সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫

ছোট্ট হওয়া

 

প্রফুল্লনগরে তের নম্বরের কোন কোয়ার্টার নেই, বারো নম্বরের পর বারোর এ, তারপরে চোদ্দ। সেদিন পোস্টম্যান রসিকলাল পাণ্ডে এসেছিল বারোর এ-তে চিঠি বিলি করতে। অন্যদিন লোহার নীচু গেটটায় ঠকঠক আওয়াজ করলে, বাড়ির ভেতর থেকে কেউ না কেউ চিঠি নিতে বেড়িয়ে আসে। আজ রসিকলাল দু-তিনবার আওয়াজ করা সত্ত্বেও কেউ বের হল না। রসিকলাল বাড়িটার দিকে নিরীক্ষণ করে দেখল। এই দুপুরবেলা, সামনের ঢাকা বারান্দায় সব বাড়িতেই শাড়ি, গামছা, কাপড় চোপড় শুকোতে দেখা যায়। সে সব কিছুই নেই। তার ওপর সিমেন্টের মেঝেয় বেশ কদিন ঝাঁট না পড়া ধুলো আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শুকনো পাতা। রসিকলাল বুঝতে পারল বেশ কদিন হল বাড়িতে কেউ নেই।

চিঠি গুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, আরেকদিন আসবে ডেলিভারি দিতে, নাকি বন্ধ দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে চিঠিগুলো? বেড়ার গায়ে সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে, রসিকলাল লোহার গেট খুলে ঢুকে পড়ল সামনের বাগানে। সিমেন্টের বাঁধানো পথে হেঁটে আসতে ভাবল, আজ না দিলে, এই গরমে আবার ফিরে আসতে হবে কাল বা পরশু, তাছাড়া কাল পরশুও যদি না ফেরে? কতদিন কে জানে, চিঠিগুলো তার জিম্মাতেই রাখতে হবে! তার চেয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো। একধাপ উঁচু বারান্দার ধারে এসে রসিকলাল দেখল দু’খানা বড়ো বড়ো তালা ঝোলানো বন্ধ দরজার নীচে, চিঠি ঢোকানোর মতো যথেষ্ট ফাঁক আছে। বাঁহাতে রাখা চিঠির বাণ্ডিল থেকে এ বাড়ির দুটো চিঠি ডানহাতে নিয়ে রসিকলাল বারান্দায় ওঠার জন্যে পা বাড়াল। রসিকলাল ছিটকে পড়ল পিছনের সিমেন্ট বাঁধানো সরু রাস্তার ওপর। তার হাতে ধরা চিঠিগুলো ছড়িয়ে পড়ল রজনীগন্ধা আর বেলিফুলের ঝাড়ের ওপর, আর কাঁধের ব্যাগটা ছিটকে গিয়ে পড়ল ওপাশে ঘাসের জমিতে

আচমকা পড়ে গিয়ে রসিকলাল একটু ভয় পেল এবং অবাক হল খুব। গরমটা উৎকট পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মাথাতো ঘোরে নি! আর কেন কে জানে তার মনে হল, কেউ যেন তাকে সামনে থেকে ধাক্কা মারল। কিছুক্ষণ সিমেন্ট বাঁধানো পথের ওপর বসে একটু ধাতস্থ হয়ে নিল রসিকলাল, তারপর গুছিয়ে তুলে নিল সব চিঠিপত্র আর কাঁধের ব্যাগ। শরীরটা নিশ্চয়ই দুর্বল হয়েছে, সে ঠিক করে ফেলল, আজকে ডিউটি সেরে, কাল থেকে দিনকতক ছুটি নিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম নেবে। এ বাড়ির চিঠিদুটো নিয়ে রসিকলাল আবার পা তুলতে গেল বারান্দায় এবং এবারও সে ছিটকে পড়ে গেল পিছনের সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তায়!

রসিকলাল এবারে আর একটুও সময় নষ্ট করল না, কোনমতে চিঠিপত্র আর ব্যাগ তুলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল লোহার গেট পেরিয়ে বড়ো রাস্তায়। ধীরে সুস্থে সাইকেল চালিয়ে সুধীরবাবু দুপুরের খাওয়া সেরে ওয়ার্কশপে যাচ্ছিলেন, রসিকলাল পড়ল গিয়ে তাঁর ঘাড়ে। হুড়মুড়িয়ে দুজনেই পড়লেন রাস্তার ধারে। বেমক্কা ধাক্কায় সুধীরবাবু রেগে উঠেছিলেন খুব, দাঁড়িয়ে উঠে ভেবেছিলেন আচ্ছা করে দেবেন বেয়াক্কেল লোকটাকে বেশ চার কথা শুনিয়ে। কিন্তু রসিকলালকে চিনতে পেরে আর তার চোখ মুখের অবস্থা দেখে সুধীরবাবু সামলে নিলেন নিজেকে। জিগ্যেস করলেন

-কি ব্যাপার বলুন, তো, পাগলা ষাঁড়ে তাড়া করেচে নাকি, অমন ছুটছিলেন কেন উন্মত্তের মতো?

-এই বাড়িতে নিঘ্‌ঘাত ভূত আছে! হাঁফাতে হাঁফাতে রসিকলাল বলল। সুধীরবাবু মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। প্রখর রোদজ্বলা দুপুর, মাথার ওপর গনগনে সূর্য, এই সময়ে ভূত? ভ্রূ কুঁচকে রসিকলালের দিকে তাকিয়ে বললেন-

-আপনাকে ভালো লোক বলেই তো জানতাম। আজকাল নেশা ভাঙ করা হয় নাকি?

-একদম না, স্যার। মা কালীর দিব্বিচা ছাড়া কোন নেশা জীবনে করিনি। চিঠি ডেলিভারি দিতে যাচ্ছিলাম, দু’ দুবার বারান্দায় পা তুলতেই কে যেন ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল! প্রথমবার ভেবেছিলাম, আমার শরীরটাই বোধহয় দুব্বল, মাথাটা ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ...। কথা শেষ করতে পারল না রসিকলাল, ভয়ে যেন শিউরে উঠল।

-ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনি একা একা যেতে পারবেন তো? অফিসে গিয়ে একটু রেস্ট নিন। হাতের সমস্ত চিঠিই কাঁধের ঝোলায় ভরে রসিকলাল উঠে পড়ল তার সাইকেলে। আজকের ডাক বিলি আপাতত স্থগিত, সে চলে গেল পোস্ট অফিসের দিকে। মাঠের ধারের রাস্তা দিয়ে সাইকেলে তার চলে যাওয়াটা লক্ষ্য করার পর সুধীরবাবু তাকালেন বারোর এ কোয়ার্টারের দিকে।

এই কোয়ার্টারে থাকেন মুকুন্দবাবু, মুকুন্দ বিষয়ী। নাম বিষয়ী হলেও খুবই অমায়িক সজ্জন। মুকুন্দবাবুর চার কন্যা; বছরখানেক আগে বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, মেজ মেয়ে পড়ে ক্লাস টুয়েল্ভে, ছোট দুটো যমজ – দুজনেই ক্লাস সেভেনে উঠেছে। তিন মেয়েকে নিয়ে মুকুন্দবাবু সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছেন, সিমলা কুলু মানালি। ঠিক কবে গেছেন মনে না করতে পারলেও দিন সাত-আট তো হবেই, পনের দিনের প্রোগ্রাম, কাজেই মুকুন্দবাবুর ফিরতে আরো অন্ততঃ দিন সাতেকের ধাক্কা। সুধীরবাবু একবার ভাবলেন ব্যাপারটা মুকুন্দবাবুকে ফোনে জানিয়ে দেবেন, আবার ভাবলেন কি হবে ভদ্রলোককে ব্যতিব্যস্ত করে? পোস্টম্যান কি করতে কি করেছে কে জানে? মুকুন্দবাবুকে জানানোর আগে, অন্ততঃ নিশ্চিত হওয়া দরকার আসল রহস্যটা কি? তিনি সাইকেলে উঠে ওয়ার্কশপের দিকে রওনা হলেন, ঠিক করলেন ডিউটি সেরে ফেরার পথে, এ রহস্যের তদন্তটা সেরে নেবেন, আপাততঃ ওটা তোলা থাক।

সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে সাইকেল স্ট্যাণ্ডে নিজের সাইকেলের লক খুলতে খুলতে সুধীরবাবুর দেখা হল নেপাল ঘোষের সঙ্গে। ছোকরা খুব করিতকর্মা আর পরোপকারী, সুধীরবাবু খুব পছন্দও করেন নেপালকে। নেপালের দিকে তাকিয়ে, সুধীরবাবু বললেন –

-এই নেপাল, খুব ব্যস্ত নাকি রে?

-কেন বলোতো, সুধীদা, কোন কাজ আছে?

-একটা জিনিষ দেখাবো, যাবি? নেপাল একগাল হেসে বলল-

-তোমার বাগানে আবার বুঝি স্থলপদ্ম ফুটেছে? সুধীরবাবুর বাগানের খুব শখ, নানান ধরনের ফুলগাছের চর্চা করা তাঁর নেশা। তাঁর গাছে বিশেষ কোনো ফুলটুল এলে তিনি চেনাশোনা সকলকে ডেকে ডেকে দেখান। অনেকটা ছেলে বা মেয়ের প্রাইজে পাওয়া ট্রোফি দেখানোর মতো। তাঁর এই দুর্বলতার কথা অনেকেই জানে। নেপালের কথাটা গায়ে মাখলেন না সুধীরবাবু, বললেন-

-উঁহু, আরো ইন্টারেস্টিং। ভূত। ঠিকঠাক বললে ভূতের ঠেলা, খাবি?

-এই সুধীদা, তোমার শরীর-টরীর ঠিক আছে তো? তোমার সাইকেলটা রেখে, আমারটায় ওঠো, তোমাকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসছি। মুচকি মুচকি হেসে, সুধীরবাবু নেপালকে কাছে ডাকলেন, তারপর খুলে বললেন রসিকলাল পোস্টম্যানের দুপুরের ঘটনাটা। সব শুনেটুনে নেপাল খুব খানিক হো হো করে হাসল, তারপর বলল-

-মুকুন্দদার কোয়ার্টারে ভূতের ঠ্যালা? তুমিও পারো, মাইরি। পোস্টম্যান বলল আর তুমি মেনে নিলে?

-মেনে নিয়েছি তোকে কখন বললাম? বললাম না তদন্ত করে দেখব, যদি ব্যাটা মিথ্যে কথা বলে থাকে, পোস্টফিসে কমপ্লেন করবো। নেশা করে ভরদুপুরে বাড়ি বাড়ি ডাক বিলি করছে। ওই সময়ে বাড়িতে শুধু মেয়েরাই থাকে, আমরা তো সব ওয়ার্কশপে। কিছু একটা হয়ে গেলে?

-হুঁ, কথাটা মন্দ বলো নি। তবে, চলো ঘুরেই আসি একবার মুকুন্দদার কোয়ার্টারে। দাঁড়াও ওদেরকেও ডাকি। ওই সময়েই সাইকেল স্ট্যাণ্ডে সাইকেল বের করতে ঢুকল দেবু নস্কর আর প্রভাত পাল। ওরা নেপালের প্রায় সমবয়সী কলিগ, খুব ভাব তিনজনে। নেপাল দেবুকে ডেকে বলল-

-এই দেবু, সাইকেল বের করে তুই আর প্রভু আয় তো, মুকুন্দদার কোয়ার্টারে যাবো।

-মুকুন্দদারা নেই তো, জানিস না? সেখানে গিয়ে কি করবি। প্রভু উত্তর দিল।

.-আয় না, কাজ আছে। রাস্তায় যেতে যেতে বলব, আমি আর সুধীদা এগোচ্ছি, তোরা আয়।

 

মুকুন্দবাবুর বারোর এ কোয়ার্টারের সামনে চারজনে সাইকেল থেকে নামল। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় আর বাগানের বেড়ার ধারে কিছু বড়ো গাছের জন্যে এখন বাড়িটাকে একটু ছায়া ছায়া মনে হল সুধীরবাবুর। এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে বেশ ঘেমে উঠেছিলেন, এখন এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটা শীতল হাওয়ার অনুভূতি পেয়ে তাঁর আরাম লাগারই কথা, কিন্তু তিনি বেশ অস্বস্তি অনুভব করলেন। ওরা তিনজনে লোহার গেটটা খুলে ঢুকল। সুধীরবাবু নিজের সাইকেলটা ধরে গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। নেপাল আর প্রভু আছে সামনে, দেবু ওদের পিছনে। সিমেন্টের বাঁধানো সরু রাস্তাটা পার হয়ে ওরা বারান্দাটার সামলে দাঁড়াল,–

-কই, কিছুইতো হল না, সুধীদা? নেপাল জিগ্যেস করল। তার গলায় ঠাট্টার সুর।

-ওই তো ওই বারান্দাটা, বারান্দায় ওঠ।

সুধীরবাবুর কথা শেষ হবার আগেই নেপাল আর প্রভু ছিটকে পিছনে এসে পড়ল দেবুর ওপর, তারপর তিনজনেই সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তায় চিৎপাত! নেপাল আর প্রভু বারান্দায় ওঠার জন্যে পা রাখতে গিয়েছিল, তাতেই এই বিপত্তিতিনজনেই মাটিতে পড়ে কয়েক সেকেণ্ড হতভম্ব হয়ে পড়ে রইল, তারপর নেপাল চেঁচিয়ে উঠল,

-পালা, দেবু পালা, প্রভু, পালা। ও সুধীদা, তোমার মনে শেষ অব্দি এই ছিল? তারপর তিনজনেই উঠে পড়ে হুটোপুটি করে এক দৌড়ে বেরিয়ে এল লোহার গেট পেরিয়ে রাস্তায়। দম নিতে নিতে চারজনে মিলে তাকিয়ে রইল বারোর এ বাড়িটার দিকে।

 

 এই ঘটনার পর সুধীরবাবু মুকুন্দবাবুকে ফোন করেছিলেন। তাঁর থেকে পুরো ব্যাপার জেনে, মুকুন্দবাবু স্ত্রী আর মেয়েদের সব কথা বললেন, শুনে মুকুন্দবাবুর স্ত্রী খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন "তোমাকে তখনই বলেছিলাম, মেয়েদের কথায় না নেচে, চলো মথুরা, বৃন্দাবন কি হরিদ্বার যাই। তা আমার কথা তুমি কানে তুলবে কেন? এখন কি উপায় হবে সেটা বলো, হাত পা গুটিয়ে, বসে না থেকে কিছু একটা ভাবো"। 

মুকুন্দবাবু খুব অবাক হয়ে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন "বোঝো, সিমলা, কুলুর সঙ্গে বাড়িতে ভূতের ঠ্যালার কি সম্পর্ক?"

 আরো অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মুকুন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে মুকুন্দবাবুর স্ত্রী বললেন "এখনো বুঝলে না?"

-নাঃ।

-ভুত প্রেতরা কার সঙ্গে থাকে, কার চ্যালা চামুণ্ডা?

-কার? শিব ঠাকুরের আর মা কালীর।

-অ্যাই, এতক্ষণে মাথা খুলছে। পাহাড় দেখা, বরফ দেখা অনেক হয়েছে। বরফ দেখে কার কটা হাত পা গজিয়েছে শুনি? নামার সময় হরিদ্বার হয়ে চলো, ওখানে পুজো দিয়ে গঙ্গাস্নান সেরে গেলে, সব অমঙ্গল ঘুঁচে যাবে।

-কিন্তু রিজার্ভেসন? আমাদের রিজার্ভেসন তো কালকা থেকে, সেটা ক্যান্সেল করালে হরিদ্বার থেকে রিজার্ভেসন পাওয়া যাবে না, খুব রাশ এই সময়টায়।

-সে আমি জানিনা, তুমি জানো আর জানে তোমার রেল কোম্পানী। মুকুন্দবাবুর স্ত্রী দুমদুম করে পা ফেলে চান করতে ঢুকলেন হোটেলের বাথরুমে, সেখান থেকে বললেন – টুম্পি, রুনুঝুনু, আমার হয়ে গেলে তোরাও চান করে রেডি হয়ে নে, হিড়িম্বা টেম্পলে পুজো দিতে যাবো। মুকুন্দবাবুর মেজমেয়ের নাম টুম্পি আর ছোট দুই যমজ মেয়ের নাম রুনু আর ঝুনু।

 

বাথরুমের দরজা বন্ধ হবার শব্দ শোনার পর টুম্পি চাপা গলায় বাবাকে জিগ্যেস করল –

-কি হতে পারে বলো তো, বাবা? মুকুন্দবাবু ঠোঁট উল্টে খুব চিন্তিত মুখে বললেন –

-কে জানে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। টুম্পি বিজ্ঞানের ছাত্রী, ক্লাস টুয়েল্ভে পড়ে। তার ধারণা, পৃথিবীতে বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছু নেই, সব ব্যাপারের ব্যাখ্যাটা হয়তো আমরা ঠিক ধরতে পারিনা, কিন্তু সেটা বুঝতে পারলেই সব জলবৎ তরলং, দুই আর দুইয়ে চার। একটু চিন্তা করে সে বলল -

-ম্যাগনেটিক ফিল্‌ড্‌। আমার মনে হচ্ছে এটা জিওম্যাগনেটিক ফিল্ডের সমস্যা।

-তার মানে? চুম্বক ঠেলে ফেলে দিচ্ছে সবাইকে! মেয়ের পাণ্ডিত্যে চমকে উঠলেন মুকুন্দবাবু।

-ধুর, এ চুম্বক সে চুম্বক নাকি? আমাদের এই পৃথিবীটাও একখানা বিশাল চুম্বক, ভুলে গেলে? ঝামেলা হচ্ছে পৃথিবীর এই চৌম্বক ক্ষেত্রটা আমাদের লোহার চুম্বকের থেকে বেশ আলাদা। পৃথিবীর উত্তর মেরুটা সামান্য নড়া চড়া করে, তার কারণ হচ্ছে পৃথিবীর পেটের মধ্যে জমে থাকা গরম তরল লোহা। তাছাড়া, কয়েক লক্ষ বছরে একবার, এমনও হয় পৃথিবীর উত্তর আর দক্ষিণ মেরুটাই উল্টে যায়। যদিও খুব সামান্য সময়ের জন্যে। মুকুন্দবাবু অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন টুম্পির কথায় –

-‘আমাকে আর জ্বালাস না, টুম্পি। তোর কি মনে হচ্ছে, আমাদের বারান্দায় যে যখন পা তুলতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীর মেরুদুটো ‘ও কুমীর তোর জলকে নেমেছি’ বলে কুমীরডাঙা খেলছে, আর ওপারে গিয়ে ভেসে উঠছে?

রুনুঝুনু খিক খিক করে হেসে উঠল বাবার কথায়, তার চেয়েও মজা পেল, বাবার কাছে দিদির হেনস্থাতে। দিদিটা এত পাকু, আর এত দিদিগিরি ফলায়, অসহ্য। টুম্পি দুই বোনকে একটুও পাত্তা না দিয়ে বাবাকে বলল –

-তোমার ফোনটা দাও তো, বাবা।

-কেন, এখন আবার কাকে ফোন করবি?

-সরুদাকে।

-সরু কি করবে?

-এমনি, ব্যাপারটা বলব, সরুদা কি বলে দেখি না।

 সর্বজিৎ, ডাকনাম সরু টুম্পিদের মাসতুতো দাদা। খুব ভালো ছেলে, আই আই টি কানপুরে পড়ে, থার্ড ইয়ার। টুম্পির ধারণা বিজ্ঞানে সরুদা হচ্ছে শেষ কথা। মুকুন্দবাবু টুম্পির হাতে ফোনটা দিয়ে উঠে গেলেন ঘরের বাইরে বারান্দায়। রুনুঝুনু নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চুপটি করে দেখতে লাগল দিদির কাণ্ডকারখানা। সরুদাকে ফোনে সব কথা বলল টুম্পি, তারপর নিজের ব্যাখাটাও শোনাল খুব জাহির করে। শুনে সরুদা এত জোরে হাসল হো হো করে, রুনু-ঝুনুও পরিষ্কার শুনতে পেল সেই আওয়াজ। টুম্পির মুখটা খুব করুণ দেখাচ্ছিল তখন। রেগে গিয়ে টুম্পি বলল-

-বেশি হ্যা হ্যা করে হেসো না তো? খুব যে হাসছো, তুমিই তাহলে বল না ব্যাপারটা কি?

-সিম্পল, ভূত। ভবিষ্যত হয়তো থাকবে, বর্তমান নিশ্চয়ই রয়েছে, ভূত তো তাহলে ছিলই। হাসি থামিয়ে সরুদা ফোনে বলল টুম্পিকে। টুম্পি বেজার মুখ করে ভেংচি করে উত্তর দিল –

-‘ভূত তো তাহলে ছিলই’, ছিলই যদি, তাহলে সেটা বর্তমান হয়ে গেল কি করে, শুনি?

-সে অনেক জটিল ব্যাপার, এখন তুই বুঝবি না। আরো ছোট হ’, বুঝতে পারবি।

-ছোট হবো, তার মানে?

-হুঁ ছোট হ’। ছোটরা অনেক কিছু চট করে বুঝে ফেলে, বড়োরা পাকামি করতে গিয়ে কেঁচিয়ে একশেষ হয়। চিন্তা করিস না, রুন্টু-ঝুন্টু ঠিক জানে, দেখে নিস। সরুদা রুনুঝুনুকে আদর করে রুন্টুঝুন্টু বলে। ফোনটা কেটে দিয়ে, টুম্পি বলল-

-বলে কি না, ভূত? এক নম্বরের ভূত।

রুনুঝুনুর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সরুদা কি বলল পুরোটা শুনতে, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না, মা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এমন তাগাদা দিলেন, ফোন রেখে টুম্পি ঢুকে পড়ল বাথরুমে। রুনু ঝুনুকে চুপিচুপি বলল-

-সরুদা, ভূতই বলল, না? কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঝুনু বলল –

-সরুদা, সবই তো জানে।

 

ছোট্ট নিরিবিলি শহর প্রফুল্লনগর তোলপাড়।

 চারপাঁচদিনে মুকুন্দবাবুর কোয়ার্টারের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। লোকাল কেব্‌লে দিনে সতেরবার দেখাচ্ছে ওই বারোর এ-র ছবি। ওরা দুটো ডানপিটে ছোঁড়াকে ধরে বারান্দায় ওঠার এবং ধাক্কা খেয়ে চিৎপাত হবার লাইভ রেকর্ডিং করেছিল। সেটা স্লো মোশনে লাগাতার দেখাচ্ছে, সিনেমার ফাঁকে ফাঁকে। কোয়ার্টারের সামনের মাঠটায় মেলার মতো ভিড়। লাল আর বেগুনি রংয়ের কাপড়ের তাঁবু ফেলে আস্তানা গেড়েছে এক জটাধারি সাধু, সঙ্গে তার দুই চেলা। সাধুবাবার গা হাত পা টিপছে, আর মাঝে মাঝে ব্যোম শংকর হুংকার দিচ্ছে। সাধুবাবা বলছে – ওই বাড়িতে বাসা বেঁধেছে বেম্মদত্তি। ইয়াব্বড়ো গোঁফ, মাথায় বাবরি চুল আর কাঁধে ধবধবে পৈতে। দখল করে নিয়েছে বাড়িটা, কাউকে ঢুকতে দেবেনা। যদিও অনেক হ্যাপা কিন্তু এর একমাত্র সমাধান “মহাপ্রবেশ যজ্ঞ”।  দেবাদিদেব মহাদেবের সাক্ষাৎ চেলা এই সাধুবাবা, তাঁর আদেশ – যা বেটা, পার কর দে মুকুন্দ্‌কো অওর উস্‌কা পরিবারকো, বসা দে উন্‌কা ঘর। মহাদেবের আদেশেই হিমালয় থেকে সরাসরি সাধুবাবা এসেছে। আর দেবতার কি লীলা, সুদূর কৈলাসেও বিখ্যাত হয়ে গেছেন মুকুন্দবাবু!     

 বিস্তর লোকজন আসছে, মুকুন্দবাবুর কোয়ার্টার দেখতে, আর সেই সঙ্গে সাধুবাবার কাছে ভাগ্য গণনা করতে। বাবামহাদেবের সঙ্গে যে সাধুবাবার রোজ কথা হয়, সেটা জানতে আর কারো বাকি নেই। সেইসঙ্গে চারদিকে বসে গেছে, অনেক ফেরিওয়ালা। এগরোল থেকে জিভে জল আনা আচারের স্টল। আইসক্রিম, বুড়িরচুল, ফুচকা, চুরমুর, আলুকাবলি সারাদিনে এত বিক্রি হচ্ছে, সামলাতে পারছে না ফেরিওয়ালারা।

 মুকুন্দবাবুরা হরিদ্বার ঘুরে যেদিন আসানসোলে ট্রেন থেকে নামলেন, স্টেশনের বাইরেই শুনলেন, মিনিবাসের কণ্ডাকটার হাঁকছে মুকুনবাড়ি, মুকুনবাড়ি। বাসের গায়ে লেখা আছে প্রফুল্লনগর-আসানসোল, এটা যে তাঁদের ওদিকেই যাচ্ছে, সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই, কিন্তু মুকুনবাড়ি স্টপেজটা কোথায় তিনি বুঝতে পারলেন না। প্রফুল্লনগর যাবার বাস চিরকাল তিনি আসানসোল বাসস্ট্যান্ড থেকেই ছাড়তে দেখেছেন। এবারে স্টেসন থেকে ছাড়তে দেখে তিনি অবাক হলেও লটবহর নিয়ে বাসে উঠে পড়লেন, সিটও পেয়ে গেলেন সকলে। আরো লক্ষ্য করলেন পাঁচমিনিটের মধ্যে বাস ছেড়ে দিল, কারণ বাসটা ভরে গিয়ে গেটে দুজন ঝুলছে! পিছনে আরো দুটো প্রফুল্লনগরের বাস দাঁড়িয়ে, কণ্ডাকটারগুলোও ডাকছে মুকুনবাড়ি, মুকুনবাড়ি। সে বাস দুটোও ভরতে দেরি নেই, এত লোকের ভিড়। 

 বাড়ির যতো কাছাকাছি আসছেন, ততই দুশ্চিন্তা বাড়ছে মুকুন্দবাবুর, আর তাঁর স্ত্রী ঘন ঘন হাত জোড় করে মাথায় ঠেকাচ্ছেন হরিদ্বারের পুষ্প। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বললে মুকুন্দবাবুর দুশ্চিন্তার চাপটা একটু হয়তো কমত, কিন্তু ভিড়ের জন্যে বলতে পারছিলেন না। কিন্তু রূপনারায়ণগঞ্জ বাসস্টপে ঘোষবাবু বাসে উঠে মুকুন্দবাবুকে দেখতে পেয়ে দরজা থেকেই বললেন – কি মুকুন্দবাবু, বাড়িতে জলজ্যান্ত বেম্মদত্তি পুষছেন, আর আমরা কেউ জানতেই পারলাম না! মুকুন্দবাবু যে ভয়ে এতক্ষণ কথা বার্তা বলছিলেন না, সেটাই ঘটে গেল। বাসের সব লোক মুকুন্দবাবুর দিকে গোলগোল চোখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একজন দেহাতি ওই ভিড়ের মধ্যেই নীচু হবার চেষ্টা করতে করতে বলল – গোড় লাগি, মহারাজ, গোড় লাগি। বোলো মুকুনমহারাজ কি জয়। বাসভর্তি লোক এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল – জয়। লাগাতার জয়ধ্বনি শুনতে শুনতে মুকুনবাড়ির রহস্যটাও তাঁর বোধগম্য হল – মুকুন্দবাড়ি, দেহাতি ভাষায় মুকুনবাড়ি হয়ে গেছে।

 আমলাবাগান মার্কেটের বাসস্টপটাই মুকুন্দবাবুর বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছে। একটু আগেই তিনি মেয়েদের তাড়া দিলেন, রেডি হ’ নামতে হবে সামনের স্টপে। সেই শুনে ঘোষবাবু, আর বাসের কণ্ডাক্টর হৈ হৈ করে উঠল। বাস তো আপনার বাড়ির সামনে দিয়েই যাবে, সবাই নামবে, ওখানেই খালি হয়ে যাবে। ভক্তি গদগদ সেই দেহাতি লোকটা নীচু হয়ে বলল – ‘পরেশান মত হোইয়ে মহারাজ, সব হি আপকা কিরপা’তারপর দুহাত তুলে বলল ‘মুকুনদেও কি জয়’, সমস্বরে রব উঠল ‘জয়’।

 সত্যি সত্যি বাসটা রাস্তা পালটে তাঁর বারোর এ কোয়ার্টারের সামনে থেমে গেল। হুড়মুড় করে নামতে লাগল বাসের সব যাত্রী। সবার শেষে মুকুন্দবাবুরা ধীরে সুস্থে নেমে এলেন, তাঁদের লটবহর নামিয়ে দিল বাসের যাত্রীরাই! বাস থেকে নামা মাত্র চেনাজানা পড়শিরা ঘিরে ধরল তাঁদের। পাশের কোয়ার্টারের বক্সিদা আর বৌদি বললেন – ‘এবেলা আমাদের বাড়ি চলো, তেতেপুড়ে এসেছ, একটু জিরিয়ে নাও। ওবেলা দেখা যাবে যাগযজ্ঞ কি করলে কি করা যায়। মুকুন্দবাবু আর তাঁর স্ত্রী হকচকিয়ে দেখতে লাগলেন সবকিছু, মাঠের মেলা, মাইকের ভজন, চারপাশের গিজগিজে ভিড়।

 টুম্পিও হতভম্ব হয়ে বাড়ির লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছিল, তাদের বাড়িটা নিয়ে এমন কাণ্ড হচ্ছে! এদিকে রুনু আর ঝুনু লোহার গেট খুলে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তায়। দুইবোন হাত ধরাধরি করে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে দিদিকে ডাকল-

-এই মেজদি, বাড়ি ঢুকবি না। ডাক শুনে টুম্পি ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখেই চিৎকার করে উঠল –

-কি করছিস কি তোরা, পালিয়ে আয়। তার চিৎকার শুনে আশেপাশে সকলেই চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠল – ‘না’ততক্ষণে রুনুঝুনু উঠে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়, দুজনের মুখেই হাসি, টুম্পিকে বলল –

-‘বাবার থেকে চাবিটা চেয়ে আন না, মেজদি, দরজাটা খুলি’।

 

বাসায় ঢুকেই পনের দিনের পড়ে থাকা ঘরের ধুলো সাফ করতে লেগে গেলেন মুকুন্দবাবুর স্ত্রী। মুকুন্দবাবু চট করে বেরিয়ে এনে দিলেন আলু, ডিম আর টুকটাক জিনিষপত্র। টুম্পির ঘাড়ে পড়ল ভাত আর ডিমের ঝোল রান্নার দায়িত্ব। গোছগাছ সেরে, চান খাওয়া করতে করতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি আর চরম দুশ্চিন্তার অবসানে, সকলেই ঘুমিয়ে নিলেন ঘন্টা দুয়েক। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাইরে বারান্দায় এসে বসলেন মুকুন্দবাবু, তাঁর স্ত্রী আর টুম্পি। রুনুঝুনু চা বানাচ্ছে তিনজনের জন্যে। রাস্তা পার হয়ে সামনের বিরাট মাঠটা আগের মতোই শুনশান। গোটা পাঁচেক কুকুর কি সব শুঁকে শুঁকে বেড়াচ্ছে আর অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে, সাধুবাবার ফেলে যাওয়া ধুনি থেকে। এসব দেখে কে বলবে কয়েক ঘন্টা আগেও ওখানে বসেছিল জমজমাট মেলা। রুনুঝুনু বাবা-মা আর দিদিকে চা দিয়ে, বারান্দার ধারে দাঁড়াল। সামনের মাঠের দিকে তাকিয়ে রুনু বলল –

-ইস, অমন সুন্দর মেলাটা কি রকম ভেস্তে গেল, না? ঝুনু উত্তর দিল-

-সত্যি, এই সময় দিব্বি চুরমুর খাওয়া যেত, কতদিন চুরমুর খাওয়া হয় নি, বল?

-আর ফুচকা? ইস, একদম ঘরের সামনে, বাটি ভরে তেঁতুলজল নিয়ে নেওয়া যেত, কি মজা। ইস।

দুবোনে জিভে জল টানার শব্দ করে হাসল। মুকুন্দবাবু তিন চার চুমুক চা খেয়ে ওদের ডাকলেন –

-রুনু, ঝুনু, এইদিকে আয় দেখি, আমার কাছে বোস। দুজনে বাবার পাশে এসে বসল। মুকুন্দবাবু আবার বললেন –

-এবারে বল তো, ব্যাপারটা কি হয়েছিল? রুনুঝুনু ভয় পাওয়া মুখে বসে রইল মুখ নীচু করে।

-কোন ভয় নেই, বল না কি হয়েছিল। আমি জানি, তোরা সব জানিস। আমাদের সকলের দুশ্চিন্তায় ঘুম ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু আমি দেখেছি তোরা দুটিতে বেশ মজা পাচ্ছিলি আমাদের কথাবার্তায়। রুনু ঝুনুর মুখের দিকে একবার তাকালো, ঝুনু ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে রুনুর কাঁধে হাত রাখল। রুনু বলল –

-বেড়াতে যাবার দিন, তুমি বললে না, পনের দিন বাড়িটা শুধু দুটো তালার ভরসায় ছেড়ে যাওয়াটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে, তাই – রুনু একটু দ্বিধা নিয়ে থেমে গেল।

-তাই, কি? মুকুন্দবাবু অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন। টুম্পি এবং মুকুন্দবাবুর স্ত্রীও আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন দুই বোনের দিকে।

-তাই, আমরা রুকু আর সুকুকে বলে গিয়েছিলাম, পাহারা দিতে। আমরা পাঁচজন ছাড়া, বারান্দায় কাউকে যেন উঠতে না দেয়।

-রুকু-সুকু, তারা আবার কে?

-ভূত।

-ভুত! যমজ ভুত?

-হ্যাঁ। ওরাও যমজ, তবে ভাই।

-তাদের কে তোরা চিনলি কি করে? পেলি কোথায়?

-ক্লাস সিক্সের রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল বলে তুমি আর মা বকবে ভয়ে আমরা দুজনে ওই গাছতলায় বসেছিলাম। মাঠের দিকে হাত তুলে গাছটা দেখাল রুনু। মুকুন্দবাবুর স্ত্রী বললেন –

-সর্বনাশ, ওটা তো পাকুড় গাছ! মুকুন্দবাবু হাত তুলে স্ত্রীকে চুপ করতে বললেন। রুনু আবার বলতে শুরু করল,

-সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল, হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শুনে আমরা চমকে উঠলাম। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাইনি প্রথমে। তারপর দেখলাম আমাদের থেকে হাত তিনেক দূরে এইটুকুনি একটু চিকিমিকি আলো, আর সেদিক থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজ। আরো ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে পেলাম, ফ্যাকাসে রঙের সুকুকে। সুকু হাঁটু ধরে কাঁদছে, তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে ঝাপসা রুকু, আর খুব চেষ্টা করছে সুকুকে ভুলিয়ে রাখতে।

-তোদের ভয় করে নি? মুকুন্দবাবু জিগ্যেস করলেন।

-না, আমরা এমনিতেই তোমাদের ভয়ে ছিলাম, আর কতো ভয় পাবো? মুকুন্দবাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-বোঝো কাণ্ড, তারপর?

-ঝুনুই প্রথম কথা বলল, জিগ্যেস করল তোমরা কারা? ও কাঁদছে কেন?

-আমার নাম রুকু, আর ও হচ্ছে সুকু, আমরা দুভাই, ঠিক তোমাদের মতো যমজ। আজকে ফুটবল খেলতে গিয়ে পল্টুর বলে ও এমন জড়িয়ে গেল, হাঁটুর ছাল উঠে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে, তাই কাঁদছে।

-ওখানটায় আলো জ্বলছে কেন?

-ওমা, তাও জানো না, তোমাদের যেমন ছাল উঠে গেলে রক্ত বেরোয়, আমাদের বেরিয়ে পড়ে, আলো। রাত্রে আলো আর দিনের বেলায় কালো। আমাদের চামড়ার রং আবার উল্টো, দিনের বেলা আলো আর রাতের বেলা কালো। সেই জন্যেই তো আমাদের চট করে দেখা যায় না। মুশকিল কি জানো, ওর ওই কাটা থেকে যতো আলো বেরোবে, ও ততো ফ্যাকাসে হয়ে যাবে, আর ওকে দেখতে পেয়ে যাবে মানুষেরা। তা হলেই আমাদের খুব বিপদ। সবাই তো তোমাদের মতো ভালো নয়।

সেদিন আমরা ওদের দুজনকে আমাদের বাড়ি এনেছিলাম, ওরা ওই পেয়েরা গাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল চুপটি করে। আমরা ডেটল দিয়ে সুকুর হাঁটুটা মুছে একটা ব্যান্ড-এড লাগিয়ে দিতেই, ওর আলো পড়া বন্ধ হয়ে গেল। তিন চারদিনের মধ্যে সেরেও উঠল সুকু। সেই থেকে আমাদের সঙ্গে খুব ভাব।

-আহারে, মরে যাই, ছেলে দুটোর মা নেই বুঝি? চোখের জল মুছে মুকুন্দবাবুর স্ত্রী বললেন।

-আঃ দাঁড়াও না। সেদিন আমি আর তোদের মা তোদের কে রেজাল্ট নিয়ে খুব বকেছিলাম মনে আছে, তোরা ভয় পাস নি?

-বাঃরে, ভয় পাবো কেন? ভূতকেই ভয় পেলাম না যখন, তখন তোমাদেরকে কিসের ভয়?

টুম্পি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল –

-সরুদা, কি করে জানলো, ওদের কথা?

-গতবার সরুদা যখন এসেছিল, আমাদের সঙ্গে ওদের কথা বলতে দেখে ফেলেছিল যে, জিগ্যেস করেছিল ঝাপসাদুটো কে রে?

-সরুদা তিনদিনের জন্যে এসে দেখে ফেলল আর আমি দেখতে পেলাম না এতদিনেও।

-ছোট হ, দিদি, তুইও দেখতে পাবি। গম্ভীর মুখে টুম্পি বলল-

-হুঁ, সরুদাও একই কথা বলেছিল সেদিন। বড়ো হতে হতেও, ছোট্ট হতে হবেতা না হলে...


-**-

রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৫

মশা-ই

 

[ আজকাল বাংলা সাহিত্যচর্চা করে, চায়ের জলও গরম হয় না - অতএব কিছু স্পনসর যোগাড় করে এই গল্প লিখতে হল দুটো পয়সার লোভে। ]


[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“বালকেশরী”®

রাত্রে শোবার আগে চুলের গোড়ায় রগড়ে নিন, চুল পড়া বন্ধ হয়, নতুন চুল গজায়

(ব্যবহারবিধিঃ ব্যবহারের আগে হাতে গ্লাভ্‌স্‌ পড়ে নেবেন, হাতের তালুতে চুল গজালে কোং দায়ি নয়)

ণকোল হইতে সাবধাণ]

রাত্রে শোবার আগে চুল বাঁধা মণিমালার অনেকদিনের অভ্যেস। খাওয়া দাওয়ার পর রান্নাঘরে সব গোছগাছ করে এসে সে রোজ ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়ায়। চুলের গোড়ায় ঘষে ঘষে বালকেশরী মাখে। সে তেলের দারুণ খোশবু। আঁচড়ানো শেষ করে খুব টান টান করে চুল বেঁধে বিনুনি বানায় রোজ। বিনুনি বাঁধার সময় ঘাড়টা বাঁ দিকে একটু হেলিয়ে দেখতে থাকে বিনুনির পাক, আর চাপা ঠোঁটে ধরে রাখে কালো ফিতের একটা ধার। অবাধ্য দু একটা চুল – তার কপালে উড়ে এসে জুড়ে বসে। কখনও শাড়ির আঁচল একটু সরে যায়, জানালার পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়ানোর মতো বেরিয়ে পড়ে ব্লাউজে ঢাকা বুকের এক আধটা দুষ্টু। অথবা সামান্য মেদ সমৃদ্ধ পেটের দুষ্টুটা। 

সিগারেট টানতে টানতে বিছানায় শুয়ে লোলুপ নজরে এই সব দেখছিল সুকান্ত। গায়ে তার জন্মদিন আর লুঙ্গি। এত রাত্রে মণিমালার শোবার ঘরের বিছানায় আধশোয়া সুকান্ত লুঙ্গি পড়ে সিগারেট টানছে কী করে? কী করেই বা সে এখন বিছানা থেকে নেমে মণিমালাকে জড়িয়ে ধরতে পারল পিছন থেকে? মণিমালার ঘাড়ে ঠোঁট রাখতে পারল? কেনই বা শিউরে উঠল মণিমালা আর প্রশ্রয়ের হাসি মুখে নিয়ে গলা দিয়ে আদুরে মেকুরের মতো আওয়াজ করতে পারল? তার কারণ সুকান্ত মণিমালার স্বামী। স্বাভাবিকভাবেই মণিমালাও সুকান্তর বউ।

 [গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“সুখশয্যা”®

মনের মতো ম্যাট্রেস

ঘুমে রাত করে দিন ভোর, সুখ স্বপ্নে থাকুন বিভোর,

সকাল হবে একদম ফ্রেস]

 

চুল বাঁধা হয়ে গেল, চিরুনিতে লেগে থাকা চুলগুলি ছাড়িয়ে নিয়ে মণিমালা ছোট্ট একটা নুটি বানিয়ে তুলল, তারপর অস্ফুটস্বরে সুকান্তকে বলল অ্যাই ছাড়ো না, আজকে ঘুমোবে না, নাকি? সুকান্ত ছেড়ে দিতে, মণিমালা মুচকি হেসে বলল লক্ষ্মী ছেলে, সোনা ছেলে। বলতে বলতে বেরিয়ে গেল ঘরের লাগোয়া বারান্দায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলের নুটিতে সশব্দে একটু থুথু দিয়ে, নুটিটা ছেড়ে দিল শূণ্যে। বেচারা চুলের নুটি! একটু আগেও সুন্দরী রমণীর কেশদামের অংশ হয়ে বেশ ছিল, শ্যাম্পু আর বালকেশরীতে নিত্য নিষিক্ত হয়ে। এখন এই প্রায় মধ্যনিশিতে অবহেলিত, পরিত্যক্ত হয়ে, মুক্ত বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল – কার জানালা দিয়ে কোথায় ঢুকে পড়বে কে জানে!

 

বারান্দার দরজা বন্ধ করে, মণিমালা পাশের ডাইনিং হলে গেল, ফ্রিজ খুলে একটা বোতল আর টেবিল থেকে দুটো গ্লাস নিয়ে এল। একটা গ্লাসে জল ঢেলে বলল জল খাবে? সুকান্ত গোমড়া মুখে ঘাড় নেড়ে না বলল। মণিমালা হাতে ধরা গ্লাসের জলটা এক নিশ্বাসে খেয়ে নিয়ে আওয়াজ করল আঃ, বলল সেই থেকে যা তেষ্টা পেয়েছিল। গ্লাস দুটো আর বাকি জলের বোতলটা মাথার কাছে ছোট টেবিলে রেখে, মণিমালা সুখশয্যায় বসতে এসেও আবার উঠে গেল। ডাইনিং টেবিলের ওপরে রাখা ভাজা মৌড়ির কৌটো নিয়ে এসে খাটের পাশে দাঁড়াল। কৌটো থেকে একটু ভাজা মৌড়ি ডানহাতের তালুতে ঢেলে বলল ভাজা মশলা খাবে? সুকান্ত হাত বাড়াল না, হাঁ করল। মণিমালা নীচু হয়ে সুখশয্যায় শোয়া সুকান্তের মুখের সামনে হাত নিয়ে ঢেলে দিল ভাজা মৌড়ি। সুকান্ত মুখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরল মণিমালাকে, টেনে নিল নিজের বুকের ওপরসুকান্তর বুকে মণিমালার বুক থেপসে গেল। একটুও আগুন জ্বলল না, কিন্তু সুকান্ত পুড়ে ছাই হতে লাগল। ছাড়ো, ছাড়ো আমার এখনো রাজ্যের কাজ বাকি। আমার পাশে শোয়াটাও তোমার একটা কাজ। ছাই কাজ। ঠিক তাই, সেই থেকে পুড়ে পুড়ে আমি ছাই হচ্ছি। ইস, আমি এখন তাহলে এসে ছাইয়ের গাদায় শুলাম? ছাইয়ের গাদা, উঁ, ছাইয়ের গাদা, দেখাচ্ছি কেমন ছাইয়ের গাদা। নরম সুখশয্যার ওপর সুকান্ত চেপে ধরল আগুনতপ্ত মণিমালাকে। তারপর মণিমালার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলল মশলা খাবে। মণিমালার দু চোখে সর্বনাশের ডাক, তার আঁখিপাখি পাখা ঝাপটিয়ে বলল খাবো। সুকান্ত ডুব ডুব ডুব দিল মণিমালার অধরে, তার জিভ মৌড়ির কয়েকটা দানা সমেত ঢুকে পড়ল মণিমালার অন্দরে।    

 

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“রমণীয় বস্ত্র বিপণি”®

সৌন্দর্যে সেজে ওঠার শেষ কথা আমাদের বিপুল বস্ত্র সম্ভার

শাড়ি শায়া ব্লাউজের একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান

বিঃ দ্রঃ- আমরা ‘শরাবি’ শাড়ি, ‘নটখট’ প্যান্টি ও ‘হাসিনা’ ব্রেসিয়ারের একমাত্র স্টকিষ্ট

আমাদের কোন শাখা নাই]

 

খোলা জানালা দিয়ে উড়ে এসেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। জবর ভোজের এমন সুন্দর সুযোগ আর পাব কিনা জানি না। অন্যদিন খাটের ওপর মশারি ঝোলে, সারারাত কেটে যায় মশারির ফাঁক খুঁজতে অথবা মশারির দেওয়ালে ছোট্ট ফুটো খুঁজতে। যদি কোনরকমে ঢুকতে পাই। মশারির চালের দিকে যাওয়া যায় না, এতো হাওয়া! দু একদিন মশারি তুলে বাথরুমে গেলে, সেই ফাঁকেও ঢুকে পড়েছি মশারির ভেতর। যদিও ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক, অনেক সময় এক পেট গিলে মশারি থেকে বের হতে না পেরে, সকালবেলায় হাতের চাপড়ে মৃত্যু ঘটে গেছে আমার দু একজন সঙ্গীর। আজ মশারি নেই। তার ওপর দুজন মানুষ একসঙ্গে। যে অবস্থায় আছে, হি হি, আমরা হলে বলতাম মেয়েটা কদিন পরেই ডিম দেবে। মানুষগুলো খুব চালাক, ডিম পাড়ে না। মেয়েগুলো বাচ্চাকে পেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। খাটের ওপর ভাঁজ করা মশারির একধারে বসে দেখতে লাগলাম। আর অপেক্ষায় রইলাম সুযোগের।

 

ছেলে মানুষটা খালি গা হয়ে গেছে, এবার মেয়ে মানুষটা খালি গা হচ্ছে। খাটের মাথা থেকে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে গেল শরাবিখানা, খাটের মাথায় হাসিনাটা লটকাতে লাগল। আর সবশেষে নটখটটা বিছানাতেই পড়ে রইল ওদের পায়ের কাছেআমি ওদের দুজনকে দেখে মুখ চাপা দিলাম, লজ্জায়। ছি,ছি, এতোটুকু লজ্জা নেই গা, বেহায়া একনম্বরের। হি হি, হি হি হাসির শব্দে আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, আরো কয়েকটা নচ্ছার ছুকরি আমার মতোই মশারির চালে বসে বসে সব দেখছে। কি তাদের হাসাহাসি, আর কি তাদের ঢলাঢলি!

 

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“হলাহুল”®

ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, এনসেফেলাইটিস হইতে বাঁচার একমাত্র উপায় হলাহুল

প্রত্যেকটি মশাকে ধরিয়া, হুলের মধ্যে একবিন্দু সেবন করাইলেই অব্যর্থ ফল

বিফলে মূল্য ফেরত।

নবদম্পতিদের জন্য বিশেষ ছাড় ২০% পর্যন্ত*

*শর্তাবলী প্রযোজ্য]

 

কি যে বাপু করছে এই মানুষ জোড়া কে জানে, সেই থেকে জোড় লেগে রয়েছে, তবু ঝুটোপুটির অন্ত নেই। আমাদের বাবা এত কল্লা নেই, উড়তে উড়তেই ছেলেগুলো আমাদের পিঠ খামচে বসে পড়ে, একটু সময় হতে না হতেই মিটে যায় ব্যাপারটা। খিদে পেয়েছে খুব, তবে এই সময় গায়ে বসাও যাবে না, হুটোপুটিতে কোথায় চাপা পড়ে শেষ অব্দি প্রাণটাই খোয়াব নাকি? তার চেয়ে আরেকটু অপেক্ষা করাই ভালো।

 

তাছাড়া আমাদের শাস্ত্রেও বলা আছে এই সময়ে কাউকে কোন চোট আঘাত করতে নেই। মানুষদেরই কেউ একজন হোমড়াচোমড়া বহুদিন আগে এমনই একটা কেলেংকারি করে সারাটা জীবন পস্তেছিল খুব। হয়েছিল কি, বনের মধ্যে একটা হরিণ তার বউকে খুব আদর করছিল। দুজনেরই তখন যাকে বলে বিহ্বল অবস্থাএদিকে সেই হোমড়াচোমড়া মানুষটা ওই বনেই শিকার করতে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেই জায়গাতেই চলে এসেছে, যে জায়গায় হরিণদুটো ফস্টিনস্টি করছিল। সে মানুষটার আর তর সয় নি, ছুঁড়ে দিল দু দুটো তীর, ব্যস পটল তুলল ছেলে হরিণটাও, মেয়ে হরিণটাও। বেচারারা লক্ষ্যই করে নি কিনা, করলে তো পালিয়ে বাঁচত। সে যাই হোক মরার আগে তারা খুব শাপ দিলে সেই হোমড়াচোমড়াকেযতোই তুমি হোমড়া হও, হে, সারাজীবন তুমি আর ভালোবাসতে পারবে না। ও মা, সত্যি সত্যি সেই হোমড়াচোমড়া মানুষটা সারা জীবনে কিচ্ছু করতে পারে নি, দু দুটো বউ থাকা সত্ত্বেও। করবে কি তার তো হি হি খাড়াই হয় না। অন্য লোকে এসে তার দু বউকে ছেলে দিয়ে যেত। সেই থেকে আমাদের মানা, ওই সময় কোন চোট দেওয়া যাবে না, এমনকি হুলও না।

 

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“স্বাস্থ্যরক্ষা ডায়াগ্নস্টিক এণ্ড রিসার্চ সেন্টার”®

সুলভে সকল চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত আছে।

যেখানে সেখানে জল জমতে দেবেন না, জমা জল মশার আঁতুড় ঘর।

রাত্রে শোবার সময় মশারি টাঙাতে ভুলবেন না।

জনস্বার্থে প্রচারিত।]

 

মেয়েটা এখন যেরকম ডাকাডাকি করছে, মনে হচ্ছে হয়ে এসেছে। আমি আমার ডানাদু্টো আর হুলটাকে একবার চেক করে নিলাম। বলা যায় না, বয়েস হয়েছে তো, লাস্ট মোমেন্টে হয়তো ডানা দুটো খুলল না, বা দেখলাম হুলটা একটু ভোঁতা হয়ে গেছে ওদিকে নীচে, যা ভেবেছিলাম তাই, হয়ে গেছে, ছেলেটা মেয়েটার থেকে নেমে পাশে শুল, আর মেয়েটা ছেলেটার বুকে মাথা রাখল। দুজনে খুব আরাম করে সুখশয্যায় শুয়ে চোখ বুজল। আমি এবং আমার দেখাদেখি অন্যরাও একসঙ্গে নেমে এলাম, ভাগাভাগি করে বসে পড়লাম ওদের গায়ে।

 

মণিমালার কদিন ধরেই খুব জ্বর। প্রথমে মনে হয়েছিল সাধারণ সর্দিজ্বর। তারপর ভাইরাল ফিভার। ডাক্তারবাবু উল্টে পাল্টে নানান অ্যান্টিবায়োটিক আর প্যারাসিটেমল ট্রাই করেও জ্বরতো ছাড়লই না, দিন দিন দুর্বল হয়ে অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠতে লাগল। ডাক্তার প্রেসক্রাইব করলেন, ব্লাড টেস্ট করানোর জন্যে। ব্লাড রিপোর্টে পাওয়া গেল প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের প্যারাসাইটঅর্থাৎ ম্যালেরিয়া, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। অ্যাডমিট করে দেওয়া হল স্বাস্থ্যরক্ষা ডায়াগ্নস্টিক এণ্ড রিসার্চ সেন্টারে।

 

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“টুকটুকি”®

সধবার নিত্য সঙ্গী টুকটুকি সিন্দুর ও তরল আলতা।

(প্রতারিত হইবেন না, প্রতারিত হইবেন না)

কিনিবার পূর্বে ৺শ্রীযুক্ত হারাধন পতিতুণ্ডর ছবি ও স্বাক্ষর দেখিয়া লইবেন)]

                                       

দিন কতক খুব যমে মানুষে টানা পোড়েনের পর, মণিমালা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করল। অনেকে বলল মণিমালা নিখাদ সতী, জলজ্যান্ত স্বামী রেখে, হাতের শাঁখানোয়া, সিঁথিতে ডগডগে টুকটুকি সিঁদুর নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গে চলে গেছে। টুকটুকি অলক্তক রাগে রাঙানো তার দুই রাতুল চরণের ছাপ সাদা কাগজে তুলে নিল সকলে। শ্রাদ্ধের দিন ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে বাসরে রাখা হল সেই চরণ চিহ্ণ। তার ওপরে লেখা, ‘তোমা বিনা সংসার নিদারুণ শূণ্য’ আর নিচেয় লেখা ‘দুটিহাত ভরে দিলে সাধ্বীর পুণ্য’। সুকান্তর ক্লাস নাইনে পড়া ডেঁপো ভাগ্নের এমন কাব্য প্রতিভা সকলকে অবাক করে দিল।    

 

মণিমালা খুবই ভাগ্যবতী তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে না মরে যদি আজ সুকান্ত মারা যেত, তার কপালে অশেষ দুঃখ ছিল। পাড়া প্রতিবেশীরা চোখ গোলগোল করে, গালে আঙুল ঠেকিয়ে বলত, যেদিন ও বউ হয়ে এ বাড়িতে ঢুক্কেছে সেদিনই আমি বুয়েছিলাম গো দিদি, এ রাক্কুসী আমাদের সুকুকে গিলে খেতে এয়েচে। তুমি সরল মনের মানুষ দিদি, কোন ঘোরপ্যাঁচ নেইওর বুকের গড়ন দেখেচ? আর পাছা? সব ডাইনীর লক্ষণ, থা নইলে আমাদের সুকু, অমন ডাকাবুকো স্বাস্থ্য, বেঘোরে প্রাণ দেয়? মায়ের কোল এমন করে খালি করে দিতে আছে, রে পোড়ারমুকি। অশ্রুহীন চোখের জল মুছতে আঁচলে মুখ ঢাকত সেই প্রতিবেশী। সেই বিদ্যাসাগরও নেই এবং তাঁর বিধবা-বিবাহ অ্যালাউন্সও নেই, মণিমালার চট করে বিয়ে হওয়াও মুশকিল হত মাঝের থেকে বেশ কিছু ছুঁচকো লোকের আনাগোনা বাড়ত, তাকে ফুঁসলে নির্দায় ফস্টিনস্টি সারার ধান্দায়।

 

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“গ্রীন লিও”®

প্রতিটি সন্ধ্যায় হতে থাকুক জমজমাট মজা,

আপনি, আপনার বন্ধুরা সঙ্গে বনের রাজা।  

(পরিশ্রুত পানীয় জল – ২৫০, ৩৭৫, ৭৫০ ও ১০০০ মিলির বোতলে উপলব্ধ)]

 

মণিমালার মৃত্যুটা সুকান্তর বুকে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে দিল। বহুদিন আগে শরৎ চাটুজ্জের এক মুকুজ্জে হিরোর ধারা অনুসরণ করে, সুকান্ত রোজ সন্ধ্যেবেলা সস্তা বারের এক কোণায় এসে জুটতে লাগলতার সঙ্গী হল গ্রীণ লিওর হাল্কা সবুজ ৭৫০ মিলির বোতল। আগে যাদের সে সযত্নে এড়িয়ে চলত, সেই সেব মদ্যপ বন্ধুরা এখন তার নিত্যসঙ্গী ও প্রাণের দোসর। সারাদিন বাবা-মা, বন্ধুবান্ধবের, আবার বিয়ে করে নতুন সংসার পাতার সদুপদেশে তার কানপাতা দায় হয়ে উঠেছে। তার এই সব ফিরে পাওয়া বন্ধুরা ঠিক তার উল্টো। তার এই প্রেম যে অমর এবং মণিমালা মারা গেলেও, সে যে তার এই অমর প্রেমের নিত্যসঙ্গী হয়ে তার পাশটিতেই থাকবে, এমন নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি সুকান্ত পেয়েছিল তার এই বন্ধুদের থেকেইতবে একটু যত্ন করতে হবে। সেটা কি রকম? তার এই প্রেম যেন একটি ছোট্ট চারাগাছ। একে নিত্য গ্রীন লিও সিঞ্চনে, বাড়িয়ে মহীরূহে পরিণত করাই এখন সুকান্তর নিত্যব্রত হওয়া উচিৎ। আর এই ব্রতপালনে তার বন্ধুরা সানন্দে নিত্যসঙ্গী হতে রাজি।

 

মাস ছয়েক পর এক রোববার তার জেঠতুতো বোন আর মা, সুকান্তর ঘুম ভাঙালো একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে। অনেকটা মণিমালার মতো দেখতে। ঘুমভাঙা চোখে তার মন্দ লাগল না। কিন্তু মণিমালাকে সে কী করে ভুলে যাবে? সে মাকে বলল পাষাণী। বোনকে বলল নারদ-বুড়ি, আমাদের দাম্পত্যে ভাঙন ধরাতে এসেছিস? মা আর বোন রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, বিছানায় ফেলে গেল প্রায়-মণিমালার ছবি। ওরা বেরিয়ে যেতে ছবিটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখল সুকান্ত। নাঃ, বিয়ে যদি করতেই হয় এই মেয়েকে নয়। এক মণিমালা থাকবে তার বুকের ভেতর, আর বাইরে ঘুরবে আরেক প্রায়-মণিমালা, এ অসম্ভব। ছবি রেখে সুকান্ত উঠে পড়ল।

    

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“সাতপাক.কম”®

 আছে পাত্র পাত্রী শতশত, বেছে নিন ঠিক মনের মতো,

 (বিধবা, বিপত্নীক ও ডিভোর্সি-দের জন্য বিশেষ ছাড়*)

*নামমাত্র বিবাহ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ]

 

ব্রেকফাস্ট টেবিলে নারদ-বুড়ি বোন ল্যাপটপে সাতপাক.কম খুলে মেয়ে দেখছিল। সুকান্তকে দেখে রাগে দুমদুম পায়ের শব্দে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। ল্যাপটপের পর্দায় একের পর এক সুন্দরীর ছবি আসতে লাগল লাগাতার। আড়চোখে সুকান্ত দেখতে লাগল আর খেতে লাগল। বাটার টোস্ট, কলা, অমলেট আর চাআনমনে অমলেটের আধখানা খেয়ে ফেলার পর সুকান্ত মাকে খুব ধমকাল। মণিমালা মারা যাওয়া্র পর থেকে সে নিরিমিষ খাচ্ছিল, তার নারদ-বুড়ি বোনের কারসাজি এটা, বুঝতে তার বাকি রইল না। বহুদিন পর অমলেটটা তার বেশ লাগল, কিন্তু পুরোটা খেল না, একটুখানি ফেলে রাখল প্লেটে। অমলেট নিয়ে মাকে ধমকানোর সময়, অনেকগুলি মেয়ের ছবি মিস হয়ে গিয়েছিল। সুকান্ত আশে পাশে কেউ নেই দেখে ফটো ফাইলটা রিওয়াইন্ড করে দেখতে দেখতে চায়ে চুমুক দিল। খিক খিক হাসির আওয়াজটা কানে এলেও, ওটা তার মনের ভুল হিসেবে পাত্তাই দিল না।

 

মিলেনিয়াম পার্কে মুক্তামালার হাত ধরে সুকান্ত সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একটা জুতসই গানের কলি খুঁজছিল। মুক্তামালা জিগ্যেস করল মণিমালাদিকে, তুমি মিস করো না? করতাম, ভীষণ করতাম। তুমি যেদিন থেকে আমার জীবনে ল্যাণ্ড করেছ, তাকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। পার্থিব মায়ার বাঁধনে বিদেহী আত্মাকে বেঁধে রাখার কোন মানে হয় না, জানো? শুনেছি, মণিমালাদি হেব্বি সুন্দরী ছিল। কে বলেছে তোমায় জানিনা, তার চোখের দোষ আছে নিশ্চয়ই। তুমি ভাববে তোমায় গ্যাস খাওয়াচ্ছি, কিন্তু বাস্তব হল, তোমার কাছে, সে একদম তুচ্ছ, কাকের পিঠে যেন ময়ুরের পুচ্ছ! আমি যদি বিয়ের পর মরে যাই, রতনমালাকেও এইরকমই বলবে? রতনমালা কে? তোমার পরের বউ। তুমি নাকি সাতপাক.কম থেকে পনের পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পেয়েছ? তোমার আর মণিমালাদির মধ্যে নাকি কোন সম্পর্কই তৈরি হয় নি, মণিমালাদি খুব অসুস্থ ছিল, না? ভীষণ, বিয়ের আগে তো বোঝা যায় নি। বিয়ের পর খালি বলত জ্বর, মাথা ব্যথা, কোমরে ব্যথা। বেচারা খুব রুগ্ন ছিল। ওসব দুঃখের কথা এখন ছাড়ো তো। আমাদের নতুন জীবন নিয়ে, এসো ভাবি। ডিসেম্বরের আঠাশ তারিখ আমাদের বিয়ের দিন ঠিক করছি, ওসময় ছুটি পেতে অসুবিধে হবে না। ওইসময় স্কুল কলেজেও ছুটিই থাকে, তোমার কি মত? আমি জানিনা, আমি বাপিকে গিয়ে বলব, বাপি তোমার সঙ্গে কথা বলে নেবে।

             

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“সদানন্দ ভবন”

 বিবাহ, পৈতা, অন্নপ্রাশন, যে কোন আনন্দ উৎসবের জন্য যোগাযোগ করুন

 (পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়*)

*শর্তাবলী প্রযোজ্য]

 

মুক্তামালার বাবা ফোনে কথা বললেন সুকান্তর বাবার সঙ্গে, দিন স্থির হয়ে গেল ওই আঠাশে ডিসেম্বরেই। সুকান্তর বাবা সেদিনই বুক করে দিলেন সদানন্দ ভবন। সুকান্তকে এখন গুণে গুনে ১৮৫টা দিন পার করতে হবে। নারদ-বুড়ি বোনের সঙ্গে সুকান্তর এখন আবার খুব ভাব। সুকান্তর মা তার হাতেই তুলে দিয়েছেন বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটার দায়িত্ব। প্রায় প্রত্যেক শনিবারেই বোন, মুক্তামালা আর সুকান্ত রমণীয় বস্ত্র বিপণিতে শাড়ি, জামা কাপড় পছন্দ করতে যাচ্ছে। কনে্র জন্যে আর তত্ত্বের জন্যে কেনা হচ্ছে অনেক শরাবী, হাসিনা আর নটখট। তত্ত্বে দেওয়ার জন্যে টুকটুকির সিন্দুর আর তরল আলতাও অনেক কেনা হলকিছুদিন আগে মোবাইলের সিমকার্ড বদলে সে নতুন নাম্বার নিয়েছে, তার সেই মদ্যপ দোসরদের এড়াতে। একটু খালি হওয়া গ্রীন লিওর ৭৫০ মিলির বোতলটা দিয়ে দিয়েছে জমাদার ঝড়ু সিংকে। বলেছিল টয়লেট সাফ করার ওষুধ। রাত্রে তার বস্তিতে বিবির সঙ্গে ঝগড়া করে সুইসাইড করতে গিয়েছিল ঝড়ু, কিন্তু অনেকটা গ্রীন লিও খেয়েও সে মরে নি। বরং পরের দিন এসে সুকান্তকে বলেছিল ওইসান বোতল আওর চাহিয়ে, বাবু, টয়লেট একদম চকাচক হো যাতা হ্যায়।

 

মুক্তামালার সঙ্গে অনেক ঝগড়াঝাঁটি মানঅভিমানের পর মধুচন্দ্রিমা যাওয়ার লোকেশনও ঠিক হয়ে গেলপটায়াবাসি বিয়ে সেরেই টাটকা হানিমুনে যাওয়ার ডেট ঠিক হল ৪ঠা জানুয়ারি। ওইসময় পটায়ায় ঠাণ্ডা কেমন পরে। কতটা পরে। কলকাতার শীতের মতো, নাকি বেশি। নাকি কম। নাকি একদম না। সেইমতো তৈরি করতে হবে ড্রেস কোড। গুগ্‌ল্‌ খুঁজে পাওয়া গেল অনেক তথ্য। ডিসেম্বর জানুয়ারিতে ম্যাক্সিমাম ২৯ থেকে ৩১ আর মিনিমাম ২২-২৩ ডিগ্রী। মুক্তামালা বলল সেন্টিগ্রেড না ফারেনহাইট? সেন্টিগ্রেড। খুব একটা ঠাণ্ডা নয়, যদি একটু আধটু লাগেও, তুমি তো রয়েছ, মুক্তা। আমি কি করবো? বারে, তুমিই তো করবে। একে তো দেশটা থাইল্যাণ্ড, ওদেশে ল্যান্ড করে কাছে যদি পাই, তোমার থাই। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মুক্তামালা বলল, পিজে, এনজে। মানে? পচা জোক, নোংরা জোক, আনলাইক।   

 

 

          

 

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“ভূরিভোজ”

 বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ যে কোন অনুষ্ঠানে সুস্বাদু ডিশের জন্য যোগাযোগ করুন.

আমরা সাউথ ও নর্থ ইণ্ডিয়ান, পাঞ্জাবী, কাশ্মীরি, মোগলাই,

চাইনিজ, মালয়েশিয়া, থাই, ইটালি, মেক্সিকান ডিশের জন্য সবিশেষ প্রসিদ্ধ।

পরীক্ষা প্রার্থনীয়

 (বাঙালী ডিশের জন্য অনুরোধ করিয়া লজ্জা দিবেন না।)]

 

মুক্তামালার সঙ্গে কনসাল্ট করে, সুকান্ত আর তার নারদ-বুড়ি বোন মেনু ঠিক করে ফেলল। কাশ্মীরি আলুর কোপ্তা, আনারসের মেক্সিক্যান স্যালাড, চিকেন পনীর রোল, নান, জিরা রাইস, রুই মাছের ওরেটা আল ফার্নো, পাঁঠার নুইয়া পিং, আলুবোখরার চাটনি, সাবুরপাঁপড়, রসগোল্লা, লেবুর ফালি দেওয়া হাত ধোবার গরম জল, ভ্যানিলা আইসক্রিম, চিনিমোড়া রঙিন মৌরির পাউচ, টুথপিক। বউভাতের নিমন্ত্রিতের দল আধপেটা খেয়ে, গিফটের আবর্জনা ঢেলে দিয়ে সবাই চলে গেল ভূরিভোজের ভূয়সী প্রশংসা করতে করতে। বাড়ির লোকজনরা সবাই মিলে খেতে বসল। সুকান্তর নারদ-বুড়ি বোন আর তার বর ক্যাটারারকে আগেই বলে রেখেছিল, ভাত রুই মাছের কালিয়া আর পাঁঠার কালিয়া ছাড়া কিছুই খেল না। বোন বলল, যাই বলিস তুই দাদা, তোর ওই মালয়েশিয়ান, ইটালিয়ান ডিশের চেয়ে এই বেশ ভালো খেলাম। কেউ কিছু বলল না, লোলুপ দৃষ্টিতে তাদের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল অন্য সবাই।

 

বউভাতের সব অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পর মুক্তামালা ফুলসজ্জিত শোবার ঘরে ঢুকেই চালু করে দিল মশ-কিল, মসকুইটো রিপেল্যান্ট। বিছানা থেকে ফুলের পাপড়ি ঝেড়ে ফেলে মশারি টাঙিয়ে নিল চটপট। বিছানার তিনদিকে মশারি গুঁজে নিয়ে, সুকান্তকে ডাকল, খাটে উঠে পড়ো, সাবধানে, একটাও মশা যেন না ঢোকে। বাধ্য ছেলের মতো সুকান্ত মশারির মধ্যে ঢোকার পর বলল, মশ-কিলতো চলছে, মশারি টাঙানোর দরকার ছিল? মুক্তামালা কোন উত্তর দিল না, ঢোকার দিকের মশারি গুঁজে, ভেতরে মুখ উঁচু করে দেখতে লাগল, মশারির মধ্যে কোন মশা ঢুকেছে কিনা। নিশ্চিত হয়ে বলল, প্রথমদিন দেখিয়ে দিলাম, কাল থেকে মশারি গুঁজে মশা চেক করবে তুমি।

[গল্পের এই অংশটি প্রযোজনা করেছেনঃ-

“মশ-কিল”

মশা আর নয় মুশকিল, বাড়িতে আনুন মশ-কিল

আপনার বাড়ি থেকে সারারাত সাতহাত দূরে রাখুন মশাদের

আল্ট্রাপাওয়ার ও সুপারপাওয়ার কোয়ালিটিও উপলব্ধ।  ]

 

 

একদল মশা মশ-কিলের গন্ধ সত্ত্বেও আড়চোখে ওটার দিকে তাকাতে তাকাতে, নাক চিপে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। মশারির বাইরে পাঁচ দিক ঘুরেও তারা না পেল কোন ফুটো, না পেল কোন ফাঁক, যেখান দিয়ে ঢুকে পড়া সম্ভব। হয়রান হয়ে আবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে জানালার পাল্লায় বসে সকলে দম নিতে লাগল। সবচেয়ে বুড়ি মশাটা তার আবার হাঁপানির টান, বেশ খানিকক্ষণ দম নিয়ে বলল, এই বয়সে এত হয়রানি আর পোষায় না, বাপু। এর জন্যে দায়ী তো আমরাই। সে কি রকম? আজ থেকে প্রায় সতের পুরুষ আগে, আমার এক ঠাকুমার হুলের খোঁচায় এ বাড়ির পেতম বউ ম্যালোরি হয়ে মরে গেছিল, সেই থেকে মানুষগুলো খুব সেয়ানা হয়ে গেছে! লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ি মশা আবার বলল, মানুষরা বাঁচে বছরে, আর আমরা ঘণ্টায়। চল চল, খিদে পেয়েছে খুব, অন্য কোথাও দেখি। মিহিন পাখনা মেলে উড়ে গেল মশাদের দলটা     

 

-*-

শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০২৫

সুরক্ষিতা পর্ব - ১০

 

১০


স্কুলে তাঁর কাজের চাপ বাড়ছে। তিনি এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিসট্রেস। মাস ছয়েক পরে এখন যিনি হেডমিস্ট্রেস, কণিকাদি, রিটায়ার করবেন। খুব চান্স আছে, কণিকাদির পর শুভময়ীদেবীর হেডমিস্ট্রেস হওয়ার। সেক্ষেত্রে কাজের প্রেসার আরো বাড়বে, বাড়বে দায়িত্ব। বেড়ে যাবে এডুকেশান বোর্ড, কাউন্সিল, স্কুল কমিটির মিটিং সামলানোর টেনসান। এরই মাঝে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা কথা শুভময়ীদেবীর বারবার মনে আসছে, বিরক্তিকর মাছির মতো, তাড়িয়ে দিলেও বারবার যেমন ফিরে আসে। কথাটা হল, বিট্টুর কি হবে? কতদিন, আর কতদিন সম্ভব এভাবে বিট্টুকে সামলে চলা এবং তার সঠিক দেখভাল করা? 

বিট্টুর বয়েস বাড়ছে প্রকৃতির সমস্ত নিয়ম মেনেই। আজ সে তার বয়েস প্রায় পনের। তার শরীরে এখন নবীন যৌবনের সূচনা। তার গালে নরম দাড়ি, নাকের নীচে চিকন গোঁফের উন্মেষ। দিন পনের-কুড়ি অন্তর তার মাথার চুলের সঙ্গে তার গোঁফ-দাড়ি বাড়িতেই ছেঁটে দেন শুভময়ী দেবী। এই বয়সের সুস্থ ও স্বাভাবিক ছেলেরা লেখাপড়া, বন্ধু-বান্ধবী, খেলাধুলো, সিনেমা, গান, ফাজলামি নিয়ে চঞ্চল থাকে। বিট্টুর কোন কাজ নেই, বাইরের জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন, অচঞ্চল নিয়ন্ত্রণহীন আলাদা এক সত্ত্বা। অথচ নিষ্ঠুর নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকৃতি তার শরীরে, তার মনে সাজিয়ে তুলছে যৌবন, জীবধর্ম মেনে তার শরীরে গড়ে উঠছে নতুন জীবন সৃষ্টির সমস্ত সরঞ্জাম ও আয়োজন! বাড়ছে নিত্যনতুন জটিলতা। সে নিজে বিপন্ন হচ্ছে, বিপন্ন করছে ছবিকে, নিজের পরিবারকে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে বারবার। কাজেই বিট্টুর এখন দরকার প্রফেসনাল কেয়ার। 

তাছাড়া আজকাল আরও একটা চিন্তা শুভময়ীদেবীর মগজে বাসা বাঁধছে, সেটা হল তাঁদের, তাঁর আর বিট্টুর বাবার মৃত্যুর পর কী হবে বিট্টুর? হয়তো আজই নয় কিন্তু পাঁচ, দশ, বিশ বছর বাদে, ঠিক কবে তাঁরা চলে যাবেন কে বলতে পারবে? সেদিন কার কাছে, কার ভরসায় রেখে যাবেন বিট্টুকে? আজ পর্যন্ত খুব স্বাভাবিক ভাবেই কোন মিরাক্‌ল্‌ ঘটেনি এবং ঘটার কোন সম্ভাবনাও নেই, যাতে বিট্টু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। কাজেই কি হবে ওর ভবিষ্যৎ? 

এইসব চিন্তার মধ্যেই বিট্টুর বাবা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন চেন্নাই। কোম্পানীর রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে তাঁর প্রমোশন হওয়াতে, তাঁকে সমস্ত দক্ষিণ ভারতের ব্যবসা সামলাতে হবে এখন থেকে। শুভময়ীদেবী প্রস্তাব করেছিলেন, প্রমোশন অ্যাক্সেপ্ট না করার জন্য, অন্য কেউ যাক না। এই বয়সে কলকাতা ছেড়ে, অতদূরে যাওয়া, কী এমন জরুরি? বিশেষ করে বিট্টুর এইরকম অবস্থায়? বিট্টুর ভালোমন্দ সমস্ত দায়িত্ব এখন থেকে শুভময়ীদেবীর? কেন, বিট্টুর এই অবস্থার জন্যে কি শুভময়ীদেবী দায়ী? মা হয়ে নিজের সন্তানকে তিনি এইভাবে বড়ো হতে দেখছেন, তাঁর এই যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ থাকবে না তাঁর পাশে? বাবা হিসেবে কোন ফিলিংস যদি নাও থাকে, কর্তব্যবোধটুকুও কিভাবে লোপ পেয়ে যায়? এই সব ভেবে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছেন শুভময়ীদেবী। এক এক সময় তাঁর মনে হয়, তাঁর স্বামীর এমন আচরণ, শুধু তাঁকেই শাস্তি দেবার জন্যে। তিনি তাঁর স্বামী ও শাশুড়ির নির্দেশ মতো স্কুলের চাকরি ছেড়ে বিট্টু-অন্ত-প্রাণ মা এবং গৃহবধূ হতে চাননি বলেই আজও এতদিন পরেও, এও একধরনের প্রতিশোধ ছাড়া আর কি হতে পারে!

কোন এক বহুজাতিক সংস্থার কোটি কোটি টাকার ব্যবসাকে আর বেশী বেশী কোটিতে দাঁড় করানোটা কি এতই জরুরি! আর তিনি যে ঘরের অধিকাংশ কাজ সামলেও কয়েক হাজার মেয়েকে বড়ো হতে, মানুষ হতে সাহায্য করে চলেছেন, তার কোন মূল্যই নেই কারো কাছে! আজকাল শুভময়ী দেবী নিজেকে ভীষণ একলা অনুভব করেন। কোন ধরনের অ্যাপ্রিসিয়েসনহীন, কোন প্রত্যাশাহীন এমন একটা দীর্ঘ লড়াই, একদম একা একা লড়ে যেতে, তিনি আর যেন পেরে উঠছেন না। কেউ একজন, যদি কেউ একজন থাকত তাঁর পাশে। যার থেকে কোন সাহায্য না পেলেও, তাঁর কাছে দিনের শেষে অন্ততঃ একবার বসলেও যদি পাওয়া যেত একটু শান্ত অবসর। তাহলেই বেঁচে যেতেন তিনি, ফিরে পেতেন লড়ে চলার নতুন শক্তি।  

তিনি কথাবার্তা বলতে লাগলেন নানান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এর আগেও অনেক জায়গা থেকেই তাঁদের কাছে অনেকে এসেছিল। যে ক্লিনিকে বিট্টুর রেগুলার চেকআপ করানো হয়, কোন প্রবলেম হলেই। যেখানে বিট্টুকে নিয়ে দৌড়ে যান ট্রিটমেন্টের জন্যে, তারাও রেফার করেছিল এরকম বেশ কতকগুলি প্রতিষ্ঠানের নাম। তখন আমল দেননি তাঁরা কেউই। মনে হয়েছিল নিজের সন্তান সে যেমনই হোক, তাঁদের কাছেই থাকুক। আজ যতদিন যাচ্ছে শুভময়ীদেবী অসহায় বোধ করছেন, অসম্ভব এক ক্লান্তি তাঁকে ঘিরে থাকছে সারাটাক্ষণ। যে ক্লান্তি থেকে তাঁর আর যেন মুক্তি নেই।

শনিবার, রবিবার, ছুটির দিন করে তিনি একা একাই আজকাল ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি, তাঁর বিতানের মতো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে সারাটা দিন প্রফেসনাল ট্রেনিং দিয়ে চলেছে, ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল দুটোই, তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কেয়ার। কেয়ার মানে কিন্তু আদরের প্রশ্রয় নয়। তাঁরা যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এদের মধ্যেও একধরনের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার। বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করার পর শুভময়ীদেবীর মনে হল, তিনি হয়তো ভুলই করেছেন, বিতানকে আরো আগেই এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দিলে হয়তো ভালই হত। বিতান তার মতো আরো অনেকের সঙ্গে থাকতে থাকতে, এঁনাদের ট্রেনিং পেয়ে সুস্থ নিশ্চয়ই হয়ে উঠত না, কিন্তু এতটা রিপালসিভ না হয়ে, অনেক সোশাল হয়ে উঠতে পারত ওর নিজের মতো করে। হয়ে উঠতে পারত অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ। আজকে বিতানকে নিয়ে যে নিত্যনতুন সমস্যা গড়ে উঠছে, হয়তো সেটা এড়ানো যেত। বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘোরাঘুরি করে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় মনস্থির করে ফেললেন। পাকা কথা দেবার আগে বিতানের বাবার সঙ্গে কথা বলা জরুরি। এক রবিবার সকালে তিনি ফোন করলেন, “হ্যালো। কেমন আছ, কেমন? শরীর ঠিক আছে তো”?

“হুঁ। ঠিক আছে”।

“খাওয়া দাওয়ার কোন অসুবিধে নেই তো, স্পাইসি ফুড অ্যাভয়েড করবে, পারলে একদম খাবে না, সাবধানে থেক কিন্তু”।         

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। কোন অসুবিধে নেই”।

“ওষুধগুলো রেগুলার নিও, ভুলে যেও না।”।

“হুঁ, নোবো”। এত নিরুত্তাপ, সংক্ষিপ্ত জবাবের পর শুভময়ীদেবী আসল কথাটা কিভাবে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একবারের জন্যেও ওর কি জানার ইচ্ছে হয় না, কিংবা সামান্য কৌতূহলও হয় না, বিট্টু কেমন আছে! আমি কেমন আছি? তবুও বলতে তো তাঁকে হবেই। তিনি খুব দ্বিধার সঙ্গে আবার কথা বললেন, “শুনছ”?

“হুঁ”।

“তোমার “একান্ত সহায়” সোসাইটির কথা মনে আছে? ডাক্তার বাগচি যার কথা বার বার বলতেন”?

“আছে, কেন”?

“তুমি তো জান বিট্টুর কি কি প্রবলেম, ও মাঝে মাঝেই খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠছে। সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আমাদের পক্ষে। ভাবছি, “একান্ত সহায়”তে বিট্টুকে এবার অ্যাডমিশন করিয়ে দেব।”।

“ভালোই তো”।

“তুমি কি বলছ, ওখানে দেওয়াটা ঠিক হবে”?

“আমার বলায় কি আসে যায়? যা ভালো বোঝো করো”। ব্যস এইটুকুই, ফোনটা কেটে গেল ওপ্রান্ত থেকে।

একজন পিতা কিভাবে এত শীতল হতে পারে, কিভাবেই বা থাকতে পারে এমন দায়িত্বহীন। শুভময়ীদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মোবাইলের দিকে। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন নেক্সট মান্থের পয়লা তারিখেই তিনি বিট্টুকে অ্যাডমিশান করিয়ে দেবেন “একান্ত সহায়ে”। 



চলবে.....

নতুন পোস্টগুলি

পেত-ন-তাৎ-তিক (ভৌতিক রহস্যগল্প)

  [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে  " ফলো করুন"  👉  বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার ...