["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের তৃতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে "ধর্মাধর্ম - ৩/৩"
তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ পর্বাংশ
(৬০০ বিসিই থেকে ০ বিসিই)
৩.৩.৩ বৌদ্ধধর্মের প্রচার
বৌদ্ধধর্মের প্রতীক ধর্মচক্র। এই চাকা দেখতে রথের
চাকার মতোই, কিন্তু
প্রত্যেকটি অংশই অত্যন্ত অর্থপূর্ণ। ধর্মচক্রের ব্যাখ্যা যুগে যুগে বারবার বদলেছে
এবং চক্রের আকারেও অনেক জটিলতা এসেছে। তবে প্রথমদিকের চক্রে, সাধারণতঃ
আটটি অর (spokes) অষ্টাঙ্গিক
মার্গ বোঝাতো। মধ্যের নাভি (hub) বোঝাতো অজ্ঞতা। আবার অনেক পণ্ডিতের মতে চাকার নাভি ও চাকার
বেড় বা পরিধির (rim)
তাৎপর্য যথাক্রমে শীল ও প্রজ্ঞা। কোন কোন ধর্মচক্রের নাভিতে তিনটি ঘূর্ণির (swirls) প্রতীকও
দেখা যায়, এই
তিন ঘূর্ণি – বুদ্ধ,
ধর্ম এবং সঙ্ঘ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ধর্মচক্রের অর্থ হতে পারে – যে কোন অজ্ঞানী
মানুষ, বুদ্ধ, ধর্ম ও
সঙ্ঘের সংস্পর্শে এসে,
অষ্টাঙ্গিক মার্গের সাধনা করলে, পরমপ্রজ্ঞা লাভ করতে পারে।
ঋষিপত্তন থেকে বেরিয়ে ধীর পদব্রজে চলতে চলতে তিনি
এলেন উরুবিল্ব গ্রামে। সেই নৈরঞ্জনা নদী, তার দুই পাড়, বোধিবৃক্ষ, সেই অরণ্য, সেখানকার
দরিদ্র অথচ প্রাণবন্ত সরল ছেলেময়েদের সঙ্গে তাঁর কটা দিন বেশ আনন্দেই কাটল।
ছেলেমেয়েদের থেকেই শুনলেন উরুবিল্ব কশ্যপ নামে কোন এক ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী কিছুদিন
আগেই নৈরঞ্জনা নদীর ওপাড়ে কিছুদূরে তাঁর আশ্রম বসিয়েছেন। সেখানে প্রায় পাঁচশ
সন্ন্যাসী আছেন। তাঁদের কেউই অবিশ্যি মুণ্ডিত মস্তক সন্ন্যাসী নন, বরং তাঁদের
মাথায় চুলের জটা। কয়েকদিন উরুবিল্বে কাটিয়ে বুদ্ধদেব চলে গেলেন উরুবিল্ব কশ্যপের
আশ্রমে। সেখানে উরুবিল্ব কশ্যপ এই যুবক সন্ন্যাসীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই বুঝতে
পারলেন, এই
সন্ন্যাসী অসাধারণ। তিনি নিজেকে বেদজ্ঞ মনে করতেন। কিন্তু বুদ্ধের সঙ্গে বেদ
প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বুঝলেন, বেদের অনেক তত্ত্বই এতদিন তাঁর কাছে
অস্পষ্ট ছিল, এই
যুবক তাঁর মনের সেই ধোঁয়াশা দূর করে দিয়েছেন। তিনি বুদ্ধের ধর্মে আকৃষ্ট হলেন।
তাঁর আশ্রমে নিত্য যজ্ঞ হত,
সেই যজ্ঞে রোজই পশুবলি দেওয়া হত। বুদ্ধের উপদেশে তিনি পশুদের মুক্তি দিলেন, যজ্ঞ ত্যাগ
করলেন। তারপর একদিন পাঁচশ শিষ্য সহ উরুবিল্ব কশ্যপ নৈরঞ্জনা নদীর ধারে মাথার জটা
মুণ্ডন করে বুদ্ধদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
নৈরঞ্জনা নদীর ভাটিতে তাঁর দুই ভাই – নন্দকশ্যপ
এবং গয়াকশ্যপেরও আশ্রম ছিল। উরুবিল্ব কশ্যপ ও তাঁর শিষ্যরা বুদ্ধদেবের শিষ্যত্ব
গ্রহণ করার কয়েকদিন পরে দুই ভাই দৌড়ে এলেন, দাদার খোঁজ নিতে। তাঁরা নদীর স্রোতে
ভেসে যেতে দেখেছেন অজস্র চুলের জটা। দাদা ও তাঁর আশ্রমের ভয়ংকর কোন বিপদের আশঙ্কায়, তাঁরা দৌড়ে
এসেছেন। দাদার সঙ্গে এবং বুদ্ধদেবের সঙ্গে কথা বলে, তাঁরাও নিজেদের শিষ্যদের নিয়ে
বুদ্ধদেবের কাছে সন্ন্যাসে দীক্ষা নিলেন। সব আশ্রমের শিষ্য নিয়ে, উরুবিল্ব
কশ্যপের আশ্রমে এখন ন’শোর ওপর শিষ্য! স্থান সংকুলান হওয়া শক্ত। উরুবিল্ব কশ্যপ
তাঁর নিজের কুটিরেই বুদ্ধদেবকে রাত্রিবাসের জন্যে অনুরোধ করলেন। বুদ্ধদেব যেহেতু
রাত্রে ধ্যান করে থাকেন,
তাই একলা ঘরের আশ্রয় চেয়ে বললেন, তিনি আশ্রমের অগ্নিহোত্র কুটিরে
রাত্রে শোবেন, ওখানে
তো কেউ শোয় না। উরুবিল্ব কশ্যপ বললেন, “ওখানে শোওয়া যেত, কিন্তু
কয়েকদিন ধরেই ওই কুটিরে আশ্রয় নিয়েছে ভয়াল এক অজগর সাপ। তাকে কিছুতেই ওখান থেকে
তাড়ানো যায়নি। হে বুদ্ধ,
আপনার ওখানে রাত্রিবাস অসম্ভব। আমরা বেশ কিছুদিন ধরে ওই ঘরে ঢুকতেই পারছি না”।
বুদ্ধ নিরুদ্বিগ্ন স্মিতমুখে বললেন, “আমি ওই
কুটিরেই রাত্রিবাস করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার কোন বিপদ হবে না”। বুদ্ধ জঙ্গলে
বেশ কয়েক বছর তপস্যা করেছেন, রাত্রে তাঁর আশেপাশেই ঘুরে বেড়াত কত হিংস্র জন্তু, অজগর, বিষধর সাপ।
তিনি কাউকেই ভয় পাননি এবং ভয় দেখাননি, তারাও কোনদিন তাঁর কোন ক্ষতি করেনি।
বুদ্ধ সেই ঘরে ঢুকে দেখলেন,
ঘরের মাঝখানে রয়েছে অগ্নিকুণ্ড, অন্যপাশে স্তূপ করা রয়েছে যজ্ঞের
কাঠ। তিনি বুঝতে পারলেন ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে সেই ভয়ংকর সাপ। বুদ্ধ উল্টোদিকে বসলেন
এবং ধ্যানস্থ হলেন। দীর্ঘ সময় নির্বিঘ্নে ধ্যান করার পর শেষ রাত্রে তিনি চোখ মেলে
দেখলেন, বিশাল
সেই সাপ এখন কুণ্ডলি পাকিয়ে বসে আছে ঘরের মাঝখানে এবং মুখ তুলে তাকিয়ে আছে, তাঁরই মুখের
দিকে। বুদ্ধ স্মিত হেসে সাপটিকে বললেন, “তোমার এবং অন্য সকলের ভালোর জন্যেই
বলছি - জঙ্গলে ফিরে যাও,
বন্ধু”। সাপটি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, কোনদিন সে
আর ফিরে আসেনি ওই আশ্রমে।
উরুবিল্ব থেকে বেরিয়ে রাজগৃহে যাওয়ার পথে ভগবান বুদ্ধ এবং তাঁর ন’শো শিষ্য তিনমাস রইলেন গয়াশীর্ষে। সেখানে তিনি নবীন সন্ন্যাসীদের ধর্মশিক্ষা দিলেন। ন’শো মানুষের জন্য রোজ সামান্য ভিক্ষান্ন যোগাড় করাও বড় সহজ কাজ নয়, ছোটখাটো গ্রাম বা জনপদের পক্ষে তো অসম্ভব। বুদ্ধদেব এবং উরুবিল্ব কশ্যপ ন’শো শিষ্যর সঙ্ঘকে প্রত্যেক দলে পঁচিশজন করে, ছত্রিশটি দলে ভাগ করে ফেললেন। প্রত্যেক দলের নেতৃত্বে রইল একজন অভিজ্ঞ ভিক্ষু। বহু দূর গ্রামে গ্রামে ছত্রিশটি দল ছড়িয়ে পড়ল এবং একই সঙ্গে এগোতে লাগল রাজগৃহের দিকে। বিস্তীর্ণ ওই অঞ্চলের অসংখ্য গ্রাম ও জনপদের বাসিন্দারাও জেনে গেল ভগবান বুদ্ধের কথা। মুণ্ডিত-মস্তক, শান্ত-সমাহিত, বিনীত বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের আচরণ তাদের কৌতূহলী এবং আগ্রহী করে তুলল বৌদ্ধধর্ম এবং ভগবান বুদ্ধ সম্পর্কে। ধর্মচক্রের রথ কোন আনুষ্ঠানিক প্রচার ছাড়াই জয় করতে করতে চলল মগধরাজ্যের বহু সাধারণ মানুষের মন।
৩.৩.৪ রাজগৃহে গৌতমবুদ্ধ
রাজগৃহের মতো বড়ো শহরের পক্ষেও একসঙ্গে এত লোকের
থাকা এবং নিত্যক্রিয়ার মতো জায়গার সংকুলান সম্ভব ছিল না। সেই চিন্তা করে রাজগৃহের
অনতিদূরেই ভগবান বুদ্ধের অনুমতি নিয়ে, তালবনে রাতারাতি এক আশ্রম বানিয়ে
তুললেন উরুবিল্ব কশ্যপ। পরদিন সকালে রাজগৃহের সমস্ত নগরবাসী চমকিত হল অভূতপূর্ব এক
দৃশ্যে। কোন চিৎকার নেই,
চেঁচামেচি নেই, পঁচিশজন
ভিক্ষুর এক একটি দল নগরে বেরিয়েছে ভিক্ষা করতে। তাদের হাতে ভিক্ষাপাত্র, মুখে
প্রশান্ত হাসি। ধনী-দরিদ্র,
উচ্চ-নীচ, রাজকর্মচারী, সেনাপতি, শ্রেষ্ঠী
কিংবা চামার, মেথরে
তারা কোন বাছবিচার করছে না। নিঃশব্দ স্মিতমুখে তারা গৃহস্থের দরজার সামনে কিছুক্ষণ
অপেক্ষা করছে। ভিক্ষা পাত্র পূর্ণ হলেই ভিক্ষা থেকে নিবৃত্ত হচ্ছে। ভিক্ষার
ক্ষেত্রেও কোন বাছবিচার নেই, যে যা দেয় তাই গ্রহণ করে স্মিতমুখে। তবে উচ্ছিষ্ট খাদ্য
তারা গ্রহণ করে না, অবিশ্যি
এক পাষণ্ড ছাড়া আর কোন গৃহস্থ উচ্ছিষ্ট ভিক্ষা দেয়?
ভিক্ষাপাত্র পূর্ণ হলেই তারা ফিরে যায় তালবনে।
সেখানেই সকলে একসঙ্গে নিঃশব্দ মনোযোগে খাবার খায়, আর বাকি সারা দিন নিজেদের মতো ধ্যান
অভ্যাস করে। তারপর বিকেলের পর সবাই ধর্মতত্ত্ব শিখতে একত্র হয়। সেখানে শিক্ষা দেন
অহর্ৎরা, শিক্ষা
দেন ভগবান বুদ্ধ নিজে। প্রায় দিন পাঁচ-ছয় হয়ে গেল বুদ্ধদেব এবং তাঁর সঙ্ঘের
ভিক্ষুরা রোজই নগরে যাচ্ছেন, কিন্তু তিনি নিজে রাজা বিম্বিসারের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন
না।
দেখতে দেখতে সংবাদ পৌঁছে গেল রাজা বিম্বিসারের কানে। তিনি শুনলেন প্রত্যেকদিনই নগরে মুণ্ডিত-মস্তক, গৈরিকবসন ভিক্ষুদের অনেকগুলি দল ভিক্ষা পাত্র নিয়ে সকালে আসে, দুপুরের মধ্যেই তারা নগর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তাদের তালবনের আশ্রমে। তাদের আচরণ এতই প্রশান্ত এবং বিনীত – নগরে এতগুলি ভিক্ষুর উপস্থিতিতেও বিরক্তি আসে না। ভিক্ষা দিতেও কার্পণ্য আসে না। এই ভিক্ষুদের যিনি আচার্য তাঁর নাম গৌতমবুদ্ধ। তাঁর সৌম্যপ্রশান্ত চেহারা থেকে যেন জ্যোতি ঠিকরে বেরোয়। তিনি সামনে এসে দাঁড়ালে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, মনের মধ্যে অদ্ভূত এক আনন্দের অনুভূতি হয়। এতগুলি ভিক্ষুর আচার্য মানে, তিনি যে বৃদ্ধ, তাও নয়। শোনা যাচ্ছে তাঁর বয়স মাত্র ছত্রিশ। তাঁর শিষ্য অর্হৎদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা বয়সে বুদ্ধের থেকে অনেক বড়ো। সমস্ত বিবরণ শুনে রাজা বিম্বিসার অনুমান করলেন, ওই আচার্য বুদ্ধই তাঁর সেই বন্ধু সিদ্ধার্থ, যাঁর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল পাণ্ডব পাহাড়ে। সেই দিন বিকেলেই তিনি, রাণি এবং রাজকুমার অজাতশত্রুকে নিয়ে, নিজের রথে চড়ে বসলেন এবং সারথিকে আদেশ দিলেন তালবনে যাওয়ার। তাঁর নিমন্ত্রণে তাঁর অনুগামী হলেন প্রায় একশ’র উপর ব্রাহ্মণ আচার্য এবং শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত। তালবন তপোবনের সামনে তিনি, রাণি এবং অজাতশত্রু রথ থেকে নেমে এলেন। তারপর পদব্রজে চললেন তপোবনের ভেতরে।
Bimbisara with his royal cortege issuing from the city of Rajagriha to visit the Buddha, Sanchi, East Face - South Pillar - East Gateway
৩.৪.১ বৌদ্ধধর্মের রাজস্বীকৃতি
শেষ অপরাহ্নে তালবন আশ্রমের ভিক্ষুরা তখন
বুদ্ধদেব এবং উরুবিল্ব কশ্যপকে ঘিরে সবে মাটিতে আসন নিয়েছে ধর্মকথা শুনবে বলে। সেই
সময় গৌতমবুদ্ধের কানে সংবাদ পৌঁছল - রাজা আসছেন। তিনি উরুবিল্ব কশ্যপকে সঙ্গে নিয়ে
এগিয়ে গেলেন রাজপরিবারকে অভ্যর্থনা করতে। রাজা বিম্বিসার দেখলেন তাঁর অনুমান
নির্ভুল, তাঁর
বন্ধু সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থই এই গৌতমবুদ্ধ। তিনি বুদ্ধদেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিলেন তাঁর রাণি এবং পুত্রের। তারপর বিখ্যাত আচার্য এবং অভিজাত কয়েকজনের সঙ্গেও
পরিচয় করালেন। বুদ্ধ এবং অর্হৎ কশ্যপ সকলের বসার ব্যবস্থা করলেন, রাজপরিবারের
জন্যে কাঠের পীঠিকা আর অন্যদের জন্য মাটিতেই আসন বিছিয়ে দেওয়া হল।
রাজার অনুগামীদের মধ্যেই অনেকেই ছিলেন প্রখ্যাত
বেদজ্ঞ আচার্য, দিগ্বিজয়ী
পণ্ডিত। তাঁদের অনেকেই উরুবিল্ব কশ্যপকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন, জানেন অথবা
নাম শুনেছেন, কিন্তু
তাঁদের কেউই গৌতমবুদ্ধের নাম কখনো শোনেননি। তাছাড়া কশ্যপের তুলনায় বয়সেও গৌতমবুদ্ধ
অনেকটাই ছোট। তাঁরা সকলেই আশ্চর্য হলেন, উরুবিল্ব কশ্যপের মতো পণ্ডিত কী ভাবে
অচেনা-অজানা এই গৌতমবুদ্ধর শিষ্য হয়ে গেলেন? নাকি তাঁরা ভুল বুঝছেন, আসলে
গৌতমবুদ্ধই উরুবিল্ব কশ্যপের শিষ্য? কিন্তু তিনি যখনই কথা বলছেন, গৌতমবুদ্ধের
প্রতি তাঁর বিনম্র শ্রদ্ধা দেখে উপস্থিত বিদ্দ্বজ্জনেরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠছিলেন।
তাঁদের মনের এই দ্বিধা বুঝতে ভুল করলেন না উরুবিল্ব কশ্যপ। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, “হে
গৌতমবুদ্ধ, হে
বোধিসত্ত্ব, আপনিই
আমার জীবনের সর্বোত্তম আচার্য। আপনাকে নতমস্তকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অনুরোধ করি
উপস্থিত সকলকে এবং আমাকেও আপনি আত্ম-জাগরণের পথ নির্দেশ দিন”। এই বলে তিনি
গৌতমবুদ্ধকে তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন।
গৌতমবুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে কশ্যপকে নিজের পাশে বসালেন, তারপর সকলের
উদ্দেশে শুরু করলেন তাঁর ধর্ম কথা। ভোরের রৌদ্রের মতো উজ্জ্বল অথচ জ্যোস্নার মতো
স্নিগ্ধ তাঁর শরীর। উদাত্ত অথচ শান্ত, প্রত্যয়ী স্বরে তিনি যখন তাঁর
উপলব্ধির কথা শুরু করলেন,
উপস্থিত মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল তাঁর মুখের দিকে। ন’শো ভিক্ষুসহ, সমবেত প্রায়
এক হাজারের ওপর মানুষ সকলেই নিঃশব্দ, নিস্পন্দ। কেউ উচ্ছ্বসিত নিশ্বাস
ফেলল না, সকলেই
নিবাত-নিষ্কম্প দীপশিখার মতোই অচঞ্চল, নড়াচড়ায় যদি বস্ত্রের খস্খস্ আওয়াজ
ওঠে!
গৌতমবুদ্ধের ধর্মকথা সমাপ্তির পর রাজা বিম্বিসার
উঠে দাঁড়ালেন, করজোড়ে
নতমস্তকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বললেন, “হে প্রভু, ছোটবেলা
থেকেই আমার পাঁচটি সঙ্কল্প ছিল। আজ এই মাত্র, আমার সব সঙ্কল্পই সম্পূর্ণ হল। প্রথম
সঙ্কল্প ছিল রাজ্যাভিষেক এবং রাজা হওয়া। রাজা আমি হয়েছি। দ্বিতীয় সঙ্কল্প ছিল এই
জীবনে একজন পরমপ্রজ্ঞাবান আচার্যের সাক্ষাৎ। সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি। তৃতীয় সঙ্কল্প
ছিল সেই প্রজ্ঞাবান আচার্যকে আমি বন্দনা করবো। সে সুযোগ আমি পেয়ে গেছি। চতুর্থ
সঙ্কল্প ছিল সেই আচার্য আমাকে সত্যের পথ দেখাবেন। আপনিই আমাকে সে পথ দেখিয়েছেন। পঞ্চম
সঙ্কল্প ছিল আমার অন্তরে,
আমার চেতনায় সেই সত্য যেন উপলব্ধি করতে পারি। আমার অন্তরে সেই আলোক আমি দেখতে
পেয়েছি। হে আচার্য, আমাকে
অনুগ্রহ করে, আপনার
গৃহী-শিষ্য হবার অনুমতি দিন”।
গৌতমবুদ্ধ স্মিতমুখে সম্মতি দিলেন।
আনন্দিত বিম্বিসার তাঁকে,
উরুবিল্ব কশ্যপকে এবং তাঁদের ন’শ ভিক্ষু সন্ন্যাসীকে আগামী পূর্ণিমায়, তাঁর
প্রাসাদে ভিক্ষা গ্রহণের অনুরোধ করলেন। গৌতমবুদ্ধ রাজার সে প্রার্থনাও আনন্দের
সঙ্গে মঞ্জুর করলেন। তারপর রাজা বিম্বিসার সপরিবার এবং সপারিষদ নগরে ফেরার জন্যে
প্রস্তুত হলেন। গৌতমবুদ্ধ এবং উরুবিল্ব কশ্যপ তাঁদের এগিয়ে দিলেন তালবনের সীমানা
ছাড়িয়ে রাজপথ পর্যন্ত।
এখন প্রতিদিনই সঙ্ঘে ভিক্ষুর সংখ্যা বাড়ছে, বিভিন্ন
শ্রেণীর মানুষ আসছে তাঁর জ্ঞানের আলোকে মনের তমসা দূর করার প্রার্থনা নিয়ে।
পূর্ণিমার দিন গৌতমবুদ্ধ হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে রাজগৃহ নগরে যখন ঢুকলেন, ন’শোর
জায়গায় তাঁকে অনুসরণ করছিল বারোশ পঞ্চাশজন ভিক্ষু। তাদের প্রত্যেকের হাঁটার গতি
ধীর কিন্তু প্রত্যয়ী,
সকলের দৃষ্টি পথের দিকে, পথ চলাতেও তারা যেন ধ্যাননিবিষ্ট। তাদের সকলেই মুণ্ডিত
মস্তক, পরনে
গৈরিক বসন এবং হাতে ভিক্ষাপাত্র। রাজগৃহের নাগরিক পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে রইল সশ্রদ্ধ
দৃষ্টিতে, নিজেদের
অজ্ঞাতেই তাদের জোড়হাত উঠে এল বুকের কাছে।
রাজা বিম্বিসার তাঁর প্রাসাদের
সিংহদ্বারে অপেক্ষা করছিলেন প্রায় সহস্র অনুচর ও অতিথিদের সঙ্গে। বুদ্ধদেব এসে
পৌঁছতেই তিনি সসম্মানে তাঁকে এবং সকল ভিক্ষুদের নিয়ে গেলেন প্রাসাদের প্রাঙ্গণে।
অজস্র পুষ্পমাল্যে সাজানো,
সুগন্ধী ধূপ ও গুগ্গুলের সৌরভে সুরভিত সেই প্রাঙ্গণের মাঝখানে রাজা বিম্বিসার
বুদ্ধদেবকে বসালেন। রাজকুমার অজাতশত্রু নিজের হাতে জল এনে ভগবান বুদ্ধের হাত ও পা
ধুয়ে দিলেন। অন্যান্য অনুচরেরা জল এনে অন্যান্য অর্হৎ এবং ভিক্ষুদের হাত-পা ধুয়ে
দিলেন। তারপর নিরামিষ খাদ্যসম্ভার এনে সাজিয়ে রাখা হল। রাজা জানতেন অহিংস বুদ্ধদেব
নিরামিষ খাদ্যই পছন্দ করেন। তিনি এবং মহারাণি নিজের হাতে খাবার তুলে দিলেন
বুদ্ধদেবের ভিক্ষাপাত্রে। রাজ পরিবারের অন্য মহিলারা খাবার পরিবেশন করলেন
ভিক্ষুদের। পরিবেশন শেষ হতে, বুদ্ধদেব এবং অন্য সকলে একসঙ্গে আহারে মন দিলেন। তাঁদের
নিঃশব্দ, শান্ত
এবং নিবিষ্ট আহার গ্রহণ দেখে উপস্থিত সকলেই অভিভূত হয়ে গেলেন। প্রতিটি খাদ্যের
স্বাদ ও গন্ধ সম্যক অনুভব করতে করতে, এভাবেও আহার করা যায়! আহার শেষে
বুদ্ধদেব এবং সকল ভিক্ষুদের ভিক্ষাপাত্র ধুয়ে ফেরৎ দেওয়া হল, সকলেই
হাতমুখ ধুয়ে এসে আবার নিজ নিজ আসনে বসলেন।
রাজা বিম্বিসার করজোড়ে একটি নীচু আসনে বসলেন
ভগবান বুদ্ধের সামনে। গৌতমবুদ্ধ রাজার ইচ্ছা বুঝে ধর্ম কথা বলতে শুরু করলেন, “প্রথম ধর্ম
সর্বদা অহিংস থাকা। এই ধর্ম থেকে আসে সহমর্মীতা। সকল জীবই মৃত্যুকে ভয় পায়। আমরা
যেমন নিজেদের জীবন পোষণ করি, সকল প্রাণীও তাই করে থাকে। আমরা যে শুধু মানুষ হত্যা থেকেই
বিরত থাকব তা নয়, আমরা
অন্য সকল প্রাণী হত্যা থেকেও বিরত থাকার চেষ্টা করব। আমরা সকল মানুষ, প্রাণী
এমনকি উদ্ভিদের সঙ্গেও মিলেমিশে থাকব। আমরা যখন প্রত্যেকটি প্রাণের মূল্য বুঝতে
শিখব, দেশে
অশান্তি থাকবে না। অন্য রাজ্য জয়ের জন্য শক্তির বৃথা অপচয় নয়, বরং আমাদের
সেনাবাহিনী ব্যস্ত থাকুক রাজ্যের রাস্তাঘাট, সেচব্যবস্থা, চিকিৎসালয়
গড়ে তুলতে।
দ্বিতীয় ধর্ম হল অচৌর্য বৃত্তি। পরিশ্রমে সঞ্চয়
করা একজনের সম্পদের ওপর অন্য মানুষের কোন অধিকার থাকতে পারে না। নিজের ক্ষমতা এবং
প্রভাব খাটিয়ে সেই সম্পদ থেকে তাকে বঞ্চিত করা আরো বেশি অপরাধ। শ্রমিকের শ্রম ও
স্বেদের বিনিময়ে প্রভূত সম্পদ অর্জন করাও এক ধরনের চুরিই। দেশের সকলেই যখন এই ধর্ম
পালন করবে, দেশ
থেকে হিংসা দূর হয়ে যাবে। সকল মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে সামাজিক সাম্যতা।
তৃতীয় ধর্ম হল কখনো যৌন দুরাচার না করা। বিবাহিত
দাম্পত্য ছাড়া কখনো যৌনাচার করো না। এই ধর্মাচরণে সমাজে আসবে বিশ্বাস এবং সুখ, দূর হবে ভুল
বোঝাবুঝি এবং পারিবারিক দুঃখ। উপপত্নীদের থেকে নিজেকে দূরে রাখলে, পরিবার ও
সমাজের মানুষকে সুখী এবং সাহায্য করার অনেক বেশি সময় মিলবে।
চতুর্থ ধর্ম হল কখনও মিথ্যা না বলা। এমন কথা কখনও
না বলা, যার
থেকে হিংসা এবং বিভেদ সৃষ্টি হয়। তোমাদের বক্তব্য যেন সত্য অনুসারী হয়। কথার মধ্যে
বিশ্বাস এবং সুখ সৃষ্টি করার শক্তি থাকতে হবে। এমন কোন কথাই বলবে না যা থেকে ভুল
বোঝাবুঝি হয়ে বিদ্বেষ বা ঘৃণা, কলহ-বিবাদ এমনকি যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি কথা বলার আগে
বক্তব্য বিষয় নিয়ে বারবার চিন্তা করবে – তোমার বক্তব্য যে শুনছে তার প্রতিক্রিয়া
কী হতে পারে?
পঞ্চম ধর্ম কোন নেশাতেই আকৃষ্ট না হওয়া, সে মদই হোক
বা অন্য কিছু। নেশার জিনিষ মনকে আচ্ছন্ন করে। নেশাগ্রস্ত মানুষ তার পরিবার, সমাজ এবং
নিজের অবর্ণনীয় দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে। এই ধর্ম প্রত্যেকের শারীরিক এবং মানসিক
স্বাস্থ্যের জন্যে সর্বদা পালনীয়।
দেশের রাজা এবং রাজ্যের সমস্ত আধিকারিক যদি এই
পাঁচটি ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে, তাহলে রাজ্যের সমৃদ্ধি অবধারিত। হে
রাজন্, রাজা
রাজ্যের কর্ণধার। রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে এবং কেন ঘটছে সে সম্বন্ধে সর্বদাই অবহিত
এবং সচেতন থাকাটা রাজার কাছে জরুরি। আপনি এবং রাজকার্যের নানান দায়িত্বে থাকা
সকলেই এই পাঁচটি ধর্ম যদি সম্যক পালন করেন, আমি বলছি, মগধ রাজ্য খুব দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে”।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য গৌতমবুদ্ধের এই
ধর্ম-পরামর্শগুলি সাধারণের জন্যে হলেও বিশেষতঃ রাজা বিম্বিসারকেই উদ্দেশ করেই যেন বললেন। রাজা বিম্বিসারের উপপত্নী
সম্ভোগ। রাজা বিম্বিসারের বিলাস, ব্যসন ও ভোগবাসনা। সিদ্ধার্থের মতো স্বল্প পরিচিত তরুণ এক
সন্ন্যাসীকে হঠাৎ অর্ধেক রাজত্ব দানের প্রস্তাব দিয়ে, নিজেকে
অসহায় ধর্মপ্রাণ প্রমাণের চেষ্টা। এই সবকিছুই গৌতমবুদ্ধের কাছে তাঁর অব্যবস্থিত
মানসিকতাকেই প্রকট করেছিল।
রাজা বিম্বিসার শ্রদ্ধায় নতমস্তকে প্রণাম করলেন
ভগবান বুদ্ধকে। মহারাণি বিদেহী পুত্র অজাতশত্রুর হাত ধরে সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি
জোড়হাতে শ্রদ্ধা জানালেন,
বালক পুত্রকেও শেখালেন কীভাবে জোড়হাতে পদ্মমুদ্রায় শ্রদ্ধা জানাতে হয়। তারপর
মহারাণি বললেন, “হে
প্রভু, আজ
এখানে অজাতশত্রুর মতোই প্রায় চারশ বালক-বালিকা উপস্থিত রয়েছে। আপনি তাদের শিক্ষণীয়
কিছু উপদেশ দিন”।
ভগবান বুদ্ধ বালক অজাতশত্রুকে কাছে টেনে নিলেন, তার একটি
হাত নিজের হাতে ধরে রেখে তিনি সকল বালকদের উদ্দেশ্যে স্মিতমুখে বললেন, “ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের
কোন উপদেশ দেব না বরং একটি গল্প শোনাবো। এই মানব জন্মের আগে, আমি এই
পৃথিবীতে পাথর, মাটি, গাছপালা, পাখি বা
অন্য নানান প্রাণী হয়ে বহুবার জন্ম নিয়েছিলাম। তোমরাও, আগের আগের
জন্মে তেমনই ছিলে! তোমাদের সঙ্গে আমার আগের কোন না কোন জন্মে, হয়তো কোন
সম্পর্ক ছিল, যার
জন্যেই আমরা এই জন্মে আবার একত্র হয়েছি। কে জানে, হয়তো বিগত জন্মগুলিতে আমরা বারবার
পরষ্পরের সুখ-দুঃখের কারণ হয়েছিলাম।
আজ যে ঘটনার কথা তোমাদের বলব, আমার কয়েক
হাজার জন্ম আগে সে ঘটনা ঘটেছিল। এক কাঁক, এক কাঁকড়া, একটি
চাঁপাগাছ, আর
অনেক চিংড়ি এবং মাছদের নিয়ে এই কাহিনী। এই গল্পে আমি ছিলাম চাঁপাগাছ, আর তোমাদের
মধ্যে কেউ হয়তো ছিলে সেই কাঁক[1], কাঁকড়া, চিংড়ি কিংবা
মাছ। এই কাহিনীতে কাঁকই ছিল ভয়ংকর এক চরিত্র, যে অন্য সকলের অশেষ দুঃখের কারণ
হয়েছিল, এমনকি
আমার মতো গাছেরও।
সে জন্মে সুন্দর স্বচ্ছ এক পদ্মদীঘির পাড়ে আমি
চাঁপা গাছ হয়ে বেড়ে উঠেছিলাম। আর সেই সরোবরের কিছুটা দূরেই ছিল ছোট্ট একটি ডোবা।
সেই ডোবার অগভীর জলে বাস করত অনেক চিংড়ি, মাছ এবং কাঁকড়া। একদিন এক কাঁক উড়তে
উড়তে তাদের সকলকে দেখে ফেলল। ছোট্ট ডোবার সীমিত জলে এতগুলি লোভনীয় শিকারকে একসঙ্গে
দেখে, সে
তখনই সেই ডোবার পাড়ে নামল। তারপর একপায়ে দাঁড়িয়ে শিকারের মতলব আঁটতে গভীর চিন্তায়
ডুব দিল।
মাছ এবং চিংড়ির দল পাড়ের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “হে কঙ্ক, আপনি এত
গভীর ভাবে কী চিন্তা করছেন?”
গভীর শ্বাস ছেড়ে কাঁক উত্তর দিল, “আমি তোদের কথাই চিন্তা করছি, রে। এই ঘোলা
কাদামাখা জলে তোরা এতজন রয়েছিস কী করে? তোদের শ্বাস নিতে কিংবা সকলের খাবার
পেতে অসুবিধে হচ্ছে না?
তোদের কষ্টের কথা চিন্তা করে, আমার খুবই দুঃখ হচ্ছে, রে!”
“কথাটা
ঠিকই, কিন্তু
আপনি কী আমাদের কোনভাবে সাহায্য করতে পারেন?”
“পারি
না আবার? একশবার
পারি। এই কাছেই একটা পদ্মদীঘি আছে। আমি তোদের প্রত্যেককে সেই দীঘির স্বচ্ছ শীতল
জলে ছেড়ে দিতে পারি। সেখানে প্রচুর জল, প্রচুর খাবার পেয়ে যাবি”।
“আমরা
কোনদিন শুনিনি, কাঁক
পাখি কোন মাছ বা চিংড়িকে সাহায্য করেছে। আপনাকে ভরসা করতে ভয় লাগে। আমাদের শিকার
করে খাবার, এ
হয়তো আপনার নতুন কোন চাল”।
“য্যাঃ, তোরা বড্ডো
সন্দেহবাতিক। আমি তোদের বড়ো কাকার মতো। আমি তোদের ঠকাতে যাবো কী করতে? এই কাছেই
সত্যিই খুব সুন্দর বড়ো একটা পদ্মদীঘি আছে, তার জল যেমন স্বচ্ছ তেমনি ঠাণ্ডা।
বিশ্বাস না হলে, তোদের
একজন কেউ আমার সঙ্গে চল,
আমি দেখিয়ে নিয়ে আসছি। তারপর না হয় তোরা সবাই মিলে, কী করবি, ঠিক করিস!”
মাছ এবং চিংড়ির ঝাঁক নিজেদের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ
শলাপরামর্শ করল, তারপর
তারা ঠিক করল একজন বয়স্ক মাছ যাবে, কাঁকের কথা সত্যি কিনা, পরখ করতে।
বয়স্ক সেই মাছটি বেশ বড়সড়ো,
শক্তপোক্ত, তার
গায়ের আঁশগুলোও খুব মোটা আর শক্ত। কাঁক তাকে মুখে করে নিয়ে গেল সেই সরোবরে, তারপর তাকে
ছেড়ে দিল সরোবরের জলে। বয়স্ক সেই মাছ সরোবরের জলে অনেকক্ষণ ঘুরল, ফিরল, দেখল।
সত্যিই, সরোবরের
জল স্বচ্ছ, শীতল।
অনেক মাছ এবং চিংড়ি থাকার পক্ষে বিস্তর জায়গা এবং খাবারেরও কোন অভাব নেই। সে
কাঁকের মুখেই আবার ফিরে এল সেই ডোবায়। সে যা দেখেছে, মাছ এবং চিংড়িদের কাছে সব খুলে বলল।
কাঁকের সদিচ্ছায় মাছ এবং চিংড়িদের এবার ভরসা হল।
এক এক করে তাদের ওই পদ্মদীঘিতে ছেড়ে আসতে, তারা কাঁককে অনুরোধ করল। ধূর্ত কাঁক
এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। সে একটি মাছকে জল থেকে তুলে, ঠোঁটে করে
নিয়ে, উড়ে
এসে বসল সরোবরের পাড়ের সেই চাঁপাগাছের ডালে। গাছের শাখার খাঁজে মাছটিকে রেখে, কাঁকটা
ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলল মাছের মাস। মাছের কাঁটাগুলো ফেলে দিল গাছের গোড়ায়। তারপর
আবার উড়ে গেল আরেকটি মাছ তুলে আনতে।
আমিই সেই চাঁপাগাছ, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম এই
সব ঘটনা। আমার কষ্ট হচ্ছিল,
রাগ হচ্ছিল খুব। কিন্তু আমি যে গাছ, কিছুই করতে পারছিলাম না, কাঁককে
আটকানোর কোন ক্ষমতা তো আমার ছিল না। একটা চাঁপাগাছ, ডালপালা ছড়াতে পারে, ফুল ফোটাতে
পারে। কিন্তু সে তো দৌড়ে কোথাও যেতে পারে না। সে চিৎকার করে মাছ এবং চিংড়িদের
সাবধান করতে পারে না। দিনের পর দিন সেই কাঁক অজস্র মাছ এবং চিংড়িদের ধরে এনে, আমারই ডালে
বসে খেতে লাগল। আর তাদের কাঁটা আর শল্ক ফেলে ফেলে ছোটখাটো পাহাড় বানিয়ে তুলল আমার
গোড়ায়। আমিই শুধু সেই ভয়ংকর দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম। আতঙ্ক, ভয় এবং
দুঃখে আমি দিনের পর দিন শুকিয়ে উঠতে লাগলাম।
সেই ডোবার মাছ এবং চিংড়িরা এক দিন শেষ হয়ে এল।
কিন্তু কাঁকের লোভ তখনও মেটেনি। ডোবার জলে থাকা কাঁকড়াদের বলল, “ভাইপোরা, সেই
পদ্মদীঘির জলে মাছ আর চিংড়ির ঝাঁক তো দিব্যি আরামে আছে, এখন তোদের
কী ইচ্ছে? তোরা
কী এখানেই থাকবি, নাকি
পদ্মদীঘিতে যাবি?”
কাঁকড়ার দল জিজ্ঞাসা করল, “আমাদের
কীভাবে নিয়ে যাবেন?”
“কেন? ঠোঁটে করে? যেভাবে
এতগুলো মাছ আর চিংড়িদের এতদিন ধরে নিয়ে গেলাম?”
“ওরে
বাবা, না
না। আপনার ঠোঁট ফস্কে একবার মাটিতে পড়লে আর দেখতে হবে না, খোলস ফেটে
আমরা অক্কা পাবো”।
“আরে
ধূর, ঘাবড়াস
না, আমি
বেশ যত্ন করেই তোদের নিয়ে যাবো”।
কাঁকড়ার দল নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা করল।
হতে পারে কাঁক হয়তো সব মাছ এবং চিংড়িদের সত্যিই পদ্মদীঘিতে নিয়ে গেছে। কিন্তু তা
যদি না হয়? কাঁকটা
যদি তাদের সবাইকে খেয়ে ফেলে থাকে? কাঁকড়ার দল পরামর্শ করে, একটা নিরাপদ উপায় চিন্তা করল। তারপর
কাঁককে বলল, “কাকা
কঙ্ক, আমাদের
ভয় হচ্ছে, আপনি
আপনার ঠোঁটে আমাদের নিরাপদে ধরে রাখতে পারবেন না। তার থেকে আমরা যদি আপনার গলাটি
দাঁড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরি?
আমাদের মনে হয় সেটা অনেক নিরাপদ।”
কাঁক রাজি হয়ে গেল, সে গলা বাড়িয়ে দিল এবং তার গলা আঁকড়ে
ঝুলে পড়ল বড়ো একটি কাঁকড়া। কাঁকড়াকে গলায় নিয়ে কাঁক উড়ে এসে বসল আমারই গাছের ডালে।
কাঁকড়া বলল, “কাকা
কঙ্ক, আপনি
নিচেয় পদ্মদীঘির কাছে না গিয়ে, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন?”
কাঁক ক্রূর হেসে বলল, “আমি কি এতই
মূর্খ? যে
অকারণে মাছ আর চিংড়িদের পদ্মদীঘিতে বয়ে বয়ে আনব? কাঁক এত পরোপকারী নয়, ভাইপো!
গাছের নিচে তাকিয়ে দেখ,
মাছের কাঁটা আর শল্কর কেমন স্তূপ জমে উঠেছে। সব কটাকে খেয়েছি, এখন তোকেও
খাবো। তোর খোলাও পড়ে থাকবে ওই স্তূপের মধ্যে”।
“কাকা, মাছ এবং
চিংড়িদের সহজেই ঠকাতে পেরেছ বলে, আমাদেরও ঠকাতে পারবে ভেবেছ? আমাকে এখনই ওই পদ্মদীঘির ধারে নিয়ে
চল, তা
না হলে আমার দুই দাঁড়ায় তোমার গলা আমি ছিঁড়ে ফেলব”।
কাঁকড়া তার দুই দাঁড়া দিয়ে কাঁকের
গলা চেপে ধরতেই, কাঁক
তার বিপদ বুঝতে পারল,
যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে, ছেড়ে দে। আমি তোকে এখনই নীচেয় নিয়ে
যাচ্ছি। তোকে আমি খাবো না”। কাঁক তাকে নিয়ে পদ্মদীঘির জলের ধারে নিয়ে গেল, কিন্তু
কাঁকড়া তাকে ছাড়ল না। মাছ এবং চিংড়িদের সঙ্গে ওই কাঁকের নিষ্ঠুর বঞ্চনার কথা মনে
করে, সে
তার দুই দাঁড়ার প্রচণ্ড চাপে ছিঁড়ে ফেলল কাঁকের গলা। কাঁক মারা গেল, আর কাঁকড়া
হেঁটে গিয়ে নেমে পড়ল জলে।
ছেলেমেয়েরা, আমিই ওই
চাঁপাগাছ ছিলাম বলে,
সমস্ত ঘটনা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। তখনই আমি শিখেছিলাম, আমরা যদি
কারও সঙ্গে সহৃদয় আচরণ করি,
সেও আমার সঙ্গে তাই করবে। আর যদি নিষ্ঠুর হিংস্র আচরণ করি, আমাদের
ভাগ্যেও তাই জুটবে। সে সময় আমার কিছু করার সাধ্য না থাকলেও, আমি মনে মনে
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,
আমি যদি পরের জন্মে কোন প্রাণী হয়ে জন্মাই, তাহলে আমি অবশ্যই দুর্বল এবং অসহায়
প্রাণীদের রক্ষা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করব। হয়তো তোমাদের মধ্যে অনেকেই সেই
জন্মে ছিলে, চিংড়ি, মাছ অথবা
কাঁকড়া।”
ছেলেমেয়েরা খুব মন দিয়ে এই কাহিনী শুনছিল। তারা
সকলেই অনুভব করল চাঁপাগাছের অসহায় দুঃখ। অসহায় মাছ এবং চিংড়িদের কথা ভেবেও তারা
ভীষণ কষ্ট পেল। কাঁকের প্রতি বিতৃষ্ণায় তাদের মনে ভরে উঠল। আর স্বস্তি পেল কাঁকড়ার
উপস্থিত বুদ্ধি আর বীরত্বে।
রাজা বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন। জোড়হাতে নতমস্তকে
শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি ভগবান বুদ্ধকে বললেন, “হে আচার্য, আপনার এই
কাহিনী শুধু ছোটদের নয়,
আমাদের মতো বড়দের কাছেও সমান শিক্ষণীয়। আমি নিশ্চিত, পুত্র
অজাতশত্রু এবং অন্য সব ছেলেমেয়েরা, এই শিক্ষা সারাজীবন মনে রাখবে।
আমাদের রাজ্য আজ আপনার উপস্থিতিতে অলংকৃত হয়ে উঠল। এবার অনুগ্রহ করে আমাদের পক্ষ
থেকে আপনাকে খুব সামান্য কিছু উপহার দেওয়ার অনুমতি দিন”।
গৌতমবুদ্ধ কোন উত্তর দিলেন না, স্মিতমুখে
তাকিয়ে রইলেন রাজা বিম্বিসারের মুখের দিকে। রাজা বিম্বিসার বললেন, “রাজগৃহের
উত্তরে অর্ধক্রোশ দূরে খুব সুন্দর একটি বড়ো উপবন আছে। সেখানে আছে স্বচ্ছ জলের
সরোবর। হিংস্র-শ্বাপদহীন সে বনে শুধু হরিণ আর কাঠবেড়ালি ঘুরে বেড়ায়। ওই উপবনের নাম
বেণুবন। আমি ওই বেণুবন আপনাকে এবং আপনার সঙ্ঘকে দান করতে চাই। সেই সঙ্গে বানিয়ে
দিতে চাই আপনাদের সবার বাসযোগ্য অনেক কুটির। সহস্রাধিক ভিক্ষু এবং আমাদের মতো
গৃহীশিষ্যদের বসার জন্যে বানিয়ে দিতে চাই স্থায়ী বাঁধানো মণ্ডপ। যেখানে স্বয়ং আপনি
এবং অহর্ৎগণ আমাদের প্রত্যহ ধর্মশিক্ষা দিতে পারবেন। হে প্রজ্ঞাবান, আপনি
অনুগ্রহ করে আমার অন্তরের এই বিনীত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন”।
ভগবান বুদ্ধ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতমুখে সম্মতি দিলেন রাজাকে। রাজা বিম্বিসার তখনই সোনার কলসে পবিত্র জল আনালেন, তারপর সেই কলসের জল ভগবান বুদ্ধের করকমলে ঢালতে ঢালতে বললেন, “হে প্রভু, যেভাবে এই কলসের জল আপনার করপদ্মে নিবেদন করলাম, সেইভাবেই বেণুবন সমর্পণ করলাম আপনাকে এবং আপনার সঙ্ঘকে”।
বুদ্ধদেব এবং তাঁর সঙ্ঘ সেই প্রথম নিজস্ব একটি
জমির অধিকার লাভ করলেন। যেখানে ভিক্ষুরা নিশ্চিন্তে বাস করবেন এবং ধর্মচর্চা
করবেন। প্রতিকূল বর্ষার সময়েও তাঁরা পেয়ে যাবেন নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়। রাজগৃহের
বেণুবন বৌদ্ধধর্মে নিয়ে এল বৌদ্ধবিহারের প্রথম ধারণা। গড়ে উঠতে লাগল বৌদ্ধবিহার
কেন্দ্রিক সুশৃঙ্খল এক ধর্মীয় সংগঠন।
সেদিন রাজা বিম্বিসারের অতিথিদের মধ্যে অনেকেই
ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের রক্ষক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। তাঁরা প্রকাশ না করলেও, মনে মনে
তীব্র ঈর্ষায় বিরূপ হলেন রাজার ওপর এবং গৌতমবুদ্ধ নামের ওই ছোকরা লোকটির ওপর।
এরপর গৌতমবুদ্ধ আমৃত্যু (৪৮৩ বি.সি.ই) সর্বদাই
পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, প্রধানতঃ এখনকার উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বিভিন্ন নগরে, জনপদে এবং
গ্রামে। তাঁর শিষ্য এবং অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন, রাজা থেকে ক্রীতদাস, বণিক থেকে
বারাঙ্গনা। বয়োবৃদ্ধ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ থেকে নিজের পুত্র বালক রাহুল। বিভিন্ন
বৌদ্ধগ্রন্থে বিখ্যাত যত অর্হৎ ও সন্ন্যাসীদের নাম পাওয়া যায়, তাঁদের
কয়েকজনের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
অহর্ৎ কঙ্খা রেবত – শ্রাবস্তীর অতি ধনী পরিবারে
পুত্র। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের অন্যতম স্তম্ভ।
অনাথপিণ্ডিক (অনাথপিণ্ডদ নামেও পরিচিত) – অন্যতম
বিখ্যাত গৃহীশিষ্য। শ্রাবস্তীর সফলতম বণিক। তাঁর সম্বন্ধে আশ্চর্য এক কাহিনী শোনা
যায়। গৌতমবুদ্ধকে একটি বিহার নির্মাণ করে দেবেন মনস্থ করে, অনাথপিণ্ডিক
বেশ বড়ো একটি ভূখণ্ড পছন্দ করেছিলেন। সেই ভূমির অধিকারী ছিলেন কোশলরাজ প্রসেনজিতের
পুত্র রাজকুমার জেত। তিনি কিছুতেই জমিটি হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। অনেক অনুরোধে
তিনি নাকি অসম্ভব এক প্রস্তাব দিয়েছিলেন - সম্পূর্ণ জমিটি ঢাকতে যতগুলি
স্বর্ণমুদ্রা প্রয়োজন,
তার বিনিময়েই তিনি জমিটি হস্তান্তর করতে পারেন। অনাথপিণ্ডিক নির্দ্বিধায় রাজি
হয়ে গেলেন এবং গোশকটে কার্ষাপণ বা নিষ্ক (স্বর্ণমুদ্রা) বহন করে এনে জমিতে বিছোতে
শুরু করলেন।
অনাথপিণ্ডিকের এই আশ্চর্য সংকল্পে মুগ্ধ হয়ে শেষ
অব্দি রাজকুমার জেত জমিটি দান করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর শর্ত ছিল এই বিহারের নাম
তাঁর নামেই রাখতে হবে। সেই কারণেই এই বিহারের নাম জেতবন বিহার। শিল্পীরা এই
কাহিনীকে অমর করে রেখে গেছেন সাঁচী এবং ভারহুত স্তূপের প্রাচীরের গায়ে (ওপরের
চিত্র)। জমিটি বিনামূল্যে পেয়ে গেলেও, জেতবন বিহারের সমস্ত নির্মাণ এবং
রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় অনাথপিণ্ডিক আজীবন বহন করেছিলেন।
অর্হৎ সুভূতি – অনাথপিণ্ডিকের আত্মীয় – ভাইপো, মতান্তরে
শালা।
ভিক্ষু পুন্নমন্তালিপুত্ত – বিখ্যাত ব্রাহ্মণ
পণ্ডিত।
অর্হৎ দাসক – অনাথপিণ্ডিকের ক্রীতদাস।
গৃহীশিষ্য রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রু – মগধের
রাজা।
গৃহীশিষ্য রাজা প্রসেনজিৎ - কোশলের রাজা।
গৃহীশিষ্য রাজা চণ্ডপ্রদ্যোত – উজ্জয়িনীর রাজা।
গৃহীশিষ্য রাজা উদয়ন – বৎসদেশের রাজা।
অর্হৎ অভয় -
রাজা বিম্বিসারের পুত্র।
অহর্ৎ সুপ্রিয় – শূদ্র কুলে জন্ম।
অর্হৎ বিমল কোণ্ড – রাজা বিম্বিসারের রক্ষিতা
অম্বাপালীর পুত্র।
অহর্ৎ ছন্ন – রাজা শুদ্ধোদনের ক্রীতদাস।
অর্হৎ তিস্র – রাজা বিম্বিসারের মিত্র।
ভিক্ষু বৎসগোত্র - ধনী ব্রাহ্মণ পুত্র।
অহর্ৎ যশ – বারাণসীর বণিক পুত্র।
অর্হৎ পিণ্ডোল ভারদ্বাজ – কৌশাম্বীর রাজপুরোহিত।
অর্হৎ সারিপুত্র – অহর্ৎ তিস্রর পুত্র। তিনি
প্রায় দ্বিতীয় বুদ্ধের মতো সম্মানীয় ছিলেন।
অহর্ৎ মৌদ্গলায়ন - অর্হৎ সারিপুত্রর আবাল্য
বন্ধু। তিনিও সারিপুত্রের মতোই সম্মানীয় ছিলেন।
অহর্ৎ ধনিয় – কুম্ভকার ছিলেন।
অহর্ৎ উপালি – নাপিত – ত্রিপিটক গ্রন্থের অন্যতম
সংকলক।
অর্হৎ উরুবিল্ব কশ্যপ – বেদজ্ঞ প্রখ্যাত পণ্ডিত
ব্রাহ্মণ। এঁর কথা আগেই বলেছি।
অর্হৎ কৌণ্ডিল্য, বপ্র, ভদ্রিক, অশ্বজিৎ এবং
মহানামা – এঁদের কথা আগেই বলেছি।
অহর্ৎ মহাকাত্যায়ন – উজ্জয়িনীর রাজা
চণ্ডপ্রদ্যোতের পুরোহিত।
অর্হৎ আনন্দ -
গৌতমবুদ্ধের খুড়তুতো ভাই, ত্রিপিটক গ্রন্থের অন্যতম সংকলক।
অহর্ৎ অনুরুদ্ধ – গৌতমবুদ্ধের খুড়তুতো ভাই।
অহর্ৎ রাহুল – গৌতমবুদ্ধের পুত্র।
গৌতমবুদ্ধের বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে জীবক
কুমারভৃত্যও একটি উজ্জ্বল নাম। ভারতীয় চিকিৎসাচর্চায় তিনিই যে পথিকৃৎ সে কথা
নিঃসন্দেহে বলা যায়। জীবকের মা ছিলেন রাজগৃহের বিখ্যাত বারবনিতা শাল্বতী বা
শালবতী। শোনা যায় পরিত্যক্ত শিশু জীবককে আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন রাজা
বিম্বিসারের পুত্র কুমার অভয়, তারপর রাজা বিম্বিসারই তাঁকে প্রতিপালন করেন। ছোটবেলা
থেকেই মেধাবী জীবক উদ্ভিদ ও ভেষজ চর্চায়
অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি তক্ষশীলা[2] মহাবিদ্যালয়ে
সাত বছর আয়ুর্বেদ এবং ভেষজশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তক্ষশিলায় তাঁর গুরু ছিলেন
বিখ্যাত ঋষি আত্রেয় পুর্ণবসু।
শোনা যায়, জীবকের পাঠ সমাপ্তির দিন গুরু আত্রেয়
শিষ্যের পরীক্ষা নিতে বলেছিলেন, “বৎস এই মহাবিদ্যালয়ের পিছনে যে বনভূমি রয়েছে, সেখানে
সারাদিন সন্ধান করে আমার জন্যে ওষধিগুণহীন অন্ততঃ তিনটি গাছ, তৃণ, গুল্ম বা
উদ্ভিদ এনে দাও”। সারাদিন নিবিড় সন্ধানে নিরত জীবক এমন উদ্ভিদ একটিও যোগাড় করতে
পারলেন না। সন্ধ্যায় বিষণ্ণ মুখে এসে দাঁড়ালেন গুরু আত্রেয়র সামনে এবং নিজের
ব্যর্থতার কথা নিজমুখে স্বীকার করলেন। গুরু আত্রেয় উজ্জ্বল সহাস্য মুখে শিষ্যকে
আলিঙ্গন করে বলেছিলেন,
“কোন না কোন ওষধিগুণ ছাড়া জগতে একটিও উদ্ভিদ নেই, বৎস। তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ ও
সার্থক”।
তক্ষশিলার পাঠ শেষে তিনি রাজগৃহে ফিরে আসেন। শোনা
যায় তিনি রাজা বিম্বিসারের দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়েছিলেন, উজ্জয়িনীর
রাজা প্রদ্যোত এবং বেশ কয়েকবার ভগবান বুদ্ধেরও চিকিৎসা করেছিলেন।
তিনি সরাসরি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সংঘে যোগ
দিয়েছিলেন, এমন
তথ্য পাওয়া না গেলেও,
গৌতমবুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে তাঁর আজীবন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, পিতৃহত্যার
পর অজাতশত্রু যখন অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন, এবং গৌতমবুদ্ধের সামনে যেতে ভয়
করছিলেন, তখন
জীবকের মধ্যস্থতায় তিনি বিরক্ত বুদ্ধদেবের ক্ষমা লাভ করেছিলেন।
জীবকের এবং ভারতীয় আয়ুর্বেদ ও চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে
পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব,
তবে এখানে এটুকু বলে রাখি, গৌতমবুদ্ধের নির্দেশে এবং জীবকের প্রভাবেই বৌদ্ধ
বিহারগুলিতে অর্হৎ এবং ভিক্ষুদের মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রচলন
হয়েছিল। যার ফলে পরবর্তীকালে, সাধারণ মানুষের শুধুমাত্র চৈতন্য বোধনের জন্যেই নয়, শারীরিক
চিকিৎসার জন্যেও, বৌদ্ধ
অর্হৎ ও ভিক্ষুরা দেশে-বিদেশে সর্বত্র সম্মানীয় এবং জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
গৌতমবুদ্ধের বিখ্যাত মহিলা ভক্তের সংখ্যাও নেহাত
কম নয়। প্রথমদিকের আশ্রম এবং বিহারগুলিতে মহিলাদের থাকার উপযুক্ত পরিকাঠামো না
থাকায় তিনি ভিক্ষু হতে ইচ্ছুক মহিলাদের অনুমতি দিতেন না। মহিলাদের গৃহীশিষ্যা হয়েই
সন্তুষ্ট থাকতে হত। এরকমই কিছু নাম পাওয়া যায়, রাজগৃহের বিখ্যাত বারাঙ্গনা
অম্বাপালী, সিরিমা
এবং বারাণসীর অড্ঢকাশী। তাছাড়া আরও ছিলেন, কৌশাম্বীর মহারাণী শ্যামাবতীর
ক্রীতদাসী খুজ্জুত্তরা। এছাড়াও (কোশলরাজার বোন) সুমনা, ভদ্রা, সুপ্রিয়া, ক্ষেমা, সুজাতা
(উরুবিল্বের সেই বালিকা),
মুত্তা এবং বড্ঢ মাতার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বুদ্ধদেবের বিমাতা ও মাসি, কপিলাবস্তুর
রাণি গৌতমী, তাঁর
শিষ্যা হয়েছিলেন এবং প্রধানতঃ তাঁর উদ্যোগেই বৌদ্ধবিহারে ভিক্ষুণীদেরও থাকার
ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। অতঃপর বিখ্যাত তিয়াত্তর জন ভিক্ষুণীর নাম পাওয়া যায়, “থেরীগাথা”
নামের বৌদ্ধদের এক ধর্মগ্রন্থে। গ্রন্থটির সমস্ত শ্লোকই থেরী অর্থাৎ
সন্ন্যাসিনীদের রচিত। “থের” শব্দের উৎপত্তি “স্থবির” থেকে, বয়স্ক
প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসীদের থের বলা হত, সন্ন্যাসিনীদের থেরী। পরবর্তী কালে বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখার
নাম হয়ে উঠেছিল “থেরবাদ” অর্থাৎ প্রাচীনপন্থী মত। সে প্রসঙ্গ আসবে পরে।
শেষ পর্যটনে গৌতমবুদ্ধ রাজগৃহ থেকে মল্লরাজ্যের
কুশীনারায় গিয়েছিলেন। সেখানে এক কর্মকারের গৃহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করার পরেই তিনি
অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অহর্ৎ আনন্দ, তিনি মল্লরাজের সহায়তায় গৌতমবুদ্ধের
অন্ত্যেষ্টি সৎকার করেছিলেন। গৌতমবুদ্ধের পুণ্য অস্থি ও ভস্ম ভাগ করে নিয়েছিলেন
তখনকার অনেক রাজা এবং গণরাজ্যগুলি, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কুশীনারার
মল্লরাজ, মগধ
রাজ্যের অজাতশত্রু, বৈশালীর
লিচ্ছবি, কপিলাবস্তুর
শাক্য, কোলিয়
রাজ্য এবং পিপ্পলি গণরাজ্যের মোরিয়রা। এঁরা সকলেই নিজ নিজ রাজধানীতে গৌতমবুদ্ধের
অস্থি-অবশেষের ওপর স্তূপ নির্মাণ করিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।
গৌতমবুদ্ধের মহানির্বার্ণের একবছর পর রাজগৃহে
প্রথম ধর্ম সম্মেলন হয়েছিল,
সেখানেই “ত্রিপিটক” গ্রন্থ সংকলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বোধিলাভের পর প্রায়
চুয়াল্লিশ বছর ধরে গৌতমবুদ্ধ যত ধর্মকথা এবং উপদেশ দিয়েছিলেন, সেগুলি
তিনটি প্রধান বিভাগে সংকলিত হয়েছিল - বিনয়, সূত্র এবং অভিধর্ম। এই ত্রিপিটক
বৌদ্ধধর্মের প্রধানতম এবং প্রথম ধর্মগ্রন্থ। একই সঙ্গে সঙ্কলিত হয়েছিল, গৌতমবুদ্ধের
নিজের মুখে বলা পূর্বজন্মের কাহিনীগুলি – যার নাম ছিল “জাতক”।
চলবে...
[1] কাঁক
বা কঙ্ক -একধরনের বড়ো পাখি,
সম্ভবতঃ হাড়গিলে [শব্দকোষ]।
[2] তক্ষশিলা – গান্ধার রাজ্যের রাজধানী – এই সময় পারস্য অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্যের একটি অঙ্গ রাজ্য ছিল। এই তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন ঋষি আত্রেয় পূর্ণবসু – অতএব ভারতীয় বিদ্দ্বজ্জনের সঙ্গে অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠতা ছিল – একথা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়।
চিত্রঋণঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন