শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫

গীতা - ৪র্থ পর্ব

  [এর আগের ৩য় পর্ব - কর্মযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে "গীতা - ৩য় পর্ব"]




চতুর্থ অধ্যায়ঃ জ্ঞানযোগ


৪/১

শ্রীভগবানুবাচ

ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্‌।

বিবস্বান্‌ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবেঽব্রবীৎ।।

শ্রীভগবান্‌ উবাচ

ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবান্‌ অহম্‌ অব্যয়ম্‌।

বিবস্বান্‌ মনবে প্রাহ মনুঃ ইক্ষ্বাকবে অব্রবীৎ।।

শ্রীভগবান বললেন – আমি এই অব্যর্থ মুক্তিদায়ক কর্মযোগের কথা সূর্যকে বলেছিলাম। সূর্য তাঁর নিজের পুত্র মনুকে এবং মনু তাঁর পুত্র ইক্ষ্বাকুকেও এই কথা শুনিয়েছিলেন

 

৪/২

এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।

স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপঃ।।

এবং পরম্পরা-প্রাপ্তম্‌ ইমং রাজর্ষয়ঃ বিদুঃ।

সঃ কালেন ইহ মহতা যোগঃ নষ্টঃ পরন্তপঃ।।

হে বীর অর্জুন, এই ভাবেই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে এই যোগের কথা রাজর্ষিগণ জানতে পেরেছিলেন। দীর্ঘ সময়ের প্রভাবে এখন সেই যোগ এই জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছে।

 

৪/৩

স এবায়ং ময়া তেঽদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।

ভক্তোঽসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম্‌।।

স এবায়ং ময়া তে অদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।

ভক্তঃ অসি মে সখা চ ইতি রহস্যং হি এতৎ উত্তমম্‌।।

তুমি আমার ভক্ত ও প্রিয় বন্ধু, তাই আমি সেই প্রাচীন কর্মযোগের কথা আজ তোমাকে বললাম। কারণ এই কর্মযোগ রহস্যময় হলেও খুবই কল্যাণকর।

 

৪/৪

অর্জুন উবাচ

অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।

কথমেতদ্বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি।।

অর্জুন উবাচ

অপরং ভবতঃ জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।

কথম্‌ এতৎ বিজানীয়াং ত্বম্‌ আদৌ প্রোক্তবান্‌ ইতি।।

অর্জুন বললেন – তোমার জন্ম অনেক পরে আর সূর্যের জন্ম তোমার অনেক আগে। কাজেই সৃষ্টির শুরুতে তুমি সূর্যকে কর্মযোগের কথা শুনিয়েছিলে, তা কি করে জানব?

 

৪/৫

শ্রীভগবানুবাচ

বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।

তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।।

শ্রীভগবান্‌ উবাচ

বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চ অর্জুন।

তানি অহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।।

শ্রীভগবান বললেন – হে শত্রুহারী অর্জুন, এই জন্মের আগে আমি, এমনকি তুমিও, অনেক জন্ম কাটিয়ে গিয়েছি। সেই সব জন্মের কথা আমি জানি, কিন্তু তুমি সে সব ভুলে গিয়েছ।

 

৪/৬

অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্‌।

প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।

অজঃ অপি সন্‌ অব্যয়াত্মা ভূতানাম্‌ ঈশ্বরঃ অপি সন্‌।

প্রকৃতিং স্বাম্‌ অধিষ্ঠায় সম্ভবামি আত্মমায়য়া।।

আমার জন্মান্তর নেই, আমার আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না, আমি এই জগতের সমস্ত জীবের নিয়ন্ত্রণকারী ঈশ্বর। তা সত্ত্বেও, আমি সত্ত্ব, তমঃ, রজঃ-প্রকৃতির এই তিনগুণের শক্তি দিয়ে, আমার নিজের মায়াতেই আমি বারবার দেহধারণ করে থাকি।

     

৪/৭

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌।।

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিঃ ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানম্‌ অধর্মস্য তৎ আত্মানং সৃজামি অহম্‌।।

হে অর্জুন, সমাজে যখনই ধর্মের বাঁধন শিথিল হয় এবং অধর্মের শক্তি বাড়তে থাকে, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি এবং দেহ ধারণ করি।

 

৪/৮

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্‌।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্‌।

ধর্ম-সংস্থাপন-অর্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

ধার্মিক ব্যক্তিদের পরিত্রাণ এবং দুষ্ট লোকের বিনাশের জন্যে, অর্থাৎ সমাজে আবার ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে আমি যুগে যুগে অবতার দেহ ধারণ করি।

 

৪/৯

জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।

ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্মং নৈতি মামেতি সোঽর্জুন।।

জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্‌ এবং যঃ বেত্তি তত্ত্বতঃ।

ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্মং ন এতি মাম্‌ এতি সঃ অর্জুন।।

হে অর্জুন, যে ব্যক্তি আমার এই অদ্ভূত জন্ম ও অলৌকিক কর্মের কথা সঠিক বুঝতে পারেন, সেই ব্যক্তি দেহ ত্যাগের পর আমার সঙ্গেই মিলিত হন, তাঁর পুনর্জন্ম হয় না।

 

৪/১০

বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ।

বহবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতা।।

বীত-রাগ-ভয়-ক্রোধাঃ মন্ময়া মাম্‌ উপাশ্রিতাঃ।

বহবঃ জ্ঞানতপসা পূতা মৎ-ভাবম্‌ আগতা।।

আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ ত্যাগ করে, আমার প্রতি একনিষ্ঠ এবং আমাকেই একমাত্র ভরসা করে, বহু ব্যক্তি জ্ঞান চর্চা ও তপস্যায় পবিত্র হয়েছেন এবং আমার স্বরূপ লাভ করেছে।।    

 

৪/১১

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্‌।

মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তান্‌ তথা এব ভজামি অহম্‌।

মম বর্ত্ম অনুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।

যে ব্যক্তি যে ভাবে আমার উপাসনা করে, আমি সেই ভাবেই তাদের সকলকে অনুগ্রহ করে থাকি। হে পার্থ, যে কোন ভাবেই হোক মানুষ শুধুমাত্র আমারই পথ অনুসরণ করে।

 

৪/১২

কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।

ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্মজা।

কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।

ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধিঃ ভবতি কর্মজা।

ইহলোকে কর্ম করে খুব সহজেই মনোমত সিদ্ধিলাভ হয়, আর সেই সিদ্ধি লাভের আশাতেই মানুষ নানান দেবতার পুজো করে।

 

৪/১৩

চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।

তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্‌।।

চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণ-কর্ম-বিভাগশঃ।

তস্য কর্তারম্‌ অপি মাং বিদ্ধি অকর্তারম্‌ অব্যয়ম্‌।।

তিনগুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের সৃষ্টি আমিই করেছি। কিন্তু আমি এই সৃষ্টির কর্তা হলেও, আমাকে অকর্তা বলেই জানবে। কারণ মানুষ তার নিজের কর্ম অনুসা্রেই এই চার বর্ণের অধিকারী হয়।

  

৪/১৪

ন মাং কর্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্মফলে স্পৃহা।

ইতি মাং যোঽভিজানাতি কর্মভির্ন স বধ্যতে।।

ন মাং কর্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্মফলে স্পৃহা।

ইতি মাং যঃ অভিজানাতি কর্মভিঃ ন সঃ বধ্যতে।।

না কোন কর্ম আমাকে স্পর্শ করতে পারে, না কর্মফলে আমার কোন তৃষ্ণা আছে। যে ব্যক্তি আমাকে এই ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি কোন কর্মের বাঁধনেই আবদ্ধ হন না।

 

৪/১৫

এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম পূর্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ।

কুরু কর্মৈব তস্মাত্ত্বং পূর্বৈঃ পূর্বতরং কৃতম্‌।।

এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম পূর্বৈঃ অপি মুমুক্ষুভিঃ।

কুরু কর্ম এব তস্মাৎ তম্‌ পূর্বৈঃ পূর্বতরং কৃতম্‌।।

আমার এই স্বরূপের অনুভব নিয়ে, পরমমুক্তি লাভের জন্যে তোমার আগেও অনেক ব্যক্তি কর্ম করে গিয়েছেন। অতএব তুমিও সেই প্রাচীন পন্থা অনুসরণ করেই কর্ম করতে থাক।

  

৪/১৬

কিং কর্ম কিমকর্মেতি কবয়োঽপ্যত্র মোহিতঃ।

তত্তে কর্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্‌জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেঽশুভাৎ।।

কিং কর্মঃ কিম্‌ অকর্ম ইতি কবয়ঃ অপি অত্র মোহিতঃ।

তৎ তে কর্ম প্রবক্ষ্যামি যৎ জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসি অশুভাৎ।।

কোনটা সঠিক কর্ম আর কোনটা নয়, এই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যেও বিভ্রান্তি আছে। অতএব যেটুকু জানলে সমস্ত অমঙ্গল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, সেই কর্মের কথাই তোমায় এখন বলব।

 

৪/১৭

কর্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্মণঃ।

অকর্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্মণো গতিঃ।।

কর্মণঃ হি অপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যম্‌ চ বিকর্মণঃ।

অকর্মণঃ চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্মণঃ গতিঃ।।

সঠিক কর্ম, নিষিদ্ধ কর্ম, এমনকি অকর্মের কথাও জেনে রাখা প্রয়োজন, কারণ কর্মের সম্পূর্ণ তত্ত্বটি জটিল।

 

৪/১৮

কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেদকর্মণি চ কর্ম যঃ।

স বুদ্ধিমান্‌ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্মকৃৎ।।

কর্মণি অকর্ম যঃ পশ্যেৎ অকর্মণি চ কর্ম যঃ।

স বুদ্ধিমান্‌ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্ন-কর্মকৃৎ।।

যে ব্যক্তি কর্মের মধ্যে থেকেও নিজেকে কর্মহীন মনে করেন এবং কর্মত্যাগী হয়েও নিজেকে কর্মরত মনে করেন, মানুষের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই কর্মযোগী এবং সকল কর্মের কর্তা।

 

৪/১৯

যস্য সর্বে সমারম্ভাঃ কামসংকল্পবর্জিতাঃ।

জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ।।

যস্য সর্বে সম-আরম্ভাঃ কাম-সংকল্প-বর্জিতাঃ।

জ্ঞান-অগ্নি-দগ্ধ-কর্মাণং তম্‌ আহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ।।

কামনা ও কর্মফলের প্রত্যাশা ছেড়ে যে ব্যক্তি সর্বদা কর্ম প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকেন, জ্ঞানের আগুনে তাঁর সমস্ত আসক্তি নষ্ট হয়ে যায়। জ্ঞানীগণ এইরকম ব্যক্তিকেই পণ্ডিত বলেন।

 

৪/২০

ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ।

কর্মণ্যভিপ্রবৃত্তোঽপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ।।

ত্যক্ত্বা কর্ম-ফল-আসঙ্গং নিত্য-তৃপ্তঃ নিরাশ্রয়ঃ।

কর্মণি অভিপ্রবৃত্তঃ অপি ন এব কিম্‌ চিৎ করোতি সঃ।।

কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করার জন্য তিনি সবসময়ই আনন্দিত থাকেন, বিষয়ের প্রাপ্তি কিংবা প্রাপ্ত বিষয়ের সুরক্ষার জন্যে তাঁর কোন আশ্রয়ের প্রয়োজন হয় না। এই ব্যক্তিরা সর্বদা কর্ম করতে থাকলেও যেন কিছুই করছেন না।

   

৪/২১

নিরাশীর্যতচিত্তাত্মা ত্যক্তসর্বপরিগ্রহঃ।

শারীরং কেবলং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্‌।।

নিরাশীঃ-যত-চিত্ত-আত্মা ত্যক্ত-সর্ব-পরিগ্রহঃ।

শারীরং কেবলং কর্ম কুর্বন্‌ ন আপ্নোতি কিল্বিষম্‌।।

যাঁর বিষয়ের কামনা নেই, সমস্ত ভোগ্যবস্তু ত্যাগ করে যাঁর মন ও ইন্দ্রিয় সংযত, শুধু দেহধারণের জন্য যিনি কাজ করেন, পাপ কিংবা পুণ্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।

   

৪/২২

যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীতো বিমৎসরঃ।

সমঃ সিদ্ধাবসিদ্ধৌ চ কৃত্বাপি ন নিবধ্যতে।।

যদৃচ্ছা-লাভ-সন্তুষ্টঃ দ্বন্দ্ব-অতীতঃ বিমৎসরঃ।

সমঃ সিদ্ধৌ অসিদ্ধৌ চ কৃত্বা অপি ন নিবধ্যতে।।

খুব সামান্য প্রাপ্তিতেও যিনি সন্তুষ্ট থাকেন, যাঁর ঈর্ষাহীন মন সুখ দুঃখ বোধের অনেক ঊর্ধে, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতায় যিনি পার্থক্য অনুভব করেন না, কাজ করলেও তিনি সংসারে আবদ্ধ হন না।     

 

৪/২৩

গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ।

যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে।।

গত-সঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞান-অবস্থিত-চেতসঃ।

যজ্ঞায় আচরতঃ কর্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে।।

বিষয়ের প্রতি আসক্তিহীন এবং আত্মজ্ঞানে যাঁর মন স্থির, তাঁর সমস্ত কর্ম আচরণ, যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সমান হয়ে ওঠে।

     

৪/২৪

ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্‌।

ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা।।

ব্রহ্ম অর্পণং ব্রহ্ম হবিঃ ব্রহ্মা-গ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্‌।

ব্রহ্ম এব তেন গন্তব্যং ব্রহ্ম-কর্ম-সমাধিনা।।

কারণ, ব্রহ্মের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন যে জ্ঞানী, তিনি যজ্ঞের অর্পণ, যজ্ঞের আহুতি, যজ্ঞের অগ্নি এবং যজ্ঞের হোতা, সকলের মধ্যেই ব্রহ্ম উপলব্ধি করেন। কাজেই সমাহিত চিত্তে কর্ম সাধনাতেও ব্রহ্মরূপ দর্শন হয়।

   

৪/২৫

দৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্যুপাসতে।

ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহ্বতি।।

দৈবম্‌ এব অপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্যুপাসতে।

ব্রহ্মা-অগ্নৌ অপরে যজ্ঞং যজ্ঞেন এব উপজুহ্বতি।।

কোন কোন যোগী নানান দেবতার পুজায় নিষ্ঠার সঙ্গে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। আবার অনেকে ব্রহ্মরূপ যজ্ঞের অগ্নিতে, যজ্ঞের সমস্ত অর্পণ আহুতি দিয়ে থাকেন।

 

৪/২৬

শ্রোত্রাদীনীন্দ্রিয়াণ্যন্যে সংযমাগ্নিষু জুহ্বতি।

শব্দাদীন্‌ বিষয়ানন্য ইন্দ্রিয়াগ্নিষু জুহ্বতি।।

শ্রোত্র-আদীনি ইন্দ্রিয়াণি অন্যে সংযম-অগ্নিষু জুহ্বতি।

শব্দ-আদীন্‌ বিষয়ান্‌ অন্য ইন্দ্রিয়-অগ্নিষু জুহ্বতি।।

অনেক যোগী কান, ত্বক, চোখ, জিহ্বা ও নাক এই পঞ্চইন্দ্রিয়কে সংযমের আগুনে আহুতি দেন। আবার কোন কোন যোগী শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পঞ্চ বিষয়কে ইন্দ্রিয়ের আগুনে আহুতি দেন।

 

৪/২৭

সর্বাণীন্দ্রিয়কর্মাণি প্রাণকর্মানি চাপরে।

আত্মসংযমযোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে।।

সর্বাণি ইন্দ্রিয়-কর্মাণি প্রাণ-কর্মানি চ অপরে।

আত্ম-সংযম-যোগ-অগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞান-দীপিতে।।

জ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল অনেক যোগী, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কর্ম এবং সমস্ত জীবন ধারণের কর্ম, তাঁদের আত্ম সংযমরূপ যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিয়ে থাকেন।

 

৪/২৮

দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাস্তথাঽপরে।

স্বাধ্যায়জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ।।

দ্রব্য-যজ্ঞাঃ তপঃ-যজ্ঞাঃ যোগ-যজ্ঞাঃ তথা অপরে।

স্বাধ্যায়-জ্ঞান-যজ্ঞাঃ চ যতয়ঃ সংশিত-ব্রতাঃ।।

কেউ কেউ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন। কেউ তপস্যারূপ যজ্ঞ করেন। কেউ কেউ প্রাণায়াম ইত্যাদি সাধনারূপ যজ্ঞ করেন। আবার কোন কোন যোগী, কঠিন ব্রত নিয়ে বেদ ও শাস্ত্রজ্ঞানের চর্চারূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন।

 

৪/২৯

অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেঽপানং তথাঽপরে।

প্রাণাপানগতী রুদ্ধা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ।।

অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণে অপানং তথা অপরে।

প্রাণ-অপান-গতী রুদ্ধা প্রাণায়াম্‌-পরায়ণাঃ।।

[নিঃশ্বাসের বায়ুকে প্রাণবায়ু ও প্রশ্বাসের বায়ুকে অপানবায়ু বলে।] কোন কোন যোগী অপানবায়ুতে প্রাণবায়ু এবং প্রাণবায়ুতে অপানবায়ুর আহুতি দেন। অর্থাৎ প্রাণ ও অপানবায়ুর গতিরোধ করে কুম্ভক প্রাণায়ম অভ্যাস করেন।

     

৪/৩০

অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্‌ প্রাণেষু জুহ্বতি।

সর্বেঽপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষপিতকল্মষাঃ।।

অপরে নিয়ত-আহারাঃ প্রাণান্‌ প্রাণেষু জুহ্বতি।

সর্বে অপি এতে যজ্ঞবিদঃ যজ্ঞ-ক্ষপিত-কল্মষাঃ।।

কোন কোন যোগী আবার ভোজন-আহারে সংযত হয়ে জীবনের সমস্ত প্রয়োজনকে শুদ্ধ জীবনের জন্য আহুতি দেন। এতক্ষণ এই যে বারোটি যজ্ঞের পদ্ধতি বর্ণনা করলাম, এই সমস্ত যজ্ঞকারীই তাঁদের যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে পাপমুক্ত হন।

    

৪/৩১

যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্‌।

নায়ং লোকোঽস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোঽন্যঃ কুরুসত্তম।।

যজ্ঞ-শিষ্ট-অমৃত-ভুজঃ যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্‌।

ন অয়ং লোকঃ অস্তি অযজ্ঞস্য কুতঃ অন্যঃ কুরুসত্তম।।

যজ্ঞের প্রসাদ অমৃতসমান, যিনি অমৃতসমান এই যজ্ঞের ফল ভোগ করেন তিনিই সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন। হে কুরুশ্রেষ্ঠ, যজ্ঞহীন ব্যক্তির ইহলোকেই কোন স্থান নেই, তো অন্যলোকে স্থান কোথায়?

   

৪/৩২

এবং বহুবিধা যজ্ঞা বিততা ব্রহ্মণো মুখে।

কর্মজান্‌ বিদ্ধি তান্‌ সর্বানেবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে।।

এবং বহুবিধাঃ যজ্ঞাঃ বিততাঃ ব্রহ্মণঃ মুখে।

কর্মজান্‌ বিদ্ধি তান্‌ সর্বান্‌ এবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে।।

ব্রহ্মের বেদরূপ উক্তিতে এই প্রকার অনেক যজ্ঞের কথা সবিস্তারে বলা আছে। কর্মযোগ থেকেই এই সমস্ত যজ্ঞপদ্ধতির সৃষ্টি, এই কথাটা জেনে রাখো। আর এই জ্ঞানই তোমাকে মুক্তির পথ দেখাবে।

   

৪/৩৩

শ্রেয়ান্‌ দ্রব্যময়াদ্‌ যজ্ঞাজ্‌ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ।

সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।।

শ্রেয়ান্‌ দ্রব্যময়াৎ যজ্ঞাৎ জ্ঞান-যজ্ঞঃ পরন্তপ।

সর্বং কর্ম অখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।।

হে শত্রুহারী, সাংসারিক দ্রব্যবস্তু সাজানো যজ্ঞঅনুষ্ঠানের থেকে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ। হে পার্থ, জগতের সমস্ত কর্ম পরমতত্ত্বজ্ঞানের উপলব্ধিতেই নিষ্পত্তি হয়।

 

৪/৩৪

তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।

উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ।।

তৎ বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।

উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনঃ তত্ত্বদর্শিনঃ।।

এই জ্ঞানের উপলব্ধির জন্যে, প্রণাম, বিনম্র জিজ্ঞাসা এবং আন্তরিক সেবায় তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীকে প্রসন্ন করবে এবং তিনিই তোমাকে সেই পরমতত্ত্ব বর্ণনা করবেন

 

৪/৩৫

যজ্‌জ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহমেবং যাস্যসি পাণ্ডব।

যেন ভূতান্যশেষেণ দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি।।

যৎ জ্ঞাত্বা ন পুনঃ মোহম্‌ এবং যাস্যসি পাণ্ডব।

যেন ভূতানি-অশেষেণ দ্রক্ষ্যস্য আত্মনি অথো ময়ি।।

হে পাণ্ডব, এই পরমতত্ত্ব উপলব্ধির পর আর কখনো তুমি এমন মোহে আবদ্ধ হবে না। এই জ্ঞানে তুমি অসীম ব্রহ্ম থেকে সমস্ত জীবজগৎকে, এমনকি আমাকেও নিজের আত্মার মধ্যেই দেখতে পাবে।

  

৪/৩৬

অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ।

সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।।

অপি চেৎ অসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ।

সর্বং জ্ঞানপ্লবেন এব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।।

যদি তুমি জগতের সমস্ত পাপীদের থেকেও ভয়ংকর পাপিষ্ঠ হও, তাও এই পরমতত্ত্ব জ্ঞানের জাহাজ তোমাকে সংসার সমুদ্র পার করে দেবে।

 

৪/৩৭

যথৈধাংসি সমিদ্ধোঽগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতেঽর্জুন।

জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।।

যথা এধাংসি সমিদ্ধঃ অগ্নিঃ ভস্মসাৎ কুরুতে অর্জুন।

জ্ঞান-অগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।।

হে অর্জুন, জ্বলন্ত আগুন যেমন কাঠের স্তূপকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে, ঠিক তেমনই এই পরমতত্ত্বজ্ঞানের আগুন সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে দেয়।

  

৪/৩৮

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।

তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।।

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রম্‌ ইহ বিদ্যতে।

তৎ স্বয়ং যোগ-সংসিদ্ধঃ কালেন আত্মনি বিন্দতি।।

ইহলোকে এই পরমতত্ত্ব ব্রহ্মজ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। দীর্ঘকাল নিষ্ঠার সঙ্গে কর্মযোগ চর্চা করার পর নিজের আত্মায় এই ব্রহ্মজ্ঞানের উপলব্ধি আসে।

 

৪/৩৯

শ্রদ্ধাবান্‌ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।

জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।।

শ্রদ্ধাবান্‌ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযত-ইন্দ্রিয়ঃ।

জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিম্‌ অচিরেণ অধিগচ্ছতি।।

শ্রদ্ধাশীল, জ্ঞানের জন্যে উৎসুক, ইন্দ্রিয় সংযমী ব্যক্তিরাই এই পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেনএই জ্ঞান উপলব্ধির পরেই পরম শান্তি অনুভব করা যায়।

  

৪/৪০

অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি।

নায়ং লোকোঽস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ।।

অজ্ঞঃ চ অশ্রদ্দধানঃ চ সংশয়-আত্মা বিনশ্যতি।

ন অয়ং লোকঃ অস্তি ন পরঃ ন সুখং সংশয়-আত্মনঃ।।

অজ্ঞ ব্যক্তি, যার মন অশ্রদ্ধা এবং সংশয়ে পরিপূর্ণ, সে ব্যক্তির বিনাশ ঘটে। যে ব্যক্তির মন সংশয়ে আচ্ছন্ন, ইহলোক কিংবা পরলোক, কোন লোকেই তার সুখ মেলে না।

 

৪/৪১

যোগসংন্যস্তকর্মাণং জ্ঞানসংচ্ছিন্নসংশয়ম্‌।

আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয়ঃ।।

যোগ-সংন্যস্ত-কর্মাণং জ্ঞান-সংচ্ছিন্ন-সংশয়ম্‌।

আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয়ঃ।।

হে ধনঞ্জয়, যিনি সকল কর্ম পরমার্থ দর্শনের যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং পরমতত্ত্ব উপলব্ধিতে যাঁর মন থেকে সমস্ত সংশয় দূর হয়েছে, সেই পরমজ্ঞানী ব্যক্তিকে কোন কর্মই আবদ্ধ করতে পারে না।

  

৪/৪২

তস্মাদজ্ঞানসম্ভূতং হৃৎস্থং জ্ঞানাসিনাত্মনঃ।

ছিত্ত্বৈনং সংশয়ং যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত।।

তস্মাৎ অজ্ঞান-সম্ভূতং হৃৎস্থং জ্ঞান-অসিনা আত্মনঃ।

ছিত্ত্বা এনং সংশয়ং যোগম্‌ আতিষ্ঠ উত্তিষ্ঠ ভারত।।

অতএব, হে অর্জুন, অজ্ঞতার জন্যে তোমার মনের মধ্যে গড়ে ওঠা এই সংশয়কে, জ্ঞানের কঠোর অস্ত্রে ছিন্ন করো। আসক্তি ত্যাগ করে কর্মযোগের পথ অবলম্বন করো এবং যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হও।

 

জ্ঞানযোগ সমাপ্ত

চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/৪

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের তৃতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/৩ " তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ পর্বাং...