[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে পড়া যায়, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাভক্ত ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগর ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। ভাগবৎ-পুরাণে মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়গুলিতে), তার বাস্তবভিত্তিক পুনর্নির্মাণ করাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য।]
এই উপন্যাসের চতুর্থ পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্র থেকে - "এক যে ছিলেন রাজা - ৪র্থ পর্ব"
১১
মহর্ষি
ভৃগুর কক্ষের দুইকোণে অষ্টদীপের আলোয় ঘরটি যথেষ্ট আলোকিত। দুই বিপরীত কোণায়
প্রদীপের অবস্থানের জন্যে ছায়ার উপদ্রব অনেকটাই কম। আচার্য বসে আছেন নিজের আসনে।
আচার্য বেদব্রত ও অন্যান্য আচার্যরা ঘরে প্রবেশের পর দেখলেন আরও পাঁচজন আচার্য বসে
রয়েছেন আসনে। সকলেই পূর্বপরিচিত। আচার্য রত্নশীল বাণিজ্য ও
অর্থনীতির আচার্য। আচার্য বিশ্ববন্ধু আয়ুর্বেদ ও বৈদ্যাচার্য। আচার্য সুনন্দ
সুর-সঙ্গীতাচার্য। আচার্য বিকচ ও আচার্য নিলয় দুজনেই এই আশ্রমের উপাধ্যক্ষ,
গুরুদেব ভৃগুর দুই হাত। গুরুদেবের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে এই দুজনই আশ্রম পরিচালনা
করেন। সব দিক বিচার করে, যে কোন কর্ম সুসমাধা করতে এঁদের অন্য জুড়ি নেই।
সকলে
আসন গ্রহণ করার পর, নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করলেন। তারপর সকলে গুরুদেব ভৃগুর
মুখের দিকে তাকালেন। গুরুদেব স্মিতমুখে অপেক্ষা করছিলেন। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে
বললেন, “সকলে প্রস্তুত, সুদীর্ঘ আলোচনার জন্যে?” সমবেত কণ্ঠে সকলে বললেন, “হ্যাঁ
গুরুদেব, আমরা প্রস্তুত”।
“উত্তম।
বিশ্বপ্রভ কক্ষের দরজা রুদ্ধ করে তুই এসে আমার পাশে বসে পড়। আমাদের এই আলোচনা
অত্যন্ত গোপন। রুদ্ধদ্বারের বাইরে কাউকে রেখেছিস তো”?
“হ্যাঁ
গুরুদেব। দুইজন অতি বিশ্বস্ত রক্ষী নিয়োগ করেছি। অনভিপ্রেত কেউ কক্ষের কাছাকাছি
এলেই আমাকে সংকেত দেবে”।
“খুব
ভালো। বৎস সুনীতিকুমার, রণধীর, তোমরা পাঁচজন আমাদের আশ্রমের অত্যন্ত সম্মানীয়
অতিথি। তোমাদের দ্বিপ্রাহরিক আহার ও বিশ্রামের কোন ত্রুটি হয় নি তো”?
আচার্য
সুনীতিকুমার বললেন, “কি বলছেন, গুরুদেব? এই আশ্রম কি আমাদেরও আশ্রম নয়? আর আপনার
সান্নিধ্যের মতো আরাম আমরা আর কোথায় পেতে পারি? আমরা নিজেদের গৃহের থেকেও তৃপ্তিতে
আহার করেছি ও শান্তিতে বিশ্রাম নিয়েছি”।
আচার্য
সুনীতিকুমারের এই কথায় মহর্ষি ভৃগু উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন, তারপর বললেন, “সাবধান,
বৎস সুনীতিকুমার, ঘরে ফিরে গৃহিণীকে এই কথা ঘুণাক্ষরেও বোল না যেন। গৃহযুদ্ধর সমূহ সম্ভাবনা”।
মহর্ষি
ভৃগুর এই কথায় সকলেই হেসে ফেললেন, আচার্য সুনীতিকুমারও সলজ্জ হাসলেন।
হাসির
রেশ কমে আসতে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “এবার আমরা কাজের কথায়
আসি। কী পরিস্থিতিতে আমরা এখানে জড়ো হয়েছি, সে কথা সকলেরই জানা আছে। সে কথার
পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন দেখি না। আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে আসছি”। মহর্ষি ভৃগু সকলের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে
নিলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বর্তমান রাজার
অপসারণ। দেশের সকলের মঙ্গলের জন্যে এছাড়া আর কোন উপায় আমি দেখছি না, বৎস তোমাদের
কি অন্য কোন উপায় জানা আছে?”।
“না
গুরুদেব, অন্য উপায় নেই”।
“উত্তম।
এই উদ্দেশ্যপূরণের প্রথম ধাপ, পরবর্তী রাজার সন্ধান। ধরা যাক আমরা রাজাকে সরিয়ে
ফেললাম, কিন্তু নতুন রাজা কে হবেন? আমার মত, আমরা এই রাজ্যের সর্বত্র ঘুরে খুঁজে
আনব সকল গুণসম্পন্ন এক তরুণকে। অনভিজ্ঞ সেই তরুণকে যোগ্য রাজা বানিয়ে তোলার
দায়িত্ব আমাদের সকলের। তোমাদের কোন বক্তব্য আছে, বৎসগণ?”
“আছে
গুরুদেব। একজন সাধারণ তরুণ, তার পক্ষে কি রাজ্যপরিচালনা করা সম্ভব, গুরুদেব?”
আচার্য সুনীতিকুমার বললেন।
তাঁর
কথার সমর্থন করে আচার্য রত্নশীল বললেন, “আমারও একই অভিমত, গুরুদেব। রাজ্য রাজনীতির জটিল সিদ্ধান্ত,
সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এক তরুণের পক্ষে কিভাবে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব! রাজ্যের রাজনীতি
ছেড়েই দিলাম, গুরুদেব, রাজপ্রাসাদের যে কুটিল রাজনীতি - তারই বা কী জানবে, সেই তরুণ?
রাজবংশের জাতক, আশৈশব এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে বড়ো হতে থাকে। অন্তঃপুরে তার একান্ত
সহায়ক থাকেন পরামর্শদাতা রাজপিতা ও রাণিমাতা। অন্যদিকে সাধারণ গৃহস্থের নিরিবিলি
সংসারে বড়ো হয়ে ওঠা এই তরুণ, হঠাৎ এক সকালে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করবে, রাজসিংহাসনে
বসে আছে! না, না, গুরুদেব, সে এক দিশাহারা অবস্থা হবে তার”।
খুব
মন দিয়ে মহর্ষি তাঁর দুই প্রিয় শিষ্যের বক্তব্য শুনলেন, তারপর স্মিতমুখে বললেন, “তোমাদের
এই আশঙ্কা একান্তই বাস্তব এবং পরমসত্য। কিন্তু মহারাজ অঙ্গ বংশ ছাড়া আমাদের রাজ্যে
অন্য কোন রাজপুত্র বা রাজবংশের কথা তোমাদের জানা আছে কি? ভিন্ন রাজ্যের যুবরাজকে
আমরা নিশ্চয়ই এই রাজ্যের সিংহাসন উপহার দিতে পারি না?”
আচার্যগণ
নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন, তারপর আচার্য রত্নশীল বললেন, “না, গুরুদেব,
আমাদের হাতে এই মূহুর্তে বিকল্প কোন রাজবংশের যুবক, প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধও নেই!”
“বৎসগণ,
তাহলে তোমাদের মনে এত দ্বিধা কেন? আমাদের কাছে বিদ্যাশিক্ষা করতে যারা আসে, তারা প্রত্যেকেই
অত্যন্ত সরল বালক। কোনো একদিন তোমরাও সকলেই তাই ছিলে। কিন্তু, আজ তোমরা
নিজেরাই এক একটি প্রতিষ্ঠান। তোমরা সকলেই নিজ নিজ বিদ্যায় বুদ্ধিতে অত্যন্ত সফল
এবং ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সেক্ষেত্রে একজন সুস্থ, সবল, বুদ্ধিমান তরুণকে একজন রাজা
বানিয়ে তোলা কেন তোমাদের অসম্ভব মনে হচ্ছে?” সামান্য বিরতি দিয়ে সকলের মুখভাব তিনি
লক্ষ্য করলেন, তারপর আবার বললেন, “এ কথা সত্য রাজবাড়িতে কিংবা রাজবংশের জাতক,
আজন্ম একটা রাজকীয় পরিবেশে বড় হয়, সেটা তার বাড়তি সুবিধা। তেমনি সেটা বিশেষ
ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণও হতে পারে। মহারাজ অঙ্গের মতো একজন ধার্মিক প্রজাপিতা
রাজার পুত্র হয়েও, যেমন হয়েছে বর্তমান রাজা বেণের ক্ষেত্রে। উদ্ধত, স্বৈরাচারী, দুরাচারী, দাম্ভিক। যাঁর
রাজ্য পরিচালনা থেকে আমরা সকলেই মুক্তি পেতে চাইছি”।
আচার্য
সুনীতিকুমার বললেন, “এ কথা সত্য, গুরুদেব। কিন্তু তাও –”
আচার্য
সুনীতিকুমারের কথায় হাসলেন মহর্ষি ভৃগু, “কোন কিন্তু নেই, বৎস, সুনীতিকুমার। এই
তরুণ কোন রাজবংশে লালিত হয়নি, ঠিকই। কিন্তু সে বড়ো হয়েছে গ্রাম্য পরিবেশে। সনাতন
ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী এক সাধারণ পরিবারে। তার নিজস্ব মূল্যবোধ, জীবনবোধ; তার
আচরণ, তার স্বাভাবিক বিনয় আমাদের কাজটা অনেক সহজ করে দেবে। আমাদের দেওয়া শিক্ষা
গ্রহণ করতে তার কোন দ্বিধা হবে না। আমাদের পরামর্শ তার কাছে অসহ্য মনে হবে না,
কারণ তার বেড়ে ওঠা মাটির খুব কাছাকাছি জীবনের পথ ধরে। রাজবাড়িতে পালিত কোন
রাজপুত্রের মতো সে কখনো দাম্ভিক হবে না”।
“অর্থাৎ,
আমাদের সকলেরই দায়িত্ব, তাকে রাজার মতো রাজা করে তোলা”। আচার্য নিলয় মহর্ষি ভৃগুর
দিকে তাকিয়ে বললেন।
উত্তরে
মহর্ষি উজ্জ্বল মুখে বললেন, “ঠিক তাই। বংশানুক্রমে আমরা রাজা পেয়ে যাই বলেই, আমার
এই প্রস্তাব তোমাদের মেনে নিতে দ্বিধা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস চিন্তা করে
দেখ, যে কোন রাজবংশের যিনি প্রতিষ্ঠাতা রাজা, তিনি আদিতে সাধারণ মানুষই ছিলেন।
তাঁর মধ্যে বিশেষ কিছু গুণের জন্যে সকলে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল, তাই তিনি রাজা
হয়েছিলেন। তারপর তাঁর অবর্তমানে তাঁর সন্তান-সন্ততিদেরই আমরা মেনে নিই। তাঁর
পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই সব গুণ থাকলে ভালো, এমনকি না থাকলেও!”
মহর্ষি
ভৃগু কিছুক্ষণের জন্যে বিরতি দিলেন, সকলে তাঁর কথা যেন যথার্থ উপলব্ধি করতে পারে,
তারপর আবার বললেন, “প্রিয় শিষ্যগণ, আমরা আজ এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের
কাছে দুটো মাত্র পথ খোলা আছে। এক, চুপচাপ বর্তমান রাজাকে মেনে নিয়ে, তাঁর সকল
দুরাচার ও অত্যাচার মাথা নত করে সহ্য করা। অথবা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন
এক জনদরদী রাজা তৈরি করা। কে বলতে পারে, আমাদের আজকের এই সিদ্ধান্ত, আমাদের এই মিলিত
প্রচেষ্টা; আমাদের এই দেশের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবে না?
আমরা
ব্যর্থও হতে পারি। যে কোন প্রচেষ্টা সর্বদা সফল হবেই এমন হয় না, বৎসগণ। এর আগে অন্য এক প্রচেষ্টায় আমি মহারাজ অঙ্গের
বংশরক্ষার এক আয়োজন করেছিলাম। আমার সঙ্গী ছিলে তোমাদের মধ্যেই অত্যন্ত স্নেহের
তিনজন; যজ্ঞশীল, বেদব্রত আর ধর্মধর। সে প্রচেষ্টায় আমরা সফল হয়েছিলাম, রাজা অঙ্গ
পুত্রসন্তান লাভ করেছিলেন। কিন্তু সহকার বৃক্ষে তীব্র হলাহলময় বিষফল উৎপন্ন হবে,
এটা ভাবতে পারিনি। সেখানে আমার ব্যর্থতা ঘটে গেছে।
এই
ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই আমি বলছি। আমার এই প্রস্তাব এবং প্রচেষ্টায় তোমাদের সকলের
আন্তরিক সহমত একান্ত জরুরি। তোমাদের সকলের সম্যক সমর্থন না পেলে, এ আলোচনা
সম্পূর্ণ অর্থহীন। সময়ের অকারণ অপচয়। অতএব তোমাদের উপর নির্ভর করছে, আমাদের
পরবর্তী পদক্ষেপ”।
মহর্ষি
ভৃগু তাঁর বক্তব্য শেষ করে, উপস্থিত শিষ্যদের মতামতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বিশ্বপ্রভ
তার আসন থেকে উঠে, মহর্ষি ভৃগুর কাছে গেল, নত হয়ে অত্যন্ত নীচু স্বরে বলল, “গুরুদেব,
কিঞ্চিৎ জলযোগের ব্যবস্থা নিয়ে দ্বারে ধরণী অপেক্ষা করছে, আপনার অনুমতি পেলে –”
মহর্ষি
ভৃগু হাসতে হাসতে বললেন, “ওদের আসতে বল, বিশ্বপ্রভ। গুরুগম্ভীর আলোচনায়, সকলেই
ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। জলখাবার গ্রহণের ব্যাপারে সহমত না পাওয়ার কোন
কারণ দেখছি না। কি বল, বৎস বিকচ? তুমি কোন কথাই বলছো না, বিকচ। তোমার অন্তরের কথা
ফুলের মতোই বিকচিত হয়ে উঠুক। আমাদের মনের মধ্যে ভরে উঠুক সৌরভ”।
আচার্য
বিকচ একটু নড়েচড়ে বসলেন, তারপর সামান্যে কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন, “আমি আপনার
সঙ্গে একমত, গুরুদেব”।
মহর্ষি
ভৃগু মুচকি হেসে বললেন, “কোন ব্যাপারে, বৎস বিকচ, জলখাবার গ্রহণের ব্যাপারে?”
মহর্ষি
ভৃগুর কথায় উপস্থিত সকলেই হেসে উঠলেন। গুরুদেবের এই লঘু-আলাপে আচার্য বিকচ একটুও
অপ্রস্তুত হলেন না, দীর্ঘদিন গুরুদেবের সঙ্গী হিসেবে, তিনি অত্যন্ত অভ্যস্ত। তিনি
জানেন মহর্ষি ভৃগু গম্ভীর আলোচনার মধ্যেও পরিহাস করতে ভালোবাসেন। তাতে পরিবেশ হালকা হয় না,
হালকা হয় মানসিক উদ্বেগ, চিন্তায় স্বচ্ছতা আসে।
আচার্য
বিকচ হাসতে হাসতে বললেন, “আমার পিতৃদেব, বিকচ নাম রেখেছিলেন, হয়তো ফুলের ফুটে ওঠা
দেখেই। কিন্তু সেই নামকে আমি আরো সার্থক করে তুলতে, খাওয়ার সুযোগ পেলেই কচমচিয়ে খেতে
আরম্ভ করি। গুরুদেব, আমাকে এখন বিকচমচ বললেও আমার কোন আপত্তি নেই”।
মহর্ষি
ভৃগু ও অন্যান্য সকলেই, আচার্য বিকচর কথায় আরও একবার হেসে উঠলেন, আর সেই অবসরে
ধরণী, কলাপাতা বিছিয়ে পরিবেশন করে দিতে লাগল জলখাবার। শসার ফালি দুটুকরো, দুফালি
নারকেল, হালকা লবণের স্পর্শ লাগা তেলে ভাজা বাদাম। আশ্রমে প্রস্তুত ননীর একটি
মণ্ড। পরিবেশন শেষ করে, ধরণী ও তার দুই সহকারি শালকু আর হানো কক্ষ ছেড়ে চলে যাবার
পর, বিশ্বপ্রভ কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিল।
মহর্ষি ভৃগু স্মিতমুখে বললেন, “এখন তাহলে আলোচনার বিরতি। বিশ্বপ্রভ আর ধরণীর উদ্যোগে পাওয়া এই জলখাবারের জন্যে ওদের সাধুবাদ দিয়ে, আমরা শুরু করি স্বল্পাহার। আর এই অবসরে, তোমরাও সকলে তোমাদের ভাবনা চিন্তাগুলি একটু গুছিয়ে নাও”।
১২
বিশ্বপ্রভর
ব্যবস্থাপনার কোন জুড়ি মেলা ভার। আহারের পর, আচার্যরা যখন চিন্তা করছেন, হাত কোথায়
ধোয়া যায় এবং উচ্ছিষ্ট কলাপাতাটি কোথায় ফেলা যায়, বিশ্বপ্রভ বলল, “আচার্যগণ,
দ্বারের বাইরে একটি ঝুড়ি ও মাটির জালায় হাত ধোয়ার জল রাখা আছে। ঝুড়িতে উচ্ছিষ্ট
পাতাগুলি ফেলে দেবেন, তারপর হাত ধুয়ে নেবেন”।
বিশ্বপ্রভর
ব্যবস্থায় আচার্যদের সকলেই সন্তুষ্ট হলেন এবং হাতধুয়ে এসে সকলেই নিজ নিজ আসন গ্রহণ
করলেন। মহর্ষি ভৃগুও হাত ধুয়ে এসে বসলেন তাঁর আসনে।
সকলের
মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা আবার আলোচনায় ফিরতে পারি। কারণ আমাদের অনেক কিছু
আলোচনার বিষয় আছে, আর সময় সীমিত। আমরা আটকে ছিলাম, সকলের আন্তরিক সহমতের জায়গায়,
বৎস বিকচ তার অভিমত জানিয়ে দিয়েছে, এখন অপেক্ষা বাকি সকলের”।
মহর্ষি
ভৃগুর কথা শেষ হবার আগেই আচার্য সুনীতিকুমার ছাড়া সকলেই একবাক্যে সহমত হলেন,
বললেন, “আমরা আপনার প্রচেষ্টায় সর্বশক্তি দিয়ে সামিল হতে চাই, গুরুদেব”।
আচার্য
সুনীতিকুমার বললেন, “আমিও আমার সহমত জানাচ্ছি, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। গুরুদেব,
আপনার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব শোনার পর আমি আমার নিঃশর্ত অভিমত জানাবো”।
মহর্ষি
ভৃগু স্মিতমুখে বললেন, “অতি উত্তম। এবার আমি তাহলে মুখবন্ধ ছেড়ে সরাসরি কাজের কথায়
চলে আসি। আমি আগেই বলেছিলাম সর্বগুণসম্পন্ন এক তরুণ আর সর্বশ্রীযুক্তা এক তরুণী
খুঁজে আনতে হবে। যারা হবে আমাদের রাজ্যের রাজা ও রাণী। এই কাজের দায়িত্ব আমি
সমর্পণ করতে চাই বেদব্রত ও ধর্মধরের উপর। এই কাজে অনেক ঘোরাঘুরি করতে হবে এবং
থাকার ও আহারের অনেক অনিয়ম হবে। এই পরিশ্রম ও অনিয়ম সহ্য করা ওদের পক্ষে সহজসাধ্য
হবে, কারণ ওদের বয়স আমাদের থেকে অনেকটাই কম, ওরা মধ্য যুবক। তোমরা এই দায়িত্ব
গ্রহণে রাজি আছো, বৎস বেদব্রত ও ধর্মধর?”
“সানন্দে
এবং সাগ্রহে রাজি, গুরুদেব। কবে রওনা হতে হবে, আদেশ করুন”।
আচার্য
বেদ ও ধর্মধরের উত্তরে, খুশি হয়ে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “যদি বলি কালই প্রত্যূষে?”
“তাই
হবে, গুরুদেব”। আচার্য ধর্মধর ও আচার্য বেদব্রত নির্দ্বিধায় বললেন।
স্মিতমুখে
মহর্ষি ভৃগু বললেন, “আমি নিশ্চিন্ত হলাম, বৎস। কিন্তু এত দ্রুত রওনা হওয়া সম্ভব
হবে না। তোমরা বরং আগামীকাল প্রত্যূষে নিজ নিজ গৃহে ফিরে যাও। তোমাদের মাতা-পিতা,
তোমাদের পত্নীদের থেকে সুস্থভাবে বিদায় নিয়ে, পরশুদিন প্রত্যূষে রওনা হও। তোমাদের
উদ্দেশ্যর কথা অতি প্রিয়জনের কাছেও গোপন রাখতে হবে একথা বলাই বাহুল্য। তোমাদের
কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে প্রশ্ন করতে পারো, বৎস”।
আচার্য
বেদব্রত বললেন, “আমাদের এই যাত্রার ব্যয় কি আমাদেরই বহন করতে হবে, গুরুদেব?”
আচার্য
বেদব্রতর এই প্রশ্নে অনেকেই বিরক্ত হলেন, আচার্য যজ্ঞশীল বলেই ফেললেন, “বেদব্রত, এই
কী তোমার বাচালতার উপযুক্ত সময়? তোমাদের এই যাত্রায় কি এমন ব্যয় হতে পারে, যা
তোমাদের পক্ষে বহন করা কষ্টকর হবে? এই রাজ্যের গৃহস্থগণ গুরুদেব ভৃগুর শিষ্যদের আতিথ্যদানে
সর্বদা প্রস্তুত, তুমি জানো না? তাহলে আর কিসের ব্যয়?”
মহর্ষি
ভৃগু আচার্য যজ্ঞশীলকে হাত তুলে নিরস্ত করলেন, বললেন, “বৎস যজ্ঞশীল, অত্যন্ত সঙ্গত
কারণেই বেদব্রত তার প্রশ্ন তুলেছে। আমাদের এই কর্মে গোপনীয়তা এত জরুরি, সর্বদা
গৃহস্থের বাড়িতে রাত্রিবাস সমীচিন নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে পান্থশালায় বাস করাই
উচিৎ হবে। আমাদের প্রচেষ্টার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সময়। আমরা যত
দ্রুত ওই তরুণ ও তরুণীকে খুঁজে বার করতে পারবো, তাদের প্রস্তুত করে তুলতে আমরা তত
বেশি সময় পাবো। সর্বত্র পদব্রজে চলাফেরাও অনেক সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে
অশ্ব কিংবা গোশকটেও যাতায়াত করতে হতে পারে। এ সমস্তই যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং
ব্যক্তিগত ব্যয়ের কোন স্থান নেই। অর্থের সংস্থান হবে, বেদব্রত”।
মহর্ষি
ভৃগুর কথায় আচার্য রত্নশীল বললেন, “এই অর্থের সংস্থান আশ্রম করতে পারে, গুরুদেব।
কারণ আশ্রমের স্বার্থেই আমাদের একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রজাপালক নৃপতির দরকার”।
আচার্য
রত্নশীলের দিকে তাকিয়ে অনুমোদনের সম্মতি দিলেন মহর্ষি ভৃগু, বললেন, “অবশ্যই,
আশ্রমেরও প্রত্যক্ষ স্বার্থ আছে। কিন্তু আমি এখনই আশ্রমকে এই প্রচেষ্টার মধ্যে
জড়াতে চাইছি না। তোমরা জানো আজ মধ্যাহ্নে আমার কাছে তিন সম্ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠী
এসেছিলেন। তাঁরা আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের বণিক সমিতির সম্মানীয় প্রতিনিধি।
প্রসঙ্গতঃ তাঁরাও এই স্বৈরাচারী রাজশাসনের অবসান চান এবং সেই উদ্দেশ্যে আমাদের
সাহায্যের প্রত্যাশায় তাঁরা এসেছিলেন। ওই বাণিজ্য সমিতিকে আমাদের এই প্রচেষ্টার
কথা কিছুই বলিনি, তাও তাঁদের বিশ্বাস আমরা কোন একটা উপায় বের করতে পারবোই। সেই বিশ্বাসে,
তারা কিছু অর্থ আমাকে দিয়ে গেছে, ভবিষ্যতে প্রয়োজন মতো আরো অর্থ সাহায্য করতে
কার্পণ্য করবে না, সে প্রতিশ্রুতিও দিয়ে গেছে। অতএব ও নিয়ে আমাদের কোন চিন্তার
কারণ দেখি না”।
মহর্ষি
ভৃগু সকলের মুখভাব একবার পর্যালোচনা করলেন, তারপর স্মিতমুখে বললেন, “এবার তোমাদের
কিঞ্চিৎ পরীক্ষা নেবো, বৎস বেদব্রত ও ধর্মধর। চিন্তা করো না, আমার এ প্রশ্ন
তোমাদের অধীত বিদ্যা থেকেই!”
“আদেশ
করুন, গুরুদেব”। আচার্য বেদব্রত বিনীত শিষ্যের মতোই উন্মুখ চেয়ে রইলেন মহর্ষি
ভৃগুর মুখের দিকে।
“সর্বগুণসম্পন্ন
রাজপুরুষের লক্ষণ কী কী?” মহর্ষি ভৃগু প্রশ্ন করলেন।
বিনা
চিন্তায় আচার্য বেদব্রত উত্তর দিলেন, “লপ্রমুপ্র, বাদীবৃস্ক, শিউ, বুধীস্থি”।
আচার্য
যজ্ঞশীল, আবার বিরক্ত হলেন, বললেন, “বেদব্রত কী সব আবোল তাবোল বকছ? তোমার ওই
প্রলাপের অর্থ কি?”
মহর্ষি
ভৃগু উচ্চস্বরে হাসলেন, বললেন, “বৎস যজ্ঞশীল, বেদব্রতের ওই শব্দগুলির সংকেত তুমি বিস্মৃত
হয়েছো? ছাত্রকালে মুখস্থ রাখার সহজ পদ্ধতিটি আমরা আশ্রম থেকে কাউকে শেখাই না, অন্য
শিষ্যদের থেকে তারা ঠিক শিখে নেয়। বৎস বেদ, তুমি লক্ষণগুলি সবিস্তারে বর্ণনা করো,
তোমার গুরু যজ্ঞশীলের উদ্বেগ শান্ত করো”।
আচার্য
বেদব্রত বিনীত স্বরে বললেন, “যথা আজ্ঞা, গুরুদেব। লপ্র মানে প্রশস্ত ললাট, মুপ্র
মানে প্রসন্নমুখ, বাদী হল দীর্ঘবাহু, বৃস্ক মানে বৃষস্কন্ধ, শিউ হল উন্নত শির এবং
বুদ্ধিমান, ধীর, স্থির হচ্ছে বুধীস্থি”।
“খুব
ভালো, আর, শ্রীময়ীর কী লক্ষণ, বৎস বেদ?” মহর্ষি ভৃগু আবার প্রশ্ন করলেন আচার্য
বেদব্রতকে।
“আজ্ঞে,
গুরুদেব, গুনি, পীনি, আয়না, শোভা, প্রসবান্তা, সুলা সুভা। অর্থাৎ কিনা
গুরুনিতম্বিনী, পীনস্তনী, আয়তনয়না, শোভনদন্তা, প্রসন্নবদনা, শান্তা, সুশীলা,
সুভাষিনী”।
অত্যন্ত
সন্তুষ্ট মহর্ষি ভৃগু হাসিমুখে বললেন, “অতি উত্তম। এমন কোনো তরুণ তরুণীর কথা
কি তোমাদের জানা আছে, বৎসগণ?”
“ধৃষ্টতা
যদি মার্জনা করেন, একটা কথা বলি, গুরুদেব?”
“বলো,
বৎস, বেদব্রত”।
“আজ্ঞে
গুরুদেব, বিবাহের পূর্বে সুন্দরী নারীরা মোটামুটি এই সমস্ত লক্ষণেই অলংকৃতা থাকেন,
কিন্তু বিবাহের পর তাঁরা নিজ স্বামীর প্রতি প্রায়শঃই প্রসন্নবদনা, শান্ত, সুশীলা ও
সুভাষিনী থাকেন না”।
আচার্য
বেদব্রতর এই কথায় সকল আচার্য, মহর্ষি ভৃগু, এমনকি বিশ্বপ্রভও উচ্চৈঃস্বরে হেসে
উঠলেন। হাসির প্রকোপ কমতে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “এ অভিজ্ঞতা কি তোমার নিজের
ব্রাহ্মণীর অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছ, বৎস?”
“আজ্ঞে
হ্যাঁ, গুরুদেব”।
“এই
অভিজ্ঞতার কথা আর কারো কাছে প্রকাশ করে মূঢ়তার পরিচয় দিয়েছ কি?
“আজ্ঞে
না, গুরুদেব”।
“এ
অভিজ্ঞতা তোমার একার নয়, বৎস। আমাদের সকলের। কি বল হে, তোমরা সবাই?” সকলেই আবার
হেসে উঠলেন। গম্ভীর আলোচনার মানসিক ভার নিমেষে হালকা হয়ে গেল সকলের মন থেকে।
আচার্য
রণধীর বললেন, “আজ্ঞে গুরুদেব, সে কথা বলাই বাহুল্য”।
মহর্ষি
ভৃগু বললেন, “আমরা আবার এখন কাজের কথায় আসি। এই তরুণ তরুণীর নামও আমি ঠিক করে
ফেলেছি। তরুণের নাম হবে পৃথু, এবং ওই তরুণী কন্যার নাম অর্চ্চি। পৃথুর জন্ম ভগবান শ্রীবিষ্ণুর
অংশে এবং অর্চ্চির জন্ম সনাতনী কমলার অংশে”।
“এ
কথা কি সত্য, গুরুদেব?” আচার্য ধর্মধর জিজ্ঞাসা করলেন।
মহর্ষি ভৃগু স্মিতমুখে বললেন, “সত্য মিথ্যায় কিছু এসে যায় না,
ধর্মধর। রাজনীতিতে সত্য-মিথ্যা খুবই আপেক্ষিক এবং দুটির মধ্যে সূক্ষ্ম সুতোর পার্থক্য। সমাজের সার্বিক মঙ্গলের
জন্যেই ধর্ম, কারণ ধর্ম আমাদের সমাজকে ধরে থাকে। আমরা যে প্রচেষ্টা নিয়েছি, সে এই
সমাজের মঙ্গলের জন্যেই। অতএব বুদ্ধিজীবি হিসেবে আমরা ধর্মপালন করছি মাত্র। এই
আপৎকালে ধর্মনীতি ও রাজনীতির মধ্যে কোন প্রভেদ নেই, ধর্মধর। আমাদের উদ্দেশ্য
রাজ্যলাভের স্বার্থসিদ্ধি নয়, আমাদের উদ্দেশ্য অকল্যাণের বিনাশ ও সাধারণ জনগণের
মঙ্গল। আমরা শ্রীবিষ্ণুর দেখানো পথেই তো চলেছি, ধর্মধর, তোমার মনে কি কোন দ্বিধা
রয়েছে?” কেউ কোন উত্তর দিলেন না, সকলেই মহর্ষির মুখের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে
রইলেন।
সকলের
মুখের দিকে তাকিয়ে মহর্ষি ভৃগু আবার বললেন, “বৎস, বেদব্রত ও ধর্মধর, তোমরা
বিশ্বপ্রভর থেকে পাঁচটি নিষ্ক নিয়ে নিও। ফিরে এসে তোমাদের ব্যয়সংক্রান্ত গণনা
বিশ্বপ্রভকে দিয়ে দেবে। আচার্য রত্নশীল ও আমি, বিশ্বপ্রভর থেকে সে গণনা বুঝে নেব।
তোমাদের যাত্রা শুভ হোক, সফল হোক। আর একটা কথা বলি, শাস্ত্রে সব কথা থাকে না।
সর্বলক্ষণ মিলিয়ে দেখার পরেও, তোমাদের বিচক্ষণ বিচারশক্তির অত্যন্ত প্রয়োজন, সে
কথা ভুলে যেও না। আর সেই বিচার করবে মস্তিষ্ক দিয়ে, হৃদয় দিয়ে নয়। সবশেষে বলি, নির্বাচনের
পর এক দিনও বিলম্ব করবে না, যত দ্রুত সম্ভব গোপনে এই আশ্রমে ওদের নিয়ে আসবে। এখন
যাও, যাত্রার প্রস্তুতি করো। আমরা নৈশ ভোজনের কালে আবার একত্র হবো। শুভমস্তু”।
আচার্য
বেদব্রত ও ধর্মধর মহর্ষি ভৃগুকে প্রণাম করলেন, প্রণাম করলেন উপস্থিত সকল আচার্যকে।
তারপর বিশ্বপ্রভর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন কক্ষ থেকে। বিশ্বপ্রভ কক্ষের দরজাটা চেপে বন্ধ
করে এগিয়ে গেল ডানদিকে, যেদিকে মহর্ষি ভৃগুর আবাস-কক্ষ।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন