ঘরে ঢোকামাত্র টুপুর এসে ঝাঁপিয়ে
পড়ল, ‘ও মা, মামা এসেচে, ও মা, মামা এসেচে’। টুপুরের ঠাকুমার হাঁটুতে ব্যথা, চলতে
গেলে একটু দুলে দুলে হাঁটেন, আমাকে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে এলেন, বললেন, ‘টুপুরসোনা,
মামাকে বিরক্ত করো না, মামাকে আগে বসতে দাও। বাড়ির সব খবর ভালো তো? বেয়াই বেয়ান
সবাই ভালো আছেন?’ শেষের কথাগুলো, টুপুরের ঠাকুমা আমাকে বললেন।
আমি নীচু হয়ে প্রণাম করে বললাম, ‘হ্যাঁ মাসীমা সবাই ভালো
আছেন, আপনার শরীর ভালো তো?’
‘ওই চলে যাচ্ছে কোন রকমে।
হাঁটুদুটো নিয়েই বড্ডো জ্বলছি। হাঁটুর ব্যথা যে কী ব্যথা বাবা, শত্তুরেরও যেন না
হয়’।
আমি টুপুরের হাত ধরে সোফায় গিয়ে
বসতেই, টুপুর আমার কোলের কাছে এসে, দু হাতে আমার দু গাল টেনে ধরল, বলল, ‘ও মামা,
আমায় একটা পেট কিনে দাও না’।
‘সে কী তোর পেট নেই? কই দেখি? ভগবান
তোকে বানানোর সময় পেট বানাতে ভুলে গেছেন নাকি?’
‘আরেঃ, এ পেট সে পেট নাকি? তুমি
না বড্ডো বাজে বকো। আমি বলছি পেট, পে-এ-ট, মানে পোষার জন্যে কিছু’। টুপুরের মা
চুমকি ঘরে এসে ঢুকল, বলল, ‘ঢোকা মাত্র ভাগ্নীর খপ্পরে পড়ে গেছিস, দাদা? চা খাবি না
কফি?’
বোনকে বললাম, ‘এখন চা দে, পেট ঠিক
হলে কফি। কী পেট নিবি ডগি, না কাবলি বেড়াল? খরগোশ না গিনিপিগ? টিয়াপাখি না মুনিয়া?
সাদা ইঁদুর না রঙিন মাছ?’ শেষের কথাগুলো বললাম টুপুরকে।
‘ধ্যাৎ, ওসব তো আমাদের বন্ধুদের
সবার আছে! তুমি এমন কিছু বলো যা অন্য কারো নেই’।
‘বলিস কী? তোর বন্ধুদের পেটে পেটে
এত? নতুন কিছু, নতুন কিছু...আইডিয়া...একটা মোরগ নিলে কেমন হয়? বেশ লাল ঝুমকো ঝুঁটিওয়ালা,
ধপধপে সাদা। তোদের বারান্দাতে লম্বালম্বা পায়ে ঘুরে বেড়াবে। আর ভোরবেলা, পাড়ার
লোকের ঘুম ভাঙিয়ে ডাকবে কঁ ককর কঁ’।
টুপুর মন দিয়ে শুনল, তারপর বলল, ‘কোলে
নিয়ে আদর করা যাবে? সেলফি তুলে ফেসবুকে ছবি আপলোড করা যাবে?’
এদিকটা আমি চিন্তা করিনি, বললাম, ‘তা
হয়তো করা যাবে। কিন্তু মোরগ রেগে গেলে ঠুকরে দেয়, নখ দিয়ে খিমচেও দেয়’!
টুপুর গম্ভীরগলায় বলল, ‘নাঃ চলবে
না। অন্য কিছু বলো’।
‘মোরগ চলবে না? তাহলে...ছোট্ট
একটা ছাগল ছানা। বেশ কালো কুচকুচে রঙ। মাথায় ছোট্ট ছোট্ট শিং। ডাকেও মন্দ না। তুই
যেমন মাকে ডাকিস, সেও তোর মাকে ডাকবে, ম্যা...। পায়ে পায়ে সারাদিন ঘুরবে। গলায়
সুন্দর একটা দড়ি বেঁধে পার্কে নিয়ে ঘুরবি। ঘাসপাতা খাবে। ছাগল কাঁঠালপাতা খুব
ভালোবাসে। তোদের পার্কে কোন কাঁঠাল গাছ নেই?’
‘ধ্যাৎ, তুমি যতো পচা পচা আইডিয়া
দিচ্ছো’।
‘ছাগলের আইডিয়াটাও তোর পছন্দ হল
না? তাহলে একদিন চিড়িয়াখানায় চল। ওখানে অনেক ধরনের জীবজন্তু আছে। ধর একটা জিরাফ
নিলি! রোজ সন্ধেবেলা তোদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে, আর লম্বা গলা তুলে দেখবে,
তোর বাবা অফিস থেকে বেরোলেন কিনা! বর্ষাকালে রাস্তায় হাঁটুজল, তোর বন্ধুরা জুতো
হাতে জল ভেঙে হাঁটছে আর নাকাল হচ্ছে! পাশ দিয়ে তুই জিরাফ চেপে বেরিয়ে যাবি, ফিটফাট
স্কুলড্রেস, পায়ে জুতো পরে, পিঠে বইয়ের বোঁচকা নিয়ে। সব্বার আগে স্কুলে পৌঁছে
আন্টিকে বলবি, গুডমর্নিং ম্যাম। আন্টি তখন শাড়িটাড়ি ভিজিয়ে হাতে চটি নিয়ে সবে
স্কুলে পৌঁছেছেন’।
চুমকি আমাকে চা দিল, সঙ্গে দুটো
বিস্কিট, চুমকি বলল, ‘দুজনে কী আরম্ভ করেছিস বলতো? তুই ওর মাথায় ওইসব আইডিয়া
ঢোকাচ্ছিস তো, দাদা, তুই চলে যাবার পর আমাদের সক্কলের মাথা খাবে’।
টুপুর খুব সিরিয়াস, মায়ের কথায়
কান দিল না, বলল, ‘জিরাফটা ভালোই বলেছো। কিন্তু বর্ষার জমা জলে হাঁটতে আমার দারুণ
মজা লাগে। জিরাফের পিঠে চাপলে সে মজা কী করে হবে?’
‘না, তা হবে না। তাছাড়া বর্ষার
দিনে জিরাফকে বের না করাই ভালো। বৃষ্টির ঝাপটাতে জিরাফের রঙ উঠে যেতে পারে’।
টুপুর খুব অবাক হল, বড়ো বড়ো চোখে
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এঃম্মা, জিরাফের রঙ উঠে যায় নাকি?’
‘যায় না আবার? আকচার যায়। বিশেষ
করে, সস্তার জিরাফ হলে তো কথাই নেই। কেনবার সময় দোকানদার বলেই দেবে, “রঙের কোন
গ্যারান্টি নেই, দিদি”!
এ কথায় টুপুর খুব মজা পেল, খিলখিল
করে হাসতে হাসতে বলল, ‘“রঙের কোন গ্যারান্টি নেই, দিদি”। আমাকে দিদি বলবে? তুমি
না, মামা, কী যে বলো?’
‘বলবে না? তোকে দিদি বলবে না? তুই
কী আর ছোটটি আছিস নাকি? ক্লাস ফোর! চাট্টিখানি কথা! বাপরে। আর ক্লাস ফোরের
ছেলেমেয়েদের ভয় করে না, এমন দোকানদার কেউ আছে’?
টুপুর এখন আবার গম্ভীর হয়ে গেল,
বলল, ‘তোমার সেই পচা ট্যাগলাইনটা বলবে তো? “ক্লাস ফোর, জুতো চোর”!’ আমি একটু দমে
গেলাম, টুপুরসোনাকে বোকা বানানো আমার উচিৎ কাজ হয়নি।
কথা ঘোরাতে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে,
ঠিক আছে। সে কথা বলছি না। কিন্তু ধর বর্ষায় ভিজে জিরাফের ঠাণ্ডা লেগে গেলে, কী
হবে? আমাদের ঠাণ্ডা লাগলে খক খক করে কাশি। আমাদের ছোট্ট গলার কাশির আওয়াজেই কান
পাতা যায় না। আর জিরাফের অত্তো লম্বা গলার কাশি? বাপরে সে একেবারে সাংঘাতিক হয়’।
‘তাহলে বর্ষার দিনে জিরাফ বের করা
যাবে না?’
‘না বের করা যাবে, তার অন্য উপায়!
জিরাফের জন্যে যদি একটা রেনকোট কিনে দেওয়া যায়, তাহলেই জিরাফ আর ভিজবে না!’ টুপুরের
ঠাকুমা সামনে বসেছিলেন, তিনি খুব হাসতে লাগলেন।
আর চুমকি বলল, ‘তোর মাথাতে আসেও,
দাদা। টুপুরসোনা, তুমি ছোট্ট বলে, তোমার রেনকোট আমি পরাতে পারি, কিন্তু জিরাফের
লম্বা গলায় আমি রেনকোট পরাতে পারবো না। তোমার মামাকে বলো, বৃষ্টি হলেই আমাদের বাড়ি
চলে আসবে, আর জিরাফের গায়ে রেনকোট পরিয়ে দেবে। তারপর বাড়ি ফিরলে জিরাফের গা থেকে
রেনকোট খুলে, ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে দিয়ে যাবে’।
টুপুর কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, ‘তুমি
কী পারবে? মনে হয় না। তুমি তো আমার জন্মদিনে আসবে বলেও আসতে পারলে না। তোমার ওপর
ভরসা করে জিরাফ নেওয়া, ঠিক হবে না। অন্য কিছু ভাবো’।
‘হুঁ। জিরাফটা একটু বড়ো হয়ে
যাচ্ছে। ছোটখাটো কিছু নিলে কেমন হয়? কচ্ছপ চলবে? কচ্ছোপের গায়েও সুন্দর ছোপ ছোপ থাকে। আর ওদের গায়ের রঙ
খুব টেঁকসই হয়। ওরা জলেও থাকে, ডাঙাতেও থাকে, কিন্তু রঙ ওঠে না। রাখার কোন অসুবিধে নেই। এখন তো তুই অ-নে-ক বড়ো হয়ে গেছিস, তোর খুব
ছোট্টবেলায় চানের জন্যে একটা প্লাস্টিকের গামলা ছিল, মনে আছে? সেটায় জল ঢেলে রেখে
দিলেই চলবে। কোলে নিয়ে আদর করতে পারবি। সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে পারবি’।
টুপুরের মা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘তোর
প্রোফাইল ইমেজেও দিতে পারিস, ভারি মানাবে। কচ্ছপও তোর মতোই সব ব্যাপারে খুব স্লো’।
এ ব্যাপারটা টুপুরর পছন্দ হল না,
মুখটা একটু গোমড়া করে তুলল। তাই দেখে আমি বললাম, ‘একটু স্লো হতে পারে। কিন্তু
খরগোশকে হারিয়ে দিয়েছিল, সেটা ভুলে যাস না চুমকি!’
‘কচ্ছপ খরগোশকে হারিয়ে দিয়েছিল?
কিসে? কবে? কী করে?’ টুপুর খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল এই খবরে।
‘সে কী? “স্লো বাট স্টেডি উইন্স্
দা রেস্” গল্পটা পড়িস নি?’
‘ও সেই টরটয়েজ আর হেয়ারের
স্টোরিটা? সেটা তো জানি! তুমি যে বললে কচ্ছপ আর খরগোশ’?
‘ও বাবা, তুই টরটয়েজ মানে কচ্ছপ
আর হেয়ার মানে খরগোশ জানিস না বুঝি?’ টুপুর একটু লজ্জা পেল, ফ্রকের একটা ফিঁতে
মুখে নিয়ে চিবুতে লাগল, মুখ নীচু করে। টুপুরের
মা, চোখ বড়ো বড়ো করে খড়খড়ে গলায় বলল, ‘টুপুর,
টর্টয়েজ মানে কচ্ছপ আর হেয়ার মানে খরগোশ তোমাকে বলিনি? বাংলায় কত পেয়েছে জা্নিস,
দাদা? সাঁইত্রিশ’।
‘একশতে?’
‘না পঞ্চাশে’।
‘খারাপ কী পেয়েছে? চুয়াত্তর
পারসেন্ট? বাংলায় তুই কত পেতিস, চুমকি?’
‘তুমি বড়ো বাজে বকো, দাদা। আমাদের
সময় পরীক্ষাগুলো খুব টাফ হতো। ওদের ক্লাসে বাংলায় হায়েস্ট কত জানো? ঊণপঞ্চাশ!’
‘আমি হলে তো পঞ্চাশ নিতাম। এক
নম্বরও ছেড়ে দেব! এত বোকা আমি! যাগ্গে, তাহলে কী হল, টুপুরসোনা? কচ্ছপই ফাইন্যাল
তো?’
টুপুর খুব গম্ভীর হয়ে বুকের কাছে
হাত ভাঁজ করে, তার মা আর মামার কথা শুনছিল। এখন মেঝের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না,
শুধু ঘাড় নাড়ল। না, কচ্ছপ মোটেই ফাইন্যাল নয়। আমি বললাম, ‘যাঃ কচ্ছপটাও পছন্দ হল
না? ট্রাই করে দেখতে পারতিস। তোর যে বন্ধুর কাছে হেয়ার আছে, তাকে বলতে পারতিস, মে
বি স্লো, বাট কচ্ছপ ইজ দা উইনার’।
টুপুর মোটেই রাজি নয়, বলল, ‘না,
টর্টয়েজ পচা’।
‘তাহলে একটা কথা বলবো?’ টুপুর
আমার দিকে তাকালো। ‘মাথা থেকে ওই সব পেটের ব্যাপারটা সরিয়ে ফেল। আমার কতো পেট আছে
জানিস? পনেরটা পায়রা, তেরটা কাক, সাতটা শালিক, চারটে চড়ুই। অবাক হচ্ছিস? আরো আছে,
একটা জবা, একটা রঙ্গন, একটা নয়নতারা’। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল টুপুর।
‘রোজ সক্কাল সক্কাল আমি যখন ছাদে
যাই, পায়রা আর কাকগুলো উড়ে এসে বসতে থাকে ছাদের আলসেতে। কাকগুলো বলে, কয় কয় কয়,
বলে, কাঃ কাঃ কাও! পায়রাগুলোও বলে, তবে তাদের বকবক কম। শালিকগুলো তো রীতিমতো ঝগড়া
করে, আর চড়ুইগুলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়ে আর চিলিক চিলিক ডাকে। মুঠো করে ছাদে ছড়িয়ে দিই,
চালের দানা, গমের দানা, চিনা ঘাসের দানা। আলসে থেকে তারা নেমে আসে, খুঁটে খুঁটে
সব্বাই দানা খায়। পায়রাগুলো খায় আর ঘুরে ঘুরে বলে, থ্যাংকিউকিউ থ্যাংকিউকিউ।
ওরা যখন খায়, ততক্ষণে আমি ছোট্ট
মগে জল নিয়ে, জল ঢালি ফুলগাছের টবে। সকালের হাওয়ায় তারা খুব দুলতে থাকে। জবাগাছ
রোজ অন্ততঃ দুটো ফুল ফো-টা-বে-ই। আমি যখন জবাগাছের পাতায় পাতায় জলের ছিটে দিই, তার
ফুলের লম্বা কেশর দুলিয়ে আমার হাতে সুড়সুড়ি দে-বে-ই। এত দুষ্টু! রঙ্গনও কম যায় না, টুকটুকে লাল ফুলের থোকা
সাজিয়ে হাসতে থাকে রোজ! ওর আবার রোজ রোজ নতুন ফুল ফোটানোর স্বভাব নয়। কয়েকদিন খুব
খেটেখুটে এক থোকা ফুল বানিয়ে তোলে। সে ফুলের গোছা অনেকদিন থাকে। কিছুদিন পর
রঙ্গনের পাতা ঢাকা পড়ে যায়, ছোট্টছোট্ট লালফুলের থোকার আড়ালে। আমি জল দিতে গেলে,
পাতারা ফুলের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বলে, “টুকি, টুকি, আমরা কেমন সবুজ পাতা দেখতে পেলে
না”। বলে আর হাসে, খুব হাসে। তবে সব থেকে মজার গাছ নয়নতারা। রোজ নতুন নতুন ফুলে সাজিয়ে তুলবে নিজেকে, উজ্জ্বল বাসন্তী
রঙের ফুল। আর রোজ একবার আমাকে তার জিগ্যেস করা চাইই চাই – “আমাকে কেমন লাগছে গো”? তার গায়ে ঝুলতে থাকা একআধটা হলদে পাতা আমি ছিঁড়ে
দিই, তাতে নয়নতারা খুশি হয় খুব। জিগ্যেস করে “কাল আসবে তো”?’
এতক্ষণ ধরে বকবক করলাম, টুপুর
একটুও অধৈর্য হল না! মন দিয়ে আমার কথা শুনতে লাগল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার
বলা শেষ হলে, সে হাঁটু মুড়ে উঠে বসল সোফায়। আমার দু গালে হাত রেখে বলল, ‘তোমার
পেটগুলো আমাকে দাও না, মামা?’
‘তুই নিয়ে নিবি? সব নিয়ে নিবি? বা
রে, তাহলে আমি কী নিয়ে থাকবো?’
ঝুমকো ঝুমকো চুলে ঝাঁকি দিয়ে, টুপুরসোনা
বেশ জোর গলায় বলল, ‘সে আমি জানিনা, তোমার পেটগুলো আমাকে দেবে কী না বলো? বলো না,
মামা, বলো না’।
‘আচ্ছা, আচ্ছা দেবো। পাঠিয়ে দেবো।
সক্কাল সক্কাল মাকে নিয়ে তোদের ছাদে উঠিস। যেমন বললাম, সেরকম চাল আর গমের দানা
নিয়ে। প্রথম প্রথম বেশি আসবে না। তোকে চেনে না তো? কয়েকদিন সময় নেবে। তুই কাছে গেলেই উড়ে পালিয়ে
যাবে। তোকে কিন্তু রোজ যেতে হবে। রোজ। তাহলেই তোকে চিনে নেবে। তারপর থেকে দেখবি
অনেকে আসবে। তুই ছাদে উঠলেই এসে হাজির হবে। তুই কাছে গেলেও ভয় পাবে না’।
‘সত্যি’?
‘একদম সত্যি! তা বলে, ওদের ধরার চেষ্টাও করিস না। তাহলেই কিন্তু খুব ভয়
পাবে’।
‘না, না, ধরবো না’।
‘ধরে রাখলে, ওরা খুব কষ্ট পায়।
খোলা আকাশে ওরা উড়বে। আর যখনই তোকে ছাদে দেখবে কাছাকাছি নেমে আসবে। সে বেশ মজার
হবে না? তখন সেলফি তুলে, ফেসবুকে আপলোড করে দিবি! দেখবি বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে
যাবে।’
হাততালি দিয়ে উঠল টুপুররাণি, বলল,
‘মা, মা, স্কুল যাবার আগে, কাল সকালেই আমরা যাবো। ঠাম্মা, তুমিও যাবে কিন্তু। বাপিকেও
নিয়ে যাবো’। তারপর আমার দিকে ফিরে আবার বলল, ‘আর তোমার ফুলগাছ দেবে না?’
‘না, সোনা। ফুলগাছ এখন নয়, তুমি
আরো বড়ো হও তখন দেব’।
‘কেন?’
‘ফুলগাছ তো পাখি নয় সোনা! রোজ জল
দিতে হয়, মাঝে মাঝে সার দিতে হয়। তোমরা যখন দারজিলিং, পুরী, গোয়া, বেড়াতে যাও
সাত-দশ দিনের জন্যে। তখন কে জল দেবে? পাখিদের তুমি খাবার না দিলেও, তারা উড়ে উড়ে
অন্য কোথাও খাবার যোগাড় করে নিতে পারে। কিন্তু গাছ তো পারে না! তারা সাত-দিন জল না
পেলে শুকিয়ে যাবে। গরমের দিন হলে তো কথাই নেই!’
‘শুকিয়ে যাবে?’
‘যাবে বৈকি, মা। বাবা-মায়ের সঙ্গে
বেড়াতে গিয়ে আমাদের কত মজা হয়, বল? এদিকে গাছেরা ভীষণ কষ্ট পেয়ে শুকিয়ে যাবে? গাছ
কথা বলতে পারে না, ছটফট করতে পারে না, তাই আমরা তাদের কষ্টের কথা বুঝতেই পারি না। যেদিন
বুঝতে শিখবি, সেদিন বাড়িতে গাছ এনে পেট করিস’।
টুপুর আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আর
কিছু বলল না। কিছু চিন্তা করতে লাগল। আমিও কথা বাড়ালাম না। চুমকিকে বললাম, ‘কফি
খাওয়া’।
চুমকি হাসিমুখে বলল, ‘পেট ঠিক হয়ে
গেছে, মনে হচ্ছে, না দাদা? বাঁচালি আমায়, কদিন ধরে যা জ্বালাচ্ছিল’!
‘কাল ভোর থেকে উঠে ছাদে যাওয়ার
জন্যে জ্বালাবে!’
‘ধুর, তুইও যেমন। সাতটায় স্কুল
যাবার জন্যে সাড়ে ছটায় যাকে ডেকে তুলতে আমার ঘাম ছুটে যায় রোজ! সে রোজ উঠেবে ছটায়?
দ্যাখ না, দু একদিন উৎসাহ থাকবে, তারপর নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে। তুই আসবি বলে,
ফিশচপ বানিয়েছিলাম, নিয়ে আসি। তারপর কফি দিচ্ছি’।
* *
সকালে ছাদে ঘুরছিলাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। এত সকালে কে
আবার ফোন করল? একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলে দেখলাম, চুমকি ফোন করেছে। ফোন কানেক্ট
করে বললাম, ‘গুডমর্নিং। কী ব্যাপার? এত সকাল সকাল ফোন?’
‘দাদা, তুই যে কী জ্বালাস না, বুঝি না! তুই যেদিন এলি, তার
পরদিন থেকে রোজ, আজ এই রবিবারেও, ভোর থেকে উঠে টুপুর ছাদে যাচ্ছে, পাখিদের দানা
দিতে! কী নেশা বাধিয়ে দিলি বল তো! স্কুল থেকে ফিরে, বিকেলেও গেম খেলে না, টিভি
দেখে না। দৌড়ে চলে যায় ছাদে’। আমি খুব হাসলাম।
‘টুপুররাণিকে আমার অনেক আদর দিস’।
‘আর আমাকে? আমিও তো নেশায় পড়ে গেছি! রোজ দুবেলা আধঘণ্টা
করে ছাদে না উঠলে ভাল লাগে না’।
আমি হাসতে লাগলাম। খুব হাসতে লাগলাম। তাকিয়ে রইলাম, আমার ছাদে দানা খুঁটে খাওয়া পায়রা আর চড়ুইগুলির দিকে। হাসি থামিয়ে অস্ফুটস্বরে বললাম, ‘ভালো থাকিস, ব্যস্। ভালো থাকিস’।
--০০--
-
দারুণ গল্প। মনটা ভরিয়ে দিলি, মাইরি!
উত্তরমুছুনএরকম মন্তব্য পেলে, লেখার উৎসাহ পাই।
উত্তরমুছুন