শুক্রবার, ৯ মে, ২০২৫

যুদ্ধ প্রস্তুতি - পর্ব ১

 [২২শে এপ্রিল ২৫ এর পহেলগামে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারত কী পদক্ষেপ নেয়, তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আমরা। যতদিন গেছে - ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক শক্তির তুচ্ছতা নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের প্রতিটি শাখায়। জনগণেশ বারবার বলেছে - এত অপেক্ষার কী আছে - ভারত তো নিমেষে গুঁড়িয়ে দিতে পারে বিরুদ্ধ দেশকে। দীর্ঘ পনেরদিন অপেক্ষার পর ভারত সরকার দুর্দান্ত আঘাত হেনেছে। পাকিস্তানের সীমানার বাইরে থেকেই ভারত নটি জঙ্গী ঘাঁটি বিধ্বস্ত করেছে মোট একুশটি মিসাইলের আঘাতে। অর্থাৎ নিখুঁত এবং নিশ্চিত আঘাত হানার জন্যে ভারত মাত্র চোদ্দদিন সময় নিয়েছে প্রস্তুতির জন্যে। সরাসরি রণাঙ্গনে নামার আগে এই যুদ্ধ প্রস্তুতির কথাই চিন্তা করেছিলেন যুধিষ্ঠির।  বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসের তের বছরে ধৈর্য ধরে নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন - কী ভাবে যুদ্ধ জয় নিশ্চিত করা যায়। সেই আলোচনাই করেছি - মহাভারতের বনপর্ব থেকে।] 


কপট দ্যুতক্রীড়ায় শোচণীয় পরাজয়ের ফলে সপত্নীক পাণ্ডবদের চূড়ান্ত অপমানিত এবং রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়ে বারো বছর বনবাস ও একবছর অজ্ঞাতবাসের প্রতিজ্ঞা পালন করতে হয়েছিল। ভীম, অর্জুন এবং দ্রৌপদী, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের এই প্রতিজ্ঞা পালনে মোটেই সন্তুষ্ট হননি। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য ছিল, শকুনির সাহায্যে কৌরবপক্ষ যেখানে অসদুপায়ে অক্ষক্রীড়া পরিচালনা করে, পাণ্ডবদের সঙ্গে চরম শঠতা করেছে, সেখানে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা দুর্বলতার লক্ষণ। স্বয়ং বাসুদেব, রাজা দ্রুপদ ও তাঁর পুত্রদের সহায়তা নিয়ে, মহাবল ভীম ও অর্জুনের মতো বীরের পক্ষে কুরুবীরদের বিনাশ করা, শুধুমাত্র যুধিষ্ঠিরের অনুমতির অপেক্ষা!

কিন্তু পত্নী দ্রৌপদী ও ভাইয়েরা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন জেনেও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল রইলেনতিনি বললেন, কোন কারণেই তিনি ধর্মপথ থেকে ভ্রষ্ট হবেন না এবং তাঁর প্রাজ্ঞ দূরদর্শীতা দিয়ে সকলকেই বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ভীম ও অর্জুন অতুলনীয় বীর তাতে তাঁর কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু বিপক্ষীয় পক্ষে আছে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, শল্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন প্রমুখ বীরেরা। তাঁদের সকলকে পরাস্ত করে রাজ্য জয় করা দুঃসাহসিক হঠকারিতা হয়ে যেতে পারে। তিনি অবশ্যই যুদ্ধ করবেন, কিন্তু ত্রয়োদশ বছরের প্রতিজ্ঞা পালনের পর! আর এই দীর্ঘ সময়টা তিনি ধৈর্য নিয়ে ব্যবহার করতে চাইছেন, তাঁর দুই মহাবল ভাইয়ের নিবিড় অনুশীলন এবং প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহের জন্য। যাতে তেরবছর পর তাঁদের ঈপ্সিত রাজ্যজয় নির্বিঘ্ন ও নিশ্চিত হয়!

একথা ঠিক দুরাত্মা দুর্যোধন ও তাঁর ভাইয়েরা সকলেই নিষ্ঠুর আততায়ী। তারা পাণ্ডবদের বধ করার জন্য বিষপ্রয়োগ করেছে, গৃহে অগ্নি সংযোগ করেছে, তাদের পৈতৃক রাজ্য হরণ করেছে এবং ধর্মপত্নীকে প্রকাশ্য রাজসভায় চরম অপমান করেছে।  অতএব ক্ষত্রিয় ধর্মমতে তারা অবশ্যই বধ্য শত্রুকিন্তু সেই শত্রুদের মধ্যে আছেন শ্রদ্ধেয় পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণ ও কৃপ, আত্মীয় শল্য এবং জ্ঞাতিভ্রাতাগণ!  রাজা যুধিষ্ঠির অবিচল ধর্মপথের পথিক, ভূভারতের সকলে তাঁকে ধর্মরাজ বলেই শ্রদ্ধা করে। রাজ্যলোভে জ্ঞাতি হত্যা ক্ষাত্রধর্মেও সমীচিন কিনা, সে বিষয়ে তিনি যেন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। সেই কারণেই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নামার আগে প্রভাবশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নৈতিক সমর্থন না পেলে তিনি যুদ্ধবিষয়ে মনস্থির করতে পারছেন না 

তাঁর এই উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছিল, সেটা এবার দেখে নেওয়া যাক বেদব্যাস বিরচিত মূল মহাভারতের, মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ কৃত বাংলা অনুবাদের “বন পর্ব” থেকে।      

 

 

মহর্ষি ব্যাসদেবের অনুগ্রহ

পাণ্ডবদের বারো বছরের বনবাসের মধ্যে, দ্বৈতবনে তখন সবেমাত্র তের মাস পার হয়েছে। পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীর কাছে বনবাসের চরম ক্লেশ দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। বিরক্ত হয়ে তিনি একদিন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ক্ষত্রিয় রাজার ধর্ম–অধর্ম নিয়ে অনেক উপদেশ দিলেন। তাঁর একটাই উদ্দেশ্য, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যেন তাঁর বীর ভাইদের এখনই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। রাণি দ্রৌপদীর দৃঢ় বিশ্বাস, মহাবলী ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব এবং রাজা যুধিষ্ঠির নিজে, দুর্যোধন সহ সকল কৌরব পক্ষকে বিনাশ করার জন্য যথেষ্ট। অতএব, এই অরণ্যে বৃথা কালহরণ না করে, রাজা যুধিষ্ঠিরের অবিলম্বে হস্তিনাপুর জয়ে উদ্যোগী হওয়া উচিৎ। যুদ্ধ করে অপহৃত রাজ্য অধিকার করা অথবা পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়াই ক্ষত্রিয়দের একমাত্র ধর্ম। তাছাড়া যে দ্যূত ক্রীড়াতে দুর্যোধনরা শঠতা অবলম্বন করেছিল, সেই কপট দ্যূত ক্রীড়ায় পরাস্ত হয়ে, তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যে সুদীর্ঘ এই বনবাসের কৃচ্ছ্রসাধন, কোন ভাবেই ধর্ম আচরণ হতে পারে না। অধার্মিক দুরাত্মা দুর্যোধন এবং তার সঙ্গীদের অবিলম্বে সমুচিত শাস্তি দিয়ে, এখন রাজ্য পুনরুদ্ধার করাই, ক্ষত্রিয় বীরের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিৎ!

দ্রৌপদীর যুক্তি মেনে নিয়েও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বললেন, “হতে পারে দ্যূতক্রীড়ায় দুর্যোধন কপটতার আশ্রয় নিয়েছিল, কিন্তু আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম, তার মধ্যে তো কপটতা, ছিল না! অতএব আমি আমার প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হতে পারবো না, যাজ্ঞসেনি। কারণ ধর্মপথ ছাড়া অন্য কোন পন্থা আমার কোনদিন ছিল না, আজও নেই”সেখানে উপস্থিত ছিলেন, মধ্যম পাণ্ডব ভীম। তিনি রাণি দ্রৌপদীর কথায় অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “কৃষ্ণা ঠিকই তো বলেছেন, দাদা। তুমি একবার আদেশ দাও, আমি আর অর্জুন মিলে কৌরব আর তাদের সঙ্গী সাথীদের বিনাশ করে দিই! তুমি আবার রাজা হও, তোমার সঙ্গে আমরাও আবার নিশ্চিন্ত রাজ্যসুখে দিন কাটাই”।

মহারাজ যুধিষ্ঠির পত্নী দ্রৌপদীকে যে কথা বলতে পারেননি, মহাবীর ভ্রাতা ভীমকে সেই বাস্তব পরিস্থিতির কথা বললেন, “ভাই বৃকোদর, তোমাদের দুজনের বীরত্বে আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। কিন্তু কৌরবপক্ষে আছেন, পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা – এঁদের বীরত্বকে অবহেলা করো না। আগে যে সকল রাজাদের আমরা পরাস্ত করে বশীভূত করেছিলাম, তারাও এখন আমাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে দুর্যোধনের পক্ষেই সসৈন্যে উপস্থিত হবে, বলা বাহুল্য! এই সকল কথা চিন্তা করে, আমার রাত্রের নিদ্রা উচ্ছিন্ন হয়ে গেছে”!

দ্রৌপদী ও দুই পাণ্ডব যখন দীর্ঘ এই আলোচনায় ব্যস্ত, সেই সময় মহাযোগী দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব সেখানে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবদের থেকে যথা বিহিত সম্মান ও পূজা গ্রহণ করার পর, তিনি রাজা যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “হে নরশ্রেষ্ঠ, আমি স্বীয় মনস্বী প্রভাবে তোমার মনের ভাব বুঝতে পেরে, তোমার কাছে সত্বর উপস্থিত হলাম। তুমি যে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও দুঃশাসনের থেকে ভয়ের আশঙ্কা করছো, তার নিরাকরণের জন্যই আমার এই আসা! হে রাজেন্দ্র, যে উপায়ে তোমার এই ভয় দূর হতে পারে, সে কথা শুনে সেই কার্যের অনুষ্ঠান করলে, তোমার আর চিন্তার প্রয়োজন দেখি না!”।

[মহামুনি পরাশরের পুত্র মহর্ষি শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ভূভারতে অত্যন্ত প্রাজ্ঞ এবং জ্ঞানী বলে সুবিদিত। তিনি রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু এবং ধর্মরাজ বিদুরের পিতা, অর্থাৎ তিনি পঞ্চপাণ্ডব ও দুর্যোধনাদি ধার্তরাষ্ট্রদের পিতামহ। তাঁর কাছে পাণ্ডব ও কৌরব উভয় পক্ষই সমান স্নেহের, কিন্তু ইদানীং তিনি কৌরবপক্ষের আচরণে বিরক্ত, বিদ্বিষ্ট। তাঁর মতো ত্রিকালদর্শী মহর্ষিও স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের সামনে এসে কৌরব বধের উপায় উপদেশ করছেন! এই নৈতিক সমর্থনই পরবর্তী কালে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্য জয়ের পাথেয় হয়ে উঠবে!]

ত্রিকালজ্ঞ মহর্ষি ব্যাসদেব, রাজা যুধিষ্ঠিরকে নির্জনে ডেকে নিয়ে বললেন, “হে ভরতকুলতিলক, আমি তোমাকে “প্রতিস্মৃতি” নামে একটি রহস্যবিদ্যা দান করছি, তুমি মনোযোগে এই বিদ্যা গ্রহণ করো। পরে এই বিদ্যা তুমি মহাবাহু অর্জুনকে অর্পণ করবে। এই বিদ্যা অনুযায়ী অর্জুন সাধনা করলে, স্বয়ং মহাদেব ও মহেন্দ্রর অনুগ্রহে অনেক অস্ত্রলাভ করতে পারবে। অর্জুন এই সাধনার প্রভাবে বরুণ, কুবের, ধর্মরাজ প্রমুখ দেবগণেরও সাক্ষাৎ লাভ করবে। মনে রেখো, অর্জুন সামান্য মানুষ নয়, চিরন্তন মহাতেজা ঋষি। ভগবান নারায়ণ তার সহায়, অর্জুনকে কেউই পরাজিত করতে পারবে না। সে রুদ্র, ইন্দ্র ও লোকপালদের থেকে আরও অনেক অস্ত্র পেয়ে মহৎকার্য সম্পন্ন করতে পারবে” 

এরপরে মহর্ষি ব্যাস আরও বললেন, “হে কৌন্তেয়, এখন তুমি নিজেদের বাসোপযোগী অন্য অরণ্যের সন্ধান করো! কারণ, অরণ্যের একস্থানে দীর্ঘবাস প্রীতিকর হয় না। তুমি বেদবেদাঙ্গপারগ অনেক ব্রাহ্মণের ভরণপোষণ করছো। তাতে অরণ্যবাসী তপস্বীরা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন; লতা, গুল্ম, ওষধি বিনষ্ট হচ্ছে এবং অসহায় মৃগদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে উঠছে!”

[মহর্ষি ব্যাসদেব কী শুধু অরণ্যবাসী তপস্বীদের বিরক্তি এবং অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার জন্যই মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করলেন? নাকি শত্রু কৌরবপক্ষের গুপ্ত আক্রমণের আশঙ্কায় পাণ্ডবদের এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যে ক্ষণস্থায়ী বিচরণের পরামর্শ দিলেন! সে কথাটা কী উহ্য রইল?]

লোকতত্ত্বজ্ঞ ভগবান ব্যাস ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ওই আশ্চর্য বিদ্যা ও উপদেশ দিয়ে চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই, মহারাজ যুধিষ্ঠির সপরিবারে দ্বৈতবন ত্যাগ করে, সরস্বতী নদীর উপকূলে কাম্যকবনে চলে এলেন। তাঁর পিছনে রইলেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরাও। কাম্যক বনে এসে মহারাজ যুধিষ্ঠির মহর্ষি ব্যাসদেবের দেওয়া সেই মন্ত্র নিবিষ্ট মনে বারবার অভ্যাস করলেন।

তারপর একদিন নির্জনে অর্জুনকে ডেকে, ভ্রাতার অঙ্গ স্পর্শ করে, খুব শান্তভাবে বললেন, “হে ভ্রাতঃ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ ও অশ্বত্থামা – এঁরা সকলেই পূর্ণ চতুষ্পাদ ধনুর্বেদে সম্যক অধিকার লাভ করেছেন। এঁরা সকলেই ব্রাহ্ম, দৈব ও মানুষী অস্ত্রসমূহের ধারণ, প্রয়োগ ও অন্যে প্রয়োগ করলে তার প্রতিকারের বিষয়ে সুশিক্ষিত। দুর্যোধন এঁদের প্রচুর অর্থদান করে, গুরুর সম্মান দিয়ে সন্তুষ্ট রেখেছে। কার্যকাল উপস্থিত হলে, এঁরা সকলেই প্রতিদানস্বরূপ নিজেদের বলবীর্য প্রকাশ করবেন। হে অর্জুন, তুমি আমাদের সকলের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এবং তোমাতেই সমগ্র দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, এখন যে কর্তব্যের কথা বলছি, মন দিয়ে শোনো। আমি মহর্ষি বেদব্যাসের থেকে একটি গূঢ় বিদ্যা গ্রহণ করেছি। ওই বিদ্যার প্রয়োগে সমস্ত জগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! তুমি ওই বিদ্যায় সংযুক্ত ও সুসমাহিত হয়ে তপস্যায় মনোনিবেশ করলে, যথাসময়ে দেবতাদের প্রসাদ লাভ করবে। অতএব, তুমি এখনই ধনু, কবচ ও খড়্গ গ্রহণ করে, সাধুব্রতধারী মুনির মতো উত্তরদিকে যাত্রা করো। কিন্তু কাউকে এই বিদ্যার কথা প্রকাশ করবে না। পুরাকালে দেবগণ বৃত্রাসুরের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রকে সকল দিব্যাস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন। তুমি তাঁর থেকে সকল অস্ত্র একসঙ্গেই পেয়ে যাবে, এই বিদ্যার প্রভাবে তিনিই তোমাকে সমুদয় অস্ত্র প্রদান করবেন। তুমি আজই দীক্ষিত হয়ে পুরন্দরের সাক্ষাতের জন্য যাত্রা করো”।

এই কথা বলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অর্জুনকে সেই রহস্যবিদ্যা অধ্যয়ন করালেন। তারপর মহর্ষি ব্যাসবিহিত নিয়ম অনুসারে অর্জুনকে দীক্ষিত ও কায়মনোবাক্যে সংযত করে, প্রস্থানের আদেশ দিলেন। অর্জুন এই ভাবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আদেশে গাণ্ডীব ধনু, অক্ষয় তূণীর, কবচ, বর্ম, গোধাঙ্গুলিত্র[i] ধারণ করে, প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে আহুতি দান করলেন। তারপর ব্রাহ্মণদের নিষ্ক[ii] দান করে স্বস্তিবাচন করিয়ে, ধার্তরাষ্ট্রদের বধ করার উদ্দেশে কৃতসংকল্প হয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে, ঊর্ধ্বদিকে তাকিয়ে প্রস্থান করলেন। সেই সময়ে সিদ্ধ ব্রাহ্মণগণ ও গূঢ় ভূতেরা অর্জুনকে দেখে বললেন, “হে মহাবীর, অনতিকাল মধ্যেই তোমার সংকল্প সিদ্ধ হবে। তোমার নিশ্চয়ই জয়লাভ হবে, তুমি প্রস্থান করো” এবং সকলেই আশীর্বাদ করলেন।

দ্রৌপদী মহাকায় অর্জুনকে প্রস্থান করতে দেখে অশ্রুসজল নয়নে বললেন, “হে মহাবাহো, তোমার জন্মগ্রহণ কালে, মাতা কুন্তী যা অভিলাষ করেছিলেন এবং তোমার যেমন ইচ্ছা, সেই সকলই সফল হোক। এখন প্রার্থনা করি, ক্ষত্রিয়কুলে যেন আর কারো জন্ম না হয়! যাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন কর জীবিকা নির্বাহ করেন, সেই ব্রাহ্মণদের আমি নমস্কার করি। পাপাত্মা দুর্যোধন রাজসভায় বহুবিধ অশালীন বাক্য সহ আমাকে “গরু গরু” বলে যে উপহাস করেছিল, সেই দুরপনেয় দুঃখের থেকেও, এখন তোমার বিয়োগজনিত দুঃখ গুরুতর মনে হচ্ছে! তোমার ভ্রাতৃগণ তোমার বীরকার্যের কথা উল্লেখ করে, সর্বদা আনন্দ করবে। হে নাথ, তুমি দীর্ঘ প্রবাসজনিত প্রয়াস স্বীকার করলে, আমাদের ভোগ, ধন বা জীবনে কদাচ সন্তোষ জন্মাবে না। আমাদের সুখ, দুঃখ, জীবন, মরণ, রাজ্য ও ঐশ্বর্য একমাত্র তোমাতেই সমাহিত রয়েছে! তুমি মঙ্গল লাভ করো। তুমি যে কার্যসাধন করতে যাচ্ছো, সে কাজ মহাবলীর; অতএব তুমি জয়লাভের জন্য নির্বিঘ্নে প্রস্থান করো। ধাতা ও বিধাতাকে নমস্কার করি, তোমার মঙ্গল হবে। তুমি প্রবাসে যাত্রা করো, হ্রী, শ্রী, কীর্তি, দ্যুতি, উত্তমা, পুষ্টি, লক্ষ্মী ও সরস্বতী তোমাকে যাত্রা পথে রক্ষা করবেন। তুমি জ্যেষ্ঠের অর্চনা করো, তাঁর আজ্ঞার প্রতিপালন করো, অতএব আমি তোমার শান্তির জন্য বসু, রুদ্র, আদিত্য, মরুৎগণ, বিশ্বদেব ও সাধ্যগণকে আরাধনা করবো। খচর[iii], পার্থিব, দিব্য এবং অন্যান্য বিঘ্নকারী ভূতগণ তোমার মঙ্গল বিধান করুন”।

দ্রৌপদীর বিদায়ী আশীর্বাদের পর, মহাবীর পার্থ ভ্রাতৃগণ ও পুরোহিত ধৌম্য মহাশয়কে প্রদক্ষিণ করে, শরাসন হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ভূতগণ ইন্দ্রের লক্ষণ যুক্ত প্রবল পরাক্রান্ত তেজঃপুঞ্জকলেবর অর্জুনের গমন পথে বিঘ্ন সাধনে নিবৃত্ত হল। 

 

দেবরাজ ইন্দ্রের সহায়তা

তপস্বী নিষেবিত[iv] বহু অচল অতিক্রম করে একদিন মহাবীর অর্জুন দেবগণ পরিবৃত দিব্য হিমাচলে উপনীত হলেন। সেখানে হিমালয় ও গন্ধমাদন পর্বত পার হয়ে অতি দ্রুত অহোরাত্র অতন্দ্রিত[v] হয়ে দুর্গম স্থান সকল অতিক্রম করে, পরিশেষে ইন্দ্রনীল পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে অকস্মাৎ অন্তরীক্ষ থেকে “তিষ্ঠ”[vi] – এই বাক্য শুনে তিনি থামলেন, এবং ইতস্ততঃ দেখতে লাগলেন। দেখলেন, একটি বৃক্ষতলে, ব্রাহ্মশ্রীসম্পন্ন সুদীর্ঘ জটাধারী এক তপস্বী বসে আছেন।

সেই তপস্বী অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বৎস, ক্ষত্রিয় ব্রতধারী হয়ে, ধনু, বর্ম ও শর হাতে, কটিতটে অসিকোষ বেঁধে এই স্থানে উপস্থিত হলে, তুমি কে? এই স্থান শান্তপ্রকৃতি, বিনীতক্রোধ তপস্বী ব্রাহ্মণদের আশ্রম, এখানে সংগ্রামের কোন সম্ভাবনাই নেই, অতএব শস্ত্রেরও কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং এখনই তোমার ওই শরাসন দূরে নিক্ষেপ করো, তুমি পরমা গতি লাভ করেছো!” অসামান্য ওজঃ ও তেজঃ সম্পন্ন সেই ব্রাহ্মণ সহাস্য আস্যে এইকথা বারবার বললেও দৃঢ়ব্রত অর্জুনকে কোনভাবেই ধৈর্যচ্যুত করতে পারলেন না।

সেই ব্রাহ্মণ তখন প্রসন্নমুখে বললেন, “হে বৎস, আমিই দেবরাজ ইন্দ্র। তুমি অভীষ্ট বর প্রার্থনা করো”।

মহাবীর অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রণাম করে বললেন, “ভগবন্‌, আমি আপনার কাছেই অস্ত্র শিক্ষালাভের অভিলাষ নিয়ে এসেছি, আপনি কৃপা করে আমাকে এই বর দিন”।

দেবরাজ ইন্দ্র প্রীতমনে সহাস্যবদনে বললেন, “বৎস, তুমি এই স্থানে এসেছো, তোমার অস্ত্র-শস্ত্রের আর প্রয়োজন কী? এখন অভীষ্ট লোকলাভে যত্ন করো। তুমি পরম গতি লাভ করেছো!”

ধনঞ্জয় বললেন, “ভগবন্‌, আমি লোভ, কাম, দেবত্ব ও সুখলাভের প্রত্যাশা করি না, দেবতাদের ঐশ্বর্যকেও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর মনে করি। আমি ভ্রাতৃগণকে অরণ্যে ত্যাগ করে, বৈরনির্যাতনের সঙ্কল্পে এসেছি, এর অন্যথা হলে ত্রিলোকে চিরকাল আমার অপযশ রটনা হবে”!

দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “হে তাত, তুমি যখন ত্রিশূলধারী ভূতনাথ শঙ্করের দর্শন পাবে, আমি সেই সময় তোমাকে আমার সকল দিব্যাস্ত্র প্রদান করবো। অতএব তাঁর সাক্ষাৎলাভের জন্য সর্বতোভাবে যত্ন করো। তাঁর সন্দর্শন হলেই, তোমার সকল অভীষ্ট পূরণ হবে”। এই কথা বলে দেবরাজ ইন্দ্র সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।  

 

কিরাতবেশী মহাদেবের সাক্ষাৎ

ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতির সন্দর্শন সংকল্পে একনিষ্ঠ ধনঞ্জয়, সেই মহাগিরি হিমাচলের নিকটবর্তী দুর্গম অরণ্যানী পার হয়ে গিরিপৃষ্ঠে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে পুষ্পভারে অবনত বৃক্ষের উপরে নানান পাখি সুমধুর সুরে গান করছে। চারিদিকে বিপুল আবর্ত[vii]বতী নদী শোভা পাচ্ছে। ওই নিম্নগা[viii]সকলের জল অতি পবিত্র, সুশীতল ও নির্মল। নদীর দুইপাশে মনোহর বনরাজি বিরাজমান এবং হংস, কারণ্ডব[ix], সারস, ক্রৌঞ্চ, পুংস্কোকিল, ময়ুর প্রভৃতি পাখির কলতানে মুখর। মহামনা অর্জুন এই দৃশ্য দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন।

তিনি সেই পরম রমণীয় বনদেশে দর্ভ[x]ময় বাস পরিধান করে, দণ্ড ও অজিনে শরীর মণ্ডিত করে ভূতলে বিশীর্ণ পত্রমাত্র শয্যা করে বাস করতে শুরু করলেনতিনি প্রথম মাসে ত্রিরাত্রি অন্তর, দ্বিতীয় মাসে ষড়রাত্রি অন্তর এবং তৃতীয় মাসে পক্ষকাল অন্তর ফলমাত্র ভক্ষণ করে, কঠোর তপশ্চর্যায় ব্রতী হলেন। চতুর্থমাস থেকে বায়ুমাত্র ভক্ষণ করে, ঊর্ধবাহু এবং পদাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ মাত্রে মেদিনী স্পর্শ করে তপস্যা শুরু করলেন। সতত অবগাহন করায়, তাঁর মাথার জটাকলাপ পিঙ্গলবর্ণ হয়ে উঠল।

সেই অরণ্যের অধিবাসী মহর্ষিগণ, তপস্বী অর্জুনের এই সাধনা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন। তাঁরা একত্র মিলিতভাবে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে উপস্থিত হলেন এবং প্রণাম করে বললেন, “হে দেবেশ্বর, মহাতেজা অর্জুন হিমাচল পর্বতে ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করেছেন, তাঁর তপস্যার প্রভাবে চতুর্দিক এবং আমরাও সন্তাপিত হচ্ছি! তাঁর কী অভিপ্রায় আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি, অতএব আপনি তাঁকে নিবৃত্ত করুন”।

সর্বভূতপতি মহর্ষিদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “হে তপোধনগণ, তোমরা অর্জুনের কারণে বিষণ্ণ হয়ো না, তোমরা নিজ নিজ আশ্রমে ফিরে যাও। আমি ধর্মাত্মা অর্জুনের অভিপ্রায় বুঝেছি, স্বর্গ, আয়ু অথবা ঐশ্বর্যে তার কোন আকাঙ্ক্ষা নেই।  তার যা অভিলাষ, আমি অচিরেই তা পূর্ণ করবো।” দেবাদিদেব ভবের আশ্বাসবাক্যে মহর্ষিগণ নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজ নিজ নিকেতনে ফিরে গেলেন।

 

মহর্ষিদের বিদায়ের পর ভগবান পশুপতি কিরাতবেশ ধারণ করলে, তিনি কাঞ্চনদ্রুম ও দ্বিতীয় সুমেরু পর্বতের মতো শোভাময় হলেন। তিনি হাতে নিলেন পিনাক, শরাসন ও আশীবিষের মতো শরসমূহ। তিনি কিরাতীর ছদ্মবেশে স্বীয় পত্নী উমাদেবীকেও সঙ্গে নিয়ে অর্জুনের তপোবনের দিকে যাত্রা করলেন।  তাঁদের সঙ্গে চললেন অজস্র অঙ্গনা ও অঙ্গনগণ।

কিরাতরূপী ভগবান ভবানীপতি ক্রমে ক্রমে তপস্যারত পার্থের কাছে এসে লক্ষ্য করলেন, মূক নামে এক অদ্ভূতদর্শন দানব, বরাহ রূপ ধারণ করে অর্জুনকে আক্রমণ করে সংহার করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সেই দেখে অর্জুন  গাণ্ডীব ধনুতে শর স্থাপন করে, জ্যাতে টংকার দিয়ে বললেন, “অরে দুরাত্মন, আমি তো তোর কোন অপকার করিনি, তথাপি তুই আমাকে সংহার করতে উদ্যত হয়েছিস! অতএব আমিই তোকে আগে যমালয়ে পাঠাচ্ছি।”

এইসময় কিরাতবেশী ভগবান শঙ্কর, অর্জুনকে বরাহের উপর শর নিক্ষেপে উদ্যত দেখে, তাঁকে নিবারণের জন্য বললেন, “হে তাপস, আমিই আগে এই ইন্দ্রনীল পর্বত সদৃশ বরাহকে দেখতে পেয়েছি।” অর্জুন তাঁর কথায় অবহেলা করে বরাহের উপর শর নিক্ষেপ করলেন; কিরাতবেশী শংকরও তৎক্ষণাৎ ওই বরাহের উপর বজ্রতুল্য এক বাণ নিক্ষেপ করলেন। নিক্ষিপ্ত উভয় শর একইসময়ে সেই বরাহের গায়ে বিদ্ধ হল। তারপর উভয়ের অন্যান্য আরও অনেক নিক্ষিপ্ত শরে বিদ্ধ হয়ে, বরাহ শয্যাশায়ী হল এবং মৃত্যুর আগে ভয়ঙ্কর রাক্ষসরূপ ধারণ করে প্রাণত্যাগ করল।

অতঃপর স্ত্রীগণপরিবৃত কিরাতবেশী মহাদেবকে দেখে অর্জুন প্রসন্ন মুখে হাস্য করে বললেন, “হে কনকপ্রভ পুরুষ, তুমি কে? এই ঘোরতর নির্জন অরণ্যে তুমি স্ত্রীগণের সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়েছ? তোমার কি কিছুমাত্র ভয় করছে না? তুমি কিসের জন্য আমার পূর্বলক্ষিত পশুকে শর নিক্ষেপ করলে? ওই বরাহ কী কারণে জানি না, আমাকে সংহারের জন্যেই এসেছিল, আমি ওকে আগেই দেখেছিলাম; তার প্রতি শর নিক্ষেপ করে তুমি মৃগয়াধর্মের বিরুদ্ধ আচরণ করেছ! অতএব এখন আমিই তোমার প্রাণ সংহার করবো।”

কিরাতবেশী ভগবান শংকর, সব্যসাচী ধনঞ্জয়ের এই কথা শুনে শান্ত স্বরে বললেন, “হে বীর, আমার জন্য তুমি ভীত হয়ো না। এই বনের নিকটস্থ ভূমিতেই আমার আবাসস্থান। আমরা সতত এই বহুসত্ত্বযুক্ত বনে ভ্রমণ করি। তুমি অগ্নিতুল্য তেজস্বী, সুকুমার ও সুখের যোগ্য হয়েও, কিসের জন্য এই দুষ্কর জনশূণ্য অরণ্যে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছো?”

অর্জুন বললেন, “আমি গাণ্ডীব ধনু ও অগ্নিসম অস্ত্রসমূহ নিয়ে দ্বিতীয় কার্তিকেয়র মতো এই অরণ্যে বাস করছি। ওই মহারাক্ষস বরাহরূপ ধরে আমাকে সংহার করতে এসেছিল, এখন আমিই তার প্রাণ সংহার করলাম”।

কিরাত বললেন, “হে তাপস, আমিই ওই পশুকে আগে লক্ষ্য করেছিলাম এবং আগে আমার নিক্ষিপ্ত শরসমূহেই ওই পশুর মৃত্যু হয়েছে! হে মন্দাত্মন, নিজ শক্তিতে অহংকারী হয়ে, নিজের দোষ অপরের উপর আরোপ করা কখনই উচিৎ নয়। তুমি অত্যন্ত দাম্ভিক, অতএব আমিই তোমাকে আজ যমসদনে পাঠাবো। দাঁড়াও, আমি তোমার উপর বাণ নিক্ষেপ করছি, তুমিও নিজের সাধ্য অনুযায়ী আমার প্রতি শরনিক্ষেপে ত্রুটি করো না।” মহাবীর অর্জুন কিরাতের এই কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর উপর শর নিক্ষেপ করলেন।

কিরাত সহাস্যে সেই শরসমুদয় সহ্য করে বললেন, “ওরে মন্দমতে, আরো বাণ নিক্ষেপ কর, তোর কাছে নারাচ[xi] প্রভৃতি আরও যে সব মর্মবিদারক অস্ত্র আছে, সব নিক্ষেপ কর”। কিরাতের কথা শুনে ক্রুদ্ধ অর্জুন শরবৃষ্টি করতে শুরু করলেন, কিন্তু কিরাতরূপী ভগবান শংকর সে সব অস্ত্রই অনায়াসে সহ্য করলেন। ভগবান পিনাকপাণি অর্জুনের নিক্ষিপ্ত সমুদয় শর সহ্য করে, অক্ষত শরীরে পর্বতের মতো অবিচল দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্জুন নিজের বাণবর্ষণ ব্যর্থ হতে দেখে, অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং “সাধু, সাধু” বলে, কিরাতকে ধন্যবাদ দিতে দিতে চিন্তা করলেন, ‘ইনি কে? ইনি দেবাদিদেব রুদ্র বা অন্য কোন দেবতা, অথবা যক্ষ কিংবা কোন রাক্ষস হবেন! শুনেছি, গিরিশ্রেষ্ঠ হিমালয়ে দেবতাদের সমাগম আছে। ভূতনাথ পিনাকপাণি ছাড়া আমার শরনিকর সহ্য করার ক্ষমতা আর কারও নেই! যদি ইনি মহাদেব ছাড়া অন্য কোন দেবতা বা যক্ষ হন, তীক্ষ্ণ শরপ্রহারে আমি তাঁকে শমনসদনে পাঠাবোই!’

মহাবীর অর্জুন নতুন উদ্যমে সূর্য্যকিরণের মতো মর্মভেদী শত শত নারাচ সকল নিক্ষেপ করতে লাগলেন। কিন্তু পর্বত যেমন শিলাবর্ষণ অনায়াসে সহ্য করে, ছদ্মবেশী শূলপাণিও সেই সকল নারাচ সহ্য করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্জুনের সকল বাণ যখন নিঃশেষ হয়ে গেল, মহাবীর অর্জুন ভীত হলেন। খাণ্ডববন দহনের সময় যিনি বীর অর্জুনকে এ দুই অক্ষয় তূণীর দান করেছিলেন, সেই অগ্নিদেবকে স্মরণ করে, তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন ‘আমার সকল বাণ নিঃশেষ হয়ে গেছে, এখন কী নিক্ষেপ করি? আর এই পুরুষই বা কে? আমার সকল বাণ গ্রাস করে ফেলল? শূলাগ্র দিয়ে যেমন হস্তীকে সংহার করা চলে, তেমনি শরাসনের অগ্রভাগ দিয়েই একে যমালয়ে পাঠাব’।

এই কথা চিন্তা করে মহাবলী অর্জুন কিরাতকে শরাসন দিয়ে আকর্ষণ করে, জ্যা দিয়ে বেঁধে, তাঁকে বজ্রের মতো মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন। কিন্তু কিরাতবেশী মহাদেব অর্জুনের হাত থেকে তৎক্ষণাৎ শরাসন কেড়ে নিলেন! ধনুক কিরাতের হস্তগত হল দেখে অর্জুন মহা ক্রোধে কিরাতের মাথা লক্ষ্য করে খড়্গ ছুঁড়লেন, কিন্তু সেই ভয়ংকার খড্গও কিরাতের মাথায় লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল! এরপর অর্জুন বড়ো বড়ো শিলা ও বৃক্ষসকল নিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন, কিন্তু কিরাতরূপী ভূতনাথ সে আঘাতও নির্বিকার চিত্তে সহ্য করে নিলেন। এরপর নিরস্ত্র পার্থ কিরাতের গায়ে মুষ্টি প্রহার শুরু করায়, কিরাতরূপী শঙ্করও অর্জুনকে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন।

এইভাবে মহাবীর পার্থ ও কিরাতের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মহা পরাক্রমশালী বীর কৌন্তেয় কিরাতের বক্ষে প্রবল আঘাত করলে, কিরাতও পার্খর বক্ষে ঘোরতর আঘাত করলেন। তখন সেই মহাপরাক্রমশালী দুই বীর বাহু নিষ্পেষণ ও বক্ষ সংঘর্ষণে মহামল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধের পর কিরাতবেশী মহাদেব তাঁর গাত্র নিষ্পেষণ করায়, অর্জুনের চিত্ত বিক্ষুব্ধ হল এবং অঙ্গসকল নিরুদ্ধ হয়ে, হৃতশক্তি জড়ের মতো ভূতলে পড়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে অর্জুন চৈতন্যলাভ করে, রুধিরাক্ত কলেবরে, দুঃখিত চিত্তে মাটির স্থণ্ডিল[xii] রচনা করে, পুষ্প মাল্য দিয়ে শরণ্য ভগবান পিনাকীর অর্চনা করলেন। পূজাবসানে কিরাতের মস্তকে সেই পুষ্পমাল্য দেখে, তিনি বিস্মিত হলেন এবং তাঁর চিত্তে জ্ঞানের উদয় হল। তিনি তৎক্ষণাৎ কিরাতরূপী ভগবানের দুই চরণে আশ্রয় নিলেন।

 

 

প্রসন্ন মহাদেবের পাশুপত অস্ত্র দান

দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্নমুখে, তপস্যায় ক্ষীণতনু অর্জুনকে বললেন, “হে ফাল্গুন, আমি তোমার এই অলোকসামান্য কর্ম ও সাহস দেখে পরম পরিতুষ্ট হয়েছি। তোমার মতো শৌর্যশালী ও ধৃতিমান ক্ষত্রিয় আর কেউ নেই। তোমার ও আমার তেজ ও বীর্য আজ সমান বোধ হল। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি। হে বিশালাক্ষ, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু দান করছি, তুমি আমাকে অবলোকন করো। তুমি পুরাতন ঋষি! দেবগণ তোমার শত্রু হলেও, তুমি অনায়াসে সংগ্রামে তাদের পরাজিত করতে পারবে।  আমি প্রীতি-প্রফুল্ল চিত্তে তোমাকে অনিবারণীয় অস্ত্র দান করলাম, একমাত্র তুমিই সেই অস্ত্র ধারণে সমর্থ হবে”

দিব্যচক্ষু লাভের পর উমাদেবীর সঙ্গে শূলপাণি মহাদেবকে প্রত্যক্ষ করে পুরঞ্জয় পার্থ নতজানু হয়ে তাঁদের প্রণাম করার পর, তাঁদের স্তুতি করে বললেন, “হে কপর্দ্দিন, হে সর্বদেবেশ। হে ভগনেত্র-নিপাতন, হে দেবদেব মহাদেব। হে নীলকণ্ঠ, জটাধর। হে ত্রিনেত্র, হে ত্র্যম্বক, আপনিই সকল কারণের শ্রেষ্ঠ, আপনিই দেবতাদের গতি, সমস্ত জগৎ আপনার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এই ত্রিলোকের মধ্যে, কি দেব, কি অসুর, কি মানব আপনার জেতা কেউই নেই। হে বিষ্ণুরূপ শিব, হে শিবরূপ বিষ্ণো, হে দক্ষযজ্ঞ বিনাশন, হে হরিরুদ্র, আপনাকে নমস্কার। হে ললাটাক্ষ, হে সর্ব, হে বর্ষক, হে শূলপাণে, হে পিনাকধারিন, হে সূর্য, হে মার্জ্জালীয়[xiii], হে বেধঃ, হে ভগবান, হে সর্বভূতমহেশ্বর, আমি আপনাকে প্রসন্ন করছি। হে শঙ্কর, আপনি আমার অপরাধ মার্জনা করুন। হে দেবেশ, আমি আপনার দর্শনের অভিলাষী হয়েই দয়িত তাপসগণের আশ্রয় এই মহাপর্বতে এসেছি। হে ভগবন, আপনি সর্বদেবনমস্কৃত, আমি অসমসাহসিক কর্ম করে আপনার নিকট অপরাধ করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। হে উমাবল্লভ, আমি না জেনে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার স্পর্ধা করেছিলাম, এখন আমি আপনার শরণাপন্ন, আমার সেই অপরাধ ক্ষমা করুন”।

মহাতেজাঃ ভগবান ভূতভাবন ভবানীপতি সহাস্যবদনে অর্জুনের বাহু ধারণ করে বললেন, “ক্ষমা করলাম”, তারপর অর্জুনকে আলিঙ্গন করে বললেন, “হে ধনঞ্জয়, তুমি পূর্বজন্মে নর নামের মহাপুরুষ ছিলে এবং নারায়ণের সঙ্গে অনেক অযুত বর্ষ তপস্যা করেছিলে। তুমি ও পুরুষোত্তম বিষ্ণু, এই উভয় ব্যক্তিতেই পরম তেজ সন্নিবেশিত হয়েছে, তোমরাই এই জগতের ভার বহন করছো। হে প্রভো, তুমি ইন্দ্রের অভিষেক সময়ে জলদের মতো গম্ভীরগর্জনশালী মহাশরাসন গ্রহণ করে, নারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে দানবদের বিনাশ করেছিলে। এই তোমার সেই গাণ্ডীব ধনু, যা আমি মায়াবলে গ্রহণ করেছিলাম। হে কুরুনন্দন, তোমার তূণীরদুটি পুনরায় অক্ষয় হবে। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি, তুমি নিঃসন্দেহে যথার্থ পরাক্রমশালী, এখন তুমি অভিলষিত বর প্রার্থনা করো। হে অরাতিনিসূদন, এই মর্তলোকে তোমার সদৃশ পুরুষ আর কেউ নেই, স্বর্গেও তোমার থেকে প্রধান ক্ষত্রিয় আর কাউকে দেখছি না।”

অর্জুন বললেন, “হে ভগবান, অনুগ্রহ করে আমাকে বরদান করার অভিলাষ যখন করেছেন, তখন প্রসন্ন হয়ে আমাকে সেই ব্রহ্মশির নামক ঘোরতর দর্শন পাশুপত অস্ত্র দান করুন, যে ভীমপরাক্রম অস্ত্র যুগান্ত সময়ে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে একবারে বিনাশ করে থাকে। আমি ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়ে আপনার যে অস্ত্র দিয়ে কর্ণ, ভীষ্ম, কৃপ ও দ্রোণকে সংহার করবো; যে অস্ত্র দিয়ে আমি দানব, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব ও পন্নগদেরকে সংগ্রামে দগ্ধ করবো। হে ভগবন্‌, এই আমার প্রথম অভিলাষ, আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে এই বিষয়ে সফল ও সমর্থ করুন।”

[মহাবীর অর্জুন সদ্ধর্ম অনুসারে তাঁর অস্ত্র সংগ্রহের কারণ ভগবান শঙ্করকে স্পষ্ট করেই বললেন, কিন্তু ভগবান ভবানীপতি অর্জুনের নিজ হাতে কর্ণ, ভীষ্ম, কৃপ, দ্রোণের সংহারের সঙ্কল্পের কথা শুনেও এতটুকু বিচলিত বা বিরূপ হলেন না! এর থেকে বড়ো নৈতিক সমর্থন আর কী হতে পারে?]

ভগবান মহাদেব বললেন, “হে পার্থ, আমি তোমাকে সেই পরমপ্রিয় পাশুপতাস্ত্র প্রদান করছি। তুমি এই অস্ত্র ধারণ, ব্যবহার ও প্রতিষেধ করতে সমর্থ হবে। মানুষের কথা দূরে থাক, ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ ও পবনও এই অস্ত্র ব্যবহারে অভিজ্ঞ নন। তুমি কিন্তু এই অস্ত্র কখনো দুর্বল পুরুষের উপর প্রয়োগ করো না, তাতে সমস্ত জগতের বিনাশ ঘটে যাবে। এই চরাচরে এই অস্ত্রের অবধ্য কেউ নেই! মন, চক্ষু, বাক্য বা শরাসন দিয়ে এই অস্ত্র প্রয়োগ করলে অবশ্যই তেজস্বী শত্রুকুল নির্মূল হয়ে যায়”।

মহাবীর ধনঞ্জয়, ভগবান মহাদেবের কথা শুনে, পবিত্র মনে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “হে বিশ্বেশ, আপনি অনুগ্রহ করে, আমকে ওই অস্ত্রের বিষয়ে শিক্ষা দিন”। দেবাদিদেব মহাদেব ত্যাগ ও সংহারের মন্ত্রসহ সেই মূর্তিমান মৃত্যুসম অস্ত্র অর্জুনকে প্রদান করলেন। সেই অদ্ভূত অস্ত্র ত্র্যম্বক উমাপতির মতোই, অর্জুনকেও ভজনা করল, অর্জুনও প্রীতিপ্রসন্ন মনে সেই অস্ত্র গ্রহণ করলেন।

এইভাবে অর্জুন অস্ত্র গ্রহণ করা মাত্র, পর্বত, কানন, সাগর, আকর, নগর ও গ্রাম সহ সমস্ত মেদিনী কেঁপে উঠল। সহস্র সহস্র শঙ্খ, দুন্দুভি ও ভেরির আওয়াজ গর্জন করে উঠল। দেব ও দানবেরা দেখলেন, ওই মারাত্মক অস্ত্র অর্জুনের হস্তগত হয়েছে! দেবাদিদেব মহাদেব অমিত তেজবান অর্জুনের গাত্র স্পর্শ করা মাত্র, তাঁর শরীরের সকল অশুভ বিনষ্ট হয়ে গেল। তারপর ভগবান শূলপাণি অর্জুনকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি ও নির্দেশ দিলেন। মহাবীর পাণ্ডুনন্দন ভগবানকে প্রণাম করে, কৃতাঞ্জলি হয়ে, সপত্নীক ভগবানের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন। এরপর প্রসন্নচিত্ত ভবানীপতি ভগবান, তাঁর সামনেই উমাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে, গিরিবর হিমাচল ছেড়ে, আকাশমার্গে প্রস্থান করলেন।


...চলবে 



[i] গোধা – গোসাপ, গোসাপের চর্ম থেকে বানানো অঙ্গুলিত্র।

[ii] স্বর্ণমুদ্রা।

[iii] আকাশ-চর

[iv] সেবিত, আরাধিত

[v] নিরলস, আলস্যহীন

[vi] থামো।

[vii] ঘূর্ণিময়, স্রোতোস্বিনী।

[viii] নিম্নগামী, নদী, নদীর স্রোত সর্বদাই নিচের দিকে প্রবাহিত হয়।

[ix]  বালিহাঁস

[x] তৃণ, কুশ।

[xi] লৌহমুখ বাণ।

[xii] যজ্ঞবেদী।

[xiii] কিরাত, শুদ্ধদেহ, নীলকণ্ঠ


শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

এখনও মারীচ

 

গেটের বাইরে থেকে একটি মেয়ে খুব কুণ্ঠিত স্বরে ডাকল, “স্যার, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল, ভেতরে আসতে পারি?”  

মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ির ছোট্ট বাগানে একটু ঘোরাঘুরি করা ডাক্তার অমিয় সান্যালের বহুদিনের অভ্যেস। এ সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বন্ধুরাও তাঁকে বিরক্ত করে না। সকালের এই স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর বাগানে ফুটে থাকা উজ্জ্বল ফুলগুলির সঙ্গ তাঁর মনে অত্যন্ত শান্তির অনুভূতি এনে দেয়। কোন উটকো লোকের উপস্থিতি সেই শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাক – সেটা তিনি পছন্দ করেন না। বিরক্ত হন খুব।

ডাক্তারবাবু বিরক্ত হয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন গেটের দিকে, বিরক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার?”

“কিছু কথা ছিল স্যার, যদি একটু সময় দেন কাইণ্ডলি। বেশি সময় নেব না, – দশ-পনের মিনিট”।

ওঁদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে হেমন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। হেমন্ত ডাক্তারবাবুর পরিচারক - সর্বক্ষণের সঙ্গী। সাধক সঙ্গীতজ্ঞদের যেমন দু একজন অপরিহার্য সঙ্গতদার থাকে – হেমন্তও তাই। বারান্দায় উঠে বেতের  চেয়ারে বসতে বসতে ডাক্তারবাবু হেমন্তকে বললেন, “ভেতরে আসতে বল”। হেমন্ত মেয়েটিকে ডেকে ভেতরে চলে গেল নিজের কাজে।  

 শান্ত ও ধীর পায়ে মেয়েটি এল। হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গী করল। ডাক্তারবাবু মুখ তুলে তাকালেন – সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন। মেয়েটি বসল। মেয়েটির পরনে সস্তা চটকদার রঙের শাড়ি। পায়ে গোলাপি রঙের বাহারি প্লাস্টিকের স্যণ্ডেল। শাড়ির আঁচলে পুরো শরীর ঢেকে মেয়েটি চেয়ারে বসেছে আলগোছে - খুব সংকোচ নিয়ে। তবুও উগ্র এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনের আভাস পেলেন মেয়েটির শরীরী ভাষায়। ডাক্তারবাবু বললেন, “কী বলবেন বলুন”

“আমি মিতালি। কলকাতার একটি পতিতা পল্লীতে আমার বাস। আমাদের মতো মেয়েদের আপনার কাছে আসার দুঃসাহস কখনো হয়নি, হবেও না। কিন্তু বাধ্য হয়েই...”

ডাক্তারবাবু কোন উত্তর দিলেন না, তাকিয়ে রইলেন মিতালির মুখের দিকে।

মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল মিতালি, তারপর বলল, “তিন চারজন এনজিও দিদি আসেন আমাদের পাড়ায়, নিয়মিত। আমাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করেন খুব। তাঁদের মুখেই আপনার নাম শুনেছি”। মিতালি আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মুখ তুলে বলল, “আপনি নাকি বেশ কয়েক বছর ধরে মেয়েদের শরীরে অদ্ভূত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন! তাতে নাকি...”  

                

ডাক্তার অমিয় হাত তুলে মিতালিকে থামালেন, বললেন, “তোমাদের পেশার কোন মেয়ের সঙ্গে আমার কোনদিন সেভাবে পরিচয় হয়নি, মা। কিংবা হয়তো কখনো হয়েছে, পেশেন্ট হিসেবে, বুঝতে পারিনি। নিজের সত্যি পরিচয় দিয়ে তুমি যে কথা জানতে এসেছ, সে কথা তোমাদের জানা একান্ত জরুরি। কাজেই সব কথাই তোমাকে বলব, মন দিয়ে শোনো।       

বিগত বছর তিরিশ বা হয়তো তারও কিছু বছর আগে থেকে – জাতিকাদের শরীরে আশ্চর্য এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তনটি প্রথম ধরা পড়ে মুর্শিদাবাদ সদর হাসপাতালে। সেখানে একটি ছবছরের বালিকাকে রাতের অন্ধকারে কেউ বা কারা ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল। পরদিন সকালে সেই বালিকার দেহ উদ্ধার হলেও অপরাধীদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করেছিল এবং স্থানীয় নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, অপরাধী অচিরেই ধরা পড়বে, আইন আইনের পথেই চলবে। আইনের হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।  

এদিকে ওই দিন দুপুরের দিকে হাসপাতালে জনৈক মধ্যবয়সী পুরুষকে তার বাড়ির লোক গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসে। আচ্ছন্ন অবস্থায় আনা ভদ্রলোকের অসুস্থতার প্রধান লক্ষণ ছিল তীব্র শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিয়মিত হার্টবিট। অ্যাডমিশনের সঙ্গে সঙ্গেই অক্সিজেন এবং স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্লাড টেস্টের ব্যবস্থা হল, ইসিজির ব্যবস্থাও করা হল। তারপর থরো চেকআপ করতে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোকের দু হাতে এবং কোমর থেকে নিম্নাঙ্গে – দুই পায়ে, উরুতে এবং বিশেষ করে দুদিকেরই ইনগুইনাল রিজিয়নে সিভিয়ার ইনফ্লামেশন রয়েছে। ইনগুইনাল রিজিয়ন হল বাংলায় যাকে আমরা উরুসন্ধি বা কুঁচকি বলি। আর ইনফ্লামেশন মানে প্রদাহ, তার মানে কী বলব - গভীর লাল রঙের দাগড়া-দাগড়া হয়ে সামান্য ফুলে উঠেছে জায়গাগুলো। আমাদের চামড়ায় পোকা-টোকার কামড়ে বা বিষাক্ত রস লেগে গেলে, যেমন হয় আর কি!

তখন আমার বয়েস বিয়াল্লিশ। ততদিনে আমার প্রায় সতের বছরের ওপর প্র্যাকটিসিং এক্সপিরিয়েন্স হয়ে গেছে – কিন্তু এরকম অ্যাকিউট ইনফ্লামেশন আগে কোনদিন দেখিনি। তারপরে আরো দেখলাম, লোকটির বুকে কাঁধে বেশ কিছু নখের আঁচড়ের ক্ষত – সেই ক্ষতগুলো ঘিরেও একই ধরনের ইনফ্লামেশন!

যাই হোক আমাদের মেডিক্যাল বিদ্যে-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা দিয়ে যথাসাধ্য চিকিৎসা শুরু করলাম – কিন্তু লোকটির কণ্ডিশন খারাপ হতে লাগল দ্রুত – রাত্রে যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। শেষ অব্দি রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ লোকটি হার্ট ফেল করল – মারা গেল। পরিবারের লোকজনকে মৃত্যু সংবাদ দেওয়া মাত্র তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, আমাদের গাফিলতিতে তাদের পরমপূজ্য পিতৃদেবের মৃত্যু হয়েছে। দুজন জুনিয়ার ডাক্তার এবং একজন নার্সকে মারধর করল। আমার ভাগ্য ভালো – কেউ গায়ে হাত তোলেনি। তবে অশ্রাব্য গালাগালিতে আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিয়েছিল। ভাঙচুর করেছিল বেশ কিছু চেয়ার টেবিল – ছিঁড়েখুঁড়ে নষ্ট করে দিয়েছিল বেশ কিছু ফাইল। ওরা চলে যাওয়ার প্রায় আধঘন্টা পরে পুলিশ এসেছিল পরিস্থিতি সামাল দিতে।

পরের দিন সকালে দুটি দেহেরই পোস্টমর্টেম হল। আমাদের কাছে যা রিপোর্ট এল – ওই লোকটিই বালিকা অভয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল। লোকটি ছিল মেয়েটির প্রতিবেশী – অতি পরিচিত জ্যেঠুমণি...। তবে আমাদের কাছে রিপোর্ট যাই আসুক – পরে সে রিপোর্ট বদলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ ওই লোকটির রাজনৈতিক মহলে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এবং যেহেতু অসহায় অভয়া এবং তার ধর্ষক লোকটি দুজনেরই মৃত্যু হয়েছিল, অতএব এ নিয়ে আমরাও কোন উচ্চবাচ্য করে জলঘোলা করাটা সমীচীন মনে করিনি।

তবে আমাদের কাছে লোকটির ব্লাড স্যাম্পল ছিলছিল মেয়েটির রক্তের নমুনাও। মেয়েটির রক্তে অস্বাভাবিক কিছু না পাওয়া গেলেও, লোকটির রক্তে পাওয়া গেল যথেষ্ট পরিমাণের বিষ, এবং তীব্র মাত্রার সেই বিষের কারণেই যে তার মৃত্যু হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গোটা বিষয়টিই তখন গোপন রাখা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে যে কয়েকজন জানতাম, অবাক হয়েছিলাম - লোকটির শরীরে এত পরিমাণে বিষ এল কোথা থেকে? তার ভিসেরার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কিন্তু কোন বিষের উল্লেখ ছিল না। তার মানে খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে  নয়, এ বিষ তার শরীরে ঢুকেছে সরাসরি রক্তে। বিষধর সাপের ছোবল থেকে আমাদের শরীরে যেভাবে বিষ রক্তে মেশে – হয়তো সেইভাবে। কিন্তু লোকটির কাঁধে ও পিঠে কিছু নখের আঁচড় ছিল। কিন্তু লোকটির নিম্নাঙ্গে সে ধরনের কোন ক্ষত চিহ্ন ছিল না। অথচ লোকটির অ্যাকিউট ইনফ্লামেশন ছিল  দুই উরু এবং উরুসন্ধিতে। কেন? কী করে হল? ঠিক বোঝা গেল না। ব্লাড-স্যাম্পল থেকে যে বিষ পাওয়া গেল, তার অ্যানালিসিস করে দেখা গেল – এ ধরনের বিষ এর আগে কখনও দেখা যায়নি।

অতএব একটা প্রশ্ন রয়েই গেল, এই বিশেষ ধরনের বিষটি লোকটির শরীরে কোথা থেকে এল?  

আমরা অন্যান্য হাসপাতালের আরএমও এবং সুপারদেরকে এই বিষয়টি গোপনে কিন্তু সবিস্তারে জানালাম। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করেননি, বরং আমাদের বিদ্রূপ করেছিল, বলেছিল আমাদের মাথা থেকে এসব উদ্ভট আইডিয়া মুছে ফেলতে।

এই ঘটনার কিছু দিন পরেই মেদিনীপুর হাসপাতাল থেকে বারো বছরের এক কিশোরী অভয়ার শ্লীলতাহানির সংবাদ এল। অপরাধী পুরুষটির বয়স ছিল বত্রিশ। মেয়েটিকে সে একটি নির্জন বাড়িতে নিয়ে যায় এবং জোর করে তাকে বিবস্ত্র করার পর, ঘটনাস্থলেই লোকটি অজ্ঞান হয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে মেয়েটি সেখান থেকে বাড়িতে পালিয়ে আসে। মেয়েটিকে নিয়ে তার পরিবারের লোক প্রথমে থানায় যায় এবং পরে মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি হয়। মেয়েটির বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধীকে যখন গ্রেপ্তার করে, লোকটির তখনও জ্ঞান ফেরেনি। অতএব তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ই ক্ষেত্রেও অপরাধী যুবকটির হাতে, পায়ে, গালে, গলায় একই ধরনের ইনফ্লামেশন – লোকটির সেরে উঠতে সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিনমাস। বিচারে লোকটির পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।

আমাদের দেশে ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির ঘটনা যেহেতু সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, অতএব এর পরেও বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে একই ধরনের ঘটনার প্রচুর সংবাদ আসতে লাগল। সৌভাগ্যক্রমে ভিকটিম কন্যাদের কেউই ধর্ষিত হয়নি – তার কারণ অপরাধীদের বিবেকবোধ নয়। তার কারণ অপরাধীরা তীব্র বিষক্রিয়ায় ঘায়েল হয়ে মেয়েগুলিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

যাই হোক আমার এই কৌতূহল এবং সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টা আমার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষদের পছন্দ হয়নি। সে কারণে আমার ওপর বাড়তে থাকে প্রশাসনিক চাপ এবং কর্মস্থলে কিছু সহকর্মীদের চরম অসহযোগিতা। যারা প্রশাসনের খুব কাছের লোক এবং আমড়াগাছি করে নানান সুযোগ সুবিধা উপভোগ করে”।

“আশ্চর্য! আপনি তো কোন অন্যায় করেননি। একটা অদ্ভূত অসুখের রহস্য খুঁজে বের করতে চাইছিলেন। তাতে ওদের আপত্তি কিসের?”

“কোন অন্যায় না করাটাই যে আজকের যুগে সবচেয়ে বড়ো অন্যায়, জানো না? সে যাগ্‌গে, আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে এলাম – একটি প্রাইভেট হাসপাতালে যোগ দিলাম – তার সঙ্গে ব্যক্তিগত চেম্বারে প্র্যাকটিস শুরু করলাম। প্রাইভেট হাসপাতালে সাধারণতঃ ধর্ষণের কেস নিয়ে কেউ আসে না, কাজেই এই বিষয়টা নিয়ে আরো গবেষণা করার কোন উপায় আমার রইল না।  

কিন্তু কলকাতায় স্থিতু হওয়ার কয়েক মাস পরে – একদিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আমার চেম্বারে এক দম্পতি এলেন। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়েই আমি চমকে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম তাঁর দু হাতের দিকেও এবং নিশ্চিত হলাম – আমার অনুমান সঠিক। ভদ্রলোক কি কোন মেয়ে বা মহিলার সঙ্গে জোরজবরদস্তি করতে গিয়েছিলেন?

কৌতূহল নিয়ে আমি আলাপ শুরু করলাম, চিকিৎসার ব্যাপারে নয়, ওঁর পারিবারিক অবস্থা জানার জন্য। ভদ্রলোক ও মহিলা দুজনেই ভালো চাকরি করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে নামী স্কুলে লেখাপড়া করে – অর্থাৎ উচ্চবিত্ত সুখী পরিবার।

ভদ্রলোকের চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসতে, আমি বললাম, ওঁনার চিকিৎসা এই চেম্বারে হওয়া সম্ভব নয়। ওঁনাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটা নাগাদ আমি যে প্রাইভেট হাসপাতালে বসি – সেখানে নিয়ে আসবেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভর্তি করে নেব। তবে আমার কিছু প্রশ্ন আছে, কোনরকম সঙ্কোচ না করে, নির্দ্বিধায় বলতে হবে – আমরা ছাড়া অন্য কেউ সে কথা জানবে না বা শুনবে না, কথা দিচ্ছি।

ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিক কখন থেকে এই উপসর্গ দেখা গিয়েছে? মহিলা বললেন, গতকাল মাঝরাতে।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মাঝরাতে? তখন আপনার স্বামী কোথায় ছিলেন?

কেন? বাড়িতে। আমাদের বেড রুমে! ডিনারের পর – ছেলেমেয়েরা তাদের ঘরে শুয়ে পড়েছে কিনা দেখে, আমরা রোজ যেমন বেডরুমে যাই।

তারপর কী হয়েছিল?

মহিলা বেশ একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, তার মানে? আপনি এবার কিন্তু আমাদের প্রিভেসিতে ইন্টারফিয়ার করছেন?

আমি খুব শান্ত স্বরেই বললাম, একটি ম্যারেড কাপল্‌ রাত্রে তাদের বেডরুমে স্বাভাবিক অবস্থায় কী করে সে কথা আমি জানি, ম্যাডাম। কিন্তু তাও জানতে চাইছি, কারণ তাতে আপনার হাজব্যাণ্ডের অসুখটা বুঝতে এবং সারাতে আমার সুবিধা হবে।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর, মহিলা বললেন, আমি কাল খুব টায়ার্ড ফিল করছিলাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিলাম। ওকে আমি সেটা বললামও – জেনারালি খুব এমপ্যাথেটিক, কিন্তু সামহাউ কাল ও রেস্টলেস হয়ে উঠেছিল – আমি বারবার আপত্তি করা সত্ত্বেও জোর করছিল। তার কিছু পরেই যন্ত্রণায় ও কেমন যেন কুঁকড়ে গেল এবং ওর শরীরে ওই সিমটমগুলো ফুটে উঠতে লাগল। এরপর কাল সারারাত আমরা আর ঘুমোতে পারিনি...।   

আমি মহিলাকে থামিয়ে বললাম, আর আমার কিছু শোনার নেই ম্যাডাম। এধরনের কেস এর আগেও অনেকগুলো হ্যাণ্ডল করেছি। কিন্তু সেগুলোর ভিকটিম ছিল রেপিস্ট পুরুষরা। তাই আপনার হাজব্যাণ্ডের সিমটম দেখে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। সুখী দাম্পত্যের মধ্যেও যে এমন ঘটতে পারে...। হাসপাতালে চলে আসুন – আর আমি এক্সপেক্ট করব, আপনিও আমাকে পূর্ণ কোঅপারেট করবেন, ম্যাডাম। যদি করেন, আমাদের চিকিৎসা শাস্ত্রে একটা নতুন অধ্যায় লেখা হতে পারে।

“মহিলা কোঅপারেট করেছিলেন”?

করেছিলেন বৈকি! তার পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এই রহস্যভেদ সম্ভবই হত না। ওদের পরিবার এখন আমাদের একান্ত আপনজন। সম্পর্কে অনেকদিনই আমি মেয়েটির কাকু হয়ে গেছি।  ভাইঝি, জামাই, নাতি-নাতনী নিয়ে আমার পরিবার এখন অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে”।

“কী জানতে পারলেন”?  

“আমরা প্রকৃতিকে যতই জয় করতে চাই না কেন – প্রকৃতি তার বিবর্তনের কাজ ঠিকই চালিয়ে যায় – ধীরে ধীরে। প্রথম থেকেই অপরাধীদের ইনফ্লেমড স্কিন-স্যাম্পলের মাইক্রোস্কোপিক টেস্ট করে দেখছিলাম – খুব সূক্ষ্ম - খালি চোখে দেখা যায় না – স্কিনের মধ্যে অজস্র রোঁয়া ফুটে আছে, যার বায়োলজিক্যাল টার্ম সেটা (seta), প্লুরালে সেটাই বা সেটি (setae)। ইন ফ্যাক্ট যেখানে যেখানে ওই সেটি ঢুকেছে – সেখানেই দেখা দিয়েছে ইনফ্লামেশন।  

শুঁয়োপোকার গায়ে প্রায়ই এধরনের সেটি থাকে। কেন থাকে? শুঁয়োপোকাদের অনেক শত্রু – তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। এমনকি তুলনায় আমাদের মতো অনেক বড়ো চেহারার প্রাণীদের গায়েও সেই সেটি বিঁধলে আমাদের অস্বস্তি হয়, চুলকায় – লাল হয়ে ছোটখাটো ইনফ্লামেশন হয়, তাই না? শুঁয়োপোকার সেটি সূক্ষ্ম হলেও চোখে দেখা যায়। কিন্তু ওই স্কিন স্যাম্পলে পাওয়া সেটি তার থেকেও বহুগুণ বেশি সূক্ষ্ম এবং অনেক বেশি বিষাক্ত।

এই সেটি বা রোঁয়া এল কোথা থেকে – সেটা বুঝতে পারছিলাম না। এই মেয়েটি সাহায্য করাতে সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেল।

কবে থেকে শুরু হয়েছে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় – তবে বেশ কিছু বছর ধরে – হয়তো তিরিশ বা তারও  বেশি বছর আগে থেকেই মেয়েদের শরীরে আশ্চর্য এই বিবর্তন শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক রোমের পাশাপাশি, মেয়েদের শরীরে জন্ম থেকেই প্রায় অদৃশ্য এই সেটির সৃষ্টি হচ্ছে। ওই মেয়েটিকে পরীক্ষা করেই বুঝতে পারি – আপত্তি সত্ত্বেও ওর হাজব্যাণ্ড যখন মেয়েটিকে আদর করতে শুরু করে – যেখানে যেখানে স্পর্শ করেছে – গালে, গলায় বা ঘাড়ে চুমো দিয়েছে, পেটে পিঠে হাত বুলিয়েছে – ওই অঞ্চলের সেটি বিষ নিয়ে ঢুকেছে স্বামীর ঠোঁটে, গালে, দুই হাতে...। মেয়েটির শরীরে ওই জায়গাগুলি ছাড়া সর্বত্র ওই সেটি অক্ষত ছিল, যেখানে যেখানে স্বামী স্পর্শ করেছে - ছিল না শুধু সেই জায়গাগুলিতে। মনে হয়েছিল, ওই জায়গাগুলো তো তার মানে রোঁয়াবিহীন হয়ে গেল। ওগুলো আবার কি গ্রো করবে, নাকি ন্যাড়া হয়েই থেকে যাবে আজীবন? হ্যাঁ গ্রো করেছিল।  দিন পনের পর মেয়েটিকে আবার যখন পরীক্ষা করি – দেখলাম কোন জায়গাই আর শূণ্য নেই – ভরে উঠেছে নতুন সেটিতে।

“কিন্তু এরকম ঘটতে থাকলে পরিস্থিতি তো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। মানুষ প্রেম করতে কিংবা ভালোবাসতে ভয় পাবে! সন্তান-সন্ততি না আসলে – রুদ্ধ হয়ে যাবে মানবজাতির প্রবাহ”!

“একদমই না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারো - সে রকম হওয়ার কোন কারণই নেই। ব্যাপারটা ঠিক কী ভাবে ঘটছে তোমাকে বলি। আমরা অনেকদিন ধরেই ব্যাড টাচ এবং গুড টাচ কি, জানি। ছোটদের স্কুলে অনেকদিন ধরেই তো এ নিয়ে সচেতন করা শুরু হয়েছে। এখানেও প্রাইম ফ্যাক্টর হচ্ছে ওই ব্যাড টাচ আর গুড টাচ। ছেলে মাকে, বাবা মেয়েকে কিংবা ভাই বোনকে, এমনকি সাধারণ ছেলেবন্ধুরাও কোন মেয়েবন্ধুকে স্বাভাবিক স্পর্শ করলে এই সেটি রিঅ্যাক্ট করে না। অর্থাৎ যাদের স্পর্শে মেয়েটির অস্বস্তি হয় না,  সেক্ষেত্রে এই সেটি নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু যখনই শরীরে অস্বস্তিকর এবং অবাঞ্ছিত স্পর্শ লাগে, তখনই মেয়েটির শরীর অ্যালার্ট হতে থাকে এবং এই রোঁয়াগুলি অ্যাক্টিভ হতে থাকে। এবার যদি সেই ব্যক্তি ধর্ষক হয় – তার স্পর্শে মেয়েটির মনে যখন হিংস্র ঘৃণা ও ভয়ের সৃষ্টি হয় – এই রোঁয়াগুলিও তখন তীব্র বিষ প্রয়োগের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। বিষের প্রাথমিক সঞ্চারেও যদি নরাধম পুরুষটি ক্ষান্ত না হয়, যদি সে মেয়েটির কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে গায়ের জোরে উপগত হওয়ার চেষ্টা করে – বিষক্রিয়ায় সেই নরাধম জ্ঞান হারাবে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার মৃত্যু অবধারিত। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে উরু, উরুসন্ধি এবং উপস্থের চারপাশে রোমের যেমন আধিক্য থাকে, তেমনই আধিক্য থাকে সেটিরও – সেই তীব্র বিষক্রিয়ার চিকিৎসা আমরা করতে পারিনি। তবে শিশু কিংবা বালিকারা এই ধরনের নরাধমের শিকার হলে, খুব স্বাভাবিক কারণেই বিষের তীব্রতা কম হয় – কারণ তাদের শরীরে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো রোমের উন্মেষ তো আর হয় না। তবে আমার বিশ্বাস, যে হারে বালিকা নির্যাতন হচ্ছে, তাদের রক্ষার্থে, কোনদিন প্রকৃতি হয়তো তাদের শরীরও ওই সূক্ষ্ম রোমে ঢেকে দেবে।

“আপনি বললেন, তীব্র বিষক্রিয়ার চিকিৎসা আপনারা করতে পারেননি। কেন, সেটা কি ইচ্ছাকৃত”?

“হতে পারে। এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করতেই হবে – এমন উৎসাহ হয়তো আমাদের মনে জাগছে না। অন্ততঃ আমার মনে তো নয়ই। তার কারণ, প্রথমত, পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে আদালতের বিচার যে ভাবে বারবার প্রহসনে পরিণত হয় সে তো আমরা দেখেছি। সেক্ষেত্রে প্রকৃতির বিচারকে মেনে নিলে ক্ষতি কী? প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের মৃত্যু হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প, ঝড়, সুনামিতে তো এক সঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সে মৃত্যুর বিচার নিয়ে আমরা তো কখনো ভাবিত হই না? তাহলে মেয়েদের ওপরে ঘটে চলা কদর্য অপরাধের প্রতিকারের জন্য, সহজাত বিচারের ব্যবস্থা দিয়েই প্রকৃতি যদি মেয়েদের সৃষ্টি করে, সে বিচারকে বাধা দেব কেন?    

এবং দ্বিতীয়ত, এই নিয়ে কোন গবেষণাই এখনো শুরু হয়নি। বিশেষ কোন হরমোনের কারণে মেয়েদের শরীরে এই সূক্ষ্ম রোঁয়াগুলি আসছে। কী ভাবে ওই বিষ তাদের শরীরে তৈরি হচ্ছে, এবং কী ভাবেই বা সেই বিষ সঠিক মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিটি রোমে রোমে – সে তথ্য আমাদের কাছে তো নেই। সাধারণ বিষক্রিয়ায় আমরা শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানোর চিকিৎসা করি, তীব্র বিষের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনাম অ্যাপ্লাই করি। স্বল্প বিষের নিরাময় এখনও সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু বিষের মাত্রা বাড়লে তার প্রতিষেধক দরকার। তার জন্যে প্রয়োজন দীর্ঘ গবেষণার সুযোগ। সে সুযোগ আর দিচ্ছে কে?

তবে আমি মনে করি, প্রতিষেধক যতদিন না বেরোয় ততদিন মেয়েদের পক্ষেই মঙ্গল – চরম বিপর্যয় থেকে বহু মেয়েই পরিত্রাণ পেয়ে যাচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে আগে কী হতো? তদন্ত করা। প্রমাণ যোগাড় করা। সাক্ষী যোগাড় করা। মাসের পর মাস ধরে অভিযুক্তদের বয়ান - সাক্ষীদের বয়ান। সামনাসামনি বসিয়ে একসঙ্গে বয়ান। তদন্তকারীদের গোপন রিপোর্ট পড়ে বিচারপতিদের চমকে চমকে ওঠা। এত সবের পরেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে জামিন বা বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়া...। ফালতু এত সাতকাহনের দরকারই নেই... যেমন কর্ম তেমন ফল, একেবারে হাতেহাতে সাজা পেয়ে যাচ্ছে কালপ্রিটগুলো। বাড়াবাড়ি করলে হাতে পেয়ে যাচ্ছে যমের বাড়ির কনফার্মড টিকিটও!

এই মৃত্যু নিয়ে কোন বিতর্কও উঠবে না। কেউ বলবে না – প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে ফাঁসানো হয়েছে। কেউ বলবে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রেপ আটকানো যায়নি - যাবে না। এই সমস্যার সমাধান মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। সমস্যার সমাধানটা কি জিজ্ঞাসা করলে বলবে – সর্বস্তরে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এদিকে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই লাটে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সকল রকমের প্রচেষ্টা চলছে, অত্যন্ত আন্তরিকভাবে”।   

“কিন্তু বিষয়টা গণ-মাধ্যমে প্রচার করে সকলকে সচেতন করা হচ্ছে না কেন? তাতে তো ছেলেরা ভয় পাবে, এরকম অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। মেয়েরাও নিশ্চিন্ত হতে পারবে”।

“তাই হয় নাকি? যারা দেশ চালায়, তারা সব কথা সবার কাছে বলবে কেন? দুরন্ত, দামাল সব মানুষগুলো, গণতন্ত্রের চেয়ারগুলোকে অক্টোপাসের মতো ধরে রাখার জন্যে, কত কত ভালো ভালো কাজ করছে নিত্যদিন, তারা দু-একদিন যদি কোন দুষ্টুমি করেই ফেলে – সেটাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখাই গণতান্ত্রিক দেশের নেতাদের কর্তব্য বৈকি। তাদের ভয় দেখিয়ে মেয়েদের নিশ্চিন্ত করবে, কোন আহাম্মক? কিন্তু তোমাদের এ বিষয়ে কৌতূহল কেন?”

“আমরা যে সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, স্যার”।

“ক্ষতি? কিসের ক্ষতি?”

“আমাদের পেশায় পুরুষ নিয়ে কোন বাছবিচার তো করা চলে না, স্যার। সেখানে গুডটাচ-ব্যাডটাচ - যেমন আপনি বললেন, সেই বিলাসিতাও আমাদের করা চলে না। অতএব আমাদের ইচ্ছায় – অনিচ্ছায় পুরুষের হাতে শরীর মেলে ধরতেই হয়। কিন্তু মন তো নির্বিকার থাকে না, থাকতে পারে না, স্যার – তাতে পুরুষরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যারা নিয়মিত আসত, তারা প্রথম প্রথম দু-চারবার বুঝতে পারেনি, কিন্তু পরে তারাও বুঝতে পারছে। তারা আমাদের পাড়ায় আসা বন্ধ করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা খাব কি”?

ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না, তাকিয়ে রইলেন তাঁর বাগানের দিকে। প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা প্রতিটি জীবন – গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি...। সভ্য মানুষ, সভ্যতার শুরু থেকেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে প্রতিদিন। এই সভ্যতাই একদিকে সৃষ্টি করেছে ধর্ষণ, অন্য দিকে এই মেয়েটির পেশা।

কিছুক্ষণ পর তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে এই কাজ ছেড়ে অন্য কোন কাজ করার উপদেশ দেওয়া অর্থহীন। কারণ সভ্য সমাজ তোমাকে কখনোই স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজই করতে হবে। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও, মা। দেখি কোন ওষুধ খুঁজে পাই কি না – যে ওষুধে কিছুক্ষণের জন্যে অসাড় হয়ে থাকবে তোমার মন। সে ওষুধ কতখানি ক্ষতি করবে তোমার শরীরের – সেটাও বুঝতে হবে। শরীরের সাংঘাতিক ক্ষতি স্বীকার করেও বহু কর্মীকে যেমন কাজ করে যেতে হয়, হয়তো তোমাকেও...”।

কথা শেষ করলেন না ডাক্তারবাবু মাথা নাড়তে লাগলেন আপন মনে। একটু পরে আবার বললেন, “আমরাই নির্বাচিত করি যে জনপ্রতিনিধিদের তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। সেই প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা ব্যর্থ বিচার-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা যাবে না। বললেই ভয়ানক ক্ষতি। তার থেকে প্রকৃতির বিরুদ্ধেই যাওয়াই সমীচীন, সে ক্ষতিটা, যদিও অমোঘ, আসে ধীরে ধীরে। তবে ক্ষতি দুদিকেই – রাম মারুক কিংবা রাবণ – আমরা যে মারীচ”।

 

-০-

          

                 

সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫

চোত-বোশেখের পালা

 

চৈত্রসংক্রান্তি, ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ

    আমাদের ছোটবেলাকার কালের সে সব দিন অন্যরকম ছিল। আমরা কাছাকাছি জেলার গেরাম গঞ্জ থেকে কলকেতায় আসিতাম রুজি রোজগারের আশায় কিংবা আমাদের ছেলে পিলেরা আসিত ভালো নেকাপড়া শিকিয়া দেশের দশের উবগার করার আশায়। মৌমাচির চাকের মতো আমরা বাসা বাঁধিতাম কলকেতার মেসবাড়িগুনোতে। সে সব মেসবাড়িতে দিনরাত ভনভন ভ্যানভ্যান লাগিয়াই থাকিত। আমাদের সংগে কলকেতার তকনো এত মাকামাকি হয়ে ওটেনি, আমারা হপ্তা-পনেরদিন কলকেতায় থাকিতাম ঠিকই, কিন্তু ছুটিছাটা পাইলেই ন্যাজ তুলিয়া গেরামের বাড়িতে পলাইতাম। কলকেতাকে আমরা তকনো পরবাস ভাবিতাম, গেরামের বাড়িতে ফিরিয়া ডাঙ্গার মাচ জলে পড়িয়া যেন পরাণ ফিরিয়া পাইতাম।

    চোত মাসের প্রায় পুরোটাই - বাসন্তীপুজো, রামনবমী, চড়কের মেলা সব মিলিয়ে গেরামে টানা মোচ্ছব চলিত  এই মাসে বাড়িতে কুটুম্বদের আসা-যাওয়া চলিতেই থাকিত। ঘরে ঘরে খাওয়া দাওয়া, বাহিরে ড্যাং ড্যাংআ, ড্যাং ড্যাং ঢাকের বাদ্যি; গেরামের ছেলেপিলের দল আমরা খুব মজিয়া থাকিতাম।  

    বেলা একটু বাড়িলেই, মাঠের দিকে চাহিয়া দেকিতাম চোতের রোদ্দুরে দূরের ঝোপঝাড়, গাছপালা ঝিলিমিলি করিতএলোমেলো শুকনো হাওয়া বহিত শনশন। শীতের ঝরাপাতা, সেই হাওয়ার হাত ধরিয়া ঝরঝর শব্দে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঘূর্ণী নেত্য করিতআর জলখাবারের বেলা পার হইলেই আমরা সেই ডাক শুনিতাম “বাবা তারকনাতের চরণের সেবা লাগি, বাবা মহাদেএএএব” মাঠের ওধার থেকে ডাক দিয়ে দিয়ে একমাসের ব্রত লইয়া সেই সন্নিসির দল গেরস্তর বাড়ির দুয়োরে দুয়োরে ভিখ মাগিয়া বেড়াইত। আমাদের দোরের সামনে আসার আগেই ঠাকমা বলিতেন “অ বউমা, ওই সন্নিসির দল আসছে, সিধে ঠিক করো, বাছা” সিধে মানে সিদ্ধ করিয়া খাইবার যোগাড়। তাহার মধ্যে থাকিত, আতপ চাল, একটু মুগ, ছোলা কিংবা মটর ডাল, আর টুকটাক কিছু সবজি - আলু, বেগুন, কাঁচকলা কিংবা কুমড়োর ফালি। ছোট বেতের বোনা ধামায় মা সিধে সাজাইয়া তুলিতেনছোট্ট একটি মাটির কটোরায় একটু সরষের তেল, অন্য আরেকটি ভাঁড়ে নুন, কাঁচালংকা। আমাদের দুয়োরের সামনে সেই সন্নিসিদের দল এসে দাঁড়াইত আর বলিত “জয় বাবা তারকনাতের জয়” ঠাকুমা কিংবা মা তাদের ঝোলায় সেই সিধে ঢালিয়া দিত সিধে নেওয়ার পর সন্নিসিরা বলিয়া উঠিত “জয় বাবা মহাদেবের জয়”

    এই ধরনের ব্রত রাখা সন্নিসিরা ছিল একাহারী, দিনের বেলায় একবার মাত্র দুপুরের ভোজন, সূর্যাস্তের পর খাওয়া নিষিদ্ধ। সন্নিসিদের আরো নিয়ম ছিল, তাদের দলের সকলের একবেলার মতো খাবার যোগাড় হইলেই ভিক্ষার সমাপ্তি একেই মাধুকরী বলা হইত। পরের দিনের জন্য খাবার জমাইয়া রাখিলে ব্রতর বিধি ভাঙ্গিয়া যাইত, আর বাড়তি চাল ডাল সবজি বিক্রি করিবার কোন প্রশ্নই ছিল না, সে ছিল মহাপাপ। পর্যাপ্ত সিধে যোগাড় হইয়া গেলে, তারা মাঠের ধারের পায়ে চলা পথ ধরিয়া চলিয়া যাইত চড়ক মেলার মাঠে। খোলা মাঠের মধ্যে কাঠকুটা যোগাড় করিয়া, ইঁট কিংবা পাথরের টুকরোর ওপর মাটির বড়ো মালসার মধ্যে রান্না করিত ফ্যানভাত, সবজিসেদ্ধ, ডালসেদ্ধ। রান্না সারিয়া, পুকুর হইতে ডুবকি স্নান সারিয়া, তাহারা সবাই গোল হইয়া বসিয়া সরিষার তৈল আর নুন মাখিয়া সিদ্ধান্ন সেবা করিত। হাপুস হুপুস শব্দ উঠিত, জিভে কাঁচালংকার ঝাল লাগিলে আওয়াজ করিত সি সি সি সি। খাওয়া সাঙ্গ হইলে মাটির যতো মালসা আর পাত্র ফেলিয়া দিত আস্তাকুঁড়ে। বাসনপত্র, তৈজস সামগ্রী কোন কিচুর প্রতিই লোভ কিংবা মায়া যেন না আসে, তাই এই বিধানযাহাদের এই মায়া থাকে তাহারা তো সন্নিসি নয়, তাহারা গেরস্ত।

    একমাস অবধি এই সন্নিসিব্রতর পর শেষ দিনে এই সন্নিসিরা এবং আশে পাশের অন্য গ্রামের সন্নিসিরাও আসিয়া জড়ো হইত চড়ক মেলার মাঠে। মোটা শালের লম্বা বল্লীর অনেকটা মাটিতে গাড়িয়া খাড়া হইত চড়ক গাছ। তাহার মাথায় লোহার তৈরি মোটা শূল। শক্ত পোক্ত লম্বা একটি বাঁশের ঠিক মাঝখানে গোল ফুটা করিয়া লোহার রিং পড়ানো থাকিতগোল এই ফুটার মধ্যে শালের মাথার শূলের উপর বসাইলে, চড়কগাছ প্রস্তুত, মস্ত এক T-র মতো দেখিতে হইত সেই বাঁশের দুই প্রান্তে থাকিত লোহার মোটা হুক, সেই হুকের মধ্যে লম্বা রশি পড়ানো থাকিত। রশির এক প্রান্ত ধরিয়া থাকিত বয়স্ক আর অভিজ্ঞ কয়েকজন সন্নিসি। আর অন্য প্রান্তে থাকিত পোক্ত লোহার তৈরি বঁড়শির মতো হুক। দুই প্রান্তের দুই হুকে, কোমরে দড়ি বাঁধিয়া এবার দুই সন্নিসি বলিয়া উঠিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি”সমস্বরে উপস্থিত সমস্ত লোক চিৎকার করিয়া উঠিত “বাবা মহাদেব”এইবার অন্য প্রান্ত ধরিয়া থাকা অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা, রশিতে টান দিতেই, কোমরে হুক বাঁধা ওই দুই সন্নিসি ঝুলিয়া পড়িত শূণ্যে। রশির টানে তাহারা দুইজন, উঁচুতে আরো উঁচুতে উঠিতে উঠিতে, চড়ক গাছের T-র দুই প্রান্তে  দুলিতে থাকিত ওপর থেকে সন্নিসি দুইজন চিৎকার করিয়া বলিত “বাবা তারকনাথের সেবা লাগি” নিচেয় দাঁড়ানো, অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরা স্বস্তির শ্বাস লইয়া বলিত “বাবা মহাদেব” এই দুই জয়ধ্বনির অর্থ অনেকটা সংকেতের মতো। ওপরের দুই সন্নিসি জয়ধ্বনি দিয়া আসলে বলিল, তাহারা ঠিক আছে, কোনকিচুর অসুবিধে নাই। আর নিচের সন্নিসিরা জয়ধ্বনিতে নিশ্চিন্ত হইয়া যেন বলিল, যাক বাবা, এবার তবে শুরু করচি

    এই শুরু হইবার সময়টাতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসিত। কারণ, নিচের সন্ন্যাসীদের দড়ির টানে তখন চড়ক গাছের মাথা ঘুরিতে শুরু করিয়াছে। ঘুরিবার গতি বাড়িতে বাড়িতে চড়ক গাছের মাথা বন বন করিয়া ঘুরিতে লাগিত সুতোয় বাঁধা ঢিলের মতো, ঝুলিতে থাকা দুই সন্ন্যাসীও মহাশূণ্যে ঘুরিতে থাকিত বন বন করে। সেই দৃশ্যে ভয়ে আমার চোখ বন্ধ করিয়া ফেলিতাম, সর্বদা মনে হইত, যদি কিছু একটা ঘটিয়া যায়, সন্নিসি দুইজনার কি হইবে! আশেপাশের দর্শকরা ভয়াকুল বিস্ময়ে চিৎকার করিয়া উঠিত “জয় বাবা মহাদেবের জয়”

     সেকালে চড়কের মেলায় চড়কগাছের ওই ভয়ংকর খেলা ছাড়াও আরো অনেক খেলা দেখিয়া শিহরিত হইতাম। সন্নিসিরা জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়া নগ্ন পদব্রজ করিতেন। কেহ কেহ জিহ্বায় লৌহ শলাকা বিদ্ধ করাইত; কেহ বা হাতের জ্বলন্ত মশালে মুখ হইতে ক্যারাসিন তৈল নিক্ষেপ করিয়া, আগুনের তীব্র হলকা সৃষ্টি করিত। সন্নিসিদের এইসব ভয়ংকর খেলা দেখিয়া বাল্যকালে আমরা অভিভূত হইতাম। এই সব খেলা দেখিবার পর পিতার হাত ধরিয়া আমরা মেলার নানান পসরা দেখিতাম। পাঁপড় ভাজা, জিভে ছ্যাঁকা দেওয়া জিলিপি, আলুর চপ, বেগুনি সহযোগে মুখের স্বাদ বদল করিতাম। মায়ের জন্যে কিনিতাম লোহার সাঁড়াশি, তেল উঠাইবার পলা, আলতা, সিঁদুর, ভগিনীদের জন্য কাঠের পুতুল, কাঁচের রঙিন চুড়ি আমরা ভ্রাতাগণ মাটির তৈরি কলা ও পেয়ারা, সুভাষ বোস ও রবি ঠাকুর, কাঠের গোশকট, জিভ বের করা তুলার কুকুর লইয়া বাবার সঙ্গে যখন ফিরিতাম, সূর্য তখন পাটে বসিবার যোগাড় করিতেছেন। মেলায় দীর্ঘক্ষণ ঘুরিয়া পরিশ্রান্ত কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পিতা কাঁধে তুলিয়া লইতেন। পিতার কাঁধে উঠিয়া পথচলার মজাই আলাদা। কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি স্নেহ মিশ্রিত ঈর্ষা লইয়া, পিতার হাত ধরিয়া আমরা আপন গেরামে ফেরার পথ চলিতাম। 

পয়লা বৈশাখ, ১৩৬৬ বঙ্গাব্দ

    সেই কালে মোকাম কলকেতার নানান অঞ্চলে চড়কের মেলা বসিত। আমাদের শৈশবে কিংবা বাল্যে দেখা আমাদের গেরামের মেলার সহিত তাহার বিস্তর ফারাক। কলকেতার মেলায় অনেক বেশি জাঁকজমক। কাঠের নাগরদোলাকাঠের হাতিঘোড়ায় বসিয়া বন বন করিয়া ঘুরিবার মেরি-গো-রাউণ্ড। চোখধাঁধানো মনোহারি পসরা কিংবা খাদ্যসামগ্রী, সব ব্যাপারেই কলকেতার মেলা বিশিষ্টকাঁচের ও চিনামাটির তৈরি সায়েব-মেম পুতুল। রূপার তবক দেওয়া মিঠা পান। নানান রঙের সিরাপ দেওয়া, বরফ শীতল রঙিন সরবৎ। মালাই কুলফি। যুবা বয়েসে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়িয়া কলকেতার মেলা বেশ কয়েকবার দেখিয়া অবাক হইয়াছিলাম, কিন্তু তাহাতে প্রাণের সাড়া পাই নাই। বরং মজা পাইয়াছিলাম অন্যত্র।

    কলকেতার চেতলার হাট মশারি আর মাছের জালের জন্যে বহুদিন হইতেই বিখ্যাত। কিন্তু আমি চেতলার যে মোহজালে মুগ্ধ হইলাম তাহা সংয়ের সাজ। পয়লা বোশেখের আগে ও পয়লা বোশেখের দিন চেতলার সং দেখিতে জন সমাগম হইত বিস্তর। কার্বাইড গ্যাসের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল আলোয় বিচিত্র বেশে বেশ কিছু লোক সাজিয়া উঠিত কলকেতার বাবুদের নষ্টামি, আখড়ার মহারাজদের ধ্যাষ্টামি, কূলবধুদের গোপন ভ্রষ্টামি, মোহান্ত এলোকেশী সম্বাদ; এসব নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ তো ছিলই। তাহার উপর আরো থাকিত নির্ভেজাল হাসির উপস্থাপন। বুকফাটা কান্না, দমফাটা হাসি, আহ্লাদে আটখানা, কাজের ভারে কুঁজো। সন্ধ্যার পর জেলেপাড়ার সঙদের সেই মিছিল সমাবেশ, উপস্থিত জনগণের সহিত আমরাও অত্যন্ত উপভোগ করিতাম।

    পয়লা বোশেখের দিন সকালে ভৃত্যের মাথায় বেতের ধামায় লাল শালুমোড়া জাব্দা খাতা, শ্রীগণেশ ও শ্রীলক্ষ্মীর মূর্তি, লক্ষ্মীদেবীর ঝাঁপি লইয়া বাবুদের কেরানীরা দলে দলে আসিতেন কালীঘাটের কালী মন্দিরে। মন্দিরে পুজার ভিড়ে রীতিমতো হট্টগোল উপস্থিত হইত। দাপুটে বাবুদের কেরানীরা অর্থের দাপট দেখাইতে কসুর করিতেন না, তাঁহাদের উৎকোচে মন্দিরের পুরোহিতগণের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়িয়া যাইত। এই পুরোহিতগণ মাকালীর সহিত সরাসরি যোগাযোগ ঘটাইয়া সম্বৎসরের ব্যবসার সুবন্দোবস্ত করিয়া দিবার আশ্বাস দিতেন। পুজার পর তাঁহারা জাব্দা খাতায় আলতাকালিতে উপরে ‘ওঁমা’, তাহার নিচে ‘শ্রীশ্রীকালিমাতা সহায়’ লিখাইয়া লইতেন। তাহার নিচে স্বস্তিকা চিহ্ন আর একদম নিচের দুই কোণায় আলতায় ডোবানো রৌপ্যমুদ্রার দুই পিঠের মোহর।

    কলকেতা শহরে সে সব মেলা আজিকালি আর তেমন দেখি না। লোকে আজিকালি অন্ধকার ঘরে টিকিট কাটিয়া বায়োস্কোপ দেখে। তাহারা নায়ক নায়িকাদের গান আর মেকি হাসিকান্নায় মজিয়া থাকে। শুনিয়াছি কলকাতার নব্য বাবুরা এখন চড়কের মেলা, সং ইত্যাদির আনন্দকে “ছোটলোকি” বলে। বলে এসব সেকেলে ফক্কুড়ি দেখিয়া সময় নষ্ট করিবার মতো সময় তাহাদের নাই। হবে হয়তো। আমাদের যৌবনে আমরা তো এসব খুবই উপভোগ করিতাম। আজিকালি বয়স হইয়াছে, এ যুগের ছোকরাদের মতিগতি আর বোধগম্য হয় না।  

    আমার গিন্নি পয়লা বোশেকের ছুটির দুপুরে বড়োই তরিবতে রন্ধন করেন। সজনে ডাঁটার শুক্ত, রুই মাছের মুড়ো দেওয়া ভাজা মুগের ডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, পটল-আলুর মাখোমাখো তরকারি, রক্তরাঙা ঝোলের মধ্যে দুইখানি অর্ধগোলক আলু সহ অনেকটা কচিপাঁঠা, কাঁচা আমের পাতলা অম্বল। সবার শেষে মিঠে দধি। এইরূপ আকণ্ঠ মধ্যাহ্ন ভোজের পর, গালে গিন্নির হাতের পান লইয়া, পয়লা বোশেখের দুপুরটি দিবানিদ্রায় অতিবাহিত করি, জানালা দরোজা বন্ধ প্রায় অন্ধকার ঘরে।

    দিবানিদ্রা সারিয়া বারান্দায় যখন বসি, পথের আলো জ্বালাইবার জন্য পুরসভার কর্মচারিরা লম্বা আঁকশি হাতে দৌড়াইয়া চলে। পাড়ার যতো বাড়ির দরোজায় দরোজায় বেলফুলের মালা লইয়া ফিরিওয়ালা ডাক পাড়ে “বেইলফুউউল”। তাহার চিকন কণ্ঠের সুরে ও বেলফুলের সৌরভে প্রথম বৈশাখের সন্ধ্যাটি বড়ো মধুর হইয়া উঠে। তাহার পশ্চাতে আসে মালাইবরফ এবং কুলফি মালাইয়ের ফিরিওয়ালা। পাড়ার বখাটে ছোকরার দল তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া সিদ্ধি মিশ্রিত কুলফি মালাই খাইয়া অকারণ হাসিতে পাড়া মাতায় তোলে।

    সন্ধ্যা একটু গড়াইলে, পাটভাঙা ধুতি আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি পড়িয়া রাশভারি মুখে বাহির হই। পায়ের পাম্পশুতে মচ মচ ধ্বনি তুলিয়া যখন হাঁটি নিজের ভারিক্কি চালে নিজেই অবাক হই। গেরামে থাকিতে যাহারা আমাকে ‘আত্তাঁ’ বলিয়া চিনিত, তাহারা আমার এই ‘আত্মারামবাবু’ মার্কা চেহারা দেখিলে কিরূপ ভিমরি খাইত কল্পনা করিয়া, বড়ো আল্লাদ পাই।

    কালেজ স্ট্রিটের মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে কল পাইপের বিপণিগুলির অধিকাংশই আমাদের দেশজ সুহৃদদের মালিকানা। হালখাতা উপলক্ষে এই সব বিপণির উদার হৃদয় মালিকেরা অতিথি আপ্যায়নের বিপুল আয়োজন করিয়া থাকে।

    দোকানের প্রবেশ পথেই একজন কর্মচারী পিচকারি হইতে মাথায় মুখে গায়ে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করিয়া গোলাপজল ছিটাইয়া দেয়। সদ্য গ্রাম হইতে আসিয়া কলকেতা নিবাসী হইবার পর যেবার প্রথম হালখাতা অনুষ্ঠানে আসিয়াছিলাম, এই ঘটনায় অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছিলাম। বলা নাই কওয়া নাই, খামোখা আমার গাত্রে জল ছিটাইয়া দেওয়া, এ কী ধরনের রসিকতা? সৌভাগ্যক্রমে সেই ক্ষণে বিপণির মালিকপুত্র “আসুন খুড়ামহাশয়” বলিয়া আমার হাতে ঝাউপাতায় মোড়া গোলাপকলি উপহার দিয়া ভিতরে বসাইয়াছিল। নচেৎ সেদিন হয়তো কুরুক্ষেত্র বাধাইয়া নিজেকেই হাস্যাস্পদ করিতাম। বসিবার পর দেখিয়াছিলাম ওই কর্মচারি সকলকেই ওই জল ছিটাইতেছে, ও তাহাতে গোলাপের সুবাস। ক্রোধ প্রশমিত হইলে, নিজ গাত্রেও ওই গোলাপজলের সুবাস উপলব্ধি করিয়া চমকিত হইয়াছিলাম।

    বিপণির ভিতরের প্রাত্যহিক ব্যবসায়িক পরিবেশ আজ নাই উজ্জ্বল আলোর নিচে ফরাস পাতা, তাহাতে ধবধবে চাদর বিছানোফরাসে বসিয়া অশীতিপর এক মুসলিম বৃদ্ধ সানাই বাজাইতেছেন। তাঁহার সহিত তবলায় একজন সঙ্গত করিতেছেনসেই সানাইয়ের মাঙ্গলিক সুর যেন নতুন বর্ষের শুভদিনের সূচনা করিতেছে। কিন্তু আশ্চর্য, সেই সুরের প্রতি উপস্থিত কাহারো মনোযোগ নাই। সকলেই নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপে ব্যস্ত। সকলের হাতেই কি এক পানীয়ের বোতল, তাহাতে সরু পাইপ বসানো। সেই পাইপে ঠোঁট লাগাইয়া হাল্কা চুমুকে সকলে পানীয়ের মজা লইতেছে। এই পানীয় কি সুরা জাতীয় কিছু? কলকেতার বাবুরা কি প্রকাশ্য সন্ধ্যালোকে নির্লজ্জের মতো মদ্যপান করিয়া থাকে?

    এই সব ভাবিতে ভাবিতে বিপণির মালিক অমিয়ভূষণ মহাশয়, আমার কাছে আসিয়া নমস্কার করিয়া বলিলেন, ‘সব ভালো তো আত্তাঁ, কোন রকম সংকোচ করবা না। আরে একি, তোমাকে কোল্ডিংক দেয় নি? অ্যাই ব্যাচা, এদিকে একটা কোল্ডিংক নে আয়। বাড়ির সব খপর ভালো? বাচ্চা পরিবার, সবাই? হে হে হে, খুব ভালো। আরে আসুন আসুন বিপত্তারণবাবু, আজকাল আপনার আর দ্যাকাই পাওয়া যায় না, আমি ওদিকটা একবার দেকে আসি, যেদিকটা না দেকবো, সেকানেই ...বোয়লে না?” অমিয়ভূষণবাবু অন্যদিকে যাইবার পরেই ব্যাচা নামের ছোকরাটি আমার হাতে এক বোতল শীতল পানীয়ের মধ্যে সরু পাইপ ডুবাইয়া দিয়া গেল। অন্যদের দেখাদেখি কায়দা করিয়া আমিও পাইপে অধর চাপিয়া পানীয় টানিয়া লইলাম। স্বাদ মন্দ নয়। স্বাদ ও গন্ধে মদ বলিয়াও মনে হইল না, কারণ ইহার পূর্বে ছোকরাকালে কুসঙ্গে পড়িয়া দু একদিন ব্রান্ডির স্বাদ লইয়াছিলাম।    

    কিন্তু ও কী ও, আমার এ কী হইল? পানীয় গলাধঃকরণের পরই পেটের মধ্যে বিশাল উদ্গারের উদ্গম হইল। আমি রোধ করিতে পারিলাম না, আমার কণ্ঠ হইতে অদ্ভূত এক শব্দ নির্গত হইল। মনে হইল আমার উদরের অজ বালক পুনর্জীবন পাইয়া তাহার মাতার সন্ধানে ডাকিতেছে। আমার আশেপাশে উপবিষ্ট, বিশিষ্ট জনের দুই চারিজন আমার বাণীতে চমকিত হইলেন, ঘাড় ফিরাইয়া আমার আপাদমস্তক মাপিয়া লইলেন। ইহার পর ওই ভুল আর করি নাই, পাইপে হাল্কা টানে অল্প পানীয় পান করিতে লাগিলাম। তাহাতেও ছোট ছোট উদ্গার উঠিতেছিল, কিন্তু আমি সেগুলিকে নাসিকা পথে ছাড়িতে লাগিলাম। তাহাতে নাসিকা জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু সম্মান রক্ষা হইল। এমন পানীয় মনুষ্যজাতির সভ্যতায় কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত করিবে, বলিতে পারি না।

    অমিয়ভূষণবাবুর বিপণি হইতে দুইখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই বাস্কো মিষ্টান্ন লইয়া বিদায় লইলাম। তাহার পর আরো ছয়খানি পরিচিত বিপণিতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিয়া টানা রিকশয় গৃহে ফিরিলাম। আমার বগলে তখন পাঁচখানি বাঙ্গালা ক্যালেণ্ডার ও দুই হাতে নয় বাস্কো মিষ্টান্নআরো দুইখানি হাত থাকিলে, আরো কয়েকটি বিপণিতে যাইতে পারিতাম ভাবিয়া আক্ষেপ হইল। কিন্তু বিধির বিধানে হাত মাত্র দুইখানি!

    রাত্রের রন্ধন হইতে মুক্তি পাইয়া আমার গৃহিণী আনন্দিতা হইলেন। দুই পুত্র ও দুই কন্যা সহ আমরা সকলে নয়খানি বাস্কো উদরসাৎ করিয়া পরিতৃপ্ত হইলাম। গৃহিণীর বানানো একখানি পান গালে লইয়া বাহিরের বারান্দায় দাঁড়াইলাম। ভাবিলাম পয়লা বোশেখের মঙ্গলরাত্রি বড়ো আনন্দে যাপিত হইল।

    জানি না কেন এই সময় মনে পড়িল সেই শীর্ণ বৃদ্ধ সানাইশিল্পীর কথা। তাঁহার সানাইবাদনের প্রতি আমাদের কাহারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একদল শূকরের সম্মুখে ছড়ানো মুকুতার মতো তাঁহার শিল্প প্রয়াস তিনি বিতরণ করিতেছিলেন, শুধুমাত্র তাঁহার নিজের ও পরিবারের উদরপূর্তির প্রত্যাশায়। একজন শিল্পীর, নামজাদা নাই বা হইলেন, এ হেন অবহেলা আমরা না করিলেও পারিতাম।

    পয়লা বৈশাখে নববর্ষের এই শুভ দিনটিতে তাঁহার সানাইয়ের সেই মাঙ্গলিক সুর কলকেতার স্বার্থ সন্ধানী মানুষের অন্তরে এতটুকুও দাগ রাখিতে পারিল না। আগামী কল্য দোসরা বৈশাখ, আর পাঁচটা সাধারণ কর্মব্যস্ত দিনের সহিত এতটুকুও ফারাক থাকিবে না। সকালে গৃহিণীর প্রস্তুত মৎস্যের ঝোল-ভাত নাকে মুখে গুঁজিয়া দপ্তরে যাইব। দিনগত পাপক্ষয় করিতে করিতে আরও একটি বৎসর পার হইয়া জীবনে আরও এক পয়লা বৈশাখ আসিবে, ভাবিতে ভাবিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম মনেও নাই।

-   ০০ –

[আত্মারাম বাগচি মহাশয়ের জন্ম প্রাক-স্বাধীনতা যুগে, কর্ম উত্তর-স্বাধীনতার দিনগুলিতে। তাঁর স্মৃতিকথার আংশিক পরিমার্জিত রূপ “চোত-বোশেখের পালা”; বানান ও শব্দ ব্যবহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।]

শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৫

মহাভারতের অশুদ্ধি

 

প্রাত্যহিক বাক্যালাপে, ধরা পড়ে যাওয়া ছোটখাটো ভুলত্রুটি ঢাকতে আমরা প্রায়ই বলে থাকি “একটু আধটু ভুলভ্রান্তি করে ফেলেছি তো কী হয়েছে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে নাকি?”। বঙ্গের ভক্তপ্রাণ সরল কবি শ্রী কাশীরাম দাস একথা শুনলে নির্ঘাৎ দুঃখ পেতেন। তিনি মহাভারতের বঙ্গ সংস্করণ লিখতে গিয়ে বারবারই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, “মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান”। অমৃত কখনো অশুদ্ধ হয় নাকি? নাকি তাকে উচ্ছিষ্ট করা যায়? অমৃত সর্বদাই পবিত্র।

কিন্তু মহাভারত সত্যিই অমৃত কী না, সে ব্যাপারে ঘোরতর সংশয়ের উদ্রেক করেছিলেন স্বয়ং দেবর্ষি নারদ। আজ্ঞে হ্যাঁ, টিভির মহাভারত সিরিয়ালে, হাতে বীণা আর কপালে তিলক আঁকা যে নারদকে দেখেছিলেন, ইনিই সেই নারদ। যাঁর মুখে সদা সর্বদা “নারায়ণ, নারায়ণ” শুনে তাঁর ভক্তিরসে আমরাও আপ্লুত হতাম। আবার সামনে বিবদমান দুই বন্ধুজনের ঝগড়া উস্কে দিতে, নখে নখ ঘষে আমরা ছোটবেলায় যে “নারদ, নারদ” জপ করতাম, ইনিও সেই একই নারদ। এ হেন নারদই মহাভারতকে যাচ্ছেতাই রকম হ্যাটা করেছিলেন। তাও আড়ালে আবডালে নয়! মহাভারত রচয়িতা স্বয়ং কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মুখের ওপরেই ছ্যা ছ্যা করে উস্তুম-ফুস্তুম ধমক দিতে কার্পণ্য করেননি। সেই ঘটনার কথা আবার নিজেই গুছিয়ে লিখে গিয়েছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের প্রথম স্কন্ধের চতুর্থ এবং পঞ্চম অধ্যায়ে! ঘটনাটা কেমন ঘটেছিল, সংক্ষেপে আগে বলে নিই।

 

“শুক, শুক, অ্যাই শুক, কোথায় চললি? ধেড়ে ছেলে, এই অবস্থায় কেউ বাইরে বের হয়? কোমরে একটা কাপড় জড়িয়ে নে হতভাগা! তোর না হয় লাজ-লজ্জার বালাই নেই, কিন্তু আমার ব্যাপারটা বোঝ, সমাজে আমি মুখ দেখাব কী করে?”

এই এক ছেলে শুকের জন্যে দ্বৈপায়নের দুশ্চিন্তার অবধি নেই। তাঁরই পুত্র, অথচ তিনি তাঁকে ঠিক বুঝতে পারেন না। সবাই বলে, তিনি মহাযোগী, পরম ব্রহ্মে একনিষ্ঠ, তিনি ব্রহ্মজ্ঞ। তিনি সমদর্শী এবং ভেদজ্ঞানরহিত, অর্থাৎ বসন ও দিগ্বসনে অথবা খাদ্য এবং বিষ্ঠার মধ্যে তিনি কোন প্রভেদ দেখতে পান না। যদিও তিনি এখন যুবক, কিন্তু তাঁর আচার আচরণ দেখলে মনে হয়, অপরিণত বুদ্ধি শিশু। এই নিয়েই দ্বৈপায়নের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তিনি তো এমন পুত্র চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর নিজের মতো পুত্র শুকও বেদজ্ঞ হয়ে উঠবে, তাঁর দেহরক্ষার পর পুত্র শুক পিতার নাম আরও উজ্জ্বল করবে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে তিনি বেজায় হতাশ হয়ে পড়ছেন, তাঁর মনে হচ্ছে এ পুত্র উল্টে তাঁর নাম ডোবাবে।

শুক ছাড়াও দ্বৈপায়নের আরও তিন পুত্র ছিল, তারা সকলেই তখন গতায়ু। তাছাড়া সেই পুত্রদের ওপর তাঁর পিতৃত্বের তেমন কোন অধিকার ছিল না। আত্মজকে কোলে পিঠে করে, লালন করার যে আনন্দ, ওই তিন পুত্রের ক্ষেত্রে সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কারণ ওই তিন পুত্রের মধ্যে দুজন ছিল হস্তিনাপুরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু। আর অন্যজন বিদুর, প্রাসাদের অন্তঃপুরিকা এক দাসীর গর্ভজাত। যাকে ভাইপো দুর্যোধন উঠতে বসতে কটুকাটব্য করতেন, ক্ষত্তা, দাসীপুত্র আরও অশ্রাব্য কত কি!

অতএব পিতৃস্নেহের সবটাই তিনি শুকদেবকে উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু পুত্রের নির্বিকার ব্যবহারে তিনি বিড়ম্বিত বলেই সর্বদা উৎকণ্ঠায় থাকেন। আজও পুত্র শুককে নগ্ন অবস্থায় আশ্রমের বাইরে বেরোতো দেখে, ব্যাকুল হয়ে ডাকতে ডাকতে দ্বৈপায়ন পুত্রের পিছু নিলেন, “দাঁড়া, শুক দাঁড়া, আমার কথাটা শুনে যা”। শুকদেব সম্পূর্ণ নির্বিকার, কোন দিকেই দৃকপাত নেই, পিতার ডাক যেন শুনতেই পেলেন না। একই গতিতে তিনি পিতার বদরিকাশ্রম ছেড়ে হেঁটে চললেন সরোবরের পাশ দিয়ে, কাননে ঘেরা গ্রামের পথ দিয়ে। দ্বৈপায়নের বয়েস হয়েছে তিনি এখন বার্ধক্যের সীমায় পৌঁছেছেন, যুবক পুত্রের হাঁটার সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে তিনি অনেকটাই পিছিয়ে পড়লেন।

যথা সম্ভব দ্রুত এসে যখন তিনি সরোবরের কাছে পৌঁছলেন, সরোবরের জলে যেন হুলস্থূল পড়ে গেল। তিনি চমকে তাকিয়ে দেখলেন, বেশ কয়েকজন অপ্সরাতুল্য খোলামেলা যুবতী সরোবরের জলে স্নান করছে। তাঁকে দেখতে পেয়ে তাদের মধ্যে কেউ জলের মধ্যে গলা অব্দি ডুবে রইল, কেউ ভেজা কাপড়ে শরীর ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, কেউ বা লজ্জায় স্তম্ভিত হয়ে মুখ ঢাকল তাদের করকমলে। পুত্রের জন্যে উদ্বেগের মধ্যেও নারীদের আচরণে দ্বৈপায়ন বিস্মিত হলেন, তিনি ওই রমণীদের জিজ্ঞাসা করলেন, “একটু আগেই আমার যুবক পুত্র তোমাদের সামনে দিয়েই নগ্ন অবস্থায় হেঁটে গেল, তখন তো তোমরা লজ্জা নিবারণের কোন চেষ্টা করনি! তাহলে আমার মতো বৃদ্ধকে দেখে তোমরা এত উতলা হলে কেন বলো তো, বাছা? তোমরা কী জানো না, আমি কে?”

লজ্জানত মুখে এক যুবতী উত্তর দিল, “আপনাকে কে না চেনে মহর্ষি, আপনি আমাদের গৌরব। আর আপনার যুবক পুত্র শুকদেব যোগীশ্রেষ্ঠ – নিষ্পাপ শিশুতুল্য, তাঁর দৃষ্টিতে নারীপুরুষে কোন প্রভেদ নেই। তাঁর দৃষ্টিতে আমাদের সংকোচ আসে না, কিন্তু আপনার...”। যুবতী কথা সম্পূর্ণ করল না, লজ্জায় মুখ নীচু করে আকণ্ঠ ডুব দিল সরোবরের জলে। স্তম্ভিত দ্বৈপায়ন পুত্র শুকদেবের পিছনে আর দৌড়লেন না, তিনি মাথা নীচু করে ধীর পায়ে চিন্তিত মুখে ফিরে চললেন তাঁর আশ্রমের দিকে। সরোবরে স্নানরতা প্রগলভা রমণীরা আজ তাঁর ও তাঁর পুত্রের আচরণের প্রভেদটুকু তাঁর চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল।

অথচ সারাজীবনে তিনি তো ধর্মাচরণ ও ধর্মপথ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ও গভীর বোধের প্রয়োগে বলা যায় তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। বেদের বিক্ষিপ্ত মন্ত্র সমূহ তিনি একত্র করে চারটি বেদগ্রন্থে সংহত করেছেন। এর জন্যে দেশের পণ্ডিত মহল তাঁকে “বেদব্যাস” উপাধিতে সম্মান করেছেন। শূদ্র আর স্ত্রীলোকের বেদপাঠ নিষিদ্ধ। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল, কেনই বা তারা ধর্ম আচরণ এবং ধর্মতত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হবে? বিশেষতঃ তাদের এবং সর্বসাধারণকে সকল ধর্মতত্ত্ব জানানোর জন্যেই তিনি মহাভারত রচনা করেছেন। সে গ্রন্থকে বিদ্বানসমাজ পঞ্চমবেদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর অসাধারণ এই দুই কীর্তিই ভারতের ধর্ম চেতনাকে এক উচ্চস্তরে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তাও লঘুমতি ওই চপলা তরুণীরা তাঁর দৃষ্টিতে সমদর্শন খুঁজে পায় না!

 

 

আপাত তুচ্ছ এই ঘটনাটাই নড়িয়ে দিল তাঁর আত্মবিশ্বাসের ভিত। গভীর চিন্তায় তিনি এখন সর্বদাই নিমগ্ন থাকেন, প্রাত্যহিক নিত্যকর্ম ছাড়া অন্য কোন কাজেই তিনি আর নিবিষ্ট হতে পারেন না। সর্বদাই তাঁর মনে হয়, তাঁর এই অগাধ পাণ্ডিত্য, তাঁর ওই অসামান্য কীর্তিসমূহ সবই অসার, ব্যর্থ। তাঁর এতদিনের জীবন ও জীবনচর্যা যেন এক ঊষর ক্ষেত্র, যেখানে তাঁর জ্ঞান ও বোধের বীজ তিনি উপ্ত করার চেষ্টা করেছেন ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছে সে সবই সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং নিষ্ফল হয়েছে।

সারাটাদিন প্রাত্যহিক নিয়মানুবর্তী কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে কোনভাবে কালাতিপাত করার পর, সায়াহ্নে তিনি নিজেকে সব কিছু থেকে মুক্ত করে নেন। এই সময়ে তিনি চলে আসেন আশ্রমের অদূরে বহমানা সরস্বতী নদীর নির্জন তীরে। একটি পাথরের উপরে বসে তিনি তাকিয়ে থাকেন বহতা নদীর দিকে, নদীর ওপারে এবং এপারেও। সন্ধ্যা নেমে আসে ধীরে ধীরে। সারাদিনের কর্মব্যস্ত মানুষজন এবং গৃহপালিত পশুরদল এসময়ে যে যার ঘরে ফেরে। তাদের পায়ে-চলা পথে, ক্ষুরের আঘাতে ধুলো উড়তে থাকে। সে ধুলোয় আবছা হয়ে আসে তাঁর পশ্চাৎপট, ঝাপসা হয়ে যায় পিছনে ফেলে আসা তাঁর আশ্রম। সব কিছুই মনে হয় অলীক, মায়া। তাঁর এতদিনের বিপুল কর্মকাণ্ডকেও যেমন আজকাল অনর্থক পণ্ডশ্রম মনে হচ্ছে। তিনি বিষণ্ণ মনে গভীর চিন্তায় ডুবে যান, তিনি নিজের প্রতিই অসন্তোষে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বারবার, মাথা নাড়েন নিজের অসাফল্যে!

এমনই একদিন, সরস্বতীর তীরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রাত্রির আকাশে জেগে উঠছে একটি-দুটি তারা। কে যেন পিছন থেকে তাঁকে ডাক দিলেন, “এই অন্ধকারে একলা বসে, কী চিন্তা করছ, দ্বৈপায়ন? অগাধ পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তোমার এত চিন্তা কিসের বলো তো?” দ্বৈপায়ন আশ্চর্য হলেন, আশ্রমে সকল শিষ্যদের তিনি কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন, এই সময় কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। তা সত্ত্বেও কে এখানে এল তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে?

দ্বৈপায়ন উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকালেন, এবং অস্পষ্ট তারার আলোতেও তাঁর দেবর্ষি নারদকে চিনতে অসুবিধে হল না। দ্বৈপায়ন নত হয়ে করজোড়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিস্মিত বিনীত কণ্ঠে বললেন, “দেবর্ষি, আপনি অসময়ে এখানে?”

দেবর্ষি নারদ মৃদু হাস্য করে বললেন, “বসো হে, বসো। তোমার সঙ্গে দুটো মনের কথা কইব বলেই আসা। তোমার আশ্রমে গিয়েছিলাম, সেখানে শুনলাম, তুমি এখানে, আর তুমি শিষ্যদের বলে এসেছ, কোনভাবেই কেউ যেন তোমাকে বিরক্ত না করে। তা গায়ে পড়ে বিরক্ত করার ব্যাপারে নারদের মতো সুনাম ভূভারতে আর কারও নেই, কী বলো?” এই কথা বলে দেবর্ষি হা হা করে হাসলেন, এবং পিড়িং পিড়িং শব্দ তুললেন তাঁর বীণায়। তারপর হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছুদিন ধরেই তোমাকে বিষণ্ণ, অবসন্ন দেখছি, দ্বৈপায়ন। সেই উদ্বেগেই আমার এখানে আসা। তোমার শারীরিক কুশল তো?”

দেবর্ষির প্রশ্নে খুশিই হলেন দ্বৈপায়ন, দেবর্ষি বহুদর্শী সর্বতত্ত্বজ্ঞানী, তাঁর কাছে ত্রিভুবনে অজানা কোন বিষয়ই নেই। তাঁর মনের সংশয় দূর করা একমাত্র এই দেবর্ষির পক্ষেই সম্ভব। দ্বৈপায়ন বিনীত কণ্ঠে নিজের মনের সকল কথা মেলে ধরলেন দেবর্ষিকে। সব কথা শুনে দেবর্ষি কিছুটা বিদ্রূপের স্বরে বললেন, “বলো কী হে? তুমি সর্ব ধর্মতত্ত্বে পূর্ণ মহাভারতের মতো গ্রন্থ রচনা করেছ, আসমুদ্রহিমাচলের মানুষ তোমার কীর্তিতে ধন্য ধন্য করছে। আর তুমি কি না মনের অশান্তিতে একলা বসে আছে, নির্জন তমসাচ্ছন্ন এই সরস্বতী তীরে?”

“সবই সত্য, দেবর্ষি, কিন্তু শুকের ওই ঘটনার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে, আমি সম্পূর্ণ হতে পারিনি, আমার জ্ঞানে কী একটা যেন অধরা থেকে গিয়েছে। বহু চিন্তা করেও, সেটা যে কী কিছুতেই ধরতে পারছি না। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারেন, দেবর্ষি? আপনার তুল্য জ্ঞান এই জগতে আর কার আছে? আমার মনের এই সংশয় দূর করতে পারবেন একমাত্র আপনিই”।

দেবর্ষি নারদ গম্ভীর স্বরে বললেন, “দ্বৈপায়ন, তোমার মহৎ রচনায় তুমি ভগবানের নির্মল যশের কথা প্রায় উল্লেখই করনি। তুমি কী বুঝতে পারছ না, ভগবান বাসুদেবের মহিমা বর্ণনা ছাড়া যে কোন সৃষ্টিই অসার এবং নিষ্ফল? তোমার মতো সর্ববেদজ্ঞ কীভাবে এমন ভুল করলে, দ্বৈপায়ন? মহাভারতের অপরূপ কাহিনী, রমণীয় উপমা, বিচিত্র অলঙ্কারের পদবিন্যাস সব কিছুই জলাঞ্জলি হয়েছে, কারণ ওই গ্রন্থে শ্রীহরির জগৎপবিত্র যশোগাথা তুমি বর্ণনা করনি। দ্বৈপায়ন, তুমি কি জানো না, বাসুদেবের অপার মহিমার বর্ণনাহীন যে কোন গ্রন্থই, শুধুমাত্র কাকের মতো ব্যক্তিরাই উপভোগ করে। তারা কিছুক্ষণের জন্য তোমার বিশাল গ্রন্থের বিচিত্র কাহিনী, অলঙ্কার ঠুকরে ঠুকরে উপভোগ করবে, তারপর অন্যত্র উড়ে যাবে। কিন্তু ব্রহ্মনিষ্ঠ সত্ত্বপ্রধান ভক্ত হংসরা তোমার এই গ্রন্থে কখনোই তৃপ্তি লাভ করতে পারবেন না। দ্বৈপায়ন, তুমি কি জানো না, যে গ্রন্থ ভগবানের যশোগাথা বিবৃত করে, সেই গ্রন্থই সম্পূর্ণ। সেই গ্রন্থ যদি অশুদ্ধপদ, ভ্রষ্ট উপমা ও ভ্রান্ত অলঙ্কারে রচিত হয়, তবুও সেই গ্রন্থই হয়ে ওঠে সারগ্রন্থ, সেই গ্রন্থই হংসসম ভক্তজনের লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে”।

দ্বৈপায়ন নত মস্তকে দেবর্ষির কথাগুলি চিন্তা করতে লাগলেন। অন্ধকারে নীরব দ্বৈপায়নকে কিছুক্ষণ চিন্তা করার সময় দিয়ে দেবর্ষি নারদ আবার বললেন, “দ্বৈপায়ন, তুমি ভগবানের অপার লীলা সমস্তই অবগত আছো। তুমি নিজেকে পরমপুরুষ পরমাত্মার অংশ বলেই জেনে রাখো। তোমার জ্ঞান নিশ্ছিদ্র, তোমার দৃষ্টি অব্যর্থ, তোমার জন্য কোন আচার্যের উপদেশের প্রয়োজন নেই। এখন থেকে তুমি মহানুভব শ্রীহরির গুণাবলী বর্ণনা করো। প্রজ্ঞাবান লোকেরা বলেন, উত্তমশ্লোক ভগবানের গুণবর্ণনাই সৎপুরুষের তপস্যা। ভগবান বাসুদেবের যশোগাথাই বেদজ্ঞান; সকল যজ্ঞের অনুষ্ঠান, স্তবপাঠ, জ্ঞান ও দানের অক্ষয় ফল স্বরূপ। অতএব বিলম্ব না করে, আগামী কাল থেকে তুমি সেই কর্মেই নিরত হও”।

মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাই শুরু করলেন। হরিবংশ, শ্রীমদ্ভাগবতের মতো মহাপুরাণ সহ অন্ততঃ আঠারোটি পুরাণ তিনি রচনা করে ফেললেন!

 

 

এ সবই ভক্তি এবং বিশ্বাসের কথা। ভাবনা-চিন্তা, বিদ্যা-বুদ্ধি বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারলে মহর্ষি দ্বৈপায়নের এই কীর্তিতে এতটুকুও সংশয় জাগে না।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা অতটা বিশ্বাসী হতে পারেন না। তাঁরা বলেন, মহাভারতের কেন্দ্রীয় ঘটনা “কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ”-র সময় কাল মোটামুটি ৯০০ বি.সি.ই। আমরা জানি এই যুদ্ধের প্রধান প্রতিপক্ষ একই কৌরব গোষ্ঠীর দুই জ্ঞাতি শাখা, কুরু এবং পাণ্ডব। মহাভারতের রচয়িতা নিজেই লিখেছেন, তিনি নিজেই এই দুই শাখা গোষ্ঠীর পিতা, অর্থাৎ তাঁর নিয়োগেই বিচিত্রবীর্যর দুই পত্নীর ক্ষেত্রে ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর জন্ম। তখনকার রাজবংশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতেন। কিন্তু বিচিত্রবীর্যর দুই পুত্রের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র অগ্রজ হওয়া সত্ত্বেও জন্মান্ধ ছিলেন বলে রাজা হতে পারেননি। রাজা হয়েছিলেন অনুজ পাণ্ডু। বেশ কয়েক বছর রাজত্ব করার পর রাজা পাণ্ডু রাজ্যের শাসন ভার দাদা ধৃতরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করে, বনবাসী হয়েছিলেন।

পাণ্ডু যতদিন রাজা হয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত ছিলেন, ততদিন অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারীর সঙ্গে পাণ্ডুপত্নী রাণি কুন্তীর আদৌ সুসম্পর্ক ছিল না। জন্মান্ধ পতির কারণে তিনি রাণি হতে পারেননি। অতএব কুন্তী যখন রাণি হলেন, অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতা হওয়ার জ্বালা তাঁর অন্তরে তীব্র ঈর্ষার সঞ্চার করেছিল। সেই ঈর্ষা আরও প্রবল হয়ে উঠল, যখন দুই নারী প্রায় একই সময়ে গর্ভধারণ করলেও, কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরে জন্ম হল গান্ধারী পুত্র দুর্যোধন ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই। অর্থাৎ কুরু রাজবংশের পরবর্তী প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন যুধিষ্ঠির, ফলতঃ তিনিই হলেন হস্তিনাপুর রাজসিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকারী। তীব্র এই ঈর্ষার বাতাবরণ থেকেই কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সূচনা হল।

কুটিল রাজনৈতিক আবর্তের নানান উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে ঘটনা পরম্পরা যখন অনিবার্য কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছিল, সেই সময়ে পাণ্ডুপুত্রদের পক্ষে সর্বদাই সহায় ছিলেন মহর্ষি দ্বৈপায়ন। সত্যি বলতে, পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের পিছনে ভগবান কৃষ্ণের ভূমিকা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, মহর্ষি দ্বৈপায়নের ভূমিকাও প্রায় তার সমান বললেও হয়তো অত্যুক্তি হয় না।

অতএব, নিঃসন্তান বিচিত্রবীর্যর ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার বপন থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্যন্ত দ্বৈপায়নের ওতপ্রোত উপস্থিতি অত্যন্ত স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞজনের মতানু্যায়ী নশো খ্রীস্টপূর্বাব্দকেই যদি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নির্দিষ্ট কাল বলে ধরে নিই, তাহলে, তাঁর জীবনকাল ৯৭০ থেকে ৮৯০-৮৮৫ খ্রীস্টপূর্বাব্দের মধ্যে অনুমান করাই যায়। অথচ পণ্ডিতেরা পুরাণ রচনার প্রারম্ভিক কাল অনুমান করেছেন, খ্রীস্টপূর্বাব্দের শেষ পর্যায়ে অথবা খ্রীস্টাব্দের প্রাথমিক পর্যায়ে। এর অর্থ দেবর্ষি নারদের পরামর্শে তিনি যখন পুরাণ রচনায় হাত দিলেন তখন তাঁর বয়েস প্রায় হাজার বছরের কাছাকাছি!

ঠিক এইখান থেকেই শুরু হল প্রকৃত ঘটনার সাজানো ইতিহাস রচনা। যার ফলে কোন ঘটনার নির্দিষ্ট কাল নির্ণয়ে আমাদের অনুমান ছাড়া অন্য কোন পন্থা অবশিষ্ট রইল না। মহাভারত রচনার প্রায় আটশ-নশ বছর পরে, সরাসরি অভিযোগ তোলা হল মহাভারত আদতে একটি অসার গল্পকথা। বলা হল বেদব্যাস বিরচিত এই বহুল জনপ্রিয় উপাখ্যান “কাক”-এর মতো অধার্মিক মানুষদের কাছেই রুচিকর, ভক্ত ও ধার্মিক “হংস”-তুল্য মানুষরা, কখনোই এই উপাখ্যান শ্রবণে তৃপ্তি পেতে পারেন না।

শুরু হল, মেদবর্জিত নিরাভরণ মহাভারতে বিক্ষিপ্ত অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার অনুপ্রবেশ। তার সঙ্গে নিত্য নতুন পুরাণ রচনারও হিড়িক পড়ে গেল। কিন্তু সাধারণ মানুষ আচমকা উৎপন্ন এই সব পুরাণের গল্প বিশ্বাস করবে কিসের ভরসায়? অতএব পুরাণকার পণ্ডিতেরা ব্যবহার করলেন বেদব্যাসের নাম, খ্যাতি এবং প্রায় হাজার বছর ধরে প্রচলিত তাঁর জনপ্রিয় বিশ্বাসযোগ্যতা। তাই পুরাণ রচনার সূচনায় পুরাণকারেরা গড়ে তুললেন, অদ্ভূত ওই কাহিনী, যেখানে অবিসংবাদিত পণ্ডিত ও বেদজ্ঞ দ্বৈপায়ন নত মস্তকে মেনে নিলেন তাঁর ভ্রান্তি। এরপরেও মাত্র একখানি পুরাণ রচনা করেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, পরবর্তী চারশ-পাঁচশ বছরে তিনি কত যে পুরাণ রচনা করেছেন, তা নিয়ে আজও বিতর্কের শেষ নেই। আর এই সময় কালেই তাঁর রচিত “অশুদ্ধ” মহাভারত কালে কালে কলেবর বৃদ্ধি করে হয়ে উঠল শুদ্ধ হংস-বিহারযোগ্য ধর্মগ্রন্থ।

অতএব ক্ষমতালিপ্সু তথাকথিত সমাজসংস্কারকরা ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে সেই ধুরন্ধর পুরাণকারদের ট্র্যাডিশানেই আজও যে ইতিহাসের অশুদ্ধি ঘটাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু তাতেও কী আর অমৃতসমান মহাভারতের অশুদ্ধি ঘটতে পারে?

 

..০০..

  

           

("ধর্মাধর্ম" গ্রন্থের একটি অধ্যায় থেকে সংগৃহীত)   

নতুন পোস্টগুলি

শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ

  ৫.৪.১ শ্রীমদ্ভাগবৎ কৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের ...