[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে পড়া যায়, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাভক্ত ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগর ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। ভাগবৎ-পুরাণে মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়গুলিতে), তার বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ করাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য।]
এই উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্র থেকে - "এক যে ছিলেন রাজা - ৩য় পর্ব"
৯
আশ্রমের
সরোবরে হাতপামুখ ধুয়ে এসে আচার্যরা সকলেই ভোজন ঘরে এসে আসন গ্রহণ করলেন। তালপাতায়
বোনা আসনগুলি আসে পূর্বের রাজ্য বঙ্গ কিংবা কলিঙ্গ থেকে। চরকায় কাটা মোটা সুতোয় বোনা আসনগুলি আরামদায়ক ও
দৃষ্টি নন্দন হয় ঠিকই, কিন্তু আশ্রমে বহুল ব্যবহারের পক্ষে অসুবিধেজনক। সে তুলনায় তালপাতায় বোনা আসন ভাঁজ
হয়ে যায় না, সহজেই পরিষ্কার করা যায়, আশ্রমের পক্ষে সুবিধাজনক।
আসনে উপবেশনের পর আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “গুরুদেব কি
করতে চাইছেন, বলতো? যজ্ঞশীল তোমার কী মনে হচ্ছে?”
“গুরুদেব, এখনো তেমন কিছুই তো বলেননি, সবে মাত্র ভূমিকা করলেন”।
আচার্য যজ্ঞশীল বললেন।
তার উত্তরে আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “তা ঠিক, কিন্তু
রাজ্যের কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের রাজা ও রাণি? কোন্ শ্রেষ্ঠীপুত্র,
কিংবা কোন্ গ্রামের কোন্ সম্পন্ন কৃষক-পুত্র, অথবা তন্তুকার-পুত্র? গুরুদেবের এই
প্রস্তাবটা আমার ঠিক মনঃপূত হল না। রাজা হওয়া কি চাট্টিখানি কথা হে?”
এই সময় ভোজন ঘরে ঢুকল ধরণী, আর সঙ্গে বড়ো বড়ো মাটির
পাত্র নিয়ে তার দুই সহকারী শালকু আর হানো।
ধরণী
ঢুকেই সকলকে নীচু হয়ে নমস্কার করল, বলল, “একটু দেরি হয়ে গেল, আর্যগণ। আপনাদের
নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়ে গেছে! শালকু, আর হানো, ওগুলো একধারে রাখ। তারপর তোরা যা, বাকি
পাত্রগুলো সব নিয়ে আয়, আমি এদিকটা ততক্ষণ সামলাচ্ছি”।
ধরণী দ্রুত হাতে সকল আচার্যের সামনে সবুজ শালপাতার থালা
বিছিয়ে দিল, প্রত্যেকের জন্যে মাটির জলপাত্র। আচার্য বেদব্রত আসন ছেড়ে উঠে, লবণ,
লেবুর টুকরো আর কাঁচা লংকা রাখা কাঠের থালাটি বামহাতে তুলে নিলেন। দক্ষহাতে সকলের
পাতে পরিবেশন শুরু করলেন লবণ, লংকা ও লেবু।
ধরণী হই হই করে উঠল, “করেন কী, করেন কী, আচার্য বেদব্রত!
আপনি বসুন দয়া করে, আমি দিচ্ছি তো”!
“আঃ ধরণী, আর বিলম্ব করো না, ভাই। কী খাওয়াবে আজ, অন্ন
না পুরোডাশ? পরিবেশন শুরু করো”।
“আজ্ঞে, আজ দুপুরে সকলের জন্যে অন্ন হয়েছে, রাত্রে হবে
পুরোডাশ”।
“অতি উত্তম, পরিবেশন শুরু করো। ক্ষুধায় উদরে অগ্নি জ্বলে
উঠেছে ভাই”।
ধরণী কাঠের পাত্রে অন্ন এনে সকলের পাতে, কাঠের হাতায় অন্ন পরিবেশন শুরু করল। লেবু-লবণ-লংকা দেবার পর আচার্য বেদব্রত অন্য কাঠের পাত্র থেকে সব্জি দেওয়া শুরু করলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কিসের ব্যঞ্জন হে, ধরণিভাই? এর গন্ধেই ভয়ংকার ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছে”।
“আজ্ঞে ওটা পাঁচমিশেলি ব্যঞ্জন। বেগুন আছে, দুরকমের কন্দ আছে, আর
আছে অলাবু”।
“আহা, আশ্রমের এই ভোজন কতদিন পরে খাচ্ছি বলো তো, ধরণীভাই”।
“আজ্ঞে, তা হবে মাস ছয়েক। আপনি তো সেই সমাবর্তনের সময়
শেষ এসেছিলেন”?
“আরে দূর দূর, সে তো সমাবর্তনের সমবেত ভোজ। বাইরের
অস্থায়ী সূপকারের রান্নাতে কি আর আশ্রমের রান্নার স্বাদ আসে”?
সকলের পাতে অন্ন ও সব্জি পরিবেশন হয়ে যেতে, ধরণী বলল, “আর
লজ্জা দেবেন না, আচার্য, এবার আপনি আসন গ্রহণ করুন। আমি ডাল দিয়ে দিই, খাওয়া শুরু
করুন”।
আচার্য বেদব্রত ধরণীর পিঠে হালকা চাপড় মেরে হাসতে হাসতে
বললেন, “হ্যাঁ। এইবার বসে যাই। ক্ষুধার সময় অন্ন সাজিয়ে বসে থাকা কোন কাজের কথা
নয়। আর ওই যে, তোমার দুই সহকারীও চলে এসেছে। ওরা আবার অত কী নিয়ে এল, ধরণি”?
আচার্য বেদব্রত আসনে বসতে বসতে বললেন।
“আশ্রমের স্বল্প আয়োজনে আর কি হতে পারে, আচার্য? ছানার
তরকারি আছে, আর শেষপাতে দই”।
গণ্ডূষে অন্ন ও জল দান করে সকলে আহার শুরু করলেন, আচার্য
সুনীতিকুমার বললেন, “এই তোমার স্বল্প আয়োজন, ধরণি? এ তো প্রায় রাজসূয় যজ্ঞ, হে।
প্রবল প্রতাপশালী রাজাদের রাজসূয় যজ্ঞতেও এর থেকে বেশি আর কী আহার করায়? কি বল,
যজ্ঞশীল?”
উত্তরে আচার্য যজ্ঞশীল বললেন, “যা বলেছেন, এর সঙ্গে খুব
জোর দু একটা মিষ্টান্ন থাকে। আবার কী? আরেকটু ডাল দাও তো ধরণি”।
ধরণীর আন্তরিক পরিবেশনে সকলেই খুব আনন্দে ভোজন সমাধা
করলেন। তারপর ভোজনগৃহের বাইরে, মাটির কলসি থেকে শালকু তাঁদের হাতে জল ঢেলে দিল হাত
ধোয়ার জন্যে। হাত ধুয়ে এসে ধরণীর থেকে এক খণ্ড করে সাদা বস্ত্র পেলেন হাত মোছার
জন্যে। তৃপ্ত আচার্যগণের হাতে ধরণী তুলে দিল লবণে জারিত আমলকির টুকরো, এক একটি
টুকরো মুখে ফেলে, আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “বড়ো ভাল খেলাম, হে ধরণি। বড় তৃপ্ত হলাম তোমার যত্নে”।
ধরণী বিনীতভাবে বলল, “এই সবই আপনাদের আশীর্বাদ আর
শিক্ষা। আপনাদের সেবা করতে পেরে আমিও কৃতার্থ হলাম, আচার্য। রাত্রে সকলের জন্যে
পুরোডাশের আয়োজন হলে আপত্তি নেই তো, আচার্য; সঙ্গে থাকবে করেলাভজ্জি আর অজমাংস?”
“আমার আপত্তি নেই। বাকি সকলের...”। আচার্য সুনীতিকুমার
সকলের মুখের দিকে তাকালেন, সকলেই সানন্দে সম্মতি দিলেন ধরণীর এই প্রস্তাবে। “তোমার
প্রস্তাবনায় আমরা সকলেই সম্মত, ধরণি। কিন্তু,
তোমার তো এখনও দ্বিপ্রহরের ভোজনই হল না, যাও, যাও বিলম্ব করো না, ভোজন করে নাও।
তারপর রাত্রের আহারের চিন্তা করবে”।
“এই বার যাবো, আচার্য, আপনাদের বিশ্রামের কক্ষগুলি দেখিয়ে
দিই, তারপর আমরা আহারে বসব। ওদিকে বিশ্বপ্রভ গুরুদেব ও অতিথি শ্রেষ্ঠীদের আপ্যায়ন
করছে। বিশ্বপ্রভর সঙ্গেই আহার করবো আমি। আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আসুন আপনাদের
বিশ্রামকক্ষে নিয়ে যাই”।
ভোজন গৃহ থেকে বের হয়ে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ পেরিয়ে তাঁরা
প্রবেশ করলেন, একটি মনোরম উদ্যানে। ফুল ও ফলের গাছে জায়গাটি নিবিড় ও শীতল। এই
উদ্যানে পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গৃহ রয়েছে, এগুলি আশ্রমের অতিথি নিবাস। এই নিবাসে
তাঁরা এর আগেও বহুবার থেকেছেন। নির্দিষ্ট গৃহের দ্বার উন্মুক্ত করে ধরণী আচার্যদের
বিশ্রামের ব্যবস্থা দেখিয়ে দিল। পাশাপাশি তিনটি কক্ষ, প্রত্যেক ঘরে তিনটি করে
শয্যা। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি কাঠের চৌকিতে হালকা তুলোর গদি। টান টান সাদা চাদর
বিছানো, একটি করে উপাধান প্রত্যেক শয্যায়।
বিশ্রামের ব্যবস্থায়, আচার্যদের সকলেই স্বস্তি ও আনন্দ
অনুভব করলেন। আচার্য রণধীর বললেন, “অতি উত্তম ব্যবস্থা, ধরণী। এই বার তুমি যাও, ওদিকটা সামলাও।
আমরা আরামের ব্যবস্থাটুকু সব বুঝে নেব”।
ধরণী বিনীত হেসে উত্তর দিল, “সব শয্যার পাশেই একটি করে
পেটিকা আছে। পেটিকাতে
পরিষ্কার ধুতি, চাদর, উড়নি রাখা আছে। আর
আছে মাটির কুঁজোয় ভরা পানীয় জল ও জল পানের পাত্র। এই গৃহের দ্বারের বাইরে, একজন
সেবাদাস সর্বদা অপেক্ষারত থাকবে। এই গৃহের সেবাদাসের নাম বান্টু। কোন প্রযোজনে ডাক
দিলেই সে উপস্থিত হবে। আর কোনরকম অসুবিধা হলে আমাকে ডেকে পাঠাতে দ্বিধা করবেন না। আমাকে
এবার তাহলে যাবার অনুমতি দিন, আচার্য ?”
“তুমি যাও, ধরণী। তুমি
যতক্ষণ এখানে থাকবে আমাদের বিশ্রামের বিলম্ব হবে, আর বিলম্ব হবে তোমার আহারের।
তোমার আতিথেয়তা দেখে এটুকু বলতে পারি, তোমার ঘরণী যিনি হবেন, তিনি খুব সুখী হবেন,
ধরণী! তাঁর অর্ধেক কাজ তুমিই নিপুণ সমাধা করে দেবে।” হাসতে হাসতে বললেন আচার্য
বেদব্রত। আচার্য বেদব্রতর প্রশংসায় আপ্লুত ধরণী, নীচু হয়ে সকলকে নমস্কার করে
বেরিয়ে গেল, ভেজিয়ে দিয়ে গেল কক্ষের দ্বার।
বয়স অনুপাতে সুবিধামতো তিনটি কক্ষের শয্যা অধিকার করলেন
আচার্যরা। আচার্য বেদব্রত ও আচার্য ধর্মধর রইলেন, একই কক্ষে। শয্যায় দেহ ফেলে দিয়ে
বেদব্রত গবাক্ষপথে বাইরে তাকালেন। গাছের নিবিড় পাতায় স্নিগ্ধ শ্যামল পরিবেশ। পাতার
আড়ালে থাকা একটি ঘুঘু কোথাও ডেকে চলেছে একটানা। পাখির ওই ডাক আরো নিশ্চিন্ত
নিরিবিলি করে তুলেছে পরিবেশ। কক্ষের মধ্যে হালকা ধুপের গন্ধটিও বড়ো মনোরম। শয্যায়
শুয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, আচার্য ধর্মধর কুঁজো থেকে পানীয় পাত্রে জল ঢেলে জল পান
করছেন।
আচার্য ধর্মধর এক পাত্র জল পানের পর বড়ো তৃপ্তির আওয়াজ
করলেন, “আআআঃ”। তারপর বললেন, “পানীয় জলের মধ্যে কিঞ্চিৎ কর্পূর, জলের স্বাদটাকেই
পাল্টে দেয়, তাই না, বেদব্রত? গুরুদেবের অদ্ভূত নিয়ন্ত্রণ, একথা স্বীকার না করে
উপায় নেই। আহার, আবাস, আপ্যায়ন কোন কিছুতেই এতটুকু ত্রুটি তোমার চোখে পড়বে না”।
“হুঁ”। আচার্য বেদব্রত সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন।
আচার্য ধর্মধর আবার বললেন, “অত্যন্ত ক্ষুধার উদ্রেক হলে,
ভোজনটা একটু বেশিই হয়ে যায়। তার ওপর আবার এমন সুস্বাদু আহার পেলে তো আর কথাই নেই।
আমার তো নিদ্রায় চোখ ভারি হয়ে আসছে, বেদব্রত। একটু না ঘুমোলেই নয়, কি বলো?”
“হুঁ”।
“কি তখন থেকে শুধু হুঁ হুঁ করে চলেছ? কথা বলবে না, নাকি আরামে
কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছ? হা হা হা হা। বুঝেছি, তুমিও আরামের নিদ্রায় ডুবতে
চলেছ?”
“হুঁ”। আচার্য বেদব্রত একইভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে
উত্তর দিলেন। তাঁর এই উত্তরে আচার্য ধর্মধর একটু বিরক্ত হলেন। তিনি আর কোন কথা না
বলে, শয্যায় শুয়ে পড়লেন, তারপর অচিরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। বাইরের ঘুঘুর ডাকের সঙ্গে
মিশে গেল তাঁর হালকা নাসিকা ধ্বনি। আচার্য বেদব্রত একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে দেখলেন।
তাঁর ঠোঁটে হাল্কা হাসির রেশ। তাঁর
ক্লান্তি আছে, কিন্তু তাঁর ঘুম আসছে না। তিনি মাথার তলায় দুহাত রেখে তাকিয়ে রইলেন
ছাদের দিকে। কাঠের কাঠামোর উপর ঘন খড়ের চাল। তাঁর নজরে এলো একটি কাঠের বাটামে ঘুণ
ধরেছে। সেই বাটামের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট ছিদ্র। আর সেই ছিদ্র পথে বেরিয়ে আসছে মিহিন
কাঠের গুঁড়ো। এখন নানান আওয়াজে কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নিঃশব্দ রাত্রে নিশ্চয়ই
শোনা যাবে, ঘুণপোকার কাঠ কাটার আওয়াজ। চোখে দেখতে না পাওয়া এই কীটের অদ্ভূত
ক্ষমতায় বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এখনই ব্যবস্থা না নিলে, ওই কীটের দৌরাত্ম্যে
ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে এই কাঠামো। শাল কাঠের এই মজবুত কাঠামোও হঠাৎ একদিন
হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তেই পারে!
গুরুদেব ভৃগুর দক্ষ পরিচালনায় গড়ে ওঠা এই আশ্রমের মজবুত
পরিকাঠামোতেও এখন কীটের আক্রমণ। সেই কীট প্রবল পরাক্রান্ত। রাজা অঙ্গের বদান্যতায় দুইশত
গ্রামের রাজস্ব থেকে এই আশ্রমের সমস্ত ব্যয় সংকুলান হয়। কিন্তু রাজা বেণের যদি সনাতন শিক্ষায়
আস্থা না থাকে? তাঁর মনে হতেই পারে, এই আশ্রমে মানুষকে শিক্ষিত করে রাজ্যের কী
লাভ? দুরাচারী রাজার কাছে শিক্ষিত মানুষের
থেকে, সাধারণ জনসমাজ অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত। তিনি চাইবেন না, তাঁর বদান্যতায় রাজ্যে এমন
একটি শিক্ষিত শ্রেণী তৈরি হোক, যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পায়। তিনি অচিরেই
এই আশ্রমকে দান করা গ্রামগুলির রাজস্ব, নিজের হাতে আবার ফিরিয়ে নিতেই পারেন।
সেক্ষেত্রে এই আশ্রমের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠবে। এই সুন্দর সুনিয়ন্ত্রিত আশ্রমের
ব্যবস্থাপনায় ধ্বস নামতে পারে যে কোনদিন। আর
সেই কারণেই গুরুদেব ভৃগু এত উদ্বিগ্ন। নিজের হাতে গড়া এমন প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে
রাখার জন্যও রাজার সঙ্গে তাঁর লড়াই। এ লড়াই জিততেই হবে। এই লড়াই সনাতন বিশ্বাসের
লড়াই। এ লড়াই সনাতন শিক্ষার লড়াই। এই লড়াই পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সনাতন শিক্ষা
তুলে দেবার লড়াই। গুরুদেব ভৃগুর উপর পূর্ণ আস্থা আছে আচার্য বেদব্রতর। গুরুদেব, আজ
সন্ধ্যে এবং হয়তো সারারাত্রিব্যাপী যে গোপন পরামর্শ সভার আয়োজন করেছেন, সেই
আলোচনাতেই হয়তো ফুটে উঠবে আসন্ন এই লড়াইয়ের রূপরেখা। গুরুদেব কিভাবে এবং ঠিক কী
করতে চলেছেন, সেটা এখনো আদৌ স্পষ্ট নয়। আচার্য বেদব্রত এই বিষয়ে ভাবতে ভাবতেই
একসময় চোখ বন্ধ করলেন এবং ঘুমিয়েও পড়লেন এক সময়।
১০
বিশ্রামের পর অতিথি আবাস থেকে পাঁচ আচার্য যখন বের হলেন,
সন্ধ্যে হতে আর বেশি দেরি নেই। আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “গুরু আহারের পর
দিবানিদ্রা শরীরকে শ্লথ আর ভারি করে তোলে। বৈকালিক স্নিগ্ধ পরিবেশে কিছুক্ষণ পায়চারি করলে, কিছুটা হাল্কা অনুভব হবে, গুরুদেবের কক্ষে
যাবার আগে, চলো একটু পায়চারি করে আসি”।
সকলেই সহমত হলেন, এবং বিকালের ম্লান আলোয়, নীড়ে ফেরা পাখিদের
কলকাকলি পূর্ণ, মনোরম পরিবেশে অলস পদচারণা উপভোগ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ
পদচারণার পর আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “রণধীর, গুরুদেবের ওই কথাটা কিন্তু আমার
ঠিক মনঃপূত হলো না”।
“কোন কথাটা, সুনীতি?” আচার্য রণধীর জিজ্ঞাসা করলেন।
তিনি ও আচার্য সুনীতি কুমার প্রায় সমবয়সী, সখাস্থানীয়। আচার্য যজ্ঞশীল তাঁদের তুলনায় অনেকটাই ছোট, আর আচার্য বেদব্রত ও ধর্মধর তো পরবর্তী প্রজন্মের। সকলেই এই আশ্রমের প্রাক্তনী হলেও বয়সের কারণে সহজাত এক দূরত্ব থেকেই যায়। আচার্য সুনীতি কুমার ও আচার্য রণধীর একটু এগিয়ে হাঁটছিলেন, অন্য তিনজন ছিলেন একটু পিছনে। আচার্য পিছন ফিরে তাকিয়ে দুরত্বটা অনুমান করে, চাপা স্বরে বললেন, “আঃহা, রণধীর, গুরুদেব ওই যে কথাটা বললেন না, রাজ্যের সর্বত্র খুঁজে এক রাজার সন্ধান করতে হবে, এক সর্বগুণসম্পন্ন তরুণ। এই কথাটা আমার কিছুতেই মনে ধরছে না, ভাই। উটকো একটা অনভিজ্ঞ লোককে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেই সে একদম গড়গড়িয়ে রাজ্য শাসন করতে লেগে যাবে, এ কী সম্ভব?”
“আদৌ সম্ভব নয়, কিন্তু এছাড়া অন্য উপায়ই বা কী? আমরা
সকলেই রাজার বদল চাইছি। কিন্তু কে হবে, নতুন রাজা? তুমি হবে, সুনীতি? এ রাজ্যে
তোমার চেয়ে অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনীতির আচার্য কেউ নেই। আমার মনে হয় তোমার মতো যোগ্য লোক
কেউ হতেই পারে না”।
“তুমি কি পাগল হয়েছ, রণধীর? আমি হবো রাজা? আমার ঊর্ধ্বতন
চৌদ্দ পুরুষে কেউ রাজা ছিলেন না। দয়া করে তুমি আবার গুরুদেবের কানে একথা তুলে দিও
না যেন। বেশ আছি ভাই, অধ্যাপনা করি, স্ত্রীপুত্র কন্যা নিয়ে দিব্য সুখে আছি। সুখে
থাকতে প্রেতের মুষ্ট্যাঘাত ভক্ষণের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।”
“ভয় নেই, সুনীতি, নিশ্চিন্ত থাকো। রাজাসনে তোমাকে বসাবার
প্রস্তাব আমি গুরুদেবের কাছে কখনোই বলব না। আর বললেও গুরুদেব সেই প্রস্তাব মেনে
নেবেন, এমন স্বপ্নেও ভেব না। গুরুদেব খুব ভালো করেই জানেন, আমরা – শিক্ষিতজনেরা
সমালোচনায় যতটা দক্ষ, প্রত্যক্ষ দায়িত্ব পালনে, ততটাই উদাসীন”। এই কথা বলে, আচার্য
রণধীর আচার্য সুনীতির মুখের দিকে তাকালেন, বুঝতে পারলেন না, তাঁর এই কথায় আচার্য
সুনীতি ক্ষুণ্ণ হলেন কিনা। দীর্ঘদিনের সঙ্গী প্রিয়সখাকে আঘাত করা তাঁর উদ্দেশ্য
ছিল না।
তিনি খুব আন্তরিক স্বরে আবার বললেন, “গুরুদেব ভৃগু
আমাদের সকলের গুরু, আমাদের থেকে অনেকবেশী বাস্তববোধসম্পন্ন ও দূরদর্শী। ধৈর্য ধরে
দেখাই যাক না, গুরুদেব কি পরিকল্পনা করেছেন। আলোচনা ও পর্যালোচনার জন্যেই তো তিনি
আমাদের সকলকে ডেকেছেন এবং সন্ধের পর থেকে সারারাত্রি সময়ও নিয়েছেন”।
কথা বলতে বলতে তাঁরা উপস্থিত হলেন, আশ্রমের মন্দিরের
সামনে। ছোট্ট কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন দেবালয়। সন্ধে নামার মুহূর্তে সেখানে আরতির
আয়োজন চলছে। মন্দিরের পুরোহিত আপনমনে দেবসেবায় নিযুক্ত ছিলেন। আচার্যদের পায়ের
শব্দ পেয়ে চমকে পিছন ফিরে তাকালেন, তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখেচোখে গভীর
আতঙ্ক। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা এই অসময়ে কোথা থেকে
আসছেন, মহাজন?”
আচার্য রণধীর বললেন, “আমরা সকলেই আচার্য, এই আশ্রমের
প্রাক্তনী। আজ আশ্রমের অতিথি নিবাসে আমরা রয়েছি। সন্ধ্যায় পদাচারণা করতে করতে
আপনার এই সুচারু মন্দিরে উপস্থিত হয়ে খুব ভালো লাগল, তাই আপনার পূজন দেখতে এলাম।
কিন্তু আমাদের দেখে আপনি এমন তটস্থ হয়ে উঠলেন কেন, পুরোহিতঠাকুর?”
পুরোহিতমশাই জোড়হাতে সকলকে নমস্কার করলেন, আচার্য
রণধীরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, উদ্বিগ্নস্বরে বললেন, “আপনারা এই আশ্রমে কোন কাজে
এসেছেন নিশ্চয়ই? পরমাচার্য মহর্ষি ভৃগু নিশ্চয়ই অবগত আছেন?”
“অবশ্যই অবগত আছেন। এবং আমাদের কাজও গুরুদেব মহর্ষি
ভৃগুর সঙ্গেই”?
পুরোহিতঠাকুরকে এবার অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে হল, তিনি
বললেন, “যাক, আপনারা মহারাজ বেণের পাঠানো কোন দূত নন। মহারাজ বেণের সেই ভয়ঙ্কর
ঘোষণার কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেইদিন থেকে এই মন্দিরের পূজনে শঙ্খ-ঘন্টা বাদন নিষেধ
করে দিয়েছেন মহর্ষি ভৃগু। অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে, গোপনে পূজন ও দেব সেবার
নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দেবতার পূজা তো কোন পাপাচার নয়, তাও গোপনে করতে হবে! কি
অদ্ভূত দুঃসময়ের মধ্যে আমরা প্রবেশ করছি, একমাত্র ঈশ্বরই জানেন! দেবসেবা করতে বসেও
সর্বদা শঙ্কিত থাকি। কবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি হবে, কে জানে!”
আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “অযথা শংকিত হবেন না,
পুরোহিতঠাকুর। মহর্ষি
ভৃগুর নির্দেশ মতোই দেবতার আরাধনা করুন, চিন্তা করবেন না। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে
আমরা সকলেই অবহিত, সকলেই চিন্তিত”।
দেবতার আরতি দেখার ইচ্ছে থাকলেও, পুরোহিতের উদ্বেগ ও
গোপনে পূজা নিবেদনের সংবাদ তাঁদের মনে অস্বস্তি এনে দিল। এতদিন মানুষ দেবপূজা করে
এসেছে, মনের শান্তির জন্যে। এখন তারা দেবতার পূজা করতে গিয়ে কী অশান্তি ডেকে আনছে?
ডেকে আনছে অনভিপ্রেত বিপদ? আচার্যরা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দুই দেবতাকেই প্রণাম করে,
ফেরার পথ ধরলেন। ফেরার
সময় কেউ কোন কথা বললেন না। সকলেই নিজেদের মতো করে গভীর চিন্তায় মগ্ন। চারিদিকে
সন্ধ্যে নেমে আসছে। বড়ো বড়ো গাছের পাতা থেকে অন্ধকার যেন ঝরে পড়ছে। জমাট বেঁধে ওঠা সেই অন্ধকারের
দিকে তাকিয়ে আচার্যরা আনমনে হাঁটতে লাগলেন।
বিশ্বপ্রভ দ্রুতবেগে হেঁটে আসছিল, তাঁদের দেখে কাছাকাছি
এসে বলল, “হে আচার্যগণ, মহর্ষি আপনাদের জন্যে নিজ কক্ষে অপেক্ষা করছেন। আমাকে
পাঠালেন আপনাদের সংবাদ দিতে”। বিশ্বপ্রভর এই কথায় সকলেই চলার গতি বাড়ালেন।
বিশ্বপ্রভ ওঁদের সঙ্গী হয়ে একসঙ্গে হাঁটতে লাগল।
আচার্য বেদব্রত বিশ্বপ্রভর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমাদের আশ্রমের মন্দিরটা দেখতে গিয়েছিলাম, বিশ্ব। দেবতাকে প্রণাম করে এলাম। তাই বিলম্ব হল”।
বিশ্বপ্রভ ম্লান হেসে বলল, “আজকাল গুরুদেব মন্দিরের পূজায় ঘন্টা – শঙ্খ বাদন নিষেধ করে দিয়েছেন। পূজণ হয় নিঃশব্দে। আমরা আশ্রমবাসীরা নানান কাজে ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যায় ঘণ্টা বা শঙ্খের আওয়াজ পেলে, মনটা পূজার দিকে চলে যেত। মন্দিরে উপস্থিত না থাকতে পারলেও দেবতাকে প্রণাম নিবেদনে ভুল হতো না। আজকাল প্রায়ই ভুল হয়ে যায়, শৃগালের ডাকে মনে পড়ে রাত্রি প্রথম প্রহর। তখন মনে পড়ে আজ সন্ধ্যায় দেবতাকে প্রণাম করা হয়নি। অসময়ে দেবতার স্মরণে কেমন যেন অস্বস্তি হয়, আচার্য”।
আচার্য বেদব্রত বললেন, “বিশ্ব, মানুষের জীবনে অনেক ধরনের দুঃখ
উপস্থিত হতে পারে। এই দুঃখের মধ্যে দিয়েই জীবনের উত্তরণ হয়। দেবতার সময়ের অন্ত নেই,
কিন্তু সীমা আছে মানুষের জীবনকালের। যখনই তোমার সময় হবে, দেবতাকে স্মরণ করো। দেবতা
কক্ষনো অসন্তুষ্ট হন না। এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়”।
উত্তরে
বিশ্বপ্রভ কিছু বলতে যাচ্ছিল, আচার্য বেদব্রত থামিয়ে দিলেন, বললেন, “চুপ, আর কথা নয়। আমরা গুরুদেবের কক্ষের সামনে
চলে এসেছি। উনি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন!”
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন