এই উপন্যাসের প্রথম পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্র থেকে - "এক যে ছিলেন রাজা - ১ম পর্ব"
[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে পড়া যায়, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাভক্ত ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগর ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। ভাগবৎ-পুরাণে মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়গুলিতে), তার বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ করাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য।]
৩
রাজার ওই ঘোষণাতে অত্যন্ত বিচলিত হলেও গতকাল হাট থেকে
ফিরতে ফিরতে একটু সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে, আচার্য বেদব্রত তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু
আচার্য ধর্মধরের বাড়ি যাননি। আজ আচার্য ধর্মধরের বাড়িতে গিয়ে যখন উপস্থিত হলেন,
আকাশে আলো ফুটলেও, সূর্যোদয়ের একটু বিলম্ব ছিল। বাঁশের আগল খুলে আচার্য ধর্মধরের
অঙ্গনে পা দিয়েই দেখলেন ধর্মধর শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে নিমের দাঁতন করছেন। শিশুর
অব্যক্ত স্বরের বক্তব্য বোঝা না গেলেও, আচার্য ধর্মধর তার সঙ্গে এই ভোরের নির্মল
আকাশ, শীতল বাতাস, আধফোটা আলো, জাগ্রত পক্ষিকুল নিয়ে ভাবগম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত। এই
অসময়ে বেদব্রতকে দেখে ধর্মধর একটু অবাক হলেন, বুঝলেন অত্যন্ত জরুরি কিছু বিষয় আছে।
ইশারায় বেদব্রতকে বললেন, আসন নিয়ে দাওয়ায় উঠে বসতে, তারপর বাড়ির অন্দরে গেলেন
শিশুপুত্রকে নিয়ে।
তিনধাপ সিঁড়ি বেয়ে মাটির দাওয়ায় উঠে, বেদব্রত আড়া থেকে দুটি
আসন পাড়লেন। তাঁর আচরণে বোঝা যায়, এই গৃহে তাঁর নিত্য যাতায়াত আছে। দাওয়াতে
সামনাসামনি দুটি আসন পেতে একটিতে বসলেন বেদব্রত, তারপর অপেক্ষা করতে লাগলেন বন্ধু
ধর্মধরের জন্যে। দাওয়ায় বসে ডানদিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে লাগলেন পরিষ্কার নিকোনো
অঙ্গনের সীমানায় ফুল গাছের সারি। ভোরের স্নিগ্ধ আলোর স্পর্শে সদ্যফোটা অজস্র ফুলের
রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে সমস্ত অঙ্গন। সেই অঙ্গনের
মাঝখানে ছোট্ট মন্দিরের চূড়ায় পূত তুলসীগাছটি এই গৃহে মঙ্গলের সঞ্চার করছে। এই গৃহের
প্রতিটি কোণায় গৃহিণীর কল্যাণী হাতের ছোঁয়া স্পষ্ট উপলব্ধি করলেন বেদব্রত। বেদব্রত
মগ্ন হয়ে দেখতে লাগলেন, পূব আকাশটাকে রঙের প্লাবনে ভাসিয়ে সূর্যদেবের উদয়।
“কী ব্যাপার, বেদ, এত সকাল সকাল? কোন বিপদআপদ নয় তো?”
ধর্মধরের প্রশ্নে বেদব্রত ফিরে তাকালেন, বললেন, “না, না, যে বিপদের আশংকা তুমি
করছো, তেমন কিছু নয়। এ অন্য বিপদ, বোসো, বলছি”। ধর্মধর সামনের বিছানো আসনে বসলেন।
কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন বেদব্রতর মুখের দিকে।
বেদব্রত বললেন, “কালকে হাটে গেছিলাম”।
“সে তো তুমি কাল যাওয়ার সময় বলেই গেলে। আমাদের কিছু আনতে
হবে কিনা, তুমি তাও জিজ্ঞাসা করেছিলে। কিন্তু...”
“সেখানে মহারাজ বেণের একটি ঘোষণা শুনলাম। এই ঘোষণা শোনা
অব্দি আমি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি। বলতে পারো কাল প্রায় সারারাত আমার ঘুম
হয়নি”।
“কি এমন ঘোষণা, বেদ, তোমার রাতের ঘুম কেড়ে নিল?” এবার
ধর্মধরের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর।
ধীমান বেদব্রত গতকাল শোনা সেই ঘোষণার হুবহু পুনরাবৃত্তি
করলেন, ঘোষণার একটি বর্ণও তিনি ভুলে যাননি। ঘোষণাটি শুনে ধর্মধর বললেন, “কী বলছো,
বেদব্রত? আমাদের এতদিনের চর্চিত বেদমন্ত্র, যজ্ঞবিধান সমস্ত ত্যাগ করে, এখন শুধু
মহারাজা বেণের জন্যে স্তোত্রমন্ত্র রচনা করতে হবে? এতদিন পরম ঈশ্বরের আলোচনায়,
ভজনায় এবং যজ্ঞে আমরা ঋদ্ধ হয়েছি। সে
সমস্ত বৃথা হয়ে যাবে অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী এক রাজার দম্ভে!”
“তাই কি হতে পারে, ধর্ম? যত বড়ো শক্তিশালী রাজাই হোন না
কেন, আমাদের সনাতন ধর্মের বিনাশ তাঁর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। আমাদের জন্যে ভাবছি
না, ধর্ম। আমি ভাবছি, এই রাজার অত্যাচারে এবং অবিচারে ভেঙে পড়বে সাধারণ মানুষের
মনোবল আর বিশ্বাস। সমাজের কাছে সে হবে এক সাংঘাতিক অভিশাপ”।
দুই বন্ধু চুপ করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। দাওয়া থেকে বসে
দুজনেই তাকিয়ে রইলেন উদিত বালার্কের দিকে। একসময়
দুজনেই অস্ফুট উচ্চারণে বললেন, “জবাফুলের মতো বর্ণময়, হে মহাদীপ্ত কশ্যপপুত্র,
সর্ব কলূষহারী হে দিবাকর, তোমাকে প্রণাম করি”। কিন্তু
এই স্তোত্র মহারাজ বেণের স্তব নয়, অতএব জ্ঞানতঃ তাঁরা দুজনেই মহারাজ বেণের অসম্মান
করে, শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেন!
দুটি ছোট মাটির পাত্রে কবোষ্ণ জলে সামান্য মধু ও কিছুটা
লেবুর রস মেশানো পানীয় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ধর্মধরের পত্নী শান্তশ্রী। সকাল
সকাল দুই বন্ধুকে মুখোমুখি চুপ করে বসে থাকতে দেখে শান্তশ্রী বিস্মিত হলেন। এই দুই
বন্ধুর সখ্যতা তিনি উপভোগ করেন। এই সংসারে আসার পর থেকেই তিনি অনুভব করেছেন আচার্য
বেদব্রত তাঁর প্রিয় অগ্রজের মতোই শুভাকাঙ্ক্ষী। দুজনের এই বিষণ্ণ বসে থাকায় তিনি
বিশেষ উদ্বিগ্ন হলেন। দুজনের হাতে পাত্র দুটি তুলে দিতে দিতে বললেন, “বেদদাদা, তোমাকে
চিন্তিত দেখছি, বাড়িতে সকলে ভালো আছেন তো? এই প্রচণ্ড গ্রীষ্মে তোমার ছেলেমেয়েরা কেউ
অসুস্থ হয়নি তো? সুমেধাদিদি ভালো আছেন তো”?
আচার্য বেদব্রত মুখ তুলে শান্তশ্রীর দিকে তাকালেন, মৃদু
হেসে বললেন, “সবাই কুশলে আছেন। কিন্তু তুমি কী জানো, শান্তাবোন, আমরা দুজনে এই
মাত্র কঠোর শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ করে ফেললাম”?
“কী বলছো, বেদদাদা। শাস্তিযোগ্য অপরাধ? সুন্দর এই সকালে,
প্রিয় সখার গৃহের দাওয়ায় শান্তভাবে বসে কী অপরাধ করে ফেললে, তোমরা”? দুজনের মুখের
দিকে ব্যাকুল চোখে তাকালেন শান্তশ্রী। পতি ধর্মধরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “খুলে বলো,
আর্যপুত্র, কী হয়েছে”?
আচার্য ধর্মধর বললেন, “আমরা দুজনেই ওই উদিত সূর্যের দিকে
তাকিয়ে সূর্যের প্রণাম-মন্ত্র উচ্চারণ করেছি”। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর,
হাসতে হাসতে স্বামী ধর্মধরের পাশে বসে পড়লেন শান্তশ্রী। হাসির বেগ কমলে বললেন, “এ
নিশ্চয়ই বেদদাদার বুদ্ধি। সকাল সকাল দুজনে মিলে আমার সঙ্গে তোমরা কৌতুক করছো? ওফ,
তোমাদের মুখ দেখে আমি এতটুকুও অনুমান করতে পারিনি, তোমাদের এই অভিনয়...” কথা বলতে
বলতে থেমে গেলেন শান্তশ্রী, কারণ এতক্ষণে তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁর হাসিতে ওঁরা
কেউই যোগ দেননি। দুজনের মুখই আগের মতো বিষণ্ণ। শান্তশ্রী এবার অশুভ কোন ইঙ্গিত
পেলেন, বললেন, “কী হয়েছে, বেদদাদা? সকাল সকাল কী সংবাদ নিয়ে এসেছো, তুমি?”
গতকাল হাটে শোনা রাজার নির্দেশের কথা বলে, বেদব্রত
বললেন, “এখন থেকে যা কিছু পুজো, মন্ত্রের উচ্চারণ সব হবে শুধুমাত্র রাজা বেণের জন্য।
তোমার অঙ্গনের ওই তুলসীমন্দির ভেঙে ফেলতে হবে। ওখানে গড়তে হবে মহারাজ বেণের
মূর্তি। তোমার গৃহের মঙ্গলাসনে অধিষ্ঠিত ভগবান বিষ্ণুকে আজ এখনই ত্যাগ করতে হবে,
সেই আসনে বসাতে হবে মহারাজ বেণকে।”
চমকে উঠলেন শান্তশ্রী, আর্ত কণ্ঠে বললেন, “এই সুন্দর
প্রভাতে এই ভয়ংকর অমঙ্গলের কথা উচ্চারণ করতে তোমার বুক কাঁপল না, বেদদাদা?” শান্তশ্রীর
কথার অনেকক্ষণ কেউ উত্তর দিলেন না, বেশ কিছুক্ষণ পর ধর্মধর বললেন, “এখন থেকে আমাদের
শিষ্যদের শেখাতে হবে মহারাজা বেণের মহিমা স্তোত্র এবং তাঁর মহান্ জীবনীগাথা। অধ্যাপক
হিসেবে মহারাজা বেণকে আদর্শ পুরুষ করে গড়ে তুলতে হবে আমাদের, আগামী প্রজন্মের
সামনে”।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বললেন না। কিছুক্ষণ পর উচ্ছিষ্ট
মাটির পাত্র দুটি তুলে নিয়ে শান্তশ্রী ধীর পায়ে, ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। তাঁর চলার
দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচার্য বেদব্রত, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কী করা যায়
বলতো, ধর্মধর? আমাদের প্রত্যেক ঘরে শান্তশ্রীর মতো এমনই কল্যাণী নারীরা, স্বামী,
পুত্র সংসারের মঙ্গলের জন্যে ভগবান বিষ্ণু অথবা দেবাদিদেব মহাদেবের বিগ্রহে নিশ্চিন্ত
ভরসা রাখেন। তাঁদের
হঠাৎ যদি আজ বলা হয়, ঐসব বিগ্রহ ফেলে দিয়ে রাজা বেণের বিগ্রহ পুজো করো, কী ঘটবে
ভাবতে পারছো”?
“এর একটা বিহিত দরকার, বেদ। এতদিন মহারাজা বেণের অনেক
অত্যাচার, অনাচারের কথা শুনেছি, কিন্তু এই নির্দেশ সমস্ত সীমাই লঙ্ঘন করেছে। এত
অনাচার অসহ্য, বেদ। প্রয়োজন হলে, বিদ্রোহ করতে হবে। লড়াই করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি
সম্ভব এই রাজার পরিবর্তন চাই।”
“ঠিক কথা, ধর্ম। এই
রাজার পতন চাই। কিন্তু চাই বললেই তো বদল হবে না। উত্তেজিত হয়ে বাইরের লোকের কাছে
একথা আর বলো না, ধর্ম। এ রাজা অত্যাচারী, দাম্ভিক। এ রাজা শিক্ষিতজনের সম্মান বোঝে
না”।
“কী বলতে চাইছো, তুমি? আমরা হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে
থাকবো? ধর্মপথ ছেড়ে আমরা অধর্মের সহচর হবো? এভাবে আপস করে বাঁচার কোন অর্থ হয়,
বেদ?”
“পতঙ্গ আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিলে অগ্নির কোন ক্ষতি হয় না, কিন্তু অকারণ দগ্ধ হয়ে মরে পতঙ্গ। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু একলা তুমি আর আমি নই, সকলে মিলে, সমবেতভাবে। আমাদের সকলের এখন গুরুদেব ভৃগুর কাছে যাওয়া উচিৎ, সঠিক পথের সন্ধান তিনিই দিতে পারবেন। আমার বিশ্বাস হয় না, এই ঘোষণায় তাঁর থেকে বেশি বিচলিত আর কেউ হতে পারেন। কারণ পরোক্ষ হলেও, আজকের এই পরিস্থিতির জন্যে তিনি এবং আমরাও কিছুটা দায়ী”!
এই সময়ে আচার্য ধর্মধরের গৃহ প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল জনা
পনের বালক। তারা
সকলেই আচার্য বেদব্রতকেও চেনে। তারা একসঙ্গে প্রণত হয়ে বলল, “প্রণাম, আচার্য
ধর্মধর, প্রণাম আচার্য বেদব্রত”।
বালকদের প্রণাম স্বীকার করে, আচার্য বেদব্রত বললেন, “তোমাদের
সকলের কল্যাণ হোক, বৎস। এখন কিছুদিনের জন্যে আশ্রমের সকল পাঠ স্থগিত থাকবে। তোমরা নিজ
নিজ গৃহে ফিরে যাও। পিতামাতাকে বলো, দুশ্চিন্তা না করতে। আচার্য ধর্মধর ঠিক সময়মতো
তোমাদের কর্তব্য নির্দেশ করবেন”।
একজন কৌতূহলী বালক জিজ্ঞাসা করল, “কাল সন্ধ্যায় আমার
পিতার এক মিত্র আমার পিতাকে যে সংবাদ দিয়েছিলেন, তা উনি বিশ্বাস করেননি। বলেছিলেন অপপ্রচার,
এমনটা হতেই পারে না। সে সংবাদ কী তবে সত্য, গুরুদেব”? দাওয়া থেকে নেমে বেদব্রত
এগিয়ে গেলেন সেই বালকের দিকে। তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “সে সংবাদ সত্য, কিন্তু
তোমাদের মতো বালকের, এ আলোচনা উচিৎ নয়, বৎস। বাড়ি গিয়ে পিতামাতাকে যা সত্য তাই
বলবে”। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের ছুটি পেতে ভালো লাগে না? তোমাদের
বয়সে এমন হঠাৎ পাওয়া ছুটিতে আমার তো দারুণ আনন্দ হত”।
সকল বালকের মুখে সরল হাসি দেখে, আচার্য বেদব্রতও হাসলেন,
বললেন, “বর্ষার সময় কিংবা তীব্র শীতের সময় তোমাদের যেমন মাসাধিক কাল পাঠ বন্ধ
থাকে, ধরে নাও না, এটাও সেরকম আর একটা দীর্ঘ ছুটি”। বালকের দল এবার কোলাহল করে উঠল
আনন্দে। আচার্যদের বিদায়ী প্রণাম করার কথা ভুলে, তারা পিছন ফিরে দৌড় লাগাল পথ ধরে। আচার্য বেদব্রত হাসি মুখে দেখলেন,
ওদের দৌড়ে চলে যাওয়া, ওদের আনন্দ উচ্ছ্বাস।
তারপর পিছন ফিরে বললেন, “উড়নিটা গায়ে দিয়ে নাও, ধর্ম।
চলো গুরুদেব যজ্ঞশীলের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। উনি কী ভাবছেন, কী করছেন জানা
দরকার”।
“তোমার বার্তা শোনার পর থেকে কিছুই ভালো লাগছে না, বেদ।
তাই চলো। ঘরে বসে থাকলে আরো দুশ্চিন্তা বাড়বে। একটু দাঁড়াও, এই ফাঁকে শ্রীনারায়ণের
পায়ে একটু পুষ্প-বারি দিয়ে আসি”।
আচার্য বেদব্রত ম্লান হেসে বললেন, “যাও, ধর্ম, আরেকটি রাষ্ট্রবিরুদ্ধ
কাজ সম্পন্ন করে এসো”।
৪
আচার্য বেদব্রত ও ধর্মধর যখন আচার্য যজ্ঞশীলের গৃহে
পৌঁছলেন, সূর্য তখন প্রায় মধ্যগগনে। তাঁদের ডাক শুনে দরজায় এসে দাঁড়াল, আচার্য
যজ্ঞশীলের দ্বিতীয়া কন্যা কিশোরী চারুকান্তি। ওঁদের দেখে চারুকান্তি উচ্ছ্বসিত হতে
গিয়েও, সংযত হয়ে গেল, মুখে সলজ্জ একটু হাসি নিয়ে বলল, “কতদিন পরে তোমরা এলে, খুল্লতাত?
বেদকাকা তো আমাদের ভুলেই গেছে, ধর্মকাকা তাও কয়েক মাস আগে একবার এসেছিলে। গৃহে সকলের কুশল তো”? এই বলে দুজনেরই
চরণস্পর্শ করে প্রণাম করল চারুকান্তি।
বেদব্রত বললেন, “আয়ুষ্মতি হ, চিরকল্যাণী হ, আমাদের সব
কুশল। তোরাও সকলে ভালো আছিস তো, মা”?
ধর্মধরও আশীর্বাদ করলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “তোর পিতা
কোথায়, মা”?
“পিতা, একটু আগে পাঠগৃহের দিকে গেলেন, ওখানেই আছেন”।
“ওখানে পাঠ চলছে নাকি”? ধর্মধর উদ্বিগ্নস্বরে জিজ্ঞাসা
করলেন।
“না, না। কিছুদিনের জন্যে আশ্রমের পাঠ স্থগিত আছে। তোমরা
যাও, পিতা তোমাদের সব কথা বলবেন”। লাজুক হেসে চোখ নামাল কিশোরী চারুকান্তি।
গৃহসীমার অন্য প্রান্তে আচার্য যজ্ঞশীলের পাঠগৃহ।
বাসস্থান ও পাঠগৃহের মধ্যে বাঁশের বেড়া দেওয়া সীমানা। আশ্রমের বেড়ার দরজার আগল
খুলে ঢোকার সময় ধর্মধর বললেন, “গুরুদেব যজ্ঞশীল, আমাদের মতোই আশ্রমের পাঠ বন্ধ
রেখেছেন?”
“না ধর্মধর, আমার মনে হয়, কারণ অন্য। আমার অনুমান,
কুমারী চারুকান্তির বিবাহ উপলক্ষে আশ্রমের পঠনপাঠন গুরুদেব আগে থেকেই স্থগিত
রেখেছিলেন”।
বেদব্রতর দিকে অবাক হয়ে তাকালেন।
“শাস্ত্রচর্চা করতে করতে তুমি আর অন্য কোনদিকে দৃষ্টি
দাও না। চঞ্চলা
চারুকান্তির সলজ্জ আচরণ তোমার চোখ এড়িয়ে গেল, ধর্ম? বিবাহযোগ্যা কিশোরী অকারণ
লজ্জা পায়, যখন পিতৃগৃহে তার বিবাহের আয়োজন চলতে থাকে। আসন্ন নতুন জীবনের প্রতি
তীব্র আকর্ষণ, পাছে অপরের কাছে ধরা পড়ে যায়! তাই অকারণ লজ্জা আসে, তখন অতিরিক্ত সংযমের
আশ্রয় নিতে হয়। সত্য কিনা জানি না, তবে চারুকান্তির আচরণে আমার সেরকমই মনে হল। এখন
গুরুদেব যজ্ঞশীলের কাছে সব সংবাদ পাওয়া যাবে। ওই তো, আচার্য যজ্ঞশীল পাঠঘরে বসে রয়েছেন”।
আচার্য যজ্ঞশীলকে প্রণাম করে, বেদব্রত ও ধর্মধর বসলেন
তাঁর সামনের আসনে। আশীর্বাদ করে আচার্য যজ্ঞশীল বললেন, “গতকাল সকালেই গুরুদেব
ভৃগুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এলাম। ইচ্ছা ছিল, আজ তোমাদের ওদিকেই যাবো। কিন্তু আজ সকাল
থেকে যা সংবাদ পাচ্ছি, তাতে সব স্থগিত করতে হলো। তোমরা কোন সংবাদ পাওনি”?
আচার্য বেদব্রত বললেন, “পেয়েছি গুরুদেব, আর সেই কারণেই
আপনার কাছে আসা। আমাদের আশ্রমে ছুটি ঘোষণা করেছি, বলেছি দীর্ঘ দিনের জন্য পাঠ
স্থগিত”।
“ঠিক করেছ, বেদ। আজ সকালে শুনলাম, কিঞ্চিৎ দূরবর্তী
গ্রামের দুই পাঠশালায় পাঠ চলছিল, চার পাঁচজন নগররক্ষী এসে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে
তাদের পাঠঘর। এক আচার্যকে প্রহার করেছে মারাত্মক, অন্য আচার্যকে বন্দী করে নিয়ে
গিয়েছে কোটালের কাছে। আমার আশ্রমে একমাসের পাঠ স্থগিত রেখেছিলাম আমার দ্বিতীয়া
কন্যা চারুর বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য। না হলে আমার উপরেও হামলা হতো। আজকের এই
অকস্মাৎ ঘটনায় সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে গেছি, এখন কোনটা কর্তব্য কোনটা অকর্তব্য
কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছি না। মাত্র নয় দিবস পরেই চারুর বিবাহ উপলক্ষে গৃহে অতিথি
সমাগম শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু, বাড়িতে কিছু বলিনি এখনও। এই বিবাহ এখন কি আর সম্ভব”?
আচার্য ধর্মধর জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন সম্ভব নয়, গুরুদেব? আমাদের
গৃহে কন্যার বিবাহে রাজার কী ভূমিকা থাকতে পারে?”
উত্তরে বেদব্রত চিন্তিত মুখে বললেন, “রাজার ভূমিকা নয়,
ধর্ম। ভূমিকা ভগবান শ্রীনারায়ণের আর অগ্নিদেবতার। আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন
হয় এই দুই ঈশ্বরের মঙ্গল আশীর্বাদে। গৃহীর ঘরে কন্যাদান ও কন্যার বিবাহ অনুষ্ঠান
অত্যন্ত তাৎপর্যময় একটি মাংগলিক অনুষ্ঠান। এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কন্যার
বিবাহ অনুষ্ঠান করতে হবে মহারাজ বেণের বিগ্রহের সামনে, ব্যাপারটা তুমি কল্পনা করতে
পারছো, ধর্ম? আমি পারছি আর আতঙ্কে শিউরে উঠছি”। আচার্য ধর্মধর এতক্ষণে যেন বুঝতে
পারলেন, ঘটনার গুরুত্ব, নির্বাক বসে রইলেন।
ম্লান হেসে আচার্য যজ্ঞশীল জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার
কন্যার কত বয়স হল, বেদ? তুমি কী কন্যার বিরহ বেদনা এখন থেকেই কল্পনায় উপলব্ধি করছো”?
সলজ্জ হেসে বেদব্রত বললেন, “আজ্ঞে গুরুদেব, মাত্র তিন
বৎসর। কিন্তু এই উপলব্ধি আমার হয়েছিল, আমার কন্যাকে প্রথম ক্রোড়ে নিয়েই! নিষ্পাপ
দুই নয়নের সেই অসহায় নির্ভরতা, মুখের সেই স্বর্গীয় হাসি আর আমার বক্ষে তার চঞ্চল
ক্ষুদ্র দুই পায়ের পদাঘাত, আমাকে এই উপলব্ধি এনে দিয়েছিল, গুরুদেব। সেই প্রাণপ্রিয়
কন্যাকে আমি সম্প্রদান করবো, রাজা বেণের বিগ্রহকে সাক্ষী মেনে? আপনার কন্যা সুশীলা
চারুকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, এ অন্যায়। এ পাপ”।
আচার্য বেদব্রতর এই আবেগে সকলেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, আচার্য যজ্ঞশীল জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কী মত, বৎস
বেদব্রত? আমার চারুর বিবাহ কি তবে স্থগিত রাখব? কিন্তু বরপক্ষ যদি স্বীকার না করে”?
“আপনার বৈবাহিক কে, আমি জানি না, গুরুদেব। কিন্তু তিনিও কী
চাইবেন, তাঁর গৃহলক্ষ্মীকে এই অমঙ্গল অনুষ্ঠানের মধ্যে বরণ করে নিতে?”
“তিনি এই রাজ্যের অধিবাসী নন, তবে তোমরাও তাঁকে চেন।
তিনি পশ্চিমে সৌরাষ্ট্রের একটি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, নাম তপোব্রত। মহর্ষি ভৃগুর
শিষ্য। আমাদের থেকে বেশ কয়েক বছরের অগ্রজ। গতবার গুরুদেবের আশ্রমে সমাবর্তনের সময়,
তিনি আমার চারুকে দেখে পুত্রবধূ করার প্রস্তাব করেন। তাঁর পুত্র, কল্যাণীয়
সৌম্যব্রতও পিতার মহাবিদ্যালয়েই অধ্যাপক হিসাবে সদ্য যোগ দিয়েছে। সেও উপস্থিত ছিল
ঐ সমাবর্তনে। চারুর এই সৌভাগ্যের সংবাদ আমি গুরুদেবকেও বলেছিলাম। তিনি সানন্দেই এই
সম্পর্কের অনুমোদন দিয়েছিলেন”।
“আমার মনে হয় গুরুদেব, কোনরকম সিদ্ধান্তের আগে, আমাদের
সকলের একবার গুরুদেব ভৃগুর সঙ্গে দেখা করা উচিৎ। আজ আর সম্ভব নয়, কিন্তু কাল
প্রত্যূষে নিশ্চিত”।
“ঠিকই বলেছ, বেদব্রত, দ্বিপ্রহর অনেকক্ষণ অতিক্রান্ত। কাল
প্রত্যূষেই আমরা রওনা হবো”।
“কাল তোমরা কোথায় যাবে, বাবা”? কুমারী চারুকান্তি কখন
পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষ্যই করেননি। তাকে দেখে, তার কথায় সকলের মন থেকে
দুশ্চিন্তা কিঞ্চিৎ লঘু হয়ে গেল।
আচার্য বেদব্রত কপট বিষণ্ণ মুখে বললেন, “আমাদের ত্যাগ
করে দূরদেশে চলে যাচ্ছিস, মা? আমরা কি তোর এতই অনাত্মীয়”?
“আমি কী করবো, বলো, বেদকাকা, পিতাই তো সব স্থির করেছেন!”
“ও, তার মানে, এই বিবাহে তোর মনে এতটুকুও ইচ্ছা নেই”?
“বা রে, আমি বুঝি তাই বললাম? আমি জানি না, যাও”। লজ্জায়
চারুর দুই গালে রক্তিম আভা ফুটে উঠল। উপস্থিত সকলেই এমনকি পিতা যজ্ঞশীলও উচ্চস্বরে
হেসে উঠলেন কন্যার এই আচরণে। তাঁদের মনের মধ্যে জমে ওঠা বিষাদের বোঝা, এক পলকে সরে
গেল এই খুশীর আবহে।
অপ্রস্তুত চারুকান্তির অধরে এখনো লাজুক হাসি, সে লজ্জানত
চোখে বলল, “মা অন্ন বেড়ে বসে আছেন। বেলা গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। এক্ষুণি না গেলে মা কিন্তু
রণক্ষেত্র বাধাবেন। এই বলে দিলাম”।
আচার্য বেদব্রত তৎক্ষণাৎ আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন, বললেন, “ওরে
বাপরে, রাজার আদেশ অমান্য করলে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে, কিন্তু গৃহিণীর আদেশ
সর্বদা শিরোধার্য। যান গুরুদেব অন্দরে যান, ভোজন সেরে আসুন”।
বিস্মিত চারুকান্তি কটিতটে হাত রেখে বলল, “আর তোমরা?
তোমরা যাবে না বুঝি? মা তো তোমাদের জন্যেও অন্ন বেড়ে বসে আছেন”।
“আমাদের জন্যেও! চলো হে, ধর্ম, চলো। আজকের সকালটা ততটা
মন্দ শুরু হয় নি, কী বলো? মধ্যাহ্নে অন্নপূর্ণার প্রসাদ পাওয়ার ভাগ্য নিয়েই তো আমাদের
সেই সকালের শুরু”।
পিতা যজ্ঞশীলের হাত ধরে ঘরের দিকে এগিয়ে চলল চারুকান্তি। পিছনে চললেন বেদব্রত ও ধর্মধর।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন