“ওফ আর পারা যাচ্ছে না। এই
অষ্টমীর দিনেই বড্ডো ধকল যায়। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুজো নাও, অঞ্জলি নাও।
তারপর সন্ধিপুজোর যোগাড় সারা হলে, সন্ধি পুজো নাও। একটানা এতক্ষণ, পা দুটো ভেরিয়ে
যায়। আআআআঃ (মস্ত হাই), মণ্ডপের কাঠের মেঝেয় বসে পাদুটো ছড়িয়ে বসে কী আরাম!
লক্ষ্মী ওদিকটা লক্ষ্য রাখিস তো, হুট করে এদিকে কেউ যেন চলে না আসে”।
“দেখেছি, মা। সবাই নাক ডাকিয়ে
ঘুমোচ্ছে। ওরা তো আমাদের থেকেও ক্লান্ত। পারে নাকি আর?”
“যাক আর তো দুটো দিন, নবমী পুজো
আর দশমীর বরণ। ব্যস, তারপরেই ফিরে যাওয়া”।
“আমার ফিরে যাওয়াই সার। আবার তো
ফিরে আসতে হবে, পাঁচদিন পরেই পূর্ণিমাতে”।
“সে আর কী করবি, বাছা? দুটো পয়সার
জন্যে আকুলিবিকুলি করছে মানুষগুলো। তোকে পুজো দিয়ে তারা একটু সুখে সম্পদে থাকতে
চায়, এইটুকু বৈ তো না”।
“সে ঠিক আছে। কিন্তু আমার
জার্নিটা দেখছো না? কাতু আসে কার্তিকের শেষে, প্রায় মাসদেড়েক পরে। আমাদের মধ্যে সরুটা
খুব সেয়ানা, সে আসে সাড়ে তিন-চারমাস পড়ে, বেশ ঠাণ্ডার সময়। যত ঝক্কি আমার আর
গণুদার। গণুদা এই কদিন আগে আগে একা এসেছিল, আবার আমাদের সঙ্গে এল। আর আমাকে গিয়েই
আবার ফিরে আসতে হবে!”
সরু হাসতে হাসতে বলল, “অ্যাই দিদি,
তোর হিংসে হচ্ছে, বুঝি? দাঁড়া একটু গান শোন, তাহলেই দেখবি মনটা ভালো হয়ে যাবে! মন
থেকে রাগ টাগ সব পরিষ্কার হয়ে যাবে!”
“অ সরু, তুই আবার এই রাত দুপুরে
বীণা নিয়ে বসলি? তোরা হাঁসটাও তো এবার হাসবে, মা”।
“একটু শোনো না, মা। নতুন একটা সুর
সেধেছি। শুনে, বলো না, কেমন হয়েছে?”
“না শুনিয়ে তুই কী আর ছাড়বি, বোন।
শোনা, তাড়াতাড়ি শোনা”। গণুদা বললেন।
খুশি হয়ে সরু বললেন, “থ্যাংকিউ,
গণুদা”।
বীণায় সুন্দর সুর বেজে উঠল। সকলে চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন। সরুর হাতে সত্যি জাদু আছে।
পিড়িং পিড়িং শব্দে কী যে আশ্চর্য সুর বের করে ফেলে, মনটা হালকা হয়ে যায়। শরীরের
ক্লান্তিও দূর হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ অচেনা গলার আওয়াজ পেয়ে সকলেই একটু চমকে উঠলেন।
“তুমি বীণা বাজাতে পারো, আমাকে
শিখিয়ে দেবে?” সরুর হাঁটুতে ছোট্ট ছোট্ট হাত রেখে একটি মেয়ে জিগ্যেস করল। সকলেই
একটু সতর্ক হয়ে উঠলেও, মা তেমন উতলা হলেন না, বললেন, “থাক থাক, বাছা। তোরা সব
ব্যস্ত হস না। ও ছোট্ট পুঁচকে মেয়ে। বড়দের মতো এখনো কুচুটেপনা শেখেনি। ও আমাদের
দেখে ফেললে কোন ক্ষতি নেই। তোর নাম কী রে, মা?”
“আমার নাম? আমার নাম দুগ্গা”।
দুগ্গা নাম শুনে সরু হেসে
ফেললেন, বললেন, “ওয়াও, হোয়াট আ সারপ্রাইজ”!
লক্ষ্মী বললেন, “এতে আর আশ্চর্য
হবার কী আছে? আমার নামের মেয়েরা কাজের মাসি বা কাজের দিদি হয়। “অ লক্ষ্মী, এঁটো
থালাবাসন কটা চট করে ধুয়ে দাও না গো”। লক্ষ্মী অবিকল বাড়ির গিন্নিদের মতো বললেন। “আর তোর নাম রাখে না, তোর নামের
বানানের জন্যে। এমন খটোমটো বানান, ইংরিজিতে তাও একটু সহজ, কিন্তু বাংলায়? বাপরে!”
গণুদা বললেন, “বোঝো কাণ্ড। তোরা
আবার নাম নিয়ে পড়লি কেন?” ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটার নাম দুগ্গা শুনে মা দুগ্গা খুব
খুশি হয়েছেন, কিন্তু মেয়েরা দুঃখ পাবে বলে, গম্ভীরভাবে বললেন, “ও লক্ষ্মী, ওসব
ভাবিস কেন, মা? নামে কী আসে যায়। হ্যাঁরে, সরু কোন এক সায়েব যেন বলেছিল ?”
“সেক্সপিয়ার”। সরু বললেন। মা
বললেন, “ওই ওই। গোলাপকে ঘেঁটু বললে, গোলাপ ঘেঁটু হয়ে যায় বুঝি?”
সরু হিহি করে হেসে বললেন, “মা,
তুমি না যাতা। ঠিক ওভাবে বলে নি, তবে অনেকটা ওরকমই”।
ছোট্ট দুগ্গা দূর থেকে দাঁড়িয়ে গত মাস
খানেক ধরেই এঁদের প্রতিমা গড়ে উঠতে দেখেছে। আর এ কদিন ধরে দেখেছে কত কত লোক, ছেলে
মেয়ে, বুড়োবুড়ি সুন্দর সুন্দর নতুন জামাকাপড়, শাড়িটাড়ি পরে রোজ এসে পুজো দেয়। আরতি
দেখে। চারদিকে আলোর সাজ। সকাল সন্ধ্যে অজস্র ফুল, ধুপ, ধুনোর গন্ধ। গোটা পাড়াটাই সম্পূর্ণ
বদলে গিয়েছে। এই পুজোর সময় সব কিছুই ভালো, শুধু ঢাক বাজে, কাঁসর ঘন্টা বাজে, শাঁখ
বাজে। আর মাসিমা, কাকিমারা জিভ নাড়িয়ে ঊলু দেয়। মা সামনে আসতে
পারে না, একটু দূর থেকে দেখে চলে যায়। যাঁর পুজো হচ্ছে, তাঁর নাম দূর্গা, সেই দূর্গা
যে দুগ্গাও, সে কথাটি সেই মেয়েটি তো আর জানে না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তাই নির্জন
মণ্ডপে উঠে এসে, বড়ো দিদির মতো দেখতে মেয়েটির হাঁটুতে ছোট্ট হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল।
বীণা বাজাচ্ছিল যে মেয়েটি, সে তার
দিদির মতোই দেখতে, তবে তার দিদি এত ফর্সা নয়। পরনের শাড়িটাও এত সুন্দর, ঝলমলে, ভাল
নয়। এই দিদিটা গলায়, হাতে, পায়ে যে এত গয়না পরেছে, তার দিদির তাও নেই। তার ওপর
সকলের কথাবার্তা শুনে দুগ্গা একটু ঘাবড়ে গেল। ভয় পাওয়া বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল
সরুর মুখের দিকে। সরু মুখ নামিয়ে তাকালেন দুগ্গার দিকে, মিষ্টি হেসে বললেন, “বীণা
শিখবি? কিন্তু একদিনে তো হবে না, সোনা! অনেক দিন ধরে শিখতে হবে। তোর বাড়ি কোথায়?”
দুগ্গা সরুদিদির কথায় কিছুটা
আশ্বস্ত হল। অনেক দূরের দিকে হাত বাড়িয়ে সে দেখাল, বলল, “ওই হোথা”। দুগ্গার কথায়
সরু হেসে ফেললেন, মজাও পেলেন, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, “কোথা?”
“দুলে পাড়া। আমার বাবা, বলরাম
দুলে। ঢাক বাজায়। আমার ছোড়দা ঘনশ্যাম ঘন্টা বাজায়”। তারপর হাত তুলে দেখালো,
মণ্ডপের নীচে মাটির এক কোণে ঢাকের পিছনে গুটিশুটি শুয়ে আছে একজন লোক আর একটা ছেলে - সেদিকে।
সরু দুগ্গার থুতনিতে হাত দিয়ে
হাল্কা আদর করে বললেন, “তুই বাবার সঙ্গে এসেছিস, ঠাকুর দেখতে?” দুগ্গা ঘাড় নেড়ে
হ্যাঁ বলল। এতক্ষণ সরু আর দুগ্গার কথা শুনছিলেন, এখন একটু উদ্বিগ্ন সুরে মা
বললেন, “ও সরু। ওকে ছুঁয়ে ফেললি যে, লোকে দেখে ফেললে কুরুক্ষেত্র বাধাবে”।
“ছুঁয়ে ফেললে কী হয়েছে, মা?
আমাদের কী জাত যাবে? দেবতার কী জাত আছে মা?”
“আমাদের জাতের কথা কে ভাবছে,
বাছা? তা নয়। কিন্তু ভোর হতে দেরি নেই। লোকেদের কেউ দেখে ফেললে এক কাণ্ড বাধিয়ে
বসবে। আমাদের কিছুই হবে না। ওদের তাড়িয়ে দেবে, মারধোর করবে। হয়তো...” ভয়ংকর কথাটা
মা বলতে পারলেন না।
লক্ষ্মীও বললেন, “সত্যি, তোরই বা
অত আদিখ্যেতা দেখানোর দরকারটা কী শুনি? দু চারটে কথা বলে সরিয়ে দে। কী থেকে কী হয়
বলা যায়?”
সরু কিছুটা বিরক্ত হলেন এবার,
বললেন, “তোমরা একটু বেশীই ভাবছো, মা। ওসব আগেকার দিনে হতো। আজকাল ছেলেমেয়েরা কত
লেখাপড়া শিখছে। বুঝতে শিখছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট সারাবিশ্বের পড়াশুনো এখন হাতের
মুঠোয়। এ মেয়েটি ভারি মিষ্টি, আমি একে বীণা শেখাবো। ওর মনের যতো সুর, আমি ওর হাতে বসিয়ে
দেবো। দেখো, বড় হয়ে ও কেমন বীণা বাজায়”।
“কী জানি বাপু, আমার মন কিন্তু কু
গাইছে, সরু। ওকে দূরে সরে যেতে বল”।
মানদাসুন্দরী রাত থাকতেই উঠে
পড়েন। কোমর বেঁকে গেছে, হাঁটুতে জোর পান না, তবুও এ সময় তাঁর মন্দিরতলায় রোজ আসা
চাই। এখন তো আবার দূর্গাপুজো হচ্ছে, জগজ্জননী মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন, বাপের
ঘরে। তাঁর না এলে চলে? বিড়বিড় করে দূর্গাস্তোত্র বলতে বলতে তিনি এসে দাঁড়ালেন
মণ্ডপের সামনে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বুক জুড়িয়ে গেল। একটিমাত্র শিশুপুত্র
নিয়ে তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বহু
দুঃখকষ্ট সহ্য করে তাকে বড়ো করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন। একটি নাতি আর একটি নাতনি নিয়ে
তাঁর ভরা সংসার হবার কথা ছিল। হল না, আঁটকুড়ির বেটি, ছেলের বউটার জন্যে। তাঁর
শিবের তুল্য ছেলের কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে, ফুসলে আলাদা হয়ে গেল। বেশ ক’বছর হল,
মানদাসুন্দরী আবার অসহায় বেধবা।
স্তোত্র আওড়াতে আওড়াতে চোখ বন্ধ করে জোড়হাত করলেন
মানদাসুন্দরী, মা দূর্গার কাছে আকুতি জানালেন, “ও মা, শেষ বয়সে একটু সুখ আর শান্তি
দাও, মা। আমার ভোলাকে, আমার বুকে ফিরিয়ে দাও মা।” আবেগের বশে তাঁর দু চোখে জল চলে
এল। চোখ মেলে, সকল প্রতিমার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়ল, সরস্বতী মায়ের
হাঁটু ধরে, ওই ছুঁড়িটা কে? ঝাপসা চোখে ঠিক দেখছেন তো? নাঃ, ঠিকই তো দেখছেন, একটা
হতভাগী মেয়ে। যেমন তার শাঁকচুন্নীর মতো চেহারা, তেমনি তার জামাকাপড়ের ছিরি।
নিশ্চয়ই কোন ছোটনোকের মেয়ে। ঝ্যাঁটা মার, ঝ্যাঁটা মার, আকাচা কাপড়ে ঠাকুরের
গায়ে কেমন লেপটে ছুঁয়ে আছে দেখো।
তাঁর কর্কশ খনখন স্বরে নবমীর স্নিগ্ধ ভোর চমকে উঠল, “ওরে ও
আবাগীর বেটি, তুই ওখানে কেন রে, হতচ্ছাড়ি? দেব্তার পিতিমে কী তোর খেলার পুতুল?
নেমে আয় নেমে আয়, শিগ্গিরি। কী আস্পদ্দা রে, তোর? কার মেয়ে তুই, কোন পাড়ায় বাড়ি”।
ছোট্ট দুগ্গা ভয়ে আতঙ্কে দৌড়ে নামতে গিয়ে মণ্ডপের সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
কাঠের সিঁড়ির কোণায় লেগে তার হাঁটু ছড়ে গেল। মণ্ডপে তিন দেবী শিউরে ব্যস্ত হয়ে
উঠলেন, “ইস্, আহা রে”।
মানদাসুন্দরী দেবী ছুঁতে পারবেন না, তা নাহলে তিনি চুলের
মুঠি ধরে মেয়ের ঝিঁকুটি নাড়িয়ে দিতেন। তিনি আগুন ঝরানো চোখে এগিয়ে চললেন, হাঁটু
চেপে বসে থাকা দুগ্গার দিকে, দুগ্গার ক্ষতে রক্ত জমছে। মানদাসুন্দরীর
চেঁচামেচিতে বলরাম দুলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘুমভাঙা চোখে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে
পেরে সেও শিউরে উঠল আতঙ্কে।
সে দৌড়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল, মানদাসুন্দরীর পায়ের কাছে, “মা
ঠাকরেন, আমার মেয়েরে ছেড়ে দ্যান, মা ঠাকরেন, ছোট মেয়ে বুঝতে পারে নাই, করে
ফ্যালেচে। আমি ওকে খুব পিটবো, খুব বকবো, পুজোর থানে আর কোনদিন আনবুনি”।
আগুনে যেন ঘি পড়ল, মানদাসুন্দরী বিকৃত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“তোর মেয়ে, হারামজাদা? দুলে, ছোটলোক? তোদের এতদূর আস্পদ্দা? ঠাকুরের গায়ে হাত দিস?
ওরে অ সিধু, অ স্বপ্না, অ দেবু, কোতায় গেলি সব, এদিকে যে অনাছিস্টির কাণ্ড ঘটে
যাচ্ছে... এখনো ঘুমিয়ে থাকবি? বলি দেশে কী জাতধর্ম, সৈরণ অসৈরণ কিছুই থাকবে নি কো?
কিছু করবি? নাকি আমি অনত্থ বাধাবো?”
মানদাসুন্দরীর চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এল সবাই।
“কী হয়েছ, ঠাকুমা?”
“হবার আর বাকি কী রইল, বাছা? সারারাত ওই ছোটলোকের দল যে
পিতিমে নিয়ে পুতুল খেলা করছে, বলি আর হবে কী?”
দেবাশীষ গেল মেয়েটির কাছে। সিদ্ধার্থ মাটিতে মাথানীচু করে
বসে থাকা বলরামের দিকে এগিয়ে গেল।
“কী হয়েছে, বলরামদা? কী করেছ?”
“আমরা ঘুমোচ্ছিলাম, আমার ওই মেয়েটা কখন উঠে গিয়ে, মায়ের
গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে। আর কোনদিন ওকে পুজোয় আনবুনি সিধুবাবু। ছোট মেয়ে জানেনা,
এবারের মতো ক্ষ্যামাঘেন্না করে দাও। আজই ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কোনদিন আর পুজোয়
আনবুনি”। হাঁটুর ব্যাথায়,
ভয়ে বিবর্ণ মেয়েটিকে দেবাশিষ সামনে আনল।
সিদ্ধার্থ বলল, “আরে, এ তো রক্ত পড়ছে। দেবু তুই ওকে তোর
বাড়ি নিয়ে যা, ব্যাণ্ডএড-টেড কিছু আছে? ফার্স্ট এড করে দে। কী নাম রে তোর?” মেয়েটি
নাম বলতে আর ভরসা পেল না, চুপ করে মাথা নিচু করে রয়েছে, তার চোখ থেকে জল ঝরছে।
বলরাম বলল, “আমার মেয়ে বাবু, নাম দুগ্গা”।
“সেকি? আজকের দিনে দুগ্গামায়ের চোখে জল? ছি ছি ছি”।
মানদাসুন্দরী অবাক হয়ে দেখছিলেন, ছোকরাদের কাণ্ড, দেখে আর
থাকতে পারলেন না, তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, “তোরা কী পাগল হলি নাকি? একি অধম্মের
কাণ্ড, ওই মেয়েকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর বলছি, নাহলে ঘোর অমঙ্গল”।
সিদ্ধার্থ দুগ্গাকে কোলে তুলে নিল, বলল, “আর কাঁদিস না,
চল, আমার সঙ্গে। ঊর্মি, আমার বোন, তোকে পেলে আর ছাড়বে না। কী রে যাবি না
ঊর্মিদিদির কাছে?”
অশ্রুভেজা চোখেও দুগ্গা ফিক করে হাসল, সিদ্ধার্থদাদার
কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে রইল মণ্ডপের দিকে। সরুদিদি হাসছেন।
* * *
গল্পটা শেষ করে, আলপনা মোবাইলে
একটা নম্বর খুঁজে ডায়াল করল। আলপনা একটা বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। রিং হচ্ছে,
তিনবার রিং হবার পর উত্তর এল, “হ্যালো।”
“হ্যালো, বিষ্ণুদা। আলপনা বলছি। আপনার পাঠানো গল্পটা,
পড়লাম। থ্যাংকুউ, দারুণ মিষ্টি একটা গল্প। খুব সুন্দর মেসেজও রয়েছে একটা”
“ওয়েলকাম, ভাই। কিন্তু কোন গল্পটার কথা বলছো বলো তো?”
“বা রে, যেটা আমাদের পত্রিকার জন্যে পাঠালেন। “দুগ্গা”।
ভুলে গেলেন?”
“ওঃ দুগ্গা? ভালো লেগেছে তোমার? অনেক ধন্যবাদ ভাই”।
“ওটা আমরা পরের সংখ্যায় ছাপছি। ভুলে অন্য কোথাও আবার দিয়ে
দেবেন না যেন। আপনার যা ভুলো মন”।
“হা হা হা হা। যা বলেছো। তবে গল্পটা সাজানো, মিথ্যে - তাই
ভুলে গেছিলাম। সত্যিটা ভুলতে পারি না যে!”।
“তার মানে? গল্পের আবার সত্যি মিথ্যে কী? কী যে বলেন,
দাদা?”
“জীবনের সত্যি নিয়ে গল্প - কটা হয় বলো তো? অধিকাংশই তো
সাজানো গল্প”।
“হুঁ, তাই? এই গল্পের সত্যি কিছু আছে নাকি, দাদা। বলুন না
শুনি”। আলপনা হালকা গলায় বলল।
“সিরিয়াসলি শুনবে? মিষ্টি নয় কিন্তু”।
“আচ্ছা, সে আমি বুঝবো। আমি একজন সম্পাদক, ভুলে যাবেন না।
হা হা হা হা”।
“তা ঠিক। সম্পাদককে অনেক যন্ত্রণাই পুষে রাখতে হয়। শুনবে,
তাহলে?”
“শিয়োর, বলুন”।
“বলছি। গল্প প্রায় সবটাই থাকবে, ওই শেষের দিকে কিছুটা...
“মানদাসুন্দরীর
চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এল সবাই। তাদের নিঃশ্বাসে তীব্র মদের গন্ধ। গতকাল রাত থেকে
শুরু হয়েছে নেশার আয়োজন, এখনো চলছে।
“কী হয়েচে অ্যাই বুড়ি? ভোর রাতে পাড়া মাতায় তুলেচিস কেন?”
“হবার আর বাকি কী রইল,
বাছা? সারারাত ওই ছোটলোকের দল যে পিতিমে নিয়ে পুতুল খেলা করছে, বলি আর হবেটা কী?”
দেবু গেল মেয়েটির কাছে।
সিধু মাটিতে মাথানীচু করে বসে থাকা বলরামের দিকে এগিয়ে গেল। তারা দুজনেই টলছে।
“কী হয়েছে বে, অ্যাই বলরাম? কী করেছিস?”
“আমরা ঘুমোচ্ছিলাম, আমার
ওই মেয়েটা কখন উঠে গিয়ে, মায়ের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে। আর কোনদিন ওকে পুজোয় আনবুনি
সিধুবাবু। ছোট মেয়ে জানেনা, এবারের মতো ক্ষ্যামাঘেন্না করে দাও। আজই ওকে বাড়ি
পাঠিয়ে দিচ্ছি। কোনদিন আর পুজোয় আনবুনি”। হাঁটুর ব্যাথায়, ভয়ে বিবর্ণ মেয়েটিকে দেবু
সামনে আনল। ঘোলাটে চোখে সিধু তাকিয়ে দেখল মেয়েটাকে। তার মুখে চিকচিকে হাসি, বলল।
“আবে, এর তো রক্ত পড়ছে।
কী নাম রে তোর?” মেয়েটি নাম বলতে আর ভরসা পেল না, চুপ করে মাথা নিচু করে রইল, তার দু
চোখ ভরা জল।
বলরাম বলল, “আমার মেয়ে
বাবু, নাম দুগ্গা”।
“দুগ্গা? দুগ্গা দুগ্গা”
সিধু মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল, বলল, “আজকের দিনে দুগ্গার চোখে জল কেন বাওয়া?”। মানদাসুন্দরী
অবাক হয়ে দেখছিলেন, ছোকরাদের কাণ্ড, দেখে আর থাকতে পারলেন না, তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে
উঠলেন, “তোরা কী পাগল হলি নাকি? এ কী অধম্মের কাণ্ড, ওই মেয়েকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর
বলছি, নাহলে ঘোর অমঙ্গল”।
সিধুর ডান হাতটা ঢাকা পড়ে গেল দুগ্গার পুজোর আগেই সদ্য কেনা সুন্দর ফুলফুল ছাপ ফ্রকের
তলায়।
ধমকে উঠল জোর গলায়, “অ্যাই বুড়ি, চোপ। আর একটা কথা বললে, গলা টিপে খালে ভাসিয়ে দেবো”। তারপর
অদ্ভূত একটা বিকৃত হাসি
মুখে নিয়ে, দুগ্গাকে বলল, “আর কাঁদিস নি, চল আমার সঙ্গে” । দুগ্গার চোখের
জল শুকিয়ে এসেছে, অদ্ভূত আতঙ্কে সে তাকিয়ে আছে সিধুর দিকে। তার ছোট্ট জীবনে এমন ভয়
সে কোনদিন পায়নি। সে ছোট্ট ছোট্ট হাতে সিধুর ফ্রকের আড়ালে থাকা হাতটা টেনে সরিয়ে
দিতে চেষ্টা করতে লাগল। পারল না। তাকে কোলে নিয়ে সিধু হাঁটতে লাগল ভোরের মাঠের
দিকে। আকাশে এখনো আলো ফোটেনি। পাখিদের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে। দুগ্গা ছোট্ট পাখির
মতো ছটফট করে ছাড়া পেতে চাইছিল, পারছিল না। ভয়ে চিৎকার করে উঠল। অন্যহাতে সিধু তার
মুখটা চেপে ধরল।
হতভম্ব বলরাম চিৎকার করে
উঠল, “ও বাবু, দুগ্গাকে কোথায় নে যাচ্ছেন, বাবু? দুগ্গা, ও দুগ্গা”। দেবু সিধুর একটু পিছনে
ছিল। ফিরে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আর একটা কথা বললে না, তুইও যাবি। মেয়েটাও মায়ের ভোগে যাবে...”।
“বিষ্ণুদা,
প্লিজ এ গল্পটা মোটেই সত্যি নয়। আপনি মিথ্যে বলছেন। প্লিজ চুপ করুন”।
“তাই?
তোমার মিথ্যে মনে হচ্ছে? থাক তাহলে আর বলব না। তবে শেষটা শুনবে না? সেদিন দুপুরের
দিকে দুগ্গাকে পাওয়া গিয়েছিল, কিছুটা দূরে খালের ধারে। মৃতা এবং উলঙ্গ, সে কথা বলাই
বাহুল্য। তোমার যখন ভালো লাগছে না, আর কিছু বলবো না। না বললেও বুঝতে
পারছো নিশ্চয়ই!”
আলপনা
অস্ফুট গলায় বলল, “রাখছি, বিষ্ণুদা”।
“এক
মিনিট, গল্পটা ছাপছো কী? ছাপলে কোনটা? আগেরটা? তাহলে কোন সমস্যা নেই - খুব নিরাপদ। সন্ধেবেলার চায়ের আসরে নিশ্চিন্তে আলোচনা করতে পারবে - সত্যি বিষ্ণুদার কলমে জাদু আছে। আর যদি
পরেরটা ছাপতে চাও, গল্পের নাম দিও “বিসর্জন”। দশমীর দিন ওই খালেই মা দূর্গারও
বিসর্জন হয়েছিল। বিসর্জনের পর জলে ভেজা, রঙ ওঠা, খড় বেরিয়ে আসা, সে কী বীভৎস কদর্য সব প্রতিমা।
রাখি? ভালো থেকো”।
..০০..
A unique story told in a symbolic style. The author has a penchant for surreal things unfolding before him. I am mightily impressed with the interplay of things taking place in the story. Amen.
উত্তরমুছুনবিসর্জন" গল্পটি মানবিক বন্ধনের সীমানায় আবদ্ধ, যা হৃদয়স্পর্শী এবং হৃদয়বিদারক। লেখক কিশোর ঘোষাল নীতিবোধের বাইরেও অবস্থান নিয়েছেন, তিনি কেবল মর্মস্পর্শী সহানুভূতির সাথে পরিস্থিতি উপস্থাপন করেছেন।
উত্তরমুছুনআজকাল সুন্দরের গা ঘেঁষেই ওঁৎ পেতে থাকে কুৎসিত - পেন ছাড়া আর কিছুই নেই এই লেখকের হাতে।
উত্তরমুছুন