাকাও খুব ক্ষুণ্ণ মুখ করে বলল, “বিজুদা, আমার কথা বিশ্বাস করছো না তো? পুরোটা না শুনেই তুমি তো রেগে যাচ্ছো! পুরোটা শোনো, তারপর বুঝবে, কী মোক্ষম দাওয়াই দিয়েছিল ওই বুড়ো রাজবৈদ্য”

সে কথায় আমিও সায় দিলাম, “এসব আগেকার রাজপুরীর ব্যাপার, পুরো না শুনলে পুরোপুরি বোঝা যাবে না, বিজুকাকা”

বিজুকাকা আবার বসলেন, কিন্তু আর কোন কথা বললেন না, ফ্যালফেলে চোখে ভূষিকাকার দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু। ভূষিকাকা সময় নষ্ট না করে আবার বলতে শুরু করল, “আমি আর নীলুও চমকে উঠেছিলাম। দেহাতি লোকটাকে যখন রাজবদ্যিমশাই, আমাদের ঘরের এক কোণায়, ওই মস্তো ওলটা ভাল করে রাখতে বললেন। আমরা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রাজবদ্যিমশাই দেহাতি লোকটিকে বিদায় দিয়ে, আমার চৌকির কোণায় বসলেন। তারপর নীলুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“অবাক হচ্ছো তো? ওটাই তোমার অম্বলের ওষুধ বলো ওষুধ, পথ্যি বলো পথ্যি  রোজ সকালে খেয়েদেয়ে কাজে বেরোনোর আগে, এতটা করে কাঁচা ওলের টুকরো, কচি শসা খাওয়ার মতো চিবিয়ে খাবে”এই বলে তিনি টুকরোর সাইজটা হাতের ভঙ্গি করে দেখালেন।

নীলু করুণ মুখ করে জিগ্যেস করল, “কাঁচা”?

“হুঁ। কাঁচা। কাঁচা মাংসর দাওয়াই, কাঁচা ওল। তবে সন্ধেবেলা বা রাত্রে খেও না। হিতে বিপরীত হবে” আরো কিছু বিধি বিধান দিয়ে তিনি একটু পরে বিদায় নিলেন। আর যাবার সময় পই পই করে, নীলুকে বলে গেলেন, ওলে অম্ল ও পিত্ত বিনাশ হয়, কাজেই ওল ছাড়া নীলুর অন্য বিকল্প নেই।

 

পরের দিন সকালে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেছিল, কাজেই খাওয়ার পর বসে বসে কাঁচা ওল খাবার সময় আর হাতে ছিল না। আমি নীলুকে বললাম, হাতে নিয়ে নে, রাস্তায় যাবার পথেই চিবোতে চিবোতে যাবি। নীলু তাই করল। কচর মচর করে কাঁচা ওল চিবোতে চিবোতে নীলু থু থু করতে লাগল, আর আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে চিড়িয়াখানায় পৌঁছে গেলাম। সাজঘরে ঢুকে নিজের নিজের ছালচামড়া পড়তে পড়তেই নীলু বেশ কবার বলল, “ভূষি রে, আমার গলা থেকে পেট অব্দি বেজায় কুটকুট করছে! মনে হচ্ছে গুচ্ছের কাঁকড়া গলা বেয়ে উঠে আসতে চাইছে, কিন্তু হড়কে পড়ে যাচ্ছে বার বার”।

সাঁত্রাগাছির রান্না করা ওল কাসুন্দি আর কাঁচা লংকা মেখে খেয়ে অভ্যস্ত নীলুতার ওই কাঁচা বুনো ওল খেয়ে কী অবস্থা হচ্ছে, বুঝতেই পারছিলাম। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “কাঁকড়ার কথা ভুলে যা, অম্বলে আর গলা অব্দি জ্বালা করছে কিনা সেটা বল”।

ব্যাজার মুখ করে নীলু বলল, “কাঁকড়া ধরবো, না, অম্বলে জ্বলবো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না”।

আমি বললাম, “ব্যস, আর চিন্তা নেই, ওই বুনো ওল তোর অম্বলকে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে, দেখে নিস”।

 

আমাদের হাতে আর বেশি সময় ছিল না, কাজেই আমরা তাড়াতাড়ি নিজের নিজের খাঁচায় গিয়ে ঢুকে পড়লাম। সেদিনও সেই সায়েব ঠিক সময়েই এল এবং টেবিলে ডাইরি মেলে, চেয়ারে বসে হাবিজাবি লিখতে শুরু করল। দেখতে দেখতে নীলুর গাল-গলা ফুলে ঢোল হয়ে উঠল। বাঘের যে মুখটা এতদিন ঢিলে ঢালা পাঞ্জাবীর হাতার মতো ঝুলঝুল করত, সেদিন একদম গোলগাল স্মার্ট ফিটিং! সেদিন বাঘ দেখে তো সায়েব খুব খুশি। রাজমন্ত্রীমশাইকে ডেকে এনে সায়েব ফলাও করে বলল, তার জোর জারিতেই বাঘের স্বাস্থ্য ফিরে গেছে। রাজমন্ত্রীমশাই কী আর উত্তর দেবেন, সায়েবের খুশিতে তিনি আদৌ খুশি হতে পারলেন না। গোমড়া মুখে সায়েবের কথা শুনতে লাগলেন।

অনেক কথা বার্তার পর সায়েব বলল, ওই দিনই তার শেষ দিন, কাল ভোরে বোম্বাই রওনা হবে, সেখান থেকে পরের দিন ফিরে যাবে নিজের দেশ বিলেতে। এই কথা শুনে রাজমন্ত্রীমশাই তো বটেই আমরাও এমন খুশি হলাম, সে আর বলার নয়! নীলু তো দু পায়ে দাঁড়িয়ে আনন্দে গর্জন করে উঠল বেশ কয়েকবার। সেই দেখে সায়েবও তাজ্জব বনে গেল। এই কদিনে সে বাঘকে একবারও দুই পায়ে দাঁড়াতে দেখেনি। রাজমন্ত্রীমশাই কটমট করে নীলুর দিকে তাকাতে, নীলু নিজের ভুলটা বুঝতে পারল, সে আবার বাঘ হয়েই চার পায়ে ঘুরতে লাগল খাঁচার ভেতর।

সায়েব মন্ত্রীমশাইকে জিগ্যেস করল, আপনাদের বাঘ দু পায়ে দাঁড়াতে পারে? এ তো মির‍্যাক্‌ল্‌! মন্ত্রীমশাই হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “নো টু লেগ স্ট্যাণ্ড স্যার, দে স্ট্যাণ্ড অন ফোর লেগ, লাইক চেয়ার অর টেবিল স্যারমোর মিট দে ইটিং, দে গোয়িং ম্যাড। নাউ হি ইজ ভেরি স্ট্রং, হি ক্যান ব্রেক কেজ। গো হোম সুন, স্যার, ডেঞ্জার মে কাম এনি মোমেন্ট!” মন্ত্রিমশাইয়ের এই কথায় মোক্ষম কাজ হল। সায়েব তখনই ডাইরি বগলে নিয়ে, চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি”

 

এই অব্দি বলে ভূষিকা চুপ করে রইল। আমরাও কেউ কিছু বললাম না। ঘটনার ঘনঘটায় আমরাও যেন হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণ পর বিজুকাকা বললেন, “আর অম্বল? সেও কি দু পেয়ে বাঘের ভয়ে পালিয়ে গেল, তোর নীলুকে ছেড়ে?”

“না, না দাদা, তাই হয়? অম্বল কী আর সায়েব নাকি? অম্বল তো তার আগেই পালিয়ে গেছে বুনো ওলের ভয়ে। বুনো ওলের জন্যে চিরকাল বাঘা তেঁতুলের কথা শুনেছি, শোনেননি দাদা, বলুন? এখানে ব্যাপারটা উলটো, বাঘা অম্বলকে জব্দ করল বুনো ওল। ওই শিবুর কথা মতো একটু ওলটপালট ব্যাপার, তাই নয় কি”?

“এই তোর অম্বলের ওষুধ? এই বলার জন্যেই তুই আমায় ডেকে আনলি?” এই কথা বলে বিজুকাকা রাগে গনগনে মুখ করে উঠে দাঁড়ালেন, পায়ে চটি পরতে পরতে আবার বললেন, “তুই ওই চিড়িয়াখানায় কী করতিস, সেটা কিন্তু বললি না। তবে, তুই না বললেও আমি জানি”

ভূষিকা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, “তাই? কী বলুন তো?”

বিজুকাকা ক্লাব ঘরের দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন, “আস্ত একটি মুখপোড়া হনুমান”!

ভূষিকা খুব নিরীহ নিরীহ মুখ গদ্গদ কণ্ঠে বলল, “বিজুদা, আপনি রিয়্যালি গ্রেট। যাবার আগে পায়ের ধুলো একটু দেবেন না, দাদা?” ততক্ষণে বিজুকাকা রাস্তায় নেমে আড়ালে চলে গেছেন।

 

আমরা এতক্ষণ অনেক কষ্টে চেপে ছিলাম, এবার সবাই হো হো করে হাসতে লাগলাম।

ভুষিকা হাসল না, গম্ভীর মুখে বলল, “বিজুদার অম্বল কিন্তু আমি ছাড়িয়ে দিলাম, মিলিয়ে নিস। কিন্তু বৃষ্টিটা ছাড়ার নাম করছে না, কেন বল তো?”  

                   --০০--

   

[*অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তর লেখা “বাংলার এম-এ” গল্পের নায়ক আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘের চাকরি নিয়েছিল; ইতিহাসের বিএ যে মধ্যপ্রদেশের চিড়িয়াখানায় চাকরি নেবে, সে তো বলাই বাহুল্য।]                

 

                                                 

বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫

কঠোপনিষদ - ১/১

 

সূচনা

 এই উপনিষদটি কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় শাখার কঠ বা কাঠক ব্রাহ্মণের অন্তর্গত বলে কঠোপনিষদ নামে পরিচিত। এই উপনিষদে যম ও নচিকেতার আখ্যান এবং তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে ব্রহ্মবিদ্যার তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। নচিকেতার এই উপাখ্যানটি অত্যন্ত প্রাচীন, ঋগ্‌বেদে এবং তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও নচিকেতার এই উপাখ্যানটির একটু অন্যভাবে উল্লেখ আছে।

কঠোপনষিদের প্রথম যে ভাষ্যটি পাওয়া যায়, সেটি আচার্য শংকরের। তিনিই এই উপনিষদকে দুটি অধ্যায়ে এবং প্রতি অধ্যায়কে তিনটি বল্লীতে বিভক্ত করেন। পরবর্তী কালে মধ্বাচার্য এটিকে অধ্যায়ে ভাগ না করে, ছয়টি বল্লীতে বিভক্ত করেছিলেন। ১৮১৭ সালে রাজা রামমোহন রায় এই উপনিষদের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন। পণ্ডিতেরা এই উপনিষদটিকে সেরা উপনিষদগুলির মধ্যে অন্যতম মনে করেন।

“উত্তিষ্ঠত জাগ্রত

প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধত।

ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া

দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি”।। (১/৩/১৪) 

উপরের শ্লোকটি স্বামী বিবেকানন্দর অত্যন্ত প্রিয় – তাঁর এই বাণীই সেসময় এবং আজও বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং করে চলেছে। শ্লোকটি এই উপনিষদের অন্তর্গত। 

  প্রসঙ্গতঃ W. Somerset Maugham-এর  ১৯৪৪ সালে লেখা বিখ্যাত উপন্যাস The Razor's Edge -এর নামটি এই শ্লোকের "ক্ষুরস্য ধারা" শব্দদুটির অনুবাদ। এই উপন্যাসের নায়ক ছিলেন একজন যুদ্ধ-বিমান চালক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা নিজের চোখে দেখে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং উপনিষদের মধ্যে শান্তি ও নতুন এক জীবনের সন্ধান করতে থাকেন। এই উপন্যাসটি নিয়ে হলিউডে সিনেমাও হয়েছে।    

       

 শান্তিপাঠ

 

ওঁ সহ নাববতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ তেজস্বি নাবধীতমস্তু,

মা বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

ওঁ সহ নৌ অবতু, সহ নৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ তেজস্বি নৌ অধীতম্‌ অস্তু,

মা বিদ্বিষাবহৈ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

আমাদের দুজনকে তিনি সমভাবে রক্ষা করুন, দুজনকেই সমভাবে (জ্ঞান) লাভ করান, আমাদের উভয়কেই (জ্ঞানলাভের) উপযুক্ত করে তুলুন। আমাদের উভয়ের কাছেই লব্ধজ্ঞান যেন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। (আমরা যেন পরষ্পরের প্রতি) বিদ্বেষ না করি।  ওঁ শান্তি, সকল বিঘ্নের শান্তি হোক।

 

প্রথম অধ্যায়

প্রথম বল্লী

ওঁ উশন্‌ হ বৈ বাজশ্রবসঃ সর্ববেদসং দদৌ।

তস্য হ নচিকেতা নাম পুত্র আস।। ১/১/১

ওঁ উশন্‌ হ বৈ বাজশ্রবসঃ সর্ববেদসং দদৌ।

তস্য হ নচিকেতা নাম পুত্র আস।। ১/১/১

বাজশ্রবার পুত্র যজ্ঞে ফললাভের জন্য সর্বস্ব দান করেছিলেন। তাঁর এক পুত্র ছিল, নাম নচিকেতা। [বাজ মানে অন্ন, শ্রবঃ মানে যশ - অন্নদান করে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেই বাজশ্রব-র বংশধরেরা বাজশ্রবা।]

   

তং হ কুমারং সন্তং দক্ষিণাসু নীয়মানাসু

শ্রদ্ধাবিবেশ সোঽমন্যত।। ১/১/২

তং হ কুমারং সন্তং দক্ষিণাসু নীয়মানাসু

শ্রদ্ধা আবিবেশ সঃ অমন্যত।। ১/১/২

যজ্ঞের দক্ষিণা(গবাদি প্রাণী) সমূহ যখন যজ্ঞস্থলে আনা হচ্ছিল, পিতার মঙ্গল চিন্তা করে, বালক নচিকেতার মনে হল,

 

পীতোদকা জগ্ধতৃণা দুগ্ধদোহা নিরিন্দ্রিয়াঃ।

অনন্দা নাম তে লোকাস্তান্‌ স গচ্ছতি তা দদৎ।। ১/১/৩

পীত-উদকাঃ জগ্ধ-তৃণাঃ দুগ্ধ-দোহাঃ নিঃ-ইন্দ্রিয়াঃ।

অনন্দাঃ নাম তে লোকাঃ তান্‌ স গচ্ছতি তাঃ দদৎ।। ১/১/৩

জীবনের শেষ জল পান করে নিয়েছে, শেষ ঘাস-পাতা খেয়ে ফেলেছে, দুধ দেওয়ারও আর ক্ষমতা নেই, নেই সন্তান ধারণের ক্ষমতাও, এমন গাভীসমূহ যিনি দান করেন, তাঁকে দুঃখময় লোকে যেতে হয়।

[এখানে আমার কিছু বক্তব্য আছেঃ উপনিষদ-গ্রন্থ লেখা যখনই হোক, উপনিষদের রচনাকাল - সত্য কিংবা ত্রেতা যুগে। আমার ধারণা সত্যযুগে - যখন অনার্য রাক্ষস, দানবদের অত্যাচার আর্য ঋষিদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেনি। ত্রেতা যুগ শ্রীরামচন্দ্রের যুগ - সে সময় উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারতের সর্বত্র অনার্য রাক্ষসদের উপদ্রব প্রশমন করতেই শ্রীরামচন্দ্রের মর্তে আগমন। 

অতএব ধরে নিই সত্যযুগেই উপনিষদ রচিত হয়েছিল। বিভিন্ন পুরাণ থেকে জানা যায় সত্য যুগ ছিল আদর্শ ধর্ম যুগ। সত্য যুগ চতুষ্পদ ধর্মের উপর নির্ভরশীল ছিল - সেই চতুষ্পদ ধর্ম হল - তপস্যা, শুদ্ধি, দয়া ও সত্য। ত্রেতা যুগ ছিল ত্রিপদ ধর্মে নির্ভরশীল - অর্থাৎ চারটি ধর্ম ছিল, কিন্তু তার প্রভাবে এক-চতুর্থাংশ হ্রাস পেয়েছিল। দ্বাপরে ওই ধর্মগুলি অর্ধেক প্রভাব হারিয়ে অর্ধাংশ - অর্থাৎ দ্বিপদ হয়ে উঠল। আর কলির কথা না বলাই ভাল - অত্যন্ত করুণ - তিন-চতুর্থাংশ প্রভাব হারিয়ে, মাত্র একটি মাত্র পায়ের উপর ওই চারটি ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে। 

সেক্ষেত্রে, সত্য যুগে - যখন চারটি ধর্ম পূর্ণ মাত্রায় বলবৎ - নচিকেতার পিতা গৌতম যিনি আবার বিখ্যাত দানশীল বাজশ্রব বংশের উত্তরপুরুষ - তিনি যজ্ঞের দান হিসাবে দিচ্ছেন - জরাগ্রস্ত অসুস্থ ধেনুসমূহ !!! যারা জীবনের শেষ জল পান করে ফেলেছে, শেষ তৃণ খেয়ে ফেলেছে, যাদের সন্তানধারণের ক্ষমতা বিলুপ্ত অতএব দুগ্ধদানেও অপারগ! এই ধেনুগুলি তিনি  দক্ষিণা হিসাবে যাদের দিচ্ছেন - তাদের প্রতি তিনি প্রকৃতপক্ষে প্রতারণা করলেন না কি? সত্য যুগেও এমন অনাচার যে ঘটত - সে কথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই - কারণ উপনিষদকার ঋষি এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন - এবং এই অনাচারের প্রতিকারের জন্য বালক বা তরুণ নচিকেতা বিচলিত হয়ে উঠে বারবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছেন, "পিতা আপনি আমাকে কার হাতে দান করছেন?" এতটুকু লজ্জিত না হয়ে, ক্রুদ্ধ পিতা তরুণ পুত্র নচিকেতাকে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু অভিশাপই দিলেন, বললেন - "তোমাকে আমি মৃত্যুর কাছে দান করলাম"। অর্থাৎ চার ধর্মের - তপস্যা, শুদ্ধি, দয়া ও সত্য - সবগুলিই তিনি লঙ্ঘন করলেন।]                 


স হোবাচ পিতরং তত কস্মৈ মাং দাস্যসীতি।

দ্বিতীয়ং তৃতীয়ং তং হোবাচ মৃত্যবে ত্বা দদামীতি।। ১/১/৪

সঃ হ উবাচ পিতরং তত কস্মৈ মাং দাস্যসি ইতি।

দ্বিতীয়ং তৃতীয়ং তং হ উবাচ মৃত্যবে ত্বা দদামি ইতি।। ১/১/৪

তিনি পিতাকে বললেন, “পিতা, আপনি আমাকে কার কাছে দান করবেন?” (পিতার উত্তর না পেয়ে) তিনি দ্বিতীয় বার, তৃতীয় বার একই প্রশ্ন করলেন। তখন পিতা বললেন, “তোমাকে আমি মৃত্যু (যম)-র কাছে দান করলাম”।


বহূনামেমি প্রথমো বহূনামেমি মধ্যমঃ।

কিং স্বিদ্‌ যমস্য কর্তব্যং যন্ময়াদ্য করিষ্যতি।। ১/১/৫


বহূনাম্‌ এমি প্রথমঃ বহূনাম্‌ এমি মধ্যমঃ।

কিং স্বিদ্‌ যমস্য কর্তব্যং যৎ ময়া অদ্য করিষ্যতি।। ১/১/৫

(নচিকেতা চিন্তা করলেন) “অনেকের মধ্যে আমি প্রথমে থাকি, অনেকের মধ্যে আমি মাঝারি, (কিন্তু কখনও অধম তো নই! সুতরাং) যমের এমন কী প্রয়োজন পড়ল যে, আজ পিতা আমাকেই তাঁর কাছে দান করলেন?”

 

অনুপশ্য যথা পূর্বে প্রতিপশ্য তথাঽপরে।

সস্যমিব মর্ত্যঃ পচ্যতে সস্যমিবাজায়তে পুনঃ।। ১/১/৬

অনুপশ্য যথা পূর্বে প্রতিপশ্য তথা অপরে।

সস্যম্‌ ইব মর্ত্যঃ পচ্যতে সস্যম্‌ ইব আজায়তে পুনঃ।। ১/১/৬

(দুর্বল হয়ে পিতা পাছে সত্যভ্রষ্ট হন, তাই নচিকেতা বললেন,) “হে পিতা, আমাদের পূর্বপুরুষদের (সত্যনিষ্ঠার) কথা চিন্তা করুন, অন্যান্য (সত্যনিষ্ঠ)-দের কথাও চিন্তা করুন। মানুষের জীবন শস্যের মতোই একবার জীর্ণ হয় আবার জন্ম নেয়” (অতএব অনিত্য এই সংসারে সত্যভ্রষ্ট হওয়া উচিৎ নয়)। 

 

বৈশ্বানরঃ প্রবিশত্যতিথির্ব্রাহ্মণো গৃহান্‌।

তস্যৈতাং শান্তিং কুর্বন্তি হর বৈবস্বতোদকম্‌।। ১/১/৭

বৈশ্বানরঃ প্রবিশতি অতিথিঃ ব্রাহ্মণঃ গৃহান্‌।

তস্য এতাম্‌ শান্তিং কুর্বন্তি হর বৈবস্বত উদকম্‌।। ১/১/৭

(যমরাজ তিন রাত্রি ঘরে ছিলেন না, তিনি ফিরলে তাঁর আত্মীয়রা বললেন,) “ব্রাহ্মণ অতিথি অগ্নির মতোই গৃহে প্রবেশ করেন। গৃহস্থ তাঁর (পথশ্রম ও ক্লান্তির) শান্তির ব্যবস্থা করেন। হে যমরাজ, তাঁর পা ধোওয়ার জল আন।   

 

আশাপ্রতীক্ষে সঙ্গতং সুনৃতাং

চেষ্টাপূর্তে পুত্রপশুংশ্চ সর্বান্‌।

এতদ্বৃঙ্‌ক্তে পুরুষস্যাল্পমেধসো

যস্যানশ্নন্‌ বসতি ব্রাহ্মণো গৃহে।। ১/১/৮

আশাপ্রতীক্ষে সঙ্গতং সুনৃতাং

চ ইষ্টাপূর্তে পুত্রপশুন্‌ চ সর্বান্‌।

এতৎ বৃঙ্‌ক্তে পুরুষস্য অল্পমেধসঃ

যস্য অনশ্নন্‌ বসতি ব্রাহ্মণো গৃহে।। ১/১/৮

যার গৃহে ব্রাহ্মণ অনাহারে বাস করেন, সেই অল্পবুদ্ধি মানুষের (শুভ ফলের) আশা, প্রতীক্ষা, সাধু সঙ্গলাভের সুফল, প্রিয়বাক্য বলার ফল, যজ্ঞে পূর্ণ হওয়া ইষ্ট, পুত্র, গবাদি পশু – সকলই বিনষ্ট হয়”।


তিস্রো রাত্রীর্যদবাৎসীর্গৃহে

মেঽনশ্নন্‌ ব্রহ্মন্নতিথির্নমস্যঃ।

নমস্তেঽস্তু ব্রহ্মন্‌ স্বস্তি মেঽস্তু

তস্মাৎ প্রতি ত্রীন বরান্‌ বৃণীষ্ব।। ১/১/৯

তিস্রঃ রাত্রীঃ যৎ অবাৎসীঃ গৃহে

মে অনশ্নন্‌ ব্রহ্মন্‌ অতিথিঃ নমস্যঃ।

নমঃ তে অস্তু ব্রহ্মন্‌ স্বস্তি মে অস্তু

তস্মাৎ প্রতি ত্রীন বরান্‌ বৃণীষ্ব।। ১/১/৯

(নচিকেতাকে অভ্যর্থনা করে যমরাজ বললেন) “হে ব্রাহ্মণ, তুমি নমস্য অতিথি, তুমি অনাহারে তিন রাত্রি আমার গৃহে যেহেতু বাস করেছো, তার জন্যে তোমাকে নমস্কার, এখন ওই তিন রাত্রির জন্যে তুমি তিনটি বর প্রার্থনা কর এবং আমার মঙ্গল হোক”।

 

শান্তসংকল্পঃ সুমনা যথা

স্যাদবীতমন্যুর্গৌতমো মাঽভি মৃত্যো।

তৎপ্রসৃষ্টং মাঽভিবদেৎ প্রতীত

এতৎ ত্রয়াণাং প্রথমং বরং বৃণে।। ১/১/১০

শান্তসংকল্পঃ সুমনা যথা

স্যাৎ বীত-মন্যুঃ গৌতমঃ মা অভি মৃত্যো।

তৎপ্রসৃষ্টং মা অভিবদেৎ প্রতীত

এতৎ ত্রয়াণাং প্রথমং বরং বৃণে।। ১/১/১০

(নচিকেতা বললেন) “হে মৃত্যু, (আমার পিতা) গৌতম যেন আমার প্রতি উৎকণ্ঠাহীন, প্রসন্নমনা এবং বিগতক্রোধ হন। আপনার এখান থেকে মুক্ত হবার পর পিতা আমায় যেন চিনতে পারেন এবং সাদরে গ্রহণ করেন। তিনটির মধ্যে এইটি আমার প্রথম বর”।

[সাধারণ ভাবে যমের গৃহে যায় মৃত মানুষ, অর্থাৎ প্রেত - প্রেতের সঙ্গে মর্ত্যের জীবিত মানুষের কোন পরিচয় থাকে না। নচিকেতা বর চাইলেন, পিতার সঙ্গে আমার যেন সেই সম্পর্ক না হয়]     

 

যথা পুরস্তাদ্ভবিতা প্রতীত

ঔদ্দালকিরারুণির্মৎপ্রসৃষ্টঃ।

সুখং রাত্রীঃ শয়িতা বীতমন্যুস্ত্বাং

দদৃশিবান্‌ মৃত্যুমুখাৎ প্রমুক্তম্‌।। ১/১/১১

যথা পুরস্তাৎ ভবিতা প্রতীতঃ

ঔদ্দালকিঃ আরুণিঃ মৎ-প্রসৃষ্টঃ

সুখং রাত্রীঃ শয়িতা বীত-মন্যুঃ ত্বাং

দদৃশিবান্‌ মৃত্যুমুখাৎ প্রমুক্তম্‌।। ১/১/১১

(যমরাজ বললেন) “ঔদ্দালকি আরুণি তোমার প্রতি আগে যেমন ছিলেন, তোমাকে চিনতে পেরে সেরকমই থাকবেন। তোমাকে মৃত্যুমুখ থেকে বিমুক্ত দেখেও, আমার ইচ্ছায় ক্রোধহীন হয়ে আরো অনেক রাত্রি তিনি সুখনিদ্রায় কাটাবেন”।

[নচিকেতার পিতা গৌতম, ঋষি উদ্দালক ও অরুণের বংশধর, তাই যমরাজ তাঁকে ঔদ্দালকি এবং আরুণি সম্বোধন করেছেন। সকলেই বাজশ্রবা বংশের ঋষি।]   

 

স্বর্গে লোকে ন ভয়ং কিঞ্চনাস্তি

ন তত্র ত্বং ন জরয়া বিভেতি।

উভে তীর্ত্বাঽশনায়াপিপাসে

শোকাতিগো মোদতে স্বর্গলোকে।। ১/১/১২

স্বর্গে লোকে ন ভয়ং কিঞ্চন অস্তি

ন তত্র ত্বং ন জরয়া বিভেতি।

উভে তীর্ত্বা অশনায়া-পিপাসে

শোকাতিগঃ মোদতে স্বর্গলোকে।। ১/১/১২

(নচিকেতা বললেন) “স্বর্গলোকে এতটুকুও ভয় নেই। সেখানে আপনি (মৃত্যু) নেই, জরাগ্রস্ত হবার ভয় নেই। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা উভয়কেই অতিক্রম করে, শোকের অনুভব-মুক্ত হয়ে, সকলে স্বর্গে আনন্দ ভোগ করে”।

 

স ত্বমগ্নিং স্বর্গ্যমধ্যেষি মৃত্যো

প্রব্রূহি ত্বং শ্রদ্দধানায় মহ্যম্‌।

স্বর্গলোকা অমৃতত্বং ভজন্ত

এতদ্‌ দ্বিতীয়েন বৃণে বরেণ।। ১/১/১৩

স ত্বম্‌ অগ্নিং স্বর্গ্যম্‌ অধ্যেষি মৃত্যো

প্রব্রূহি ত্বং শ্রদ্দধানায় মহ্যম্‌।

স্বর্গলোকা অমৃতত্বং ভজন্ত

এতৎ দ্বিতীয়েন বৃণে বরেণ।। ১/১/১৩

   হে মৃত্যু, স্বর্গকামী মানুষেরা অগ্নিবিদ্যার তপস্যা করে যে ভাবে স্বর্গ এবং অমরত্ব লাভ করে, সে বিষয় আপনার জানা আছে। শ্রদ্ধাবান আমাকে আপনি সেই বিষয় বলুন, এই আমার প্রার্থিত দ্বিতীয় বর”।    

 

প্র তে ব্রবীমি তদু মে নিবোধ

স্বর্গ্যমগ্নিং নচিকেতঃ প্রজানন্‌।

অনন্তলোকাপ্তিমথো প্রতিষ্ঠাং

বিদ্ধি ত্বমেতং নিহিতং গুহায়াম্‌।। ১/১/১৪

প্র তে ব্রবীমি তৎ উ মে নিবোধ

স্বর্গ্যম্‌ অগ্নিং নচিকেতঃ প্রজানন্‌।

অনন্তলোকাপ্তিম্‌ অথো প্রতিষ্ঠাম্‌

বিদ্ধি ত্বম্‌ এতম্‌ নিহিতম্‌ গুহায়াম্‌।। ১/১/১৪

(যমরাজ বললেন) “হে নচিকেতা, স্বর্গলাভের জন্য অগ্নি বিদ্যার বিষয় আমি ভালোভাবেই জানি। মন দিয়ে শোনো, আমি বলছি। জেনে রাখো, এই বিষয় অনন্তলোক লাভের উপায়, জগতের আশ্রয় এবং বিদ্বানদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত”।   

 

লোকাদিমগ্নিং তমুবাচ তস্মৈ

যা ইষ্টকা যাবতীর্বা যথা বা।

স চাপি তৎ প্রত্যবদদ্‌ যথোক্তমথাস্য

মৃত্যুঃ পুনরেবাহ তুষ্টঃ।। ১/১/১৫

লোকাদিম্‌ অগ্নিং তম্‌ উবাচ তস্মৈ

যা ইষ্টকা যাবতীঃ বা যথা বা।

সঃ চ অপি তৎ প্রত্যবদৎ যথা উক্তম্‌

অথ অস্য মৃত্যুঃ পুনঃ এব আহ তুষ্টঃ।। ১/১/১৫

(যমরাজ নচিকেতাকে) সৃষ্টির আদিতে উপস্থিত অগ্নির বিষয়ে বললেন, কতগুলি ইঁট সংগ্রহ (যজ্ঞবেদী নির্মাণের জন্য) করে অন্যান্য ক্রিয়া (সমিৎসজ্জা, অগ্নিচয়ন, অগ্নিস্থাপন ইত্যাদি) কীভাবে করতে হয়। একনিষ্ঠ নচিকেতাও যমরাজের সকল কথা মন দিয়ে শুনে, তিনি যেমন বলেছিলেন, তেমনই পুনরুক্তি করলেন। নচিকেতার এই একাগ্রতায় যমরাজ আবার সন্তুষ্ট হয়ে বললেন।

  

তমব্রবীৎ প্রীয়মাণো মহাত্মা

বরং তবেহাদ্য দদামি ভূয়ঃ।

তবৈব নাম্না ভবিতাঽয়মগ্নিঃ

সৃঙ্কাং চেমামনেকরূপাং গৃহাণ।। ১/১/১৬

তম্‌ অব্রবীৎ প্রীয়মাণো মহাত্মা

বরং তব ইহ অদ্য দদামি ভূয়ঃ।

তব এব নাম্না ভবিতা অয়ম্‌ অগ্নিঃ

সৃঙ্কাম্‌ চ ইমাম্‌ অনেকরূপাং গৃহাণ।। ১/১/১৬

মহাত্মা (যমরাজ) প্রীত হয়ে তাঁকে বললেন, “আজ আরেকটি বর আমি তোমাকে দান করছি। এই অগ্নি তোমার নামেই প্রসিদ্ধ হবে, আর বহু বর্ণময় এই মালাও গ্রহণ করো”।

[“সৃঙ্কা” শব্দের এক অর্থ মালা, অন্য অর্থ শাস্ত্রসিদ্ধ কর্মবিজ্ঞান, যে কর্মজ্ঞানের-মালা দিয়ে পরমমঙ্গল লাভ করা যায়।]    

 

ত্রিণাচিকেতস্ত্রিভিরেত্য সন্ধিং

ত্রিকর্মকৃৎ তরতি জন্মমৃত্যু।

ব্রহ্মজজ্ঞং দেবমীড্যং বিদিত্বা

নিচায্যেমাং শান্তিমত্যন্তমেতি।। ১/১/১৭

ত্রিণাচিকেতঃ ত্রিভিঃ এত্য সন্ধিম্‌

ত্রিকর্মকৃৎ তরতি জন্মমৃত্যু।

ব্রহ্মজ-জ্ঞম্‌ দেবম্‌ ঈড্যং বিদিত্বা

নিচায্য ইমাম্‌ শান্তিম্‌ অত্যন্তম্‌ এতি।। ১/১/১৭

“তিনজনের (মাতা, পিতা ও আচার্য) সঙ্গে উপদেশ লাভ করে, যিনি তিনবার নাচিকেত অগ্নি চয়ন করবেন এবং তিন-কর্মের অনুষ্ঠান করবেন, তিনি জন্ম-মৃত্যুকে অতিক্রম করবেন। তিনি ব্রহ্ম থেকে সৃষ্টি হওয়া পূজনীয় এবং সর্বপ্রকাশশীল জ্ঞান আত্মরূপে উপলব্ধি করে পরমা শান্তি লাভ করবেন”

[শৈশবে মাতার, বাল্যে পিতার এবং উপনয়নের পর আচার্যের সঙ্গে থেকে যে উপদেশ লাভ করা যায়।]

 

ত্রিণাচিকেতস্ত্রয়মেতদ্‌ বিদিত্বা

য এবং বিদ্বাংশ্চিনুতে নাচিকেতম্‌।

স মৃত্যুপাশান্‌ পুরতঃ প্রণোদ্য

শোকাতিগো মোদতে স্বর্গলোকে।। ১/১/১৮

ত্রিণাচিকেতঃ ত্রয়ম্‌ এতৎ বিদিত্বা

যঃ এবম্‌ বিদ্বান্‌ চিনুতে নাচিকেতম্‌।

সঃ মৃত্যুপাশান্‌ পুরতঃ প্রণোদ্য

শোকাতিগঃ মোদতে স্বর্গলোকে।। ১/১/১৮

“যিনি এই তিন (সমিৎসজ্জা, অগ্নিচয়ন, অগ্নিস্থাপন) জেনে, তিনবার নাচিকেত অগ্নি চয়ন করেন এবং নাচিকেত অগ্নির ধ্যান করেন, তিনি শরীরত্যাগের আগেই মৃত্যুর বন্ধন দূর করেন এবং দুঃখ-শোকের ঊর্ধে স্বর্গলোকের আনন্দ উপভোগ করেন” 

 

এষ তেঽগ্নির্নচিকেতঃ স্বর্গ্যো

যমবৃণীথা দ্বিতীয়েন বরেণ।

এতমগ্নিং তবৈব প্রবক্ষ্যন্তি

জনাসস্তৃতীয়ং বরং নচিকেতো বৃণীষ্ব।। ১/১/১৯

এষ তে অগ্নিঃ নচিকেতঃ স্বর্গ্যঃ

যম্‌ অবৃণীথাঃ দ্বিতীয়েন বরেণ।

এতম্‌ অগ্নিং তব এব প্রবক্ষ্যন্তি

জনাসঃ তৃতীয়ং বরং নচিকেতঃ বৃণীষ্ব।। ১/১/১৯

“হে নচিকেতা, তুমি দ্বিতীয় বরে যা প্রার্থনা করেছিলে, স্বর্গলাভের উপায়স্বরূপ যে অগ্নিবিষয়ের কথা তোমাকে বললাম, তোমার নামেই লোক সেই অগ্নির নাম বলবে। এখন তোমার তৃতীয় বর প্রার্থনা করো”।

 

যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে

অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে।

এতদ্বিদ্যামনুশিষ্টস্ত্বয়াঽহং

বরাণামেষ বরস্তৃতীয়ঃ।। ১/১/২০

যা ইয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে

অস্তি ইতি একে ন অয়ম্‌ অস্তি ইতি চ একে।

এতৎ বিদ্যাম্‌ অনুশিষ্টঃ ত্বয়া অহং

বরাণাম্‌ এষঃ বরঃ তৃতীয়ঃ।। ১/১/২০

(নচিকেতা বললেন) “মৃত্যু হলেই মানুষের (মনে) এই যে সন্দেহ উদয় হয়, কেউ বলেন (পরলোকগত আত্মা) “আছে”, কেউ কেউ বলেন “নেই”, আপনার উপদেশ থেকে আমি এই বিষয়ে জানতে চাই, তিন বরের মধ্যে এই আমার তৃতীয় বর”।

 

দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং পুরা

ন হি সুবিজ্ঞেয়মণুরেষ ধর্মঃ।

অন্যং বরং নচিকেতো বৃণীষ্ব

মা মোপরোৎসীরতি মা সৃজৈনম্‌।। ১/১/২১

দেবৈঃ অত্র অপি বিচিকিৎসিতম্‌ পুরা

ন হি সুবিজ্ঞেয়ম্‌ অণুঃ এষ ধর্মঃ।

অন্যম্‌ বরম্‌ নচিকেতঃ বৃণীষ্ব

মা মা উপরোৎসীঃ অতি মা সৃজ এনম্‌।। ১/১/২১

(যমরাজ বললেন) “এই বিষয়ে আগে দেবতারাও সংশয়ে ছিলেন, কারণ সূক্ষ্ম এই আত্মতত্ত্ব সহজে উপলব্ধি করা যায় না। তুমি অন্য বর প্রার্থনা করো নচিকেতা, আমাকে অনুরোধ করো না, এই বিষয়টি ছেড়ে দাও”।

 

দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং কিল

ত্বং চ মৃত্যো যন্ন সুজ্ঞেয়মাত্থ

বক্তা চাস্য ত্বাদৃগন্যো ন লভ্যো

নান্যো বরস্তুল্য এতস্য কশ্চিৎ।। ১/১/২২

দেবৈঃ অত্র অপি বিচিকিৎসিতং কিল

ত্বং চ মৃত্যো যৎ ন সুজ্ঞেয়ম্‌ আত্থ।

বক্তা চ অস্য ত্বাদৃক্‌ অন্যঃ ন লভ্যঃ

ন অন্যঃ বরঃ তুল্যঃ এতস্য কঃ চিৎ।। ১/১/২২

(নচিকেতা বললেন) “দেবতাদেরও যখন এই বিষয়ে নিশ্চিত সংশয় ছিল, এবং হে যমরাজ, আপনিও বলছেন এই বিষয়টি সহজবোধ্য নয়, এ বিষয়ে আপনার মতো শ্রেষ্ঠ গুরু আর কাউকেই পাবো না, অতএব এই বরের তুল্য অন্য কোন বর আর কী হতে পারে?”  

 

শতায়ুষঃ পুত্রপৌত্রান্‌ বৃণীষ্ব

বহূন্‌ পশূন্‌ হস্তিহিরণ্যমশ্বান্‌।

ভূমের্মহদায়তনং বৃণীষ্ব,

স্বয়ং চ জীব শরদো যাবদিচ্ছসি।। ১/১/২৩

শত-আয়ুষঃ পুত্রপৌত্রান্‌ বৃণীষ্ব

বহূন্‌ পশূন্‌ হস্তি-হিরণ্যম্‌-অশ্বান্‌।

ভূমেঃ মহৎ-আয়তনং বৃণীষ্ব,

স্বয়ং চ জীব শরদঃ যাবৎ ইচ্ছসি।। ১/১/২৩

(মৃত্যুর গূঢ় রহস্য নিয়ে যমরাজ নচিকেতার সঙ্গে আলোচনায় ইচ্ছুক নন, তিনি নচিকেতাকে প্রলোভন দেখিয়ে নিরস্ত করার জন্যে বললেন) “তুমি পুত্র-পৌত্র নিয়ে শত বর্ষ আয়ুর বর নাও। অনেক গবাদিপশু, হাতি, অশ্ব এবং স্বর্ণ কিংবা বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য প্রার্থনা কর, কিংবা যত বছর ইচ্ছে, নিজে ততদিন জীবিত থাকো”। 

 

এতত্তুল্যং যদি মন্যসে বরং বৃণীষ্ব

বিত্তং চিরজীবিকাং চ।

মহাভূমৌ নচিকেতস্ত্বমেধি কামানাং

ত্বা কামভাজং করোমি।। ১/১/২৪

এতৎ তুল্যং যদি মন্যসে বরং বৃণীষ্ব

বিত্তং চিরজীবিকাং চ।

মহাভূমৌ নচিকেতঃ ত্বম্‌ এধি কামানাম্‌

ত্বা কামভাজং করোমি।। ১/১/২৪

“যদি এই বরের তুল্য অন্য বর মনে করো, প্রার্থনা করো। যদি সম্পদ (সোনা, ধনরত্ন) ও চিরজীবন চাও, তাও প্রার্থনা করতে পারো। হে নচিকেতা, তুমি বিশাল এক ভূখণ্ডের রাজা হও, তোমাকে আমি সমস্ত কাম্যবস্তু ভোগের অধিকারী করে দিচ্ছি”।


যে যে কামা দুর্লভা মর্ত্যলোকে

সর্বান্‌ কামাংশ্ছন্দিতঃ প্রার্থয়স্ব।

ইমা রামাঃ সরথাঃ সতূর্যা

ন হীদৃশা লম্ভনীয়া মনুষ্যৈঃ।

আভির্মৎপ্রত্তাভিঃ পরিচারয়স্ব

নচিকেতো মরণং মাঽনুপ্রাক্ষী।। ১/১/২৫

যে যে কামা দুর্লভা মর্ত্যলোকে

সর্বান্‌ কামান্‌ ছন্দিতঃ প্রার্থয়স্ব।

ইমাঃ রামাঃ সরথাঃ সতূর্যা

ন হি ঈদৃশা লম্ভনীয়া মনুষ্যৈঃ।

আভিঃ মৎ-প্রত্তাভিঃ পরিচারয়স্ব

নচিকেতঃ মরণম্‌ মা অনুপ্রাক্ষীঃ।। ১/১/২৫

“মর্তলোকে যা যা দুর্লভ কাম্যবস্তু আছে, সেই সমস্ত ইচ্ছেমতো কামনা করো। (তোমার সামনেই) এই যে সব সুন্দরী অপ্সরাগণ রথে চড়ে, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উপস্থিত রয়েছে, এরা অবশ্যই মানুষের জন্যে নয়, কিন্তু আমার বরে তুমি এদের সেবা উপভোগ করো। কিন্তু হে নচিকেতা, তুমি মরণবিষয়ে আর কোন প্রশ্ন করো না”। 

 

শ্বোভাবা মর্ত্যস্য যদন্তকৈতৎ

সর্বেন্দ্রিয়াণাং জরয়ন্তি তেজঃ।

অপি সর্বং জীবিতমল্পমেব

তবৈব বাহাস্তব নৃত্যগীতে।। ১/১/২৬

শ্বঃ-ভাবাঃ মর্ত্যস্য যৎ অন্তক এতৎ

সর্ব-ইন্দ্রিয়াণাং জরয়ন্তি তেজঃ।

অপি সর্বং জীবিতম্‌ অল্পম্‌ এব

তব এব বাহাঃ তব নৃত্যগীতে।। ১/১/২৬

(নচিকেতা বললেন) “হে অন্তক, আপনার বলা কামনার বস্তু কাল পর্যন্ত থাকবে না, (কামনা) সকল ইন্দ্রিয়ের শক্তি জারিত করতে থাকবে। তাছাড়া সকলেরই জীবন অল্প। অতএব রথ ইত্যাদি আপনারই থাকুক, নৃত্যগীত আপনারই থাকুক”।

 

ন বিত্তেন তর্পণীয় মনুষ্যো

লপ্স্যামহে বিত্তমদ্রাক্ষ্ম চেৎ ত্বা।

জীবিষ্যামো যাবদীশিষ্যসি

ত্বং বরস্তু মে বরণীয়ঃ স এব।। ১/১/২৭

ন বিত্তেন তর্পণীয় মনুষ্যো

লপ্স্যামহে বিত্তম্‌ অদ্রাক্ষ্ম চেৎ ত্বা।

জীবিষ্যামঃ যাবৎ ঈশিষ্যসি

ত্ব্ম্‌ বরঃ তু মে বরণীয়ঃ স এব।। ১/১/২৭

“বিত্ত নিয়ে মানুষ কখনো তৃপ্ত হয় না। আপনার দর্শন লাভেই আমার বিত্ত লাভ হয়ে গেছে। আর যতদিন আপনি যমপদে রয়েছেন, ততদিন আমার জীবনও থাকবে (তার জন্যে বর প্রার্থনার প্রয়োজন কী?) কিন্তু আমার প্রার্থনার বর ওইটাই”।  

 

অজীর্যতামমৃতানামুপেত্য

জীর্যন্‌ মর্ত্যঃ ক্বধঃস্থ প্রজানন্‌।

অভিধ্যায়ন্‌ বর্ণরতিপ্রমোদান্‌

অতিদীর্ঘে জীবিতে কো রমেত।। ১/১/২৮

অজীর্যতাম্‌ অমৃতানাম্‌ উপেত্য

জীর্যন্‌ মর্ত্যঃ কু-অধঃস্থ প্রজানন্‌।

অভিধ্যায়ন্‌ বর্ণ-রতি-প্রমোদান্‌

অতিদীর্ঘে জীবিতে কঃ রমেত।। ১/১/২৮

“নিম্নলোকে বাস করা জরা-মৃত্যুশীল মানুষ, জরাহীন অমর দেবতাদের সামনে উপস্থিত হয়ে, তাঁদের (কৃপায় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান লাভ করা যায়) জেনেও, গান-কামনা-সুখের ভোগ অনিত্য বুঝেও, অতি দীর্ঘ জীবনের আনন্দ কে পায়?”

 

যস্মিন্নিদং বিচিকিৎসন্তি মৃত্যো

যৎ সাম্পরায়ে মহতি ব্রূহি নস্তৎ।

যোঽয়ং বরো গূঢ়মনুপ্রবিষ্টো

নান্যং তস্মান্নচিকেতা বৃণীতে।। ১/১/২৯

যস্মিন্‌ ইদম্‌ বিচিকিৎসন্তি মৃত্যঃ

যৎ সাম্পরায়ে মহতি ব্রূহি নঃ তৎ।

যঃ অয়ং বরঃ গূঢ়ম্‌ অনুপ্রবিষ্টঃ

না অন্যং তস্মাৎ নচিকেতা বৃণীতে।। ১/১/২৯

 “হে মৃত্যু, যে আত্মা এবং পরলোকের বিষয়ে লোকের মনে সংশয় রয়েছে, সেই বিষয়েই আমাকে বলুন। আত্মবিষয়ে নিহিত এই যে দুর্বোধ্য জ্ঞান, সেই বর ছাড়া অন্য কোন বর নচিকেতা প্রার্থনা করে না”।

প্রথম অধ্যায় প্রথম বল্লী সমাপ্ত

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় ও শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র সেন, হরফ প্রকাশণী

চলবে... ১/২ বল্লী আসবে সামনের বুধবার।  

নতুন পোস্টগুলি

শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

  ৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের ...