ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ ধ্যানযোগ
[যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত দুই পক্ষের মাঝে রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে "ধ্যানযোগ" জানার কী প্রয়োজন?
প্রয়োজন কারণ, যুদ্ধ করাও এক সম্যক কর্ম - ধ্যান কর্মও বটে - কারণ "সমস্ত ইন্দ্রিয় জয় ক’রে, যিনি মাটি, পাথর আর সোনার মধ্যে কোন পার্থক্য অনুভব করেন না, এবং সুহৃদ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, দুর্বৃত্ত, বন্ধু, সদাচারী, এমনকি পাপী ব্যক্তিকেও যিনি সমান চোখে দেখেন, তাঁকেই যোগারূঢ় সন্ন্যাসী বলা হয়"। এমন নিবিড় যোগধ্যানে নিবিষ্ট যুদ্ধই ধর্মযুদ্ধ - দ্বিধাগ্রস্ত সংশয়াচ্ছন্ন চিত্তে যে যুদ্ধ তাকে নিষ্ঠুর গণহত্যা বলা যায়।]
|
১ |
শ্রীভগবান
বললেন- অগ্নিহীন যজ্ঞের অনুষ্ঠানকারী অথবা কর্মত্যাগী ব্যক্তিরা নন, কর্মফলের
আশা না করে যিনি কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই সন্ন্যাসী, তিনিই যোগী। |
||
|
২ |
হে
পাণ্ডব, শাস্ত্র যাকে সন্ন্যাসী বলে, তাকেই কর্মযোগী বলে জানবে। কারণ, সংকল্প
অর্থাৎ কর্মফলের বাসনা ত্যাগ না হলে কর্মযোগী হওয়া যায় না। |
||
|
৩ |
যে
জ্ঞানীব্যক্তি জ্ঞানযোগে উত্তরণের জন্য উৎসুক, তাঁরও সাধনার একমাত্র পথ এই
কর্মযোগ। জ্ঞানযোগে প্রতিষ্ঠিত যোগারূঢ় ব্যাক্তির পরমশান্তি এবং সকল কর্মের
অবসানের কারণও এই কর্মযোগ, এমনই বলা হয়। |
||
|
৪ |
যে
জ্ঞানীব্যক্তি সকল কামনা মুক্ত হয়ে, সমস্তবিষয় থেকে, এমনকি নিত্যকর্ম থেকেও
ইন্দ্রিয়ের সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করতে সক্ষম হন, তাঁকেই যোগারূঢ় জ্ঞানী বলা হয়। |
||
|
৫ |
বিবেকযুক্ত
আত্মা, জীব আত্মার উত্তরণের এবং বিবেকহীন আত্মা, জীব আত্মার পতনের কারণ হয়। কারণ
আত্মা কখনও আত্মার পরমবন্ধু, আবার কখনও চরমশত্রু। |
||
|
৬ |
যে
আত্মার প্রভাবে ইন্দ্রিয়ের আসক্তি দূর হয়, সেই আত্মা পরমবন্ধু, কিন্তু যে আত্মা
ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে, অসংযত ক’রে তোলে, সেই আত্মা চরম শত্রু। |
||
|
৭ |
সমস্ত
ইন্দ্রিয়কে জয় ক’রে, প্রশান্তচিত্তে যে ব্যক্তি ব্রহ্ম উপলব্ধিতে অবস্থান করেন,
তিনি শীত-গ্রীষ্মে, সুখ-দুঃখে, সম্মান কিংবা অপমানে অবিচলিত থাকেন। |
||
|
৮ |
শাস্ত্র
এবং বিভিন্ন তত্ত্বব্যাখ্যায় যিনি সন্তুষ্ট এবং নির্বিকার, সমস্ত ইন্দ্রিয় জয় ক’রে,
যিনি মাটি, পাথর আর সোনার মধ্যে কোন পার্থক্য অনুভব করেন না, তাঁকেই যোগারূঢ়
সন্ন্যাসী বলা হয়। |
||
|
৯ |
সুহৃদ,
মিত্র, শত্রু, উদাসীন, দুর্বৃত্ত, বন্ধু, সদাচারী, এমনকি পাপী ব্যক্তিকেও যিনি
সমান চোখে দেখেন, তিনিই যোগারূঢ়। |
||
|
১০ |
ধ্যানযোগী
একাকী সর্বদা নির্জনে থেকে, দেহ ও মনকে সংযত ক’রে, নিশ্চিন্ত চিত্তে, কোন কিছু
পাওয়ার অথবা কোন কিছু দেওয়ার আশা না রেখে, আত্মাকে সমাহিত করবেন। |
||
|
১১ |
পবিত্র স্থানে, প্রথমে কুশের আসন, তার ওপর মৃগচর্ম এবং বস্ত্র দিয়ে খুব উঁচু অথবা খুব নিচু নয় এমন এক স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা ক’রে, যোগী ধ্যানে বসবেন। |
||
|
১২ |
সেই আসনে
স্থিরভাবে বসে, একাগ্র মনে, অন্তরের এবং ইন্দ্রিয়ের সমস্ত চাঞ্চল্য সংযত ক’রে,
আত্মার বিশুদ্ধির জন্যে যোগাভ্যাস করবে। |
||
|
১৩ |
দেহ,
মাথা ও গ্রীবা একরেখায় নিশ্চলভাবে ধারণ ক’রে, কোনদিকে দৃষ্টি না দিয়ে, শুধু
নিজের নাকের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে।
|
||
|
১৪ |
প্রশান্ত
চিত্তে, মনে কোন ভয় না রেখে, ব্রহ্মচর্য ব্রতে মনকে সংযত রেখে, শুধুমাত্র আমার
চিন্তায় এবং সবকিছু আমাতেই সমর্পণ ক’রে, সমাহিত মনে ধ্যান করতে হবে। |
||
|
১৫ |
ধ্যানযোগী
এইভাবে সর্বদা সংযত চিত্তে, একাগ্র চিত্ত ধ্যানে নিমগ্ন অবস্থায়, আমার স্বরূপ
উপলব্ধি করেন এবং পরম শান্তি লাভ করেন। |
||
|
১৬ |
হে
অর্জুন, যারা বেশী আহার করে, অথবা যারা খুবই কম আহার করে তাদের পক্ষে ধ্যান
সম্ভব নয়। যারা অত্যধিক নিদ্রাকাতর অথবা যারা সম্পূর্ণ নিদ্রাত্যাগী তাদেরও
ধ্যান হয় না। |
||
|
১৭ |
যিনি
পরিমিত আহার ও চলাফেরা করেন, যিনি কাজের চেষ্টায় নিজেকে যুক্ত রাখেন, যাঁর
নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তাঁর যোগ আচরণে সংসারের দুঃখ দূর হয়। |
||
|
১৮ |
যে
অবস্থায় যোগীর সংযত চিত্ত নিজের আত্মাতেই স্থায়ী অবস্থান নেয় এবং সকল কামনা থেকে
মন সম্পূর্ণ নির্বিকার হয়ে যায়, সেই অবস্থাকেই সমাধি বলে। |
||
|
১৯ |
বায়ুর
প্রবাহহীন স্থানে দীপের শিখা স্থিরভাবে জ্বলতে থাকে, জেনে রেখ, ওই দীপশিখাই হল ধ্যান
অভ্যাসকারী যোগীর সংযত চিত্তের উপমা। |
||
|
২০ |
যোগ
ক্রিয়ায় সর্ব বিষয়ে আসক্তিহীন হয়ে, যে অবস্থায় মন পরমশান্তি লাভ করে এবং যে
অবস্থায় শুদ্ধ চিত্তে পরম আত্মার উপলব্ধি হয়ে যোগী নিজের আত্মাতেই পরমাত্মার
স্পর্শে আনন্দিত হন, |
||
|
২১ |
যে
অবস্থায় এই যোগী সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অতীত এক অনন্য অনুভবে পরম আনন্দ উপলব্ধি করতে
পারেন এবং একবার আত্মস্থিত হবার পর আর বিচলিত হন না, |
||
|
২২ |
যে
অবস্থা লাভ করার পর যোগী আর অন্য সমস্ত লাভকেই তুচ্ছ জ্ঞান করেন এবং এই
আত্মস্থিত অবস্থায় যিনি চরম দুঃখেও অবিচলিত থাকতে পারেন, |
||
|
২৩ |
সমস্ত
দুঃখের সম্পর্কহীন এই অবস্থাকেই সমাধি বলে জানবে। আন্তরিক অধ্যবসায়ে নির্বিকার
চিত্তে এই সমাধির একনিষ্ঠ সাধনাই কর্তব্য। |
||
|
২৪ |
সংকল্পের
সমস্ত কামনা নিঃশেষে ত্যাগ ক’রে, অন্তরের সমস্ত দিক থেকে সকল ইন্দ্রিয়কে
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ক’রে, |
||
|
২৫ |
ধৈর্যের
সঙ্গে, সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে ধীরে ধীরে, মনের উত্তরণ ঘটাবে এবং মনকে নিজের আত্মায়
প্রতিষ্ঠা ক’রে, অন্য আর কিছুই চিন্তা করবে না, |
||
|
২৬ |
চঞ্চল ও
অস্থির মন যে যে বিষয়ের প্রতি বিক্ষিপ্ত হবে, সেই সেই বিষয় থেকে সংযত ক’রে, মনকে
আত্মার বশে আনবে। |
||
|
২৭ |
প্রশান্ত
চিত্তের যোগীই পরম আনন্দের অবস্থায় স্থিত হতে পারেন, কারণ তাঁর মন থেকে রজোগুণ দূর
হয়ে, অন্তরে নিষ্পাপ ব্রহ্মভাবের উপলব্ধি হয়। |
||
|
২৮ |
এই ভাবেই
নিষ্পাপ যোগী নিজের আত্মায় নিত্য যোগ সাধনায়, অনায়াসে ব্রহ্মভাব অনুভব ক’রে পরম
আনন্দ উপলব্ধি করেন। |
||
|
২৯ |
যোগ
সমাহিত ব্যক্তি সমস্ত জীবে সমদর্শী হয়ে জীবের আত্মার মধ্যে নিজের আত্মা এবং
নিজের আত্মায় সমস্ত জীবের আত্মাকে দেখে থাকেন।
|
||
|
৩০ |
যিনি
সর্বজীবের মধ্যে আমাকেই দেখতে পান এবং আমার মধ্যেই সমস্ত জগৎকে দেখে থাকেন, তাঁর
কাছে আমি প্রত্যক্ষ হই এবং তিনিও আমার দৃষ্টির আড়ালে থাকেন না। |
||
|
৩১ |
যিনি
সর্ব জীবের আত্মায় একাত্ম হয়ে আমার ভজনা করেন, সেই যোগী যে পরিস্থিতিতেই থাকুন
না কেন, আমার মধ্যেই অধিষ্ঠান করেন। |
||
|
৩২ |
হে
অর্জুন, যিনি সকল জীবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, তাদের সুখ ও দুঃখের সমান অনুভব, নিজের
অন্তরে অনুভব করেন, আমার মতে তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী। |
||
|
৩৩ |
অর্জুন
বললেন – হে মধুসূদন, এই যে তুমি সমদর্শন যোগের কথা বর্ণনা করলে, আমার মনের
অস্থিরতার কারণে আমি এই যোগের অবিচল স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না। |
||
|
৩৪ |
হে
কৃষ্ণ, যেহেতু মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয়ের উপর তার শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ
দুর্ভেদ্য। বায়ুর মতো সেই মনকে রুদ্ধ ক’রে রাখা অতি দুষ্কর বলেই আমি মনে করি। |
||
|
৩৫ |
শ্রীভগবান
বললেন- হে মহাবীর, মন যে চঞ্চল এবং একে দমন করা যে দুঃসাধ্য তাতে কোন সন্দেহ
নেই। কিন্তু একনিষ্ঠ যোগ অভ্যাসে এবং বৈরাগ্য চর্চায় এই মনকে রুদ্ধ করা সম্ভব,
হে অর্জুন। |
||
|
৩৬ |
আমার মতে
অসংযমী চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে যোগসমাধি লাভ অসম্ভব। কিন্তু একাগ্র অধ্যবসায় ও
সংযতচিত্ত ব্যক্তির নিয়মিত ধ্যান অভ্যাসে যোগসমাধি লাভ করা সম্ভব। |
||
|
৩৭ |
অর্জুন
বললেন – হে কৃষ্ণ, শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি একাগ্রতার অভাবে যোগভ্রষ্ট হয়ে যদি
যোগসিদ্ধি লাভ করতে না পারেন, তাহলে তাঁর কি উপায় হবে? |
||
|
৩৮ |
হে
কৃষ্ণ, ব্রহ্মত্বলাভের পথে, বিভ্রান্ত ও অস্থিরচিত্ত হয়ে, কর্মযোগ ও ধ্যানযোগ –
এই উভয় পথ থেকেই ভ্রষ্ট হওয়া ব্যক্তি, এক খণ্ড ছিন্ন মেঘের মতোই কি নষ্ট হন না? |
||
|
৩৯ |
হে
কৃষ্ণ, আমার মনের এই সংশয় নির্মূল করার যোগ্য লোক একমাত্র তুমিই। কারণ তুমি ছাড়া
কোন ঋষি বা দেবতার, আমার এই সংশয় দূর করার সাধ্য নেই। |
||
|
৪০ |
শ্রীভগবান
বললেন – হে পার্থ, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তির ইহলোকে, এমনকি পরলোকেও কোন ক্ষতি হয় না।
কারণ কল্যাণকারী যোগের প্রচেষ্টায় কোন ব্যক্তিরই দুর্গতি হতে পারে না। |
||
|
৪১ |
পুণ্যবানব্যাক্তিরা
যে লোকে বাস করেন, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি সেই লোকে বহু বছর বাস করার পর, সদাচারী ও
ভাগ্যবান মানুষের ঘরে আবার জন্ম নেন। |
||
|
৪২ |
অথবা পরমজ্ঞানী
সন্ন্যাসীদের বংশেই এঁরা জন্মগ্রহণ করেন। যদিও এই জগতে এই রকম জন্মলাভের ভাগ্য
দুর্লভ। |
||
|
৪৩ |
|
||
|
৪৪ |
তিনি
পূর্বজন্মের অভ্যাস বশে স্বভাবতই যোগসাধনে প্রবৃত্ত হন এবং যোগের স্বরূপ
উপলব্ধির ইচ্ছায়, যোগসাধনার শুরুতেই, যজ্ঞ অনুষ্ঠানের ফলকে অতিক্রম করতে
পারেন। |
||
|
৪৫ |
যোগভ্রষ্ট
ব্যক্তি পূর্বজন্মের সাধনার থেকেও অনেক বেশী অধ্যবসায় এবং আরো বেশী পবিত্রভাবে
সাধনা করলে, বহুজন্মের সাধনার ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত পরম মুক্তি লাভ করতে পারেন। |
||
|
৪৬ |
যাঁরা
তপস্যা করেন তাঁদের থেকে এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণের থেকেও যোগী শ্রেষ্ঠ। আমার
মতে যাঁরা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন সেই সব কর্মযোগীদের থেকেও যোগী শ্রেষ্ঠ। অতএব হে
অর্জুন, তুমি যোগী হও। |
||
|
৪৭ |
যিনি
শ্রদ্ধাযুক্ত মনে, আমাতে চিত্ত সমর্পণ ক’রে, আমার ভজনা করেন, আমার মতে, তিনিই
সমস্ত যোগীগণের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ। |
ধ্যানযোগ সমাপ্ত
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন