বাবার চাকরি সূত্রে তোয়া অনেক শহরে থেকেছে, কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি, পুণে..। এখন থাকে হায়দ্রাবাদে। তার থাকা ব্যাপারটা যেন ভূগোল গোলা বইয়ের পাতা। আবার ভূগোলের বাইরেও - এই যেমন এখন সে আছে পরশপুর গ্রামে। এই গ্রামের কথা কোন ভূগোল বইয়ে খুঁজেও পাবে না। এই গ্রামে তার দাদুন থাকেন, দিম্মা থাকেন। এখানে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে কয়েকদিনের জন্যে।
এই গ্রামে সে যেন আগেও এসেছে।
এমনই মনে হয় তার। কিন্তু কবে? উঁহু সে তার মনেই পড়ে না, শুনেছে খুব ছোট্টবেলায়,
যখন তার কথাও ফোটেনি। তার মনে থাকার কথা নয়, অথচ তার যেন দাদুনের বাড়ির সব কটা
ঘর চেনা। কোনটা দাদুন-দিম্মার ঘর। এই বাড়ির বারান্দা, ছাদ। আসলে কোন জায়গা ভালো
লেগে গেলে, এমনই মনে হয়, মনে হয় যেন খুব চেনা। এ বাড়ির পেছনের দিকে, পাঁচিলের
বাইরের ওই পুকুর। পুকুরের চার পাড়ে অনেক গাছ, নিম, তেঁতুল, নারকেল, খেজুর। একটা নারকেল
গাছ তো আবার হেলে পড়েছে জলের দিকে। ওই গাছটা বেশ মজার, গাছের গা বেয়ে জলের ওপরে
চলে যাওয়া যায় অনেকটা। তারপর পা ঝুলিয়ে বস্সে, পা দোলাতে দোলাআতে বিটনুন আর কারেন্ট
নুন ছিটোনো বনকুল খাও আর ঠোঁট জড়ো করে ফু করে ছুঁড়ে দাও বনকুলের বীজ। জলের মধ্যে
টুপুস শব্দ করে তারা পড়বে। আর জলের মধ্যে গোল গোল ছোট্ট থেকে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠে একটু
পরেই মিলিয়ে যাবে। গোল গোল ওই ঢেউ গুলোকে সার্ক্ল্ বলে। আর যেখানে কুলের বীজটা
টুপুস করে পড়ে, সেটা হল সার্ক্লের সেন্টার।
ঝিঙে অবিশ্যি তা বলে না। ও কী সব
আজেবাজে বলে। গোল গোল ঢেউগুলোকে বলে বৃত্ত। আর সেণ্টারটাকে বলে কেন্দ্র। তোয়া যত
বলে, ওটা বৃত্ত নয় রে পাগল, ওঠা সার্কল্। আর ওটা মোটেও কেন্দ্র নয়, ওটা সেন্টার।
কিছুতেই মানবে না। জিদ করে বলবে, উঁহু, ওটা বৃত্ত আর ওটা কেন্দ্রই!
ঝিঙের কথা তো বলাই হয়নি। ঝিঙে এই
গ্রামেই থাকে। এই গ্রাম ছেড়ে সে কোনদিন কোত্থাও যায়নি। অনেকদিন আগে একবার
জামালপুরের রথের মেলায় গিয়েছিল। সে এখান থেকে দুক্রোশ হবে। ক্রোশ মানে? ক্রোশ মানে
ক্রোশ আর এক ক্রোশে দুমাইল! ব্যস্, তার দৌড় ওই অব্দিই। তোয়ার মুখে সে কলকাতা,
মুম্বাই, দিল্লি, পুণে আর হায়দ্রাবাদের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। চারটে বনকুল মুখের মধ্যে নিয়ে, চিবোতে চিবোতে বলেছিল, ওসব
জায়গায় যাওয়া যায় বুঝি? ওসব জায়গা তো ভূগোলের পড়া মুখস্থ করার জন্যে, আর পরীক্ষার
খাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখার জন্যে। নয়তো ভারতের ফাঁকা মানচিত্রে শহরগুলোকে
গোলগোল চিহ্ন দিয়ে এঁকে দেওয়ার জন্যে। সে জানে, কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী।
মুম্বাই মহারাষ্ট্রের, দিল্লি ভারতের। পুনে শহরের নামটাও সে পড়েছে। তবে সেটা কোন
রাজধানী নয়।
ঝিঙে গ্রামের যে স্কুলে পড়ে,
সেখানে টিফিন আর ছুটির সময় স্কুলের গেটের সামনে বসে হজমিওয়ালা। সে বুনোকুলও নিয়ে আসে। স্কুল ছুটি হওয়ার সময় বিটনুন আর
কারেন্ট নুন দেওয়া চারটাকার বুনোকুল কিনে, সে তোয়াদের বাড়ি চলে আসে। তারপর দুজনে নারকেল
গাছে চড়ে পা ঝুলিয়ে বসে, আর বুনো কুল খায়। বুনোকুলের কাগজের ঠোঙাটা দেখেও অবাক হয়
তোয়াদিদি। ঠিক যেন সানাইয়ের মতো, ওপরটা চওড়া আর তলার দিকটা সরু। কুল খাওয়ার পর
ঠোঙাটা খুলে সে দেখেছে, কাগজটা আসলে পুরোনো খাতার ছেঁড়া পাতা। তাতে পেন্সিলে লেখা
গোটা গোটা বাংলা অক্ষর! তোয়া বাংলা বলতে পারে, কিন্তু লিখতে বা পড়তে পারে না। সে
ছেঁড়া খাতার পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে, ইস্ সে যদি বাংলা পড়তে পারত! এবার
হায়দ্রাবাদ ফিরে মাকে বলবে, বাংলা লেখাটা শেখাতে।
ঝিঙেদের বাড়ি গ্রামের এদিকে না।
গ্রামের অন্যদিকে। পুকুরপাড়ে রাস্তা ধরে, হুই বাঁদিকে কিছুটা গিয়ে শিবের থান আছে, তার
সামনে বিশাল ঝাঁকড়া মাথা বকুল গাছ। বর্ষার সময় সে গাছে ছোট্ট ছোট্ট মাকড়সার মতো
ফুল হয়। সে ফুল গাছের তলার মাটিতে যেন চাদর বিছিয়ে দেয়। দু হাতের আঁজলা ভরে সে ফুল
তুলে নিয়ে নাকের কাছে আনলেই – আআআঃ সুবাসে মনটা হালকা হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায় শিমূল
তুলোর মতো। এসব কথা ঝিঙে বলেছে, আর তোয়া অবাক হয়ে শুনেছে! সেই শিবের থান ছাড়িয়ে
ডানদিকে গেলেই একটা বড়ো বাঁশঝাড়।
সে বাঁশঝাড়ে রাতের দিকে শেয়ালের
পাল এসে লুকিয়ে থাকে। গেরস্তের বাড়ি থেকে হাঁস মুরগি শিকার করে এনে, ওরা ওখানেই
ভোজ সারে। ওদের ছেড়ে যাওয়া রক্তমাখা পাখনাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে, সকালের
হালকা হাওয়ায় উড়তে থাকে কিছু পালক। আবার বিকেলে ওই বাঁশঝাড়ের মাথায় এসে বসে
রাজ্যের বক, ওখানেই ওদের বাসা। তখন দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বাঁশঝাড়ের মাথায় ফুটে
আছে থোপা থোপা সাদা ফুল। আর বর্ষার ঝড়ো হাওয়ায় বাঁশে বাঁশে যখন ঠোকাঠুকি লাগে,
আওয়াজ ওঠে ক্যাচর ক্যাচর, কটর কটর। রাতে ঘুম ভেঙে ওই শব্দ শুনলে বুকের ভেতরটা কেমন
ভয় ভয় করে ওঠে। মনে হয় কারা যেন ঝগড়া করছে, কিন্তু যারা ঝগড়া করছে তারা কেউ আমাদের
মতো মানুষ নয় কিংবা কুকুর, বেড়াল, শেয়ালের মতো জন্তুও নয়, তবে তারা কারা...? সে
সময় মায়ের বুক ঘেঁষটে চোখ বুজে শুলে একটু সাহস মেলে। এসব কথাও তোয়াকে ঝিঙে
বলেছে।
ওই বাঁশ-ঝাড়ের ঠিক পেছনেই তাদের
বাড়ি। বাড়ির দিকের রাস্তা দিয়ে তারা যখন যায়, সামনে কিংবা পেছনে কুকুরও হাঁটে,
ল্যাং ল্যাং করে, বেঁকা লেজ তুলে। কিছু বলে না? কী আবার বলবে? বদমাশ ছেলেরা ঢিল
মারলে বলে, কেঁই কেঁই। হারুকাকার চায়ের দোকানে কিছু লোক বসে চা খায়, তারা লেড়ো
বিস্কুটের টুকরো ছুঁড়ে দিলে বলে, ভৌ ভৌ, ভুক। এছাড়া আর কী বলবে? ও হ্যাঁ। মাঝে
মাঝে সদর থেকে একজন বুড়ো আসে, কাঁধে ঝোলানো বাঁকের দুদিকে ঝাঁকা নিয়ে। সে বাড়ি
বাড়ি ঘুরে, যত রাজ্যের পুরোনো ভাঙ্গাচোরা থালা-ঘটি-বাটি, লোহার জিনিষ কেনে। তার
বদলে সে মেয়েদের দেয় কাচের চুড়ি, পায়ে পরার আলতা, কপালের সিঁদুর। তাকে দেখলে
কুকুরগুলো হয় খুব ভয় পায় কিংবা খুব রেগে যায়। তখন খুব ঘেউ ঘেউ করে, আর সহজে তার
পিছু ছাড়ে না। শীতের রাত্রে কুকুরগুলো ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গুটিসুটি শুয়ে থাকে। আর হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে, কিছুই দেখা যায় না, বোঝাও যায় না,
অথচ কিসের দিকে দৌড়ে যায় খুব ব্যস্ত হয়ে...কিছুটা দূরে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে
ডাকে ঘৌউউউউউউ। সে ডাক শুনতে তোমার একটুও
ভালো লাগবে না, তোয়াদিদি!
ওই রাস্তা দিয়ে সকাল সকাল
হাঁসেরাও হাঁটে। পাশাপাশি বাড়ি থেকে ছোট ছোট হাঁসের দল বেরিয়ে রাস্তায় আসে। তারপর
সক্কলে মিলে বেশ বড়ো একদল হাঁস হয়ে, হেলে দুলে থপর থপর পা ফেলে হাঁটতে থাকে,
নিজেদের মধ্যে কথা বলে প্যাঁক প্যাঁক। এগুলো পাতি হাঁস। এরা পুকুরের কাছে এসে ঝপাস
ঝপাস জলে নেমে পড়ে। জলের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে সাঁতরে বেড়ায় পুকুরে। কিছুক্ষণ পরে, জল
থেকে উঠে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পাখা ঝাড়ে, লেজ ঝাড়ে আর আরামে ডাকাডাকি করে প্যাঁয়াক
–প্যাঁয়াক। পাড়ের ধারে ধারে পা ডুবিয়ে তারা মাঝে মাঝে গুগলিগেঁড়ি খুঁজে খুঁজে
বেড়ায়, আর চোখে পড়লেই টকাস করে তুলে নেয় চ্যাপ্টা ঠোঁট দিয়ে! সারাদিন পর এই হাঁসগুলোই
আবার বিকেলবেলা ঘরে ফিরে যায়। নিজে নিজেই ফিরে যায়? নিজে নিজেই যায় তো। তবে টুকলিদিদি,
নোনামাসি পুকুরের ধারে এসে, একবার দুবার ডাক দিয়ে যায়, বলে, আয় আয় চৈ চৈ। সেই ডাক
শুনে হাঁসেরা দল বেঁধে ওই রাস্তা ধরে যে যার ঘরে ফিরে যায়। তখন তারা সকলেই গলা ছেড়ে
হাঁকাহাঁকি করে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আবডালে বিকেলের হেরে যাওয়া আলো গায়ে মেখে তারা ঠিকঠাক
পথ চিনে তাড়াতাড়ি নিজেদের ঘরে ফিরে যায়।
সার্কল্ আর সেন্টার নিয়ে ঝিঙের
সঙ্গে তার মতের অমিল হলেও তোয়া অবাক হয়ে শোনে ঝিঙের কথা। মাঝে মাঝে জিগ্যেস করে
নানান কথা। এখন যেমন জিগ্যেস করল, “হেরে যাওয়া আলো মানে? আলো আবার হেরে যায় নাকি?
কী যে বলিস, তুই ঝিঙে?”
ঝিঙে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে বলল, “ও
বাবা, তুমি এটাও জানোনা তোয়াদিদি। আলো আর অন্ধকারের মধ্যে নাগাড়ে লড়াই চলছে তো! সে
লড়াইতে সব সময় কী আর আলো জিততে পারে? যখন জিততে পারে তখন হয় দিন। আর যখন বিচ্ছিরি
রকম হেরে যায়, তখন হয়ে যায় রাত। আবার মেঘলা দিনে আকাশ জুড়ে যখন মেঘেরা তাদের ঘোলাটে
পুরু শতরঞ্চিটা মেলে ধরে বসে থাকে, দমবন্ধ করে থাকে চারপাশ, তখন আলোটা খুব লড়তে
থাকে, তবে দুজনের কেউই খুব একটা সুবিধে করতে পারে না। সেদিন ছায়াতে আলোতে মিশে
থাকে সারাটাদিন। অথবা আলোর সঙ্গে ছায়া মিশে থাকে! দেখনি? আর যেদিন ঝড়ো হাওয়ার
সঙ্গে পশ্চিম আকাশ থেকে রেগে মেগে দৌড়ে আসে ঘন কালো মেঘের দল, সেদিন? সেদিন তো আলো
হেরে ভূত হয়ে যায় এক্কেবারে। ভর দুপুরেও মনে হয় যেন সন্ধে নেমে এল, তখন?”
“সে মেঘ খুব কালো?”
“হ্যাঁ গো, দিদি তোমার ওই চুলের
মতো ঘন কালো। আর তার সঙ্গে কী হাওয়া, বাপরে! মস্তো মস্তো গাছের ডালপালা নুয়ে পড়ে
যেন মাটি ছুঁয়ে ফেলে। আম গাছের ডাল ভরা আমের গুটি ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে মাটিতে। মালা
ছিঁড়ে যেমন পুঁতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মেঝেয়। সে সময় আমাদের স্কুলের টিনের চালেও ভীষণ
আওয়াজ ওঠে। মনে হয় বিশাল এক দত্তি, যেন তার শক্ত দুই হাতে উপড়ে ফেলতে চাইছে ঘরের
চালটা। কোন কোনদিন যখন শিল পড়ে, টিনের চালে আওয়াজ ওঠে চড়বড় চড়বড়। ঠিক যেন একশ ঢাকী
তাদের ঢাকে কাঠি পিটিয়ে ঢাক বাজাচ্ছে! বুকের ভেতরটাও কেমন গুরগুর করতে থাকে। তখনই হয়তো আমরা রবিঠাকুরের কবিতা পড়ছিলাম, “কুমোর
পাড়ার গরুর গাড়ি”, কিংবা নামতা মুখস্থ করছিলাম “তিন তিরিক্ষে নয়, তিন চারে বারো,
তিন পাঁচে পনের...”। পড়া বন্ধ করে চুপ করে মাথার ওপরে তাকিয়ে বসে থাকি। মাস্টারমশাই
আমাদের বলেন, “হল্লা করিসনি, ধরিত্রি মা আজ খুব ক্ষেপে উঠেছেন”।
“ধরিত্রি মা কে?”
“ধরিত্রি মা? আমিও ঠিক জানিনা গো।
আমি তো ছোট, সব কথা বড়োরা কী আর আমাদের খুলে বলেন? বলেন না। তাঁরা বলেন, বড়ো হ, সব
জানতে পারবি”।
গায়ে ময়লা হাফহাতা জামা, আর পরনে
কালো হাফপ্যাণ্ট, সেই ঝিঙে বারবার অবাক করে দিচ্ছিল তোয়াকে। সে যেন অন্য এক
পৃথিবীর কেউ। যে পৃথিবীটা তোয়ার একদম অচেনা, অজানা। অনেক বড়ো বড়ো শহরে সে থেকেছে।
তার বাবা মস্তো বড়ো অফিসে কাজ করেন। এই বয়সেই কত যে শহর, কত ট্রেন, কত উড়ান সে চড়ে
ফেলেছে। ঘরে বাইরে সর্বদাই কম্পিউটার, স্মার্টফোন! সেই পৃথিবীটা তার খুব চেনা,
কিন্তু ঝিঙের জগৎটা তার থেকে অনেক অনেক দূরে। অথচ এখন এই শেষ বিকেলবেলায়, ঝিঙে স্কুল
থেকে ফিরে বসে আছে তার ঠিক পাশটিতে। তোয়া ঠিক করল কাল সে ঝিঙের সঙ্গে
একবার গ্রামটা ঘুরে আসবে। হেঁটে আসবে ওই পথে, যে পথে তার সামনে ও পেছনে কুকুর
হাঁটবে। সে
দু একবার ডাকবে ঘৌ ঘৌ, কিন্তু কিচ্ছু করবে না। যে পথে সকাল-বিকেল হেঁটে বেড়ায়
হাঁসের পাল।
ঝিঙে বনকুল শেষ করে, কাগজের
ঠোঙাটা দুমড়ে হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “তোয়াদিদি, বাড়ি চলো, সন্ধে নামতে খুব দেরি
নেই আর। ওই দেখ আকাশে কেমন মরা আলো। আর পুকুরের জলও দেখ কেমন কালচে হয়ে উঠছে,
গাছের ছায়ায়। একটু পরেই ঘরে ঘরে শাঁখ বাজবে। বাড়ির নাচদোরে পিদিম দেখিয়ে, সে পিদিম
তুলসীতলায় নামিয়ে রাখবে, তারপর তুলসী মন্দিরে পেন্নাম করবে মায়েরা - দিদিরা। এসময় বাচ্চাদের বাড়ির বাইরে থাকতে নেই”।
নারকেল গাছের গা বেয়ে বসে বসে
নেমে আসতে আসতে তোয়াদিদি ঝিঙেকে জিগ্যেস করল, “নাচদোর মানে? সে দরজার সামনে সবাই
নাচে নাকি?”
ঝিঙে হিহি হিহি হেসে ফেলল, তারপর
বলল, “নাচতে যাবে কী দুঃখে? মানে কী জানিনা তোয়াদিদি, সবাই বলে তাই শুনেছি। সব
বাড়িতেই দুটো দরজা থাকে, নাচদোর আর পাছদোর। একটা সামনের দিকে আর আরেকটা পিছনের
দিকে”। তোয়াদিদি আর ঝিঙে এখন তাদের বাড়ির
পাছদোর দিয়ে বাড়িতে ঢুকল। বাড়ির সামনের দিকে দালানের সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে দেখল, শাড়ি
পরা, মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা, পিদিম নিয়ে চলেছেন সদর দরজার দিকে। সিঁড়িতেই
দাঁড়িয়ে পড়ল তোয়াদিদি, আর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ওই মহিলা তো তার মা! তার মা
খুব সুন্দর দেখতে, কিন্তু এমন সুন্দর? আগে তো কোনদিন দেখেনি, তোয়াদিদি!
সদরে প্রদীপ দেখিয়ে, তার মা ফিরে
এলেন বাড়ির উঠোনে। একধারে সিমেন্ট বাঁধানো তুলসী মন্দির, তার ওপরে প্রদীপ রেখে
শাঁখ বাজালেন। তারপর মাটিতে উবু হয়ে বসে প্রণাম করলেন তুলসী মন্দিরের সামনে।
দালানের সিঁড়ির দিকে আসতে আসতে মা ওদের দুজনকে দেখে জিগ্যেস করলেন, “কী দেখছিস,
অমন হাঁ করে? এতক্ষণ ছিলি কোথায়? আয় ঘরে আয়”।
মায়ের সঙ্গে মস্তো বসার ঘরে ঢুকতেই
ইজি চেয়ারে বসে থাকা দাদুন বলে উঠলেন, “এতক্ষণ কোথায় ছিলে দিদিভাই? এ গ্রামের
কাউকেই চেন না, জানো না, একা একা ঘুরতে ভালো লাগল?” তোয়া বলল, “একা কেন হবে দাদুন,
আমার সঙ্গে ঝিঙে ছিল তো। ও কত কী দেখাল, কত কী শেখাল”!
দাদুন
ভারি অবাক হয়ে গেলেন, বললেন, “বলো কী? ঝিঙে তোমায় শেখাল? কী শেখাল”? তোয়াদিদি বড়
বড়ো চোখ করে, ঝিঙের সঙ্গে এতক্ষণ যা যা কথা হয়েছে দাদুনকে সব বলল। অন্ধকারের কাছে
আলোর হেরে যাওয়ার গল্প। হাঁসেদের ঘরে ফেরার গল্প। ঝিঙেদের স্কুলের চালে, একশ ঢাকের
আওয়াজ তোলা শিল পড়ার গল্প। বৃত্ত আর কেন্দ্র, নাচদোর এবং পাছদোর... সঅঅব। বাবা আর
মা সোফায় বসে বসে এতক্ষণ মেয়ের কথা শুনছিলেন।
তোয়ার
কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠলেন, “বাঃ। ভেরি গুড!”
তোয়ার মা
বললেন, “ঠিক বলেছ! বড়ো বড়ো শহরে কত ছেলেমেয়ে, নামিদামি স্কুলে পড়ে। কত কোচিং পায়।
তাও কেমন ভ্যাবলা হয়ে থাকে! আর এই ছেলেটি সে সবের কিচ্ছুই পায় না, অথচ বেশ সুন্দর
কথা বলে তো! সরলা, তোমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাও তো?”
তোয়ার মা
শেষ কথাটা বললেন, কাজের মাসি সরলাকে। সরলামাসি এই ঘরেরই অন্য দিকে মেঝেয় বসে কুটনো
কাটছিল। তার সামনে ডিভানে বসে আছেন, তোয়ার দিদিমা। তিনি বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন
না, তাই তিনি যেমন যেমন বলছেন, সরলা সেই মতো কাজ করছিল। এত লোকের সামনে নিজের এবং
তার ছেলের বিষয়ে কথা বলতে, সরলা খুব লজ্জায় পড়ে গেল। দিদিমার দিকে তাকিয়ে চাপা
স্বরে বলল, “যায় দিদিমণি। তবে মাঝে মাঝে কামাই হয় বৈকি! ওই চাষবাসের সময় আর
ধানকাটার সময় যেতে পারে না! বাবার সঙ্গে মাঠে যায়, ওর বাবার একটু সাহায্য হয়!”
সরলামাসির
কথায় তোয়াদিদি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে, চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “ঝিঙে মাঠে যায় চাষ করতে? ও
চাষ করতে জানে?”
সরলামাসি
মাথা নিচু করে ম্লান হাসল, বলল, “যেতে হবে না? না গেলে শিখবে কী করে? তা নইলে
আমাদের চলবে কী করে, বলো তো মা? সম্বচ্ছর খাবো কী?”
ইংরিজিতে
লেখাপড়া শিখে বড়ো বড়ো পরীক্ষা পাশ করা। তারপর দেশে কিংবা বিদেশে ভালো ভালো চাকরি
করা, এটাই তো ছেলেমেয়েদের কাজ। অথচ এই ঝিঙে বাংলায় লেখাপড়া করে, জলে কাদায় নেমে
তার বাবার সঙ্গে চাষের কাজ শেখে! এই জগৎটার কথা তার কোন বইয়ে কোনদিন পড়েনি তোয়া,
শোনেওনি কোনদিন। তোয়া চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। ঝিঙের জন্যে মনখারাপ করবে কিনা,
সেটাও সে বুঝতে পারছিল না। কারণ ঝিঙে তো কোন দুঃখের কথা বলেনি, কোন কষ্টের কথা
বলেনি। যা বলেছে সে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অনুভবের গল্প।
মেয়েকে
গালে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে, তোয়ার বাবা বললেন, “ঝিঙে যে তোর সার্ক্লকে
বৃত্ত আর সেন্টারকে কেন্দ্র বলেছে, কিচ্ছু ভুল বলেনি, তোয়া! ওরা বাংলায় পড়ে তো,
তাই বাংলায় বলেছে”!
তোয়া ঝিঙের
দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাই?”
তোয়ার
বাবা মৃদু হেসে আরো বললেন, “হ্যাঁ। আর ওই যে নাচদোর আর পাছদোর – ওগুলো দ্বার, মানে
দরজা, তুমি যাকে ইংরিজিতে বলো ডোর! নাচদোর মানে ফ্রন্টডোর, যে দরজা দিয়ে সরাসরি
রাস্তায় বেরোন যায়। আর পাছদুয়ার মানে ব্যাকডোর, পিছনের দরজা। একটা জিনিষ লক্ষ্য করো, তোয়া, তোমার
ইংরিজির ডোর, আর শ্রীমান ঝিঙের দোর, উচ্চারণে প্রায় একই”!
তোয়াদিদি
খুব মজা পেয়ে বলল, “তাই তো! দোর আর ডোর...। এমন আরো আছে না কী বাবা?”!
তোয়াদিদির
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, “আছে বৈকি! প্রচুর আছে। একদিন সময় করে তোমাকে বলবো। তবে
তার আগে তোমাকে বাংলাটা ভালো করে শিখতে হবে যে!” ঘরের সব্বাই কিছুক্ষণ চুপ করে
ওদের কথা শুনছিলেন।
তোয়ার মা
ঝিঙেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই কোন ক্লাসে পড়িস, ঝিঙে”?
ঝিঙে
ঘরের সকলের এবং তোয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “ক্লাস ফাইভ”।
“লেখাপড়া
করতে ভালো লাগে?” ঝিঙে কথা বলল না, মস্ত ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
তোয়াদিদির
মা সরলামাসিকে ডেকে বললেন, “সরলা, তোমার এই ছেলের লেখাপড়া যেন কখনো বন্ধ না হয়। আমি
বলছি দেখ, ও খুব ভালো রেজাল্ট করবে, বড়ো হয়ে ও তোমাদের, এই গ্রামের, আমাদের সকলের
মুখ উজ্জ্বল করবে। যদি কোনদিন কোন কিছুর অসুবিধে হয়, আমাদের বলতে লজ্জা করো না,
সরলা”। শেষ কথাগুলো বলতে বলতে, তোয়ার মায়ের গলা আবেগে কেঁপে উঠল।
ঘরের
সবাই চুপ করে শুনলেন তোয়ার মায়ের কথাগুলো। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বললেন না। বেশ
কিছুক্ষণ পরে সরলামাসি খুব নিচু অথচ স্পষ্ট স্বরে বলল, “আপদে-বিপদে তোমরাই তো
আমাদের ভরসা দিদি। তোমাদের মুখ চেয়েই তো নিশ্চিন্তে থাকি। কিন্তু ঝিঙে আমার যেমন
বড়ো হচ্ছে, তেমনই হোক দিদি। চাকরি নিয়ে শহরে থাকা সুখী জীবনের লোভ ওকে দেখিও না।
এই গ্রাম, মাঠ-ঘাট, পাখ-পাখালি, পুকুর-মন্দির, জল-মাটির মধ্যেই ও বড়ো হোক, মানুষ
হোক। এর বেশি কিচ্ছু চাই না গো, দিদি, কিচ্ছু না”।
সরলামাসির
কথার উত্তরে কেউ আর কিছু বলতে পারলেন না।
তোয়ার দাদুন ও দিম্মা স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন, সরলার মুখের দিকে।
কিছুক্ষণ পরে দাদুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিকই বলেছ, সরলা, এতেই আমাদের সবার
মঙ্গল, আমাদের - সব্বার”।
..০০..
"কিশোর ভারতী" পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত এবং "এককুড়ি কিশোর" গ্রন্থে সংকলিত। বইটি এই লিংক থেকে "এক কুড়ি কিশোর " কিনলে বাড়িতে বসেই পেয়ে যাবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন