সপ্তম অধ্যায়ঃ
জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
|
১ |
শ্রীভগবান বললেন – হে পার্থ,
আমার প্রতি পূর্ণ অনুরাগে, আমার একান্ত শরণাপন্ন হয়ে, যোগ সাধনার যে প্রক্রিয়ায়,
আমার আত্মাকে পূর্ণস্বরূপে সন্দেহাতীত উপলব্ধি করা সম্ভব, এখন সেটাই শোনো। |
||
|
২ |
আমি তোমাকে আমার এই পরমব্রহ্ম
অনুভবের বিশেষ জ্ঞানের কথা সম্পূর্ণ বর্ণনা করব। যে জ্ঞানের কথা উপলব্ধি করতে
পারলে, এই জগতে অন্য আর কিছুই জানার বাকি থাকে না। |
||
|
৩ |
হাজার মানুষের মধ্যে
খুব অল্প লোকই আত্মজ্ঞানের জন্যে চেষ্টা করে থাকেন। আবার সেই অল্প লোকের মধ্যেও
ক্বচিৎ কেউ আমার আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন। |
||
|
৪ |
ভূমি, জল, অগ্নি,
বাতাস, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহংকার – এই আটভাগে আমার ঐশ্বরী প্রকৃতি বিভক্ত। |
||
|
৫ |
এই যে আটটি প্রকৃতির
কথা বললাম, এগুলি আমার নিকৃষ্ট স্বরূপ। এর বাইরে সমস্ত জীবের চেতনা স্বরূপ আমার
যে উত্তম প্রকৃতি, হে মহাবীর, তার কথা শোনো। আমার এই প্রকৃতিই জগৎকে ধারণ করে
আছে। |
||
|
৬ |
ধারণা করো যে, আমার এই
উভয় প্রকৃতি থেকেই জগতের সমস্ত জড় ও জীবের সৃষ্টি হয়েছে। অতএব আমিই এই জগতের
স্রষ্টা এবং আমিই এই জগতের প্রলয়। |
||
|
৭ |
হে
ধনঞ্জয়, আমার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য আর কিছুই হতে পারে না। সুতোয় গাঁথা মণির মতো, এই
জগতের সবকিছু আমার স্বরূপেই বাঁধা আছে। |
||
|
৮ |
হে
কুন্তীপুত্র, আমিই জলের তারল্য, আমিই সূর্য ও চন্দ্রের জ্যোতি, চারবেদে আমিই
ওঁকার, আকাশে আমিই শব্দ এবং মানুষের মধ্যে আমিই পৌরুষ। |
||
|
৯ |
পৃথিবীতে
আমি পবিত্র গন্ধ, আমিই অগ্নির দাহিকা শক্তি, সমস্ত জীবের আমিই প্রাণস্বরূপ এবং
আমিই তপস্বীগণের তপস্যা। |
||
|
১০ |
|
||
|
১১ |
হে
ভরতকুলশ্রেষ্ঠ, আমিই বলবান ব্যক্তির কামরাগহীন শক্তি, আবার আমিই সর্বজীবের
জীবধর্ম পালনের কামনা। [না পাওয়া জিনিষ পাওয়ার ইচ্ছাকে বলে কাম, আর পাওয়া বস্তু অস্থায়ী জেনেও, তার প্রতি আগ্রহের নাম রাগ। দেহধারণ ও বংশরক্ষার জন্যে যে কামনা, সে কামনা ধর্মবিরুদ্ধ নয়, সেটা জীবধর্ম, জীবধর্ম না থাকলে জীবের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায়।] |
||
|
১২ |
জেনে
রাখো, আমার থেকেই জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাবের উৎপত্তি হয়। আমি এদের বশীভূত না হলেও, এই
সমস্তভাব আমার অধীন। |
||
|
১৩ |
এই
তিনগুণের মায়ায় সমস্ত জীব মুগ্ধ ও বিভ্রান্ত হয়, এবং তার ফলে এই তিনগুণের অতীত
আমার পরম নির্বিকার স্বরূপ তারা উপলব্ধি করতে পারে না। [ত্রিগুণ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃগুণ - এই গুণের কথা সবিস্তারে পড়া যাবে গীতার সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগ যোগে।] |
||
|
১৪ |
সত্ত্ব,
রজ ও তম, এই তিনগুণের প্রভাবে, আমারই সৃষ্টি করা অলৌকিক মায়াকে অতিক্রম করা
দুঃসাধ্য। যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আমার শরণাপন্ন হয়, তার পক্ষেই এই মায়া অতিক্রম
করা সম্ভব। |
||
|
১৫ |
এই মায়ার
প্রভাবে, দুর্জন ও মোহগ্রস্ত ইতর জনেরা বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে অসুরের মতো ব্যবহার
করে, কিন্তু তারা আমার ভজনা করে
না। |
||
|
১৬ |
হে
ভরতকুলশ্রেষ্ঠ অর্জুন, রোগশোকে অভিভূত আর্তজন, আত্মজ্ঞানের জন্য উৎসুক, সম্পদের
প্রত্যাশী ও ব্রহ্মজ্ঞ – এই চার প্রকৃতির ব্যক্তি আমাকে ভজনা ক’রে সুকৃতি করেন। |
||
|
১৭ |
এই চার প্রকৃতির
ব্যাক্তিদের মধ্যে আমাতে একনিষ্ঠ এবং সর্বদা আমাতে ভক্তিযুক্ত জ্ঞানীই
সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ আমি জ্ঞানীব্যক্তির অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার প্রিয়। |
||
|
১৮ |
এঁদের
সকলেই মহান ও আমার প্রিয়, কিন্তু জ্ঞানী আমার আত্মা স্বরূপ এবং আমার সঙ্গে তাঁর
কোন প্রভেদ নেই, কারণ শ্রেষ্ঠ সাধনায়, জ্ঞানী আমাতেই তাঁর সবকিছু সমর্পণ করে
থাকেন। |
||
|
১৯ |
জ্ঞানী
আমার অত্যন্ত প্রিয়, তার কারণ বহুজন্মের একাগ্র সাধনায় জ্ঞানী ব্যক্তি ‘এই নিখিল
বিশ্বই বাসুদেব’ এই অনুভবে আমার ভজনা
করেন। এই প্রকৃতির মহাপুরুষ খুবই দুর্লভ। |
||
|
২০ |
অনেক
বিবেক বুদ্ধিহীন ব্যক্তি পুত্র, বিত্ত এবং বিষয়ের কামনায়, নানান জপ ও উপবাসের
নিয়ম পালন করেন এবং নিজের স্বভাব অনুসারে অন্য অনেক দেবতার পুজা করেন। |
||
|
২১ |
যে যে
ভক্ত যে যে প্রতিমায় শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজা অর্চনা করেন, আমি সেই সেই ভক্তদের সেই
সেই প্রতিমার প্রতি অচলা ভক্তি প্রদান করে থাকি। |
||
|
২২ |
সেই ভক্ত
পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর প্রিয় যে দেবতার আরাধনা করেন, আমারই বিধানে সেই ভক্ত
তাঁর প্রিয় দেবতার থেকে কাম্য বস্তু লাভ করে থাকেন। |
||
|
২৩ |
কিন্তু
অল্পবুদ্ধি ভক্তদের এই যে ফল লাভ, তা অস্থায়ী হয়। দেবতার উপাসক ভক্তেরা দেবতাকেই
পেয়ে থাকেন। কিন্তু একই প্রচেষ্টায় আমার ভক্তগণ আমাতেই মিলিত হয়ে থাকেন। |
||
|
২৪ |
অল্পবুদ্ধি
ব্যক্তিগণ আমার অপূর্ব ও অক্ষয় পরমাত্মস্বরূপ উপলব্ধি করতে না পেরে, আমাকে
ব্যক্তিভাব স্বরূপ দেহধারী মনে করে। |
||
|
২৫ |
আমি
যোগমায়ার আড়ালে থাকি, সকলের কাছে প্রকাশ হই না। সেই কারণে, মায়ায় মুগ্ধ এই জগতের
লোক জন্মমৃত্যুর অতীত আমার এই অক্ষয় স্বরূপও জানতেও পারে না। |
||
|
২৬ |
হে
অর্জুন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিন কালের সমস্ত ভূত অর্থাৎ জীবের বিষয় আমার
জানা আছে, কিন্তু আমার স্বরূপ কেউ জানতে পারে না। |
||
|
২৭ |
হে
শত্রুদমন অর্জুন, আসক্তি আর বিদ্বেষের দ্বিধায় জন্মকাল থেকেই সমস্ত জীব
মোহগ্রস্ত হয়ে থাকে। [প্রিয়
বিষয় পাওয়ার ইচ্ছে থেকে আসে আসক্তি, আর অপ্রিয় বিষয়ে আসে বিদ্বেষ। এই দ্বিধা
থেকেই মানুষ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-শোকের মোহে বাঁধা পড়ে।] |
||
|
২৮ |
কিন্তু
যে সকল পুণ্যকর্মা ব্যক্তির পাপ আর অবশিষ্ট নেই, চিত্ত থেকে দ্বন্দ্ব এবং এই মোহ
দূর হয়ে গিয়েছে, তাঁরা একনিষ্ঠ কঠিন ব্রতে আমার ভজনা করেন। |
||
|
২৯ |
যাঁরা
জরা ও মৃত্যু থেকে মুক্তির ইচ্ছায়, আমার শরণাগত হয়ে সাধনা করেন, তিনি পরম
ব্রহ্ম, সমগ্র অধ্যাত্ম এবং নিখিল কর্মের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন। |
||
|
৩০ |
যাঁরা অধিভূত, অধিদৈব এবং অধিযজ্ঞের সহিত আমাকে উপলব্ধি করতে পারেন, সেই সব সমাহিতচিত্ত ব্যক্তি মৃত্যুর সময়েও আমায় ভুলতে পারেন না। [অধিভূত - আমাদের এই নশ্বর শরীর যে পঞ্চভূতের অধিষ্ঠান, সেই পঞ্চভূতও প্রকৃতপক্ষে পরম ব্রহ্মাই। অধিদৈব - অধিষ্ঠাতা দেবতা, দেবতাত্মা ব্রহ্ম - হিরণ্যগর্ভ, অর্থাৎ আমরা যে যে দেব-দেবী প্রতিমার ধ্যান বা পূজা করি, তাঁদের সকলেরই আত্মা পরমব্রহ্ম। অধিযজ্ঞ - যে দেবতার উদ্দেশ্যেই আমরা যজ্ঞ সংকল্প করি না কেন, পরম ব্রহ্মই সেই যজ্ঞের প্রবর্তক ও ফলদাতা।] |
জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন