মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫

বিদায়বেলার মালাখানি

 

 

সামান্য দিবানিদ্রা ও বিশ্রামের পর অনাদি এখন কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন। বুকের ভেতর সেই চাপ ভাবটা রয়েছে, তবে অনেকটাই কম। করুণাডাক্তার ঠিকই বলেছিলেন, সাধারণ গ্যাস আর অম্বল, চিন্তার কারণ নেই। বিকেলে পাড়ায় বেরিয়েছিলেন। পোড়ো-মন্দিরতলায় তাঁদের বয়স্ক মানুষদের একটা জমায়েত হয়, সেখানে নানান কথাবার্তায় সময়টা কাটে। খুব যে আনন্দ পান সেই আড্ডায়, তা হয়তো নয়, কিন্তু কীই বা করার আছে এই গাঁয়েঘরে। সে আড্ডায় গ্রামের কথাবার্তা, এই দিগড়ের কথাবার্তা হয়, কলকাতার কংগ্রেস রাজনীতির কথাও ওঠে। আজকাল আর একটা বিষয় নিয়েও খুব চর্চা হচ্ছে, বিশেষ করে ছেলে ছোকরাদের মধ্যে। সেটা হল কমিউনিস্ট রাজনীতি। জার্মানীর এক সায়েবের তত্ত্ব বুঝে, রাশিয়ার দুই সায়েব খুব নাকি সাড়া ফেলে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। ভারতের স্বাধীনতা সবে বারো বছরের বালক। স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা কংগ্রেস দলের প্রতি বয়স্কদের এখনও অবিমিশ্র বিশ্বাস আর ভরসা। নেহরুর এখনও অবিসংবাদিত জনপ্রিয়তা। তিনি আবার রাশিয়া পন্থী। কিন্তু আজকের যুবসমাজ বয়স্কদের এই ভরসায় আর আস্থা রাখতে পারছে না। তারা চাইছে নতুন কিছু, তারা চাইছে আমূল সামাজিক পরিবর্তন। 

আগে তেমন শোনা যেত না, আজকাল কয়েকটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া, শ্রেণীশত্রু। অনাদি শুনেছেন, তাঁরাই আজকাল এই সমস্ত বিশেষণের অধিকারী। উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের বেশ কিছুটা জমি জায়গা আছে। তাঁরা নিজে হাতে চাষ করেন না, চাষ করান ভাগচাষী বা চাষ-মজুরদের দিয়ে। ভাগচাষীরা গ্রামেরই বাসিন্দা, তাদের নিজস্ব জমি নেই, অথবা থাকলেও সে সামান্য। অনাদির মতো জমির মালিকরা চাষের জমি দেয়, বীজ দেয়, চাষের বলদ দেয়, দেয় লাঙল। ভাগচাষীরা চাষ করে, ফসল ফলায়, ফসল তোলে। বদলে তারা পায়, উৎপন্ন শস্যের একটা অংশ। এর মধ্যে শঠতা আছে, তঞ্চকতা আছে, ভুল আছে, ভ্রান্তি আছে, অহংকার আছে, জেদ আছে, আছে বঞ্চনা। কিছু কিছু অপ্রিয় ঘটনার অভাব নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও যুগ যুগ ধরে এমনই চলে আসছে। দুঃখে-সুখে, দায়-দৈবে, শান্তি-অশান্তিতে পরষ্পরের নির্ভরতায় কেটে গেছে কত শত বছর।

ঠিক যেমন বহু বহু ঝড়-ঝাপটা সয়ে - দাঁড়িয়ে আছে এই পোড়ো মন্দির। সারা গায়ে পোড়ামাটির কাজ করা – দেওয়ালে ফাটল ধরা এই মন্দির – যার ভিতের অনেকটাই চলে গেছে কালের করাল গ্রাসে। কেউ বলে তিনশ, কেউ বলে চারশ বছরের পুরোনো এই মন্দির…। অনাদি পড়ন্ত বিকেলের আবছা আলোয় কিছুক্ষণ মুখ তুলে তাকিয়ে রইলেন মন্দিরের দিকে।    

ভাগচাষ ছাড়া চাষ-মজুর বা মুনিষ খাটিয়েও জমির মালিকরা চাষ আবাদ করেন। তাঁরা ছেলে-মজুরদের বলেন মুনিষ, আর মেয়ে-মজুরদের কামিন। মানুষ আর কামিনী থেকেই ওই দুই শব্দের উৎপত্তি কবে হয়েছিল কে জানে! বর্ষার আগে সাঁওতাল পরগণা, দুমকা থেকে মুনিষ আর কামিনরা গ্রামে গ্রামে চলে আসে। জমির মালিকদের খামারে তারা অস্থায়ি বাসা নেয়। প্রত্যেক বছর চাষের জমি তৈরি থেকে শুরু করে, ফসল তুলে মালিকের গোলায় শস্য ভরা পর্যন্ত সমস্ত কাজ তারাই করে। বন্যা কিংবা খরায় ফসলের ক্ষতি হলে তাদের কোন দায় থাকে না। থাকা খাওয়া ছাড়া, চুক্তি অনুযায়ি তাদের মজুরি মিটিয়ে দিতে হয়। মানুষের স্বাভাবিক স্বভাবে এক্ষেত্রেও বঞ্চনা আর তঞ্চকতার অভাব নেই। জমি মালিকদের অন্ধ স্বার্থ আর অহংকারের জন্যে খেটে খাওয়া এই অকিঞ্চন মানুষগুলোর মনেও তাই ক্ষোভ আর ক্রোধ জন্ম নিচ্ছে। দিনকাল আর আগের মত থাকছে না।

গ্রামে গ্রামে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ক্ষোভ আর ক্রোধকে কাজে লাগিয়ে, কলকাতার শিক্ষিত অল্পবয়সি যুবকরা সংগঠিত করছে অদ্ভূত এক বিপ্লব। তারা কমিউনিজমে দীক্ষিত, তারা বিশ্বাস করে সাম্যবাদে। ধনী আর দরিদ্র, এই দুই শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা সমাজকে ভেঙে চুরে, তারা গড়ে তুলতে চায় শ্রেণীহীন সমাজ। দুনিয়ার সমস্ত শ্রমজীবী মানুষদের তারাই একমাত্র মুখপাত্র। অত্যাচারিত ও বঞ্চিত সর্বহারাদের তারাই একমাত্র সহায়। কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ছে সারা ভারতে, তবে তাদের বেশি প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ আর কেরালায়। বছর তিনেক আগে কেরালার জনগণ তাদের রাজ্যে নির্বাচিত করেছে, কমিউনিস্ট সরকার। তারা চলে এসেছে সংসদীয় ক্ষমতার অলিন্দে। পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা এখন দ্রুত নিম্নগামীবিপ্লবের নামে প্রতিরোধ, প্রতিঘাত বেড়ে উঠছে প্রতিদিন, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও তার প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছে প্রত্যহ।

নির্বিবাদী, সজ্জন এই মানুষটি বিশ্বাস করেন মানুষের নিজস্ব মূল্যবোধে। যে মূল্যবোধ তিনি অর্জন করেছেন, সুপ্রাচীন এক ঐতিহ্যের পরম্পরা থেকে। এক শ্রেণীর মানুষ তাঁকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলছে, এই ভাবনা তাঁকে পীড়া দেয়। অথচ এই বিশাল সমাজের মধ্যে তিনি কতটুকু? কীই বা তাঁর কর্তব্য, কতোটুকুই বা তাঁর ক্ষমতা? বিপুল ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণের মধ্যে তিনি অতি সাধারণ একজন ক্রীড়নক। তাঁর হাতে কিছুই নেই। অমোঘ ভবিতব্যের মতো তাঁকেও মেনে নিতেই হবে, সামাজিক পরিবর্তন, পরিবর্তিত পর্যবেক্ষণ এবং তার ফলাফল। তিনি নিজে ভালো কী মন্দ এ প্রশ্ন সেখানে অবান্তর।

অনাদি সন্ধের একটু পরে বাড়ি ফিরলেন। কলতলায় হাত পা ধুয়ে উঠে এলেন ঠাকুরঘরের বারান্দায়। তাঁর হাতে গামছা এগিয়ে দিল কন্যা সুভা। তার অন্য হাতে পট্টবস্ত্র। তিনি এখন সন্ধ্যা আহ্নিকে বসবেন। ঠাকুরঘরের ছোট্ট পরিসরে পেতলের ছোট্ট সিংহাসনে শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠিত। টাটকা ফুল আর তুলসি পাতায় ঢাকা। ছোট্ট একটি প্রদীপের স্নিগ্ধ আলো। ধুপদানিতে জ্বলতে থাকা ধুপের সুগন্ধে ঘরটি পবিত্র। পাটের কাপড় পরে তিনি কম্বলের আসনে বসলেন, কোষা থেকে কুষিতে কফোঁটা গঙ্গাজল নিয়ে, বাঁহাতে ঢাললেন। তিনবার ওঁ বিষ্ণু মন্ত্রে তিনি আচমন করে শুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তারপর হাতের মূলচক্র মুদ্রায়, সমগ্রীবকায় হয়ে কতক্ষণ বসে রইলেন আসনে, তাঁর চোখ বন্ধ, শ্বাস অত্যন্ত ধীর, অধরে জপমন্ত্র।

 

সন্ধ্যাহ্নিকের পর ঠাকুরঘরের বাইরে এসে, পট্টবস্ত্র বদলে, অনাদি কাচা ধুতি পরলেন। আহ্নিকের পর তিনি অনেকটাই স্বস্তি অনুভব করছিলেন। সকালে শারীরিক অস্বস্তিতে যে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন, এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ বোধ করছেন। যদিও বুকে একটা যেন চাপ অনুভব হচ্ছে।

বৌমা এসে জিগ্যেস করলেন, “বাবা, জলখাবার কিছু দি? দুপুরে তো প্রায় কিছুই খেলেন না”

অনাদি হাসলেন, বললেন, “দুপুরে কিছুই খাইনি বলতে চাও, মা? কদিন গুরুভোজনের পর, আজ একটু লঘুপাক হয়েছে, ঠিকই। এখন একটু খিদে খিদেও পাচ্ছে। তুমি বরং চারটি মুড়ি দাও, সঙ্গে শসা আর নারকেল কুচি। বাস, আর কিছু না”

বৌমা বঁটি পেতে শসার খোসা ছাড়াতে বসলেন। সুভা দাওয়ায় আসন পেতে রেখেছিল, অনাদি সেই আসনে গিয়ে বসলেন। একলা বসে থাকতে দেখে ষোড়শীবালা হাতে হ্যারিকেন নিয়ে সামনে এলেন। একধারে হ্যারিকেনটা রেখে দাওয়াতেই বসে বললেন, “অন্ধকারে বসে, একা একা কী ভাবছো?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনাদি বললেন, “হাআঃ, ভাবনার শেষও নেই, শুরুও নেই। বিষ্ণু ফিরেছে”?

“ফিরেছে। হাত মুখ ধুয়ে ওপরের ঘরে গেছে, কলের গান বাজাবে বোধ হয়”

“বাঃ, ওকে বলো তো, রবিবাবুর সেই গানটা বাজাতে”

ষোড়শীবালা মেয়ে সুভাকে ডাকলেন, “অ্যাই সুভা, একবার ওপরে যা তো, মা। তোর বাবা কী গান শুনতে চাইছে, দাদাকে গিয়ে বল।”

সুভা ও বাড়ি থেকে দৌড়ে এল, “কী হয়েছে, মা?

অনাদি বললেন, “তোর বড়দা কলের গান চালাতে গেল মনে হয়। ওকে গিয়ে বল, রবিবাবুর একটা গান বাজাতে”

সুভা আবার দৌড়ে ওপরের সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল, অনাদি বললেন, “কোন গান বলবি?

সুভা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “কোন গান?

“কোন গান? পুরোটা না শুনেই ছুটতে লাগলি, খেপি! বলবি তার বিদায় বেলার মালাখানি’, মনে থাকবে”? সুভা আর দাঁড়াল না, দৌড়ে উঠে গেল দোতলায়।

অনেকদিন চালানো হয়নি বলে বিষ্ণু গ্রামোফোনের বাক্স খুলে একটু ঝাড়পোঁছ করছিলেন। এখন সুভার মুখে বাবার গান শোনার ইচ্ছে হয়েছে শুনে, একটু হাসলেন, বললেন, “আচ্ছা, যা আমি বসাচ্ছি”রেকর্ডের বাক্স থেকে কাননদেবীর রেকর্ডটা খুঁজতে খুঁজতে তাঁর মনে পড়ল, বর্ধমানের কলেজে পড়ার সময় তাঁর বায়োস্কোপ আর গানের ঝোঁক হয়েছিল খুব। পয়সা জমিয়ে তখনই কিনেছিলেন এই গ্রামোফোনটা। বাড়িতে যখন নিয়ে এসেছিলেন, বাবা খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এসব বিলাসিতা আমাদের জন্যে নয়”মাকে বলেছিলেন, “তোমার বড়ো ছেলে একেবারেই বখে গেছে, আজকাল সে উড়তে শিখেছে! পানের দোকানের মতো, তোমার ঘরেও এখন লারেলাপ্পা গান বাজবে! ছি ছি ছি”

কিছুদিন পরে অবিশ্যি গানটান শুনতে শুনতে, বাবাও এখন অনেক গানের ভক্ত হয়ে উঠেছেন। মাঝে মাঝেই আদেশ করেন, বিষ্ণু তোর ওই কলে, সেই গানটা একবার বাজা তো। কাননদেবীর এই গানটা ১৯৩৭ সালে বেরিয়েছিল, আজ এত বছর পরেও গানটা শুনলে, কেমন যেন গায়ে কাঁটা দেয়। যেমন গানের কথা, তেমনি গায়কী। খুঁজে পেয়ে, প্যাকেট থেকে বের করে, রেকর্ডটা নরম কাপড়ে মুছলেন। গ্রামোফোনের ডিস্কে রেকর্ডটা চাপিয়ে দিলেন সন্তর্পণে। তারপর দয়ের মতো হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে গ্রামোফোনে দম দিলেন বেশ খানিকক্ষণ। এবার গ্রামোফোনের ওপরে একটা নব ঘোরাতেই ঘুরতে শুরু করল রেকর্ড, ঘুরতে শুরু করল রেকর্ড কোম্পানির গান শোনা কুকুরের ছবি। এবার ক্রেডলের স্ট্যাণ্ড থেকে, স্টাইলাস হেড তুলে, নতুন পিন লাগালেন, তারপর হেডটা নামিয়ে দিলেন চলন্ত রেকর্ডের শেষ প্রান্তে। প্রথমে কিছুক্ষণ খড়খড় আওয়াজের পর, অর্গ্যানের আওয়াজ আর কাননদেবীর কণ্ঠ শোনা গেল। গ্রামের নির্জন শান্ত সন্ধ্যায়, সেই অদ্ভূত কণ্ঠস্বরের আবেশ ছড়িয়ে পড়ল। সেই গানের বাণী, কী যে বার্তা পৌঁছে দিল শ্রোতার মনে।

গান শুরু হতেই অনাদি নিশ্চল বসে রইলেন আসনে। ষোড়শীবালা, চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। একটি বাটিতে আমতেলমাখা অল্প মুড়ি, আর অন্য প্লেটে কুচোনো শসা আর নারকেল নিয়ে চিত্রার্পিতের মতো অপেক্ষা করতে লাগলেন বৌমা। শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও গানের রেশ যেন চারপাশে রয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ।

অনাদি একটু পরে চোখ মেলে তাকালেন, বললেন, “বাঃ। কী গানই বেঁধে গেছেন, রবিবাবু। আর তেমনি গলা মেয়েটির, কী যেন নাম? আহা, মনটা ভরিয়ে দিয়ে গেল”গুনগুন করে, আবৃত্তির সুরে বললেন,    

দিনের শেষে যেতে যেতে পথের পরে

ছায়াখানি মিলিয়ে দিল বনান্তরে।

সেই ছায়া এই আমার মনে, সেই ছায়া ওই কাঁপে বনে,

কাঁপে সুনীল দিগঞ্চলে রে।

তার বিদায়বেলার মালাখানি আমার গলে রে

বৌমা মুড়ির বাটি আর শসার প্লেট নামিয়ে রাখলেন অনাদির সামনে। অনাদি যেন আবার বাস্তবে ফিরলেন, স্ত্রীকে বললেন, “তোমার বড়পুত্র, বর্ধমান থেকে বিএ ডিগ্রিখানা যেমন এনেছে তার সঙ্গে এই কলের গান এনে একটা মস্তো কাজের কাজ করেছে”

 

বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শরীরে যে একটা হাল্কা, ঝরঝরে অনুভূতি হচ্ছিল, এখন সেটা আর নেই। বুকের চাপটা বাড়ছে, জাঁকিয়ে বসেছে। শ্বাস নিতে অস্বস্তি হচ্ছে কিছুটা। ষোড়শীবালা রাত্রের খাবারের জন্যে যখন ডাকলেন, মনের মধ্যে খাবার কোন ইচ্ছে টের পেলেন না।

অনাদি বললেন, “রাত্রে কিছু খাবো না, ভাবছি”।

“সে কী? আবার কী শরীর খারাপ লাগছে নাকি? সন্ধ্যেবেলা যে বললে ভালো আছো?

“ভালই তো ছিলাম। এখন আবার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। বুকের কাছে একটু চাপ মতো লাগছে”

“বিষ্ণুকে বলি, করুণা ডাক্তারকে খবর দিক”

“না, গো না। সে রকম কিছু নয়। একটু শুয়ে ঘুমোলেই ভালো হয়ে যাবে। কাল সকালে যা হবার হবে, এখন এই রাত্রে আর লোককে ব্যতিব্যস্ত করে লাভ নেই”

“তাহলে, এককাজ করি, দুটো রুটি আর একটু দুধ এনে দি, খাও”

“না, না, এখন আর কিছু খাবো না। এক গেলাস জল দাও বরং খেয়ে শুতে যাই”

“তাই আবার হয় নাকি? সারারাত না খেয়ে কাটাবে? কথায় আছে, রাতের উপোসে হাতিও দুব্বল হয়ে যায়। তুমি আর না করো না, দুধ-রুটি এনে দি, খেয়ে শুয়ে পড়ো”

অনাদি বাধ্য হয়েই খেতে বসলেন, বিষ্ণু আর তিনি পাশাপাশি বসলেন। বিষ্ণু ভাত-ডাল, আলু পোস্ত আর মাছের ঝাল খেলেন, অনাদি খেলেন রুটি আর দুধ। সংক্ষিপ্ত খাওয়া সেরে অনাদি চলে গেলেন নিজের ঘরে। বিছানায় টানটান শুয়ে শ্বাস নিতে লাগলেন, জোরে জোরে। বুকের অস্বস্তিটা বাড়ছে।

কিছুক্ষণ পর সোনা আর মণি এলেন বাবার কাছে। সোনা জিগ্যেস করলেন, “বাবা, কি ঘুমোলে?

“নারে মা, আয়। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো। পান্না, হীরুর খাওয়া হয়েছে”?

“হ্যাঁ বাবা, ওদের খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে এলাম। মা বলল, তোমার নাকি শরীর ভালো লাগছে না”!

“হুঁ ওই রকমই। বয়েস তো হচ্ছে”!

মাথার কাছে বসে, সোনা বাবার কপালে হাত দিয়ে বললেন, “তুমি এত ঘামছো কেন, বাবা? অঘ্রাণের শেষ, আমাদের সবার গায়েই চাদর থাকা সত্ত্বেও শিরশিরে ঠাণ্ডা লাগছে। আর শুধু একখানা জামা গায়ে দিয়ে তুমি ঘামছো? খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা? দাদাকে বলি, করুণামামাকে খবর দিক, একবার দেখে যাক”

“না রে পাগলি। অস্বস্তি একটু হচ্ছে। সে তেমন কিছু না। অল্পতেই লোককে ব্যস্ত করিস না”সোনা আর কথা বললেন না। তাঁর মনে হল, কথা না বাড়িয়ে, চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে থাকলে বাবা স্বস্তি পাবেন। সোনা বাবার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন আর মণি হাত বোলাতে লাগল বাবার পায়ে। বাঁ হাত বাড়িয়ে হ্যারিকেনের পলতেটা একটু নামিয়ে দিলেন, ঘরের আলোটা স্তিমিত হয়ে এলে অনেকটা।

ঘামটা কমছিল না। শ্বাস নিতেও কষ্টটা বাড়ছিল। তার সঙ্গে পেটেও একটা অস্বস্তি। অনাদি কিছুক্ষন চোখ বুজে শুয়ে থাকার পর ভাবলেন, একবার বাহ্যে গেলে, কিছুটা স্বস্তি মিলবে হয়তো। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, বললেন, “হ্যারিকেনটা নিয়ে আমার সঙ্গে একটু চ তো মা, একবার পাইখানায় যাই”

সোনা দ্রুত উঠে এসে হ্যারিকেনের পলতে উঠিয়ে আলোটা বাড়িয়ে দিলেন। আর মণি দৌড়ে গেল গামছা আনতে। সোনা বললেন, “পেট খারাপ হয়নি তো, বাবা?

“নাঃ। সকালে মাঠে গেলাম। ভালোই তো হল। জানি না কেন, এখন মনে হচ্ছে আবার হবে”

অনাদি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরোলেন, সামনে হ্যারিকেন হাতে সোনা। মণিও সঙ্গে রইল, তার হাতে গামছা। নতুন ঘরের পৈঠেতে ধুতি, জামা ছেড়ে, অনাদি গামছা পরে, পাইখানার দিকে এগোলেন। সোনা মণিকে বললেন, “তুই হ্যারিকেন দেখিয়ে বাবার সঙ্গে যা। বাবা ঘরে ঢুকে গেলে হ্যারিকেনটা ধাপিতে রেখে আসিস। ততক্ষণ আমি একটা বালতিতে জল নিয়ে আসি”সোনা টিউবওয়েল টিপে এক বালতি জল এনে পাইখানার দরজার সামনে রাখলেন। মণির হাত ধরে বললেন, “চ আমরা নতুন ঘরের দাওয়ায় বসি, বাবার হয়ে গেলে আসবো”ওরা দুবোনে দাওয়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, লক্ষ রাখতে লাগল পাইখানার দরজার দিকে। দুজনেই খুব উদ্বিগ্ন। মণি বলল, “আমার কিন্তু খুব ভয় করছে, দিদি। দাদাকে বললে হতো না?

“দাদাকে বলবো তো, বাবাকে ঘরে নিয়ে যাই, দাদাকে খবর দেব” দুজনে আর কোন কথা বলল না। নানান চিন্তা করতে করতে সোনার মনে হল, বসত বাড়ির ভেতরেই আজ যদি এই পাইখানা না থাকতো, কী হত?  অসুস্থ শরীরে বাবাকে আজ খিড়কির বাঁশবাগানে ছুটতে হতো!

সোনা নিজেই তখন ফ্রক পরা ছোট্ট খুকি। তাঁর পরের বোন সাবির বয়েস ছয়, মণি বছর তিনেকের, আর ভাই চিনু তখন মায়ের পেটে। বাড়িতে নতুন কুয়ো বসানোর তোড়জোড় চলছিল। দাদা তখন সবে বর্ধমান গেছেন, কলেজে পড়তে। দাদা বাড়ি এসে সব শুনে, বাবাকে বলেছিলেন,

“কুয়ো বসাতে হও বসাও, সেখানে একটা পাইখানা হোক। আর জলের জন্যে বসাও টিউকল। চিরকালের মতো সমস্যা মিটে যাবে। বাড়ির মেয়েগুলোকে, মাকে আর ভোর বেলা মাঠে ছুটতে হবে না”দাদার কথায় বাবা গুরুত্ব দেননি, বলেছিলেন, “আজকালকার ছোকরাদের শুধু বারফট্টাই। খরচ-খরচার ব্যাপারটা দেখতে হবে না? আমার উপযুক্ত ছেলে, বাবার জমিদারি দেখে ফেলেছে! বাহ্যে করতে মানুষ মাঠে যাবে না তো কি, ঘরে হাগবে? যত্তোসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা”

আর মা বলেছিলেন, “সে কি, বাছা? বাড়িতে নিত্যসেবার শালগ্রাম ঠাকুর রয়েছেন, সে বাড়ির ভেতরে হবে পাইখানা? ছি ছি এ কথা তুই ভাবতে পারলি, বিষ্ণু?” দাদা কথা বাড়াননি। বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। তারপর পাঁচিলের ধারের ওই কোনায় কুয়ো খোঁড়া হল, জল উঠল। কুয়োর পাড় বাঁধিয়ে, শানের চাতাল বানিয়ে জল তোলা শুরু হল। দাদা বর্ধমান থেকে ছুটিতে এসে, একদিন খুব ভোরে সেই কুয়োর পাড়ে বসেই বাহ্যে করে, নোংরা করে দিলেন কুয়োটা। সকালে বলেও দিলেন সে কথা মাকে এবং বাবাকে। কদিন খুব চেঁচামেচি, হৈচৈ চলল। দাদার সঙ্গে বাবা কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন বেশ কদিন। শেষমেষ মা বুঝিয়েসুঝিয়ে বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন। চারপাশে দেয়াল তুলে, দরজা বসিয়ে, টিনের চালের ছাউনি দিয়ে ঘর হল। কুয়োর মুখে ঢালাই করে, পাদানি লাগিয়ে, বসার জায়গা তৈরি হল। চালু হয়ে গেল পাইখানার ঘর। প্রথম প্রথম তাদেরও দাদার ওপর খুব রাগ হয়েছিল, বাবা, মায়ের সঙ্গে অমন শয়তানি করার জন্যে। কিন্তু যত বড়ো হয়েছে, তারা সকলেই বুঝেছে এর প্রয়োজনীয়তা। তারা বুঝেছে, উদ্দেশ্য সঠিক হলে, বাবা-মায়েরও কিছু কথার অবাধ্য হওয়াটা জরুরি। আজ আরেকবার সেটা টের পেল সোনা।

দরজা খুলে অনাদি বালতির জল ভেতরে নিলেন। একটু পরে আবার বেরিয়েও এলেন। হ্যারিকেনের আলোয় তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দুই বোনেই খুব ভয় পেয়ে গেল। বাবার চোখের চাউনি কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত, ভয়ার্ত। দুই বোনে এগিয়ে যেতে, অনাদি জিজ্ঞাসা করলেন, “শব্দটা কিসের বল তো, মা? বুঝতে পারলি?”

“শব্দ? কিসের শব্দ, বাবা?”

“সে কি, তোরা শুনতে পাসনি? অত জোরে আওয়াজ হল, আর তোরা শুনতে পাসনি? টিনের চালে ভারি পাথর আছড়ে পড়ার মতো, বিকট আওয়াজ?”

“না তো। আমরা দুজনেই তো সারাক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম”

“সে কি রে? ওই আওয়াজের পরেই, সব কিছু যেন অন্ধকার হয়ে গেল। আমার মাথাটা কেমন টলে উঠল। আমি কোথায়, এখন দিন না রাত, কিছুই যেন বুঝতে পারছিলাম না। একটু পরেই আস্তে আস্তে আবার সব ঠিক হয়ে এল। কী হলো বল তো, মা?” দুই বোনের কেউই কোন উত্তর দিতে পারল না। তবে তারা বুঝতে পারল, বাবার শরীর একদমই ভালো নয়। এখনই করুণামামাকে খবর দিতে হবে।

দুই মেয়ের সঙ্গে টিউকলের দিকে যেতে যেতে অনাদি শিউরে উঠলেন একবার। তাঁর বাঁদিকের ঘাড়, কাঁধ, বাহুতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছেন। এসব কিসের লক্ষণ? সোনা টিউকল টিপে জল করে দিলেন, অনাদি হাত, পা মুখ ধুলেন। তারপর মণির হাত থেকে নিয়ে ধুতি আর জামা পরে বললেন,

“আমি এখন ঘরে যাবো তনু, আমাকে একটু ধর। বিকাশ, বিষ্ণুকে গিয়ে শিগ্‌গির খবর দে, মা। তোদের মাকেও ডাক। বেশি সময় আর নেই রে, পাগলি”বাবার এই অসহায় কথায় সোনা কেঁদেই ফেললেন, মণিও।

“কীসব আবোল তাবোল, বলছো বাবা” সোনা আর মণি কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠলেন,

‘দাদা, দাদা, ও মা। মা? বাবা কেমন করছে, শিগগির এসো’

বিষ্ণু ঘরে বসে লণ্ঠনের আলোয় বই পড়ছিলেন, দৌড়ে এলেন। ষোড়শীবালা আর বৌমা সকলকে খাইয়ে, হাতের কাজ কর্ম সেরে খেতে বসেছিলেন। খাওয়া ছেড়ে, কোনমতে হাতে জল দিয়ে দৌড়ে এলেন। অনাদি বিছানায় শুতে শুতে সকলের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ। বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই, বিষ্ণু দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। সদরের খিল খুলে অন্ধকার পথে দৌড়ে চললেন করুণামামার বাড়ি। তাড়াহুড়োতে টর্চটা আনার কথা মনে হয়নি।

বাবার বুকে হাত বোলাতে বোলাতে, সোনা আর মণি ব্যাকুল হয়ে জিগ্যেস করতে লাগলেন, “বাবা, ও বাবা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে, বাবা? ও বাবা, কথা বলছো না, কেন? একটু জল এনে দিই খাও না, বাবা”।

অনাদি হাতের ইঙ্গিতে জল চাইলেন। হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু হাত কাঁপছিল থরথর করেসোনা আর ষোড়শিবালা দুজনে মিলে উঠে বসিয়ে দিলেন অনাদিকে। বৌমা কলসি থেকে এক গেলাস জল এনে বাবার হাতে তুলে দিলেন। গেলাস খালি করে এক চুমুকে জল খেয়ে, অনাদি তৃপ্তির শ্বাস ছাড়লেন ‘আঃ’আবার শুয়ে পড়তে পড়তে জিজ্ঞাসা করলেন, “এত রাত হল, বিষ্ণু এখনো ফেরেনি?”

ষোড়শীবালা বললেন, “বাড়িতেই তো ছিল, ও তো করুণাকে ডাকতে বের হল এইমাত্র”সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে, অনাদি বালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরে শুলেন। দু তিনবার দীর্ঘ শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে, চোখ বন্ধ করলেন। সোনা আর মণির হাতের তালুর নিচে স্থির হয়ে গেল তাঁর হৃদয়ের স্পন্দন। হাহাকার করে উঠলেন দুজনে।

ষোড়শীবালা দিশাহীন দৃষ্টিতে দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন, “তোরা অমন কেঁদে মরছিস কেন, পোড়ারমুখি? বিষ্ণু আসছে তো ডাক্তারকে নিয়ে, এত অধৈর্য হলে হয়? বিষ্ণুটাও কী যে করছে, কখন গেছে, এখনো ফেরার নাম নেই। বৌমা, চিনুকে একবার পাঠাও না। আলোটা নিয়ে সদরে দাঁড়িয়ে দেখুক দাদা আসছে কিনা?”

বৌমা ষোড়শীবালাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “চিনুতো নেই, মা। চিনু কালনা গেছে বড়দির বাড়ি। আপনার ছেলে এখনই এসে যাবে মা”

“সেই থেকে তো এসে যাবে এসে যাবে করছো, কোথায় আসছে বাছা? মানুষটা যে কষ্ট পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো না”

বিষ্ণু আর ডাক্তার করুণাসিন্ধু ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। অনাদির মুখের দিকে তাকিয়েই, তাঁর মুখটা পাথরের মতো হয়ে গেল। তাঁর মুখের দিকে সকলের অসহায় দৃষ্টি। বিছানায় বসে, তিনি অনাদির একটা হাত তুলে নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর চোখের পাতা টেনে টর্চের আলোয় পরীক্ষা করলেন চোখের মণি। উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় নত করে, বললেন, “আমার আর কিছু করার নেই, দিদি”

ষোড়শীবালা প্রচণ্ড আক্ষেপে চেঁচিয়ে উঠলেন, “তুমি কিছু করার নেই বললেই আমি শুনবো? জলজ্যান্ত মানুষটা, এই তো একটু আগেই গান শুনল, খাবার খেল, আর তুমি বলছো কিছু করার নেই? বিষ্ণু তুই গাড়ির ব্যবস্থা কর। আমি এখনই তোর বাবাকে বর্ধমান নিয়ে যাবো। সেখানে না হলে, কলকাতা”

বিষ্ণু মায়ের পাশে বসে, জড়িয়ে ধরলেন, মাকে। দুজনেই কাঁদতে লাগলেন হাহাকার করে। কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে ভয়ে ভয়ে নিচেয় নেমে এল, সুভা, কলু আর হীরু। সুভার কোলে পান্না। ওদেরকে কাছে টেনে নিলেন বৌমা। পান্নাকে তিনি নিজের কোলে নিলেন। এতজনের কান্নায় বিহ্বল পান্না, বিপন্ন মুখে তাকিয়ে দেখতে লাগল সকলের মুখ। তাকে ভালোবাসার, তার নির্ভরতার সব মুখগুলিই এখন অসহায়, ব্যাকুল। তার কাছে এই স্মৃতি স্থায়ি নয়, কিন্তু দুর্বোধ্য এক বোধ তার মনে বাসা বেঁধে রইল।

 ..০০..

পরের পর্ব "পাখির চোখ" এই সূত্রে - পাখির চোখ  

আগের পর্ব " অভাব জয়ের স্বভাব" - এই সূত্রে - অভাব জয়ের স্বভাব

রবিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৫

অদৃশ্য বন্ধু

  

নন্দস্যারের কাছে আমরা ফিজিক্স আর ম্যাথ্‌স্‌ পড়ি। নন্দস্যার ভীষণ ভালো পড়ান। আর আমরাই লাস্টব্যাচ বলে, পড়াতে পড়াতে উনি প্রায়ই সময়ের কথা ভুলে যানআটটা থেকে সাড়ে নটা আমাদের সময়, কিন্তু দশটার সময় ওঁনার মেয়ে যখন এসে বলে “বাপি, তুমি আর কতক্ষণ পড়াবে? মা কিন্তু রাগ করছে”। তখন উনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘড়ির দিকে তাকান, আর বলেন, “এঃহে, এত দেরি করিয়ে দিলাম তোদের...যা, যা বাড়ি যা, অনেক রাত হল। বাকিটা না হয় পরশু হবে”।

আজও তাই হল। রাত তখন প্রায় সোয়া দশটা। আমি সন্তোষ, ডাকনাম সন্তু, শরৎ আর দীপু নন্দস্যারের বাড়ি থেকেই ফিরছিলাম। আমাদের একই পাড়ায় বাড়ি, কয়েকটা বাড়ির এদিক আর ওদিক। কাজেই আমরা একসঙ্গেই ফিরি গল্প করতে করতে। বড়ো রাস্তা থেকে আমাদের পাড়ার গলির মুখটায় যখন এসে পড়েছি, সনাতনদার সঙ্গে দেখা হল। সনাতনদার মুদির দোকান। আমাদের গলির একেবারে মুখেই কোণের বাড়িটায় উনি থাকেন, আর ওঁনার দোকান ওই বাড়ির একতলায়। এতরাত্রে দোকানে কোন খদ্দের নেই, দোকানের সামনে সনাতনদা দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, “কী, কোচিং পড়ে বাড়ি ফেরা হচ্ছে?”

আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ”।

শরৎ বলল, “আপনি এখনও দোকান বন্ধ করেননি?”

সনাতনদা উত্তর দিলেন, “এই করব, এইবার”।

আমরা কথা বলতে বলতেই গলিতে ঢুকে বাড়ির দিকেই হাঁটছিলাম। পেছন থেকে সনাতনদা ডাকলেন, “অ্যাই সন্তু, শরৎ, একটু দাঁড়াও তো ভাই। একটা কথা আছে”। আমরা ফিরে দাঁড়ালাম।

সনাতনদা আমাদের কাছে এগিয়ে এসে একটু চাপা স্বরে বললেন, “কদিন ধরেই একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ্য করছি। কাউকে বলতে ঠিক ভরসা হচ্ছে না”।

আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, “কী ব্যাপার বলুন তো”?

সনাতনদা বললেন, “তেমন কিছু নয় হয়তো, কিন্তু মন থেকে খটকাটা যাচ্ছে না। সনৎবাবুকে চেন তো, ভেতরের দিকে থাকেন?”

আমরা তিনজনেই একসঙ্গেই বললাম, “চিনি বৈকি! কেন, কী করেছেন উনি?”

সনৎকাকু আর তাঁর বুড়ি মা আমাদের পাড়াতেই থাকেন, এই গলির একেবারে শেষের দিকে। বিয়ে-থা করেননি। নাম করা এক কলেজের লাইব্রেরিয়ান। পাড়ায় তেমন মেশেন না, কোন সাতেপাঁচেও থাকেন না। ওঁনার একমাত্র নেশা বই পড়া। ছুটির দিনে ওঁনার বাড়ির দিকে গেলেই দেখা যায়, বসার ঘরের জানালার পাশে বসে বই পড়ছেন। সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে গেলে, ওঁনার ওই ঘরে ঢুকে দেখেছি, ঘরটা বইয়ের জঙ্গল। আলমারি, সোফা, টেবিল, ঘরের মেঝে, সর্বত্র বই ডাঁই করা আছে।  আর আমরা কিছু চাওয়ার আগেই, উনি যা চাঁদা দেন সে আমাদের কল্পনার থেকেও বেশি! গতবার দিয়েছিলেন পাঁচশো একটাকা! তার আগের বারে তিনশ একান্ন! সেই সনৎকাকু আবার কী করলেন?

সনাতনদা থুতনি চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “উনি রোজই সন্ধে সাড়ে সাতটা, আটটা নাগাদ গাড়িতে ফেরেন। ওঁনার গাড়িটা, দেখেছ তো? যেটা উনি নিজেই চালান, সেই গাড়িতেই অফিসে যান এবং ফেরেন”।  

সনৎকাকু রিসেন্টলি গাড়ি কিনেছেন এবং সেটা যে উনি নিজেই চালান, সে কথা আমরা সবাই জানি। একটু ভয় পেয়েই আমি জিগ্যেস করলাম, “সে কী? কাউকে ধাক্কা-টাক্কা মেরেছেন, নাকি?”

“নারে বাবা, সে সব কিছু নয়। তবে কদিন ধরেই দেখছি, তা প্রায় দিন পনের তো হবেই! ফেরার সময়, এই মোড়ে এসে গাড়িটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে দাঁড় করান, তারপর সামনের বাঁদিকের দরজাটা খুলে দেন। একটু অপেক্ষা করে, বাঁ হাত নেড়ে বলেন, “ওকে, কাল আবার দেখা হবে”। তারপর দরজাটা টেনে বন্ধ করে, গলির ভেতরে ঢুকে যান”।

এর মধ্যে আশ্চর্য হবার কী আছে, আমরা কেউই বুঝতে পারলাম না। তিনজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, তারপর দীপু বলল, “কোন বন্ধু-টন্ধু হবেন, একই জায়গায় হয়তো চাকরি করেন। এই পাড়াতেই থাকেন। একসঙ্গে ফেরেন। এতে অবাক হওয়ার কী আছে?”

সনাতনদা বললেন, “সে কী আর আমিও বুঝি না? তেমন তো হতেই পারে। সে হলে কী আর মাঝরাতে তোমাদের ডেকে এত কথা বলি? আমি কিন্তু কোনোদিনই ওঁনার পাশের সিটে কাউকে বসে থাকতে দেখিনিবা কাউকে গাড়ি থেকে নামতেও দেখিনি। অথচ উনি রোজই এই কাণ্ডটি করেন”

সনাতনদার কথাটা এতই অদ্ভূত, আমাদের বিশ্বাসই হল না। আমি বললাম, “যাঃ, তাই আবার হয় নাকি সনাতনদা? নিশ্চয়ই থাকেন কেউ, আপনি লক্ষ্য করেননি”।

সনাতনদা একটু যেন রেগে গেলেন, “বললেই হল, আমি লক্ষ্য করিনি? গত পনেরদিন ধরে আমি দেখছি। গতকাল তো আমি গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম”।

শরৎ বলল, “কাউকে দেখেননি?”

সনাতনদা বললেন, “তবে আর বলছি কী? ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল ঠেকছে না। সনৎবাবু পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছেন না তো! তাহলে এই যে উনি গাড়ি চালিয়ে রোজ যাচ্ছেন, আসছেন, বলতে নেই...কবে কোথাও একটা কিছু ঘটিয়ে ফেললে...?”

সনাতনদার এই কথায়, আমরা কেউই কোন উত্তর দিতে পারলাম না, চুপ করে রইলাম। সনাতনদা আমাদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “রাত হয়েছে, এখন বাড়ি যাও। কথাটা তোমাদের মাথায় দিয়ে রাখলাম, ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করে দেখতবে এখনই পাঁচকান করার দরকার নেই”

আমরা আর কথা বাড়ালাম না, চুপচাপ বাড়ির দিকে আবার হাঁটা শুরু করলাম। শরতের বাড়িটাই সবার আগে পড়ে, কলিং বেল টিপে দরজা খোলার অপেক্ষা করতে করতে বলল, “মাথাটা কার খারাপ হয়েছে, সেটাই আমাদের দেখতে হবে, বুঝলি সন্তু? সনাতনদার না সনৎকাকুর”!

আমি আর দীপু হেসে ফেললাম শরতের কথায়। আমি হাত নেড়ে শরকে বললাম, “ওকে, কাল আবার দেখা হবে”।

আমার বলার ধরনে দীপু এবং শরৎ হো হো করে হেসে উঠল, শরৎ বলল, “হ্যারে, তোরা আমায় দেখতে পাচ্ছিস তো?”

 

সনাতনদার কথাটা আমরা ভুলেই গেছিলাম, কিন্তু সনাতনদাই ভুলতে দিলেন না। পরশুদিন আমরা আবার যখন নন্দস্যারের ওখান থেকে পড়ে ফিরছিলাম, আমাদের ডেকে জিগ্যেস করলেন, “কী হে, কিছু চিন্তাভাবনা করলে?” আমরা কিছুই করিনি, আর করার আছেটাই বা কী? আমরা সনাতনদার কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে, উত্তর দিলাম, “ভাববেন না, সনাতনদা। সব ঠিক হয়ে যাবে”। বলেই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ির দিকে এগোলাম।

কিন্তু তার কয়েক দিন পরেই, নিজের চোখেই যা দেখলাম তাতে সনাতনদার কথাটার গুরুত্ব না দিয়ে আর থাকতে পারলাম না। শুক্রবার সকালবেলা আমাদের বাড়িতে হঠাৎ মামা-মামিমা এসে উপস্থিত। তখন সাড়েনটা বাজে। বাবা অফিসে বেরোনর জন্যে রেডি। মা আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, “তোর বাবার তো এখন সময় হবে না, চট করে সনাতনের দোকান থেকে এক কিলো ময়দা আর এক প্যাকেট সাদা তেল এনে দে তো! তোর মামারা এসেছে, কখানা লুচি ভেজে দিই”।

আমি সনাতনদার দোকানে গিয়ে দেখি বেশ ভিড়। এসময় অনেক লোক ও মহিলা জিনিষপত্র কিনতে এসেছেন। সকলেরই তাড়া আছে, সবাই বলছেন, “সনাতন, সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছি, এবার আমায় ছাড়”। সনাতনদাও জিনিষ ওজন করতে করতে আর দামের হিসেব করতে করতে বার বার বলছেন, “এই দিই, এরপর আপনারটাই ধরব”।

আমি দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম, ভিড়টা একটু কমলে ভেতরে ঢুকব। সেই সময়েই দেখলাম আমাদের গলির ভেতর থেকে সনৎকাকুর গাড়িটা বেরিয়ে আসছে। আগে তেমন লক্ষ্য করিনি, কিন্তু আজ মন দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম। গাড়িটা আস্তে আস্তে মোড়ের কাছে এল, দাঁড়িয়ে গেল। সনৎকাকু হাত বাড়িয়ে এপাশের দরজাটা খুলে বললেন, “গুড মর্নিং। কতক্ষণ? আজ আমার একটু দেরি হয়ে গেল”তার একটু পরে আবার হাত বাড়িয়ে উনি দরজাটা টেনে বন্ধ করলেন। তারপর বাঁদিকে মোড় নিয়ে চলে গেলেন। যে পাশের দরজাটা উনি খুললেন এবং বন্ধ করলেন, সেপাশেই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু, নাঃ কাউকে দেখতে পেলাম না। কেউ ওঠেনি, উঠে সনৎকাকুর পাশের সিটে বসেওনি। সনৎকাকুর কথার কোন উত্তরও দেয়নি।

আমি বেশ ঘাবড়েই গেলাম। সনাতনদা তার মানে ঠিকই দেখেছেন, উনি এ সময় দোকানে ব্যস্ত থাকেন বলে, সকালের ব্যাপারটা হয়তো লক্ষ্য করেননি! সনৎকাকু যাবার সময় সকালে যাকে গাড়িতে তোলেন, তার মানে রাত্রে তাকেই নামিয়ে দেন! আর সেটাই সনাতনদার চোখে পড়েছে! আমি ময়দা আর তেল নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম, দোকানের ভিড়ের মধ্যে সনাতনদার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলার কোন সুযোগ ছিল না।

 

 স্কুলে টিফিনের সময় শরৎ আর দীপুকে পুরো ব্যাপারটা বললাম। শুনে ওরাও কেমন ভেবলে গেল। শরৎ বলল, “তার মানে, সনাতনদা ঠিকই দেখেছেন? এখন তাহলে দেখা যাচ্ছে সনাতনদা পাগল নয়, সনৎকাকুই! কিন্তু সনৎকাকুর মতো লোক পাগল, এটা ঠিক হজম হচ্ছে না, রে!” আমাদের মধ্যে দীপু কথা ভীষণ কম বলে, কিন্তু যখন বলে খুব ভেবেচিন্তে বলে।

দীপু শরতের কথায় বলল, “অসম্ভব। সনৎকাকু পাগল হতেই পারেন না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে! সেটা আমাদেরই বের করতে হবে!”

আমি বললাম, “রহস্য? তুই আবার এর মধ্যে রহস্য কোথায় পেলি? কাউকে দেখা যাচ্ছে না, অথচ উনি তাকে দুবেলা গাড়িতে তুলছেন, নামাচ্ছেন, কথা বলছেন...”! হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হল, বললাম, “তুই কী বলতে চাইছিস? অশরীরী? ভূত?”

দীপু মাথা নেড়ে বলল, “ভূত কিনা জানি না, তবে রহস্য কিছু একটা তো আছেই! সেটাই তো বুঝতে চাইছি”। আমরা চুপ করে রইলাম। আমি চিন্তা করতে লাগলাম, এই কলকাতা শহরে, আমাদের পাড়ায় জলজ্যান্ত একজন ভূত বাস করছে। যে কিনা সনৎকাকুর সঙ্গে গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়! এবং সনৎকাকুও মহানন্দে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়! এক আধ দিন নয়, রোজ?

কিছুক্ষণ চিন্তা করে দীপু বলল, “স্কুল ছুটির পর কাল একবার কলেজস্ট্রিট যাবো ভাবছিলাম। যাবি?”

আমি বললাম, “কী কিনতে, বই?”

দীপু বলল, “হুঁ বই। বাড়িতে বলে আসিস, কাল ফিরতে দেরি হবে। সনৎকাকুর কলেজটাও কলেজস্ট্রিটে না? ফেরার সময় আমরা যদি ওঁনার গাড়িতে ফিরতে চাই, উনি আমাদের নেবেন না?”

আমি আর শরৎ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, বুঝলাম দীপুর বই কিনতে যাওয়াটা একটা অজুহাত, আসলে ও সনৎকাকুর গাড়িতেই চড়তে চাইছে!

আমি একটু ভয়ে ভয়েই বললাম, “ওই গাড়িতে? কিন্তু...সেটা কি ঠিক হবে? বিশেষ করে ওই গাড়িতেই যখন...”!

দীপু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, বলল, “কি রে, ভয় পেলি নাকি?”

ব্যাপারটা এর আগেও দেখেছি, ভয় পাওয়ার সময়, কেউ যদি ফট করে বলে বসে, “কি রে, ভয় পেলি নাকি?” শুনলেই কেমন যেন সাহসটা বেড়ে যায় চট করে!

আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “ধুস্‌, ভয় পেতে যাব কেন? এমনিই বলছিলাম”।

টিফিন শেষের ঘন্টা পড়ে যেতে আমরা উঠে পড়লাম, ক্লাসে যেতে হবে।  


 

সন্ধে ছটা নাগাদ সনৎকাকুর কলেজের গেটের সামনে আমাদের ঘুরঘুর করতে দেখে বিহারি দারোয়ানজি জিজ্ঞাসা করলেন, “কা ভইল, বাবুয়া? কা কাম?”

শরৎ বলল, “ইয়ে মানে, আমরা সনৎস্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। এখন কী ঢোকা যাবে?”

দারোয়ানজি বললেন, “ইখন তো কালেজ ছুটি হইয়ে গেল, অন্দরে যিবার অ্যালাউন্স নাহি। সোনোতবাবু আভি গাড়ি লিয়ে নিকলোবে...”

সনৎস্যার যে বেরিয়ে যাননি, সে খবরটাই আমাদের দরকার ছিল। আমরা আর কিছু বললাম না, নিশ্চিন্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘন্টা অপেক্ষার পর সনৎস্যারেরটা গাড়িটা দেখলাম, আস্তে আস্তে গেটের কাছে আসছে। দারোয়ানজিও আমাদের বললেন, “ও আয়া সোনোতবাবুর গাড়ি...”। আমরা গেটের ফাঁক দিয়ে গলে, ভেতরে ঢুকে দাঁড়ালাম, দারোয়ানজি কিছু বললেন না। দারোয়ানজি গেট খুলতে লাগলেন। গেটের সামনে এসে সনৎকাকু একটু দাঁড়ালেন, শরৎ ওঁনার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “কাকু, একটা বই কিনতে এখানে এসেছিলাম। এখন ফিরতে পারছি না, বাসে-টাসে যা ভিড়...আপনার গাড়িতে যদি আমাদের...”।

সনৎকাকু একটু অবাক হলেন, “শরৎ না? তোমরা এতদূরে বই কিনতে এসেছ? কজন আছ তোমরা?”

“আমরা তিনজন, কাকু!”

সনৎকাকু একটু চিন্তা করে বললেন, “উঠে পড়ো”।

শরৎ আর দীপু গাড়ির পিছনের সিটে উঠে পড়ল, আমি গাড়ির সামনের দরজাটা খোলার জন্যে হাত দিতেই সনৎকাকু বেশ চমকে উঠে বললেন, “ওকি করছ, সন্তোষ? ওখানে বসবে কী করে? পেছনে যাও...”।

দীপু একটু সরে মাঝখানে চলে যেতে আমিও পিছনেই বসলাম। আমি উঠে দরজা বন্ধ করতেই সনৎকাকু গাড়ি চালু করলেন। গেট দিয়ে বেরোনর সময়, দারোয়ানজি হাত তুলে কাকুকে নমস্কার করলেন।

বড়ো রাস্তায় পড়ে বাঁদিকে মোড় নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে, সনৎকাকু একবার বাঁদিকে তাকিয়ে যা বললেন, তাতে আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। সনৎকাকু বললেন, “চিনতে পারিস্‌নি? আমাদের পাড়াতেই থাকে তো। সন্তোষ, শরৎ আর দীপাঞ্জন। ভাল ছেলে। তিনজনে সর্বদা একসঙ্গেই ঘোরে - থ্রি মাস্কেটিয়ার্স”, বলে একটু হাসলেন। অথচ আমরা নিশ্চিত সামনের বাঁদিকের সিটে কেউ নেই।

আমরা যতটা অবাক হয়েছি, আমি অন্ততঃ তার থেকে বেশি ভয় পেয়েছি। মনে হচ্ছিল, দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিই। কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়! তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল, অশরীরী যিনি, তিনিও এই কলেজেই কাজ করেন। একসঙ্গে আসেন, এক সঙ্গে ফেরেন। কিন্তু অশরীরী কলেজের কোন কাজটা করে? সনৎকাকুর কথাবার্তা কিন্তু শেষ হয়নি। তিনি গাড়ি চালাতে চালাতে অনর্গল বকবক করে যেতে লাগলেন। সে কথাগুলো কিন্তু নিজের মনে কথা বলা নয়, ঠিক যেন অন্য কারো সঙ্গে কথার পিঠে কথা বলছেন। মাঝে মাঝে হাসছেনও। সারা রাস্তা আমরা কেউই একটাও কথা বললাম না। আমি তো ভয়ে কাঠ হয়ে বসে বসে সনৎকাকুর কথা শুনতে লাগলাম, আর কতক্ষণে পাড়ায় পৌঁছোব সেই চিন্তা করতে লাগলাম।

অবশেষে আমরা পাড়ায় ঢুকলাম এবং প্রত্যেকদিনের মতোই সনাতনদার দোকানের সামনে গাড়িটা দাঁড়াতেই, আমরা তিনজনেই হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়লাম। সনৎকাকু রোজকার মতো আজও বাঁহাত নেড়ে বললেন, “ও কে, কাল আবার দেখা হবে”। তারপর হাত বাড়িয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন, “ও, তোমরাও নেমে পড়লে নাকি?”

শরৎ একটু তোৎলাতে তোৎলাতে বলল, “এই তো এইটুকু আ-আমরা হেঁ-হেঁটেই যাবো, থ্যা-থ্যাংকিউ কাকু”।

সনৎকাকু শরতের মুখের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “কি ভয় পেয়ে গেছ নাকি?” তারপর একটু হেসে আবার বললেন, “শোনো, এক কাজ করো, এই রোববার বিকেলের দিকে তোমরা তিনজনেই আমার বাড়ি চলে এসো। কিছুটা যখন জেনেই গেছ, পুরোটা না জানলে ভয় পাওয়ারই কথাকিন্তু তোমাদের মতো ছেলেরা ভয় পেলে চলবে...?”

সনৎকাকু আরো কিছু হয়তো বলতেন, কিন্তু সময় পেলেন না। এই সময় তাঁর গাড়ির পেছনে একটা সাইকেল রিকশ এসে এমন প্যাঁক প্যাঁক ভেঁপু বাজাতে লাগল, সনৎকাকুর দাঁড়ানোর উপায় রইল না। গাড়ি চালু করতে করতে সনৎকাকু বললেন, “রোববার বিকেলে, আমি ওয়েট করব”। শরৎ বলল, “আচ্ছা, যাব”।

সনাতনদা আমাদের তিনজনকে সনৎকাকুর গাড়ি থেকে নামতে দেখে দোকান ছেড়ে দৌড়ে এলেন। বললেন, “কী ব্যাপার বল তো? মনে হচ্ছে তোমরা কিছু একটা করে ফেলেছ? কিছু বুঝতে পারলে?”

শরৎ কিছু বলতে যাচ্ছিল, দীপু শরতের হাত ধরে থামাল, বলল, “এখনও কিছুই হয়নি সনাতনদা, রোববার বিকেল অব্দি অপেক্ষা করতে হবেতারপর যা হবার হবে!”

সনাতনদা আঁতকে উঠলেন, বললেন, “বলো কী? খী সর্বনাআআশ, তাহলে কী হবে গো!”

 

 

রোববার বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা তিন মূর্তি হাজির হলাম সনৎকাকুর বাড়ি। দীপু দরজায় বেল টিপতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সনৎকাকু দরজা খুলে বললেন, “এসো ভেতরে এসো, তোমাদের জন্যেই ওয়েট করছিলামযে যেমন পার চেয়ারে বসে পর” বসার ঘরে ঢুকে বইয়ের স্তূপের ফাঁকে ফাঁকে রাখা চেয়ারে আমরা বসলাম, সনৎকাকু বসলেন একটা সোফায়। সেই সোফারও অধিকাংশই বইয়ে বোঝাই। আমরা কেউ কোন কথা বললাম না।

সনৎকাকু আরাম করে বসে, আমাদের তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সেদিন গাড়িতে আসার সময় তোমাদের লক্ষ্য করছিলাম। সন্তোষ আর শরৎ একটু ভিতু টাইপের আছ, না? কিন্তু দীপাঞ্জন একদম স্টেডিতখনই আমার মনে হয়েছিল, তোমাদের আসল ব্যাপারটা বলা উচিৎ। কারণ আজ তোমরা জেনেছ। এবং জেনেশুনেই তোমরা সেদিন কলেজস্ট্রিট গিয়েছিলে, আমার গাড়িতে চাপবে বলে, কি তাই না?” সনৎকাকুর কথায় আমরা লজ্জা পেয়ে, নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

সনৎকাকু বললেন, “আরেঃ, লজ্জা পাচ্ছ কেন? তোমাদের কৌতূহল হবে না তো কী নব্বই বছরের বুড়োদের হবে? নাকি তোমরা ল্যাম্প পোস্ট বা শহীদ বেদীর মত, নির্বিকার উদাসীন হবে? তোমাদের এই সরল কৌতূহল দেখেই আজ আমি তোমাদের ডেকেছি, সব বলব বলে। সন্তোষ আর শরৎকে ভিতু বললাম ঠিকই, কিন্তু ততটা নয়। সনাতন যেমন, রোজই দেখে, আর ভয়ে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে। এটা যদি কলকাতা শহরের জোরালো আলোওয়ালা গলি না হয়ে, গাঁয়ের অন্ধকার মেঠো পথ হত, সনাতন নির্ঘাৎ ভূত ভূত করে ভিরমি খেত। যাগ্‌গে, যে জন্যে তোমাদের ডাকা, সেই কথাটাই এবার বলি”।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সনৎকাকু বলতে শুরু করলেন, “কাঞ্চন আর আমি। ঠিক তোমাদেরই মতো ভীষণ বন্ধু, স্কুলের এক্কেবারে নিচু ক্লাস থেকে। লেখাপড়াতে মন্দ ছিলাম না, আবার দুষ্টুমি-ফচকেমি যে একেবারেই করতাম না, তাও না। এক কথায় আমরা গুড বয় কিংবা ব্যাড বয় কোন দলেই নই, কিন্তু বলতে পারো স্ট্যাণ্ডার্ড-বয় ছিলাম।

আমরা ওপার থেকে চলে আসা বাঙাল তো, তাই কলকাতা ছাড়া আমাদের কোন বাড়ি নেই। কিন্তু কাঞ্চনরা ঘটি, ওদের হুগলিতে দেশের বাড়ি ছিল, ছিল কেন বলছি, এখনও আছেকাঞ্চনরা স্কুলের গরমের ছুটিতে প্রত্যেকবারই দেশের বাড়ি যেত। ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্যে আমি বাড়িতে বায়না করলেও, কোনদিন অনুমতি পাইনি। কিন্তু যেবার মাধ্যমিক দিলাম, সেবার অনুমতি মিলল। সে বছর থেকে আমার মা-বাবা আমার গায়ের ছেলেমানুষী গন্ধটা হয়তো আর পাননি! অতএব, কাঞ্চনের সঙ্গে প্রথমবার ওদের দেশের বাড়ি, গ্রামের বাড়ি ঘুরতে চললাম।

প্রথম কদিন বেশ মজাতেই কাটল। সবই কেমন নতুন ধরনের। ওদের বাড়ি, গ্রামের পুকুর, পুরোন কারুকার্যওয়ালা ভাঙা মন্দির, খেত, খামার, ধানের গোলা, গরুরগাড়ি – যা দেখছি অবাক হয়ে যাচ্ছি। ওদের বাড়ির সবার সঙ্গেই খুব ভাব হয়ে গেল, বড়োরাও খুব আদর যত্ন করতে লাগলেন। এর মধ্যেই পরিচয় হল, কাঞ্চনের ছোটকার সঙ্গে। অদ্ভূত লোক, কিছুটা খ্যাপাটে ধরনের। কিন্তু কাঞ্চনের মুখে শুনেছি দারুণ জিনিয়াস। বাড়ির বাইরের দিকের একটা ঘরে সারাদিন কী সব নিয়ে গবেষণা করতেন। চান, খাওয়া আর ঘুমোনোর সময় ওই ঘরের দরজায় তালা দিয়ে, তবে বাইরে আসতেন। আমি একদিন বায়না করলাম, ছোটকা তুমি কী নিয়ে গবেষণা করছো, দেখাও। প্রথমে না, না, করছিলেন, অনেকবার ঝুলোঝুলি করার পর রাজি হলেন। বললেন, ঠিক আছে, তুই আর কাঞ্চন কাল সকালে আটটা নাগাদ আসবি, কিন্তু ঠিক মিনিট পনেরর জন্যে।

পরদিন সকালে আমি আর কাঞ্চন ওঁনার ঘরে গেলাম। বন্ধ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করতে উনি দরজা খুলে ভেতরে আসতে বললেন, আমরা ঢোকা মাত্র আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর পইপই করে বললেন, কোন জিনিষে যেন হাত না দিই। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বিশাল একটা টেবিলের ওপর নানারকমের কাচের ফ্লাস্ক, বিকার, পিপেট, বুনসেন বার্নার, টেস্ট টিউব...তাতে নানান রঙের কেমিক্যাল। দেয়ালের ধারে কাঠের র‍্যাক। সেখানে বড়োবড়ো কাচের জারে নানা রকমের অ্যাসিড, আর কেমিক্যাল। সবার গায়ে লেবেল করে ইংরিজিতে লেখা আছে। শুধু দুটো জারের গায়ে বাংলায় লেখা - একটা জারে লেখা “নিসা”, তার পাশেরটায় “সাসা”অন্য একধারে মস্ত মস্ত খাঁচার ভেতরে প্রচুর গিনিপিগ আর ইঁদুর। গিনিপিগগুলো শান্তশিষ্ট, কিন্তু ইঁদুরগুলো ভীষণ চঞ্চল। 

আমাদের সব দেখাতে দেখাতে ছোটকা বলছিল, এখন দুটো ওষুধের ফর্মুলা আবিষ্কার করেছি। গিনিপিগ আর ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করব। সাকসেসফুল হলেই, ব্যস্‌, কেল্লা ফতে। কিসের ফর্মুলা আবিষ্কার করেছ, ছোটকা, জিগ্যেস করতে, ছোটকা হাসল, কিছু বলল না।  অনেকবার ঘ্যানঘ্যানে বায়না করার পর বলল, কাউকে বলিস না। একটাতে বয়েস বাড়বে না। আর অন্যটাতে শরীর সর্বদাই চাঙ্গা থাকবে, কোন অসুখ করবে না। আমি বললাম সেকেণ্ডটাই ভালো, কিন্তু প্রথমটা দিয়ে কী হবে? ছোটকা উত্তেজিত হয়ে বলল, বলিস কী, বয়েস না বাড়লে লোকজন কত অ্যাক্টিভ থাকবে সেটা ভাব। কেউ বৃদ্ধ হয়ে অথর্ব হয়ে পড়বে না। আমি তর্ক করলাম না, কিন্তু ছোটকার কথাটা মনঃপূত হল না। আরও কিছুটা থাকার পরেই ছোটকা বলল, আর নয়, যা দেখার সব দেখিয়ে দিয়েছি, এবার তোরা বের হ, আমার অনেক কাজ আছে! আমাদেরও ঘরের ভেতরে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। কী রকম বিচ্ছিরি গন্ধ ঘরের ভেতর। একদিকে এত কেমিক্যাল, তার সঙ্গে অতগুলো ইঁদুর আর গিনিপিগের গন্ধ মিশে উৎকট একটা গন্ধ, বন্ধ ঘরের ভেতরে।

দরজার কাছে এসে ছোটকাকে জিগ্যেস করলাম, ওই “নিসা” আর “সাসা” লেখা জার দুটোতে কী আছে, ছোটকা? ছোটকা বলল, ওদুটো আমার নয়, আমার এক স্যারের বানানো। প্রথমটায় অদৃশ্য হওয়া যায়, দ্বিতীয়টায় আবার ফিরে আসা যায়। আমি আর কাঞ্চন দুজনেই বলে উঠলাম, আরিব্বাস। ও ছোটকা আমাদের একটিবার টেস্ট করাও। ছোটকা দারুণ রেগে গিয়ে বলল, বেরো আমার ঘর থেকে, ফাজলামি পেয়েছিস? ওটা কী চা না কফি, যে টেস্ট করবি? বলেই আমাদের দুজনকে ঘর থেকে ঠেলে বের করে দিয়ে, দরজায় খিল তুলে দিল।

ছোটকা আমাদের ধমকে বের করে দিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের মাথায় ওটাই বসে গেল। যে করে হোক একবার ট্রাই করতেই হবে। অদৃশ্য হওয়ার মজাটা কেমন দেখতেই হবে।

দুজনে মিলে অনেক আলোচনা করে আমরা ঠিক করলাম, রাত্রে ছোটকা ও ঘরে তালা দিয়ে এ বাড়িতে যখন শুতে আসে, তখনই কাজটা সারতে হবে। ছোটকার থেকে চাবি চুরির দায়িত্ব কাঞ্চনের”

দীপু জিজ্ঞাসা করল, “সনৎকাকু, গাড়িতে আপনার সঙ্গে যিনি যাওয়া আসা করেন, তিনিই কী সেই কাঞ্চনকাকু?”

সনৎকাকু বিষণ্ণ হেসে বললেন, “ঠিকই ধরেছ। ওই দিন রাত্রে চাবি চুরি করে, আমরা দুটো কাঁচের বোতল ভরে “নিসা” আর “সাসা” নিয়ে এসেছিলাম। পরের দিন সকালে জলখাবারের পর, দুজনে দু ঢোঁক করে “নিসা” খাওয়ার পর সত্যিসত্যিই অদৃশ্য হয়ে টই-টই করে ঘুরে বেড়ালাম গোটা গ্রাম। ওফ্‌, কী আনন্দ যে হয়েছিল, সে আর বলার নয়।

কাঞ্চনদের গাঁয়ে এক খিটখিটে বুড়ি ছিল, তিনকূলে তার কেউ নেই। সারাক্ষণ খেটে মরত আর গাল পাড়ত পাড়া-প্রতিবেশীর ছেলে-বউদের। সবাই অতিষ্ঠ। সেই বুড়ি পাড়ার টিউবওয়েল টিপে জল ভরছিল বালতিতে, আমরা বার বার সে বালতি উলটে দিচ্ছিলাম। বেশ কয়েকবার এমন হওয়ার পর বুড়ি হাত-পা ছুঁড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল, “আ মা গ...এ কোন ভূতের পাল্লায় পড়িছি গ...বারবার আমার আমার বালতি উলটে দিতেছে...”বুড়ি খুব জব্দ হয়েছিল সেদিন। তারপর অবিশ্যি আমি আর কাঞ্চন বালতি ভরা জল রেখে এসেছিলাম বুড়ির ঘরের দাওয়াতে।

হারু গয়লা দুধ দোওয়ার সময় বাছুরটাকে একটু দূরে খোঁটায় বেঁধে রেখেছিল, যাতে সে এসে মায়ের দুধ সব খেয়ে না ফ্যালে। আমরা বাছুরের বাঁধনটা খুলে দিলাম। বাছুরটা দৌড়ে গিয়ে জোর সে ঢুঁ মারল হারু গয়লার পিঠে। হারু গয়লা খুব অবাক হল, বলল, “হতভাগা, কী করে ছাড়া পেলি র‍্যা?” উঠে গিয়ে বাছুরটাকে টেনে সরিয়ে আবার খোঁটায় বেঁধে রাখল। আমরাও আবার খুলে দিলাম! হারু ভীষণ অবাক হয়ে ভ্যাবলা তাকিয়ে বসে রইল, বাছুরটাকে বলল, “তরে আজ ভূতে পেইছে নাকি র‍্যা?” বাছুরটা মহানন্দে মায়ের দুধ খেতে লাগল, আর তার মাও খুব খুশিতে বাছুরের গা চাঁটতে লাগল।   

কিন্তু গোল বাধল ফিরে এসে “সাসা” খাবার সময়। আমি দু ঢোঁক খেয়ে বোতলটা কাঞ্চনকে দিতে যাব, সে সময়েই ঘরে ঢুকল, ছোটকা। চেঁচিয়ে উঠে জিগ্যেস করল, কী খাচ্ছিস রে, সনৎ, কাঞ্চন কই? ছোটকার গলা পেয়ে কাঞ্চন এমন চমকে উঠল, বোতলটা দিল ফেলে। মেঝেয় পড়ে ঠাস্‌ করে বোতলটা ভেঙে “সাসা” গড়াতে লাগল মেঝেয়। কী ভয়ংকর কাণ্ড হল চিন্তা করে, আমি ছোটকাকে বললাম, “ছোটকা তোমার ঘর থেকে শিগ্‌গির “সাসা”-র জারটা নিয়ে এস। তা নাহলে কাঞ্চনকে সারা জীবন অদৃশ্য থাকতে হবে”।

ছোটকা আমার চারপাশে কাঞ্চনকে খুঁজতে খুঁজতে বললেন, “সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। তার মানে তোরাই গতরাত্রে আমার ঘরে ঢুকেছিলি, ও দুটো চুরি করতে! ইঁদুরের গন্ধ পেয়ে একটা বেড়ালও ঢুকেছিল, তোদের পিছনে, সেটা আর লক্ষ্য করিসনি। তোরা বেরিয়ে আসার পরও, বেড়ালটা ঘরেই ছিল। বেরোতে না পেরে সারা রাত গোটা ঘরে হুলস্থূল কাণ্ড করেছে। “নিসা” এবং “সাসা” দুটো জারই মেঝেয় পড়ে ভেঙে গেছে। কাঞ্চনকে দেখতে পাওয়ার আর আশা নেই”। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ছোটকা। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনও চেঁচিয়ে উঠল, “ছোটকা, কী বলছ তুমি? তাহলে আমার কী হবে?”

ছোটকা কাঞ্চনের কথা শুনতে পেল না, কাঁদতে কাঁদতে আক্ষেপ করতে লাগল, “কেন যে তোদের ঘরে ঢুকিয়ে সব দেখাতে গেলাম”!

দু-একদিন পরেই আমরা সবাই ফিরে এলামকাঞ্চনও এল, কিন্তু ওকে দেখা গেল না। বছর সাত-আটেক আগে কাঞ্চনের বাবা-মাও পরপর চলে গেলেন। এখন আমি ছাড়া কাঞ্চনের আর কেউ নেই।

ওদের বাড়িতে নীচের ঘরে ও একলাই থাকে। এ বাড়ি থেকে সিধুদা গিয়ে ওকে খাবার-দাবার দিয়ে আসে। সিধুদা আমাদের বাড়িতে আছে বহু বছর। কাঞ্চনকে খুব ভালও বাসে।  ছুটির দিনে কাঞ্চন নিজেই চলে আসে এ বাড়িতে। আমার সঙ্গেই ও কলেজে যায়, ওখানেই ঘোরাঘুরি করে, তা নইলে সারাদিন সময় কাটাবে কী করে...! আমাদের ছোট্ট একটা ভুলের জন্যে কাঞ্চনের জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল। এবং তার জন্যে সম্পূর্ণ দায়ি আমিই!”

সনৎকাকু মাথা নীচু করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ওঁনার দু চোখে জল।

একটু পরে দীপু বলল, “কাকু, ওই “নিসা” মানে কী নিরাকার সালসা?”

সনৎকাকু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কী করে জানলে? ঠিকই বলেছ। কাঞ্চনের ছোটকার মুখে পরে শুনেছিলাম“সাসা” মানে সাকার সালসা”

দীপু বলল, “আমাদের চিলেকোঠার ঘরে, আমার দাদামশাইয়ের একটা বিরাট ট্রাংক রাখা আছে। শুনেছি তিনি খুব নাম করা বৈদ্য ছিলেন। নাম চণ্ডীপ্রসাদ সেনশর্মা। বহুদিন হল তিনি মারা গেছেন, তখন আমি খুবই ছোট! ওই ট্রাংকে আমি দাদুর হাতে লেখা অনেকগুলি খাতা দেখেছি।  যার মধ্যে ওই সালসা, মানে ওষুধদুটোর নামও পড়েছিলাম”।

হঠাৎ সনৎকাকু বাঁদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কী যেন শুনলেন, তারপর বললেন, “তোমাদের বলা হয়নি, আমার পাশেই কাঞ্চন বসে আছে। এতক্ষণ সে আমাদের সব কথাই শুনছিল। দীপুর দাদামশাইয়ের নাম শুনে ও বলছে, উনিই ছিলেন কাঞ্চনের ছোটকার গুরু। ওই খাতা যদি, ওর ছোটকার হাতে দেওয়া হয়, ওর ছোটকা হয়তো আবার সাসা বানিয়ে ফেলতে পারবেন। তাহলে কাঞ্চনকে আবার সবাই দেখতে পাবে! অবিশ্যি তোমার, বা তোমার বাবা-মায়ের ওই খাতাগুলো দিতে যদি কোন আপত্তি না থাকে!”

দীপু বলল, “আমার মনে হয়না মা-বাবার কোন আপত্তি হবে। এমনিতেই ওই বই নিয়ে আমরা আর কী করবো? তাছাড়া সত্যিই যদি ওই ওষুধ খাইয়ে কাঞ্চনকাকুকে দেখতে পাওয়া যায়, তার থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে?”

শরৎ বলল, “তুই দেখে নিস, দীপুওই ওষুধেই কাজ হবে। এ সবই কাঞ্চনকাকুর ভাগ্য। তা নইলে সনাতনদা আমাদেরই প্রথম এসব কথা বলবেন কেন? আর আমরাই বা কৌতূহলী হয়ে সনৎকাকুর পিছু নেব কেন?”

সনৎকাকু বললেন, “কাঞ্চন তোমাদের বলতে বলছে, আজ থেকে তোমরাও ওর বন্ধু”।

 

 

পরের শনিবারেই ভোর ভোর আমরা সনৎকাকুর গাড়িতে রওনা হলাম কাঞ্চনকাকুর দেশের বাড়ির উদ্দেশে। অবিশ্যি সেটা খুব সহজ হয়নি। বাড়ির অনুমতি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। শেষ অব্দি কাঞ্চনকাকুর কথা শুনে এবং সনৎকাকু আমাদের বাড়ি এসে অনুরোধ করাতে আমাদের বাবা-মায়েরা নিমরাজি হলেন। দীপুকে অবিশ্যি খুব বেগ পেতে হয়নি। ওর দাদামশাইয়ের ডায়রি পড়ে দীপুর বাবা নাকি বলেছিলেন “স্ট্রেঞ্জ”, তারপর অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন, “এমন যে হতে পারে, সেটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু এসব জিনিষ বাজারে চালু হয়ে গেলে বিপদ। শয়তান লোকেরা এ জিনিষের অপব্যবহার করে নানান দুষ্কর্ম করবে। সনৎবাবু, আমার অনুরোধ কাঞ্চনবাবু ফিরে আসুন, কিন্তু তারপরে এ জিনিষ নষ্ট করে দেওয়াই ভালো। ওই সালসা আর ওই ডায়রি– দুটোই। এমনিতেই মানুষের বিপদ-আপদের শেষ নেই। তার ওপর আরও বিপদ না বাড়ানোই ভাল”।

সকাল সাড়ে নটা নাগাদ আমরা কাঞ্চনকাকুর দেশের বাড়ি পৌঁছলাম। সনৎকাকু গাড়ি থেকে নেমে চার দিকে তাকিয়ে আক্ষেপের সুরে বললেন, “এঃ কী অবস্থা হয়েছে রে, কাঞ্চন। সেই জমজমাট বাড়ির এই অবস্থা! সবই কেমন জরাজীর্ণ আর দৈন্য দশা”। সনৎকাকুর ডাক শুনে বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক বেড়িয়ে এলেনসনৎকাকু প্রণাম করতে আমরাও সবাই প্রণাম করলাম। বৃদ্ধ খুব অবাক হয়ে বললেন, “আপনাদের কাউকেই চিনতে পারলাম না তো”!

সনৎকাকু বললেন, “প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা, কাকু, চিনতে পারবেন কী করে? আমি সনৎ আপনার ভাইপো কাঞ্চনের বন্ধু, মনে পড়ছে, কাকু?” বৃদ্ধ বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সনৎকাকুর দিকে, তারপর খুব আক্ষেপের সুরে বললেন, “মনে পড়বে না, আবার? ওই ঘটনার পরেই তো এ বাড়ির এমন দুর্দশা শুরু হল। বড়দা আর বড়বৌদি কোনদিনই আমাকে ক্ষমা করতে পারেননি আজও আমি তাঁদের অভিশাপ বয়ে চলেছি”

কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম, একটা ঘরে আমরা সবাই বসলাম, বৃদ্ধ আমাদের উল্টোদিকে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তা এতদিন পরে হঠাৎ কী মনে করে?” সনৎকাকু বললেন, “আমার সঙ্গে কাঞ্চনও এসেছে, কাকু। আপনিই পারেন ওকে আবার সাকার করে তুলতে”। বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বললেন, “ও সব আমি বহুদিন ছেড়ে দিয়েছি, সনৎ। আর আমি ওই সালসা বানাব কী করে? আমি তো তার ফর্মুলা জানি না”।

“আপনার শ্রীযুক্ত চণ্ডীপ্রসাদ সেনশর্মার কথা মনে আছে তো?” সনৎকাকু বললেন। 

বৃদ্ধ দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “ওফ্‌, তিনি তো নমস্য পূজনীয় ব্যক্তি, আমার গুরুদেব ছিলেন”। 

“আমাদের এই দীপুর দাদামশাই ছিলেন, শ্রীযুক্ত চণ্ডীপ্রসাদতাঁর বেশ কিছু ডায়রি ওদের কাছে রয়ে গেছে। তার মধ্যে ওই সালসা বানানোর কথা লেখা আছে” বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, আমাদের সকলের দিকে, তারপর বললেন, “কই দেখি”? দীপু তার ব্যাগ থেকে দুটো ডায়রি বের করে বৃদ্ধের হাতে দিল। বৃদ্ধ হাতে নিয়ে দু চারপাতা উল্টে বললেন, “আরেঃ কী আশ্চর্য, এতো তাঁরই হাতে লেখা ডায়রি! এতদিন পর তাঁর লেখা ডায়রি আমাদের হাতে এসে পড়বে, এতো অবিশ্বাস্য”। বৃদ্ধ ডায়রির মধ্যে ডুবে গেলেন। মন দিয়ে অনেকগুলি পৃষ্ঠা পড়ার পর, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “ওফ্‌, এতদিনে  আমার শাপমুক্তি হবে। বড়দা আর বড়বৌদি ওপর থেকে আমাকে আশীর্বাদ করবেন। কাঞ্চনকে আমরা আবার দেখতে পাবো”! বলতে বলতে বৃদ্ধ ডায়রি দুটো হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে, আমাদের কথা তাঁর মনেও রইল না।

আমরা হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ, অবিশ্যি বৃদ্ধের মনের অবস্থাটাও আমরা সকলেই অনুভব করতে পারলাম। এমন সময় ঘরে এলেন, এক বৃদ্ধা, ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, “কাঞ্চন এসেছিস? ছোড়দা বলছিল!”

“হ্যাঁ পিসিমা, কাঞ্চন এসেছে, আমি কাঞ্চনের বন্ধু সনৎ”। বৃদ্ধা সন্দেহের চোখে জিজ্ঞাসা করলেন,

“তুমি কী করে চিনলে, আমি কাঞ্চনের পিসিমা?”

“কাঞ্চন পাশেই রয়েছে যে, ওই বলল। তা নইলে আমি আর চিনব কী করে বলুন। পঁয়ত্রিশ বছর পর দেখা”।

“কাঞ্চন রয়েছিস?” বলেই বৃদ্ধা কেঁদে ফেললেন, ধরা গলায় বললেন, “দেখতে না পাই রয়েছিস জেনেই বড়ো স্বস্তি পেলাম, বাবা। যা, তোরা সব মুখে হাতে জল দিয়ে আয়, আমি জলখাবারের ব্যবস্থা করি”।

 

সেই সকালের পর থেকে আমরা আর বৃদ্ধের দেখা পেলাম না। আমরা জলখাবার সেরে গ্রামটা একটু ঘুরে দেখে এলাম। দুপুরের খাওয়ার সময়েও বৃদ্ধ এলেন না, সনৎকাকু জিজ্ঞাসা করাতে বৃদ্ধা বললেন, “ছোড়দার খাবার আমি ওর ঘরেই দিয়ে এসেছি তবে মনে হয় না খাবে বলে, কাঞ্চনের ওষুধ বানাতে পারলে, ছোড়দা বলল, তবেই জলস্পর্শ করবেঠাকুর নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন”। সত্যি বলতে আমাদেরও খুব টেনশান হচ্ছিল। আজ দুবার - জলখাবার আর দুপুরের খাওয়ার সময়, অদৃশ্য কাঞ্চনকাকুর সামনে রাখা খাবারের থালা খালি হয়ে যেতে দেখে, সত্যিই অদৃশ্য থাকার কষ্ট কিছুটা যেন টের পেলাম। একই সঙ্গে বেশ ভয়-ভয় মাখা কষ্টের এমন অনুভূতি জীবনে কোনদিন পাইনি! আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, এমন অভিজ্ঞতায় তোমাদের যেন কখনো পড়তে না হয়

রাত্রে কাঞ্চনকাকুর পিসিমা আমাদের খেতে ডাকতে, সবাই খাবার ঘরে গেলাম। দেখলাম সকলের জন্যেই আসন পাতা রয়েছে, তার সামনে ভাত-তরকারি সাজানো থালা। বৃদ্ধা হাত দিয়ে একটা আসন দেখিয়ে বললেন, “কাঞ্চন এটায় বস, আর প্রথমেই এক চুমুকে এই বাটির জলটা খেয়ে নে”। বাটিটা শূণ্যে উঠে গেল এবং বাটির জল শেষ হতে না হতে, আমাদের সামনে উপস্থিত হল, সম্পূর্ণ অচেনা এক ব্যক্তি। এমন আশ্চর্য ঘটনা জীবনে আর দেখতে পাবো বলে মনে হয় না। সনৎকাকু এবং বৃদ্ধা দুজনেই একসঙ্গেই বলে উঠলেন, “কাঞ্চন?” অচেনা ব্যক্তিও অবাক হয়ে তাকালেন, বললেন, “তোমরা আমায় দেখতে পাচ্ছো, ছোট পিসিমা?”

“দেখতে তো পাচ্ছি, কিন্তু তুই আমাদের সেই কাঞ্চন তো? এমন বয়স্ক হয়ে গেলি কী করে?”

“হবো না? তোমাদের বয়েস বেড়েছে, আর আমার বাড়েনি? তোমাদের চোখে আমার সেই পনের বছরের চেহারাটাই তো রয়ে গেছে!” বৃদ্ধা কাঞ্চনকাকুর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে ডাকলেন, “ছোড়দা, দেখে যাও, তোমার সালসায় কাঞ্চনকে আবার আমরা ফিরে পেয়েছি”। বৃদ্ধ দরজায় এসে দাঁড়ালেন। কাঞ্চনকাকুর দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে জিগ্যেস করলেন, “সত্যিই তুই কাঞ্চন”? তারপর যা হল তাতে আমাদের সকলের চোখেই জল এসে গেল। কাঞ্চনকে বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা দুজনেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বৃদ্ধ বললেন, “এতদিনে তোর সঙ্গে আমারও শাপমুক্তি হল রে। বড়দা-বৌদি নিশ্চয়ই আমাকে এবার ক্ষমা করে দেবেন”।

**

 পরের দিন দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা কলকাতার দিকে রওনা দিলাম, সামনের সিটে সনৎকাকুর পাশে আমিই বসলাম। কারণ এবারে কাঞ্চনকাকু আমাদের সঙ্গে ফিরলেন না। বললেন, “আমি আর কলকাতায় গিয়ে কী করবো? বরং এখানেই থেকে বুড়োবুড়ির সেবা করি। তবে সনৎ আর তোমরা সবাই লম্বা ছুটি নিয়ে এখানে চলে আসবে। দীপু, সন্তু আর শরৎ তোমাদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। আমি কলকাতায় যাবো, তোমাদের বাবা-মাকেও আমাদের এখানে নিয়ে আসবো”। আসার পথে আমাদের কেউই কোন কথা বলিনি, সকলেই অদ্ভূত এই অভিজ্ঞতার চিন্তায় ডুবে রইলাম।

..০০..

 

 

 

নতুন পোস্টগুলি

দাঁতের পোকা

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...