রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৫

"চিনি"লে না...

 




 চিনিলে না ...

পাঠ্যপড়ার চাপ নেই, কাজেই অবসর এবং গরমের রাতে ছাদে বসে রেডিও সিলোন...। অ্যান্টেনা শেষসীমা পযর্ন্ত বাড়িয়ে বারেবারে পূবপশ্চিমমুখো আর উত্তরদক্ষিণমুখো করলে আমিন সায়ানির গলা কাছে থেকে দূরে আবার দূর থেকে কাছে ভেসে আসত...। বহনো অওর ভাইয়োঁ...। তার সঙ্গে উড়ে আসত গান। পোষা পায়রার মতো...। এই মাথার ওপর কাছাকাছি, আবার অনেক দূরে অস্পষ্ট...। এ ভাই, জারা দেখকে চলো... অথবা পরী কাঁহা সে লাউঁ, জিসে দুলহন তুঝে বানাউঁ

দেখতে দেখতে অনেক পথ পার হওয়া গেল। ছাদে গিয়ে দাঁড়ালেই সেই যে, যারা সামনের বারান্দায় অকারণ ঘর বার করত। বারবার সরানো পর্দার আলোর উস্কানি লেগে মনে হত এই তো সেই পরী! মোবাইল নেই। এসএমএস নেই। শুধু চোখ আর কান। আমাদের কানগুলো কি তখন নড়াচড়া করত? কার কখন কোনদিক থেকে ডাক আসবে শোনার অপেক্ষায়?

সামনের বাড়ির পল্টু আমাদের বয়সী, পল্টুর দিদি বীণাদিদি প্রায়ই আমাকে ডাকত সেকি আমাকে না আমার দাদাকে আজও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। অথচ বীণাদিদির সঙ্গে ওদের একতলার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কেটে গেছে রেশনে রেখে আসা লাইন কবে পার হয়ে গেছে। আমার সাত আট জন পরে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের মাসি –মালতীমাসি কতদিন বলেছে –“অ মা। তুমি একেনে দেঁইড়ে কি করতেস? মোর রেশন ধরা, গম ভাঙানো সব সারা-

এক ছুট্টে আবার রেশনের দোকানে মানিককাকুর কাছে দাঁড়াতেই বলল, কোন চুলোয় যাওয়া হয়েছিল, শুনি। ডেকে ডেকে পাত্তা মেলে না। আজ আর চিনি নেই, ডিউ স্লিপ লিয়ে যা, বুধবার আবার আসবি

-বুধবার তো হবে না, অন্য কাজ আছে, ওদিন আসব কি করে কাকু?

-আচ্ছা আচ্ছা সে হবে খন। আমি তুলে রাখব না হয়। সময়মতো লিয়ে যাসরামদীন ছিল রেশনের দোকানের ওজনদার, স্লিপ অনুযায়ী চাল, গম, চিনি ওজন করে দেবার কাজ তার। রামদীন বললে-দুফরে আমি মাইজিকে দিয়ে আসবে, তুমারে আসতে হোবে না

আমার একটাই চিন্তা, মালতীমাসি চিনি পেয়েছে কিনা। পেলে মাকে গিয়ে নির্ঘাত বলে দেবে। আর আমি যদি চিনি না নিয়ে যাই, আমার কপালে বিশেষ দুঃখ।

ঠাকুমার কাছে শুনেছিলাম - চিনি যোগান চিন্তামণি। আমাদের সময় চিন্তামণির আরেক নাম ছিল রেশন। সেই চিনিও হাতছাড়া করেছি কতবার, বীণাদিদি, তোমার মিষ্টি কথা আর মধুর হাসির টানে। সেই গুহ্যিপক্ক জীবন থেকে বীণাদিদির মতো পরীরা সব হারিয়ে গেছে । আজ শোণিতে চিনির জোয়ার, তাই বিনা চিনির পরিপক্ক জীবনটা ছিন্ন তার বীণার মত পড়ে আছে ঘরের এককোণে।

 

 


চারমিনারের চূড়ো


প্রায় সাড়ে তিনমাস এমনই চলল। বঙ্কিম থেকে শীর্ষেন্দু, প্রভাত মুখুজ্জে থেকে দিব্যেন্দু পালিত, প্রমথ চোধুরি থেকে সুনীল গাঙ্গুলি। বাংলা ভাষার অতীত ও সমসাময়িক দিক্‌পাল সাহিত্যিকদের রচনা পড়তে পড়তে আমার মনে হল, আমিই বা কম কিসে? আমিও কি পারিনা এমন সব গল্প লিখতে? লেখার একটা নড়বড়ে বাঁধুনি কি করে যেন তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গল্পের প্লট? মাথায় আসছিল না কিছুতেই। যাই মনে আসে, ভেবে দেখি সেটা হয়তো নরেন্দ্রনাথ মিত্তির অলরেডি লিখে ফেলেছেন – অথবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছায়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ক্ষমতায় না কুলোক, কিন্তু ভেতরে একটা স্বপ্ন রয়েই গেল – লেখালেখির জগতে যাওয়ার। মনে হত এমন একদিন ঠিক আসবে যেদিন, আমি মারকাটারি কিছু একটা লিখতেই থাকব – সকলে অবাক নয়ন মেলে বলবে ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’। আমার উপস্থিতিতে বাংলা সাহিত্যের খাতে এসে পড়বে নতুন জোয়ার।  কাজেই, বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত নদীর বুকে ময়ূরপঙ্খী নাও ভাসানোর স্বপ্নটা বুকের মধ্যে জেঁকে বসল। আর তার নিস্তেজ পালে দমকা হাওয়ার পরশ লাগল মাধ্যমিকের রেজাল্ট। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা শুনেই ছিলাম – অনুভবে ছিল না। মাধ্যমিক পরীক্ষার মার্কশীট পেয়ে সেটা উপলব্ধি হল এবং চোদ্দ আনা নয়, একেবারে ষোল আনা।

আমার মতো এলেমদার একটি ছেলে, অত্যল্প প্রচেষ্টায় এতটা ভালোভাবে উৎরে যাবো, এটা কল্পনাতেও ছিল না। যে অঙ্ক নিয়ে বহু পরীক্ষায় নাকালের একশেষ হয়েছি সে অঙ্কে যখন একখানা লেটার জুটে গেল, নিজেকে প্রতিভাবান ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলাম নাকাজেই আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলাম, আমার মধ্যে আগুন আছে। সে আগুনটা আপাততঃ ছাই চাপা আছে, সেটাকে ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেবার অপেক্ষা। আমার স্বপ্নের পাল ফুলে উঠল কল্পনার অনুকূল বাতাসে।

বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ হাতের মুঠোয় অবলীলায় চলে এল। আমার দশবছরের প্রিয় স্কুল ছেড়ে আমাকে অন্যত্র কোথাও ভাগ্যপরীক্ষায় নামতেও হল না। আরো দু বছরের জন্যে এই স্কুলের সঙ্গে আমার নাড়া বাঁধা হয়ে গেল। সমস্ত ব্যাপারটা এত সহজ ও সাবলীলভাবে ঘটে গেল, আমার গায়ে এতটুকু আঁচও লাগল না। আমি আগে নিশ্চিন্ত ছিলাম, এখন আমার অনবদ্য মেধা আর সহজাত বুদ্ধির উপর নিশ্চিত হলাম। আর আমি শুধু একলা নয় – আমার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য জোট বেধে গেল বেশ কিছু সহপাঠীর।

বিভূতিভূষণের আরণ্যক থেকে তারাশঙ্করের হাঁসুলিবাঁকের উপকথা। সুবোধ ঘোষের অলীকবাবু থেকে সমরেশ বসুর আদাব। বিমল করের আত্মজা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাড় থেকে শীর্ষেন্দুর শ্যাওলা। সক্কলের তুল্যমূল্য বিচার চলতে থাকল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সত্যজিৎ থেকে ঋত্বিক। মৃণাল সেন থেকে শ্যাম বেনেগাল। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় থেকে তরুণ মজুমদার। সেদিন কারো পরিত্রাণ ছিল না আমাদের সেই তর্কের বিষয় থেকে। অনায়াসে আমরা হিসেব কষে বের করে ফেলতে পারতাম তাঁদের কাজের যাবতীয় ত্রুটি এবং বিচ্যুতি, আর আমাদের মত করে আমরাই বলে ফেলতাম শেষ কথা। বাইরে আড্ডা আর সিনেমা। ঘরে বই পড়া – নাঃ পড়ার বই পড়ার সুবুদ্ধি তখন কমই হত। লেখা পড়া নিয়ে মা খুব চাপ দিলে ফিজিক্সের বইয়ের নীচে থাকত বুদ্ধদেব বসুর রাত ভোর বৃষ্টি অথবা কেমিস্ট্রি বইয়ের অন্তরালে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মহাস্থবির জাতক।

এইভাবেই একদিন কোন এক গরমের ছুটিতে দাদার নির্জন ঘরে বসে শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ পড়তে পড়তে দাদার পড়ার বইয়ের ফাঁকে আবিষ্কার করলাম একটি চারমিনারের প্যাকেট। খুলে দেখলাম চারটে সিগারেট রয়েছে। একটি হাতে নিলাম। পাশের ঘরে গিয়ে দেখলাম মা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন, মায়ের রান্নাঘর থেকে দেশলাই নিয়ে এসে ধরিয়ে ফেললাম সিগারেটটা, টোস্টেড টোব্যাকোর কড়া স্বাদে মাথার মধ্যে কেমন যেন ঘূর্ণি লাগল। খুব সন্তর্পণে সিগারেটটা শেষ করলাম। মনে হল মাথাটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল। এতদিন ফিল্টার লাগানো সিগারেট খেয়ে তেমন জুৎ পাই নি, আজ বেশ লাগল। বুঝলাম বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়ার মৌতাত মন্দ নয়।

ইলেভেনের ক্লাস শুরু করার আগেই পিঠের দুপাশে ডানা গজিয়ে উঠল প্রায় রাতারাতি। পাঠ্য লেখাপড়ার থেকে শতহস্ত দূরে, নির্বিঘ্নে শুয়ে শুয়ে শরৎবাবুর নভেল পাঠ, হাতে জ্বলন্ত চারমিনার আর মাথার মধ্যে সাহিত্যের ভূত। সেদিন ইন্টেলেকচুয়াল হবার অমোঘ সিঁড়িতে উঠে পড়লাম। সে স্বপ্নের বুদবুদ চারমিনারের চূড়া পার হয়ে অনেক উচ্চে উঠেও ভেসে চলতে লাগল, কোন একদিন ফেটে যাবার অপেক্ষায়

চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/৪

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের তৃতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/৩ " তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ পর্বাং...