এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্র থেকে - ""চিনি"লে না.."
এরকমই
এক সময়ে বড়মামা বাবাকে চিঠি লিখলেন,
“পরম
কল্যাণীয় নারায়ণ,
শ্রী
মঙ্গলময়ের কৃপায় তোমরা সকলে কুশলে আছ আশা করি। শ্রীমান পান্নার পরীক্ষার ফল শুনিয়া
আমরা সকলে অশেষ প্রীতি লাভ করিয়াছি জানিবে। এমনই সফলতার সহিত শ্রীমান পান্না
ভবিষ্যতেও পিতৃকুল ও মাতৃকুলের মুখ উজ্জ্বল করিবে সন্দেহ নাই।
এক্ষণে,
তোমাদিগের নিকট আমাদের সকলের বিশেষ অনুরোধ, শ্রীমান পান্না কয়েক দিবসের জন্য যেন
আমাদের এখানে আসে। আমাদের তো বটেই, শ্রীমান পান্নার মাতামহীরও বড়ো সাধ একবার সে
আসিয়া দেখা করিয়া যায়। উপরন্তু, এই বৎসর বাস্তুপুজোর পালা আমাদের ভাগে পড়িয়াছে,
কাজেই শ্রীমান পান্না আসিলে সে অন্যরকম এক পুজোর আয়োজনও প্রত্যক্ষ করিতে পারিবে –
যাহা সচরাচর কলিকাতায় দেখা সম্ভব নহে। পান্নার প্রতি আমাদিগের স্নেহাধিক্যের কথা
তোমরা অবগত রহিয়াছ, কাজেই আমরা সকলে পান্নার প্রতীক্ষায় রহিলাম জানিবে।
পত্রপাঠ
উত্তর দিবে ও তোমরা সকলে আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করিবে। ইতি।
আঃ
বড়দাদা।”
[আমার সমবয়স্ক যাঁরা, তাঁরা অবগত আছেন, কিন্তু অর্বাচীন ছোকরা সম্প্রদায়ের জন্য বলি, "আঃ" শব্দটি কোন বিরক্তিসূচক ধন্ব্যাত্মক শব্দ নয় - এটি "আশীর্বাদক"-এর সংক্ষিপ্তসার।]
চিঠি পাওয়া মাত্র আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং মাকে তিতিবিরক্ত করে ফেললাম কবে যাবো জানিয়ে বড়োমামাকে চিঠির উত্তর দিতে। অফিস থেকে ফেরার পর বাবাকে জল খাবার দিতে দিতে মা বড়োমামার চিঠিটি বাবাকে দিলেন। বাবা পড়লেন কিছু বললেন না, নিশ্চিন্তে মুড়ি খেতে লাগলেন – মা জলের গ্লাস দিতে দিতে বাবাকে জিগ্যেস করলেন, ‘পড়লে’?
-‘হুঁ’।
-‘তুমি কি এই রবিবার পান্নাকে ছেড়ে দিয়ে আসতে পারবে’?
-‘না, না কাল বাদ পরশু, এই শুক্রবার আমায় পুরুলিয়া যেতে
হবে – অন্ততঃ দিন চার পাঁচেকের টুর’।
-‘তাহলে, পরের রোববার’?
-‘ততদিনে তো বাস্তুপুজো শেষ হয়ে যাবে’।
-‘সে না হয় যাবে, কিন্তু দেখা তো করে আসতে পারবে। এরপর তো
আবার ইলেভেনের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, তখন আবার কবে যাওয়া হবে, না হবে...’।
-‘না, না। তা কেন? পান্না একলা যেতে পারবি না’? বাবা আমায়
জিগ্যেস করলেন।
-‘না পারার কি আছে? মা শুধুশুধু ভয় পাচ্ছে, বলছে একলা পারব না। ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে...’। আমি বললাম।
মা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘কখন বললাম ছেলে ধরায় নিয়ে যাবে? বলছিলাম এতটা দূরের পথ, ট্রেন, বাস...পারবে কি’? মায়ের গলায় দ্বিধার সুর। বাবা হাসলেন।
মাকে বললেন ‘ঠিক পারবে। বড়ো হচ্ছে। একলা চলতে হবে না? তোমার ঘুনুকে আমি বোকাসোকা ভাবতাম বলে আমাকে খুব কথা শোনাতে! দেখলে তো মাধ্যমিকের রেজাল্টটা - যতটা বোকা ভাবতাম ততটা তো নয়। ও ঠিক পেরে যাবে। চিন্তা করো না...’।
বাবার আশ্বাসবাক্যেই হোক বা বাবার মুখে আমার প্রশংসা শুনেই হোক মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হলো, বললেন, ‘কবে যাবে বলো, রোববারে’?
-‘না, না, রোববারে ট্রেন কম থাকে, রেগুলার চলেও না। আর
শনিবারের ট্রেনে খুব ভিড় হয়, কাজেই শুক্রবারেই ও চলে যাক, হাল্কা ভিড়ে অসুবিধে হবে
না উঠতে, নামতে’।
-‘সেই ভাল, তাহলে ও চিঠির আর জবাব দিয়ে কাজ নেই, একেবারে হাজির হয়ে যাবি, দেখ পারবি তো’? শেষ কথাগুলো মা আমাকে বললেন।
একটু চিন্তা করে বাবা বললেন, ‘মাঝে শুধু কালকের দিনটা - বৌবাজারে খুব ভালো ফুলকপি উঠেছে দেখছিলাম, কাল সকালে ভাল দেখে গোটা ছয়েক নিয়ে আসবি। নাঃ থাক, আমিই এনে দেব যা যা আনার’।
কোন বিপদ ঘটল না, কোন ছেলে ধরা ফিরেও তাকালো না, নির্বিঘ্নে হাওড়া স্টেশন পৌঁছলাম, মেমারির টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে পড়লাম। জানালার ধারে একটা নিশ্চিন্ত সিট দখল করে সিটের নীচেয় রাখলাম ব্যাগটা আর থলি দুটো। তারপর আরাম করে বসে সদ্য কেনা চারমিনারের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরালাম সদ্য কেনা টেক্কা দেশলাই দিয়ে। এক বুক ধোঁয়া নিয়ে উপলব্ধি করলাম বড়ো হয়ে ওঠার ঝাঁজালো আমেজ। এইটুকুর জন্যেই রিকশা না করে পয়সার সাশ্রয় করেছিলাম আসার সময়। কাজেই বড় হয়ে ওঠার বাড়াবাড়িটা তারিয়ে উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম মেমারি।
মেমারিতে বাসে উঠতে গিয়ে বিড়ম্বনা, কোন সিট খালি নেই, পরের বাস একঘণ্টা পর। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এতটা পথ দাঁড়িয়ে যাওয়া আদৌ সুখপ্রদ নয়। কাজেই উঠতে গেলাম বাসের ছাদে। বাসের কণ্ডাকটার আমাকে উঠতে দেবে না – আমি নাকি বাচ্চা। গম্ভীরভাবে যখন তার সামনে এক ভাঁড় চা খেয়ে একটা চারমিনার ধরালাম, সে আর আপত্তি করল না, বরং সে আমাকে সাহায্য করল বাসের ছাদে আমার ভারি থলিটা তুলে নিতে।
গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে যখন নামলাম, সকাল সাড়ে দশটা। একটানা রোদ, তীব্র হাওয়া আর প্রচণ্ড ধুলোয় মাথার চুল থেকে ভুরু অব্দি কিচকিচ করছিল, মুখের মধ্যেও ধুলোর অনুভূতি। মাথার চুলগুলো শক্ত হয়ে খাড়া। আমার কৈশোরের কিশলয়সম গোঁফদাড়িও তথৈবচ। মামাবাড়িতে এইরূপে একলা একলা আবির্ভাব বেশ আলোড়ন তুলবে নিঃসন্দেহে।
বাসস্ট্যাণ্ডে মামাতো বড়দার এক বন্ধু ক্ষিতীশদার সঙ্গে দেখা, স্ট্যাণ্ডে তার সাইকেল ছিল, সাইকেল বের করতে করতে সে বলল, ‘কিরে, একা-একা? পিসীমা ছাড়ল’?
-‘তবে? বাচ্চাই থাকব নাকি চিরটাকাল’?
-‘উঁ - বাব্বা, খুব পেকে গিয়েছিস দেখছি! নে’ নে’ থলেটা হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে দে, আর তুই পেছনে বসে পড়’। তাই করলাম, আমি ব্যাগ নিয়ে চেপে পড়লাম ক্যারিয়ারে। যদিও মনে হচ্ছিল এমন আন্তরিক লিফ্টটা নিষ্কণ্টক হবে না। হলও তাই, সাইকেল চালু করেই বলল, ‘আমি তো সাতগেছে থেকে উঠলাম, তোকে বাসের ভেতর তো দেখলাম না, ছাদে চেপেছিলি নাকি’?
-‘কি করব মেমারিতে সিট পেলাম না যে’।
-‘তাই বলে ছাদে? দাঁড়া বিষ্ণুকা’কে বলছি, খুব পেকে গেছিস,
না’? বিষ্ণুকা’ মানে আমার বড়োমামা। গ্রামের দিকে কাকাকে সংক্ষেপে কা’ বলে, ছোটকা,
মেজকা...।
-‘অনেকেই তো ছিল, আমি কি একলা নাকি? আর এ কথা মামাকে বলার
কি দরকার’?
-‘অনেকে মানে? ওরা সব গাঁয়ের চাষাভুষো লোক, ওরা আর তুই?
কিছু একটা হয়ে গেলে’?
-‘ঠিক আছে। কিছু হয় তো নি, ছেড়ে দাও না, ক্ষিদ্দা’।
-‘পাগল হয়েছিস, এই তিন চারদিন আগেই বিষ্ণুকা’ আমাদের বাড়ি
এসেছিল, কথায় কথায় তোর কথাও উঠল। বলছিল তুই খুব ভাল রেজাল্ট করেছিস। আমি জেনেশুনে
একথা চেপে যাবো, আর পরে জানতে পারলে বিষ্ণুকা’ আমাকে ছেড়ে দেবে’? চুপ করে রইলাম।
এবড়ো খেবড়ো মেঠো রাস্তার ঝাঁকুনি পশ্চাতে সহ্য করতে করতে ভাবতে লাগলাম, এরপর সব
শুনে বড়োমামা কি রকম ঝাঁকুনি দেন কে জানে।
বাড়ি পৌঁছে ক্ষিদ্দা কিন্তু ওই প্রসঙ্গ তুলল না, বড়মামা ছিলেন না, মামীমাকে গিয়ে বলল, ‘কাকিমা, তোমাদের বাড়ি কাকে নিয়ে এলাম দেখ, একদম জুয়েল, নামেও, কাজেও – পান্না’। মামীমা সত্যি আমাকে দেখে খুব অবাক হলেন।
আমি প্রণাম করতে আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বললেন, ‘কি করে এলি? একা একা! কলকাতা থেকে? বাসরে কতো বড় হয়ে গেছিস। বোস বোস, ক্ষিতু তুই ও বোস। তুই ঠিক বলেছিস একদম জুয়েল’! আমি ক্ষিদ্দার সাইকেলের থেকে থলিটা নামিয়ে পিঁড়েয় রাখলাম। মা বলে দিয়েছিলেন থলি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফুলকপিগুলোকে হাওয়ায় বের করে রাখার জন্যে, আমি থলি থেকে বার করতে লাগলাম সব জিনিষপত্র। মামীমা সরবৎ বানিয়ে নিয়ে এলেন চটপট - দুজনের জন্যে দু গেলাস, হাতে নারকেলের নাড়ু।
আমাকে থলি খালি করতে দেখে মামীমা বললেন, ‘ওই থলেটা তুই এনেছিস, আমি ভেবেছিলাম ওটা ক্ষিতুর...তোর বাবা-মায়ের কি আক্কেল রে, পান্না। এতবড়ো একটা বস্তা তোকে দিয়ে পাঠালো...নে, ওসব এখন রাখ, অনেক করেছিস, একটু জল খেয়ে জিরো দেখি’।
নারকেলের নাড়ু আর সরবৎটা খেয়ে খুব তৃপ্তি হল, কিন্তু মামীমার মুখটা বেশ রাগ রাগ, একটু ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আরেকটু জল দেবে, মামীমা’?
আমার বলার ভঙ্গীতে মামীমা ফিক করে হেসে ফেললেন, বললেন, ‘ঠিক তো, তোর বাবার ওপর রাগ, তোর ওপর দেখাচ্ছি কেন? দাঁড়া আনছি’।
নাড়ু আর সরবৎ খেয়ে ক্ষিদ্দা কেটে পড়ল, এদিকে দিদিমা ফিরলেন পুকুরঘাট থেকে স্নান সেরে শিবতলায় জল দিয়ে, সঙ্গে ছোটমাসিমা, বন্নিদিদি। আমাকে দেখে সকলেই তাজ্জব। কখন এলি, কার সঙ্গে এলি, কী করে এলি, এতো মালপত্র কী করে আনলি, উত্তর দিতে দিতে জেরবার। বিশ্বাসই করল না যে আমি একলা এসেছি। মামীমা বলাতে বিশ্বাস করল।
এবার দিন তিনেক থাকার পর ঠিক আগের অনুভূতিটা আর মিলল না। গতবারে গ্রামে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্কের যে সুর বাঁধা হয়েছিল, মনে হল সে সুরটা কেটে গেছে! কথাবার্তার মধ্যে বারবার চলে আসছিল আমার ভাল রেজাল্ট অথবা হতে পারে আমারই মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল অকারণ অহং। দুইয়ে মিলে তৈরি হয়ে উঠেছিল আমাদের দূরত্ব। কাজেই একঘেয়ে লাগছিল দিনগুলো, মনে হচ্ছিল কলকাতায় আমার বন্ধুদের কথা।
এরকম সময়েই একদিন সক্কাল সক্কাল ছোটমাসিমা আর বন্নিদিদি চুপিচুপি আমার কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এল, ‘সিনেমা দেখতে যাবি’?
-‘কি বই? কোথায়? মেমারি, বর্ধমান গিয়ে সিনেমা দেখা আমার
পোষাবে না’।
-‘না রে, এই তো সাতগেছেতে, নতুন হল হয়েছে মাস কয়েক হল। এখন
“সপ্তপদী” লেগেছে – উত্তম-সুচিত্রার’।
-‘এর আগে কোনদিন যাও নি’?
-‘পাগল নাকি? বড়দা ছাড়বে নাকি একা একা’? ছোটমাসিমা বললেন।
‘আমরা মেয়ে না’?
-‘বড়োমামা আমার সঙ্গে তোমাদের ছাড়বেন কি করে জানলে’?
-‘ছাড়বে, বাবা তোকে একদম অন্যচোখে দেখে’। বন্নিদিদি বলল।
-‘গ্যাস খাওয়াচ্ছিস না তো’? আমি বন্নিদিদিকে বললাম।
-‘কি সব ভাষা শিখছিস, গ্যাস খাওয়ানো আবার কি রে’? ছোটমাসিমা
বিরক্ত হলেন।
-‘হুম। কবে যাবে’?
-‘আজই’।
-‘শো কটার সময় শুরু’?
-‘দুটোয়’
-‘তার মানে বারোটার বাস ধরতেই হবে’।
-‘হ্যাঁ’
-‘বড়োমামা কোথায়’?
-‘জলখাবার খাচ্ছে, একটু পরেই বেরোবে’। বলে ছোটমাসিমা আর বন্নিদিদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সাগ্রহে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে পিছু ফিরতে পারলাম না। যতই হোক ছেলে তো – মানে পুরুষ!
বড়ো মামা নীচের দাওয়ায় বসেছিলেন, আমাকে দেখে ডাকলেন, ‘পান্না। এদিকে আয়, বোস। পরশু থেকে বাস্তুপুজো। আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। এবারে আমাদের ভাগে পুজো, আমাদের পাঁঠা মানত আছে, বলি হবে। সেই পাঁঠা দিয়ে নিরিমিষ মাংস রান্না হবে মায়ের ভোগের জন্যে - কোন দিন খাসনি এমন’।
-‘মাংস আবার নিরামিষ হয় নাকি’?
-‘মানে ওই আর কি। মায়ের এই ভোগ রান্নায় পেঁয়াজ, রসুন দেওয়ার নিয়ম নেই কিনা, শুধু আদা আর ধনে জিরে, তাই নিরিমিষ বলে লোকে...দেখিস কেমন অন্য রকম স্বাদ’। মামীমা জলখাবারের থালা নিয়ে এসেছিলেন। পরোটা আর আলু ছেঁচকি।
খেতে খেতে জিগ্যেস করলাম, ‘মামা, সাতগেছেতে নাকি সিনেমা হল খুলেছে, সিনেমা দেখতে যাবো’? বড়োমামা খুব একচোট হাসলেন হা হা করে, তারপর হাসি থামিয়ে মামীমাকে ডেকে বললেন, ‘শুনছ? পান্নার কথা শুনে যাও। কলকাতার গ্লোব, মেট্রো ছেড়ে, পান্না সাতগেছে যাবে সিনেমা দেখতে...’।
মামীমা আরো পরোটা দিতে দিতে বললেন, ‘তাতে কি? সে রাজধানী শহর, আর এ হচ্ছে গ্রাম, যেখানে যেমন। যাক না ঘুরে আসুক, এখানকার সিনেমা হল কেমন হয় দেখে আসুক। তোর সঙ্গে, পান্না, মেয়েগুলোকেও নিয়ে যা। বেচারারা বই দেখতে পায় না, মুখ শুকিয়ে ঘোরে...’। বুঝলাম বড়োমামীমাও, মাসিমা আর বন্নিদিদির পরামর্শে সামিল। কিন্তু বড়োমামা অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না। চুপ করে খেতে লাগলেন। মামীমা আর আমি সামনে বসে, আর আড়ালে ছোটমাসিমা আর বন্নিদিদির টেনসানের পারদ চড়তে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে বড়োমামা জিগ্যেস করলেন, ‘কি বই’?
-‘“সপ্তপদী” – উত্তম-সুচিত্রার’। আমি উত্তর দিলাম।
-‘অ। এই পথ যদি না শেষ হয়...’ বড়োমামার মুখে হাল্কা হাসি। খাওয়া শেষ করে এক গেলাস জল খেয়ে তৃপ্তির শব্দ করে বললেন, ‘আআআঃ, যা, দেখে আয় – ওদেরও নিয়ে যা, তুই যাচ্ছিস যখন ওরাও দেখে আসুক তোর সঙ্গে...’। রান্নাঘর থেকে ছোটমাসিমা বড়োমামার জন্যে চা আনছিলেন, তাঁর হাত কেঁপে উঠল বড়োমামার এই কথায় – আনন্দে একটু চা চলকে পড়ল প্লেটে।
মুশুরির ডালসেদ্দ, আলুসেদ্দ আর ডিমসেদ্দ আর ঘরে বানানো গব্য ঘি মেখে এক পেট গরম ভাত খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সাড়ে এগারোটা নাগাদ, বারোটার বাস ধরে আমরা সাতগেছে পৌঁছে গেলাম পৌনে একটায়। করোগেটেড টিনের শেড আর ইঁটের দেওয়াল দেওয়া বিশাল গুদামঘরে সিনেমা হল। কোলাপ্সিব্ল্ গেটের ওপাশে চটের পর্দা। দেয়ালে বড়ো বড়ো পোস্টারে সুচিত্রা আর উত্তমের মোহময় ছবি। পরের সপ্তাহের বই উত্তম-তনুজার “অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি”! দেড়টার থেকে টিকিট দেবে বলে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা, বন্ধ কাউন্টারের সামনে। আমার পাশে দাঁড়ানো বন্নিদিদি আমার হাত ধরে বলল, ‘নেক্সট উইকেও তুই থাকছিস তো’?
আমি গম্ভীরভাবে বললাম, ‘শুধু নেক্সট উইক না, ভাবছি এরপরে সারাজীবনটাই থাকবো’।
অবাক হয়ে বন্নিদিদি বলল, ‘তার মানে’?
-‘এ হপ্তায় “সপ্তপদী”, পরের সপ্তায় “অ্যান্টনী ফিরিঙ্গী”, তার পরের সপ্তাহে...এ সব ছেড়ে কলকাতা গিয়ে কী করবো’? আমার কথার ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে বন্নিদিদি আর ছোটমাসিমা দুজনেই রেগে গেল, ছোটমাসিমা বললেন, ‘ছাড় তো ওর কথা। খুব বেড়ে গেছে, পান্নাটা। ন’দিদিকে বলতে হবে...’। ন’দিদি মানে আমার মা।
ভাদ্র মাসের তীব্ররোদ আর গুমোট ঘামে আমাদের অস্থির অবস্থার মধ্যে প্রায় পৌনে দুটোর সময় টিকিট দেওয়া শুরু হল। বেশ ধাক্কাধাক্কির মধ্যে তিনটে টিকিট যোগাড় করে বীরের মতো যখন বের হলাম, তখন পশ্চিম আকাশে ঘন শ্যামল মেঘ উঁকি দিচ্ছে। আমরা টিকিট নিয়ে হলে ঢুকলাম। টিনের চাল দেওয়া বদ্ধ ঘরের ভেতর অসহ্য গরম, আমাদের পেটের সেদ্ধ-ভাতের সঙ্গে আমরাও সেদ্ধ হতে হতে চেয়ারে বসলাম। কাঠের ঠকঠকে শক্ত চেয়ার।
হলের মাঝখানে প্রজেক্টার বসানো, তার পাশে থরে থরে টিনের গোল বাক্সে ফিল্মের রোল। কয়েক বার আমাদের স্কুলে আর পাড়ায় সাদা পর্দা খাটিয়ে দেশভক্তির সিনেমা দেখা ছিল বলে, ওগুলো চিনতে অসুবিধে হল না। দুটো দশ নাগাদ দুটো দরজায় চটের পর্দা নেমে এল, সারা হলে গোটা চারেক বাল্ব জ্বলছিল, সেগুলোও নিভে গেল। মাথার ওপর টিনের চালে অজস্র ছোট ছোট ফুটো দিয়ে ঢুকে আসছিল রোদ্দুর, আধো অন্ধকারে খড়খড় আওয়াজ তুলে চালু হয়ে গেল প্রজেক্টরের মোটর। বর্ষার জলে ভেজা, ছোপ ধরা সাদা পর্দায় নড়ে চড়ে বেড়াতে লাগল ছবি – চলচ্চিত্র!
স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের পরম উন্নতির জন্য, আমাদের সরকার কতটা দায়বদ্ধ সেই প্রচার-সংবাদ প্রথমে দেখতেই হল। সাদাকালো গমের গোছা হাতে পাঞ্জাবী চাষীর হাসিভরা মুখ পর্দায় প্রকট হচ্ছিল বারবার। সেই সংবাদ শেষ হতে, শুরু হল ‘সপ্তপদী’। মোটামুটি আধঘন্টা অন্তর ফিল্মের রিল পাল্টানোর জন্যে সিনেমা থেমে যাচ্ছিল বার বার, প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আমরা সিনেমার গল্পে যখন ডুবে রয়েছি, উত্তমকুমার যখন বেসুরে বেতালায় এবার কালী তোমায় খাব গান ধরেছে্ন, সুচিত্রার ফিরিঙ্গী গানের প্রতিবাদে, সেই সময়ে নামল তুমুল বৃষ্টি। টিনের চালে্র ওপর সেই বৃষ্টির তোড়ে অশ্রুত রয়ে গেল উত্তমসুচিত্রার অস্ফুট রোমান্টিক ডায়লগের বহুলাংশ। তার ওপর টিনের চালের ছিদ্রপথে ঝরতে থাকা জলের বিন্দু আমাদের শীতল করে দিল, আমাদের এতক্ষণের সহ্য করা ভ্যাপসা উৎকট গরম। তাও এতটুকু ক্ষেদ হয়নি মনে, এমনই আকর্ষণ সেই ছায়াছবির।
সিনেমা শেষ হতে আমরা বাইরে এসে দেখলাম তখনও বৃষ্টি পড়ছে – তবে টিপ টাপ। আমরা বড়োরাস্তায় বাসস্টপে যখন দাঁড়ালাম, তখন আমার হাতঘড়িতে বাজে সাড়ে পাঁচটা। বাসস্টপে অপেক্ষারত অনেক লোকজন দেখে আর তাদের আচরণ দেখে আমার কেমন সন্দেহ হল, আশেপাশে জিগ্যেস করে জানলাম, বাস চলছে না। বৃষ্টি বাদল হলেই নাকি এমন হয়, বাসচালকেরা বাস চালাতে চায় না, রুট থেকে বাস তুলে নেয় আচমকা!
মেঘলা আকাশের জন্যে সেই অকাল সন্ধ্যেয় মাসিমাকে যখন একথাটা বললাম, মাসিমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমিও খুব নিশ্চিন্ত রইলাম না। জীবনে প্রথম এমন একটা দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারব না? আমার ভরসায় আসা সঙ্গী দুই নারীকে নিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছতে পারব না – এমনই বীরপুরুষ আমি? আমি পায়ে পায়ে সরে গেলাম বাসস্টপের ভিড় থেকে, একটু দূরে একটা ছোট ট্রাক দাঁড়িয়েছিল, ড্রাইভার চালকের আসনে বসেই চা খাচ্ছিল। জিগ্যেস করতে জানা গেল, চা খেয়েই সে রওনা দেবে, মাঝের গাঁ দিয়ে সোজা বেরিয়ে যাবে এই ট্রাক, আমাদের গন্তব্য মাঝের গাঁ থেকে বাঁদিকে মোড় নিয়ে। তবু অনেকটাই রাস্তা পার হয়ে যাওয়া যাবে। আমি রিকোয়েস্ট করতে ড্রাইভার রাজি হয়ে গেল কুড়িটি টাকার শর্তে। আমি দৌড়ে গিয়ে মাসিমা আর বন্নিদিদিকে নিয়ে এলাম, বন্নিদিদি চটপট উঠে পড়ল ট্রাকে, মাসিমা প্রথমে একটু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে তিনিও উঠে পড়লেন, পিছনে আমি। আমাদের এই উদ্যোগ দেখে বাসস্টপের অনেক লোক দৌড়ে আসছিল, কিন্তু ততক্ষণে ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে জোরে।
সাড়ে ছটা নাগাদ মাঝের গাঁয়ের মোড়ে আমাদের নামিয়ে, টাকা নিয়ে চলে গেল সেই পরিত্রাতা ট্রাকওয়ালা। ঘটনার মধ্যে হল, ট্রাক থেকে নামতে গিয়ে লোহার হুকে লেগে ছিঁড়ে গেল মাসিমার শাড়ীর আঁচলের অনেকটা। তার জন্যে একটুও দুঃখ না পেয়ে তিনি বললেন, ‘দাদা, আজকে আমাকে কেটেই ফেলবে’।
তাঁর কণ্ঠে অপরিসীম উদ্বেগ। মাঝের গাঁ থেকে আমাদের মামাবাড়ির গ্রাম মাইল চারেক হবে। আমি বললাম অপেক্ষায় সময় নষ্ট করে লাভ নেই, চলো হাঁটা লাগাই, মাঝ রাস্তায় বাস-টাস পেলে না হয় উঠে পড়া যাবে। মাসিমাও রাজি হয়ে গেলেন, মাসিমা আর কোন মতেই ট্রাকে চড়বেন না, সে ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই ছিলেন, কাজেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আসার সময় পথে একটাও বাস কিংবা কোন যান-বাহনই আমরা দেখতে পেলাম না। বাড়ি এসে পৌঁছলাম আটটা নাগাদ। বড়োমামা সদরে দাঁড়িয়ে ছিলেন চরম উদ্বেগ নিয়ে, আমাদের দেখে বললেন, ‘এসে গিয়েছিস, কী করে এলি? শুনলাম বাস-টাস কিছু চলছে না’?
-‘মাঝের গাঁ থেকে হেঁটে’। মাসিমা বললেন।
-‘আর মাঝের গাঁ অব্দি? ওদিকে বাস চলছিল বুঝি’?
-‘না, মানে, বাস তো ছিল না, তাই ট্রাকে’। এবারে বলল বন্নিদিদি।
-‘ট্রাকে’? কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছিলাম,
মামাতো ভাই ও দাদারা পড়তে বসে গিয়েছিল, আর পড়া ফেলে উন্মুখ হয়েছিল বড়োমামার হাতে
আমাদের ঠিক কী ধরনের দুর্গতি হয় - সেটা চাক্ষুষ করার জন্যে। বড়োমামা আমাদের দিকে অবাক নেত্রে এমন দেখতে লাগলেন
যেন আমরা ভিন্ন গ্রহের জীববিশেষ।
-‘এটা কার মাথায় এসেছিল’? বড়োমামা তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে
উঠলেন। এবারে আমার পৌরুষ জেগে উঠল, আর না - এই অবলা নারীদের আমি ছাড়া কে এই সময়
ত্রাণ করবে? আমি বললাম, ‘আমার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বাস না পেয়ে আমিই ট্রাকটা যোগাড়
করেছিলাম’। বড়োমামীমা ধীরে ধীরে এসে পিছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, কিছু বললেন
না।
বড়োমামাও বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ছোটমাসিমার
দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবারে বুঝলি, কেন তোদেরকে একা ছাড়ি না, আর পান্না একবার বলাতে
কেন তোদেরকে ছাড়লাম? পান্না না থাকলে তোদের এই বুদ্ধি মাথায় আসত? যা এখন ঘরে যা,
মুখ হাত ধুয়ে কিছু মুখে দে...’।
এইভাবে ফুল মার্কস নিয়ে পাশ করে যাওয়াতে আমাদের ধড়ে প্রাণ এল, আর মামাতো ভাইয়েরা খুবই হতাশ হল কিছু না ঘটায়। জামা প্যান্ট ছেড়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে, দিদিমার হাতের ঘি আর গুড় মাখানো বাটিভর্তি মুড়ি খেতে খেতে আমার মনে হল – কলকাতার সাজানো স্টুডিওতে নায়ক-নায়িকারা কত পরিশ্রম করে থাকেন একটা ফিল্ম তৈরির জন্যে, কিন্তু শহরের বাইরে গণ্ডগ্রামে থাকা তাঁদের বিপুল সংখ্যক ভক্তও কম কষ্ট করেন না - তাঁদের সেই সিনেমা উপভোগ করার জন্যে। আজই যেমন, মাত্র আড়াই ঘন্টার বিনোদনের জন্যে আমাদের প্রায় ছয় ঘণ্টার ধকল অনায়াসে সহ্য হয়ে গেল! একটা সিনেমা উপভোগের জন্যে এটুকু ভোগান্তিকে যৎসামান্যই বলা যায়।
কাজেই পরের দিন সকালেই জলখাবারের সময় সাব্যস্ত হয়ে গেল, বাস্তুপুজোর
হাঙ্গামা সেরে, পরের বুধবার “অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি” যাওয়া হবে – আর এবার আমাদের
সঙ্গী হবেন বড়োমামীমাও! তিনি অলরেডি বড়োমামাকে বলে দিয়েছেন সারা জীবনইতো তিনি
সংসারের জোয়াল টেনে চলেছেন, পান্না এসেছে, এই সুযোগে কিঞ্চিৎ মনোরঞ্জন তাঁরও
দরকার। বড়োমামাও গৃহযুদ্ধে উৎসাহী না হয়ে মত দিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আমরা আবার
প্রস্তুত হতে থাকলাম পরবর্তী বিনোদনের জন্যে!
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন