রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

আবার আসিব ফিরে...

 

রোজই পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এলে মা, বাবা যখন জিগ্যেস করতেন – পরীক্ষা কেমন হল? আমার জবাব ছিল – মোটামুটি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, এই উত্তরটাই সবচেয়ে নিরাপদ। খারাপ বললে এখন ওঁদের মন খারাপ হবে, ভালো বললে দারূণ আশায় বুক বাঁধবেন। পরে রেজাল্ট খারাপ বের হলে ভীষণ হতাশ হবেন। কাজেই - মোটামুটি। আমার সরলা মা অতশত বুঝতে না পারলেও, বাবা ঠিকই বুঝেছিলেন, আর মাকে ডেকে বলেছিলেন –

-‘তোমার ঘুনুসোনা, এখন বেশ লায়েক হয়ে উঠেছে, বুঝেছ? চালাকি-টালাকিগুলো বেশ শিখে যাচ্ছে দিন দিন’। এই কথায় মা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু তাঁর স্নেহদৃষ্টিতে আমার চেহারায় লায়েকির কোন লক্ষণ খুঁজে না পেয়ে, তিনি হতাশ হয়েছিলেন, আমার প্রতি বাবার বিপক্ষপাতিত্বে।

পরীক্ষার পর আমরা আমাদের সময়টাকে বেশ সুন্দর সাজিয়ে ফেললাম। নুন শো অথবা এবং ম্যাটিনী শোতে সিনেমা একদিনে দুটি শো আমাদের বহুদিনই দেখতে হত নেশার বিপুল টানে! আমাদের রাজ্যের সীমানা ছিল উত্তরে শ্যামবাজারের মিত্রা সিনেমাহল থেকে মধ্য কলকাতায় ধর্মতলার হলগুলি। মাঝে গ্রেস, বীণা, পূরবী, ছবিঘর, অরুণা ইত্যাদি। দক্ষিণের হল পর্যন্ত রাজ্যবিস্তারের ইচ্ছে তখনো গড়ে ওঠেনি। শুরু হল বাংলা, হিন্দী আর ইংরেজি সিনেমার মহোৎসব। প্রথম দিন দেখলাম রাজেশ খান্না আর হেমা মালিনীর “মেহবুবা”আমার জীবনের প্রথম বাণিজ্যিক হিন্দী সিনেমা দর্শন। মুগ্ধ হতে কিছু বাকি রইল না। সুন্দর বর্ণবিন্যাস, অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য, হেমার নিখুঁত সৌন্দর্য ও নৃত্য, কিশোর-লতা-মান্নার অনবদ্য গান মনকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলল। প্রথমদিনেই নেশায় বুঁদ হয়ে বুঝে ফেললাম এ জিনিষের স্বাদ নিত্য চাই, অনেক অনেক। বম্বের সিনেমা জগতের নেশায় কেন গোটা ভারতবাসী বুঁদ - তা বুঝতে দেরী হল না একটুও। কাজেই সোম থেকে শনি, আমাদের বিরামহীন সিনেমা দর্শন চলতে লাগল। বেশীর ভাগ হিন্দী, তার সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি সিনেমাও চলতে লাগলতবে হিন্দী ছবির তুলনায় অন্যান্য সিনেমায়, নেশার মৌতাত হত বেশ ফিকে। স্বাভাবিক কারণেই রোববারটা বাদ থাকত, কারণ ওইদিন বাবা বাড়িতে থাকতেন।

আর বাকি সময়টা চলতে লাগল বইপড়া। আমাদের বাসার ঠিক উল্টোদিকেই ছিল এক সমৃদ্ধ পাঠাগার, স্বরাজ পাঠাগার, বাবা ছিলেন তার সক্রিয় সভ্য। তার ওপর বই ইসু করতেন যিনি, আমি ছিলাম তাঁর বিশেষ স্নেহধন্যকাজেই মায়ের পরামর্শে আমি যখন তাঁকে বললাম বঙ্কিম, শরৎ, বিভূতি, তারাশঙ্কর পড়তে চাই – তিনি আপ্লুত হলেন আমার আগ্রহে, বললেন, “বল কি হে, ওসব বই বহুদিন কেউ খোঁজও করে নাএসব পড়তে তোমায় কেউ বলেছে, বুঝি”? 

আমি বললাম, “হ্যাঁ, মা। বলেছেন বাংলা সাহিত্য বুঝতে গেলে শুরু থেকে শুরু করা উচিৎ - মানে বঙ্কিম থেকে...”

-‘ঠিক কথা। ভেরি গুড। এক কাজ কর, তুমি ভিতরে চলে এসো – ওই যে ওইদিকে, ওই আলমারিতে আছে, পছন্দমতো তুমি বেছে নিয়ে যাও...ভেতরে চলে এসো’ পাঠাগারের ভিতরে ঢুকে নিজে হাতে বই বেছে নেওয়ার বিরল অধিকার পেয়ে, ঢুকে পড়লাম ভিতরেঅজস্র বইয়ে সাজিয়ে রাখা সারি সারি বুক-শেল্ভবই, বই আর বই। পুরোনো বইয়ের অদ্ভূত গন্ধে গোটা হলঘরটি পরিপূর্ণ। 

আমাকে ভিতরের দিকে নিয়ে গিয়ে একটি বুক-শেল্ভের সামনে দাঁড় করিয়ে তিনি বললেন, ‘এইখানেই, তুমি যা খুঁজছ সব পেয়ে যাবে। বুক-শেল্ভে দ্যাখ লেখকের নামের লেবেল দেওয়া আছে, তাছাড়াও প্রত্যেক বইতে দেওয়া আছে বইয়ের নম্বর। ক্যাটালগ থেকেও দেখে নিয়ে খুঁজে নিতে পারো, যে বইটি তোমার চাই। আর কোন অসুবিধে হলে, আমার কাছে চলে এসো, কেমন’?

উনি চলে যাওয়ার পর বেশ অনেকক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম বুক-শেল্ভ গুলো। বিবর্ণ, ধূলিধূসর অবহেলিত বুকশেল্ভের বুকে থরে থরে সাজানো আমাদের বঙ্গসাহিত্যের দিকদর্শক সাহিত্যিকদের রচনা। বহুদিন সে বইগুলি কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। আমার পাঠ্যবইয়ে এঁদের সকলের সঙ্গেই অল্পবিস্তর আলাপ আছে, কিন্তু সে নগণ্য। আজ আমি তাঁদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, বঙ্গ সাহিত্যের বিবিধ অমূল্য রতন ভাণ্ডার আমার সামনে – অপেক্ষা শুধু তুলে নেওয়ার।

সারাটাজীবন আমি কোন ধাঁধার বা কোন কূট প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হইনি। কিন্তু আজ আমায় যদি কেউ প্রশ্ন করেন “কোন জিনিষ গোগ্রাসে গিললেও বদহজম হয় না”? এর অব্যর্থ উত্তর আমার জানা – বই, বই আর বই

বাস্তবিক ওই সময়ে দুটি জিনিষের নেশায় আমি বুঁদ হয়ে থাকতাম – সিনেমা আর বই। সিনেমার নেশা কেটে গিয়েছিল কয়েকবছরের মধ্যেই, কিন্তু পড়ার নেশা আজও বয়ে চলেছি। যেকোন বই হাতে পেলেই পড়ে ফেলার চেষ্টা আজও করে চলেছি নিরন্তর। প্রত্যেকটি বই - ভাল হোক, মন্দ হোক – সবটা বুঝি বা না বুঝি, কোন না কোন ভাবে আমাকে ঋদ্ধ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

প্রথম দিন শুরু করলাম বঙ্কিমের ‘কপালকুণ্ডলা’ বইখানা দিয়েবাবার নামে ইসু করিয়ে বইটি যখন নিলাম, লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক খুব প্রীত হলেন। বেশ অনেকক্ষণ বইটিতে বঙ্কিমের অনবদ্য রচনাশৈলী নিয়ে আমাকে পাঠ দিলেনঅন্যান্য সভ্যবৃন্দ যারা নিক কার্টার, হেডলি চেজ কিংবা ইয়ান ফ্লেমিংযের তপ্ত বঙ্গানুবাদ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আমার পিছনে, তাঁরা খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন আমাদের এ হেন আলাপে। ভাবখানা – এই হচ্ছে বুড়োদের দোষ, একটা বাচ্চাকে পেয়ে খুব জ্ঞান ঝাড়ছে...।

মাঝের একদিন পরে বইটি ফেরৎ দিয়ে যখন আরেকটি বই আনতে গেলাম, সেই ভদ্রলোক খুব বেদনা অনুভব করেছিলেন, বলেছিলেন, ‘ভাল লাগল না, না? তোমাদের বয়েসের পক্ষে একটু শক্ত, কিন্তু...’

‘পড়া হয়ে গেছে, জেঠু, আজ অন্য বই নেব, “দুর্গেশনন্দিনী”’

‘পড়া হয়ে গেছে? একদিনে? সত্যি বলছো? অসম্ভববলোতো নবকুমারের মা ও বোনেরা কপালকুণ্ডলার কি নাম রেখেছিল?

‘মৃণ্ময়ী’

‘বাঃ লুৎফা আসলে কে’?

‘নবকুমারের প্রথম স্ত্রী, ধর্মান্তরের আগে নাম ছিল পদ্মাবতী’

‘বাবাঃ – ভেরি গুড ? শেষমেস নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার কি হল বলো দেখি’?

‘শেষটা কেমন যেন, দুজনেই নদীর জলে ডুবে মারা গেল’ আমি বললাম।

‘না, বাবা আমার আর কিছু বলার নেইআজ থেকে এই লাইব্রেরিতে তোমার অবাধ যাওয়া আসা। তোমাদের মতো ছেলেদের জন্যেই তো লাইব্রেরি খোলা সার্থক। তবে একটা কথা বাবা, কোনদিন কোন বইকে অসম্মান করো না’

এরপর থেকে ওই লাইব্রেরি থেকে প্রায় বছর তিনেক লাগাতার অজস্র বইয়ের পাঠ নিয়েছি। বাংলা ভাষার মহীরূহ থেকে নবীন প্রজন্মের সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার যাবতীয় যোগসাজশের সূত্রপাত ও ভিত্তি স্থাপন ওই লাইব্রেরির মাধ্যমেই। এখানে বলে রাখা ভাল, ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় কিছুই পড়িনি, চেষ্টাও করিনি। কারণ, তখনই আমার মনে হয়েছিল উনি নিজেই একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থাগার। ওঁনার জন্যে সযত্নে তোলা রইল পরবর্তী জীবন এবং সারা জীবন।

কিন্তু আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শেষ আর করতে পারলাম না। কারণ আমার মনে হয় তাঁর এক একখানি গ্রন্থের মধ্যেই থাকে অনেক গ্রন্থের আভাস। তাঁর প্রত্যেকটি রচনা – গান, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, নাটক... যেন বহুধা বর্ণের অদ্ভূত সমাহার। এক এক বয়সে, বিভিন্ন মানসিক পর্যায়ে তাঁর একই রচনা ভিন্নতর মাত্রায় ধরা দেয়, মেলে ধরে তার বিচিত্র রূপের বর্ণচ্ছটাএকই গ্রন্থ প্রত্যেক বার পাঠে নতুন চেতনার জন্ম হয়, বিকশিত হয় নিত্য নতুন বোধ।

আমি নিশ্চিত, এই এক জীবনে তাঁকে পড়ে শেষ করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু অসম্ভব তাঁর রচনার চরম উপলব্ধি। তিনি ঈশ্বরের মতোই সুমঙ্গল রহস্যময়, তাই যদি আরেকবার ফিরে আসার কোন দুর্বোধ্য উপায় থেকেও থাকে, তাহলে আবার আসিব ফিরে এবং অবশ্যই এই বাংলার তীরে...। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের জন্যেই।

 __০০__

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/৪

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের তৃতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/৩ " তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ পর্বাং...