[এর আগের ৩য় পর্ব - কর্মযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে "গীতা - ৩য় পর্ব"]
চতুর্থ অধ্যায়ঃ জ্ঞানযোগ
|
৪/১ |
শ্রীভগবান বললেন – আমি এই অব্যর্থ মুক্তিদায়ক কর্মযোগের কথা সূর্যকে
বলেছিলাম। সূর্য তাঁর নিজের পুত্র মনুকে এবং মনু তাঁর পুত্র ইক্ষ্বাকুকেও এই কথা
শুনিয়েছিলেন। |
||
|
৪/২ |
হে বীর অর্জুন, এই ভাবেই এক প্রজন্ম থেকে অন্য
প্রজন্মে এই যোগের কথা রাজর্ষিগণ জানতে পেরেছিলেন। দীর্ঘ সময়ের প্রভাবে এখন সেই
যোগ এই জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। |
||
|
৪/৩ |
তুমি আমার ভক্ত ও প্রিয় বন্ধু, তাই আমি সেই প্রাচীন
কর্মযোগের কথা আজ তোমাকে বললাম। কারণ এই কর্মযোগ রহস্যময় হলেও খুবই কল্যাণকর। |
||
|
৪/৪ |
অর্জুন বললেন – তোমার জন্ম অনেক পরে আর সূর্যের জন্ম
তোমার অনেক আগে। কাজেই সৃষ্টির শুরুতে তুমি সূর্যকে কর্মযোগের কথা শুনিয়েছিলে,
তা কি করে জানব? |
||
|
৪/৫ |
শ্রীভগবান বললেন – হে শত্রুহারী অর্জুন, এই জন্মের
আগে আমি, এমনকি তুমিও, অনেক জন্ম কাটিয়ে গিয়েছি। সেই সব জন্মের কথা আমি জানি,
কিন্তু তুমি সে সব ভুলে গিয়েছ। |
||
|
৪/৬ |
আমার জন্মান্তর নেই, আমার আত্মার কোন পরিবর্তন হয়
না, আমি এই জগতের সমস্ত জীবের নিয়ন্ত্রণকারী ঈশ্বর। তা সত্ত্বেও, আমি সত্ত্ব,
তমঃ, রজঃ-প্রকৃতির এই তিনগুণের শক্তি দিয়ে, আমার নিজের মায়াতেই আমি বারবার দেহধারণ
করে থাকি। |
||
|
৪/৭ |
হে অর্জুন, সমাজে যখনই ধর্মের বাঁধন শিথিল হয় এবং অধর্মের শক্তি বাড়তে
থাকে, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি এবং দেহ ধারণ করি। |
||
|
৪/৮ |
ধার্মিক ব্যক্তিদের পরিত্রাণ এবং দুষ্ট লোকের
বিনাশের জন্যে, অর্থাৎ সমাজে আবার ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে আমি যুগে যুগে অবতার দেহ
ধারণ করি। |
||
|
৪/৯ |
হে অর্জুন, যে ব্যক্তি আমার এই অদ্ভূত জন্ম ও অলৌকিক
কর্মের কথা সঠিক বুঝতে পারেন, সেই ব্যক্তি দেহ ত্যাগের পর আমার সঙ্গেই মিলিত হন,
তাঁর পুনর্জন্ম হয় না। |
||
|
৪/১০ |
আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ ত্যাগ করে, আমার প্রতি একনিষ্ঠ এবং আমাকেই একমাত্র ভরসা করে, বহু ব্যক্তি জ্ঞান চর্চা ও তপস্যায় পবিত্র হয়েছেন এবং আমার স্বরূপ লাভ করেছে।। |
||
|
৪/১১ |
যে ব্যক্তি যে ভাবে আমার উপাসনা করে, আমি সেই ভাবেই
তাদের সকলকে অনুগ্রহ করে থাকি। হে পার্থ, যে কোন ভাবেই হোক মানুষ শুধুমাত্র
আমারই পথ অনুসরণ করে। |
||
|
৪/১২ |
ইহলোকে কর্ম করে খুব সহজেই মনোমত সিদ্ধিলাভ হয়, আর
সেই সিদ্ধি লাভের আশাতেই মানুষ নানান দেবতার পুজো করে। |
||
|
৪/১৩ |
তিনগুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার
বর্ণের সৃষ্টি আমিই করেছি। কিন্তু আমি এই সৃষ্টির কর্তা হলেও, আমাকে অকর্তা বলেই
জানবে। কারণ মানুষ তার নিজের কর্ম অনুসা্রেই এই চার বর্ণের অধিকারী হয়। |
||
|
৪/১৪ |
না কোন কর্ম আমাকে স্পর্শ করতে পারে, না কর্মফলে আমার কোন তৃষ্ণা আছে। যে
ব্যক্তি আমাকে এই ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি কোন কর্মের বাঁধনেই আবদ্ধ হন
না। |
||
|
৪/১৫ |
আমার এই স্বরূপের অনুভব নিয়ে, পরমমুক্তি লাভের জন্যে
তোমার আগেও অনেক ব্যক্তি কর্ম করে গিয়েছেন। অতএব তুমিও সেই প্রাচীন পন্থা অনুসরণ
করেই কর্ম করতে থাক। |
||
|
৪/১৬ |
কোনটা সঠিক কর্ম আর কোনটা নয়, এই নিয়ে পণ্ডিতদের
মধ্যেও বিভ্রান্তি আছে। অতএব যেটুকু জানলে সমস্ত অমঙ্গল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়,
সেই কর্মের কথাই তোমায় এখন বলব। |
||
|
৪/১৭ |
সঠিক কর্ম, নিষিদ্ধ কর্ম, এমনকি অকর্মের কথাও জেনে
রাখা প্রয়োজন, কারণ কর্মের সম্পূর্ণ তত্ত্বটি জটিল। |
||
|
৪/১৮ |
যে ব্যক্তি কর্মের মধ্যে থেকেও নিজেকে কর্মহীন মনে
করেন এবং কর্মত্যাগী হয়েও নিজেকে কর্মরত মনে করেন, মানুষের মধ্যে তিনিই
বুদ্ধিমান, তিনিই কর্মযোগী এবং সকল কর্মের কর্তা। |
||
|
৪/১৯ |
কামনা ও কর্মফলের প্রত্যাশা ছেড়ে যে ব্যক্তি সর্বদা
কর্ম প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকেন, জ্ঞানের আগুনে তাঁর সমস্ত আসক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
জ্ঞানীগণ এইরকম ব্যক্তিকেই পণ্ডিত বলেন। |
||
|
৪/২০ |
কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করার জন্য তিনি সবসময়ই আনন্দিত
থাকেন, বিষয়ের প্রাপ্তি কিংবা প্রাপ্ত বিষয়ের সুরক্ষার জন্যে তাঁর কোন আশ্রয়ের
প্রয়োজন হয় না। এই ব্যক্তিরা সর্বদা কর্ম করতে থাকলেও যেন কিছুই করছেন না। |
||
|
৪/২১ |
যাঁর বিষয়ের কামনা নেই, সমস্ত ভোগ্যবস্তু ত্যাগ করে
যাঁর মন ও ইন্দ্রিয় সংযত, শুধু দেহধারণের জন্য যিনি কাজ করেন, পাপ কিংবা পুণ্য
তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। |
||
|
৪/২২ |
খুব সামান্য প্রাপ্তিতেও যিনি সন্তুষ্ট থাকেন, যাঁর ঈর্ষাহীন মন সুখ দুঃখ
বোধের অনেক ঊর্ধে, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতায় যিনি পার্থক্য অনুভব করেন না, কাজ
করলেও তিনি সংসারে আবদ্ধ হন না। |
||
|
৪/২৩ |
বিষয়ের প্রতি আসক্তিহীন এবং আত্মজ্ঞানে যাঁর মন স্থির, তাঁর সমস্ত কর্ম
আচরণ, যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সমান হয়ে ওঠে। |
||
|
৪/২৪ |
কারণ, ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন যে জ্ঞানী, তিনি যজ্ঞের অর্পণ,
যজ্ঞের আহুতি, যজ্ঞের অগ্নি এবং যজ্ঞের হোতা, সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম উপলব্ধি করেন।
কাজেই সমাহিত চিত্তে কর্ম সাধনাতেও ব্রহ্মরূপ দর্শন হয়। |
||
|
৪/২৫ |
কোন কোন যোগী নানান দেবতার পুজায় নিষ্ঠার সঙ্গে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। আবার
অনেকে ব্রহ্মরূপ যজ্ঞের অগ্নিতে, যজ্ঞের সমস্ত অর্পণ আহুতি দিয়ে থাকেন। |
||
|
৪/২৬ |
অনেক যোগী কান, ত্বক, চোখ, জিহ্বা ও নাক এই পঞ্চইন্দ্রিয়কে সংযমের আগুনে
আহুতি দেন। আবার কোন কোন যোগী শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পঞ্চ বিষয়কে
ইন্দ্রিয়ের আগুনে আহুতি দেন। |
||
|
৪/২৭ |
জ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল অনেক যোগী, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের
কর্ম এবং সমস্ত জীবন ধারণের কর্ম, তাঁদের আত্ম সংযমরূপ যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিয়ে
থাকেন। |
||
|
৪/২৮ |
কেউ কেউ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন। কেউ তপস্যারূপ যজ্ঞ
করেন। কেউ কেউ প্রাণায়াম ইত্যাদি সাধনারূপ যজ্ঞ করেন। আবার কোন কোন যোগী, কঠিন
ব্রত নিয়ে বেদ ও শাস্ত্রজ্ঞানের চর্চারূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। |
||
|
৪/২৯ |
[নিঃশ্বাসের বায়ুকে প্রাণবায়ু ও প্রশ্বাসের বায়ুকে অপানবায়ু
বলে।] কোন কোন যোগী অপানবায়ুতে প্রাণবায়ু এবং প্রাণবায়ুতে অপানবায়ুর আহুতি দেন।
অর্থাৎ প্রাণ ও অপানবায়ুর গতিরোধ করে কুম্ভক প্রাণায়ম অভ্যাস করেন। |
||
|
৪/৩০ |
কোন কোন যোগী আবার ভোজন-আহারে সংযত হয়ে জীবনের সমস্ত
প্রয়োজনকে শুদ্ধ জীবনের জন্য আহুতি দেন। এতক্ষণ এই যে বারোটি যজ্ঞের পদ্ধতি
বর্ণনা করলাম, এই সমস্ত যজ্ঞকারীই তাঁদের যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে পাপমুক্ত হন। |
||
|
৪/৩১ |
যজ্ঞের প্রসাদ অমৃতসমান, যিনি অমৃতসমান এই যজ্ঞের ফল
ভোগ করেন তিনিই সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন। হে কুরুশ্রেষ্ঠ, যজ্ঞহীন ব্যক্তির ইহলোকেই
কোন স্থান নেই, তো অন্যলোকে স্থান কোথায়? |
||
|
৪/৩২ |
ব্রহ্মের বেদরূপ উক্তিতে এই প্রকার অনেক যজ্ঞের কথা
সবিস্তারে বলা আছে। কর্মযোগ থেকেই এই সমস্ত যজ্ঞপদ্ধতির সৃষ্টি, এই কথাটা জেনে
রাখো। আর এই জ্ঞানই তোমাকে মুক্তির পথ দেখাবে। |
||
|
৪/৩৩ |
হে শত্রুহারী, সাংসারিক দ্রব্যবস্তু সাজানো যজ্ঞঅনুষ্ঠানের
থেকে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ। হে পার্থ, জগতের সমস্ত কর্ম পরমতত্ত্বজ্ঞানের উপলব্ধিতেই
নিষ্পত্তি হয়। |
||
|
৪/৩৪ |
এই জ্ঞানের উপলব্ধির জন্যে, প্রণাম, বিনম্র জিজ্ঞাসা
এবং আন্তরিক সেবায় তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীকে প্রসন্ন করবে এবং তিনিই তোমাকে সেই
পরমতত্ত্ব বর্ণনা করবেন। |
||
|
৪/৩৫ |
হে পাণ্ডব, এই পরমতত্ত্ব উপলব্ধির পর আর কখনো তুমি এমন মোহে আবদ্ধ হবে না।
এই জ্ঞানে তুমি অসীম ব্রহ্ম থেকে সমস্ত জীবজগৎকে, এমনকি আমাকেও নিজের আত্মার
মধ্যেই দেখতে পাবে। |
||
|
৪/৩৬ |
যদি তুমি জগতের সমস্ত পাপীদের থেকেও ভয়ংকর পাপিষ্ঠ হও, তাও এই পরমতত্ত্ব
জ্ঞানের জাহাজ তোমাকে সংসার সমুদ্র পার করে দেবে। |
||
|
৪/৩৭ |
হে অর্জুন, জ্বলন্ত আগুন যেমন কাঠের স্তূপকে পুড়িয়ে
ছাই করে ফেলে, ঠিক তেমনই এই পরমতত্ত্বজ্ঞানের আগুন সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে দেয়। |
||
|
৪/৩৮ |
ইহলোকে এই পরমতত্ত্ব ব্রহ্মজ্ঞানের মতো পবিত্র আর
কিছুই নেই। দীর্ঘকাল নিষ্ঠার সঙ্গে কর্মযোগ চর্চা করার পর নিজের আত্মায় এই
ব্রহ্মজ্ঞানের উপলব্ধি আসে। |
||
|
৪/৩৯ |
শ্রদ্ধাশীল, জ্ঞানের জন্যে উৎসুক, ইন্দ্রিয় সংযমী
ব্যক্তিরাই এই পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। এই জ্ঞান উপলব্ধির পরেই পরম
শান্তি অনুভব করা যায়। |
||
|
৪/৪০ |
অজ্ঞ ব্যক্তি, যার মন অশ্রদ্ধা এবং সংশয়ে পরিপূর্ণ,
সে ব্যক্তির বিনাশ ঘটে। যে ব্যক্তির মন সংশয়ে আচ্ছন্ন, ইহলোক কিংবা পরলোক, কোন
লোকেই তার সুখ মেলে না। |
||
|
৪/৪১ |
হে ধনঞ্জয়, যিনি সকল কর্ম পরমার্থ দর্শনের যোগে
প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং পরমতত্ত্ব উপলব্ধিতে যাঁর মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর হয়েছে,
সেই পরমজ্ঞানী ব্যক্তিকে কোন কর্মই আবদ্ধ করতে পারে না। |
||
|
৪/৪২ |
অতএব, হে অর্জুন, অজ্ঞতার জন্যে তোমার মনের মধ্যে
গড়ে ওঠা এই সংশয়কে, জ্ঞানের কঠোর অস্ত্রে ছিন্ন করো। আসক্তি ত্যাগ করে কর্মযোগের
পথ অবলম্বন করো এবং যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হও। |
জ্ঞানযোগ সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন