অষ্টম অধ্যায়ঃ
অক্ষরব্রহ্মযোগ
|
১ |
অর্জুন
বললেন- হে পুরুষোত্তম, ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি? কাকেই বা অধিভূত বলে আর
কাকেই বা অধিদৈব বলা হয়? |
||
|
২ |
হে
মধুসূদন, এই দেহে অধিযজ্ঞ কে এবং কোথায় তার অবস্থান? আত্মসংযমী ব্যক্তি কিভাবেই
বা মৃত্যুকালে তোমাকে জানতে পারে? |
||
|
৩ |
শ্রীভগবান
বললেন- অক্ষরকেই পরম ব্রহ্ম বলে। ব্রহ্মের স্বভাবকে অধ্যাত্ম বলে। সমস্ত
ভূতবস্তুর সৃজনকারী দেবতাদের উদ্দেশে বিসর্গের নাম কর্ম। [ওঁ হল
পরম অক্ষর ও আদি শব্দ, প্রণব। এই শব্দ থেকেই এই জগতের সৃষ্টি। বিসর্গ মানে বিসর্জন, দেবতাদের
উদ্দেশে দ্রব্য উৎসর্গ করা হয় যে যজ্ঞে, তাকেই বিসর্গ বলে।] |
||
|
৪ |
হে
নরশ্রেষ্ঠ অর্জুন, বিনাশশীল সমস্ত পদার্থই অধিভূত, পরমপুরুষ ব্রহ্ম অধিদেবতা, আর
আমিই এই দেহে অবস্থিত অধিযজ্ঞ। |
||
|
৫ |
এবং
মৃত্যুকালে আমাকেই স্মরণে রেখে, দেহ ত্যাগ ক’রে যিনি প্রয়াণ করেন, তিনি আমার
স্বরূপেই মিলিত হন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। |
||
|
৬ |
হে
কুন্তীপুত্র অর্জুন, যিনি সর্বদা যে দেবতার শরণাগত থাকেন, মৃত্যুকালেও সেই
দেবতার বিষয়ে চিন্তা করে দেহ ত্যাগ করলে, তিনি সেই দেবতারই স্বরূপ লাভ করেন। |
||
|
৭ |
অতএব,
আমাকে সর্বদা স্মরণে রেখে, তুমি যুদ্ধ করো। কোন দ্বিধা বা সংশয় না ক’রে, তোমার
মন এবং বুদ্ধি আমাকে সমর্পণ করলে, তুমি আমাকেই লাভ করবে। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই। |
||
|
৮ |
হে
পার্থ, অন্তরে সর্বদা ঈশ্বর চিন্তার অভ্যাসকে অন্তরঙ্গ সাধন বলে। অভ্যাস যোগে,
একাগ্র মনে সর্বদা ধ্যান করতে করতেই সেই দিব্য পরমপুরুষকে লাভ করা যায়। |
||
|
৯ |
যিনি
সর্বজ্ঞ, চিরায়ত বিশ্বকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, যিনি সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর,
যাঁর স্বরূপ চিন্তা করা যায় না, যিনি সূর্যের মতো স্বপ্রকাশ ও দীপ্তিমান, যিনি
সমস্ত অন্ধকারের অতীত এবং সর্ব জীবের কর্মফলদাতা। |
||
|
১০ |
মৃত্যুকালে
একান্ত ভক্তিতে, একাগ্র মনে, একনিষ্ঠ সাধনায়, নিজের প্রাণকে ভ্রূযুগলের মধ্যে
স্থির রেখে, তাঁর স্মরণে যিনি ধ্যানমগ্ন থাকেন, তিনিই সেই দিব্য পরম পুরুষকে লাভ
করেন। |
||
|
১১ |
বেদবিৎ
পণ্ডিতেরা যাঁকে অবিনাশী অক্ষর বলেন, বিষয়ের আসক্তিহীন সন্ন্যাসীরা যাঁর স্বরূপে
মিশে যান, যাঁকে উপলব্ধির জন্যে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়, সেই পরম ব্রহ্মপদ
লাভের উপায় আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলছি। |
||
|
১২ |
সমস্ত
ইন্দ্রিয়দ্বার সংযত করে, অস্থির চিত্তকে হৃদয়ের মধ্যে রুদ্ধ রেখে, ভ্রুযুগলের
মাঝখানে নিজের প্রাণকে স্থির রেখে, একনিষ্ঠ সাধনায়, |
||
|
১৩ |
এবং যিনি
মৃত্যুকালে দেহত্যাগের সময় ব্রহ্মস্বরূপ ‘ওঁ’ এই এক অক্ষর উচ্চারণ করতে করতে,
আমার চিন্তা করেন, তিনি পরম ব্রহ্মপদ লাভ করেন। |
||
|
১৪ |
হে
পার্থ, যিনি অন্য কোন চিন্তা না করে, সারা জীবন সব সময় আমাকেই স্মরণ করেন, আমার
চিন্তায় মগ্ন সেই সন্ন্যাসীর কাছে আমি সহজেই ধরা দিয়ে থাকি। |
||
|
১৫ |
আমাকে
লাভ করার পর, পরমজ্ঞানী সিদ্ধ পুরুষকে, দুঃখের আধার এই অনিশ্চিত সংসারে আর জন্ম
গ্রহণ করতে হয় না। |
||
|
১৬ |
হে
অর্জুন, ব্রহ্মলোক থেকে এই ভূলোক পর্যন্ত সর্বত্র বার বার জন্ম নিতে হয়, কিন্তু,
হে কৌন্তেয়, আমাকে লাভ করলে আর
পুনর্জন্ম হয় না। |
||
|
১৭ |
হাজার
যুগ ধরে ব্যাপ্ত ব্রহ্মার দিন এবং হাজার যুগ ব্যাপি তাঁর রাত, এই তত্ত্ব যিনি
জানেন, তিনিই দিনরাত্রির রহস্য উপলব্ধি করতে পারেন। |
||
|
১৮ |
ব্রহ্মার
দিন শুরু হলে অব্যক্ত থেকে এই জগতের সবকিছুই আকার পায় এবং রাত্রিতে তারাই আবার
নিরাকারে বিলীন হয়। |
||
|
১৯ |
হে
পার্থ, সেই পার্থিব বস্তুসকল বার বার সৃষ্টি হয়ে ব্রহ্মার রাত্রিতে বিলীন হয় এবং
তাঁর দিনের শুরুতে, নিজের কর্মের ফল
অনুসারে তারা আবার জন্মলাভ করে। |
||
|
২০ |
কিন্তু
যে অব্যক্তভাব থেকে এই বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি হয়, তার থেকে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অগোচর
সনাতন অব্যক্তভাব। সমস্ত বিশ্বচরাচরের বিনাশ হলেও এই ভাব নষ্ট হয় না। |
||
|
২১ |
এই যে
সনাতন অব্যক্তভাবের কথা বললাম, এই ভাবকেই অক্ষর বলে, এই ভাবকেই পরমা গতি বলে। এই
ভাব লাভ করলে পুনর্জন্ম হয় না, আর এই ভাবই আমার পরমধাম। |
||
|
২২ |
হে
পার্থ, যাঁর অন্তরে সকল জীবজগতের আশ্রয়, যিনি এই বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে
রয়েছেন, সেই পরম পুরুষকে হৃদয়ের একান্ত ভক্তি দিয়ে লাভ করা যায়। |
||
|
২৩ |
হে
ভরতকুলশ্রেষ্ঠ, যে কালে মৃত্যু হলে, যোগীগণ পরমমুক্তি লাভ করেন অথবা আবার জন্ম
গ্রহণ করেন, সেই কালের কথাই তোমাকে এখন বলব।
|
||
|
২৪ |
অগ্নি,
জ্যোতি, দিবস, শুক্লপক্ষ, এবং উত্তরায়ণের ছয়মাস, দেবযানের এই মার্গে প্রয়াণ হলে,
ব্রহ্মসাধক ব্যক্তিগণ ব্রহ্মলোক লাভ করেন। |
||
|
২৫ |
ধোঁয়া,
রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ এবং দক্ষিণায়নের ছয় মাস, পিতৃযানের এই মার্গে যোগী চন্দ্রের
জ্যোতি লাভ ক’রে আবার এই জগতে ফিরে আসেন।
|
||
|
২৬ |
শুক্ল
এবং কৃষ্ণ এই দুটি পথই জগতের সনাতন পথ বলে জ্ঞানীরা মনে করেন, একটি পথে পরম
মুক্তি পাওয়া যায়, আর অন্যটিতে আবার দেহধারণ করতে হয়। |
||
|
২৭ |
হে
পার্থ, এই দুই মার্গ সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে, কোনও যোগীই মোহের বন্ধনে আবদ্ধ হন
না। অতএব, হে অর্জুন, তুমি সর্বদা ব্রহ্মধ্যানে অভ্যস্ত হও। |
||
|
২৮ |
বেদ পাঠ,
যজ্ঞ অনুষ্ঠান, কঠোর তপস্যা এবং দান কর্ম থেকে যে সমস্ত পুণ্যফলের কথা শাস্ত্রে
বলা হয়েছে, তোমার ওই সাতটি প্রশ্নে আমার এই উত্তর সম্যক উপলব্ধি করতে পারলে,
ধ্যানযোগী ঐ সব পুণ্যফল অতিক্রম করে জগতের আদি কারণস্বরূপ পরমপদ লাভ করে
থাকেন। |
অক্ষরব্রহ্মযোগ
সমাপ্ত
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন