সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ২

 

[পূর্ব প্রকাশিত শ্রীশ্রী চণ্ডীর পর্ব ১ এই সূত্রে পড়া যাবে - শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ১  ]


আগেই বলেছি মার্কণ্ডেয় পুরাণের তেরটি অধ্যায় নিয়ে “দেবীমাহাত্ম্যম্‌” বা “শ্রীশ্রী চণ্ডী” বিরচিত। এই শ্রীশ্রী চণ্ডী তিনটি চরিতে বিভক্ত। প্রথম চরিত (প্রথম অধ্যায়), মধ্যম চরিত (দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায়) এবং উত্তর চরিত (পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ অধ্যায়)। বলা হয় যে, মনে যে কোন কামনার সংকল্প নিয়ে এই তিন চরিত পাঠ করলে, পাঠকের ধর্ম, অর্থ ও কাম অর্থাৎ অভ্যুদয় বা সাংসারিক উন্নতি লাভ হয়। আর নিষ্কাম সংকল্প নিয়ে পাঠ করলে পাঠকের মোক্ষলাভ হয় অর্থাৎ সংসার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অতএব চণ্ডীপাঠে মানবজীবনের সমুদয় চতুর্বর্গ লাভ হয়ে থাকে। এই কারণেই শ্রীশ্রীচণ্ডীদেবীর আরাধনা করে রাজা সুরথ হারানো-রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন এবং বৈশ্য সমাধি ব্রহ্মজ্ঞান বা মোক্ষ লাভ করেছিলেন।           

 

প্রথম চরিত – মধুকৈটভ বধ

প্রথম অধ্যায়

ওঁ নমশ্চণ্ডিকায়ৈ

 

ওঁ ক্লীং মার্কণ্ডেয় উবাচ। ১

সাবর্ণিঃ সূর্যতনয়ো যো মনুঃ কথ্যতেঽষ্টমঃ।

নিশাময় তদুৎপত্তিং বিস্তরাৎ গদতো মম।। ২

[সাবর্ণিঃ সূর্য-তনয়ঃ যঃ মনুঃ কথ্যতে অষ্টমঃ। নিশাময় তৎ উৎপত্তিম্‌ বিস্তরাৎ গদতঃ মম।। ২]

ঋষি মার্কণ্ডেয় বললেন। সূর্য-পুত্র সাবর্ণি, যাঁকে অষ্টম মনু বলা হয়, তাঁর জন্মবৃত্তান্তের কথা আমি বিস্তারিত বর্ণনা করছি, মন দিয়ে শোন।

[ওঁ, ঐং, হ্রীং, ক্লীং প্রভৃতি শব্দগুলি বৈদিক ও তন্ত্রশাস্ত্রের বীজ মন্ত্র। ওঁ আদি প্রণব মন্ত্র। ঐং মন্ত্র চিৎরূপা সরস্বতী কে, হ্রীং মন্ত্র সৎ-রূপা লক্ষ্মীকে, ক্লীং মন্ত্রে আনন্দস্বরূপিনী মহাকালীকে সম্বোধন, আবাহন এবং স্মরণ করা হয়।] 


মহামায়ানুভাবেন যথা মন্বন্তরাধিপঃ।

সঃ বভূব মহাভাগঃ সাবর্ণিস্তনয়ো রবেঃ।। ৩

[মহামায়া অনুভাবেন যথা মন্বন্তর অধিপঃ। স বভূব মহাভাগঃ সাবর্ণিঃ তনয়ঃ রবেঃ।। ৩]

মহামায়ার অনুগ্রহে রবির পুত্র সেই মহা-ঐশ্বর্যবান সাবর্ণি যে ভাবে মন্বন্তরের অধীশ্বর হয়েছিলেন, (সে কথাই এখন বলব)।

স্বারোচিষেঽন্তরে পূর্বং চৈত্রবংশসমুদ্ভবঃ।

সুরথো নাম রাজাঽভূৎ সমস্ত ক্ষিতিমণ্ডলে।। ৪

 [স্বারোচিষে অন্তরে পূর্বং চৈত্র-বংশ-সমুদ্ভবঃ। সুরথঃ নাম রাজা অভূৎ সমস্ত ক্ষিতিমণ্ডলে।। ৪]

পুরাকালে স্বারোচিষ মনুর সময়ে এই পৃথিবীতে চৈত্র বংশজাত সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন।

  

তস্য পালয়তঃ সম্যক্‌ প্রজাঃ পুত্রানিবৌরসান্‌।

বভূবুঃ শত্রবো ভূপাঃ কোলা-বিধ্বংসিনঃ তদা।। ৫

[তস্য পালয়তঃ সম্যক্‌ প্রজাঃ পুত্রান্‌ ইব ঔরসান্‌। বভূবুঃ শত্রবঃ ভূপাঃ কোলাবিধ্বংসিনস্তদা।। ৫]

সেই রাজা প্রজাদের নিজের পুত্রদের মতোই যথানীতি পালন করতেন। কিন্তু সেই সময় কোলা-ধ্বংসকারী কিছু যবন রাজা তাঁর শত্রু হয়ে উঠছিল।

[কোলা – কোন মতে কোলা রাজা সুরথের রাজধানী শহর। কাশ্মীর সীমান্তের কোন যবন জাতি – অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যরা কোলা আক্রমণ করেছিল। কিন্তু ৭ নম্বর শ্লোকে আমরা দেখব, শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে তিনি নিজের রাজধানীতে ফিরে এলেন। সেক্ষেত্রে কোলা রাজা সুরথের রাজধানী ছিল না। অথবা এমনও হতে পারে, যবন সৈন্যরা রাজধানী লুঠপাট করে, চলে গিয়েছিল – রাজা সুরথ তাদের ঠেকাতে পারেননি। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারতে মুসলিম আক্রমণকারীদের এমনই উপদ্রব শুরু করেছিল।] 

 

তস্য তৈরভবদ্‌ যুদ্ধমতিপ্রবলদণ্ডিনঃ।

ন্যূনৈরপি স তৈর্যুদ্ধে কোলাবিধ্বংসিভির্জিতঃ।। ৬

[তস্য তৈঃ অভবৎ যুদ্ধম্‌ অতি-প্রবল-দণ্ডিনঃ। ন্যূনৈঃ অপি স তৈঃ যুদ্ধে কোলাবিধ্বংসিভিঃ জিতঃ।। ৬]

শত্রুদের অতি কঠোর দণ্ডদাতা, রাজা সুরথের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধে তাদের সংখ্যা কম হলেও রাজা সুরথ, কোলাবিধ্বংসীদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।

 

 ততঃ স্বপুরমায়াতো নিজদেশাধিপোঽভবৎ।

আক্রান্তঃ স মহাভাগস্তৈ স্তদা প্রবলারিভিঃ।। ৭

  [ততঃ স্বপুরম্‌ আয়াতঃ নিজ-দেশ অধিপঃ অভবৎ। আক্রান্তঃ স মহাভাগঃ তৈঃ তদা প্রবল-অরিভিঃ।। ৭]

সেই প্রবল শত্রুদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর, তিনি নিজের রাজধানীতে ফিরে এসে, নিজ-রাজ্যেরই অধিপতি হলেন।

অমাত্যৈর্বলিভির্দুষ্টৈর্দুর্বলস্য দুরাত্মভিঃ।

কোষো বলঞ্চাপহৃতং তত্রাপি স্বপুরে ততঃ।। ৮

[অমাত্যৈঃ বলিভিঃ দুষ্টৈঃ দুর্বলস্য দুরাত্মভিঃ। কোষঃ বলম্‌ চ অপহৃতং তত্র অপি স্বপুরে ততঃ।। ৮]

কিন্তু তাঁর নিজের রাজধানীতেও দুর্বল রাজা সুরথের দুষ্ট, প্রভাবশালী, নীচ অমাত্যরা তাঁর সেনাদল এবং রাজকোষ অপহরণ করে নিল।

ততো মৃগয়াব্যাজেন হৃতস্বাম্যঃ স ভূপতিঃ।

একাকী হয়মারুহ্য জগাম গহনং বনম্‌।। ৯

[ততঃ মৃগয়া-ব্যাজেন হৃত-স্বাম্যঃ স ভূপতিঃ। একাকী হয়ম্‌ আরুহ্য জগাম গহনম্‌ বনম্‌।। ৯]

তখন রাজ্যহারা সেই ভূপতি মৃগয়ার অজুহাতে একা একাই ঘোড়ায় চড়ে গহন অরণ্যে চলে গেলেন।

 

স তত্রাশ্রমমদ্রাক্ষীদ্‌ দ্বিজবর্যস্য মেধসঃ।

প্রশান্তশ্বাপদাকীর্ণং মুনিশিষ্যোপশোভিতম্‌।। ১০

[স তত্র আশ্রমম্‌ অদ্রাক্ষীৎ দ্বিজ-বর্যস্য মেধসঃ। প্রশান্ত-শ্বাপদ-আকীর্ণং মুনি-শিষ্য উপশোভিতম্‌।। ১০]

শান্ত-স্বভাবের হিংস্রপশু ঘুরে বেড়ানো সেই অরণ্যের মধ্যে, তিনি মুনি ও শিষ্য শোভিত দ্বিজবর ঋষি মেধসের আশ্রম দেখতে পেলেন।

 

তস্থৌ কঞ্চিৎ স কালঞ্চ মুনিনা তেন সৎকৃতঃ।

ইতশ্চেতশ্চ  বিচরংস্তস্মিন্‌ মুনিবরাশ্রমে।। ১১

[তস্থৌ কঞ্চিৎ সঃ কালম্‌ চ মুনিনা তেন সৎকৃতঃ। ইতঃ চ এতঃ চ বিচরন্‌ তস্মিন্‌ মুনিবর-আশ্রমে।। ১১]

মুনিদের থেকে সমাদর পেয়ে রাজা সুরথ সেই মুনিবরের আশ্রমে কিছুদিন থাকলেন এবং এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালেন।

সোঽচিন্তয়ত্তদা তত্র মমত্বাকৃষ্টচেতনঃ

মৎপূর্বৈঃ পালিতং পূর্বং ময়া হীনং পুরং হি তৎ।।

মদ্‌ভৃত্যৈস্তৈরসদ্বৃত্তৈরধর্মতঃ পাল্যতে ন বা। ১২

[সঃ অচিন্তয়ৎ তদা তত্র মমত্ব-আকৃষ্ট-চেতনঃ। মৎ-পূর্বৈঃ পালিতং পূর্বং ময়া হীনং পুরং হি তৎ।। মৎ ভৃত্যৈঃ তৈঃ অসৎ-বৃত্তৈঃ ধর্মতঃ পাল্যতে ন বা। ১২]

সেখানে মমতায় অভিভূত চিত্তে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, অতীতকালে আমার পূর্বপুরুষেরা যাকে সুরক্ষিত রেখেছিলেন, সেই রাজধানীতে আমি এখন আর নেই। আমার সেই অসৎ-চরিত্রের ভৃত্যেরা তাকে ধর্মানুসারে রক্ষা করছে কি?

 

ন জানে সপ্রধানো মে শূরহস্তী সদামদঃ।

মম বৈরিবশং যাতঃ কান্‌ ভোগানুপলপ্স্যতে।। ১৩

[ন জানে সপ্রধানো মে শূরহস্তী সদা-মদঃ। মম বৈরি-বশং যাতঃ কান্‌ ভোগান্‌ উপলপ্স্যতে।। ১৩]

জানিনা আমার সেই সর্বদা মদস্রাবী প্রধান গজবীর, আমার শত্রুদের অধীন হয়ে কেমন আহার্য পাচ্ছে।

 

যে মমানুগতা নিত্যং প্রসাদ-ধন-ভোজনৈঃ।

অনুবৃত্তিং ধ্রুবং তেঽদ্য কুর্বন্ত্যন্যমহীভৃতাম্‌।। ১৪

[যে মম অনুগতা নিত্যং প্রসাদ-ধন-ভোজনৈঃ। অনুবৃত্তিং ধ্রুবং তে অদ্য কুর্বন্তি অন্য-মহীভৃতাম্‌।। ১৪]

আমার থেকে নিত্য পুরষ্কার- বেতন – ভোজ্য লাভ করে যারা অনুগত ছিল, তারা নিশ্চয়ই আজকাল অন্য রাজার দাসত্ব করছে।

 

অসম্যগ্‌ব্যয়শীলৈস্তৈঃ কুর্বদ্ভিঃ সতত ব্যয়ম্‌।

সঞ্চিতঃ সোঽতিদুঃখেন ক্ষয়ং কোষো গমিষ্যতি।। ১৫

[অসম্যক্‌ ব্যয়শীলৈঃ তৈঃ কুর্বদ্ভিঃ সতত ব্যয়ম্‌। সঞ্চিতঃ সঃ অতিদুঃখেন ক্ষয়ং কোষঃ গমিষ্যতি।। ১৫]

অতিকষ্টে আমি যে ধন সঞ্চয় করেছিলাম, সর্বদা অমিতব্যয়ী সেই তাদের (অমাত্যদের) অপরিমিত ব্যয়ে রাজকোষ নিঃশেষ হয়ে যাবে।

 

এতচ্চান্যচ্চ সততং চিন্তয়ামাস পার্থিবঃ।

তত্র বিপ্রাশ্রমাভ্যাসে বৈশ্যমেকং দদর্শ সঃ।। ১৬

[এতৎ চ অন্যৎ চ সততং চিন্তয়াম্‌ আস পার্থিবঃ। তত্র বিপ্র আশ্রম-অভ্যাসে বৈশ্যম্‌ একম্‌ দদর্শ সঃ।। ১৬]

এই রকম নানান বিষয় নিয়ে রাজা যখন চিন্তা করছিলেন, তখন, হে বিপ্র, আশ্রমের কাছেই তিনি এক বৈশ্যকে দেখতে পেলেন।

[ মার্কণ্ডেয় পুরাণের প্রবক্তা স্বয়ং ঋষি মার্কণ্ডেয় এই কাহিনী বলছিলেন তাঁর শিষ্যকে, তাঁকেই তিনি “বিপ্র” বলে সম্বোধন করলেন।]

 

স পৃষ্টস্তেন কস্ত্বম্ভো হেতুশ্চাগমনেঽত্র কঃ।

সশোক ইব কস্মাত্ত্বং দুর্মনা ইব লক্ষ্যসে।। ১৭

      [সঃ পৃষ্টঃ তেন কঃ ত্বম্‌ ভোঃ হেতুঃ চ আগমনে অত্র কঃ। সশোক ইব কস্মাৎ ত্বং দুর্মনা ইব লক্ষ্যসে।। ১৭]

রাজা (বৈশ্যকে) জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভদ্র, আপনি কে? কিসের জন্যে এখানে এসেছেন? কিসের জন্যে আপনাকে এত শোকাকুল এবং বিমনা দেখাচ্ছে? 

ইত্যাকর্ণ্য বচস্তস্য ভূপতেঃ প্রণয়োদিতম্‌।

প্রত্যুবাচ স তং বৈশ্যঃ প্রশ্রয়াবনতো নৃপম।। ১৮

[ইতি আকর্ণ্য বচঃ তস্য ভূপতেঃ প্রণয়-উদিতম্‌। প্রতি-উবাচ স তং বৈশ্যঃ প্রশ্রয়া-অবনতঃ নৃপম।। ১৮]

রাজার সহানুভূতি পূর্ণ এই কথা শুনে, সেই বৈশ্য বিনীত শ্রদ্ধায় রাজাকে উত্তরে বললেন।

 

বৈশ্য উবাচ

সমাধির্নাম বৈশ্যোঽহমুৎপন্নো ধনিনাং কুলে।

পুত্রদারৈর্নিরস্তশ্চ ধনলোভাদসাধুভিঃ।। ১৯

[সমাধিঃ নাম বৈশ্যঃ অহম উৎপন্নঃ ধনিনাং কুলে। পুত্র-দারৈঃ নিরস্তঃ চ ধন-লোভাৎ- অসাধুভিঃ।। ১৯]

বৈশ্য বললেন, ধনী বৈশ্য বংশে আমার জন্ম, আমার নাম সমাধি। ধনের লোভে অসাধু স্ত্রী ও পুত্ররা আমাকে পরিত্যাগ করেছে।

বিহীনশ্চ ধনৈর্দারৈঃ পুত্রৈরাদায় মে ধনম্‌।

বনমভ্যাগতো দুঃখী নিরস্তশ্চাপ্তবন্ধুভিঃ।। ২০

[বিহীনঃ চ ধনৈঃ দারৈঃ পুত্রৈঃ আদায় মে ধনম্‌। বনম্‌ অভ্যাগতঃ দুঃখী নিরস্তঃ চ আপ্ত-বন্ধুভিঃ।। ২০]

স্ত্রী-পুত্ররা আমার ধন কেড়ে নিয়েছে, ধনহীন হওয়াতে ছেড়ে গেছে আমার আত্মীয়-বন্ধুরাও। (তাই) মনের দুঃখে এই বনে এসেছি।

সোঽহং ন বেদ্মি পুত্রাণাং কুশলাকুশলাত্মিকাম্‌।

প্রবৃত্তিং স্বজনানাঞ্চ দারাণাঞ্চাত্র সংস্থিতঃ।। ২১

[সঃ অহম্‌ ন বেদ্মি পুত্রাণাং কুশল-অকুশল-আত্মিকাম্‌। প্রবৃত্তিম্‌ স্বজনানাম্‌ চ দারাণাম্‌ চ অত্র সংস্থিতঃ।। ২১]

এখন এই বনে অবস্থান করায়, আমি পুত্রদের, পত্নীদের এবং স্বজনদের শুভ কিংবা অশুভ কোন সংবাদই আর পাই না। 

কিন্নু তেষাং গৃহে ক্ষেমমক্ষেমং কিন্নু সাম্প্রতম্‌।

কথন্তে কিন্নু সদ্‌বৃত্তা দুর্বৃত্তাঃ কিন্নু মে সুতাঃ।। ২২

[কিন্নু তেষাং গৃহে ক্ষেমম্‌-অক্ষেমম্‌ কিন্নু সাম্প্রতম্‌। কথন্তে কিন্নু সদ্‌বৃত্তা দুর্বৃত্তাঃ কিন্নু মে সুতাঃ।। ২২]

তাদের সংসারে সম্প্রতি মঙ্গল বা অমঙ্গল কিনা, পুত্রেরা সজ্জন নাকি দুর্জন হয়েছে, সে কথাও জানি না।

রাজোবাচ।

যৈর্নিরস্তো ভবাঁল্লুব্ধৈঃ পুত্রদারাদিভির্ধনৈঃ।

তেষু কিং ভবতঃ স্নেহমনুবধ্নাতি মানসম্‌।। ২৩

[রাজা উবাচ। যৈঃ নিরস্তঃ ভবান্‌ লুব্ধৈঃ পুত্র-দারাদিভিঃ ধনৈঃ। তেষু কিম্‌ ভবতঃ স্নেহম্‌ অনুবধ্নাতি মানসম্‌।। ২৩]

রাজা বললেন, ধনলোভী পুত্র-পরিবারাদি আপনাকে পরিত্যাগ করার পরেও, আপনার মনে কেন (তাদের প্রতি) স্নেহবন্ধন রয়েছে?

বৈশ্য উবাচ।

এবমেতদ্‌ যথা প্রাহ ভবানস্মদ্‌গতং বচঃ।

কিং করোমি ন বধ্নাতি মম নিষ্ঠুরতাং মনঃ।। ২৪

[এবম্‌ এতৎ যথা প্রাহ ভবান্‌ অস্মদ্‌গতম্‌ বচঃ। কিম্‌ করোমি ন বধ্নাতি মম নিষ্ঠুরতাম্‌ মনঃ।। ২৪]

বৈশ্য বললেন। আমার সম্বন্ধে যা বললেন সে কথা ঠিকই, কিন্তু কী করব আমার মন মমতাহীন হতে পারছি না।

যৈঃ সন্ত্যজ্য পিতৃস্নেহং ধনলুব্ধৈর্নিরাকৃতঃ।

পতিস্বজনহার্দঞ্চ হার্দি তেষ্বেব মে মনঃ।। ২৫

[যৈঃ সন্ত্যজ্য পিতৃস্নেহং ধনলুব্ধৈঃ নিরাকৃতঃ। পতি-স্বজন-হার্দম্‌ চ হার্দি তেষু এব মে মনঃ।। ২৫]

যে ধনলোভীরা আমার পিতৃস্নেহ, পতি-প্রেম এবং স্বজনপ্রীতি ভুলে আমাকে পরিত্যাগ করেছে, আমার মনে এখনও তাদের প্রতিই স্নেহবন্ধন রয়ে গেছে।

 কিমেতন্নাভিজানামি জানন্নপি মহামতে।

যৎ প্রেমপ্রবণং চিত্তং বিগুণেষ্বপি বন্ধুষু।। ২৬

[কিম্‌ এতৎ ন অভিজানামি জানন্‌ অপি মহামতে। যৎ প্রেম-প্রবণং চিত্তম্‌ বিগুণেষু অপি বন্ধুষু।। ২৬]

হে মহামতি, সব জেনেও, গুণহীন বন্ধু (পুত্র-দারা-স্বজন)-দের প্রতি কেন আমার মন স্নেহপ্রবণ হচ্ছে আমি জানি না।

তেষাং কৃতে মে নিঃশ্বাসো দৌর্মনস্যঞ্চ জায়তে।

করোমি কিং যন্ন মনস্তেষ্বপ্রীতিষু নিষ্ঠুরম্‌।। ২৭

[তেষাম্‌ কৃতে মে নিঃশ্বাসঃ দৌঃ-মনস্যম্‌ চ জায়তে। করোমি কিং যৎ ন মনঃ তেষু অপ্রীতিষু নিষ্ঠুরম্‌।। ২৭]

প্রীতিহীন তাদের জন্যে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলছি, আমার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে, কিন্তু কী করব, তাও তাদের প্রতি আমার মন নিষ্ঠুর হচ্ছে না।

মার্কণ্ডেয় উবাচ।

ততস্তৌ সহিতৌ বিপ্র তং মুনিং সমুপস্থিতৌ।

সমাধির্নাম বৈশ্যঽসৌ স চ পার্থিবসত্তমঃ।। ২৮

[ততঃ তৌ সহিতৌ বিপ্র তম্‌ মুনিম্‌ সমুপস্থিতৌ। সমাধিঃ-নাম বৈশ্যঃ অসৌ স চ পার্থিব-সত্তমঃ।। ২৮]

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বললেন। হে বিপ্র, তখন সেই বৈশ্য সমাধি এবং সেই রাজা - দুজনে একসঙ্গে মুনির  (মেধস) সামনে উপস্থিত হলেন।

কৃত্বা তু তৌ যথান্যায়ং যথার্হং তেন সংবিদম্‌।

উপবিষ্টৌ কথাঃ কাশ্চিচ্চক্রতুর্বৈশ্যপার্থিবৌ।। ২৯

[কৃত্বা তু তৌ যথা-ন্যায়ং যথা-অর্হম্‌ তেন সংবিদম্‌। উপবিষ্টৌ কথাঃ কাঃ চিৎ চক্রতুঃ বৈশ্য-পার্থিবৌ।। ২৯]

সেই বৈশ্য এবং রাজা দুজনে যথাবিধি ও যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে তাঁর (মুনির) সামনে বসে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করলেন।

রাজোবাচ।

ভগবংস্ত্বামহং প্রষ্টুমিচ্ছাম্যেকং বদস্ব তৎ।

দুঃখায় যন্মে মনসঃ স্বচিত্তায়ত্ততাং বিনা।। ৩০

[রাজা উবাচ। ভগবন্‌ ত্বাম্‌ অহম্‌ প্রষ্টুম্‌ ইচ্ছামি একম্‌ বদস্ব তৎ। দুঃখায় যৎ মে মনসঃ স্ব-চিত্ত-আয়ত্ততাম্‌ বিনা।। ৩০]

রাজা বললেন। হে ভগবন্‌, আপনাকে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই, (দয়া করে) উত্তর দিন। দুঃখের কারণে আমার মন নিজের আয়ত্ত্বে নেই।

 মমত্বং গতরাজ্যস্য রাজ্যাঙ্গেষ্বখিলেষ্বপি।

জানতোঽপি যথাজ্ঞস্য কিমেতন্মুনিসত্তম।। ৩১

[মমত্বম্‌ গত-রাজ্যস্য রাজ্য-অঙ্গেষু অখিলেষু অপি। জানতঃ অপি যথা-অজ্ঞস্য কিম্‌ এতৎ মুনিসত্তম।। ৩১]

হে মুনিবর, রাজ্য এবং সকল রাজ্যাঙ্গ আর আমার নয় জেনেও, অজ্ঞের মতো (তার প্রতি) মনে কেন মমত্ব রয়েছে?

[রাজ্যাঙ্গ – ভূস্বামী, অমাত্য, সুহৃৎ, রাজকোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও বল বা সেনা – এই সাতটিকে রাজ্যাঙ্গ বলে।

অয়ঞ্চ নিকৃতঃ পুত্রৈর্দারৈর্ভৃত্যৈস্তথোজ্ঝিতঃ।

স্বজনেন চ সন্ত্যক্তস্তেষু হার্দী তথাপ্যতি।। ৩২

[অয়ম্‌ চ নিকৃতঃ পুত্রৈঃ-দারৈঃ-ভৃত্যৈঃ তথা উজ্ঝিতঃ। স্বজনেন চ সন্ত্যক্তঃ তেষু হার্দী তথা-অপি-অতি।। ৩২]

এই মহাশয়ও (বৈশ্য সমাধি) পুত্র-দারাদের থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, ভৃত্যেরা উদ্ব্যস্ত করেছে, স্বজনেরা পরিত্যাগ করেছে, তা সত্ত্বেও ইনি তাঁদের প্রতি অতীব মমতাময়।

এবমেষ তথাহঞ্চ দ্বাবপ্যত্যন্তদুঃখিতৌ।

দৃষ্টদোষেঽপি বিষয়ে মমত্বাকৃষ্টমানসৌ।। ৩৩

[এবম্‌ এষ তথা অহম্‌ চ দ্বৌ এব অপি অত্যন্ত-দুঃখিতৌ। দৃষ্ট-দোষে অপি বিষয়ে মমত্ব-আকৃষ্ট-মানসৌ।। ৩৩]

অতএব ইনি এবং আমি দুজনেই অত্যন্ত দুঃখিত, যারা এই দুঃখের কারণ তা বুঝতে পেরেও, আমাদের মন তাদের প্রতিই মমতায় আকৃষ্ট

তৎ কেনৈতন্মহাভাগ যন্মোহো জ্ঞানিনোরপি।

মমাস্য চ ভবতোষা বিবেকান্ধস্য মূঢ়তা।। ৩৪

[তৎ কেন এতৎ মহাভাগ যৎ মোহঃ জ্ঞানিনঃ অপি। মম-অস্য চ ভবতি এষা বিবেক-অন্ধস্য মূঢ়তা।। ৩৪]

হে মহামতি, আমি এবং ইনি দুজনেই জানি মোহ দোষযুক্ত, কিন্তু তাও বিবেকহীন মূর্খের মতো কেন আমাদের মনে এই মোহ আসছে?

ঋষিরুবাচ।

জ্ঞানমস্তি সমস্তস্য জন্তোর্বিষয়গোচরে।

বিষয়শ্চ মহাভাগ যাতি চৈবং পৃথক্‌ পৃথক্‌।। ৩৫

দিবান্ধাঃ প্রাণিনং কেচিদ্রাত্রাবন্ধাস্তথাপরে।

কেচিদ্দিবা তথা রাত্রৌ প্রাণিনস্তুল্য দৃষ্টয়ঃ।। ৩৬

[ঋষিঃ উবাচ। জ্ঞানম্‌ অস্তি সমস্তস্য জন্তোঃ বিষয়-গোচরে। বিষয়ঃ চ মহাভাগ যাতি চ এবং পৃথক্‌ পৃথক্‌।। ৩৫

দিবা-অন্ধাঃ প্রাণিনং কেচিৎ রাত্রৌ-অন্ধাঃ তথা-অপরে। কেচিৎ দিবা তথা রাত্রৌ প্রাণিনঃ তুল্য দৃষ্টয়ঃ।। ৩৬]

ঋষি মেধস বললেন। সমস্ত প্রাণীদেরই (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য) বিষয়ের জ্ঞান আছে, হে মহাভাগ, কিন্তু সেই জ্ঞান প্রত্যেকের আলাদা আলাদা। কেউ কেউ দিনের বেলায় অন্ধ, আবার অন্য কেউ অন্ধ রাত্রে, অনেকে আবার দিন ও রাত্রে সমান দেখতে পায়, অনেকে কোন সময়েই দেখতে পায় না।

জ্ঞানিনো মনুজাঃ সত্যং কিন্তু তে ন হি কেবলম্‌।

যতো হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশুপক্ষিমৃগাদয়ঃ।। ৩৭

জ্ঞানঞ্চ তন্মনুষ্যাণাং যত্তেষাং মৃগপক্ষিণাম্‌।

মনুষ্যাণাঞ্চ যত্তেষাং তুল্যমন্যৎ তথোভয়োঃ।। ৩৮

[জ্ঞানিনঃ মনুজাঃ সত্যং কিন্তু তে ন হি কেবলম্‌। যতঃ হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশু-পক্ষি-মৃগ-আদয়ঃ।। ৩৭

জ্ঞানম্‌ চ তৎ মনুষ্যাণাম্‌ যৎ এষাম্‌ মৃগপক্ষিণাম্‌। মনুষ্যাণাম্‌ চ যৎ এষাম্‌ তুল্যম্‌ অন্যৎ তথা উভয়োঃ। ৩৮]

শুধু মাত্র যে মনুজ অর্থাৎ মানুষরাই (ইন্দ্রিয়বিষয়ে) জ্ঞানী তা নয়, পশু-পক্ষি-মৃগাদি সকল প্রাণীও জ্ঞানী। মানুষের যতটা বিষয়জ্ঞান, মৃগপক্ষিদের বিষয়জ্ঞান ঠিক ততটাই। আহার-নিদ্রা-মৈথুন বিষয়ে মানুষ ও প্রাণীদের জ্ঞান সমতুল্য।

জ্ঞানেঽপি সতি পশ্যৈতান্‌ পতগাঞ্ছাবচঞ্চুষু।

কণমোক্ষাদৃতান্‌ মোহাৎ পীড্যমানানপি ক্ষুধা।। ৩৯

[জ্ঞানে অপি সতি পশ্য এতান্‌ পতগান্‌ শাবচঞ্চুষু। কণ-মোক্ষ-আদৃতান্‌ মোহাৎ পীড্যমানান্‌ অপি ক্ষুধা।। ৩৯]

দেখুন, (ইন্দ্রিয় বিষয়ের) জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, ক্ষুধায় পীড়িত পাখিরা (নিজে অভুক্ত থেকে) মোহবশে শাবকের ঠোঁটে শস্যকণা তুলে দিয়ে আনন্দ পায়।

মানুষা মনুজব্যাঘ্র সাভিলাষাঃ সুতান্‌ প্রতি।

লোভাৎ প্রত্যুপকারায় নন্বেতে কিং ন পশ্যতি।। ৪০

[মানুষা মনুজব্যাঘ্র স-অভিলাষাঃ সুতান্‌ প্রতি। লোভাৎ প্রত্যুপকারায় ননু এতে কিম্‌ ন পশ্যতি।। ৪০]

হে নরশ্রেষ্ঠ, মানুষ (পিতা) যে প্রত্যুপকারের লোভে সন্তানের প্রতি অনুরক্ত হয়, সেটা কী দেখছেন না?

 তথাপি মমতাবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ।

মহামায়াপ্রভাবেণ সংসারস্থিতিকারিণা।। ৪১

তন্নাত্র বিস্ময়ঃ কার্যো যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ।

মহামায়া হরেশ্চৈতত্তয়া সংমোহ্যতে জগৎ।। ৪২

[তথাপি মমতা-আবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ। মহামায়াপ্রভাবেণ সংসার-স্থিতি-কারিণা।। ৪১

তৎ-ন-অত্র বিস্ময়ঃ কার্যঃ যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ। মহামায়া হরেঃ চ এতৎ তয়া সংমোহ্যতে জগৎ।। ৪২]

তবুও সংসারের স্থিতিকারিণী মহামায়ার প্রভাবে, সবাই মোহ রূপ গর্তে মমতার আবর্তে নিমগ্ন থাকে।  জগৎপতি শ্রীহরিও মহামায়ার প্রভাবে যোগনিদ্রায় অভিভূত ছিলেন। অতএব তাঁর সম্মোহনেই যে এই জগৎ চলছে, এর মধ্যে আর আশ্চর্য হওয়ার কারণ কি?

জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা।

বলাদাকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্রযচ্ছতি।। ৪৩

তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগদেতচ্চরাচরম্‌।

সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে।। ৪৪

[জ্ঞানিনাম্‌ অপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা। বলাৎ আকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্রযচ্ছতি।। ৪৩

তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগৎ এতৎ চরাচরম্‌। সা এষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে।। ৪৪]

এই দেবী ভগবতী (মহা-ঐশ্বর্যশালিনী) মহামায়া, জ্ঞানীদের চেতনাও সবলে আকর্ষণ করে মোহগর্তে নিক্ষেপ করেন। তিনিই এই বিশ্ব-জগৎ-চরাচর সৃষ্টি করেছেন, তিনি প্রসন্না হলেই মানুষকে মুক্তির বরদান করে থাকেন।

সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।

সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী।। ৪৫

[সা বিদ্যা পরমা মুক্তেঃ হেতু-ভূতা সনাতনী। সংসার-বন্ধ-হেতুঃ চ সা এব সর্ব-ঈশ্বর-ঈশ্বরী।। ৪৫]

তিনিই সনাতনী (অনাদি, অনন্তা, নিত্যস্থিতা) এবং তিনিই মুক্তির কারণ স্বরূপা পরমাবিদ্যা (ব্রহ্মজ্ঞান)। তিনিই (অবিদ্যা-রূপা) সংসার বন্ধনের কারণস্বরূপা, তিনি সকল ঈশ্বরেরও (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহশ্বর) ঈশ্বরী।

রাজোবাচ।

ভগবন্‌ কা হি সা দেবী মহামায়েতি যাং ভবান্‌।

ব্রবীতি কথমুৎপন্না সা কর্মাস্যাশ্চ কিং দ্বিজ।। ৪৬

যৎস্বভাবা চ সা দেবী যৎস্বরূপা যদুদ্ভবা।

তৎ সর্বং শ্রোতুমিচ্ছামি ত্বত্তো ব্রহ্মবিদাং বর।। ৪৭

[রাজা উবাচ। ভগবন্‌ কা হি সা দেবী মহামায়া ইতি যাম্‌ ভবান্‌। ব্রবীতি কথম্‌ উৎপন্না সা কর্ম অস্যাঃ চ কিম্‌ দ্বিজ।। ৪৬

যৎ-স্বভাবা চ সা দেবী যৎ-স্বরূপা যৎ-উদ্ভবা। তৎ সর্বম্‌ শ্রোতুম্‌ ইচ্ছামি ত্বত্তঃ ব্রহ্মবিদাং বর।। ৪৭]

রাজা বললেন। হে ভগবন্‌, আপনি যাঁকে মহামায়া বলছেন, সেই দেবী কে? হে মুনিবর, তিনি কিভাবে আবির্ভূতা হন, তাঁর কারণই বা কী?  হে ব্রহ্মবিদ-শ্রেষ্ঠ, সেই দেবীর যেমন স্বভাব, যেমন স্বরূপ এবং যে কারণে তাঁর আবির্ভাব – সবই আপনার থেকে জানতে ইচ্ছে করি।

ঋষিরুবাচ।

নিত্যৈব সা জগন্মূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্‌।

তথাপি তৎ সমুৎপত্তির্বহুধা শ্রূয়তাং মম।। ৪৮

[ঋষিঃ উবাচ। নিত্যা এব সা জগৎ-মূর্তিঃ তয়া সর্বম্‌ ইদম্‌ ততম্‌। তথাপি তৎ সমুৎপত্তিঃ বহুধা শ্রূয়তাং মম।। ৪৮]

মেধস ঋষি বললেন, তিনিই নিত্য – সনাতনী, এই প্রপঞ্চময় জগৎ তারই মূর্তি, তিনিই সর্বত্রই ব্যাপ্ত। কিন্তু তিনিই যে বহুরূপে আবির্ভূতা হয়ে থাকেন, সে কথাটি আমার কাছে শুনুন।

দেবানাং কার্যসিদ্ধ্যর্থমাবির্ভবতি সা যদা।

উৎপন্নেতি তদা লোকে সা নিত্যাপ্যভিধীয়তে।। ৪৯

যোগনিদ্রাং যদা বিষ্ণুর্জগত্যেকার্ণবীকৃতে।

আস্তীর্য শেষমভজৎ কল্পান্তে ভগবান্‌ প্রভুঃ।। ৫০

তদা দ্বাবসুরৌ ঘোরৌ বিখ্যাতৌ মধুকৈটভৌ।

বিষ্ণুকর্ণমলোদ্ভূতৌ হন্তুং ব্রহ্মাণমুদ্যতৌ।। ৫১

[দেবানাং কার্য-সিদ্ধি-অর্থম্‌ আবির্ভবতি সা যদা। উৎপন্না ইতি তদা লোকে সা নিত্যা অপি অভিধীয়তে।। ৪৯

যোগনিদ্রাম্‌ যদা বিষ্ণুঃ জগতি এক-অর্ণবীকৃতে। আস্তীর্য শেষম্‌ অভজৎ কল্প-অন্তে ভগবান্‌ প্রভুঃ।। ৫০

তদা দ্বৌ অসুরৌ ঘোরৌ বিখ্যাতৌ মধু-কৈটভৌ। বিষ্ণু-কর্ণমল-উদ্ভূতৌ হন্তুং ব্রহ্মাণম্‌ উদ্যতৌ।। ৫১]

যখন তিনি দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্যে আবির্ভূতা হন, তিনি স্বরূপতঃ নিত্য হলেও, তিনি এই ধরণীতে জন্ম নিয়েছেন, লোকে এমন কথাই বলেন। প্রলয়কালে (ব্রহ্মার দিবা অবসানে) পৃথিবী যখন বিশাল এক সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল, তখন শেষ বা অনন্তনাগকে শয্যার মত বিছিয়ে প্রভু বিষ্ণু যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। সেই সময় মধু ও কৈটভ নামে বিখ্যাত দুই ভয়ংকর অসুর বিষ্ণুর কর্ণমল (কানের ময়লা) থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মাকেই হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল।

[ব্রহ্মার দিবা অবসানে - সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি – মানুষের এই চার যুগে দেবতাদের এক দিব্য-যুগ হয়। মোটামুটি ৭১ দিব্য-যুগে এক মন্বন্তর হয়। এরকম চোদ্দ মন্বন্তরে ব্রহ্মার এক দিবস।

বিষ্ণু জগতের পালনকর্তা। পৃথিবীর লয়ের সময় যখন তাঁর কার্য স্থগিত হয়ে যায়, তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যোগনিদ্রায় মগ্ন হন। দেবী মহামায়ার সত্ত্বগুণ বিষ্ণুরূপে প্রকাশিত। অতএব দেবীর সাত্ত্বিকী পালিকা শক্তিও তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে।]   

স নাভিকমলে বিষ্ণোঃ স্থিতো ব্রহ্মা প্রজাপতিঃ।

দৃষ্ট্বা তাবসুরৌ চোগ্রৌ প্রসুপ্তঞ্চ জনার্দনম্‌।। ৫২

তুষ্টাব যোগনিদ্রাং তামেকাগ্রহৃদয়স্থিতঃ।

বিবোধনার্থায় হরের্হরিনেত্রকৃতালয়াম্‌।। ৫৩

ওঁ ঐঁ বিশ্বেশ্বরীং জগদ্ধাত্রীং স্থিতিসংহারকারিণীম্‌।

নিদ্রাং ভগবতীং বিষ্ণোরতুল্যং তেজসঃ প্রভুঃ।। ৫৪

[স নাভিকমলে বিষ্ণোঃ স্থিতঃ ব্রহ্মা প্রজাপতিঃ। দৃষ্ট্বা তৌ অসুরৌ চ উগ্রৌ প্রসুপ্তঞ্চ জনার্দনম্‌।। ৫২

তুষ্টাব যোগনিদ্রাম্‌ তাম্‌ একাগ্র-হৃদয়-স্থিতঃ। বিবোধন-অর্থায় হরেঃ হরি-নেত্র-কৃত-আলয়াম্‌।। ৫৩

ওঁ ঐঁ বিশ্বেশ্বরীম্‌ জগদ্ধাত্রীম্‌ স্থিতি-সংহার-কারিণীম্‌। নিদ্রাম্‌ ভগবতীম্‌ বিষ্ণোঃ অতুল্যম্‌ তেজসঃ প্রভুঃ।। ৫৪]

 সেই (অনন্ত শয়ানে যোগনিদ্রারত) বিষ্ণুর নাভি থেকে প্রস্ফুটিত কমলের উপর অবস্থান করছিলেন প্রভু প্রজাপতি-ব্রহ্মা। তিনি উগ্র দুই অসুরকে দেখলেন, দেখলেন যোগনিদ্রামগ্ন জনার্দনকে। শ্রীহরির জাগরণের জন্যে তিনি একাগ্র চিত্তে, হরির নেত্রে অবস্থানকারী অতুলনীয় তেজশক্তি স্বরূপা বিশ্বেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী – স্থিতি-সংহারকারিণী ভগবতী যোগনিদ্রার স্তব করতে শুরু করলেন।

ব্রহ্মোবাচ।

ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্‌কারঃ স্বরাত্মিকা।

সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।। ৫৫

অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ।

ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।। ৫৬

ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।

ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।। ৫৭

[ব্রহ্মা উবাচ। ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্‌কারঃ স্বর-আত্মিকা। সুধা ত্বম্‌ অক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রা-আত্মিকা স্থিতা।। ৫৫

অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যা ন-উচ্চার্যা বিশেষতঃ। ত্বম্‌ এব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা।। ৫৬

ত্বয়া এব ধার্যতে সর্বং ত্বয়া এতৎ সৃজ্যতে জগৎ। ত্বয়া এতৎ পাল্যতে দেবি ত্বম্‌ অৎসি অন্তে চ সর্বদা।। ৫৭]

ব্রহ্মা বললেন, আপনিই স্বাহা, আপনিই স্বধা, আপনিই বষট্‌মন্ত্র এবং স্বর-স্বরূপা। আপনিই অমৃত, আপনি নিত্য ত্রিমাত্রারূপে অধিষ্ঠিতা অক্ষর। আপনিই নির্গুণে অধিষ্ঠিতা, আপনিই নিত্যা, আপনাকে বিশেষতঃ বর্ণনা করা যায় না। আপনিই সেই গায়ত্রীর দেবী সাবিত্রী, আপনিই দেবজননী, আপনিই সর্বোত্তমা। আপনিই এই জগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং ধারণ করেছেনআপনিই একে পালন করেন, আবার হে দেবি, প্রলয়কালে আপনিই এই জগতকে গ্রাস করে থাকেন

[দেবতাদের যজ্ঞে আহুতি দেওয়ার প্রধান মন্ত্র – “স্বাহা”। পিতৃযজ্ঞের আহুতি মন্ত্র “স্বধা”। বষট্‌ মন্ত্রে দেবতাদের আবাহন করা হয়। ত্রিমাত্রা – অ-কার, উ-কার ম-কার এই তিন মাত্রার অক্ষর বা বর্ণ আদি বীজ মন্ত্র, অউম বা ঔঁ এই মন্ত্রকে প্রণব বলা হয়।]

বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে

তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে।। ৫৮

মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ।

মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।। ৫৯

[বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে। তথা সংহৃতিরূপ অন্তে জগতঃ অস্য জগৎ-ময়ে।। ৫৮

মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ। মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।। ৫৯]

আপনিই সৃষ্টিরূপে সৃজন করেন, স্থিতিরূপে আপনিই পালন করেন, আবার আপনিই বিনাশিনীরূপে প্রলয় উপস্থিত করেনআপনিই এই জগৎময় ব্যাপ্ত। আপনিই (ব্রহ্মস্বরূপা) মহাবিদ্যা, আবার আপনিই (অবিদ্যাস্বরূপা) মহামায়া, আপনিই মহৎ-চেতনা, আপনিই মহা-স্মৃতি, আপনিই (অজ্ঞানরূপা) মহামোহ, আপনিই দেবশক্তি-স্বরূপা মহাদেবী এবং অসুরশক্তি-স্বরূপা মহাসুরী।

 প্রকৃতিস্ত্বং হি সর্বস্য গুণত্রয় বিভাবিনী

কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহরাত্রিশ্চ দারুণা।। ৬০

[প্রকৃতিঃ ত্বং হি সর্বস্য গুণত্রয় বিভাবিনী। কালরাত্রিঃ –মহারাত্রিঃ – মোহরাত্রিঃ চ দারুণা।। ৬০]

আপনিই সর্বভূতের প্রকৃতিরূপা – তাদের তিনগুণের (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ) বিধায়িনী। আপনিই কালরাত্রি, মহারাত্রি এবং নিদারুণ মোহরাত্রি।

[যে সময় ব্রহ্মার দিবাবসান হয়, সেই কালে সত্ত্বগুণ লয় হয়, সেই রাত্রিকে কালরাত্রি বলা হয়যে সময় জগতের লয় হয়, অর্থাৎ রজোগুণের বিলোপ ঘটে, সেই রাত্রিকে মহারাত্রি বলে। মোহরাত্রি মানুষ এবং জীবের নিত্য সঙ্গী। জীবের জন্ম মাত্রই মোহরাত্রির শুরু, মৃত্যুতে তার লয়। অর্থাৎ তমোগুণের প্রভাবে মোহরাত্রি আসে। এই মোহরাত্রি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় দুস্তর ব্রহ্মজ্ঞানলাভ।]

 ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্বোধলক্ষণা।

লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিস্ত্বং শান্তি ক্ষান্তিরেব চ।। ৬১

খড়্গিনী, শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিণী তথা।

শঙ্খিনী চাপিনী বাণভুসণ্ডীপরিঘায়ুধা।। ৬২

[ত্বম্‌ শ্রীঃ ত্বম্‌ ঈশ্বরী ত্বম্‌ হ্রীঃ ত্বম্‌ বুদ্ধিঃ-বোধ-লক্ষণা। লজ্জা পুষ্টিঃ তথা তুষ্টিঃ ত্বম্‌ শান্তি ক্ষান্তিঃ এব চ।। ৬১

খড়্গিনী, শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিণী তথা। শঙ্খিনী চাপিনী বাণ-ভুসণ্ডী-পরিঘ-আয়ুধা।। ৬২]

আপনিই লক্ষ্মীরূপা শ্রী, আপনিই ঐশ্বর্যরূপা ঈশ্বরী, আপনিই হ্রী, আপনিই বুদ্ধি ও চেতনার লক্ষণআপনিই লজ্জা, পুষ্টি ও তুষ্টি, আপনিই শান্তি এবং ক্ষান্তিও। আপনিই খড়্গ, ত্রিশূলধারিণী, একহাতে নরমুণ্ডধারিণী ভয়ংকরী, আপনিই গদা, চক্র, শঙ্খ, ধনুক, তির, ভুসণ্ডী ও মুষলধারিণী। অর্থাৎ দশ হাতে দশ অস্ত্রধারিণী।

সৌম্যাসৌম্যতরাশেষসৌম্যেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী।

পরা পরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।। ৬৩

যচ্চ কিঞ্চিৎ ক্বচিদ্‌বস্তু সদসদ্‌ বাখিলাত্মিকে।

তস্য সর্বস্য যা শক্তিঃ সা ত্বং কিং স্তূয়সে ময়া।৬৪

[সৌম্য অসৌম্যতর অশেষ-সৌম্যেভ্যঃ তু অতিসুন্দরী। পরা পরাণাম্‌ পরমা ত্বম্‌ এব পরমা-ঈশ্বরী।। ৬৩ যৎ চ কিম্‌-চিৎ ক্বচিৎ বস্তু সৎ-অসৎ বা অখিল-আত্মিকে। তস্য সর্বস্য যা শক্তিঃ সা ত্বম্‌ কিম্‌ স্তূয়সে ময়া। ৬৪]

আপনি (দেবতাদের প্রতি) প্রশান্ত, আপনি (অসুরদের প্রতি) রুদ্রা, অশেষ সুন্দরের তুলনায় আপনি অতীব সুন্দরীসকল শ্রেষ্ঠদের মধ্যে আপনিই শ্রেষ্ঠা, আপনিই পরমা, আপনিই পরমেশ্বরী। হে বিশ্ব-স্বরূপিণী, জগতের যেখানে যত কিছু চেতন বা জড় বস্তুর (অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে) শক্তি, সে সবই আপনিঅতএব আমার পক্ষে আপনার স্তব কিভাবে করা সম্ভব?

 যয়া ত্বয়া জগৎস্রষ্টা জগৎপাতাত্তি যো জগৎ।

সোঽপি নিদ্রাবশং নীতঃ কস্ত্বাং স্তোতুমিহেশ্বরঃ।। ৬৫

বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণমহমীশান এব চ।

কারিতাস্তে যতোঽতস্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান্‌ ভবেৎ।। ৬৬

[যয়া ত্বয়া জগৎ-স্রষ্টা জগৎ-পাতা অত্তি যঃ জগৎ। সঃ অপি নিদ্রা-বশম্‌ নীতঃ কঃ ত্বাম্‌ স্তোতুম ইহ ঈশ্বরঃ।। ৬৫

বিষ্ণুঃ শরীর-গ্রহণম্‌ অহম্‌ ঈশান এব চ। কারিতাঃ তে যতঃ অতঃ ত্বাম্‌ কঃ স্তোতুম্‌ শক্তিমান্‌ ভবেৎ।। ৬৬]

যিনি ব্রহ্মারূপে জগতের স্রষ্টা, বিষ্ণুরূপে যিনি জগতের পালয়িতা, শিবরূপে যিনি জগতকে গ্রাস করেন, তাঁদের সকলকেই আপনি নিদ্রাবিষ্ট করে রেখেছেন, সুতরাং আপনার স্তব করতে কে আর সমর্থ হবেন? আপনিই আমাকে, বিষ্ণুকে এবং রুদ্রকে শরীর ধারণ করিয়েছেন, অতএব আপনার স্তব কে করতে পারে?

সা ত্বমিত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈরুদারৈর্দৈবি সংস্তুতা।

মোহয়ৈতৌ দুরাধর্ষাবসুরৌ মধুকৈটভৌ।। ৬৭

প্রবোধঞ্চ জগৎস্বামী নীয়তামচ্যুতো লঘু।

বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্তুমেতৌ মহাসুরৌ।। ৬৮

[সা ত্বম্‌ ইত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈঃ উদারৈঃ দৈবি সংস্তুতা। মোহয় এতৌ দুরাধর্ষৌ অসুরৌ মধুকৈটভৌ।। ৬৭

প্রবোধম্‌ চ জগৎস্বামী নীয়তাম্‌ অচ্যুতঃ লঘু। বোধঃ চ ক্রিয়তাম্‌ অস্য হন্তুম্‌ এতৌ মহাসুরৌ।। ৬৮]

হে দেবি, নিজের এবংবিধ অলৌকিক প্রভাবে সজ্জিত হয়ে, আপনি এই দুই দুর্ধর্ষ অসুর মধু ও কৈটভকে মোহিত করুন। আপনি জগৎ-স্বামী অচ্যুতকে যোগনিদ্রা থেকে শীঘ্র জাগরিত করুন এবং এই দুই মহাসুরকে বধ করার জন্যে তাঁকে উদ্দীপ্ত করুন।

ঋষিরুবাচ।

এবং স্তুতা তদা দেবী তামসী তত্র বেধসা

বিষ্ণোঃ প্রবোধনার্থায় নিহন্তুং মধুকৈটভৌ।। ৬৯

নেত্রাস্যনাসিকবাহুহৃদয়েভ্যস্তথোরসঃ।

নির্গম্য দর্শনে তস্থৌ ব্রহ্মণোঽব্যক্তজন্মনঃ।।৭০

[ঋষিঃ উবাচ। এবম্‌ স্তুতা তদা দেবী তামসী তত্র বেধসাবিষ্ণোঃ প্রবোধনার্থায় নিহন্তুম্‌ মধুকৈটভৌ।। ৬৯

নেত্র অস্য নাসিক-বাহু-হৃদয়েভ্যঃ তথা উরসঃ। নির্গম্য দর্শনে তস্থৌ ব্রহ্মণঃ অব্যক্ত-জন্মনঃ।। ৭০]

(মেধস) ঋষি বললেন। ব্রহ্মার এই স্তুতিতে দেবী তামসী মধু-কৈটভকে বধ করার জন্যে এবং বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগরিত করার জন্যে, তাঁর চোখ, মুখ, নাক, বাহু, হৃদয় এবং বক্ষ থেকে প্রকাশিতা হয়ে স্বয়ম্ভূ-ব্রহ্মার দৃষ্টিগোচর হলেন।

[তিনগুণে শ্রীশ্রী চণ্ডীর তিনটি রূপ, তিনি সত্ত্বরূপে মহাসরস্বতী, রজোরূপে মহালক্ষ্মী এবং তমোরূপে মহাকালী। এখানে তিনি তামসী অর্থাৎ মহাকালীরূপে প্রকট হলেন।]

 উত্তস্থৌ চ জগন্নাথস্তয়া মুক্তো জনার্দনঃ।

একার্ণবেঽহিশয়নাত্ততঃ স দদৃশে চ তৌ।। ৭১

মধুকৈটভৌ দুরাত্মানাবতিবীর্যপরাক্রমৌ।

ক্রোধরক্তেক্ষণাবত্তুং ব্রহ্মাণং জনিতোদ্যমৌ।। ৭২

 [উত্তস্থৌ চ জগন্নাথঃ তয়া মুক্তঃ জনার্দনঃ। একার্ণবে অহি-শয়নাৎ ততঃ স দদৃশে চ তৌ।। ৭১

মধুকৈটভৌ দুরাত্মানৌ অতিবীর্য-পরাক্রমৌ। ক্রোধ-রক্ত ঈক্ষণৌ অত্তুম্‌ ব্রহ্মাণম্‌ জনিত উদ্যমৌ।। ৭২]

(যোগনিদ্রা থেকে) মুক্ত হয়ে জনার্দন জগন্নাথ একার্ণবের অনন্তশয়ান থেকে উঠে দেখলেন, মধু-কৈটভ নামের অতিপরাক্রমী দুরাত্মা দুই অসুর, ক্রোধে রক্ত চক্ষু হয়ে ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে।   

সমুত্থায় ততস্তাভ্যাং যুযুধে ভগবান্‌ হরিঃ।

পঞ্চবর্ষসহস্রাণি বাহুপ্রহরণো বিভুঃ।। ৭৩

[সমুত্থায় ততঃ তাভ্যাং যুযুধে ভগবান্‌ হরিঃ। পঞ্চ-বর্ষ-সহস্রাণি বাহু-প্রহরণঃ বিভুঃ।। ৭৩]

তৎক্ষণাৎ ভগবান শ্রীহরি উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন এবং তাদের সঙ্গে পাঁচহাজার বছর ধরে বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন।  

তাবপ্যতিবলোন্মত্তৌ মহামায়াবিমোহিতৌ।

উক্তবন্তৌ বরোঽস্মত্তো ব্রিয়তামিতি কেশবম্‌।। ৭৪

শ্রীভগবানুবাচ।

ভবেতামদ্য মে তুষ্টৌ মম বধ্যাবুভাবপি।

কিমন্যেন বরেণাত্র এতাবদ্ধি বৃতং মম।। ৭৫

[তৌ অপি অতিবল-উন্মত্তৌ মহামায়া-বিমোহিতৌ। উক্তবন্তৌ বরঃ অস্মত্তঃ ব্রিয়তাম্‌ ইতি কেশবম্‌।। ৭৪

শ্রীভগবান্‌ উবাচ। ভবেতাম্‌ অদ্য মে তুষ্টৌ মম বধ্যৌ উভৌ অপি। কিম্‌ অন্যেন বরেণ অত্র এতাবৎ হি বৃতম্‌ মম।। ৭৫]

অতঃপর অতি-পরাক্রমী উদ্ধত দুই অসুর, মহামায়ার প্রভাবে বিমোহিত হয়ে ভগবান কেশবকে বলল, “আমাদের থেকে বর প্রার্থনা করো”।

শ্রীভগবান বললেন, “তোমরা দুজনেই যদি আজ আমার প্রতি তুষ্ট হয়ে থাকো, তাহলে তোমরা দুজনেই আমার হাতে বধ্য হও, এখন এই আমার একান্ত অভিপ্রায়, এছাড়া অন্য বরের আর প্রয়োজন কি?”

ঋষিরুবাচ।

বঞ্চিতাভ্যামিতি তদা সর্বমাপোময়ং জগৎ।

বিলোক্য তাভ্যাং গদিতো ভগবান্‌ কমলেক্ষণঃ।। ৭৬

প্রীতৌ স্বস্তব যুদ্ধেন শ্লাঘ্যস্ত্বন্মৃত্যুরাবয়োঃ।

আবাং জহি ন যত্রোর্বী সলিলেন পরিপ্লুতা।। ৭৭

[ঋষিঃ উবাচ। বঞ্চিতাভ্যাম্‌ ইতি তদা সর্বম্‌ আপোময়ম্‌ জগৎ। বিলোক্য তাভ্যাম্‌ গদিতঃ ভগবান্‌ কমল-ঈক্ষণঃ।। ৭৬

প্রীতৌ স্বঃ তব যুদ্ধেন শ্লাঘ্যঃ ত্বৎ মৃত্যুঃ আবয়োঃ। আবাম্‌ জহি ন যত্র ঊর্বী সলিলেন পরিপ্লুতা।। ৭৭]

ঋষি বললেন, সমগ্র বিশ্ব জলময় দেখে, মহামায়ার প্রভাবে বিমোহিত দুই অসুর, কমললোচন শ্রীবিষ্ণুকে বলল, “তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা খুব প্রীত হয়েছি। তোমার হাতে মৃত্যু আমাদের গৌরবের বিষয়। পৃথিবীর যে স্থানে জল নেই, আমাদের সেখানেই হত্যা করো”।

ঋষিরুবাচ।

তথেত্যুক্ত্বা ভগবতা শঙ্খচক্রগদাভূতা।

কৃত্বা চক্রেণ বৈ ছিন্নে জঘনে শিরসী তয়োঃ।। ৭৮

[ঋষিঃ উবাচ। তথা ইতি উক্ত্বা ভগবতা শঙ্খ-চক্র-গদা-ভূতা। কৃত্বা চক্রেণ বৈ ছিন্নে জঘনে শিরসী তয়োঃ।। ৭৮]

ঋষি বললেন। শঙ্খ-চক্র-গদাধারী ভগবান “তাই হোক” - এই বলে তিনি নিজের উরুতে তাদের দুজনকে রেখে, চক্র দিয়ে তাদের মাথা কেটে ফেললেন।

এবমেষা সমুৎপন্না ব্রহ্মণা সংস্তুতা স্বয়ম্‌।

প্রভাবমস্যা দেব্যাস্তু ভূয়ঃ শৃণু বদামি তে।। ৭৯

[এবম্‌ এষা সমুৎপন্না ব্রহ্মণা সংস্তুতা স্বয়ম্‌। প্রভাবম্‌ অস্যা দেব্যা অস্তু ভূয়ঃ শৃণু বদামি তে।। ৭৯]

এইভাবে ব্রহ্মার একনিষ্ঠ স্তবে সন্তুষ্টা দেবী সেখানে সাক্ষাৎ আবির্ভূতা হয়েছিলেন। এই দেবীর আরও প্রভাবের কথা আপনাকে আবার বলছি, আপনি শুনতে থাকুন।

 ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে মধুকৈটভবধো নাম প্রথমোধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে মধুকৈটভবধ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত হল।


...চলবে...

পরের পর্বে আসবে শ্রীশ্রী চণ্ডীর দ্বিতীয় চরিত

গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির।  

শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মহালয়ায় মহা-স্মরণ

 

এই কিছুক্ষণ আগে স্বপনদা ফোন করেছিল, আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। এমন অসময়ে স্বপনদা ফোন করে না তো! কোন বিপদ-আপদ হল নাকি? ফোনটা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী খবর স্বপনদা, এত রাতে?”

“লে, ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি? ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম?”

“না। না। ঘুমোইনি, বই পড়ছিলাম”।

“অ। তোর তো আবার বইপড়ার নেশা – আমার যেমন মালের। শোন না, কাল তো মহালয়া বলে আমাদের অফিস ছুটি। তোর কি প্রোগ্রাম? চলে আয় একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে দিতে মাল খাওয়া যাবে”।

“কখন?”

“মাল খাওয়ার আবার কখন কিরে? তিথি নক্ষত্র দেখতে হবে নাকি? সকালেই চলে আয়, ব্রেকফাস্টের সঙ্গে হাল্কা বিয়ার...”।

আমি ইতস্তত করে বললাম, “না, মানে স্বপনদা, হয়েছে কি? কাল মহালয়া তো, তাই ওই একটু...”

“তর্পণ? তুই সেই চিরকেলে মাকড়াই রয়ে গেলি, মানুষ হলি না। আচ্ছা, এত বছর তর্পণ করে কী পেয়েছিস বল তো, কটা হাত পা গজিয়েছে?”

হেসে ফেললাম, বললাম, “তর্পণ করি আর না করি নতুন হাত-পা কোনভাবেই গজায় না। বরং যে কটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, সে কটা আবার জমা করে যেতে হবে যাওয়ার সময়...”।

“একদম হক কথা বলেছিস। লোকে পুজো-আচ্চা করে কিছু পাওয়ার ধান্ধায় – টাকা দাও, ক্ষ্যামতা দাও, নামজাদা করে দাও, গুচ্ছের বাচ্চা-কাচ্চা দাও, চাকরি দাও, মেয়ের জন্যে ঘ্যামা বর দাও, ছেলের জন্যে টুকটুকে আত্মীসূয়ো বউ দাও...খালি শালা দাও, দাও...যেন ভিখিরির বাচ্চা। তুই কিসের জন্যে পুজো করবি, রে হতভাগা?”

আমি হাসলাম, বললাম, “আমি পুজো তো করব না, তর্পণ করব”।

“আবে ছাড়, যারে কই চালভাজা তারেই কয় মুড়ি। কিছু অংবং মন্ত্র ঝাড়া, আর গঙ্গা থেকে হাতে জল নিয়ে গঙ্গাতেই হাত ঝেড়ে ফেলা। ব্যাপারটা একই। মরে হেজে যাওয়া পূর্বপুরুষদের তেল দিয়ে কিছু কামাই করার ছক”।    

“না স্বপনদা, তর্পণ মানে কাউকে কোন তেল-টেল দেওয়া নয় – পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা – জাস্ট স্মরণ করা”।

“আচ্ছা লে, তোর কথা মেনে নিলাম, স্মরণ করা। ওসব করে কী পাস কি”?

“আশ্চর্য এক তৃপ্তির অনুভূতি। সেটাই আমার পাওনা”।

“অ তুই তো আবার লিখিস-টিখিস, আবেগ আর অনুভূতি তো তোর লেখার মূলধন। তার মানে তর্পণ করে তুই গল্পের প্লট পেয়ে যাস”?

“না, স্বপনদা, এ অনুভূতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতি। ব্যস্‌, তার বাইরে আর কিচ্ছু পাই না”।

“কৃতজ্ঞতা? যা শালা, কার প্রতি কৃতজ্ঞতা? কিসের জন্যে কৃতজ্ঞতা”?

আমি হেসে ফেললাম, বললাম, “এখনও পর্যন্ত তোমার ক পেগ হল? কার প্রতি এবং কিসের কৃতজ্ঞতা -  সেটা বোঝাতে একটু সময় লাগবে”।

“আবে, চার পেগ চলছে, আরও না হয় দু পেগ মেরে দেব। কালকে ছুটি – বেলা পর্যন্ত হোগ্‌গা উলটে ঘুমোব – কোন ব্যাপার না। তুই যখন বলছিস, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। বলে যা শুনছি”।

“বেশ। তোমার মেয়ে ঝিমলি প্রমিসিং সায়েন্টিস্ট, থাকে মিউনিখে। তোমার ছেলে অলোক একজন আইএএস, থাকে দিল্লিতে”।

“অ্যাই তুই ভাঁট বকছিস। তার সঙ্গে তর্পণের কি সম্পর্ক, বে?”

“আরে বলতে দেবে তো? ধর ঝিমলি এবং অলোক তোমাকে কাল থেকে আর স্বীকার করল না। বাবা হিসেবে তোমাকে, এবং মা হিসেবে বৌদিকে পাত্তাই দিল না, বলল বাবা-মা কী করেছে কি আমাদের জন্যে?”

স্বপনদা বেশ ক্ষুব্ধ হল, বলল, “কী আলবাল বকছিস? তাই কোনদিন হতে পারে? আমরা ওদের জন্ম দিলাম, ঠিকঠাক গাইড করে বড়ো করলাম। অস্বীকার করব না, ওরাও ব্রিলিয়ান্ট, উই আর প্রাউড অফ দেম। তাই বলে, আমাদের স্বীকার করবে না?”

“রেগে গেলে তো? স্বাভাবিক, রাগ হবারই কথা। ভয় নেই, ঝিমলি এবং অলোক সেরকম ছেলেমেয়েই নয়। এবার বলি তুমিও ভালই ছাত্র ছিলে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কর্পোরেটে অফিসের অনেক উঁচুতে উঠে এসেছ। তোমাকে বড়ো করার পেছনে তোমার বাবা-মার অবদানকে, তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে?”

“আলবাৎ না। কিন্তু তখন থেকে তুই কী ধানাইপানাই করছিস বলতো? কী বোঝাতে চাইছিস?”

“তোমার হাতের গ্লাসটা কি খালি হয়ে গেছে? হয়ে গেলে আর এক পেগ ঢাল”।

“আবে, তোর কথামতো চলব নাকি, অলরেডি আমার ঢালা হয়ে গেছে”।

“গুড। তাহলে ধৈর্য ধরে শোন। তোমার বাবা যখন তোমাদের নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন, তোমার দাদু সেটা মেনে নেননি। দাদুর কথা না শুনেও তোমার বাবা এসেছিলেন, শহরে এসে লেখাপড়া শিখতে সুবিধে হবে বলে। তাও তোমার বাবা-মা কি তোমার দাদু-ঠাকুমাকে কোনদিন অশ্রদ্ধা করেছেন?”

“কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি একটু বড় হতেই দাদু-ঠাকুমা সব রাগ-অভিমান ঝেড়ে ফেলে আমাদের কাছেই এসে থেকে গিয়েছিলেন”।

“ঠিক, তুমি তোমার দাদুর থেকে তাঁর বাবা, কিংবা তাঁর দাদুর কথা কোনদিন শোননি? অথবা তোমার ঠাকুমার থেকে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি এবং তাঁর বাবা-মা-ভাই-বোনদের গল্প”?

“ওফ, সে সব দিনের কথা মনে করিয়ে মনটা খারাপ করিয়ে দিলি, মাইরি। ছোটবেলায় পাশে বসিয়ে ঠাকুমা আর দাদু এমন গল্প করতেন, বাবার – ছোটবেলাটা যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম। মাঠ-ঘাট, পুকুরপাড়, তালগাছের সারি, গাঁয়ে ঢোকার মুখে বড় একটা অশ্বত্থ গাছ...আহা ফ্ল্যাশব্যাকে সিনেমা দেখার মতো...”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে স্বপনদার কথা শুনতে লাগলাম – স্বপনদা আপন মনে কথা বলেই চলেছে। কিছুক্ষণ পরে স্বপনদার টনক নড়ল, বলল, “হতভাগা, চুপ করে গেলি, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি, শালা?”

আমি হাসলাম, বললাম, “না রে, বাবা, তোমার স্মৃতিচারণ শুনছিলাম মন দিয়ে। সে যাক, এ ভাবেই তুমি যদি পিছিয়ে যেতে থাক... আমাদের পারিবারিক ইতিহাস কেউই মনে রাখেনি, লিখেও রাখেনি...কিন্তু ভারতের বা বাংলার ইতিহাস তো জানি...। আমাদের বা তোমাদের এই পূর্বপুরুষরা কত বিপদ-আপদ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ঝড়-ঝাপটা, বন্যা, খরা, সামলেছেন, চিন্তা করতে পারো? ইংরেজ শাসন, তার আগে পলাশীর নবাবী আমল, বর্গী আক্রমণ, তারও আগে পাঠান রাজত্বের শুরু, সেনরাজাদের পতন...। অনুমান করার চেষ্টা কর, এই সমস্ত রাজনৈতিক পালাবদলের সময় তাঁদের সুদীর্ঘ জীবনসংগ্রামের ইতিহাস! সে কথা কোথাও লেখা নেই...তাই বলে ভুলে যাবো?”

“কী বলছিস রে, আমার তো গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠছে...দাঁড়া, দাঁড়া...একটু সামলাতে দে...”

আমি চুপ করে রইলাম। আওয়াজে মনে হল স্বপনদা খালি গ্লাসে আরেক পেগ ঢালল, তারপর বলল, “নেশাটা জমে আসছিল, কিন্তু এমন সব চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দিলি... নে আর কী বলবি বল”।  

“আর তো বেশি কিছু বলার নেই, স্বপনদা, এইটুকুই বলার যে আমাদের এই জীবন যাঁদের সুদীর্ঘ জীবন-সংগ্রামের জন্য আমরা আজ পেয়েছি, সেই সব অজানা পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানানোটা কি কুসংস্কার – নাকি অন্ধ ধর্মবিশ্বাস”?

“বুঝলাম। কিন্তু সংস্কৃত ওই মন্ত্রগুলো”?

“তোমার কি সংস্কৃততে এলার্জি, তাহলে কোনটা শুনতে বা বলতে তোমার সুবিধে হবে, বাংলা না ইংরিজি?”

“প্যাঁক দিচ্ছিস? দে। কিন্তু বাংলাতেই বল”।

“আচ্ছা শোন। অন্য সব বিধিবিধান বাদ দিয়ে পিতৃতর্পণ দিয়ে শুরু করি? তর্পণ মানে জানো তো? তৃপ্তি সাধন অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের তৃপ্তি দান। সে তৃপ্তি কী আর গঙ্গাজল আর কালোতিলের অঞ্জলি দিয়ে হয়? না, ওটা বহিরাচার – তুমি যে তাঁদের স্মরণ করছ, তাতেই তাঁরা তৃপ্ত হবেন। বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা বেঁচে থাকলে কিন্তু তাঁদের নামে তর্পণ হবে না, হবে শুধুমাত্র মৃত ও মৃতাদের উদ্দেশে। তোমার পূর্বপুরুষদের কতজনের নাম জানো?”

“আমি? ধুস্‌, দাদু-ঠাকুমার নাম জানি, তার আগেকার কিছুই জানি না। বাবা জানতেন, মনে হয় বাবার কোন ডায়েরিতে লেখা আছে”।

“দেখে নিতে পারো। সাতপুরুষের নাম – মানে বাবার তরফে দাদু ও ঠাকুরমাদের নাম, মায়ের তরফে দিদিমা, দাদামশাইদের নাম। বুঝতেই পারছ, এক এক জনের নাম বলে, পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধ পিতামহ, প্রবৃদ্ধপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ ইত্যাদি এবং একইভাবে মহিলাদের ক্ষেত্রে পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহী এরকম। প্রত্যেকের জন্যেই তিনবার করে, না পারলে অন্ততঃ একবার করে বলবে, “হে পিতামহ/ পিতামহী, আমার এই সতিল জলাঞ্জলি গ্রহণ করে তৃপ্ত হও বা তৃপ্তা হও”। কি, খুব শক্ত কিছু?”

“না, আগে আমাকে নামগুলো যোগাড় করতে হবে”।

“সে কাল সকালে খুঁজে দেখ। কিন্তু এরপর যা বলব শুনে আশ্চর্য হবে, আমাদের ইতিহাসের কিছু কিছু টুকরোও হয়তো খুঁজে পাবে...”।

“কিরকম?”

ওঁ নমঃ আ-ব্রহ্মভুবনাল্লোকা, দেবর্ষি-পিতৃ-মানবাঃ ,

তৃপ্যন্তু পিতরঃ সর্ব্বে , মাতৃ-মাতামহাদয়ঃ

এর মানে হচ্ছে, ব্রহ্মলোক থেকে শুরু করে, সকল লোকে বাস করা জীবগণ ( যক্ষ, নাগাদি), দেবর্ষি (মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরাদি ), পিতৃগণ, মনুষ্যগণ ( সনক, সনন্দ প্রভৃতি ), পিতা-পিতামহাদি এবং মাতা-মাতামহাদি সকলে তৃপ্ত হোন”

“সেই তো তুই ঘুরেফিরে ব্রহ্মা আর ঋষি এনে হাজির করলি”।  

“বাঃ, এই ঋষি, মনীষীরা না থাকলে ভারতীয় সংস্কৃতি থাকত কোথায়? আচ্ছা বেশ, পৌরাণিক মনীষীদের ছেড়েও যদি দাও – কালিদাস, বরাহমিহির, আর্যভট্ট, বিষ্ণুগুপ্ত থেকে সেদিনের রবিঠাকুর, বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষ এমনকি সত্যজিৎ রায় – এঁরাও কি মনীষী নন? তাঁদের শ্রদ্ধা জানালে খুব কুসংস্কার হয়ে যাবে?”

“হতভাগা, তুই বেজায় ধুরন্ধর। আচ্ছা, তারপর বল”।     

আমি হাসলাম, বললাম, “অতীত-কুলকোটীনাং, সপ্তদ্বীপ-নিবাসিনাং

                        ময়া দত্তেন তোয়েন, তৃপ্যন্তু ভুবনত্রয়ং ।

অর্থাৎ অতীতের কোটি কোটি কুলের মানুষ, সপ্তদ্বীপের বাসিন্দা (জম্বু, প্লক্ষ, শাল্মলি, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক, পুষ্কর, এই সপ্তদ্বীপ) সমুদয় মানুষ এবং ত্রিভুবনের সব্বাই আমার এই জলে তৃপ্ত হোন”।

“আবার ঢপের গল্প এনে ফেললি, সপ্তদ্বীপ আর ওই ত্রিভুবন”।

“ঠিক আছে, ওসব বাদ দিয়ে অখণ্ড ভারতভূমির সমুদয় মানুষ বল, তাহলে হবে তো?”

“চলবে, এগো”।

“এরপরেই, যে কথা আগে বলেছিলাম, আসছে ইতিহাসের সামান্য আভাস।

ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ

তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ ।

যেমন, আমার যে আত্মীয়রা কখনো অবান্ধব হয়েছেন, পরে আবার কখনো বান্ধব হয়েছেন, তাঁরাও আমার জলের অর্ঘ্যে তৃপ্ত হোন”।

“এতে ইতিহাসের আভাস কোথায় পেলি?”

“ধরো, অতীতে দেশ ও সামাজিক পরিস্থিতিতে, আমাদের কোন জ্ঞাতি-আত্মীয় হয়তো শত্রুতা করেছিলেন বা শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তিনিই হয়তো পরে নিজের ভুল বুঝে আবার মিত্র হয়েছেন...তাঁরাও আমার হাতের জলে তৃপ্ত হোন”।

“বড্ডো গোঁজামিল দিচ্ছিস মনে হচ্ছে”।

“বোধ হয় না, পরেরটা শুনলে আরও স্পষ্ট হবে।

ওঁ নমঃ অগ্নিদগ্ধাশ্চ যে জীবা, যেহপ্যদগ্ধাঃ কুলে মম

ভূমৌ দত্তেন তৃপ্যন্তু, তৃপ্তা যান্ত পরাং গতিং ।

যেমন, যাঁদের মৃতদেহের দাহ হয়েছে, অর্থাৎ সৎকার হয়েছে, আবার যাঁদের মৃতদেহের সৎকার হতে পারেনি, তাঁরাও আমার হাতের জলে তৃপ্ত হোন। অবশ্য এই জল সিঞ্চিত করতে হবে মাটিতে - জলে নয়। মৃতদেহ সৎকার হতে পারেনি, এর অর্থ অনেককিছু হতে পারে। মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্লাবন, ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে অজস্র মৃতদেহের যে সৎকার হয় না, এ কথা আমরা সকলেই জানি। করোনা কালে এমন ঘটনা আমরা অজস্র দেখেছি। কাজেই এমনটা যে আগেও ঘটেছে, সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়। আবার বর্গী, হার্মাদ দস্যুদের, শত্রুরাজ্যের আক্রমণে গ্রামকে গ্রাম যখন ধ্বংস হয়েছে, সেক্ষেত্রে কে করবে আত্মীয়দের দেহ সৎকার? আমরা সেই মানুষদেরও স্মরণ করে যদি দু-বিন্দু জল অর্পণ করি, সেটাকে তুমি বোগাস, কুসংস্কার বলবে?”

“আর কেউ আছে?”

“আছে বৈকি।

ওঁ নমঃ যে চাস্মাকং কুলে জাতা, অপুত্রা-গোত্রিণো মৃতাঃ

তে তৃপ্যন্তু ময়া দত্তং, বস্ত্র-নিষ্পীড়নোদকং ।

এঁরা হলেন, আমাদের বংশের সন্তানহীনা নারীরা। সন্তানহীনা নারী বন্ধ্যা হতে পারেন অথবা তিনি বাল-বিধবাও হয়ে থাকতে পারেন। অভাগী সেই নারীদের স্বামীর মৃত্যুর অনেক কারণ থাকতে পারে, অসুখ, দুর্ঘটনা, অথবা ওই আগের মন্ত্রে মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্লাবন ইত্যাদি যা যা বললাম, যে কোন একটা হতে পারে। তবে এঁদের জল দেওয়া হচ্ছে পরনের ভিজে কাপড় নিংড়ানো জল দিয়ে”।  

“কাপড় নিংড়ানো জল? ছ্যাঃ, কেন?”

“জানি না গো, স্বপনদা, মন্ত্রকার কী চিন্তা করে এমন লিখেছিলেন। তোমার পছন্দ না হলে, তোমার যেমন পছন্দ সেভাবেই দিও। ক্ষতি কি?” 

“হুঁ। তুই বেশ ভাবিয়ে তুললি, সংস্কৃত বুঝতাম না, বা বলা ভাল সেভাবে বুঝতে চেষ্টাও করিনি কোনদিন। তোর কথায় বুঝলাম এটা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান তো নয়”।

“একটা জাতের মানসিক ব্যাপ্তিটা বুঝতে পারছ, স্বপনদা? হাজার-হাজার বছরের আত্মীয়-অনাত্মীয় সকল মানুষকে মনে করে, বিশেষ দিনে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো... এই আশ্চর্য ঐতিহ্যকে আমরা অন্ধ বিশ্বাস বা কুসংস্কার বলে অবহেলা করব...?”  

দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বপনদা বলল, “না রে, অন্ধ সংস্কার বলে মনে তো হচ্ছে না। বছরের একটা দিন মিনিট পনের-কুড়ির জন্যে পূর্বপুরুষদের কথা মনে না করার, তেমন কোন যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছি না। তাতে আমাদের পূর্বপুরুষরা তৃপ্তি পাবেন কিনা জানি না, আমি তো নিশ্চিত পাব। রাখছি রে, বাবার ডাইরিটা বের করে, কাল সকালে তোকে আবার ফোন করব। গুড নাইট”।

 ...০০...

সুরক্ষিতা - পর্ব ১৬

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


[আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে "সুরক্ষিতা - পর্ব ১৫"]


 বর্ষার সেই দিন থেকে শুভময়ীদেবীর চিন্তায় এখন শুধু ছবি। এতদিন ছবি তাঁর ফ্ল্যাটে ছিল অনেক আসবাবের মধ্যে যেন আরেকটা। চেয়ার বা টেবিল, সকলে ব্যবহার করে, ঝাড় পোঁছ করে, যত্ন নেয়কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া তার কথা কেউ মনে করে না। এতদিন তিনি ছবিকে ব্যবহার করেছেন, নতুন জামা কাপড়, ক্রিম পাউডার দিয়ে সাজিয়েছেন, কিন্তু সারাদিনে একবারও কি তাঁর মনে পড়ত ছবির কথা? কিন্তু এই ক’দিন স্কুলের হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ছবিকে। ওর কমনীয় দৃষ্টির গভীরতা। ওর ব্যবহার, আচার-আচরণ।

ওই দিন শোনা, পড়শী ভদ্রমহিলার উড়ো মন্তব্যটা দিনরাত্রি কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে শুভময়ীদেবীকে। পড়শী মহিলার প্রতি তাঁর রাগ হচ্ছে ঠিকই – কিন্তু তার থেকেও রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। তৎক্ষণাৎ উনি ওই কথার প্রতিবাদ করলেন না কেন? ছবির মতো একটা মেয়ের – অর্থাৎ কাজের মেয়ের জন্য, প্রতিবেশী মহিলাকে কোন উত্তর দেওয়া – আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা, সেটাই কী ভাবছিলেন? তার মানে, প্রকৃতপক্ষে তিনিও কি মনের গভীরে মহিলার ওই কথাটি বিশ্বাস করেন? সেকথা কোনদিন প্রকাশ করেননি ঠিকই, কিন্তু...। আচ্ছা ধরা যাক ওই মহিলা তাঁর বিট্টু, কিংবা বোন, ভাই, এমনকি তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়া তাঁর স্বামী সম্পর্কেও যদি কোন আপত্তিকর কথা বলতেন – তিনি কি সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করতেন না? সেক্ষেত্রে ঠিক কত সেকেণ্ড লাগত তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে? অথচ ছবির ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া-কাল এত ধীর হল কেন? কথাটা শোনার পর, ছবির কাঁধে ভর দিয়ে তিনতলায় তাঁর ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত পৌঁছনোর পর - সত্যি বলতে - তাঁর মনে হয়েছিল – “ইস মহিলাকে দুকথা শুনিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল”। আসলে নিজের কাছেই নিজের মুখোসটি তাঁর খুলে গিয়েছে। একথা অস্বীকার কোন উপায় নেই।

ঘরে এসে চেয়ারে বসতে গিয়ে শরীরের ব্যথাগুলো টের পেয়েছিলেন শুভময়ীদেবী। কোমর, দুই উরু এবং দুই নিতম্বেও বেশ আড়ষ্ট যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন। ব্যাথা ছিল বাঁহাতের বাহুমূল, কনুই ও কব্জিতেও। পাটা স্লিপ করার মুহূর্তে তিনি বাঁ হাতে সিঁড়ির হাতলটা খামচে চেপে ধরেছিলেন, এবং মুখ থুবড়ে পড়া আটকাতে আচমকা শরীরে মোচড়ে দিয়ে সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে বসে পড়েছিলেন ধপাস করে। এই পুরো প্রতিবর্ত-ক্রিয়ায়, তিনি না জানলেও, তাঁর শরীর জানে ঠিক কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোন কোন পেশীকে সচল করলে – বিপদটাকে সম্পূর্ণ এড়ানো না গেলেও সহনশীলভাবে সামলানো যাবে। চেয়ারে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে তিনি চোখ বুজে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। বুঝতে চেষ্টা করলেন – তাঁর শরীরের কোন কোন পেশীতে রয়েছে যন্ত্রণার অনুভব। এবং হিসেব করে বুঝলেন, সারাদিনের কাজ কর্মের মধ্যে, যে বিশেষ পেশীগুলো সর্বদা সচল সেগুলি ছাড়া, তাঁর শরীরের কিছু  কিছু পেশীকে আজ আচমকা অতি-সক্রিয় হতে হয়েছে। সেই কারণেই প্রায় সারা শরীর জুড়ে তাঁর এই যন্ত্রণা এবং আড়ষ্টতার অনুভব।

ছবি সারাক্ষণই পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে লক্ষ্য করছিল, চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল, “মামীমা, খুব ব্যথা হচ্ছে? ডাক্তারবাবুকে ফোন করব?”

চোখ মেলে ছবির মুখের দিকে তাকিয়ে শুভময়ীদেবী বললেন, “সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি রে। মনে হচ্ছে গরম জলে স্নান করলে ব্যথার অনেকটাই উপশম হবে। নাঃ ডাক্তার ডেকে লাভ নেই। ডাক্তার এসে কী করবে? বলবে এক্সরে করো, হ্যান করো, ত্যান করো, তারপর কিছু পেন কিলার দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তুই গিজারটা চালু করে দিয়ে আয় তো, ঝট করে চানটা করে নিই”।

“তোমার বাথরুমেগিজার চালু করা আছে অনেকক্ষণ। রান্না শেষ হওয়ার পর তোমার চানের যোগাড় করতে গিয়ে দেখি তুমি ঘরে নেই। ভাবলাম ছাদে গেছ – দেখে এলাম সেখানেও নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন ভাবছি কোথায় গেলে, দেখলাম তুমি মেন গেট দিয়ে ঢুকছ…”।

“ভাবলাম বৃষ্টিটা ধরে গেছে – টুক করে বেরিয়ে কটা ডিম নিয়ে আসি – কিন্তু শেষ রক্ষা হল না...”

“কটা ডিম এনেছিলে?”

“ছটা! কেন সব কটাই ভেঙে গেছে নাকি?”

“দুটো আস্তো আছে – বাকিগুলো প্যাকেটের মধ্যে ফেটেফুটে গোলা হয়ে গেছে...”।

চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে শুভময়ীদেবী বললেন, “আমি বরং চানটা সেরে আসি – তুই গোলা দিয়ে যা পারিস কর...”।

ছবি নাক কুঁচকে বলল, “ছিঃ, ডিমের গায়ে মুরগির গু-মূত লেগে থাকে দেখনি? ওই গোলার মধ্যে সব আছে – ও গোলা আমি ফেলে দেব...”

শুভময়ীদেবীর সুসভ্য কানে “গু-মূত” কথাটা খট করে বাজল। কিছু বললেন না – কিন্তু ছবির বিচক্ষণতায় বেশ নিশ্চিন্তই হলেন – কথাটা তাঁর মাথায় আসেনি কেন? বাথরুমে ঢুকে নাতিশীতোষ্ণ জলের ধারার নীচে  দাঁড়িয়ে অনেককটাই আরাম ও স্বস্তি বোধ করলেন। এবং তখনই তাঁর মনে হল – পটি আর গু – ইউরিন আর মূত ... দুটোর মধ্যে তফাৎ কিছুই নেই – বিদেশী কারুকার্য ছাড়া। এই ছবি দিনের পর দিন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, তাঁর পুত্রের গু-মূত সাফ করেছে? নাকি পটি আর ইউরিন? এ নিয়ে তার কথাবার্তায়, আচরণে কোনদিন কোন বিকার তিনি লক্ষ্য করেননি। সেকি শুধু টাকার জন্যে নাকি অন্য কিছু – যার হদিশ তিনি রাখেননি, বোঝেনওনি কোনদিন। ছবি কি শুধুই “কাজের লোক”, আয়া, নাকি ঝি? নাকি মেডসার্ভেন্ট, অ্যাটেন্টডেন্ট? ওই মহিলা কোনটা বললে, তাঁর অস্বস্তি কম হত? তিনি নিজেও এতদিন ছবিকে ঠিক কোন চোখে দেখেছেন?

ছেলের চির-অসুস্থতা, স্বামী-শ্বাশুড়ি, আত্মীয়-পরিজনদের শীতল ও উদাসীন দূরত্ব, তাঁকে একদিকে কি স্বার্থপর করে তোলেনি? অন্যদিকে তাঁর কর্মজীবনের সাফল্য, তাঁর মনে কি অহংকার সৃষ্টি করেনি? তিনি বিপক্ষকে  অবহেলায় পরাস্ত করেছেন এবং তার সঙ্গে অক্লেশে উপভোগ করেছেন তাঁর কর্মজীবন – এই দুই বিপরীত মেরু তিনি মাথা উঁচু করে সামলেছেন একদম একা – একথা তিনি তো অহরহ চিন্তা করেছেন। তার জন্যে তিনি অনুভব করেছেন শ্লাঘা। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তিনি সত্যিই কি একা হাতে সব সামলেছেন? নাকি আড়ালে থেকে নিঃশব্দে তাঁকে আরেকজন কেউ সাহায্য করেছে প্রতিটি দিন – চব্বিশ ঘন্টা? সেই মেয়েটি কি ছবি নয়? ছবি এ বাড়িতে আসার আগে – প্রায় দ্বিগুণ বা তার বেশি অর্থ ব্যয় করে তাঁরা সেন্টার থেকে যে ট্রেন্‌ড্‌ আয়া রাখতেন – তারা দিনের পর দিন তাঁকে ধোঁকা দেয়নি? মনে কী দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ নিয়েই না তিনি সেসময় স্কুলে যেতেন। সেকথা ভুলে গেলেন কী করে? ছবি নামের এই “কাজের মেয়ে”টি তাঁকে একদিনের জন্যেও ধোঁকা দেয়নি। তাঁর ভরসাতেই তিনি স্কুলের কাজে মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন নিশ্চিন্তে। স্কুলের শত কাজের চাপেও বাড়ির কথা ভেবে তাঁকে কোনদিন বিপর্যস্ত হতে হয়নি – কারণ তিনি জানতেন বাড়িতে ছবি আছে।

 

স্নান সেরে অনেকটাই সুস্থ বোধ করেছিলেন শুভময়ীদেবী। যদিও হাঁটতে গেলে পিঠে আর কোমরে একটু ব্যথা এবং সারা শরীরের অসম্ভব ক্লান্তি অনুভব করছিলেন। তাঁর মনে হল খাওয়া-দাওয়া সেরে দুপুরে নিখুঁত একটা ঘুমের প্রয়োজন।  ডাইনিং টেবিলে বসতেই তাঁর সামনে এসে গেল ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়ি, ঈষৎ সোনালী রঙের ডিমভাজা আলাদা একটা প্লেটে আর পটলভাজা।

এক চামচ মুখে তুলে শুভময়ীদেবী বললেন, “বাঃ অপূর্ব। সত্যিই তোর হাতের ছোঁয়ায় বাদুলে দিনটা সার্থক হল – কিন্তু পাঁপড় ভাজিসনি?”

“না। ভেজে দেব? দুটো ভাজা রয়েছে – চাটনি করেছি…তাই আর…। সন্ধেকফির সঙ্গে পাঁপড়ভাজা আর পেঁয়াজি…”।

“ওক্কে, ঠিকই করেছিস – কিন্তু তোর প্লেট কোথায়? নিয়ে আয় – খিচুড়ি জুড়িয়ে গেলে মোটেই ভালো লাগে না…”। কথাগুলো বলেই শুভময়ীদেবী একটু অস্বস্তি অনুভব করলেন। এমন কথা তো তিনি কোনদিন বলেননি ছবিকে। আজ কেন বললেন? নীচের ওই ভদ্রমহিলার কথায় তাঁর যে বিবেক জাগ্রত হয়ে উঠেছে – এটা কি তারই বহিঃপ্রকাশ? সেক্ষেত্রে তাঁর তো ওই ভদ্রমহিলাকে “থ্যাংক্‌স্‌ আ লট” বলা উচিৎ, দু কথা শোনানোর কোন প্রশ্নই ওঠে না।

“আমি পরে খাচ্ছি, তুমি এখন শান্তিতে খাও তো। চাটনিটা নিয়ে আসি…” বলে দ্রুত চলে গেল রান্নাঘরে। শুভময়ীদেবী ভাবলেন তাঁর বলাটা একটু দৃষ্টকটু রকমের বাড়াবাড়ি হয়ে উঠল – যাকে বলে শো অফফ্‌। ছবি এটাকে ঠিক কি বলতে পারে – ঢং নাকি আদিখ্যেতা? শুভময়ীদেবীর হাসি পেল।

চাটনিটা আনারসের – একটা প্লেটে এনে তাঁর হাতের কাছে রাখল ছবি। তারপর গামলা খুলে আরও দুহাতা তপ্ত খিচুড়ি তুলে দিল শুভময়ীদেবীর প্লেটে।

“দুহাতা দিয়ে দিলি? বেশি হয়ে গেল অনেক…এত খাই আমি কোনদিন”?

“আজ – ছুটির দিন – খাও না বেশি করে – দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিলেই সব হজম হয়ে যাবে…”। 

খাওয়া শেষ করে, নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে শুভময়দেবী বললেন, “বেলা হল অনেক, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, ছবি”। ছবি উত্তর দিল, “এই তো চানটা সেরেই খেয়ে নেব”।

 

বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গভীর ঘুম যাকে বলে। ছবিই ঘুম ভাঙাল – কফি আর পাঁপড় ভাজা – পেঁয়াজি নিয়ে। লোভনীয় গন্ধে বেশ চনমনে মেজাজে বিছানায় উঠতে গিয়েই টের পেলেন – তাঁর কোমরের দুই পাশ আড়ষ্ট – বেশ যন্ত্রণা অনুভব করলেন। মুখে ফুটে উঠল ব্যথার অভিব্যক্তি।  

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ছবি বলল, “ব্যাথাটা রয়েছে এখনো? ও বেলার থেকে কমেছে নাকি আরও বাড়ল? কফিটা খেয়ে ডাক্তারবাবুকে একবার ডাকবে নাকি?”

ম্লান হেসে শুভময়ীদেবী বললেন, “কমেছে অনেকটা। আজকের দিনটা দেখি – তারপর যা হয় করা যাবে...”।

“তাহলে তুমি কফিটা খেয়ে নাও, আমি বরং সামান্য গরম তেল নিয়ে এসে তোমার কোমরটা একটু ডলে দিই, দেখো আরাম পাবে”।

ছবি গরম তেল দিয়ে ম্যাসাজ করে দেওয়ার কথা বলতে, তাঁর ভালই লাগল।  এসব টোটকাতে অনেক সময়  কাজ হয়। শুভময়ীদেবী তৃপ্তি পেলেন পেঁয়াজি এবং ভাজা পাঁপড়ের কুড়মুড় শব্দ সঙ্গতে কফিতে চুমুক দিয়েও।

কফি শেষ হতে না হতেই ছবি সাঁড়াশিতে ধরে ছোট্ট বাটিতে করে তেল গরম নিয়ে এল, বলল, “চট করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো তো…দেখি কোথায় তোমার ব্যথা”।

বাধ্য মেয়ের মতোই শুভময়ীদেবী উপুড় হয়ে শুলেন। তাঁর পাশে বসে ছবি দুহাতে তেল মেখে কোমরে তেল ডলতে লাগল – তেলের উষ্ণতা আর ছবির হালকা স্পর্শে  বড়ো আরাম অনুভব করলেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করলেন, “এসব তুই কার থেকে শিখেছিস, রে পাকাবুড়ি?”

“কেন? আরাম হচ্ছে না? শিখেছি আমার দিদুর থেকে এবং মায়ের থেকেও। দুজনেই চার-পাঁচ বাড়ি কাজ করে তো – ওদেরও মাঝে মাঝে মাজা কনকন করে – বিশেষ করে বর্ষার দিনে। দুজনেরই বয়েস হচ্ছে – কতদিন আর এভাবে টানতে পারবে কে জানে?” শেষ কথাগুলো শুভময়ীদেবীর মন ছুঁয়ে গেল। বড়ো মায়া হল ছবির ওপর। সংসারের সুরাহা করতে, মা আর দিদুর সঙ্গে মেয়েটা সেই কবে থেকে কাজে লেগে পড়েছে। কিন্তু ওদের দুঃখের দিন যেন শেষ হবার নয়।

শুভময়ীদেবী মন দিয়ে ছবির আন্তরিক স্পর্শ অনুভব করতে করতে ভাবলেন, তাঁদের কর্মজীবনের একটা সীমা আছে – আছে অবসরের বয়েস। সেই বয়সে পৌঁছে আর কাজ করতে হয় না। কাজ না করলেও কিন্তু তাঁদের তেমন কিছু দুশ্চিন্তা থাকে না। পেনসন আছে, পিএফ-গ্র্যাচুইটি আছে। সঞ্চয় আছে। কিন্তু এদের? আমৃত্যু লড়তে হবে – দুটি অন্ন সংস্থানের জন্যে, বছরে তিন-চারটে কাপড়ের জন্যে। তবু ভালো মাথা গোঁজার জন্যে ছবির দিদুর একটা বাড়ি আছে। তা না থাকলে এক চিলতে বাসার ভাড়ার জন্যেও ওদের লড়াই করে যেতে হবে আজীবন।

এই পরিবারটা তাঁকে অনেক কিছু দিয়েছে – শুভময়ীদেবী ভাবলেন – এবার সময় এসেছে এদের জন্যে কিছু একটা করার। তাঁর জীবনটাকে যে বা যারা নিশ্চিন্ত রেখেছে এতদিন ধরে, তারা কি একটু সুখের প্রত্যাশা করতে পারে না? 

চলবে...

 

নতুন পোস্টগুলি

গীতা - ৩য় পর্ব

                          [ এর আগের ২য় পর্ব - সাংখ্যযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে  গীতা - ২য় পর্ব  ] তৃতীয় অধ্যায়ঃ কর্মযোগ ৩/১ ...