মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ৩/৩



["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের দ্বিতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে "ধর্মাধর্ম - ৩/২"


তৃতীয় পর্ব - তৃতীয় পর্বাংশ

(৬০০ বিসিই থেকে ০ বিসিই)


৩.২.৩ মহাজ্ঞানী গৌতম

গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে গৌতম অনুভব করলেন জগতের সমস্ত প্রাণ এবং জড় – সমস্ত উদ্ভিদ, খনিজ, তৃণ, লতাগুল্ম, সকল প্রাণী এমনকি মানুষও এখন তাঁর অন্তরেই অবস্থান করছে। তিনি দেখতে পেলেন নিজের সমস্ত অতীত জীবন। তিনি নিজের অন্তরে অজস্র জগতের উত্থান-পতন, অজস্র নক্ষত্রের সৃষ্টি ও বিনাশ প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি তাঁর অন্তরে জগতের সমস্ত জীবের আনন্দ ও দুঃখ অনুভব করলেন। তিনি অনুভব করলেন, তাঁর প্রতিটি দেহকোষেই ধরা পড়েছে স্বর্গ ও মর্ত এবং ত্রিকাল - অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। সেদিন রাত্রি প্রথম প্রহরে তাঁর এই অনুভব ঘটল।

আরও গভীর ধ্যানে তিনি দেখলেন অগণিত কাল ধরে, অগণিত জীবের জন্ম এবং মৃত্যু। সমুদ্রে নিরন্তর ঢেউ গড়ে ওঠে এবং ভাঙে, কিন্তু সমুদ্রের যেমন জন্ম বা মৃত্যু নেই, লক্ষকোটি জীবের জন্ম-মৃত্যু হলেও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। জন্ম-মৃত্যু যে একটা বাহ্যিক ধারণা, সে কথা বুঝতে পারলে দুঃখভোগ থাকে না, মনে আসে প্রশান্তি। জন্ম-মৃত্যু চক্রের রহস্য বুঝতে পেরে গৌতম এখন মৃদু হাসলেন। তাঁর হাসিটি রাতের অন্ধকারে ফুটে উঠল উজ্জ্বল একটি ফুলের মতো।  

গৌতম আরও নিবিষ্ট ধ্যানে নিমগ্ন হলেন, কিন্তু তখনই ভয়ংকর গর্জনে বিদ্যুৎ চমকাল এবং ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল আকাশের চাঁদ ও যত নক্ষত্র। শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। অশ্বত্থগাছের নিচে গৌতমও ভিজতে লাগলেন, বৃষ্টির অঝোর ধারায়, কিন্তু তাও তিনি মগ্ন রইলেন নিবিষ্ট ধ্যানে। এই সময় গৌতমের চেতনায় বিকশিত হল আরেকটি সত্য। তিনি দেখলেন জীব যাবতীয় দুঃখভোগ করে তার অজ্ঞানের জন্যে। তারা ভুলে যায় সকল জীবের উদ্ভব একই মাটিতে। অজ্ঞান তাদের মনে এনে দেয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, লোভ, মোহ, ঈর্ষা, সন্দেহ, অবিনয় এবং অবিশ্বাস। শান্ত হয়ে আমরা যদি মনের গভীরে ডুব দিতাম, আমরা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারতাম সকল দুঃখ-দুশ্চিন্তার অবসান। আমাদের মনে সঞ্চারিত হত সহমর্মীতা এবং ভালোবাসা।

গৌতম এখন দেখলেন, উপলব্ধির সঙ্গে ভালোবাসার নিবিড় যোগাযোগ। উপলব্ধি ছাড়া ভালোবাসার অস্তিত্ব নেই। প্রতিটি মানুষের স্বভাব বা চরিত্র নির্ভর করে তার শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার ওপর। আমাদের একবার যদি এমন উপলব্ধি হয়, আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর মানুষকেও ঘৃণা করতে পারব না, বরং তার শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করব। অতএব সহমর্মীতা এবং ভালোবাসা আসে উপলব্ধি থেকে। আর উপলব্ধি আসে মনন থেকে। জীবনের প্রতিটি মূহুর্তের, অন্তর কিংবা বাহিরের প্রতিটি ঘটনার মনন আমাদের উপলব্ধি বাড়িয়ে তোলে। আমাদের মুক্তি এবং প্রজ্ঞালাভের অনন্য উপায় হল মনন। সৎ উপলব্ধি, সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ জীবন, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ মনন এবং সৎ মনোযোগ জীবনকে আলোকিত করে। গৌতম এই আটটি পথকে বললেন অষ্টমার্গ, আটটি মহা পথ।

তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘ সরে গেছে, আকাশে আবার উজ্জ্বল হয়েছে চাঁদ ও তারা। গৌতমের মনে হল, বিগত হাজার জন্ম ধরে তিনি যেন বন্দী ছিলেন এক কারাগারে, এখন সেই কারাগার উন্মুক্ত। অজ্ঞান ছিল সেই কারাগারের প্রহরী। ঘন মেঘে আচ্ছন্ন আকাশে যেমন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল উজ্জ্বল চাঁদ ও নক্ষত্ররা, তেমনি অজ্ঞানের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে মানুষের উপলব্ধি। যার থেকেই সৃষ্টি হয় যত ভ্রষ্ট চিন্তা, ভ্রান্ত ধারণা, কল্পিত তত্ত্ব এবং জীবনের যত দুঃখভোগ। অষ্টমার্গ অনুসরণ করে মানুষ অজ্ঞান প্রহরীকে একবার পরাস্ত করতে পারলেই, অদৃশ্য হবে কারাগার, কোনদিন তা আর ফিরে আসবে না।

সন্ন্যাসী গৌতম হাসলেন, মনে মনে বললেন, “ওহে প্রহরী, আমি তোমাকে এখন চিনেছি। কত জন্ম ধরে তুমি আমায় জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনে বেঁধে রেখেছিলে? কিন্তু এখন আমি তোমাকে স্পষ্ট চিনে গিয়েছি, এখন থেকে তুমি আমাকে আর কোন বাঁধনে বাঁধতে পারবে না”। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন ভোরের শুকতারা। এই তারা এর আগেও এই আসনে বসে কতবার তিনি দেখেছেন। কিন্তু আজ যেন তার গায়ে এসেছে হীরকের উজ্জ্বল দ্যুতি। গৌতম উপলব্ধি করলেন, শুকতারা একই আছে, কিন্তু তিনিই উজ্জ্বল হয়েছেন অন্তরের আলোকে। তাঁর মনের সমস্ত তমসার বিনাশ হয়ে তিনি পেয়েছেন মহাজাগরণ, মহান প্রজ্ঞা।

একে একে তাঁর মনে পড়ল সবার কথা, পিতা শুদ্ধোদন, মাতা, মাসি গৌতমী, পত্নী যশোধরা, পুত্র রাহুল। তাঁর বন্ধুরা, কপিলাবস্তুর প্রাসাদ, উদ্যান, রাজ্যের সাধারণ জনগণ সবার কথা। তিনি কথা দিয়েছিলেন, পথের সন্ধান পেলেই তিনি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন সেই অভিজ্ঞতা। আজ তিনি পেয়েছেন। তিনি অন্তরে অনুভব করলেন, জগতের সকল প্রাণীর জন্যেই অনন্ত করুণা এবং ভালোবাসা।

সূর্যোদয় হতেই তিনি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং তখনই তাঁর চোখে পড়ল বালক মোষপালক স্বস্তি দৌড়ে আসছে। তিনি হাসলেন। কিন্তু দৌড়ে আসতে আসতে কিছুটা আগেই স্বস্তি থমকে গেল, অবাক চোখে তাকিয়ে রইল গৌতমের মুখের দিকে।

গৌতম স্মিতমুখে ডাকলেন, “স্বস্তি, কাছে আয়”।

স্বস্তি জোড় হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল, নিচু হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল, “গুরুদেব, আজকে আপনাকে একদম অন্যরকম লাগছে কেন?”

গৌতম আরও এগিয়ে স্বস্তিকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই? ঠিক কী রকম লাগছে বল তো?”

স্বস্তি গৌতমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক কী বলতে পারব না, তবে একদম অন্যরকম। আপনি যেন কোন নক্ষত্রের মতো। সবে ফুটে ওঠা পদ্মফুলের মতো। কিংবা... কিংবা... গয়াশীর্ষ পাহাড়চূড়ার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদের মতো”।

গৌতম হেসে ফেললেন, বললেন, “বাবা, তুই যে আজ একেবারে কবি হয়ে উঠলি রে? সে যাক, আজ এত সকাল সকাল চলে এলি যে? মাঠে যাসনি? তোর মোষেরপাল কোথায়?”

স্বস্তি বলল, “প্রভু মোষদের নিয়ে আজ জমিতে গেছেন চাষ করতে, আস্তাবলে আছে শুধু বাছুরগুলো। কাজেই আজ কাজ একটু হালকা। তবে ঘাস কাটতে হবে। মাঝরাত্রে মেঘের গর্জন আর প্রচণ্ড বৃষ্টি হল, আমাদের বিছানা, ঘরদোর ভিজে গিয়েছিল সব, তাই ঘুম এল না আর। তখনই মনে হয়েছিল, আপনি গাছতলায় একা একা কী করছেন, কেমন আছেন ঝড়-বৃষ্টিতে? ভোর হতেই গোয়ালে গিয়ে কাস্তে আর লাঠিটা নিয়ে তাই দৌড়ে এলাম আপনাকে দেখতে”।

গৌতম স্বস্তির হাত ধরে বললেন, “আজকে আমার সব থেকে আনন্দের দিন, রে স্বস্তি। পারলে তোরা সব্বাই একবার আসিস বিকেলের দিকে। তোর ভাইবোনদেরও সঙ্গে আনতে ভুলিস না যেন। কিন্তু এখন যা, তাড়াতাড়ি ঘাস-টাস কেটে তোর কাজগুলো সেরে আয়”।

সেদিন দুপুরে সুজাতা যখন খাবার নিয়ে এল, দেখল গৌতম অশ্বত্থগাছের নিচে তাঁর আসনেই বসে আছেন। তাঁর মুখ ভোরের সূর্যের মতোই উজ্জ্বল এবং সুন্দর। তাঁর অনুদ্বিগ্ন শরীরে এখন প্রশান্তি এবং আনন্দজ্যোতি। এর আগেও সুজাতা তাঁকে এভাবে অশ্বত্থগাছের নিচে বহুদিন, বহুবার বসে থাকতে দেখেছে, কিন্তু আজ তাঁকে যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে! তারও মন আনন্দ ও শান্তিতে ভরে উঠল। সুজাতা কলাপাতায় তাঁর খাবার সাজিয়ে এগিয়ে দিল, তারপর জোড়হাতে দাঁড়িয়ে রইল সামনে।

গৌতম তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, বললেন, “আমার পাশে এস বস, সুজাতা। এই ক’মাস ধরে প্রতিদিন তুই আমায় খাবার আর জল দিয়ে গেছিস, তার জন্যে আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার জীবনে আজকের দিনটা সব থেকে আনন্দের, যে পথ আমি এতদিন খুঁজছিলাম, সেই মহামার্গের সন্ধান পেয়ে গেছি। তোরাও সবাই আজ আনন্দ কর। সবার কাছে এই মহান পথের প্রচার করতে, খুব শিগ্‌গিরিই আমি বেরিয়ে পড়ব”।

সুজাতা অভিমানী স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি আমাদের ছেড়ে চিরদনের মতো চলে যাবেন?”

গৌতম স্মিতমুখে বললেন, “যেতে তো হবেই, মা, কিন্তু তাই বলে চিরদিনের মতো ছেড়ে যাব না। যাওয়ার আগে আমি তোদেরও দেখাব সেই পথের সন্ধান, যে পথ আমি আবিষ্কার করেছি”। সুজাতা ঠিক ভরসা পেল না যেন, আরও কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, তার আগেই গৌতম বললেন, “আরও কটা দিন আমি তোদের কাছেই থাকব, তোদের সবাইকে বুঝিয়ে দেব, আমার খুঁজে পাওয়া পথের সন্ধান। তারপর রওনা হব আমার উদ্দিষ্ট পথে, কিন্তু আমি আবার ফিরেও আসব, তোদের সকলকে দেখতে”।

গৌতমের খাওয়া হয়ে যেতে সুজাতা যখন গ্রামে ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়াল, গৌতম তাকেও বললেন, গ্রামের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে, বিকেলের দিকে আবার আসতে।

 

৩.৩.১ গৌতম বুদ্ধ

বিকেলে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে এল। সকলেই এসেছে স্নান করে, পরিষ্কার কাপড় পরে। স্বস্তি এসেছে, তার ভাইবোন, রূপক, নন্দবালা আর ভীমাকে নিয়ে। দাদা নালকের সঙ্গে এসেছে সুজাতা, পরনে তার গজদন্ত রংয়ের সুন্দর শাড়ি।  হাতে একঝুড়ি ফল আর খাবার। স্বস্তির বোন নন্দবালা এসেছে, পরনে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি, আর ভীমা এসেছে গোলাপি শাড়ি পরে। ছেলেমেয়েরা সবাই যখন গৌতমকে ঘিরে অশ্বত্থ গাছের নিচে বসল, মনে হল ঘাসের ওপর যেন নানারঙের গুচ্ছগুচ্ছ ফুল ফুটেছে। সুজাতা নিয়ে এসেছে একঝুড়ি ছাড়ানো নারকেল আর তালের মিছরি। নন্দবালা এনেছে একঝুড়ি পাকা লেবু। রূপক গৌতমকে অনেকটা নারকেলের শাঁস দিল, মিছরি দিল, নন্দবালা দিল একটি লেবু।

সকলেই খেতে আরম্ভ করার পর সুজাতা বলল, “ভাই-বোনেরা, আমাদের গুরুদেবের জীবনে আজকের দিনটা খুবই আনন্দের। আজ তিনি মহামার্গের সন্ধান পেয়ে গেছেন। আমার কাছেও এই দিনটি খুবই আনন্দের দিন। আমরা সবাই তাই এখানে এসেছি, আজকের বিশেষ এই দিনটি উদ্‌যাপন করতে। হে গুরুদেব, আমরা জানি আপনি চিরদিন আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন না। কঠিন তপস্যা করে পাওয়া আপনার এই মহাজ্ঞানের যতটুকু আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব, সেটুকুই বলুন”। কথাটা বলে সুজাতা করজোড় এবং নত হয়ে শ্রদ্ধা জানাল মহাজ্ঞানী গৌতমকে, সুজাতাকে দেখে অন্য ছেলেমেয়েরাও উঠে দাঁড়াল এবং একই ভঙ্গিতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাল।

মহাজ্ঞানী গৌতম সকলকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন, তারপর বললেন, “তোরা সকলেই খুব সরল এবং বুদ্ধিমান ছেলে ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। যে মহামার্গের সন্ধান আমি পেয়েছি, সে হয়তো গভীর এবং সূক্ষ্ম, কিন্তু তোদের পবিত্র ও সরল মনে এর ধারণা করা খুব কঠিন হবে না।

এই যে এখন আমরা লেবু খাচ্ছি, ছেলেমেয়েরা, আমরা খুব মন দিয়ে খাচ্ছি কি? খুব নিষ্ঠার সঙ্গে আমরা কি এই লেবুর খোসা ছাড়াচ্ছি? খোসা ছাড়িয়ে, লেবুর প্রত্যেকটি কোয়া মুখে নিয়ে আমরা মন দিয়ে এর স্বাদ নিচ্ছি কি? আমরা এই লেবুর গন্ধ, স্বাদ - মিষ্টতা, অম্লতা সঠিক উপভোগ করছি কি? নাকি যেমন তেমন করে, লেবু ছাড়িয়ে খেতে হয়, তাই খেয়ে ফেলছি। নন্দবালা আমাকে যে লেবুটি দিয়েছে, তাতে নটি কোয়া আছে। আমি এই লেবুর নটি কোয়াই কিন্তু নিষ্ঠা ভরে মন দিয়ে উপভোগ করতে চাই। যাতে এই লেবু, তার স্বাদ, গন্ধ, এবং তার সঙ্গে নন্দবালা ও তোদের সকলকে এবং এই সুন্দর বিকেলটা আমার সারাজীবন মনে থাকে।

ছেলেমেয়েরা, নিষ্ঠা নিয়ে, এই লেবুটি খাওয়া মানে, মনটা লেবুতেই নিবিষ্ট রাখা। গতকাল কী কী হয়েছিল, অথবা আগামীকাল কী কী ঘটতে পারে সেসব চিন্তা থেকে তোদের মনকে দূরে রেখে, এখন এই বর্তমান সময়ে যা ঘটছে তাতেই মনোনিবেশ করা। তার মানে এইখানে এই সময়ে তোদের মন, শরীর এবং চিন্তাকে - একবিন্দুতে স্থির রাখা। এই লেবুতে যেমন কোয়া রয়েছে, তেমনি আমাদের একএকটি দিনে থাকে আটটি কোয়া বা প্রহর। আমাদের এই লেবুটির প্রত্যেকটি কোয়া খাওয়ার মতো, আমরা যদি অন্য সব চিন্তা ভুলে দিনের প্রত্যেকটি প্রহরের কাজ - সে যে কোন কাজই হোক না কেন, ঘরের কাজ, বাবা-মায়ের সেবা, ভাইবোনদের দেখাশোনা, মোষ চারণ, নদীর চড়ায় ঘাস কাটা, খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো, ঘুমোনো – নিষ্ঠার সঙ্গে করতে থাকি, আমরা প্রত্যেকটি কাজই উপভোগ করতে পারব। আর যদি তা না করি, যে কোন কাজকেই মনে হবে বোঝা, ভুল হবে, হতাশা আসবে, বাবা-মা, কিংবা কর্মদাতা প্রভু বকাবকি করবে, জীবন দুঃসহ মনে হবে। সুজাতা?”

বলুন গুরুদেব”। সুজাতা জোড়হাতে উত্তর দিল।

তোর কী মনে হয়, যে মন দিয়ে কাজ করে, তার কী বেশি ভুল হয়?”

না, গুরুদেব, যে মন দিয়ে কাজ করে, তার খুব কমই ভুল হয়। আমার মা বলেন, একটি মেয়ের হাঁটাচলা, দাঁড়িয়ে থাকা, কথা বলা, হাসা, কাজ করা – সব ব্যাপারেই মন দেওয়া উচিৎ, নয়তো নিজের এবং অন্যদের দুঃখের কারণ হতে হয়”।

ঠিক তাই, সুজাতা। কথাটা শুধু মেয়েদের জন্যে নয়, ছেলেদের জন্যেও জরুরি। সব কাজেই যে মনোযোগ দেয়, সে সর্বদাই সতর্ক থাকে, সে কী করছে, কী বলছে, কী ভাবছে। এমন মানুষ সেই সেই কাজ, কথা বা চিন্তা সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে, যার কারণে তার বা অন্যদের হয়তো দুর্ভোগ আসতে পারত। ছেলেমেয়েরা, মনঃসংযোগ করা মানে, সর্বদা বর্তমানে থাকা। তার নিজের এবং তার চারপাশে কী ঘটে চলেছে সে সম্বন্ধে সর্বদা সচেতন থাকা। তাতে নিজের এবং আশেপাশের সকলের সঙ্গেই পারষ্পরিক বোঝাপড়া বেড়ে ওঠে। পারষ্পরিক বোঝাপড়া বাড়লে বেড়ে ওঠে আমাদের সহিষ্ণুতা এবং ভালোবাসা। একই পরিবারে, বা একই সমাজে যখন পারষ্পরিক বোঝাপড়া তৈরি হয়, তখনই একে অপরকে মেনে নিতে সুবিধে হয়, সুবিধে হয় ভালোবাসতে। সেক্ষেত্রে দুঃখ-কষ্টের বোঝা আপনা থেকেই হাল্কা হয়ে যায়। তোর কী মনে হয়, স্বস্তি? একজন যদি অন্যকে সঠিক বুঝতে না পারে, সেখানে ভালোবাসা কতটা গভীর হয়?”

গুরুদেব, ঠিকঠাক বুঝতে না পারলে, কাউকেই ভালোবাসা যায় না। এমনই একবার ঘটেছিল, আমাদের আদরের বোন ভীমার সঙ্গে। ভীমা তখন খুব ছোট্ট, একদিন রাত্রে ও খুব কাঁদছিল, কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। ওর দিদি নন্দবালা এক সময় ধৈর্য হারিয়ে, ভীমাকে একটা থাপ্পড় লাগাল, ভীমার কান্না থামার বদলে আরও বেড়ে গেল। আমি ভীমাকে কোলে নিলাম, দেখলাম ওর গায়ে হাল্কা জ্বর রয়েছে। জ্বর হয়েছিল, হয়তো মাথাব্যথাও করছিল বলেই ও কাঁদছিল, আমরা কেউই বুঝিনি। আমি ডেকে বলতে, বালাও এসে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখল, হ্যাঁ জ্বর রয়েছে। বোনের কষ্টে বালার চোখে জল এল, ও ভীমাকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরল, ঘুমপাড়ানি গান গাইতে লাগল গুনগুন করে। একটু পরেই ভীমা কান্না থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, যদিও তখনও তার জ্বর একটুও কমেনি। গুরুদেব, আমার মনে হয়, বালা প্রথমে ভীমার কষ্টটা বুঝতে পারেনি, বুঝতে যখন পারল, সমস্যার সমাধানও হয়ে গেল। সেই কারণেই আমার মনে হয়, একে অন্যকে সঠিক বুঝতে না পারলে, ভালোবাসা সম্ভব নয়”।

ঠিক তাই, স্বস্তি। ভালোবাসা তখনই সম্ভব যখন সঠিক বোঝাপড়া থাকে। অতএব ছেলেমেয়েরা, সারা দিনের যা কিছু কাজ, সব করবি সচেতন মনে। অন্যকে সঠিক বোঝার চেষ্টা কর। দেখবি নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা আরও কত গভীর হয়ে ওঠে। এই মহান পথই আমি আজ আবিষ্কার করেছি”।

স্বস্তি জোড়হাতে জিজ্ঞাসা করল, “এই পথকে কী আমরা “সচেতন পথ” বলতে পারি?”

গৌতম হাসলেন, বললেন, “বাঃ বেশ বলেছিস, “সচেতন পথ” – এই পথই আমাদের নিয়ে যাবে জাগরণের দিকে।”

সুজাতাও জোড়হাতে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি বলছিলেন, আপনার মহাজাগরণ হয়েছে। আমাদের এখানে মহাজ্ঞানকে আমরা বলি “বুধ” আর মহাজ্ঞানীকে বলি, “বুদ্ধ”। আপনাকে আমরা “বুদ্ধ” বলে ডাকতে পারি, গুরুদেব?”

গৌতম খুশি মনে সম্মতি দিলেন। সুজাতার দাদা নালক, এখানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সে সবার বড়ো, জোড়হাতে বলল, “সুজাতার মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি। এখন আপনার “সচেতন পথ”-এর শিক্ষাও পেলাম। যে অশ্বত্থগাছের নিচে আপনি এতদিন তপস্যা করলেন, কাছাকাছি অঞ্চলে ওই গাছটিই সব থেকে সুন্দর। ওই গাছের নিচেই আপনার মহাজ্ঞান লাভ হয়েছে, তাই আমরা ওই গাছটিকেও স্মরণীয় করতে চাই। আমাদের মাগধী ভাষায় “বুধ” কথা থেকে আরেকটি কথা আসে “বোধি”, যার অর্থ জ্ঞান, যে গাছের নিচে আপনার মহাজ্ঞান লাভ হল, সেই গাছকে আমরা “বোধি বৃক্ষ” বলতে চাই।

গৌতম এবারও হাসিমুখেই সম্মতি দিলেন। তিনি মনে মনে আশ্চর্য এক আনন্দও অনুভব করলেন। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি অতি সাধারণ এই ছেলেমেয়েরা, তাঁর প্রথম ধর্মশিক্ষাতেই এমন অভিভূত হয়ে পড়বে। যার জন্যে তিনি এবং এই অশ্বত্থবৃক্ষ পেয়ে যাবে এমন অবিস্মরণীয় নাম। এই নামই, তিনি স্থির করলেন, সারা জীবন বহন করবেন সসম্মানে। আজ থেকে তিনি নিজের পরিচয় দেবেন গৌতমবুদ্ধ।

নন্দবালা এবার জোড়হাতে বলল, “অন্ধকার হয়ে আসছে, আমাদের এখনই ঘরে ফেরা উচিৎ। কিন্তু হে বুদ্ধ, আমরা আপনার থেকে আরও অনেককিছু শিখতে চাই, আমরা আবার সবাই আসব”। ছেলেমেয়েরা সকলেই করজোড়ে গৌতমবুদ্ধকে নত হয়ে শ্রদ্ধা জানাল। তাঁর মনে হল, ছেলেমেয়েদের করজোড় যেন একএকটি পদ্মের কলি, পূর্ণ বিকশিত হবার অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি স্থির করলেন, তিনি আরও কিছুদিন থেকে যাবেন। এই ছেলেমেয়েদের মধ্যেও তিনি মহাজাগরণের বীজ বপন করে যাবেন। তিনিও পেয়ে যাবেন কিছুটা বাড়তি সময়, এই শান্তি এবং আনন্দ উপভোগ করতে করতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করে নেবেন। ছেলেমেয়েরা বিকেলের ম্লান আলোয় পাখির মতো আনন্দে কলকাকলি করতে করতে ফিরে গেল তাদের গ্রামে।

গৌতমবুদ্ধ এখন রোজই নৈরঞ্জনা নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকক্ষণ ধ্যান করেন। তারপর নদীতেই স্নান করেন।  তারপর কখনো নদীর পাড়ে, কখনো বা বোধিবৃক্ষের নিচে বসে ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। তাঁর চোখে এখন সব কিছুই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ওই বহতা নদী, নদীর দুই পাড়ের তৃণ, আকাশ, নক্ষত্র, পিছনের পাহাড়, অরণ্য, এই বোধিবৃক্ষ, সারাদিন এই গাছের কলকাকলি মুখর পাখির দল, এমনকি প্রত্যেকটি ধূলিকণা - সব কিছুই তাঁর জীবনসঙ্গী। তাঁর জীবনে প্রত্যেকের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘ সাধনার পর এই মহাজ্ঞান বা বোধি তিনি অর্জন করেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, এই বোধি বাইরে থেকে আরোপিত কোন ধারণা নয়। এই বোধি রয়েছে সমস্ত মানুষের অন্তরেই, এমনকি প্রত্যেক প্রাণীর অন্তরেও। এ তত্ত্ব তারা জানে না, তারা অনুভব করতে পারে না। তারা জন্ম-মৃত্যু নিয়ে গড়া সীমিত জীবনের অর্থ সন্ধান করে ফেরে বাইরে বাইরে। গৌতমবুদ্ধ নিজের অন্তরেই আবিষ্কার করতে পেরেছেন সেই মহাপথ, যে পথে পৌঁছে যাওয়া যায় মহাবোধের অনন্ত সাগরে। তিনি উদ্ভাসিত হয়েছেন মহাজাগরণে, তিনি মুক্ত হয়েছেন।

তাঁর মনে পড়ল, অনেকেই তাঁর এই আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে। কপিলাবস্তু শহরে তাঁর পরিবারের সকলে, রাজগৃহের রাজা বিম্বিসার। তিনি নিজেও এখন সকল মানুষের অন্তরে এই মহাজাগরণের আলো পৌঁছে দিতে উদ্গ্রীব। তাঁর মনে পড়ল তাঁকে ছেড়ে যাওয়া সেই পাঁচ সন্ন্যাসীর কথাও। তাঁরা সাধনার যে স্তরে ছিলেন, তাঁদের পক্ষে এই বোধিলাভ সহজ হবে। তাঁরাও হয়ে উঠতে পারবেন গৌতমবুদ্ধের প্রচারসঙ্গী।

ছেলেমেয়েরা এখন তাঁর কাছে রোজই আসে। গৌতমবুদ্ধ খুব খুশী হন ওরা এলে। গ্রামের এই সরল প্রথাগত শিক্ষাহীন ছেলেমেয়েরাও তাঁর কথা মন দিয়ে শোনে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, তাদের আচরণেও তাঁর শিক্ষার প্রভাব পড়েছে। বাপ-মা মরা স্বস্তি মোষচারণ করে, সে এবং তার পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র শূদ্র-দাস, গ্রামে ওরা অছ্যুত। সুজাতা স্বচ্ছল বৈশ্য পরিবারের মেয়ে। তিনি দেখেছেন, সুজাতা এবং তার ভাই-বোন, আজকাল স্বস্তির ভাই-বোনদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে, একসঙ্গেই খায়। সুজাতা আর নন্দবালা এখন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ভীমাকে নিজের ছোটবোনের মতোই আদর করে সুজাতা। সুজাতা আর নন্দবালা গৌতমবুদ্ধের জন্যে একটি কাপড় নিয়ে এল একদিন। টুকটুকে লাল কাপড়টি দুজনে মিলে সেলাই করেছে। গৌতমবুদ্ধ খুশি হলেন খুব, এই কাপড়টি তাঁর খুবই দরকার ছিল। নদীর ধার থেকে পাওয়া সেই মৃতদেহের কাপড়টিও এখন পুরোনো হয়েছে এবং কেচে দিলে, না শুকনো পর্যন্ত তাঁর অসুবিধে হয়। সুজাতা যখন জানল, গৌতমবুদ্ধের পুরোনো বস্ত্রটি ছিল নদীর ধার থেকে কুড়িয়ে আনা মৃতদেহের আবরণ, সে কেঁদেই ফেলল। বলল, ওই মেয়েটি ছিল, তাদেরই বাড়ির দাসী, নাম রাধা, জ্বর-বিকারে মারা গিয়েছিল। গুরুদেব এতদিন সেই বস্ত্রটি ব্যবহার করে আসছেন! সুজাতা আর নন্দবালা নিজেরা চুপিচুপি ঠিক করে নিল, আরেকটি বস্ত্র তারা খুব শিগ্‌গিরি উপহার দেবে গৌতমবুদ্ধকে।

সুজাতার আরও দুই প্রিয় বান্ধবী বালাগুপ্তা আর জোতিলিখা। কিছু একটা কারণে বালাগুপ্তা আর জোতিলিখার মধ্যে ঝগড়া হয়ে যাওয়াতে, এখন দুজনের বাক্যালাপ বন্ধ। ওরা সুজাতার সঙ্গে আসে, কিন্তু বালাগুপ্তা আর জোতিলিখা পাশাপাশি না বসে, অনেকটা দূরে বসে। একদিন বালাগুপ্তা গৌতমবুদ্ধকে বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু বলতে বলল। দুই বান্ধবীর দূরে বসা লক্ষ্য করে গৌতম বুদ্ধ স্মিতমুখে বললেন, “তাহলে তোদের একটা কাহিনী বলি শোন। বহু বহু বছর আগে আমি একবার হরিণ হয়ে জন্মেছিলাম”। ছেলেমেয়েরা সবাই ভীষণ আশ্চর্য হল এবং মজাও পেল, বলল, “আপনি হরিণ ছিলেন?”

শুধু আমি না রে, আমরা সবাই, তোরাও। আমাদের আগের আগের জন্মে আমরা কখনো ছিলাম, মাটি, পাথর, শিশিরবিন্দু, বায়ু, জল বা আগুন। কখনো ছিলাম, শ্যাওলা, ঘাস, গাছ, পোকামাকড়। কখনো ছিলাম মাছ, কচ্ছপ, পাখি কিংবা হরিণ, বাঘ, ঘোড়া, কুকুর। আমি সেই সব জন্মের কথা ধ্যানে জানতে পেরেছি, দেখতেও পেয়েছি। এক জন্মে আমি ছিলাম, পাহাড়চূড়ার এক বিশাল পাথর। আরেক জন্মে ছিলাম চাঁপাগাছ। এরকমই আরেক জন্মে আমি ছিলাম বনের হরিণ। আমার বন্ধু ছিল একটি দোয়েল আর কচ্ছপ। হয়তো তোদের মধ্যেই কেউ ছিলি সেই দোয়েল, কেউ বা সেই কচ্ছপ। আর ছিল একজন ব্যাধ।

আমরা তিন বন্ধু মিলে বাস করতাম এক অরণ্যে, সেই অরণ্যে ছিল একটি সরোবর। সেই সরোবরের জলে থাকত কচ্ছপ, দোয়েল থাকত গাছে আর আমি ঘুরে বেড়াতাম সেই অরণ্যের তৃণভূমিতে। সরোবরে আমি যখন জল খেতে যেতাম, আমাদের রোজ দেখা হত, আমরা খুব গল্প করতাম আর মজা করতাম। একদিন এক ব্যাধ সেই সরোবরে যাওয়ার পথেই ফাঁদ পেতে রেখেছিল আমাকে ধরার জন্যে। বুঝতে পারিনি, বিকেলের দিকে সরোবরে যখন জল খেতে যাচ্ছিলাম, ধরা পড়ে গেলাম। ভয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠতে, জল থেকে উঠে এল কচ্ছপ, গাছ থেকে নেমে এল দোয়েল। আমি তো ভয়ে তখন দিশাহারা, ওরা দুজন কীভাবে আমাকে বাঁচানো যায়, সেই চিন্তা করতে লাগল। দোয়েল বলল, “কচ্ছপভাই, তোমার ধারালো দাঁত আর শক্ত চোয়াল দিয়ে হরিণের বাঁধন কাটতে চেষ্টা করো। ততক্ষণ আমি ব্যাধকে সামলাচ্ছি, ও যাতে চট করে এদিকে না আসতে পারে”। কচ্ছপ আমার পায়ের দড়ি কাটতে শুরু করল, আর দোয়েল উড়ে গেল ব্যাধের বাড়ির দিকে।

ব্যাধের বাড়ির পাশের একটা আমগাছে বসে দোয়েল সারারাত পাহারা দিল। খুব ভোরে ব্যাধ হাতে মস্ত ছুরি নিয়ে যেমনি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়েছে, তার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দোয়েল। ডানার ঝাপটানি আর পায়ের নখ দিয়ে খিমচে দিল ব্যাধের মুখচোখ। আচমকা সেই আক্রমণে ব্যাধটা বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল, সে ঘরে ঢুকে পড়ে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিল। তারপর আবার ছুরি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গেল পিছনের দরজা দিয়ে। এবারও দোয়েল একইভাবে তার মুখে চোখে খিমচে দিল। পরপর দুবার এমন হওয়াতে ব্যাধ আর সেদিন বেরোলই না। কিন্তু পরের দিন ভোরে দোয়েল দেখল ব্যাধ মাথায় পাগড়ি বেঁধেছে, মুখটাও ঢেকে রেখেছে গামছায়। তার হাতে আজও ছিল ভয়ংকর সেই ছুরিটা।

দোয়েল তাড়াতাড়ি উড়ে এল আমাদের কাছে। বলল, “কত দেরি কচ্ছপভাই, আজ আর ব্যাধকে আটকাতে পারলাম না। সে এদিকেই আসছে”। কচ্ছপ আমার তিন পায়ের দড়ি কেটে ফেলেছিল, বাকি ছিল একটাই। সেটারও অর্ধেক হয়ে এসেছিল, গাছের ওপর থেকে দোয়েল বলল, “ওই ব্যাধ আসছে, হরিণভাই। তুমি একবার লাফ মেরে, ঝটকা দিয়ে দড়িটা ছিঁড়ে ফেলতে পারো কিনা দেখ না”। আমি তাই করলাম আর দড়ির শেষটুকু সত্যিই ছিঁড়ে গেল। আমি মুক্ত হয়ে সামান্য দূরের ঝোপের আড়াল থেকে দেখতে লাগলাম ব্যাধটা এবার কী করে।

ব্যাধটা আমাকে দেখতে পেয়েছিল, ফাঁদের কাছে এসে কচ্ছপকে দেখে তার বুঝতে বাকি রইল না, আমি ফাঁদে পড়েছিলাম, আর কচ্ছপই সেই ফাঁদের দড়িগুলো কেটে দিয়েছে। সে রেগে গিয়ে কচ্ছপকেই ধরল, তারপর গামছায় বেঁধে ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। আমি পালাতে পারলেও কচ্ছপ পারেনি। কচ্ছপ এমনিতেই আস্তে হাঁটে, তার ওপর তখন সে ভীষণ ক্লান্ত, টানা দু’রাত এবং একদিন ধরে সে তার দাঁত দিয়ে দড়িগুলো চিবিয়েছে। তাড়াতাড়ি হেঁটে সরোবরের জলে নেমে যাওয়ার মতো শক্তিও, তার তখন অবশিষ্ট ছিল না।

কচ্ছপ ধরা পড়তে দোয়েল আমার কাছে এল, বলল, “হরিণভাই, কচ্ছপকে বাঁচাতেই হবে। তুমি এক কাজ করো, ভুলিয়ে-ভালিয়ে ব্যাধকে তুমি একটু দূরের দিকে টেনে আনো। ও নিশ্চয়ই কচ্ছপের বোঝা নিয়ে তোমার দিকে দৌড়বে না, কোথাও নামিয়ে রাখবে, তখন আমি যা করার কিছু একটা করব”। তাই করলাম, ব্যাধের সামনে সামনে আমি ঘোরাঘুরি করে ঘাস খেতে লাগলাম। ব্যাধটা মনে করল, গতকাল খেতে না পেয়ে আমি নিশ্চয়ই দুর্বল, একটু দৌড়লেই আমাকে ধরে ফেলতে পারবে। সে গামছায় বাঁধা কচ্ছপটাকে মাটিতে রেখে আমার দিকে দৌড়ে এল। আমিও একটু সরে গেলাম, ব্যাধও আমার পিছনে আসতে লাগল। ওদিকে দোয়েল আর কচ্ছপ দুজনে মিলে গামছার বাঁধন কেটে ফেলল। তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে কচ্ছপ নেমে পড়ল সরোবরের জলে। দোয়েল আবার আমার কাছে এসে খবর দিল, “হরিণভাই, আর ভয় নেই, তুমি পালাও। কচ্ছপ সরোবরে নেমে পড়েছে”। দোয়েলের কথা শুনে আমি দৌড় লাগালাম বনের গভীরে। ব্যাধটা হতাশ হয়ে ফিরে গেল সরোবরের কাছে, গিয়ে দেখল তার গামছাটা ছেঁড়া আর আশেপাশে কচ্ছপটাও নেই। জব্দ হয়ে ঘরে ফিরে গেল হতাশ ব্যাধটা।

বিকেলে সেই সরোবরের ধারে আমরা আবার তিন বন্ধু একত্র হলাম। কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন, তিন বন্ধু মিলে কতক্ষণ গল্প করলাম, হাসলাম, মজা করলাম”। ছেলেমেয়েরা সকলেই মন দিয়ে গল্প শুনছিল, শেষ হতে গৌতমবুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, “বহুদিন আগের ওই ঘটনায় আমি ছিলাম হরিণ, তোদের মধ্যে কী কেউ কচ্ছপ ছিলি?” সুজাতা এবং অন্য তিনজন হাত তুলে বলল, “আমি”। গৌতমবুদ্ধ হাসলেন, বললেন, “আর সেই দোয়েল?” এবার হাত তুলল স্বস্তি, জোতিলিখা আর বালাগুপ্তা, বলল, “আমি”।

সুজাতা জোতিলিখা আর বালাগুপ্তাকে বলল, “তোরা সেই জন্মে যদি দুজনে মিলে একটি দোয়েল হয়ে থাকিস, তাহলে এই জন্মে কী দুই দোয়েলে ঝগড়া হতে পারে? এই জন্মে আমাদের মধ্যেও তো অমন বন্ধুত্ব হয়ে উঠতে পারে, ওই হরিণ, দোয়েল আর কচ্ছপের মতো?”

বালাগুপ্তা উঠে দাঁড়িয়ে জোতিলিখার সামনে গেল, জোতিলিখার দুই হাত ধরল নিজের দুহাতে। জোতিলিখা বালাগুপ্তকে জড়িয়ে ধরল, তারপর একটু সরে পাশে বসার জায়গা করে দিল বালাগুপ্তকে। গৌতমবুদ্ধ মুগ্ধ আনন্দে হাসলেন, বললেন, “বাঃ তোরা গল্পটা বেশ বুঝেছিস তো! গল্পটা মনে রাখিস আর সর্বদা লক্ষ্য করে দেখিস, এমন কত ঘটনা আজও ঘটে চলেছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে”। গৌতমবুদ্ধ উপলব্ধি করলেন, জটিল ও সূক্ষ্ম তত্ত্বকথার থেকে এমন গল্পগাছা, সাধারণ মানুষ এবং ছেলেমেয়েদের মনকে খুব সহজেই নাড়া দিতে পারবে।

৩.৩.২ ধর্মচক্র

গৌতমবুদ্ধ উরুবিল্ব গ্রাম ছেড়ে একদিন বেরিয়ে পড়লেন। ছেলেমেয়েদের সকলেই এসেছিল তাঁকে বিদায় জানাতে। সকলের চোখেই জল, গৌতমবুদ্ধ স্মিত মুখে সবার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন, তারপর বললেন, “আমার এই মহামার্গ আবিষ্কারের পেছনে তোদের সব্বার সাহায্যের কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে, আমি তোদের সবার কাছেই কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোদের ছেড়ে আমাকে যেতেই হবে। সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে আমার নতুন বার্তা, প্রত্যেককে জানাতে হবে মুক্তি-পথের সন্ধান। যেটুকু তোদের শিখিয়ে গেলাম, সেগুলি মনে রাখিস এবং নিয়মিত অভ্যাস করিস। আমি দূরে গেলেও, তোদের মনের মধ্যেই এভাবেই থাকবো সর্বদা। আর কথা দিচ্ছি, সুযোগ পেলেই আমি আবার ফিরে আসবো তোদের কাছে। সুজাতা, চোখের জল মুছে, আমায় হাসি মুখে বিদায় দে, মা”।

ছেলেমেয়েরা তাঁর সঙ্গে এল গ্রামের সীমানা পর্যন্ত। গ্রাম ছেড়ে কিছুদূর গিয়েই তাঁর সঙ্গে পথেই দেখা হল এক সন্ন্যাসীর। সন্ন্যাসী তাঁকে দেখেই জোড়হাতে এগিয়ে এলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “হে সন্ন্যাসি, আপনার চেহারা অদ্ভূত জ্যোতির্ময় এবং আপনার মুখে দেখছি আশ্চর্য প্রশান্তি। আপনার নাম কী? আপনার আচার্যই বা কে?”

গৌতমবুদ্ধ বললেন, “আমি গৌতমবুদ্ধ। আমি অনেক আচার্যের কাছেই শিক্ষা পেয়েছি, কিন্তু এখন আমার কেউ আচার্য ছিলেন না। আপনার নাম কী? আর আপনি কোথা থেকে আসছেন?”

আমার নাম উপক। আমি আচার্য রুদ্রক রামপুত্রের আশ্রম ছেড়ে এই আসছি”।

আচার্য রুদ্রক ভালো আছেন তো?”

আচার্য রুদ্রক এই কয়েকদিন আগেই দেহরক্ষা করেছেন”।

গৌতম বুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী কোন সময় আচার্য আলাড় কালামসের আশ্রমে ছিলেন?”

ছিলাম। কিন্তু তিনিও বছরখানেক হল গতায়ু হয়েছেন”।

হতাশ গৌতমবুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী সন্ন্যাসী কৌণ্ডিল্যর নাম শুনেছেন?”

শুনেছি বৈকি। যতদূর জানি কৌণ্ডিল্য এবং আরও চারজন সন্ন্যাসী বারাণসীর কাছে ঋষিপত্তনের মৃগদাবে রয়েছেন এবং আজকাল ওখানেই তপস্যা করছেন। এবার আমাকে যেতে হবে, গৌতম, আমার যাত্রার পথ বহুদূর”। গৌতমবুদ্ধ জোড়হাতে সন্ন্যাসীকে বিদায় দিলেন। তিনি স্থির করলেন, নৈরঞ্জনা নদীর ধার দিয়েই তিনি হাঁটবেন। এই নদী যেখানে গঙ্গায় মিশেছে, সেই পর্যন্ত গিয়ে, তিনি গঙ্গার পাড় দিয়ে পশ্চিমে হেঁটে পৌঁছবেন পাতালিগ্রাম। সেখানে গঙ্গা পার হয়ে কিছুটা গেলেই বারাণসী, কাশী রাজ্যের রাজধানী।

কৌণ্ডিল্য, ভদ্রিক, অশ্বজিৎ, বপ্র আর মহানামা, সেদিন মৃগদাবে সবে ধ্যানে বসছেন, লক্ষ্য করলেন, দূর থেকে একজন সন্ন্যাসী তাঁদের দিকেই আসছেন। একটু কাছে আসতে তাঁরা চিনতে পারলেন, এ সেই সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থ। ভদ্রিক সিদ্ধার্থকে চিনতে পেরেই অন্যদের বললেন, “সিদ্ধার্থ মাঝপথেই তপস্যা ছেড়ে দিয়েছিল। সে এখন ভাত খায়, দুধ খায়, বাচ্চাদের সঙ্গে এমনকি মেয়েদের সঙ্গেও হেসে হেসে কথা বলে। সিদ্ধার্থ আর সন্ন্যাসীই নয়। অতএব তার সঙ্গে আমরা কোন কথা বলব না। সামনে এসে দাঁড়ালেও আমরা তাকে কোন সম্মান দেখাবো না”।

কিন্তু গৌতমবুদ্ধ যখন শান্ত পায়ে তাঁদের সামনে স্মিতমুখে দাঁড়ালেন, সন্ন্যাসীরা তাঁদের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন। গৌতমবুদ্ধের উজ্জ্বল প্রশান্ত উপস্থিতিতে তাঁরা সকলে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং করজোড়ে মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানালেন। কৌণ্ডিল্য তাঁর হাতের ভিক্ষাপাত্র গ্রহণ করলেন। মহানামা দৌড়ে গিয়ে তাঁর হাত ও পা ধোয়ার জল আনলেন। ভদ্রিক কাঠের পিঁড়ি এনে দিলেন বসার জন্যে। বপ্র তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগলেন। অশ্বজিৎ একধারে দাঁড়িয়ে রইলেন, গৌতমবুদ্ধের নির্দেশের অপেক্ষায়।

সামান্য বিশ্রামের পর পাঁচজন সন্ন্যাসী গৌতমবুদ্ধকে ঘিরে বসলেন। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে  গৌতমবুদ্ধ বললেন, “আমি যে পথের সন্ধান করছিলাম, প্রিয় বন্ধুরা, সেই মহামার্গ আমি আবিষ্কার করেছি। আমি তোমাদেরও সেই পথ দেখাব”। কথাটা পাঁচজন সন্ন্যাসীর কারো খুব একটা বিশ্বাস হল না যেন, তাদের মনে এখনও সন্দেহ রয়েছে। কৌণ্ডিল্য বললেন, “সিদ্ধার্থ, তুমি তো মাঝপথে তপস্যাই ছেড়ে দিয়েছিলে। আমরা দেখেছি তুমি ভাত খাচ্ছিলে, দুধ খাচ্ছিলে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করছিলে। কীভাবে তুমি মুক্তির পথ খুঁজে পেয়ে গেলে?”

গৌতমবুদ্ধ স্নিগ্ধ শান্ত স্বরে বললেন, “সে কথাই আমি তোমাদের বলতে এসেছি। দেখ, যে দুটি চরম পথের কথা এতদিন আমরা শুনেছি, সন্ন্যাসীদের সেই দুটো পথই ত্যাগ করা উচিৎ। প্রথমটি হল ভোগ, দ্বিতীয়টি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন। এই দুই পথেই আসে চরম ব্যর্থতা। এই দুই পথকে এড়িয়ে আমি যে পথ আবিষ্কার করেছি, সে পথের নাম “মধ্যম পন্থা”, এই পথেই আমি পেয়েছি মহাজ্ঞান এবং মুক্তির সন্ধান”। তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল এতটাই আত্মপ্রত্যয়, পাঁচজন সন্ন্যাসীই এবার শ্রদ্ধা-নিবিড় চোখে করজোড়ে তাকিয়ে রইলেন বুদ্ধের মুখের দিকে।

বুদ্ধ আরও বললেন, “এই মধ্যম পন্থার সাধনা দিয়েই আমি আরও আটটি পথের সন্ধান পেয়েছি, যার নাম “অষ্টাঙ্গিক মার্গ”। সম্যক দর্শন, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। এই আটটি আচরণ আয়ত্ত করতে পারলে, আমরা চারটি আর্য বা শ্রেষ্ঠ সত্য উপলব্ধি করতে পারবো। এই চারটি আর্যসত্য হল দুঃখ, দুঃখের হেতু, দুঃখ নিরোধ, দুঃখনিরোধ মার্গ।

দুঃখ-সত্য হল জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু – শোক সন্তাপ, দুশ্চিন্তা, প্রিয়জনের বিরহ অথবা বিয়োগ, দুর্জনের অত্যাচার। আরও দুঃখ হল, যা পেতে চাইছি, তা না পাওয়া এবং যা চাইনি তাই পেয়ে যাওয়া। শেষ দুটি দুঃখের উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধে হবে, অনেকদিন ধরেই আমি অত্যন্ত কম দায়িত্বের কিন্তু প্রচুর আয় ও সুখ-সুবিধে যুক্ত একটি উত্তম চাকরি চেয়েছি, পাইনি। জেল খাটতে চাইনি, কিন্তু রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় ঘুঁষ নিয়ে, ধরা পড়ে জেল খাটছি।

দুঃখ-হেতু-সত্য হল, তৃষ্ণা অর্থাৎ ভোগের আকাঙ্খা বা কামনা। এই তৃষ্ণার জন্যেই রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়। মাতা-পুত্র, পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, ভাই-বোন, প্রতিবেশী কিংবা মিত্র-মিত্রের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয়।

দুঃখ-নিরোধ-সত্য হল, মন থেকে তৃষ্ণার নিরোধ এবং বিনাশ। তৃষ্ণার বিনাশ হলে উপাদান অর্থাৎ বিষয় অথবা সম্পদের আকাঙ্খা নিরোধ হয়। তখন দুঃখ-হেতুর নিরোধ হয় অর্থাৎ অন্য মানুষের সঙ্গে বিবাদের সৃষ্টি হতে পারে না।

দুঃখনিরোধ-মার্গ সত্য হল, সেই পথ যে পথে দুঃখ নিরোধ সম্ভব। সে ওই অষ্টাঙ্গিক মার্গ, যার কথা আগেই বলেছি। এই আটটি মার্গকে প্রজ্ঞা, শীল এবং সমাধি ভাবেও বিভক্ত করা যায়। যেমন, সম্যক দর্শন, সম্যক সঙ্কল্প হল প্রজ্ঞা। সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা হল শীল। আর সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি হল সমাধি।

প্রজ্ঞা হল, সম্যক বা সঠিক দর্শন বা দৃষ্টি – এই দৃষ্টি কায়িক, বাচনিক এবং মানসিক, সু ও কুকর্ম বিষয়ে প্রজ্ঞা দেয়। যেমন কায়িক সুকর্ম হল হিংসা না করা, চুরি না করা, ব্যাভিচার না করা। বাচনিক সুকর্ম হল সত্য বলা, প্রিয় কথা বলা, পিছনে কথা না বলা (অর্থাৎ চুকলি না কাটা) এবং আজেবাজে না বকে সুচিন্তিত অর্থপূর্ণ কথা বলা। মানসিক সুকর্ম হল লোভ না করা, বন্ধুত্ব, করুণা, সহমর্মীতা এবং অভ্রান্ত ধারণা। মানুষ প্রায় সর্বদাই আজন্ম-লালিত কিছু ধারণায় আবদ্ধ থাকে। সেই ধারণাতেই আটকে না থেকে নতুন পরিবেশে, নতুন যুগে ধারণাকে সচল এবং উন্মুক্ত রাখাই হল অভ্রান্ত ধারণা। প্রজ্ঞার মধ্যে আরও রয়েছে সম্যক সঙ্কল্প – রাগ, হিংসা, প্রতিহিংসাবিহীন সঙ্কল্পকেই সম্যক সঙ্কল্প বলে।

শীল কথার অর্থ সদাচার – ভালো স্বভাব।  তার মধ্যে সম্যক বাক্য হল বাচনিক সুকর্ম, যার কথা আগেই বলেছি। সম্যক কর্ম হল কায়িক সুকর্ম। সম্যক জীবিকা হল জীবনধারণের প্রয়োজনে সৎ জীবিকা। অস্ত্র, প্রাণী, মাংস, নেশা ও বিষদ্রব্যের উৎপাদন ও এগুলির বাণিজ্য সংক্রান্ত সকল কাজই অসৎ জীবিকা। 

সমাধি বিভাগে সম্যক প্রযত্ন হল ইন্দ্রিয়ের সংযম এবং কুচিন্তা ত্যাগ করে সুচিন্তায় মানসিক স্থিতি। আমাদের দেহ, আমাদের দুঃখ-সুখ, শোক-আনন্দ সবই ক্ষণস্থায়ী, এই কথাটি সর্বদা মনে রাখাই হল সম্যক স্মৃতি। সম্যক সমাধি হল মনের একাগ্রতা। সমাধি অর্থাৎ সাধনা বা ধ্যান করে মনের যাবতীয় বিক্ষেপ দূর করা সম্ভব”।

বুদ্ধের কথা শেষ হওয়ার আগেই সন্ন্যাসী কৌণ্ডিল্য অন্তরে অনুভব করলেন অবর্ণনীয় আনন্দ-জ্যোতি। তাঁর শরীরে লাগল শিহরণ এবং মুখে প্রশান্ত হাসি। বুদ্ধর চোখ এড়াল না, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কৌণ্ডিল্য, তুমি কী পেয়েছ আলোর সন্ধান”? সন্ন্যাসী কৌণ্ডিল্য জোড় হাতে নত হয়ে বুদ্ধের চরণ স্পর্শ করলেন, বললেন, “হে মহাগুরু সিদ্ধার্থ, আমাকে আপনার শিষ্যত্বে অনুমতি দিন, আপনার সহায়তায় আমিও চাই এমনই জাগরণ”। অন্য চার সন্ন্যাসীও বুদ্ধের চরণে নিজেদের সমর্পণ করলেন, তাঁর শিষ্যত্বের অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন। বুদ্ধ তাঁদের পাঁচজনকেই হাত ধরে দাঁড় করালেন, তারপর স্মিত মুখে বললেন, “উরুবিল্বর ছেলেমেয়েরা আমার নাম দিয়েছে “বুদ্ধ”, আর এই মহাজাগরণের নাম দিয়েছে “বোধি”। আজ থেকে তোমরাও আমায় “গৌতমবুদ্ধ” নামেই ডাকবে”।

গৌতমবুদ্ধ ঋষিপত্তনে (আজকের সারনাথ) পৌঁছেছিলেন এবং পাঁচ সন্ন্যাসীকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন ৫২৮ বি.সি.ই-র আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার দিন। বৌদ্ধধর্মে এই দিনটি আজও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এই ঋষিপত্তনেই তিনি থাকলেন বর্ষার চারটি মাস। তাঁর সাহায্যে এবং সন্ন্যাসীদের একনিষ্ঠ সাধনায় পাঁচজনেই উপলব্ধি করলেন, পরম সত্য। কিছুদিনের মধ্যে তাঁরা সকলেই হয়ে উঠলেন আলোকপ্রাপ্ত অর্হৎ। গৌতমবুদ্ধ স্মিতমুখে বললেন, “এখন আমরা আর একা নই, আমরা এখন সঙ্ঘ। এই সঙ্ঘের সদস্যরা সম্যকভাবে প্রাজ্ঞ জীবনযাপন করবে। আমাদের এই সঙ্ঘ জাগরণের বীজ নিয়ে বেরিয়ে পড়বে এবং রোপণ করবে সর্বত্র”। শুধু ওই পাঁচজন অর্হৎই নন, বর্ষা শেষে ওই ঋষিপত্তনেই আরও ষাটজন মুক্তিকামী মানুষ তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়ে ভিক্ষু হলেন।

 অর্হৎ কৌণ্ডিল্য গৌতমবুদ্ধের অনুমতি নিয়ে ভিক্ষুদের দীক্ষিত করার একটি পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিলেন।

১. সন্ন্যাস গ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা গৌতমবুদ্ধ কিংবা অর্হৎ-দের কাছে, তাদের ইচ্ছার কথা নিবেদন করত।  দীর্ঘ আলাপ ও নানান প্রশ্নোত্তরে অর্হৎ-রা সন্তুষ্ট হলে, তবেই তাদের দীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হত।

২. দীক্ষা গ্রহণের শুরুতেই মুণ্ডন করতে হত মাথার চুল, দাড়ি ও গোঁফ। তারপর নদী বা সরোবরে স্নান করে, পরতে হত বিশেষ বস্ত্র। সাধারণ ধুতি-চাদরের মতো নয়, সেটি পরারও বিশেষ ধরণ ছিল – কাঁধ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত আবৃত থাকত সেই বসনে – শুধু ডান কাঁধ আর ডান হাত থাকত উন্মুক্ত। বসন পরার এই বিশেষ পদ্ধতি শিখতে হত দীক্ষা-রত সন্ন্যাসীদের।  

৩. এরপর দীক্ষাগুরুর সামনে নতজানু হয়ে বসত দীক্ষাপ্রার্থী সন্ন্যাসী, কমলপুটে তিনটি মন্ত্র তিনবার শপথের মতো উচ্চারণ করতে হত, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি”। যিনি আমায় জীবনের পথ দেখাবেন, আমি সেই বুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করলাম। যে আমায় উপলব্ধি ও ভালোবাসার পথ দেখাবে, আমি সেই ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করলাম। যে আমাকে সচেতন সহযোগীতার পথ দেখাবে আমি সেই সংঘের আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

৪. দীক্ষাগ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে, দীক্ষিতের প্রথম পাঠ নির্দিষ্ট মাপের ভিক্ষাপাত্র নিয়ে লোকালয়ে ভিক্ষা করা। ভিক্ষাপাত্র একবার পূর্ণ হলেই লোকালয় থেকে আশ্রমে ফিরতে হত। সেখানেই সকলের সঙ্গে বসে সেই ভিক্ষালব্ধ খাদ্য নিবিষ্ট মনে আহার করতে হত। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিক্ষা গ্রহণের এই প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান দিয়েই শুরু হত দীক্ষিতদের সাধনা। এই সাধনায় দীক্ষিতের অহংকার, লোভ ও ঔদ্ধত্য বিনাশ হয়, বাড়ে ধৈর্য এবং মানসিক স্থিতি।           

ঋষিপত্তন ছাড়ার আগে  গৌতমবুদ্ধ  শিষ্য অর্হৎ এবং ভিক্ষুদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন, “হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্যে, সমস্ত জীবের প্রতি সহমর্মীতা নিয়ে বিচরণ কর। একসঙ্গে দুজন নয়, একলা পথ চলো। আমিও এবার বের হবো – আমার উপলব্ধির আলো পৌঁছে দিতে হবে, রাজগৃহ নগর, উরুবিল্ব গ্রামের ঘরে ঘরে”। বুদ্ধদেব আষাঢ়ী পূর্ণিমায় যে ধর্মপ্রচার শুরু করেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই সেই প্রচারের রথ ধর্মচক্রে ভর করে দৌড়ে চলল গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকায়।  


চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নতুন পোস্টগুলি

ধর্মাধর্ম - ৩/৪

  ["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের তৃতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে " ধর্মাধর্ম - ৩/৩ " তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ পর্বাং...