[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে পড়া যায়, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাভক্ত ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগর ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। ভাগবৎ-পুরাণে মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়গুলিতে), তার বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ করাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য।]
এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্র থেকে - "এক যে ছিলেন রাজা - ২য় পর্ব"
৫
ভোজনের পর তিনজনে এসে বসলেন ঘরের দাওয়াতে। চারুকান্তি ঘর থেকে তিনটি উপাধান এনে দিয়ে গেল তিনজনকে। নিকোনো পরিচ্ছন্ন দাওয়ায় উপাধানে ভর দিয়ে আধশোয়া হলেন আচার্য যজ্ঞশীল। তাঁর বয়সে ভোজনের পর শরীর একটু বিশ্রাম চায়। আরামে তিনি চোখ বুজে রইলেন। বেদব্রত উপাধান নিয়ে আনমনে দেখতে লাগলেন অঙ্গনে একজোড়া কপোত-কপোতীর দাম্পত্য।
অনেকক্ষণ পর, আচার্য ধর্মধর খুব চাপাস্বরে বললেন, “গুরুদেব
কি তন্দ্রার্ত?”
আচার্য যজ্ঞশীল উত্তর দিলেন, “না, না। ধর্মধর, বলো”।
“সমালোচনা করা উচিৎ নয়, কিন্তু তাও বলি, আজকের এই
পরিস্থিতির জন্যে আমরাই কি দায়ী নই, গুরুদেব”?
“ঠিক কী কারণে, এমন বলছো, বলো তো, ধর্মধর?”
“মহারাজ অঙ্গ অপুত্রক ছিলেন, সে বরং ভালো ছিল। কিন্তু
তাঁর এই নরাধম পুত্রের জন্যেই তো, আজ আমাদের এই অবস্থা, গুরুদেব। আর সেই পুত্রের
জন্মের জন্যে দায়ী তো আমরাই”।
“সেই পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কথা বলছো, ধর্মধর? সেই যজ্ঞের
পরমান্ন খেয়ে মহারাণি সুনীথা, বেণের মতো এক কুলাঙ্গার পুত্রের জন্ম দেবেন, এটা
বুঝবো কী করে বলো দেখি! এই বেণকে দেখলে কেউ বলবে, যে এর পিতা মহারাজ অঙ্গ কী
অসাধারণ রাজা ছিলেন! রাজ্য পরিচালনায়, প্রশাসনে, প্রজাদের মঙ্গলের জন্যে তিনি সর্বদা
ব্যতিব্যস্ত থাকতেন! তোমরা তখন বালকমাত্র, তোমরা তো সেই সোনার দিনগুলি দেখনি। এমন
আদর্শ রাজার মৃত্যুর পর, কোন অযোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতে চলে যাবে এই রাজ্যের শাসনভার,
অথবা বিদেশী শত্রুদের আক্রমণে চুরমার হয়ে যাবে আমাদের সুন্দর এই জীবনযাত্রা, সেটা আমরা
চাইনি। রাজা অপুত্রক, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হতোই, মহর্ষি ভৃগু একদিন সিদ্ধান্ত
করলেন, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন”।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আচার্য যজ্ঞশীল যেন মনের মধ্যে
সাজিয়ে নিচ্ছিলেন, বছর কুড়ি আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাগুলি। তারপর আবার বললেন, “মহর্ষি
ভৃগুকে মহারাজ অঙ্গ অগ্রজের মতোই শ্রদ্ধা করতেন আবার ভালোও বাসতেন। গুরুদেব ভৃগুর
সঙ্গে পরামর্শ না করে কোন কাজই করতেন না। কিন্তু এই বংশরক্ষার ব্যাপারে মহারাজ
অঙ্গ গুরুদেবের সম্পূর্ণ অবাধ্য ছিলেন। একান্ত বৈঠকে বহুবার গুরুদেব মহারাজ অঙ্গকে
বোঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। মহারাজের একই কথা, এই জীবনে তিনি আর কোন
মায়ার বন্ধনে জড়াতে চান না। অগত্যা রাজবৈদ্য বসুমিত্রর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হল,
মহারাজ অঙ্গ ও রাণি সুনীথাকে যৌবনসঞ্জীবনী ওষধি প্রয়োগ করা হবে। এই ওষধি একই সঙ্গে
স্বামীস্ত্রী উভয়েরই সেবন করা উচিৎ, অন্যথায় হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু কীভাবে এই
প্রয়োগ সম্ভব? গুরুদেব ভৃগু তার উপায় ঠিক করলেন।
রাজা অঙ্গ ছিলেন স্বভাবতঃই ধর্মপ্রাণ, অতএব তাঁর কাছে পৌর্ণমাসী
যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করলে তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যাবেন। রাণি সুনীথা অধর্মের
পৌত্রী এবং মৃত্যুর কন্যা - কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, যে কোন নারীর কাছে
সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সম্মান হচ্ছে মাতৃত্ব, গুরুদেব ভৃগু এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। রাণি
সুনীথার উপস্থিতিতে গুরুদেব ভৃগু এই পৌর্ণমাসী যজ্ঞকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞে রূপান্তরিত
করার পরিকল্পনা করলেন”।
হাসতে হাসতে আচার্য বেদব্রত বললেন, “এর পরের ঘটনা আমরা
জানি, গুরুদেব। কারণ আমরাও সেই যজ্ঞে আপনার ও মহর্ষির সহকারী ছিলাম। যজ্ঞের
অগ্নিতে ঘৃতাহুতির সময় আমাদের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতায় আপনার কপট তিরষ্কারের কথা মনে
পড়লে আজও বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, গুরুদেব”।
আচার্য যজ্ঞশীল উচ্চ হাস্য করতে করতে উঠে বসলেন, বললেন, “গুরুদেবের
নিয়ন্ত্রণে সেদিন অমোঘ নিয়তির মতোই পরিকল্পনা মতো সব কিছু কী সুন্দর ঘটে গেল।
ভাবলে আজও অবাক লাগে। তোমাদের ইচ্ছাকৃত ভুলের আশ্চর্য ব্যাখা করলেন গুরুদেব। বললেন,
মহারাজ এই যজ্ঞের মুখস্বরূপ অগ্নিদেব আপনার ঘৃতাহুতি অস্বীকার করছেন। কারণ আপনি
অপুত্রক! হে মহারাজ, আপনি স্বয়ং তত্ত্বজ্ঞানী ধার্মিক, আপনি জ্ঞাত আছেন, অপুত্রক
ব্যক্তির পিতৃঋণ শোধ হয় না। আপনি এই পৌর্ণমাসী যজ্ঞের আয়োজনে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের
অনুষ্ঠান করুন। হে মহারাণি, আপনাদের অপত্যলাভ হলেই আপনারা পিতৃঋণ মুক্ত হয়ে
সার্থকজন্মা হয়ে উঠবেন”!
আচার্য ধর্মধর কিছুটা অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, “তখনকার
মতো সব সুন্দর ঘটে গেল ঠিকই, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ঐ দুর্ঘটনা না ঘটলেই ভালো হত”।
“না, না। ধর্মধর। ঘটনার কুড়ি বছর পরে, আজ তার ফলাফল দেখে,
আমাদের সেই কাজের দোষ গুণ বিচার করলে, তুমি ভুল করবে। আমি যদি বলি, এ সমস্তই
পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য, আমরা সকলে নিমিত্তমাত্র। কী উত্তর দেবে, তুমি? সেদিন কেন
রাজা অঙ্গ রাণির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অনুমতি দিয়েছিলেন?
পুত্রেষ্টি যজ্ঞের পরমান্ন তাঁর হাতে আমরা তুলে দিলাম, তিনি তো সেই পরমান্ন সেবা
নাও করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। মহারাজ অঙ্গের বংশরক্ষাও
হয়েছিল। কিন্তু ধর্মের ঔরসে অধর্মের গর্ভজাত সন্তানের মধ্যে, অধর্মভাব এত প্রবল
হবে, কারও পক্ষে এই অনুমান করা সম্ভব ছিল কি? দোষ আরোপ করে নিশ্চিন্ত হওয়ার সময়
এখন নয়, আমাদের এখন সমাধানের সূত্র খুঁজতে হবে!”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, আচার্য যজ্ঞশীল কিছুটা আত্মস্থভাবে
আবার বললেন, “আমাদের হাতেই যেন তৈরি, মহারাজ অঙ্গের সেই শিশুপুত্র বেণ দিন দিন বড়ো
হতে লাগল আমাদের সকলের চোখের সামনে। বাল্যকাল থেকেই সে হয়ে উঠল দুর্ধর্ষ দুরাচারী।
তার এক একটা কীর্তির কথা আমরা শুনতাম আর শিউরে উঠতাম। খেলায় পরাজিত হলে সে নিষ্ঠুরভাবে
হত্যা করেছে তার প্রতিপক্ষ সাথীকে। আতঙ্কিত সঙ্গী বালকরা তার সঙ্গে খেলায় সম্মত না
হলে, জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। কতো অসহায় প্রজা উৎখাত হয়ে চলে গেছে দূর
প্রদেশে, অন্য রাজ্যে! মৃগয়ায় নিষিদ্ধ জেনেও, বয়স্ক মৃগ ছেড়ে নিষ্ঠুরভাবে আহত
করেছে মৃগশিশুকে। ভয়-ব্যাকুল
বিকলাঙ্গ মৃগশিশুদের অকারণ দৌড় করিয়ে সে হেসেছে হা হা করে। সমস্ত নিষিদ্ধ খাদ্যেই
তার ছিল আশ্চর্য অভিরুচি। নির্দিষ্ট ধর্ম অনুষ্ঠানে অনাচার করাই ছিল একমাত্র
কর্তব্য। ধর্মভীরু প্রজাদের আতঙ্কে সে অট্টহাস্যে হেসেছে। এক কথায় সকল প্রকার
অনৈতিক অনাচারেই তার আগ্রহ চিরকাল!
এইভাবেই সে বড়ো হয়ে উঠল। তার চারপাশে জড়ো হতে লাগল পাষণ্ড
স্তাবকের দল। সকলেই সমান অনাচারী ও অত্যাচারী পিশাচ। আর আমাদের ধার্মিক রাজা, যাঁর
সুবিচারে আমরা সবাই বিশ্বস্ত ছিলাম, আশ্বস্ত ছিলাম, গর্বিত ছিলাম। তিনি অন্ধ হয়ে
রইলেন পুত্রের প্রতি। পুত্রের অত্যাচারে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাদের অর্থ দিয়ে ক্ষতিপূরণ
করলেন। কিন্তু পুত্রকে
শাসন কিংবা তার শাস্তিবিধানের কোন চেষ্টাই করলেন না কোনদিন। নিজের এই দুর্বলতা
সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। মাতা সুনীথার অন্ধ স্নেহে পুত্র বেণ ও তার
দুরাচারী মিত্রদের প্রতাপ যত বাড়তে লাগল, রাজকার্যে মহারাজ অঙ্গ ততই নিস্পৃহ হয়ে
উঠলেন। রাজকার্য থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সর্বদাই মগ্ন হয়ে রইলেন দেবপূজায়।
এরপর ধীরে ধীরে এসেই গেল সেই সংকটের দিন। মহারাজ অঙ্গ কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ চলে
গেলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। সে কী আত্মধিক্কারে, অনুশোচনায়? কোথায় গেলেন তিনি,
বাণপ্রস্থে? এতদিনেও কেউ তাঁকে দেখতে পেল না কেন? নাকি এ রাজ-অন্তঃপুরেরই কোন
অভাবনীয় মর্মান্তিক চক্রান্ত? মহারাজ অঙ্গের মতো মানুষের এমন রহস্যময় অন্তর্ধান!
চিন্তা করা যায় না, ধর্মধর।
মহারাজা অঙ্গের অকস্মাৎ এই অন্তর্ধানে, যুবরাজ বেণের সিংহাসনে
অভিষেক ছাড়া, সে সময় আর কোন উপায় রইল না। বেণ রাজা হলে সাধারণ রাজ্যবাসীর সমূহ
সর্বনাশ জেনেও, আমাদের মেনে নিতেই হল সেই অভিষেক। আজ যে ঘোষণার ফলে আমরা সকলে
বিচলিত, রাজা বেণের পক্ষে এই ঘোষণা এতটুকুও আশ্চর্যের নয়। মহারাজ অঙ্গের পুত্র
রাজা বেণ আবাল্য দেবপূজা, যজ্ঞ-পার্বণ ও সনাতন-ধর্ম আচরণের বিরুদ্ধে।
প্রায় দেড় বছর হতে চলল রাজা বেণ সিংহাসন লাভ করেছে।
মহারাজ অঙ্গের সমস্ত নির্দেশ, আদেশ, রীতিনীতি ভেঙে সে ক্রমাগত রাজ্যশাসন পদ্ধতির পরিবর্তন
করে চলেছে। যতদিন যাবে, সে মুছে দেবে এই রাজ্যের সমস্ত সনাতন রাজধর্ম। অত্যাচার,
অবিচার, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি হবে এই রাজধর্মের সমার্থক। হত্যার আতঙ্কে রুদ্ধ হতে থাকবে
প্রতিবাদের স্বর, সমালোচনার কণ্ঠ। রাজ্য জুড়ে দেখা দেবে মাৎস্যন্যায়। রাজার
স্নেহধন্য ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা মুখ বুজে সহ্য করতে হবে সাধারণ প্রজাদের”।
বেশ কিছুক্ষণ পর আচার্য ধর্মধর অস্ফুটস্বরে বললেন, “এই
পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের কী কোন উপায় নেই, গুরুদেব”?
আচার্য যজ্ঞশীল পূর্ণ প্রত্যয় নিয়ে উত্তর দিলেন, “উপায়
বের করতেই হবে, বৎস ধর্ম। নিশ্চেষ্ট ঘরে বসে হা হুতাশ করব, ভাগ্যের অজুহাতে মেনে
নেব এই অন্যায়, এ হতেই পারে না। সফল হই কিংবা ব্যর্থ, চেষ্টা করতেই হবে। এই রাজার
পতন চাই, এ ছাড়া অন্য আর কোন পন্থা নেই”।
আচার্য বেদব্রত অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কীভাবে,
গুরুদেব”?
আচার্য যজ্ঞশীল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় নাড়লেন, তারপর
বললেন, “জানি না, বেদ। আগামীকাল
আমরা সকলেই মহর্ষি ভৃগুর আশ্রমে যাবো, তিনি কী চিন্তা করছেন দেখা যাক। ওই অসাধারণ
মানুষটির মুখের দিকেই এখন মানুষ তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ আর বিলম্ব করো না। কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে বৈকাল
সমাগত। তোমরা ঘরে ফিরে যাও। দিনকাল ভালো নয়। কাল মহর্ষির আশ্রমেই আমাদের আবার দেখা হবে। ঈশ্বর
তোমাদের রক্ষা করুন”।
আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত গুরুদেব যজ্ঞশীলের চরণ স্পর্শ
করে যখন বিদায় নিলেন, রিক্ত-তেজ সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে।
৬
সঙ্গীতের তুলনায় নৃত্যেই মহারাজা বেণের অত্যন্ত আসক্তি।
নৃত্যের অনুষঙ্গে নারীর উপস্থিতি অনিবার্য। অতএব নৃত্য পটিয়সী নিত্যনূতন নারীতেও
তাঁর অত্যন্ত অভিরুচি। নগরবিলাসিনী এই রূপসী নারীরা শুধু যে নৃত্যকলায় দক্ষ, তা
নয়। আলাপ-আলোচনায় বিদূষী ও বিদগ্ধা, আচার-আচরণে অত্যন্ত সম্ভ্রান্তা, অথচ নম্র এবং
বিনীতা। সাধারণ গৃহরমণীর মধ্যে এই গুণবত্তা একান্তই বিরল। তাঁর পরিচিত
রাজকুমারীদের মধ্যে অনেকেই সুন্দরী, অনেকেই উচ্চশিক্ষিতা এবং আচরণে অত্যন্ত
সম্ভ্রান্তা, কিন্তু তাঁরা সকলেই অত্যন্ত অহংকারী ও দুর্বিনীতা। অন্যদিকে সাধারণ
নারী সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা, দেবদ্বিজে অত্যন্ত ভক্তিপ্রাণা এবং মাত্রাতিরিক্ত
বিনয়ী। তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা, বিড়ম্বনার নামান্তর। মহারাজা বেণ একজন
রূপসী নগরনটী ভিন্ন সমস্তগুণের এমন সুসমঞ্জস সমাহার, অন্য কোন নারীর মধ্যেই খুঁজে
পান না। রহস্যময়ী এই নারীদের সঙ্গ তাঁকে অত্যন্ত তৃপ্ত করে।
নটী বিদ্যুল্লতা ভিন্ন রাজ্যের অধিবাসিনী হলেও, তাঁর রূপ
ও গুণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। মহারাজ বেণের কানেও সে খ্যাতির সংবাদ পৌঁছে
গেছে বহুদিন আগেই। এতদিন সাক্ষাৎ হয়নি, কারণ নটী বিদ্যুল্লতা জানতেন, এই রাজ্যের
রাজা অঙ্গ অত্যন্ত ধার্মিক ও ঈশ্বর পরায়ণ। খুব স্বাভাবিক কারণেই, ঈশ্বরপরায়ণ প্রৌঢ়
রাজার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহ, নটী বিদ্যুল্লতা অনুভব করেননি। অধুনা তিনি
জানতে পেরেছেন, সেই পরমধার্মিক মহারাজা অঙ্গ রহস্যজনক বাণপ্রস্থে গিয়েছেন। এখন এই
রাজ্যের সিংহাসনে বসেছেন তাঁর পুত্র যুবরাজ বেণ। এও শুনেছেন মহারাজ বেণ নৃত্যের
পূজারী, কিন্তু কোন ধর্মের কিংবা দেবতার পূজায় বিশ্বাস করেন না।
কয়েকদিন আগে, অত্যন্ত গোপন এক আমন্ত্রণ পেয়ে, নটী
বিদ্যুল্লতা এ রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁর গন্তব্য ছিল অন্যত্র। অন্যদিকে এই
রাজ্যে তাঁর প্রবেশের সংবাদ পেয়ে, মহারাজ বেণ রাজদূত পাঠিয়েছিলেন। মহারাজ বেণ যে
নটী বিদ্যুল্লতার সাক্ষাৎপ্রার্থী, সে কথা রাজদূতের মুখে শুনে, তিনি গন্তব্য
পরিবর্তন করেছেন। গতকাল অপরাহ্নে তিনি রাজধানীতে এসে পৌঁছেছেন। রাজাবেণের প্রাসাদের
সর্বোত্তম অতিথিশালায় আতিথ্য স্বীকারের জন্য, রাজা বেণ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বার্তা
পাঠিয়েছিলেন নটী বিদ্যুল্লতাকে। নটী বিদ্যুল্লতা তার প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিলেন,
তিনিও রাজা বেণের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য অত্যন্ত উদ্গ্রীব! স্থির হয়েছে, আজ সন্ধ্যায়
প্রাসাদের প্রমোদভবনে, মহারাজা বেণের সঙ্গে রূপসী নটী বিদ্যুল্লতার সাক্ষাৎ পরিচয়
হবে। মহারাজ বেণ অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন, কেমন হবে নটী বিদ্যুল্লতার সঙ্গে
তাঁর এই প্রথম সাক্ষাৎ!
মহারাজা বেণ আজও সকালে তাঁর উদ্যানবাটিকা পরিদর্শনে
গিয়েছিলেন। রাজ পথ নির্মাণের কাজ চলছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। উপনগরপাল শক্তিধর
অত্যন্ত দক্ষতায় বাড়ি ভাঙার কাজ ও সেখান থেকে উপাদান সরবরাহের কাজ পরিচালনা করছেন।
বাড়ি ভাঙার কাজে লিপ্ত আছে দেড়শতাধিক কর্মী এবং উপাদান সরবরাহ করে চলেছে শতাধিক
শকট। কাজের প্রগতিতে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। আজ পরিদর্শন থেকে ফেরার পথে তাঁর মনে
হল, এই উদ্যানবাটিকার উদ্বোধন নটী বিদ্যুল্লতার করকমলে হলে কেমন হয়? করকমল এবং
চরণকমলও! এই উদ্যানবাটিকার নৃত্যশালায়, প্রথম নৃত্যের অনুষ্ঠান হবে নটী
বিদ্যুল্লতার – এর চেয়ে ভালো শুভারম্ভ আর কী হতে পারে? এই ভাবনার কথা তিনি অন্য
কাউকে বলেননি, তিনি আজ নিজেই নটী বিদ্যুল্লতাকে এই আমন্ত্রণ জানাতে চান।
আসন্ন সাক্ষাতের রোমাঞ্চে তিনি এখন নিমগ্ন। নিজেকে
রাজসিক সম্ভ্রান্তিতে সাজিয়ে তোলাই, এখন তাঁর কাছে সব থেকে জরুরি বিষয়। রাজসিক
আচার আচরণে, নৃত্যকলার সূক্ষ্ম বিচারে, রসালাপে, তিনি বিস্মিত করে দিতে চান নটী
বিদ্যুল্লতাকে। এই ভারতের বহু রাজার প্রশংসায় ধন্যা, নটী বিদ্যুল্লতার মুগ্ধ নয়নের
ভাষায় তিনি পড়ে নিতে চান, সেই আকাঙ্ক্ষিত বার্তাটি - মহারাজা বেণ রাজা হিসাবে,
ভূভারতে অনন্য।
ইষদুষ্ণ সুগন্ধী জলে স্নান করে এসে, তাঁর খাস ভৃত্যেরা
তখন তাঁর গায়ে চন্দন তেল ও অগুরু চর্চা করছিল। অর্ধ শায়িত আরামে তিনি উপভোগ
করছিলেন নিজ অঙ্গের সুবাস ও দক্ষ ভৃত্যদের অঙ্গ সংবাহন। তিনি নিমীলিত চোখে চিন্তা
করছিলেন আসন্ন সন্ধ্যার অভূতপূর্ব রমণীয়তা। এমন সময়ে ধীর পায়ে তাঁর কক্ষে প্রবেশ
করলেন রাজমাতা সুনীথা, তাঁর সঙ্গে এলেন তাঁর নিজস্ব দাসী পদ্মবালা। এই দাসী মহারাজা
বেণের ধাত্রীমাতাও, আশৈশব বেণকে তিনিই মানুষ করে তুলেছেন। মহারাজা বেণের ভৃত্যের দল নত হয়ে
প্রণাম করল রাজমাতাকে এবং সরে দাঁড়াল কক্ষের অন্য প্রান্তে। নটী বিদ্যুল্লতার
চিন্তায় মগ্ন মহারাজা বেণ, শরীরে ভৃত্যদের করস্পর্শ না পেয়ে, চোখ মেলে তাকালেন, আর
তখনই দেখতে পেলেন মাতাকে।
অত্যন্ত অসময়ে নিজের কক্ষে মাতাকে দেখে প্রসন্ন হলেন না
মহারাজা বেণ, তিনি উঠে বসে বললেন, “প্রণাম, মাতঃ। এই অসময়ে তুমি আমার কক্ষে? আমাকে
ডেকে পাঠালেই পারতে!”
“মঙ্গল হোক বৎস, কিছুক্ষণ আগে কিছু অদ্ভূত সংবাদ শুনে
স্থির থাকতে পারলাম না। জানি আজ প্রমোদ কাননে তোমার বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি
চলছে, তাও আসতে বাধ্য হলাম”।
“কী এমন সংবাদ, মাতঃ, যার জন্যে তুমি এমন বিচলিতা হলে?”
“তুমি নাকি কিছুদিন আগে শ্রীবিষ্ণুমন্দিরের পুরোহিত
বৃদ্ধ বিষ্ণুদাসকে কষাঘাতে জর্জরিত করে, রাজপথের স্তম্ভে বেঁধে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলে?
তাঁর অপরাধ তিনি তাঁর ধর্ষিতা কন্যার জন্য বিচার চাইতে এসেছিলেন! এবং অভিযোগ সেই
ধর্ষণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিল তোমার বাল্যবন্ধু শক্তিধর, যে এখন তোমার প্রসাদে এই
রাজ্যের উপনগরপাল?”
“এ সংবাদ সত্য। কিন্তু শক্তিধর এই ঘটনায় লিপ্ত নয়”।
“কী ভাবে জানলে, পুত্র বেণ? তুমি কি অনুসন্ধান করেছিলে?”
“না, অনুসন্ধান করার প্রয়োজন অনুভব করিনি। কারণ শক্তিধর
অত্যন্ত বিশ্বস্ত। আর যদি শক্তিধর অপরাধী হয়েও থাকে, সামান্যা এক দুশ্চরিত্রা
রমণীর জন্যে শক্তিধরকে ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শক্তিধর আমার প্রশাসনের
স্তম্ভ”।
“অনুসন্ধান ছাড়াই তুমি কী করে বুঝতে পারলে, বৎস, যে ওই
কন্যা দুশ্চরিত্রা? আজ সন্ধ্যায় যার সঙ্গে মিলনের জন্যে তুমি উন্মুখ হয়ে আছো, সেও
কি দুশ্চরিত্রা নয়? নটী বিদ্যুল্লতাকে যদি তোমার প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অনেকে মিলে
ধর্ষণ করে, তুমি কি তাদেরও কোন বিচার করবে না, পুত্র?”
রাজমাতার এই প্রশ্নে তীব্র জ্বালা অনুভব করলেন মহারাজা
বেণ, ক্রোধে অগ্নিস্রোত বইতে লাগল শিরায় শিরায়। ক্রোধ সংবরণ করে, তিনি তীব্র চোখে
মাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নটী বিদ্যুল্লতার সঙ্গে আমি এমন ঘটতে দেব না, মাতঃ। আর
ঘটলেও অপরাধীদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করবো, সে যেই হোক না কেন!”
“অতএব, তোমার বিচার আসলে নিজের স্বার্থরক্ষা। তুমি দুর্বলের উপর অত্যাচারী এবং
সবলের অনুগত। তুমি বিলক্ষণ জানো নটী বিদ্যুল্লতা যে রাজার পালিতা কন্যা ও যে
রাজ্যের নাগরিকা, তার কিছু হলে, তাঁরা তোমার রাজত্ব বিপন্ন করে তুলবেন। আর সেই
কারণেই তুমি এই দুশ্চরিত্রা নটীকে রক্ষা করবে, আর দুশ্চরিত্রা নয় বুঝেও তুমি
দুর্বল ব্রাহ্মণকন্যার কোন বিচার করবে না”।
ক্রুদ্ধস্বরে মহারাজা বেণ প্রশ্ন করলেন, “সেই বৃদ্ধ এখন মৃত,
মৃতা সেই নারীও। এতদিন পরে তুমিই বা কী করে জানলে, যে ওই ব্রাহ্মণকন্যা অসতী নয়?”
মহারাজা বেণের এই কথার উত্তর না দিয়ে রাজমাতা সুনীথা
নিজের মনেই বললেন, “আমার পিতার নাম মৃত্যু। আমার পিতামহ অধর্ম। শুনেছি, ভগবান
বিষ্ণুর প্রজাসৃষ্টির আদেশে স্বয়ং ব্রহ্মার পিঠ থেকে আমাদের বংশের সৃষ্টি। পূজা-পার্বণ-ব্রত-যজ্ঞ পালনের যে
ধর্ম, সে ধর্ম আমরা মানি না। সেই কারণে সমাজের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় আমাদের অধর্ম
বলে থাকেন। কিন্তু তাঁরা কদাচ আমাদের অনাচারী, অত্যাচারী, দুরাচারী বলেননি। কিন্তু
এখন থেকে বলবেন! পুত্র, তোমার এই বীভৎস দুরাচারে স্বয়ং অধর্মও শিউরে উঠবে।
আরো শুনলাম, তোমার প্রমোদবাটিকা যাবার পথের সংস্কারের
জন্য তুমি অজস্র গৃহস্থকে গৃহহারা করেছ? তাদের ভাঙা বাড়ির পাথর ও ভাঙা ইঁটের টুকরো
বিছিয়ে বানিয়ে তোলা মসৃণ পথে তোমার বিলাসের রথ দৌড়বে! মহারাজ অঙ্গের পুত্র হয়ে
তুমি এমন কদর্য অত্যাচারের কথা কী করে ভাবতে পারলে, পুত্র? ওই গৃহহারা মানুষগুলির
পুনর্বাসনের কথা কিছু চিন্তা করেছ?”
ক্রুদ্ধ বিরক্ত মহারাজা বেণ উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, “তুচ্ছ
এই সব ঘটনার কথা কে তোমার কানে তুলছে, মাতঃ। এ রাজকার্য, এ রাজ-সিদ্ধান্ত। তুমি
অন্তঃপুরিকা নারী, রাজকাজে হস্তক্ষেপ অথবা
সে সম্পর্কে অনভিপ্রেত মন্তব্য আমার সহ্য হয় না, মাতঃ। এ আমার বিরুদ্ধাচরণ, এ আমার
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! একজন রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অর্থাৎ রাজদ্রোহিতা। অত্যন্ত আপনজন হলেও রাজদ্রোহিতা
আমি কোনভাবেই সহ্য করবো না”।
পুত্র মহারাজা বেণের এই সতর্কবার্তায়, রাজমাতা সুনীথা
বিষণ্ণ হাসলেন, বললেন, “তোমার পিতাকে আমি তিরিশ বছরের অধিক রাজত্ব করতে দেখেছি,
পুত্র। একদিনের জন্যেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন নিন্দাবাক্য শুনিনি। তুমি মাত্র দেড় বছর,
তাঁর সিংহাসনে বসেছ, তোমার নামে নিত্য নতুন অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে
উঠছি! কিছুদিন আগেও অসহায় প্রজারা আমার কাছে আসত সুবিচারের আশায়, সুবিচার না
পেলেও, অন্ততঃ একটু সহানুভূতির আশায়! বেশ কিছুদিন হল, তারা আর আসে না। হয়তো তারা মনে
করে আমি প্রত্যক্ষভাবে নাহলেও পরোক্ষে তোমাকেই সমর্থন করি”।
অত্যন্ত ক্রুর চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে মহারাজা বেণ
বললেন, “তার মানে তুমি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোন ভাবেই আমাকে সমর্থন করো না!
আমাকে পুত্র হিসাবে তুমি সমর্থন করলে কিংবা না করলে তাতে খুব ইতর বিশেষ হয় না!
কিন্তু মহারাজ বেণের প্রতি তোমার সমর্থন নেই এবং সে কথাটা স্বীকার করতেও তোমার ভয়
করলো না, এটা ভয়ংকর। এ নিয়ে
আমরা পরে আলোচনা করব, মাতঃ, এখন আর সময় নেই, তুমি এখন আসতে পারো। এক বিশেষ অতিথির
সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় আমার সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট আছে”।
“সেই বিশেষ অতিথি তো সুন্দরী সতী বিদ্যুল্লতা, না”?
রাজমাতা সুনীথার কণ্ঠে তীব্র শ্লেষ।
আচমকা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মহারাজা বেণ, তীব্র হুংকারে বলে
উঠলেন, “চুপ করো দুর্বিনীতা রমণী। মনে কোর না, শুধু মাত্র রাজমাতা বলেই তুমি যা
খুশি বলে যাবে, আর আমিও নিশ্চেষ্ট বসে থাকব! মহারাজা বেণ বিরুদ্ধাচরণ এবং অযাচিত
উপদেশ কোনটাই সহ্য করে নি, করবেও না। সে মহারাজ অঙ্গই হোক কিংবা তুমি !”
মহারাজ বেণের এই কথায় শিউরে উঠলেন রাজমাতা সুনীথা।
বিস্ফারিত নেত্রে পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে কী তুই পিতা মহারাজ অঙ্গকে
হত্যা করে, এই সিংহাসন অধিকার করেছিস?”
এতক্ষণ রাজমাতা ও মহারাজা বেণের আলাপে, দাসী পদ্মবালা
কোন কথাই বলে নি, এখন ব্যাকুল হয়ে বলল, “মহারাণি, তোমরা দুজনেই এখন অত্যন্ত
উত্তেজিত। উত্তেজনার বশে মানুষ স্বাভাবিক বিবেচনা হারায়। এই কক্ষের মধ্যে অনেক
দাসদাসী রয়েছে, তারা সকলেই এই আলোচনা শুনছে। আমাদের উচিৎ এই মূহুর্তে এই কক্ষ
ত্যাগ করে চলে যাওয়া। উত্তেজনার প্রশমন হলে, শান্তভাবে এই আলোচনা পরে কোনোদিন আবার
করা যাবে”!
মহারাজা বেণ দাসী পদ্মবালার কথায় কিছুটা শান্ত হলেন,
তিনি ওঁদের দুজনের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজমাতাকে বিদায় প্রণাম জানানোর
কথা তাঁর মনেও এলো না। রাজমাতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পুত্রের চওড়া বলিষ্ঠ কাঁধের
দিকে, তারপর কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন। তাঁর দু চোখে তখন অশ্রুর ধারা।
৭
বিস্তৃত এই মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই চোখ
জুড়িয়ে যায়, অন্তরে প্রশান্তির অনুভব আসে। গাছপালা,
লতাগুল্ম, ফুলের গন্ধ, ভ্রমরের গুঞ্জন সব কিছু মিলিয়ে উপবনের পরিবেশ। গাছের ছায়াঘন
এই উপবনের মধ্যেই শিষ্যদের পাঠঘর, গ্রন্থাগার, শিষ্য ও শিষ্যাদের আলাদা আবাস।
আচার্য ও অন্যান্য অধ্যক্ষদের আবাসও আছে এই মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। সেখানে তাঁরা
অনেকেই সপরিবারে থাকেন। তাঁদের পুত্রকন্যারা এই মহাবিদ্যালয়ের আশেপাশের অন্য
পাঠশালায় পড়তে যায়। ভিন্ন রাজ্য থেকে অথবা এই রাজ্যেরই দূরাগত অতিথিদের জন্যেও
অনেকগুলি আবাস আছে। তবে
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যখন একই সঙ্গে অনেক সম্মানীয় মানুষজনের সমাগম ঘটে, তখন তাঁদের
জন্য আলাদা করে অস্থায়ী শিবির বানিয়ে দিতে হয়। এই উপবনের মধ্যে সে জায়গাও আলাদা
করে রাখা আছে। কোন সময়ে, কোন কারণেই এই মহাবিদ্যালয়ে শৃঙ্খলার কোন বিচ্যুতি ঘটে
না।
শিষ্যদের আবাসের পিছনে আছে পাকশালা। সেখানে আবাসিক
ছাত্র, ছাত্রীদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা। আবাসিক অধ্যক্ষদের যাঁরা সপরিবারে বাস
করেন না, তাঁরাও এই যৌথ পাকশালার রন্ধনই আহার করেন। দূরাগত অতিথিদের জন্যও এই
পাকশালা থেকেই আহারের বন্দোবস্ত হয়ে থাকে। এই মহাবিদ্যালয়ের মহাপাকশালায় অহোরাত্র
যে অদ্ভূত কর্মযজ্ঞ চলে, তা অত্যন্ত আশ্চর্যের!
পাকশালার বামদিকে সারি সারি গোলায় এই আশ্রমের
শস্যভাণ্ডার। সেইসব গোলায় সঞ্চয় করা থাকে গোধূম, ব্রীহি, নানান ধরনের ডাল, মটর, চণক,
তিল, সরিষা, এরণ্ড ইত্যাদি শস্য। সূর্যোদয় থেকেই বলদে টানা সারিসারি যাঁতাকলে ঘরঘর
শব্দে শস্য চূর্ণ হয়, কাষ্ঠ-ঘানিতে প্রস্তুত হয় তেল। সারি সারি ঢেঁকির একটানা
ছন্দে ব্রীহি থেকে বের হয়ে আসে তণ্ডুল দানা। মহিলা কর্মীদের কুলোর একটানা সপ-সপ
শব্দে, ডালের ভূষি, ধানের তুষ ঝেড়ে বের হয়ে আসে পরিচ্ছন্ন খাদ্য শস্য। তিল ও সরষে
থেকে উৎপন্ন তেল প্রধানতঃ ব্যবহার হয় রান্নার জন্যে এবং প্রসাধনের জন্যে। রেড়ি
থেকে উৎপন্ন তেলে সন্ধের পর দীপ জ্বালানো হয়। গমের চূর্ণে জল দিয়ে কাঠের বিশাল
পাত্রে মণ্ড বানায় কিছু লোক। কিছু লোক মণ্ড থেকে কাঠের চাকি বেলুনে পুরোডাশ বেলেই
চলেছে সারাটাদিন। কিছুলোক আগুনের চুল্লিতে সেই পুরোডাশ নিরলস সেঁকে চলেছে।
অন্যদিকে লোহার কিংবা তামার বড় বড় পাত্রে, রান্না হচ্ছে ডাল, ভাত, সবজি। রুটি সবজি
ডাল সাধারণের জন্যে। ভাতের পরিমাণ অল্প, সম্মানীয় অতিথি কিংবা অসুস্থ আবাসিকের
পথ্যের জন্য।
পাকশালা থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণদিকে রয়েছে বিশাল
গোশালা। বহুবছর আগে মহারাজ অঙ্গ আটশটি গরু ও মহিষ এই আশ্রমকে দান করেছিলেন। এই
আশ্রমে প্রতিপালিত হতে হতে তাদের সংখ্যা এখন দুই সহস্রেরও অধিক। এই গাভীদের
পরিচর্যা করে দক্ষ গোপজন। প্রত্যেকদিন সকালে, বিকালে যে দুধ উৎপন্ন হয়, তার
অনেকটাই আহারের জন্যে ব্যয় হয়। বাকি দুধ থেকে তৈরি হয়, ঘি, মাখন ও দধি। আশ্রমে
উৎপন্ন শস্যের ভূষি, খোল, ভাতের ফ্যান, আনাজের খোসা, কিছুই ফেলা যায় না, গবাদির
খাদ্যে ব্যবহৃত হয়।
এই বিশাল আয়োজনের অধিকাংশ উপাদানই আসে আশেপাশের দুইশত
গ্রাম থেকে। মহারাজা অঙ্গ এই গ্রামগুলি আশ্রমকে নিষ্কর দান করেছিলেন। সেই সকল
গ্রামে উৎপন্ন যাবতীয় শস্য ও পণ্যের এক পঞ্চমাংশের অধিকারী এই আশ্রম। ওই সমস্ত
গ্রাম থেকে যেমন খাদ্য শস্য আসে, তেমনই আসে জ্বালানি কাঠ, গবাদি পশুর খাদ্য বিচালি
খড়, কুমোরের তৈরি মাটির তৈজসপত্র, কামারের তৈরি নানান সরঞ্জাম। সূত্রধরের তৈরি
কাঠের আসবাব, তাঁতির তৈরি বস্ত্র, উড়নি, গামছা। আশ্রমের সদর প্রবেশ পথ ছাড়াও আরো
একটি প্রবেশ পথ আছে। সে পথ সাধারণের জন্যে নয়। সে পথে সারাদিন গোশকট ও অশ্ব-শকটের
জটলা। আশ্রমের প্রয়োজন অনুযায়ী, দূর দূর গ্রাম থেকে তারা বয়ে আনে শস্য, সব্জি,
কিংবা নানান পণ্য। সে প্রবেশ পথের দায়িত্বে থাকেন আশ্রমের দক্ষ করণিকগণ। তাঁরা
হিসাব রাখেন, কোন গ্রাম থেকে কোন ব্যক্তি কী কী সম্ভার পাঠালো। এই আশ্রমের আয় ও
ব্যয়ের যাবতীয় হিসাব রাখতে তাঁরা সর্বদা তৎপর। এই দক্ষ করণিকদের মধ্যে বেশ
কয়েকজন আছেন, যাঁরা সারা বছরই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ান উৎপন্ন শস্য ও
পণ্যের পরিমাণ গণনা করতে। আশ্রমের প্রাপ্য অংশের আদায় এবং অনাদায়ী শস্য ও পণ্যের
পরিমাণ ও অনাদায়ের কারণ বুঝতে।
বিপুল এই মহাবিদ্যলয়ের কর্মকাণ্ড সম্যক না জানলে, এর
ব্যাপ্তি বুঝে ওঠা যায় না। প্রত্যেকটি বিভাগের জন্যেই একজন করে অধ্যক্ষ ও
সহ-অধ্যক্ষ নিযুক্ত আছেন এবং সবার উপরে আছেন মহর্ষি ভৃগু। প্রত্যকটি বিভাগের
দায়িত্বে থাকা কর্মীদের তিনি স্বাধীন কাজ করার প্রশ্রয় দেন, অথচ সকলের উপরেই থাকে
তাঁর ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন
সূত্র থেকে তিনি গোপনে নানান তথ্য সংগ্রহ করেন। এই আশ্রমের প্রাঙ্গণে, বাইরের দুইশত
গ্রামে, এমনকি সমস্ত রাজ্যের প্রত্যেক প্রান্ত থেকেই তিনি গোপনে নিয়মিত তথ্য ও
বার্তা পেয়ে থাকেন তাঁর অনুগত শিষ্যদের থেকে। তাঁর গোপনে পাওয়া এই তথ্যের সঙ্গে
তিনি মিলিয়ে নেন তাঁর আশ্রম-করণিকদের তথ্যসমূহ। খরা, বন্যা কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক
দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের থেকে তিনি আশ্রমশুল্ক আদায়ের নিয়ম শিথিল করেন। কোন
কোন দুর্নীতিগ্রস্ত করণিক উৎকোচ গ্রহণ করে, অথবা ভয় দেখিয়ে অতিরিক্ত শুল্ক আদায়
করে। কিংবা আদায় হওয়া শুল্ক নিজেই আত্মসাৎ করে কোন কোন করণিক। সে তথ্যও তাঁর কাছে
চলে আসে নিয়মিত। প্রয়োজন মতো দোষী করণিকের কঠোর
শাস্তিবিধান তিনিই করেন।
এই মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনা এক অর্থে ছোট একটি রাজ্য
পরিচালনার মতোই জটিল। আর এই জটিল কর্মকাণ্ডটি ঘটে চলেছে মহর্ষি ভৃগুর বিচক্ষণ
পরিচালনায়। সেই কারণেই এই মহাবিদ্যালয়ের এতো সুনাম ও সাফল্য।
৮
পরের দিন সকালে আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত যখন মহর্ষি
ভৃগুর গৃহদ্বারে এসে দাঁড়ালেন, মহর্ষি ভৃগু তখন কক্ষেই ছিলেন, কিন্তু তাঁর
নির্দিষ্ট আসনে বসেননি। তাঁর আসনের সামনে তিনি পদচারণা করছিলেন। পিছনের দিকে একহাতে অন্য হাতটি
ধরে তিনি কোন আলোচনায় ব্যস্ত। আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত দরজায় অপেক্ষমাণ রইলেন,
মহর্ষিকে বিরক্ত করলেন না। কক্ষের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পদচারণার পর, মহর্ষি যখন
ঘুরে দাঁড়ালেন, দেখতে পেলেন ওঁদের দুজনকে। হাসিমুখে বললেন, “আরেঃ, ধর্মধর,
বেদব্রত, কতক্ষণ এসেছ? দ্বারে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসে বসো”।
তাঁরা মহর্ষির চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলেন, স্মিত মুখে
মহর্ষি আশীর্বাদ করে বললেন, “তোমরা দীর্ঘজীবি হও। গৃহের সব সংবাদ কুশল তো?”
আচার্য বেদব্রত বললেন, “আজ্ঞে হ্যাঁ, গুরুদেব”।
“বেশ, বেশ। যাও, আসনে বস। তোমাদের গুরু যজ্ঞশীল তো আগেই
এসে পড়েছেন”।
অনেকের মধ্যে জায়গা বের করে আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত
আসনে বসলেন। মহর্ষি ভৃগু স্মিতমুখে তাঁদের আসনে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। কক্ষে
উপস্থিত সকলে তাঁর কথা শোনার জন্যে উন্মুখ।
সকলের মুখের দিকে একবার দেখে, মহর্ষি বললেন, “রাজার
আদেশে তোমরা সকলে বিচলিত, আমি জানি। আমিও
বিচলিত। আমি কিন্তু কোন হঠকারি সিদ্ধান্তের পক্ষপাতী নই। আমি চাই না, আমার একজনও
শিষ্য কারার অন্তরালে তার জীবন অতিবাহিত করুক অথবা আমার কোন শিষ্যের প্রাণদণ্ড হোক। এখানে উপস্থিত এবং অনুপস্থিত সকল
শিষ্যই আমার অত্যন্ত প্রিয়, আমার সন্তানের মতো। এমন কী আমার শিষ্য নয়, কিন্তু এই
রাজ্যের অধিবাসী সাধারণ মানুষও রাজার কোপ-দৃষ্টিতে পড়ে অত্যাচারিত হোক, এ আমি চাই
না”।
কিছুক্ষণ নির্বাক পদচারণার পর, মহর্ষি আবার বললেন, “প্রজা
হিসাবে, রাজার আদেশ পালন করা আমাদের সকলেরই অবশ্য কর্তব্য। না হলে প্রজাদের সমূহ
সর্বনাশের সম্ভাবনা। প্রজাদের অকল্যাণে রাজারও ক্ষতি, এই বোধ আমাদের বর্তমান রাজার
নেই। অতএব, আমাদের রাজার আদেশ মান্য করা ছাড়া আপাততঃ অন্য কোন উপায় নেই। এ আমাদের
দুঃসময়। ঘোরতর দুঃসময়। কিন্তু ধৈর্য ধরে অনুকূল সময়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে
হবে। যতদিন সেই অনুকূল সময় না আসে, আমাদের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধির বিরুদ্ধে হলেও,
রাজার আদেশ আমাদের পালন করতেই হবে। আমাদের সনাতন সংস্কারের বিরুদ্ধে হলেও রাজার
অনাচারেই সায় দিতে হবে”।
“মার্জনা করবেন, গুরুদেব। কবে সেই অনুকূল সময় আসবে, সেই
আশায় আমাদের ইষ্ট দেবতার পুজা বন্ধ করে, পুজার বেদিতে বসাব দুরাচারী এক রাজার
প্রতিমা? অগ্নিদেব নন, নিজ নিজ গৃহের গৃহদেবতারা নন, আচার্য যজ্ঞশীলের কন্যার
পুণ্যবিবাহ হবে সেই দুর্মতি রাজাকে সাক্ষী মেনে? এ আমার পক্ষে মান্য করা সম্ভব নয়,
গুরুদেব”। আচার্য রণধীর মহর্ষির বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেন, কিছুটা উদ্ধত স্বরেই! “একটি
কুমারী কন্যার বিবাহের মতো অত্যন্ত পুণ্য অনুষ্ঠানের এমন বীভৎস পরিবর্তন, সঠিক
অর্থেই অনাচার – মহাপাপ, গুরুদেব। এই মহাপাপের ভাগী হওয়ার থেকে প্রতিকারের চেষ্টায়
মৃত্যুবরণ করাও আমার মতে অনেক বেশী মঙ্গলদায়ক”।
আচার্য রণধীর, এই আশ্রমেই সমরবিদ্যা বিভাগের অধ্যক্ষ।
তাঁর সফল অধ্যাপনায় বহু কৃতী ছাত্র, এই রাজ্যের এবং এই ভারতভূমির অন্যান্য
রাজ্যেরও সেনাধ্যক্ষ, সহ-সেনাধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন
করছেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করে, সম্মুখ সমরে এই অত্যাচারি রাজার পতন ছাড়া অন্য কোন সহজ
উপায় নেই, আচার্য
রণধীরের এটাই অভিমত। তাঁর ডাকে ও প্ররোচনায় তাঁর অনেক শিষ্য সেনাধ্যক্ষ নিজ নিজ
সেনাদল নিয়ে রাজধানীতে উপস্থিত হতেই পারেন।
আচার্য রণধীরের কথার উত্তরে আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “ভাই,
রণধীর, আমার মনে হয় সঠিক সময় আর উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া যে কোন যুদ্ধেই অকারণ
সম্পদ ক্ষয় ও প্রাণনাশ হয়। এমনকি যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্যও অনেক সময় ফলপ্রসূ হয় না।
এই সংকট কালে আমাদের উচিৎ মাথা ঠাণ্ডা রেখে সঠিক পরিকল্পনা। যদিও এই অপশাসনের
পরিবর্তন ছাড়া অন্য উপায় নেই। তবুও সব দিক ভেবে চিন্তে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ
নেওয়াটাই বিবেচনার কাজ হবে। এ কথা ভুললে চলবে না যে, এই নির্দেশের ফলে রাজ্যে
বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা রাজাও নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছেন। তিনি যে সেই বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের
জন্যে, লোকচক্ষুর আড়ালে প্রস্তুতি নিচ্ছেন না, কে বলতে পারে? রাজশক্তি প্রতিবাদী
কণ্ঠের থেকে সর্বদাই সবল হয়ে থাকে, রণধীর”।
আচার্য রণধীরের মতো, আচার্য সুনীতিকুমার এই আশ্রমের
রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ। তাঁর বিদ্যা ও মেধার সুখ্যাতি ভারতবর্ষের
শিক্ষিত মহলে সুবিদিত। তাঁর অনেক সফল শিষ্য এই দেশের অনেক রাজার মুখ্য উপদেষ্টা
হিসাবে নিয়োজিত। এই রাজ্যের মুখ্য উপদেষ্টাও ছিলেন, তাঁর এক অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র।
নতুন রাজা সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তিনি এখন প্রতিবেশী মিত্র
রাজ্যের মুখ্য উপদেষ্টা।
মহর্ষি এতক্ষণ স্মিতমুখে তাঁর দুই প্রিয় শিষ্যের কথা
শুনছিলেন। তিনি জানেন রাজা বেণের এই অদ্ভূত নির্দেশিকায় প্রত্যেকটি মানুষই বিপন্ন।
পিতৃ-পিতামহের থেকে বংশ পরম্পরায় অর্জন করা, বিশ্বাস ও সংস্কারে আঘাত লাগলে এমনই
হয়। তিনি বাধা দিচ্ছেন না, তিনি নিজের অভিমত চাপিয়ে দিতে চাইছেন না। সকলের মনের
আবেগ ও ক্ষোভের কথা তিনি শুনতে চাইছেন। বিভিন্ন মানুষের ক্ষোভ আর আবেগের মিলিত
শক্তি থেকেই তিনি গড়ে তুলবেন এই রাজাকে সিংহাসন থেকে অপসারণের নির্দিষ্ট অভিমুখ।
দুজনের বক্তব্য শেষ হয়ে যাবার পর, আরেকবার সকলের মুখের
দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “এখানে উপস্থিত তোমরা সকলেই অত্যন্ত মেধাবী বিদ্বান
ব্যক্তিত্ব। তোমরা সকলেই অসাধারণ। কখনো কি ভেবে দেখেছ, সাধারণ মানুষের কথা? যারা
জমিতে ফসল ফলায়, গ্রামে গ্রামে যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গড়ে তোলে নানান সামগ্রী।
দুর্গম দূর দেশে দেশে ঘুরে যারা বাণিজ্য ক’রে, বাঁচিয়ে রাখে আমাদের অর্থনীতি? তারা
সকলেই আজ বিহ্বল, দিশাহারা। এর মধ্যে আমরা, এই বিদ্বানেরা যদি এখনই একটা গৃহযুদ্ধ
বাধিয়ে তুলি, তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আচার্য রণধীর, আমি স্থির বিশ্বাস করি,
তোমার ইশারাতে আমাদের এই রাজ্যের সেনাবাহিনীর অনেকাংশ এবং প্রতিবেশী রাজ্যের
সেনাবাহিনীরা আমাদের সমর্থনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কিন্তু রাজ্যের প্রত্যেকটি অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা, রাজার
অন্নে প্রতিপালিত সেনাবাহিনীরা ঝাঁপিয়ে পড়বে এই সাধারণ মানুষের ওপর। আমরা রাজধানী
অবরোধ করে, রাজাকে হয়তো সরিয়ে ফেলব। কিন্তু রাজার অনুগত সেনারা তাদের আক্রোশ
মেটাবে, গ্রামের সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করে, হত্যা করে। তারা ছারখার করে দেবে আমাদের
গ্রামীণ সমাজকে, ভেঙে দেবে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিকে। বাইরের রাজ্য থেকে সাহায্য
করতে আসা সেনাবাহিনী, যুদ্ধজয়ের বিনিময়ে কি চাইবে আমাদের থেকে? আমাদের নিরঙ্কুশ
বশ্যতা! অথবা তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য, দাবি করবে, বিশাল অর্থ। সে অর্থ পূরণ করতেই,
আমাদের রাজকোষ হয়তো শূণ্য হয়ে যাবে।
একমাত্র সূর্য, চন্দ্র, মেঘ, বায়ু এবং সবার উপরে পরমেশ্বর ছাড়া জগতে কোন সাহায্যই
নিঃস্বার্থ হতে পারে না। সেই শূণ্য রাজকোষ ভরে তুলতে, সাধারণ প্রজাদের উপর নতুন কর
চাপাতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সাধারণ মানুষের কাছে, সেটাও হয়ে উঠবে আরেক অসহ্য
অত্যাচার।”
“গুরুদেব, আপনার অনুমান নির্ভুল, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব
হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আপনি নিশ্চয়ই কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছেন। দয়া করে আপনি পরামর্শ
দিন। আমরা এই রাজাকে সিংহাসন থেকে টেনে নামাতে চাই, গুরুদেব। সে যে কোন পন্থাই হোক”।
আচার্য রণধীর দৃঢ় প্রত্যয়ের স্বরে বললেন।
সকলেই তাঁর কথায় সমর্থন করে বলে উঠল, “আপনি আমাদের পথ
দেখান, গুরুদেব। আমরা আপনার নির্দেশে যে কোন কাজের জন্যে প্রস্তুত”।
প্রসন্ন মুখে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “ধৈর্য ধরো। আমার
বিশ্বাস আছে তোমাদের প্রজ্ঞায়। আমার প্রতি তোমাদের অখণ্ড আস্থাতেও আমার বিশ্বাস
আছে। যেদিন বিশ্বপ্রভ হাট থেকে ফিরে প্রথম আমাকে এই রাজ আদেশের কথা শোনালো, তার
অনেক আগে থেকেই আমার পরিকল্পনার শুরু হয়ে গেছে। চোখের আড়ালে কিছু কিছু কাজ শুরুও হয়ে গেছে।
প্রিয় বেদব্রত, তুমিও ওইদিন সেই হাটে উপস্থিত ছিলে শুনেছি, বিশ্বপ্রভ ফিরে এসে
তোমার কুশল সংবাদ দিয়েছিল”।
“হ্যাঁ, গুরুদেব”। আচার্য বেদব্রত বললেন।
“আমার পরিকল্পনা, একটু জটিল। সম্পূর্ণ হতে তিন থেকে চার
মাসাধিক অথবা তারও অধিক সময় লাগতে পারে। প্রিয় রণধীর, তোমার যুদ্ধযাত্রার আয়োজন
করতেও ওইরকমই সময় লাগার কথা। আজ থেকে মাস দেড়-দুই পরেই আমাদের রাজ্যে পূর্ণ বর্ষার
কাল, সে সময় যুদ্ধঘোষণা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত হবে না। অর্থাৎ শরৎ কিংবা হেমন্তের
আগে আমাদের যুদ্ধ শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, তাই তো, বৎস রণধীর?”
“আপনার বিশ্লেষণ অভ্রান্ত, গুরুদেব”। আচার্য রণধীর মেনে
নিলেন মহর্ষির কথা।
“তার অর্থ, বৎস রণধীর, আমি তোমার থেকে খুব একটা বেশি সময়
চাইছি না। আমার এই পরিকল্পনার মধ্যে, প্রিয় শিষ্যগণ, কোন বীরত্ব নেই। বরং
তাত্ত্বিকভাবে যারা নীতিনিষ্ঠ তাদের কাছে এই পরিকল্পনাকে এক ধরনের শঠতা বলেই মনে
হবে। সে হোক। আমি আবার বলছি, সে হোক। শঠতা দিয়ে আমরা যদি রক্ষা করতে পারি শতশত প্রাণ,
শঠতা দিয়ে যদি রক্ষা করতে পারি অসংখ্য সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। সে শঠতায় কোন
অন্যায় নেই। প্রিয়
সুনীতিকুমার আমাকে নিশ্চয়ই সমর্থন করবে যে, রাজনীতিতে শাঠ্যও একটি স্বীকৃত নীতি”।
মহর্ষি আচার্য সুনীতিকুমারের দিকে তাকালেন। আচার্য
সুনীতিকুমার বললেন, “রাষ্ট্রনীতির পাঠ আমি আপনার থেকেই শিখেছি, গুরুদেব। উপরন্তু দীর্ঘদিন রাষ্ট্রনীতির
চর্চা করে এটুকু উপলব্ধি করেছি, গুরুদেব, যে কোন যুদ্ধেই বিবাদী দুই পক্ষেরই
অপূরণীয় ক্ষতি হয়। যারা পরাজিত হয় তাদের তো বটেই, যারা জয়ী হয়, তাদেরও ক্ষতি হয়
সমপরিমাণেই। অতএব দণ্ড অর্থাৎ প্রত্যক্ষ যুদ্ধের আগে, সাম, দান অথবা ভেদনীতিতে যদি
উদ্দেশ্য সফল হয়, তার থেকে শুভ আর কিছু হতে পারে না।”
“সে কথা সত্য। কিন্তু অধীত বিদ্যাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া
অনেক সময়, সহজ নাও হতে পারে, সুনীতিকুমার। ভেদনীতির মধ্যে শাঠ্যও একটি
গুরুত্বপূর্ণ নীতি। সে যাই হোক, শঠতার কথায় আমি পরে আসছি। প্রথমেই আমার প্রশ্ন বর্তমান
রাজাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে কে হবেন আমাদের ভবিষ্যতের রাজা? কার হাতে আমরা তুলে দেব,
আমাদের এই রাজ্যের শাসনভার? রাজা হয়ে তিনিও যে বর্তমান রাজার মতো দুরাচারী হবেন
না, কে দেবে সেই আস্থা? তোমরা কেউ ভেবেছ?”
উপস্থিত আচার্যরা সকলেই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি
করলেন। কিন্তু সবাই নিরুত্তর রইলেন। এই রাজাকে সিংহাসন থেকে সরানোর কথা সকলেই
ভেবেছেন। কিন্তু কেউই ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি। মহর্ষি কিছুটা সময় দিলেন সকলকে,
তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার এই পরিকল্পনায় আমাদের সর্বপ্রথম প্রয়োজন এক
সর্বগুণসম্পন্ন তরুণ, যিনি হবেন এই রাজ্যের রাজা। আমার আরও প্রয়োজন সর্বকল্যাণময়ী
এক তরুণী। যিনি হবেন এই রাজ্যের রাজমহিষী। এই রাজদম্পতির থেকে এই রাজ্য পাবে এক
সুস্থ রাজ বংশ। সে তরুণ
কোন রাজবংশের বিলাসী রাজকুমার নাও হতে পারেন। সে তরুণী নাও হতে পারেন কোন রাজার
দুলালী”।
“তিনি কে, গুরুদেব?” আচার্য সুনীতিকুমার জিজ্ঞাসা করলেন।
মহর্ষি উত্তর দিলেন, “জানি না, প্রিয় সুনীতিকুমার। এখনও জানি না। এই রাজ্যে কোথাও না
কোথাও আছেন সেই ভবিষ্যতের রাজা, তাঁকে খুঁজতে হবে। আর সেটাই হবে আমাদের প্রথম
কর্তব্য। আর এই দায়িত্ব আমি দিতে চাই এখানে উপস্থিত ...।”
মহর্ষির কথায় বাধা পড়ল, দ্বারে দাঁড়ানো বিশ্বপ্রভর
নিবেদনে, “গুরুদেব, বহির্দ্বারে তিনজন শ্রেষ্ঠী উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা আপনার সঙ্গে
সাক্ষাতের অনুমতি চাইছেন”।
“তিনজন শ্রেষ্ঠী? কোথা থেকে এসেছেন কিছু বললেন?” মহর্ষি
বিশ্বপ্রভকে জিজ্ঞাসা করলেন।
“তা কিছু বললেন না। তবে বেশভূষা, আচার আচরণে সম্ভ্রান্ত
বলেই মনে হল। তাঁরা এসেছেন সুসজ্জিত দুই অশ্বের সুন্দর একটি রথে। আশ্রম দ্বারের
বাইরে অপেক্ষা করছেন। আলাপে আমাদের রাজ্যের অধিবাসী নয় বলেই মনে হল”।
“অতি উত্তম। তুমি নিজে গিয়ে তাঁদের এখানে নিয়ে এসো,
বিশ্বপ্রভ। দেখো কোনভাবেই যেন তাঁদের অসম্মান না হয়। আর শোনো, এখন মধ্যাহ্নকাল,
তুমি নিজে ওই তিন শ্রেষ্ঠীর আহারের ব্যবস্থা করবে। ওঁনাদের কোন সারথি আছে কি? যদি
থাকে, তারও ভোজনের সুব্যবস্থা করতে ভুলো না, বৎস”।
“যথা আজ্ঞা, গুরুদেব”।
বিশ্বপ্রভ চলে যেতে মহর্ষি তাঁর সমবেত শিষ্যদের
উদ্দেশ্যে বললেন, “আমাদের আলোচনা, এত সংক্ষেপে সম্পূর্ণ হবার নয়। এখন মধ্যহ্নকাল, তোমরা সকলে এই
অবসরে আহার করে নাও। আর তোমাদের অনেকেই পথশ্রমে ক্লান্ত, ভোজনের পর কিঞ্চিৎ
বিশ্রামও নিয়ে নাও। আমরা আবার বিকেলে একত্র হবো। আরও একটা কথা, তোমরা যারা আশ্রমের
আবাসিক নও, তারা আজ এই আশ্রমেই রাত্রিযাপন করলে, আমাদের পরিকল্পনার আলোচনা হয়তো
সম্পূর্ণ হবে। একান্ত অসম্ভব না হলে, তোমরা সেই ভাবেই প্রস্তুত হও। তোমরা সকলেই অত্যন্ত বিচক্ষণ, এ
কথা বলা বাহুল্য যে, আমাদের এই আলোচনার কথা এই কক্ষের বাইরে কেউ না জানলেই ভাল”।
মহর্ষির কথা শেষ হওয়ার আগেই, মহর্ষির গৃহের বাইরে
অশ্বশকট থামার আওয়াজ পাওয়া গেল। আচার্যরা সকলেই কক্ষের অন্য দ্বার দিয়ে আশ্রমের আবাসের
দিকে বেরিয়ে গেলেন।
চলবে...