বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ২/৩

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


দ্বিতীয় পর্ব - ৩য় পর্বাংশ

(১২,০০০ বিসিই থেকে ৬০০ বিসিই)

 [এর আগের পর্বাংশ পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 -  ধর্মাধর্ম - ২/২ ]


২.৩.৫ সিন্ধু সভ্যতার সিল

মাটির পাত্র যেমন সিন্ধু সভ্যতার অনন্য প্রতীক, তেমনি আরেকটি প্রতীক হল তার সিল। সাধারণতঃ স্টিটাইট[1] পাথরে তৈরি পাতলা এই সিলগুলি হত বর্গাকার বা আয়তাকার। সিলগুলির ওপরে নানান চিত্র, নকশা এবং বেশ কিছু লিপি আঁকা থাকত। চিত্রের মধ্যে ছিল নানান ধরনের পশু, মানুষের আকৃতি, জ্যামিতিক নকশা। লিপিগুলির পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি, যেদিন হবে সিন্ধুসভ্যতার নতুন মূল্যায়ন আমাদের ইতিহাসকে আরো উজ্জ্বল করে তুলবে। 


⮜ সিন্ধু সভ্যতার কিছু সিল 


বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, এগুলি আমাদের অ-আ-ক-খ-র মতো বর্ণলিপি নয়, বরং চিত্রলিপি। যে ধরনের চিত্রলিপি আমরা আজও ব্যবহার করি ট্র্যাফিক সিগন্যালের “নো-হর্ণ জোন” বা “স্কুল-জোন” বোঝাতে অথবা পাব্লিক টয়লেটের মহিলা-পুরুষ চিহ্নিত দরজায়। যে কারণে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সমাজে – মেসোপটেমিয়া থেকে গুজরাট – সবার কাছেই এই চিত্রলিপি সেসময় পাঠযোগ্য ছিল। সিন্ধু সভ্যতার ধোলাভিরা শহরে বড়ো বড়ো লিপি খোদাই করা একটি পাথরের বড়ো ব্লক পাওয়া গেছে, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, এটি হয়তো কোন সাইনবোর্ড ছিল।

খুব স্পষ্ট না হলেও, অনুমান করা যায়, পণ্য চিহ্নিতকরণের জন্যেই এই সিলগুলির বহুল ব্যবহার ছিল। যেমন পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করা, পণ্যটি কোন শহরে বানানো, কোন আধিকারিক সেটি শংসিত করেছে, ইত্যাদি। এমনকি কোন বিখ্যাত শিল্পীর বানানো, হয়তো সেটাও। আজও, আমাদের বহু পণ্যে যেমন “চেক্‌ড্‌ ওকে”, “মেড ইন ইণ্ডিয়া”, “হলমার্ক”, ব্যাচ নাম্বার উল্লেখ করা থাকে। সিলগুলিতে কোন রং বা কালি মাখিয়ে ছাপ দিয়ে দেওয়া হত, কিংবা সরাসরি নরম অবস্থায় ধাতু এবং মাটির গায়ে চাপ দিয়ে ছাপ ফেলা হত। অর্থাৎ ছাপ দেওয়ার জন্যে আমরা রাবার স্ট্যাম্পের লেখা বা লোগোচিহ্ন যেমন উলটো করে লিখি, এই সিলগুলির চিত্র, নকশা বা লিপিগুলিও উলটো করে লেখা হয়েছিল। 

 ২.৩.৬ সিন্ধু সভ্যতার সুদীর্ঘ অস্তিত্ব

ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বে সুদীর্ঘ এক হাজার সাতশ পঞ্চাশ বছর ধরে, কোন মহিমময় সাম্রাজ্যই সগৌরবে টিকে থাকতে পারেনি। পৃথিবী বিখ্যাত বারোটি মহান সাম্রাজ্যের সময়কালে একবার চোখ রাখা যাকঃ-

 

ক্রম সংখ্যা

সাম্রাজ্যের নাম

দেশ বা অঞ্চল

সময় কাল

সাম্রাজ্যের বছর

১.

আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য

(বিশ্বের প্রথম সাম্রাজ্য)

মেসোপটেমিয়া (আধুনিক ইরাক)

২৩৩৪-২০৮৩ বি.সি.ই

 ২৫১ বছর

২.

অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্য (পারস্য সাম্রাজ্য)

পারস্য (আধুনিক ইরান)

৫৫০ – ৩৩০ বি.সি.ই

২২০ বছর

৩.

রোমানসাম্রাজ্য

 

২৭ বি.সি. – ৪৭৬ এ.ডি./১৪৫৩ সি.ই.

৫০৩ / ১৪৮০* বছর

৪.

উম্মায়েদ খলিফা

আরব, ইজিপ্ট, ইরাক

৬৬১ – ৭৫০ সি.ই.

৮৯ বছর

৫.

কিং সাম্রাজ্য

চীন, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত

১৬৪৪ – ১৯১২ সি.ই.

২৬৮ বছর

৬.

রাশিয়ান সাম্রাজ্য

রাশিয়া

১৭২১ -১৯১৭ সি.ই.

১৯৬ বছর

৭.

মঙ্গোলিয় সাম্রাজ্য

মঙ্গোলিয়া এবং আংশিক চীন

১২০৬ – ১৩৬৮ সি.ই.

১৬২ বছর

৮.

মুঘল সাম্রাজ্য

দাক্ষিণাত্যের কিছুটা ছাড়া সমগ্র অখণ্ড ভারত।

১৫২৬ -১৮৫৮ সি.ই.

 

৩৩২ বছর

৯.

ব্রিটিশ সাম্রাজ্য

পৃথিবীর স্থলভূমির এক চতুর্থাংশের বেশী

ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ।

 ৩০০ বছরের কিছু বেশি।

১০.

অটোম্যান সাম্রাজ্য

ভূমধ্য সাগরের তিনদিক, আরবের কিছু অংশ, ইরাক।

১২৯৯ – ১৯২৩ সি.ই.

৬২৪ বছর

১১.

মৌর্য সাম্রাজ্য

অখণ্ড ভারতের অধিকাংশ।

৩২৩১৮৪ বি.সি.

১৩৯ বছর

১২.

গুপ্ত সাম্রাজ্য

আধুনিক ভারতের অনেকটাই

৩৭৫ – ৫৫০ সি.ই.

১৭৫ বছর

 

চার্ট সংখ্যা – ২

*মূল রোম সাম্রাজ্যের সময়কাল ৫০৩ বছর। তারপর বহুবার ভেঙে টুকরো হয়েছে এবং সম্রাটদের হাত বদল হয়েছে।

 সিন্ধু সভ্যতা কিন্তু কোন সাম্রাজ্য নয়, কাজেই তার সঙ্গে সম্রাট বা রাজবংশের পরিচালনাধীন সাম্রাজ্যের কোন তুলনাই চলতে পারে না। তবুও তথ্যগুলি আমি তুলে ধরলাম, এই কারণে যে, আমাদের বাল্যবয়সে এই সব রাজবংশের উত্থান-সাফল্য-পতনের বৃত্তান্ত আমাদের কত না রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্ব অবহেলায় সরিয়ে রাখা হয়েছিল মাত্র দু-তিন পাতায়।

২.৩.৭ গণসঙ্ঘী প্রশাসন

সাম্রাজ্যই হোক বা কোন উদ্যোগই হোক, তার সাফল্য এবং দীর্ঘস্থায়ীতা নির্ভর করে প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর। আমার বিস্ময় এখানেই, কোন প্রশাসনিক দক্ষতার জোরে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এমন একটা উদ্যোগকে এত দীর্ঘ সময় সাফল্যের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল? আমার বিশ্বাস – এই প্রশাসন চালাতেন নির্বাচিত কোন গণসঙ্ঘ বা বুধমণ্ডলী। তাঁদের এতদিন ধরে সগৌরবে টিকে থাকার রহস্য হল বন্ধুত্বপূর্ণ নিবিড় যোগাযোগ। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল – যুদ্ধ নয়, রাজ্য জয় ও ক্ষমতার লিপ্সা নয় - মৈত্রী এবং সহযোগীতা। যার সূচনা করেছিলেন, পিতা পশুপতি, মাতা মিত্তিকা এবং বিশ্‌ভাই।

সিন্ধু সভ্যতার এত জটিল এবং ব্যপ্ত নাগরিক সমাজকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ করত কে বা কারা, সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না। এতগুলি শহর কী নিয়ন্ত্রিত হত একই প্রশাসনের অধীনে? নাকি প্রত্যেকটি শহর এবং আশেপাশের কৃষিক্ষেত্র আলাদা আলাদা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকত? সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি শহরের পণ্যের গুণমান কী করে একই রকম হতে পারত?

শহরগুলির গঠন এবং সুশৃঙ্খল কার্যপ্রণালী দেখে, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, প্রত্যেকটি শহরকে নিয়ন্ত্রণ করত পরিচালন সমিতি। আঞ্চলিক এই পরিচালন সমিতি আবার বৃহত্তর এক পরিচালক সমিতিকে অনুসরণ করত। এই বৃহত্তর সমিতি গঠিত হত, সবগুলি শহরের আঞ্চলিক সমিতির দু’একজন প্রতিনিধি নিয়ে। এই ধরনের প্রশাসনকে নিশ্চয়ই গণসঙ্ঘ (confederation) প্রশাসন বলা যায়। যে গণসঙ্ঘের স্পষ্ট রূপ আমরা এই ভারতেই আবার দেখতে পাবে প্রায় হাজার খানেক বছর পরে। সে কথা আসবে যথা সময়ে, তবে একথা নিশ্চিতভাবেই আন্দাজ করা যায়, এই পরিচালন সমিতিগুলির মধ্যে যে নিবিড় সমন্বয় ছিল, তার অকাট্য প্রমাণ এই সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ীতা। যুদ্ধ এবং অসভ্য হানাহানিহীন - এক হাজার সাতশো পঞ্চাশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন নিবিড় সভ্যতা। এই সভ্যতা হয়তো আরও দীর্ঘায়ু হত, যদি না পরপর অনেকগুলি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটত।  সে কথায় একটু পরেই আসছি।

 অতএব এই কারণেই সিন্ধুসভ্যতার কোন শহরেই রাজকীয় কোন প্রাসাদ, বিশিষ্ট কোন সমাধি মন্দির অথবা কোন স্মারক ভবনের নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

 প্রশাসনের এই পেশাগত দক্ষতা এবং নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক দায়বদ্ধতার কারণেই কোন শহরেই গড়ে উঠতে পারেনি কোন ধর্মস্থান বা ধর্ম মন্দির। বিভিন্ন অঞ্চলের বিবিধ সামাজিক-সংস্কৃতির মানুষেরা এই শহরগুলিতে এসেছিল তাদের কারিগরি দক্ষতা নিয়ে, প্রশাসনের চাহিদা শুধু সেটুকুই। কোন আঞ্চলিক ধর্মীয় প্রথা বা ব্রতপালনকে প্রশ্রয় দিয়ে অন্য অঞ্চলের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁদের ছিল না। কাজেই কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠান, কিংবা চোখ ধাঁধানো কোন মন্দির বা ধর্মস্থান গড়ে তোলার কোন পরিকল্পনা তাঁরা কোন শহরে কোনদিনই করেননি। কিছু কিছু মূর্তি – যেগুলিকে বিশেষজ্ঞরা দেবমূর্তি এবং মাতৃকা মূর্তি বলে মনে করেছেন, সেগুলি শিল্পীরা হয়তো তাদের ব্যক্তিগত অবসরে বানিয়েছিল, নিজের সমাজ ও সংস্কৃতির স্মৃতিটুকু চোখের সামনে ধরে রাখার জন্যে। কারণ সুমেরীয় কিংবা মেসোপটেমিয়ার মতো বহির্বিশ্বে এই মূর্তিগুলির কোন রপ্তানি মূল্যই থাকার কথা নয়। বরং আমার মনে হয় - আজও যেমন আমাদের মধ্যে অনেকে সর্বদাই পার্সের মধ্যে ঠাকুর রামকৃষ্ণ কিংবা তিরুপতি বাবা অথবা কামাখ্যা কালীমাতার ছবি এবং দূর প্রবাসে গেলে তাঁদের একটি ফটো আমাদের ব্রিফকেসে বহন করে থাকি, সিন্ধু সভ্যতার সেই শিল্পীরাও আমাদেরই পূর্বপুরুষ - সে বিষয়ে আমার কোন সংশয় নেই।

২.৩.৮ নিরাপত্তা ও রণসম্ভার

সিন্ধু সভ্যতার সবকটি শহরেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্রোঞ্জের কিছু অস্ত্র–শস্ত্র যা পাওয়া গেছে, সেগুলিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার রণসম্ভার বলা যায় না। হয়তো সেগুলি বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিল। কোন শহরের কোথাও অস্ত্রাগার কিংবা সেনা আবাসের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। বহু শহরেই বেশ কিছু সমাধির গর্ভে অনেক কংকাল পাওয়া গেছে। তার মধ্যে কয়েকটিকে গণ-সমাধি বলা যায়। যেগুলিকে প্রথম দিকে মনে করা হত যুদ্ধে বা সংঘর্ষে মৃত। কিন্তু পরবর্তী কালে ময়না তদন্ত করে দেখা গেছে, মৃতদের মৃত্যুর কারণ যুদ্ধ বা সংঘর্ষজনিত কোন আঘাত নয়, বরং তীব্র রক্তাল্পতা। যার একমাত্র কারণ হতে পারে অসুস্থতা - হয়তো কোন মহামারি। বাকি সব সমাধিই নেহাত ব্যক্তিগত সাধারণ সমাধি। অতএব যুদ্ধে অথবা অন্য কোন কারণেই শহরে গণ-হত্যার ঘটনা যে ঘটেনি, সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

বেশ কিছু শহরের সীমানায় শক্ত-পোক্ত পাথর বা ইঁটের প্রাচীরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলি শত্রু আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্যে নয়, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, নদীর বন্যার জল আটকানোর জন্যে। কারণ এমন অনেকগুলি শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলি কয়েকশ বছরে কয়েকবার বন্যার জলে সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছিল। এবং তার ওপরে আবার নতুন করে শহর নির্মাণ হয়েছিল। অতএব খামখেয়ালী সিন্ধু এবং হাকরা নদীর প্লাবনই ছিল সিন্ধুসভ্যতার শহরগুলির আতঙ্কের একমাত্র কারণ, কোন আগ্রাসী শত্রুপক্ষ নয়। এবং এই প্রসঙ্গ থেকেই আমরা পেয়ে যাবো - সিন্ধুসভ্যতার অস্তাচলে যাওয়ার প্রকৃত রহস্য। 

 ২.৩.৯ সিন্ধুসভ্যতার অবসান

সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলি আবিষ্কারের প্রথম দিকে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করতেন, এই সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল আর্যদের আক্রমণে। কিন্তু এখন সেই অনুমান সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞানীদের স্থির বিশ্বাস আর্যদের সঙ্গে গুরুত্বহীন কিছু ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়তো হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলি অত্যন্ত গৌণ।  সিন্ধুসভ্যতার সম্পূর্ণ অবলুপ্তির মুখ্য কারণ তো বটেই, হয়তো একমাত্র কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

১৯৪০ সালে একজন ভারতীয় জীবাশ্মবিদ, এম আর সাহ্‌নি, সিন্ধু সভ্যতার অবলুপ্তির প্রথম এবং প্রধান কারণগুলি আবিষ্কার করেছিলেন। এই উপমহাদেশে সে সময়টা ছিল প্রাক-স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়। অতএব সে সময়ে তাঁর বক্তব্য নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল না এবং কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু পরবর্তী কালের বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তাঁর তত্ত্বকে শুধু সমর্থন নয়, দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আজ থেকে মোটামুটি পাঁচ থেকে চার হাজার বছর আগে ওই অঞ্চলে বেশ কয়েকবার – অন্ততঃ তিনবার - যে ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটেছিল সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা নিঃসন্দেহ। এমনই এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের ফলে মহেঞ্জোদারো শহর থেকে প্রায় ১৫০ কি.মি. দক্ষিণে সেহ্‌ওয়ান অঞ্চলে বেশ বড়োসড়ো এক ভূস্তরীয় চ্যুতি (fault) ঘটেছিল। সেই চ্যুতির ফলে ওই অঞ্চলে সিন্ধু নদের স্বাভাবিক প্রবাহপথের সামনে গড়ে উঠেছিল মাটি ও পাথরের বিস্তীর্ণ এক প্রাকৃতিক বাঁধ। সেই বাঁধে আটকে যাওয়া সিন্ধুর জল জমে উঠছিল সেহ্‌ওয়ানের ওপরের দিকে। আর সেহ্‌ওয়ানের নিচে আরব সাগর পর্যন্ত সিন্ধুর স্বাভাবিক প্রবাহ শুকিয়ে গিয়েছিল। বাঁধের ওপারে সিন্ধুর জলপ্রবাহ জমতে জমতে বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গিয়েছিল প্রাকৃতিক এক সরোবরের গভীর জলের তলায়। যার মধ্যে ছিল মহেঞ্জোদারো শহর এবং তার আশেপাশের বেশ কিছু শহর, অজস্র জনপদ ও গ্রাম। অদ্ভূত এই বিপর্যয়ের আরও প্রমাণ পাওয়া যায়, মহেঞ্জোদারো শহরের নগর নির্মাণের বিভিন্ন স্তর পর্যবেক্ষণ করলে। অভূতপূর্ব এই প্লাবন থেকে শহরকে রক্ষা করার জন্যে, শহরের চারদিকে প্রাচীর দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালের প্রত্নখননে বিশাল সেই প্রাচীরের যে নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল, তার উচ্চতা ছিল পঁচিশ ফুটেরও বেশি! তাছাড়াও সরোবরের জলস্তর থেকে উঁচুতে শহরের ভিত তুলে আনারও চেষ্টা করেছিল, মহেঞ্জোদারো শহরের প্রশাসন।

প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে ভূমিক্ষয় করে, সেহ্‌ওয়ানের প্রাকৃতিক বাঁধ উপচে সিন্ধু তার নতুন যাত্রা পথ তৈরি করে আরব সাগরে আবার মিশে যেতে পেরেছিল। সরোবরের জলও বেরিয়ে এসেছিল সিন্ধুর প্রবাহ ধরে, পিছনে ফেলে এসেছিল বিশাল পলির স্তর। বহু জনপদ ও গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পঁচিশ থেকে তিরিশ ফুট গভীর সেই পলির তলায়।

ওই অঞ্চলে অন্ততঃ তিনটে বড়ো ভূমিকম্পের প্রমাণ প্রত্নবিদেরা পেয়েছেন, ২৯০০, ২৭০০, এবং ২২০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি সময়ে। এই ভূমিকম্পের ফলে গোটা অঞ্চলেরই ভূস্তরে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল, তার আরও একটি প্রমাণ হাকরা নদীর গতিপথের আমূল পরিবর্তন। যে হাকরা নদীর জলের ভরসায় গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি শহর এবং অজস্র জনপদ, সেই হাকরা শুকনো হয়ে গিয়েছিল মোটামুটি ২০০০ বি.সি.ই-তে।

অতএব একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বারবার বিপন্ন হয়ে উঠল সিন্ধু সভ্যতার সুশৃঙ্খল বাণিজ্যিক অন্তর্জাল। অজস্র জনপদ ও ছোট শহর অবলুপ্ত হয়ে গেল, বড়ো শহরগুলিকে সুরক্ষিত করতে বিপুল অর্থব্যয় করতে হচ্ছিল বারবার। জলের অভাবে শুকনো হাকরা অববাহিকার শহরগুলিকেও পরিত্যক্ত করতে হল। নিশ্চিন্ত অন্নসংস্থান হত যে বিপুল কৃষিক্ষেত্র থেকে তারও অনেকখানি চলে গেল পলির তলায় অথবা শুষ্ক অনুর্বর হয়ে উঠল। সব মিলিয়ে ভেঙে পড়ল গোটা সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতি। যার থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে না পেয়ে, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষরা ফিরে যেতে শুরু করল তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে। সিন্ধু সভ্যতার সুখের স্মৃতি ও দুঃখের ভয়ংকর রেশটুকু নিয়ে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা সরে আসতে লাগল রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানায়। পরবর্তী কালে তারা ছড়িয়ে পড়ল আরও পূর্বদিকে গঙ্গার অববাহিকায়, দক্ষিণের গুজরাটে, এমনকি মধ্যভারতের নর্মদার অববাহিকা অঞ্চলেও।

 

২.৩.১০ দেবতার অভিশাপ(?)

ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের, যার অধিকাংশই এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত, ভূতাত্ত্বিক চরিত্র কিছুটা অনন্য। দুটি টেকটনিক[2] প্লেটের ওপর অঞ্চলটি বিস্তৃত। সিন্ধ, পাঞ্জাব এবং জম্মু-কাশ্মীরের অধিকাংশ অঞ্চলই রয়েছে দক্ষিণ-এশিয় প্লেটের ওপর। বাকি সব অঞ্চলের অবস্থান ইউরেসিয়ান প্লেটের পারস্য মালভূমির ওপর। এই দুই প্লেটের সঞ্চলনের ফলে এই অঞ্চল অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ। এই অঞ্চলের বিগত তিনশ’ বছরের ভূমিকম্পের তথ্যের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে অন্তত তিনবার পঞ্চাশ হাজারের বেশী মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। অন্ততঃ দুবার সুনামি এবং একবার ভয়ংকর ভূস্খলনের ঘটনা ঘটেছিল। আর ছোটখাটো ভূমিকম্পে এই অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় প্রত্যেক বছর।

২৯০০ বি.সি.ই-র বিপর্যয় হয়তো অনেক কষ্টে সামলে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মোটামুটি দু’শ বছরের ব্যবধানে, ২৭০০ বি.সি.ই-র দ্বিতীয় বিপর্যয়ে সিন্ধু সভ্যতা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ল না, এখানকার অধিবাসীরা মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে উঠতে লাগল। ২৯০০ বি.সি.ই-র বিপর্যয় যদি টেকটনিক প্লেট থিওরির তত্ত্ব অনুযায়ী ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে ছোটখাটো ভূমিকম্প মাঝে মধ্যেই ঘটে চলাও বিচিত্র নয়। তারপরেই দুশ বছরের পরে আবার এল ২৭০০ বি.সি.ই-র বিপর্যয়। বারবার এই বিপর্যয়, যার নিয়ন্ত্রণের সাধ্য কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, কেন হচ্ছিল বারবার?

অধিবাসীদের মনে বাসা বাঁধতে লাগল আশঙ্কা এবং আতঙ্ক। এই পর্যায় থেকেই বহু মানুষ সরে আসতে লাগল ওই অঞ্চল থেকে। নতুন নতুন শহর এবং জনপদ গড়ে উঠতে লাগল, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং গুজরাটে। তার বহু প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। বারবার বিপর্যয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকেও দুর্বল হতে থাকা পরিচালক সমিতির নিয়ন্ত্রণ কমতে লাগল। সিন্ধু সভ্যতার অনন্য গুণমান নিয়ন্ত্রণের গুণ ও মান কমতে লাগল ধীরে ধীরে, হারাতে লাগল তার বাণিজ্যিক গৌরব । অতএব ২০০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি আবার একটি বিপর্যয়ের পরেই সিন্ধু সভ্যতার শহর এবং জনপদগুলি একে একে পরিত্যক্ত হতে শুরু করল। এবং মোটামুটি ১৭৫০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি সময় থেকে, সিন্ধু সভ্যতার সদাব্যস্ত শহরগুলি পরিত্যক্ত পড়ে রইল, খুব দ্রুত বিস্মরণের অপেক্ষায়।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পূর্বসূরীদের মুখে শুনে আসা একদা উজ্জ্বল গৌরবময় অতীতের কাহিনী এবং শহর ও জনপদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়া এখনকার আতঙ্কিত মানুষদের মনে এখন জমা হতে লাগল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আধুনিক টেকটনিক তত্ত্ব তাদের কল্পনার বাইরে। কিন্তু নতুন জনপদে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হতে নিজেদের মতো করেই তারা বিশ্লেষণ করতে লাগল এই পরিণতির। তারা বিশ্বাস করত দেবতা এবং দেবীরাই মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা-ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেন। অতএব লাগাতার এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলিও নিশ্চয়ই তাঁদের অভিশাপের ফল। কিন্তু কোথায় হয়েছে মানুষের অপরাধ? সে কোন পাপ, যার ফলে এমন চরম শাস্তি দিলেন দেবতারা? চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করে, তারা বের করে ফেলল নিজেদের যথেষ্ট অপরাধ ও প্রচুর পাপের হিসাব।

পশুপতিদেব, মাতৃদেবী এবং বিশ্‌দেব তো শুধু মানুষের দেবতা নন। সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ, অরণ্যের গাছপালা নির্বিশেষে, তাঁরা তো সবার দেবতা। হাকরা-সিন্ধু উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অরণ্য এবং তৃণভূমি নির্মূল করে গড়ে তোলা হয়েছিল অজস্র শহর, জনপদ, গ্রাম এবং কৃষিক্ষেত্র। সে কী অপরাধ বা পাপ নয়? কত গাছপালা, কত জীবজন্তু, সরীসৃপ, পাখি, কীটপতঙ্গ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জীবন ধারণের জন্যে দুচারটে জীব হত্যা কিংবা গাছের ফলমূল আহরণ, সে তো দেবতারাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের এমন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া? দেবতারা ক্রুদ্ধ হবেন না?

সিন্ধু সমাজের পাপ(?) আরো আছে।

পিতৃ-পিতামহের কাল থেকে তাদের যে কোন সাফল্যে কিংবা বিপদে মানুষ দেবতাদের কাছে গিয়েছে। তারা কখনো জানিয়েছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, কখনো বা করুণা ভিক্ষা করেছে। দেবতারা সন্তুষ্ট হয়েছেন, কখনো কখনো লঘু অপরাধ ক্ষমা করেছেন, কখনো বা পাপের শাস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু এভাবে গোটা সিন্ধু-সমাজকে তিনি চিরতরে উৎখাত করে দিলেন কেন? কোন পাপে? সে পাপ তাঁকে নিয়মিত স্মরণ না করার পাপ। সিন্ধু-সমাজের মানুষ কোনদিন কোন ব্রত পালন করেছে? করেনি। কোনদিন কোন পুজোর আয়োজন করেছে? করেনি। এমন সফল বাণিজ্যের জন্যে কোনদিন কোনভাবে তারা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে? জানায়নি। কোন অপরাধের জন্যে কোন দিন ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছে? চায়নি। তাহলে? মানুষের এই সীমাহীন ঔদ্ধত্যে, দেবতারা ক্রুদ্ধ হবেন না?

প্রাচীন সমাজের মুখ্য হতেন সমাজের প্রাজ্ঞ গুরুজন স্থানীয় কেউ, তিনিই দেবতাদের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখতেন। আর এদিকে সিন্ধু-সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখ? এমন কী কেউ কোনদিন ছিলেন? ছিলেন না। পরিচালন সমিতির সকলেই ছিলেন পেশাদার বণিক, তাদের কারও সঙ্গে তো দেবতাদের সংযোগ ছিল না। তাহলে কার মাধ্যমে দেবতারা তাঁদের সন্তুষ্টি বা বিরক্তির বার্তা দেবেন? দেবতাদের থেকে মানুষ যদি বিচ্ছিন্নই হয়ে যায়, তাহলে আর সমাজের রইল কী? এতেও যদি দেবতারা ক্রুদ্ধ না হন, তাহলে আর কিসে হবেন?

পরিত্যক্ত সিন্ধু-সমাজ থেকে বেরিয়ে আসা জনসংখ্যা ধরা যাক পাঁচ লক্ষাধিক। বড়ো শহরগুলির গড় জনসংখ্যা যদি বিশ-পঁচিশ হাজার হয়, তাহলে যে ছটি বড়ো শহরের উল্লেখ করেছিলাম, তাতেই জনসংখ্যা হয় দেড় লক্ষের কাছাকাছি। তার ওপরে ছিল আরও অনেক ছোট শহর, অজস্র জনপদ ও গ্রামের সপরিবার কৃষিজীবী এবং পশুপালক। সব মিলিয়ে পাঁচলক্ষ না হওয়ার কোন কারণ নেই। এই পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থী মানুষ প্রায় চার-পাঁচশ বছর ধরে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে এবং ধীরে ধীরে মিশে গিয়েছে ভারতের জন সমাজের মধ্যে। তাদের স্মৃতি-রোমন্থন, অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছে, স্থানীয় মানুষরাও। সিন্ধু-সমাজের মানুষরা 'ঠেকে শিখেছিল', ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের 'দেখে শিখল', মানুষের অপরাধ কী? পাপ কী? দেবতাদের সন্তুষ্টি কী, তাঁদের ক্রোধ কী?

অতএব বিপুল এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভারতীয় জনগোষ্ঠী, পশ্চিমের রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরের জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যভারত এবং দক্ষিণের রায়চুর দোয়াব পর্যন্ত পরোক্ষ অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করল যে, নির্বিচারে অরণ্য এবং আরণ্যকদের নিশ্চিহ্ন করা নাগরিক সভ্যতা মঙ্গলকর নয়। দেবতারা ক্রুদ্ধ হন। দেবতাদের সঙ্গে সতত সংযোগ রাখা একান্ত জরুরি এবং নিয়মিত সংযোগর জন্যে নির্দিষ্ট হবেন কোন শ্রদ্ধেয় মানুষ – শমন, ওঝা, গুণিন অথবা সমাজের প্রাজ্ঞ কোন গুরুজন। দেবতাদের নিয়মিত কৃতজ্ঞতা এবং কৃপা ভিক্ষা করার জন্যে অবশ্যই পালন করতে হবে ব্রত, পার্বণ, পুজো। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু, সকল কার্যের কারণ দেবতারাই। শিশুর জন্ম, অন্নপ্রাশণ, (কন্যাদের ক্ষেত্রে) ঋতুদর্শন, বিবাহ ও মৃত্যু – সকল ক্ষেত্রেই দেবতাদের স্মরণ করা একান্ত জরুরি। কৃষিজীবীরা কৃষি কাজের শুরুর থেকে শস্য ঘরে তোলা পর্যন্ত – প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেবতাদের স্মরণ করে থাকে। অম্বুবাচীর - ওই সময় জমি রজঃস্বলা হন, জমিকর্ষণ নিষিদ্ধ - ব্রত পালনের পর চাষ শুরু হবে। শেষ হয় নবান্নে – দেবতাকে নতুন শস্য উৎসর্গের ব্রতে।

এভাবেই জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, সমাজের প্রতিটি কাজে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেল ব্রত, মানত, পার্বণ পুজো। দেবতাদের খুব পরিবর্তন হল না, পশুপতিদেব এবং বিশ্‌ভাই হলেন বিশ্‌দেব। কিন্তু অঞ্চল ভেদে মাতৃদেবী মিত্তিকার এখন অজস্র নাম এবং রূপ। কখনো তিনি রুদ্ররূপা কালী, তারা, করালী, চণ্ডী। কখনো বরাভয়দায়িনী

ব্যঘ্রবাহনা, কখনো সিংহবাহিনী, কখনো অন্নপূর্ণা। যেভাবে মাকুর টানাপোড়েনে তন্ত্রী নিবিড় বুনোটে বস্ত্র বয়ন করে, সেভাবেই নিবিড় তন্ত্রে ধীরে ধীরে একসূত্রে বাঁধা পড়তে থাকল ভারতের অধিকাংশ সমাজ। এই তন্ত্র সমাজকে ধরে রাখে, সহযোগী করে তোলে, সহাবস্থান গড়ে তোলে অরণ্য, আরণ্যক, প্রকৃতি এবং প্রতিবেশী মানুষদের নিয়ে। আজকের তীব্র নাগরিক সভ্যতার সমাজে, আজও সেই ট্র্যাডিশন আমরা একইভাবে বহন করে চলেছি, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুষ্ঠান ও উৎসব হিসেবে, কিন্তু আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের কথা ভুলতে বসেছি।   

২.৪.১ সমসাময়িক ভারতের অন্যান্য প্রান্ত

সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল নিওলিথিক এবং চ্যালকোলিথিক যুগ। পরবর্তী প্রসঙ্গে যাবার আগে, এই দুই যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আরেকবার মনে করিয়ে দিই। নিওলিথিক হচ্ছে সেই যুগ, যখন যথেষ্ট কৃষি এবং পশুপালন শুরু হয়ে গেছে ও পাথরের আরো সূক্ষ্ম বা তীক্ষ্ণ উন্নত যন্ত্রপাতি এবং অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। তার পরবর্তী চ্যালকোলিথিক যুগে তামা এবং সংকর ধাতু ব্রোঞ্জের প্রচলন শুরু হয়ে গেছে, কৃষি ও পশুপালন আরো ব্যাপ্ত হয়েছে। ব্রোঞ্জ ও তামার ব্যবহার শুরু হলেও, কাঠ, বাঁশ ও পাথরের যন্ত্রপাতি বা অস্ত্র তখনও বহুল প্রচলিত রয়েছে।

সিন্ধুর নগরকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক সভ্যতা উন্নতির শিখর স্পর্শ করলেও, ভারতের অন্যত্র তাদের অনুকরণে বা অনুসরণে শহর গড়ে ওঠার হিড়িক পড়ে যায়নি। তখনও দেশের অন্যান্য প্রান্তের জনজীবন প্রধানতঃ কৃষি, পশুপালন এবং শিকারী-সংগ্রাহী আরণ্যক সমাজেই বিভক্ত ছিল। উত্তরপশ্চিম ভারতের সভ্যতার আঁচ তাদের খুব বেশি কিছু প্রভাবিত করতে পারেনি। যেটুকু পরিবর্তন তাদের হয়েছিল তার কারণ তামা ও ব্রোঞ্জের  ব্যবহার।

মোটামুটি তিনহাজার বি.সি.ই থেকেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নিওলিথিক এবং তার পরবর্তী কালে চ্যালকোলিথিক সমাজের উদ্ভব শুরু হয়ে গিয়েছিল। যার প্রত্ন নিদর্শন ভারতের প্রায় সর্বত্র পাওয়া গেছে এবং পাওয়া যাচ্ছে। কাশ্মীরের বুরযাহোম এবং গুফক্রালে, ওই উপত্যকার লোয়েস মাটিতে গর্ত করে থাকত যে মানুষরা, তাদের কাছেও কিছু কার্নেলিয়ান[3] পুঁতি এবং শিং-ওয়ালা পশুচিত্রিত মাটিরপাত্র পাওয়া গেছে। এর থেকে তাদের সঙ্গে যে সিন্ধু সভ্যতার যোগাযোগ ছিল সে প্রমাণ পাওয়া যায়। অবিশ্যি তার মানে এই নয় যে তারা সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল, এই সামগ্রীগুলি তারা বণিকদের থেকেই হয়তো সংগ্রহ করেছিল। তাদের সমাধিগুলি হত ঘরের আশেপাশেই এবং মৃতের সঙ্গে তারা সাধারণতঃ কুকুরকেও সমাধি দিত। এমন সমাধির নিদর্শন অবশ্য ভারতের অন্যত্রও পাওয়া গেছে। বুরযাহোমে সমাধির ধারে একটা পাথর – মেনহির খাড়া করা ছিল। এর আগে কোন সমাধিতেই এমন নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে এর পরবর্তী সময়ে ভারতের বহু অঞ্চলেই সমাধির পাশে মেনহিরের ব্যবহার প্রচলিত হয়ে উঠেছিল।


একই ধরনের আবাস ছিল উত্তরাঞ্চলের আলমোড়ায় এবং উত্তরপশ্চিমের সুদূর সোয়াৎ[4] উপত্যকায়। সেখানকার গান্ধার সমাধিগুলিতে মোটামুটি দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে ঘোড়ার এবং প্রথম সহস্রাব্দের শুরুতে লোহা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। উত্তর ভারত থেকে আফগানিস্তান বা মধ্য এশিয়া যাওয়ার পথেই পড়ত এই সোয়াৎ উপত্যকা।

গাঙ্গেয় উপত্যকায় অনেক বেশি সংখ্যক উপনিবেশের নিদর্শন মিলেছে। এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ বসবাস করত। প্রত্নবিদেরা এক একটি সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করতে পারেন, তাদের মৃৎপাত্রের ধরন দেখে। মৃৎপাত্রের ধরন অনুযায়ী তাঁরা সেই সেই সংস্কৃতির নাম দিয়ে থাকেন। যেমন ওসিপি - OCP (Ochre Coloured Pottery – গিরি রঙের পাত্র), পিজিডব্লিউ - PGW (Painted Grey Ware – ধূসর রং করা পাত্র), বিপিডব্লিউ - BPW (Black Polished Ware – কালো পালিশকরা পাত্র), এনবিপিডব্লিউ – NBPW (Northern Black Polished Ware),  ইত্যাদি।

গাঙ্গেয় সমভূমির পশ্চিমদিকের অত্রাঞ্জিখেরা, লাল কিলা এবং হুলায় ওসিপি ধরনের পাত্র পাওয়া গেছে। যার সঙ্গে খুব ক্ষীণ হলেও হরপ্পার পাত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও হুলার প্রত্নখননের প্রাচীনতর স্তর থেকে হরপ্পার অনেক পাত্র পাওয়া গেছে। হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের বেশ কিছু অঞ্চলে, হরপ্পার পাত্রের সঙ্গে পিজিডব্লিউ পাত্রও পাওয়া গেছে। অতএব অনুমান করা যায়, এই অঞ্চলগুলিতে হরপ্পা-সংস্কৃতির সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিতি থাকলেও তারা নিজস্ব সংস্কৃতিও অনুসরণ করত। পিজিডব্লিউ পাত্রের উপনিবেশ আরও পাওয়া গেছে, রোপার (পাঞ্জাব), ভগবানপুরা (হরিয়ানা), হস্তিনাপুর, অহিচ্ছত্র এবং জাখেরায় (উত্তরপ্রদেশ)।

গাঙ্গেয় সমভূমির আরও পূর্বদিকের উপনিবেশগুলিতে তামার কাজে যথেষ্ট দক্ষতা ছিল – বর্শার ফলা, হারপুন, ছেনি, পাতলা তলোয়ার এবং কিছু নর-পশুমূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তিগুলি মাটির নিচে যেন সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এই ধরনের সামগ্রী পাওয়া গেছে ছোটনাগপুর এবং আরও পূর্বদিকের অঞ্চলগুলিতে।

মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমির প্রচুর অঞ্চলে অনেক উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন পিপরাওয়া, গানোরিয়া, সোগাউরা, নারহান, খাইরাডি এবং মির্জাপুরের আশেপাশে বেশ কয়েকটি অঞ্চল। এলাহাবাদের দক্ষিণে বেলান উপত্যকা অথবা চোপানি-মাণ্ডো, কোলডিহোয়া - এই সব অঞ্চলে গম ও যবের পাশাপাশি ধানও চাষ হতো, আজ থেকে মোটামুটি আট হাজার বছর আগে থেকে। গঙ্গা এবং সরযূর সঙ্গমের কাছে চিরাণ্ডে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেকার উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে, যার অস্তিত্ব ছিল খ্রীষ্টাব্দের পরেও। বাঁশের কঞ্চি আর সরু কাঠের কাঠামোর ওপর মাটি, গোবর আর খড়ের কুচি মেশানো পলেস্তারা করে তারা ঘর[5] বানাতো। তারা পাথরের কুড়ুল, ছোট ছোট পাথরের ফলা, হাড়ের যন্ত্র–পাতি, পাথরের হামান-দিস্তে, যাঁতা ব্যবহার করত। পোড়া মাটির বাসন পত্র, মূর্তি বানাত। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কাজে তামা এবং আরও পরে লোহাও ব্যবহার করত। গাঙ্গেয় সমভূমিতে চিরাণ্ড এমন একটি জায়গা, যেখানে সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা যায়।

গাঙ্গেয় সমভূমির আরেকটি বিশেষত্ব ছিল তাদের এনবিপিডব্লিউ পাত্র এবং স্থানীয় হিমাটাইট মাটি থেকে উচ্চ-তাপমাত্রায় লোহা নিষ্কাশনের উপায় আবিষ্কার। সম্ভবতঃ এখানেই লোহার প্রথম সামগ্রী বানানো হয়ে, নদী পথে দেশের নানা দিকে বাণিজ্য শুরু হয়েছিল।

আরো পূর্বের বঙ্গদেশে ভাগিরথীর পশ্চিমে দামোদর এবং অজয় উপত্যকায় এবং আরো কিছু জায়গায় উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। তার কারণ সম্ভবতঃ উর্বর জমি এবং ছোটনাগপুরের তামার খনি। এমনই কিছু জায়গা যেমন পাণ্ডু রাজার ঢিবি, মহিষাদল, মঙ্গলকোট ইত্যাদি। এই উপনিবেশ নিওলিথিক যুগের আগেই শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তী কালে তারা তামার ব্যবহারও শিখে গিয়েছিল। আরও পূর্বে আসামের দাওজালি হেডিং, গারো হিলসের কিছু জায়গায় এবং কাছাড় অঞ্চলেও বেশ কিছু নিওলিথিক উপনিবেশ ছিল।

মধ্য প্রদেশের মালোয়া, কায়াথ এবং নওদাতোলি সংস্কৃতি বহু বছরের প্রাচীন। এই অঞ্চলের সঙ্গেও হরপ্পা সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিল। নাওদাতোলিতে নর্মদা পার হয়ে মাহেশ্বর, এবং তার আরও নিচে সাবাতপুর, পীঠানগর, মান্দাসৌরেও নিওলিথিক উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে এই পথেই হোসাঙ্গাবাদ হয়ে দক্ষিণে যাওয়ার রাস্তা গড়ে উঠেছিল।

উত্তর মহারাষ্ট্রের দাইমাবাদ এবং জরওয়ের সঙ্গে সিন্ধু-সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। ইনামগাঁওয়ে গভীর প্রত্নখননে কৃষি এবং পশুপালনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্যে তারা বাঁধ বানিয়েছিল। এবং শুধুমাত্র বৃষ্টির ভরসায় না থেকে, বাঁধের জলেও যব এবং জোয়ার বা বজরার চাষ করত। বাঁশের কঞ্চি বা কাঠের কাঠামোতে কাদামাটি মিশ্রণের পলেস্তারা করা গ্রামের বাড়িগুলি হত গোলাকার বা বর্গাকার। আশেপাশের জঙ্গলের হিংস্র পশুদের আক্রমণ ঠেকাতে গ্রামের চারপাশে তারা মাটির দেওয়াল তুলেছিল। পোড়ামাটির তৈরি বেশ কিছু মুণ্ডহীন কিন্তু গুরুস্তনী নারী মূর্তি পাওয়া গেছে। সাধারণতঃ ঘরের মেঝেয় গর্ত খুঁড়ে মৃতদের সমাধি দেওয়া হত, সমাধিতে কিছু সামগ্রীও রাখা হত। আশ্চর্যের বিষয় হল কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাধির মৃতদের পায়ের পাতা ইচ্ছে করেই কেটে দেওয়া হত। মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু জায়গায়, যেমন জুনাপানি, মহুরঝারির বেশ কিছু সমাধিতে পাথর সাজিয়ে স্মারক (Menhir) রাখা হত।

দক্ষিণের গোদাবরী, কৃষ্ণা, পেন্নার, তুঙ্গভদ্রা এবং কাবেরী উপত্যকায় বেশ কিছু উপনিবেশের নিদর্শন পাওয়া গেছে যেগুলি আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেকার। যেমন হাল্লুর, কুপগাল, মাস্কি (কর্ণাটক), নাগার্জুনাকোণ্ডায় (অন্ধ্রপ্রদেশ) ছিল কৃষি সমাজ। পিকলিহাল (কর্ণাটক), উটনুর (অন্ধ্রপ্রদেশ) এবং কুপগালের মতো উষর জায়গায় পশুপালনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। অন্ধ্রপ্রদেশের বুদিহালেও পশুপালনের গ্রাম ছিল, সেখানে একটি কসাইখানা পাওয়া গেছে। প্রথম দিকে গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া পালন করলেও পরের দিকে তারা মোষপালনও শুরু করেছিল। ভারতে মহিষপালনের সূচনা সম্ভবতঃ এখানেই শুরু হয়েছিল। এখানকার মানুষরা প্রথমদিকে জোয়ার এবং বাজরার চাষ করত, পরের দিকে অপেক্ষাকৃত ভেজা জমিতে ধান চাষও শুরু করেছিল। মাটির পাত্র বানাতে কুমারের-চাকের (potter’s wheel) ব্যবহারও শুরু করেছিল।

খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ পর্যন্ত দক্ষিণের উপনিবেশগুলিতে তামা বা ব্রোঞ্জের ব্যবহার খুবই কম পাওয়া গেছে। পরবর্তী কালে পাইয়ামপল্লি (তামিলনাড়ু), হাল্লুর এবং টি.নারসিপুরে তামা ও ব্রোঞ্জের প্রচুর শিল্প ও বাসন সামগ্রী, পুঁতি, পোড়ামাটির মূর্তি এবং কুমোর-চাকে বানানো পাত্র পাওয়া গেছে। একই ধরনের প্রগতি দেখতে পাওয়া যায় সাংগানকাল্লু (কর্ণাটক)-তে। বরং হাল্লুর এবং কুমারানহাল্লিতে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে লোহার ব্যবহারও শুরু হয়ে গিয়েছিল।

২.৪.২ পরিস্থিতির পর্যালোচনা

আগের অধ্যায়টুকু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অবশিষ্ট ভারতের কোথাও কোথাও কয়েকটি মাটির পাত্রের টুকরো আর কিছু কার্নেলিয়ান পুঁতি ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব নেই। এবং প্রতিটি অঞ্চলেই সভ্যতার প্রগতি চলছিল স্বাভাবিক ঢিমেতালে। একটু উণিশ-বিশ থাকলেও, সর্বত্রই সেই প্রগতির গতি প্রায় একই রকম।

অবশিষ্ট ভারতে সিন্ধু সভ্যতার উজ্জ্বল উন্নতির কোন প্রভাব তো ছিলই না, উপরন্তু আমার বিশ্বাস সমসাময়িক মানুষ মানসিক দিক থেকেও অনেকটাই পিছিয়ে এসেছিল আতঙ্কে এবং আশঙ্কায়। নচেৎ সিন্ধু ও হাকরা অববাহিকার সমস্ত শহরগুলি পরিত্যক্ত হওয়ার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাটের নিরাপদ শহরগুলি এবং সমুদ্রবন্দর লোথাল ও ধোলাভিরা পরিত্যক্ত হল কেন? সেখান থেকে ছোট ভাবে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া যেত না? বা পরবর্তীকালে আবার শুরু করা যেত না? রাজস্থানের তামা, টিন, সোনা, রূপোর উৎসগুলি তো বন্ধ হয়ে যায়নি। এই শহরগুলির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। সোয়াৎ উপত্যকার সঙ্গে উত্তরপশ্চিম ভারতের যোগাযোগও যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, সে কথাও জানতে পারবো পরবর্তী অধ্যায়ে। সেই পথে আগের মতোই আনা যেত লাপিজ-লাজুলি, কার্নেলিয়ান অথবা টারকোয়েজ। আর দক্ষ শিল্পীরাও ছিল আশেপাশের এলাকার গ্রামে এবং জনপদে। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বরং সিন্ধু-সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত সব কটি নিরাপদ ভারতীয় শহরকেও তুলে দেওয়া হল প্রকৃতির হাতে। অথচ তাদের আশেপাশেই বেশ কিছু জনপদ ও গ্রাম ছিল, যারা এই শহরের মানুষদের খাদ্য সংস্থান করত। তারা খুব ভালো করেই জানত শহর ছেড়ে সব মানুষরা চলে যাচ্ছে। কিন্তু তারা কেউই ওই শূণ্য শহরের স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতেও গেল না। কেন? তারা কী তবে ভুলতেই চেয়েছিল এবং সত্যিই একদিন ভুলে গেল, কেন?

আমার ধারণা, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত সকল মানুষই দেব-দেবীদের অভিশাপের কথা ভেবে ভয় পেয়েছিল। অর্থাৎ তাদের কাছে অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছিল সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার সমাজ এবং সংস্কৃতি। যার সংস্পর্শে কেউ থাকতেও চায়নি কিংবা ফিরেও আসতে চায়নি। বরং ভুলে যেতে চেয়েছিল এবং সেই কারণেই এদেশের অনেকটাই পিছিয়ে থাকা মানুষদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে তারা আবার মিশে গিয়েছিল।

এই অনীহার পিছনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবশ্যই ছিল – সেটি হল মেসোপটেমিয়ার আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্যের অবসান (২০৮৩ বিসিই)। এই সাম্রাজ্যই সিন্ধু সভ্যতার সব থেকে বড়ো পৃষ্ঠপোষক ছিল। অতএব এই সময়ে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে সিন্ধুসভ্যতার প্রোডাক্টের চাহিদা আর তেমন উৎসাহব্যঞ্জক রইল না।

এই দ্বিতীয় পর্বের প্রাককথায় বলেছিলাম, প্রতিটি উত্তরণ হল সভ্যতার অসীম সিঁড়ির এক একটি ধাপ। আমাদের সমাজের বেশ কিছু মানুষ এই পর্যায়ে এসে সভ্যতার অনেকগুলি ধাপ খুব দ্রুত পার হতে পেরেছিল, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও রপ্তানির বাজার মন্দা হওয়ার কারণে, তারাই আবার বেশ খানিকটা পিছিয়ে দিল আমাদের সভ্যতার অগ্রগতি।  

আর ঠিক এই সময়েই মানুষের নতুন এক গোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করল।  


চলবে...



[1] স্টিটাইট (steatite) একধরনের নরম পরিবর্তিত শিলা, সাধারণতঃ সোপস্টোনও বলে। খুব সহজে কাটা যায়, খোদাই করা যায়।

[2] পৃথিবীর কেন্দ্রের লাভার উপরে ভাসমান সাতটি বিশাল এবং বেশ কিছু ছোট স্থলভূমিকে টেকটনিক প্লেট (tectonic plate) বলে, এগুলি অতি ধীরে সতত সঞ্চরমান।

[3] কার্নেলিয়ান (carnelian) সিলিকা গোষ্ঠীর উজ্জ্বল লাল কিংবা কমলা রঙের মূল্যবান খনিজ পাথর। বিশ্বের বহুদেশেই ভীষণ জনপ্রিয় এই পাথরের কাজেও সিন্ধুসভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল।

[4] সোয়াৎ উপত্যকা (Swat valley) সম্প্রতি বিখ্যাত হয়েছে অসমসাহসী ও লড়াকু একটি কিশোরী মেয়ের জন্যে, যাঁর নাম মালালা ইউসুফজাই। তাঁর জন্ম স্থান উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াৎ জেলায়। পরবর্তীকালে তিনি নোবেল শান্তি পুরষ্কারও পেয়েছেন।  

[5] এই ধরনের ঘর বানানোর প্রযুক্তিকে ইংরিজিতে Wattle and daub বলে। বিশেষজ্ঞর বলেন প্রায় ৬০০০ হাজার বছর আগে থেকে শুরু হয়ে, আজও বিশ্বের বহু সমাজে এই প্রযুক্তি প্রচলিত রয়েছে।


মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

রোববার - ১

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 



বেশ ছোটবেলায় রোববারগুলো আসত মিশ্র প্রভাব নিয়ে। যাকে সাপ্তাহিক রাশিফলে ইংরিজিতে বলে মিক্সড ইনফ্লুয়েন্স। সকাল সকাল উঠে পড়তে হত। যদিও অন্য দিনের চেয়ে একটু দেরীতে। কারণ অন্য দিনে স্কুল থাকত আর আপটু ফাইভ স্কুল শুরু হত সকাল সাতটায়। 

রবিবারের সকালটা শুরু হত দারুণ মজায়। কোনরকমে মুখ টুখ ধুয়ে এসেই বসে পড়তে হত পরোটা নিয়ে। গরম গরম তিনকোণা পরোটা। এ পিঠ - ও পিঠ আরশোলার ডানার রঙে মুচমুচে ভাজা আর তার সঙ্গে ফালি ফালি লম্বা কাটা আলুভাজা পাঁচফোড়নের গন্ধ মাখা। মাঝে মাঝে মেথি দাঁতে চলে এলে তেঁতো লাগত সে হোক সব মিলিয়ে সে এক অনবদ্য ঘটনা। কোন রোববার লুচি আর চৌকো কাটা আলু চচ্চড়ি তাতে পাঁচফোড়ন নয় থাকত কালো জিরের ফোড়ন।  মুখ তেঁতো হবার কোনো রিস্ক থাকত না

জলখাবারের পর সকাল আটটা নাগাদ আমাকে নিয়ে বাবা রওনা দিতেন বাজারে। দুটো বড় থলি, আর একটা ছোট খালি থলিগুলো আমি রাখতাম হাতে। কারণ বারান্দা বা জানালা থেকে আমার পাড়ার বন্ধুরা কেউ না কেউ দেখবেই তখন গম্ভীর ভাবে বেশ বয়স্ক বয়স্ক ভাবটা ফোটাতে সুবিধে হত, হাতে খালি থলিগুলো রাখলে।

শ্রী গোপাল মল্লিক লেন, আর পুলি লেন হয়ে বড় রাস্তা কলেজ স্ট্রিট পুরোনো নাম ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিট বিহারি টানা রিকশাওয়ালারা বলত কানোয়ালিস কর্ণ মানে কান সেখান থেকেই আমি নিশ্চিত হই। কলেজ স্ট্রিটে পড়ে বাঁদিকে একটু গেলেই প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। আর ল্টোদিকে বরাবর সঙ্গে থাকত মেডিকেল কলেজের পাঁচিল।

প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মুখে একটা শিবমন্দির। সকাল বেলায় ট্যাং ট্যাং ট্যাং ট্যাং টানা ঘন্টা বাজিয়ে পুজো চলত। আর তার ল্টোদিকে ছিল বিখ্যাত বাঙালি পাঁঠার দোকান। পাঁঠাও যে বাঙালি হয় সেই প্রথম জেনেছিলাম। সেই দোকানে চিরপ্রতিষ্ঠিতা ছিলেন মা কালীর সুন্দর একটি প্রতিমা। এই পাঁঠা বিক্রেতার পূর্বপুরুষ এক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, যাকে নিয়ে অধুনা একটি বিতর্কিত সিনেমাও তৈরি হয়েছে। সেই দোকানের সামনে রবিবারে বেশ ভিড় জমত। এসব পার হয়ে, কল পাইপের অজস্র বন্ধ দোকান ডিঙিয়ে আমরা চলে আসতাম বৌবাজার মোড়ে ল্টোদিকে অধুনালুপ্ত রূপম সিনেমা, তার কোলের ছানাপট্টি থেকে ছানার জলের টোকো গন্ধ নাকে আসত এপারেও।

রাস্তা পার হয়ে ফুলের দোকানের মাঝখানের গেট দিয়ে বাজার। ভীষণ হট্টগোল, হৈ চৈ আর সবুজে সবুজ। এত সবুজ জঙ্গল আর ধানের ক্ষেত ছাড়া কোথাও দেখিনি। দুনিয়ার যত শাক পাতার ঝোপঝাড় নিয়ে ফিরিওয়ালারা বসত ঠিক মুখটাতেই। পুঁই, লাউ, কুমড়ো, নটে, কলমি, শুসনি, হিঞ্চে, থানকুনি, সজনে পাতা, কারি পাতা, ধনে পাতা এছাড়াও থাকত ঋতু অনুসারি বিশেষ শাক গরমের শুরুতে নিম পাতা, সজনে ডাঁটা, বর্ষাকালে পাটশাক আর শীতকালে পালং আর পেঁয়াজকলি।

এই সব ডিঙিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল মাছের দিকে। কি মাছ মিলবে। তার মুড়ো এবং কাঁটা তেল দিয়ে কোন চচ্চড়ি জমবে তার ওপরে নির্ভর করত শাক সব্জি বাজারের নসিব। কারণ রোববারে কোন চচ্চড়ি হবে না এটা আমার বাবা ও মা ভাবতেই পারতেন না। রুই কাতলা হলে একরকম, ইলিশ হলে অন্যরকম আর ভেটকি হলে পুরো পাল্টে যেত সব্জির ভাগ্য। কাজেই প্রথমেই কানকো উল্টে পেট টিপে পছন্দসই মাছ দরদাম হয়ে ঢুকে পড়ত ছোট থলিতে। আমার দায়িত্বে বাবা দিয়ে দিতেন ছোট থলিটি। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে ঢুকে পরত মৌরলা বা চুনো মাছও তার আছে অন্য রহস্য । মাছ যদি হয় নায়িকা এরা সব এক্সট্রা, তাই বলে মোটেই ফেলনা নয়। সে কথায় পরে আসছি।

তারপর সেই সবুজের সমারোহ থেকে একটা বড়সড় ঝোপ আমাদের থলিতে ঢুকে পড়ত। হয়তো লাউ শাক, কুমড়ো শাক বা পুঁই শাক হয়ে। সেটা নির্ভর করত আমার থলির মাছের ওপরমানে আমার থলিতেই পুরো বাজারের ভরকেন্দ্র! এইবার আসবে সব্জির পালা কোন শাকের কে জুড়িদার থোড় না কুমড়ো, বেগুন না লাউ, মূলো না কচু, রাঙা আলু না ঝিঙে। এসব ব্যাপারে হরেক পারমুটেসন-কম্বিনেসন থেকে বাবা ঠিক ঠাক বেছে নিতে পারতেন সঠিক সব্জি। অতি দ্রুত তারা চলে আসত শাকের থলিতে।

রোববারের শেষ পাতে চাটনি বা অম্বল হবে না এও কখনো হয়? চাটনির জন্যে ছিল পেঁপে, টোম্যাটো, চালতা, জলপাই সেও চলে আসত সব্জির থলিতে সীজন মাফিক যখন যেমন পাওয়া যেত। আমাদের দেশ   যারে কয় আমাগো দ্যাশ বর্ধমান জেলায়। সেখানে তেঁতুল দিয়ে মাছের টক যাকে বর্ধমানের লোকেরা আদর করে অম্বল বলে আমাদের বাড়িতেও মাঝে মাঝে হতো । মৌরলা মাছ বা পাঁচমিশেলি চুনো মাছ পেলে অম্বলের জন্যে পুরোনো তেঁতুল নিতে ভুল হতো না বাবার

সবার শেষ বাজার আলুর বাজার। আলুর সাজানো পাহাড়ের থেকে আলু বেছে নিতে দেখতাম বাবাকে। বড়ো আলুর ওজন বেশী, বেশী বাছতে হবে না বলে আমিও হাত লাগাতাম বাবার সঙ্গে বাবা দেখে বলতেন – ‘উঁহু, ওটা আজ লাগবে না, ওটা মাংসের আলু - পরের রোববারে নোবো। আজ মাছ, তাই এই সাইজটা বেছে তোলবলে বাবা দেখিয়ে দিলেন স্পেসিফায়েড সাইজটা! বুঝলাম আমার ছোট থলিতে যিনি আছেন তিনি নিছক মাছ নন মৎস্য অবতার। বিষ্ণু কেন সব ছেড়ে, অন্ততঃ একবার মাছ হয়ে জন্মেছিলেন, সেটা সেদিন টের পেয়েছিলাম। এতক্ষণ যে একটা বড়োথলি খালি ছিল সেটার পেটে ঢুকে পড়ল আলু। তার সঙ্গে আদা। আর আমার থলিতে ঢুকল লাস্ট আইটেম পেঁয়াজ আর রসুন। এতক্ষণ যে থলি ছিল বাজারের কেন্দ্রবিন্দু সেই থলি এখন হয়ে গেল ব্রাত্য। আমি জানতাম আমার থলিটা আমিষ থলি এর সঙ্গে অন্য কিছুর ঠেকাঠেকি হয়ে গেলে মা খুব বিরক্ত হতেন। আমার দিদিমা ও ঠাকুমা দুজনেই ছিলেন বিধবা তাঁরা দেশ থেকে মাঝে মাঝে আসতেন আমাদের বাসায়। সেই সম্মানে মা খুব নিষ্ঠা নিয়ে মেনটেন করতেন আমিষ-নিরামিষ ভেদাভেদটা। আমাদের বাড়িতে থলি, ঝুড়ি, বঁটি, শিল-নোড়া সবই আলাদা ছিল আমিষের জন্যে।

ঘরে ফিরে আমার থলিটা আমাকেই রাখতে হত ঘরের এককোণায় বেড়ালের হাত থেকে বাঁচাতে গামলা চাপা দিয়ে আর আমাকে বিশেষ ভাবে হাত পা ধুয়ে আসতে হতো আমিষ থলির বহনকারী হিসেবে। এসে দেখতাম মা বঁটি আর বড় বড় দু তিনটে থালা নিয়ে তৈরী হয়ে বসে গেছে কুটনো কুটতে। বাবা থলি থেকে বেড়াল বার করার মতো বের করে ফেলেছে সব কিছু ঘরের মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে মিনি বৌবাজার। দু একটা আলু দৌড়ে চলে গেছে এদিক সেদিক। আর রান্নার ময়দানে নামার আগে লাস্ট মিনিটস গভীর ডিসকাসন চলছে বাবা মায়ের মধ্যে। আমি মায়ের পিঠে শুয়ে কাঁধে চিবুক রেখে শুনছি সে সব কথা।

কথা শেষ হয়ে যায়। মা আমাকে বললেন, - পিঠ থেকে নাম, হাজার কাজ পড়ে আছেআর বাবা বললেন - হ্যাঁ, অনেক হয়েছে, এবার চল, ইংরিজি গ্রামারটা নিয়ে বসি। ট্রানস্লেসানগুলো কিচ্ছু পারছিস না তুই

মাথা নীচু করে পাশের ঘরে গিয়ে কোণা দোমড়ানো বই, খাতা আর শিস ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিল নিয়ে বসে পড়লাম। যা বাজার করে আনা হয়েছে সেটা মায়ের হাতে রান্না হয়ে খাবার বনতে ঘণ্টা তিনেকের ব্যাপার। এখন সবে সাড়ে নটা। কাজেই সাড়ে বারোটা একটার আগে গ্রামারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি নেই। সে এক অন্য ইতিবৃত্ত। অন্য কোন দিন।

সকালের হাজার মজার পর গ্রামারের গ্রাম্ভারি অত্যাচার তাই আগেই বলেছিলাম তখনকার রোববারগুলো আসত - যাকে রাশিফলে ইংরিজিতে বলে - মিক্সড ইনফ্লুয়েন্স নিয়ে।

-- 00 --

[এর পরের পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্রে - "রোববার - ২"] 

নতুন পোস্টগুলি

বকের মৃত্যু

  [এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 " বাংলাদেশের হৃদয় হতে "]   শীতের এক ছুটির দুপুরে, পাড়ার গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় শেখরদা এ...