পুজোর
সেকাল
সেবার পুজোয় হায়ার সেকেণ্ডারির দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা যেন
স্পষ্ট অনুভব করতে পারলাম আমাদের হাড় জিরজিরে পিঠের দুপাশে চিকন চিকন পাখনা
গজিয়েছে। না, চোখে দেখা মেলে না। বুঝে নিতে হয়। জামায় ডগ কলার। প্যান্টের
তলাটা ঘন্টা। চুলে অমিতাভ।
“গুরু, সেনজেঠুর ছোট মেয়েটা তোকে পরপর চারবার ঝারি দিল,
মাইরি...অন গড, টপ সেজেছে...গুরু এইবেলা তুলে নে, ফাৎনা নড়ছে...”।
“আরে, ওতো তিৎলি, ধুর ... ছোটবেলায় ওর সঙ্গে কত লুকোচুরি খেলেছি...”।
আমাদের পাড়ার বড়ো রাস্তার মোড়ে কর্পোরেশনের গেটের সামনে ঝরঝরে টেম্পো দাঁড়িয়ে থাকত একটা সারাটা দিবস। সারা হপ্তা। সারা মাহ। পুজোর চারদিন ভাঙা টেম্পোর কানায় পশ্চাৎ ঝুলিয়ে আমরা সাত আটজন।
কলেজস্কোয়্যারের পুজোর তখন ভীষণ নাম ডাক। মায়ের মুখটি খোদ রমেশ পাল ফিনিশ করতেন। থিম টিম আসতে তখনো বহু দেরী। গোলদীঘির চারপাড়ে আলোর বন্যা। চন্দননগরের চিকিরমিকির ঝিকিরঝিকির আলোর গপ্প সবে চালু হয়েছে। শেয়ালের টকসা আঙুর খাওয়া। এক কাক ন্যাজে ময়ুরের প্যাখম ঝুলিয়ে হেব্বি ন্যাজে গোবরে হচ্ছে অন্য কাকদের কাছে। নেকড়ের গলায় বোকা বকের সার্জারি। পাব্লিক খুব খাচ্ছে।
সবে সন্ধে আটটা কি সাড়ে আটটা। শেয়ালদা হয়ে নেবুতলার ঠাকুর সেরে আমহার্স্ট স্ট্রীটের দিক থেকে ধেয়ে আসত অনেক প্রজাপতি। তাদেরও মিহিন মিহিন পাখনা। চিকন চিকন চেকনাই। আশেপাশে ঝোপঝাড়, পাতা, কাঁটাসমেত ডালপালা যতই না কেন আড়াল করতে চেষ্টা করুক, ঠিক চারিচক্ষুর মিলন – পপাত চ, মমার চ।
আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু বাপি, পয়লা নম্বরের হেগো রুগি। ব্যাটা হামেশা আমাশায় ভুগত, আর দ্যাখ না দ্যাখ প্রেমে পড়ত। তার ধারণা তার চোখে এমন কিছু আছে, যেমন নাকি অজগরের থাকে - ছাগলের চোখে চোখ পড়লেই ফিনিস...। সেই রকম। কতবার তার কেঠো পশ্চাতে “নাতি” মেরে আমরাই পায়ে চোট পেয়ে আয়োডেক্স মলেছি। ব্যাটা হাসত ফ্যাক ফ্যাক করে। সেই বাপির বরাদ্দ ছিল পুজোর চারদিন চারটি -
ষষ্ঠীর রাতে “হলেও হতে পারত” শ্বশুরের হাতে গাঁট্টা –“ডেঁপো ছোঁড়া, এই বয়েসেই বজ্জাতি”?
সপ্তমীতে চার-পাঁচ প্রিয়সখী পরিবৃতা নায়িকার কমলকলি করে কানমলা –“অসব্য কলে না, সোনা, ললিপপ খাবে, না, খেলনা বিচকুট খাবে, মানা”?
কেস ক্যান্টার, প্রেস্টিজে একমুঠো গ্যামাক্সিন। আর এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল আমাদের পাড়ারই মিন্টুদা। উল্টোদিকের পানের দোকানে সিগারেট টানতে টানতে গম্ভীরমুখে খোরাকটা নিয়েছিল...এবং পরবর্তী আধা ঘন্টার মধ্যে আমাদের শান্তিদার চায়ের দোকানের নেড়ি কেলোও জেনে গিয়েছিল। কেলোকে লেড়ো বিস্কুট দিলে খুব লেজ নাড়ার চেষ্টা করত, কিন্তু লেজের চেয়ে কোমর আর পাছাটা হিলত বেশী। সে এক হাস্যকর প্রয়াস। ব্যাটার ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট বোধ হয়। ওই দ্যাখার জন্যে শান্তিদার দোকানে চায়ের চেয়েও লেড়ো বিক্রি হত মারকাটারি।
ওই যাঃ খেই হারিয়ে ফেলেছি। সে কথা হবে আরেকদিন।
অষ্টমীতে আরেক কেলো। একাকিনী নায়িকা ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে। বাপি সিওর যে ওর চোখের জাদু খেটে গেছে। বাপি রয়ে সয়ে কাছ ঘেঁষে “আপনার সঙ্গীরা ভিড়ে হারিয়ে গেছে বুঝি...” বলে সবে খেজুর শুরু করেছে। ঢ্যাঙা এক ছোকরা পাশেই ল্যাম্পপোষ্টে লটকানো দড়ি থেকে সিগারেট ধরাচ্ছিল, সে সন্দিগ্ধ চোখে বাপিকে বলেছিল “তোত্তাতে কি বে? কেলিয়ে বৃন্দাবন দেকিয়ে..., ফোট শা...”।
পুঁটিরাম আর মৌচাকের যত শালপাতাখেকো একটা ষাঁড় বসে ঝিমুচ্ছিল একটু তফাতে। দৌড়ে পালাতে গিয়ে তার ঘাড়ে উল্টে পড়েছিল আমাদের কঙ্কালসার বাপি। ঘাড়ে কঙ্কাল পড়ার জন্যে নাকি কে জানে, ষাঁড়টা ধড়মড় করে উঠে আচমকা ছুটতে শুরু করে দিল ভরা রাস্তা লোকজনের মাঝখান দিয়ে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি কান্ড।
পরে ভাঙাচোরা বাপিকে আমরা উদ্ধার করেছিলাম, হার্ডিঞ্জ হষ্টেলের উল্টোদিকে মেডিকেলের ফুটপাথ থেকে। যেখানে জনগণ হিসি করে ভাসিয়ে রাখত।
নবমীতে বাড়ি থেকে বের হবার মতো অবস্থায় ছিল না বাপি। সকালে একবার ওর বাড়ি গেছিলাম খবর নিতে। বদখৎ গন্ধ ওর বিছানায়। পচা হিসি, হিংযের কচুরি, ষাঁড়। বসার ঘরে শুনলাম ওর বাবা, বাপির কানে খাটো ঠাকুমাকে বলছেন – “তোমার হীরের আংটি নাতি, কালকে কোন চুলোয় ছিল জান...? মুতের গাদায়...”।
বাপি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে বলল “কালকের মেয়েটা টপ ছিল, জানিস তো। কিন্তু কি রুচি মাইরি। ওই লোচ্চাটার সঙ্গে...। ছ্যাঃ। রূপসী মেয়েগুলো না, মাথামোটা হয়। তা না হলে...”। আবার দীর্ঘশ্বাস।
মোদের পাড়ার কুকুরগুলো
“তোদের পোষা বেড়ালগুলো, শুনছি নাকি বেজায় হুলো?...
ক্যান রে ব্যাটা, ইস্টুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট!”।
সুকুমার রায়ের এই লাইনের পরে, বেড়ালের ওপর কোন আদিখ্যেতা দেখানোর সাহস কোনদিন করিনি। কারণ “ইস্টুপিড” হিসেবে আমার যথেষ্ট নাম ডাক আছে – নাহক বেড়াল পুষে সেটাকে বাড়াবার কোন মানে হয় না।
তার
চেয়ে কুকুর ভাল। এদের পুষতে হয় না। নিজেরাই পোষ মেনে নেয়। রাস্তায় ঘাটে চায়ের
দোকানে বিশেষ লাই না দিলে মাথায় কেন – ঘরে ঢোকার আগেও বিশবার ভাবে। না, আমি কোন
ডালমেসিয়ান, ল্যাব্রাডার, স্পিৎসের মতো খানদানি ঘরানার নীল রক্ত কুকুরের ভক্ত নই।
যারা সোফা ছাড়া বসে না। কমোড ছাড়া পটি বা হিসি করে না। অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে
সিংহের কান্ডকারখানা দেখে, যারা মজা পেয়ে একবার দুবার মৃদু ভৌ বলে।
ঘরে
না ঢুকলেও আমাদের একদম ঘরের ছেলে – দিশি কুকুর। কেউ বলে রোডেসিয়ান, কেউ বলে নেড়ি।
উত্তর কলকাতায় আবার কাউকে কাউকে ফেতি কুকুর বলতেও শুনেছি। “ফেতি কুকুরের মতো তোর
দরজায় পনেরদিন ঘুরছি দশটা টাকার জন্যে” – এমন কথা কোন এক উত্তমর্ণ বলেছিল তার
অধমর্ণকে। যে সময়ে কথাটা কানে এসেছিল সে সময় দশটাকায় নিউ এম্পায়ারে দুটো ৬৫ পয়সার
টিকিট উইথ দুটো অনাদির মোগলাই পরোটা আর চা খেয়ে দুটো চারমিনার হয়েও পাচঁ দশ পয়সা
বেঁচে যেত।
কেলোর
সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় শান্তিদার চায়ের দোকানে। একটু সাদা আর বেশীর ভাগটাই কালো
বলে ওর নাম ছিল কেলো। কেউ লেড়ো বিস্কুট হাতে তুললেই কেলোর অমোঘ দৃষ্টি চলে যেত
বিস্কুটের ওপর। এতো ফোকাসড ম্যানেজার আর কাউকে আমি কোনদিন দেখিনি। দ্রুত গোল সেটিং
এবং তৎক্ষণাৎ মার্কেটিংযে কনসেনট্রেট – অবিশ্বাস্য! আরও একটা ব্যাপারে ওর ঈর্ষণীয়
আই কিউ ছিল – সম্ভাব্য কাস্টমার সিলেকসনে। আমরা লেড়ো নিলে কেলো যতটা মোটিভেটেড হত
তার চেয়ে অনেক কম হত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের – রিকশাওলা, ঠেলাওলার হাতে লেড়ো
দেখলে।
মার্কেটিংযের
সম্ভাব্য সকলরকমের প্রসিডিওরে কেলো ছিল সিদ্ধথাবা। প্রথমে ঘন ঘন লাঙ্গুল সঞ্চালন ও
মাঝে মাঝে মিহি স্বরে কুঁই কুঁই। তাতে চিঁড়ে না ভিজলে ফ্রি অফার আর ডিস্কাউন্ট
হিসেবে স্যান্ডাল পড়া পায়ের গোড়ালিতে বা বুড়ো আঙুলে হাল্কা জিভের সুড়সুড়ি। সেটাতেই
আমরা যারা একটু ইস্টুপিট প্রকৃতির – অর্ধভুক্ত বা সিকিভুক্ত লেড়োটি সমর্পণ করে
দিতাম। যারা ওই সামান্য ফ্রি গিফট বা ডিস্কাউন্টে বধ না হতো, তাদের পায়ে কেলো থাবা
দিয়ে থাপ্পি মারত আর ছোট্ট করে “ভুখ, ভুখ” নারা লাগাত। শেষমেশ “ধ্যাত্তেরি, শালার
কুত্তা...” বলে তারাও লেড়োর অবশিষ্টাংশটি ফেলে উঠে চলে যেত অন্যদিকে। সফল কেলো
লেড়োর সদ্ব্যবহার করত – হাড়গোড় ভাঙার সাউন্ড এফেক্ট কড়মড় শব্দে।
কেলো
বাংলা বা ইংরিজি কোন মিডিয়ামেই লেখাপড়া করেনি – এমনকি ব্যাটাকে নিরক্ষর বললেও কম
বলা হয়। চারটে শব্দ ভৌ, ভুখ, কেঁউ, কুঁই - ছাড়া কেলোর অভিধানে আর কিছু ছিল বলে মনে
হয় না। সেলসম্যানদের সকাল সন্ধ্যের ফিল্ড মিটিং নাকি এই ধরনের চায়ের দোকানের
কাছাকাছিই হয়। সেই শুনেই মনে হয় কেলোর এই ধরনের কীর্তি কলাপ।
আমরা
যারা ভাঙা টেম্পোয় পাছা ঝুলিয়ে কাল কাটাতাম, তারা শান্তিদার দোকান থেকেই চায়ের
সাপ্লাই পেতাম। আর যুধিষ্ঠিরের সাথী ধর্মরাজ কুকুরের মতো বাচ্চুর সঙ্গে চলে আসত
কেলো। বাচ্চু ছিল শান্তিদার হাত নুড়কুত। চা দিয়ে আসা, খালি কাপ ফিরিয়ে আনা, কাপ
প্লেট গেলাস ধোয়া – এইসব ছিল তার কাজ। আজকে জলের দূষণ আর সংরক্ষণ নিয়ে চারদিকে
সেমিনার, ওয়ার্কশপ আর ওয়েবসাইটের হিড়িক। জলের সংরক্ষণ কাকে বলে সেটা শিখিয়ে দিতে
পারত বাচ্চু। এক মগ জলে আটত্রিশটা কাপ, ছাব্বিশটা প্লেট আর বিয়াল্লিশটা গেলাস
অবলীলাক্রমে ধুয়ে ফেলতে পারত বাচ্চু।
সেই
কেলোর ওপর অত্যাচারও কিছু কম করিনি আমরা। আমাদের সেই বন্ধু বাপি – যার স্বভাব যায়
না মলে – সে ব্যাটা কালীপুজোর এক রাত্রে কেলোর ন্যাজে – উত্তর কলকাতার নোকগুনো
লেজকে ন্যাজই বলত সে সময় – ফুলঝুরি বেঁধে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কেলো মিনিট কয়েকের
জন্যে দিশেহারা ছুটে বেড়িয়েছিল বঙ্কিম চাটুজ্জ্যে স্ট্রীটের জমজমাট ভিড়ের মধ্যে।
সেই করুণ দৃশ্য আজও চোখে লেগে আছে। ওই তল্লাটে আমাদের বেশ কদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে
হয়েছিল। আর বাপির হাড় ঠকঠকে পশ্চাতে নাতি মেরেও মনের শান্তি পাইনি আমরা। কারণ
আমাদের সক্কলকেই বেশ কদিন আয়োডেক্স মলতে হয়েছিল আর ভাইফোঁটার পর স্কুল যেতে হয়েছিল
নেংচে নেংচে।
এই
ঘটনায় ভাগ্য ভাল যে কোন অঘটন ঘটেনি বা কেলোরও কোন শারীরক ক্ষতি হয় নি। কিন্তু
আমাদের ওপর বিশ্বাসে ভাঙন ধরেছিল কেলোর। তারপরে কোনদিনই আর স্বাভাবিক হতে পারেনি
কেলো। আমাদের দেওয়া লেড়ো নিত – কিন্তু খেত একটু দূরে দাঁড়িয়ে।
কেলো
আজ নিশ্চই আর নেই এই দুনিয়াতে। কুকুরের আয়ু দশ বারো বছরের বেশী হয় না শুনেছি।
কেলোর আত্মার কাছে আমি অন্ততঃ ক্ষমাপ্রার্থী। বহুদিন আমরাও চলে এসেছি অন্য পাড়ায়
সেখানে কেলো নেই। কিন্তু আছে ব্ল্যাকি, ব্রাউনি, শাইনি্রা...আমার কন্যার দেওয়া
নাম। তারা সামান্য কিছু উচ্ছিষ্ট খাবারের পরিবর্তে নির্জন দুপুরে বা নিদ্রিত
মধ্যরাত্রে পাড়া পাহারা দেয় নিয়মিত। এসকর্ট করে একলা বাচ্চাদের। দমদমে সকাল ছটা দশের
উড়ান ধরতে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় রাত প্রায় চারটের সময়। বড়ো রাস্তায় ট্যাক্সি না
মেলা পর্যন্ত তারা গলির মুখটাতেই বসে থাকে। ট্যাক্সিতে উঠে বসলে ব্রাউনি বিলম্বিত
আওয়াজ দেয় – ভৌউউউউ। তারপর তারা পাড়ায় ফিরে যায় একসাথে।
-০০-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন