বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫

গড্ডল

 







তোমার নামটা কী যেন হে?

মন্টু, আজ্ঞে, মন্টু মাজি

জেরক্সটা করে আনলে আর অরিজিনালটা কোথায় হারালে, য়্যাঁ। এক নম্বরের গাড়ল তুমি একটি। ঝাও, শিগগির খুঁজে নিয়ে এস। যত্তোসব

সক্কাল সক্কাল ঝাড় খেয়ে গোলগাপ্পি মুখ করে ছোট সায়েবের চেম্বার থেকে বের হল মন্টু।

ব্যাপারটা হয়েছিল কী জেরক্স টেরক্স সাধারণত বিকাশ করায়, বিকাশ আসেনি এখনও। এদিকে ছোট সায়েব চলে এসেছেন অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি। এসেই ছোট সায়েবের জেরক্স দরকার অগত্যা মন্টু গিয়েছিল জেরক্স করাতে, আর দোকানেই ফেলে এসেছে অরিজিনালটা, তার কপি সায়েবকে জমা করতে গিয়েই বিপত্তি।

বাঁধা দোকান অসুবিধা হবে না। মন্টু দৌড়ে গেল আবার দোকানে। শ্যামল ছিল দোকানে তাকে ব্যাপারটা বলতে মেশিনের ঢাকনা খুলে অরিজিনালটা ফেরত দিল। চলেই আসছিল মন্টু, কী মনে হতে শ্যামলকে জিগ্যেস করল, শ্যামলদা, গাড়ল মানে কী বলো তো, জানো?

মন্টুদের আপিসের সঙ্গে শ্যামলের মাসকাবারি খাতা সিস্টেমে কাজ চলে পুরোটাই ধারে - এ মাসের টাকা পেতে পেতে পরের মাসের শেষ  - তাও আবার কমিসন দিতে হয় বিকাশকে, কপিতে দশ পয়সা। আজ বউনি হবার আগেই মন্টু এসে জেরক্স করাতে তার মেজাজ বিগড়েই ছিল তার ওপর ওই প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে চটে ঠল শ্যামল, বলল, দ্যাখ মন্টু, বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে - তোদের সঙ্গে খাতা চালাই বলে, যখন তখন আসবি আবার, যা খুশী বলবি.....?

ব্যাপারটা সুবিধের নয় বুঝে মন্টু আমতা আমতা করে কেটে পড় তৎক্ষণাৎ।

     বাড়ি থেকে ছটায় সাইকেলে বেরিয়ে ছটা সাতাশের শেয়ালদা লোকাল ধরে মন্টু বালিগঞ্জ স্টেসন পৌঁছয় সাতটা পনের নাগাদ। সেখান থেকে আপিস অব্দি হেঁটে আসতে আরও মিনিট কুড়ির ধাক্কা। এদিকে নটা থেকে আপিস শুরু। তার আগে বড়, মেজ, ছোট তিন সায়েবের চেম্বার, রিসেপশন ছাড়াও সবার চেয়ার, টেবিল, মনিটার, কি-বোর্ড, মাউস, ফোনের হাতল পরিষ্কার করা, সবার টেবিলে পুরোনো জল পালটে নতুন জল ভরে বোতল রাখা হাজার কাজ। এর মধ্যে ঝাড়ুদার আসে ঘর, টয়লেট সাফ করতে তার আবার একটু হাতটান আছে। নজর না রাখলেই গায়েব হয়ে যায় ছোট খাটো জিনিষপত্র। এসব সেরে পৌনে নটার মধ্যে চায়ের জল চাপাতেই হবে। তাও দুজায়গায় একটা ছোট সসপ্যানে বড়-মেজ-সেজ তিন সায়েবের জন্যে আর অন্যটা ঢাউস সসপ্যানে বাকি সবার জন্যে। চায়েরও দুরকমের কোয়ালিটি আছে, ইস্পেসাল আর চালু।

নটা বাজার পাঁচ/সাত মিনিট আগে থেকে নটা পনের/বিশ অব্দি সবাই চলে আসে। ওই সময়টায় মন্টু মড়ারও সময় পায় না। সবার পছন্দমতো হরেক রকমের চায়ের সাপ্লাই চিনি ছাড়া, কড়া চিনি, ফিকা চিনি, লিকার চা, লিম্বু চা। ভুল চা দিয়ে ফেললেই আবার ঝাড়। 

সেদিন সাড়ে নটা নাগাদ একটু ফাঁক পেয়ে, এক কাপ কড়াচিনি চা নিয়ে মন্টু ভাবতে বসল, সকালের ঘটনাটা নিয়ে। ছোট সায়েব এই মাসখানেক হল এসেছে সব সময়েই যেন চড়ে থাকে, খুব কড়া মেজাজ। অথচ ওঁনার ঘরের এসিটাই সবচেয়ে জোর চলে, একবার ঢুকলেই কেমন যেন শীত ধরে যায়। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই মাথা একদম গরম। সাত ঝামেলার মধ্যে অরজিনাল পেপারটা নাহয় ভুলেই এসেছিল, তা বলে সক্কাল সক্কাল ওভাবে ঝাড়তে হবে? গাড়ল বলতে হবে?

গাড়ল। এই শব্দটা মন্টুকে বহুবার শুনতে হয়েছে ছোটবেলা থেকে। আজকে ছোট সায়েব বলাতে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। সিক্সে প্রথম ইংরিজি শেখার সময় মহিমবাবু এক কেলাস ছেলের সামনে তাকে গাড়ল বলেছিলেন। গলায় গলায় বন্ধু নন্দকে টিপিন ঘন্টায় মন্টু গাড়ল মানে জিগ্যেস করাতে নন্দ পাত্তা দেয়নি। পরের দিন এক ফাঁকে তাদের কেলাসের ফাস্ট বয় রাজুকে জিগ্যেস করাতে, ফিচেল হেসে উত্তর দিয়েছিল – “গাড়ল মানে মন্টু মাজি

দু- দুবার চেষ্টা করেও সিক্স থেকে সেভেন উঠতে পারল না মন্টু, ইংরিজি আর অংকের যুগপৎ বজ্জাতিতে। মন্টুর বাবা নিমাই মাজি, গ্রিল কারখানার ওয়েল্ডার; একদিন তার মাকে ডেকে বলল, গাড়লটার নেকাপড়া কিসু হবে নি, কাল আমি ওরে নে’ যাব, হেদয়বাবুকে বলা আসে কম সে কম গিরিল বানানোটা শিখুক। হৃদয়বাবু তার বাবার গ্রিল কারখানার মালিক।

নয় নয় করেও মাস ছয়-সাত গ্রিল কারখানায় কাজ শিখতে চেষ্টার কসুর করে নি মন্টু। বার দশেক হাতে পায়ে ছ্যাঁকা খেল - ওয়েল্ডিং আর গ্যাস কাটিং করা গরম লোহার টুকরোর ওপর হয় দাঁড়িয়ে পড়ে, নয়তো হাত দিয়ে খামচে ধরতে গিয়ে। শেষের দিন ওয়েল্ডিং মেসিনের কানেকসনে হাত দিয়ে চেক করতে গিয়েছিল মেসিনে কারেন্ট আসছে কিনা। কারেন্ট ছিল এবং সেটা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেল, যখন মন্টু এক ঝটকায় চিৎপাৎ হল। বেশ কিছুক্ষণ টোটকা চিকিৎসায় চোখ ওলটানো মন্টু উঠে বসল। ধরাধরি করে সবাই অফিস ঘরে নিয়ে গিয়ে পাখার তলায় বসিয়ে দিল মন্টুকে। সামনেই ভোলাদার চায়ের দোকান থেকে এক গ্লাস গরম দুধও চলে এল মন্টুর সেবায়।

মন্টুর দুধের গ্লাস যখন হাফ, হৃদয়বাবু সবাইকে বললেন কাজে যেতে। ঘরে রইল শুধু মন্টু আর তার বাবা নিমাই মাজি। গম্ভীর গলায় হৃদয়বাবু বললেন,

নিমাই, তুমি এখন বাড়ি যাও মন্টুকে নিয়ে। আর কাল থেকে তোমার ছেলেকে আর এনো না বাপু, কবে কোনদিন কী অঘটন ঘটিয়ে বসবে। হাতে হ্যারিকেন হয়ে, ব্যবসা আমার লাটে উঠবে

না, না, বাবু, আপনি ঠিক কয়েচেন, এই কান মলতেসি, ওরে কাল থিকে আর আনব নি। তবে বাবু, কী যে করি ওটারে লিয়ে একদম হাবা গবা, গাড়ল একখান। না শিখল নেকাপড়া, না শিখল হাতের কাজ। মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকল নিমাই মাজি।

ও নিয়ে ভেব না নিমাই, একটা কিছু হয়ে যাবে ঠিক। তুমি ওকে নিয়ে ঘরে যাও এখন। মন্টুর একটু রেস্ট দরকার

          সেদিন রিকশ করে বাপের সাথে ঘরে ফিরেছিল মন্টু। ঘরে ফেরার পর সব শুনে, তার মা খানিক হাউমাউ করেছিল। বাবাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল

ওই সব্বনেশে গিরিলের কারখানায় কচি ছেলেকে কেউ নে যায়? তোমার যেমন বুদ্ধি। কাল থিকে ও আর যাবে নি। কক্‌খনো যাবে নি আর

বাবা কিছু বলে নি, বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।  

গায়ে মাথায় মায়ের হাত বোলানোর আরামে মন্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল শাঁখের আওয়াজে। প্রদীপ দেখিয়ে, ধূপ জ্বেলে, শাঁখ বাজিয়ে মা ঘরে এসে মন্টুকে জেগে ওঠা দেখে খুশি হল খুব। বিছানায় বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কেমন বুজচিস বাবা, বল পাচ্চিস শরীলে? মন্টু ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

খিদে পেয়েচে, মুড়ি খাবি? মন্টু আবার ঘাড় নেড়ে সায় দিল। মা বিছানা থেকে নেমে ও ঘরে যাচ্ছিল, মন্টু ক্ষীণ স্বরে ডাকল,

মা, শোন। মা কাছে এল।

কী হয়েছে, বাবা?। মন্টু মায়ের একটা হাত ধরে, বলল,

গাড়ল মানে কী, মা?

তোরে গাড়ল বলেচে? কে বলেচে? যে বলেচে সে নিজেই একখান গাড়ল। বলে মা রেগে দুম দুম করে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুড়ি আনতে।  

হৃদয়বাবু হৃদয়হীন নন, সোজা সাপটা ভোলাভালা মন্টুকে তিনি পছন্দই করতেন। ছেলেটার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। তা হোক, খাটিয়ে এবং বিশ্বাসী এটুকু তিনি লক্ষ্য করেছিলেন; এমন গুণ আজকের দিনে বিরল। যে আপিসে এখন মন্টু কাজ করে, তারা ঘর বাড়ি তৈরির কাজ করে। এদের সঙ্গে হৃদয়বাবুর অনেকদিনের লেনদেন ও ব্যবসা। সেই সূত্রেই হৃদয়বাবু মন্টুকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এই আপিসে। সেও প্রায় আজ বছর পাঁচেক হল।

এর পরে আরো একবার গাড়ল কথাটা শুনতে হয়েছিল, একদম অচেনা লোকের থেকে। বছর খানেক আগে, আপিসে আসার সময়, ঢাকুরিয়ার আগে ট্রেনটা মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল, সামনে অবরোধ ট্রেন আর যাবে না। কখন অবরোধ উঠবে কে জানে। মন্টু ট্রেন ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে বাসে চেপে পড়েছিল আপিসে দেরী হয়ে যাবার ভয়ে। গড়িয়াহাটের মোড়ে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়েছিল উলটো মুখ করে। পড়তে পড়তেও সামলে গিয়েছিল মন্টু, কিন্তু কানে এসেছিল বাস কন্ডাক্টারের মন্তব্যটা –“দ্যাখ্‌, দ্যাখ্‌, আরেকটু হলে মরত গাড়লটা।  

মন্টু সবার টেবিল থেকে এঁটো চায়ের কাপগুলো নিয়ে এল। সিঙ্কের কল খুলে কাপ প্লেট ধুতে ধুতে ভাবল গাড়ল মানে কী তবে সত্যিই মন্টু মাজি? কাপপ্লেট ধোয়াধুয়ি শেষ হবার আগেই বিকাশ এসে বলল,

সকাল সকাল শ্যামলদাকে, কী বলেচিস, তুই?

কই সেরম কিছু বলিনা তো...

গাড়ল না কি বলেচিস যে? যা, এবার সরকারবাবু কেমন দেয়, দ্যাখ 

এই অফিসের পত্তনের সময় থেকে সরকারবাবু আজ প্রায় বছর বিশেক একই সিংহাসনে সমাসীন। শুরুর দিন থেকে কোম্পানীর লাভ ক্ষতি, সাদা কালোর হিসেব তাঁর হাতে। কোন সায়েব কোন ফুলে তুষ্ট হয় - তার হাল হকিকত নখের ডগায়। যে যতো বড়ো অফিসারই হোক না কেন, তাঁর মাতব্বরি তাকে মানতেই হবে। সরকারবাবুকে বিগড়ে দিলে বড়ো সায়েবদের কানভাঙানি দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলবে যে কোন কলিগের জীবন। কাজেই সরকারবাবুকে সমঝে চলে না এমন কেউ নেই এই অফিসে।

বিকাশের কথায় মন্টুর শরীরটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে এল। এক পেট জল গিলে নিল জলের জগ উল্টে। তবুও গলার শুকনো ভাবটা কাটল না। মিয়োনো মুড়ির মত মন্টু গিয়ে দাঁড়াল সরকারবাবুর টেবিলের সামনে। শ্যামলদা দাঁড়ানো, টেবিলের ওদিকের কোণটা ঘেঁষে চুপচাপ মাথা গোঁজ করে। গলা ঝেড়ে সরকারবাবু সিনেমায় দেখা পাক্কা জজসায়েবি চাল মেরে বলতে শুরু করল,

মন্টু, আজ সকালে জেরক্স করাতে গিয়ে শ্যামলকে তুমি কি বলেচ?

সরকারবাবু অন্য সময় মন্টুকে তুই বলে, এখন তুমি বলছে মানে কেস গড়বড়, এটা মন্টু আগেও লক্ষ্য করেছে।

আজ্ঞে খারাপতো কিচু বলি না। মন্টু শুকনো মিহি গলায় বলে।

সকাল সকাল যেচে পড়ে আমায় গাড়ল বলিস নি? শ্যামল খেঁকিয়ে উঠল।

আঃ, শ্যামল, আপিসের মধ্যে চেঁচামেচি আমি ভালবাসি না। তোমায় তো বললাম আমি দেকচি। খারাপ বলনি, তার মানে শ্যামল বাজে কথা বলচে? শেষ কথাটা মন্টুকে বললেন সরকারবাবু।

আজ্ঞে, তা না। মন্টুর মিনমিনে উত্তর।আসলে আমি...মানে...গাড়ল মানে কি, জানতি...শ্যামলদাকে ...

গাড়লের মানে? তার মানে? সরকারবাবু তাঁর চাকরি জীবনে অনেক থানা-পুলিশ-কোর্ট-কাছারির এঁড়ে সওয়াল ম্যানেজ করেছেন, কিন্তু এমন প্রশ্নে তিনিও হতবাক। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে জিগ্যেস করলেন,

তা তোমার গাড়লের মানে হঠাৎ এমন জরুরি হয়ে উঠল কেন?

খুব করুণ মুখে করে মন্টু আজ সকালের পুরো ইতিহাসটা ঘোষণা করল সবার সামনে। শ্যামলদা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল সব শুনে ওই হাসি দেখে মন্টুর, শেয়ালের কথা মনে পড়ল। তাদের বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ে আছে একপাল। রাত্রে ঝোপেঝাড়ে টর্চ জ্বাললে, মাঝে মাঝে অবিকল ওই ভাবে ধেয়ে আসে অবিকল ওই আওয়াজ, ওইরকম দাঁত... কোন ফারাক নেই।

হাসছিল সবাই। মন্টু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল হলে প্রায় সকলেই হাসছে, তার মানে সবাই শুনেছে সব কথা। এই হাটে হাঁড়ি ভাঙা অপমানটা মন্টুরও গায়ে লাগল। সরকারবাবু হাসেন নি, কিন্তু চোখে মুখে হাসির পরতটা বোঝা যাচ্ছিল, গম্ভীর মুখোসটা মুখে লেগে থাকা সত্ত্বেও। সরকারবাবু বললেন, ঠিক আছে, এখন যা

আস্তে আস্তে হল থেকে বেরিয়ে এল মন্টু, মাথা নীচু করে। এই অপমানের মধ্যেও একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হল চাকরিটা এখনই যাচ্ছে না। সরকারবাবু তাকে আবার আগের মতোই তুই বলেছেন।  

বিকাশের কি কোন কাজ নেই? সে বসে বসে প্রতিদিন পড়ছিল। ওটা রোজ দেসায়েব নিয়ে আসেন। তার মানে দে সায়েব চলে এসেছেন, বিনা চিনি লিকার চা। দে সায়েবের চায়ের জল বসাল মন্টু। 

দে সায়েবও সরকারবাবুর মতো আদ্যিকাল থেকে আছে এই অফিসে। বড়ো সায়েবদের স্টেনো টাইপিস্ট। আলাদা খুপরি গৌরবে চেম্বার। আগে ছিল টরেটক্কা টাইপ মেসিন পরে ইলেক্ট্রনিক্‌স্‌। সে সব পাট উঠে গেছে বেশ কবছর। বাক্স বাজানো বন্ধ হয়ে কম্পিউটার চলে এসেছে। ইংরিজিতে দখল আর টাইপিংয়ের স্পিডের জন্যে আগে বড়ো সায়েবদের প্রিয় ছিলেন। এখন এক ছোঁড়া অরুণ এসেছে এই বছর পাঁচেক হল। কম্পিউটার জানে কিন্তু ইংরিজি শিখেছে ক্লাস সিক্স থেকে। ড্রাফট বানিয়ে দেসায়েবের থেকে মেরামত করে নেয় ইংরিজিটা। দেসায়েব আর অরুণ একে অপরের পরিপূরক হয়ে টিকে আছে কোন মতে।

অফিসের সময় নটা হলেও দেসায়েব কদাচ সাড়ে দশটার আগে ঢোকেন না। মন্টু চা নিয়ে দেসায়েবের ঘরে ঢুকল প্রায় এগারোটায়। তাকে দেখে দে সায়েব বললেন, কিরে, তোকে নিয়ে কি মহাসভা চলছিল শুনলাম। তুইও কিছু ঘাপলা করেছিস না কি?

আস্তে আস্তে ফুঁ মেরে, আর লম্বা আওয়াজে টান দিয়ে চা পানের অব্যেস দেসায়েবের। ভীষণ ধীর স্থির ভাবে সব কাজ করেন দেসায়েব। এমনকি চোখের পাতা ফেলতেও বেশ সময় নেন তিনি। প্রতিটি কথা মুখ থেকে নামানোর আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরখ করে নেন। মন্টুকে নিরুত্তর দেখে আবার বললেন, যাক এতদিনে তুই মানুষ হলি বলতে হবে

কেন, এর আগে কী সিলাম, গাড়ল?

মন্টুর এ হেন ঝাঁঝালো প্রশ্নে দেসায়েবের মতো না-চমকানো লোকও একটু থমকে গেলেন। চা পান থামিয়ে চোখ তুলে বললেন, কী ব্যাপারটা রে, আজ তোরও মেজাজ মনে হচ্ছে চড়া? কী হয়েছে কি?

ঘাপলা যদি করতি পারতুন তো, আজ এই অপমানটা সহ্যি করতি হত না। আমি গাড়ল কিনা, সকলে তাই শুনায় ঘুরায়ে ফিরায়ে...। 

দেসায়েব মৃদু হাসলেন, বললেন, অ্যাই, আমার কাছে ঝাল ঝাড়ছিস কেন, যদি ক্ষমতা থাকে যে বলেছে তাকে বলগে, যা...। সেখানে তো মেনিমুখো।   

দেসায়েব নির্ঝঞ্ঝাটে মানুষ, সাতে পাঁচে থাকেন না। থাকার উপায়ও নেই। কারণ এই অফিসে আজকাল তাঁকে আর প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন ভাল কাজ করার সুবাদে, আজও তাঁকে পোষা হচ্ছে নিছক চক্ষুলজ্জার খাতিরে। যে কোনদিন অফিস বলতেই পারে দরজা খোলা আছে, হে, কেটে পড়, ফুল অ্যান্ড ফাইন্যাল নিয়ে। তাঁর যা এলেম এই শেষ বয়সে অন্য কোথাও আর কিছু হবারও নয়।

অফিসে এই দেসায়েবের সঙ্গেই মন্টুর যা দুচারটে মনের কথা হয়। সেই অধিকারেই মন্টু একটু ঝাঁজ দেখিয়ে ফেলেছিল। দেসায়েবের কথায় একটু লজ্জা পেল।

সকাল থিকে আমারে লিয়ে যা চলতিসে...

সেটাই তো জিগ্যেস করছি, কী হয়েছে কি?

মন্টু সব কথাই সবিস্তারে বলল দেসায়েবকে। বলে আর কিছু না হোক হাল্কা হল মনে মনে। সব শুনে টুনে দেসায়েব বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকলেন। মন্টু একটু অপেক্ষা করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সোয়া এগারোটা বেজে গেছে, আরেক রাউন্ড চা না পেলে আবার হাল্লা শুরু করবে। অফিসের লোকগুলোর দশা দেখে মনে হয়, চা নয় যেন বেঁচে থাকার দাওয়াই নিচ্ছে। না পেলে হেদিয়ে টেঁশে যাবে।

সকলের চা সাপ্লাই করে মন্টু দেসায়েবের জন্যে এক কাপ বিনা চিনি কফি নিয়ে ঢুকল। বড় সায়েবদের জন্যে কফি রাখা থাকে। কখনো সখনো সায়েবরা খায়, আর সরকারবাবু আর দেসায়েবের ইচ্ছে হলে। বাকি কেউ অ্যালাউড নয়।

তখন চাটা রাগের মাথায় বানাইসিলাম, ঠিক হয় নি হবে। এখন এট্টু কফি খান, স্যার। আর বলেন দিকি গাড়ল কথাটা কি - কোন গালাগাল? খুব খারাপ কিছু - নাকি মোটামুটি

কফিতে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে দেসায়েব বললেন, মানে জেনে কী করবি? ধর আমি বললাম গাড়ল মানে খুব খারাপ কিছু। কী করবি? মন্টুর দিকে তাকিয়ে দেসায়েব প্রশ্নটা করলেন। 

মন্টু ইতস্ততঃ করে বলল, তা, সত্যি বটে। কিছুই করতে পারব নি। শুনেও চুপচাপ হজম করতিই হবে। মানেটা সত্যি কি বেজায় খারাপ, স্যার?

না, না, তা নয়। গাড়ল মানে হচ্ছে ভেড়া। তার মানে বোকাসোকা, নিরীহ, ভিড়ের মধ্যে একাকার। আলাদা করে চেনা যায় না। একদম সাধারণ। কিছু বুঝলি? আমরা সবাই। তুই, আমি, এ অফিসে, অটোতে, বাসে, ট্রেনে। রাস্তাঘাটে, চলার পথে। আমরা সবাই সাধারণ। আমরা সকলেই একে অন্যকে নিজের ধান্দা মত, সুবিধে মত গাড়ল বানাই, আবার নিজেরাও প্রায়ই গাড়ল হই। আর অন্য কাউকে গাড়ল ভাবতে পারলে বা বলার সুযোগ পেলে, খুব খুশি হয়ে ভাবি – যাক আমি অন্ততঃ ওর চেয়ে একটু কম গাড়ল। ওইটুকুই তখন আমাদের সান্ত্বনা”।

দে সায়েব কথা থামিয়ে একটু আনমনা তাকিয়ে রইলেন কফির কাপের দিকে, তারপর কফির কাপটা শেষ করে মন্টুর হাতে খালি কাপ প্লেট ফিরিয়ে দিতে দিতে আবার বললেন, মাঝে মাঝেই নেকড়ের পাল ভেড়ার পালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারা শিকার তুলে নিয়ে পগার পার হয়। যারা বেঁচে যায়, তারা নিজেদেরকে মনে করে খুব চালাক, আর শিকার হয়ে যাওয়া ভেড়াগুলোকে তারা ভাবে – এক নম্বরের গাড়ল। এই নেকড়েগুলো হচ্ছে ধর অফিসের বড়োবাবু, বস, পাড়ার দাদা, প্রমোটার, পুলিশ, নেতা, মন্ত্রী; যে কেউ হতে পারে”।   

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে দেসায়েব আবারও বললেন, “মানে তো বললাম, কি কদ্দূর বুঝলি, তুইই জানিস। মানেটা জেনেই বা তোর কটা হাত পা গজাল, আর কী করবি কে জানে...

আজ্ঞে, কী আর করব সত্যি। ওদিকে যাই গিয়ে সকলের এঁটো কাপপ্লেটগুলো নে এসে ধুই গিয়ে...আর আপনের জন্যি আজ কি টিপিন আনব বলে দেন ... মুড়ি-বাদাম? না চিঁড়ে-বাদাম? ওদিকে আবার সায়েবরা কি বলে দেকি

-০০-       


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/৪

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের তৃতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/৩ " তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ পর্বাং...