[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉
বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন]
[পূর্ব প্রকাশিত শ্রীশ্রী চণ্ডীর পর্ব ৩ এই সূত্রে পড়া যাবে - শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ৩ ]
মধ্যম চরিতের তৃতীয় অধ্যায়ে মহিষাসুর বধ সাঙ্গ হয়েছিল। তারপর ইন্দ্রাদি দেবতারা দেবরাজ্য ফিরে পেয়ে কতখানি উল্লসিত হয়ে উঠল, এবং কৃতজ্ঞতায় তারা দেবী চণ্ডিকাকে গালভরে কত যে স্তব-স্তুতি করল - সেই বর্ণনাই রয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে। দেবীও দেবতাদের স্তাবকতায় সন্তুষ্ট হয়ে উদার হাতে তাদের বর দিলেন।
মধ্যম চরিত
চতুর্থ অধ্যায়
ধ্যান
কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলিবদ্ধেন্দুরেখাং
শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং
ত্রিনেত্রাম।
সিংহস্কন্ধাধিরূঢ়াং ত্রিভুবনমখিলং তেজসা পূরয়ন্তীং
ধ্যায়েদ্দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশগণবৃতাং সেবিতাং
সিদ্ধসঙ্ঘৈঃ।।
[কালাভ্র-আভাম্
কটাক্ষৈঃ অরি-কুল-ভয়দাম্ মৌলিবদ্ধ-ইন্দুরেখাং শঙ্খম্ চক্রম্ কৃপাণম্ ত্রিশিখম্
অপি করৈঃ উদ্বহন্তীম্ ত্রিনেত্রাম্।
সিংহ-স্কন্ধ-অধিরূঢ়াম্
ত্রিভুবনম্ অখিলং তেজসা পূরয়ন্তীম্ ধ্যায়েৎ দুর্গাম্ জয়া-আখ্যাম্
ত্রিদশগণ-বৃতাম্ সেবিতাম্ সিদ্ধসঙ্ঘৈঃ।।]
সুবর্ণবর্ণা, কটাক্ষে শত্রুকুল-ভয়দায়িনী, কপালে শোভিত চন্দ্রকলা, চার
হাতে শঙ্খ, চক্র, কৃপাণ ও ত্রিশূলধারিণী, ত্রিনয়না, সিংহের উপর অধিষ্ঠিতা, নিখিল
ত্রিভুবন নিজের তেজে পূর্ণকারিণী, দেবগণ পরিবৃতা, সিদ্ধগণ যাঁর সেবা করেন, জয়া
নামের সেই দুর্গার ধ্যান করবে।
শক্রাদির দেবীস্তুতি
ঋষিরুবাচ।
শক্রাদয়ঃ সুরগণা নিহতেঽতিবীর্যে তস্মিন্ দুরাত্মনি
সুরারিবলে চ দেব্যা।
তাং তুষ্টুবুঃ প্রণতিনম্রশিরোধরাংসা বাগ্ভিঃ
প্রহর্ষপুলকোদ্গমচারুদেহাঃ।। ১
[ঋষিঃ উবাচ। শক্রাদয়ঃ সুরগণা নিহতে অতিবীর্যে তস্মিন্ দুরাত্মনি
সুরারিবলে চ দেব্যা।
তাম্ তুষ্টুবুঃ প্রণতি-নম্র-শিরোধর অংসাঃ বাগ্ভিঃ
প্রহর্ষ-পুলক-উদ্গম-চারুদেহাঃ।। ১]
ঋষি বললেন। অতি পরাক্রমী সেই মহিষাসুর ও অসুরসেনারা দেবীর হাতে নিহত
হওয়ায়, শক্রাদি (ইন্দ্রাদি) দেবতারা মাথা, ঘাড় ও কাঁধ আনত করে তাঁকে প্রণাম করলেন এবং আনন্দে পুলকিত
ও রোমাঞ্চিত দেহে মধুর বাক্যে তাঁর স্তুতি করতে লাগলেন।
তামম্বিকামখিলদেবমহর্ষিপূজ্যাং ভক্ত্যা নতাঃ স্ম বিদধাতু
শুভানি সা নঃ।। ২
[দেব্যা যয়া ততম্ ইদম্ জগৎ-আত্ম-শক্ত্যা
নিঃশেষ-দেবগণ-শক্তি-সমূহ-মূর্ত্যা।
তাম্ অম্বিকাম্ অখিল-দেব-মহর্ষি-পূজ্যাং ভক্ত্যা নতাঃ স্ম বিদধাতু
শুভানি সা নঃ।। ২]
নিখিল দেবতাদের সমুদয় শক্তির মূর্তিরূপা যে দেবী নিজ মায়াশক্তির
প্রভাবে এইজগতে ব্যাপ্ত রয়েছেন, যাঁকে সকল দেবতা, মহর্ষিগণ পূজা করেন, সেই দেবী
অম্বিকাকে আমরা ভক্তিভরে প্রণাম করি, তিনি আমাদের সর্বপ্রকার মঙ্গলের বিধান করুন।
যস্যাঃ প্রভাবমতুলং ভগবাননন্তো ব্রহ্মা হরশ্চ ন হি বক্তুমলং বলঞ্চ।
সা চণ্ডিকাখিলজগৎপরিপালানায় নাশায় চাসুরভয়স্য মতিং করোতু।।
৩
যা শ্রীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেষ্বলক্ষ্মীঃ পাপাত্মনাং
কৃতধিয়াং হৃদয়েষু বুদ্ধিঃ
শ্রদ্ধা সতাং কুলজনপ্রভবস্য লজ্জা তাং ত্বাং নতাঃ স্ম
পরিপালয় দেবি বিশ্বম্। ৪
[যস্যাঃ
প্রভাবম্ অতুলং ভগবান্ অনন্তঃ ব্রহ্মা হরঃ চ ন হি বক্তুম্ অলম্ বলম্ চ।
সা চণ্ডিকা অখিল-জগৎ-পরিপালানায় নাশায় চ অসুর-ভয়স্য মতিম্ করোতু।। ৩
যা শ্রীঃ
স্বয়ম্ সুকৃতিনাম্ ভবনেষু অলক্ষ্মীঃ পাপ-আত্মনাম কৃতধিয়াম্ হৃদয়েষু বুদ্ধিঃ
শ্রদ্ধা
সতাম্ কুল-জন-প্রভবস্য লজ্জা তাম্ ত্বাম্ নতাঃ স্ম পরিপালয় দেবি বিশ্বম্। ৪]
ভগবান অনন্ত, ব্রহ্মা ও মহাদেব যাঁর অতুল প্রভাব ও শক্তির বর্ণনা করতে
পারেন না, সেই দেবী চণ্ডিকা সমগ্র জগৎ পরিপালনের এবং অসুর-ভয় বিনাশের ইচ্ছা করুন।
যিনি পুণ্যবানদের গৃহে স্বয়ং লক্ষ্মীরূপা, পাপাত্মাদের গৃহে অলক্ষ্মীরূপা। যিনি
শুদ্ধচিত্তদের হৃদয়ে সুবুদ্ধিরূপা, সজ্জনব্যক্তিদের শ্রদ্ধাস্বরূপা। যিনি সদ্বংশ
জাত মানুষের লজ্জারূপা (অর্থাৎ যিনি লজ্জারূপে অসৎ চিন্তা ও কর্ম থেকে সৎ মানুষকে
দূরে রাখেন), সেই আপনাকে আমরা বিনত প্রণাম করি, হে দেবি, আপনি বিশ্বকে পরিপালন
করুন।
কিং বর্ণয়াম তব রূপমচিন্ত্যমেতৎ কিঞ্চাতিবীর্যমসুরক্ষয়কারি ভূরি।
কিঞ্চাহবেষু চরিতানি তবাতি যানি সর্বেষু
দেব্যসুরদেবগণাদিকেষু।। ৫
[কিম্ বর্ণয়াম তব রূপম্ অচিন্ত্যম্ এতৎ কিম্ চ অতিবীর্যম্
অসুরক্ষয়কারি ভূরি।
কিম্ চ আহবেষু চরিতানি তব অতি যানি সর্বেষু দেবি অসুর-দেব-গণাদিকেষু।।
৫]
হে দেবি, সকল অসুর, দেবতা, প্রমথ এবং মহর্ষিদের মধ্যে আপনার অচিন্তনীয়
রূপের, অসংখ্য অসুরনাশকারী অমিত-পরাক্রমের এবং এই সংগ্রামে আপনার অসামান্য আচরণের
কি বর্ণনা দেব?
হেতুঃ সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈর্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।
সর্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশভূতমব্যাকৃতা হি পরমা
প্রকৃতিস্ত্বমাদ্যা। ৬
[হেতুঃ সমস্ত-জগতাম্ ত্রিগুণা অপি দোষৈঃ ন জ্ঞায়সে হরি-হরাদিভিঃ অপি
অপারা।
সর্ব-আশ্রয়া-অখিলম্ ইদম্ জগৎ-অংশভূতম্ অব্যাকৃতা হি পরমা প্রকৃতিঃ
ত্বম্-আদ্যা। ৬]
আপনি সমস্ত জগতের কারণ-স্বরূপা, আপনি তিনগুণের অধিকারিণী হলেও,
দোষযুক্ত ব্যক্তিরা আপনাকে জানতে পারে না। বিষ্ণু ও শিবাদি দেবতাদের কাছেও আপনি
অজ্ঞাত। এই অখিল জগতের আপনিই আশ্রয় এবং আপনার অংশেই তাদের সকলের জন্ম। আপনি সকল
বিকারবিহীনা পরমা-প্রকৃতি, আপনিই আদ্যা।
[জীবের বিকার-ধর্ম ছটি – জন্ম, অস্তিত্ব, বৃদ্ধি, বিপরিণাম, অপক্ষয় ও
বিনাশ, দেবী চিৎ-শক্তিস্বরূপা তাঁর এই বিকার নেই।]
যস্যাঃ সমস্তসুরতা সমুদীরণেন তৃপ্তিং প্রয়াতি সকলেষু মখেষু দেবি।
স্বাহাসি বৈ পিতৃগণস্য চ তৃপ্তিহেতুরুচ্চার্যসে ত্বমত এব
জনৈঃ স্বধা চ।। ৭
[যস্যাঃ সমস্তসুরতা সমুদীরণেন তৃপ্তিম্ প্রয়াতি সকলেষু মখেষু দেবি।
স্বাহা অসি বৈ পিতৃগণস্য চ তৃপ্তি-হেতুঃ উচ্চার্যসে ত্বম্ অতঃ এব জনৈঃ
স্বধা চ।। ৭]
হে দেবি, যে মন্ত্র উচ্চারণে ইন্দ্রাদি দেবতারা সকল যজ্ঞে তৃপ্তি লাভ
করেন, আপনিই সেই স্বাহা মন্ত্র এবং পিতৃগণের তৃপ্তির স্বধা-মন্ত্রও আপনি; এই
কারণেই সকল যজ্ঞের অনুষ্ঠানকারী আপনারই নাম উচ্চারণ করে থাকেন।
মোক্ষার্থিভির্মুনিভিরস্তসমস্তদৌষৈর্বিদ্যাসি সা ভগবতী
পরমা হি দেবি।। ৮
[যা মুক্তি-হেতুঃ অবিচিন্ত্য-মহাব্রতা চ অভ্যস্যসে
সুনিয়ত-ইন্দ্রিয়-তত্ত্ব-সারৈঃ।
মোক্ষার্থিভিঃ মুনিভিঃ অস্ত-সমস্ত-দৌষৈঃ বিদ্যা অসি সা ভগবতী পরমা হি
দেবি।। ৮]
হে দেবি, যে বিদ্যা মুক্তির কারণ এবং যে বিদ্যা সনিষ্ঠ মহাব্রতে
পালনীয়, আপনিই সেই পরমা বিদ্যা। হে ভগবতি, এই জন্যই সকল দোষ
বিবর্জিত, শুদ্ধচিত্ত, জিতেন্দ্রিয়, তত্ত্বনিষ্ঠ মুক্তিকামী মানুষ ও মুনিদের
সাধনার বিষয় আপনিই।
শব্দাত্মিকা সুবিমলর্গ্যজুষাং নিধানমুদ্গীতরম্যপদপাঠবতাঞ্চ সাম্নাম্।
দেবী ত্রয়ী ভগবতী ভবভাবনায় বার্তা চ সর্বজগতাং
পরমার্তিহন্ত্রী।। ৯
[শব্দ-আত্মিকা সুবিমল-ঋক-যজুষাম্ নিধানম্ উদ্গীত-রম্য-পদ-পাঠবতাম্ চ
সাম্নাম্।
দেবী ত্রয়ী ভগবতী ভব-ভাবনায় বার্তা চ সর্বজগতাম্ পরম-আর্তি-হন্ত্রী।।
৯]
হে দেবি, আপনিই শব্দরূপা ব্রহ্ম। আপনিই পবিত্র ঋক ও যজুঃ এবং
উদাত্তস্বরে গীত রম্যপদ-সাম পাঠের আশ্রয়স্বরূপা। আপনিই বেদত্রয়ের স্বরূপ ও
সর্ব-ঐশ্বর্যময়ী। আপনিই জগৎ-পালনের বার্তাস্বরূপা, আপনিই সমস্ত জগতের
পরমাদুঃখহারিণী।
[বার্তা অর্থাৎ বৃত্তি – কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ইত্যাদি জীবিকার
নানাবিধ উপায়। এই সকল জীবিকার কারণেই মানব সমাজ পূর্ণতা পায়। ]
শ্রীঃ কৈটভারিহৃদয়ৈককৃতাধিবাসা গৌরী ত্বমেব
শশিমৌলিকৃতপ্রতিষ্ঠা।। ১০
[মেধাসি দেবি বিদিতা অখিল-শাস্ত্র-সারা দুর্গা অসি দুর্গ-ভবসাগর-নৌঃ
অসঙ্গা।
শ্রীঃ কৈটভ-অরি-হৃদয়-এককৃত অধিবাসা গৌরী ত্বম্ এব
শশি-মৌলি-কৃত-প্রতিষ্ঠা।। ১০]
হে দেবি, যাঁর কৃপায় সকলশাস্ত্রের তত্ত্ব উপলব্ধি হয় আপনিই সেই মেধা। দুষ্পার সংসার-সাগরের
নৌকাস্বরূপ আপনিই অদ্বিতীয়-ব্রহ্মস্বরূপা দুর্গা। আপনিই কৈটভারি বিষ্ণুর
হৃদয়-স্থিতা প্রিয়া লক্ষ্মী, আপনি চন্দ্রশিখর মহাদেবের হৃদয়ে সংস্থিতা গৌরী।
[অর্থাৎ দেবী একই সঙ্গে ব্রাহ্মী, বৈষ্ণবী ও শৈবা।]
ঈষৎসহাসমমলং পরিপূর্ণচন্দ্রবিম্বানুকারি কনকোত্তমকান্তিকান্তম্।
অত্যদ্ভূতং প্রহৃতমাপ্তরুষা তথাপি বক্ত্রং বিলোক্য সহসা
মহিষাসুরেণ ।। ১১
[ঈষৎ-সহাসম্-অমলম্ পরিপূর্ণ-চন্দ্র-বিম্ব-অনুকারি
কনক-উত্তম-কান্তি-কান্তম্।
অত্যৎ-অদ্ভূতম্ প্রহৃতম্ আপ্ত-রুষা তথা অপি বক্ত্রং বিলোক্য সহসা
মহিষাসুরেণ ।। ১১]
হে দেবি, পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্না তুল্য নির্মল-মৃদু-হাস্যময়ী এবং
শ্রেষ্ঠ স্বর্ণপ্রভার তুল্য আপনার মুখ দেখেও মহিষাসুর ক্রোধভরে আপনাকে হঠাৎ আঘাত
করতে পারল, এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়।
প্রাণান্মুমোচ মহিষস্তদতীব চিত্রং কৈর্জীব্যতে হি
কুপিতান্তকদর্শনেন।। ১২
[দৃষ্ট্বা তু দেবি কুপিতম্ ভ্রূকুটি-করালম্-উদ্যৎ-শশাঙ্ক-সদৃশ-ছবি যৎ
ন সদ্যঃ।
প্রাণান মুমোচ মহিষঃ তৎ অতীব চিত্রম্ কৈঃ জীব্যতে হি
কুপিত-অন্তক-দর্শনেন।। ১২]
হে দেবি, আপনার ভ্রূকুটি-কুটিল ভয়ংকর ক্রুদ্ধ, সদ্য-উদিত পূর্ণচন্দ্রের
মতো আরক্ত মুখ দেখেও মহিষের প্রাণ বিয়োগ হল না, এটাই আশ্চর্যের। কারণ
কুপিত-মৃত্যু-দর্শনে কে বেঁচে থাকতে পারে?
[দেবীর দর্শনে ভক্তদের ষড়রিপু নাশ হয়ে চিত্তশুদ্ধি ঘটে এবং তৎক্ষণাৎ
পরমতত্ত্ব উপলব্ধি হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন হয়নি, কারণ মহিষাসুর ঘোরতর পাপী এবং
তমোগুণের অধিকারী, দেবী-দর্শনের পরেও তার চিত্তশুদ্ধি অথবা প্রাণ-মুক্তি হয়নি।
মহিষাসুরের পাপের মাত্রা বোঝানই এই দুই শ্লোকের উদ্দেশ্য।]
বিজ্ঞাতমেতদধুনৈব যদস্তমেতন্নীতং বলং সুবিপুলং
মহিষাসুরস্য।। ১৩
[দেবী প্রসীদ পরমা ভবতী ভবায় সদ্য-বিনাশয়সি কোপবতী কুলানি।
বিজ্ঞাতম্ এতৎ অধুনা এব যৎ অস্তম্ এতৎ নীতম্ বলম্ সুবিপুলম্
মহিষাসুরস্য।। ১৩]
হে দেবি, আপনি প্রসন্ন হোন। আপনি কৃপাময়ী। জগতের আশু মঙ্গলের জন্যে,
আপনি ক্রুদ্ধা হয়ে ওঠেন এবং অসুরকুল বিনাশ করে থাকেন। মহিষাসুরের সুবিপুল সৈন্যদের
আপনি নাশ করায় একথা আমরা এখনই উপলব্ধি করলাম।
তে সম্মতা জনপদেষু ধনানি তেষাং তেষাং যশাংসি ন চ সীদতি ধর্মবর্গঃ।
ধন্যাস্ত এব নিভৃতাত্মজভৃত্যদারা যেষাং সদাভ্যুদয়দা ভবতী
প্রসন্না।। ১৪
[তে সম্মতা জনপদেষু ধনানি তেষাম্ তেষাম্ যশাংসি ন চ সীদতি ধর্মবর্গঃ।
ধন্যাঃ ত এব নিভৃত-আত্মজ-ভৃত্য-দারা যেষাম্ সদা-অভ্যুদয়দা ভবতী
প্রসন্না।। ১৪]
আপনি সর্বদাই অভীষ্টদাত্রী। আপনি যাদের প্রতি প্রসন্না হন, তাদের
সর্বত্র যশোলাভ ঘটে, তাদের ধন লাভ হয়, স্ত্রী-পুত্র-ভৃত্য সহ নিরাপদ জীবনে তারা
ধন্য হয়। তাদের ধর্মাদি চতুর্বর্গ ম্লান হয় না।
[চতুর্বর্গ – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ প্রতিটি মানবের জীবনের লক্ষ্য।]
স্বর্গং প্রয়াতি চ ততো ভবতীপ্রসাদাল্লোকত্রয়েঽপি ফলদা ননু
দেবি তেন।। ১৫
[ধর্মাণি দেবি সকলানি সদা এব কর্মাণি ইতি আদৃতাঃ প্রতিদিনম্ সুকৃতী
করোতি।
স্বর্গম্ প্রয়াতি চ ততঃ ভবতী-প্রসাদাৎ লোকত্রয়ে অপি ফলদা ননু দেবি
তেন।। ১৫]
হে দেবি, যে সকল মানুষ সর্বদা ধর্ম আচরণ করে, প্রতিদিন অত্যন্ত
শ্রদ্ধার সঙ্গে পুণ্যকর্ম করে, আপনার প্রসাদে তাঁরাই স্বর্গ এমনকি ত্রিলোকও লাভ
করতে পারে। অতএব হে দেবি, নিঃসন্দেহে
আপনিই ফলদায়িনী।
দারিদ্র্যদুঃখভয়হারিণি কা ত্বদন্যা সর্বোপকারকরণায়
সদার্দ্রচিত্তা।। ১৬
[দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিম্ অশেষ-জন্তোঃ স্বস্থৈঃ স্মৃতা মতিম্ অতীব
শুভাং দদাসি।
দারিদ্র্য-দুঃখ-ভয়-হারিণি কা ত্বৎ-অন্যা সর্বঃ-উপকার-করণায়
সদা-আর্দ্র-চিত্তা।। ১৬]
সঙ্কটে আপনাকে স্মরণ করলে, সকল জীবের ভয় বা বিপদ আপনি হরণ করেন।
স্থিতধী ব্যক্তিগণ আপনাকে স্মরণ করলে আপনি তাঁদের চিত্তে অতীব শুভচিন্তা দান করেন।
হে দারিদ্র-দুঃখ-ভয়হারিণি, সকলের উপকার করার জন্যে আপনার মতো সদা সদয়-চিত্তা আর কে
আছেন?
এভির্হতৈর্জগদুপৈতি সুখং তথৈতে কুর্বন্তু নাম নরকায় চিরায় পাপম্।
সংগ্রামমৃত্যুমধিগম্য দিবিং প্রয়ান্তু মত্বেতি নূনমহিতান্
বিনিহংসি দেবি।। ১৭
[এভিঃ হতৈঃ জগৎ উপৈতি সুখম্ তথা এতে কুর্বন্তু নাম নরকায় চিরায় পাপম্।
সংগ্রাম-মৃত্যুম্ -অধিগম্য দিবিম্ প্রয়ান্তু মত্বা ইতি নূনম্
অহিতান্ বিনিহংসি দেবি।। ১৭]
হে দেবি, এরা (অসুরেরা) নিহত হলে জগতে সুখ বিরাজ করবে এবং চিরকাল
নরকবাসের মতো পাপ করে থাকলেও, সংগ্রামে মৃত্যু ঘটলে তারা দিব্যলোকে যাবে –
নিঃসন্দেহে এমন চিন্তা করেই আপনি এই অহিতকারীদের বিনাশ ঘটিয়েছেন।
দৃষ্ট্বৈব কিং ন ভবতী প্রকরোতি ভস্ম সর্বাসুরানরিষু যৎ প্রহিণোষি শস্ত্রম্।
লোকান প্রয়ান্তু রিপবোঽপি হি শস্ত্রপূতাঃ ইত্থং মতির্ভবতি
তেষ্বপি তেঽতিসাধ্বী।। ১৮
[দৃষ্ট্বা এব কিম ন ভবতী প্রকরোতি ভস্ম সর্ব-অসুরান্ অরিষু যৎ
প্রহিণোষি শস্ত্রম্।
লোকান প্রয়ান্তু রিপবোঃ অপি হি শস্ত্রপূতাঃ ইত্থম্ মতিঃ ভবতি তেষু অপি
তে অতিসাধ্বী।। ১৮]
হে দেবি, আপনি কি দৃষ্টিপাতেই সকল অসুরকে ভস্ম করতে পারেন না? তবুও
শস্ত্রের আঘাতেই আপনি শত্রুদের নিহত করেছেন, যাতে শস্ত্রের আঘাতে পাপমুক্ত হয়ে
তারা উত্তম-লোকে যেতে পারে – নিঃসন্দেহে এ আপনার অতি উদার অনুগ্রহের ইচ্ছা।
খড়্গপ্রভানিকরবিস্ফুরণৈস্তথোগ্রৈঃ শূলাগ্রকান্তিনিবহেন
দৃশোঽসুরাণাম্।
যন্নাগতা বিলয়মংশুমদিন্দুখণ্ডযোগ্যাননং তব বিলোকয়তাং
তদেতৎ।। ১৯
[খড়্গ-প্রভা-নিকর-বিস্ফুরণৈঃ তথা উগ্রৈঃ শূল-অগ্র-কান্তি-নিবহেন দৃশঃ
অসুরাণাম্।
যৎ ন আগতাঃ বিলয়ম্ অংশুমৎ ইন্দু-খণ্ড-যোগ্য-আননম্ তব বিলোকয়তাম্ তৎ
এতৎ।। ১৯]
আপনার খড়্গের প্রভাকিরণের এবং শূলের অগ্রভাগের ঔজ্জ্বল্যের ঝলকানিতে,
অসুরদের দৃষ্টি যে নষ্ট হয়নি, তার কারণ তারা আপনার চন্দ্রকলা তুল্য জ্যোতির্ময় মুখ
দেখছিল।
বীর্যঞ্চ হন্তৃ হৃতদেবপরাক্রমাণাং বৈরিষ্বপি প্রকটিতৈব দয়া
ত্বয়েত্থম্।। ২০
[দুর্বৃত্ত-বৃত্ত-শমনম্ তব দেবি শীলম্ রূপম্ তথা এতৎ অবিচিন্ত্যম্
অতুল্যম্ অন্যৈঃ।
বীর্যম্ চ হন্তৃ হৃত-দেব-পরাক্রমাণাম্ বৈরিষু অপি প্রকটিত এব দয়া
ত্বয়া ইত্থম্।। ২০]
হে দেবি, দুর্বৃত্তদের প্রবৃত্তি দমন করাই আপনার স্বভাব, আপনার রূপও
অন্য সবার থেকে অতুলনীয় ও অবর্ণনীয়, বীর্যে আপনি দেব-পরাক্রম-বিনাশী শত্রুদের
হন্তারক। অতএব শত্রুদের প্রতি একমাত্র আপনিই এমন করুণা প্রকাশ করতে পারেন।
চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্ট্বা ত্বয্যেব দেবি বরদে
ভুবনত্রয়েঽপি।। ২১
[কেন উপমা ভবতু তে অস্য পরাক্রমস্য রূপম্ চ শত্রু-ভয়-কার অতিহারি
কুত্র।
চিত্তে কৃপা সমর-নিষ্ঠুরতা চ দৃষ্ট্বা ত্বয়ি এব দেবি বরদে ভুবন-ত্রয়ে
অপি।। ২১]
হে দেবি, আপনার এই পরাক্রমের সঙ্গে কার তুলনা হতে পারে? শত্রুর ভীতিজনক অথচ এমন মনোরম রূপই বা আর কার আছে? হে বরদে, আপনার হৃদয়ে একদিকে যেমন কৃপা অন্যদিকে তেমন যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা – ত্রিভুবনে একমাত্র আপনাতেই এমন দেখা যায়।
ত্রৈলোক্যমেতদখিলং রিপুনাশনেন ত্রাতং ত্বয়া সমরমূর্ধনি
তেঽপি হত্বা।
নীতা দিবং রিপুগণা ভয়মপ্যপাস্তমস্মাকমুন্মদসুরারিভবং
নমস্তে।। ২২
[ত্রৈলোক্যম্ এতৎ অখিলম্ রিপু-নাশনেন ত্রাতম্ ত্বয়া সমরমূর্ধনি তে
অপি হত্বা।
নীতা দিবম্ রিপুগণাঃ ভয়ম্ অপি অপাস্তম্ অস্মাকম্ উন্মদ-সুর-অরি
ভবম্ নমঃ তে।। ২২]
হে দেবি, আপনি এই শত্রুনাশ করে অখিল ত্রিলোকের ত্রাণ করলেন। রণক্ষেত্রে যারা নিহত হল, সেই শত্রুদেরও দিব্যলোক প্রাপ্তি হল, আর উন্মত্ত দেবারিদের থেকে আমাদের ভয়ও দূর করলেন। আপনাকে প্রণাম।
শূলেন পাহি নো দেবি পাহি খড়্গেন চাম্বিকে।
ঘণ্টাস্বনেন নঃ পাহি চাপজ্যানিঃস্বনেন চ।। ২৩
প্রাচ্যাং রক্ষ প্রতীচ্যাঞ্চ চণ্ডিকে রক্ষ দক্ষিণে।
ভ্রামণেনাত্মশূলস্য চোত্তরস্যাং তথেশ্বরি।। ২৪
সৌম্যানি যানি রূপাণি ত্রৈলোক্যে বিচরন্তি তে।
যানি চাত্যন্তঘোরাণি তৈ রক্ষাস্মাংস্তথা ভুবম্।। ২৫
খড়্গশূলগদাদীনি যানি চাস্ত্রাণি তেঽম্বিকে।
করপল্লবসঙ্গীনি তৈরস্মান্ রক্ষ সর্বতঃ।। ২৬
[শূলেন পাহি নঃ দেবি পাহি খড়্গেন চা অম্বিকে। ঘণ্টা-স্বনেন নঃ পাহি
চাপ-জ্যা-নিঃস্বনেন চ।। ২৩
প্রাচ্যাম্ রক্ষ প্রতীচ্যাম্ চ চণ্ডিকে রক্ষ দক্ষিণে। ভ্রামণেন
আত্ম-শূলস্য চ উত্তরস্যাম্ তথা ঈশ্বরি।। ২৪
সৌম্যানি যানি রূপাণি ত্রৈলোক্যে বিচরন্তি তে। যানি চ অত্যন্ত-ঘোরাণি তৈঃ রক্ষ অস্মান্ তথা ভুবম্।। ২৫
খড়্গ-শূল-গদাদীনি যানি চ অস্ত্রাণি তে অম্বিকে। কর-পল্লব-সঙ্গীনি তৈঃ অস্মান্ রক্ষ সর্বতঃ।। ২৬]
হে দেবি, আপনি আমাদের শূল ও খড়্গ দিয়ে রক্ষা করুন। হে অম্বিকে,
ঘণ্টাধ্বনি এবং ধনুকের টংকার ধ্বনিতে রক্ষা করুন। হে চণ্ডিকে, হে ইশ্বরি, আপনি
আপনার শূল চালনা করে পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তরদিকও রক্ষা করুন। আপনি যে সৌম্য এবং অত্যন্ত করাল রূপে ত্রিলোকে
বিরাজ করছেন, সেইভাবেই আমাদের এবং এই বিশ্বকে রক্ষা করুন। হে অম্বিকে, আপনার
করকমলে ধৃত শূল, খড়্গ, গদা প্রভৃতি যত অস্ত্র আছে, তাই দিয়ে আমাদের সর্বত্র রক্ষা
করুন।
[দেবী ত্রিলোকে সৃষ্টি-স্থিতির জন্য সৌম্যরূপ এবং সংহারের জন্য করালরূপ ধারণ করেন, অর্থাৎ তিনিই এই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়কারিণী।]
ঋষিরুবাচ।
এবং স্তুতা সুরৈর্দিব্যৈঃ কুসুমৈর্নন্দনোদ্ভবৈঃ।
অর্চিতা জগতাং ধাত্রী তথা গন্ধানুলেপনৈঃ।। ২৭
ভক্ত্যা সমস্তৈস্ত্রিদশৈর্দিব্যৈর্ধূপৈঃ সুধূপিতা।
প্রাহ প্রসাদসুমুখী সমস্তান্ প্রণতান্ সুরান্।। ২৮
[ঋষিঃ উবাচ। এবম্ স্তুতা সুরৈঃ দিব্যৈঃ কুসুমৈঃ নন্দন-উদ্ভবৈঃ।
অর্চিতা জগতাম্ ধাত্রী তথা গন্ধা-অনুলেপনৈঃ।। ২৭
ভক্ত্যা সমস্তৈঃ ত্রিদশৈঃ দিব্যৈঃ ধূপৈঃ সুধূপিতা। প্রাহ প্রসাদ-সুমুখী
সমস্তান্ প্রণতান্ সুরান্।। ২৮]
মেধস ঋষি বললেন। এইভাবেই দেবতারা দেবী জগদ্ধাত্রী (জগতের ধাত্রী)-র স্তব করলেন। তারপর নন্দনকাননে উদ্ভূত দিব্য কুসুম (পারিজাত), সুগন্ধী-অঙ্গরাগ (চন্দন, কুঙ্কুম ইত্যাদি), দিব্য ধূপে তাঁকে সুরভিত করে, সকল দেবতারা পরম ভক্তিভরে দেবীর অর্চনা করলেন। তখন সমস্ত প্রণত দেবতাদের প্রতি প্রসন্ন-সুন্দর মুখে দেবী বললেন।
দেব্যুবাচ।
ব্রিয়তাং ত্রিদশাঃ সর্বে যৎ অস্মত্তোঽভিবাঞ্ছিতম্।
দদাম্যহমতিপ্রীত্যা স্তবৈরেভিঃ সুপূজিতা।। ২৯
[দেবী উবাচ।
ব্রিয়তাম্ ত্রিদশাঃ সর্বে যৎ অস্মত্তঃ অভিবাঞ্ছিতম্। দদামি অহম্
অতিপ্রীত্যা স্তবৈঃ এভিঃ সুপূজিতা।। ২৯]
দেবী বললেন। হে দেবগণ, তোমাদের যা কিছু বাঞ্ছনীয় আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি প্রদান করব; তোমাদের স্তবে ও ভক্তি-পূজায় আমি অত্যন্ত প্রসন্না হয়েছি।
দেবা ঊচুঃ।
ভগবত্যা কৃতং সর্বং ন কিঞ্চিদবশিষ্যতে।
যদয়ং নিহতঃ শত্রুরস্মাকং মহিষাসুরঃ।। ৩০
যদি বাপি বরো দেয়স্ত্বয়াস্মাকং মহেশ্বরি।
সংস্মৃতা সংস্মৃতা ত্বং নো হিংসেথা পরমাপদঃ।। ৩১
যশ্চ মর্ত্যঃ স্তবৈরেভিস্ত্বাং স্তোষ্যত্যমলাননে।
তস্য বিত্তর্দ্ধিবিভবৈর্ধনদারাদিসম্পদাম্।
বৃদ্ধয়েঽস্মৎপ্রসন্না ত্বং ভবেথাঃ সর্বদাম্বিকে।। ৩২
[দেবা ঊচুঃ।
ভগবত্যা কৃতম্ সর্বম্ ন কিঞ্চিৎ অবশিষ্যতে। যৎ অয়ম্ নিহতঃ শত্রুঃ
অস্মাকম্ মহিষাসুরঃ।। ৩০
যদি ব অপি বরঃ দেয়ঃ ত্বয়া অস্মাকম্ মহেশ্বরি। সংস্মৃতা সংস্মৃতা ত্বং
নঃ হিংসেথাঃ পরম-আপদঃ।। ৩১
যঃ চ মর্ত্যঃ স্তবৈঃ এভিঃ ত্বাম্ স্তোষ্যতি অমল-আননে। তস্য
বিত্ত-ঋদ্ধি-বিভবৈঃ ধন-দারাদি-সম্পদাম্। বৃদ্ধয়ে অস্মৎ-প্রসন্না ত্বম্ ভবেথাঃ
সর্বদা অম্বিকে।। ৩২]
দেবতারা বললেন। হে ভগবতি, আমাদের শত্রু মহিষাসুরকে আপনি যখন বধ করেছেন, তখনই আপনি সব করেছেন, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। হে মহেশ্বরি, তার পরেও আপনার দেওয়ার মত বর হল, যখনই আপনাকে আমরা স্মরণ করব, আমাদের মহা-বিপদসমূহের বিনাশ করবেন। আমাদের এই স্তবে আপনি যখন প্রসন্না হয়েছেন, হে অম্বিকে, মর্ত্যের মানুষ এই স্তবে আপনার স্তুতি করলে, তাদের সর্বদাই প্রভাব, সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, ধন-সম্পদ, দারা-পুত্রাদির বৃদ্ধির কারণ হবেন।
ঋষিরুবাচ।
ইতি প্রসাদিতা দেবৈর্জগতোঽর্থে তথাত্মনঃ।
তথেত্যুক্তা ভদ্রকালী বভূবান্তর্হিতা নৃপ।। ৩৩
ইত্যেতৎ কথিতং ভূপ সম্ভূতা সা যথা পুরা।
দেবী দেবশরীরেভ্যো জগত্ত্রয়হিতৈষিণী।। ৩৪
পুনশ্চ গৌরীদেহা সা সমুদ্ভূতা যথাভবৎ।
বধায় দুষ্টদৈত্যানাং তথা শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ৩৫
রক্ষণায় চ লোকানাং দেবানামুপকারিণী।
তচ্ছৃণুষ্ব ময়াখ্যাতং যথাবৎ কথয়ামি তে।। ৩৬
[ঋষিঃ উবাচ।
ইতি প্রসাদিতা দেবৈঃ জগতঃ অর্থে তথা-আত্মনঃ। তথা ইতি উক্তা ভদ্রকালী
বভূব অন্তর্হিতা নৃপ।। ৩৩
ইতি এতৎ কথিতম্ ভূপ সম্ভূতা সা যথা পুরা। দেবী দেবশরীরেভ্যঃ
জগৎ-ত্রয়-হিতৈষিণী।। ৩৪
পুনশ্চ গৌরীদেহা সা সমুদ্ভূতা যথা অভবৎ। বধায় দুষ্ট-দৈত্যানাম্ তথা
শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ।। ৩৫
রক্ষণায় চ লোকানাম্ দেবানাম্-উপকারিণী। তৎ শৃণুষ্ব ময়া আখ্যাতম্
যথাবৎ কথয়ামি তে।। ৩৬]
ঋষি বললেন। হে নৃপ, দেবতাদের নিজেদের ও জগতের মঙ্গলের জন্য, দেবতাদের
প্রতি প্রসন্না দেবী ভদ্রকালী, “তাই হোক” বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। হে রাজন্,
পুরাকালে দেবতাদের শরীর থেকে উদ্ভূতা ত্রিজগতের হিতৈষিণী সেই দেবীর কাহিনী আপনাকে
বললাম। লোকসকল ও দেবতাদের উপকারিণী সেই দেবী গৌরীদেহে আবার আবির্ভূতা হয়েছিলেন,
দুষ্ট দুই দৈত্য শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করার জন্য। সে কথাও আমি বর্ণনা করছি, শুনুন।
ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে
সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবী মাহাত্ম্যে শক্রাদিকৃতদেবীস্তুতি
নাম চতুর্থঽধ্যায়ঃ।
শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে
শক্রাদিকৃত দেবীস্তুতি নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত।
মহিষাসুর বধেই দেবীর কাজ সমাপ্ত হয়নি, কারণ মহিষাসুর ছাড়াও সে সময় অনেকানেক অসুর সাংঘাতিক সব পাপকর্মে লিপ্ত ছিল। কাজেই দেবী চণ্ডিকাকে আবার আবির্ভূতা হয়ে তাদেরও নিধন করতে হয়েছিল। উত্তর চরিতে আমরা সেই সকল ঘটনার বিবরণ পাব।
উত্তর
চরিত
পঞ্চম
অধ্যায় – দেবীদূত সংবাদ।
(ওঁ ঐঁ) ঋষিরুবাচ।
পুরা
শুম্ভনিশুম্ভাভ্যামসুরাভ্যাং শচীপতেঃ।
ত্রৈলোক্যং
যজ্ঞভাগাশ্চ হৃতা মদবলাশ্রয়ঃ।। ১
তাবেব
সূর্যতাং তদ্বদধিকারং তথৈন্দবম্।
কৌবেরমথ
যাম্যঞ্চ চক্রাতে বরুণস্য চ।। ২
তাবেব
পবনর্দ্ধিঞ্চ চক্রতুর্বহ্নিকর্ম চ।
ততো দেবা
বিনির্ধূতা ভ্রষ্টরাজ্যা পরাজিতাঃ।। ৩
(ওঁ ঐঁ) ঋষিঃ উবাচ।
পুরা শুম্ভ-নিশুম্ভাভ্যাম্ অসুরাভ্যাম্
শচীপতেঃ। ত্রৈলোক্যম্ যজ্ঞভাগাঃ চ হৃতা মদ-বল-আশ্রয়ঃ।। ১
তৌ এব সূর্যতাম্ তৎবৎ অধিকারং তথা ঐন্দবম্।
কৌবেরম্ অথ যাম্যম্ চ চক্রাতে বরুণস্য চ।। ২
তৌ এব পবন-ঋদ্ধিম্ চ চক্রতুঃ বহ্নি-কর্ম চ।
ততঃ দেবাঃ বিনির্ধূতাঃ ভ্রষ্ট-রাজ্যাঃ পরাজিতাঃ।। ৩
(ওঁ ঐঁ) ঋষি বললেন। পুরাকালে শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুর অহংকার ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে, দেবরাজ শচীপতির অধিকার থেকে ত্রিলোক এবং যজ্ঞভাগ হরণ করেছিল। ওই দুই অসুর সূর্য এবং চন্দ্রের, কুবের, যম ও বরুণেরও, যাঁর যেমন অধিকার, সব হরণ করেছিল। তারা দুজনে পবনের ঋদ্ধি (মেঘবহন ও বৃষ্টিপাত) এবং অগ্নির কর্ম সকলও অধিকার করল। অতএব রাজ্যচ্যুত ও পরাজিত দেবতারা অধিকারহীন হয়ে পড়লেন।
হৃতাধিকারাস্ত্রিদশাস্তাভ্যাং
সর্বে নিরাকৃতাঃ।
মহাসুরাভ্যাং
তাং দেবীং সংস্মরন্ত্যপরাজিতাম্।। ৪
তয়াস্মাকং
বরো দত্তো যথাপৎসু স্মৃতাখিলা।
ভবতাং
নাশয়িষ্যামি তৎক্ষণাৎ পরমাপদঃ।। ৫
ইতি
কৃত্বা মতিং দেবা হিমবন্তং নগেশ্বরম্।
জগ্মুস্তত্র
ততো দেবীং বিষ্ণুমায়াং প্রতুষ্টুবুঃ।। ৬
[হৃত-অধিকারাঃ ত্রিদশাঃ তাভ্যাম্ সর্বে
নিরাকৃতাঃ। মহাসুরাভ্যাম্ তাম্ দেবীম্ সংস্মরন্তি-অপরাজিতাম্।। ৪
তয়া অস্মাকম্ বরঃ দত্তঃ যথা আপৎসু স্মৃতা
অখিলা। ভবতাং নাশয়িষ্যামি তৎক্ষণাৎ পরম-আপদঃ।। ৫
ইতি কৃত্বা মতিম্ দেবাঃ হিমবন্তম্ নগেশ্বরম্।
জগ্মুঃ তত্র ততঃ দেবীম্ বিষ্ণুমায়াম্ প্রতুষ্টুবুঃ।। ৬]
দুই অসুরের হাতে নিজ নিজ অধিকার হারিয়ে এবং স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে, দেবতারা সেই অপরাজিতা দেবীকে সম্যক্-স্মরণ করলেন। সেই দেবী আমাদের বর দিয়েছিলেন, “তোমরা যখন যা কিছু বিপদে পড়বে, আমাকে স্মরণ করলেই তৎক্ষণাৎ সেই পরম-আপদ আমি নাশ করব”। এই কথা মনে করে দেবতারা গিরিরাজ হিমালয়ে গিয়ে, বিষ্ণু-শক্তি মহামায়া-দেবীর স্তব শুরু করলেন।
দেবা ঊচুঃ।
(ওঁ ঐঁ)
নমো দেব্যৈ মহাদেব্যৈ শিবায়ৈসততং নমঃ।
নমঃ প্রকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্।।
৭
রোদ্রায়ৈ
নমো নিত্যায়ৈ গৌর্যৈ ধাত্রৈ নমো নমঃ।
জ্যোৎস্নায়ৈ
চেন্দুরূপিণ্যৈ সুখায়ৈ সততং নমঃ।। ৮
কল্যাণ্যৈ
প্রণতা বৃদ্ধ্যৈ সিদ্ধ্যৈ কুর্মো নমো নমঃ।
নৈর্ঋত্যৈ
ভূভৃতাং লক্ষ্ম্যৈ শর্বাণ্যৈ তে নমো নমঃ।। ৯
[দেবা ঊচুঃ। (ওঁ ঐঁ) নমঃ দেব্যৈ মহাদেব্যৈ
শিবায়ৈ সততম্ নমঃ। নমঃ প্রকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্।। ৭
রোদ্রায়ৈ নমঃ নিত্যায়ৈ গৌর্যৈ ধাত্রৈ নমঃ নমঃ।
জ্যোৎস্নায়ৈ চ ইন্দুরূপিণ্যৈ সুখায়ৈ সততম্ নমঃ।। ৮
কল্যাণ্যৈ প্রণতা বৃদ্ধ্যৈ সিদ্ধ্যৈ কুর্মঃ
নমো নমঃ। নৈর্ঋত্যৈ ভূভৃতাম্ লক্ষ্ম্যৈ শর্বাণ্যৈ তে নমঃ নমঃ।। ৯]
দেবতারা বললেন। দেবীকে, মহাদেবী শিবাকে প্রণাম করি। সতত মঙ্গলদায়িনীকে প্রণাম করি। প্রকৃতিরূপিণী ও স্থিতিকারিণী দেবী ভদ্রাকে প্রণাম করি। আমরা নিয়ত বারবার তাঁকে প্রণাম করি। তাঁর রুদ্র-শক্তিকে, তাঁর নিত্যস্বরূপকে ও গৌরবর্ণা ধাত্রীদেবীকে বারবার প্রণাম করি। জ্যোৎস্নারূপিণী, চন্দ্ররূপিণী এবং আনন্দময়ী দেবীকে সর্বদা প্রণাম করি। তাঁর কল্যাণীরূপকে প্রণাম করি, তাঁর বৃদ্ধি ও সিদ্ধি-রূপকে বারবার প্রণাম করি। অলক্ষ্মীরূপে, নৃপতিদের লক্ষ্মীরূপে, হে শর্বাণি, আপনাকে বারবার প্রণাম করি।
দুর্গায়ৈ
দুর্গপারায়ৈ সারায়ৈ সর্বকারিণ্যৈ।
খ্যাত্যৈ
তথৈব কৃষ্ণায়ৈ ধূম্রায়ৈ সততং নমঃ।। ১০
অতিসৌম্যাতিরৌদ্রায়ৈ
নতাস্তস্যৈ নমো নমঃ।
নমো
জগৎপ্রতিষ্ঠায়ৈ দেব্যৈ কৃত্যৈ নমো নমঃ।। ১১
[দুর্গায়ৈ দুর্গপারায়ৈ সারায়ৈ সর্বকারিণ্যৈ।
খ্যাত্যৈ তথা এব কৃষ্ণায়ৈ ধূম্রায়ৈ সততং নমঃ।। ১০
অতিসৌম্য-অতিরৌদ্রায়ৈ নতাঃ
তস্যৈ নমঃ নমঃ। নমঃ জগৎপ্রতিষ্ঠায়ৈ দেব্যৈ কৃত্যৈ নমঃ নমঃ।। ১১
দুরধিগম্যা-দুর্গা,
দুস্তর-সংসার-পারকারিণী, শক্তিরূপিণী, সর্বসৃষ্টিকারিণীকে সর্বদা প্রণাম।
খ্যাতি*রূপিণী এবং কৃষ্ণবর্ণা ও ধূম্রবর্ণা দুর্গাকে প্রণাম। অতিসৌম্য অর্থাৎ
বিদ্যারূপে, অতিরৌদ্র অর্থাৎ অবিদ্যারূপে তাঁকে বারবার প্রণাম। জগতের
প্রতিষ্ঠাকারিণী দেবীকে বার বার প্রণাম করি।
[*খ্যাতি – নির্বিকার-ব্রহ্ম-পরমপুরুষ প্রকৃতির সাহায্যে জগতের সৃষ্টি-স্থিতি ও লয় কার্য নিষ্পন্ন করেন। এই প্রকৃতিই মহামায়া। প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদরূপকেই দর্শন তত্ত্বে খ্যাতি বলা হয়েছে।]
যা দেবী
সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১২
যা দেবী
সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১৩
যা দেবী
সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১৪
যা দেবী
সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১৫
যে দেবী সকল জীবে বিষ্ণুমায়া শব্দে প্রসিদ্ধা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার। যে দেবী সকল জীবে চেতনা-স্বরূপে প্রসিদ্ধা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে বুদ্ধি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে নিদ্রা-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি।
যা দেবী
সর্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১৬
যা দেবী
সর্বভূতেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১৭
যা দেবী
সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১৮
যা দেবী
সর্বভূতেষু তৃষ্ণারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ১৯
যা দেবী
সর্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২০
যে দেবী সকল জীবে ক্ষুধা-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে ছায়া-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে শক্তি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে তৃষ্ণা-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে ক্ষান্তি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি।
যা দেবী
সর্বভূতেষু জাতিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২১
যা দেবী
সর্বভূতেষু লজ্জারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২২
যা দেবী
সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২৩
যা দেবী
সর্বভূতেষু শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২৪
যা দেবী
সর্বভূতেষু কান্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২৫
যে দেবী সকল জীবে জাতি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে লজ্জা-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে শান্তি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে শ্রদ্ধা-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে কান্তি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি।
যা দেবী
সর্বভূতেষু লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২৬
যা দেবী
সর্বভূতেষু বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২৭
যা দেবী
সর্বভূতেষু স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২৮
যা দেবী
সর্বভূতেষু দয়ারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ২৯
যা দেবী
সর্বভূতেষু তুষ্টিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ৩০
যা দেবী
সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ৩১
যা দেবী
সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ৩২
যে দেবী সকল জীবে লক্ষ্মী-রূপে অবস্থিতা,
তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে বৃত্তি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে
বারবার বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে স্মৃতি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার
বারবার নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে দয়া-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার
নমস্কার করি। যে দেবী সকল জীবে তুষ্টি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার
করি। যে দেবী সকল জীবে মাতৃ-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি। যে
দেবী সকল জীবে ভ্রান্তি-রূপে অবস্থিতা, তাঁকে বারবার বারবার নমস্কার করি।
ইন্দ্রিয়াণামধিষ্ঠাত্রী
ভূতানাঞ্চাখিলেষু যা।
ভূতেষু
সততং তস্যৈ ব্যাপ্তিদেব্যৈ নমো নমঃ।। ৩৩
চিতিরূপেণ
যা কৃৎস্নমেতদ্ ব্যাপ্য স্থিতা জগৎ।
নমস্তস্যৈ
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ৩৪
[ইন্দ্রিয়াণাম্ অধিষ্ঠাত্রী ভূতানাম্ চ
অখিলেষু যা। ভূতেষু সততম্ তস্যৈ ব্যাপ্তি-দেব্যৈ নমঃ নমঃ।। ৩৩
চিতিরূপেণ যা কৃৎস্নম্ এতৎ ব্যাপ্য স্থিতা
জগৎ। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।। ৩৪]
যিনি অখিল জীবের ইন্দ্রিয়সমূহের অধিষ্ঠাত্রী,
সর্ব ভূতের মধ্যে যে দেবী সর্বদা ব্যাপ্ত থাকেন তাঁকে বারবার প্রণাম। যিনি
চিৎ-শক্তি রূপে (চেতনা-শক্তি) সমগ্র জগতেই ব্যাপ্ত, সেই দেবীকে বারবার প্রণাম করি।
স্তুতা
সুরৈঃ পূর্বমভীষ্টসংশ্রয়াৎ তথা সুরেন্দ্রেণ দিনেষু সেবিতা।
করোতু সা
নঃ শুভহেতুরীশ্বরী শুভানি ভদ্রাণ্যভিহন্তু চাপদঃ।। ৩৫
যা
সাম্প্রতং চোদ্ধতদৈত্যতাপিতৈরস্মাভিরীশা চ সুরৈর্নমস্যতে।
যা চ
স্মৃতা তৎক্ষণমেব হন্তি নঃ সর্বাপদো ভক্তিবিনম্রমূর্তিভিঃ।। ৩৬
[স্তুতা সুরৈঃ পূর্বম্ অভীষ্ট-সংশ্রয়াৎ তথা
সুরেন্দ্রেণ দিনেষু সেবিতা। করোতু সা নঃ শুভ-হেতুঃ-ঈশ্বরী শুভানি ভদ্রাণি অভিহন্তু
চ আপদঃ।। ৩৫
যা সাম্প্রতম্ চ উদ্ধত-দৈত্য-তাপিতৈঃ
অস্মাভিঃ ঈশা চ সুরৈঃ নমস্যতে। যা চ স্মৃতা তৎক্ষণম্ এব হন্তি নঃ সর্ব-আপদঃ
ভক্তি-বিনম্র-মূর্তিভিঃ।। ৩৬]
দেবতারা আগে যাঁর স্তব করেছিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র (মহিষাসুর-বধরূপ) অভীষ্ট-পূরণের জন্যে প্রতিদিন যাঁকে পূজা করেছেন, সেই শুভকারিকা ঈশ্বরী আমাদের আপদ বিনাশ করে কল্যাণ করুন। সম্প্রতি উদ্ধত দুই দৈত্য দেবতাদের পীড়িত করায়, আমরা ভক্তি-বিনম্র-চিত্তে সেই ঈশ্বরীর স্মরণে স্তুতি করছি, যিনি এখনই আমাদের সকল আপদের বিনাশ করতে পারবেন।
ঋষিরুবাচ।
এবং
স্তবাদিযুক্তানাং দেবানাং তত্র পার্বতী।
স্নাতুমভ্যাযযৌ
তোয়ে জাহ্নব্যা নৃপনন্দন।। ৩৭
সাব্রবীত্তান্
সুরান্ সুভ্রূর্ভব্দভিঃ স্তূয়তেঽত্র কা।
শরীরকোষতশ্চাস্যাঃ
সমুদ্ভূতাহব্রবীচ্ছিবা।। ৩৮
[ঋষিরুবাচ।
এবম্ স্তবাদি-যুক্তানাম্
দেবানাম্ তত্র পার্বতী। স্নাতুম্ অভ্যাযযৌ তোয়ে জাহ্নব্যা নৃপনন্দন।। ৩৭
সা অব্রবীৎ তান্ সুরান্
সুভ্রূঃ ভব্দভিঃ স্তূয়তে অত্র কা। শরীর-কোষতঃ চ অস্যাঃ সমুদ্ভূতা অব্রবীৎ শিবা।।
৩৮]
ঋষি বললেন। হে নৃপপুত্র
সুরথ, দেবতারা যখন এইভাবে দেবীর স্তবে নিযুক্ত রয়েছেন, তখন সেখানে উপস্থিত হলেন
পার্বতী। তিনি জাহ্নবীর জলে স্নান করতে এসেছিলেন। সেই সুচারু-ভ্রূ দেবী দেবতাদের
বললেন, “আপনারা এখন কার স্তব করছেন?” তখন তাঁর (দেবী পার্বতীর) দেহকোষ থেকে শিবা
আবির্ভূতা হয়ে বললেন।
স্তোত্রং
মমৈতৎ ক্রিয়তে শুম্ভদৈত্যনিরাকৃতৈঃ।
দেবৈঃ
সমেতৈঃ সমরে নিশুম্ভেন পরাজিতৈঃ।। ৩৯
শরীরকোষাৎ
যত্তস্যাঃ পার্বত্যা নিঃসৃতাম্বিকা।
কৌশিকীতি
সমস্তেষু ততো লোকেষু গীয়তে।। ৪০
[স্তোত্রম্ মম এতৎ
ক্রিয়তে শুম্ভ-দৈত্য-নিরাকৃতৈঃ। দেবৈঃ সমেতৈঃ সমরে নিশুম্ভেন পরাজিতৈঃ।। ৩৯
শরীর-কোষাৎ যৎ তস্যাঃ
পার্বত্যা নিঃসৃতা-অম্বিকা। কৌশিকী ইতি সমস্তেষু ততঃ লোকেষু গীয়তে।। ৪০]
(দেবী শিবা বললেন) “দৈত্য
শুম্ভ দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করায় এবং দৈত্য নিশুম্ভর হাতে দেবতাদের পরাজয়
হওয়ায়, দেবতারা সমবেত হয়ে আমারই স্তোত্র বলছেন”। দেবী পার্বতীর দেহকোষ থেকে এই
দেবী অম্বিকার আবির্ভাব হওয়ায়, সমস্ত লোকে তিনি “কৌশিকী” নামে পরিচিতা হলেন।
[শুম্ভ-নিশুম্ভ দুই দৈত্যভাই কঠোর তপস্যায় ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে, এই বর পেয়েছিলেন যে, তাঁরা দুজনেই দেব কিংবা মানব উভয়ের অবধ্য হবেন। কিন্তু পুরুষের সংস্পর্শরহিত কোন অনুপমা নারীর প্রতি আসক্তিবশতঃ, তাঁদের দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হবে। সেই ভ্রাতৃবিবাদেই মৃত্যু হবে দুই দৈত্যের। সেই সময় তাঁরা ভ্রাতৃবিরোধের কথা স্বপ্নেও চিন্তা করেননি। কিন্তু পরবর্তী কালে কী ঘটেছিল, সে দিকে এবার চোখ রাখা যাক।]
তস্যাং
বিনির্গতায়ান্তু কৃষ্ণাভূৎ সাপি পার্বতী।
কালিকেতি
সমাখ্যাতা হিমাচলকৃতাশ্রয়া।। ৪১
ততোঽম্বিকাং
পরং রূপং বিভ্রাণাং সুমনোহরম্।
দদর্শ
চণ্ডো মুণ্ডশ্চ ভৃত্যৌ শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ৪২
[তস্যাম্ বিনির্গতায়াম্
তু কৃষ্ণা অভূৎ স অপি পার্বতী। কালিকা ইতি সমাখ্যাতা হিমাচল-কৃত-আশ্রয়া।। ৪১
ততঃ অম্বিকাম্ পরম্
রূপম্ বিভ্রাণাম্ সুমনোহরম্। দদর্শ চণ্ডঃ মুণ্ডঃ চ ভৃত্যৌ শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ।।
৪২]
(দেহ থেকে) তাঁর (দেবী কৌশিকীর) নির্গমনের পরেই পার্বতী দেবী কৃষ্ণাবর্ণা হয়ে, হিমালয়েই বাস করতে লাগলেন এবং কালিকা নামে প্রসিদ্ধা হলেন। ওদিকে শুম্ভ ও নিশুম্ভের দুই অনুচর চণ্ড ও মুণ্ড, অতি মনোহর রূপধারিণী দেবী অম্বিকাকে দেখত পেল।
তাভ্যাং শুম্ভায় চাখ্যাতা সাতীব সুমনোহরা।
কাপ্যস্তে
স্ত্রী মহারাজ ভাসয়ন্তী হিমাচলম্।। ৪৩
নৈব
তাদৃক ক্কচিদ্রূপং দৃষ্টং কেনচিদুত্তমম্।
জ্ঞায়তাং
কাপ্যসৌ দেবী গৃহ্যতাঞ্চাসুরেশ্বর।। ৪৪
[তাভ্যাম্ শুম্ভায় চ
আখ্যাতা সা অতীব সুমনোহরা। কা অপি আস্তে স্ত্রী মহারাজ ভাসয়ন্তী হিমাচলম্।। ৪৩
নৈব তাদৃক ক্কচিৎ রূপম্
দৃষ্টম্ কেনচিৎ উত্তমম্। জ্ঞায়তাম্ কা অপি অসৌ দেবী গৃহ্যতাম্ চ অসুরেশ্বর।।
৪৪।]
তারা শুম্ভের কাছে দেবীর বর্ণনা করে বলল, “হে মহারাজ, কোন এক নারী আছেন, যাঁর অতি মনোহর রূপে হিমালয় উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে। হে অসুরেশ্বর, অমন রূপ কোনদিন কেউ কোথাও দেখেনি। ইনি নিশ্চয়ই কোন দেবপত্নী, সে কথা জেনে, তাঁকে গ্রহণ করুন”।
স্ত্রীরত্নমতিচার্বঙ্গী
দ্যোতয়ন্তী দিশস্ত্বিষা।
সা তু
তিষ্ঠতি দৈত্যেন্দ্র তাং ভবান্ দ্রষ্টুমর্হতি।। ৪৫
যানি
রত্নানি মণয়ো গজাশ্বাদীনি বৈ প্রভো।
ত্রৈলোক্যে
তু সমস্তানি সাম্প্রতং ভান্তি তে গৃহে।। ৪৬
[স্ত্রী-রত্নম্-অতিচারু-অঙ্গী
দ্যোতয়ন্তী দিশঃ ত্বিষা। সা তু তিষ্ঠতি দৈত্যেন্দ্র তাম্ ভবান্ দ্রষ্টুম্
অর্হতি।। ৪৫
যানি রত্নানি মণয়ঃ
গজ-অশ্বাদীনি বৈ প্রভো। ত্রৈলোক্যে তু সমস্তানি সাম্প্রতম্ ভান্তি তে গৃহে।। ৪৬]
“হে দৈত্যেন্দ্র, এই
রমণী-রত্নের চারু-অঙ্গের প্রভায়, দশদিক উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, আপনার অবশ্যই তাঁকে
দর্শন করা উচিৎ। হে প্রভু, ত্রিলোকে যত মণি-রত্ন, শ্রেষ্ঠ গজ ও অশ্ব প্রভৃতির সবই
সম্প্রতি আপনার প্রাসাদে বিরাজ করছে”।
ঐরাবতঃ
সমানীতো গজরত্নং পুরন্দরাৎ।
পারিজাততরুশ্চায়ং
তথৈবোচ্চৈঃশ্রবা হয়ঃ।। ৪৭
বিমানং
হংসসংযুক্তমেতৎ তিষ্ঠতি তেঽঙ্গনে।
রত্নভূতমিহানীতং
যদাসীদ বেধসোঽদ্ভূতম্।। ৪৮
[ঐরাবতঃ সমানীতঃ গজরত্নম্
পুরন্দরাৎ। পারিজাত-তরুঃ চ অয়ং তথা এব উচ্চৈঃশ্রবা হয়ঃ।। ৪৭
বিমানম্ হংস-সংযুক্তম্
এতৎ তিষ্ঠতি তে অঙ্গনে। রত্ন-ভূতম্ ইহ আনীতম্ যৎ আসীৎ বেধসঃ অদ্ভূতম্।। ৪৮]
“আপনি পুরন্দর ইন্দ্রের
থেকে গজরত্ন ঐরাবত, এই পারিজাত বৃক্ষ এবং উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়াও এনেছেন। একসময় যা দেব
ব্রহ্মার ছিল, সেই হংস-যুক্ত রত্নভূষিত আশ্চর্য বিমান, এখন আপনি এনে আপনার প্রাঙ্গণে স্থাপিত করেছেন”।
নিধিরেষ
মহাপদ্মঃ সমানীতো ধনেশ্বরাৎ।
কিঞ্জল্কিনীং
দদৌ চাব্ধির্মালামম্লানপঙ্কজাম্।। ৪৯
ছত্রং তে
বারুণং গেহে কাঞ্চনস্রাবি তিষ্ঠতি।
তথায়ং
স্যন্দনবরো যঃ পুরাসীৎ প্রজাপতেঃ।। ৫০
[নিধিঃ এষ মহাপদ্মঃ
সমানীতঃ ধনেশ্বরাৎ। কিঞ্জল্কিনীম্ দদৌ চ অব্ধিঃ মালাম্ অম্লান-পঙ্কজাম্।। ৪৯
ছত্রম্ তে বারুণম্ গেহে
কাঞ্চন-স্রাবি তিষ্ঠতি। তথা অয়ম্ স্যন্দন-বরঃ যঃ পুরা আসীৎ প্রজাপতেঃ।। ৫০]
“ধনরাজ কুবেরের থেকে আপনি
মহাপদ্মরাগ-নিধি এনেছেন, সাগর আপনাকে কিঞ্জল্কিনী নামের পদ্ম-মালা দিয়েছেন, যে
মালার পদ্ম কখনো মলিন হয় না। বরুণের স্বর্ণময় বা স্বর্ণঝরানো ছাতা এবং শ্রেষ্ঠ সেই
রথ যে রথ আগে প্রজাপতি দক্ষের ছিল, সবই এখন আপনার প্রাসাদে শোভা পাচ্ছে”।
[নিধি মানে রত্ন-সম্পদ। পুরাণে নব-নিধি অর্থাৎ নটি রত্নের নাম পাওয়া যায়, যেমন মুক্তা, মাণিক্য, বৈদুর্য, গোমেদ, বজ্র, বিদ্রুম, পদ্মরাগ, মরকত ও নীলকণ্ঠ।]
মৃত্যোরুৎক্রান্তিদা
নাম শক্তিরীশ ত্বয়া হৃতা।
পাশঃ
সলিলরাজস্য ভ্রাতুস্তব পরিগ্রহে।। ৫১
নিশুম্ভস্যাব্ধিজাতাশ্চ
সমস্তা রত্নজাতয়ঃ।
বহ্নিরপি
দদৌ তুভ্যমগ্নিশৌচে চ বাসসী।। ৫২
এবং
দৈত্যেন্দ্র রত্নানি সমস্তান্যাহৃতানি তে।
স্ত্রীরত্নমেষা
কল্যাণী ত্বয়া কস্মান্ন গৃহ্যতে।। ৫৩
[মৃত্যোঃ উৎক্রান্তিদা নাম
শক্তিঃ ঈশ ত্বয়া হৃতা। পাশঃ সলিল-রাজস্য ভ্রাতুঃ তব পরিগ্রহে।। ৫১
নিশুম্ভস্য অব্ধি-জাতাঃ চ
সমস্তাঃ রত্ন-জাতয়ঃ। বহ্নিঃ অপি দদৌ তুভ্যম্ অগ্নি-শৌচে চ বাসসী।। ৫২
এবম্ দৈত্যেন্দ্র রত্নানি
সমস্তানি আহৃতানি তে। স্ত্রী-রত্নম্ এষা কল্যাণী ত্বয়া কস্মাৎ ন গৃহ্যতে।। ৫৩]
“হে ভগবন্, যমের থেকে
উৎক্রান্তিদা নামের শক্তি হরণ করেছেন। আপনার ভাই জলদেবতার থেকে পাশ-অস্ত্র অধিকার
করেছেন। সমুদ্রে উৎপন্ন যাবতীয় রত্নই আপনার ভাই নিশুম্ভের অধিকারে, অগ্নিও আপনাদের
এমন দুই বসন দিয়েছেন, যা শুধুমাত্র অগ্নিতেই শুচি হয়। হে দৈত্যেন্দ্র, সকল শ্রেষ্ঠ
বস্তুই যখন আপনি আহরণ করেছেন, তখন এই কল্যাণী রমণী-রত্নকে কেন আপনি গ্রহণ করছেন
না?”
[উৎক্রান্তিদা – যমদণ্ড, জীবের আয়ু শেষ হলে যে অস্ত্রে যমদেব, তার প্রাণ সংগ্রহ করেন।]
ঋষিরুবাচ।
নিশম্যেতি
বচঃ শুম্ভঃ স তদা চণ্ডমুণ্ডয়োঃ।
প্রেষয়ামাস
সুগ্রীবং দূতং দেব্যা মহাসুরম্।। ৫৪
ইতি চেতি
চ বক্তব্যা সা গত্বা বচনান্মম।
যথা
চাভ্যেতি সংপ্রীত্যা তথা কার্যং ত্বয়া লঘু।। ৫৫
[ঋষিঃ উবাচ। নিশম্য ইতি
বচঃ শুম্ভঃ সঃ তদা চণ্ড-মুণ্ডয়োঃ। প্রেষয়ামাস সুগ্রীবম্ দূতম্ দেব্যা মহাসুরম্।।
৫৪
ইতি চ ইতি চ বক্তব্যা সা
গত্বা বচনান্ মম। যথা চ অভ্যেতি সংপ্রীত্যা তথা কার্যম্ ত্বয়া লঘু।। ৫৫]
ঋষি বললেন। চণ্ড-মুণ্ডের থেকে এই কথা শুনে, শুম্ভ মহা-অসুর সুগ্রীবকে দূত করে দেবীর কাছে পাঠাল। শুম্ভ দূতকে বলল, “তাঁর কাছে গিয়ে আমার “এই” “এই” কথা তাঁকে বলবে, তিনি যাতে সন্তুষ্ট হয়ে তাড়াতাড়ি এখানে আসেন, সেইরকম কাজই করবে”।
স তত্র
গত্বা যত্রাস্তে শৈলোদ্দেশেঽতিশোভনে।
সা দেবী
তাং ততঃ প্রাহ শ্লক্ষং মধুরয়া গিরা।। ৫৬
দূত
উবাচ।
দেবি
দৈত্যেশ্বরঃ শুম্ভস্ত্রৈলোক্যে পরমেশ্বরঃ।
দূতোঽহং
প্রেষিতস্তেন ত্বৎসকাশমিহাগতঃ।। ৫৭
অব্যাহতাজ্ঞঃ
সর্বাসু যঃ সদা দেবযোনিষু।
নির্জিতাখিলদৈত্যারিঃ
স যদাহ শৃণুষ্ব তৎ।। ৫৮
[স তত্র গত্বা যত্র আস্তে
শৈল-উদ্দেশে-অতিশোভনে। সা দেবী তাম্ ততঃ প্রাহ শ্লক্ষম্ মধুরয়া গিরা।। ৫৬
দূত উবাচ। দেবি
দৈত্য-ঈশ্বরঃ শুম্ভঃ ত্রৈলোক্যে পরমেশ্বরঃ। দূতঃ অহম্ প্রেষিতঃ তেন ত্বৎ-সকাশম্
ইহাগতঃ।। ৫৭
অব্যাহত-আজ্ঞঃ সর্বাসু যঃ
সদা দেবযোনিষু। নির্জিত-অখিল-দৈত্য-অরিঃ স যৎ আহ শৃণুষ্ব তৎ।। ৫৮]
অতীব সুদৃশ্য শৈল শিখরে যেখানে দেবী বাস করছিলেন, সেই দূত সেখানে গিয়ে, দেবীকে অতি মৃদু ও মধুর কথায় বলল। দূত বলল, “হে দেবি, দৈত্যেশ্বর শুম্ভ ত্রিলোকের পরমেশ্বর। তিনি আপনার কাছে আমাকে এখানে তাঁর দূত করে পাঠিয়েছেন। সকল দেবতাদের মধ্যে যাঁর আদেশ সর্বদাই অপ্রতিহত। সকল দৈত্য-শত্রুদের যিনি পরাভূত করেছেন, তিনি যে কথা বলে পাঠিয়েছেন, তা শুনুন,”।
মম
ত্রৈলোক্যমখিলং মম দেবা বশানুগাঃ।
যজ্ঞভাগানহং
সর্বানুপাশ্নামি পৃথক্ পৃথক্। ৫৯
ত্রৈলোক্যে
বররত্নানি মম বশ্যান্যশেষতঃ।
তথৈব
গজরত্নং চ হৃতং দেবেন্দ্রবাহনম্।। ৬০
[মম ত্রৈলোক্যম্ অখিলম্
মম দেবা বশ-অনুগাঃ। যজ্ঞ-ভাগান্ অহম্ সর্বান্ উপাশ্নামি পৃথক্ পৃথক্। ৫৯
ত্রৈলোক্যে বর-রত্নানি মম
বশ্যানি অশেষতঃ। তথা এব গজ-রত্নম্ চ হৃতম্ দেবেন্দ্র-বাহনম্।। ৬০]
“এই ত্রিলোক ও সকল দেবতা
আমার বশীভূত ও অনুগত। সকল দেবতাদের আলাদা আলাদা যজ্ঞ-ভাগের পুরোটা আমিই উপভোগ করি।
ত্রিলোকে যত শ্রেষ্ঠ রত্নাদি আছে, তার অবিসম্বাদিত অধিকার আমার। এমনকি দেবরাজ
ইন্দ্রের বাহন শ্রেষ্ঠ হস্তীও (ঐরাবত) আমিই অধিকার করেছি”।
ক্ষীরোদমথনোদ্ভূতমশ্বরত্নং
মমামরৈঃ।
উচ্চৈঃশ্রবসংসজ্ঞং
তৎ প্রণিপত্য সমর্পিতম্।। ৬১
যানি
চান্যানি দেবেষু গন্ধর্বেষূরগেষু চ।
রত্নভূতানি
ভূতানি তানি ময্যেব শোভনে।। ৬২
[ক্ষীরোদ-মথন-উদ্ভূতম্
অশ্বরত্নম্ মম অমরৈঃ। উচ্চৈঃশ্রব-সংসজ্ঞম্ তৎ প্রণিপত্য সমর্পিতম্।। ৬১
যানি চ অন্যানি দেবেষু
গন্ধর্বেষু উরগেষু চ। রত্নভূতানি ভূতানি তানি ময়ি এব শোভনে।। ৬২]
“ক্ষীরোদ সাগর মন্থনে উচ্চৈঃশ্রবা নামে যে অশ্বরত্ন উদ্ভূত হয়েছিল, দেবতারা প্রণাম করে আমাকেই সেটি সমর্পণ করেছেন। হে সুন্দরি, দেবতা, গন্ধর্ব এবং নাগদের কাছে অন্যান্য যা কিছু শ্রেষ্ঠবস্তু আছে সবই আমার”।
স্ত্রীরত্নভূতাং
ত্বাং দেবি লোকে মন্যামহে বয়ম্।
সা
ত্বমস্মানুপাগচ্ছ যতো রত্নভুজো বয়ম্।। ৬৩
মাং বা
মমানুজং বাপি নিশুম্ভমুরুবিক্রমম্।
ভজ ত্বং
চঞ্চলাপাঙ্গি রত্নভূতাসি বৈ যতঃ।। ৬৪
পরমৈশ্বর্যমতুলং
প্রাপ্স্যসে মৎপরিগ্রহাৎ।
এতদ্বুদ্ধ্যা সমালোচ্য মৎপরিগ্রহতাং ব্রজ।। ৬৫
[স্ত্রী-রত্নভূতাং ত্বাং
দেবি লোকে মন্যামহে বয়ম্। সা ত্বম্ অস্মান্ উপাগচ্ছ যতঃ রত্নভুজঃ বয়ম্।। ৬৩
মাম বা মম-অনুজম বা অপি
নিশুম্ভম্-উরুবিক্রমম্। ভজ ত্বম্ চঞ্চল-অপাঙ্গি রত্নভূতাসি বৈ যতঃ।। ৬৪
পরম-ঐশ্বর্যম্-অতুলম্
প্রাপ্স্যসে মৎপরিগ্রহাৎ। এতৎ বুদ্ধ্যা সমালোচ্য মৎ-পরিগ্রহতাম্ ব্রজ।। ৬৫]
“হে দেবি, আমরা আপনাকেই জগতের রমণী-রত্ন বলে মনে করি। আপনি আমাদের কাছে আসুন, যেহেতু আমরাই শ্রেষ্ঠবস্তু উপভোগের যোগ্য পাত্র। হে চঞ্চল-নয়না, যেহেতু আপনিই সকলের শ্রেষ্ঠ, অতএব আমাকে বা আমার ভাই মহাবীর নিশুম্ভকে পতিরূপে বরণ করুন। আমার আশ্রয়ে আপনি অতুল পরম-বৈভব লাভ করতে পারবেন, সুবিবেচনার এই বুদ্ধিতে আমার পত্নীত্ব স্বীকার করুন”।
ঋষিরুবাচ।
ইত্যুক্তা
সা তদা দেবী গম্ভীরান্তঃস্মিতা জগৌ।
দুর্গা
ভগবতী ভদ্রা যয়েদং ধার্যতে জগৎ।। ৬৬
[ঋষিঃ উবাচ। ইতি উক্তা সা
তদা দেবী গম্ভীরা-আন্তঃস্মিতা জগৌ। দুর্গা ভগবতী ভদ্রা যয়া ইদম্ ধার্যতে জগৎ।।
৬৬]
ঋষি বললেন। এই কথা শুনে
দেবী দুর্গা, যিনি জগতের ধারয়িতা, কল্যাণী এবং সর্ব-ঐশ্বর্যশালিনী ভগবতী, গম্ভীর
হয়ে মনে মনে হাসলেন এবং বললেন।
দেব্যুবাচ।
সত্যমুক্তং
ত্বয়া নাত্র মিথ্যা কিঞ্চিৎ ত্বয়োদিতম্।
ত্রৈলোক্যাধিপতিঃ
শুম্ভো-নিশুম্ভশ্চাপি তাদৃশঃ।। ৬৭
কিন্ত্বত্র
যৎ প্রতিজ্ঞাতং মিথ্যা তৎ ক্রিয়তে কথম্।
শ্রুয়তামল্পবুদ্ধিতাং
প্রতিজ্ঞা যা কৃতা পুরা।। ৬৮
যো মাং
জয়তি সংগ্রামে যো মে দর্পং ব্যপোহতি।
যো মে
প্রতিবলো লোকে স মে ভর্তা ভবিষ্যতি।। ৬৯
তদাগচ্ছতু
শুম্ভোঽত্র নিশুম্ভো বা মহাসুরঃ।
মাং
জিত্বা কিং চিরেণাত্র পাণিং গৃহ্নাতু মে লঘু।। ৭০
[দেবী উবাচ। সত্যম্
উক্তম্ ত্বয়া ন অত্র মিথ্যা কিঞ্চিৎ ত্বয়া উদিতম্। ত্রৈলোক্য-অধিপতিঃ
শুম্ভঃ-নিশুম্ভঃ চ অপি তাদৃশঃ।। ৬৭
কিন্তু অত্র যৎ
প্রতিজ্ঞাতম্ মিথ্যা তৎ ক্রিয়তে কথম্। শ্রুয়তাম্ অল্প-বুদ্ধিতাম্ প্রতিজ্ঞা যা
কৃতা পুরা।। ৬৮
যঃ মাম্ জয়তি সংগ্রামে যঃ
মে দর্পম্ ব্যপোহতি। যঃ মে প্রতিবলঃ লোকে স মে ভর্তা ভবিষ্যতি।। ৬৯
তৎ আগচ্ছতু শুম্ভঃ অত্র
নিশুম্ভঃ বা মহাসুরঃ। মাম্ জিত্বা কিম্ চিরেণ অত্র পাণিম্ গৃহ্নাতু মে লঘু।।
৭০]
দেবী বললেন। “তুমি যা বলেছ সত্য, তাতে কিছু মাত্র মিথ্যা বলা হয়নি। শুম্ভ এবং নিশুম্ভ ত্রিলোকের অধিপতিই বটে। কিন্তু আগেকার স্বল্পবুদ্ধিতে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সে কথা শোন, কারণ যে প্রতিজ্ঞা আমি তখন করেছিলাম, তাকে কী করে এখন মিথ্যা প্রতিপন্ন করি? আমাকে যে যুদ্ধে জয় করবে, যে আমার গর্ব খর্ব করবে, জগতে যে আমার তুল্য বলবান হবে, সেই আমার পতি হবে। অতএব শুম্ভ বা মহাসুর নিশুম্ভ এখানে আসুক। আমাকে জয় করে চিরকালের মতো আমার পাণিগ্রহণ করুক, বিলম্বের দরকার কি?”
দূত
উবাচ।
অবলিপ্তাসি
মৈবং ত্বং দেবি ব্রূহি মমাগ্রতঃ।
ত্রৈলোক্যে
কঃ পুমাংস্তিষ্ঠেদগ্রে শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ৭১
অন্যেষামপি
দৈত্যানাং সর্বে দেবা ন বৈ যুধি।
তিষ্ঠন্তি
সম্মুখে দেবি কিং পুনঃ স্ত্রী ত্বমেকিকা।। ৭২
ইন্দ্রাদ্যাঃ
সকলা দেবাস্তস্থুর্যেষাং ন সংযুগে।
শুম্ভাদীনাং
কথং তেষাং স্ত্রী প্রযাস্যসি সম্মুখম্।। ৭৩
সা ত্বং
গচ্ছ ময়ৈবোক্তা পার্শ্বং শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।
কেশাকর্ষণনিধূর্তগৌরবা
মা গমিষ্যসি।। ৭৪
[দূত উবাচ। অবলিপ্তা অসি
মা এবম্ ত্বম্ দেবি ব্রূহি মম অগ্রতঃ। ত্রৈলোক্যে কঃ পুমান্ তিষ্ঠেৎ অগ্রে
শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ।। ৭১
অন্যেষাম্ অপি দৈত্যানাম্
সর্বে দেবাঃ ন বৈ যুধি। তিষ্ঠন্তি সম্মুখে দেবি কিম্ পুনঃ স্ত্রী ত্বম্ একিকা।।
৭২
ইন্দ্র-আদ্যাঃ সকলা দেবাঃ
তস্থুঃ যেষাম্ ন সংযুগে। শুম্ভ-আদীনাম্ কথম্ তেষাম্ স্ত্রী প্রযাস্যসি
সম্মুখম্।। ৭৩
সা ত্বম্ গচ্ছ ময়া এব
উক্তা পার্শ্বম্ শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ। কেশ-আকর্ষণ-নিধূর্ত-গৌরবা মা গমিষ্যসি।। ৭৪]
দূত বলল। “হে দেবি, আপনি অত্যন্ত গর্বিতা হয়েছেন, আমার সামনে আর এমন কথা বলবেন না। ত্রিলোকে এমন কোন পুরুষ আছে যে শুম্ভ-নিশুম্ভের সামনে দাঁড়াতে পারে? যুদ্ধে কোন দেবতাই অন্যান্য দৈত্যদের সামনেই দাঁড়াতে পারে না। সেখানে, হে দেবি, আপনি একাকিনী কী করে তাঁদের সামনে দাঁড়াবেন? ইন্দ্রাদি সকল দেবতারা শুম্ভাদিদের সঙ্গে যুদ্ধে টিকতেই পারেনি, সেখানে তাঁদের সামনে আপনি কী করে যাচ্ছেন? আমার উপদেশ শুনুন দেবি, কেশ-আকর্ষণে গৌরবহীনা হয়ে যাবেন না, আপনি শুম্ভনিশুম্ভদের পাশে (পত্নীর মর্যাদায়) চলুন”।
দেব্যুবাচ।
এবমেতদ্
বলী শুম্ভো নিশুম্ভশ্চাতিবীর্যবান্।
কিং
করোমি প্রতিজ্ঞা মে যদনালোচিতা পুরা।। ৭৫
স ত্বং
গচ্ছ ময়োক্তং তে যদেতৎ সর্বসমাদৃতঃ।
তদাচক্ষ্বাসুরেন্দ্রায়
স চ যুক্তং করোতু যৎ।। ৭৬
[দেবী উবাচ। এবম্ এতদ্
বলী শুম্ভঃ নিশুম্ভঃ চ অতিবীর্যবান্। কিম্ করোমি প্রতিজ্ঞা মে যৎ-অনালোচিতা
পুরা।। ৭৫
স ত্বম্ গচ্ছ ময়া উক্তম্
তে যৎ এতৎ সর্ব-সমাদৃতঃ। তৎ আচক্ষ্ব অসুর-ইন্দ্রায় সঃ চ যুক্তম্ করোতু যৎ।। ৭৬
দেবী বললেন। শুম্ভ ও
নিশুম্ভ অতিবীর্যবান একথা সত্য। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করার সময় আমি আগে এমন চিন্তা
করিনি, কী করব? অতএব তুমি যাও, আমি যা বললাম সে সবই অসুরেন্দ্রকে সশ্রদ্ধ হয়ে বল
এবং যুক্তিযুক্ত যা করার হয়, সে করুক।
ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবী মাহাত্ম্যে দেব্যা দূতসংবাদো
নাম পঞ্চমোঽধ্যায়ঃ।
শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে
দেবী-দূতসংবাদ নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার পঞ্চম অধ্যায়
সমাপ্ত।
...চলবে...
পরের পর্বে আসবে শ্রীশ্রী চণ্ডীর উত্তর চরিত ষষ্ঠ অধ্যায়
গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির।