জানালার পাল্লায় কাক বসলে মা ঠাকুমারা বরাবর যা
করেন, সেদিন আমিও তাই করতে গেলাম, বললাম, হুস, হুস। কাকটা চোখ মটকে মুখ ঘোরাল,
উড়েও গেল না, ভয়ও পেল না। এবার আমি যেমনি হাত বাড়িয়ে আবার হুস হুস বলতে যাবো,
কাকটা এক আঙুল তুলে বলে উঠল, “অ্যাই, অ্যাই, চুপ, একদম চুপ, কাক-এ ভয় দেখাচ্ছ
কাকে? তোমার মা-ঠাম্মা হুস বললে, আমরা উড়ে যাই ঠিকই, কিন্তু ভয়ে নয়, ওঁরা গুরুজন,
ওঁদের মান্যি করেই উড়ে যাই। তাছাড়া তুমি কাকতাড়ুয়াও তো নও, যে তোমাকে ভয় পেতে হবে।
সবে তো ক্লাস থ্রিতে পড়ো, নেহাতই পুঁচকে ছেলে, তুমি হুস বললেই উড়ে যাবো, এমনটা
মনেও করো না। আমরা দুবার ডাকলে তোমাদের কাকা হয়, হয় না? তার মানে আমরাও কি তোমার
একধরনের কাকা হই না? এটুকু কৃতজ্ঞতা তোমার থেকে আমরা আশা করতেই পারি, নয় কি?”
কাকের কথায় আমার খুব রাগ হল, আচ্ছা করে দুকথা
শুনিয়ে দেবার জন্যে বললাম, “যতো বড়ো ঠোঁট নয় তোমার, তত বড়ো কথা? তুমি আমার কাকা হবে?
আমার কাকা আমাকে কত ভালোবাসে, জানো? কত লেখাপড়া জানে, জানো?”
কাকটা খা খা হেসে উঠল, বলল, “তোমার কাকা তোমার
পেছনে লাগে না? বলে না, ক্লাস থ্রি খায় ব্রি? এরপর ক্লাস ফোর-জুতো চোর”?
আমি একটু থতমত খেলাম, এ কথাগুলো কাকটা জানল কী
করে? বললাম, “তাতে কি? সে তো মজা করে বলে, সে কি সত্যি নাকি? কিন্তু তুমি কী করে
সে কথা জানলে”?
কাকটা ঘাড় দুলিয়ে বেজায় বোদ্ধার মতো ঘাড় চুলকোল,
তারপর গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি কী ভেবেছিলে, তোমাদের কাকা-ভাইপোর কথা কাকপক্ষীতেও
টের পাবে না! হেঃ, তোমরা নিজেদের বিশাল বুদ্ধিমান আর আমাদের এত তুচ্ছ ভাবো বলেই
তোমাদের এই দশা। আচ্ছা কলসির তলানি জল খাবার উপায় তোমাদের কে শিখিয়েছিল? সেই যে
সেই কাকের গল্পটা, পড়োনি”?
গল্পটা পড়েছি বৈকি, আর সেই কাকের কথা মনে করে আমি
বেশ একটু দমে গেলাম, বললাম, “তাতে কী, অমন বুদ্ধির গল্প তোমাদের থেকে শেয়ালদের
অনেক বেশি, শেয়ালের গল্পও অনেক পড়েছি”।
কাকটা খা খা করে হেসে বলল, “যাক, কাক আর শেয়ালের
বুদ্ধি যে তোমাদের থেকে কম নয়, সেটা নিজে নিজেই স্বীকার করে ভালোই করলে। আমাকে
বেশি বকতে হল না। আচ্ছা, ইংরিজি পড়ো তো, কাকের ইংরিজি জানো?”
আমি ফুঃ করে মুখে একটা শব্দ করে বললাম, “এ আর এমন
কি শক্ত, ক্রো মানে কাক”।
কাকটা আমার বাহাদুরিকে গুরুত্বই দিল না, বলল, “ক্রমে
ক্রমে সব বুঝতে পারবে যে আমরা কাকেরা তোমাদের সব দিক খেকেই ঘিরে রেখেছি। ক্রমের
মধ্যেও ক্রো মানে আমরাই রয়েছি, হে হে, এটা কি লক্ষ্য করলে? বিক্রম, পরাক্রম,
আক্রমণ, মন দিয়ে দেখ এ সবের একদম মাঝখানে রয়েছি আমরাই। ক্রমাগত মানে কাকের মা
এসেছেন, একথাটা তোমরা মানবে না জানি, কিন্তু আমার সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে যে ঘোল
খেয়ে যাবে, সেটাও বলে রাখছি, কারণ তক্র মানে ঘোল। ব্যাঁকা কথায় মানুষদের সঙ্গে পেরে
ওঠা শক্ত, তাই তোমাদের কোন বক্রোক্তিতেই আমরা কিছু মনে করি না। আমরা জলে বাস করি
না কিংবা কুমীরের সঙ্গে লড়াইও করিনা, কিন্তু তাও তোমরা কুমীরের নাম দিয়েছ নক্র।
তোমাদের মতিগতি বোঝা ভার।
আচ্ছা, একটা কথা বলতো, আমাদের ওপর তোমাদের এত
রাগ, আবার এই কাকদের নিয়েই তোমাদের নানান বায়নাক্কা। কাক ডাকলে গাছ থেকে তাল খসে
পড়ে, এমন আমি কোনদিন দেখিনি, কিন্তু কাকতালীয় ঘটনার নানান ঘনঘটা তোমরাই বানিয়ে
ছেড়েছ। তুমি এখনও ছোট্ট তোমার এখনও গজায়নি,
তোমার বাবা কাকার কিন্তু কাকপক্ষ আছে, তার মানে জানো, জুলফি! আমরা তো আর তোমাদের
মতো বিছানায় আরাম করে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোই না, আমরা ঘুমের মধ্যেও সতর্ক থাকি, তাকে
তোমরা বলো কাকনিদ্রা। কাকজ্যোৎস্না্র রাতে, তোমরা কত কি দেখে যে ভয় পাও, ভাবলে
আমরা হেসে কুটোপাটি হই। শীতকালে কনকনে ঠাণ্ডায় তোমরা যখন চানের ঘরে ফাঁকি দাও,
তোমার ঠাকুমা বলেন না, বালু কাকচান করে এলি? হে হে হে। তোমরা শহরের ছেলে বড় বড়
দীঘি দেখইনি, দীঘির পরিষ্কার স্বচ্ছ জলকে কাকচক্ষু বলে, তা জানো? নিমফলকে তোমরা
কাকফল বলো, আর বকফুলের গাছকে বলো কাকশীর্ষ। হে হে হে, তারপরেও তোমরা কাক তাড়াও?
ও হ্যাঁ আরেকটা কথা, কোনদিন কাকতাড়ুয়া দেখেছ?”
ক্রমান্বয়ে কাকের এত কথায় আমি বেশ দমে গিয়েছিলাম,
ঘাড় নেড়ে বললাম, না। তখন কাক বক্র হাসিমুখে আবার বলল, “শহরে তোমাদের মতো ছেলেরা
থাকতে কাকতাড়ুয়ার দরকার হয় না। সে সব দেখা যায় গ্রামের দিকে ক্ষেত-জমিতে। আর দেখা
যায়, তোমার কাকার ল্যাপটপে, কিংবা বাবার পি.সি.তে, দেখে নিও, পড়ে নিও। পি.সি. বলতে মনে পড়ল, কাকের ভাল নাম
বায়স, আর এই BIOS ছাড়া তোমাদের কম্পিউটারের সব
কারিকুরি খতম, হে হে হে, তোমার কাকাকে জিগ্যেস করে নিও, কথাটা বিশ্বাস না হলে। আর
পুরোনো দিনে দাদু ঠাকুমাদের জিগ্যেস করো, তখন সিনেমাকে বলতো বায়োস্কোপ, যদিও
বায়সদের সিনেমা হলে ঢোকার কোন স্কোপ তখনও ছিল না, আজও নেই।
যাকগে, যে কথা বলছিলাম, কাকতাড়ুয়া কিন্তু কাকদের
তাড়ানোর জন্যে নয়, বরং পুঁচকে পুঁচকে পাখিদের ভয় দেখানোর জন্যে, চড়াই, শালিক,
বুলবুলি, ঘুঘু, এইসব। ওরাই তোমাদের শস্যের দানা-বীজ খেয়ে ফেলে, ওদের তাড়ানোর জন্যে
কাকতাড়ুয়া খাড়া করা হয়। আমরা ক্ষেত-জমি, ফাঁকা জায়গার বড়ো একটা কাছ ঘেঁষি না,
কাজেই আমাদের কাকতাড়ুয়ার কেলে হাঁড়ি মাথায়, গোল্লা চোখমুখ দেখলে, হাসিই পায়, ভয়
পাওয়া তো কা কস্য পরিবেদনা। ক্রোমোজোমের ক্রমোন্নতিতে ক্রোম্যাগনন থেকে তোমরা হোমো
স্যাপিয়েন্স হয়েছ, একটু আধটু হোম-ওয়ার্ক করো, আমাদের দেখলেই হুস হুস করার আগে,
আমাদের who’s who ভালো করে জেনে নাও। হে হে হে”।
এরপর কাকটা আর বসল না, উড়ে গেল মাঠ পেরিয়ে গাছপালার দিকে।
-০০-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন