মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

বীণাপাণি ভাতের হোটেল

  


‘অ্যাই দিদি, জানিস তো সেদিন যে বউটা জিগ্যেস করছিল, তোমার এতগুলো বাচ্চা? তার সঙ্গে আজও দেখা হল’

‘কী বলল?’

‘কী আবার বলবে? একটু হাসল। বলল, তোমাদের আজকে কী রান্না হচ্ছে গো? আমি বললাম, ভাত, ডাল, পুঁই ডাঁটার চচ্চড়ি, আলুভাজা, মাছ আর ডিম’।

‘এতকথা বলার কী দরকার ছিল শুনি? ওরা সব বড়োলোকের মেয়ে, বড়ো ঘরের বউ - ওরা আমাদের এই রান্নার কথা শুনলে নাক সিঁটকোবে’।

‘নাক সিঁটকোলো তো, বয়েই গেল। আমরা কী ওদের কথায় থাকি? না চলি’?

‘এই অবস্থায় তুই আর বেশি দৌড়োদৌড়ি করিসনি ছুটকি। একজায়গায় বসে কুটনোগুলো কেটে দে, তোর দাদা সবজি বাজার এনে ফেলেছে, হারু এখনই মাছের বাজার নিয়ে এসে পড়ল বলে। তখন আর মুখ তোলার সময় পাবি না’।

‘বসছি বাবা, বসছি। তুই এমন করছিস, দিদি, আমার যেন এই প্রথমবার। এত আতুপুতু করলে, আমারও ওই বউটার মতোই অবস্থা হবে, হ্যাঁ।’

‘কেন? ওই বউটার আবার কী অবস্থা হয়েছিল?’

‘ও মা, সেদিন বললাম না? ওর নাকি সাত বছর বে হয়েছে, প্রতি বছর পেটে বাচ্চা আসে আর মাস দুয়েকের মধ্যে সে বাচ্ছা খসে যায়। সেই জন্যেই তো আমাকে জিগ্যেস করছিল, তোমার এতগুলো বাচ্চা?’

‘সে আবার কী, এমন আবার হয় নাকি? বড়লোকের বউরা কত কত খায়, কত যত্নআত্তি, বড়ো বড়ো ডাক্তার, তাও এমন হয়? আসলে সারাদিন শুয়ে বসে থাকে কিনা, থাকত আমাদের মতো, কিচ্ছু হত না। তা তুই কী বকেই চলবি, নাকি কাজে হাত লাগাবি? আমার কিন্তু সব কাজ সারা, তাড়াতাড়ি কুটনো করে দে, আমি এবার রান্না চড়াব ওই দ্যাখ স্কুল ছুটির সময় হয়ে এল, বাপ-মায়েরা একে একে আসতে আরম্ভ করে দিয়েচে, তারমানে দশটা বাজতে আর খুব দেরি নেই’ 

এবার আর কথা না বাড়িয়ে, ফুটপাথের ধারেই শামলী বঁটি নিয়ে আর বিশাল একটা ডেকচি নিয়ে বসে গেল। শামলী দিদিকে সে যেমন চোখ বন্ধ করে ভরসা করে, তেমনি বেশ ভয়ও পায় দিদি এমনিতে খুব ভালো, কিন্তু রেগে গেলে খুব চেঁচামেচি করে, আর কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না। পুরো সংসারটাকেই সে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে, কাজেই তার কথা অমান্য করতে কেউ সাহসও করে না। এই দিদির সঙ্গে তার আরও একটা সম্পর্ক আছে, জামাইবাবুর ভাই হারাধনের সঙ্গেই তার বিয়ে হয়েছে, সেই সম্পর্ক ধরলে দিদি তার বড়ো জা। বিয়ের আগে জামাইবাবুকে সে বলত নারুদা, বিয়ের পর আর বলে না। ভাসুরের নাম করতে আছে বুঝি?

ভাসুরের আনা সব্জির বস্তাটা কাত করে, শামলি ফুটপাথে ঢেলে ফেলল। পুঁই শাকের জঙ্গল, একটা গোটা নাদুস কুমড়ো, ছোট ছোট কানা-অকানা অজস্র বেগুন, চার-পাঁচগোছা ছোট ছোট মুলো, আর কেজি পাঁচেক আলু। চচ্চড়িতে আলু খোসা শুদ্ধু যাবে, খোসা শুদ্ধু যাবে কুমড়োও। তা নাহলে, কড়াইতে দিয়ে নাড়াচাড়ার সময়ই সব ঘেঁটে ঘ্যাঁট হয়ে যায়। কুমড়ো, আলু আলাদা করে চেনা যায় না। খোসা সমেত ডুমো ডুমো কাটলে খাবারসময় এক আধটা টুকরো মুখে আসে, বাঁধা কাস্টমাররা খুশি হয়।

শামলি পুঁইশাকের ডাঁটা ঘচঘচ করে কেটে ফেলতে লাগল ডেকচিতে। তারপর পোকা কাটা, হলদে-সবুজ পাতাগুলোও গরুর জাবনা কাটার মতো ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে কুচিয়ে জমিয়ে তুলল ডেকচিতে। অভ্যস্ত হাতে কতক্ষণ আর সময় লাগে? এবার বস্তা থেকে গোটা কুমড়োটা গড়িয়ে গড়িয়ে কাছে নিয়ে এলো শামলী। বঁটির পাতের সামনে তুলে এনে দুহাতে ঠেলে দিল তার হাতের ধাক্কায় ধারালো বঁটিতে দু আধখানা হয়ে গেল কুমড়োটা, দু পাশে গড়িয়ে গেল দুটো অর্ধেক। শামলী আধলা কুমড়োর ভেতর থেকে আঁতি আর বীজদানাগুলো বের করে ফেলে দিল, পাশে রাখা আবর্জনার ঝুড়িতে। ফেলতে গিয়ে মনে হল, এই কুমড়োটাও তো তার মতোই পোয়াতি, এই বীজগুলোই কুমড়োর পেটে পুষ্ট হচ্ছিল, পেকে যাবার পর আরো অনেক কুমড়ো গাছ হবে বলে। সে কি গর্ভিণী কুমড়োর গর্ভপাত করে ফেলল না? যদিও এমন সে রোজই করে, কিন্তু আজ তার মনে হল, সেই বউটার কথা ভেবে, যে বার বার পোয়াতি হয়েও একটা বাচ্চারও মা হতে পারেনি এতদিন! সে দুই সন্তানের মা, আরেকটি বেড়ে উঠছে তার গর্ভে। গর্ভের সন্তানের জন্যে মায়াভরা আশঙ্কায় তার মনটা ভরে উঠল। সে বলল,

‘যাই বলিস দিদি, আঁটকুড়িদের কিন্তু খুব দুঃখ’। শামলির দিদি মৌলি হাতের কাজ সারতে সারতে বোনের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, একটু মুচকি হেসে বলল,

‘হঠাৎ আজ তোর এই কথা মনে হল কেন? ওই বউটার কথা ভেবে? তোর তো মনে হচ্ছে ওই বউটার সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে খুব’?

‘ভাব? ধুস তা নয়। তেলে আর জলে কোনদিন মিশ খায়, দিদি? ওরা কোথায় আর আমরা কোথায়? বড়োলোকের বউ, গাড়ি করে আসেগাড়িতে বসে বসে সব দেখে স্কুলের বাচ্চাদের দেখে, আমাদের দোকান দেখে, তারপর একসময় হুস করে চলে যায়’।

‘তবে যে বলছিলি, ওর বাচ্চা নেই, তাহলে ও রোজ আসে কেন? কার বাচ্চা নিয়ে স্কুলে আসে?’

‘রোজ তো আসে না, তবে বলল যে, প্রায়ই আসে। বাড়িতে একা একা যেদিন খুব মন খারাপ করে, সেদিনই চলে আসে। এই সময়টায় সকালের বাচ্চা মেয়েদের ছুটি হয়ে যায়, আর বড়ো মেয়েরা আসে উঁচু কেলাসে পড়াশোনা করতে। তাই এই সময়টাতেই বউটা বাচ্চাগুলোকে দেখতে আসে। কোন বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছতে বা বাড়ি ফিরিয়ে নিতে নয়, ও আসে হ্যাংলার মতন শুধু দেখতে’।

তাই? যার যা কপাল, তুই আমি ভেবে আর কী করবো, বল।

‘তা ঠিক, তবুও... এমন কপাল যেন শত্তুরেরও না হয়’।

তেলচিটে ময়লা তেলের ক্যান থেকে উনুনে বসানো কড়াইতে কলকল করে অনেকটা তেল ঢালল মৌলি। তেল ঢালার পর, এক মুঠো পাঁচফোড়ন আর এক মুঠো শুকনো লংকা ফেলে দিল তেলের মধ্যে। তারপর বেশ কবার ঠকাঠক পাম্প করে বাড়িয়ে তুলল কেরোসিন স্টোভের তেজ, নিচু হয়ে আগুনের নীল শিখা নিরীক্ষণ করতে করতে বলল,

‘তোর হল? আমি কিন্তু খোলায় তেল দিয়ে দিয়েছি’।

‘এই তো হয়ে গেছে, আলুগুলো কেটে দিলেই তোর চচ্চড়ির কুটনো শেষ, বাকি সবজিগুলো তেলে ফেলে দে, আলু কাটতে আর কতক্ষণ লাগবে’?

কড়াইতে তেল গরম হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে, মৌলি সেদিকে একবার তাকিয়ে বলল,

‘বাচ্চাদের শুধু দেখতে আসে? বাড়িতে কাজকম্মো কিছু নেই নাকি? চাকরি-বাকরিও করে না? আজকাল তো মেয়েরাও কত কী কাজ করে’।

‘নেই বোধ হয়। বাড়িতে সব কাজেরই হয়তো ঝি-চাকর আছে। সুখের সংসারেও বেচারার কিন্তু খুব দুঃখ, সে আমি কথা বলেই বুঝেছি, দিদিওপর ওপর দেখতে হয়তো খুব সুখ, কিন্তু ভেতরটা...ফাঁপা’

‘আজকাল তো শুনেছি ডাক্তাররা কত কী করছে, কত রকম চিকিৎসে বেরিয়েছে। সে সব করেনি বউটা? এই তো সেদিনই শুনলাম, পোড়াবটতলার শেফালি, বিয়ের পরেও চারবচ্ছর বাচ্চা হচ্ছিল না, ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে কি সোন্দর একটা ছেলে হয়েছে। এই মাস দেড়েক আগেই খুব ধুমধাম করে তার মুখে ভাত দিল’।

‘কোন শেফালি? চন্দনা পিসির সেজ মেয়েটা?’

‘আঃ দূর, সে কেন হবে? পানু জ্যেঠুর ছোট মেয়ে। সেই যে রে, যে মেয়েটা মাধ্যমিক অব্দি পড়ে, সেকেন ডিভিসনে পাশ করেছিল’।  

‘অ। তাই? ও বুঝি বাঁজা ছিল’? বোনের এই কথায় মৌলি হেসে ফেলল,

‘ধুর গাধি, বাঁজা হলে আর বাচ্চা হয় কী করে? কিছু একটা গণ্ডগোল ছিল, ডাক্তার দেখিয়ে ভাল হয়ে গেছে’।  নিজের নির্বুদ্ধিতায় লাজুক হাসল শামলি, বলল,

‘এই বউটাও কী আর সে সব করেনি? ওদের কী আর টাকার অভাব, না চেনাজানার অভাব? কে জানে’? 

তেল গরম হয়ে এসেছিল, ভাজা শুকনো লংকার ঝাঁজে দু একজন পথ চলতি মানুষ হেঁচেও ফেলল। বিরক্ত হয়ে তাকাল ওদের দিকে। নেহাৎ মেয়ে বলে কিছু বলল না, ছেলেরা কেউ থাকলে দু কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ত না। মৌলি ডেকচি তুলে গরম তেলের মধ্যে ঢেলে দিল চচ্চড়ির সবজি। কড়াইতে ভীষণ শব্দ হয়ে উঠল, সব ঢেলে দেওয়ার পর খুন্তি দিয়ে উলটে পালটে দিয়ে মৌলি কিছুটা সময় পেল। হলুদ আর শুকনো লংকার গুঁড়ো ঢেলে দিল পরিমাণ মতো, তার সঙ্গে নুন আর বাঁটা মশলা। প্রত্যেকদিনই এই একই রান্নার পরিমাণে সে অভ্যস্ত। সব মশলা দেওয়ার পর আরেকবার খুন্তি দিয়ে নেড়ে নিল কড়াইয়ের সবজি। ততক্ষণে শামলির আলুগুলোও কাটা হয়ে গেছিল, সেগুলোও ওর মধ্যে ঢেলে, চাপা দিয়ে দিল কড়াইটা। 

একটা রান্না চেপে যেতে কিছুটা নিশ্চিন্ত, চচ্চড়ি নামতে নামতে একটু সময় হাতে পাওয়া গেল। শামলি এবার পা ছড়িয়ে বসে, আদা, পেঁয়াজ আর রসুন ছাড়াতে বসল। হামান দিস্তায় আদা পেঁয়াজ রসুন থেঁতলে ঝোলে পড়বে। শুকনো লংকা দেওয়া সেই গরগরে লাল ঝোল, কখনো পাতে পড়বে ভেজে রাখা মাছের সঙ্গে, অথবা ভেজে রাখা ডিমের সঙ্গে। নিরামিষ সবজি ভাত পনের টাকা প্লেট, মাছ নিলে বাড়তি পনের, আর ডিম নিলে দশ। এক্সট্রা ভাত দু টাকা হাতা।

বীণাপাণি ভাতের হোটেলে রোজ ষাট থেকে সত্তর জন দুপুরের খাওয়া সারে। তার মধ্যে জনা পঞ্চাশেক বাঁধা, বাকিরা উড়ো। বাঁধা খদ্দেরদের জন্যে একটু বেশি ফেলিসিটি – থুড়ি ফেসিলিটি রাখতেই হয়। তাদের এক্সট্রা ভাতের পরিমাণ সামান্য বেশি থাকেতারা ভাতের সঙ্গে এক টুকরো পেঁয়াজ কিংবা একটা কাঁচালংকা বেশি চাইলে, না করা যায় না। রেগুলারদের মধ্যে বেশির ভাগই ট্যাক্সি, পুলকার বা স্কুলবাসের ড্রাইভার, হেল্পার তাছাড়া কাছাকাছির মধ্যে এই পাড়ায় অনেক ধরনের অফিস আছে, সেই সব অফিসের অফিসবয়, সিকিউরিটিদের মধ্যেও কেউ কেউ। আবার এই হোটেলের পিছনে দু মানুষ উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা যে পার্কটা আছে, সেখানে অনেকগুলো ক্রিকেট ট্রেনিংয়ের ক্লাব আছে সেই সব ক্লাবের মালি, কেয়ারটেকারও এই বীণাপাণি ভাতের হোটেলের রেগুলার কাস্টমার। মাসের প্রথম দিকের দিন পাঁচ-সাত হোটেলে মুরগিও পাওয়া যায়, হাফপ্লেট তিরিশ, ফুল পঞ্চান্ন। খাবারের মেনুতে এই মুরগি-মাছ-ডিম রাখার হিসেবটা খুব খেয়াল করে না চললে, লস খাওয়ার চান্স থেকে যায়। মাসের প্রথমদিকে মাইনে হওয়ার পর, মুরগি-মাছের চাহিদাটা বেশি থাকে। দিন যত গড়াতে থাকে, মুরগির ডিমাণ্ড কমতে থাকে, তারও পরে কমে যায় মাছ, শেষের দিকে ডিমের ঝোল না করে, কাঁচা ডিম রাখতে হয়। কেউ চাইলে ঝটপট মামলেট বানিয়ে দিলেই ঝামেলা খতম। আর এ সবই দক্ষ হাতে সামলায় শামলীর দিদি।

বীণাপাণি নারু আর হারুর মায়ের নাম। এই হোটেলের আগে নারুর বাবার ছিল বীণাপাণি টি স্টল। দুটো নড়বড়ে বেঞ্চি পাতা, একটা কয়লার তোলা উনুন, একটা কেরাসিন কাঠের ক্যাবিনেট। কাঁচের বয়ামে সাজানো থাকত পাঁচ-ছ রকমের লেড়ো আর দিশি কেক। পাশের ছাতিম গাছের গুঁড়িতে হুকে ঝোলানো থাকত তোবড়ানো ফ্রাই প্যান, ডিমের মামলেট বানানোর জন্যে। ক্যাবিনেটের ভেতরে থরে থরে সাজানো থাকত হাতেগড়া পাঁউরুটি। পুরোনো হ্যাক-স ব্লেডের তলায় কাঠের বাঁট লাগানো ছুরিসেই ছুরি দিয়ে পাঁউরুটি কেটে ছুরিতে গেঁথে জ্বলন্ত কয়লার উপর ধরলেই, পাঁউরুটি হয়ে উঠত টুচ। তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়মের গেলাসে ডিম ফাটিয়ে একটু পেঁয়াজ কুচি, কুচোনো লংকা, আর টুকচা নুন ফেলে, তেলচিটে চামচে ঘট ঘট ঘট ঘট...।  ডিম ফেটিয়ে মামলেটের ওপর দুপিস টুচ চেপে, উল্টে দিলেই হয়ে যেত ডিম-টুচ। বীণাপাণির ঘুগ্নির হাতও ছিল দিব্য। বেলা এগারোটার এক ডেকচি টইটুম্বুর ঘুগ্নি, বেলা দেড়টা নাগাদ এক সসপ্যান গরম জল খেয়েও, আড়াইটে তিনটের মধ্যে শেষ হয়ে যেত রোজ।

এই বীণাপাণি টি স্টল থেকেই নারুর বাবা পূর্ণচন্দ্র সংসার চালিয়েছে, দুই ছেলেকে বড়ো করেছে। ছোট খাটো শখ আহ্লাদও মিটিয়েছে। বড়ছেলে নারু উপযুক্ত হওয়ার পর, বাপ আর ছেলে যুক্তি করে, টি স্টলটাকে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে ভাতের হোটেল শুরু করেছিল। এখন নারুর বাবা আর নেই, দুই ভাই আর দুই ভাইয়ের বউরা মিলে এই ভাতের হোটেল মন্দ চালাচ্ছে না। নারুর এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলে শ্রীমন্ত, ডাকনাম মণ্টু ক্লাস এইটে পড়ে, আর মেয়ে শুভশ্রী, সবাই শুভা বলে ডাকে, পড়ে ক্লাস ফাইভে। ওদিকে হারুর দুটিই মেয়ে, বড় মেয়ে হাসির বয়েস পাঁচ, আর ছোট খুশি তিনে পড়ল। হারুরবউ শামলির পেটে আরেকজন এখন হাডুডু খেলে বেড়াচ্ছে, সে ছেলে না মেয়ে, কে জানে?

ফুটপাথে শতরঞ্চি বিছিয়ে হারুর মেয়ে দুটোকে সামলায় তাদের ঠাকুমা বীণাপাণি। মেয়ে দুটোই ঠাকুমার খুব ন্যাওটা। মাঝে মাঝে ‘মা যাবো, মা যাবো’ বলে খুশিটা নাকে কাঁদলেও, ঠাকুমা আর পুঁচকে দিদি হাসি, তাকে দিব্যি সামলেও নেয়। বোনটা খুব বায়না ধরলে, হাসি বোনকে কাঁকালে নিয়ে ফুটপাথে ঘুরে বেড়ায়। এঁটো থালা বাসনের ওপর কাকের ঝাঁক এসে বসলে, ছোট বোনকে হুস হুস বলতে শেখায়। নেড়ি কুকুর দেখে বোন ভয় পেলে, গোল গোল ঠোঁট করে ভৌ ভৌ ডাকতে শেখায়। মাছের কাঁটা-তেল খেয়ে মোটা সোটা অলস বেড়ালের লেজটা নিয়ে ছোট বোনটা টানাটানি করে। বেড়ালটা কিছু বলে না। ঘাড় ঘুরিয়ে মিহি সুরে বলে মিঁয়াও।  

  ‘ছেলে ছেলে, করে তোমার মাথাটা একেবারেই গেছে, শুচি। কী সব বলছো? ওই ছোটলোকের বাচ্চাকে তুমি ঘরে আনবে’? শুচিস্মিতা ফোঁস করে উঠলেন, স্বামী শুদ্ধসত্ত্বের কথায়, বললেন,

‘ছোটলোক? ওরা ছোটলোক? দুই ভাই, দুই বউ মিলে মিশে, কী সুন্দর ব্যবসা করছে। চুরি করে না, চামারি করে না; গায়ে গতরে খেটে খায়। বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়েদুটো রীতিমত স্কুলে যায়, জানো? তুমি ওদের ছোটলোক বলছো? ওদের যোধপুর পার্কে, কিংবা নিউআলিপুরে বাইশশ’ স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট নেই বলে? ওদের কোন চোদ্দলাখি গাড়ি পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে নেই বলে? পয়সা থাকলেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না, বুঝেছ? ওই তো তোমার বস, আর তার বউ অমৃতাবৌদি। পঞ্চাশের ওপর বয়েস, ইস কি চেহারা, কি অঙ্গভঙ্গি। তলপেট দেখিয়ে, বুক দেখিয়ে এখনো এমন ভাব দেখায় যেন কচি খুকিটি। এবছর সিঙ্গাপুর, সে বছর থাইল্যাণ্ড-পাটায়া, করে বেড়াচ্ছে। আর ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখ। ছেলেটাকে পঁচিশ লাখ টাকা গুনে মেডিকেলে দিল, বছর না ঘুরতেই ড্রাগ নিয়ে, বছরে তিনমাস করে নার্সিং হোমে পড়ে আছে। মেয়েটার দুদুবার বিয়ে হল, প্রথমটা ডিভোর্স, এটাও ভাঙল বলে। তাতেও বাপ-মায়ের কোন হেলদোল আছে? আমি হলে তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতাম না। এরা সব তোমাদের ভদ্রলোক আর, ওরা ভাতের হোটেল চালিয়ে সুন্দর সুস্থ জীবন চালাচ্ছে, তারা হল ছোটলোক?’ শুচিস্মিতা কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠছে দেখে শুদ্ধসত্ত্ব হাসতে হাসতে বললেন,

‘ওক্কে, ওক্কে, আমি ছোটলোক কথাটা আনকণ্ডিশনালি উইথড্র করে নিচ্ছি। ওরা ছোটলোক নয়, কিন্তু খেটে খুটে ভাতের হোটেল চালানোটা কারো চরিত্রের সার্টিফাইং ক্রাইটেরিয়া হতে পারে কিনা, সেটাও ভাববে না’?

‘সার্টিফাইং ক্রাইটেরিয়া তো বলছি না। আমি বলছি, আমি ওদের বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছি। ওদের মধ্যে সুন্দর একটা গ্রাম্য সরলতা আছে। সকলের সঙ্গে আন্তরিক অ্যাটাচমেণ্ট আছে, দুই ভাইয়ের সঙ্গে দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, দুই ভাই এবং দুই বোন সকলেই খেটে খুটে জীবনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বুড়িমাকেও ফেলে দেয়নি। তোমাদের ভদ্রলোকেরা প্রায়ই যা করে থাকে, সেও দোকানে এসে তার যেটুকু কন্ট্রিবিউসন সেটুকু দেয়, একপাশে বসে বসে, ছোট ছেলের দুই নাতনিকে আগলায়এমন একটা ফ্যামিলিকে তুমি গরিব বলতে পারো, কিন্তু ছোটলোক বলতে পারো না’।

‘শুচি, আমি স্যরি, ছোটলোক বলতে আমি ঠিক নীচ মিন করতে চাই নি, কিন্তু এমন একটা ফ্যামিলির থেকে আমরা একটি বাচ্চা কেন অ্যাডপ্ট করব, এটা তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখছ না!’

‘দেখেছি, খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখেছি বলেই আমি আজ কদিন ধরেই তোমাকে বোঝাতে চেষ্টা করছি। তোমার আপত্তিটা কিসের জন্যে, সেটাই বুঝতে পারছি না। বছর খানেক আগে তুমি আমাকে কোন হোম থেকে একটি শিশুকে অ্যাডপ্ট করার জন্যে খুব বোঝাতে, মনে আছে?”

‘আছে। তুমি কিছুতেই রাজি হওনি। কিন্তু আজ এই বাচ্চার জন্যে কেন এত পাগলামি করছো, আমার মাথায় ঢুকছে না’।

‘ঢুকছে না নয়, তুমি মাথায় ঢোকাবে না ঠিক করে নিয়েছ! কারণ হোমের বাচ্চার সঙ্গে এদের বাচ্চার ফারাকটা তুমি বুঝতে চাইছো না’।

‘বিস্তর ফারাক। সেখানে একটা লিগ্যাল ব্যাপার আছে, একটা প্রসিডিয়র আছে। সেখানে একটা ব্যাকগ্রাউণ্ড আছে। এখানে? আছে?’

‘হোমের হয়তো ব্যাকগ্রাউণ্ড আছে, কিন্তু কোন শিশুর নিশ্চিত ব্যাকগ্রাউণ্ড নাও থাকতে পারে, তাই না? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা হোমে এসে পৌঁছয়, অবাঞ্ছিত হয়ে, পরিত্যক্ত হয়ে। কিন্তু এই পরিবারের তা নয়। এদের কাছে শিশুরা অবাঞ্ছিত নয়, আদরের – ভালবাসার শিশু। এদের স্বাচ্ছল্য, সম্বল আমাদের থেকে অনেকটাই কম হলেও’।

‘মানছি, কিন্তু...আচ্ছা, তুমি কী ওদের সঙ্গে কথা বলেছ? এমনও তো হতে পারে, ওরা রাজি হল না?’

‘না কথা বলিনি। তুমি রাজি না হলে, কথা বলে লাভ কী? তুমি যদি রাজি হও, তবেই না কথা বলব। হ্যাঁ জানি, আমি বললেই যে রাজি হয়ে যাবে, এমন নাও হতে পারে। রাজি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্ততঃ শামলিকে দেখে এবং কথা বলে, আমার মনে হয়েছে, ও রাজি হবে না’।

‘শামলি? দু মেয়ের মা। এবং আবার কনসিভ করেছে? কত বয়েস হবে?’

‘মেয়েদের বয়েস বোঝা যায় নাকি? নাকি সত্যি বয়েসটা কেউ বলে?’ শুচিস্মিতা হাসতে হাসতে বললেন। শুদ্ধসত্ত্ব গভীর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘তুমিও? তুমিও আমার কাছে তোমার সত্যি বয়েসটা বলো না’? স্বামীর পিঠে হালকা চাপড় মেরে শুচিস্মিতা বললেন,

‘ইয়ার্কি কোরো না তো। চব্বিশ, পঁচিশ হবে হয়তো’।

‘কার বয়েস? তোমার?’ এবার পিঠে একটা কিল মারলেন শুচিস্মিতা, কপট রাগতস্বরে বললেন,

‘আঃ, কোন কথাটাই তুমি সিরিয়াসলি নাও না, বলছি শামলির বয়েস চব্বিশ, পঁচিশ হতে পারে’।

‘অ, তাই বলো। খুব সুন্দরী?’ স্বামীর কথায় শুচিস্মিতা ভুরু কুঁচকে তাকালেন, বললেন,

‘কেন? তাতে তোমার কী? সুন্দরী নিয়ে তুমি কী করবে?’

‘বোঝো, তোমার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। মেয়েটা দেখতে কেমন সেটাই জানতে চাইছিলাম। তোমার কোলে ভুতের ছ্যানার মতো একটা শিশু চ্যাঁ চ্যাঁ করে কাঁদবে, এ আমার সহ্য হবে না, সে তুমি আমাকে যাই ভাবো’। শুচিস্মিতা স্বামীর হাতটা নিজের কোলে টেনে নিলেন, হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললেন,

‘সে কী আর আমি জানিনা? শামলি ডানকাটা পরির মতো সুন্দরী, তা নয়। কিন্তু শামলা রঙের মধ্যেও তার খুব শান্ত সুন্দর মুখশ্রী। খুব স্নিগ্ধ। দেখলেই তোমার মায়া পড়ে যাবে!’

‘সর্বনাশ, বলছো কী? আমার মায়া পড়ে গেলে, তোমার সহ্য হবে তো’ স্বামীর এই ঠাট্টার কথা শুচিস্মিতা গায়ে মাখলেন না, তিনি একই ভাবে বলতে লাগলেন,

‘ওর দুটি মেয়েও একদম মায়ের মতো। ছোটটা তো দারুণ মিষ্টি দেখতে। এই ডাগর ডাগর চোখ। টোপা টোপা গাল, খিলখিলিয়ে যখন হাসে, বাঁদিকের গালে টোল পড়ে। তবে নাকটা একটু বুঁচকু মতো। সে হোক, বাচ্চাদের বোঁচা নাকে খুব মিষ্টি দেখায়, নাক টিপে আদর করতে ইচ্ছে করে’শুদ্ধসত্ত্ব স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, শুচিস্মিতা এখন গভীর স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছে, সেখান থেকে তাকে তুলে আনা আপাতত অসম্ভব। জোর করতে গেলে, সম্পর্কের বাঁধনও আলগা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। শুদ্ধসত্ত্ব ধৈর্য ধরে শুনতে লাগলেন স্ত্রীর কথা।

‘বাপ-মার মধ্যে গভীর ভালোবাসা থাকলে না, তাদের শিশুরা সুন্দর আর হাসিখুশি হয়। শামলি বউটা সারাবেলা এত কাজ করে, খাটে, কিন্তু সর্বদা হাসিমুখী। কুটনো কাটতে কাটতে, বাসন মাজতে মাজতে যখন বেলা চড়ে যায়, প্রচণ্ড গরমে ঘেমে নেয়ে একসা হয় মেয়েটা। তখনো তার হাতের কাজ, মুখের হাসির বিরাম নেই। দিদির সঙ্গে অনর্গল বকর বকর বকেই চলে, আর হেসেই চলে। তার সিঁথির সিঁদুর কপালের ঘামে গলে, নেমে আসে ভুরুর কাছে। তেলে আর ঘামে জবজবে মুখখানি চকচক করতে থাকে সংসারের মায়ায়। তার হাতের শাঁখাপলা আর কগাছা ইমিটেসানের চুরিতে বাজতে থাকে কাজ করার আনন্দ। এর মধ্যেই তার কোলের মেয়েটা ঠাকুমার কোলে একবার হয়তো চঞ্চল হয়ে উঠল, “মা যাবো, মা যাবো” করে, “বৌমা, খুকিকে একবারটি সামলে দে যাও”, হাঁক পাড়ল শ্বাশুড়ি। হাতের কাজ ফেলে, গামলার জলে দুহাত ধুয়ে সে দৌড়ে গেল মেয়ের কাছে। তাকে কোলে নিয়ে শ্বাশুড়ির পিঠের আড়ালে বসে আঁচলের তলায় মেয়েকে নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে শুরু করল। তখনও তার মুখে হাসি, আর লাগাতার কথা। মাঝে মাঝে আঁচল সরিয়ে, গোপন সম্পদ নিরীক্ষণ করার মতো মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। মেয়ের নরম চুলের মধ্যে, আলতো আঙুলে বিলি কেটে দেয়। তোমরা ছেলেরা এসব ঠিক বুঝবে না। মেয়েরা বোঝে, আমরা বুঝি। ওদের সংসারের প্রত্যেকেই এমন নিবিড়বাঁধনে বাঁধা কোথাও যেন এতটুকু আলগা হবার জো নেই; অথচ সে বাঁধন শেকলের কড়া বাঁধন নয়। সে বাঁধন ভালোবাসার। লোহার শেকল চেষ্টা করলে, ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু মায়ার বাঁধন? অসম্ভব - ভীষণ শক্ত!’

‘শুচি, প্লিজ। একবার দম ছেড়ে শ্বাস নাও, সোনা’এই কথায় শুচি ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, স্বামীর দিকে। অতি প্রিয় মুখে খুঁজতে লাগলেন বিদ্রূপের ছোঁয়া। শুদ্ধসত্ত্বর আপাতগম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুচিস্মিতার অভিমান হল, বলল,

‘থাক, তোমার আর শুনেও কাজ নেই, আর আমাকে নিয়ে ঠাট্টাতেও কাজ নেই’।

‘শুচি, আমি ঠাট্টা করছি কী? আমি তোমায় একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বলছি। শোন শুচি, শোন। আমি তোমার থেকে কিছু কথা খুব স্পষ্ট করে বুঝতে চাই। প্লিজ, হেল্প মি আউট’।

শুচিস্মিতা তাকিয়ে রইল স্বামীর মুখের দিকে, কিছুটা নির্বিকার তার মুখের অভিব্যক্তি। সে যেন বুঝে গেছে, তার কোন আবেগই শুদ্ধসত্ত্বকে স্পর্শ করবে না। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে, শুদ্ধসত্ত্ব বলল,

‘শুচি, ধরো আমরা দুজনে সহমত হলাম, তোমার ওই শামলির কাছে, ওর পরিবারের কাছে আমরা প্রস্তাব দিলাম যে...আমরা প্রস্তাব দিলাম যে, শামলি, তোমার গর্ভের এই বাচ্চাটিকে আমরা কোল দিতে চাই, পুষ্যি নিতে চাই। আমরা সন্তানহীন অভাগা দম্পতি, ওকে আমরা আপন সন্তানের মতো বড়ো করে তুলবো। আমাদের বুকভরা ভালোবাসা দেব, আমাদের নাম দেব, বিনিময়ে আমরা নেব ওর সকল মঙ্গল-অমঙ্গলের দায়িত্ব আর দুশ্চিন্তা। যে দায়িত্ব পেলে প্রত্যেক বাবা-মাই নিজেদের ভাগ্যবান মনে করে’

শুদ্ধসত্ত্ব একটু থামলো, শুচিস্মিতার চোখে তার মনের ভাষা পড়তে চাইলশুচি তাকিয়েই ছিল, খুব ধীরে চোখের পলক ফেলে, বলল,

‘বেশ বলছো, কিন্তু কোনদিকে যে নিয়ে যেতে চাইছো, সেটাই বুঝতে পারছি না’। শুদ্ধসত্ত্ব মৃদু হাসল, বলল,

‘তার মানে, আমাকে ঠিক বিশ্বাস করছো না। তোমার বিশ্বাস হারানো আমার পক্ষে মোটেই কাজের কথা নয়; তবু আমাকে বলতেই হবে। শামলির থেকে আমরা তার সন্তান চাইছি, বদলে আমরা তাকে কী দেব? টাকা, তাই না? কত টাকা? দুই-পাঁচ-দশ লাখ, তাইতো? তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে? আমরা দরদস্তুর করতে চলেছি, খুব সুন্দর সংসারের, লক্ষ্মীমন্ত একটি বউ ঠিক কত টাকা পেলে, তার মাতৃত্ব হস্তান্তর করতে পারে? যে ভালোবাসা আর মায়ায়, সে একটু একটু করে নিজের গর্ভে সন্তানকে বড়ো করে তুলছে, সেই ভালোবাসা আর মায়ার বাঁধন, ঠিক কত টাকার বিনিময়ে মুছে দেওয়া যায়?’

শুদ্ধসত্ত্ব একটু থামল, তার মুখ এক ভীষণ গম্ভীর, সে শুচির দিকে তাকিয়ে দেখল, শুচির মুখ থমথমে, দৃষ্টি আনমনা। শুদ্ধসত্ত্ব হাত বাড়িয়ে শুচিরমু়খ আড়াল করা চুলের গুছিটা আলতো হাতে সরিয়ে দিতে গেল, শুচি হাতটা ছাড়ল না। হাতের তালুতে গাল রেখে চোখ বন্ধ করল। শুদ্ধসত্ত্ব অস্ফুট স্বরে বলল,

‘যে শিশু মা-বাবার স্নেহ ভালোবাসা পাবেই তুমি নিশ্চিত, তাকে তুমি টাকা দিয়ে কিনতে চাইছ। আর যে শিশুরা জন্মেছে বাপ-মায়ের অবহেলায়, যে শিশুরা কোনদিনই বাপ-মায়ের স্নেহ ভালোবাসা পাবে না, অনাথ আশ্রমের সেই শিশুদের কাউকেই তুমি কোলে নিতে চাওনি! তোমার মাতৃত্বের স্পর্শে, তাদের দু একজনের জীবনকে তুমি আমূল বদলে দিতে পারতে, শুচি। এ কথাটা একবার ভেবে দেখবে না?’

শুদ্ধসত্ত্ব হাতের তালুতে উষ্ণ অশ্রুর অনুভব পেয়ে শুচিকে টেনে নিলেন বুকের কাছে, তারপর একই ভাবে বললেন,

‘শুচি, তুমি এতটা উতলা হয়ে উঠেছ, শামলির সন্তানকে নেবার জন্যে, কিন্তু শামলি যদি রাজি না হয়? না হবারই কথা। হলে আশ্চর্য তো হবোই, বিরক্তও হবো। যে নিখুঁত মাতৃত্বের বর্ণনা তুমি দিলে, টাকার লোভে যদি সে সব বিকিয়ে যায়, তাহলে বিরক্ত হবো না, বলো?’

শুচি স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদতেই লাগল, তার অশ্রুধারায় ভিজে উঠল শুদ্ধসত্ত্বর পাঞ্জাবী। শুদ্ধসত্ত্ব আর কিছু বলল না, শুচির মেঘের মত ঘন কালো চুলের মধ্যে নরম আঙুলে বিলি কাটতে লাগল।  

 রাতের খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে একটা বিড়ি টানতে টানতে নারু মৌলির সাজুগুজু দেখছিল। এ সময় মৌলি রোজই টানটান করে চুল বাঁধে। মু়খে ক্রিম মাখে তারপর শুতে আসে বিছানায়। সারাদিন আগুনের সামনে থাকে, এত লোকের রান্না বান্না একা হাতে সামলায়। শীত নেই, গ্রীষ্ম বর্ষা নেই, রোজ – তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এমন খাটনি, চাট্টিখানি কথা নয়, নারু জানে। বীণাপাণি ভাতের হোটেলের সাফল্যের চাবিকাঠিটি যে তার বউ মৌলির হাতে, সে কথা নারু হাড়ে হাড়ে টের পায়। আর এই মৌলির জন্যেই যে গোটা সংসারটা একসঙ্গে রেলগাড়ির মতো গড়গড়িয়ে চলছে, সে বিষয়েও তার কোন সন্দেহ নেই। আঁচড়ানো চুলের গুছিতে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে মৌলি বলল,

‘মেয়েটা সেই থেকে কেঁদে চলেছে, জানো?’

‘কে? শামলি?’ নারুর গলায় উদ্বেগ।

‘হ্যাঁ’।

‘হঠাৎ কী হল? শরীরটরীর খারাপ হল নাকি? তুমি তো পঞ্চাশবার ওকে বলো শুনেছি, ভারি জিনিষ না তুলতে’!

‘না গো, সে সব কিছু নয়। এ একদম ফালতু উটকো ঝামেলা’।

‘আরে কী হয়েছে বলবে তো, হারু কিছু বলেছে, নাকি?’

‘না গো। আরে, সেই আঁটকুড়ো বউটা, গাড়ি নিয়ে সেই যে মাঝে মাঝেই আসে, আর ছুটকির সঙ্গে কথা বলে’।

‘কতদিন বলেছি...আমি কতদিন বলেছি, ওই সব বড়োলোকেদের সঙ্গে মাখামাখি না করতে’?

‘সে তো আমিও বলেছিলাম, মাখামাখি আর কোথায় করেছে, ডেকে কথা বলত, তাই গেছে’।

‘তা আজকে কী এমন বলল, যে ঘরে ফিরে, সারা দিন পরেও, এখনো কান্নাকাটি করছে?’

‘দুটো পয়সা থাকলেই লোকেদের কেমন আস্পদ্দা বেড়ে যায়, সেটাই ভাবি। আমাদের মতো গরিবগুর্বোদের টাকা দিলেই যেন কিনে ফেলা যায়, এমন ভাবখানা। এরাই আবার কত লম্বা লম্বা বচন ঝাড়ে, উপদেশ দেয়। এরা বোধহয় আমাদের গরু-ছাগলের বেশি কিছু ভাবতে পারে না। ভাবে দুটো পয়সা ছিটিয়ে দিলেই আমরা ল্যা ল্যা করে ওদের পা চাঁটবো।’

‘আরে, গেল যা। তুমি তো দেখছি বাজে বকেই চলেছ, আসল কথাটা না বলে। কী বলেছে বলবে তো?’

‘বউটার নাকি শখ হয়েছিল, ছুটকির পেটের বাচ্চাটাকে পুষ্যি নেবে। ছুটকিকে দেখে, ওর দুই মেয়েকে দেখে, আমাদের সকলকে দেখেই ওর নাকি খুব পছন্দ হয়েছিল। আমাদের সংসার করা। সকলের সঙ্গে সবার মিলমিশ। আমাদের মধ্যে নাকি এখনও একটা বেশ, গেরামের সরলতা আছে। যেটা আজকের যুগে শহুরে লোকেদের মধ্যে নাকি দেখাই যায় না। এই সরল...সরল...দাঁড়াও আরেকটা কী যেন বেশ বলছিল, ছুটকি, স্নিগ্ধ...হ্যাঁ মনে পড়েছে এই স্নিগ্ধ সরলতার জন্যেই ওই বউটা নাকি ওর স্বামীকে বলে পাঁচ-সাত লাখ দেবার ব্যাপারেও রাজি করিয়ে ফেলেছিল।’

‘কত টাকা? পাঁচ-সাত লাখ?’

‘হুঁ, ওদের কী আর টাকার অভাব? এ কটা টাকা তো ওদের কাছে খোলামকুচির মতো। এই টাকা ছাড়াও ডাক্তার দেখানো, নার্সিং হোমে ডেলিভারির সমস্ত খরচ। ভাল খাওয়াদাওয়া, ভিটামিন, হাবিজাবি সমস্ত খরচও ওই বউটাই দিতে রাজি ছিল। কতখানি আস্পদ্দা তুমি একবার ভাবো? এমন চিন্তা ওদের মাথায় আসে কী করে, সেটাই ভাবছি। ওদের মতো টাকার গদিতে ওঠাবসা করি না বলে, আমরা কী বানের জলে ভেসে এসেছি? ছুটকিটা নেহাত বোকোসোকা ভালমানুষ। কিছু বলতে পারেনি। শুধু মুখ গোমড়া করে, শুনেটুনে চলে এসেছে, এত বোকা মেয়েটা! আর সেই থেকে আপন মনে গুমরে গুমরে কেঁদে মরছে। আমি হলে তো ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিতাম ধুদ্ধুড়ি নেড়ে দিতাম বেশ করে। পয়সা আছে তো তোদের আছে বাপু, আমরা কি হাত পেতে, তোদের কাছে ভিখ মাগতে গেছি? গায়ে পড়ে এমন কথা বলার সাহস হয় কী করে? আমাদের বাচ্চারা কী ছাগলের বাচ্চা, নাকি কুকুরের বাচ্চা? যে দরদাম করে গাড়িতে তুলে, বাড়ি নিয়ে গেলেই হল!’

 মৌলি এক টানা কথায় বিরাম দিল, তার বিনুনি বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। এবার মুখে ক্রিম লাগিয়ে, ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। বিছানায় স্বামীর পাশে উঠে এসে বলল,

‘কী ব্যাপার তুমি কিছু বলছো না যে?’

‘বউটা লাস্টে কী বলল? পুষ্যি নেবে, কী নেবে না?’

‘নেবে না। একটা সময় বউটা নাকি মনে মনে একদম ঠিক করে ফেলেছিল, তারপর ওর স্বামী কী সব কথা অনেক করে বুঝিয়েছে, তার পরে ওর মাথাটা ঠাণ্ডা হয়েছে, এখন আর নেবে না। ছুটকিকে বলেছে, এই সপ্তাহে দু একটা অনাথ আশ্রমে যাবে, কথা বলবে। সব ঠিকঠাক থাকলে সেখান থেকে দেখেশুনে কোন বাচ্চা পুষ্যি নেবে

‘যাঃ ফস্কে গেল? টাকাটা পেলে কিন্তু মন্দ হত না’, নারু বিছানায় উঠে বসে অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে বিড়ির বাণ্ডিল আর দেশলাই নিল। মৌলি স্বামীর কথায় এতই অবাক হয়েছিল, বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারল না। দেশলাই কাঠি জ্বালার শব্দে আর তার হঠাৎ আলোয় সে সম্বিত ফিরে পেলঅল্প আলোর ঝলকের মতোই সেও ঝলসে উঠল, বলল,

‘কী বললে, তুমি?’ বিড়িতে লম্বা টান দিতে, অন্ধকার ঘরে নারুর মুখটা লাল গনগনে দেখাল, ফুসফুসের মধ্যে পোড়াতামাকের মৌতাত নিয়ে ধীরে সুস্থে বলল,

‘যা শুনেছ, ঠিকই শুনেছ। একটু চাপ দিলে পাঁচ-সাতটা বেড়ে দশও হয়ে যেতে পারে। দশ লাখ মানে বুঝতে পারছো? আমাদের পোড়া কপালে দুব্বোর চাড়া গজিয়ে উঠত নতুন করে। আমাদের নিজস্ব একটা ভাতের হোটেল হয়ে যেতবেশ চকচকে চেয়ার টেবিলওয়ালা খাবার ঘর, মাথার ওপর দু চারটে ফ্যান, কাঁচের গেলাস, ডিশ, পয়সার কাউন্টার। খদ্দের সামলানোর জন্যে, জনা দুয়েক ছোকরা, তোমার খাটনিও কমে যেততুমি তখন মালকিন হতে, বুঝেছ মৌলি, মালকিনকাউন্টারে বসে মালপত্রের হিসেব রাখা, আর টাকা গোনা। বেশ গুছিয়ে নেওয়া যেত, বুঝেছ? হাঘরের মতো ফুটপাথে আর কতদিন হোটেল চলবে বলো দেখি? আজ পাড়ার দাদাদের তোলা দিয়ে, তেল দিয়ে চলছে, ঠিক আছে। কোনদিন ওদের মতিগতি পাল্টাবে, দেবে আমাদের হুড়কো দিয়ে ফুটপাথ থেকে তাড়িয়ে। কী হবে তখন ভেবে দেখেছ? পথে বসতে হবে, পথেতাও বসতে দেবে না। ভাঙা হারমোনিয়াম নিয়ে আমি বাজাবো, আর তোমাকে গান গেয়ে ভিক্ষে করতে হবে লোকাল ট্রেনে - “কতদূর আর কতদূর, বলো মা” বুঝেছো? আর শুধু কী হোটেল? একটু হিসেব করে চললে এই ঘরদোরগুলোও সাজিয়ে নেওয়া যাবে। টালি নামিয়ে শোবার ঘরদুটোর ছাদটাও ঢালাই করে নেওয়া যাবে। দশলাখ বড়ো কম নয়, মৌলি’

নিভে যাওয়া বিড়িটা ঘরের কোণায় ছুঁড়ে দিয়ে নারু আবার একটা বিড়ি ধরাল। এতক্ষণ মৌলি একটা কথাও বলেনি। এতদিন এই লোকটার সঙ্গে সে ঘর করছে, তার মনের মধ্যে যে এমন সব মতলবও চাপা ছিল সে বুঝতেই পারেনি বলে খুব আশ্চর্য হল। একটু ঠেস দিয়ে বলল,

‘যে রেটে বিড়ি খাওয়া শুরু করেছ, শামলির বাচ্চা বিয়োনোর আগেই কিছু একটা বিপদ না ঘটে বসে। শুনেছি বিড়ি সিগ্রেট থেকে ক্যানসার হয়। সাবধানে থেকো, বাপু’

উত্তেজিত নারু বিছানা থেকে নেমে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল, তারপর বিছানায় মৌলির মুখোমুখি বসে বলল, 

‘তুমি কী পাগল হয়েছ, মৌলি? ভাইয়ের বউ বলো, ভাইয়ের বউ; শালী বলো শালী, তার ওপরে আমার কিসের জোর? সে যদি টাকা পায় তাতেই বা আমার মাতব্বরি তারা মানতে যাবে কোন দুঃখে? শামলি নয় আমি ভাবছি আমাদের কথা। আমরাই তো পারি, সেই আঁটকুড়ি বউয়ের কোলে পুষ্যি তুলে দিতে। পারি না?’ স্বামীর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে মৌলি তাকিয়ে থেকে বলল,

‘আমার হয়েছে মরণদশা আর তোমার হয়েছে মতিচ্ছন্ন। আমার ছেলে মেয়ে কাউকেই আমি তোমার ভাতের হোটেল খোলার জন্যে বেচতে পারব না। এই রাতদুপুরে আমি পোতিজ্ঞা করছি, তোমার ওই প্যাঁচকষা হেঁড়ে মুন্ডুতে যদি এই বদ খেয়াল হয়, তার আগে ছেলেমেয়েকে আমি নিজের হাতে বিষ দোবো, তারপর নিজে হয় গলায় দড়ি দেব, নয় গঙ্গায় ঝাঁপ দোবো। তোমার মুরোদ থাকলে, তখন আবার একটা কচি বউকে বিয়ে করে সাধ মিটিয়ে তোমার বাচ্চার ব্যবসা শুরু করো গে, আমি দেখতেও আসব না।’ নারু খুব হতাশ আর বিরক্ত হয়ে বলল,

‘তোমাদের মেয়েছেলেদের এই দোষ, বড্ডো আড়বুঝো হও। আরে বাবা, আমি কী আক্কেলের মাথা চিবিয়ে খেয়েছি বলে তোমার মনে হচ্ছে? মন্টু আর শুভার কথা, আমি থোড়ি বলেছি’? চোখের দৃষ্টিতে আর ঠোঁটের কোণায়, যতটা পারে আদি রসের ইঙ্গিত জড়ো করে, নারু মৌলিকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল, 

‘তোমার আমার ইসে হওয়ার নমাস পরে আমাদের যে নতুন বাচ্চা আসবে আমি তার কথা বলছিভেবে দেখো না, মাত্র ন মাস, কী খুব জোর দশমাস, তার পরেই দশলাখ। এমন সুযোগ হাতছাড়া করো না, মৌলি। বেশ ভালো করে ভেবে দ্যাখো দেখি, আমাদের বাচ্চা বড়ো হবে বড়লোকের বাড়িতে রাজার হালে, ইংরিজি স্কুলে পড়বে, ভালো খাওয়া দাওয়া, যত্ন আত্তি। ভাবতে পারছো? আর আমাদের হাতে চলে আসবে দশ লাখ টাকা। এদিকে কপালপোড়া বউটাও বাচ্চা পেয়ে খুশি হবেসবার মঙ্গল, মৌলি, সবার মঙ্গল। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দ্যাখো।’

 নারুর ওই রসের ইঙ্গিত দেখে আর কথা শুনে, মৌলি, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে উঠে বসল, তার হাসি দেখে নারুর গা জ্বলে উঠল, বলল,

‘এতে এতো হাসি মস্করার কী হল শুনি? রাত দুপুরে আমি তোমার সঙ্গে ফক্কুড়ি করছি, মৌলি’?

হাসতে হাসতেই মৌলি স্বামীর গায়ে ভর দিয়ে বসল, তারপর বলল, 

‘শুভা হওয়ার সময়ই, ডাক্তার আমার লাইগেশান করে দিয়েছিল, আমি কোনদিনই আর মা হতে পারবো না। কাজেই, সে গুড়ে বালি, আর তোমার ওই সুখস্বপ্নের মুখে আগুন। বরং আরেকটা বিয়ে করে মনের সুখে বাচ্চার চাষ করো। খুব উন্নতি করবে।’

‘লাইগেশান করিয়েছিলে! আমাকে একবার জানানোর দরকার মনে করলে না? এত বড়ো সাহস তোমার? ওসব কারা করে জানো, নচ্ছার মেয়েরা! ছি ছি ছি ছিঃ’ নারুর এই কথা শুনে মৌলির মাথায় আগুন চিড়িক দিয়ে উঠল, বেশ ঝেঁজে উত্তর দিল,

‘অ, এতদিন নচ্ছার ছিলাম না, আজ নচ্ছার হয়ে গেলাম, ভোঁদা মিনসে! শুভা এই সামনের চোতে এগারোয় পা দেবে। এতদিন ধরে মনের আনন্দে আমাকে ধামসে চলেছো, কোনদিন বোঝনি, সে ধামসানিটা কোথায় যাচ্ছে? ন্যাকা চৈতন্য, নাকি ভাজা মাছ উলটে খেতে শেখনি? তোমার বাচ্চা বেচার ভীমরতি, নচ্ছারি ধান্দা নয়, না? তোমার ব্যবসার জন্যে আমি বছর বিয়োনি হবো, আর তুমি হোটেল খুলে ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে,নাচাবে? এ নিয়ে আর একটা কথাও যেন না শুনি। চুপ করে ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। এই বন্ধ ঘরে আর যদি বিড়ি ধরিয়েছো, সে বিড়ি আমি তোমার মুখেই ছ্যাঁকা দিয়ে নেভাবো এই বলে রাখলাম। এএএএএঃ, বড়লোকের বাঁজা বউয়ের মঙ্গলের জন্যে দরদ একেবারে উথলে উঠছে, মুখপোড়া, হাড় হাভাতে, মিনসের’

আর কোন কথা না বলে, মৌলি চোখের উপর হাত চাপা দিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। নারুও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বউয়ের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখল। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে খুব সন্তর্পণে চৌকিতে উঠল, পুরোনো চৌকি বেশি নড়বড় করলে, মৌলি রেগে যেতে পারে। একটা স্বপ্ন তো শুরুতেই ভেঙে গেল, এখন মৌলি ক্ষেপলে নড়বড়ে বীণাপাণি ভাতের হোটেলটাই না লাটে ওঠে!  

-০-

 

 

 

সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫

এক যে ছিলেন রাজা - ১ম পর্ব

 

[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাধার্মিক ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগরা এই ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত পাওয়া যায় ভাগবৎ-পুরাণে (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়), সেই ঘটনার সম্ভাব্য পুনর্নির্মাণ এই উপন্যাস।]

 

মহারাজ বেণের মন আজ অত্যন্ত প্রসন্ন। রাজসভায় আজ প্রথমবার অত্যন্ত জরুরি, একদম মনের মতো কিছু সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পেরেছেন। তাঁর পিতার সমসাময়িক জরাগ্রস্ত মন্ত্রী-অমাত্যদের তিনি কোন কথাই বলতে দেননি। আজকের এই সাফল্যের পর তাঁর ইচ্ছে আছে, অচিরেই এই সকল অপদার্থ জড়বুদ্ধি মন্ত্রি ও অমাত্যদের রাজসভা থেকে বিদায় করে দেবেন। রাজসভায় নিয়ে আসবেন এমন সব যুবা অমাত্য, যারা বিনা দ্বিধায় তাঁর আদেশ মেনে নেবে এবং তৎক্ষণাৎ কাজ করবেযে কোন সিদ্ধান্তের আগে, রাজসভায় বসে দিনের পর দিন, বৃদ্ধ এই অমাত্যদের “কিন্তু”, “তবে”, “হয়তো”, “নয়তো” এত আলোচনা তাঁর সহ্য হয় না। তাঁর মনে হয়, রাজসভায় যে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও মত বিনিময়, আসলে সময়ের অকারণ অপচয়। তিনি বিশ্বাস করেন, এই রাজ্যের মহারাজার অধিকারে, তিনিই সব সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সকল নির্দেশ দেবেন। আর অমাত্যদের একমাত্র কর্তব্য হবে, বিনা প্রশ্নে তাঁর সকল নির্দেশ অত্যন্ত দ্রুত দক্ষতার সঙ্গে পালন করা! তাঁর আজকের এই বলিষ্ঠ ঘোষণা, খুব শীঘ্রই বদলে দেবে এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ। মহারাজা বেণকে ইতিহাস মনে রাখবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি নয়, স্বয়ং ঈশ্বর রূপেই। 

আজ তিনি অসময়ে সভার কাজ বন্ধ করে দিয়ে এসেছেন! এই সভাভঙ্গের কারণ, তাঁর পিতার সমসাময়িক মন্ত্রী ও অমাত্যদের সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা। তাঁর আদেশ ও নির্দেশ নিয়ে, রাজসভায় পক্ষে কিংবা বিপক্ষে, কোন আলোচনাই যাতে না ঘটতে পারে! রাজ-অন্নে প্রতিপালিত ওই অলস জরাগ্রস্ত অমাত্যদের তিনি একটা স্পষ্ট সংকেত দিলেন “ওহে বিগতবুদ্ধি জম্বুকের দল, এই রাজ্য পরিচালনায় তোমাদের আর কোন অধিকার নেই! নিজেদের সম্মান যদি রাখতে চাও, তবে স্বেচ্ছা অবসর নাও। নচেৎ আরো বড়ো অপমান ও দুর্ভোগের জন্য প্রস্তুত হতে থাকো”!

রাজসভা থেকে তিনি অন্তঃপুরে চলে এসেছেন অনেকক্ষণ। রাজবেশ পরিত্যাগ করে, তিনি এখন নিজের ঘরের অলিন্দে পায়চারি করছেন, আর মনে মনে পর্যালোচনা করছিলেন, আজকের রাজসভার অধিবেশনের সমস্ত ঘটনা। তিনি, মহারাজ বেণ, অনেক কিছুই হয়তো সহ্য করলেও করতে পারেন। কিন্তু সহ্য করতে পারেন না, অকৃতজ্ঞতা আর ঔদ্ধত্য। তিনি এই রাজ্যের অধীশ্বর, তাঁর অনুগ্রহে সুখে শান্তিতে সংসারধর্ম পালন করছে সমস্ত প্রজাকুল। তাঁর একটি ইশারায় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি সংসার, একটি গ্রাম, একটি অঞ্চল। কিন্তু কই তিনি তো তা করেন না! দরিদ্র শ্রমনির্ভর মানুষগুলির প্রতি, সত্যি বলতে, তিনি অদ্ভূত এক করুণা অনুভব করেন। কারণ এই মানুষগুলি কীটপতঙ্গের মতো কী ভাবে বেঁচে থাকে, সেটা ভাবলেই তিনি আশ্চর্য হয়ে যান!

মানুষের মতোই দেখতে এই অদ্ভূত জীবগুলির কোন আনন্দ নেই, বিলাস নেই, কিছু না কিছু কাজ নিয়ে এরা সর্বদাই ব্যস্ত –সারাটাদিন, প্রত্যেকদিন! হয় বাইরের কাজ, নয়তো ঘরের কাজ। আর যখন কোনও কাজ করে না, তখন দেবতার পূজা করেহে ঈশ্বর ধন দাও, সন্তান দাও, সুখ দাও, সমৃদ্ধি দাও। মূর্খ এই জীবগুলো এটাও বোঝে না, ঈশ্বর তাদের কিছু দেয় না। দেয় কে? দেশের রাজা। অত্যন্ত কৃপাপরবশ হয়ে রাজাই তোদের কৃষির জমি দেয়, কর্মের অধিকার দেয়, আবাসের ভূমি দেয়। তবেই না তোদের সুখ আসে, সমৃদ্ধি আসে, ধন আসে, সন্তান আসে, সন্তানের প্রতিপালন হয়! আর সন্তান যে আসে, সে তো প্রকৃতির বিধান। কীট-পতঙ্গ থেকে অজ, মেষ, গবাদি, শ্বাপদ সকলেরই সন্তান আসে, তার জন্যে ঈশ্বর কী করবে? এত অনুগ্রহের প্রতিদান স্বরূপ রাজা যদি কখনো অধিক শুল্ক আদায়ের নির্দেশ দেন, কিংবা মহামান্য রাজার অনুচরদের কেউ যদি সামান্য অবিচার অনাচার কিছু করেই ফেলে, তার জন্যে এত আক্রোশ কেন? কর্ম করে যে মানুষ, তার এক-আধটা ভুল-ভ্রান্তি তো হতেই পারে! কিন্তু তুচ্ছ পিপীলিকার তুল্য এই মানুষগুলোর কী এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ থাকতে নেই?

সকালের সমস্ত ঘটনার কথা মনে পড়লে, মহারাজ বেণের মস্তিষ্ক এখনো তপ্ত হয়ে উঠছে।

মহারাজ বেণের বহুদিনের স্বপ্ন, রাজধানীর অদূরে সুরম্য একটি উদ্যান বাটিকা প্রতিষ্ঠা। আগামী শ্রাবণী পূর্ণিমায় সেই বাটিকার গৃহপ্রবেশের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। গতকাল দ্বিপ্রহরে সভার অধিবেশন স্থগিত রেখে, মহারাজ বেণ তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে উদ্যান বাটিকায় গিয়েছিলেন, নির্মাণ কার্যের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে। উদ্যান বাটিকার নির্মাণ পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট হলেও, সন্তুষ্ট হননি পথের পরিস্থিতিতে। রাজধানী থেকে উদ্যানবাটিকা পর্যন্ত যাবার যে একমাত্র পথ, সে পথের অবস্থা আদৌ আরামদায়ক নয়। কিছুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া, প্রাকবর্ষার অর্ধপ্রহরের বৃষ্টিতেই সে পথের পরিস্থিতি কদাকার। আসন্ন বর্ষায় সে পথের কী দশা হবে সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়। উদ্যান বাটিকা পরিদর্শনের পর, এই পথের আশু নির্মাণ কী ভাবে করা সম্ভব সেই আলোচনাই ছিল আজকের সভার মুখ্য বিষয়।

আজ প্রভাতী সভায় সিংহাসনে বসেই মহারাজ বেণ গম্ভীর স্বরে বললেন, “গতকাল উদ্যান বাটিকার কাজ স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে এসে আমার মনে হচ্ছে, আমার চতুর্দিক অকর্মণ্য ব্যক্তিরা বেষ্টন করে আছে। হাতে আর মাত্র পাঁচ পক্ষকাল সময়এই সভায় সকলেই উপস্থিত, কিভাবে এই রাজপথের দ্রুত নির্মাণ সম্ভব, আমাকে এখনই জ্ঞাত করা হোক। আগামী দুই পক্ষের মধ্যে, আমার রথ এবং অশ্বারোহী নিরাপত্তারক্ষীদের যাওয়ার মতো কঠিন ও সমতল পথ আমার চাই। মনে রেখো, আজ থেকে ঠিক দুই পক্ষকাল পর, আমি নিজে রথ চালনা করে উদ্যান বাটিকায় যাবো। সেইদিন যদি পথের পরিস্থিতির মনোমত উন্নতি না দেখি, ইহজগতে তোমাদের মুখও আমি দেখতে চাইব না”।

ভীত সন্ত্রস্ত প্রাজ্ঞ বাস্তুবিদ শংকরপাদ, মহারাজ বেণের সামনে নতজানু হয়ে, তাঁর আদেশের অপেক্ষা করছিলেন। গতকাল রাজা বেণের উদ্যান বাটিকা পরিদর্শনের সময়েই, তিনি কঠোরভাবে সতর্কিত হয়েছিলেন। রাজসভায় তাঁর উপস্থিতির নির্দেশ দিয়ে এসেছিলেন রাজা বেণ নিজে! আজ রাজসভায় ভীত কম্পিত স্বরে বললেন, “মহারাজ, আপনার মনোমত উদ্যান-প্রাসাদ নির্মাণেই আমি আমার সমস্ত মনোযোগ নিয়োগ করেছিলাম। পথের প্রতি অবহেলা হয়ে গিয়েছে সত্য। এক মাসকালের মধ্যে পথের যথাযথ সংস্কার হয়তো সম্ভব, কিন্তু...”।

সভায় উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে, অত্যন্ত বিরক্তিতে রাজা বেণ গর্জন করে উঠলেন, “কি মূর্খ এই বাস্তুবিদ্‌! এখনো একটি বাক্যও সম্পূর্ণ করেনি, অথচ তার মধ্যেই “হয়তো” এবং “কিন্তু”!  কিসের “কিন্তু”, কিসের “হয়তো”? আপনারা সকলেই অবগত আছেন, এই মূর্খ, আমার সরল সজ্জন পিতার প্রশ্রয়ে সারা জীবন সুসম্মানের সঙ্গে প্রতিপালিত হয়েছে! এই ধরনের কর্মবিমুখ অলস জীবেরা রাজার অন্নে প্রতিপালিত হয়, অথচ কর্মকালে দেখা যায় সে একটি বরাহ বিশেষ”! তারপর বাস্তুবিদ শংকরপাদের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “তোমার নাম শংকরপাদ কেন হে? শংকর তো তোমাদের এক ভগবানের নাম। এখনই যদি ঘাতককে তোমার মুণ্ডটা ধড় থেকে আলাদা করে দিতে বলি, তোমার ভগবান তোমাকে রক্ষা করবে তো?”

বৃদ্ধ, প্রাজ্ঞ বাস্তুবিদ শংকরপাদ আতঙ্কে অপমানে শিউরে উঠলেন। তাঁর সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল, তিনি বললেন, “মহারাজ, এক মাসের মধ্যে পথের নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু নির্মাণের জন্যে যে বিপুল পরিমাণ পাথরের টুকরো প্রয়োজন, এই কয়দিনের মধ্যে তা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব”।

মহারাজ ঘৃণায় কুঞ্চিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “অসম্ভব কেন?”

“আজ্ঞে মহারাজ, দয়া করে বিবেচনা করে দেখুন। মাত্র দুই পক্ষকালের মধ্যে পাহাড় কেটে পাথর সংগ্রহ করা, সেগুলো বহন করে এনে ভেঙে টুকরো করা কি একান্তই অসম্ভব নয়?”

মহারাজ বেণ অত্যন্ত বিরক্ত হলেন বাস্তুবিদ শংকরের কথায়, “আরে এই রাসভনন্দন একই কথা বারংবার বলেই চলেছে, “অসম্ভব, অসম্ভব”। ও শুনে আমার কোন মোক্ষলাভ হবে? কী করলে সম্ভব হবে, সেটা বলার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি তোমার আছে কি?”

সভার মধ্যে বসেছিলেন বৃদ্ধ নগরপালের যুবক পুত্র, শক্তিধর। শক্তিধর মহারাজ বেণের বাল্যবন্ধু ও অকৃত্রিম ক্রীড়া সহচর। সেই অনুগ্রহেই শক্তিধর সম্প্রতি উপ-নগরপাল পদের অধিকারী হয়েছেন। তিনি বললেন, “মহারাজ, আমার একটি নিবেদন আছে”

বন্ধুবর শক্তিধরের কথায় মহারাজ বেণ কৌতূহলী হলেন, বললেন, “কী নিবেদন, শক্তিধর”।

“আপনার উদ্যানবাটিকার অনতিদূরেই একটি বড়ো গ্রাম আছে। সেই গ্রামের অধিকাংশ গৃহই ইঁট এবং পাথরে তৈরি। ওই বাড়িগুলিকে ভেঙে ফেললে, বিপুল পরিমাণ ইঁট ও পাথরের টুকরো পাওয়া সম্ভব। শতাধিক গোশকটে এবং রাসভ-বাহনে সেই সমস্ত উপাদান বহন করে এনে, পথের উপর বিছিয়ে দিলেই আপনার সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব, মহারাজ”।

মহারাজা বেণ বন্ধুবর শক্তিধরের অদ্ভূত প্রস্তাবটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেনসভার মধ্যে তখন অখণ্ড নীরবতা। মহারাজা বেণের অত্যন্ত ধার্মিক পিতা মহারাজা অঙ্গের সমসাময়িক মন্ত্রী, অমাত্যরা সকলেই রয়েছেন সেই সভায়। শক্তিধরের এই প্রস্তাবে তাঁরা সকলেই শিউরে উঠলেন মহারাজা বেণ যদি তাঁর বাল্যসখার এই প্রস্তাবে রাজি হন, তাহলে আসন্ন বর্ষায়, ওই সমস্ত অসহায় গৃহবাসীর করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে তাঁরা মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করলেন।

মহারাজা বেণ কিছু বলতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এমন সময়, দুই রক্ষীর সঙ্গে সভার মধ্যে ঢুকে পড়ল এক বৃদ্ধ। দুই রক্ষী তাকে নিরস্ত করতে চাইছে, কিন্তু বৃদ্ধ কিছুতেই তাদের বাধা শুনছে না। চেঁচামেচি হট্টগোলে সভার রুদ্ধশ্বাস নীরবতা ভেঙে গেল। বিরক্ত মহারাজা বেণ, জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে, রক্ষীগণ? এত শক্তিশালী তোমরা, দুইজনে মিলে একজন বৃদ্ধকে সামলাতে পারছো না? কে এই বৃদ্ধ, কী চায় আমার কাছে?”

রক্ষী দুজন দুইপাশ থেকে দুইবাহু ধরে থাকল সেই বৃদ্ধর, তারা নত হয়ে মহারাজকে প্রণাম করে বলল, “মহারাজ, ইনি শ্রীবিষ্ণুমন্দিরের মুখ্যপুরোহিত। সম্মানীয় ব্যক্তি, ওঁনার ওপর শক্তি প্রয়োগ করা সমীচিন নয় বিবেচনা করেই আমরা শক্তি প্রয়োগ করিনি। মহারাজ, অন্য কোন অবাধ্য দর্শনার্থী হলে, তার রক্তদর্শন করে, ফেলে রাখতাম কারাগারের অন্তরালে। মহারাজ, আমাদের অপরাধ মার্জনা করবেন”।

অদ্ভূত এক বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ সুরে রাজা বেণ বললেন, “শুধুমাত্র মন্দিরের পুরোহিত বলেই একজনের এত সম্মান?” সভার সকলের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে মহারাজা বেণ আবার বললেন, “এই ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের মতো পরাশ্রয়ী জীব, আমি আর দ্বিতীয় দেখি না। কোন কর্ম করে না, সারাদিন ঈশ্বর নামক এক নিষ্প্রাণ মূর্তির সেবা, আরতি, যজ্ঞে কাল কাটায়, আর মূর্খ জনগণকে পাপ-পুণ্যের ভয় দেখিয়ে অর্থ আর মহামূল্য দ্রব্য হরণ করে। নিজেরা আনন্দে থাকে, সমাজের সমস্ত মানুষের থেকে সম্মান আদায় করে! ওহে, পুরোহিত, কি নাম তোমার?”

“শ্রীবিষ্ণুদাস দেবশর্মা” সেই ব্রাহ্মণ দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললেনব্রাহ্মণপুরোহিতের এই ঔদ্ধত্য, মহারাজ বেণের পছন্দ হল না তিনি লক্ষ্য করেছেন, সভায় এসে থেকে এই ব্রাহ্মণ তাঁর প্রতি সম্মানের অভিবাদন, নমস্কার কিংবা প্রণাম কিছুই করেনি।

শ্লেষ ভরা কণ্ঠে বললেন, “খুব তেজস্বী ব্যক্তি সন্দেহ নেই। কী তোমার বক্তব্য, শুনি”।

“মহারাজ, গতকাল সন্ধ্যার একটু আগে, কিছু অশ্বারোহী দুরাত্মা আমার কন্যাকে জোর করে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। ওরা পাঁচজন ছিল, কাল সারারাত আমার কন্যাকে বলাৎকার করেছে, মহারাজ! আমি এর বিচার চাই, আপনি এর বিহিত করুন। আজ সকালে সেই অশ্বারোহীদের কেউ তাকে রাজ পথের ধারে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমার কন্যা বিধ্বস্ত, মৃতপ্রায়, বাঁচার আশা ক্ষীণ। সে বলেছে, ওই পাঁচজনের মধ্যে উপনগরপাল শক্তিধরও ছিল”

নিস্তব্ধ রাজসভায়, মহারাজ বেণ বৃদ্ধ পুরোহিতের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, তারপর বললেন, “তোমার কন্যা সুন্দরী এবং দুশ্চরিত্রা নিশ্চয়ই। নচেৎ এমন হবার তো কথা নয়। একজন মৃতপ্রায়, দুশ্চরিত্রা রমণীর কথা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? এমন তো নয়, তোমার দুশ্চরিত্রা কন্যা মিথ্যা অপবাদে উপনগরপালের চরিত্র হনন করছে?”

রাজসভায় উপস্থিত প্রাচীন সদস্যরা সকলে মাথা নীচু করলেন। মহারাজ বেণ এবং তাঁদের সকলের দিকে তাকিয়ে, বিমূঢ় বৃদ্ধ পুরোহিত অন্তরের অসহায় আক্ষেপ থেকে হাহাকার করে উঠলেন, “আমার কন্যা দুশ্চরিত্রা? হাআআআঃ, আমার কন্যা দুশ্চরিত্রা? হা ঈশ্বর, হা ভগবান। এ কোন রাজার কাছে আমি এলাম সুবিচারের আশায়! সারা জীবন তোমার পূজা আর আরাধনায়, আমার কী কোন অপরাধ ঘটে গেছে? কেন আমার কন্যার এই বীভৎস পরিণতি! কেন বিচারের জন্য এসে আমার নিষ্পাপ কন্যার নামে এমন চরম অপবাদ শুনতে হচ্ছে? হে ঈশ্বর, হে পতিতপাবন, হে করুণাসিন্ধু, রক্ষা করো, রক্ষা করো আমাদের।”

মহারাজ বেণের পিতা মহারাজ অঙ্গ, সভায় প্রবেশের মুখেই ভগবান শ্রীবিষ্ণুর একটি সুন্দর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সভায় প্রবেশের আগে, তিনি এই ভগবান বিষ্ণুর পায়ে পুষ্পমাল্য অর্ঘ্য দিয়ে, রাজ সিংহাসনে বসতেন। পাথরের সেই মূর্তির পায়ে মাথা কুটতে লাগলেন বৃদ্ধ পুরোহিত। কপাল কেটে রক্তাক্ত হয়ে উঠল তাঁর শুভ্র কেশ, দাড়ি। অসহায় হতাশায় আর আক্ষেপে, কান্নাভাঙা বিকৃত স্বরে তিনি চিৎকার করতে লাগলেন, পাথরের কঠিন পাদুটি ধরে।

মহারাজ বেণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলসিংহাসন ছেড়ে সভাকক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি গর্জন করে উঠলেন, “শক্তিধর, এটা কি রাজসভা, নাকি নাট্যশালা? বসে বসে কী দেখছিস? তোর রক্ষীদের ডাক। আমি মহারাজা বেণ, আদেশ দিচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই দুর্বিনীত ব্রাহ্মণ পুরোহিত জ্ঞান না হারায় ওকে কশাঘাত কর। তারপর রাজপথের স্তম্ভে বেঁধে রেখে দে, তৃষ্ণার একবিন্দু জলও যেন না পায়, লক্ষ্য রাখিস। নগরের সকলে দেখুক মহারাজা বেণই বিচার করেন, কোন ঈশ্বর নয়। আর ভেঙে ফ্যাল ওই দেব মূর্তি, আজই, এখনই। সারা রাজ্যে আদেশ ঘোষণা কর, আগামীকাল থেকে সমস্ত দেবতার পূজা, আরাধনা বন্ধ। যদি পূজা করতেই হয়, প্রজারা আমার আরাধনা করবে। অন্য কারো নয়। আমি এই রাজ্যের রাজা, সমস্ত প্রজার মঙ্গল-অমঙ্গলের আমিই নিয়ামক, আমিই বিধাতা, আমিই ঈশ্বর”।   

মহারাজ বেণের এই ভয়ংকর রুদ্ররূপ কোনদিন দেখেনি, তাঁর বাল্যবন্ধু উপনগরপাল শক্তিধর। সন্ত্রস্ত উপনগরপাল, তার রক্ষীবাহিনী দিয়ে তৎক্ষণাৎ রাজার আদেশ পালন করল। রক্ষীদের লৌহ মূষলে, টুকরো টুকরো হয়ে ধুলোয় মিশে গেল শ্রীবিষ্ণু ভগবানের পাথরের সুচারু মূর্তি। অন্য একদল রক্ষী টেনে হিঁচড়ে সভাঘরের বাইরে নিয়ে গেল বৃদ্ধ পুরোহিতকে। তাঁকে নিয়ে যাবার সময় মহারাজ বেণের কানে এল কশাঘাতের তীক্ষ্ণ আওয়াজ ও বৃদ্ধ পুরোহিতের আর্ত চিৎকার। আভূমি নত হয়ে সন্ত্রস্ত উপনগরপাল শক্তিধর বললেন, “আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন হয়েছে, মহারাজ। কাল প্রত্যূষে দিকে দিকে সংবাদবাহক রওনা হয়ে যাবে আপনার আদেশপত্র নিয়ে। আগামী সাতদিনের মধ্যে সমস্ত রাজ্যবাসী জেনে যাবে আপনার ঘোষণা”।

মহারাজ বেণের তীব্র ক্রোধ এখন অনেকটাই প্রশমিত। আজ তিনি আরেকবার উপলব্ধি করলেন, বাল্যবন্ধু শক্তিধরকে তিনি উপনগরপালের দায়িত্ব দিয়ে ভুল কিছু করেননিশক্তিধরের পিতা ছিলেন, তাঁর পিতা মহারাজা অঙ্গের নগরপাল। তাঁকে তিনি অবসর নিতে বাধ্য করেছেন। এত দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া তাঁর মত অশক্ত বৃদ্ধের পক্ষে সম্ভব হতো না।

মহারাজ বেণ, স্মিতমুখে বললেন, “খুব ভালো, প্রিয়সখা শক্তিধর, খুব ভালো। যে কোন ঔদ্ধত্যের অঙ্কুরেই বিনাশ জরুরি। বিলম্বে আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়। অনেকদিন ধরেই আমি ভাবছিলাম, ধর্ম নিয়ে বিরক্তিকর এই ছেলেখেলাটা বন্ধ হওয়া দরকার। ভগবানের নামে কত যে সময় নষ্ট হয়, কত যে অজুহাত বানানো যায়! ভগবানের নামে অশিক্ষিত প্রজাদের কতভাবে যে বঞ্চনা করা যায়! আরও ভয়ংকর হচ্ছে, ভগবানের নামে কত অর্থ যে ব্যয় হয় মন্দির নির্মাণে, যজ্ঞ আর নিত্য পূজা-আরতির নামে, তার সীমা নেই। কোন একজনকে এই কাজটা করতেই হত। আমি মহারাজা বেণ, সেই কাজটাই শুরু করলাম, আগামীকাল থেকে এই রাজ্যে সমস্ত পূজা-পাঠ, শাস্ত্রচর্চা বন্ধএখন থেকে যাবতীয় স্তব-স্তুতি রচনা হবে মহারাজা বেণের নামে। আমিই এই রাজ্যের অবিসংবাদিত ঈশ্বর। এখন থেকে আমার সমস্ত নির্দেশ ও আদেশই হবে একমাত্র শাস্ত্রবচন”।

উপনগরপাল শক্তিধর, মহারাজা বেণের এখনকার স্বাভাবিক আলাপে অনেকটাই স্বস্তি পেলেন। মহারাজা বেণ তাঁর এককালের বাল্যসখা হলেও, তাঁর মনে প্রীতির থেকে আতঙ্কই বেশি কাজ করে। অপ্রত্যাশিত অনুগ্রহে তিনি উপনগরপাল হয়েছেন। অভূতপূর্ব এই ক্ষমতায় তিনি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন হয়ে উঠছেন, উচ্ছৃঙ্খল, অত্যাচারী ও দাম্ভিক। বাল্যসখার প্রতিটি আদেশ তিনি নির্দ্বিধায় পালন করতে বদ্ধপরিকর। তিনি জানেন, যতদিন তিনি মহারাজ বেণের অনুগত থাকবেন, তাঁর কোন অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হবে না। আবাল্য সঙ্গী মহারাজ বেণকে তিনি চেনেন নিজের হাতের তালুর মতো। মহারাজ বেণের সবথেকে পছন্দের ক্রীড়া, নৃশংসতম ও বীভৎসতম অত্যাচার।

মহারাজ বেণের প্রসন্নতায় নিশ্চিন্ত হয়ে, উপনগরপাল শক্তিধর বললেন, “মহারাজ, সব তো হল। কিন্তু আপনার উদ্যান-বাটিকায় যাওয়ার পথের কী হবে?”

“কেন, শক্তিধর? তুইই তো বললি, পাথর আর ইঁটের টুকরোর ব্যবস্থা তুই করে ফেলবি। ওই বাস্তুবিদ গেল কোথায়? উত্তেজনায় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। এই তো, এখনো নতজানু বসেই আছে, সিংহাসনের সামনে! হতভাগ্য অজনন্দন, এই কদিনের মধ্যে ওই পথ যদি বানিয়ে তুলতে পারে, তো ভালো, না হলে –”

“আপনার আদেশ, শিরোধার্য মহারাজ”। উপনগরপাল শক্তিধর বললেন। তারপর আতঙ্কিত বাস্তুবিদ শংকরপাদকে বললেন, “কাল অতি প্রত্যূষে পথের কাজ শুরু হওয়া চাই, ইঁট-পাথরের টুকরো আজ মধ্য রাতের মধ্যেই পৌঁছতে থাকবেএখন যান”

মহারাজ বেণকে এবং উপনগরপাল শক্তিধরকে প্রণাম করে অপমানিত, আতঙ্কিত বাস্তুবিদ শংকরপাদ, ক্লান্ত শরীরটাকে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলেন সভা থেকে। তাঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন মহারাজা বেণ, তাঁর মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠল। অপদার্থ এই বৃদ্ধের কথা তিনি মনে রাখবেন। ওর আয়ু এখন তাঁর হাতে, হয়তো উদ্যানবাটিকার নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত!

এতক্ষণ সভায় উপস্থিত সভাসদগণের কথা মহারাজ বেণের মনেই ছিল না। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, এই জরাগ্রস্ত বৃদ্ধেরা যদি পুত্তলির মতো বসে না থেকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে সচেতন হত, তাহলে তাঁর রাজকার্যের অনেক সুবিধা হত। তাঁদের স্থাণু মুখের দিকে তাকিয়ে মহারাজা বেণ বললেন, “আজকের মতো এখানেই সভার কাজ সাঙ্গ হল। আপনারা সকলে আসতে পারেন। নিশ্চেষ্ট বসে থাকবেন না, আমার ঘোষণা অনুযায়ী রাজ্যবাসীকে সচেতন করুন আগামীকাল থেকে রাজ্যে সমস্ত ধরনের পূজা ও শাস্ত্রচর্চা বন্ধ”।  



বেলা দুপ্রহরে হাটে তখনও জমজমাট ভিড়। সকাল থেকে বেচাকেনা, ব্যস্ততার পর হাটুরেদের এখন একটু গাছাড়া ভাব। বেসাতির লাভ ক্ষতি যা হয়েছে, সে হয়ে গেছে। এখন একটু কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, সংবাদের আদানপ্রদান। একটু নেশা ভাঙ। ভাত থেকে ধেনো, তালের রস থেকে তাড়ি, গুড় থেকে গৌড়ি। আর বিলাসীদের জন্য মধু থেকে মাধ্বী। তার সঙ্গে আছে আফিং, গঞ্জিকার নেশাও। নেশার ঝোঁকে তর্কবিবাদ, কলহ। নেশার ঝোঁকে রসের ফোয়ারা। তরল রসের ভিয়েন যেই করুক, মাটির কলসি থেকে শালপাতার দোনায় উপচে ওঠা রসের বেসাতি করে যুবতী মেয়েরা। রসের ভাণ্ডারি সেই মেয়েরাও কম রসিকা নয়। তাদের প্ররোচনায় হাটের রসিক মানুষজন উথলে ওঠে। বাড়াবাড়ি করলে অবশ্যি নিস্তার নেই, তাদের পিছনে থাকে খাণ্ডারনী মাসি, আড়ালে আবডালে থাকে ষন্ডাগুন্ডা লোকজন। তারা হাটের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় বেতালা মাতালদের। সে সময় সকালের যতো উপার্জন, মদ্যপদের ট্যাঁক থেকে হস্তান্তর হয়ে যায় তাদের হাতে।

মাথার উপর থেকে সূর্য একটু পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলেই হাটের লোকজন ঘরে ফেরার তোড়জোড় করে। যারা দূরের গাঁয়ে যাবে, তারা আর দেরি করে না। যারা কাছাকাছি থাকে, তারা আরো কিছুক্ষণ রসের সন্ধান করতে থাকে।

বিশ্বপ্রভ হাটে এসেছিল আশ্রমের জন্য জিনিষপত্র আদায় করতেআশ্রমবাসীদের পূজার জন্য চন্দন, ধূপ, ধুনো, নানান গন্ধ দ্রব্য, রন্ধনের মশলা। জরুরি কিছু লোহার ও কাঠের তৈজসপত্র, কিছু জড়ি, বুটি, ঔষধি গাছগাছড়া তিন সঙ্গীকে নিয়ে গরুরগাড়িতে সে হাটে এসেছে। আশ্রমের জিনিষে গরুরগাড়ি বোঝাই হয়ে গেছে হাট থেকে তাদের আশ্রম ক্রোশ তিনেকের স্বল্প পথ। তাই  কেনাকাটা হয়ে যাওয়ার পরেও হাতে অনেকটা সময় ছিল বলে বিশ্বপ্রভ ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছিল হাটের মধ্যে।

হাটের মধ্যে সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করতে বিশ্বপ্রভর খুব ভাল লাগে। ছোটখাটো লাভক্ষতি, সুখদুঃখ, শোকতাপে এই মানুষগুলো সহজেই উতলা হয়ে ওঠে। এরা নিজেদের মধ্যে খুব সামান্য কারণেই ঝগড়া করে, বিলাপ করে, কপাল চাপড়ে হা হুতাশ করে। আবার খুব স্বল্প আনন্দেই, হুল্লোড় করে, একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে, সুরার আসরে গিয়ে বসে, আকণ্ঠ মদ্যপানের পর আবার নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে, চিৎকার করে, হাটের লোক জড়ো করে। জীবনের এই সমস্ত লীলায় বিশ্বপ্রভ নিজে যোগ দেয় না ঠিকই, কিন্তু উপভোগ করে। তার আশ্রমের সুচারু শৃঙ্খলার জীবনপ্রণালীতে সে অভ্যস্ত, কিন্তু দূর থেকে হলেও, সাধারণ মানুষের এই আচরণের প্রতি সে বিদ্বিষ্ট নয়।

সে বিশ্বাস করে, এই সব সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের আবেগ থেকেই গড়ে ওঠে সুস্থ একটা সমাজ, বয়ে চলে সমাজবদ্ধ জীবনধারা। এই সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরের পরিপূরক। এই মানুষদের মধ্যে কৃষক চাষ করে ফসল ফলায়, সেই ফসল সমস্ত সমাজের মুখে তুলে দেয় দুবেলার অন্নতন্তুকার বানায় বস্ত্র পরিধান। কুম্ভকার বানায় গৃহস্থালীর মাটির তৈজসপত্রকর্মকার বানায় লোহার নানান সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র। সূত্রধর শিল্পীরা বানায় কাঠের আসবাব, খেলনা। স্বর্ণকার বানায় সোনা বা রূপোর অলংকার। আর এই সমস্ত পণ্য নিয়ে বাণিজ্য করে বণিকরা। তারা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্যের বেসাতি করে। তাদের বাণিজ্যের সাফল্যের সঙ্গে নির্ভর করে গোটা সমাজের আর্থিক উন্নতি! সকল শ্রেণীর মানুষের সফল যোগদানেই গড়ে ওঠে সুস্থ সমাজের কাঠামো।

বিশ্বপ্রভ যে আশ্রমে এখন শিক্ষারত, এই রাজ্যে তো বটেই, সমগ্র ভারতভূমিতেই সেই আশ্রমের খুব সুনাম। সকলে এই আশ্রমকে মহাবিদ্যালয় বললেও, মহর্ষি ভৃগু যিনি এই মহাবিদ্যালয়ের মহাচার্য্য, তিনি কিন্তু আশ্রম নামটিই পছন্দ করেনএই রাজ্য এবং এই বিশাল ভারতভূমির অন্যান্য রাজ্যের পরাক্রান্ত রাজারাও তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। বিচক্ষণ সুপণ্ডিত হিসেবে তিনি সুবিদিত, সাধারণ জনগণও তাঁর নাম শুনলেই প্রণাম করে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। মহর্ষির প্রতি শ্রদ্ধায় এবং তাঁর আশ্রমের একজন আশ্রমিক হওয়ার কারণেই, তাকেও এই হাটে অনেকেই চেনে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। মহর্ষি ভৃগুর কাছে শিক্ষারত এই তরুণের বুকের মধ্যে তারা নিঃস্বার্থ মায়ার আঁচ পায়। বয়সে তরুণ হলেও সাধারণ মানুষ তাদের সুখদুঃখের কথা, বিশ্বপ্রভকে বলে যেন শান্তি পায়

হাটে ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে বিশ্বপ্রভর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আচার্য বেদব্রতর আচার্য বেদব্রতও গুরুদেব ভৃগুর কৃতী শিষ্য, তবে প্রাক্তনী। বিশ্বপ্রভর থেকে বয়সে অনেকটাই বড়ো। মহর্ষি ভৃগুর আশ্রম থেকে পাঠ সাঙ্গ করে, আচার্য বেদব্রত এখন গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করছেন এবং বেশ সুনামের সঙ্গে নিজেই একটি আশ্রম পরিচালনা করছেন আচার্য বেদব্রতর সঙ্গে বিশ্বপ্রভর পরিচয় মহর্ষির আশ্রমে। নানান অনুষ্ঠানে আশ্রমের কৃতী প্রাক্তন ছাত্ররা আমন্ত্রিত হন, সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। পরিচয় পর্ব থেকেই দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। আচার্য বেদব্রতর আচার্য সুলভ গাম্ভীর্য থাকলেও, আলাপে সুরসিক ও আন্তরিক। সকল বয়সীদের সঙ্গেই তিনি স্বচ্ছন্দ। মহর্ষির সঙ্গে কোথাও যেন তাঁর খুব মিল খুঁজে পায় বিশ্বপ্রভ।

বিশ্বপ্রভ আচার্য বেদব্রতকে প্রণাম করল, আচার্য বেদব্রত তাকে বুকে জড়িয়ে মস্তক আঘ্রাণ করার পর জিজ্ঞাসা করলেন, “গুরুদেব, ভালো আছেন তো, বিশ্ব? অনেকদিন তোমাদের ওখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি”

“ভালো আছেন, আচার্য। আপনার সংবাদ সব কুশল তো?”

“সংসারী মানুষ কবে কোথায় সর্বকুশলে থাকে, আমার জানা নেই বিশ্ব, তবে সাধারণ অর্থে কুশল। তোমার লেখাপড়া কদ্দূর?”

“আশা করি সামনের বাসন্তী সমাবর্তনে সামবেদ কিছুটা আয়ত্ত্ব হয়ে উঠবে”।

“তোমার মেধা এবং স্মরণশক্তি সম্পর্কে, গুরুদেব স্বয়ং উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, আমি জানি। তারপরেও তুমি কিছুটা বলছো কেন, বিশ্ব? তোমার পাঠ সম্পর্কে তোমার মনে কি কোন দ্বিধা আছে?”

বিশ্বপ্রভ কিছুটা ম্লান মুখে বলল, “আমার বিদ্যাচর্চায় গুরুদেব সন্তুষ্ট কিনা, গুরুদেবের আচরণে ঠিক বুঝতে পারি না, আচার্য

“কেন বলতো, উনি কি কিছু বলেছেন, তোমাকে”?

“কিছুই বলেননি। মাস তিনেক আগে, আমার সহপাঠী ছয়জনকে গুরুদেব বিদ্যাসমাপ্তির নির্দেশ দিলেনতাদের আশ্রম ত্যাগ করে, জীবিকার সন্ধান এবং গার্হস্থ্যধর্ম পালন করার নির্দেশ দিলেন। অথচ আমার পাঠ নিয়ে কোন মন্তব্যই করলেন না”।

আচার্য বেদব্রত প্রাণখোলা হাস্যে চমকে দিলেন আশেপাশের সকলকে, বললেন, “আমার ধারণা, ছয়মাস চর্চার পরও তোমার ঐ সহপাঠীরা তেমন সুবিধে করতে পারেনি বলেই, গুরুদেব তাদের বিদায় করেছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমার সম্পর্কে তাঁর মতামত ভিন্ন...”  

হঠাৎ উৎকট পটহের আওয়াজে আচার্য বিরক্ত হয়ে কথা থামালেন। দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন হাটের মধ্যস্থলে দেবমণ্ডপের অঙ্গনে। সেখানে রাজার দুই অশ্বারোহী সৈনিক দাঁড়িয়ে, সঙ্গে এসেছে বাদ্যকরের দল আর অশ্বারোহী ঘোষক। রাজার কোন বিশেষ ঘোষণা প্রচার করার থাকলে এই ধরনের হাটেই সেই ঘোষণার প্রচার হয়, এই ভাবেই পনের-বিশখানা গ্রামে লোকমুখে প্রচার হয়ে যায় রাষ্ট্রের ঘোষণা। পটহ ধ্বনিতে হাটে উপস্থিত সকলেই যখন সৈনিকদের দিকে মনোযোগ দিল, পটহ বাদন বন্ধ হয়ে শোনা গেল ঘোষকের উচ্চস্বর,

“আজ জৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষের পুণ্য দ্বিতীয়া তিথির বিশেষ ঘোষণা - আজ থেকে এই রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, প্রজাদের কাছে স্বয়ং পরমপুরুষস্বরূপ, মহারাজাধিরাজ বেণ ছাড়া অন্য কোন ঈশ্বরের অথবা দেবতার পুজো করা চলবে না। এই রাজ্যের অধিপতি মহারাজাধিরাজ বেণই সকল দেবতার পরম দেবতা, সকল ঈশ্বরের তিনিই পরম ঈশ্বর। অতএব তাঁকে ছাড়া অন্য কোন দেবতার কিংবা ঈশ্বরের পূজাকর্মকে, তাঁর অপমান কিংবা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ বলেই বিবেচনা করা হবে। রাজশক্তির অপমানের শাস্তি নির্বাসন, অথবা সশ্রম কারাদণ্ড কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যুদণ্ড। অতএব, প্রজাদের মঙ্গলের জন্য সদাচিন্তিত, প্রজাদের পিতৃতুল্য ও স্বয়ং ঈশ্বরস্বরূপ রাজাধিরাজ বেণের ভজন ও পূজনই সকল প্রজার পক্ষে কল্যাণকর। অন্যথায় সমূহ সর্বনাশ”।      

ঘোষণা শেষে রাজার সৈনিকেরা চলে গেল।

দেবপূজা বন্ধ? এ কখনো হতে পারে? হাটে উপস্থিত লোকজন ঘোষণার অভিঘাতে বিহ্বল ও হতবাক। তারা যা শুনল, তার সম্যক অর্থ সকলের কাছে যেন স্পষ্ট নয়। তাদের আচরণে উদ্বেগ ও শংকা। এতক্ষণ যে স্বাভাবিক আচরণে হাটে উচ্চ কোলাহল শোনা যাচ্ছিল, এখন তা চাপা গুঞ্জনে পরিণত হল।  

আচার্য বেদব্রত বিশ্বপ্রভর কাঁধে হাত রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, “হাটের কাজ যদি শেষ হয়ে থাকে, তুমি তাড়াতাড়ি আশ্রমে ফিরে যাও, বিশ্ব। গুরুদেবকে আমার প্রণাম দিও, যা শুনলে ও জানলে, ওঁকে বিস্তারিত জানিও। আর বলো, আমরা অতি শীঘ্রই গুরুদেবের দর্শনপ্রার্থী হবো। এখন এসো, আর বিলম্ব করো না”।


চলবে...

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/২

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের প্রথম পর্বাংশ  পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/১ " তৃতীয় পর্ব - দ্বিতীয়  পর্...