Powered By Blogger

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫

রোববার - ২

 

রোববার -২

হিন্দী সিনেমায় প্রায়ই এমন হয়। ভিলেনের সাংঘাতিক ডেরায় এক হিরো ভারি ভারি শিকলে বন্দী, পায়ের তলায় প্লাস্টিকের ভুখা কুমীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য হিরো ঝনঝনিয়ে কাচের জানালা ভেঙে ঢুকে পড়ল অকুস্থলে। ঢুকেই দেখল খেলনা বন্দুক হাতে ঝুড়ি ঝুড়ি কাতিল ভিলেনের সাঙ্গপাঙ্গ সবসেও পড়ে গেল ভিলেনের খপ্পরে। দুই হিরোকে বন্দী করে ভিলেন এবার শুরু করল তার সাত পাতার ডায়ালগ। তার আজীবন করে আসা কুকীর্তির বিশাল ফর্দ। লাস্টে মিচকে হাসি হেসে ঘোষণা করল দুই হিরো আসলে বচপনমে বিখরে হুয়ে দুই ভাই। ভেইয়া চোখে চোখে কথা শুরু দুই ভাইয়ে। তারপর যা হয় সেটা সিনেমায় দেখে নেবেন সবটা বললে আড়াই ঘন্টার হিন্দী সিনেমার জমাট রহস্যটাই মাটি।

কিন্তু সাড়ে চার ঘন্টা উইথ চড় চাপড় চর্চার পর যে ছেলেটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার ভাই হয় শুনে আমি মোটেই আনন্দ পাইনি। মনে হয়েছিল ভাইটা খামোকা ওখানে দাঁড়াল কেন? আর দাঁড়ালই যদি তো আমার ভাই হতে কে ওকে মাথার দিব্বি দিয়েছিল। কারণ ওটাই ছিল আমার ট্রানস্লেসানের লাইন। The boy who stands there is my brother.

লখী বাবুকা সোনা চাঁদি গহনাকা দুকান। আসলি শব্দটা ভিন্ন ভিন্ন শব্দের সামনে বসিয়ে একসময় বেশ কিছু দোকান চালু ছিল। যেমন আসলি লখী বাবুকা..., লখী বাবুকা আসলি সোনা..., লখী বাবুকা সোনা আসলি চাঁদিকা..., লখী বাবুকা সোনা চাঁদিকা আসলি গহনাকা...ইত্যাদি। ঠিক সেই রকম বয়, হু, স্ট্যান্ডস আর ইজ এই চারটে শব্দ স্থানে অস্থানে সামনে পিছনে বহুবার বসিয়েও বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি সেদিন। যেমন   দি ব্রাদার ইজ মাই বয় হু স্ট্যান্ডস দেয়ার, দি হু ইজ মাই দেয়ার স্ট্যান্ডস ব্রাদার বয়... এই রকম সবসত্যি বলতে সেদিন থেকেই আমি সকল বেরাদরির ওপর বিশ্বাস হারিয়েছি।

এরকম আরো কিছু ছিল। স্টেসনে পৌঁছানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আর ডাক্তার পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই রোগী মারা গেল। কোনটা আগের আর কোনটা পরের অতীত। আরো সহজে বললে পুরোনো ভূত আর আনকোরা ভূত খুঁজে বের করার সেই একই বিড়ম্বনা নো সুনার হ্যাড ... । নাঃ - এটা আর ট্রাই করব না। এই বয়সেও ভুল করলে বেইজ্জতের একশেষ হবো।

তখন আমাদের বাড়িতে চিকেনের চল একদম ছিল না। আর হরহপ্তায় মাংসও হতো না এখনকার মতো। মাসের প্রথম রোববারে মাংস হত পাঁঠা বা খাসি সামনের রাঙ বা গর্দান। পাড়ায় সব বাড়ি থেকেই ওই দিনে মাংস রান্নার গন্ধ উঠত।  আরো বড় হয়ে যখন প্রেসার কুকার চালু হল, তখন রবিবারে বারোটা সাড়ে বারোটার সময় কোরাসে কুকারের সিটি বহুবার শুনেছি পাড়ায় সব বাড়ি থেকে।

বিশেষ এই মাংস হওয়ার রবিবারেই পড়ার চাপটা পড়ত বেশী। মাংস কষার সময় থেকে মায়ের রান্নাঘর থেকে গন্ধ এসে ভুলিয়ে দিত ইংরিজির টেনস, ফ্রেজ, ইডিওমস, কগনেট অবজেক্ট, পার্টিসিপল, অ্যাডজেকটিভ, ন্যারেসন, ভয়েস চেঞ্জ... অথবা সংস্কৃত ব্যাকরণ কৌমুদীর শব্দ ও ধাতুরূপ, প্রত্যয়, সমাস, অপিনিহিতি, যোগরূঢি...। সব তালগোল পাকিয়ে একাকার মনে হত।

মাংস সেদ্ধ হয়েছে কিনা আর নুন ঠিক আছে কিনা টেস্ট করে দেখার জন্যে এক এক পিস মাংস সঙ্গে একটু ঝোল আমাদের বরাদ্দ ছিল স্নান করার আগে। এটাকে আজকালকার রেস্তোরাঁর ভাষায় স্টার্টার বা অ্যাপিটাইজার বললেও চলে। ওই স্যাম্পলটা খাওয়ার পর আমার স্নানের সময়টা খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যেত। প্রায়ই মায়ের কাছে বকুনি খেতে হত চান করে বেরিয়ে আসার পরেও কানের পিছনে সাবানের ফেনা আর গোড়ালির পিছনে রাজ্যের ময়লা লেগে থাকার জন্যে।

আমার মাথায় তখন কিচ্ছু ঢুকছে না সে সময় পেরেক ঠুকলেও বেঁকে যেত এমনই নিরেট আমার মাথা। বাবাও ছাড়ার পাত্র নন, জিদ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন - আমাকে দ্বিতীয় নেসফিল্ড বা পি কে দেসরকার এবং ঈশ্বর চন্দ্র দেবশর্ম্মা বানিয়ে তুলতে। আমার এই চরম দুর্গতির সময় মা স্টেজে অবতীর্ণা হতেন মা দুর্গার মতোই। দশ হাত নিয়ে নয়, দুহাতে দুটি - গরম ঝোলের ধোঁয়া ওঠা কাঁসার বাটি নিয়ে। সুগন্ধে জিভে স্যালাইভার বন্যা বইত আর পাকস্থলী থেকে সব কিসিমের পাচক এনজাইম নিঃসৃত হয়ে আমার মাথার নিরেট ভাবটাও বেশ ফিকে হয়ে আসত।

প্রথমে বাবার হাতে বাটি দিয়ে মা বলতেন, দ্যাখোতো নুন টুন সব ঠিক আছে কিনা..."। 

বাবা সুড়ুৎ শব্দে ঝোলে চুমুক দিয়ে বলতেন, ফাসক্লাস হয়েছে ভেরি গুড। 

আমি তখন উবু জ্বলন্ত গরম মাংসের টুকরো মুখে নিয়ে হিমসিম, জিভে গালে ছেঁকা মুখ হাঁ করে হা হা করছি ঠান্ডা হবার জন্যে। বাবার প্রশংসায় প্রসন্ন মা হাসি হাসি মুখে আমার অবস্থা দেখে বলে উঠতেন, দ্যাখো, দ্যাখো বোকা ছেলের কান্ড দ্যাখো, একটু ঠান্ডা হতে দে - কিরে সেদ্দ হয়েছে? আমি হা হা করা হাঁ মুখেই বড়সড় ঘাড় হেলিয়ে মাকে জানাতাম দারুণ।

এতক্ষণ রান্নাঘরের গরমে থাকার কারণে মায়ের স্বেদসিক্ত মুখে তৃপ্তির হাসি, বাবার প্রশংসা পেয়ে আর আমার অত্যাগ্রহ দেখে। দুচোখে স্নেহের অকূল পারাবার। সেই মুখ আর চোখের তুলনা পেতাম দুর্গা পুজোর সময় কলেজ স্কোয়ারে মা দুগগার ঘাম তেল মাখা মুখ আর চোখে। সে সময় প্রতিমা বানাতেন শ্রী রমেশচন্দ্র পাল।

আমার নেসফিল্ড হবার নিষ্ফল ও নিদারুণ প্রচেষ্টার দুর্গতি থেকে মুক্তি দিয়ে আমার মা, বাবাকে নির্দেশ দিতেন তাড়াতাড়ি চান করে নেবার জন্যে, তা না হলে খাবার দাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাবাও চূড়ান্ত হতাশায় আমাকে মুক্তি দিয়ে বলতেন, তোমার এ ছেলের কিসস্যু হবে না, দেখো

আচ্ছা, আচ্ছা, ঘুনু হয়েই থাকবে না হয় চিরটাকাল তুমি এখন যাও তো, চান করে নাও

বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। মায়ের কথাও খেটে গেছে অবিকলবাবা মা কেউই আর নেই এই জীবনে। ঘুনু হয়ে থাকা জীবনের অজস্র দুর্গতির মধ্যেও দুর্গতিনাশিনী সেই দৃষ্টি কিন্তু সঞ্চারিত হয়ে এসেছে পরবর্তী প্রজন্মেও। আজকাল বড় হতে থাকা আত্মজার চোখে মেলে হারিয়ে যাওয়া সেই শান্তির অনুভব - দিনশেষে ঘরে ফেরা হা-ক্লান্ত মনে আর সেই ক্ষণটুকুই হয়ে ওঠে প্রকৃত রোববার।

-- ০০ --

আমার প্রথম গ্রন্থ "বিনিসুতোর মালা"-র একটি অধ্যায়।

বইটি ঘরে বসে অনলাইনে পেয়ে যাবেন "সৃষ্টিসুখ প্রকাশন" এর এই লিংক থেকে - 

https://sristisukh.com/ss_new/product/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE/



রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫

মহাভারতের কথাঃ- রমণীর চোখে রমণীয়া নারী

 সংসারে অজানা, অচেনা রূপসী এবং যুবতী পরিচারিকা ঢোকালে সংসারের কর্ত্রীর কী কী বিপদ ঘটতে পারে? কোন কোন দিক থেকে নেমে আসতে পারে সাংসারিক জটিলতা? এমনকি কপাল এবং মুখ দুটোই পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও যে অমূলক নয়, সে কথা হাড়ে হাড়ে টের পান কমবেশী সকল সংসারের ওয়াকিবহাল গিন্নীরা। বাড়ির পরিচারিকাকে না হয় তাও এড়িয়ে যাওয়া যায়, দাঁতে ছোপধরা, গালে মেচেতার দাগ, নক্কিমাসি কিংবা পদ্দোমাসিকে দিয়ে, কিন্তু সেই নারী যদি হয় অফিসের সুন্দরী সেক্রেটারি? সেক্ষেত্রে বিপদ আরো বেশী। সপ্তাহের পাঁচ থেকে ছদিন, দিনে আট-নঘন্টা একসঙ্গে ওঠাবসা, কথাবার্তা, চোখাচোখি। লাঞ্চ সারতে সারতে কিংবা বাদলা দিনে হালকা মেজাজে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের কথা বলতে বলতে, অনেক বেশী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এবং হয়ও। যে সব গিন্নিরা কত্তাদের চোখে চোখে রাখেন, নিজের মানুষটির চালচলনের চালাকি চটপট ধরে ফেলেন, তাঁদের জন্যে চিন্তা একটু কম। কিন্তু যাঁরা একটু আলবোড্ডে টাইপের, যাঁরা তাঁদের মানুষটিকে প্রাণ ভরে বিশ্বাস করেন, চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন এবং স্বামীর প্রতিটি কথাই বেদবাক্য বলে মনে করেন, তাঁরা কী করবেন?

 
তাঁদের জন্যেই সব শাস্ত্রের সার মহাভারত থেকে তুলে আনা একটি ঘটনার বিবরণ দিলে, সেই সব সরলমতি অবলা গৃহিণীরা কিছুটা বুঝতে পারবেন, যুবতী নারী তুলকালাম সুন্দরী হলে, ঘনিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে রসায়নটা কী দাঁড়াতে পারে!
 
অজ্ঞাতবাসের সময়, পাঞ্চালদুহিতা দ্রৌপদী, পাণ্ডব স্বামীদের সঙ্গে বিরাটরাজের অন্দর মহলে ঢুকলেন পরিচারিকার কাজের সন্ধানে। ইচ্ছে একটা বছর নাম পরিচয় লুকিয়ে রাজপ্রাসাদে কাটিয়ে দেবেন। তাঁরা আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর নাম হবে সৈরিন্ধ্রী, আর বিরাট রাজমহিষীর পরিচারিকা হিসেবেই কাজ করবেন। সেই পরিকল্পনা মতোই প্রস্তুত হয়ে  তিনি এগিয়ে চললেন বিরাট রাজপ্রাসাদের দিকে -

“অসিতলোচনা দ্রৌপদী, মেঘবরণ কেশে সূক্ষ্ম, সুকোমল ও দীর্ঘ বেণী বাঁধলেন, মলিন বসন পরলেন, তারপর সৈরিন্ধ্রী বেশে রাজপ্রাসাদের দিকে হাঁটতে লাগলেন। নগরের পথে স্ত্রী পুরুষেরা দ্রুতপায়ে তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁগা, তুমি কে, গা? কিসের জন্যে এয়েচ এই নগরে?” তারা বারবার এই কথা জিজ্ঞাসা করায়, দ্রৌপদী বললেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী, যদি কেউ আমাকে একটা কাজ দেন, সে কাজ আমি খুব সুন্দর ক’রে করে দেব। কাজের খোঁজে এসেছি, গো, কাজের খোঁজে”। কিন্তু তাঁর অসামান্য রূপ- লাবণ্য, মলিন হলেও পরনের বসনবিন্যাস ও এমন মধুর স্বরে সুস্পষ্ট উচ্চারণের কথা শুনে, তাঁকে দু মুঠি অন্নের কাঙালিনী বলে, কেউ বিশ্বাসই করতে পারল না।
বিরাট রাজমহিষী সুদেষ্ণা সেই সময় প্রাসাদের ছাদে উঠে রাজপথের দিকে তাকিয়ে অলস অবসর যাপন করছিলেন। হঠাৎ রাজপথে মরালগমন ভঙ্গিতে পথচলা পাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীতে তাঁর চোখ আটকে গেল। রাজমহিষী তাঁর অসাধারণ রূপ এবং তাঁকে অনাথা, ও এক-বসনা দেখে, ডেকে পাঠালেন। 
 
জিজ্ঞাসা করলেন, “ভদ্রে, তুমি কে? এবং কী অভিলাষে তুমি এখানে এসেছ”? দ্রৌপদী তাঁকেও একই কথা বললেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী, যদি কেউ আমাকে একটা কাজ দেন, সে কাজ আমি খুব সুন্দর ক’রে করে দেব। হে মহারাজ্ঞি, আমি কাজের খোঁজেই এখানে এসেছি”।
 
সুদেষ্ণা বললেন, “হে ভাবিনি, তুমি যেভাবে বলছো, তোমার মতো কামিনীদের পক্ষে সেরকম কখনোই সম্ভব নয়। বস্তুতঃ, তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমিই অনেক দাসদাসী রাখতে পারো। তোমার গোড়ালি উঁচু নয়, তোমার দুই উরু নিবিড়, তোমার নাভিদেশ অত্যন্ত গভীর, তোমার নাক উন্নত, তোমার নেত্রকোণ, করতল, চরণতল, জিভ ও অধর রক্তিম; তোমার বাক্য রাজহংসীর মতো অস্ফুট গদগদ, কেশবিন্যাস অতি মনোহর, তোমার শ্যামল অঙ্গ, তোমার নিতম্ব ও পয়োধর নিবিড়তম, তোমার আঁখিপক্ষ্ম বক্র, তোমার কটিতট ক্ষীণ, গ্রীবা শঙ্খের মতো, তোমার শরীরের কোন শিরা দেখা যায় না এবং তোমার মুখমণ্ডল পূর্ণিমার চাঁদের মতো রমণীয়। তুমি কাশ্মীরি অশ্বিনীর মতো এবং পদ্মপলাশলোচনা কমলার মতো অপরূপা। হে ভদ্রে, তোমাকে পরিচারিকা বলে মোটেই মনে হচ্ছে না। তুমি যক্ষ রমণী কি দেবকামিনী নও তো? গন্ধর্বী বা অপ্সরা? নাগবনিতা কিংবা এই নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী? বিদ্যাধরী, কিন্নরী কিংবা স্বয়ং রোহিণী? তুমি অলম্বুষা না কি মিশ্রকেশী? পুণ্ডরিকা বা মালিনী? অথবা তুমি কি ইন্দ্রাণী, বারুণী, বিশ্বকর্মার পত্নী, ব্রহ্মাণী কিংবা অন্যান্য দেবকন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা? সে যাই হোক, তুমি কে বল”?
দ্রৌপদী বললেন, “হে মহারানি, আমি দেবী, গন্ধর্বী, অসুরী বা রাক্ষসী নই। সত্যি বলছি, আমি সৈরিন্ধ্রী। আমি কেশসংস্কার, রূপচর্চা, কেশসজ্জা, চন্দন ইত্যাদি বিলেপন এবং মল্লিকা, উৎপল, কমল ও চম্পক প্রভৃতি ফুলের বিচিত্র মাল্য গ্রন্থন করে থাকি। প্রথমে আমি কৃষ্ণপ্রিয়তমা সত্যভামা এবং তারপরে কুরুকুলের একমাত্র সুন্দরী দ্রুপদকুমারীর সেবা করেছিলাম। সেই স্থানে আমি সমুচিত অশন ও বসন সহ পরমসুখে কাল কাটাচ্ছিলাম। স্বয়ং দ্রুপদকুমারী ভালোবেসে আমাকে "মালিনী" নামে ডাকতেন। রাজ্যচ্যুত হয়ে ওঁরা কোথায় অজ্ঞাতবাসে চলে গেছেন, জানি না, তাই কর্মহীনা হয়ে, আজ কর্মের সন্ধানে আপনার আশ্রয়ে এসেছি”।
সুদেষ্ণা বললেন, “আমি তোমাকে মাথায় করে রাখতে পারি। কিন্তু ভয় হয়, পাছে আমার রাজা সর্বান্তঃকরণে তোমার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। পুরুষের কথা দূরে থাক, এই রাজকুল এবং আমার গৃহের যত রমণীরাও মুগ্ধ হয়ে, অনন্যমনে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার প্রাসাদে ও উদ্যানের যত তরু,  তারাও তোমাকে দেখার জন্য মাথা নত করেছে। হে নিবিড়নিতম্বিনি, বিরাটরাজ তোমার অলৌকিক অঙ্গসৌষ্ঠব মন দিয়ে দেখলে, আমাকে ত্যাগ করে, তোমাতেই মন ও প্রাণ সমর্পণ করে দেবেন। হে চঞ্চলায়তলোচনে, অনুরাগের সঙ্গে তুমি যে পুরুষের দিকে দৃষ্টি দেবে অথবা সর্বদা যার চোখের সামনে তুমি থাকবে, সে পুরুষ অবশ্যই অনঙ্গ শরে বশীভূত হবে। মানুষ আত্মহত্যার জন্য যেমন উচ্চ তরুশাখায় চড়ে বসে, আমার পক্ষে তোমাকে রাজপুরীতে স্থান দেওয়াও অনেকটা সেই রকম। ফলে তোমাকে রাজ অন্তঃপুরে স্থান দেওয়া, কাঁকড়ার গর্ভধারণের মতো, আমার পক্ষে মৃত্যুস্বরূপ হয়ে উঠবে”।
দ্রৌপদী বললেন, “হে ভাবিনি, মহারাজ বিরাট বা অন্য কোন পুরুষ আমাকে লাভ করতে সমর্থ হবেন না, কারণ পাঁচজন যুবা গন্ধর্বতনয় আমার স্বামী, তাঁরা মহাসত্ত্ব গন্ধর্বরাজের পুত্র। আমার ঐ পঞ্চ স্বামী আমাকে সর্বদা রক্ষা করে থাকেন। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দান না করেন এবং আমাকে দিয়ে পদ প্রক্ষালন ইত্যাদি পদসেবার কাজ না করান, তাঁর প্রতি গন্ধর্বগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন। যে পুরুষ ইতরকামনায় আমার প্রতি লোভপরবশ হয়, সেই রাত্রেই সেই পুরুষকে শমন সদনে যেতে হয়। কোন পুরুষই আমাকে, আমার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আমার প্রিয়তম গন্ধর্ব স্বামীগণ, এখন দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়েও, প্রচ্ছন্নভাবে আমার কাছাকাছিই থাকেন এবং আমাকে রক্ষা করে থাকেন”।
বিরাট রাজমহিষী সুদেষ্ণা বললেন, “হে আনন্দবর্ধিনি, তোমাকে তোমার মনের মতোই বসন দেব এবং তোমাকে কারও চর্বিত কিংবা উচ্ছিষ্ট খাবারও দেওয়া হবে না”।



শ্রীকৃষ্ণের পত্নী সত্যভামা এবং পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীর রেফারেন্সেই  সৈরিন্ধ্রী - অর্থাৎ বিউটিসিয়ানের কাজটা পেয়ে গেলেন দ্রুপদনন্দিনী । তিনি একবছর রাজমহিষী সুদেষ্ণার পরিচারিকা হিসাবে সাফল্যের সঙ্গেই কাজকম্ম করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে রাজমহলে মারাত্মক এক বিপদও উপস্থিত হয়েছিল। সে বিপদ অবশ্য মহারাজ বিরাটের দিক থেকে নয়, অন্য পক্ষ থেকে। সে আর এক বৃত্তান্ত, অন্য আরেক দিন করা যাবে।
 
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা জরুরি, এই সৈরিন্ধ্রী-সুদেষ্ণা বাক্যালাপ কিন্তু কোন মহিলার লেখা নয়, লিখেছেন এক জবরদস্ত মহাপণ্ডিত বেদজ্ঞ পুরুষ, মহর্ষি বেদব্যাস, কুরু রাজ পরিবারের অন্দরমহলে যাঁর ছিল অতি ঘনিষ্ঠ যাতায়াত। সেই সূত্রেই হয়তো কোনদিন এইরকম কোন অভিজ্ঞতা, তিনি পর্যবেক্ষণ করে থাকবেন। নারীর চোখে নারীদেহ বর্ণনার আড়ালে তাঁকে চট করে পুরুষ বলে চিনে ফেলা যায়। কিন্তু সর্বাঙ্গসুন্দরী এক নারী পরিচারিকার জন্য গৃহকর্ত্রীর মানসিক সংশয় ও দ্বিধার বর্ণনাটি বড়ো নিখুঁত ও অনবদ্য এবং আজও প্রাসঙ্গিক। একথা ভুক্তভোগী নারী ও পুরুষ প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও, মনে মনে মেনে নেবেন, সন্দেহ নেই!           

(কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকারঃ মহামতি কালিপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত সম্পূর্ণ মহাভারতের বাংলা গদ্য অনুবাদ থেকে সংগৃহীত। বিরাটপর্ব।)   
 
--০০--

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫

দিনটা হোলি

 সকাল সকাল সদর দরজায় দুমদাম ঘা আর তার সঙ্গে একটি মেয়ের ডাকাডাকি শুনে, অন্বেষাদেবী উঠোনে নামলেন। দরজার দিকে যেতে যেতে বেশ গলা তুলেই বললেন, “ওফ্‌ কি ডাকাতে মেয়ে রে, বাবা। দরজাটাই না ভেঙে পড়ে। দাঁড়া দাঁড়া, আর দরজা বাজাস না মা, খুলছি”। তাঁর আচরণে বা কণ্ঠস্বরে কোথাও বিরক্তির লেশমাত্র নেই, বরং যথেষ্ট প্রশ্রয়ের সুরেই বললেন কথাগুলো।

দরজা খুলতেই দেখলেন, ফুটকি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে গভীর রাগরাগ ভাব, কিন্তু ঠোঁট থেকে হাসির আভাসটা পুরো মুছতে পারেনি। ফুটকি রাগত স্বরে বলল, “তুমি আমাকে ডাকাতে মেয়ে বললে, কাকিমা? এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। একদিন দেখো সত্যিই তোমাদের বাড়ি ডাকাতি করতে আসবো, হ্যাঁ। তখন টেরটি পাবে”।

“বাড়িতে ঢোক তো আগে। তুই ডাকাতি করতে এলে উলু দিয়ে শাঁখবাজিয়ে বরণডালা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। তাতে আবার টের পাওয়ার আছেটা কী, রে পোড়ারমুখি?

“ও, শুধু ডাকাতে মেয়ে বলে হচ্ছিল না, তাই আবার পোড়ারমুখিও হয়ে গেলাম?”

“সব কথা ওভাবে ধরিস কেন? আমরা পুরোনো দিনের লোক। কথায় কথায় তোদের মতো “আই লাভ ইউ”, “আই মিস্‌ ইউ” বলতে পারিনা। ওগুলোই আমাদের স্নেহ, ভালোবাসা আর আদরের কথা। ভেতরে আয় বস। পাখাটা চালিয়ে দিই। দোল পড়তেই কেমন চিড়বিড়ে গরম পড়েছে, দেখেছিস?” 

ঘরে ঢুকেই ফুটকি পিছন থেকে অন্বেষা দেবীর গলা জড়িয়ে ধরে, আদুরে সুরে বলল, “ও কাকিমা, আজ কী খাওয়াবে গো?” 

“তুই আসবি জেনে, নারকেল কুচি দিয়ে নিরিমিষ ঘুগনি আর কিসমিস দেওয়া হালুয়ার বরফি বানিয়ে রেখেছি। ময়দা মাখা আছে – গরম গরম লুচি ভেজে দেব”। 

“বাঃ রে আমি, একা একা খাবো নাকি? কাকু কোথায়? এখনো ওঠেননি?”

“কঅঅঅঅখন উঠে পড়েছে, তোর কাকু। মর্নিং ওয়াক সেরে। চা খেয়ে এখন বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। ওটা মুখস্থ না হলে, উঠবে না”।

“আর তোমার ছেলে?”

অন্বেষাদেবী, আড়চোখে ফুটকির মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “সে খোঁজে তোর কী দরকার? তুই আমার কাছে এসেছিস, নাকি আমার ছেলের কাছে?”

ফুটকি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “দরকার আবার কী? সেদিন ভুবনকাকা আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বউ, ছেলেমেয়ে কেমন আছে ভুবন? গাইগরুটা ঠিকঠাক দুধ দিচ্ছে তো? হাঁসগুলো রোজ পুকুরে যায় তো? ভুবনকাকা আমাদের দেশের জমিজায়গা দেখা শোনা করেন। বাড়িতে কেউ এলে, কিংবা কোথাও গেলে ওরকম জিজ্ঞাসা করতে হয়, তাই করলাম”।

অন্বেষাদেবী এবার খুব জোরে হেসে ফেললেনহাসতে হাসতে বললেন, “বেশ চোপা করতে শিখেছিস তো? তোর সঙ্গে আমার জমবে ভালো”। একটু অবাক হয়ে, ফুটকি জিজ্ঞাসা করল, “তোমার সঙ্গে আমার কী জমবে গো?” 

“তোরা তো আবার সিরিয়াল দেখিস না। দিনরাত হোয়াটসয়্যাপ আর ফেসবুকে মুখ গুঁজে বসে থাকিস। সিরিয়াল দেখলে বুঝতে পারতিস, শাশুড়ি আর বউরা সব পাটভাঙা শাড়ি ব্লাউজ পরে, গয়নায় গা সাজিয়ে সারাক্ষণ কেমন চুলোচুলি, ঢুসঢাস করে। চোখ ঘুরিয়ে, ঘাড় নাড়িয়ে আর নাক-ঠোঁট-ভুরু কচলে তারা এমন সব ব্যায়াম করে না? ওদের কক্‌খনো ছানি পড়বে না। ঘাড় কনকন করবে না। বুড়ো বয়েসেও তাদের নাকের পাশে, ঠোঁটের পাশের চামড়ায় কোঁচ পড়বে না। তোরা  “আন্টি” হওয়ার ভয়ে যেসব অ্যান্টি-এজিং ক্রিম ঘষিস গালে, ওসব কিচ্‌ছু লাগবে না। দেখে নিস”।

অন্বেষা দেবীর কথা শুনে হাসতে হাসতে ফুটকির পেটে খিল ধরে যাওয়ার যোগাড়। হাসির দমক একটু কমলে বলল, “আহা, এত নিন্দে করছো, দেখতেও তো ছাড়ো না”।

“তুই আয়, তখন দেখবি, ঘরে এমন সিরিয়াল জমিয়ে দেব, পাড়ার লোক সিরিয়াল ছেড়ে আমাদেরই দেখতে আসবে”।

ফুটকি লাজুক হেসে বলল, “আহা, আমি বুঝি তাই বললাম? তোমার বাড়ি আসতে আমার বয়েই গেছে”।      

অন্বেষা দেবী বললেন, “আমার কাছে অত লজ্জা আর পেতে হবে না, মা। তুই বরং ওপর থেকে ঘুরে আয়, ততক্ষণ আমি লুচি ভাজার যোগাড় করি”।

এই সময়েই ওপর থেকে নেমে ঘরে ঢুকলেন, অনিমেষবাবু - ফুটকির কাকু। ঘরে পা দিয়েই বললেন, “ফুটকি মায়ের গলা পেলাম, দরজায় গুম গুম কিল মারারও আওয়াজ পেলাম। তারপরেও অনেকক্ষণ কোন সাড়া না পেয়ে নিজেই নেমে এলাম। মনে হল, যা শুনেছি, সে সবই তবে ঝুট কি? আসেনি কি আমাদের ফুটকি?” বলে হা হা করে হেসে উঠলেন, হাসলেন অন্বেষা দেবীও।

ফুটকি অপ্রস্তুত হাসি মুখে নিয়ে বলল, “আমি বরং তোমাদের ছাদটা একবার দেখে আসি। অনেকদিন তোমাদের ছাদটা দেখা হয়নি”।

অনিমেষবাবু নিরীহ মুখে বললেন, “সেই ভালো, ঘুরে আয়। আমগাছ ঝেঁপে কেমন মুকুল এসেছে, ছাদ থেকে দেখতে পাবি। আর কাঁঠাল গাছের সারা গায়ে কেমন মুচি ধরেছে, তাও। আর হ্যাঁ, ভুলেও যেন, বিল্টুর ঘরে যাস না। আমার সঙ্গেই বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। তোর গলা শুনেই নিজের ঘরে গিয়ে ইয়াম্মোটা একখানা বই মুখে নিয়ে বসেছে। পড়ছে কিনা জানি না, তবে ডিস্টার্ব করাটা উচিৎ হবে না”। হাসি চাপতে অন্বেষা দেবী মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

লজ্জায় রাঙা হয়ে ফুটকি বলল, “কাকু, তুমি আর কাকিমা দুজনেই না, একেবারে Zআতা”। তারপর দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়।

 

ফুটকি, ভালো নাম অভীষ্টা আর বিল্টু, ভালো নাম অনময়, ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বন্ধু। দুই পরিবারের মধ্যেও ভীষণ ঘনিষ্ঠতা। দুই পরিবারের এই ঘনিষ্ঠতা এখন নির্দ্বিধায় বৈবাহিক সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছে। সদ্য পিএইচডি করে, অনময় এখন একটি কলেজের লেকচারার। আর অভীষ্টা এম এ পাস করে, অন্য একটি কলেজে পার্টটাইম পড়ায়, তার সঙ্গে পিএইচডিও করছে। দুজনেই যখন কর্মক্ষেত্রে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে, অতএব উভয় পরিবারেরই এখন একটাই লক্ষ্য মুক্ত দুই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর পায়ে শিকলি দিয়ে সংসারের দাঁড়ে বেঁধে ফেলা।

ফুটকি দোতলায় গিয়ে নিঃশব্দে বারান্দা পেরোলো, তারপর কাকু কাকিমাদের ঘর ছাড়িয়ে, পাশের ঘরে উঁকি দিল। সাদা পাজামা আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে বিল্টু টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে। এবং অত্যন্ত মনোযোগে মোটা একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল ফুটকি। নিঃসাড়ে এগিয়ে বিল্টুর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। বিল্টু একবারের জন্যেও এতটুকু নড়াচড়া করল না, ফুটকিরও ধারণা সে অতি গোপনে এ ঘরে ঢুকেছেকিন্তু বিল্টু কী করে টের পেল কে জানে, শরৎবাবুর নভেলে যেমন থাকে, সেভাবে বলল, “এভাবে অসময়ে একলা পুরুষের ঘরে, তোর আসাটা ঠিক হয়নি, ফুটকি। সমাজ, প্রতিবেশীদের কথাটা তোর মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। নিচে বাবা-মাও আছেন। আমাকে নিয়ে তোর নামে কলঙ্ক রটবে, সে আমার সইবে না রে”।

ফুটকি এত অবাক হল, তার সঙ্গে এত চটেও গেল, চট করে কোন উত্তর দিতে পারল না।

একটু সময় নিয়ে, মাথা নিচু করে, মেঝেয় পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে ফুটকি বলল, “আমাকে ভুল বুঝবেন না, বিল্টুবাবু। কারণ, প্রথমতঃ এই ঘরে কোন পুরুষ আছে এ ধারণা আমার ছিল না। দ্বিতীয়তঃ, আমি এক সরলা নারী। শ্বশ্রু মাতা ও পিতার নির্দেশেই আমি আপনার ধ্যান ভাঙাতে এসেছি। আজকে বসন্তোৎসব, দোলের সকাল। আমি যে এসেছি, সেকথা অবগত হওয়া সত্ত্বেও, একখানা গাব্দা বইয়ে মুখে গুঁজে তপস্যার ঢং করার মতো বিড়ম্বনা আর কী হতে পারে?”

বিল্টুর ভেতরে হাসির ফোয়ারা উঠে আসতে চাইছিল। সেটাকে কোন মতে চেপে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুটকিকে দুহাতে বুকে টেনে নিল, তারপর বলল, “এ ঘরে কোন পুরুষ নেই, না? বসন্তোৎসবে আমি বই নিয়ে ঢংয়ের তপস্যা করছি?” বলেই ফুটকির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ফুটকি কোন আপত্তি করল না। বেশ কিছুক্ষণ তার ঠোঁটে বিল্টুর উষ্ণ ও দুষ্টু স্পর্শ উপভোগ করার পর তার মনে হল, বিল্টুকে আর পাত্তা দেওয়া ঠিক হবে না। বিল্টুর দু হাত থেকে ছাড়া পেতে ছটফট করে উঠল, বলল, “ছিঃ, সকাল সকাল এঁটো করে দিলি তো? কাকিমা ঠিক টের পেয়ে যাবেন। ওঁনার সামনে এখন কী করে যাবো?”

ফুটকির আচমকা এই অভিযোগে বিল্টু অপ্রস্তুত হল, ফুটকিকে ছেড়ে দিয়ে, জিজ্ঞাসা করল, “এ রাম তাহলে কী হবে?”

ছাড়া পেতেই ফুটকি এক দৌড়ে দরজার সামনে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, মুখ ভেংচে বলল, “কী হ্যাব্যে? তুই একটা বুদ্ধু, আর ভিতুর ডিম...”। বলেই দৌড়ে সিঁড়ির দিকে গিয়ে, উঠে গেল ছাদে। বিল্টু ঘন ঘন ঘটনার মোচড়ে অবাক হল খুব। এমন নয় যে, সে আজই প্রথম ফুটকিকে চুমু খেল। এর আগেও খেয়েছে বহুবার। কিন্তু আজ কী সে কিছু বোকামি করে ফেলল? “অ্যাই, ফুটকি” জোরে ডাকতে গিয়েও ডাকল না, নিচেয় বাবা-মা আছেন, শুনতে পেলে, ব্যাপারটা আরও হাস্যকর হবে।

সেও দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে গেল, দেখল, মুকুল ভরা আমগাছের সামনে আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, ফুটকি গুনগুন করে গান গাইছে। বিল্টু তার পাশে দাঁড়াতে, আড়চোখে দেখল, গান না থামিয়েই লাজুক হাসল। তারপর বিল্টুর একটা হাত নিজের দু হাতে ধরে, গালে ঠেকালো। তারপর বিল্টুর কানে কানে গাওয়ার মতো গাইল,

“দখিন হাওয়ায় কুসুমবনের বুকের কাঁপন থামে না যে।

নীল আকাশে সোনার আলোয় কচি পাতার নূপুর বাজে।

ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ,

মৃদু হাসির অন্তরালে গন্ধজালে শূণ্য ঘিরিস –

তোমার গন্ধ আমার কণ্ঠে আমার হৃদয় টেনে আনে।

লুচির গন্ধ নাকে এলে, আর কি আমার মন মানে”? গানের শেষে এই লাইনটা জুড়ে দিয়ে ফুটকি খিলখিলিয়ে হেসে বলল, “এবার নিচেয় চল, যা অবস্থা করেছিস, গরম লুচি ঠোঁটে ঠেকাতে পারলে হয়”।

বিল্টু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “অমন সুন্দর গানের মুডটা এভাবে সর্বনাশ করতে হয়? রবিঠাকুরের এ গানটা কারো গলায় শুনিনি তো”। 

ফুটকি হাসতে হাসতে বলল, “এতগুলো বছর লক্ষ্মীছেলে হয়ে শুধু বই-মুখেই তো কাটালি। এসব আর শুনবি, কোত্থেকে? অনেকেই গেয়েছেন, কিন্তু আমার ভালো লাগে শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়েরটি। অপূর্ব। এত অনায়াস উদাত্ত গেয়েছেন, আর এতই রাবীন্দ্রিক, বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে। আমার মতো অলক্ষ্মীর সঙ্গে ঘর কর, সব পাবি। রবিঠাকুরের গান, লুচি, নারকেল দেওয়া ঘুগনি, কিসমিস দেওয়া হালুয়ার বরফি।

        

দুপুরের খাওয়ার পর কাকিমার ঘরেই সারাক্ষণ থাকতে হল ফুটকিকে। বার দুয়েক কাকিমার তন্দ্রা এসেছে ভেবে, ফুটকি চুপিচুপি পাশের ঘরে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্ত বিছানা থেকে নামতেই, কাকিমা প্রথমবার গম্ভীর গলায় বললেন, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে? এ ঘরের বাইরে বের হলে, ঠ্যাং খোঁড়া করে ফেলে রাখবো”। আর দ্বিতীয়বার বললেন, “বিছানা থেকে মেঝেয় পা দিয়ে দেখ, তোর পিঠ আমি আস্তো রাখব না”।

দ্বিতীয়বার ধরা পড়ে কাকিমার কাছে বকুনি খেয়ে, ফুটকি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তুমি আর মা, একই তো! খালি ঠ্যাং ভাঙবো, আর পিঠ ফাটাবো। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর একটু আরামে থাকবো, বকাঝকা করার কেউ থাকবে না। নেচে নেচে বেড়াবো। তা নয়, সেই তুমিও বকছো। তাহলে আর বিয়ে-টিয়ে করে লাভ কী?”

কাকিমা উঠে বসলেন, হাসতে হাসতে ফুটকির মাথাটা কোলে নিয়ে, ফুটকির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “এমন উতলা হস না রে, মেয়ে। এখন মনে হচ্ছে কাকিমাটা খুব হিংসুটি ভিলেন, সিনেমার গল্পের মতো তোদের প্রেমে খালি ব্যাগড়া দিচ্ছে। পরে বুঝবি রে, মুখপুড়ি, কোন কিছুতেই রাশ আলগা করতে নেই। তাতে সব কিছুই চট করে সস্তা আর একঘেয়ে হয়ে যায়। অনেকটা চাওয়া, একটু পাওয়া – তাতে আগ্রহ বেড়ে ওঠে। অনেক চাওয়া আর সবটা পাওয়া মানেই তো শেষ হয়ে যাওয়া রে, খেপি। তার পরে আর থাকবে কী? সেটা বুঝতে শিখলেই জীবনে আনন্দের অভাব ঘটে না। এই যে মন্ত্রটা শিখিয়ে দিলাম, কোনদিন ভুলবি না। আজকাল চারদিকেই শুনছি, বিয়ে ভাঙার গল্প। এই বিয়ে সেই ডিভোর্স। আবার বিয়ে, আবারও ডিভোর্স। আমার মতো যেদিন বুড়ি হবি, একদিন এই দিনটার কথা ভাববি, দেখবি খুব মজা পাবি”।

ফুটকি কেঁদে ফেলেছিল, কাকিমা টের পেলেন একটু পরে। শাড়ির আঁচলে ফুটকির চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, “কদিন পরেই তুই আমাদের ঘর আলো করবি। সে জেনেও আজ তোকে কাঁদিয়ে বড়ো আনন্দ পেলাম রে, পাগলি। দুঃখের দিনে ডুকরে কেঁদে ওঠা কিছু না। কিন্তু আনন্দের দিনে যে চুপিচুপি কাঁদতে পারে, তার চোখের কোলে, জানবি, দুঃখের দিনেও থাকে খুশির ছোঁয়া। মুখ তোল, তাকা আমার দিকে। কই? দেখি, মুখখানা। অ্যাই তো, এই না হলে তুই আমার মেয়ে? সোনা মা, আমার। পাঁচটা বাজল, চল চা করি। চা খেয়ে বিল্টু তোকে বাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসুক। দোলের সন্ধে, দিনকাল ভালো নয়। পথে ঘাটে নেশাখোর লোকেদের নানান উপদ্রব”।

ফুটকি কান্না ভেজা চোখ মেলে কাকিমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, “তোমাকে আর মাকে খুব ইচ্ছে করে গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করতে। কিন্তু পারি না, কেন বলো তো? মনে হয় নিজের মাকে ঘট ঘট করে প্রণাম করার মধ্যে কেমন যেন একটা লোক দেখানে-পনা থাকে। শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা যদি ভেতরে থাকে, সে তো আপনিই ঝরে পড়বে মা, তোমার পায়ে। স্যরি, কাকিমা”।

অন্বেষা দেবী হাসলেন, বললেন, “স্যরি, কিসের? আর কটা দিনই তো বাকি। তারপর তো, কাকিমার, মাটুকুই থাকবে, বাকি যাবে সরে। আর মাকে প্রণাম করার কথা বলছিস? বুকের দুধ খাওয়ার সময় সব সন্তানই তার মায়ের গায়ে কতই না লাথি মারে!  তার জন্যে কোন মা কি প্রত্যাশা করেন, তাঁর সন্তান হিসেব করে, তাঁকে সব প্রণাম মিটিয়ে দেবে? তা কক্‌খনো নয় রে”।

একটু বিরতি দিয়ে আবার বললেন, “শাস্ত্রে আছে ছেলেদের দু বার করে জন্ম হয়। শাস্ত্রের নিয়ম আগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য ছেলেদের জন্যে ছিল। এখন শুধু ব্রাহ্মণরা সেই নিয়ম রক্ষা করে। কিন্তু আমি বলি, মানুষের সমাজে যখন থেকে বিয়ের প্রথা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে প্রতিটি কন্যাই দ্বিজা। একজন মা কন্যার জন্ম দেন, অন্য মা সেই কন্যাকে সংসারে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা দেন। উভয় পক্ষ থেকেই এর অন্যথা হলে, সে সংসারে ভাঙন ধরে, আগুন জ্বলে – কেউ শান্তি পায় না”।

এতক্ষণ অন্বেষা দেবী আবেগের মধ্যে ছিলেন, হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল, বললেন, “এই মুখপুড়ি, কোল থেকে নাম, চল চা করি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সন্ধে হয়ে যাবে তোর ফিরতে। ওঠ”।

কুচো নিমকি দিয়ে চা খাওয়া হতে, অন্বেষা দেবীর তাড়াতেই ফুটকিকে বাইকে বসিয়ে বিল্টু বের হল। সোজা রাস্তায় না গিয়ে সে একটু ঘুর পথে নির্জন এক মাঠের ধারে দাঁড় করিয়ে খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, “তোর জন্যে আমি সারাটা দুপুর অপেক্ষায় রইলাম, আর তুই এলিই না। মায়ের ঘরেই ঘুমিয়ে পড়লি? হোলির পুরো দিনটাই তুই মাটি করে দিলি, মাইরি”।

ফুটকি বিল্টুর চোখে চোখ রেখে বলল, “ঘুমোইনি তো। তোর মায়ের কাছে নতুন জন্ম নিলাম। তোর মা বললেন, দ্বিজা”।

“তার মানে?”

“সে সব তুই এখন বুঝবি না। আর দুপুরে তোর কাছে যেতে পারিনি বলে, রাগ করিস না, প্লিজ। তোকে পরে বুঝিয়ে বলবো। আর এখানেই বা আমাকে আনলি কেন? আপনজনকে বুঝি লুকিয়ে চুরিয়ে ভালোবাসতে হয়? আয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবি চল। তোর মা হয়তো, আমার মাকে ফোন করবেন। আমাদের দেরি হলে, দুশ্চিন্তা করবেন দুজনেই”।

ব্যাজার মুখে বাইকে চড়ল বিল্টু, ফুটকি পিছনে বসতে, বাইক স্টার্ট করে বলল, “কী যে তোর হল, কিছুই বুঝলাম না”।

ফুটকি বিল্টুকে জড়িয়ে ধরে তার কানে কানে বলল, “আজ যে দিনটা হোলি। এইচ ও এল ওয়াই, হোলি। আজকের দিনে যেটুকু হল, তাতেই বসন্তের বাতাস খেলে গেল বুকের মধ্যে! কিছু বুঝলি, বুদ্ধু?”

 

.০০.

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

আমরি বাংলা - ১

বসার ঘরে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে ফল্গু বলল, “দিদু, এই যে আমরা এখন ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি তার কোন বাংলা নেই?” দিদু অর্থাৎ ফল্গুর দিদিমা কিছু বলার আগেই ফল্গুর মা নিভাদেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাংলা ভাষা নিয়ে পিএইচডি করছিস আর তুই ব্রেকফাস্টের বাংলা জানিস না? থাকবে না কেন? প্রাতরাশ।”

ফল্গু মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলল, “ধ্যাৎ ওটা তো কলোনিয়াল বাংলা। ব্রেকফাস্টের সঙ্গে মিলিয়ে শব্দটা বানানো হয়েছে সংস্কৃত থেকে ধার করে। ওটা জানি, কিন্তু এই বাংলায় লোকেরা সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে কি কিছু খেত না? নাকি সেটাও আমাদের শিখিয়ে বৃটিশরা আমাদের ধন্য করে দিয়েছিল? যদি তা না হয়, তাহলে এই খাওয়াটাকে তারা নিশ্চয়ই কিছু একটা বলত। সেটা কি? গ্রামের মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির গিন্নিরা নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েদের ডেকে বলতেন না, “ওরে খ্যাঁদা, পল্টু, বোঁচা, কুসমি, চম্পা প্রাতরাশ বেড়েছি, খাবি আয়”। অথবা “অ খ্যাঁদা, তোর বাবার প্রাতরাশটা বৈঠকখানা ঘরে দিয়ে আয়”। এটা সম্ভব বলে তোমার মনে হয়, মা?”

নিভাদেবী বললেন, “তোর যতো সব উদ্ভট চিন্তা। ওসব ভেবে আর হবেটা কি? আজ সারা উত্তর ভারত হাইওয়ে দিয়ে ঘুরে আয় – ছোট বড়ো ঢাবায় সর্বত্র – বাইরে টিনের বোর্ডে লেখা থাকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। তার মানে কথাগুলো শুধু বাংলা নয় সর্বত্র চালু হয়ে গেছে”।

“তা হয়েছে, মানছি। কিন্তু তার আগে কী বলা হত? দিদু জানো?”

ফল্গুর দিদিমা নাতনি আর মেয়ের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। নাতনির প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে বললেন, “বলতো বই কি। সকালের খাওয়াকে বলত জলখাবার। দুপুরের খাওয়াকে বলত ভাত খাওয়া। আর রাত্রের খাওয়াটাকে রাতের খাবারই বলত। তবে সত্যি বলতে ওরকম পোশাকি মানে তোদের ভাষায় ফর্মাল নাম সত্যিই ছিল না। ওই যে তুই বললি না, মধ্যবিত্ত গিন্নিরা ছেলেমেয়েদের খেতে ডাকতেন, খ্যাঁদা, পল্টু মুড়ি বেড়েছি খাবি আয়। অথবা ছাতু মেখেছি খাবি আয়। দুপুরে ডাকতেন, ভাত বেড়েছি, খাবি আয়। কোন কোন উগ্রচণ্ডী মায়েরা রেগে গেলে বলতেন, “ভাত বেড়ে দিয়েছি, গিলে আমায় উদ্ধার করো”। আবার মায়েদের মুখে শুনেছি, স্বদেশী করা ছেলেদের মায়েরা ভাতের হাঁড়ি কোলে সারারাত জেগে অপেক্ষা করতেন। লাঞ্চ, ডিনার তো দূরের কথা – মধ্যাহ্ন-আহার কিংবা নৈশ-ভোজন এসব কথাও কাউকে কোনদিন বলতে শুনিনি – পড়েছি সাহিত্য-উপন্যাসে। ইংরিজিতে শিক্ষিত সাহিত্যিকরা বাংলা উপন্যাস লিখতে গিয়ে লাঞ্চ বা ডিনারের সমার্থক শব্দ বানিয়েছিলেন তৎসম শব্দ ধার করে।    

তার ওপর ধর, তখন তো আর ঘরেঘরে বা হাতেহাতে ঘড়ি ঘুরত না। লোকে এই খাবারের নামে সময়ও বুঝে যেত। যেমন ধর আমাদের ছোটকা কোথাও যাবে, মাকে বলল, “এই তো জলখাবার খেয়ে বেরোব, বাড়ি ফিরে ভাত খাবো”। সকলেই বুঝে গেল – ছোটকা সকাল সাড়ে আটটা-নটা নাগাদ বেরিয়ে, দুপুর দেড়টা-দুটো নাগাদ ফিরবে। ঘড়ির দরকারই হত না।    

আসলে সে সব দিনে আমাদের বাঙালী ঘরের প্রধান শস্যই ছিল ধান। তার থেকেই তৈরি হত, ভাতের চাল, মুড়ি, খই, চিঁড়ে। ছোলা বা যব গুঁড়ো করে ছাতু। ছোটবেলায় দুধ আর গুড় দিয়ে মাখা যবের ছাতু, আমরা কম খেয়েছি? বেশ আনন্দ করেই খেয়েছি”।

ফল্গু উজ্জ্বল মুখে বললে, “বাঃ বেশ বললে তো, দিদু”।

“বেশ কি বললাম জানি না, বাপু। আজকাল শহরে দেখেছি শনিবার রাত্রে ডিনার করতে করতে লোকে পরের দিন ব্রেকফাস্টে কী খাবে তার প্ল্যান করে। ছেলে বলে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবো। মেয়ে বলে চিজ স্যাণ্ডুইচ। বাবা বলে লুচি-আলু চচ্চড়ি। মা বলে ছোলে বাটুরা। সকালে মুখ ধুয়ে ছেলে বা মেয়ে বসে পড়ে ফোন নিয়ে – সবার মনোমতো খাবারের অর্ডার দিয়ে দেয়। আধঘন্টার মধ্যে ঘরে পৌঁছে যায় গরমাগরম খাবার। ব্রেকফাস্ট। আমাদের সময় এমন কল্পনা করতে পারলে, আমাদের নাম আজ জুলে ভার্ন বা এইচ জি ওয়েল্‌সের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকত”।

 

ব্রেকফাস্ট সাঙ্গ করে ফল্গু আর নিভাদেবী কফির আর দিদু ব্রজবালা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। ফল্গুর কৌতূহল শেষ হয়নি, সে বলল, “আমাদের স্কুল লাইফ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল রবি ঠাকুর ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কেউ গান লেখেননি। বাংলা ভাষায় যা কিছু লেখা হয়েছে – কবিতা কিংবা গদ্য -গল্প, উপন্যাস”।

নিভাদেবী বিরক্ত হলেন খুব, “কি যাতা বলছিস? নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদের গান শুনিসনি?”

ফল্গু এতটুকুও বিচলিত না হয়ে বলল, “কোথায় শুনব, বলো। আমাদের স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে, পাড়ার যে কোন ফাংশানে সর্বত্র শুনেছি রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাড়িতেও তুমি কিংবা বাবা গান চালাতে – বাংলা মানেই রবীন্দ্র সঙ্গীত – হেমন্ত, সুচিত্রা, কণিকা, দেবব্রত, সাগর, ঋতু। তাছাড়া বাবা কিশোরের আর লতার হিন্দি গান শুনতে পছন্দ করতেন। এ ছাড়া আমাদের গান শোনার কোন উপায় ছিল? ও হ্যাঁ আরেকজনের গান শুনতাম, পাড়ায় কালীপুজোর সময় – পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত। আমার ধারণা ছিল, গানগুলি ওঁরই রচনা। বাংলা নিয়ে পড়াশুনো করতে গিয়ে দেখলাম, ওরেব্বাবা, বাংলা গানের অথৈ ভাণ্ডার। আমাদেরকে সে সব শুনতেই দেওয়া হয় না। সে সব গানের এখনও চর্চা হয়, কিন্তু রবি ঠাকুরের ভারে সবাই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে”।

ব্রজবালা বললেন, “আমার জন্ম স্বাধীনতার ন-বছর আগে। ছোটবেলায় রবিঠাকুরের গান যে শুনিনি তা নয়। তবে সে সব অধিকাংশই দেশাত্মবোধক – বাংলার মাটি, আমার সোনার বাংলা, সঙ্কোচের বিহ্বলতা, আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে। নজরুলের গানও খুব শুনেছি, কারার ওই লৌহ কপাট, দুর্গম গিরি কান্তার। সে সব গাইত আমাদের স্কুলের দাদা-দিদি, কিংবা মাস্টারমশাইরা। অর্থাৎ শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি না, আমাদের কান জুড়িয়ে দিত চারণকবিদের গান। তাঁদের মধ্যে সবার সেরা ছিলেন মুকুন্দ দাস। সকলে বলত চারণ কবি মুকুন্দ। আহা সে কী গান – গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। ভয় কী মরণে, রাখিতে সন্তানে। আরেকটা গান ছিল, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।  সে গান মা, কাকিমা, ঠাকুরমাদের কানে গেলেই দেখতাম মন দিয়ে শুনতেন, তাঁদের চোখ জলে ভরে উঠত। বড়ো হয়ে, তখন ভারত স্বাধীন হয়ে গেছে, আমিও সে গান শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেছি কতবার। আমি তো মুকুন্দ দাসের কণ্ঠে এ গান শুনিনি, শুনেছি আমাদের গ্রামে আসা গীতজীবীদের কণ্ঠে”।

নিভা অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালেন, ফল্গু জিজ্ঞাসা করল, “গীতজীবী মানে?”

ব্রজবালা লাজুক হেসে বললেন, “ভিক্ষার জন্যে কেউ কেউ গান গায়, সে গানে আন্তরিকতা থাকে না, এবং সে গানের মর্যাদাও সে বুঝতে পারে না। তার আসল লক্ষ্য ভিক্ষা, ভিক্ষা পেলেই গান থামিয়ে পাশের বাড়ি বা পাশের পাড়ায় হাঁটা দেয়। বাড়ির লোকজনও দেখতাম তাদের ভিক্ষে দিয়ে বিদায় করতে পারলে যেন বেঁচে যায়। অন্যদিকে কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালে বাড়িতে সারা পড়ে যেত। ঠাকুমাকে বলতে শুনেছি, “অ কেষ্ট, অনেকদিন পর এদিকে এলি, বাবা। খপর সব ভালো তো”। আজ্ঞে খপর ভালই মা ঠাকরোন, এদিকে ছিলম না, গেছিলাম ঘোষপাড়ার মেলায়। তাই ক’মাস এদিকে...”।  “তা বেশ, একটু ব বাবা, জলখাবার খেয়ে একটু জিরিয়ে নে। হাতের কাজ সেরে গান শুনবো তোর। তা সেই কৃষ্ণপদও নিশ্চিন্তে জলখাবার খেয়ে ছায়ায় বসে টুংটাং করে তার একতারার তার বাঁধত।

দুপুরের রান্নাবান্না-ঘরের কাজ শেষ হলে ঠাকুমা হাঁক পাড়তেন, কই রে কোথায় গেলি সব। সবাই এসে বসলে কৃষ্ণপদ সকলকে প্রণাম জানিয়ে গান ধরত। তার গলা হেমন্ত, মান্না, কিশোরের মতো মেজে-ঘষে পোষ মানানো গলা নয়। গ্রীষ্মের দাহে দগ্ধ হতে থাকা ফুটিফাটা মাঠের মতো উদ্ধত। শরতের শস্য-ভরা ক্ষেতের গন্ধমাখা স্বপ্নময়। হেমন্তের হিমঝরা সন্ধ্যার মতো বিষণ্ণ-বিধুর। উদাত্ত, ব্যাপ্ত সেই কণ্ঠ নিমেষে আমাদের বেঁধে ফেলতে পারত, কথা আর সুরের নিবিড় বন্ধনে। বৈঠকখানা ঘরে বসে দাদু এবং তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা হুঁকোয় টান দিতে ভুলে যেতেন।

পরপর চার-পাঁচখানা গান শুনে ঠাকুমা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বিরতি ঘোষণা করতেন। বলতেন, “এখন থাক বাবা। বেলা হল। পুকুরে ডুব দিয়ে এসে দুটি ভাত মুখে দিয়ে একটু গড়িয়ে নে। রোদের তাপটা পড়লে বাড়ি যাবি”।

সেই কৃষ্ণপদ বিকেলের দিকে আরও কখানা গান শুনিয়ে, যখন বাড়ি ফিরত, মায়েরা তার ঝোলায় সিধে ভরে দিত। চাল, ডাল, কিছু আনাজ, তেল, নুন, মশলা। আমাদের দাদু দিতেন নগদ দুটাকা কিংবা তিনটাকা। এই রকম গুণী মানুষদের আমি বলি গীতজীবী। গানই ছিল তাঁদের জীবিকা, কিন্তু সেটাকে কেউ ভিক্ষা বলে মনে করত না। সাধারণ মানুষের মন জয় করেই তাঁরা জীবিকা অর্জন করতেন। শুধু কৃষ্ণপদ নয়, আরো অনেকে আসতেন – নাকে-কপালে আঁকা চন্দনের তিলক, গায়ে নামাবলি। তাঁরা গাইতেন – রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলা, মাথুর, মানভঞ্জন…সে সব গানও ছিল অপূর্ব। আমরাও হাঁ করে শুনতাম – আর বড়োরা তো আনন্দে দুঃখে কেঁদে তাঁদের শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ফেলতেন”।

 

ব্রজবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আবার বললেন, “তোদের তো দোষ নেই দিদিভাই, দোষ তো আমাদের । মাতৃভাষা মায়ের দুধের মতো – এ কথাটা আমাদের মনে আসে একমাত্রে ভাষা দিবসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখন আমাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে মায়ের দুধ ছাড়িয়ে বাচ্চাদের কত দ্রুত সেরেল্যাক খাওয়ানো যায়। ভাষার ক্ষেত্রেও এই সেরেল্যাক আমাদের সেরে দিয়েছে – দেশি ডাল-ভাত-শাকসব্জি-মাছ-মাংস ভুলে আমরা বেড়ে উঠছি ইংরিজি আর মুম্বাইয়ান হিন্দিতে...। দুঃখ করে লাভ কি? বাংলা ভাষা এখন ভেসে চলেছে বেনো জলে – তাকে ফিরিয়ে আনবে  ভবিষ্যতের কোন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-শরৎ-রবিঠাকুর – কে জানে? 


চলবে...       


শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

পঋপাটি ফে৯ওর





 নৃপেনবাবু বিনোদিনী দেবী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন দীর্ঘদিন। এই মফস্বল শহরে তাঁর ছাত্র সংখ্যা ঈর্ষণীয়। টোটো চালক থেকে ব্যাঙ্গালুরু শহরের পাঁচলাখি সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল বঁটিতে ঝপাঝপ ছ-সাত কিলোর কাতলা মাছ কেটে কাটাপোনা বিক্রেতা থেকে – জার্মান প্রবাসী তুলনামূলক সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক।

তাঁর পুত্র - ওই স্কুলেরই ছাত্র - দীপেনও কম যান না। আমেরিকার একটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং জল ছাড়াই যে কোন জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধানের উৎপাদনযোগ্য সংকর বীজ সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। সফল হলে পৃথিবীর চেহারাটাই পালটে যাবে। সাহারা, কালাহারি এমনকি আমাদের ঘরের থর মরুভূমিতেও দিগন্ত বিস্তৃত চোখ জুড়োনো সবুজ ধানক্ষেত দেখা যাবে। গবেষণা এখনও সফল হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ – কাল কিংবা পরশু...।

প্রতি বছর শীতকালে দীপেন সপরিবারে বাড়ি আসেন। এবারে আসতে পারেননি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সেমিনারে ইউরোপ যেতে হয়েছে। তাই দীপেনের স্ত্রী নমিতা এসেছেন তাঁর একমাত্র পুত্র নমপেনকে নিয়ে। এখানে তাঁরা মাস খানেক থাকবেন। মাসখানেক পর দীপেন এলে, আরও দিন সাতেক থেকে এক সঙ্গে উড়ে যাবেন আমেরিকায়।

নিজের পুত্র হলে কী হবে, নৃপেনবাবু দীপেনকে একদমই গ্রাহ্য করেন না। পত্নীর সামনে তিনি পুত্রকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু পুত্র-প্রসঙ্গ এলেই, তিনি মনে মনে “হতভাগা, গাধা একটা” বলে বেশ শান্তি পান। তাঁর যুক্তি সেই ধান চাষই যখন করবি, তখন অতদূরে না গিয়ে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান কিংবা বড়জোর তাঞ্জাভুর যেতে পারতিস?

আরো একটা কারণ আছে। তাঁর নাতিটির নাম নমপেন। প্রথম বার শুনে তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর পুত্র কম্বোডিয়াতে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য দেখে বা শুনে, ওখানকার রাজধানীর নামে পুত্রের নাম নমপেন রেখেছে। ঘন্টা – মোটেই তা নয়। তাঁর বউমার নাম নমিতার – নম, আর দীপেনের পেন – দুইয়ে মিলে নমপেন। তাঁর নাতির নাম।

এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি আরও জেনেছেন, কম্বোডিয়া দেশটার নাম তাঁর পুত্র শুনেছে – কিন্তু সেটা ঠিক কোন দিকে সে জানে না। একটু ভেবেচিন্তে বলেছিল, ইউরোপের কোন দেশ মনে হয় – লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া...। নৃপেনবাবু কিছু বলেননি। মনে মনে দীপেনের ভূগোলের মাস্টারমশাই ভূদেববাবুর কান মলে দিয়ে বলেছিলেন, “হতভাগা, দীপেনটাকে ভূগোলে পাসমার্ক দিয়েছিলি কী করে”? প্রসঙ্গতঃ ভূদেববাবুও তাঁর ছাত্র ছিলেন।

 

কথায় আছে টাকার থেকে সুদ মিষ্টি। নৃপেনবাবুর ক্ষেত্রেও কথাটি সমান প্রযোজ্য। নিজের পুত্রটিকে তিনি গাধা মনে করলেও, পৌত্র নমপেনকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। এবং বিশ্বাস করেন, বছর চোদ্দর এই প্রতিভাধর নাতিটিই তাঁর নামের পূর্ণ মর্যাদা রাখবে, এমনকি বংশের নামও উজ্জ্বল করবে।  

বাড়ি আসার পরের দিনই তাঁর বউমা একটি আবদার করলেন, বললেন, “বাবা, নমু মোটামুটি বাংলা বলতে পারে। ওখানে তো বাংলা শেখার সুযোগ খুব কম, তাই পড়তে বা লিখতে জানে না। এই এক মাসে যদি নমুকে বাংলা অক্ষর পরিচয় আর লেখাটা একটু শিখিয়ে দেন...তাহলে আমি ফিরে গিয়ে বাংলা বইটই পড়ানো চালু করে দেব”।

বৌমার কথায় নৃপেনবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, বললেন, “মোক্ষম বলেছ বউমা। মাতৃভাষা হল মায়ের দুধের মতো। সে কী আর কৌটোর দুধ কিংবা প্লাস্টিক-প্যাকেটের দুধ দিয়ে পূরণ হয় মা? মাতৃভাষা না জানলে কোন বিদ্যা বা জ্ঞানই পূর্ণ হতে পারে না...”।

নৃপেনবাবুর স্ত্রী বললেন, “এই শুরু হল লেকচার... ক্লাসের ঘন্টা না পড়া পর্যন্ত থামবে না। পাগলকে কোনদিন, সাঁকো নাড়া দিও না, বলতে আছে, বৌমা?”

নমিতা মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না। শ্বশুর শ্বাশুড়ির মধ্যে এই নিরন্তর খুনসুটির ব্যাপারটা নমিতা বেশ উপভোগ করেন।

 

দাদু ও নাতির যৌথ উদ্যোগে শুরু হল বাংলা-শিক্ষা অভিযান। বাংলা পড়া ও লেখা দ্রুত গতিতেই চলতে লাগল। অবশ্য একথাও মানতে হবে নমপেন বা নমু এতটুকু চঞ্চল, অমনোযোগী বা অধৈর্য হল না – সমান উৎসাহে দাদুর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গেল।

ঠিক কুড়ি দিন পর। রবিবারের সকাল। নৃপেনবাবুর স্ত্রী ব্রেকফাস্টের টেবিলে বললেন, “শুনছো, আমি আর বৌমা একটু শপিং করতে যাবো টাউন মলে। আজ রবিবার – সন্ধের দিকে খুব ভিড় হয় – আমরা এবেলাতেই যাবো – এই এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ, ফিরতে ফিরতে দেড়টা দুটো হয়ে যাবে। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করো না - তুমি আর নমু খেয়ে নিও। নীলিমাকে বলে যাচ্ছি – ও খাবার বেড়ে দেবে। কেমন?”

কথাটা শুনেই নৃপেনবাবুর মাথায় একটা আইডিয়া এল। এতদিন তিনি নমুকে পড়িয়েছেন, লিখিয়েছেন বাঁধা-ধরা ছোটদের বই থেকে। সেসব নমুর ভালই আয়ত্ত হয়ে গেছে। সে সব পড়ে সত্যি সত্যি নমু কতটা শিখেছে এবং বুঝেছে তার একটা পরীক্ষা নিলে কেমন হয়?

ছাত্রদের উপহার দেওয়া অনেক ডাইরি তাঁর ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমের বুকসেলফের ড্রয়ারে রাখা থাকে। ব্রেকফাস্টের পর তিনি নতুন একটা ডাইরি আর একটা পেনসিল বের করে নমুকে বললেন, “দাদুভাই, আজকে একটা নতুন খেলা খেলব”।

নমু বেশ মজা পেয়ে বলল, “বাঃ কী খেলা দাদু”?

“খেলাও বটে আবার লেখাপড়াও বটে”।

“খেলা আর লেখাপড়া একসঙ্গে?” নমু বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল।

“হুঁ। খেলাটার নাম ধরো ডাইরি-ডাইরি খেলা। মানে এখন থেকে দুপুরের খাওয়ার সময় পর্যন্ত তুমি যা যা দেখবে, যা যা কথা বলবে, যা যা করবে এবং শুনবে, সব লিখে রাখবে তোমার ডাইরির পাতায়। বুঝতে পারলে?”

“ধরো এই তুমি আমাকে যা বললে, সে কথাও লিখবো? তারপর দিম্মা, মা, নীলিমা মাসি, আজ বাগানে মালিমামা এসেছে, যে যা বলবে, করবে, তারপর আমি যা যা করব, সব লিখবো?”

“গুড। ঠিক বুঝেছ। বাগানে গেলে গাছের নাম, ফুলের নাম, পাখির নাম, যা জানো সে সবও লিখবে...”।

“এখনই শুরু করি?”

“করো। কিন্তু এখন কাউকে দেখাবে না, এমনকি আমাকেও না। আমাকে দেখাবে সেই দুপুরে খাওয়ার আগে। ঠিক আছে?”

বিশাল ঘাড় নেড়ে নমু বলল, ঠিক আছে।

“ডাইঋ ডাইঋ খেলা

দাদুর থেকে ডাইঋ আর পেন্সিল নিলাম। এই ডাইঋতে আমি এখন থেকে যা কিছু দেখব, শুনব - সব ৯খে রাখবো। ঘর থেকে বেঋয়েই  দেখি সিঁড়ির মাথায় বেড়ালটা বসে আছে। আমাকে দেখেই পড়িমঋ করে দৌড়ে পালাল। কি মুশকিল, এখনও পর্যন্ত বেড়ালটা আমার পঋচিত হতে পারল না? আমাকে দেখলেই ভয় পায় কেন? কই অন্য কাউকে তো ভয় পায় না। কই ঠাকুমা কিংবা নী৯মামাসিকে তো ভয় পায় না? দাদুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দাদু বলেছিল, তোমার ঠাকুমা আর নী৯মা ওকে পঋপাটি করে খেতে দেয় যে – মাছ, দুধের বাটি – তাই বেড়ালটা ওদের পায়ে পায়ে ঘোরে।   

 নিচে বাগানে গেলাম। মা৯মামাকে দেখতে পেলাম না। পিছনদিকে গিয়ে দেখি মা৯মামা মাটিতে বসে কাজ করছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “মা৯মামা কী করছো গো?”

আমাকে দেখে হেসে বলল, “এই মাটিটা একটু খুঁড়ে দিচ্ছি। গাছের গোড়া খুঁড়ে দিলে শেকড়ে হাওয়া পায়, গাছ খুব বাড়ে। আমাদের গায়ে ঝিঋঝিঋ হাওয়া লাগলে যেমন ভাঋ আরাম হয়, গাছেদেরও হয় জানো তো?”

“এটা কী গাছ গো মামা?”

“পেঁয়াজ গাছ, সবে গজাচ্ছে। আরও দিন সাতেক গেলে পুষ্ট হয়ে পেঁয়াজক৯ হবে”।

“আর ওই চারাগু৯?”

“ওগুলো গাজর – এধারে টোম্যাটো। টোম্যাটোকে অনেকে বি৯তি বেগুন বলে জানো তো! ওই দিকে লংকা। আর ওই যে ওদিকের কটা বেগুন গাছ। আর এই যে এইখানে আছে ফুলকপি আর বাঁধাকপি। ফুলকপির সবে ফুল এসেছে – দিন পনের পরে এত্তোবড়ো ফুল হবে – সে ফুলকপি দিয়ে তরকাঋ রাঁধলে যা স্বাদ হবে না – সব কিছু ভু৯য়ে দেবে”।

“আর ওদিকের লম্বা লম্বা পাতাওয়ালা গাছগুলো কি?”

“ওগুলো? ওগুলো কলাগাছ – কাঁঠা৯ কলা। সবে মোচা এসেছে, কলা হতে অনেক দেঋ”।

“মোচা থেকে কলা?”

“হ্যাঁগো মোচার বড়ো বড়ো পাপড়ির তলায় সাজানো আছে – সাঋসাঋ ক৯র গুচ্ছ। ওগুলোই বেড়ে বেড়ে হয়ে যাবে কলার কাঁদি”।

ভেতর থেকে মা ডাকলেন, “নমু, কোথায় গে৯? আমরা এবার বেরোব”।

আমি মা৯মামাকে বললাম, “মা ডাকছেন। আসি”। দৌড়ে দোতলায় গিয়ে দেখি মা আর দিদিমা বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি। ঠাকুমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নী৯মামাসিকে বলছেন, “নী৯মা, মেসোমশাইকে সাড়ে বারোটা থেকে তাগাদা দিবি চান করতে যাবার জন্যে। আর যদি চা চায় একবার দিবি – ৯কার চা। চিনি ছাড়া। একটু পরে নমুসোনার জন্যে একটা ডিমের পোচ দিবি, সামান্য নুন-গোলমঋচ দিয়ে। মেসোমশাইকে দিবি না”।

মা বললেন, “একদিন একটা ডিম খেলে কী হবে মা? বাবা ডিম খেতে ভালোবাসেন”।

ঠাকুমা বললেন, “না বৌমা তুমি জানো না, ডিম খেলেই ওঁনার পেটের ক৯ক পেনটা বেড়ে ওঠে। আর শোন দেড়টার মধ্যে খেতে দিয়ে দিবি। মেসোমশাইকে ভাত কম দিয়ে তরকাঋ বেশি দিবি। কেমন? ডাক্তার বলেছে বেশি বেশি তরকাঋ খেতে। নমুসোনা, ঠিক সময় মতো স্নান সেরে দাদুর সঙ্গে খেয়ে নেবে, কেমন? দাদু যেন বেশি দুষ্টুমি না করে, লক্ষ্য রাখবে”।

মা বললেন, “তোর হাতে ওটা কি, নমু?”

আমি বললাম, “ডাইঋ, দাদু বলেছেন ডাইঋ ৯খতে”।

মা বললেন, “৯খছিস? কই কী ৯খ৯ দেখি?”

আমি বললাম, “এখন দেখানো যাবে না, দাদু মানা করেছেন। বলেছেন কেউ যেন দেখতে না পায়। দাদু দুপুরে খাবার আগে দেখবেন”।

ঠাকুমা বললেন, “ছাড়ো বৌমা, বেঋয়ে পড়ি। তোমার বাবার যত্তো ছিটিয়া৯ কারবার, সারাজীবন মাষ্টাঋ করে মাথার মধ্যে ছিটমহল বানিয়ে ফেলেছেন। নী৯মা আমার বেরোচ্ছি...” গলা তুলে নৃপেনবাবুকে চেঁচিয়ে বললেন, “শুনছো, আমরা বেরোচ্ছি”। তারপর নমুর গাল টিপে বললেন, “তুমি তো লক্ষ্মী ছেলে, দাদুর দিকে একটু নজরদাঋ করো, কেমন? দাদু যেন দুষ্টুমি না করতে পারে। আমরা বেরোলে দরজাটা বন্ধ করে ওপরেই থেকো”।

মা-ঠাকুমা বেঋয়ে যেতে আমি আবার বাগানে গেলাম। মা৯মামা দেখলাম ফুলের বাগানে কাজ করছেন। কী সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে – এতো বড়ো বড়ো – তেমনি সুন্দর রঙ। মা৯মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কী ফুল মামা?”

“ডা৯য়া। রোদ্দুর পড়ে ফুলগুলো যেন খিলখি৯য়ে হাসছে, তাই না, ছোটবাবু? আর ওই দিকে দেখ চন্দ্রমল৯কা। কতরকমের রঙ, দেখছো? ওই দিকের গুলো সূর্যমুখী আর এই যে এগুলো ক্যালেনডুলা। তারপাশেই দেখ এই যে এগু৯ গাঁদাফুল। রকমাঋ রঙের ফুল শীতকালেই হয়। গরমকালের ফুলে তেমন রঙ হয় না, অধিকাংশই সাদা – বে৯, শিউ৯, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, টগর, মালতী, কামিনী। একটু একটু রঙ থাকে কাঁঠা৯ চাঁপায়, মাধবীলতায়। অবিশ্যি গরমের অধিকাংশ ফুলেই ভাঋ মিষ্টি গন্ধ হয় – শীতকালের ফুলে আবার তেমন গন্ধ হয় না”।

মা৯মামার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে বললাম – “এই বড়ো গাছগুলো কী গাছ, মামা”।

“ওই গাছটা আম গাছ, আম্রপা৯ – ছোট ছোট আম পাকলে মিছঋর মতো মিষ্টি। এটা জামরুল। আর ওইটা হল ৯চু। গরমকালে ৯চু পেকে লাল টুকটুকে হয়ে ওঠে – ওঃ সবুজপাতার মধ্যে থোকাথোকা পাকা লাল ৯চুগুলো হাওয়ায় যখন দোলে - সে ভাঋ চমৎকার দেখতে লাগে। গরমকালে একবার চলে এসো না, ছোটবাবু। দাদুর বাগানের আম্রপা৯ আর ৯চু খেলে, আমেঋকা ফিরতে তোমার ইচ্ছেই হবে না...”।

মা৯মামার কাজ হয়ে গেল। বাগানের নানান যন্ত্রপাতি ধুয়ে মুছে পঋপাটি করে গুছিয়ে রাখলেন, গ্যারেজের এক কোনে। বললেন, “এখন তবে আসি, ছোটবাবু। আমি আবার বেষ্পতিবার আসবো, তুমি থাকবে তো?”

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ থাকব, বাবা আসবেন মাসের শেষ দিকে – তারপর আমাদের আমেঋকা ফিরতে হবে...”। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল – এমন সুন্দর দেশ আমাদের – এসব ছেড়ে আমরা কেন আমেঋকায় থাকি – সেটা তো আমাদের দেশ নয়...। মা৯মামা চলে গেলেন, আমি দরজা বন্ধ করে দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই নী৯মামাসির ডাক শুনলাম – “নমুবাবা, ওপরে এসো...”। বুঝলাম আমার পোচ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

সিঁড়ির মাথায় নী৯মামাসির সঙ্গে দেখা হল, তাঁর এক হাতে ডিমের পোচ আর অন্য হাতে ৯কার চা। বললেন, “দাদুর ঘরে চলো। ওখানে বসে দাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে খাবে”।

দাদুর ঘরে ঢুকে দেখি দাদু খাটে মশাঋর ভেতরে ঢুকে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। আমি অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদু তুমি দিনের বেলা মশাঋর মধ্যে ঢুকে বসে আছো কেন?” দাদু মশাঋর থেকে বেড়িয়ে এসে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “এস, বসো, দাদুভাই। দিন হোক বা রাত, মশাদের আমি মোটেই বিশ্বাস কঋ না। কখন যে হুল ফোটাবে...ঠিক তোমার দিদিমার মতো”।

টেবিলে চায়ের কাপ রেখে নী৯মামাসি দাদুর কথায় মুখ টিপে হেসে বললেন, “মেসোমশাই, আপনার চা। চা খেয়েই আপনি কিন্তু চান করে নেবেন। গিজার চালু করে দিয়েছি”। তারপর আমার হাতে প্লেট আর চামচ ধঋয়ে দিয়ে বললেন, “তুমিও পোচ খেয়েই চান করতে যাবে। তোমাদের বাথরুমেও গিজার চালু করে দিয়েছি”।

নী৯মামাসি চলে যেতে দাদু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমার পোচে নুন-গোলমঋচ দিয়েছে তো, দাদুভাই? গোলমঋচের গুঁড়ো ছাড়া পোচের স্বাদ জমে না। আমারও পোচ খুব প্রিয়, খুব খেতাম – কিন্তু তোমার ঠাকুমা ডাক্তারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে...আমার ডিম খাওয়াটাই নাকচ করে দিয়েছে। কী ঝকমাঋ বলো তো, দাদুভাই!”

   দাদুর সামনে বসে তাঋয়ে তাঋয়ে পোচ খেতে খুব খারাপই লাগছিল। কিন্তু দাদুর বয়স হয়েছে – ডিম-টিম না খাওয়াই ভালো।

চা শেষ করে দাদু বললেন, “কই কী ৯খলে, কেমন ৯খলে দেখি। এই পরীক্ষায় তুমি পাশ করলে, আমারও পাশ করা হবে। বুঝবো আমি এতদিনেও মাষ্টাঋ করা ভু৯নি”।

আমি ডাইঋ লেখা এখানেই শেষ করলাম। লেখাপড়া করতেও যে এমন মজা হয় – এর আগে বুঝতেই পাঋনি”।

-  -  -

 

নমু পোচ শেষ করে ডাইরিটা দাদুর হাতে দিয়ে বলল, “তুমি দেখ দাদু, আমি ততক্ষণ স্নানটা সেরে আসি”।

নৃপেনবাবু ডাইরি খুলতে খুলতে বললেন, “বেশ বেশ। সেই ভালো। আমি তোমার লেখাটা পড়ে ফেলি”।

ডাইরি পড়তে পড়তে নৃপেনবাবু বেশ কয়েকবার জিভে বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “দোষ তো দাদুভাইয়ের নয় – আমার। আমি পুরোপুরি ফেল করে গেলাম। দাদুভাইকে বলাই হয়নি – বাংলা ভাষায় ৯ বর্ণের কোন ব্যবহারই আর নেই। এও বলা হয়নি – ঋ বিশেষ কিছু তৎসম – অর্থাৎ সংস্কৃত - যেমন ঋতু, ঋষি, ঋত, ঋজু, ঋত্বিক, এই রকম সীমিত কিছু শব্দ ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার হয় না। এটা যদি বলে দিতাম দাদুভাইয়ের লেখায় তো কোন খুঁত ছিল না! একশো তো একশ। কিন্তু আমি? ছিঃ – ফেল হয়তো করিনি। কিন্তু বত্রিশের বেশি – অর্থাৎ বড়ো জোর টায়েটায়ে পাশ করেছি বলা চলে।

কিন্তু ওর ঠাকুমা এসব কী বলেছে আমার সম্পর্কে? – তাও বৌমা, নীলিমা, নাতির সামনে? আমি ছিটিয়াল? মাষ্টারি করে করে আমার মাথায় ছিট-মহল গজিয়েছে? তার ওপর আমি দুষ্টুমি করলে, আমাকে সামলাবে আমাদের নাতি? ছি ছি। ছেচল্লিশ বছর একসঙ্গে ঘর করে, নিজের স্বামী সম্পর্কে এই রকম মন্তব্য? মহিলার মাথার ঠিক আছে তো?

তার পরেই ভাবলেন, কিন্তু তিনিই বা কম কিসে? নাতির সামনে ঠাকুমাকে মশার সঙ্গে তুলনা করলেন? ওর ঠাকুমা তাঁকে মশার মতো হুল ফোটান? ছি ছি। তিনিও তো বজ্জাতিতে তাঁর স্ত্রীর থেকে এক চুলও কম যান না!

ডাইরিটা হাতে নিয়ে নৃপেনবাবু অনেকক্ষণ বসে রইলেন। জানালা দিয়ে দূর আকাশে একটা চিলকে ভেসে বেড়াতে দেখলেন বহুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে সিদ্ধান্ত করলেন, দীর্ঘ দাম্পত্যের এটাই মজা। পরষ্পরের পিছনে লাগাতেই সম্পর্কটা সুন্দর টিকে থাকে – একদম গলাগ৯ – পঋপাটি সম্পর্ক।   

 ----০০০০----

নতুন পোস্টগুলি

চ্যালেঞ্জ - নাটক

  কুশীলব   (মঞ্চে প্রবেশের ক্রম অনুসারে)   প্রাণপণবাবু                       কমলা – প্রাণপণবাবুর স্ত্রী                  প্রতাপ – প্...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ