আমরা বলি সতুদা, কিন্তু তাঁর নাম সইত্যব্রত
চট্টরাজ, এমএসসি পাশ। শুনেছি তাঁর প্যাশান ছিল স্কুলের শিক্ষকতা। কিন্তু যে কোন
কারণেই হোক তাঁর শিক্ষকের চাকরির শিকে ছেঁড়েনি। অতএব তিনি চাকরি করেন না। ভাগ্যিস
করেন না, করলে আজ হয়তো তাঁকে দাগি অথবা নির্দাগি-শিক্ষক হয়ে, কলকাতার পথেঘাটে ধর্ণা
মঞ্চে বিরাজ করতে দেখা যেত - বছরের পর বছর। তবে একটা কথা মানতেই হবে – ছোটবেলা থেকে
আমরা দাগি চোরের কথা বিস্তর শুনেছি – কিন্ত দাগি শিক্ষক নৈব নৈব চ। এদিক থেকে দেখলে
আমাদের উন্নয়ন পথের ধারেই বসে আছে – নির্দাগি শিক্ষকরূপে! এ কি কম উন্নয়ন?
চাকরি না করলেও সইত্যদা নিজের
বাড়িতেই কোচিং ক্লাস খুলে ছেলে মেয়েদের ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর ম্যাথস পড়ান। তাঁর
ক্লাসঘরের বাইরে সকাল ছটা থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত সাইকেল আর খোলা চটির সংগ্রহ দেখলেই
তাঁর হাতযশের আঁচ পাওয়া যায়। পিতৃদত্ত নাম সত্যব্রত হলেও, তিনি ইদানীং নিজের পরিচয়
দেন এবং সই করেন সইত্যব্রতই নামেই। এর পিছনে গূঢ় রহস্য আছে। সেটা হল বিখ্যাত এক
নিউমেরোলজিস্ট সতুদাকে বলেছিল, “খাঁটি সত্য বলে তো আজকাল কিছু হয় না, ভেজাল মেশাতে
হয়”। তারপর সমাধান দিয়েছিলেন “SAITYA বা সইত্য নামটাই আপনাকে সুট করবে, আপনার জীবন
পাল্টে দেবে”।
সেই সতুদাই আমাদের পাড়ার
পুজোকমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আর আমাদের জন্যে প্রত্যেকবার চোখ ধাঁধানো চাঁদাও
একদম বাঁধা থাকে। কবছর আগে খবরের কাগজে পড়ে আইডিয়াটা সতুদার মাথায় এসেছিল এবং গতবার
সতুদা প্রস্তাব দিয়েছিল - এবার আমাদের পুজোর থিম হবে জ্যান্ত ঠাকুর। নো কাঠ-খড়-মাটির
বানানো পুতুল বিজনেস। টানা তিনদিন তর্কবিতর্কের পর ফাইন্যাল সিদ্ধান্ত হল।
ঠিক হল আমাদের গলির মোড়ে “মধুমাখা
মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের” মালিক বোঁদে কাকুর ভাইপো হবে গণেশ। কমবয়সী ছেলে – কাকুর
দোকানে বছর দুয়েক বসছে, এর মধ্যেই ঈর্ষা জাগানো সুন্দর একটা ভুঁড়ি বাগিয়ে নিয়েছে।
কাজেই গণেশ হিসেবে তার থেকে উপযুক্ত আর কেউ হতেই পারে না। এখানে বলে রাখি বোঁদে
কাকুর আসল নাম বৈদ্যনাথ – কিন্তু বোঁদে বানানোয় হাত পাকিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন বোঁদে
নামে।
বলিউডের স্বপ্নে বিভোর, দিনে
দুবার জিম করা নিমাইকে দেওয়া হল কার্তিকের ভূমিকা।
আমাদের পাড়ার উঠতি ছোকরাদের
চিরস্থায়ী দীর্ঘশ্বাসের উৎস কদমাদির বোন মিছরি হবে সরস্বতী। স্বপ্না কাকিমা হবেন,
মা দুর্গা। তিনি দেখতেও যেমন ভারিক্কি, তেমনি তাঁর মুখে চোখে বেশ একটা ইয়ে আছে – মানে
মা, মা ভাব। লতিকা বৌদি বিয়ে করে আমাদের পাড়ায় এসেছেন বছর খানেক হল – তাঁকে মা
লক্ষ্মীর ভূমিকায় সাব্যস্ত করা হল।
মহিষাসুরের জন্যে কমিটি প্রথমে
সাব্যস্ত করেছিল আমাদের পাড়ার তোলাবাজ ও মাস্তান ঠোঁটকাটা পটলদাকে। ঠোঁটকাটা অর্থে পটলদা কিন্তু মোটেই স্পষ্টবক্তা
নয়। আসলে তাঁর ঠোঁটের বাঁদিকে বেশ গভীর একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। শোনা যায় বেশ বড় একটা ছোরার
ধারালো ফলা ঠোঁটে চেপে পটলদা আগে খুব তোলাবাজি করত। ঠোঁটে ধরা ওই ছোরার ফলা দেখিয়েই
পটলদা ধরাকে সরা জ্ঞান করত। একদিন কোন এক নিরীহ চিকেন-ব্যাপারী – প্রতিহপ্তায়
হপ্তার টাকা গুনতে গুনতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে আচমকা এক ঘুঁষি চালিয়েছিল তোলাবাজ পটলদার
মুখে। ব্যস, পটলদার ঠোঁট কেটে প্রবল রক্তারক্তি – প্রায় দেড়মাস চিকিৎসার পর ঠোঁট
সেরে উঠলেও নামের সঙ্গে জুড়ে গেল ঘটনাটা।
ঠোঁটকাটা পটলদার বেশ হাট্টাকাট্টা
জবরদস্ত চেহারা – গায়ের রং, মাথার চুলও অনেকটা মহিষাসুরের মতোই। কিন্তু পটলদা
কিছুতেই রাজি হল না। বলল, “পাগল নাকি, আমি ভোলেভালা সাতেপাঁচে না থাকা
মানুষ...আমায় কখনো মইষাসুর মানায়?” শেষমেষ “বাঙালি খাসির” দোকানের হেল্পার সুকুলদা
রাজি হওয়াতে জ্যান্ত প্রতিমার ঝামেলাটা মিটল।
প্রথমে প্ল্যান হয়েছিল, বাহনরাও
সবাই জ্যান্ত হবে। কিন্তু জ্যান্ত ইঁদুর-পেঁচা-রাজহাঁস যোগাড় হলেও, ময়ূর-কাটামোষ-সিংহ
যোগাড় করার বাড়াবাড়িটা কোনভাবেই সামলানো গেল না। অতএব মাটির পুতুল দিয়েই বাহনের কাজ
সারতে হল।
পুজোর কটা দিন বেশ নির্বিঘ্নে আর
আনন্দেই সম্পন্ন হল। আজ বিসর্জন। আমাদের ভাসান দেওয়ার প্ল্যানটাও খুব কুল। মাদুগ্গা সপরিবার উইথ মহিষাসুর
যাবেন স্করপিওতে। তাঁরা গঙ্গাঘাটে স্নান সেরে, ঠাকুরের সাজসজ্জা ছেড়ে পুনর্মনিষ্যি
হবেন। আমরা মেটাডোরে গিয়ে গঙ্গাতে বিসর্জন দেব ঘট আর মাটির বাহনগুলো।
বিকেলে শুরু হল সিঁদুরখেলা, বিদায়বরণ। সমস্যাটা এল অন্যদিকে। প্রত্যেকবার
আমরা যারা গোবর মাথা, লরিতে তোলার আগে মাসরস্বতীর চরণে মাথা ঠুকতাম আর প্রসাদীফুল রাখতাম
পকেটে। এবারে মিছরি হয়েছে সরস্বতী। তার চরণতলে ফুলের পাহাড়! কিন্ত কে তাকে প্রণাম
করবে, তার চরণের ফুল কুড়োবে? যে করবে তার নামটা তো মিছরির বয়ফ্রেণ্ড লিস্ট থেকে
কাটা পড়বে! কিন্তু অন্যদিকে মা সরস্বতীর চরণ না ছুঁলে পরীক্ষা পাস করব কী করে? আমাদের
সকলের তখন একটাই চিন্তা - পরীক্ষা আগে না, প্রেস্টিজ আগে? পরীক্ষায় একবার ফেল করলেও
পরেরবার উৎরোনো যায়। কিন্তু প্রেস্টিজ কি সাইকেলের টায়ার, পাংচার হলেও, সারানো যাবে?
আজ মিছরিকে ব্যাপক দেখাচ্ছে। মনে
হচ্ছে পরি, শুধু ডানাদুটো নেই, ডানাজোড়া কেচে যেন ছাদের দড়িতে শুকোতে দিয়ে এসেছে! পায়ের
ওপর পা, হাতে বীণা, ঘ্যাম পোজ মেরেছে, চোখ ফেরানো দায় হয়ে উঠেছে। নিখিল আর বাচ্চু ভেজাগলায়
আমাকে বলল, ‘কিছু একটা কর, ভল্টু’।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম,
“ভাবিস না, উপায় বের করেছি। আমার ঘরের সরস্বতীমূর্তিটা, চুপচাপ নিয়ে আয়, তারপর আমি দেখছি’।
ওরা সরে যেতে আমি মিছরিকে গিয়ে
বললাম, ‘মিছিমিছি বসে সময় নষ্ট করছিস কেন, মিছরি? এই সময় গিয়ে “এই সময়”টা দেখে আয়।
আজকের এপিসোডটা শুরু হল বলে”। “এই সময়”
সিরিয়ালের হিরো সমীর মহাপাত্র, মিছরি সমীরের হেব্বি ফ্যান।
মিছরি চমকে উঠে বলল, ‘এম্মা, তাইতো,
ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু এসময় কেটে পড়লে কেলো হবে না’?
‘আধঘন্টার ব্যাপার, মিছরি। কোন চাপ নিস না, তুই আলতো করে
পাতলা হয়ে যা, আমি এদিকটা সামলাচ্ছি’।
বীণা রেখে প্যান্ডেলের পিছন দিয়ে মিছরি
সরে পড়ল। আর প্রায় তখনই বাচ্চুরাও পৌঁছে গেল আমার ঘরের সরস্বতীপ্রতিমা নিয়ে।
প্রতিমাটিকে বেদিতে বসিয়ে চটপট সেরে নিলাম প্রণামপর্ব, প্রসাদীফুল কুড়োনোর পর্ব। আমরা
দশবারোজন ছোকরা মা সরস্বতীর বেদিটাকে ঘিরে রেখে, ‘সরস্বতীমায়িকি, জয়’ রব তুলতে
লাগলাম। বরণ করতে এসেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে আমার মাও ছিলেন,
খুব খুশি হলেন আমাদের মতিগতি দেখে। মাদুগ্গা সাজা স্বপ্নাকাকিমা বলেই ফেললেন, ‘ছোঁড়াগুলো
দুগ্গাপুজোর সময়েও মাসরস্বতীর ভক্তিতে কি সুন্দর মেতে আছে। দ্যাখ দ্যাখ, পরীক্ষার
ভয় দেখিয়ে মিছরি কেমন ছোঁড়াগুলোর ঘাড় ধরে প্রণাম আদায় করছে”!
আমার চোখ ছিল ঘড়ির দিকে, আধঘন্টা
হতেই বাচ্চুরা চুপিচুপি মাসরস্বতীর প্রতিমা আবার আমার ঘরে রেখে এল। মিছরিও ফিরে এসে, বীণাহাতে বসে
পড়ল বেদিতে। আমার দিকে ডাগর চোখের কটাক্ষ হেনে মিছরি ফিসফিস করে বলল, “থ্যাংকু, ভল্টুদা।
আজ না গেলে বিচ্ছিরি মিস করতাম। আজ সমীরের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে হঠাৎ এসে
উপস্থিত হল সমীরের প্রথম পক্ষের বউ – তার কোলে একটা মেয়ে...”।
আমি হাসলাম, বললাম, “ভল্টু ছাড়াও আমার
নাম তিমির, জানিস তো? সমীরের থেকে চোখ ফিরিয়ে, তোর আঁখির টর্চ এদিকে ফেললে, মাইরি
বলছি, আমার তিমিরত্ব সবটুকু ঘুঁচে যেত রে, মিছরি”!
আঁখিপাখির ডানা ঝাপটে মিছরি উত্তর
দিল, “য্য্যাঃ। ভল্টুদা তুমি না একটা Zআআতা। এমন ফচকেমি করো না...”।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি বুকে হাত
রাখলাম, মা সরস্বতীর আশীর্বাদী ফুল রয়েছে আমাদের পকেটে।
-০০-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন