এর আগের পর্বগুলি পড়তে হলে এই সূত্র ধরে টান দিন
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=31438
৩১
বীজপুরে জনাইয়ের
চটিতে ভল্লা আর মারুলা যখন পৌঁছল মধ্যরাত্রির তখনো দণ্ডদুয়েক বাকি। পিছনের
দরজায় ভল্লা টোকা দিতে জনাইয়ের সহকারী এসে দরজা খুলে দিল। দুজন পরিচারক ভল্লাদের ঘোড়াদুটো নিয়ে
চলে গেল অশ্বশালার দিকে। দরজা বন্ধ করে নমস্কার
জানিয়ে সহকারী চলে যেতে, ভল্লারা জনাইয়ের ঘরে
ঢুকল। ভল্লা এবং মারুলা দুজনের কাছেই
এই ঘর অত্যন্ত সুপরিচিত। কাজেই তারা নিজেদের মতো করে মেঝেয় আরাম করে বসল।
জনাই বাইরে কোথাও
ছিল, ঘরে ঢুকে ওদের জিজ্ঞাসা করল, “এত
রাত্রে নিশ্চয়ই চান করবি না, একবারে মুখ-হাত-পা ধুয়ে এসে বস না। খাওয়া-দাওয়া সেরে
শুয়ে পড়বি”।
মারুলা বলল,
“কী খাওয়াবি?”
“গমের রুটি আর
অজমাস”।
মারুলা উঠে
দাঁড়িয়ে বলল, “ভল্লা রে, চল চল ঝট করে চানটা সেরে আসি – ওফ্ কত মাস পর
যে অজ-মাংস খাবো...শুনেই পেটটা খিদেয় কেমন জ্বলে উঠল”।
খেতে বসে
জনাই বলল, “কী অবস্থায় তুই সেদিন এসেছিলি, মনে
আছে ভল্লা?”
“মনে নেই আবার?
আধমরা অবস্থায়”।
“তোকে দেখে ভয়
পেয়েছিলাম খুব – এতটা পথ হেঁটে যাবি কী করে? যাওয়ার সময় তুই রণপা নিতে চেয়েছিলি – দিতে
পারিনি – ওপরের নিষেধ ছিল। শেষ রাতে তুই যখন বেরিয়ে গেলি – মনটা খুব খারাপ হয়েছিল –
জ্যান্ত অবস্থায় নোনাপুর পৌঁছতে পারবি তো? কাজ শেষ করে সুস্থ শরীরে এখন বাড়ি ফিরছিস,
এটা ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া আর কী বলব?”
ভল্লা হাসল কিছু
বলল না।
“এখন কী
অবস্থা নোনাপুরের?” জনাই জিজ্ঞাসা করল।
“নোনাপুর নয়
– ও গ্রামের নাম এখন জুজাকপুর”। ভল্লা বলল।
“শুনেছি।
কিন্তু ও নাম আমাদের মাথায় বসতে সময় লাগবে। এও শুনেছি গ্রামপ্রধান হয়েছেন কমলিমা”।
“ওটাও তোর
বোদা মাথায় বসতে সময় লাগবে, জনাই। গ্রামপ্রধান নয় প্রধানা – উনি একজন মহিলা”। হাড়ের
ভিতর থেকে মজ্জা বের করার চেষ্টা করতে করতে মারুলা বলল।
“বুঝলাম – কিন্তু
তাতে ওই গ্রামগুলোর কিছু উন্নতি হচ্ছে বা হবে বলে মনে হচ্ছে? তা
নাহলে গ্রামের নাম বদলে কিংবা মহিলাপ্রধান নিয়ে কি গ্রামের লোক ধুয়ে ধুয়ে খাবে?”
ভল্লা বলল,
“হয়েছে বৈকি। নতুন যে জমিগুলোতে বাদাম আর তুলোর চাষ করেছিল গ্রামের লোক, ভালই ফসল
হয়েছে। জনাধিকারিক এসেছিল দুজন – গ্রামের পরিস্থিতি দেখে গেছে। তারা আমাদের বানানো
নড়বড়ে বাঁধটা দক্ষ লোক এনে আরো পোক্ত করে
তুলবে। কাছাকাছি কয়েকটা কূপও বানিয়ে দেবে – জমিতে জলসেচের জন্যে। চাষের জন্যে ওরা
ছটা বলদ দেবে – আর দেবে গোটা পাঁচেক দুধেল গাই। তোর জানাশোনা জনা দুয়েক যাদব-ছোকরাকে ওখানে
পাঠাতে পারবি? গ্রামের লোকদের মধ্যে কোনদিনই কেউ গোপালন করেনি...কীভাবে করতে হয়
জানেও না”।
জনাই বলল, “মাস
খানেক আগে আমার কাছে একটা ছোঁড়া এসে উপস্থিত হয়েছিল। একেবারে আধমরা সঙ্গীন অবস্থায়।
এখানে কদিন রেখে, খাইয়েদাইয়ে সুস্থ করে জানতে পারলাম এই ছোঁড়াটার সঙ্গেই উপানু
বজ্জাতি করত। ছোঁড়া গোপালনের কাজ ভালই জানে – আমার গোশালাতেই ওকে কাজে লাগিয়েছি।
ছোঁড়ার নাম বিড্ডা। ওকে আমি তোদের গ্রামে পাঠাতে পারলে নিশ্চিন্ত হই...”।
“কেন?”
খাওয়া থামিয়ে মারুলা জিজ্ঞাসা করল, “ছোঁড়াটা কি সত্যিই ঢ্যামনা? নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে
আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছিস?”
“ধ্যার
ব্যাটা, সে হলে তো আমিই ওকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতাম। ওসব কিছু নয় - ছোঁড়া খুবই
নিরীহ – নাদুনুদু ধরনের। কিন্তু কাজের ছেলে। এত ভীতু আর মুখচোরা –
হয়তো উপানুর অত্যাচারের জন্যেই – দেখলেই তোদের মায়া হবে”। একটু থেমে জনাই আবার বলল,
“আমার এখানে অনেক লোক কাজ করে, সে তো তোরা জানিস। তাদের সকলেই জেনে গেছে – উপানু
ওকে কীভাবে অত্যাচার করত। তাদের মধ্যে অনেকেই ওর পেছনে লাগছে – অশ্রাব্য নানান ইঙ্গিত
করছে। অন্যের জীবনে যদি কেউ একটা বিষাক্ত ক্ষত খুঁজে পায়,
জানি না কেন, কিছু লোক সেটাকেই খুঁচিয়ে বড়ো আনন্দ পায়…”।
মারুলা বলল,
“ভাবিস না জনাই, আমি ওকে নিয়ে যাবো…ও জুজাকপুরেই থাকবে। কিন্তু ও একা হাতে দশ-বারোটা বলদ-গরু
সামলাতে পারবে?”।
জনাই বলল,
“দু-একজন হাত-নুড়কুত দিলে ও শিখিয়ে
নেবে – যতটা দেখেছি ওকে, কাজটা ও ভালই
বোঝে”।
“তাহলে
নিশ্চিন্ত থাক – ওকে আমি কালই নিয়ে যাবো”।
খাওয়া হয়ে যাওয়াতে
সকলেই উঠে পড়ল, বাইরে থেকে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেদের বিছানায় এসে আবার যখন বসল, রাত্রি
দ্বিতীয় প্রহর শেষের ঘন্টা বেজে উঠল দুবার। মারুলা বিছানায় আরাম করে আড় হয়ে বসে
বলল, “অনেকদিন পর, খেয়ে বড়ো আনন্দ পেলাম রে জনাই, আশীর্বাদ করছি তুই শত সন্তানের
বাবা হবি”।
জনাই খ্যাঁক
করে উঠল, মুখ ভেংচে বলল, “কেন রে হতভাগা? আমাকে তোর জন্মান্ধ বলে মনে হচ্ছে?”
জনাইয়ের ভড়কে
যাওয়া দেখে মারুলা হাসল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। তাকে পাত্তা না দিয়ে জনাই ভল্লাকে
জিজ্ঞাসা করল, “এদিকে তোর সেই ছোকরা রামালি ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’ নামিয়ে ফেলল?
একেবারে বিয়ে-থা করে কমলিমায়ের বাড়িতেই জাঁকিয়ে বসল? দু-দুটো গাঁয়ের লোককে পেট ভরে
খাওয়াল?”
“কেন? তাতে খারাপটা
কি হয়েছে? কমলিমায়ের শূণ্য সংসার আবার ভরে উঠল। শৈশবেই বাপ-মা হারানো রামালি পেল একজন
মা। কুসির মতো সুন্দর মেয়েটি বউ এবং বউমা হয়ে – দুজনকেই বেঁধে রাখবে পরম মমতায়। কমলিমা
এবং রামালি দুজনেরই জীবন এতদিনে সার্থক হয়ে উঠবে। আর আড়ালে থাকবে কুসি। ওই দিকের সবকটা
গ্রামের অবস্থাই আমূল বদলে যাবে – একথা তোকে আমি আজ জোর গলায় বলে যাচ্ছি জনাই, ভবিষ্যতে
মিলিয়ে নিস”।
ভল্লার আবেগ
জনাই এবং মারুলা দুজনকেই স্পর্শ করল বেশ। দুজনেই মাথা নীচু করে বসে রইল অনেকক্ষণ। নিজেকে
সামলে নিয়ে, গম্ভীর পরিবেশটাকে হাল্কা করার জন্যে, ভল্লা বলল, “রাজ-শ্যালকের কী সংবাদ রে? ব্যাটাকে কী খাওয়াচ্ছিস কি? তোর চটি
থেকে সে নড়ছেই না। নিজের প্রাসাদে কবে যাবে?”
জনাই
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আর বলিস না
ভাই, রতিকান্তর চ্যালাচামুণ্ডারা যা শুরু করেছে... আমার রাত্রে ঘুম ছুটে গেছে। যেদিন
বিদায় হবে... দুমাসের ছুটি নিয়ে উত্তরে যাবো গঙ্গাস্নান করতে”।
“কেন কী
করছে কি?” ভল্লা জিজ্ঞাসা করল।
“কী আর
করবে? মাকালটা চিরকাল যা করে এসেছে - পতিতাপল্লী থেকে মেয়েদের তুলে আনছে”। মারুলা
খুব নিশ্চিত সুরে আরও বলল, “বীজপুরের ছোকরাদের একটা বড় দল খেপেছে – দু তিনদিনের
মধ্যেই কিছু একটা ঘটবে...একটু ধৈর্য ধর জনাই। আচ্ছা একটা কথা বলতো জনাই – তোর এই
পান্থশালা থেকে আধক্রোশ দূরে, জঙ্গলের মধ্যে নাকি হঠাৎ কোন এক পাগলের
উদয় হয়েছে? জানিস কিছু?”
“হ্যাঁ। এই
ধর মাস দেড়েক আগে। শুনেছি তার ঝোলায় নাকি মড়ার
খুলি এবং আরও বেশ কিছু হাড়গোড় আছে। সঙ্গে আছে দুটো ভল্লও। যারা প্রথম থেকে ওকে দেখেছে, বলছে, ও প্রথম এসেছিল মস্ত গালপাট্টা আর গোঁফ নিয়ে। সারাক্ষণ নিজের
মনেই বিড়বিড় করত – মাথা-খ্যাপা মানুষ যেমন হয় আর কি। তখন মোটামুটি
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। এখন শুনেছি তার মাথায় জটা, মস্ত দাড়ি গোঁফ। ভয়ংকর নোংরা
চেহারা – খালি গা আর পরনে বিশ্রী নোংরা ট্যানা। আগের মতোই সারাক্ষণ আপনমনে বিড়বিড়
করে। কিন্তু আজকাল রাত্রে মাঝে মাঝে বিকট
চিৎকার করে ওঠে। কি বলতে চায় সঠিক বোঝা যায়
না”।
“বিরাট গালপাট্টা আর গোঁফ… আচ্ছা?” মারুলা বলল।
জনাই জিজ্ঞাসা
করল, “তুই চিনিস নাকি?”
“না রে ভাই, আমি চিনব কী করে? তবে গালে গালপাট্টা আর বড়ো গোঁফ থাকলে - সহজেই লোকের মনে থাকে যায়…তাই না? তা লোকটা খায় কি?”
“এদিকের
লোকদের খুব দয়া-মায়া রে মারুলা – কাছকাছি গ্রামের লোকজন কেউ না কেউ যাওয়া আসার পথে
দুবেলা দুমুঠো খাওয়া জুগিয়ে যাচ্ছে, শুনেছি”।
“লোকটা
পাগল-ছাগল যাই হোক, তার মানে বেশ সুখেই আছে...”
জনাই এ কথার
কোন উত্তর না দিয়ে বলল, “কাঁধে হাড়গোড়ের ঝোলা নিয়ে – লোকটা সত্যিই পাগল নাকি কোন অভিসন্ধিতে ভেক ধরে আছে
– কে জানে? যাগ্গে আমি আর চিন্তা করে কী করব? তোরা ঘুমো – সব ঠিকঠাক আছে কিনা একবার
দেখে আসি চট করে, শালা-মহারাজের পান থেকে চূণ খসলেই… ”। জনাই উঠে পড়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল – দরজাটা চেপে দিয়ে।
ভল্লা খুবই নীচু
গলায় মারুলাকে জিজ্ঞাসা করল, “পাগলাটাকে তুই
চিনিস মনে হচ্ছে?”
মারুলা ভল্লার
মুখের দিকে সরুচোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “আমার ধারণা ও আস্থান থেকে পালিয়ে যাওয়া একব্যাটা রক্ষী - নাম
বিপন। আমরা যে রাতে আস্থান আক্রমণ করেছিলাম – ও ঘরে ঘুমোচ্ছিল। তারপর ভোর হতেই সবার
সঙ্গে পালিয়েছিল। ওই ঘটনার দিন পনের আগে বিপনের
ছেলেটাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়...”।
“নিরুদ্দেশ?”
“আরেঃ - ওই ছোঁড়াটাই
তো ছিল উপানুর চর।
রাজধানীর অস্ত্রবাহী শকটগুলোর পিছনে ব্যাটা এঁটুলির মতো সেঁটেছিল, মনে নেই? ছোঁড়াটাকে মেরে পুঁতে
দিয়েছিলাম – বীজপুর থেকে নোনাপুর যাওয়ার পথের ধারের মাঠে। মনে হচ্ছে নেকড়ে বা শেয়ালের দল সন্ধান পেয়ে
হতভাগার দেহটা খুঁড়ে বের করেছিল। বিপন পালানোর সময় কোনোভাবে সেই দেহাবশেষ দেখতে পেয়েছে। আর তার
নিরুদ্দেশ হওয়া ছেলেকে চিনতেও পেরেছে... সেই কারণেই শোকে-দুঃখে
ওর মাথা খারাপ…। কিন্তু এ লোককে তো বাঁচিয়ে
রাখা যাবে না, ভল্লা। ওর পাগলামি কোনক্রমে ভালো হয়ে গেলে – ব্যাটা রাজধানীতে অভিযোগ করতে
পারে – তাতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়লেও অবাক হব না”।
“ঠিক। তাহলে
আর কি – কাজটা নির্বিঘ্নে সেরে ফেল”।
“উঁহু –
আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে – শালা এক ঢিলে দু পাখি মারবো”।
“কী রকম?”
“তুই তো
জানিস, রতিকান্তকে মুতিকান্ত বানানোর দায়টা তোর ঘাড়ে চাপিয়ে – তোকে মেরে ফেলার নাটক করে, “ভল্লা” নামটাকেই মুছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কোন নিরীহ
লোককে ভল্লা সাজিয়ে, অকারণ না মেরে, বিপনকে মারলেই সব ল্যাঠা চুকে যায় – কী বলিস?”
“কেউ বিশ্বাস করবে - কুখ্যাত ভল্লা পাগল সেজে প্রায়
একমাসের ওপর জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে”?
“থাকতেই পারে...ভল্লা যে কি ভয়ানক তুই জানিস না? সে জলে আগুন জ্বালতে পারে…
পাখি হয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে পারে…”।
ভল্লা বিরক্ত
হয়ে বলল, “ওফ্ এত বাজে বকিস কেন বল তো?”
মারুলা গম্ভীর
হয়ে বলল, “ভল্লার মৃত্যুসংবাদ শুনে – এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ওরকমই বলবে রে, ডামল।
নিরীহ বঞ্চিত জনসাধারণের কাছে “ভল্লা” তখন হয়ে উঠবে স্বপ্নপূরণের নাম। যে নিজের জীবন
দিয়েছে – কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়েনি। “ভল্লা” নামটাই হয়ে উঠবে – বিদ্রোহের
স্ফুলিঙ্গ…। বাজে কথা বলিনি, রে ডামল – আর আমার কথা যদি না ফলে – তাহলে তোর বাড়ির গাইটার
নাম রাখিস মারুলা – আমি গোমাতা হয়ে যৌবনের শেষদিন পর্যন্ত তোর পরিবারকে দুধ জুগিয়ে
যাবো…”।
ভল্লা লাথি কষাল
মারুলার কোমরে – মারুলা খিঁকখিঁক করে ফিচেল হাসল, বলল, “রতিকান্তকে খাসি করার পরিকল্পনাটা
শুনেছিস?”
“বললি কখন যে
শুনবো”?
মারুলা উত্তেজিত
হয়ে বিছানায় উঠে বসল, বলল, “রতিকান্ত রোজই বিকেলের ঝোঁকে বিশেষ একটা পাড়ার দিকে যায়…”
“বেশ্যাপাড়া”?
“হুঁ। কিন্তু
পাড়ার ভেতরে যায় না। রতির আড়কাঠিরা পাড়ার বেশ কিছু মেয়েকে পাড়ার বাইরে এনে – সার দিয়ে
দাঁড় করায় তার সামনে। যাকে তার চোখে ধরে – তাকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে রসালাপ করে –
আর বাকিরা ফিরে যায়। তার দেহরক্ষীরা ওই সময় একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে…”।
“বলিস কী, রসালাপের
জন্যে এত বড়ো ঝুঁকি নেয় হতভাগা?”
“বুঝলি না, রসের
জোয়ারে মাথা ঠিক রাখতে পারে না”। খুকখুক করে একটু হাসল মারুলা, তারপর বলল, “বীজপুরের
কিছু ছেলেদের নিয়ে আমি আগামীকাল বিকেলে এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করব। ওই দলে এক ছোঁড়া
আছে – বেশ সুন্দর দেখতে – শুনেছি যাত্রা পালায় সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী সেজে দর্শকদের
চোখের জলের বান আনে। কালকে পতিতা মেয়েদের সঙ্গে ওই ছেলেটিকে মেয়ে সাজিয়ে দাঁড় করানো
হবে”।
“তোরা ধরে নিচ্ছিস,
অন্য সকলকে ছেড়ে রতিকান্ত ওই ছেলেটিকেই ডাকবে…যদি না ডাকে?”
“একশবার ডাকবে
– ওর সঙ্গে বাকি যারা থাকবে – তারা সকলেই হবে যৌবনের উপান্তে পৌঁছানো পৃথুলা নারী…তাদের
মধ্যে ওই ছেলেটিকে ছাড়া আর কাউকেই চোখে ধরবে না রতিকান্তর। আমরা কয়েকজন লুকিয়ে থাকবো…
রতিকান্ত ছেলেটিকে নিয়ে আড়ালে এলেই – ব্যাটার মুখ-হাত-পা চেপে ধরে আসল কাজটা সেরে ফেলব…”।
“এই কাজটার জন্যেই
তুই দাড়ি আর চুল রাখতে শুরু করেছিস?”
“তা নয় তো কী
- কদম্বপুরে রতির দিকে তুই ভল্ল ছুঁড়েছিলি – তোর ছিল গালভর্তি দাড়ি আর ঝাঁকড়া চুল –
আমারও এখন তাই। রতি ভয়ে দুজনকে একই লোক ধরে নেবে – বলবে এটাও ভল্লারই কাজ। ওখান থেকে
পালিয়ে আমি প্রথমেই চুলদাড়িগোঁফ সাফ করব – তারপর বিপানকে শেষ করে ভল্লার গল্প শেষ করে
দেব”।
ভল্লা মুচকি
হেসে বলল, “পরিকল্পনাটা ভালই ফেঁদেছিস – নিজের
চোখে দেখে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে…”।
মারুলা উদ্বিগ্নমুখে
বলল, “এ কথা মনেও আনিস না ডামল, রক্ষীদের অনেকেই তোকে খুব ভালো ভাবে চেনে – দেখতে পেলে
তোকে বাঁচানো যাবে না…”।
ভল্লা মারুলার
আন্তরিক উদ্বেগটা অনুভব করে মারুলার একটা হাত টেনে নিয়ে বলল, “ভাবিস না – তোরা যখন
কাজটা করবি – তখন আমি হয়তো অনন্তপুরের চটিতে পৌঁছে যাবো”।
মারুলা ভল্লার
ধরে থাকা হাতে চাপ দিয়ে বলল, “না – তুই কাল অনন্তপুরের থামবি না, সোজা কদম্বপুর যাবি।
সহাধ্যক্ষকে সব বার্তা দিয়ে, তারপর তুই বাড়ি ঢুকবি”।
ভল্লা মারুলার
চোখে চোখ রাখল কিছুক্ষণ, বলল, “শুয়ে পড় – কাল বেরোনোর আগে তুই আমার ক্ষৌরী করে দিবি
– ভল্লা যেন আগের ডামল হয়ে উঠতে পারে”।
(ক্রমশঃ)