রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

ধরে রাখাই ধর্ম

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]



তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়ো, আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন ঘোরতর ইংরিজীভাষা বিরোধী, গোঁড়া সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত টোল এবং ভট্টপল্লীর সংস্কৃত শিক্ষা ছাড়া হিন্দুসমাজের যে পরিত্রাণ নেই সে বিষয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ বিশ্বাসী। তাঁর ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর মেজভাই – আমাদের মেজদাদু এন্ট্র্যান্স পরীক্ষায় বসেছিলেন আর সে পরীক্ষায় অংক আর সংস্কৃতে পাওয়া সোনার মেডেলদুটি দাদার পায়ে উৎসর্গ করে যখন নত মুখে দাদার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, দাদা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং বলেছিলেন ভাইয়ের সাফল্যে তিনি গর্বিত এবং এই সংস্কৃতর জ্ঞানই যে তাঁর ভাইকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে, এ বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত

কিন্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, দাদুকে গ্রামসমাজে কঠোর শাস্ত্রবিধির প্রসারে সহায়তা না করে, মেজদাদু যখন কলকাতায় এসেছিলেন সরকারি ‘গোলামি’ করতে, তখন তিনি ভীষণ বিরক্ত ও হতাশ হয়েছিলেনএমনকি বিদায়ের সময় মেজদাদু যখন দাদুকে প্রণাম করেছিলেন, দাদু কোন আশীর্বচনও উচ্চারণ করেন নি মেজদাদুর উদ্দেশে। পরে মেজদাদু গ্রামে ফিরে দাদার পায়ে যখন প্রথম মাসের চোদ্দ টাকা ছ আনা বেতন নিবেদন করেছিলেন, তখনো দাদু কোন কথা বলেন নি, গম্ভীরভাবে আমার বালক বাবাকে ডেকে বলেছিলেন টাকাকটা তুলে ঠাকুমার হাতে দিতে।

এসব কথা বাবার মুখে শোনা। বাবার কাছেই শুনেছিলাম পিতৃসম বড়োদাদাকে এতটুকু অসম্মান না করেও, বিনীত অথচ বিদ্রোহী মেজদাদুর এই বাস্তব ও যুগোপযোগী চেতনার কথা। এই মেজদাদুর প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাবাও ইংরিজি শিক্ষার আলোয় আসতে পেরেছিলেন এবং কলকাতায় আসতে পেরেছিলেন উচ্চতর শিক্ষার প্রাঙ্গণে। কলেজে পড়ে বাবার চূড়ান্ত অধঃপাত অবিশ্যি দাদুকে দেখে যেতে হয়নি, কারণ আমার দাদু বিগত হয়েছিলেন বাবা কলেজে পড়ার শেষদিকে।

কাজেই প্রত্যক্ষভাবে আমার বাবার জীবনে এবং পরোক্ষভাবে আমাদের জীবনেও মেজদাদুর ছিল অপরিমিত অবদানএককথায় তাঁরই একক প্রচেষ্টায় আমাদের সমস্ত পরিবারটিই, অন্ধ কূপমান্ডুক্য থেকে মুক্তির আলোর সন্ধান পেয়েছিল

আমাদের ছোটবেলায় তাঁর শিবপুর ট্রামডিপোর কাছাকাছি বাড়ি থেকে মেজদাদু আমাদের শ্রী গোপাল মল্লিক লেনের বাসায় আসতেন অনায়াস পদব্রজে। আমরা অবাক হলে সৌম্য হাসিতে ভরে উঠত তাঁর সদাশিব মুখ, বলতেন, ‘এ আর কি এমন দূর গো। এখন বয়েস হয়েছে, তেমন আর হাঁটতে পারি কই? হাঁটতাম তখন - প্রত্যেক মাসে একবার কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরতাম, দুহাতে থাকত দুটো চটের থলিভরা মাসকাবারি বাজার, পূর্বস্থলী স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে আমাদের শুরু হত হাঁটা। তা প্রায় ধরো আট-ন’ ক্রোশ তো হবেই -’

‘ক্রোশ মানে’?

‘ক্রোশ মানে ধরো প্রায় দু মাইল, তোমাদের এখনকার হিসেবে প্রায় সওয়া তিন কিলোমিটার। তোমাদের বাবাও যখন কলেজের ছুটিতে বাড়ি আসত, ওইভাবেই আসত...’

‘অত্তোটা পথহাঁটা, কষ্ট হত না, দাদু’? আমার প্রশ্নের উত্তরে আমার পিঠে হাত রেখে উনি বলেছিলেন, ‘আসলে কি জান, দাদু, আমরা ওই বয়সে কেউই কলকাতাকে নিজের জায়গা হিসেবে ভাবতেই পারতাম না। কলকাতা ছিল নিছক কর্মস্থল, পরবাস। এখানে কেউ থাকে নাকি? ঘরবাড়িউঠোন, জমিজিরেত, পুকুরপাড়, মন্দিরতলা, ঠাকুর-দালান, পাড়া প্রতিবেশী – সব মিলে মিশে এমনই সে মমত্ব ও মায়া – যার টান, সারাটা মাস আমাদের অনুভবে থাকত। শনিবার বিকেলে বড়বাজারে চটের থলি ভরা জিনিষপত্র কিনে হাওড়ার পন্টুন ব্রীজ পার হয়ে যখন ট্রেনে চাপতাম – নিজেকে মনে হত জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কয়েদি। কি প্রবল আকর্ষণই না ছিল আমাদের ছেড়ে আসা ওই গ্রামজীবনের। কষ্ট হতো, ভীষণ কষ্ট হতো, বর্ষার দিনগুলোয় তো বটেই - কিন্তু সহ্যও হয়ে যেত ওই মায়ার অদ্ভূত আরামে...’

দাদুর উচ্চারণে, বলার ভঙ্গীতে এমন কিছু থাকত, আমরাও যেন চোখের সামনে কল্পনা করতে পারতাম সেই পথচলা। ভরা বর্ষায় বেড়ে ওঠা সতেজ ঝোপঝাড়-জঙ্গলে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসা পথ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে জোনাকির নাক্ষত্র্য আলোক। ঝিঁঝিঁর একটানা ডেকে চলা। পুকুর বা জলার ধারে ব্যাঙের কোলাহল। দলবদ্ধ শেয়ালের চকিত ছোটাছুটি আর সমবেত হুউউক্কা হুউউয়া। অথবা পূর্ণিমায় আলোকিত শরতের স্বচ্ছ রাত। কিংবা শীতের ঘন কুয়াশার রহস্যে ঢাকা পরিবেশে ঘরে ফেরা কয়েকটি মানুষের অবিরত সুদীর্ঘ পথ হেঁটে চলা – যা শেষ হত নিজ নিজ গ্রামে এবং প্রায় শেষ রাতে। 

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেজদাদু আবার বললেন, ‘আজকাল সারাদিনে কত ট্রেন, কত বাস – হাঁটতেও হয় না আর তেমন, এখন গ্রাম অব্দিই প্রায় বাস চলে যাচ্ছেকত সুবিধে হয়ে গেছে, দাদুভাই। তবু যাওয়া হয়ে ওঠে না। কতদিন যাইনি, জান – তা প্রায় বছর দশেক তো বটেই। এখন বুঝতে পারবে না দাদুভাই, বড়ো হলে বুঝতে পারবে – কোন দূরত্বই দূর নয়, কোন কষ্টই বেদনা নয়, যদি তার পিছনে থাকে তোমার অন্তরের সাড়া। আর যদি তা না থাকে ঘরের উঠোন পার হতেও মনে হবে অনন্তপথযাত্রা’!       

গৌরবর্ণ, শুভ্রকেশ, শুভ্রভ্রূ বেঁটে-খাটো সেই বৃদ্ধ মানুষটি, এমনই এক সোনালী মায়াময় অথচ বেশ কষ্টকর অতীত জীবনের ঐতিহ্যময় ইতিহাস, আমার বালক হৃদয়ে এঁকে দিতে পেরেছিলেন, যা আজও আমার কাছে অম্লান। 


ক্লাশ সিক্সের মাঝামাঝি, এক রোববারে বাবা খুব বকা খেলেন আমাদের মেজদাদুর কাছে। আমাদের সামনে বকা খেয়ে, মাথা নীচু করে চুপ করে রইলেন বাবা! যেমন আমরা বাবার কাছে বকা খেয়ে মুখ কাঁচুমাচু হয়ে থাকতাম - অবিকল সেরকম। তার আগে পর্যন্ত জানতাম বাবারাই শুধু বকা দেন – তাঁরাও যে বকা খেতে পারেন সেদিন চাক্ষুষ করে খুব মজা পেয়েছিলাম। তবে মেজদাদুর বকা মানে যে চেঁচামেচি - রাগারাগি তাও নয়, সেও এক অদ্ভূত আত্মবিশ্লেষণ।  

সেদিন সকাল থেকে দাদুর কাছে আমার সংস্কৃতচর্চার পর, দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে বসেছিলাম আমরা চারজন, মেঝেয় আসন পেতে। সামনে বসে ঘোমটা মাথায় মা পরিবেশন করছিলেন। মায়ের রান্নার একান্ত ভক্ত মেজদাদু, রুই মাছের মুড়ো দেওয়া মুগের ডালে ভাত মেখে কুমড়ো ফুলের বড়া খেতে খেতে কথাটা তুললেন, ‘বৌমা, নারাণকে আমরাই সঠিক মানুষ করে তুলতে পারিনি, ও কোনদিনই আর প্রাপ্তমনস্ক হবে না। তুমি তো মা, এমন না - ছেলেদুটোর পৈতে দেবার কথা, তুমি কি ভাবছ’?

অকস্মাৎ দাদুর এই কথায় মা ও বাবা দুজনেই অপ্রস্তুত। ঘোমটার আড়ালে মা বাবার দিকে তাকালেন, বাস্তবিক এই ব্যাপারে মা অনেকবারই বাবাকে তাগাদা দিয়েছেন, কিন্তু বাবাই এ বছর নয়, পরের বার - সামনের পূজোটা যাক – এই করে করে আর হয়ে ওঠেনি মা কিছু বললেন না, বাবাকে ইশারা করলেন উত্তর দিতে। বাবা গলা ঝেড়ে, একটু কেশে উত্তর দিলেন, ‘না, মানে। ভেবেছি দুভাইয়ের একসঙ্গেই দিয়ে দেব। তা হাজার ঝামেলায় - ওই দোবো দোবো করে আর দেওয়া হচ্ছে না’।

‘আর কতদিন ভাববে? উপনয়ন সংস্কারের নিয়ম বিধি জানা আছে? উপনয়নের একটা বয়স সীমার ব্যাপার আছে, সেটা তো তোমারও না জানার কথা নয়, বৌমা। হীরকের সে বয়স অতিক্রান্ত, পান্নাও সে বয়সের উপান্তে। তোমরা যদি ওদের পৈতে দেবে না ঠিক করে ফেলে থাক, সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই – কারণ তোমরা এখন আধুনিক সংস্কৃতির প্রবাহে ভাসমান...’

‘না, না। ওদের পৈতে হবে না, তা কি করে হয়, কাকামশাই। আসলে কলকাতার এই বাসায় হবে, না গাঁয়ের ভিটেয় হবে – এই এক চিন্তায় আমাদের দিন কাটছে’মা ভীষণ চিন্তিত স্বরে বললেন ‘কলকাতার এতটুকু বাসায়, লোক-জন, আত্মীয়-স্বজন, তারওপর এরমধ্যেই ওদের দুভাইয়ের একঘরে তিনদিন আলাদা থাকা – সব মিলিয়ে মনে হয়, এ বাসায় ও অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। গাঁয়ে গিয়ে করতে পারলে সবচে’ ভালো হতো, পৈতৃক ভিটে বলেও কথা। কিন্তু সেখানেও সবাই মিলে গিয়ে – যোগাড়-যন্ত্র - অন্ততঃ দিন দশেক অফিস-স্কুল-কলেজ কামাই – তার ওপর...মানে...তার ওপর খরচও হবে অনেক বেশি’।

মেজদাদু শুনলেন, কিছু বললেন না। মুগডাল দিয়ে কুমড়োর বড়া শেষ করে নতুন ভাত ভাঙলেন, মা লক্ষ্য রেখেছিলেন – আলু-পটলের তরকারি দিলেন মেজদাদুর পাতে। তরকারি দিয়ে ভাত মেখে মুখে গ্রাস তুলে বললেন, ‘অপূর্ব। বৌমা, এ সময় রোজ পটল খেতে খেতে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল, তোমার হাতে পড়ে কি করে তার এমন স্বাদ হয় বল তো? আরেকটু ঝোল দাও তো মা, ওই দেখ আবার পটল দিলে – তোমার জন্যেও রেখো বৌমা’। 

মা বললেন, ‘আমাদের আছে, আপনি খান না’। 

খুব তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে মেজদাদু বললেন, ‘ধর্ম মানে কি জানো তো বৌমা – যা ধরে থাকে। কি ধরে থাকে বল তো?’ আরেক গ্রাস ভাত মুখে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের সমাজ, আমাদের জীবন, আমাদের সম্পর্ক। এই যে এত যত্নে রান্না করে তুমি আমাদের খাওয়াও – এর সঙ্গে মিশে থাকে তোমার শ্রদ্ধা, ভক্তি – গড়ে ওঠে অটুট সম্পর্ক। বেড়ে ওঠে জীবনের আনন্দ – এই আনন্দটাই ধর্ম। ধর্ম সঠিক অর্থে মানুষকে কোনদিন বিপন্ন করতে পারে না। মানুষ বিপন্ন হয় এবং অন্য মানুষকে বিপন্ন করে অন্ধ বিশ্বাস আর মনগড়া কিছু লোকাচার মানার জিদ থেকে’।

পটলের তরকারি দিয়ে মাখা ভাত শেষ করে আবার নতুন ভাত ভাঙলেন মেজদাদু, সেই দেখে মা মাছের তরকারি দিলেন – বড়ো আংটির মতো রুইমাছের একটা পিস, দুটো লম্বা ফালি করে কাটা আলু আর ঝোল। মেজদাদু আলুদুটো ভেঙে ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন, ‘আসল কথাটা হচ্ছে, হীরক আর পান্নার পৈতে - এটা আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কারতাতে তোমাদের সাধ আর সাধ্যর মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে, তার মানে তোমরা একভাবে বিপন্ন...’। ঝোলমাখা ভাত এক গ্রাস মুখে নিয়ে, মাছের একটা টুকরো মুখে নিলেন, একটা বড় কাঁটা মুখ থেকে টেনে বের করে বললেন, ‘এটা তো ধর্ম হতে পারে না, বৌমা। ধর্ম যদি আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়, সমাজে থেকেও যদি আমরা অসহায় হয়ে পড়ি, তাহলে সে সমাজের, তুমি কি উন্নতি আশা করবে? ধর্ম কি শুধু সর্বস্বান্ত হয়ে পূজোয় ঢাক বাজানো? যদি তাই হয় - সে ধর্ম দিয়েই বা তুমি কি করবে...’?

মেজদাদু চুপ করলেন। খুব মন দিয়ে ভাত খেতে লাগলেন। মা আরেকটু ভাত দেবার চেষ্টা করেছিলেন, নিলেন না। খুব গভীর কোন চিন্তায় আচ্ছন্ন মেজদাদু কাঁসার থালা চেঁটেপুটে পরিষ্কার করে ফেললেন। বাবা মা কেউ কথা বললেন না। মা আলাদা চিনেমাটির প্লেটে আমের চাটনি দিলেন, কারণ কাঁসার থালায় টক জিনিষ নষ্ট হয়ে যায় - বিস্বাদ হয়ে যায়মেজদাদুর মুখে দিব্য হাসি, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিছুই বাদ রাখো নি, বৌমা। গরমের সময় কাঁচা আমের চাটনি বড় উপাদেয়, তাই না, পান্নাভাই’? তারপর ভীষণ তৃপ্তির সঙ্গে চাটনিও শেষ করলেন। আমাদের তখনো খাওয়া হয় নি। মেজদাদু বসে রইলেন। 

কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘তোমার যদি আপত্তি না থাকে বৌমা, আমি নিজে তোমার দুই পুত্রের উপনয়ন যজ্ঞের হোত্রী হব। পূর্ণ শাস্ত্র বিধান মেনে, সামবেদীয় পদ্ধতিতে। ওদের তিনদিন অসূর্য্যম্পশ্যও থাকতে হবে না। আর কলকাতার এই বাসাকেই এই অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করো কোন অসুবিধে নয়, কোন ব্যয়বাহুল্যও নয়। কিন্তু বিধিসম্মত ধর্মপালন হওয়া চাই’


-০০-

শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

কুমীরের বন্ধু (ছোটদের নাটক)

     [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে "ফলো করুন" 👉

    বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন। এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে ড়লে

    স্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]


[কৃতজ্ঞতাঃ পণ্ডিতেরা বলেন, বাইবেলের পরে সব থেকে যে প্রাচীন গ্রন্থটি পৃথিবীতে সব থেকে বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, সেই গ্রন্থের নাম “পঞ্চতন্ত্র”। পঞ্চতন্ত্রের রচয়িতা পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের মহিলারোপ্য নামক কোন এক রাজ্যের রাজা অমরশক্তির তিন মূর্খ পুত্রকে মাত্র ছয়মাসে নীতিশাস্ত্রের পণ্ডিত করে তোলার ব্রত নিয়ে পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা, এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন়। প্রধানতঃ জঙ্গলের পশুপাখিদের নিয়ে সেই সব নীতিশিক্ষার গল্পগুলির একটি নিয়েই এই নাট্যরূপ।] 


প্রথম দৃশ্য

[সামনে বেশ চওড়া এক নদী। এপাড়ে বেশ কিছু গাছপালা। সেখানে জামগাছের ডালে বসে একটি বাঁদর জাম খাচ্ছে, তার কপিকান্ত ।]

বাঁদরঃ  হেউ...হেএএউ.. নাঃ, আর পারা যাচ্ছে না, পেট ফুলে জয়ঢাক হয়ে গেল! এরপর আরও খেলে পেটটাই হয়তো ফেটে যাবে ফটাস করে! না, আর খাবো না। এবার নদীর জলে হাত-মুখ ধুয়ে একটু বসি আরাম করে। (গাছ থেকে নেমে নদীর ধারে গিয়ে হাত-মুখ ধুল, তারপর পাড়ে বসে, ভুঁড়ি চুলকোতে চুলকোতে মহানন্দে গান ধরলো....)

         গাছে গাছে নেচে বেড়াই এই ডালে ওই ডালে।

         পাকা পাকা ফলগুলি ভাই, টপ করে নিই গালে।

         বগলদুটি চুলকোই খুব, আরো চুলকোই ভুঁড়ি।

         বাঁদরামিতে এই দুনিয়ায় নেই গো মোদের জুড়ি... [ হঠাৎ গান থামিয়ে..]

আরেঃ, ওটা আবার কী রে বাবা, নদীর জলে ভেসে আসছে, মস্ত গাছের গুঁড়ির মতো! উঁহুঃ, ভালো ঠেকছে না।  গাছে উঠে পড়ে, আড়াল থেকে ঘাপটি মেরে দেখি, ব্যাপারটা কী? 

[বাঁদর তরতরিয়ে গাছে উঠতেই, হাপুস হুপুস শব্দ করে পাড়ে উঠল একটা কুমীর। বিশাল হাঁই তুলে বলল]

কুমীরঃ  ওফ সেই থেকে সাঁতার কাটতে কাটতে, গায়ে শ্যাওলা পড়ে গেল! মাছেরা সারা দিন রাত জলের মধ্যে কী করে থাকে কে জানে! আমার তো আধ ঘন্টা থাকলেই হাঁফ ধরে যায়। পাড়ে উঠে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে চুপ করে একটু শুয়ে থাকলে ধড়ে প্রাণ আসে। ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নিই, তারপর ফেরার পথে বউ আর ছেলেমেয়েদের জন্যে মাছ ধরে নিয়ে যাবো। এ তল্লাটে নদীর মাছ ছাড়া আর কিছু পাওয়াও যায় না ছাতা। দু একটা জন্তুজানোয়ার পেলে মাঝে মাঝে একটু মুখ বদল হতে পারতো। এমন ওঁচা জঙ্গল এর আগে কোনোদিন দেখিনি বাপু!

[জঙ্গলের নিন্দে শুনে বাঁদর বেজায় রেগে গেল, উত্তেজিত হয়ে বলল, ]

বাঁদরঃ  অ্যাইও, কে হে আপনি, হঠাৎ এসেই জঙ্গলের নিন্দে শুরু করে দিয়েছেন?

[থতমত খেয়ে কুমীর চারদিকে তাকাল, কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,]

কুমীরঃ  কে ভাই? আপনি কোথায় ভাই? কিছু ভুল বলে ফেললাম কী, ভাই?

বাঁদরঃ  আপনি বেশ নড়েভোলা তো! চারদিকে তাকালেন, আর ওপরেই তাকালেন না? এই যে এদিকে, এখানে, গাছের ওপর। [কুমীর ওপরের দিকে তাকিয়ে, বাঁদরকে দেখতে পেল, বলল]

কুমীরঃ  অ, আপনি গাছের মগডালে উঠে বসে আছেন, আপনি উট নাকি?

বাঁদরঃ  আপনি বেশ গোলমেলে জীব তো মশাই, গাছে উঠলেই বুঝি সব উট হয়ে যায়! উট থাকে মরুভূমিতে, যেখানে জল পাওয়া যায় না।

কুমীরঃ  তাই বুঝি? আমি তো কোনোদিন মরুভূমিতে যাই নি, তাই চিনি না। আমি কুমীর, আমি জলেও থাকি আবার ডাঙাতেও থাকি। মানে উভচর, আর কি, হে হে হে।

বাঁদরঃ  আমি কপি। আমাদের আরো অনেক নাম আছে, যেমন, বানর, শাখামৃগ। মানুষরা আমাদের বাঁদরও বলে। শুনেছি তারা নিজের ছেলেমেয়েদের আদর দিয়ে দিয়ে বাঁদর বানায়। আমরা গাছেও থাকি, আবার মাটিতেও হাঁটাচলা, লাফালাফি করতে পারি। কিন্তু আমাদের কেউ উভচর বলে না।

কুমীরঃ  বলে না বুঝি?  

বাঁদরঃ  না না, বলে না। স্যরি, একটা কথা মনে পড়লো, তাই বলছি, আপনারা সরীসৃপ না?

কুমীরঃ  ঠিক ঠিক, আমরা সরীসৃপই তো! আমরা যে বুকে হাঁটি। কিন্তু এতে স্যরি হবার কী আছে?

বাঁদরঃ  একে উভচর, তাতে আবার সরীসৃপ, এর পরেও স্যরি না হলে, আর কিসে হবেন? যাগ্গে, ওকথা থাক। তা আপনাদের খাবার দাবারের কী ব্যবস্থা?

কুমীরঃ  আমাদের আবার খাবারের অভাব? জলে মাছ ধরে খাই। ডাঙায় গরু, ছাগল, কুকুর, হরিণ যখন যা জোটে খাই। সুযোগ পেলে মানুষও খাই। তবে এ জঙ্গলে তেমন কিছুই মেলে না, সেই জন্যেই বলছিলাম, বাজে জঙ্গল। 

বাঁদরঃ  বাজে বললেই শুনবো? এমন সুন্দর জায়গা ভূভারতে আর কেউ দেখেছে? দেখেনি। আমি বলছি কেউ দেখেনি। সামনেই এমন তিরতিরে নদী। নদীর ধারে এমন জমকালো জঙ্গল। আর সেই জঙ্গলে ফল ভরা এমন গাছ, পাবে কেউ? গরমকালে আম জাম লিচু। সারা বছরভর কলাটা, পেয়ারাটা- কত ফল খাবে খাও না। আর সে ফলে ভাগ বসাতে, দুচারটে পাখি ছাড়া, আর কেউই নেই এ জঙ্গলে!

কুমীরঃ  [খুব অবাক হয়ে] ফল খাবো? গাছের? আমরা?

বাঁদরঃ  উঠলে তো নদীর জল থেকে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে পড়লে! কোনোদিন খেয়েছো? খেয়ে দেখেছো?

কুমীরঃ  না তা খাইনি।

বাঁদরঃ  তবে? সর্বদা মাংস খাবার জন্যে হাঁকপাক না করে, মাঝে মাঝে ফল-টল খেয়েও দেখো না!

কুমীরঃ  না মানে, ইয়ে ফল খাবার কথা আমাদের মাথাতেই আসেনি কোনদিন। বলি পেট-ফেট খারাপ হবে না তো?

বাঁদরঃ  হে হে, খুব অবাক করলে যা হোক। পাকা ফল খেয়ে কারো পেট খারাপ হয়েছে, এমন শুনিনি ভাই।

কুমীরঃ  [লেজ দিয়ে পিঠ চুলকে] আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখবো না হয়।

বাঁদরঃ  আরে ধুর চেষ্টা করবে কী? গোটা কয়েক ফল দিচ্ছি, এখনই খেয়ে দেখো দেখি! হাঁ করো, হাঁ করো...ও বাবা, অত্তো বড়ো হাঁ! ঠিক আছে এই নাও। [বাঁদর বেশ কটা পাকা জাম ছুঁড়ে দিল কুমীরের মুখে, কুমীর চিবোতে লাগল] কি, কেমন?

কুমীরঃ  বাঃ, সত্যিই দারুণ তো! কী মিষ্টি! আরও আছে নাকি? আমাকে আরো কটা দাও দেখি, বাড়ির জন্যেও কটা নিয়ে যাবো! বউ ছেলেমেয়েরাও এ জিনিষ পেলে অবাক হয়ে যাবে! কোনোদিন খায়নি তো! কী নাম বলো তো এগুলোর?

বাঁদরঃ  হে হে, এ হল জাম। এ তো কিছুই না, এর থেকেও কতো ভালো ভালো ফল আছে! সে সব খেলে তো আর মাছ-মাংসের ধার ঘেঁষবে না! আচ্ছা সে হবে খন, আমার সঙ্গে কদিন কাটাও, তোমাকে আরো অনেক ফল খাওয়াবো। আজ এই জামগুলো নিয়ে গিয়ে বাড়িতে সকলকে খাওয়ায়, কাল এসে বলবে, বাড়িতে কে কী বলল!

[বাঁদর গাছের ডালপালা ঝাঁকিয়ে অনেক জাম ফেলল মাটিতে, কুমীর সেগুলো কুড়িয়ে নিল চটপট।]

কুমীরঃ  তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল, বাঁদর ভাই। অনেক কিছু জানা হল, শেখা হল। কাল এরকম সময়েই আবার আসবো।

বাঁদরঃ  আচ্ছা। কুমীরভাই। কাল আসবে কিন্তু আবার। আজ তো তেমন কোন কথাই হল না। কাল অনেক গল্প হবে, কেমন? কাল সকালে আরো নতুন কিছু ফল তোমার জন্যে যোগাড় করে রাখবো।

কুমীরঃ  একটা কথা তোমাকে বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কী জানি তুমি কী ভাববে, সেই ভেবে বলতে ভরসা পাচ্ছি না।

বাঁদরঃ  কী কথা বলো তো?

কুমীরঃ  আমার তো কোনো বন্ধু নেই! তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে বেশ হতো!

বাঁদরঃ  হা হা হা হা। আমরা তো বন্ধু হয়েই গেছি! তা, এ কথাটা বলতে এতো কিন্তু কিন্তু করছো কেন, বন্ধু?

কুমীরঃ না অনেকে বলে, সমান সমান না হলে বন্ধুত্ব হয় না। তাই একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম।

বাঁদরঃ  সমান সমান বলতে?

কুমীরঃ  মানে এই যেমন ধরো আমি সরীসৃপ আর তুমি স্তন্যপায়ী। তারপর যেমন ধরো, আমার তুলনায় তোমার চেহারা অনেক ছোট্ট। তুমি ফলটল খাও, আর আমরা মাংস খাই। আমাদের গায়ের জোরও তোমার তুলনায় অনেক অনেক বেশি...

বাঁদরঃ  বুঝেছি বুঝেছি, আর বলতে হবে না। ওই সব কথা পণ্ডিতেরা বলে। ওদের সব কথায় কান দিতে আছে, নাকি? সব কিছু সমান যদি নাও হয়, তবু মনের মিল বলে একটা ব্যাপার আছে, বলি সেটা মানবে তো?

কুমীরঃ  সে কথা তো একশ বার।

বাঁদরঃ  ব্যস্, ব্যস্, ওটুকুই যথেষ্ট। মনের মিল যখন হয়েছে, তখন আমরা বন্ধু।

কুমীরঃ  বড়ো আনন্দ পেলাম, বন্ধু। আজকে বাড়ি গিয়ে বলবো, এতদিনে আমি একজন বন্ধু পেয়েছি। আজ তবে আসি বন্ধু?

বাঁদরঃ  এসো বন্ধু, এসো। কাল আসবে কিন্তু। বেশ জমিয়ে গল্প করা যাবে।           

 

দ্বিতীয় দৃশ্য

 

[কুমীরের বাসা। কুমীর আর তার ছানাপোনারা কচর মচর করে ফল খাচ্ছে। কুমীরের বউ চোখকুঁচকে দেখতে দেখতে বলল- ]

কুমীরীঃ পরশু আবার যেন হুট করে কোথাও বেরিয়ে পড়ো না।

কুমীরঃ  কেন? পরশু কী আছে?

কুমীরীঃ পরশু ছেলেমেয়ের স্কুল থেকে আমাদের দুজনকেই ডেকেছে।

কুমীরঃ  [ছানাপোনাদের ধমকে] কেন রে? কী করেছিস তোরা? নিশ্চয়ই নিয়মিত হোম টাস্ক করিস না। নাকি পড়া পারিসনি? পড়াশুনোর নাম নেই, দিন রাত কেবল খেলা আর খেলা। পিঠের চামড়া তুলে দিতে হয়!

কুমীরীঃ পুরোটা না শুনেই ছেলেমেয়েদের বকছো কেন? আমার ছেলেমেয়েদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম হতে পারে, কিন্তু ফাঁকি দেয় না।

কুমীরঃ  তাহলে স্কুল থেকে ডাকল কেন? তার মানে নিশ্চয়ই কোন বদমায়েশি করেছে! দুষ্টুমি করে থাকলে, দুটোরই লেজ মুচড়ে দেব – এই বলে রাখলাম।

কুমীরীঃ ধ্যাত্তেরিকা, খালি পিঠের চামড়া তুলছে, নয় লেজ মুলে দিচ্ছে!  আর অন্য কোন কথা নেই মুখে? বেশ কদিন ধরেই তোমার রকমসকম কিন্তু আমার ভালো ঠেকছে না। ছেলেমেয়েরাও দেখছি তোমার চোখের বালি হয়ে উঠছে দিন দিন।

কুমীরঃ  [ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আম খেতে খেতে] বাজে না বকে, কী ব্যাপার হয়েছে খুলে বলবে নাকি?

কুমিরীঃ আগে বলো তো, আজকাল রোজই তোমার এই হাবিজাবি ফলপাকুড় নিয়ে আসার মতি হচ্ছে কেন? তুমি কী আমার ছেলেমেয়েদের ছাগল-গরু বানিয়ে তুলতে চাইছো?

কুমীরঃ  [ভারি অবাক হয়ে] তার মানে?

কুমীরীঃ তা নয়তো কি? কুমীরের বাচ্চারা, কবে কোথায় ওই সব ছাইপাঁশ খেয়ে বড়ো হয়েছে, শুনি?

কুমীরঃ  ছাইপাঁশ মানে? জানো, আমার বন্ধু বলেছে,  এইসব ফল মানুষেরাও খায়আম, জাম, কাঁঠাল, কলা এসব ছাইপাঁশ! কী বলছো গো, গিন্নি?

কুমীরীঃ রাখো তোমার বন্ধু। ওই বন্ধুই তোমার মাথাটা খেয়েছে। কুমীরের বন্ধু বাঁদর! এমন শুনেছে কেউ, নাকি দেখেছে? লজ্জায় মরি আর কি! কুমীর সমাজে কেউ শুনলে, ছি ছি করবে। আমাদের সঙ্গে আর কেউ সম্পর্ক রাখবে? আমাদের এক ঘরে করবে।

কুমীরঃ  আহা, ব্যাপারটা বুঝছো না, গিন্নি! এতদিন আমাদের কেউ কোন ফল পায়নি, তাই খায়নি কোন কুমীর কি কোনদিন গাছে চড়েছে, নাকি ফল পেড়ে খেয়েছে? কুমীর তো গাছে চড়তেই পারে না! সে আবার ফল খাবে কী করে? আমার বন্ধু বাঁদর, গাছে চড়তে পারে। তার দৌলতেই আমরা ফলের স্বাদ পেয়েছি। আমি বলি কী – আমাদের পাড়ার সবাইকে একদিন নেমন্তন্ন করো, সক্কলকে ফল খাওয়াই!

কুমীরীঃ বোঝো নেমন্তন্ন করে কী করবে শুনি? তোমার ছেলেমেয়ের পেটে কোন কথা থাকে? স্কুলে গিয়ে তারা বন্ধুদের গিয়ে গল্প করেছে। ওদের ক্লাসের বন্ধুরা আবার তাদের বাবা-মাকে গিয়ে বলেছে, “ও বাবা, ফল খাবো, ফল এনে দাও! ও মা, বাবাকে বলো না অনেক অনেক ফল আনতে”ছেলেমেয়েদের নাকে কান্না শুনে তাদের বাবা-মায়েরা কমপ্লেন করেছেন স্কুলের হেড দিদিমণির কাছে...

কুমীরঃ  হা হা হা হা, এ হচ্ছে হিংসে, গিন্নি, হিংসে! তুমি কিচ্ছু ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কুমীরীঃ ঘোড়ার ডিম ঠিক হবে! অলরেডি ক্লাসের বন্ধুবান্ধবেরা ওদের সঙ্গে কথা বলে না। ওদের সঙ্গে এক বেঞ্চে বসে না। তাদের গার্জেনরা একসঙ্গে হেডদিদিমণিকে চিঠি দিয়ে বলেছে, আমাদের ছেলেমেয়েদের যদি স্কুল থেকে বের করে না দেওয়া হয়, তারাই নিজেদের ছেলেমেয়েকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দেবে!

কুমীরঃ  তার মানে? আমাদের ছেলেমেয়ে পড়াশুনো করে, অসভ্য নয়, দুষ্টু নয়, তাদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে, তারা ফল খায় বলে? এ কি মগের মুল্লুক নাকি? আমরা আমাদের মতো যা খুশি খেতে পারবো না? আমরা কী খাব না খাব, সেটা আর পাঁচ জনে ঠিক করে দেবে? আর স্কুলও সেটা মেনে নেবে? দেখে নিও, স্কুল নিশ্চয়ই এই অন্যায় আবদার মানবে না!

কুমীরীঃ ওই ভরসায় থাকলেই হয়েছে আর কী! অলরেডি স্কুল ঠিক করে ফেলেছে আমাদের ছেলেমেয়েদের তাড়িয়ে দেবে! পরশু হেডদিদিমণি আমাদের সেই কথাই বলবেন, আর শেষ বারের মতো হয়তো দুচারদিন সময় দেবেন। আমরা যদি আর কোনোদিন ফল-টল খাবো না বলে প্রমিস করি, তাহলে স্কুল ওদের পড়তে দেবে।

কুমীরঃ  এ তো অত্যাচার। কুমীরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এ চলতে পারে না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করছি।

কুমীরীঃ ভালো, তুমি প্রতিবাদ করো। আর আমাদের ছেলেমেয়েরা মুখ্যু হয়ে বড়ো হোক। অন্য কুমীরের ছানারা স্কুল থেকে পাস করে, বড়ো বড়ো হরিণ, গরু, ছাগল, মানুষ-টানুষ শিকার করার নানান ফন্দি ফিকির শিখে, দুবেলা ভরপেট মাংস খাবে! আর আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করবে, আর কেঁদে কেঁদে ভিক্ষে করবে, “দুপিস মাংস হবেএএএ..”! দুএকজন হয়তো দয়া করে একটা কান বা দুটো ক্ষুর ছুঁড়ে দেবে, ওদের দিকে!

কুমীরঃ  কী ভয়ানক কথা বলছো, গিন্নি! আমার তো চোখে জল চলে আসছে!

কুমীরীঃ যাক এতদিন মানুষরা “কুমীরের কান্না”, “কুমীরের চোখে জল” বলে, যে সব ঠাট্টা বিদ্রূপ করত, তোমার চোখের জল দেখে, সে সব বন্ধ হয়ে যাবে!

কুমীরঃ  এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী, গিন্নি?

কুমীরীঃ খুব সহজ। ওই কুচুটে বাঁদরটাকে মেরে ফেললেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে। বরং কুমীরেরা তোমাকে ধন্য ধন্য করবে!

কুমীরঃ  ধন্য ধন্য করবে? কী বলছো, গিন্নি?

কুমীরীঃ ঠিকই বলছি। এখন পর্যন্ত কুমীরের দল, অনেক জন্তু জানোয়ারের স্বাদ পেলেও, বাঁদরের স্বাদ খুব একটা পায়নি মনে হয়। একে তারা গাছে থাকে, আর খুব সেয়ানা হয়, তাদের ধরা কুমীরের পক্ষে বেশ শক্ত!

কুমীরঃ  তাতে কী?

কুমীরীঃ [মুচকি হেসে] তাতেই আমাদের কপাল খুলে যাবে! ধরো বাঁদরটাকে তুমি মেরে আনলে, তারপর বাঁদরের মাংসের টুকরো আমরা পাড়ার মাতব্বর কিছু কুমীরকে, স্কুলের হেড দিদিমণির বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম।

কুমীরঃ  তাতে লাভ কী হবে?

কুমীরীঃ বুঝলে না? পাড়ার লোক বুঝবে, বাঁদরটাকে ধরার জন্যেই তুমি এতদিন, বন্ধু সেজে, ওই সব ছাই-পাঁশ ফল-টল খাচ্ছিলে! লোকে তোমার বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে, দেখে নিও।

কুমীরঃ  যা বললে সেটা হয়তো ঠিকই বললে! কিন্তু আমি সত্যিই বাঁদরকে বন্ধু বলে মনে করি। আমি বাঁদরকে কোনমতেই মারতে পারবো না।

কুমীরীঃ সে আমি জানি, তুমি শুধু তাকে এখানে নিয়ে এসো, তোমাকে আর কিচ্ছু করতে হবে না। তারপর যা করার আমিই করবো।

কুমীরঃ  কিন্তু, বন্ধু হয়ে বন্ধুর সঙ্গে এমন শয়তানী করা উচিৎ হচ্ছে না, গিন্নি!

কুমীরীঃ তুমি তো কিছু করছো না গো, তুমি শুধু নেমন্তন্ন করে ডেকে আনবে।

কুমীরঃ  নেমন্তন্ন করলেই চলে আসবে! প্রথম কথা সে সাঁতার জানে না। তার ওপর আমরা যে মাংস ছাড়া কিছুই খাই না, সেও সে জানে! আমরা তাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো কী? নেমন্তন্ন করলেই সন্দেহ করবে।

কুমীরীঃ ধুর বাবা, তুমি বড্ডো বোকা। নেমন্তন্ন মানে বলবে, “আমাদের ও পাড়েও অনেক গাছপালা আছে, তাতে অনেক রকম ফলও ফলে। আমরা তো ফল চিনি না, আর ফল পাড়তেও পারি না। বন্ধু, তুমি যদি আমাদের ওখানে গিয়ে ফলগুলো চিনিয়ে দাও, আর কিছু পেড়ে দাও, তাহলে খুব উপকার হয়। আমাদের ওখানে সারাদিন থেকে, তুমিও যতো খুশি ফল খাবে, তারপর বিকেল হলে তুমি এপাড়ে ফিরে আসবে”!

কুমীরঃ  ওফ্ তুমি তো আমার প্রথম কথাটা শুনলেই না, ও আসবে কী করে? ও তো সাঁতারই জানে না!

কুমীরীঃ ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় গো, উপায় হয়। বাঁদর এমন কী আর বড়ো আর ভারি হয়? তুমি পিঠে চাপিয়ে নিয়ে চলে আসবে। নিয়ে আসতেই তোমার যা একটু কষ্ট হবে। তারপর আমরা তো সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েই নেব। পিঠের ভার, পেটে এলে, দেখবে মন্দ লাগবে, না গো!

কুমীরঃ  হুঁ, যে ফন্দি তুমি বের করেছো, তাতে আমার বন্ধু, বাঁদর বিশ্বাস করে নেবে এবং সত্যিই চলে আসবে।

কুমীরীঃ আসবে গো আসবে। নিশ্চয়ই আসবে দেখে নিও। ওফ্, আমার যা আনন্দ হচ্ছে না! সারা জীবন মিষ্টি মিষ্টি ফল খেয়ে তোমার বন্ধুর কলজেটার যা স্বাদ হয়েছে, ভাবতেই আমার জিভে জল আসছে গো!

কুমীরঃ  [খুব মনমরা মুখে] সেই তো মানলে, যে ফল খেতে মিষ্টি আর মজাদার!

কুমীরীঃ বাজে কথা বকো না তো। তোমার ওই ফলের জন্যে ছেলেমেয়েদের, আমাদের ভবিষ্যৎ-টবিষ্যৎ - সব জলাঞ্জলি দেবো নাকি? যা বললাম, তা যদি না করেছো, তাহলে আমি কালই ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো। তখন থেকো তোমার মিষ্টি ফল আর প্রাণের বন্ধুকে নিয়ে।

[দুমদুম পা ফেলে, মুখ হাঁড়ি করে, কুমীরী বেরিয়ে গেল অন্য জলায়।] 

কুমীরঃ  [দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল] হায় বন্ধু, আমাদের এই বন্ধুত্ব না হলেই ভালো হত। ছি ছি বন্ধু হয়ে বন্ধুকে কী বিপদেই ফেললাম!!

 

তৃতীয় দৃশ্য

 

[প্রথম দৃশ্যের নদীর পাড়। পাড়ে বসে বাঁদর। নদী থেকে মাথা তুলল কুমীর।]

বাঁদরঃ  গুডমর্নিং, কুমীরভাই। আজ একটু দেরি করে ফেললে, আসতে!

কুমীরঃ  হ্যাঁ, ঘরের কিছু কাজকর্ম সেরে আসতে, একটু দেরি হল।

বাঁদরঃ  খুব কাজের চাপ, নাকি বন্ধু? মুখটাও কেমন ভার ভার দেখছি!

কুমীরঃ  মুখভার? না না মুখভার হবে কেন? এই তো হাসছি। আজ আমাদের ওখানে তোমার নেমন্তন্ন, আমার সঙ্গে তোমাকে একবার যেতেই হবে বন্ধু।

বাঁদরঃ  ওয়াও, অনেকদিন নেমন্তন্ন খাইনি! কিসের নেমন্তন্ন, ভাই? বিবাহ-বার্ষিকী নাকি ছেলেমেয়ের জন্মদিন? তা কী কী খাওয়াবে গো, বন্ধু?

কুমীরঃ  আমরা তো মাংস খাই, সে তো তুমি খাবে না, বন্ধু। তাই আমার বউ বলল, আমরা যে জলা জঙ্গলে থাকি সেখানেও তো অনেক ফল-ফুলুরির গাছ আছে। সে সব ফলের কোনটা খাদ্য কোনটা অখাদ্য, সেও তো আমরা জানি না। তুমি একবার গিয়ে আমাদের চিনিয়ে দেবে, আর ওই সঙ্গে তুমি নতুন নতুন ফলও খেয়ে আসতে পারবে পেট ভরে।

বাঁদরঃ  কথাটা মন্দ বলোনি, কিন্তু যাবো কী করে? আমি তো সাঁতারই জানি না।

কুমীরঃ  ধুর বাবা, আমি থাকতে ও নিয়ে তুমি ভাবছো কেন? আমার পিঠে চেপে পড়বে, নৌকোর মতো ভেসে ভেসে, হাওয়া খেতে খেতে দিব্যি আরামে যাবে আর আসবে।

বাঁদরঃ  হে হে এত করে যখন বলছো, তখন তো যেতেই হয়। কিন্তু আজ তো অনেক দেরী হয়ে গেল, আজ কী আর হবে, বরং কাল একটু সকাল সকাল চলে এসো, কাল বেরিয়ে পড়বো দুই বন্ধুতে।

কুমীরঃ  না না বন্ধু, আজই যেতে হবে, আমার বউ আরো অনেককে বলে রেখেছে, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে -  তারা সব এসে বসে থাকবে যে!

বাঁদরঃ  [জনান্তিকে] হঠাৎ হুটোপাটি করে কিসের নেমন্তন্ন কে জানে? গতিক সুবিধের ঠেকছে না। কিন্তু যেভাবে উৎসাহ দেখাচ্ছে, না করাও বেশ মুশকিল।

কুমীরঃ  কী এতো ভাবছো, বলো তো, বন্ধু? একেবারে চুপ মেরে গেলে যে? বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর বাড়ি যেতেও তোমার এত ভাবনা?

বাঁদরঃ  না না, ভাবনা আর কিসের? চলো তবে যাওয়া যাক

[পাড় থেকে নেমে, বাঁদর কুমীরের পিঠে উঠে বসতেই, কুমীর জলে নামল প্রথম প্রথম একটু ভয় ভয় লাগলেও পরে বেশ মজাই লাগল বাঁদরের!]

কুমীরঃ  কেমন লাগছে, বন্ধু? ভয় লাগছে না তো? হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসো, বন্ধু। আমার পিঠটা তেমন ছোট তো নয়

বাঁদরঃ  না, না বন্ধু, তোমার মতো বন্ধু থাকতে আবার ভয় কীসের? আর সত্যিই, নদীর মাঝখান থেকে দুই পাড় যে এত সুন্দর দেখায়, তোমার সঙ্গে না এলে জানতেই পারতাম না!

কুমীরঃ  তবে? আমার সঙ্গে এসে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হল বলো?

বাঁদরঃ  তা হলো। কিন্তু আজকে আমার কিসের জন্যে নেমন্তন্ন সেটা বললে না তো, বন্ধু?

কুমীরঃ  কিসের নেমন্তন্ন? বন্ধুর বাড়ি বন্ধু যাচ্ছে, তাতে আবার কারণ দরকার হয় নাকি?

বাঁদরঃ সে কথা একশ বার। কিন্তু তুমি বললে না, আজকে আমার নেমন্তন্ন! কিসের নেমন্তন্ন সেটা জানলে একটু সুবিধে হতো!

কুমীরঃ  কিসের সুবিধে?

বাঁদরঃ  বাঃরে, প্রথম দিন তোমার বাড়ি যাচ্ছি নেমন্তন্ন খেতে, খালি হাতে যাওয়া ভাল দেখায় না, বন্ধু।

কুমীরঃ  খালি হাতে মানে?

বাঁদরঃ মানে কোন উপহার-টুপহার নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল আর কী! ধরো ছেলে-মেয়ের জন্মদিন হলে, একটা দুটো চকোলেট। অথবা বিবাহ-বার্ষিকী হলে বৌদির জন্যে এক গোছা ফুল...

কুমীরঃ ভুল করছো, বন্ধু, মস্তো বড়ো ভুল। সত্যি কথাটা তাহলে তোমাকে বলেই ফেলি। তোমাকে মিথ্যে বলতে আমার ভালোও লাগছে না!

বাঁদরঃ মিথ্যে কথা? কী মিথ্যে কথা, বন্ধু? [ভয়ে বুক কেঁপে উঠল বাঁদরের]

কুমীরঃ নেমন্তন্ন-টেমন্তন্ন কিচ্ছু না। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি...

বাঁদরঃ  নেমন্তন্ন নয়? তাহলে কী?

কুমীরঃ আমার বউ তোমার দেওয়া মিষ্টি ফল খেয়ে খুব খুশী হয়েছে। তার ধারণা, সারাজীবন এমন মিষ্টি মিষ্টি ফল খেয়ে তুমিও নিশ্চয়ই মিষ্টি হয়ে উঠেছো!

বাঁদরঃ  আমি মিষ্টি হয়ে উঠেছি? যাঃ, কোনদিন টের পাইনি তো!

কুমীরঃ  তুমি না পেলে কী হবে? আমার বউ টের পেয়েছে! তার খুব ইচ্ছে আজ তোমার কলজে খাবে...

বাঁদরঃ  কী খাবে? [বাঁদরের মাথা ঘুরতে লাগল, কোন রকমে বলল]

কুমীরঃ   কলজে, কলজে...মানে হৃৎপিণ্ড!

[ভয়ে বাঁদরের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। কী সর্বনাশ। এখন কী উপায়? মাঝনদীতে সে বসে আছে মস্তো এক কুমীরের পিঠে, সেখান থেকে পালাবার কোন উপায় নেই! জলে ঝাঁপ দিলেও কুমীর অনায়াসে ঝপ করে কামড়ে ধরবে! কী করা যায়, ভাবতে লাগল, বাঁদর। এদিকে অনেকক্ষণ সাড়া না পেয়ে কুমীর বলল,]

কুমীরঃ  কী হল? চুপ করে গেলে যে? কিছু বলছো না তো! ভয় পেলে নাকি? ভয় কী? আর মিনিট পাঁচেক গেলেই আমার বাসা, সেখানে গেলেই আমার বৌ তোমার গলাটা টিপে দেবে...ব্যস্‌, ভয়-ভরসা সব মিটে যাবে, বন্ধু। 

বাঁদরঃ  হো হো হো হো [হাসতে হাসতে বাঁদর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠল কুমীরের পিঠে] হো হো হো হো...

কুমীরঃ [অবাক হয়ে] পাগল হয়ে গেলে নাকি? বন্ধু, এত হাসছো কেন?

বাঁদরঃ  হো হো হো হো ...

কুমীরঃ কী বিপদ, কেন হাসছো বলবে তো?

বাঁদরঃ এ কথাটা তুমি আমাকে আগে বলতে পারলে না? হা হা হা হা হা, হাসবো না তো কী?

কুমীরঃ  কোন কথাটা?

বাঁদরঃ  হো হো হো হো ...ওই ওই ... আমার কলজের কথাটা।

কুমীরঃ  কেন...কী হতো বললে?

বাঁদরঃ কী হতো? তুমি যে এতটা মুখ্যু আমি বুঝতেই পারিনি, বন্ধু। বাঁদরেরা বুঝি সর্বদা কলজে নিয়ে ঘোরে?

কুমীরঃ  তার মানে?

বাঁদরঃ  বলি বাঁদরের কলজে কটা হয়?

কুমীরঃ  একটাই তো হয়!

বাঁদরঃ তবে? আমরা যে গাছের এডালে ওডালে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াই, যদি হাত ফস্কে পড়ে যাই?

কুমীরঃ  হাত - পা ভাঙবে, সে আর আশ্চর্য কী?

বাঁদরঃ  আজ্ঞে না, স্যার, হাত-পা ভাঙলে সেরে যায়, তার জন্যে আমরা চিন্তা করি না। চিন্তা করি কলজের জন্যে। পড়ে গিয়ে কলজেটা ফাটলেই – শেষ, অক্কা।

কুমীরঃ  তাহলে?

বাঁদরঃ তাহলে? কলজেটা খুলে গাছের কোটরে আমাদের বাসায় রেখে দিই। তারপর গাছে গাছে লাফালাফি করি।

কুমীরঃ  তারপর?

বাঁদরঃ  তারপর আবার কী? সন্ধেয় ঘরে ফিরে কলজে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। রাত্রিবেলা ছাড়া কলজের দরকারই বা কী?

কুমীরঃ  তাই? তার মানে, তোমার কাছে এখন কলজে নেই?

বাঁদরঃ  হা হা হা হা, সেই থেকে কী বলছি কী তোমায়? আর হাসছিই বা কেন? তুমি যদি তখনই বলতে তোমার মিষ্টি বৌ আমার মিষ্টি কলজে খেতে চেয়েছে, তখনই তোমায় দিয়ে দিতাম!

কুমীরঃ তাই বুঝি? তাহলে এখন উপায়?

বাঁদরঃ  উপায় আর কী? আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। নয়তো আমার কলজেহীন ফাঁপা শরীরটা পেলে তোমার বউ খুব দুঃখ পাবে - হয়তো কেঁদেই ফেলবে, বেচারি!

কুমীরঃ  কাঁদবে না, ছাই! গাল দিয়ে আমার ভূত তাড়াবে! না হে, বন্ধু, চলো ফিরেই যাই।

বাঁদরঃ  সেই ভালো। একটু দেরি হয়তো হবে, কিন্তু কলজেটা পেয়ে যাবে!

[কুমীর ঘুরে উল্টোমুখে সাঁতার দিতে লাগল।]

কুমীরঃ  ভাগ্যে তোমায় সময় থাকতে বলেছিলাম, বন্ধু, তা না হলে ঘরে আজ কী অশান্তিটাই না হতো!

বাঁদরঃ  যাই বলো, আর তাই বলো, বন্ধুতুমি কিন্তু আমাকে সত্যিকারের বন্ধু বলে মনে করো না!

কুমীরঃ  কেন কেন? এ কথা বলছো কেন?

বাঁদরঃ প্রথমেই আমায় যদি সব কথা খুলে বলতে, তাহলে এই হয়রানি হতো, বলো?

কুমীরঃ সে কথা সত্যি! আমার খুব ভুল হয়ে গেছে, বন্ধু!

বাঁদরঃ  যাগ্‌গে, যা হবার হয়ে গেছে, এখন তাড়াতাড়ি চলো, দেরি দেখে, ওদিকে তোমার বৌ আবার উতলা হয়ে উঠবে। [বাঁদরের কথায় কুমীর সাঁতারের গতি বাড়ালো। নদীর পাড়ে তার গাছটাকে দূর থেকে দেখতে দেখতে বাঁদরের বুক মানে কলজে দ্রুত ধুক ধুক করতে লাগল। পাড়ের কাছাকাছি এসে পড়ার পর, কুমীর জিগ্যেস করল,]

কুমীরঃ  আচ্ছা, বাঁদর ভাই, কলজে ছাড়া কোন জীব বাঁচতে পারে?

বাঁদরঃ হা হা হা হা, কী যে বলো তার কোন মাথামুণ্ডু বুঝি নাকলজে ছাড়া যদি বাঁচা না যায় তো, আমি রয়েছি কী করে?

[নদীর পাড় এসে যাওয়াতে, বাঁদর বিশাল লাফ দিয়ে কুমীরের পিঠ থেকে লাফ মারল পাড়ে, সেখান থেকে তরতরিয়ে উঠে গেল গাছের মগডালে। আরাম করে গাছের মগডালে বসে লেজ দুলিয়ে বলল]

         ওরে হতভাগা কুমীর, শুধু কলজে নয়, মগজ ছাড়াও দিব্যি বেঁচে বর্তে থাকা যায়! তা নইলে তোদের মতো শয়তান কুমীরকে বিশ্বাস করে, আমি তোর পিঠে চড়তে যাই? আর ভাগ্যে তুইও মগজ ছাড়াই জন্মেছিস, নইলে কী আর আমার কলজের কথায় বিশ্বাস করে, ফিরে আসতিস? যাঁরা বলেন সমানে সমানে ছাড়া বন্ধু হয় না, তাঁরা ঠিকই বলেন, তাঁরা সত্যিকারের পণ্ডিত! তাঁদের কথা না শুনলে, আমার মতোই বিপদে পড়তে হয় রে, বজ্জাত কুমীর। যা, এবার কেটে পড়, কোনদিন যদি তোকে আর এপাড়ে দেখি, পাথর ছুঁড়ে তোর মাথা ভাঙবো, এই বলে রাখলাম!

 

[কুমীর ডুব দিল জলে। পর্দানেমে এল।]

 


   




শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

নতুন গাড়ি

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলেডান দিকের কলামে

"ফলো করুন" 👉

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন।

এই ব্লগটি আপনি মোবাইলে পড়লেস্ক্রিন ডিসপ্লে মোডটি ডেস্কটপ মোডে চেঞ্জ করে নিলে

ডানদিকের কলমটি নজরে আসবে।]

 

 বীরভূম জেলার মুচকুন্দপুরে অজিতেশবাবুর এই পৈতৃক বাড়ির আমেজই আলাদা। হাতপা ছড়ানোর মতো বিস্তর জমি-জায়গা নিয়ে বিশাল এই বাড়িটা শ দেড়েক বছরের পুরোনো অজিতেশবাবু এবং তাঁর স্ত্রী সরযূদেবী সারা জীবন চাকরিসূত্রে কলকাতা আর পাটনায় ছিলেন ঠিকই, কিন্তু এ বাড়ির সঙ্গে তাঁদের সংযোগ কোনদিনই ছিন্ন হতে দেননি। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর তাঁরা দুজন পাকাপাকিই এ বাড়িতে এসে বসবাস করছেন। যদিও ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের কর্মস্থলে। দুই ছেলের মধ্যে বড়োটি থাকে দিল্লিতে, আর ছোটোটি ব্যাঙ্গালুরুতে। একমাত্র মেয়ে থাকে মুম্বাইতে, জামাই ওখানে চাকরি করে।

বিশাল এই বাড়িতে সারা বছর তাঁরা সব মিলিয়ে থাকেন সাতটি প্রাণী। সস্ত্রীক অজিতেশবাবু, সরযূদেবীর এক বোনপো পথিক। রান্নাবান্না করার জন্যে মালতী, ঘরদোর পরিষ্কার রাখার জন্যে লক্ষ্মী পাহারা দেওয়া এবং বাজার হাট করে দেওয়ার জন্যে মাধব আর বাগানের গাছপালা দেখাশোনা করে রামখিলাওন। পথিক ছাড়া অন্য সবাই এ বাড়িতে অনেকদিন ধরেই রয়েছেন, যার ফলে ওঁনারাও এ বাড়ির এবং এই পরিবারেরই সদস্য হয়ে গেছেন বহুদিন।

বড়দিনের ছুটিতে অজিতেশবাবুর নির্জন এই বাড়িটা প্রত্যেকবারই বেশ জমে ওঠে। ওই সময় নাতি-নাতনীদের স্কুলে ছুটি থাকে, দুই ছেলে ও দুই বৌমা এবং মেয়ে-জামাইও এ সময় অফিস থেকে দিন দশেকের ছুটি নেয়। আগের দিন ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছে, সকালের ট্রেন ধরে, হৈচৈ করতে করতে ওরা কলকাতা থেকে এসে উপস্থিত হয়স্টেশন থেকে ওদের আনতে অজিতেশবাবু গাড়ি পাঠান। বাতের ব্যথাটা আয়ত্ত্বে থাকলে কোন কোন বার নিজেই যান গাড়ি নিয়ে। বাড়িতে ঢুকেই বাচ্চা নাতি-নাতনীগুলো এমন আনন্দ আর হৈচৈ শুরু করে, অজিতেশবাবুর মনটা ভরে ওঠে। সারা বছর তিনি এই দিনগুলোর প্রতীক্ষাতেই থাকেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সরযূদেবী এত খুশী হন, এ কটাদিনের অনভ্যস্ত বাড়তি পরিশ্রমকেও গায়ে মাখেন না।

প্রত্যেকবারই অন্ততঃ দিন তিনেক তাঁরা সব্বাই মিলে, ময়ূরাক্ষীর ধারে পিকনিক করতে যান। সক্কাল সক্কাল খাবার-দাবার বানিয়ে দুটো গাড়ি ভাড়া করে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। নদীর পাড়ে সারাদিন খেলাধুলো, আড্ডা, গল্প করে, বিকেলের দিকে ফিরে আসেন। বেশ মজায় কাটে দিনগুলো, বিশেষ করে ছোটদের ফূর্তি আর আনন্দের কোন সীমা থাকে না। অজিতেশবাবু আর সরযূদেবী ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু শতরঞ্চিতে বসে বসে ওদের লাফালাফি আর হৈচৈ করতে দেখে ভারি আনন্দ পান।

তবে প্রতিবারই ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভারগুলো কিছু না কিছু ঝামেলা পাকায়। সকাল থেকে বিকেল অব্দি বসে থাকতে তাদের ভালো লাগে না। তাদের দুপুরের খাবারও পছন্দ হয় না, আর দুপুর থেকেই ফেরার জন্যে তাগাদা দিতে থাকে তাদের কোন না কোন অজুহাতের আর শেষ নেই! চাকায় হাওয়া কম আছে। ঠিকঠাক ব্রেক ধরছে না। বাঁদিকের হেডলাইটটা জ্বলছে না, রাত হয়ে গেলে অন্ধকারে গাড়ি চালাতে অসুবিধে। একটা না একটা কিছু থাকবেই!

এ বছর অজিতেশবাবুর প্ল্যান রয়েছে সব্বাইকে বেশ একটু চমকে দেবেন। তিনি বেশ জব্বর একটা এসইউভি গাড়ি বুক করেছেন। সেটার ডেলিভারি দেওয়ার ডেট ছিল গত পরশু। কিন্তু সে আর হয়নি। যথারীতি তারা দুঃখ-টুঃখ পেয়ে, ক্ষমা-টমা চেয়ে, দুদিন পিছিয়ে আজ শনিবার ডেলিভারি দেবে বলেছে। ওদিকে ছেলেমেয়েরা পৌঁছচ্ছে আগামিকাল, সকাল দশটা, সাড়ে দশটা নাগাদ। তিনি ভেবেছিলেন, পথিককে সঙ্গে নিয়ে, নিজেই শহরে যাবেন গাড়ি ডেলিভারি নিতে। কিন্তু আজ সকালে উঠে দেখলেন, শরীরটা তাঁর ভালো নেই। সারা গায়ে, হাতে-পায়ে ব্যথা, গলাটাও খুসখুস করছে, একটু যেন জ্বর-জ্বর ভাবতিনি তাও হয়তো বেরিয়ে পড়তেন, কিন্তু সরযূদেবী বেরোতে দিলেন না। বললেন, “আজকের দিনটা বিশ্রাম নাও, বরং কাল সকালে গাড়ি নিয়ে ওদের স্টেশনে আনতে যেও। আজ এবং কাল, পরপর দুদিন, এতটা পথ উজিয়ে যাওয়া-আসার ধকলে শরীর খারাপ বাড়লে, সকলের ছুটির মজাটাই মাটি হয়ে যাবে”এই গ্রাম থেকে শহরের দূরত্ব পায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার। সেখানেই রেলস্টেশনও। কাজেই তাঁর এই বয়সে পরপর দুদিন এতটা পথ যাওয়া-আসা মোটেই সহজ কাজ নয়। অতএব স্ত্রীর কথাটা অজিতেশবাবু মেনে নিলেন এবং ঠিক হল পথিক একাই যাবে এবং শোরুম থেকে একজন ড্রাইভার নিয়ে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ি আসবে। কথা হয়ে আছে শোরুমের ওই ড্রাইভারই এ কটা দিন এ বাড়িতেই থাকবে। 

 

গাড়ির ডেলিভারি নিতে পথিক শোরুমে পৌঁছে গেল সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ। কাগজপত্র সইসাবুদ হয়ে, গাড়িতে হাই-সিকিউরিটি নাম্বার প্লেট লাগিয়ে, গাড়ি রেডি হল প্রায় সাড়ে চারটে নাগাদ। তারপর শোরুমের ড্রাইভার, গোবিন্দবাবু গেল, দিন দশেক বাইরে থাকার মতো, বাড়ি থেকে জামাকাপড় আনতেফিরল প্রায় পৌনে ছটা নাগাদ। সব ঝামেলা মিটিয়ে নতুন গাড়ি রাস্তায় নামল যখন, তখন ঘড়িতে সোয়া ছটা। ডিসেম্বরের শেষে দিন খুবই ছোট, ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে সন্ধে নেমে এসেছে অনেকক্ষণ। শোরুম থেকে বেরিয়েই তারা প্রথমেই পেট্রল পাম্পে ঢুকল। সেখান থেকে ট্যাংকি ফুল করে তেল নিয়ে, গাড়ি মুচকুন্দপুরের দিকে রওনা হল যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন পৌনে সাতটা। পেট্রলপাম্প থেকে বেরিয়েই পথিক ফোন করে মেসোমশাইকে জানাল তারা রওনা হয়ে পড়েছে। বাড়ি পৌঁছতে খুব জোর ঘন্টা দুয়েক লাগবে। অজিতেশবাবু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “যাক বাবা, শেষ অব্দি গাড়ি হাতে এসেছে! সাবধানে আয়। তাড়াহুড়ো করিস না, একটু বেশি সময় লাগে তো লাগুক। এদিকের রাস্তাটা তেমন সুবিধের নয়” পথিক বলল, “ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, মেসোমশাই, আমি সাবধানেই আসব”।

পথিক ফোনটা বন্ধ করার পরেই গোবিন্দবাবু, শহরের ঘিঞ্জি রাস্তায় ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, “পথিকদা, নতুন গাড়ি কিনলেন পুজো দেবেন না? সবাই দেয় কিন্তু”। পুজোর ব্যাপারটা পথিকের মাথাতেই আসেনি। একটু চিন্তা করে পথিক বলল, “তা ঠিক। কিন্তু সে পরে দেখা যাবে। বাড়ি গিয়ে মাসিমা পুজো-টুজো যা করার করবেন, এখন সোজা বাড়িই চলুন”

গোবিন্দবাবু ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, “আপনাদের যেমন ইচ্ছে”।

শহরের সীমানা থেকে তিন-চার কিলোমিটার রাস্তার দুধারে খাপছাড়া কিছু বসতি রয়েছে, তারপর থেকেই শুরু হল জঙ্গল। রাস্তায় লোকজন কিংবা অটোরিকশ, সাইকেল রিকশ না থাকাতে বেশ ফাঁকা হয়ে গেল রাস্তা। গোবিন্দবাবু এবার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে তুললেন পঞ্চাশের ওপর। আরো মিনিট কুড়ি পঁচিশ যাওয়ার পর রাস্তা সম্পূর্ণ নির্জন হয়ে গেল, মাঝে মাঝে দু একখানা ট্রাক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সাঁৎ সাঁৎ করে। রাস্তার দুপাশে বেশ গভীর জঙ্গল। হেডলাইটের আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে তার বাইরে ঘন অন্ধকার। এ রাস্তায় গোবিন্দবাবু গাড়ির স্পিড তুললেন আশি-নব্বইয়ের কাছাকাছি।

গাড়ির এত স্পিড দেখে পথিক একটু ঘাবড়ে গেল, বলল, “এতটা স্পিডে না চালালে হত না, গোবিন্দবাবু? একটু পরেই বড়ো রাস্তা ছেড়ে, আমাদের ডানদিকে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকতে হবে। অন্ধকারে জায়গাটা চিনতে ভুল হলে, মুশকিল”।

গোবিন্দবাবু সামনের দিকে স্থির নজর রেখে, হেসে বললেন, “মুচকুন্দপুর আমি অনেকবার গিয়েছি, ও রাস্তা আমার হাতের তালুর মতো চেনা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পথিকদা, কিচ্‌ছু ভুল হবে না”।

আরো মিনিট পনের চলার পর গোবিন্দবাবু গাড়ির স্পিড কমিয়ে ডানদিকে সিগ্ন্যাল দিল। তারপর বেশ কিছুটা গিয়েই ডানদিকে ঘুরিয়ে দিল গাড়িটা, তারপর বলল, “কী পথিকদা? ঠিক আছে? ভুল করিনি তো?” ব্যাপারটা এমনই চট করে ঘটে গেল, পথিক ঠিক ঠাহর করতে পারল না।

তার মনে কেমন যেন খটকা লাগল। বলল, “মোড়ের বাঁদিকে একটা বড়ো বটগাছ ছিল? যার তলাটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো?” এই রাস্তাটা বড়ো রাস্তার মতো মসৃণ নয়, পিচের রাস্তাই তবে একটু এবড়ো-খেবড়ো। গাড়ি লাফাচ্ছে, তিরিশের বেশি স্পিডে চালাতে পারছেন না, গোবিন্দবাবু।

তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “বটগাছ তো দেখিনি। আমি তো শুধু রাস্তা দেখছি!”

পথিক বলল, “আমার কিন্তু এ রাস্তাটা চেনা মনে হচ্ছে না, গোবিন্দবাবু। রাস্তা ভুল হয়েছে...”।

“এ রুটে গোবিন্দলাল মিদ্দার রাস্তা ভুল হবে? আপনি হাসালেন, পথিকদা...” বলেই হা হা করে হাসতে লাগলেন খুবএই সময়েই গাড়ির হেডলাইট দুটো নিভে গেল ঝপ করে। সামনে পেছনে এবং দুপাশে গভীর অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, প্রায়। গোবিন্দবাবু খুব অবাক হয়ে গাড়ি থামালেন। হেডলাইটের লিভারটা কয়েকবার নাড়াচাড়া করলেন, কোন লাভ হল না।

তারপর দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললেন, “কী ব্যাপার হল?”

পথিক বলল, “তখনই বললাম, এত স্পিডে গাড়ি চালাবেন না, ঝাঁকুনিতে লাইটের তার-টার খুলে গেছে হয়তো”। 

“আনকোরা গাড়ির তার খুলে গেছে, বললেই হল? টিভিতে এ গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখেননি? পাহাড়ি রাস্তায় কেমন নাচতে নাচতে দৌড়োয়? একখুনি ঠিক হয়ে যাবে। একটু চেক করে নিই...”গোবিন্দবাবু বনেট খুলে, আলো জ্বেলে মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে দিলেন ভেতরে। তারপর কী সব খুটখাট করতে লাগলেন

পথিকও এবার গাড়ি থেকে নামল। বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁর শব্দ। কোন একটা পাখি কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর একসুরে ডেকে চলেছে, টুইট, টুইট, টুইট...। পথিকের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। হেডলাইট যদি না জ্বলে, কী করে গাড়ি চালানো যাবে? সারারাতই তাদের এই জঙ্গলেই থাকতে হবে নাকি? অসহায় ভাবে সে একবার মুখ তুলে তাকাল, আর তখনই আকাশের এপার থেকে ওপার, ফালাফালা করে দিল বিদ্যুতের সুদীর্ঘ নীল ঝলক। আর সেই সঙ্গে জ্বলে উঠল, গাড়ির হেডলাইট। কয়েক মূহুর্ত পরেই, আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত গড়িয়ে গেল ভীষণ ভারি একটা লোহার গোলা – দেখা গেল না, কিন্তু আওয়াজ পাওয়া গেল গুম, গুম, হুড়ুম, গুড়ুম, গুম, গুম...পথিক কেমন শিউরে উঠল। অসময়ে এসব কী হচ্ছে? আজ সারাদিন মেঘ-টেঘের কোন বালাই ছিল না, সারা দিনটা শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে ঝলমল করছিল। কখনই বা এমন মেঘ জমে উঠল, আর এমন ভয়ংকর গর্জন করতে শুরু করল? গোবিন্দবাবু বনেট ফেলে দিয়ে বললেন, “উঠে পড়ুন, পথিকদা, লাইট ঠিক হয়ে গেছে”। পথিক এবং গোবিন্দবাবু দুজনেই গাড়িতে উঠল, এবং গাড়ি স্টার্ট করতে না করতেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি।  গাড়ি চলতে লাগল, কিন্তু ওয়াইপার চালিয়েও উইণ্ডস্ক্রিন থেকে বৃষ্টির ধারা মোছা যাচ্ছিল না, মনে হচ্ছে কেউ যেন বড় হোসপাইপ থেকে হুড় হুড় করে জল ঢালছে, কাচের ওপর।

পথিকের গলা শুকিয়ে গেল, খসখসে গলায় বলল, “বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করে এ কী বৃষ্টি রে, বাবা?”

“প্রকৃতির খেয়াল, ও কী আর আমার আপনার হাতে?” খুব ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে গোবিন্দবাবু বললেন। কিছুক্ষণ গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে চলতে গাড়িটা হঠাৎ যেন জোর ধাক্কা খেল কিছুর সঙ্গে। বীভৎস আওয়াজ করে ঝাঁকিয়ে উঠল গোটা গাড়িটা।

পথিক আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল, “কী করছেন কী? ব্রেক করুন, গাড়ি থামান!”

গোবিন্দবাবুও অসহায়ভাবে বলে উঠলেন, “ব্রেক চেপে মেঝেয় ঠেকিয়ে দিয়েছি, গাড়ি দাঁড়াচ্ছেই না। মনে হয় ব্রেক ফেল হয়েছে”এ জায়গায় রাস্তাটা বেশ কিছুটা ঢালু। গাড়ি নিচের দিকে গড়াতে লাগল বেশ জোরেই...এবং তার সঙ্গে মড়মড় কড়কড় ধাতব শব্দে, খুলে গেল গাড়ির ছাদ। কেউ যেন চেঁছে দিল গাড়ির মাথাটা। ওরা গাড়িতে বসে আছে, গাড়ি চলছে, কিন্তু মাথার ওপরে কোন ছাদ নেই। পথিক বিস্ময়ে আর আতঙ্কে মাথায় হাত দিল, বলে উঠল “সর্বনাআআআশ”। ওদিকে গোবিন্দবাবু তখনো গাড়িটাকে থামানোর চেষ্টা করছেন, হ্যান্ডব্রেকটাও টানছেন বারবার, কোন ফল হচ্ছে না। গাড়ি ঢালু রাস্তায় গড়িয়েই চলেছেখানা-খন্দে ভরা রাস্তায় গাড়িটা লাফাচ্ছেও বেশ।

মিনিট পাঁচেক এভাবে গড়িয়ে চলার পর গাড়িটা রাস্তার ধারের একটা বিশাল উইঢিবিতে গিয়ে ধাক্কা মারল, তারপর বিশ্রী একটা ঘ্যাস্‌স্‌স্‌ শব্দ করে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ির বাঁদিকের হেডলাইটের উপর ভেঙে পড়ল উইঢিবির মাথাটা, ঝুরঝুরে কাদা মাটিতে ঝাপসা হয়ে গেল, হেড লাইটের আলো।

 

 একটার পর একটা ঘটনা পর পর এমন ঘটছিল, পথিকের মাথা কাজ করছিল না। গাড়িটা থেমে যেতেই, সে দরজা খুলে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল এখন এতটুকুও বৃষ্টি হচ্ছে না। আরো আশ্চর্য, এতক্ষণ ছাদহীন গাড়ির ভেতরে বসেও তারা বৃষ্টিতে এতটুকুও ভেজেনি। গাড়িটার চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে আরো অবাক হয়ে গেল। চারপাশে বেশ আলো রয়েছে, একটু আবছা হলেও দেখা যাচ্ছে বেশ! চাঁদের আলো! আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভয়ে শিউরে উঠল, আকাশে কোত্থাও মেঘের লেশমাত্র নেই। বরং সেখানে হালকা কুয়াশা ঢাকা একাদশী বা দ্বাদশীর চাঁদ, ঝলমলে আলো না হলেও, ফ্যাকাসে আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে! মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল পথিকের।

সে গোবিন্দবাবুকে জিগ্যেস করল, “কী হচ্ছে বলুন তো?”

গোবিন্দবাবু জিভে চিক শব্দ করে বললেন, “ঝড়ে কোন গাছের ডাল হয়তো বেঁকে নিচু হয়ে এসেছিল। তাতে ধাক্কা খেতেই গাড়ির মাথাটা চেঁছে গেছে। আমার বাইশ বছরের ড্রাইভারি জীবনে এমন কাণ্ড কোনদিন হতে দেখিনি। তার ওপর নতুন গাড়িটাও বার বার কেন যে বিগড়োচ্ছে, তাও আমার ছাতার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না”!

গোবিন্দবাবুর কথায় আরও অবাক হল পথিক। তুমুল বৃষ্টি হল, কিন্তু ছাদভাঙা গাড়িতে বসেও তারা ভিজল না! প্রবল ঝড়ে গাছের ডাল নুয়ে পড়ল, কিন্তু মাথার ওপরে চাঁদের কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নার আকাশ! 

“এ গাড়ি কার?” পেছন থেকে হঠাৎ বাজখাঁই আওয়াজে দুজনেই চমকে উঠে ঘাড় ঘোরালো। পথিকের তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।

গোবিন্দবাবু কোন ক্রমে তোৎলাতে তোৎলাতে বললেন, “ইয়ে...এ গ্‌-গাড়ি, ম্‌মুচকুন্দপুরের অ-অজিতেশ ক্‌-কুণ্ডু চ্‌-চৌধুরিবাবুর। শোরুম থেকে নতুন নিয়ে বেরিয়েছিলাম, এখন ভাঙাচোরা...”।

“অ, খুদু? খুদুর গাড়ি? খুদু নতুন গাড়ি কিনল? বাঃ বেশ বেশ, আয়, তোরা আমার সঙ্গে আয়”। একথা বলেই বাজখাঁই গলাওয়ালা লোকটি জঙ্গলের ভেতরের দিকে হাঁটা লাগাল। গোবিন্দবাবু পথিকের হাত ধরে টানতে টানতে তার পিছু নিলেনলোকটার মাথায় ঝাঁকড়া সাদা চুল, মুখেও সাদা গোঁফ দাড়ি, চাঁদের আলোয় চিকচিক করছিল। পরনে একটা ছোট্ট ধুতি, সেটা সাদা নয়। হয়তো লাল, আবছা আলোয় ভালো বোঝা যাচ্ছে না। বেশ ঢ্যাঙা আর ডিগডিগে রোগা চেহারা। কিন্তু গলার আওয়াজ গমগমে।  লোকটা কে? কেনই বা তারা ওর কথা মতো পেছন পেছন দৌড়চ্ছে? সে কথা দুজনের কারও মাথাতেই এল না। দুজনেই ভূতে পাওয়া মানুষের মতো জঙ্গলের পায়েচলা সরু পথে লোকটার পেছন পেছন দ্রুত হাঁটতে লাগল।

বেশ কিছুটা যাওয়ার পর তারা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছল। একটু দূরেই দেখতে পেল একটা মন্দিরের আবছা কালো মতো অবয়ব। চাঁদের আলোয় আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে। লোকটা সেই মন্দিরের দিকেই যেন দৌড়চ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মন্দিরের কাছে পৌঁছল। ভাঙ্গাচোরা বহুদিনের পুরোনো কাঠামোর মন্দির। দরজার পাল্লা নেই। ভেতর থেকে হাল্কা আলো আসছে। লোকটা দরজার ভেতরে ঢুকে গেল। ওরা ঢুকল না, বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখল, কুলুঙ্গিতে একটা প্রদীপ জ্বলছে টিমটিম করে। সেই অল্প আলোতেই তারা দেখল ফাটা-চটা পাথরের বেদিতে এক দেবী প্রতিমা। হাত তিনেক উঁচু, কুচকুচে কালো তাঁর গায়ের রং।

গোবিন্দবাবু ফিসফিস করে পথিককে বললেন, “বিশালাক্ষী মা! আমরা তার মানে বিশালাক্ষীতলায় চলে এসেছি”!

পথিক কিছু বলার আগেই লোকটা দরজার সামনে এগিয়ে এল, পথিকের হাতে এক মুঠো তাজা জবাফুল তুলে দিয়ে একই রকম গমগমে গলায় বলল, “বাইরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? ভেতরে আয়। মায়ের পায়ে ভক্তিভরে পুজো দে, হতভাগা!”

ভয়ে পথিকের পা কাঁপছিল থরথর করেকোনরকমে এগিয়ে গিয়ে মায়ের মূর্তির সামনে হাঁটু মুড়ে বসল। হাতের জবাফুলগুলি দু হাতের অঞ্জলিতে ধরে তাকিয়ে রইল মায়ের মুখের দিকে। কতক্ষণ বসে ছিল তার মনেও নেই।

গোবিন্দবাবু তার কাঁধে হাত রাখতে পথিকের সম্বিৎ ফিরল। গোবিন্দবাবু ফিসফিস করে বললেন, “পথিকদা, মায়ের বেদিতে ফুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে শিগ্‌গির উঠে আসুনতাকিয়ে দেখুন কিচ্‌ছু নেই”পথিক তাকিয়ে দেখল, তার সামনে কোন প্রতিমা নেই। ঘরের মধ্যে জ্বলতে থাকা কোন প্রদীপ নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকটাও নেই। এমনকি মন্দিরের মাথার ওপর ছাদও নেই! চাঁদের ঝাপসা আলোয়, হা হা করছে শূণ্য ভাঙা মন্দির! পাথরের শূণ্য বেদিতে জবাফুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে, গোবিন্দবাবু আর পথিক ঊর্দ্ধশ্বাসে বেরিয়ে এল মন্দিরের বাইরে। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে ফাঁকা জমিটুকু পেরিয়ে দৌড়তে লাগল জঙ্গলের পায়ে চলা পথ দিয়ে।

মুচকুন্দপুরের বাড়িতে গাড়ি নিয়ে পথিক আর গোবিন্দবাবু যখন পৌঁছল তখন রাত সাড়ে এগারোটা। সদরের উঠোনে গাড়িটা রেখে পথিক দোতলায় উঠল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সরযূদেবী সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

পথিকের চেহারা দেখে সরযূদেবী রীতিমতো চমকে উঠলেন, চাপা গলায় বললেন, “কী রে? এ কি চেহারা তোর? কী হয়েছে?” 

সে কথার উত্তর না দিয়ে পথিক হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, বলল, “মাসিমা, সর্বনাশ হয়ে গেছে”।  

“আঃ কী হয়েছে, বলবি তো? নতুন গাড়ি ওরা দেয়নি? তাহলে নিচেয় গাড়ি আসার শব্দ শুনলাম যে”!

“নতুন গাড়ি তো দিয়েছে, কিন্তু যে গাড়ি নিয়ে এসেছি, সে ভেঙেচুরে একেবারে লজ্‌ঝড় হয়ে গেছে”

“কী বলছিস? কী করে হল? অন্য গাড়িকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে এসেছিস নাকি? দাঁড়া, তোর মেসোকে ডাকি। কী সর্বনাশ। একটা কাজ তোকে দিয়ে ঠিকমতো হয় না।”

“সে সব কিচ্ছু হয়নি, মাসিমা। পুরোটা না শুনলে বুঝতে পারবে না! সে এক অদ্ভূত ব্যাপার”।

“থাম, থাম। কোথায় কী সব সর্বনাশ ঘটিয়ে এসে, এখন অদ্ভূত গল্প শোনাবি?” মাসিমা রাগে থমথমে মুখে বললেন, “তোর মেসোকে খবর দিই। তিনিই যা করার করুন”।

ওঁদের কথাবার্তার মধ্যেই মেসোমশাই ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “কিসের সর্বনাশ হয়েছে? গাড়ি কোথায়, পথিক”?

“গাড়ি তো নিয়ে এসেছি, মেসোমশাই, কিন্তু তার অবস্থা সঙ্গীন। নিচেয় যাবেন? চলুন না। দেখলে বুঝতে পারবেন, কোন সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, বেশ ভুতুড়ে ব্যাপার। কি করে যে কী ঘটে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা”।

সবার আগে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অজিতেশবাবু বললেন, “আমরা আবার কে কে”?

পথিক বলল, “মানে, আমি আর গোবিন্দবাবু, শোরুমের ড্রাইভার”।      

অজিতেশবাবুর পিছনে নামছিলেন সরযূদেবী, তাঁর পিছনে পথিক। অজিতেশবাবু সরযূদেবীকে খুবই বিরক্তির সুরে বললেন, “তোমাকে বলেছিলাম কিনা, তোমার এই বোনপোটি একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছে? নেশা করে নতুন গাড়িটার বারোটা বাজিয়ে, এখন আমাদের ভূতের গল্প শোনাবে”।

পথিক খুব ব্যাকুল গলায় বলল, “মেসোমশাই, বিশ্বাস করুন, চা ছাড়া কোন নেশা আমি করি না। আর আমাদের আসার পথে যা ঘটেছে, সেটার মাথামুণ্ডু আমরা কিছুই খুঁজে পাইনি”।   

উঠোনের আলোটা খুব জোরদার নয়, তবুও সে আলোয় ঝলমল করছিল গভীর নীল রঙের নতুন গাড়িটা। সরযূদেবী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বাঃ, কী সুন্দর রং গো, ঠিক যেন ময়ূরকণ্ঠী। দারুণ হয়েছে। মনে হচ্ছে ময়ূরপঙ্খী নাও, এখনি আমাদের নিয়ে ভেসে পড়বে স্বপ্ন রাজ্যে”।

অজিতেশবাবু খুব তৃপ্তিমাখা সুরে বললেন, “রঙটা তার মানে তোমার পছন্দ হয়েছে, কী বল? অনেকদিনের শখ অ্যাদ্দিনে পূরণ হল। এবার দেখ না, সব্বাই মিলে যখন পিকনিকে যাব, কী মজাটাই না হবে! পিকলু, মুনিয়া, টাবলু আর টিপ খুব আনন্দ পাবে। কাল সকালে ওদের আনতে আমিই স্টেশনে যাব। ওরা যা অবাক হবে না...ওঃ”!

অজিতেশবাবু দু হাত কচলে আনন্দে সামান্য দুলে উঠলেন। সরযূদেবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে, মুখে আঁচল চাপা দিলেন। দাদু আর তাঁর নাতি-নাতনীদের আনন্দের মধ্যে খুব একটা তফাৎ দেখতে পেলেন না। পিকলু, মুনিয়া, টাবলু আর টিপ ওঁদের নাতি-নাতনীদের নাম।

অজিতেশবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল, গম্ভীর গলায় বললেন, “পথিক, তুই যে বললি, গাড়িটার নাকি সঙ্গীন অবস্থা করে ছেড়েছে ভূতেরা? কই কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না”। 

বাস্তবিক মেসোমশাই আর মাসিমার পিছনে দাঁড়িয়ে পথিকও এতক্ষণ সেটাই দেখছিল। কোথাও কোন ভাঙাচোরা দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে না একটা আঁচড়ের দাগও! অবাক হয়ে সে তাকিয়েছিল গাড়িটার দিকে। পথিককে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়াল গোবিন্দবাবুও।   

মেসোমশাইয়ের প্রশ্নে পথিক থতমত খেয়ে বলে উঠল, “এ কী দেখছি, গোবিন্দবাবু? গাড়িটার কোত্থাও কিছু হয়নি তো, কোত্থাও এতটুকু টোলও খায়নি!” অজিতেশবাবু এবং সরযূদেবী পথিকের কথায় আরও বিরক্ত হলেন।

সরযূদেবী তো ঝংকার দিয়ে বললেন, “নতুন গাড়ি নিয়ে ঢুকে থেকে তোর মুখে যতো অলক্ষুণে কথা শুনছি”। অজিতেশবাবু কিছু বললেন না, কিন্তু কটমট করে তাকিয়ে রইলেন পথিকের দিকে।

পথিক উজবুকের মতো গোবিন্দবাবুর মুখের দিকে তাকাল, মাথা চুলকে বলল, “গতকাল আসার সময় যা বিপদে পড়েছিলাম। যেমন ঝড়, তেমনি বৃষ্টি, তার ওপর মেঘের গর্জন। গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে গাড়ির ছাদটা উড়েই গেছিল...কিন্তু এখন...”। 

অজিতেশবাবু এবার ধমকে উঠে, পথিককে বললেন, “থামোঃ, বেয়াদব ছোকরা”। তারপর গলা নামিয়ে সরযূদেবীকে বললেন, “তোমাকে বললে তুমি আমার কথা তো কানেই নাও না। ছোঁড়াটা যে দিন কে দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে! এবার মিলিয়ে নাও আমার কথাটা”!

পথিক ছটফট করে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, মেসোমশাই? পুরোটা শুনুন, শুনলে বুঝতে পারবেন”। সেদিন সন্ধ্যেয় নতুন গাড়ি নিয়ে আসার পথে যা যা হয়েছিল, পথিক সব বলল মাসিমা আর মেসোমশাইকে। গোবিন্দবাবুও ঘাড় নেড়ে নেড়ে সায় দিলেন পথিকের কথায়। পথিকের কথা শুনতে শুনতে অজিতেশবাবুর ভুরু কুঁচকে উঠল, আর সরযূদেবী অবাক তো হলেনই, ভয়ও পাচ্ছিলেন খুব।

পথিকের কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, সরযূদেবী খুব আতঙ্কিত হয়ে জিগ্যেস করলেন, “যে মানুষটা তোদের পেছনে এসে দাঁড়ালেন, যাঁর পেছন পেছন তোরা সেই মন্দিরে ঢুকলি, কেমন দেখতে বল তো, মানুষটা?”

পথিক বলল, “ঝাপসা আলোয় মুখটা তো ভাল করে দেখতে পাইনি, মাসিমা। আর দেখবই বা কী? গোটা মুখটাই সাদা ধপধপে দাড়িগোঁফে ঢাকা। মাথাতেও ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সাদা চুল। চেহারাটা রোগা, কিন্তু বেশ লম্বা। এই মেসোমশাইয়ের থেকেও অন্ততঃ ফুটখানেক বেশি তো হবেই! আর গলাটাও ভীষণ গমগমে, শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন গুরগুর করে ওঠে”!

সরযূদেবী অজিতেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “চিনতে পারলে?”

অজিতেশবাবু রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, “কাকে? তোমার এই বোনপোটিকে তো? আমি ওকে বহুদিন থেকে হাড়ে হাড়ে চিনেছি। আজকাল উনি ভালই নেশা করতে শিখেছেন। তা নইলে আমার ডাকনাম ধরে ডাকে?” তারপর কিছুটা ভেংচে বললেন, ““অ, খুদু! খুদুর গাড়ি! খুদু নতুন গাড়ি কিনল”! হতভাগা আমাকে ওর ইয়ার-বন্ধু ঠাউরেছে, আমার নাম ধরেই ডাকছে, তাও আমারই সামনে”! পথিক কিছুই বুঝল না, অবাক হয়ে মেসোমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

কিন্তু সরযূদেবী বিরক্ত হয়ে অজিতেশবাবুকে বললেন, “তুমি কী গো? পথিক কী করে তোমার ওই ডাক নাম জানবে? তোমাকে ওই নামে ডাকার মতো লোক কেউ আর আছে নাকি ইহলোকে, যে ও শুনবে? তোমার বোঝা উচিৎ ছিল। রোগা চেহারা, খুব লম্বা। চুল, দাড়ি, গোঁফ সব সাদা। তোমাকে ভীষণ ভালবাসতেন, আর “খুদু” বলেই তোমাকে ডাকতেন। মনে নেই? তোমার ছোড়দাদু, গো!”

অজিতেশবাবু গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন, স্ত্রীর দিকে।

সরযূদেবী আবার বললেন, “আমার বিয়ের পর বার তিনেক এ বাড়িতে এসেছিলেন, তখন দেখেছি। তুমিই তো গল্প করেছিলে, বিএ পাস করে উনি ঘর ছেড়েছিলেন, সাধু হবার জন্যে কোনদিন তিনি আর সংসার করেননি।  কখনো সখনো হুট করে বাড়ি আসতেন, এক-দুদিন বারবাড়িতে থেকে আবার চলে যেতেন কোথাও। তিনি কী তবে আর বেঁচে নেই ...”! সরযূদেবী কথা শেষ না করে, হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেনতারপর গলায় শাড়ির আঁচল জড়িয়ে, হাঁটু গেড়ে মাটিতে গড় হয়ে প্রণাম করে বললেন, “আমাদের নতুন গাড়ি দেখে খুব খুশি হয়েছেন, আর আমাদের আশীর্বাদ করার জন্যেই উনি কাল এত অশৈরণ কাণ্ড ঘটিয়েছেন, গো”!

অজিতেশবাবু বিড়বিড় করে কিছু বললেন, শোনা গেল না! তারপর দু হাত জোড় করে তিনিও কপালে ঠেকালেন। তাঁর দুই চোখ ভরে উঠল জলে, অস্ফুট স্বরে বললেন, “আমাদের ছোড়দাদু, বাবার ছোটকা...ইস্‌স্‌ আমিও যদি গাড়ি আনতে শহরে যেতাম, তাঁর সঙ্গে শেষ দেখাটাও হয়ে যেত”!

                                                    ..০০..                             


নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/২

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের প্রথম পর্বাংশ  পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/১ " তৃতীয় পর্ব - দ্বিতীয়  পর্...