[প্রাককথাঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ হোক কিংবা প্রাচীন রাজতান্ত্রিক সমাজ – বিদ্রোহ, বিপ্লব সর্বদাই প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। নিরীহ, অনুন্নত এবং প্রান্তিক মানুষরা যুগেযুগে সেই বিদ্রোহের পথে যেতে কীভাবে উদ্বুব্ধ হয়েছিলেন এবং হচ্ছেন? কীভাবে তাঁরা অস্ত্র সংগ্রহ করেন? সেই বহুমূল্য অস্ত্রসম্ভার কি তাঁরা বিনামূল্যে সংগ্রহ করেন? কোদাল চালানো কিংবা লাঙ্গল ঠেলার দক্ষতা যাঁদের সম্বল, কে তাঁদের আধুনিক অস্ত্র চালনায় শিক্ষিত করে তোলে? কার শক্তি ও উস্কানি তাঁদের রাষ্ট্রশক্তির চোখে চোখ রাখার স্পর্ধা যোগায়? হয়তো কখনও তাঁরা পর্যুদস্ত হয়েছেন, কখনও ক্ষণস্থায়ী সাফল্য পেয়েছেন। আবার কখনও কখনও প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রকে তাঁরা পরাস্ত করে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও করেছেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতেও পুরোন বিদ্রোহ-বিপ্লবের আগুন নেভে না কেন? কেনই বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই বিপ্লব চলতে থাকে আবহমান কাল ধরে?]
১
রাজার সিংহাসনের পাশে গিয়ে মহামন্ত্রী রাজার
কানেকানে বললেন, “রাজামশাই, আজকে এই সভার অধিবেশন যদি একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে
পারেন, তাহলে আমাদের জরুরি কিছু কথা আলোচনার আছে – সেগুলো সভার পরে সেরে ফেলতে
পারতাম”।
রাজামশাই ভুরু কুঁচকে মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বোঝো কাণ্ড, তাড়াতাড়ি সভা ভঙ্গের কথায় আমি ভেবেছিলাম, আপনি অকালে ছুটি দিয়ে দিলেন।
ভালই হল, আমি বিদূষকের সঙ্গে বসে দু হাত চতুরঙ্গ খেলে নেব। কিন্তু সে গুড়ে বালি –
আপনি সভার পরে আবার মন্ত্রণাকক্ষে বসাবেন?”
মহামন্ত্রীমশাই
হেসে উত্তর দিলেন, “কী করি রাজামশাই, রাজকার্যে বড়ো ঝামেলি – কখন যে কোন বিষয়টা
জরুরি হয়ে পড়ে আগে থেকে তার কোন অনুমান করা যায় না”।
সভা ভঙ্গ হতে রাজামশাই ও মহামন্ত্রীমশাই মন্ত্রণা
কক্ষে গেলেন। চারদিকে কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। রাজা বা মহামন্ত্রীর বিশেষ অনুমতি
ছাড়া এই কক্ষে এমনকি কক্ষের আশেপাশেও কারও দাঁড়িয়ে থাকার কোন অবকাশ রাখা হয় না।
মন্ত্রণাকক্ষের নির্দিষ্ট আসনে বসার পর, মহামন্ত্রীমশাই বললেন, “সংগ্রামপুর থেকে
অস্ত্রবিশারদ অসিবল্লভ এসেছেন, রাজামশাই। ওঁর সঙ্গেই আমাদের জরুরি আলোচনা। তাঁকে
ডেকে নিই, রাজামশাই?”
রাজামশাই সম্মতি দিতে, মহামন্ত্রীমশাই প্রহরীকে আদেশ
দিলেন, অসিবল্লভকে ভেতরে পাঠানোর জন্যে। অসিবল্লভ অচিরেই মন্ত্রণা কক্ষে ঢুকলেন,
প্রথমে রাজামশাইকে প্রণাম করে তাঁর হাতে একটি রত্নখচিত তরবারি উপহার দিলেন, তারপর মহামন্ত্রীমশাইকেও
প্রণাম করলেন।
স্মিতমুখে রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন, “কী সংবাদ,
অসিবল্লভ? তোমার অস্ত্রশালায় কোন গণ্ডগোল হয়নি আশা করি। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে।”
বিনীত সুরে অসিবল্লভ বললেন, “না মহারাজ, আমাদের
অস্ত্র নির্মাণশালায় কোন বাধা-বিঘ্ন উপস্থিত হয়নি, সব ঠিকঠাক চলছে। প্রকৃতপক্ষে
আপনার রাজ্যের সর্বত্রই অখণ্ড শান্তি ও নিবিড় নিরাপত্তা বিরাজ করছে। আমাদের মতো
সাধারণ প্রজাদের পক্ষে সেটি খুবই আনন্দের বিষয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেই কারণেই আমি অস্ত্রনির্মাণকারী
হিসেবে বিশেষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি, মহারাজ। আর সেই কথাটিই আমি মহামন্ত্রীমশাইকে
নিবেদন করেছিলাম”।
বিস্মিত রাজামশাই বললেন, “রাজ্যে শান্তি আর
নিরাপত্তার কারণে তোমার দুশ্চিন্তা কেন? ঠিক বুঝতে পারলাম না, অসিবল্লভ। মন্ত্রীমশাই
আপনি বুঝেছেন?”
“কিছুটা বুঝেছি, রাজামশাই। সে কথা বলার জন্যেই আজকের
এই মন্ত্রণার আয়োজন। খুব সংক্ষেপে অসিবল্লভ মহাশয়ের উদ্বেগের কারণটা আমি আপনাকে
বলি, বাকি যা কথা আছে উনিই বলবেন”।
রাজামশাইয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে
মহামন্ত্রীমশাই বললেন, “আপনার রাজত্বকালের পনের বছর পূর্ণ হতে চলল। প্রথম দুবছরের
কিছু গৌণ বিদ্রোহ এবং দু-একটা ছোটখাটো যুদ্ধের পর এই রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিরাজ
করছে। অতএব অস্ত্র-শস্ত্রের কোন ঝনৎকার বহুদিন শোনা যায়নি। অসিবল্লভের সমস্যাটা
ঘটছে সেখানেই। অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার যদি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, অস্ত্র-শস্ত্রের
চাহিদা যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের কোন প্রয়োজনই থাকছে না। অসিবল্লভের
কথায় ওর অস্ত্রনির্মাণশালায় যে ভাণ্ডারগুলিতে ও নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ করে,
সেগুলিতে আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না। উপরন্তু, সংরক্ষিত অস্ত্রশস্ত্রগুলির
অনেকাংশই দীর্ঘ অব্যবহারে জং ধরে এবং ধুলো পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠছে”।
রাজামশাই চিন্তিত মুখে বললেন, “হুঁ। তার মানে, আপনি
কি বলতে চাইছেন, রাজ্যের পক্ষে নিরঙ্কুশ শান্তিও কাম্য নয়”?
মহামন্ত্রীমশাই সবিনয়ে বললেন, “সেটাই আমাদের এখন
বিবেচনার বিষয়, মহারাজ। মহারাজ এই প্রসঙ্গ
ছাড়াও আরও একটি জরুরি বিষয় আছে। যুদ্ধ হোক বা না হোক, প্রতিবেশী বিরোধী রাজ্যগুলির
সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র নির্মাণের
উন্নতিসাধন জরুরি। সে কাজটাও আমরা সর্বদাই চালিয়ে যাচ্ছি। তার ফলে দশ বছরের পুরোনো
অস্ত্রশস্ত্র, আমাদের সদ্য বানানো আধুনিক অস্ত্র সম্ভারের কাছে নেহাতই
লোহা-লক্কড়ের টুকরো হয়ে উঠছে। এখন কথা হল, আমরা কি তবে পুরোনো অস্ত্র-সম্ভার
গালিয়ে আবার লোহার তাল বানিয়ে ফেলব, এবং তার থেকে আধুনিক অস্ত্র বানাবো। কিন্তু
তাতে বেজায় খরচ, মহারাজ। আর যুদ্ধ-টুদ্ধ যদি না ঘটে, প্রতি বছরের বানানো নতুন
অস্ত্র, পরের বছরেই পুরোনো হতে থাকবে। আর তাকে গালিয়ে আরো আধুনিক অস্ত্র বানানোর
প্রক্রিয়াও চলতেই থাকবে! অর্থাৎ প্রতিবছরই রাজকোষ থেকে প্রভূত অর্থের এরকম অনর্থক
অপচয় হতেই থাকবে”।
রাজামশাই মন দিয়েই মহামন্ত্রীমশাইয়ের কথা
শুনছিলেন আর মাথা নিচু করে চিন্তা করছিলেন। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে বললেন, “সমস্যাটা
বুঝতে পারছি। কিন্তু আধুনিক ও উন্নততর
অস্ত্র বানানোর গবেষণা ও উৎপাদন তো আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। এ ছাড়া আর অন্য উপায়
তো দেখছি না। বহুকাল ধরে শান্তি বজায় রয়েছে বলে, আমরা অস্ত্র উৎপাদন তো বন্ধ করে
দিতে পারি না। কবে কোন প্রতিবেশী রাজার কী মতিগতি হয় কোন ঠিকানা আছে? তার জন্যে
সতর্ক থাকাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। তাই না?”
মহামন্ত্রীমশাই বললেন, “একদম যথার্থ বলেছেন
মহারাজ। কিন্তু আমি বলছিলাম, পুরোনো অস্ত্রগুলি যদি আমরা কোনভাবে বিক্রি করতে
পারি, তাহলে আমাদের নতুন অস্ত্র বানানোর যে খরচ সেটা আমাদের গায়ে লাগবে না এবং
অপব্যয় বলেও মনে হবে না। এমনকি বলা যায় না, আমাদের অস্ত্র-পসরার ঠিকঠাক প্রচার
করতে পারলে রাজ্য-কোষাগার হয়তো দু-পয়সা লাভের মুখও দেখতে পারে!”
রাজামশাই অবাক হয়ে মন্ত্রীমশাই ও অসিবল্লভের
মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, “সে কী করে সম্ভব? কে কিনবে? আপনিই তো বললেন, আমাদের
অত্যাধুনিক অস্ত্রের তুলনায় আমাদের পুরোনো অস্ত্রগুলি লোহা-লক্কড়ের সমান - সেই বাজে
লোহা-লক্কড় কিনবে কোন আহাম্মক?”
অসিবল্লভ সবিনয়ে বললেন, “কেনার লোক এখন নেই,
কিন্তু হতে কতক্ষণ, মহারাজ? তীক্ষ্ণ কূটবুদ্ধি সম্পন্ন কিছু যোগ্য গুপ্তচরকে নিয়োগ
করে, আমরা রাজ্যের সীমান্তে দু-চারটে বিদ্রোহ বানিয়ে তুলতেই পারি!”
রাজামশাই আরও অবাক হলেন, বললেন, “কি বলছেন, অসিবল্লভ,
আমরা আবার কাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বানাবো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না”।
অসিবল্লভ নিজের দুই কান ও নাক মুলে বললেন, “ক্ষমা
করবেন, মহারাজ, আমার ওভাবে বলা উচিৎ হয়নি। মহারাজ আমরা কারও বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবো
না - বরং আমরাই আমাদের বিরুদ্ধে কিছু মানুষকে বিদ্রোহী করে তুলবো”।
রাজামশাই কিছু বললেন না, তিনি যেন বিস্ময়ের শেষ
পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। কী বলছে এরা সব? যেখানে কোথাও কোন অশান্তি নেই, সেখানে
নিজেরাই খাল কেটে কুমীর ডেকে বিদ্রোহের অনল জ্বালিয়ে তুলবে? তিনি অসিবল্লভের মুখের
দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলেন।
অসিবল্লভ একটু ইতস্ততঃ করে আবার বললেন, “সত্যি
বলতে আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আপনার বিরুদ্ধে কিছু লোককে আমারা নানান
উস্কানি দিয়ে বিদ্রোহী করে তুলবো। তাদের মাথায় ঢোকাবো অস্ত্র ছাড়া বিদ্রোহ সম্ভব নয়।
তারা যেখান থেকে সম্ভব অর্থ সংগ্রহ করবে, অস্ত্র কেনার জন্যে। আর সেই অর্থের
বিনিময়ে আমরা আমাদের পুরোনো অস্ত্র-সম্ভার তাদের কাছে বিক্রি করবো”।
“কিন্তু সে বিদ্রোহ যদি আমাদের রাজ্যের পক্ষে
ক্ষতিকারক হয়?”
“কক্খনো হবে না, রাজামশাই। তার আগেই আমাদের সুশিক্ষিত
সৈন্যদল আমাদের বানানো আধুনিক অস্ত্র দিয়ে তাদের দমন করবে। হ্যাঁ মহারাজ, তারা
বিদ্রোহীদের নিঃশেষ করবে না, শুধু দমন করবে। যাতে আমাদের সৈন্যদল ফিরে এলেই বিদ্রোহীরা
আবার কিছুদিনের মধ্যেই নতুন করে তাদের বিদ্রোহ শুরু করতে পারে”।
রাজামশাই এ প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হলেন না, তিনি মহামন্ত্রীমশাইকে
বললেন, “আমার কিন্তু এ প্রস্তাব একেবারেই পছন্দ নয়। এতো আমাদের প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি
তঞ্চকতা, শঠতা? তাদের জেনেবুঝে অনিশ্চিত এক বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া... না, না, এ
হতে পারে না। আপনি কী বলেন, মহামন্ত্রীমশাই?”
“আমিও একমত, রাজামশাই। তবে রাজ্যের সকল প্রজাদের
মঙ্গলের জন্যে সামান্য কিছু প্রজাকে বিড়ম্বনায় ফেলা তেমন কিছু দোষাবহ নয়, অন্ততঃ
শাস্ত্রে সেরকমই বলে থাকে। তাছাড়া অন্য একটা দিকও ভেবে দেখবেন, রাজামশাই। আমাদের
সুশিক্ষিত সৈন্যরা কৃষিকাজ করে আর অলস বসে থেকে দিনদিন অপদার্থ হয়ে উঠছে। কোন
রাজ্যের সঙ্গে সত্যিসত্যিই হঠাৎ যদি যুদ্ধ লেগে যায়, আমাদের আধুনিক অস্ত্র নিয়ে
তারা কতটা কী প্রতিরোধ ও আক্রমণ করতে পারবে – সে বিষয়ে আমার ঘোর সন্দেহ হয়,
রাজামশাই। তাছাড়া তেমন যুদ্ধ যদি লেগেই যায়, এমনও হতে পারে তাদের অনেকেই যুদ্ধ
করতে রাজিই হবে না। কারণ দীর্ঘদিন নিশ্চিন্ত গৃহবাসী হয়ে, তাদের মানসিকতায় রণক্ষেত্রের
উত্তেজনা, হিংস্রতা, শক্তির অহংকার অনেকটাই মিইয়ে যেতে বসেছে। সেদিক থেকে মাঝে
মাঝে – বছরে এক দুবার - বিদ্রোহ দমনের জন্যে তাদের সীমান্তে পাঠাতে পারলে তাদের
পুরোনো অভ্যাস এবং দক্ষতা কিছুটা ঝালিয়েও নেওয়া যাবে”।
মন্ত্রীমশাই এবং অসিবল্লভের কথাগুলো উত্তরে রাজামশাই
কিছু বললেন না। সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে গেলেন গবাক্ষের দিকে। অনেকক্ষণ
বাইরে তাকিয়ে রইলেন, সবুজ রম্য প্রাসাদকাননের গাছপালা, ফুলের সমোরোহ দেখতে লাগলেন।
মহামন্ত্রীমশাই ও অসিবল্লভ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন, দু তিনবার চোখে চোখে
কথাও বলে নিলেন দুজনে।
বেশ কিছুক্ষণ পর রাজামশাই মহামন্ত্রীর দিকে ফিরে
চিন্তিত মুখে বললেন, “আপনাদের প্রস্তাবগুলিকে প্রত্যাখ্যান করার মতো যথেষ্ট যুক্তি
আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ – যুদ্ধবাজ দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা
কোনদিনই হতে চাইনি, সে কারণে মন থেকে ঠিক সায় পাচ্ছি না। আবার একথাও ঠিক, সুষ্ঠু রাজ্যশাসনের
জন্য রাজাকে অনেক সময়েই অপ্রিয় কাজ করতে হয়। অতএব আপনি বলুন, সীমান্তে বিদ্রোহ
বানিয়ে তোলার জন্যে আপনারা কী চিন্তা করেছেন?”
মহামন্ত্রীমশাই বললেন, “আমাদের রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম
সীমান্ত অঞ্চলটির অনেকটাই রুক্ষ অনুর্বর। সেই কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ অনুন্নত।
অতএব ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা আমাদের রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটাই দরিদ্র।
নিত্য-অভাব মানুষের মনে কখনও ঈশ্বরের প্রতি আবার কখনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভের
সঞ্চার করে। সেই ক্ষোভটাকেই আমরা কাজে লাগাতে চাই মহারাজ। আমাদের গুপ্তচর গিয়ে ওখানকার
প্রজাদের বিচ্ছিন্ন ক্ষোভগুলিকে উস্কে তুলতে থাকুক এবং একমুখী করে তুলুক। জমে উঠতে
থাকা সেই ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করলেই, আপনি যদি অনুমতি দেন, আপনার শ্যালক
শ্রী রতিকান্ত মহাশয়কে ওই ক্ষোভ প্রশমনের জন্যে আমরা পাঠাতে পারি...”।
মহারাজ চমকে উঠলেন, “রতিকান্ত? কী বলছেন
মহামন্ত্রী। ও করবে প্রজাদের ক্ষোভ নিরসন? বিলাসী- ইন্দ্রিয়ের দাস, বিবেক-বুদ্ধিহীন
গোঁয়ার...তাকে আপনি এই দায়িত্বে নিয়োগ করতে চান?”
অসিবল্লভ অতি বিনীতভাবে হাত কচলে বললেন, “ওঁকেই
যে দরকার মহারাজ। এ রাজ্যের আপামর জনগণ আপনাকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে এবং বিশ্বাস
করে। প্রজাদের ক্ষোভ যতই উস্কে তোলা যাক, তারা আপনার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ করতে
শতবার দ্বিধা করবে। কিন্তু আপনার
প্রতিনিধি হয়ে শ্রীযুক্ত রতিকান্ত মহাশয়ের মতো প্রশাসক ওদের মধ্যে গিয়ে পৌঁছলে, অচিরেই
তাদের ক্ষোভ বিদ্রোহে পরিণত হয়ে উঠবে। মহারাজ, এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তবে শ্রী
রতিকান্ত মহাশয়ের সুরক্ষা ব্যবস্থায় আমরা কোন কার্পণ্য করব না, সে বিষয়ে আপনি
নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন”।
মহারাজার এই শ্যালকটি তাঁর তৃতীয় রাণির ভ্রাতা।
রাজধানীতে তার নানান উপদ্রবে তিনি প্রায়শঃ ব্যতিব্যস্ত থাকেন। রাজপ্রাসাদ থেকে
অদূরে, তার নিজস্ব প্রমোদকাননে সে সর্বদাই মদ্যাসক্ত অবস্থায় থাকে। নিত্যনতুন
শয্যাসঙ্গিনীদের সঙ্গে সে রাত্রি যাপন করে। বেলা দ্বিপ্রহরে তার নিদ্রাভঙ্গ হয়। বিলাসী
রতিকান্ত প্রতি হেমন্তে মৃগয়া অথবা রাজ্যভ্রমণে বের হন। তার নিজস্ব নিরাপত্তা
রক্ষী থাকলেও, মহারাজ তার ভ্রমণ পথের সর্বত্র তাঁর বিশ্বস্ত কিছু অনুচরদের নিযুক্ত
রাখেন। পথের ধারের গ্রাম, জনপদ এবং নগরের সাধারণ প্রজাবৃন্দ যেন কোনভাবেই
রতিকান্তর লালসার শিকার না হয়ে পড়ে, সে দিকে তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখেন।
অতএব মহামন্ত্রীর এই প্রস্তাবে প্রথমে বিরক্ত
হলেও, তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। এবং একথাও তাঁর বুঝতে বাকি রইল না, মূর্খ,
অশিক্ষিত ও বিবেকহীন রতিকান্তই হয়ে উঠবে মহামন্ত্রী ও অসিবল্লভের হাতের পুতুল। সে যত বেশি উদ্ধত হবে, অত্যাচার-অনাচার করবে - ক্ষুব্ধ
প্রজারা তত তাড়াতাড়ি বিদ্রোহের ফাঁদে পা ফেলবে। অন্যদিকে রাজধানী থেকে
রতিকান্ত বিদায় হলে, তাঁকেও সর্বদা তটস্থ থাকতে হবে না। রতিকান্তর দিদি অর্থাৎ তাঁর
তৃতীয় রাণিও জানলে খুশি হবেন, মহারাজা তাঁর ভ্রাতাটিকে এতদিনে
চিনতে পেরেছেন। এবং ভরসা করে রাজ্যের কোন এক অঞ্চলের প্রশাসনিক
পদে নিযুক্ত করেছেন। অন্দরের অভিমান এবং বাইরের বিপদ দুটো দিক থেকেই তিনি চিন্তামুক্ত
থাকতে পারবেন।
মহারাজা বললেন, “সমস্ত বিষয়টি নিয়ে আমাকে এক-দুদিন চিন্তা করার
সময় দিন মহামন্ত্রীমশাই। আজ আমাদের মন্ত্রণা এখানেই স্থগিত থাক, আগামী পরশুদিন এই বিষয়ে
আমার মতামত জানাব”।
অসিবল্লভ মহারাজা ও মহামন্ত্রীকে বিনীত অভিবাদন করে মন্ত্রণাকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
২
পিপুলতলা গ্রামের ডামল বেশ কদিন বাড়িতে ছিল না। আজ
সন্ধের বেশ একটু পরেই সে বাড়ি ফিরল।
এরকমই তার স্বভাব। বাড়ি থেকে সে বেরোয় ভোরের আলো
ফোটার আগে, আর ফেরে রাত্রি প্রথম প্রহরে। মাঝে মাঝে আবার বেশ কদিন তার পাত্তা থাকে
না। গ্রামের লোক ডামলকে দেখতে পায়, তার বড়োসড়ো অসুখ হলে কিংবা বড়ো পালাপার্বণে।
অবিশ্যি অসুখ তার করে না বললেই চলে। ডামলের যা স্বাস্থ্য অসুখ-বিসুখ তাকে তেমন
কাবু করতে পারে না। লম্বা দোহারা চিতার মতো চেহারা। প্রবল শক্তি এবং অসম্ভব দ্রুত
তার চলা ফেরা। লাঠি বা বল্লম খেলায় ওস্তাদ। রণপা নিয়ে সে যখন দৌড়য় – তেজি ঘোড়াও
হার মানে তার গতিতে।
উঠোনে এসে ডামল যখন দাঁড়াল, ডামলের বুড়ি মা আঁতকে
উঠেছিলেন প্রথমে। ঘরের ভেতরে জ্বলা প্রদীপের আভাসে চিনতে না পেরে বুড়ি
চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, “কে র্যা ওখানে”।
ডামল হেসে ফেলল, বলল, “নিজির ব্যাটারে চিনতি পারলিনি,
কেমন মা বটে রে তুই?”
শ্বাশুড়ি আর ডামালের গলা শুনে রান্নাঘরের দরজায়
লম্ফ হাতে এসে দাঁড়াল মহুল, ডামালের বউ। লম্ফের আলোয় উঠোনের আঁধার কিছুটা ঘুঁচল।
ডামলের মা একটু লজ্জা পেলেন, ছেলের কথায়, “তোরে চিনব কী করে রে,
ড্যাকরা? মুখভর্তি দাড়ি, মাতায় চুলের বোজা...কি চেহারা করেছিস?”
মাটির দাওয়ায় উঠে বসল ডামল, বুক খোলা ফতুয়াটা
খুলে ঝুলিয়ে দিল, আড়ায়। বউকে বলল, “হুল, এক ঘটি জল দে দিনি। তেষ্টা পেয়েচে খুব”।
আদরের বউকে ডামল হুল বলে ডাকে।
ডামলের মা ছেলের পাশে বসলেন, “দিন দিন তুই বাপের মতন হয়ে উঠচিস। ভিটেতে তার মন বসত না। কোথায় যেত, কী
করত কিচুই খোলসা করেনি কোনদিন। একলষেঁড়ে। আর ঠিক তোর মতোই হুট করে ঘরে ঢুকেই হ্যা
হ্যা করে হাসত। হাড়জ্বালানে”।
বউয়ের হাত থেকে এখো গুড়ের ডাবটা নিয়ে মুখে পুরল
ডামল। তারপর মুখের উঁচুতে ঘটি তুলে গলায় ঢালতে গিয়েও থমকে গেল, হা হা করে হেসে
বলল, “বাপের ব্যাটা বটি। বাপের মতো হব না তো কি, ও পাড়ার নাদু মোড়লের মতো হবো?”
তারপর কলাৎ কলাৎ শব্দে ঘটির জল শেষ করে, খালি ঘটি দাওয়ায় রাখল।
ডামলের মা একটু অপ্রস্তুত হলেন। মঝের পাড়ার নাদু, গাঁয়ে না মানে আপনি মোড়ল ছিল। ডামল তখন ছোট্ট। ডামলের
বাপ ডামলের মতোই মাঝেমাঝেই হপ্তাভর, মাসভর বাড়ি থাকত না। তখন নাদু সন্ধের পর বাড়ির
সামনে ঘুরঘুর করত। ‘চোখ গেল’ পাখির শিস দিত। নাদুর ছিল ছোঁকছোঁকানি রোগ, একলা মেয়েছেলে
দেখলেই হুলো হয়ে উঠত। ডামলের মা বেশ কিছুদিন দেখে দেখে থাকতে পারেননি। একদিন রামদা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেড়ার ধারের
পেয়ারাগাছের আড়ালে। নাদু শিস দিয়ে দুবার ‘চোখ গেল’ ডাকতেই – খনখনিয়ে উঠেছিলেন ডামলের মা, “কোন আবাগির পুতের আঁতে চোক গেল পাকি সেঁদিয়েচে র্যা? আয় না,
এই রামদার চোপে গলাটা ফাঁক করে দি। দেকবি? সে পাকি ক্যামনে উড়ে যায় খাঁচা ছেড়ে”? এমনিতেই
ডামলের বাপকে নাদু ভয় পেত খুব। ওই দিনের পর সেই ‘চোখ গেল’ পাখি আর কোনদিন ফিরে
আসেনি ওদের পাড়ায়।
সেই ঘটনার কথাই আজ মনে করিয়ে দিল ডামল। বহুদিন হল
নাদু যমের দখিন দুয়োরে গেছে। ডামলের
বাপও চলে গেছে বছর তিনেক হল। ডামল বড়ো হয়েছে, সংসার হয়েছে, আর অবিকল বাপের মতোই হয়ে উঠছে দিন কে
দিন। ভুরু কুঁচকে ডামলের দিকে তাকিয়ে ডামলের মা বললে, “আলঝাল
বকে কতা ঘুরোস ক্যান? কোন চুলোয় ছিলি অ্যাদ্দিন – কী কাজ আমারে বল দিনি”।
ডামল মায়ের দিকে তাকিয়ে চোক নাচিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“আমার বাপ তোরে কোনদিন কয়েচিল, কোতা যায়, কী করে? শুধোলি কইত “আজকাজ”। আমারও সেই “আজকাজ”। তয় কোন আজা, কেমন আজা, তার আনি কে, সেটি বুলতে পারবনি। আমার বাপও ওই কাজই
করত, সে কতা তুই, জানিস। তুই যে ওই ভুঁড়ো-শেয়াল নাদুটাকে ঢিট করেছিলি, সে কতাটা
জেনেই বাপ আমার, তোকে-আমাকে ছেড়ে লিশ্চিন্তে বাইরে বাইরে কাজে ফিরতে পারত। তুই
আমার বৌ হুলটার বুকেও অমন বল এনে দে দিকিন, মা”।
“নে, নে আমারে আর বেশি ভালাই বুলোতি হবেনি। আজকাজ
করিস না কি ছাইপাঁশ করিস, বুজি না বাপু। আজার সঙ্গের নোকেরাও দেকেচি – কেমন সোন্দর
সাজপোশাক পরে, মাথায় পাগ বাঁধে, গলায় এতএত সোনার হার পরে। তোদের বাপ-ব্যাটার মতো
অখদ্দ্যে চেহারার কাউকে কোনদিন দেকিনি”।
ডামল অবাক হয়ে বলল, “তুই আবার আজা-আনিদের কবে
চাক্ষুষ করলি, মা?”
ডামলের মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, “ক্যানে? যাত্রাপালায় দেকায় না বুজি? আজা থাকে, আনি থাকে, তাদের সঙ্গে
মহামন্তী, সেনাপতি, নগরপাল...দেকিনি নাকি?”
ডামল হো হো করে হেসে উঠল, তারপর বলল, “কতাটা কয়েচিস
ঠিকই মা, ওরা হল গে উঁচু থাকের মানুষ। ওরা সবাই মিলে আমাদের এই আজ্যটা চালায়। কিন্তু ওদের আদেশে আসল কাজগুলো করে নিচের তলার মানুষরা।
আমাদের মতন মানুষরা। যেমন ধর, সেপাই, সান্ত্রী, ছোট কোটাল, বড় কোটাল...সে অনেক
লোক”।
ছেলেটা তার মাকে ফাঁকি দিতে পারেনি – ধরে ফেলেছে
ঠিক, ডামলের মা এমন একটা হাসি মুখে নিয়ে বললেন, “তয় তুই কি?
সেপাই? সান্ত্রী না কোটাল”?
ডামল আবার হাসল, বলল, “অত সহজ লয় কো মা। আজ্য চালাতে কত নোকের যে কত কাজ থাকে – সে তোর শুনে কাজ নেই কো। এটুকুন জেনে রাক, আমার বাপ আর আমিও তাদেরই একজন”।
ডামলের মা বুঝলেন, ছেলে শেষমেষ খোলসা করে কিছুই ভাঙল না। এড়িয়ে
গেল কথাটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে রইলেন। ডামল মায়ের এই আকুতিটা বোঝে। এ গ্রামের
কেউ চাষ করে, কেউ দোকান খুলে বাণিজ্য করে, কেউ মাটির হাঁড়ি কলসি বানায়, কেউ লোহার দা,
কাটারি, শাবল বানায়। এই সব লোকদের চেনা যায়, বোঝা যায়। কিন্তু তার বাপ কী করত, এবং এখন সে কী করে
- কেউ জানেও না, বোঝেও না। গ্রামের মণ্ডলসভায় তাদের নিয়ে জল্পনা হয়, সে জানে। কেউ ভাবে
ডামলের বাপ ডাকাতি করত, কেউ বলে ঠগী। ডামলও এখন সেই দলেই নাম লিখিয়েছে। তা নাহলে তাদের
পরিবারটা চলে কী করে? ডামলের বাপ কখনও কখনও দুমাস তিনমাস বাড়ি ফিরত না, কিন্তু তাতেও
তার পরিবারকে কোনদিন অভাবে-আতান্তরে পড়তে হয় না। কেন? তাদের পেশার এই দুর্বোধ্যতার
কারণেই গ্রামের কুচুটে দুর্জনেরা ওদের পরিবারটিকে সদাসর্বদা এড়িয়ে চলে। ঘনিষ্ঠ
মিত্রতা করতেও যেমন কেউ আসে না, তেমনি আসে না সামান্যতম কলহ করতেও।
ডামল
মায়ের ডানহাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বিশ্বেস যা মা,
আমরা যা করি খুব গোপন আজকাজ। সে কথা বুক ফুলিয়ে পাঁচজনকে বলার মতন লয়। ছেলেমানুষ কাল
থেকে দেকেচি, তোর কাচে ভিনগাঁয়ের এক মেয়েমানুষ আসত, আমি বলতাম “ময়নামাসি”। মনে আচে?
সে এসে আমাদের পরিবারের সকলের তত্ত্বতাবাস করত। পয়সা-কড়িও দিয়ে যেত। এখনও তো তাই করে –
ময়নামাসির মেয়ে ফুলকিদিদি।
করে না?”
ডামলের
মা ডামলের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। কিছু বললেন না, ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।
ডামল উত্তরে বলল, “ওরাও কিন্তু আমাদেরই মতো আজকাজ করছে, মা। কিন্তু এ কতা কোনভাবেই যেন কারও
কাছে পেকাশ করিস না, মা। পাঁচকান হলেই আমাদের সবার জেবনে বেপদ নামবে”।
ডামলের
মা কিছু বললেন না, চুপ করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ডামল মুখ তুলে দাওয়ার কোণের দিকে তাকাল।
হুল বসে আছে উনুনের সামনে, কড়াইতে কিছু রান্না হচ্ছে - বেশ সুবাস ছেড়েছে বাড়িময়। হুল মুখ
তুলে তাকাল – চোখাচোখি হল ডামলের সঙ্গে। লম্ফ আর উনুনের আভায় তার মুখখানিতে
আলো-আঁধারি ছায়া, কিন্তু চোখ দুটি বেশ উজ্জ্বল। সেই মায়াবী মেদুর দৃষ্টিতে
সে একটু আনমনা হয়ে গেল।
এই
ঘর, বুড়ি মা আর ওই যুবতী বউ নিয়ে তার সংসার – এই সব কিছু ছেড়ে তাকে কোথায় কোথায় ঘুরে
বেড়াতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় সব কাজ ছেড়েছুড়ে দিয়ে গ্রামে এসে জমি-জায়গা
নিয়ে চাষ করবে। গ্রামের আর সব লোকের মতো গতরে খেটে ফসল ফলাবে – শস্যে ভরে তুলবে গোলা।
তার বুকে পিঠে খেলা করবে – তার আর হুলের সন্তানরা…। তাদের নির্মল হাসিতে ভরে উঠবে
এই বাড়ির উঠোন, দাওয়া আর ঘরগুলি…।
কিন্তু গ্রামে একটানা কিছুদিন থাকলেই তার
মন-প্রাণ আনচান করতে থাকে। তার মন চলে যায় রাতের অন্ধকারে নির্জন
পথে দৌড়ে চলায়। পথের ধারের চটিগুলিতে অপেক্ষা
করে এক একজন অচেনা অজানা মানুষ – নির্দিষ্ট
নির্দেশ নিয়ে – অচেনা পথের হদিস নিয়ে। এ রাজ্যের নগরে-বন্দরে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় নানান সংবাদের খোঁজে, বিচিত্র
উদ্দেশে। ঠিক মানুষের থেকে সঠিক তথ্য এনে পৌঁছে দিতে হয় রাজধানীতে।
এই রহস্যময় অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার যেন নেশা ধরে গেছে। এই ধরনের দুশ্চিন্তা
আর উত্তেজনাবিহীন গ্রাম্য জীবন তার জন্যে নয় – সেকথা বুঝে গিয়েছে বেশ ক’বছর। তাই আজকাল
সে এই জীবনের জন্যে আর হাহুতাশ করে না। বরং বাড়িতে অবসর যাপনের সময়ও সে উদ্গ্রীব অপেক্ষায়
থাকে কবে আসবে তার ডাক। এবারে অবশ্য সে এসেছে, মাত্র, দুটি রাতের ছুটি নিয়ে।
ডামল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোন না মা, আমি কিন্তু পরশু
ভোর থাকতেই বেরিয়ে যাব। আর এবার ফিরতে ফিরতে অন্ততঃ মাস চার-পাঁচ…”।
ডামলের মা ডামলের হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলেন,
তারপর বেশ ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, “তাই বলি, মায়ের সঙ্গে তোর হঠাৎ এত নলপতা-সলপতা কেন?
তুই বেরিয়ে যা, এখনই – পরশু কেন? তোকে থাকতে হবে না, আজই বেরিয়ে যা। অ বৌ, ভাত বেড়ে
দে, ডামল বেরোবে…”।
ডামলের মা হাঁফাতে থাকেন রাগে এবং হতাশায়। ডামল চোখ তুলে তাকাল
হুলের দিকে, হুল একইভাবে তাকিয়ে আছে – মাটিতে গড়া মূর্তির মত।
“ও মা, শোন না, রাগ করিস না। এবারটা যেতে দে। এ কাজটায় না গেলেই
নয়। আমি কথা দিচ্ছি, এই কাজ সেরে অন্ততঃ ছমাস বাড়ির বাইরে পা রাখব না”।
ডামলের মা পাগলের মত বলে উঠলেন, “তুই কি জানিস, আজ প্রায় দু’মাস
হল তোর বৌ পোয়াতি? এসময় ওই মেয়েটার সোয়ামিকে কাছে পাওয়ার গুরুত্ব কি তুই বুজিস? আমি এই বুড়ো বয়সে তোর সংসার সামলাবো, আর তোর বউকে নিয়ে আতুপুতু
করে দিন কাটাব? পাষণ্ড, পিশাচ – ওরে ওই বাচ্চাটা যে তোর, তার প্রতিও তোর কোন দয়ামায়া
নেই রে অলপ্পেয়ে আক্খুটে? তুই পরশু যাবি তো? বেশ কথা। আমি কাল ভোরেই বেরিয়ে যাব বাড়ি
থেকে… তোর সংসার তুই বুঝে নে… আমি এই জ্বালা আর সইতে পারবনি”।
তিন ধাপ পৈঠে ভেঙে মহুল দ্রুত নেমে এল উঠোনে, বুকে জড়িয়ে ধরল
শাশুড়ি মাকে। কান্নাধরা গলায় বলল, “শান্ত হ, শান্ত হ, মা রে, এত রাগ করিসনি… নিজের
বেটাকে গাল দেওয়া মানে আমার বাচ্চাকেও গাল দেওয়া, মা। ওর জন্ম যেমন ডামলের রক্তে, তেমনি
তোর রক্তেও তো! ঠানদিদির গাল যে তার কাছে অভিশাপ, সেটা ভুলে গেলি কেন, মা? শান্ত হ,
শান্ত হ…”।
মহুলের কথায় এবং স্পর্শে ডামলের মায়ের রাগ অনেকটাই স্তিমিত হল।
দু হাতে বউয়ের মুখখানি ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায়
ভেঙে পড়লেন, “এ সব আমি কি বলে ফেললাম রে, বউ, এ আমার কি হল…”।
ডামল উঠোনের একধারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যে অনুভব করল, তার বউ আর
মায়ের পারষ্পরিক নির্ভরতা আর নিবিড় ভালোবাসা। সে স্বস্তির শ্বাস ফেলল নিঃশব্দে। তার
মা আর বউয়ের মধ্যে, মমতা আর মায়ার এই যে নিবিড় সম্পর্ক, সে কি ওরা দুজনেই মা বলে? একজন
অভিজ্ঞা জননী আর অন্যজন অপত্য-সম্ভবা। বাপ হয়ে এই মমতা সে কোনদিন অনুভব করতে পারবে
কি? তার প্রতি তার বাপের কি এমন মমতা ছিল? কিছু একটা ছিল সেটা মমতা না হোক, অন্য কিছু।
ছোটবেলায় বাড়ি ফিরলে, বাবা তাকে কোনসময়ই কাছছাড়া করত না। হাটে,
ধ্বজাপূজার মেলায় কিংবা গ্রামসভায় যেত বেটাকে কাঁধে চাপিয়ে। নদীতে নিয়ে যেত সাঁতার
শেখাতে। সেখানে সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে কুস্তি শেখাত। বড় হতে হতে নিজের হাতে শিখিয়েছে
নদীতে নৌকো বাইতে। তারপর তরোয়াল চালাতে, বল্লম চালাতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে রণপা চড়ে
দৌড়ে বেড়াতে। শিক্ষায় সন্তুষ্ট হলে বুকে জড়িয়ে ধরেছে ডামলের ঘর্মাক্ত শরীর। ডামলের
আজও মনে পড়ে, তার বাবার মুখের সেই তৃপ্তির হাসি আর দুই চোখের আশ্চর্য আলো। বাবার মতো
সে কি পারবে তার সন্তানকে বুকে করে গড়ে তুলতে?
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন