["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের চতুর্থ পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে "ধর্মাধর্ম - ৩/৪"]
তৃতীয় পর্ব - পঞ্চম পর্বাংশ
(৬০০ বিসিই থেকে ০ বিসিই)
৩.৪.২ প্রাক-মৌর্য ভারত
কথিত আছে রাজা বিম্বিসারের দীর্ঘ আয়ুতে বিরক্ত
হয়ে, যুবরাজ
অজাতশত্রু পিতাকে হত্যা করে মোটামুটি ৪৯৩ বি.সি.ই-তে মগধের রাজা হয়েছিলেন।
উচ্চাভিলাষী অজাতশত্রু রাজা হয়েই রাজধানী রাজগৃহকে আরও সুরক্ষিত করেছিলেন এবং
গঙ্গার ধারে পাতলিগ্রামে একটি দুর্গ বানিয়েছিলেন। রাজা বিম্বিসার পূর্বে অঙ্গ জয়
করেছিলেন, এখন
অজাতশত্রু রাজা হয়ে উত্তর ও পশ্চিমদিকে মন দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কোশল, কাশী এবং
বৃজি গণসঙ্ঘ জয় করে,
গাঙ্গেয় উপত্যকায় পূর্ণ আধিপত্য স্থাপন করলেন। নদীপথের যাবতীয় বাণিজ্য এবং
বিস্তীর্ণ উর্বর জমির কৃষিজ সম্পদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মগধরাজ্যের শক্তি ও
সমৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলল। তাছাড়াও মগধের নিয়ন্ত্রণে ছিল লোহা এবং তামার আকরগুলি। সব
মিলিয়ে সে সময় মগধ উত্তরভারতে সব থেকে শক্তিশালী রাজ্য হয়ে উঠেছিল। শোনা যায়, মোটামুটি
৪৬১ বি.সি.ই-তে রাজা অজাতশত্রুরও মৃত্যু হয় তাঁর পুত্রের হাতে। এবং তাঁর বংশের
পরবর্তী পাঁচজন রাজাই নাকি পিতৃহন্তারক[1] এবং রাজ্য
পরিচালনায় অদক্ষ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাজগৃহের অভিজাত নাগরিকেরা বিরক্ত হয়ে বিদ্রোহ
করে এবং শেষ রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে, শিশুনাগ নামে এক রাজকর্মচারীকে
সিংহাসনে বসায়। শিশুনাগের বংশ সম্ভবতঃ পঞ্চাশ বছরের বেশি রাজত্ব করতে পারেননি, তাঁকে সরিয়ে
মগধের রাজা হয়েছিলেন মহাপদ্ম নন্দ। নন্দরা বর্ণে শূদ্র ছিলেন। অতএব ভারতের ইতিহাসে
তাঁরাই ছিলেন প্রথম অক্ষত্রিয় রাজা।
নন্দ রাজারা বিশাল মগধরাজ্যের সীমানা আরও বাড়িয়ে
তুললেন তাঁদের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী দিয়ে। উত্তরভারতের যতগুলি গণসঙ্ঘী রাজ্য ছিল, সবগুলিকেই
পরাস্ত করে নিজের অধিকারে নিয়ে এসেছিলেন। অজাতশত্রু গঙ্গার ধারে পাতলিগ্রামে যে
দুর্গ বানিয়েছিলেন, সেখানেই
নন্দ রাজারা রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। সে শহরের নাম হল পাটলিপুত্র। নন্দরাজারা খুব
বেশি দিন রাজত্ব করতে না পারলেও, ভারতে তাঁরাই প্রথম বিশাল এক সাম্রাজ্য পরিচালনার প্রশাসনিক
ধারণা ও দক্ষতার সূচনা করতে পেরেছিলেন। সমস্ত সাম্রাজ্য জুড়ে কর ব্যবস্থা এবং কর
আদায়ের নির্দিষ্ট প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন। সুষ্ঠু কর আদায় নন্দবংশের
বৈভবকে সে সময় প্রবাদে পরিণত করেছিল। সেই সম্পদ দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিরক্ষা
ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। আলেকজাণ্ডার যখন ভারত জয়ে এসেছিলেন, সে সময়
মগধের সেনাবাহিনীতে ছিল কুড়ি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, দু’হাজার রথ
এবং তিন হাজার হাতি। এই বর্ণনা পাওয়া যায় আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে আসা গ্রীক
ঐতিহাসিকদের লেখায়। শোনা যায় এই বিপুল সৈন্য বাহিনীর সংবাদ পেয়েই, দীর্ঘদিন
দেশের বাইরে থাকা ক্লান্ত গ্রীক সৈন্যদল ভারতবিজয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। শুধু
প্রতিরক্ষাই নয়, নন্দরাজারা
সেচ ব্যবস্থার জন্যেও বহু ক্যানাল এবং জলাধার নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজ্যের সমস্ত
ভূমি এবং ভূসম্পদ ও জলসম্পদের অধিকারী যে রাষ্ট্র এবং সেই যাবতীয় সম্পদই যে
করযোগ্য ভারতবর্ষে সে ধারণারও প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন নন্দরাজারাই।
৩২১ বি.সি.ই-তে ধননন্দকে পরাস্ত করে নন্দ-রাজত্বের হঠাৎই সমাপ্তি ঘটালেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
৩.৪.৩ মৌর্য
সাম্রাজ্য - চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (রাজত্বকাল ৩২১-৩০০ বি.সি.ই)
মৌর্যদের সঠিক বংশ পরিচয় বেশ অস্পষ্ট এবং
বিতর্কিত। কেউ কেউ বলেন,
তাঁরা ছিলেন আদতে ময়ূর-পোষমানানো জনগোষ্ঠী। ময়ুরকে চলতি ভাষায় মোর বলা হয়, সেখান থেকে
এসেছে মৌর্য। সেক্ষেত্রে মৌর্যরা অনার্য এবং শূদ্র। অনেকে বলেন চন্দ্রগুপ্তের
মায়ের নাম মুরা, তিনি
নন্দবংশের শেষ রাজা ধননন্দের প্রাসাদে ক্রীতদাসী ছিলেন। মাতা মুরার সম্মানেই
মাতৃভক্ত চন্দ্রগুপ্ত তাঁর বংশের নাম রেখেছিলেন মৌর্য। এই মত মেনে নিলেও মৌর্যরা
ছিলেন অনার্য এবং শূদ্র। ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থে মৌর্যদের “পাষণ্ড” বলেই উল্লেখ করা
হয়েছে, কারণ
তাঁরা ছিলেন প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধী।
কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র মতে, কয়েকশ’ বছর
আগে থেকেই পিপ্পলিবনে ছোট একটি গণসঙ্ঘী রাজ্য ছিল, সে রাজ্যের এক গোষ্ঠীর নাম ছিল
মোরিয়। এই গণরাজ্যের গোষ্ঠী প্রধানরাও, মহানির্বাণের পর বুদ্ধদেবের অস্থি
নিয়ে, তাঁদের
রাজ্যে স্তূপ নির্মাণ করিয়েছিলেন, সে কথা আগেই বলেছি। অজাতশত্রু রাজা হয়ে মগধ সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠার সময়, যে
গণরাজ্যগুলিকে অধিকার করেছিলেন, তার মধ্যে পিপ্পলি গণরাজ্যও নিশ্চয়ই ছিল। অতএব সে সময়
মোরিয়রা রাজ্যচ্যুত হন। বৌদ্ধমতে মৌর্য নামকরণ সেই মোরিয়া থেকেই। এক্ষেত্রে তাঁরা
ক্ষত্রিয় কিনা স্পষ্ট নয়,
কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিরোধী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমরা আগেই দেখেছি
আর্যাবর্তের গণরাজ্যগুলি সাধারণতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্ম এড়িয়ে চলত। তাছাড়া তাঁরা যে
বৌদ্ধধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, তার প্রমাণ, প্রবল শক্তিশালী রাজ্য মগধের
পাশাপাশি, তাঁরাও
ভগবান বুদ্ধের অস্থি-অবশেষের অংশ পেয়েছিলেন।
মৌর্যরা ব্রাহ্মণ্য বিরোধী হলেও একজন ব্রাহ্মণ
নন্দরাজাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে মগধের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, এমনই শোনা
যায়। সেই ব্রাহ্মণের নাম কৌটিল্য বা চাণক্য এবং তিনিই “অর্থশাস্ত্র” নামক জটিল এক
রাষ্ট্রনীতির অনন্য গ্রন্থ প্রণেতা। শোনা যায় তিনি তক্ষশিলায় অধ্যয়ন করেছিলেন।
আধুনিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটো
প্রবাদই আংশিক সত্য হতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রথমতঃ মগধের মতো
শক্তিশালী এক বিশাল রাজ্য কৌটিল্য শুধুমাত্র কূটনীতি করে চন্দ্রগুপ্তকে পাইয়ে
দিলেন এ কথা অবিশ্বাস্য। যদি তিনি তেমন কিছু করেও থাকেন, কেন করলেন? কারণ
চন্দ্রগুপ্ত উচ্চাভিলাষী এবং রাজ্যকামী, হয়তো এক শূদ্রজাত কিংবা শূদ্র না
হলেও মোরিয় গোষ্ঠীর ক্ষত্রিয় যুবক। যাদের ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী হিসেবে বহুদিনের
দুর্নাম। এমন একজন মানুষকে কৌটিল্য এতটা সাহায্য করলেন কেন? শোনা যায়
রাজা ধননন্দর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল। গভীর ষড়যন্ত্রে তিনি তাই কাঁটা
দিয়ে কাঁটা তুলেছিলেন?
দ্বিতীয়তঃ অর্থশাস্ত্র যে একজনের লেখা কোন
শাস্ত্র নয়, সে
কথাও এখন প্রমাণিত এবং এটাও প্রমাণিত যে বহু বছরের প্রচলিত তত্ত্বসমূহ একত্র করে, “অর্থশাস্ত্র”
সংকলন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বিষ্ণুগুপ্ত। অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে রাজবৃত্তির
বিনয়াধিকারিকের প্রথম অধিকরণে বিষ্ণুগুপ্ত বলছেন, “ওঁ। শুক্র ও বৃহষ্পতিকে প্রণাম। ভূমি
অধিগ্রহণ এবং তার সংস্কার সম্পর্কে পূর্ববর্তী আচার্যগণ যত অর্থশাস্ত্র রচনা করে
গেছেন, তার
প্রায় সবগুলিই এই গ্রন্থে সংকলিত হল”[2]। অতএব এমন অনুমান করা যায়, চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্যের প্রধান মন্ত্রণাদাতা ছিলেন আচার্য কৌটিল্য, এবং তাঁদের মধ্যে নিবিড় নির্ভরতা
ছিল। উচ্চাভিলাষী চন্দ্রগুপ্ত যেমন যেমন সাম্রাজ্যের পরিসীমা বাড়িয়েছেন, সেই অনুযায়ী
জটিল থেকে জটিলতর রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রকরণে তাঁরা অভিজ্ঞ হয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতার কথাই
কৌটিল্য লিখে গিয়েছিলেন “অর্থশাস্ত্রে”। যার ফলে, অর্থশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ
নীতিই কৌটিল্যরই রচনা,
কারণ তার আগে এত বড়ো সাম্রাজ্য এবং এমন জটিল প্রশাসনের অভিজ্ঞতা কারও ছিল না।
যদিও আগের অধ্যায়েই আমরা দেখেছি, ভারতবর্ষে ভূমি এবং ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন
নন্দরাজারা।
অতএব কৌটিল্য তাঁর লেখা শুধুমাত্র অর্থশাস্ত্র
বইখানি হাতে নিয়ে, সম্পূর্ণ
একক প্রচেষ্টায় চন্দ্রগুপ্তকে পুতুলের মত ব্যবহার করে, এত বড়ো
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন। কিংবা তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই সেই সাম্রাজ্যের
প্রশাসনিক যাবতীয় কাজ,
চন্দ্রগুপ্তকে দিয়ে সুষ্ঠুভাবে করিয়ে নিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের বিবিধ বিতর্কের
মধ্যে না জড়িয়েও এমন অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়।
চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে বসেছিলেন ৩২১
বি.সি.ই-তে। তার মাত্র ছ’বছর আগে ৩২৭ বি.সিই-তে
ম্যাসিডোনিয়ার (গ্রীসের ছোট একটি রাজ্য) দিগ্বিজয়ী রাজা আলেকজাণ্ডার
পারস্যের শক্তিশালী আকিমিনিড সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে এগিয়ে আসছিলেন ভারত বিজয়ের
লক্ষ্যে। আসার পথে তিনি জয় করলেন, আকিমিনিড সাম্রাজ্যেরই আরেকটি প্রদেশ গান্ধার এবং তার
রাজধানী তক্ষশিলা। তারপর তিনি সিন্ধু উপত্যকার ছোটখাটো রাজ্যগুলি জয় করে পৌঁছে
গেলেন পাঞ্জাবে (অধুনা পাকিস্তানে অবস্থিত)। সেখানে ঝিলাম নদীর ধারে রাজা পুরুর
সঙ্গে আলেকজাণ্ডারের তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। গ্রীক ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধকে “হাইডেসপাস
নদীর যুদ্ধ” (৩২৬ বি.সি.ই) বলে উল্লেখ করেছেন। সেই যুদ্ধে আলেকজাণ্ডারের জয় হয়েছিল
ঠিকই, তবে
ক্ষতিও হয়েছিল বিস্তর। রাজা পুরুর রাজ্য জয় করে, আরও পূর্বদিকে আলেকজাণ্ডারের সৈন্য
বাহিনী এসে পৌঁছল বিপাশা নদীর তীরে। সেখানেই তারা শুনল নন্দরাজার সাম্রাজ্য এবং
তাদের বিপুল সৈন্যবাহিনীর কথা। ছোট্ট এক রাজ্যের রাজা পুরুর সঙ্গে লড়াইতে তারা যে
বেগ পেয়েছিল, সে
কথা চিন্তা করে, আলেকজাণ্ডারের
সৈন্যরা এবার বেঁকে বসল। অনেক দিগ্বিজয় হয়েছে এবার তারা দেশে ফিরতে চায়। অতএব ৩২৫
বি.সি.ই-র কোন এক সময়ে,
ভারত জয়ের স্বপ্ন ছেড়ে আলেকজাণ্ডার বাধ্য হলেন দেশে ফিরে যেতে। শোনা যায়
চন্দ্রগুপ্ত কোন এক সময়ে নাকি আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাঁর
সৈন্য শিবিরে বেশ কিছুদিন ছিলেন।
হয়তো আলেকজাণ্ডারের রণকুশলতার শিক্ষা নিয়েই, চন্দ্রগুপ্ত
নন্দসাম্রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। নন্দ সাম্রাজ্যের রণসজ্জার তুলনায়
চন্দ্রগুপ্তের ক্ষমতা নগণ্য বলেই, তিনি সরাসরি যুদ্ধের পথে হাঁটেননি। প্রথমে ছোট ছোট আক্রমণে
নন্দসাম্রাজ্যের সীমানাগুলিকে তিনি ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাকে
দুর্বল করে তুলছিলেন। তাঁর এই কৌশলের পিছনেও একটি কাহিনী শোনা যায়। গরম ভাতের
থালায় মাঝখানের ভাতের চূড়া গরম থাকে অনেক বেশি। কাজেই মাঝখান থেকে না খেয়ে, থালার ধার
থেকে ভাত খেতে শুরু করা অনেক সুবিধেজনক। বালকপুত্রকে বলা কোন এক মহিলার এই উপদেশ
নন্দসাম্রাজ্য জয় করার পথে চন্দ্রগুপ্ত মনে রেখেছিলেন। এরপর কোন একসময় কৌটিল্যের
সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় এবং হয়তো তাঁর তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং ষড়যন্ত্রের সাহায্যে তিনি
সহজেই মগধের সিংহাসন অধিকার করতে পেরেছিলেন।
মগধের সিংহাসনে বসে প্রথমেই তিনি সাম্রাজ্য
বিস্তারে মন দিলেন। আলেকজাণ্ডার ও তাঁর সৈন্যদল দিগ্বিজয় করে দেশে ফিরে যাওয়ায়, উত্তর-পশ্চিম
ভারতের পরাজিত রাজ্যগুলি তখনও বেশ দুর্বল ছিল।
অন্যদিকে তাঁর নিজের এবং নন্দরাজাদের সেনাবাহিনী মিলিত হয়ে, তাঁর
রণশক্তি তখন প্রবল। অতএব উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধু নদ পর্যন্ত রাজ্যগুলি জয় করতে তাঁকে
বেগ পেতে হল না। সে সময় তিনি সিন্ধু নদ পার হয়ে আর এগোলেন না। কারণ সে পারে ছিল
আলেকজাণ্ডারের রাজত্বের সীমানা এবং তার দায়িত্বে ছিলেন তাঁর গ্রীক সেনাপতি সেলুকস
নিকেটর। উত্তর-পশ্চিমের পর,
তিনি মধ্যভারত জয়ে মন দিলেন এবং নর্মদার তীর অব্দি সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন।
এরপর দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি নতুন রাজ্য জয়ের থেকে, সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাজেই হয়তো
বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি আবার রাজ্য জয়ে বের হলেন ৩০৫ বি.সি.ই-তে, হানা দিলেন
সেলুকাসের সীমানায়। ৩০৩ বি.সি.ই-র এক চুক্তিতে সেলুকীয় (Seleucid) সাম্রাজ্যের
বেশ কিছু অঞ্চল - এখনকার বালুচিস্তান, আফগানিস্তান (কপিশা) এবং মাকরান –
চন্দ্রগুপ্তের হাতে সমর্পণ করা হয়েছিল। তার পরিবর্তে সেলুকাস পেয়েছিলেন পাঁচশ হাতি, হেলেনিয় (Hellenistic) যুদ্ধবাহিনীতে
তখনও হাতি ছিল এক আশ্চর্য রণসম্ভার। এ ছাড়াও তাঁদের মধ্যে একটি বৈবাহিক সম্পর্ক
স্থাপিত হয়েছিল। সেলুকাস তাঁর এক কন্যাকে মৌর্যবংশে সম্প্রদান করেছিলেন।
অতএব পশ্চিমে সেলুকীয় সাম্রাজ্যের সীমানা থেকে
পূর্বের গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত শুধু বিশাল এক
সাম্রাজ্যই প্রতিষ্ঠা করলেন না, প্রতিষ্ঠা করলেন অভূতপূর্ব এক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। গান্ধার
এবং তক্ষশিলা তাঁর আয়ত্ত্বে এসে যাওয়াতে সুদূর পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের
নিয়ন্ত্রণ এখন তাঁর হাতে এসে গেল। তার ওপর হেলেনীয় কন্যা এদেশের বধূ হয়ে যখন
পাটলিপুত্রে এসে বসবাস করতে লাগলেন, প্রাচীন দুই সভ্যতা এবং সংস্কৃতির
নিবিড় আদানপ্রদানও শুরু হয়ে গেল।
চন্দ্রগুপ্তর বিশাল এই সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে
এবং প্রদেশগুলি বিষয়ে (জেলা) বিভক্ত ছিল। এই প্রদেশগুলির মধ্যে প্রধান ছিল
উত্তরাপথ (রাজধানী তক্ষশিলা), অবন্তী (রাজধানী উজ্জয়িনি), দাক্ষিণাত্য (রাজধানী সুবর্ণগিরি)
এবং মগধ (রাজধানী পাটলিপুত্র)।
মোটামুটি ৩০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন এক সময়ে
চন্দ্রগুপ্ত পুরোপুরি জৈনধর্মী হয়ে উঠেছিলেন এবং পুত্র বিন্দুসারের হাতে
সাম্রাজ্যভার ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। এরপর তিনি বিখ্যাত জৈন আচার্য
ভদ্রবাহুর সঙ্গে পাটলিপুত্র ছেড়ে কর্ণাটকের শ্রবণ বেলগোলায় চলে যান। সেখানেই কট্টর
জৈনধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী উপবাস করে দেহত্যাগ করেন।
সম্রাট বিন্দুসার ২৯৭ বি.সি.ই-তে ক্ষমতায় এসে মৌর্য সাম্রাজ্যকে আরও দক্ষিণে কর্ণাটক পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন এবং আরও দক্ষিণে যুদ্ধ ছাড়াই মৈত্রী বন্ধনে সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়াতে পেরেছিলেন। রাজা বিন্দুসার আজীবিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। ২৭২ বি.সি.ই-তে বিন্দুসার যখন মারা গেলেন, একমাত্র কলিঙ্গ এবং দক্ষিণভারতের শেষ প্রান্তটুকু ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের পুরোটাই ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে। কলিঙ্গ রাজ্য জয়ের দায়িত্বটুকু রইল সম্রাট অশোকের জন্যে। বিন্দুসার তাঁর পিতা চন্দ্রগুপ্তের মতোই বৈদেশিক সম্পর্ক অটুট রাখতে পেরেছিলেন। শোনা যায়, বিন্দুসার গ্রীক রাজা অ্যান্টিওকাসকে একটি চিঠি দিয়ে মূল্যের বিনিময়ে কিছু গ্রীক সুরা, আঞ্জির (figs) এবং একজন দার্শনিককে ভারতে পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। রাজা অ্যান্টিওকাস সুরা ও আঞ্জির পাঠিয়েছিলেন এবং চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন গ্রীকরাজা পণ্য বিক্রয় করে থাকেন ঠিকই, কিন্তু দার্শনিক বিক্রয় করেন না।
৩.৫.১ সম্রাট ধর্মাশোক (রাজত্বকাল ২৬৮- ২৩১ বি.সি.ই)
পিতা বিন্দুসারের সময়েই অশোক দুটি অঞ্চলের
প্রশাসনিক প্রধান (Viceroy)
হয়ে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। প্রথমে ছিলেন উজ্জয়িনী (মালব্য)-র এবং
পরবর্তী কালে তক্ষশিলা (গান্ধার)-র। তরুণ অশোকের হাতে গান্ধারের মতো নব বিজিত
রাজ্যগুলির প্রশাসন তুলে দেওয়া থেকে, অশোকের যোগ্যতার ওপর বিন্দুসার যে
যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন,
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সদ্য পরাজিত রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারী, অভিজাত ও
সম্পন্ন বণিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রেখে আস্থাশীল সম্পর্ক গড়ে
তোলা নিঃসন্দেহে কঠিন চ্যালেঞ্জ। অশোকের সেটাই ছিল দায়িত্ব। বিশেষ করে, গান্ধারের
পরিবেশ এবং মানুষজনের ভাষা,
আচরণ, সংস্কৃতি
ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সে সময় গান্ধারে ছিল বহুজাতিক সংস্কৃতি – পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য
এবং গ্রীস প্রভাবিত সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা এবং বিদেশী । তার ওপর গান্ধারের রাজধানী
তক্ষশিলায় ছিল সেই সময়ের বিশ্ববিখ্যাত মহাবিদ্যালয়। অতএব ধরে নেওয়া যায় তক্ষশিলায়
ছিল বিখ্যাত দার্শনিক ও বিদগ্ধ পণ্ডিতসমাজ। বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব
করার ঔদ্ধত্য আড়ালে রেখে,
সকলের সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে নিজের প্রশাসনিক দক্ষতা এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা
– ছোকরা এক প্রশাসকের অনন্য কৃতিত্ব বৈকি!
বৌদ্ধ সূত্র থেকে জানা যায় অশোকের মা ছিলেন রাণি
সুভদ্রাঙ্গী, এক
ব্রাহ্মণকন্যা। বিন্দুসারের মৃত্যুর পর অশোক গান্ধার থেকে পাটলিপুত্রে চলে আসেন।
কোন বৌদ্ধ মতে তিনি নাকি তাঁর বড়োভাই সুসীমকে হত্যা করেছিলেন আবার কোন মতে, তাঁর
নিরানব্বই (কোন কোন মতে ছয়) জন ভাইকে হত্যা করে পিতার সিংহাসন অধিকার করেছিলেন।
অবশ্যই এই সব কাহিনী বৌদ্ধ পণ্ডিতদের অতিরঞ্জন।
একসময়ের নৃশংস অশোক বৌদ্ধ দর্শনের জাদুতে কেমন ধর্মাশোক হয়ে উঠেছিলেন - সেই মহিমা
প্রচারই ছিল এই কাহিনী বানিয়ে তোলার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু স্বয়ং বুদ্ধের
স্নেহধন্য অজাতশত্রু,
বুদ্ধের পরমভক্ত বৃদ্ধ পিতাকে কীভাবে হত্যা করেছিলেন, সে বিষয়ে
তাঁরা নীরব থাকাই সমীচীন মনে করেছিলেন।
সৌভাগ্যক্রমে সম্রাট অশোক নিজেই এমন কিছু
প্রত্যক্ষ প্রমাণ রেখে গেছেন, যার থেকে মানুষ-অশোক এবং সম্রাট-অশোককে আদ্যন্ত চিনতে
অসুবিধে হয় না। মৌর্য সাম্রাজ্যের নানান প্রান্তে বেশ কিছু শিলা-নির্দেশ (Rock Edict), গুহা-নির্দেশ
(Cave Edict) এবং
স্তম্ভ-নির্দেশ (Pillar Edict) পাওয়া
গেছে। পাথরের গায়ে খোদাই করা এই নির্দেশগুলি যে সম্রাট অশোকেরই বক্তব্য, সে বিষয়ে
সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
সম্রাট অশোক তাঁর পিতা বা পিতামহর মতো রাজ্য জয়ে
খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর রাজ্য জয়ের ইতিহাস যা পাওয়া যায়, সে শুধু
কলিঙ্গ বিজয়। তাও কলিঙ্গ অভিযান করেছিলেন সিংহাসনে বসার আট বছর পর।
কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর
তাম্রলিপ্তি থেকে গঙ্গা এবং অন্যান্য নদীপথগুলি, রাজধানী পাটলিপুত্র এবং গাঙ্গেয়
উপত্যকার অন্যান্য শহরের বাণিজ্য যোগাযোগের পক্ষে ছিল সব থেকে সহজ ও নিরাপদ।
উপরন্তু তাম্রলিপ্তি তথা কলিঙ্গ অধিকার করতে পারলে, মায়ানমার ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ
এবং দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে আসত মৌর্যদের হাতে। আবার
পূর্ব ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার সহজতম স্থলপথ ছিল সমুদ্রের উপকূল বরাবর।
অরণ্যসঙ্কুল মধ্যভারত,
বিন্ধ্য এবং সাতপুরা পর্বতমালা অতিক্রম করে স্থলপথে উত্তর থেকে দক্ষিণভারত
যাত্রার পথ সেসময় ছিল অত্যন্ত দুর্গম। অতএব অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেই
কলিঙ্গ জয় করা মৌর্য সাম্রাজ্যের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
[Maximum extent of the Maurya Empire, as shown by the locations of Ashoka's inscriptions, and visualised by eminent historians - Vincent Arthur Smith, R. C. Majumdar and historical geographer Joseph E. Schwartzberg. ]
সিংহাসনে বসার পর থেকেই, তাঁর
মন্ত্রীমণ্ডল থেকে কলিঙ্গ জয়ের জন্যে সম্রাট অশোকের কাছে হয়তো বারবার প্ররোচনা
আসছিল। অশোক হয়তো চেষ্টা করেছিলেন কলিঙ্গ বিনা যুদ্ধে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনতা
স্বীকার করুক, যেভাবে
দক্ষিণ ভারতের অনেকগুলি গোষ্ঠী করেছিল – চোল, পাণ্ড্য এবং সত্যপুত্র। অথবা কোন
মৈত্রী চুক্তি করে কলিঙ্গ অধিকার করতে, যেমন হয়েছিল সেলুকীয় রাজ্যগুলির
সঙ্গে। দীর্ঘ আট বছর এই টালবাহানার পরেই তিনি হয়তো যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য
হয়েছিলেন।
ছোট্ট কলিঙ্গ রাজ্যের তুলনায় মৌর্য সাম্রাজ্যের
সামরিক শক্তি ছিল অপরিমেয়[3]। কিন্তু দুপক্ষেরই জেদ এবং
অনমনীয় মনোভাবের জন্যেই যুদ্ধ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতঃ
নির্বিবাদী সম্রাট অশোক স্বপ্নেও ভাবেননি যুদ্ধজয়ের এমন ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে। এই
যুদ্ধের পরিণতি জাগিয়ে দিয়েছিল তাঁর নিভৃত মানবচেতনা। কলিঙ্গ জয়ের প্রায় পাঁচ বছর
পরে তিনি যে দীর্ঘতম শিলালিপিটি লিখিয়েছিলেন, তার আংশিক উদ্ধৃতি থেকে তাঁর সেই
বিষণ্ণ মানসিকতার পরিচয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, -
“অভিষেকের আটবছর পরে দেবতাদের প্রিয় (দেবানাম্পিয়[4]) রাজা প্রিয়দর্শী (প্রিয়দশী[5]) কলিঙ্গ জয় করলেন। একশ পঞ্চাশ হাজার মানুষ যুদ্ধবন্দী, একশ হাজার মানুষ মৃত এবং তার থেকেও অনেক বেশি লোকের সর্বনাশ হয়েছে। কলিঙ্গ অন্তর্ভুক্তির পরে, দেবপ্রিয় (দেবপিয়) আন্তরিক ভাবেই ধর্ম (ধম্ম) আচরণ করছেন, ধম্ম সঙ্কল্প করছেন এবং ধম্ম শিক্ষা দিচ্ছেন। কলিঙ্গজয়ের পর দেবপ্রিয় গভীর মর্মাহত, স্বাধীন রাজ্য জয়ে মানুষের হত্যা, মৃত্যু এবং ছন্নছাড়া হওয়া দেখে দেবপ্রিয় শোকাহত, তাঁর মন ভারাক্রান্ত। দেবপ্রিয়র কাছে আরও শোচনীয় হল, যারা সেখানে বাস করে, ব্রাহ্মণ, শ্রমণ কিংবা অন্য কোন ধর্মের (মানুষ) কিংবা গৃহস্থ - যারা গুরুজনকে মান্য করে, মাতাপিতাকে শ্রদ্ধা করে, শিক্ষককে শ্রদ্ধা করে এবং বন্ধু, পরিচিত, সহকর্মী, আত্মীয়, দাস ও ভৃত্যদের সঙ্গে ভদ্র এবং আন্তরিক ব্যবহার করে – তারাও এই হিংসা, হত্যা এবং প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছেদের অসহনীয় দুঃখ ভোগ করছে। এমনকি যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে এবং প্রিয়জনদের হারায়নি, তারাও তাদের বন্ধু, পরিচিত, সহকর্মী এবং আত্মীয়দের দুর্ভাগ্যের যন্ত্রণা ভোগ করছে। সকল মানুষের এই দুঃসহ দুঃখে দেবপ্রিয়র মন বিষাদগ্রস্ত”। (কালসি শিলালিপি নং ১৩ – ত্রয়োদশ রাজত্ব বর্ষ – ২৫৫ বি.সি.ই - ডঃ রোমিলা থাপারের ইংরিজি অনুবাদের বাংলা – লেখক।)
তবে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসার আগে অন্য মতগুলিও
অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখা যাক।
শোনা যায় রাজকুমার অশোক যখন উজ্জয়িনীর প্রধান প্রশাসক ছিলেন, সে সময় তাঁর বড়দা সুসীম ছিলেন গান্ধার বা তক্ষশিলার প্রধান প্রশাসক। কোন কারণে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এবং তক্ষশিলায় বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভের পরিস্থিতি তীব্র হয়ে ওঠায়, রাজা বিন্দুসার অশোককে সেখানে পাঠিয়েছিলেন পরিস্থিতি সামলাতে। রাজকুমার অশোক কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করতে পেরেছিলেন এবং আগেই বলেছি, তিনি স্থানীয় অভিজাত, বণিক ও পণ্ডিত সম্প্রদায়ের আস্থাও অর্জন করতে পেরেছিলেন। শোনা যায় এই বিদ্রোহ দমনের সময় রাজপুত্র সুসীম নিহত হন, আবার কেউ বলেন অশোকই দাদাকে হত্যা করিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে অশোকের মনে কঠোর নিষ্ঠুরতারও একটা দিক হয়তো ছিল। যার জন্যে তাঁর বদনাম রটেছিল “চণ্ডাশোক”।
তিনি নিজে সিংহাসনে বসার পর তেমন কোন
গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিগ্রহের কথা শোনা যায় না। কিন্তু তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল
কলিঙ্গ বিজয়, তার
কারণ আগেই বলেছি। দীর্ঘদিন নানান চেষ্টাতেও কলিঙ্গ যখন তাঁর সাম্রাজ্যের বশ্যতা
স্বীকার করল না, তাঁর
রাজত্বের অষ্টম বছরে তিনি হয়তো আবার চণ্ডাশোক হয়ে উঠলেন। তাঁর সাম্রাজ্যের বিপুল
ক্ষমতার প্রয়োগে উগ্র নিষ্ঠুরতায় জয় করলেন কলিঙ্গ। যে কারণে তিনি নিজেই হতাহত এবং
যুদ্ধবন্দীর যে বিপুল হিসেব দিয়েছেন, সমসাময়িক যে কোন যুদ্ধের প্রেক্ষীতে
সে হিসেব অস্বাভাবিক হিংস্রতার পরিচয় দেয়। হয়তো এই যুদ্ধের ফলাফলে তিনি
সাম্রাজ্যের ভেতরের আপাতবিদ্রোহী অঞ্চলগুলিকে এবং সীমানার বাইরের রাজ্যগুলিকেও এই
বার্তা দিতে চেয়েছিলেন,
রাজা অশোক এমনিতে ভালো,
কিন্তু বিরুদ্ধদের যম। হয়তো এটা ছিল তাঁর “প্রথম রাত্রেই বিড়াল মারা”-র
বার্তা। যার ফলে পরবর্তীকালে তিনি যখন পুরোপুরি “ধম্ম” প্রচারে মনোনিবেশ করলেন, তাঁর উণত্রিশ বছরের ধর্ম-রাজত্বকালে কোন সীমান্ত যুদ্ধ বা আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কথা
শোনা যায় না।
সত্যি যাই হোক, অশোকের কলিঙ্গ বিজয়ের সময়কাল ২৬০
বিসিই। যুদ্ধজয়ের পরে বিজয়ী রাজার এমন বিষণ্ণতা, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনদিন কোথাও
দেখা যায়নি। এই ঘটনার প্রায় আড়াই বছর পরে অশোক একনিষ্ঠ বৌদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। শোনা
যায় মথুরা-বৌদ্ধবিহারের মহা-অর্হৎ উপগুপ্ত অথবা মৌদ্গলিপুত্র তিস্য অশোককে
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। অর্হৎ উপগুপ্ত পূর্বাশ্রমে ছিলেন বারাণসীর এক
গন্ধবণিকের পুত্র।
আরেকটি সূত্রে জানা যায় অশোককে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণে
হয়তো প্রভাবিত করেছিলেন তাঁর অন্য এক রাণি কারুবাকী। যিনি অধিকাংশ সময় বিদিশা[6]-য় থাকতেন এবং
পাটলিপুত্রে খুবই কম যাওয়া-আসা করতেন। বিদিশার এক ধনী বণিকের সুন্দরী কন্যা ছিলেন
কারুবাকী। এলাহাবাদ স্তম্ভ-নির্দেশে যে বিদিশা-রাণির দানের উল্লেখ আছে, সেই রাণিই
কারুবাকী। ধারণা করা হয় অশোকের সঙ্গে বিবাহের অনেক আগে থেকেই কারুবাকী বৌদ্ধধর্মে
প্রভাবিতা ছিলেন এবং সেই কারণেই তিনি পাটলিপুত্রের বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদের জাঁকজমক
এবং প্রাসাদের অন্তঃপুর-রাজনীতি এড়িয়ে বিদিশায় থাকতে পছন্দ করতেন। বিদিশাগিরি
মহাবিহার তিনিই নির্মাণ করিয়েছিলেন। অশোক ও রাণি কারুবাকীর প্রথম পুত্রের নাম
উজ্জেনিয়, তাঁর
সম্বন্ধে তেমন কিছু শোনা যায় না, তিনি হয়তো অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের অন্য পুত্র
মহেন্দ্র এবং কন্যা সঙ্ঘমিত্রা দুজনেই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সঙ্ঘে যোগ
দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁরা দুজনেই পিতা অশোকের নির্দেশে সিংহলে গিয়েছিলেন
বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতে। অশোক ও রাণি কারুবাকীর আরেক পুত্রের শুধু নাম ছাড়া আর
কিছুই জানা যায় না, তিনি
তিবারা।
চলবে...
[1] চতুরাশ্রম
ছিল ব্রাহ্মণ্য সামিজিক রীতি – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও
সন্ন্যাস। তবে বাস্তবে খুব কম লোকই এই রীতি অনুসরণ করত। কোন রাজা দীর্ঘায়ু হলেই
পারিবারিক ষড়যন্ত্র প্রবল হয়ে উঠত। সে কালের স্বচ্ছল মানুষরা অল্পবয়সেই, মোটামুটি
১৬-১৮ বছরেই সন্তানের পিতা হত। অতএব পিতা সত্তর-আশি বছর জীবিত থেকে সিংহাসন আগলে
বসে থাকলে, সিংহাসনের
মুখ্য দাবিদার জ্যেষ্ঠপুত্রের বয়স দাঁড়াত ৫২-৬২ বছর! যুবরাজ অথবা আঞ্চলিক প্রধান
হয়ে, জ্যেষ্ঠ
রাজপুত্র কতদিন আর ধৈর্য ধরবে সিংহাসনের আশায়! শুরু হত অন্তঃপুরে অঘটন।
[2] “Óm. Salutation to Sukra and
Brihaspati. This Arthasástra is made as a compendium of almost all the Arthasástras, which, in view of
acquisition and maintenance of the earth, have been composed by ancient
teachers”. - From Kautilya’s Arthashastra – Translated in English by Shrijukta
R. Shamasastry. বাংলা অনুবাদ- লেখক।
[3]
এই প্রসঙ্গে বর্তমানে ছোট্ট ইউক্রেন ও বিপুলা রাশিয়ার যুদ্ধের কথা বড়ো বেশি
মনে আসে। রাশিয়া হয়তো অচিরেই ইউক্রেন অধিকার করে ফেলবে, কিন্তু
মহামতি পুতিন কী পারবেন,
কলিঙ্গ-যুদ্ধ সমাপ্তিতে সম্রাট অশোকের মতো বিষণ্ণ স্বীকৃতি প্রকাশ করতে? ভবিষ্যৎ কে
বলতে পারে?
[4]
আমাদের স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ কৌমুদী (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-প্রণীত ও হরলাল
বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত)-তে দেখছি, অলুক সমাসের ১৬ নম্বর নিয়মে বলা আছে, “প্রিয় শব্দ
পরে থাকিলে দেব-শব্দের পরবর্তী ষষ্ঠী বিভক্তির লোপ হয় না। যথা, দেবানাম্প্রিয়ঃ
(মূর্খ)। অন্যত্র, দেবপ্রিয়ঃ
(dear to the
gods).”
[5] “দেবানাম্পিয়”, “দেবপিয়”, “পিয়দশী”, “ধম্ম” – এই
ধরনের শব্দগুলি মূল সংস্কৃত শব্দের প্রাকৃত রূপ।
[6] আধুনিক
ভূপাল শহরের ৬২.৫ কিমি উত্তরপূর্বে ছিল বিদিশা নগরীর অবস্থিতি।
মানচিত্র ঋণঃ উইকিপিডিয়া
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন