শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫

সপ্তপদী

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 

 

ভোরের কুয়াশা মাখা মায়াবি আলোয়, লেকের ধারে বেঞ্চে বসে, অনামিকা মন দিয়ে শুনছিলেন, কথকতার কথা, “আজকেই ফিরে গিয়ে বোমাটা ফাটিয়ে দাও, অনু”

অনামিকা হাসলেন, স্নিগ্ধ দৃষ্টি মেলে কথকতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বৌমাকে বোমা? ঠিকই বলেছেন। বলবো, আজই বলবো। আগে পেতাম না, আজকাল মনের মধ্যে বেশ একটা জোর পাচ্ছি। ক'মাস আগেও, আজ যে কথাগুলো বলবো বলে মনস্থ করেছি, বলা তো দূরের কথা, সে চিন্তাটুকুও করতে পারতাম না”

“থ্যাংক্স আ লট”

“ও মা, কেন?”

“এটা আমার কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই ধরে নিলাম, তাই। তোমার এই নতুন জীবনে পা ফেলার পেছনে আমার এ ক'মাসের আন্তরিক প্রচেষ্টা যে সফল হয়েছে, এটুকু আমি ধরে নিতেই পারি”

অনামিকা স্মিত উজ্জ্বল চোখে তাকালেন কথকতার দিকে, বললেন, “সত্যি, আজ যে আমি আমার রুদ্ধকণ্ঠ ইচ্ছেগুলো ওদের সামনে ঘোষণা করবো, তার পিছনে যে এত দিনের প্রস্তুতি, এত রকমের কথা। সে সব কথা তো আপনারই কথা, কথকতা! আমার নতুন এই জীবনটাই কী কন্‌গ্র্যাচুলেটরি নয়?”

“ওভাবে বলো না, প্লিজ। এই বয়েসে তোমাকে কাছে পেয়ে আমিএকটু বেশি মাত্রায় কমপ্লিমেন্টেড ফিল করছি। আমার মনের এই কথাটা ইংরিজিতে প্রকাশ করার মতো কোন উপযুক্ত শব্দ মনে আসছে না। বরং বাংলায় বলতে পারি অতি সহজে। কথাটা হল, তুমি আমার জীবনে এসেছো আশ্চর্য এক আভ্যুদয়িক হয়ে! তবু তো তুমি আজও “আপনি” থেকে “তুমি” তে নামতে পারলে না। আজকাল ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর নিজেদের মধ্যে “তুই” “তুই” করে। বিয়ের আগে, বিয়ের পরেও।  প্রথম প্রথম “হ্যাঁগো শুনচো”, “কী গো, কী বলচো” শুনতে বা বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা। ছেলেমেয়ে হয়ে যাওয়ার পর, স্ত্রী বলতেন, তোর বাবাকে ডাক, আমিও বলতাম, তোর মা কোথায় রে? আর এরা, সারাজীবনই বন্ধু। যেন দাম্পত্য নয়, ইলংগেটেড ফ্রেন্ডশিপ! বাইরে যে বন্ধুত্বটা ছিল, তাকেই সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে গৃহী করে তোলার আনন্দ!”

হাসতে হাসতে অনামিকা বললেন, “ওফ, বাপরে, আপনি এত কথাও বলতে পারেন। তবে আপনি যাই বলুন, আমি ওই তুই-তোকারি পর্যন্ত যেতে পারবো না, সে কথা কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি।”

কথকতাও হাসলেন, বললেন, “অতটা ছোকরা হতে আমারও সাধ নেই। তবে “আপনি” থেকে “তুমি” তে আসার কথা আগেই বলেছি, আবারও বলছি বলে বিরক্ত হয়ো না, প্লিজ। আর সঙ্গে যদি “ওগো শুনছো, হ্যাঁগো শুনছো” পাই, তাহলে তো সোনায় নয়, শোনায় সোহাগা”

অনামিকা হাসলেন না, আনমনা মুখে লেকের স্থির জলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার এক মাসিমা আছেন, এখন অনেক বয়েস, একসময় ছুঁচসুতোর টানাপোড়েনে খুব সুন্দর চটের আসন বুনতেন। আমরা নানান বয়সের তুতো ভাইবোনেরা লম্বা মাটির দাওয়ায়, সেই সব আসনে বসে ভাত খেতাম একসঙ্গে। একটা আসনে ছিল ঘনিষ্ঠ শুকসারির নকশা আঁকা, তার মাথার ওপরে লেখা “শাসন করা তারই সাজে” আর পায়ের তলায় “সোহাগ করে যে”। আপনার সোনায় সোহাগা কথাটা শুনে হঠাৎ সে কথাটা মনে পড়ে গেল”

কথকতা কিছু বললেন না। কোলের ওপর রাখা অনামিকার ডান হাতটি টেনে নিয়ে, নিজের দু হাতে চেপে ধরলেন। মুখ নীচু করে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে, অনামিকা স্মিত মুখ তুলে তাকিয়ে রইলেন কথকতার মুখের দিকে তারপর না বলা কথার অনুভবে দুজনেই মগ্ন হয়ে রইলেন কতক্ষণ।  

 জেনারালি রাত্রেই একসঙ্গে খেতে বসা হয়ছেলে রাজন, ছ’বছরের নাতি গুবলু আর বৌমা ঝুমুররাত্রে অনামিকা সামান্যই খান। দুটো রুটি, একটু ডাল আর নিরামিষ তরকারি। কাজের দিদি শম্পা আটটা-সাড়েআটটার মধ্যে রান্না করে রেখে যায়। দশটা-সাড়েদশটা নাগাদ খেতে বসার সময় বৌমা আভেনে খাবারগুলো গরম করে টেবিলে সার্ভ করে। আগে সার্ভ করার সময় অনামিকা অনেকবার সাহায্য করতে চেয়েছেন, ঝুমুরের উৎকট ঝংকারে, বিরত হতে হতে, আজকাল হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

আজ খেতে বসে অনামিকা বললেন, “আজ তোমাদের চিকেন হয়েছে না? একটু দিও তো, বৌমা!”

অনামিকার এই কথায়, পৃথিবীটাই থমকে রইল কিছুক্ষণ। রাজনের বাবা পৃথ্বীশ দেহ রেখেছেন, বছর চারেক হল। সেই থেকে অনেক অনুরোধ-উপরোধেও অনামিকা আমিষ স্পর্শ করেননি।

আহ্নিকগতি আবার স্বাভাবিক হতেই, অনামিকার প্লেটে একটুকরো চিকেন আর একটু ঝোল দিতে দিতে ঝুমুর বলল, “আর কত খেল্‌ যে দেখাবেন, মা! সেই তো খেলেন, তবে এতদিন এত নাটকের কী দরকার ছিল”?

“তোমাদের আবার কম পড়বে না তো, বৌমা?” নির্বিকার অনামিকা রাজন আর গুবলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী রে? তোদের চিকেনে ভাগ বসালাম নাকি?”

রাজন বিরক্ত কিনা বোঝা গেল না, বলল, “আমরা কতবার কতদিন তোমাকে বলে বলে হেরে গেলাম, মা, হঠাৎ আজকে তোমার সুমতি হল?”

“সুমতি, নাকি দুর্মতি?” অনামিকা হেসে বললেন, “কী জানি, কেন যে ইচ্ছে হল। হয়তো যাওয়ার আগে লোভটোভগুলো আবার জেগে উঠছে!”

ঝুমুর তীব্র শ্লেষমাখা কণ্ঠে বলল, “লোভ আপনার কোনদিনই যায়নি, মা। পুরোটাই ছিল লোকদেখানে বাহাদুরি - “দ্যাখো স্বামী মারা গেছে, আমি সাধ্বী বিধবা, মাছ-মাংস ছেড়ে দিলাম আজ সেই চক্ষুলজ্জাটাও ঘুঁচে গেল!”

“তাই হবে হয়তো, মাদেরি করছো কেন, তুমিও বসে যাও”

থাক ঢের হয়েছে, আপনারা শুরু করুন, আমি বসছি। আপনার আরও বায়নাক্কা যদি কিছু থাকে”!

“বুঝতে পারি, আমাকে নিয়ে তোমাদের খুব হ্যাপা, তাই না, বৌমা? না না, আপাতত আর কোন বায়নাক্কা নেই। বসে পড়োএই তো আর কটাই বা দিন, এ মাসের তিরিশ তারিখ। আজ তো সতের হয়েই গেল, তার মানে তেরদিন - ব্যাস্‌”

“কেন, তারপরে কী হবে?” রাজন মুখে খাবার তুলতে গিয়েও থমকে গেল।

অনামিকা হাসলেন, বললেন, “সেদিন থেকে আর দমন নয়, ইচ্ছেবরণ এত দিন পূর্ণ না হওয়া সকল সাধপূরণ! তোর বাবার আর তোদের এই সংসারের আধারে দুমড়ে-মুচড়ে গুঁজে রাখা এতদিনের মনটা সেদিন ডানা মেলবে

কী ব্যাপার বলো তো মা? কোনদিন তো এভাবে তোমায় কথা বলতে শুনিনি। আজ বেশ মুডে রয়েছো মনে হচ্ছে? শরীর-টরীর ঠিক আছে তো? হঠাৎ ডানা মেলার উত্তেজনায় চিকেন খেয়ে মাঝরাত্রে আবার কিছু বাধিয়ে বসো না, প্লিজ! কাল সকালে আমার অফিসে জরুরি মিটিং, ঝুমুরের স্কুলে পরীক্ষা। গুবলুর ক্লাসটেস্ট! সব ভেস্তে যাবে”

হালকা হেসে অনামিকা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিচ্ছু হবে না, ভাবিস না। সত্যি বলতে বিয়ের পর থেকে এত ভালো আমি কোনদিন ছিলাম না। আমার নিজের বিয়ের কথা বললাম, বৌমা, তুমি আবার তোমার বিয়ের দিন থেকে ধরে বসো না”

ঝুমুর ভীষণ বিরক্ত হয়ে রেগে উঠে বলল, “তোমাদের মা আর ছেলের এই হেঁয়ালি করার বদভ্যেসটা কবে যাবে বলো তো? লোককে হ্যারাস করে তোমরা খুব আনন্দ পাও, না? স্যাডিস্টের ঝাড়! তোমাদের সংসারে এসে আমার জীবনটার কী হাল হচ্ছে, সেটা একবারও ভেবে দেখেছো, স্বার্থপর শয়তানের দল?”

এতক্ষণ বড়োদের কথার মধ্যে গুবলু কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না, এখন সে বলে উঠল, “স্যাটানের মাথায় হর্ন থাকে না, মাম্মি?”

অনামিকা হেসে ফেলে বললেন, “থাকে বৈকি, গুবলুসোনা, হর্ন দেখেই তো চট করে, স্যাটান চেনা যায়। তবে মানুষ-শয়তানদের শিং, নখ, দাঁত কিছুই থাকে না, তাদের চিনে ওঠা খুব মুশকিল”অনামিকার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তিনি উঠে পড়লেন

ঝুমুর দু চোখে আগুন নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী আমাকে মিন করলেন, মা”?

বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, “ও মা, তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি?”

অনামিকা নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা চেপে দিতে দিতে ঝুমুরের গলা শুনলেন, “তোমার মা যা নয় তাই বলে গেল আমাকে, তুমি চুপ করে শুনলে? সারাজীবন কী মেনিমুখো মায়ের ছেলে হয়ে কাল কাটাবে? এই যদি তোমার ইচ্ছে ছিল, বিয়ে করে সংসার পাতলে কেন? আজ নবছর হল বিয়ে হয়েছে, আজও নিজের সংসার, নিজের পরিবার কেমন জিনিষ জানতেই পারলাম নাআর কতদিনে তুমি নিজের স্ত্রীকে, কাজের লোক হিসেবে না দেখে, স্ত্রী বলে সম্মান করতে শিখবে? একনম্বরের স্পাইনলেস…

 অনামিকা দরজাটা চেপে দিতে, ইয়েল লকে আওয়াজ হল, ক্লিক। নির্জন ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনামিকা নিজের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তাঁর নতুন জীবনে পা ফেলার কথা ওদের বলার জন্যেই তিনি কথার সূত্রপাত করেছিলেন। কিন্তু কেউই তেমন কোন কৌতূহল প্রকাশ করল না – আসলে এ সংসারে তাঁর থাকাটা এতই স্বাভাবিক – অনেকটা রোদ-বৃষ্টি-হাওয়ার মতোই। সাধারণ ঝড়বাদলে আমাদের মনে একটু প্রভাব ফেলে ঠিকই – কিন্তু সেটাকেও জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ধরে নিয়ে আমরা তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়ার কোন প্রয়োজনই অনুভব করি না। অনামিকা শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, এ সংসারে তাঁর অস্তিত্ব – সামনের ওই ড্রেসিং টেব্‌ল্‌টার মতোই। বিয়ের পর তাঁর এ বাড়িতে আসার দিন থেকে ওটা ওই জায়গাতেই রয়েছে  - নড়েও চড়েও না – শুধু সার্ভিস দিয়ে যায়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়ো লাইট নিভিয়ে, নাইট ল্যাম্প জ্বেলে নিঃসঙ্গ বিস্তৃত বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তেরো দিন পরের নির্মল সকালে তিনি কী প্রবল ঝড় হয়ে উঠবেন?  

 সকাল ঠিক ছটায় দরজায় বেলের আওয়াজ, অনামিকা রেডিই ছিলেন। দরজা খুলতেই দেখলেন, কথকতা দাঁড়িয়ে। পরনে স্মার্টফিট ডেনিম ট্রাউজার আর সাদা টি শার্ট।

ভীষণ ভালো লাগায়, মনটা ভরে উঠল অনামিকার, বললেন, “এসে গেছো! এসো এসো, ভেতরে এসো। ধন্যি টাইমিং তোমার, ঘড়িও হার মেনে যাবে তোমার কাছে”

“তুমিও তো রেডি! মেয়েরা যে টাইমে রেডি হয় তোমাকেই প্রথম দেখলাম” ভেতরে এসে অনামিকার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর টাইমিংয়ে, তুমিই বা কম কী? এই যে “তুমি” ডেকে, আজ আমাকে অবাক করে দিলে, বিশ্বাস করো এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না, বিশেষ দিনে সঠিক লগ্নে বরণ করতে পারে শুধু মেয়েরাইআমরা ছেলেরা যেখানে সেখানে যখন তখন আগলহীন হয়ে নিজেদের হাল্কা করে ফেলি! শুভক্ষণ, কিংবা পরমলগ্নের হিসেব করতে ছেলেরা কোনদিনই শিখল না।”

তারপর অনামিকার ডানহাতটা তুলে নিলেন নিজের হাতে, নিজের অধরে স্পর্শ করে বললেন, “আজ এই সর্বমঙ্গলা সকালে তোমার শাড়ির হাল্কা আসমানি রঙটি, যে কী গভীরতা পেলো, তুমি তো তা জানতেও পারলে না! এতদিনের বর্ণহীন তুমি, কোন জাদুমন্ত্রে আজ অবর্ণনীয় হয়ে উঠলে, গো?”

স্মিত সলজ্জ মুখে অনামিকা অস্ফুটে বললেন, “মন্ত্রটা কার, সে কী তোমার অজানা কথক ঠাকুর? এ শাড়ি তুমিই দিয়েছিলে, আমার লাস্ট জন্মদিনে। সেটাও মনে নেই, বুঝি?”

বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে, ঘরের বাইরে এসে ঝুমুর দেখল, অনামিকার ডানহাত হাতে নিয়ে উটকো একটা লোক খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! সেদিনের সেই কথাবার্তার পর গতকাল রাত পর্যন্ত, তার কোন বাক্যালাপ ছিল না শ্বাশুড়ির সঙ্গে।

ভীষণ অবাক হয়ে সে আজ বলে ফেলল,  “ইনি কে মা? এই ভোরবেলা সুটকেস-টুটকেস নিয়ে কোথায় বেরোচ্ছেন? আজ মর্নিং ওয়াকে যাননি?”

কথকতার হাতে অনামিকার হাত ধরাই রইল, অনামিকা ছাড়াবার চেষ্টা করলেন না, মৃদু হেসে বললেন, “ইনি কথকতা যশ, আমার বন্ধু, আমার বন্ধুর জীবনপথের নবীন সঙ্গীওঁনার সঙ্গে আজ সপ্তপদী যাত্রায় চললাম, মা, তাই মনে হল রোজকার মর্নিং ওয়াকটা আজ বাহুল্য। সেদিন তুমি খুব রেগে গেলে, কিন্তু তোমাকে তো বলেইছিলাম, চোদ্দদিন পরে আমার ইচ্ছে-বরণআজ সেই দিন, বৌমা”ঝুমুর বাক্যরহিত। রাজনকে ডাকতে হল না, বেলের আওয়াজ, তারপর ঝুমুর আর মায়ের কথাবার্তা শুনে সেও বেরিয়ে এল।

রাজনকে দেখে অনামিকা বললেন, “রাজু উঠে পড়েছিস, বেশ করেছিস! আয়, পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি কথকতা যশ, বাকি যে কদিন বাঁচি, এঁনার সঙ্গেই থাকবো ঠিক করেছি, রাজু”

টেবিলের ওপর একটা মুখবন্ধ মোটা খাম রাখা ছিল, সেটা রাজুর হাতে দিয়ে অনামিকা বললেন, “এই খামটা যত্ন করে রাখ, আমি চলে যাবার পর খুলিস”

“চলে যাচ্ছো মানে? বলা নেই কওয়া নেই, এমন আচমকা?”

“চোদ্দদিন আগেই বলতে চেয়েছিলাম তো! তোরা তো শুনতে চাসনি। সেদিন মনের নিবিড় কথাটি – তোদের সংসারের তুচ্ছ খিটিমিটির মধ্যে জোর করে টেনে আনতে আমারও আর প্রবৃত্তি হল না। তোর বাবার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত নিজের ইচ্ছেয় তো কিছুই করিনি। আজ সেসব নিয়ে অভিযোগ করার মানে হয় না, করছিও না। এতদিন নিজের সকল ইচ্ছের মরণ বরণ করেই বেঁচে চলছিলাম, আজ থেকে নিজের ইচ্ছেকে বরণ করেই বাঁচবো। এই ইচ্ছে-বরণ আশা করি আনন্দের হবে। রিক্ত প্রাণের জ্বালা মেটানোর মৃত্যু নয়, অনেক পাওয়ার সাধ মেটানো তৃপ্তির মৃত্যু। তাই আজ সব লজ্জা-ভয়-মান-অভিমান, ঠুনকো সব দায়-দায়িত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে ঘর ছাড়ছি, রেখুব ইচ্ছে হচ্ছে নতুন করে বাঁচার”

খুব কর্কশ স্বরে, ঝুমুর বলল, “এভাবে মুখ পুড়িয়ে আপনি চলে গেলে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, ওর অফিস, আমার স্কুল, গুবলুর স্কুলে আমরা মুখে দেখাতে পারবো? আপনার ভীমরতি হয়েছে, মা! এভাবে কোনমতেই আপনি যেতে পারেন না”!

স্মিতমুখে অনামিকা বললেন, “তুমিই সেদিন বলেছিলে না, ওসবই তুচ্ছ চক্ষুলজ্জা আর লোক দেখানো বাহাদুরি! সত্যিই তাই, বৌমা, অদ্ভূত কিছু সংস্কার – যার পিছনে কী এক মোহে যে আমরা সারাক্ষণ ছুটে চলি। ও সবে কিচ্ছু যাবে আসবে না, মা, লোকে এক হপ্তা, দু হপ্তা বলবে, তারপর ভুলে যাবে। ও নিয়ে তুমি ভেবো না। ঝোড়ো হাওয়া একটু উঠবে, বন্ধ করতে হবে ঘরদোরের এবং মনের জানালাগুলো – কিন্তু তার দৌড় শেষ রাত্তিরেও পৌঁছবে না – দেখে নিও – ঝকঝকে নির্মল সকালটা দেখতে পাবে বন্ধ জানালা খুললেই”

ঝুমুরের মতো মুখরা মেয়েও এমন কথায় আর ঘটনার আকস্মিকতায় কথা হারিয়ে ফেলল যেন। অনামিকা কথকতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলো”

“এই দুটো সুটকেশই তো? আমাকে দাও”

“হুঁ দুটোই? না একটা তুমি নাও, একটা আমি আমার নিজের গুরুত্বটা এখনই হাল্কা করে দিও না কথক”। কথকতা অপ্রস্তুত মুখে অনামিকার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “অমন চিন্তা আমি করিও না, অনু। পুরুষের কাজ মেয়েদের বহন করা। মেয়েরা যদি নিজের ভার নিজেরাই বইতে থাকে, অথবা তারা যদি হাল্কা হয়ে ওঠে রাতারাতি, তাহলে পুরুষের কর্তব্য কী হবে বল দেখি?”

অনামিকা বললেন, “আচ্ছা সে তর্ক করার অনেক সময় পাবো আমরা প্রতিদিন – বাকি জীবন। এখন চলো, বেরিয়ে পড়ি। রাজনের অফিস আছে, গুবলুর স্কুল, বৌমারও স্কুল - ওদের বেরোতে দেরি হয়ে যাবে”। তারপর রাজনের দিকে ফিরে বললেন, “চলি রে। বৌমা চললাম। গুবলুটার সঙ্গে দেখা হল না...”

রাজন ধরা গলায় বলল “চলি নয়, আসি বলো, মা”

রাজনের কথায় অনামিকা হাসলেন, “না রে, আবার ফিরে আসার ইচ্ছে তো নেই, তাই আসি নয়, চলিই”

প্রচণ্ড রাগে ঝুমুর হিসহিস্‌ করে বলে উঠল, “কী বলছো কি, তুমি? মাকে আটকাও। তুমিও কি পাগল হলে নাকি? অচেনা অজানা এক পরপুরুষের সঙ্গে তোমার মা এই বয়সে ভেগে পড়ছে...আর তুমি বলছো, এসো?”

রাজন সেকথার কোন উত্তর দিল না, মাকে জিজ্ঞাসা করল, “ঠিকানাটা দেবে না, মা?”

অনামিকা বললেন, “ঠিকানা কলকাতারই কোথাও, তবে ঠিকানার কী দরকার, মোবাইল নাম্বার তো রইলই”

অনামিকা কথকতার সঙ্গে বাড়ির বাইরে পা রাখলেন। ছোট্ট গাড়ির ডিকিতে সুটকেশ তুলে, অনামিকা সামনের বাঁদিকের সিটে বসলেন, কথকতা ডিকি বন্ধ করে, গাড়ির ডানদিকের সিটে বসে স্টার্ট দিলেন।

 ..০০..

 

 

 

শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

অপহারী হরেন (ভূতের সমাজসেবা)

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


১ 

এ তল্লাটে হরেন পোল্লেকে সকলেই চেনে, কিন্তু আবার কেউই সঠিক চেনে না। আশে পাশে পাড়া পল্লীতে তার অবাধ যাতায়াত। বিশেষ করে যারা একটু মুরুব্বিগোছের জমি জায়গার মালিক কিংবা ব্যবসা-ট্যাবসা করে মা লক্ষ্মীকে ঘরে আদর যত্নে রেখেছে, তাদের বাড়িতেই তার যাতায়াত। তবে ঘন ঘন যায় না হরেন, সে জানে ঘন ঘন কুটুমবাড়ি গেলে সেখানে কদর কমে যায়, বাড়ির লোক জন সতর্ক হয়ে যায়

আসলে হরেন পোল্লে একজন তস্কর। চোর বললে বড্ড খারাপ শোনায়, তাই তস্কর। অনেকে আবার নিশিকুটুম্বও বলে। রাতের কুটুম - বলা নেই কওয়া নেই পাঁচিল টপকে, ঘরের দেয়ালে সিঁদ দিয়ে ঢুকে পড়ে বাড়ির অন্দরে। কাজ-টাজ সেরে সুযোগ পেলে অনেক সময় ফ্রিজ খুলে ভালোমন্দ খেয়েও আসে। কুটুমবাড়ি গিয়ে কিছু না খেয়ে আসতে নেই কিনা, তাতে গেরস্তের অমঙ্গল হয়, মা লক্ষ্মী অস্থির হন, চঞ্চল হয়ে ওঠেন।

পুলিনগড়ের হাটে হরেন পোল্লের একটা ইলেকট্রিকের দোকান আছে। এমনিতে সেখানে নানান ধরনের বাল্ব, ইলেক্ট্রিকের তার-টার, সুইচের বাক্সটাক্স আরো নানান তামঝাম সরঞ্জাম বিক্রি করে। আবার দরকার পড়লে সারাইয়ের কাজ টাজ করতে লোকের বাড়িতেও যায়। কথাবার্তা তার খুব ভালো আর আপনি, আজ্ঞে ছাড়া কথা কয় না, এমনই বিনয়ী। সেই কারণেই কারো মনে সন্দেহও হয় না, যে মাঝরাতের নিষুতিতে হরেন পোল্লে মিসমিসে অন্ধকারে মিশে কোথায় যায়, কী করে। সে যে কোনদিন ধরা পড়েনি, তাও নয়, বার পাঁচেক পড়েছেকিন্তু পরনে কালো হাফপ্যাণ্ট, সারাগায়ে বিটকেল গন্ধওলা তেল মাখা, ঝুল-কালি মাখা মুখ দেখে তাকে চেনবার জো থাকে না। খুব মার ধোর করলে সে নানান নাম বলে, বিশু মণ্ডল, হারু বাগ, ছোঁচা মল্লিক, মটর সর্দার...এক এক জায়গায় এক এক নাম, আর সেই জায়গার নামটা সে ভোলেও না। একজায়গায় দুবার ধরা পড়লে একই নাম বলতে তার ভুল হয় না। এতে সুবিধে কি হয়, চট করে কেউ ধরতে পারে না, যে সে একই লোক।

এই যেমন সেদিন দুটো ছাগল নিয়ে বদরু শেখ হাটে যাচ্ছিল, বাসে দেখা গুলে মিদ্দের সঙ্গে। অনেক দিনের সুখদুখের বন্ধু তারা। বাসের ছাদে বসে দুটো বিড়ি ধরিয়ে দুজনে নানান কথাবার্তা চালাচ্ছিল। কথায় কথায় উঠল চুরির কথা। বদরুমিঁয়ার পাড়ায় গত পরশু রাতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল হরেন পোল্লে। বেদম উত্তম মধ্যম দিয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, ‘আজ্ঞে অধমের নাম হারু বাগ’তাই শুনে গুলে মিদ্দে বললে, ‘আরে, আমাদের পাড়াতে বছর খানেক আগে একটা চোর ধরা পড়েছিল, সে ব্যাটাও খুব পেটানি খেয়ে নাম বলেছিল ছোঁচা মল্লিক। তাহলে সে ব্যাটা অন্য। আজকাল পাড়ায় পাড়ায় কত চোর যে আমদানি হয়েছে, সামলে ওঠা মুস্কিল হয়ে উঠছে। থানাটাও বড্ড দূর। এর সুরাহা কি করা যায় বল দিকি, বদরুভাই?’

হরেন পোল্লের হাটের ইলেকট্রিকের দোকান, আহামরি তেমন চলে না। আগে মাসে এক দুদিন চুরি চামারি করলেই তার সংসারের সংকুলান হয়ে যেত। বুড়ি মা, বউ আর একটা মেয়ে নিয়ে তার সংসারও তেমন কিছু বড়ো নয়। সমস্যা হয়েছে তার এই সোনামুখী মেয়েটি। তার মেয়েটি এই দিগড়ের সেরা মেয়ে, লেখাপড়ায় খুব ভালো। ভালোই তো, এটা আবার সমস্যা নাকি? সমস্যাই তো, মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে সেকেন্ড হওয়ার পর, তার মেয়েকে নিয়ে দিন দশেক খুব নাচানাচি হলগুচ্ছের আবর্জনা বই, পাঁচহাজার টাকা আর একটা প্রশংসাপত্র। টিভির ক্যামেরার সামনে সদরের বাবুরা খুব বলাবলি করল, এই মেয়ে আমাদের গৌরব। আমাদের জেলার মুখ উজ্জ্বল করেছে, সব রকম সাহায্যের জন্যে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু সদরের হাইস্কুলে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে হরেন পোল্লের উজ্জ্বল মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।

সদরের হাইস্কুলে এত খরচ? বাপরে। তার রোজগার কম বলে, আর মেয়ের দারুণ রেজাল্টের জন্যে টুইশন ফি আদ্দেক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাওতো নেহাত কম নয়! তাছাড়াও এতদূরে রোজ যাওয়া আসা, স্কুলের টিফিন, টুকটাক হাতখরচা, বই খাতা, সেই বা কম কি? হরেন পোল্লের কপালের ভাঁজে আরো একটা ভাঁজ বাড়ল। কিন্তু তার এমন মেয়েকে সে পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানিয়ে সারা জীবন কাটাতে দিতে পারবে না। হরেন পোল্লে স্বপ্ন দেখে, তার মেয়ে ডাক্তার হয়ে তার চোখের কোল পরীক্ষা করছে। বুকে পিঠে স্টেথো ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে বলছে, বাবা বড়ো বড়ো শ্বাস নাও”। থুতনি ধরে বলছে, “হাঁ করো তো বাবা, বলো অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা...। স্বপ্নে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল। হরেন পোল্লে ঠিক করে ফেলল, দিনের ব্যবসাটা কমিয়ে, রাতের ব্যবসাতেই জোর দিতে হবে। বিপদ আছে, ঝুঁকি আছে, কিন্তু দুটো পয়সাও আছে। 

 আশে পাশের গ্রামগঞ্জে যাই হোক আর তাই হোক, প্রফুল্লনগরে চুরি চামারি রাহাজানির তেমন কোন ইতিহাস নেই। এই ছোট্টশহর সরকারি শিল্পনগরী, লোকজন সকলেই চাকরি সূত্রে এখানে বাস করে। অবসর নেওয়ার পর, সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে, যে যার নিজের জায়গায় ফিরে যায়। যারা এ শহরে নতুন আসে, তাদের স্মৃতিতে থাকে ছেড়ে আসা অঞ্চলের চুরি চামারি, ফেরেব্বাজির বিস্তর ঘটনাঅতএব তারা প্রথম প্রথম এসে খুব অসহায় বোধ করে। কোন বাড়িতে পাঁচিল নেই। চারপাশে প্রচুর গাছপালা, বিস্তর ফাঁকা জমি। সন্ধ্যে হতে না হতে, আনকোরা লোকেরা ভয়ে দরজায় খিল এঁটে বসে থাকে। তারপর পাড়া প্রতিবেশীদের থেকে ভরসা পেয়ে, নিজেরাও কিছুদিন থাকার পর সব কিছু বুঝে সুঝে নিলে, ভয়টা কমে। তখন শান্ত নিরিবিলি অথচ নিরাপদ এই জায়গাটাকে সকলেই ভালোবেসে ফেলে। বুঝে যায়, এমন জায়গা এ রাজ্যে আর দ্বিতীয় নেই।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গাকে নোংরা করার আগে লোকে তিনবার ভাবে। কিন্তু যে জায়গায় ময়লা থাকে, লোকের স্বভাব হল সেই জায়াগাটাকে আরো নোংরা করা। ঠিক একই কারণে প্রফুল্লনগরে চুরি করা খুব সহজ জেনেও, চোরেরা এই জায়গাটাকে সমীহ করে এড়িয়ে চলত। কারণ ওই একটাই, এখানে চুরি চামারির কোন ইতিহাস নেই।

প্রফুল্লনগর থেকে পুলিনগড় এমন কিছু দূরে নয় ঠিকই আবার খুব কাছেও নয়, যে জোরে হাঁক পাড়লে শোনা যাবে। সাইকেলে গেলে আধঘন্টা চল্লিশমিনিট লেগেই যায়। পুলিনগড়ে মঙ্গল আর শনিবার এই দুদিন হাট বসে। সেই হাটে বাঘা বাঘা সব ফড়েরা সব্জি নিয়ে আসে সব্জিমণ্ডিতে। তাদের মধ্যে অনেকেরই প্রফুল্লনগরেও সব্জির দোকান আছে। তাদেরই একজন মিঠু শেখ। মিঠুশেখের সঙ্গে একদিন ঘনিষ্ঠ আলাপে হরেন পোল্লে প্রফুল্লনগরের হদিশ পেল

কদিন আগে পুলিনগড়ের উত্তরদিকের গ্রাম জোতলখিমপুরে বেশ বড়ো সড়ো একটা চুরির ঘটনায় চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। সে গাঁয়ের সম্পন্ন ধানচাষী নিতু হাজরার পেল্লায় বাড়িতে সিঁদ দিয়ে চুরি হয়ে গেছে বিস্তর জিনিষপত্র। ঐ নিতু হাজরার ছোটছেলের সামনে বিয়ে। বিয়ের আগে ঘরদোর সাফসাফাই, রং চং করার কাজ চলছিল। সেই রংমিস্ত্রির তুলির খোঁচায় ছিঁড়ে খুঁড়ে গিয়েছিল পুরোনো দিনের ইলেকট্রিক তারের জটিল সংযোগ। আর সেই ইলেকট্রিকের তারের কাজ করতে হরেন পোল্লের ডাক পড়েছিল নিতু হাজরার বাড়িতে। চারদিন যাওয়া আসা করে বাড়ির প্রায় সব ঘরের সুলুক সন্ধান, বাড়ির সামনে, পিছন, আঁদাড়-পাঁদাড় সব বুঝে নিয়েছিল হরেন পোল্লে। ইলেকট্রিকের কাজকম্মো ঠিক ঠাক সেরে, পাওনা গণ্ডা পেয়ে যাওয়ার পাঁচদিনের মাথায়, একদিন নিষুত রাতে হরেন পোল্লে হানা দিয়েছিল নিতু হাজরার বাড়ি।

নিজের হাতের তালুর মতো চেনা বাড়ির পিছনের পাঁচিল টপকে মোক্ষম সিঁদ দিয়েছিল সিঁড়ির দালানের দেওয়ালে। বাড়ির বাইরে উঁচু পাঁচিল, তার গেট বন্ধ। রাত্রে বাড়ির সামনের সদর দরজা আর পিছনের খিড়কি দরজা, সবই বন্ধ থাকে রোজ। সেই কারণে বাড়ির ভিতর ছেলে পুলেরা অনেক ঘরেই দরজা বন্ধ না করেই ঘুমোয়। সেদিন নিখুঁত সিঁদ দিয়ে হরেন পোল্লে নিঃশব্দে উঠে গিয়েছিল দোতলায়। নিতু হাজরার ছোটছেলে আর ভাইপোদের চারটে ঘর খোলা পেয়েছিল হরেন, আর সেই ঘরগুলো থেকে সে সরিয়ে ফেলেছিল, ছটা হাতঘড়ি, পাঁচটা মোবাইল ফোন, একটা ক্যামেরা, নোট আর কয়েন মিলিয়ে নগদ আট হাজার সাতশ তেত্রিশ টাকা। একটা ঘর থেকে টিভি সরানোর জন্যে হাত নিসপিস করলেও নিজেকে সামলেছিল, কারণ তার সিঁদের গর্ত দিয়ে ও জিনিষ বার করা মুশকিল হতো।

ঘটনাটা হয়েছিল মঙ্গলবার রাতে, আজ শনিবারের হাটে সেই গল্প নিয়ে হাট সরগরম। গোপলাবেনের চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে মিঠুশেখের কাছে পুরো ঘটনাটা অবাক হয়ে শুনল হরেন পোল্লে। সে যা যা করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশীই শুনল।

“কি দিন কাল পড়ল রে, হরুএতবড়ো চুরি এ দিগড়ে আগে কোনদিন শুনিনি, বাপরে। কি সাহস চোর ব্যাটার”।

“যা বলেছিস। ঐ হাজরা মশাইয়ের বাড়িতে সেদিন যেটা হল, সেটার কথা বলছিস তো? সত্যি ভয়ংকর”।

“শুধু ভয়ংকর নয় রে হরু, সাংঘাতিকজিনিষপত্র যা গেছে, সে তো গিয়েছে। কিন্তু নিতু হাজরার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে, ওর অমন তাজা তাজা ছেলেপুলে, ভাইভাইপোরা প্রাণে বেঁচে গেল”। হরেন পোল্লে চমকে উঠল নিজের অজানা কীর্তিতে, জিজ্ঞেস করল, “সে কি? চোরটা কাউকে মারধোর বা খুনখারাপি করতে গিয়েছিল এমন তো শুনিনি”।

“তা করেনি ঠিকই, কিন্তু বাকিটাই বা কি রেখেছিল বল? ব্যাটা এমন নিদ-বন্ধন মন্ত্র চালিয়েছিল, কেউ সাড়া পর্যন্ত করতে পারেনি”।

“নিদ-বন্ধন মন্ত্র? সে আবার কি”? তার চোদ্দ বছর চোর জীবনের অভিজ্ঞতায় এমন মন্ত্রের কথা হরেন প্রথম শুনল।

“চোরেরা ঢোকার আগে বাড়ির চারদিক ঘুরে মন্ত্র পড়ে দেয়। তাতে বাড়ির ভিতরে থাকা লোকজন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। সে এমন ঘুম, সে সময় তাদের গায়ের পাশ দিয়ে রাজধানী ট্রেন চলে গেলেও ঘুম ভাঙে না। ঘুমের বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে বলেই, এ মন্ত্রের নাম নিদ-বন্ধন”।

চায়ে একটা চুমুক দিয়ে, চোখ বড়ো বড়ো করে হরেন বলল, “বাপরে, বলিস কি”? 

“তবে? তা নাহলে তুই ভাব, চোরটা সিঁদ দিয়েছে, একতলার সব ঘরে ঢুকেছে, ওপরে গিয়ে দোতলার সব ঘরে ঢুকেছে, সমস্ত ঘর থেকে গুচ্ছের জিনিষ হাত সাফাই করে, নিশ্চিন্তে সটকে পড়েছে। এ কি কম সময়ের ব্যাপার? এতক্ষণের মধ্যে বাড়িতে অতগুলো লোক, কারুর ঘুম ভাঙল না, এ হতে পারে! শুনেছি এই মন্ত্রের এতটুকু এদিক সেদিক হলে, মানুষের মৃত্যু হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়”!

“হুম। একদম হক কথা। তবে কী কী হাতিয়েছে, কিছু খবর পেলি”?

মিঠু শেখ লম্বা চুমুকে চায়ের গেলাস শেষ করে, বলল, “সে অনেকে অনেক কথা বলছে। শুনলাম দশবারো ভরি সোনার গয়না, প্রায় হাজার চল্লিশেক নগদ টাকা। চার পাঁচ গন্ডা হাত ঘড়ি, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা। এক কথায় বাড়ির লোকগুলোকে ছাড়া সব নিয়ে গেছে। সেই চোর ব্যাটা, নিতু হাজরাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়ে, পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে, রে হরু”

হরেনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের গেলাস খালি করল, তারপর বলল, “ইস, ছি ছি। হাজরা মশাইয়ের মতো অমায়িক মানুষের এতবড়ো ক্ষতি কেউ করতে পারল? ভাবা যায় না, মিঠু ভাই”।

“সেই জন্যেই তো বলছি রে, এই তল্লাটে চোর ছ্যাঁচড়ের বড্ডো বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠছে দিন কে দিন। আর চিন্তা কর, এই তো এখান থেকে মাইল দশেক হবে কি হবে না, প্রফুল্লনগর। চুরি নেই, জোচ্চুরি নেই। সারা রাত লোকে দরজা জানালা খুলে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। একটা সেফটি পিন অব্দি চুরি যায় না। যেন সত্যযুগ, রামরাজত্ব।”

“যাঃ, এমন জায়গা আবার হয় নাকি? হতে পারে, এদিকের থেকে কম সম হয়, কিন্তু একেবারেই হয় না”?

“আমার কথায় তোর বিশ্বাস হলো না তো?। আমি তো হপ্তায় পাঁচদিন প্রফুল্লনগরেই যাই। ওখানকার বাজারে আমার সব্জির দোকান আছে, ওখানকার বড়ো বড়ো অফিসাররা আমার কাছে আসে টাটকা সব্জির জন্যে। তাদের মুখেই শুনেছি, প্রফুল্লনগর নামেও প্রফুল্ল কাজেও প্রফুল্ল, হাসি খুশি। কোন ভয় নেই, আতংক নেই, শান্তির জায়গা”।

“তাই নাকি, প্রফুল্লনগর এমন জায়গা? মিঠুভাই, এ নিয়ে পরে আবার কথা বলব। এখন উঠছি, দোকানে কেউ নেই, অনেকক্ষণ খোলা রেখে এসেছি”।

 ছোট্ট শহর হিসেবে প্রফুল্লনগরে থানা একটা আছে, কিন্তু সে না থাকারই মতো। থানার বড়ো, মেজ কোন বাবুই নেই, আছেন এক ছোটবাবু আর সঙ্গে গোটা তিনেক হাবিলদার। যে খাতায় ডাইরি লেখা হয়, সে খাতাটায় ছোটবাবুর বড়ছেলে, কাটাকুটি খেলে শেষ করে দিয়েছে। শহরে রোজ কটা কুকাজ হল, তার বর্ণনা লিখে রাখার নিয়ম থানার ক্রাইম রেজিস্টারে সেই রেজিস্টার শেষ লেখা হয়েছিল, ২০১০ সালের সরস্বতীপুজোর ভোরবেলা। দুটো বাচ্চা মেয়েকে একদম বমাল সমেত ধরে এনেছিল এক কটকটে বুড়ি। কটকটে বুড়ির পাল্লায় পড়ে ছোটবাবুকে ডাইরি আর ক্রাইম রেজিস্টার দুটোই লিখতে হয়েছিল। বাচ্চা মেয়েদুটোর হাত থেকে বাজেয়াপ্ত করতে হয়েছিল পুজোর ফুল সমেত, ফুলের সাজি। থানার জিম্মায় দিয়ে কটকটে বুড়ি ফিরে যাওয়ার পর, বাচ্চা মেয়েদুটিকে রিকশায় নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন ছোটবাবু নিজেই। সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ফুলের সাজি দুটোও। বেচারা মেয়েদুটি ফুলচোর, সরস্বতী পুজোর জন্যে ফুল চুরি করতে গিয়েছিল ঐ বুড়ির বাগানেযাই হোক, সেই রেজিস্টারে ছোটবাবুর স্ত্রী এখন বাজারের হিসেব লেখেন।

সেই ঘটনার প্রায় চার বছর পরে, সেদিন শিবেনবাবু থানায় গিয়েছিলেন, চুরির অভিযোগ নিয়ে। খোলা জানালার ধারে টেবিলের উপর রাখা ছিল তিনটে হাতঘড়ি, দুটো মোবাইল ফোন, ক্যালকুলেটর, জ্যামিতির বাক্স সব চুরি হয়ে গেছে। ছোটবাবু শিবেনবাবুকে অনেক বোঝালেন, প্রফুল্লনগরে এমন হতেই পারে না। জিনিষগুলো তাঁর বাড়ির বাচ্চারাই দুষ্টুমি করে লুকিয়ে রেখেছে। টিভিতে “ছোটাভীম” দেখতে দিলেই সব বের করে দেবে। কিংবা দুপুরের দিকে মাঝে মাঝে হনুমানের দল আসে, তাদের বাঁদরামিও হতে পারে। কিন্তু চুরি? অসম্ভব।

এই ঘটনার দিন কুড়ি পরে, সন্টুবাবু প্রায় একই অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলেন। এবারে ছোটবাবুকে একটু নড়েচড়ে বসতেই হল। পরপর দুটো একইরকম ঘটনায় তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হাবিলদারকে বলে পাড়ার দোকান থেকে দুটো বড়ো বড়ো রুলটানা খাতা আনিয়ে তিনি ডাইরি লিখলেন, লিখলেন ক্রাইম রিপোর্টকিন্তু এতেই থেমে থাকল না, এই ঘটনার মাস খানেকের মধ্যে চুরির অভিযোগ নিয়ে আবার এলেন স্বপন সাঁতরা। তাঁরও প্রায় একই অভিযোগ, বাড়তির মধ্যে তাঁর কোয়ার্টারের সীমানার মধ্যে দুটো নারকেল গাছ থেকে চোরটা সমস্ত নারকেল সাফ করে দিয়েছে। ডাইরি আর ক্রাইম রিপোর্ট লিখিয়ে স্বপনবাবু চলে যাবার পর, তিনি হাবিলদার সুখন রাম আর রামপ্রকাশকে বললেন, তাঁর সাইকেল বের করতে। তিনি তদন্তে যাবেন। কিন্তু সুখন রাম জানাল, সাইকেলের যা হাল, তাকে সারিয়ে সুরিয়ে খাড়া করতে দিন দুয়েক লাগবেই।

দুমাসের মধ্যে লাগাতার তিনটে চুরির ঘটনায়, প্রফুল্লনগরের শান্ত পরিবেশ উত্তাল হয়ে উঠল। অফিসে, বাজারে, স্কুলে কলেজে, চায়ের দোকানে, মহিলাদের বিউটি পার্লারে সর্বত্র এই আলোচনা। প্রফুল্লনগর যে অপরাধীদের হাতে চলে গেছে, এতে সকল বাসিন্দারাই একমত। সন্ধের পর লোকজন জরুরি কাজ না পড়লে বের হচ্ছে না। বাজারের দোকানপাট সাড়ে সাতটায় বন্ধ হয়ে, শুনসান হয়ে যাচ্ছে। অসহায় নেড়ি কুকুরগুলোও ভয়ে ফুটপাথের ধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে।

বাবা তখনো অফিস থেকে ফেরেননি। সন্ধেবেলা মায়ের সঙ্গে ঘরের বাইরের বারান্দায় বসে গল্প করছিল টুম্পি আর তার দুই যমজ বোন রুনুঝু্নুকথায় কথায় চলেই এল প্রফুল্লনগরের চুরির ব্যাপারটা। টুম্পি রুনুঝুনুকে বলল, “এই চুরির ব্যাপার নিয়ে, তোদের ভূতবন্ধু রুকুসুকু কিছু জানে না”? রুকুসুকু দুই যমজ ভাই, কিন্তু ভূত, রুনুঝুনুর সঙ্গে খুব ভাব।

[এই দুই যমজ ভূত এবং রুনু-ঝুনুর পরিবার সম্পর্কে সব কথা জানতে হলে পড়ুন "ছোট্ট হওয়া"] 

রুনুঝুনু বলল, “তুইই জিজ্ঞেস কর না, দিদি। ওই তো ওরা, সেই থেকে বসে বসে আমাদের কথা শুনছে।”

“হ্যারে রুকুসুকু, আমাদের এ শহরে কী হচ্ছে বল দেখি, বাবা? তোরা কিছু জানিস”? মা আগে ভয় পেতেন, কিন্তু আজকাল আর পান না। উল্টে বাড়িতে মিষ্টিটিষ্টি আনলে কিংবা ভালোটামন্দটা রান্না হলে ডেকে খেতে দেন, বলেন, “আহা, ওরা দুই বেচারা ভুত হলে কি হবে, আমি জানি মা মরা ভুতদের খুব দুঃখ”।

মায়ের কথায় রুকু একটু কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে মা, জানি বৈকি। ওই চোরের বিস্তর খবর জানি। ওর ভালো নাম হরেন পোল্লে। ধরা পড়লে আরো চারটে নাম ও বলে থাকে বিশু মণ্ডল, হারু বাগ, ছোঁচা মল্লিক, মটর সর্দার”

টুম্পি নাক বেঁকিয়ে বলল, “ছোঁচা? ছোঁচা আবার কারো নাম হয় নাকি? নাম শুনলেই তো সাবান মেখে ভালো করে চান করতে ইচ্ছে হয়।“

“আজ্ঞে, যা বলেছো, মেজদিদি। ও ওইরকমই। এক এক জায়গার জন্যে এক এক নাম। পুলিনগড়ের হাটে একটা ইলেক্ট্রিকের দোকান আছে, ভালো চলে না। অভাবে স্বভাব নষ্ট। এক এক দিন এক এক গাঁয়ে চুরি করে বেড়ায়। চোদ্দ বছরের চুরির অভিজ্ঞতা, মাত্র পাঁচবার ধরা পড়েছে ছোঁচা মল্লিককে গোটা চোরসমাজে সকলেই সমীহ করে চলে”।   

“বাবা, চোরেদের আবার সমাজ”? মা অবাক হয়ে গালে হাত দিলেন।

“চোরেরা কি মানুষ নয়, মা? ওদেরও সমাজ আছে, বিধি নিষেধ আছে, সভা সমিতি, ব্রত পালা পার্বণ, উৎসব সবই আছে”।

“ব্রত? কিসের ব্রত পালন করে চোরেরা”? হেসে ফেলে টুম্পি জিজ্ঞেস করল।

“সে এক আধটা নয়, অনেক, মেজদিদি। একটার কথা বলি। পোষ মাসের অমাবস্যায় পোষালি ব্রত খুব ধুম জাঁক করে চোরেরা পালন করে। ওই দিন ওরা গৃহস্থের বাড়ি চুরি করবেই। চোরেদের ওটাই নাকি বছরের প্রথম দিন। ওদের ধারণা, ওইদিন ভালোয় ভালোয় চুরি হলে, সারা বছর ভালোই যাবে” 

“সে না হয় পরে একদিন শুনবো, তার আগে আমাদের এই ছোঁচা, না কি বললি, তার খবর কী বল”। মা বললেন।

“হ্যাঁ মা, এই বলি। চোর হিসেবে খুব সুনাম থাকলেও হরেন পোল্লে, আগে রয়ে সয়ে কম সম চুরি করতো। কিন্তু ইদানীং সে চুরির মাত্রা খুব বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে”।

“বাধ্য হয়েছে? কেন”? মা জিজ্ঞেস করলেন

“আজ্ঞে মা, সে যেমন আনন্দের কথা, তেমনই দুঃখের কথাও বটে। হরেন পোল্লের একমাত্র মেয়ে শুক্লা পোল্লে, নামেও শুক্লা, গুণেও শুক্লা সরস্বতী। এবারের মাধ্যমিকে আমাদের এই জেলায় শুক্লা দ্বিতীয় হয়েছিল। হরেনের স্বপ্ন মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবে, তাই সদরের স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পাঠিয়েছে, কিন্তু খরচ? সেই খরচের যোগাড়েই হরেনকে এখন ফি হপ্তায় দুবার করে চুরিতে বেরোতে হচ্ছে”।

“বলিস কি রে, রুকুসুকু, অমন হীরের টুকরো মেয়েকে মানুষ করার জন্যে বাবাকে শেষ অব্দি চুরি করে বেড়াতে হচ্ছেছি, ছি, এতো আমাদেরই, লজ্জা রে। এর একটা বিহিত তো না করলেই নয়”মা খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন। সুকু এতক্ষণ কিছু বলেনি, চুপ করে সব কথা শুনছিল, সে বলল, “হ্যাঁ মা, এমন কিছু করুন যাতে ছোঁচা মল্লিককে আর চুরি করতে না হয়, অথচ শুক্লাদিদি ডাক্তার হয়ে শহরে ফিরে আসে”।

সুকুর এই কথায় কেউ কোন উত্তর দিল না। কিন্তু সকলেই মন খারাপ করে বসে ভাবতে লাগল সুকুর কথাগুলো। টুম্পির এখন মনে হল ছোঁচা নামটাও এমন কিছু মন্দ নয় কিছুক্ষণ পর মা বললেন, “ঠিক আছে আমি কালই আমাদের মহিলা সমিতির সভায় এই কথাটা পাড়বো, দেখি কী করা যায়”।   

 আলু চচ্চড়ি দিয়ে গরম গরম চার খানা রুটি আর ভেলিগুড় দেওয়া ঘন চা। এই জলখাবার খেয়ে, রবিবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ হরেন পোল্লে তার দোকান খুলতে হাটের দিকে রওনা হল। গত দু হপ্তা জ্বরজ্বারিতে জেরবার হয়ে রাত্রে কোথাও বেরোতে পারেনি হরেন। বাজারও মন্দা, দোকানে বেচাকেনা নেই বললেই হয়। ঘরে টাকা পয়সার বাড়ন্ত, এমন চললে দিন পনের পর উনুনে হাঁড়ি চড়বে কিনা সন্দেহলেখাপড়া শিকেয় তুলে, শুক্লামাকেও ঘরে এসে বসতে হবে। পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানাতে হবে, নয়তো লোকের বাড়ি বাড়ি কাজে লাগতে হবে। হরেনের মাথার মধ্যে এই চিন্তাগুলো সর্বদাই ঘুরপাক খাচ্ছে, আর এই চিন্তা করলেই, তার দুচোখ ঝামড়ে জল চলে আসছে। ঝাপসা দুই চোখে তখন কিচ্ছু দেখতে পায় না। এখনো সে নিজের দুরবস্থার কথা ভাবতে ভাবতেই ঝাপসা চোখে সাইকেল চালাচ্ছিল।

চোখ ঝাপসাই হোক আর যাই হোক, হাটে যাবার এই রাস্তা তার এত চেনা, যে চোখ বন্ধ করেও হাটে পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তু পারল না, সামনে আরেকটা সাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে, পড়ে যেতে যেতেও ডান পায়ের ঠেকনো দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে তার মুখটাও ঝাপসা দেখল হরেন। সেই লোকটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “চোখে দেখতে পান না, কানা নাকি? চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত লোক সাইকেল খাড়া করে দাঁড়িয়ে, হাত নেড়ে দাঁড়াতে বলছি সেই থেকে, দৃকপাত না করে, ধাক্কা মেরে দিলেন?”

হরেন হাতের তালুতে চোখ মোছার পর, এবার স্পষ্ট দেখতে পেল লোকটাকে। লোকটা একলা নয়, তার পিছনে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে, আর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হরেন ধরা ধরা গলায় বলল, “আজ্ঞে, শোকে তাপে পোড়া মানুষ। দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে এসেছিল, তাই অঘটনটা ঘটিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না। চোট টোট লাগে নি তো, দাদাভাই”?

“চোখে জল নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন, এতো, ভাল কথা নয়, হরেনবাবু”। 

পিছনের লোকটি এতক্ষণ কিছু বলে নি, এখন বলল, “হরেনবাবু, না ছোঁচা মল্লিকবাবু”? 

তার এই কথায় ধাক্কা খাওয়া প্রথম লোকটি বলল, “নাকি বিশু মণ্ডলবাবু, না মটর সর্দারবাবু? কি নামে আপনাকে ডাকব বলুন তো, ভাই”?

লোকদুটোর এই সব কথায় হরেন পোল্লের পায়ের এবং সাইকেলের চাকার তলা থেকে মাটি সরে গেল। এ লোকদুটো যে সাধারণ লোক নয়, সেটা বুঝতে তার আর বাকি রইল না। কারণ তার এতদিনের তস্কর জীবনে এই লোক দুটোই প্রথম, যারা তার নামরহস্য জানে! আতঙ্কে আর বিস্ময়ে হরেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে, বলল, “আপনাদের তো আজ্ঞে, চিনতে পারলাম না, দাদাভাই। আমার মতো সামান্য লোকের এত তত্ত্বতালাশ জানলেনই বা কি করে”?

“কি করে জানলাম সেটা বড়ো ব্যাপার নয়, ছোঁচা মল্লিকবাবু। আমরা দুজনেই আসছি প্রফুল্লনগর থেকে, আমার নাম নেপাল ঘোষ, আর উনি দেবু নস্করআমরা সাতসকালে আপনার অপেক্ষাতেই এই পথে দাঁড়িয়েছিলাম, আপনাকে প্রফুল্লনগর নিয়ে যাবো বলে।”

“আপনারা কি পুলিশ”?

“পুলিশ হলে কি খুব ভালো হত, মটরবাবু? কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে সকলের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গেলে তবেই না পুলিশ? হাটের লোকজন কি মনে করত, তাতে কি আপনার সম্মান বাড়ত? না মটরবাবু, আমরা পুলিশ নই”

দেবু নস্কর মিচকে হেসে উত্তর দিল, “সাইকেলে চেপে পড়ুন, হরেন বাবু। কতটুকুই বা পথ, তিনজনে সুখদুঃখের গল্প করতে করতে দিব্যি চলে যাব। সেখানে গেলে আপনার ভালোই হবে, চাই কি আপনার জীবনের আর আপনার মেয়েকে নিয়ে সব স্বপ্নও হয়তো পূরণ হয়ে যাবে”।

“আমার মেয়েকেও চেনেন, আপনারা? আমার মেয়েটা যদি জানতে পারে, আসলে আমি একটি চোর, ও বোধহয় আর বাঁচবে না। ওর কানে যেন এই সব কথা না যায়, দাদাভাই, সেটা একটু দেখবেন”। বলতে বলতে হরেন পোল্লের গলা ভারি হয়ে এল, আবার তার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। নেপাল ঘোষ হরেনের হাত ধরল, দেবু নস্কর হাত রাখল তার কাঁধে, তারপর নেপাল ঘোষ  বলল, “আপনার মেয়ে, আমাদের জেলার গর্ব, তাকে আমরা হেরে যেতে দেব না, হরেনবাবু। এখন তাড়াতাড়ি চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে”।    

 ওদের পৌঁছে যাবার খবর পেয়ে সমিতির হলঘরে শহরের গণ্যমান্য লোকজন এবং সমিতির মহিলারা এসে জড়ো হলেন। তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। স্টেজের নীচেয় সকলের সামনে হরেন পোল্লেকে দাঁড় করিয়ে দিল নেপাল ঘোষ ও দেবু নস্কর। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে নেপাল ঘোষ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “আমাদের এই নিরিবিলি প্রফুল্লনগরে, দুমাসে তিন তিনটি চুরি করে অশান্তি এনে দিয়েছে যে লোকটি, তার নাম হরেন পোল্লে। এই হচ্ছে সেই লোক। উপস্থিত দিদিভাই ও দাদারা, এখন আপনারাই ঠিক করুন, এর কি শাস্তি হওয়া উচিৎ”

এত গণ্যমান্য লোক এবং মহিলাদের দেখে হরেন পোল্লের হাঁটু কাঁপতে লাগল। রাতের অন্ধকারে নিখুঁত দক্ষতায় লোকের বাড়ি বাড়ি চুরি করতে যার বুক কাঁপে না, আজ এই উজ্জ্বল আলোর হলঘরে, ভয়ে তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ, জিভটাকে মনে হচ্ছে শুকনো কাঠের টুকরো। সামনের সারির বাঁদিক ঘেঁষে বসে আছেন থানার ছোটবাবু, তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন হাবিলদার। পাশে দাঁড়ানো নেপাল ঘোষকে হরেন পোল্লে বলল, “দাঁড়াতে পারছি না, দাদাভাই, একটু বসব”? বলে স্টেজের দেওয়ালে হেলান দিয়ে হলের মেঝেতেই থেবড়ে বসে পড়ল।

“আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান, ওখানে বসছেন কেন, চেয়ার দিচ্ছি”। দেবু নস্কর ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল।

“না দাদাভাই, এই বেশ আছি। বড়ো দুব্বল লাগছিল, এখন একটু ভাল বোধ হচ্ছে”

কেউ একজন এক গ্লাস জল এনে দিতে জলটা ঢক ঢক করে খেয়ে খুব শান্তি পেল হরেন পোল্লে। তারপর মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইল।

একটু পরে রুনু-ঝুনুর মা উঠে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে বললেন, “শ্রদ্ধেয় নাগরিকবৃন্দ ও আমাদের সমিতির সদস্যাগণ, এই লোকটি একজন চোর। সামান্য পুঁজির ইলেকট্রিকের দোকান থেকে এর ছোট্ট সংসার প্রতিপালন হত না। সেই অভাব ঘোচানোর জন্যে ছোটখাটো চুরি করতে করতে আজ এই লোকটি একজন মহাচোর। এই চোরের আতংকে আমাদের রাতের ঘুম চলে গেছিল। আজ এই লোকটি ধরা পড়ে, অসহায় হয়ে আমাদের সামনে হাজির। গত রবিবারেও এই সমিতি ঘরেই, আমাদের একটি সভা হয়েছিল। সেই সভায় আমাদের সকলেই এক মত হয়ে এই লোকটির কি শাস্তি দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছিলাম। এখন আমি মহিলা সমতির প্রধান আলোকা দত্তকে অনুরোধ করব, তিনি সামনে এসে তাঁর দেওয়া সেই কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করুন”

আলোকা দত্ত সামনে এগিয়ে এলেন, প্রথমে হরেন পোল্লের দিকে তাকালেন তারপর সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “এই লোকটি, যার নাম হরেন পোল্লে একজন চোর, ভদ্রলোক নয়, একজন লোক। আর এই হলে বাকি আমরা সবাই ভদ্রলোক।  আজ আমরা যারা এই কারখানায়, বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ করতে এসেছি, আমরা সবাই ভদ্রলোক। কিন্তু আজ আমাদের এই কারখানাটা যদি বন্ধ হয়ে যায়, কাল সকাল থেকে আমাদের কাজটা যদি আর না থাকে? আমরাও কি পারবো এই রকম ভদ্রলোক থাকতে? নাকি কিছুদিন ভদ্রলোক থাকার চেষ্টা করতে করতে, আমরাও হেরে গিয়ে, ভদ্রতা হারিয়ে, ঐ লোকটির মতোই হরেন পোল্লে কিংবা মটর সর্দার অথবা ছোঁচা মল্লিক হয়ে উঠবো? আপনারা উপস্থিত সকলে একবার চিন্তা করে দেখুন তো, ভদ্র অভদ্র ব্যাপারটা কি হাওয়ার মতো খুব হালকা নয়”?

আলোকা দত্ত কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন, সে সময় হরেন পোল্লে মুখ তুলে তাকালো তাঁর দিকে, হরেনের চোখ এখন আর ঝাপসা নয়, দু চোখ থেকে জলের ধারা নেমে আসছে। দুই হাত জড়ো করে সে আলোকা দত্তের দিকে নমস্কার করে, আবার মুখ নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

“হরেনবাবু, ওই জোড়হাত আর চোখের জল দেখে আপনার শাস্তি মকুব হবে না। আপনাকে কঠোর শাস্তি পেতেই হবে। তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে, আপনি আর চুরি করবেন না। বলুন, কথা দিন”

“কথা দিলাম, দিদিভাই, কোনদিন আর চুরি করবো না”। হরেন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।                 

“তাহলে আপনার সংসার চলবে কী করে? আপনার মেয়ে শুক্লা ডাক্তার হবে কী করে”?

“সে সব আর হবে না, দিদিভাই। মেয়েকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে কোন কাজে ঢুকিয়ে দেব। মা, মেয়ে, আমি সবাই মিলে খাটলে সংসারটা টিকে যাবে, দিদিভাই, ভাববেন না। কিন্তু নাঃ, এই চোরের কাজ করে সত্যি খুব ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম দিন দিন, আর করবো না। যে স্বপ্ন পূরণ হবার নয়, সে স্বপ্ন আর দেখবোই না।”

“শুক্লার মতো মেধাবী ছাত্রীকে আমরা তো এমন সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিতে পারি না, হরেনবাবু। চুরি করেছেন, তাও আমরা আপনাকে পুলিশে দিইনি। কিন্তু লেখা পড়া ছাড়িয়ে শুক্লাকে এখন কাজে লাগিয়ে দিলে আমরা সবাই মিলে আপনাকে পুলিশে দিয়ে দেব। দেখেছেন তো আমাদের সঙ্গে দারোগাসায়েবও আছেন?

হরেনবাবু, আপনার পুলিনগড় হাটের ঐ দোকান তুলে দিন। আমরা আমাদের এখানে দোকান করার জন্যে আপনাকে দোকান ঘর দেব, বড়ো রাস্তার ধারে, ইলেকট্রিকের আলো ফ্রি। আমাদের এই সমিতির সকলে আপনার সঙ্গে সবরকমের সহযোগিতা করবো। আপনার দোকান থেকে আমরা সবাই জিনিষ কিনব। আমাদের বাড়িতে ইলেক্ট্রিকের সমস্যা হলে আমরা আপনাকেই ডাকব। আমাদের এই শহর ছোট্ট হলেও, আপনার ঐ পুলিনগড়ের থেকে অনেক বেশী লোকজন থাকে। অতএব আপনার বিক্রিবাটা খারাপ হবে না। আর সবার শেষে বলি, আমাদের মহিলা সমিতি আর নাগরিক সমিতি থেকে আপনার মেয়েকে প্রত্যেক মাসে দেড় হাজার টাকা বৃত্তি দেওয়া হবে।

নেপালভাই, দেবুভাই তোমরা হরেনবাবুকে দোকানঘর দেখিয়ে দাও। কালকে সন্ধের মধ্যেই যেন ওঁনার এই দোকান চালু হয়ে যায়, আমরা সবাই যাবো সেই নতুন দোকান দেখতে। আর হরেনবাবু, আপনার বা আপনার মেয়ের ব্যংকে অ্যাকাউন্ট আছে? না থাকলে দু পাঁচদিনের মধ্যে খুলে নিন, আমরা শুক্লার বৃত্তির টাকাটা তার নামে ব্যাংকেই জমা দেব” 

হরেন কাঁদতে কাঁদতে উঠে এসে আলোকা দত্তর পায়ে ধরতে নীচু হচ্ছিল। আলোকা দত্ত জোর ধমকে বলে উঠলেন, “মাথা নীচু করে প্রণাম-ট্রণাম করবেন না, হরেন বাবু। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখুন। আপনাকে আমরা সবাই মিলে যে সুযোগ দিলাম, সেখান থেকে আবার যদি বিপথে যান, তাহলে কিন্তু আপনাকে আমরা ছেড়ে দেব না। মনে রাখবেন আপনার প্রত্যেকটি গতিবিধি, সর্বক্ষণ লক্ষ্য করবে দুইভাই, রুকুসুকু। আপনি তাদের দেখতে না পেলেও, জানবেন তারা আছে। তাদের থেকেই আপনার সব বৃত্তান্ত আমরা সবাই জেনেছি। আমাদের অনুরোধ, আপনার মেধাবী মেয়েটিকে মাথা তুলে বাঁচতে দিন, আপনিও মাথা তুলে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যান। ব্যস, এই আপনার শাস্তি

 এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে, পুজোর ছুটির পর হরেন পোল্লে মেয়েকে সদর স্কুলের বোর্ডিংয়ে রাখতে যাচ্ছিল। বাসে দেখা নিত্য মণ্ডলের সঙ্গে। গাঁ ঘরের কথা আলোচনা হতে হতে, নিত্য হঠাৎ বলে উঠল, “আমাদের এদিকে চুরি চামারিটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে, জানো? শুনেছি এদিকের ছোঁচা মল্লিক বলে চোরটাকে আর নাকি দেখাই যায় না। বাইরে কোথাও চলে গেছে, বোধ হয়”হরেন পোল্লে ঘাড় নেড়ে সায় দিল আর মনে মনে বলল, ‘হুঁ, বিশু মণ্ডল, হারু বাগ, ছোঁচা মল্লিক কিংবা মটর সর্দার, কোন চোরকেই আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারণ তারা সব্বাই নতুন করে বাঁচার মন্ত্র পেয়ে গেছে’! 

 -০০-  

 

বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ১৭

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


[আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে "সুরক্ষিতা - পর্ব ১৬"]


১৭

 প্রত্যেক রোববার সকালেই শুভময়ীদেবী “একান্ত সহায়”-এ যান, বিট্টুকে দেখতে। আজ যখন তিনি বিতানের “একান্ত সহায়”-এ পৌঁছলেন, বিতানরা অনেকে মিলে বেশ বড় একটা হলঘরে ছিল। সকলেই হুইল চেয়ারে বসেওদের পিছনে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন ম্যাডাম। শুভময়ীদেবীকে দেখে ম্যাডাম দুজন তাঁকে ইশারায় চুপ করে একটু আড়ালে দাঁড়াতে বললেন। তিনি বিতানকে ও অন্য সকলকেই দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু ওরা তাঁকে লক্ষ্য করে নি। শুভময়ীদেবী দেখলেন কথা বলতে পারছে না, কিন্তু মুখের অব্যক্ত আওয়াজ, দুইহাত আর চোখমুখের ইঙ্গিতে ওরা নিজেদের মতো আলাপ করছে। মা হিসেবে বিট্টুর অনেক ইঙ্গিত তিনি বুঝতে পারতেন, কিন্তু আজ প্রায় কিছুই বুঝতে পারলেন না। কিন্তু ওদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ায় যে কোন অসুবিধে হচ্ছে না, ওরা যে খুবই আনন্দে রয়েছে, এটুকু বুঝে নিতে পারলেন অতি সহজে।   

বেশ কিছুক্ষণ ওদের এই আলাপচারিতা দেখতে দেখতে তাঁর চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল। তাঁর মনে হল বিট্টুকে তাঁদের আঁচলের তলায়, বদ্ধ একটা ঘরে এতদিন বন্দী রেখে শুধু ভুল নয়, তাঁরা অন্য্যয় করেছেন। একটা শিশু সুস্থই হোক বা অসুস্থ, বেড়ে ওঠার জন্যে, বাবা-মা এবং ঘরের পরিবেশ ছাড়াও বাইরের সঙ্গে পরিচিতিও সমান জরুরি। তাঁর বিট্টুকে সাধারণ স্কুলে দেওয়া সম্ভব হত না ঠিকই, কিন্তু এরকম কোন প্রতিষ্ঠানে আগেই দেওয়া যেত। তাতে তাঁর এই পিছিয়ে পড়া বিট্টুর ভালোই হত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি দেখতে লাগলেন ওদের, খুশীতে তাঁর মুখে ফুটে উঠল হাসির আভাস, অথচ দুচোখ ভরে উঠল জলে।        

বেশ কয়েকবার ছবিকেও নিয়ে গেছেন সঙ্গে, আজ নিলেন না। গতকাল স্কুলে বেরোনোর আগেই ছবিকে তিনি বলে দিয়েছিলেন – ওর মা আর দিদুকে বলতে – দুপুরে আজ এখানে খাবে। আরও বলেছিলেন, ভালো করে রান্না করতেভাত, শুকনো করে সরু সরু ফালির করলা ভাজা, পোনা মাছের তরকারি, বিউলির ডাল, সঙ্গে বেশ ঝালঝাল আলুপোস্ত, আর শেষ পাতে চাটনি ধরনের কিছু। তাঁর এই খাবারের ফর্দ শুনে খুব অবাক হল এবং ভয়ও পেল ছবি, কিন্তু কিছু বলল না।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি খুব অবাক চোখে লক্ষ্য করতে লাগল শুভময়ীদেবীকে। গত কয়েকদিন ধরেই শুভময়ীদেবী অনেকটাই হাল্কা মেজাজে রয়েছেন। তাঁর মুখের থেকে বিষণ্ণ গম্ভীর ছায়াটা সরে গেছে। জল দিয়ে ধুয়ে কাপড় দিয়ে গাড়ির বডি মুচ্ছিল ড্রাইভার রামদীন, শুভময়ীদেবী গাড়িতে না বসে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন গাড়িটা। কোনদিন এমন করেন না। আগে মনে হত, এ গাড়ি যেন তাঁর নয়, অন্য কারো ভাড়ার গাড়ি। তিনি শুধু যাত্রীআজ বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, দু’একটা নির্দেশ দিলেন রামদীনকে। তারপর অল্প হেসে ছবির দিকে তাকিয়ে, হাত নেড়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।

এই সময়ে ছবির একটা কথা মনে পড়ল। অনেকদিন আগে মিঠুদিদি বলেছিল, ওদের স্কুলে নাকি শুভময়ীদেবীকে, শুভ“মই” বলে আড়ালে। “মই” কেন? “বারে দেখিস নি - ছিপছিপে কি সুন্দর লম্বা গড়ন আন্টির? দুর্ধর্ষ ফিগার। কম বয়সে বহু ছেলের হার্টথ্রব ছিলেন নিগ্‌ঘাৎ”“হার্টথ্রব” মানে? ছবির এ প্রশ্নে, হাল ছেড়ে দিয়ে মিঠুদিদি বলেছিল “কিন্তু সব ছেড়ে কেন যে অমন ভোঁদকা স্বামী জুটল কে জানে”আজ এই সময় কথাটা তার হঠাৎই মনে পড়ল, কেন?

শুভময়ীদেবীকে নিয়ে গাড়ি বেড়িয়ে যেতে, ছবি ঘরে ঢুকল, তাকে এখন বাজার যেতে হবে। কিনে আনতে হবে, টাটকা করলা, মাছ, আলু। পোস্ত, বিউলির ডাল, মৌরি, কাঁচা লঙ্কা, সাদা সরষে, সরষের তেল ঘরেই আছে, আনতে হবে একটু টক দই...আরো কিছু টুকটাক তার কাছেই এখন মাস খরচের টাকা দিয়ে দেন শুভময়ীদেবী। টাকা আর বাজারের থলি নিয়ে, দরজায় তালা দিয়ে ছবি বের হল বাজারের উদ্দেশ্যে মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে

কী এমন হল যে, মামী তার মা আর দিদুকে ডেকে পাঠাল? তার ওপর আবার দুপুরে খাওয়াবে, বেশ তরিবত করে? কেন? তাকে কি ছাড়িয়ে দেবে বলে, ঠিক করে নিয়েছে মামী? তা যদি হয়, সেকথা তো ছবিকেই বলতে পারত – সরাসরি। “এ মাসের কটা দিন যাক – সামনের মাস থেকে তুই অন্য কোথাও কাজ ধরে নে, ছবি”। তার কাজটা যে সামনের মাস থেকে আর থাকবে না – সে কথা বলার জন্যে এত ঘটা করে, তার মা আর দিদুকে ডেকে খাওয়ানোর কি দরকার ছিল?  

বাজার থেকে ফিরে প্রত্যেকটা রান্নাই খুব মন দিয়ে আর যত্ন নিয়ে করল ছবি। যেমনভাবে তাকে শিখিয়েছিলেন শুভময়ীদেবীর শাশুড়িবাজার থেকে ফেরার পথে মিষ্টি দই কিনে এনে রেখে দিয়েছে ফ্রিজে – শুভময়ীদেবী বলেননি, কিন্তু ছবি জানে শুভময়ীদেবী শেষ পাতে মিষ্টি দই পছন্দ করেন খুবরান্না বান্না সেরে, সব গুছিয়ে ফেলার পর হাত খালি হয়ে গেল ছবির। আপাততঃ তার আর কোন কাজ নেই, সাড়ে বারোটা বাজে প্রায়। শুভময়ীদেবীর ফিরতে এখনো ঘন্টা খানেক তো বটেই।

রান্নাবান্না সেরে চট করে স্নানটা সেরে নিল ছবি। ঘড়িতে দেখল সোয়া বারোটা বাজছে। মা আর দিদুর আসতে সাড়ে-বারোটা, পৌনে একটা হবে। মামীর আসতেও প্রায় একটাই হয়। আপাততঃ হাতে এখন আর কোন কাজ নেই বলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ছবি। এই মধ্য দুপুর ছুটিরদিনে সামনের বাগানে লোকজন বেশ কম। দু তিনটে কুকুর ল্যাং ল্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক – শুঁকছে, দাঁড়াচ্ছে, আবার হাঁটছে...। ছবির মনে ফিরে এল দুশ্চিন্তা।

এই বারান্দা। এই ঘর। এই অ্যাপার্টমেন্ট। এই ঘরে তার ওপর অর্পিত গৃহিণীপনা! কতদিন, আর কতদিন। এ সব ছেড়ে, সেও কি প্লাস্টিকের চটি ঘসটানো আওয়াজ তুলে দৌড়বে টালিগঞ্জ স্টেসনে ট্রেন থেকে নেমে। আধা রাতে ঘরে ফিরে আলু-পটল সেদ্দ-ভাত রান্না করে খাবে আর ক্লান্ত শরীরটাকে ফেলে দেবে ঘুমের কোমল কোলে। তাও মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যাবে সারাটা দিন সস্তা ডিটারজেন্ট পাউডার আর জলে হেজে যাওয়া হাতের আর পায়ের যন্ত্রণায়। সে দেখেছে তার মাকে। তার দিদুকে। মাঝরাতে লম্ফ জ্বেলে ওরা তেল লাগায় হাতের তালুতে, পায়ের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে। জলে ভিজে থাকলে হাজার যন্ত্রণা কম হয়, শুকোলে বাড়ে।

নিজের হাতের পরিষ্কার তালুর দিকে সে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, এই স্পষ্ট রেখাগুলি নাকি মানুষের ভাগ্য বলে দেয়? কি আছে তার ভাগ্যে? বাসন মাজার সস্তা ডিটারজেন্টের দাপটে তার মায়ের, দিদুর হাতের তালু কবেই ক্ষয়ে-হেজে গেছে, হাতের ভাগ্যরেখাও ঝাপসা হয়ে গেছে কতদিন...। তাই কি তাদের ভবিষ্যতও সর্বদাই অনিশ্চিত আর ঝাপসা? অনেক, অনেকদিন পর চোখে জল চলে এল ছবির, ঝাপসা হয়ে এল মেলে রাখা দুহাতের তালুতে আঁকা রেখাগুলিও। এই মাসটাই কী শেষ? তারপর তাকেও কি রোজ ভোরে পান্তা খেয়ে বেরোতে হবে কলকাতার ট্রেন ধরতে? রোজ – প্রত্যেকদিন, মাস, বছর!    


চলবে...


নতুন পোস্টগুলি

বকের মৃত্যু

  [এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 " বাংলাদেশের হৃদয় হতে "]   শীতের এক ছুটির দুপুরে, পাড়ার গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় শেখরদা এ...