সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫

শ্রীশ্রী চণ্ডী - শেষ পর্ব

 [প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

 বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


এর আগের পর্ব পাশের সূত্রে "শ্রীশ্রী চণ্ডী - পর্ব ৬"



উত্তরচরিত

একাদশ অধ্যায়

ধ্যান

বালরবিদ্যুতিমিন্দুকিরীটাং তুঙ্গকুচাং নয়নত্রয়যুক্তাম্‌।

স্মেরমুখীং বরদাঙ্কুশপাশাভীতিকরাং প্রভজে ভুবনেশীম্‌।।

[বাল-রবি-দ্যুতিম্‌ ইন্দু-কিরীটাম্‌ তুঙ্গ-কুচাম্‌ নয়ন-ত্রয়-যুক্তাম্‌। স্মের-মুখীম্‌ বরদা-অঙ্কুশ-পাশ-অভীতিকরাম্‌ প্রভজে ভুবন-ঈশীম্‌।।]

যিনি শিশু-রবির মতো প্রভাময়ী, যাঁর মুকুটে চন্দ্র, যিনি পীনপয়োধরা ও ত্রিনেত্রা। যিনি হাস্যমুখী, যিনি বরদা, অঙ্কুশ, পাশ ও অভয়দায়িনী, সেই ভুবনেশ্বরীকে একনিষ্ঠ ধ্যান করি।

  

একাদশ অধ্যায় – নারায়ণীস্তুতি

 ঋষিরুবাচ।

দেব্যা হতে তত্র মহাসুরেন্দ্র সেন্দ্রাঃ সুরা বহ্নিপুরোগমাস্তাম্‌।

কাত্যায়নীং তুষ্টুবুরিষ্টল্মভাদ্‌ বিকাসিবক্ত্রাস্তু বিকাসিতাশাঃ।। ১

দেবি প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ প্রসীদ মাতর্জগতোঽখিলস্য।

প্রসীদ বিশ্বেশ্বরি পাহি বিশ্বং ত্বমীশ্বরী দেবী চরাচরস্য।। ২

আধারভূতা জগতস্ত্বমেকা মহীস্বরূপেণ যতঃ স্থিতাসি।

অপাং স্বরূপস্থিতয়া ত্বয়ৈতৎ আপ্যায্যতে কৃৎস্নমলঙ্ঘ্যবীর্যে।। ৩

[ঋষিঃ উবাচ। দেব্যা হতে তত্র মহা-অসুর-ইন্দ্র স ইন্দ্রাঃ সুরাঃ বহ্নি-পুরঃ-গমাঃ তাম্‌। কাত্যায়নীম্‌ তুষ্টুবুঃ ইষ্ট-লম্ভাৎ বিকাসিবক্ত্রাঃ তু বিকাসিত-আশাঃ।। ১

দেবি প্রপন্ন-আর্তি-হরে প্রসীদ প্রসীদ মাতঃ জগতঃ অখিলস্য। প্রসীদ বিশ্ব-ঈশ্বরি পাহি বিশ্বম্‌ ত্বম্‌ ঈশ্বরী দেবী চরাচরস্য।। ২

আধার-ভূতা জগতঃ-ত্বম্‌ একা মহী-স্বরূপেণ যতঃ স্থিত অসি। অপাম্‌ স্বরূপ-স্থিতয়া ত্বয়া এতৎ আপ্যায্যতে কৃৎস্নম্‌ অলঙ্ঘ্য-বীর্যে।। ৩]

ঋষি বললেন। দেবীর হাতে মহাসুরাধিপতি শুম্ভ নিহত হওয়ায় ইন্দ্র সহ অগ্নিপ্রমুখ দেবতারা অভীষ্টলাভ ও পূর্ণমনোরথ হয়ে, সহাস্যমুখে সেই দেবী কাত্যায়নীর স্তব করতে লাগলেন।

হে দেবি, হে আশ্রিতের দুঃখ-হারিণি প্রসন্ন হোন, হে অখিল জগতের মাতা আপনি প্রসন্ন হোন। হে বিশ্বেশ্বরি, আপনি প্রসন্ন হয়ে জগৎ পালন করুন, হে দেবি আপনি বিশ্বচরাচরের ঈশ্বরী। হে দেবি, আপনাকে শক্তিতে অতিক্রম করা যায় না, আপনি পৃথিবী-স্বরূপে অবস্থিতা, আপনি একা (অদ্বিতীয়া) এই জগতের আশ্রয়রূপাআপনার জলরূপের স্থিতিতেই এই সমগ্র জগৎ পুষ্টি লাভ করে।

                    ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরনন্তবীর্যা বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া।

                    সম্মোহিতং দেবি সমস্তমেতৎ ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ।। ৪

                    বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।

                    ত্বয়ৈকয়া পূরিতমম্‌বয়ৈতৎ কা তে স্তুতিঃ স্তব্যপরাপরোক্তিঃ।। ৫      

[ত্বম্‌ বৈষ্ণবী-শক্তিঃ-অনন্ত-বীর্যা বিশ্বস্য বীজম্‌ পরমা অসি মায়া। সম্মোহিতম্‌ দেবি সমস্তম্‌ এতৎ ত্বম্‌ বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি-হেতুঃ।। ৪

বিদ্যাঃ সমস্তাঃ তব দেবি ভেদাঃ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ স-কলাঃ জগৎসু। ত্বয়া একয়া পূরিতম্‌ অম্বয়া এতৎ কা তে স্তুতিঃ স্তব্য-পর-অপর-উক্তিঃ।। ৫]

আপনি অনন্ত শক্তিময়ী বৈষ্ণবী শক্তি, আপনি জগতের বীজস্বরূপা ও মহামায়া। হে দেবি, আপনার মায়ায় সমস্ত জগৎ মোহিত হয়ে রয়েছে, আবার প্রসন্না হলে আপনিই তাদের মুক্তির কারণ স্বরূপ। হে দেবি, জগতের সমস্ত বিদ্যা, সমস্ত স্ত্রী–গুণ ও সকল কলা আপনারই রূপভেদ । আপনি একা ও অদ্বিতীয়া জননীরূপে এই জগতের সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত, অতএব আপনার পরা ও অপরা মহিমার স্তব আর কী হতে পারে?

[বিদ্যা আঠারোটি – চার বেদ, ছয় বেদাঙ্গ, আট শাস্ত্র। স্ত্রীগুণ – তিনটি, পাতিব্রত্য, সৌন্দর্য ও তারুণ্য। কলা – চৌষট্টি – গীত, বাদ্য, নৃত্য, নাট্য ইত্যাদি। দেবীর অপরা মহিমা থেকে ঐহিক সুখ-সম্পদ লাভ হয় এবং পরা মহিমায় পরমার্থ প্রাপ্তি ঘটে।]

সর্বভূতা যদা দেবী স্বর্গমুক্তিপ্রদায়িনী।

ত্বং স্তুতা স্তুতয়ে কা বা ভবন্তু পরমোক্তয়ঃ।। ৬

সর্বস্য বুদ্ধিরূপেণ জনস্য হৃদি সংস্থিতে।

স্বর্গাপবর্গদে দেবি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ৭

[সর্বভূতা যদা দেবী স্বর্গ-মুক্তি-প্রদায়িনী। ত্বম্‌ স্তুতা স্তুতয়ে কা বা ভবন্তু পরম-উক্তয়ঃ।। ৬

সর্বস্য বুদ্ধি-রূপেণ জনস্য হৃদি সংস্থিতে। স্বর্গ-অপবর্গ-দে দেবি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ৭

আপনি সর্বভূতস্বরূপা, স্বর্গ ও মুক্তি প্রদায়িনী দেবী, যখন আপনার স্তুতি করি, তখন এর থেকে স্তবের পরমা-উক্তি আর কী হতে পারে? হে দেবি, আপনিই সকল মানুষের হৃদয়ে বুদ্ধিরূপে অবস্থান করেন, আপনিই স্বর্গ ও অপবর্গ দাত্রী নারায়ণী, আপনাকে প্রণাম করি। [তন্ত্রমতে জীবনের লক্ষ্য দুটি, অপবর্গ ও মোক্ষ বা মুক্তি। অপবর্গ হল ধর্ম, অর্থ ও কাম। দেবী এর সবগুলিই দান করেন।]

কলাকাষ্ঠাদিরূপেণ পরিণামপ্রদায়িনী।

বিশ্বস্যোপরতৌ শক্তে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ৮

সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে  শিবে সর্বার্থসাধিকে।

শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ৯

[কলা-কাষ্ঠাদি-রূপেণ পরিণাম-প্রদায়িনী। বিশ্বস্য উপরতৌ শক্তে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ৮

সর্ব-মঙ্গল-মঙ্গল্যে  শিবে সর্ব-অর্থ-সাধিকে। শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ৯

আপনি কলা-কাষ্ঠাদি রূপে সকল পরিণাম দান করেন। শক্তিরূপে আপনি বিশ্বের সংহার করে থাকেন, হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। [কলা ও কাষ্ঠা কাল বা সময়ের একক। ১ কাষ্ঠা = ১৮ নিমেষ, ১ কলা = ৩০ কাষ্ঠা। অর্থাৎ দেবী কালরূপে সকল কর্মের ফল প্রদায়িনী।] শিবারূপে সকল মঙ্গলের আপনিই মঙ্গলস্বরূপা ও সর্ব-অর্থ (চতুর্বর্গ – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ) দায়িনী,  গৌরী রূপে আপনি ত্রিভুবনের আশ্রয়দাত্রী, হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম।

সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।

গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১০

শরণাগতদীনার্তপরিত্রাণপরায়ণে।

সর্বস্যার্তিহরে দেবি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১১

হংসযুক্তবিমানস্থে ব্রহ্মাণীরূপধারিণি।

কৌশাম্ভঃক্ষরিকে দেবি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১২

[সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশানাম্‌ শক্তিভূতে সনাতনি। গুণ-আশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১০

শরণা-আগত-দীন-আর্ত-পরিত্রাণ-পরায়ণে। সর্বস্য আর্তি হরে দেবি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১১

হংস-যুক্ত-বিমানস্থে ব্রহ্মাণী-রূপ-ধারিণি। কৌশ-অম্ভঃ-ক্ষরিকে দেবি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১২]

আপনি সৃষ্টি-স্থিতি ও সংহারের শক্তিরূপা, তিনগুণের আশ্রয় আপনি সনাতনি হলেও আপনি ত্রিগুণময়ী। হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। হে দেবি, আপনার শরণাগত দীন ও আর্তদের প্রতি আপনি পরিত্রাণ পরায়ণ, আপনি সকলের দুঃখ-হারিণী, হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। ব্রহ্মাণীরূপে আপনি হংসযুক্ত বিমানে অবস্থিতা, কমণ্ডলু থেকে কুশ দিয়ে (পবিত্র) জল-সিঞ্চনকারিনী, হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম।

[সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ – তিনগুণ। দেবী এই তিনগুণের আধার, অতএব তিনি গুণময়ী। প্রকৃতিরূপে তাঁর এই তিনগুণের প্রভাবেই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি নিজে নির্গুণ এবং ত্রিগুণাতীতা, সনাতনী আদ্যাশক্তি।]

ত্রিশূলচন্দ্রাহিধরে মহাবৃষভবাহিনি।

মাহেশ্বরীস্বরূপেণ নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৩

ময়ূরকুক্কুটবৃতে মহাশক্তিধরেঽনঘে।

কৌমারীরূপসংস্থানে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৪

শঙ্খচক্রগদাশার্ঙ্গগৃহীতপরমায়ুধে।

প্রসীদ বৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৫

গৃহীতোগ্রমহাচক্রে দংষ্ট্রোদ্ধৃতবসুন্ধরে।

বরাহরূপিণি শিবে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৬

[ত্রিশূল-চন্দ্র–অহি-ধরে মহা-বৃষভ-বাহিনি। মাহেশ্বরী-স্বরূপেণ নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৩

ময়ূর-কুক্কুট-বৃতে মহা-শক্তি-ধরে-অনঘে। কৌমারীরূপসংস্থানে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৪

শঙ্খ-চক্র-গদা-শার্ঙ্গ–গৃহীত-পরম-আয়ুধে। প্রসীদ বৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে ।। ১৫

গৃহীত-উগ্র-মহা-চক্রে দংষ্ট্র-উদ্ধৃত-বসুন্ধরে। বরাহরূপিণি শিবে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৬]

আপনি ত্রিশূল, চন্দ্র ও নাগ ধারণ করেন এবং আপনি বৃষবাহনা, এই মাহেশ্বরীস্বরূপে হে নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। ময়ুর ও কুক্কুট পরিবৃতা মহাশক্তিধারিণী হে দেবি, হে নিত্য-শুদ্ধ কৌমরীরূপা নারায়ণি, আপনাকে প্রণাম। শঙ্খ, চক্র, গদা ও শার্ঙ্গ (বিষ্ণুর ধনু বা খড়্গের নাম শার্ঙ্গ) এই চার পরম অস্ত্রধারিণী হে দেবি, আপনি প্রসন্না হোন, হে বৈষ্ণবীরূপিণী নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। মহাতুণ্ড-চক্রে এবং উগ্রদন্তে আপনি পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন, হে নারায়ণি, মঙ্গলময়ী বারাহীরূপা, আপনাকে প্রণাম।

নৃসিংহরূপেণোগ্রেণ হন্তুং দৈত্যান্‌ কৃতোদ্যমে।

ত্রৈলোক্যত্রাণসহিতে নারায়ণি নমোঽস্তুতে।। ১৭

কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্রনয়নোজ্জ্বলে।

বৃত্রপ্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৮

শিবদূতীস্বরূপেণ হতদৈত্যমহাবলে।

ঘোররূপে মহারাবে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ১৯

দংষ্ট্রাকরালবদনে শিরোমালাবিভূষণে।

চামুণ্ডে মুণ্ডমথনে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ২০

[নৃসিংহ-রূপেণ-উগ্রেণ হন্তুম্‌ দৈত্যান্‌ কৃত-উদ্যমে। ত্রৈলোক্য-ত্রাণ-সহিতে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।।  ১৭

কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্র-নয়ন-উজ্জ্বলে। বৃত্র-প্রাণ-হরে চ ঐন্দ্রি নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ।। ১৮

শিবদূতী-স্বরূপেণ হত-দৈত্য-মহা-বলে। ঘোর-রূপে মহা-আরাবে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ১৯

দংষ্ট্রা-করাল-বদনে শিরঃ-মালা-বিভূষণে। চামুণ্ডে মুণ্ড-মথনে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ২০]

উগ্র নৃসিংহরূপে আপনার দৈত্যবধের উদ্যোগ সার্থক, হে ত্রিলোকতারিণি নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। মুকুটধারিণী, উজ্জ্বল সহস্রনয়না এবং আপনি বৃত্রেরও প্রাণঘাতিনী, ঐন্দ্রীরূপে হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। ভয়ংকরী, মহাগর্জনে মহাদৈত্যসেনা নিধনকারিণী, হে নারায়ণি শিবদূতীস্বরূপে আপনাকে প্রণাম। ভয়াল দন্তমুখী, মুণ্ডমালায় অলংকৃতা ও মুণ্ডাসুরমর্দিনী, হে নারায়ণি চামুণ্ডারূপে আপনাকে প্রণাম।

লক্ষ্মী লজ্জে মহাবিদ্যে শ্রদ্ধে পুষ্টি স্বধে ধ্রুবে।

মহারাত্রি মহামায়ে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ২১

মেধে সরস্বতি বরে ভূতি বাভ্রবি তামসি।

নিয়তে ত্বং প্রসীদেশে নারায়ণি নমোঽস্তু তে।। ২২

সর্বস্বরূপে সর্বেশে সর্বশক্তিসমন্বিতে।

ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে দেবি নমোঽস্তু তে।। ২৩

এতৎ তে বদনং সৌম্যং লোচনত্রয়ভূষিতম্‌।

পাতুঃ ন সর্বভূতেভ্যঃ কাত্যায়নি নমোঽস্তু তে।। ২৪

[লক্ষ্মী লজ্জে মহাবিদ্যে শ্রদ্ধে পুষ্টি স্বধে ধ্রুবে। মহারাত্রি মহামায়ে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ২১

মেধে সরস্বতি বরে ভূতি বাভ্রবি তামসি। নিয়তে ত্বম্‌ প্রসীদ-ঈশে নারায়ণি নমঃ অস্তু তে।। ২২

সর্বস্বরূপে সর্ব-ঈশে সর্ব-শক্তি-সমন্বিতে। ভয়েভ্যঃ ত্রাহি নঃ দেবি দুর্গে দেবি নমঃ অস্তু তে।। ২৩

এতৎ তে বদনম্‌ সৌম্যম্‌ লোচন-ত্রয়-ভূষিতম্‌। পাতুঃ নঃ সর্বভূতেভ্যঃ কাত্যায়নি নমঃ অস্তু তে।। ২৪]

আপনিই লক্ষ্মী, লজ্জা, পরমবিদ্যা, শ্রদ্ধা, পুষ্টি, স্বধা-মন্ত্র এবং নিত্যরূপিণী, হে নারায়ণি, আপনিই প্রলয়রূপিণী মহারাত্রি ও মহামায়া, আপনাকে প্রণাম। আপনিই সরস্বতী, মেধা, সর্বশ্রেষ্ঠারূপিণী, আপনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণধারিণী, আপনি নিয়তি এবং ঈশ্বরী। আপনি প্রসন্না হোন, হে নারায়ণি আপনাকে প্রণাম। আপনি সর্ব-স্বরূপা, সর্বেশ্বরী, সর্ব শক্তির সমন্বয়, হে দেবি দুরধিগম্যা দুর্গা, সকল ভয় থেকে আমাদের ত্রাণ করুন, হে দেবি, আপনাকে প্রণাম। ত্রিনয়নে শোভিতা, হে চারু-আননে, আমাদের সর্ব উপদ্রব থেকে রক্ষা করুন, হে কাত্যায়নি আপনাকে প্রণাম।

জ্বালাকরালমত্যুগ্রমশেষাসুরসূদনম্‌।

ত্রিশূলং পাতু নো ভীতের্ভদ্রকালি নমোঽস্তু তে।। ২৫

হিনস্তি দৈত্যতেজাংসি স্বনেনাপূর্য যা জগৎ।

সা ঘণ্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যোঽনঃ সুতানিব।। ২৬

অসুরাসৃগ্‌বসাপঙ্কচর্চিতস্তে করোজ্জ্বলঃ।

শুভায় খড়্গো ভবতু চণ্ডিকে ত্বাং নতা বয়ম্‌।। ২৭

[জ্বালা-করালম্‌ অতি-উগ্রম্‌ অশেষ-অসুর-সূদনম্‌। ত্রিশূলং পাতু নঃ ভীতেঃ ভদ্রকালি নমঃ অস্তু তে।। ২৫

হিনস্তি দৈত্য-তেজাংসি স্বনেন আপূর্য যা জগৎ। সা ঘণ্টা পাতু নঃ দেবি পাপেভ্যঃ অনঃ সুতান্‌ ইব।। ২৬

অসুর-অসৃক্‌-বসা-পঙ্ক-চর্চিতঃ তে কর-উজ্জ্বলঃ। শুভায় খড়্গঃ ভবতু চণ্ডিকে ত্বাম্‌ নতা বয়ম্‌।। ২৭]

প্রচণ্ড তেজময়, অতি ভয়ংকর, অসংখ্য অসুর নিধনকারী আপনার ত্রিশূল আমাদের সকল ভয় থেকে রক্ষা করুক, হে ভদ্রকালি, আপনাকে প্রণাম। যে ঘণ্টার ধ্বনি জগতে ব্যাপ্ত হওয়ায়, দৈত্যরা নিস্তেজ হয়েছিল, হে দেবি, মাতা যেমন পুত্রকে রক্ষা করেন, সেই ঘণ্টা সকল পাপের থেকে আমাদের রক্ষা করুক। হে চণ্ডিকে, আপনার হাতের যে উজ্জ্বল খড়্গ অসুরের রক্ত-মেদরূপ কাদায় লিপ্ত, সেই খড়্গ আমাদের মঙ্গল করুক, হে দেবী আমাদের বিনত প্রণাম নিন।

রোগানশেষানপহংসি তুষ্ট্বা রুষ্টা তু কামান্‌ সকলানভীষ্টান্‌।

ত্বামাশ্রিতানাং ন বিপন্নরাণাং ত্বামাশ্রিতা হ্যাশ্রয়তাং প্রয়ান্তি।। ২৮

এতৎ কৃতং যৎ কদনং ত্বয়াদ্য ধর্মদ্বিষাং দেবি মহাসুরাণাম্‌।

রূপৈরনৈকর্বহুধাত্মমূর্তিং কৃত্বাম্বিকে তৎ প্রকরোতি কান্যা।। ২৯

বিদ্যাসু শাস্ত্রেষু বিবেকদীপেষ্বাদ্যেষু বাক্যেষু চ কা ত্বদন্যা।

মমত্বগর্তেঽতিমহান্ধকারে বিভ্রাময়ত্যেতদতীব বিশ্বম্‌।। ৩০

[রোগান্‌ অশেষান্‌ অপহংসি তুষ্ট্বা রুষ্টা তু কামান্‌ সকলান্‌ অভীষ্টান্‌। ত্বাম্‌ আশ্রিতানাম্‌ ন বিপৎ নরাণাম্‌ ত্বাম্‌ আশ্রিতা হি আশ্রয়তাম্‌ প্রয়ান্তি।। ২৮

এতৎ কৃতম্‌ যৎ কদনম্‌ ত্বয়া অদ্য ধর্ম-দ্বিষাম্‌ দেবি মহা-অসুরাণাম্‌। রূপৈঃ অনৈকঃ বহুধা-আত্মমূর্তিম্‌ কৃত্বা অম্বিকে তৎ প্রকরোতি কা অন্যা।। ২৯

বিদ্যাসু শাস্ত্রেষু বিবেক-দীপেষু আদ্যেষু বাক্যেষু চ কা ত্বৎ অন্যা। মমত্ব-গর্তে-অতি-মহা-অন্ধকারে বিভ্রাময়তি এতৎ অতীব বিশ্বম্‌।। ৩০]

আপনি তুষ্টা হলে সকল রোগ এবং ক্রুদ্ধা হলে অভীষ্ট সকল সংকল্প হরণ করেন, আপনার আশ্রিত মানুষের কোন বিপদ থাকে না, আপনার আশ্রিতরাই অন্যের আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠে। হে দেবি, অনেক রূপে বহুবিধ আত্মমূর্তিতে এই যে আপনি আজ ধর্ম বিদ্বেষী মহাসুরদের বিনাশ করলেন, হে অম্বিকে, আপনি ছাড়া এই কাজ আর কে করতে পারে? এই বিশ্বের মানুষকে সকল বিদ্যায়, ধর্মশাস্ত্রে, বিবেকের আলোকে, আদি বাক্যে এবং মোহগর্তের মহাতিমির-অবিদ্যায়, আপনি ছাড়া কে আর বারবার ভ্রমণ করাতে পারে?     

রক্ষাংসি যত্রোগ্রবিষাশ্চ নাগা যত্রারয়ো দস্যুবলানি যত্র।

দাবানলো যত্র তথাব্‌ধিমধ্যে তত্র স্থিতা ত্বং পরিপাসি বিশ্বম্‌।। ৩১

বিশ্বেশ্বরি ত্বং পরিপাসি বিশ্বং বিশ্বাত্মিকা ধারয়সীতি বিশ্বম্‌।

বিশ্বেশবন্দ্যা ভবতী ভবন্তি বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ।। ৩২

দেবি প্রসীদ পরিপালয় নোঽরিভীতেঃ নিত্যং যথাসুরবধাদধুনৈব সদ্যঃ।

পাপানি সর্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উৎপাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গান্‌।। ৩৩

প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবি বিশ্বার্তিহারিণি।

ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।। ৩৪  

[রক্ষাংসি যত্র উগ্রবিষাঃ চ নাগাঃ যত্র অরয়ঃ দস্যু-বলানি যত্র। দাবানলঃ যত্র তথা অব্‌ধি-মধ্যে তত্র স্থিতা ত্বম্‌ পরিপাসি বিশ্বম্‌।। ৩১

বিশ্ব-ঈশ্বরি ত্বম্‌ পরিপাসি বিশ্বম্‌ বিশ্ব-আত্মিকা ধারয়সি ইতি বিশ্বম্‌। বিশ্ব-ঈশ-বন্দ্যা ভবতী ভবন্তি বিশ্ব-আশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তি-নম্রাঃ।। ৩২

দেবি প্রসীদ পরিপালয় নঃ অরি-ভীতেঃ নিত্যম্‌ যথা অসুর-বধাৎ অধুনা এব সদ্যঃ। পাপানি সর্ব-জগতাম্‌ চ শমম্‌ নয় আশু উৎপাৎ-অপাক-জনিতাম্‌ চ মহা-উপসর্গান্‌।। ৩৩

প্রণতানাম্‌ প্রসীদ ত্বম, দেবি বিশ্ব-আর্তিহারিণি। ত্রৈলোক্য-বাসিনাম্‌ ঈড্যে লোকানাম্‌ বরদা ভব।। ৩৪]

যেখানে রাক্ষস ও উগ্রবিষ নাগ, যেখানে শত্রু ও দস্যুসেনা, যেখানে দাবানল, সেখানে - এমনকি সমুদ্রমধ্যেও আপনি সর্বদা বিরাজিতা হয়ে বিশ্বকে প্রতিপালন করেনহে বিশ্বেশ্বরি, আপনি এই বিশ্বকে আত্ম-স্বরূপে ধারণ করেন এবং পরিপালনও করেন। আপনি বিশ্বের সকল ঈশ্বরের বন্দনীয়া, যে আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়, তিনিই বিশ্বের আশ্রয় হয়ে থাকেন। হে দেবি, আপনি প্রসন্না হোন, যেভাবে আপনি সদ্য সদ্য অসুরদের বিনাশ করলেন, সেইরকমই আমাদের শত্রুভয় থেকে সর্বদা রক্ষা করুন। সর্ব জগতে পাপের এবং উৎপাত ও অপবিত্রতা থেকে উৎপন্ন মহাউপসর্গের শান্তি এনে দিন। [মহামারী, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদিকে উপসর্গ বলা হয়।] হে দেবি, হে বিশ্বের দুঃখহারিণি, হে ত্রৈলোক্যবাসীদের আরাধ্যা, আপনি প্রসন্ন হন, আপনার চরণে প্রণত ভক্তদের বরদান করুন।

দেব্যুবাচ।

বরদাহং সুরগণা বরং যং মনসেচ্ছথ।

তং বৃণুধ্বং প্রযচ্ছামি জগতামুপকারকম্‌।। ৩৫

দেবা ঊচুঃ।

সর্ববাধাপ্রশমনং ত্রৈলোক্যস্যাখিলেশ্বরি।

এবমেবা ত্বয়া কার্যমস্মদ্বৈরিবিনাশনম্‌।। ৩৬

[দেবী উবাচ। বরদা অহম্‌ সুরগণা বরম্‌ যম্‌ মনস-ইচ্ছথ। তম্‌ বৃণুধ্বম্‌ প্রযচ্ছামি জগতাম্‌ উপকারকম্‌।। ৩৫

দেবা ঊচুঃ। সর্ব-বাধা-প্রশমনম্‌ ত্রৈলোক্যস্য-অখিলেশ্বরি। এবম্‌ এবা ত্বয়া কার্যম্‌ অস্মৎ বৈরি-বিনাশনম্‌।। ৩৬]

দেবী বললেন, আমিই বরদা, হে দেবগণ, তোমাদের যা মনের ইচ্ছা প্রার্থনা কর, জগতের কল্যাণের জন্য আমি প্রদান করব।

দেবতারা বললেন। হে অখিলেশ্বরী, ত্রিলোকের সকল বাধার প্রশমনে আপনি আমাদের এই যে শত্রুবিনাশ করলেন, এমনই কাজ আপনি করতে থাকুন।

দেব্যুবাচ।

বৈবস্বতেঽন্তরে প্রাপ্তে অষ্টাবিংশতিমে যুগে।

শুম্ভো নিশুম্ভশ্চৈবান্যাবুৎপৎস্যেতে মহাসুরৌ।। ৩৭

নন্দগোফৃহে জাতা যশোদাগর্ভসম্ভবা।

ততস্তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচলনিবাসিনী।। ৩৮

পুনরপ্যতিরৌদ্রেণ রূপেণ পৃথিবীতলে।

অবতীর্য হনিষ্যামি বৈপ্রচিত্তাংস্তু দানবান্‌।। ৩৯

ভক্ষয়ন্ত্যাশ্চ তানুগ্রান্‌ বৈপ্রচিত্তান্‌ মহাসুরান্‌।

রক্তা দন্তা ভবিষ্যন্তি দাড়িমীকুসুমোপমাঃ।। ৪০

[দেবী উবাচ। বৈবস্বতে অন্তরে প্রাপ্তে অষ্টাবিংশতিমে যুগে। শুম্ভঃ নিশুম্ভঃ চ এব অন্যৌ উৎপৎস্যেতে মহাসুরৌ।। ৩৭

নন্দ-গোপ-গৃহে জাতা যশোদা-গর্ভ-সম্ভবা। ততঃ তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচল-নিবাসিনী।। ৩৮

পুনঃ অপি অতিরৌদ্রেণ রূপেণ পৃথিবীতলে। অবতীর্য হনিষ্যামি বৈপ্রচিত্তান্‌ তু দানবান্‌।। ৩৯

ভক্ষয়ন্ত্যাঃ চ তান্‌ উগ্রান্‌ বৈপ্রচিত্তান্‌ মহাসুরান্‌। রক্তা দন্তা ভবিষ্যন্তি দাড়িমী-কুসুম-উপমাঃ।। ৪০]

দেবী বললেন। অষ্টবিংশতিতম যুগে বৈবস্বত মনুর অধিকার কালে, এই দুই মহাসুর শুম্ভ ও নিশুম্ভ যখন অন্য নামে প্রাদুর্ভূত হবে, তখন আমি বিন্ধ্যাচল-নিবাসিনী হয়ে এবং নন্দগোপের গৃহে যশোদার গর্ভে জন্ম নিয়ে দুজনকে বিনাশ করব। আবার অতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, পৃথিবীতে অবতীর্ণা হব এবং দানব বৈপ্রচিত্তান বংশীয় দানবদেরও হত্যা করব। সেই ভয়ানক মহাসুর বৈপ্রচিত্তানদের যখন আমি গ্রাস করব, রক্তে আমার দাঁত ডালিমফুলের তুল্য হয়ে উঠবে।

ততো মাং দেবতাঃ স্বর্গে মর্ত্যলোকে চ মানবাঃ।

স্তুবন্তো ব্যাহরিষ্যন্তি সততং রক্তদন্তিকাম্‌।। ৪১

ভূয়শ্চ শতবার্ষিক্যামনাবৃষ্ট্যামনম্ভসি।

মুনিভিঃ সংস্তুতা ভূমৌ সম্ভবিষ্যাম্যযোনিজা।। ৪২

ততঃ শতেন নেত্রাণাং নিরীক্ষিষ্যামি যন্মুনীন্‌।

কীর্তয়িষ্যন্তি মনুজাঃ শতাক্ষীমিতি মাং ততঃ।। ৪৩

ততোঽহমখিলং লোকমাত্মদেহসমুদ্ভবৈঃ।

ভরিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরাবৃষ্টেঃ প্রাণধারকৈঃ।। ৪৪

শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যাম্যহং ভুবি।

তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরম্‌।। ৪৫

[ততঃ মাম্‌ দেবতাঃ স্বর্গে মর্ত্যলোকে চ মানবাঃ। স্তুবন্তঃ ব্যাহরিষ্যন্তি সততম্‌ রক্ত-দন্তিকাম্‌।। ৪১

ভূয়ঃ চ শত-বার্ষিক্যাম্‌ অনাবৃষ্ট্যাম্‌ অনম্ভসি। মুনিভিঃ সংস্তুতা ভূমৌ সম্ভবিষ্যামি অযোনিজা।। ৪২

ততঃ শতেন নেত্রাণাং নিরীক্ষিষ্যামি যৎ মুনীন্‌। কীর্তয়িষ্যন্তি মনুজাঃ শতাক্ষীম্‌ ইতি মাম্‌ ততঃ।। ৪৩

ততঃ অহম্‌ অখিলম্‌ লোকম্‌ আত্ম-দেহ-সমুদ্ভবৈঃ। ভরিষ্যামি সুরাঃ শাকৈঃ আবৃষ্টেঃ প্রাণধারকৈঃ।। ৪৪

শাকম্ভরী ইতি বিখ্যাতিম্‌ তদা যাস্যামি অহম্‌ ভুবি। তত্র এব চ বধিষ্যামি দুর্গম্‌ আখ্যম্‌ মহাসুরম্‌।। ৪৫]

তখন স্বর্গের দেবতারা ও মর্তের মানবেরা স্তব করার সময় সর্বদা রক্তদন্তিকা নামে আমার কীর্তন করবে। আবার শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টিতে পৃথিবী যখন জলহীন হবে, তখন মুনিদের স্তবে ভূতলে অগর্ভজাতা হয়ে আবির্ভূতা হবো। [কর্মফলের অধীন মানুষ মাতৃগর্ভে জন্ম নেয়, দেবী কর্মফলের অধীনা না হওয়ায় তিনি গর্ভজাতা না হয়েও আবির্ভূতা হতে পারেন।] তখন যেহেতু আমি শত-নেত্র দিয়ে মুনিদের নিরীক্ষণ করব, সেহেতু মানুষ শতাক্ষী নামে আমার কীর্তন করবে। হে দেবগণ, তখন বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত, নিজের দেহ থেকে জাত শাক (শস্য-সব্জি) দিয়ে অখিল জগতকে পালন করব। সেই সময় আমি শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব এবং সেই সময়েই দুর্গম নামের এক মহাসুরকে বধ করব।

দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।

পুনশ্চাহং যদা ভীমং রূপং কৃত্বা হিমাচলে।। ৪৬

রক্ষাংসি ক্ষয়য়িষ্যামি মুনীনাং ত্রাণকারণাৎ।

তদা মাং মুনয়ঃ সর্বে স্তোষ্যন্ত্যানম্রমূর্তয়ঃ।। ৪৭

ভীমাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।

যদারুণাখ্যস্ত্রৈলোক্যে মহাবাধাং করিষ্যতি।। ৪৮

তদাহং ভ্রামরং রূপং কৃত্বাঽসংখ্যেয়ষট্‌পদম্‌।

ত্রৈলোক্যস্য হিতার্থায় বধিষ্যামি মহাসুরম্‌।। ৪৯

ভ্রামরীতি চ মাং লোকাস্তদা স্তোষ্যন্তি সর্বতঃ।

ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি। 

তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্‌।। ৫০ 

[দুর্গাদেবী ইতি বিখ্যাতম্‌ তৎ মে নাম ভবিষ্যতি। পুনঃ চ অহম্‌ যদা ভীমম্‌ রূপম্‌ কৃত্বা হিমাচলে।। ৪৬

রক্ষাংসি ক্ষয়য়িষ্যামি মুনীনাম্‌ ত্রাণ-কারণাৎ। তদা মাম্‌ মুনয়ঃ সর্বে স্তোষ্যন্তি আনম্র-মূর্তয়ঃ।। ৪৭

ভীমাদেবী ইতি বিখ্যাতম্‌ তৎ মে নাম ভবিষ্যতি। যৎ অরুণ-আখ্যঃ ত্রৈলোক্যে মহা-বাধাম্‌ করিষ্যতি।। ৪৮

তদা অহম্‌ ভ্রামরম্‌ রূপম্‌ কৃত্বা অসংখ্যেয়-ষট্‌পদম্‌। ত্রৈলোক্যস্য হিত-অর্থায় বধিষ্যামি মহা-অসুরম্‌।। ৪৯

ভ্রামরী ইতি চ মাম্‌ লোকাঃ তদা স্তোষ্যন্তি সর্বতঃ। ইত্থম্‌ যদা যদা বাধা দানব-উত্থা ভবিষ্যতি। তদা তদা অবতীর্য অহম্‌ করিষ্যামি অরি-সংক্ষয়ম্‌।। ৫০]

 তখন (দুর্গম অসুরকে বধ করার জন্য) আমার নাম দুর্গা নামে বিখ্যাত হবে। আবার হিমাচলে ভীমা রূপ ধারণ করে যখন আমি রাক্ষসদের বিনাশ করে মুনিদের ত্রাণকারিকা হব, তখন সকল মুনি নতমস্তকে আমার স্তব করবেন। সেই সময় আমি ভীমাদেবী নামে বিখ্যাত হব। যখন অরুণ নামক অসুর ত্রিলোকে মহাবিঘ্ন করতে থাকবে, তখন ভ্রমররূপে অসংখ্য ষট্‌-পদ ভ্রমর হয়ে ত্রিলোকের হিতের জন্যে মহাসুরকে বধ করব। তখন সর্বলোক ভ্রামরী নামেই আমার স্তব করবে। এইভাবে যখনই দানবের উত্থানে বিঘ্ন ঘটবে, তখনই আমি অবতীর্ণা হয়ে শত্রু-বিনাশ করব।

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে নারায়ণীস্তুতিঃ 

নাম একাদশোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে নারায়ণীস্তুতি

নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত

 

 

উত্তরচরিত

দ্বাদশ অধ্যায়

ধ্যান

বিদ্যুদ্দামসমপ্রভাং মৃগপতি-স্কন্ধ-স্থিতাং ভীষণাং

কন্যাভিঃ করবাল-খেট-বিলসদ্ধস্তাভিরাসেবিতাম্‌।

হস্তৈশ্চক্রধরালি-খেট-বিশিখাংশ্চাপং গুণং তর্জনীং

বিভ্রাণামনলাত্মিকাংশশিধরাং দুর্গাং ত্রিনেত্রাং ভজে।।

[বিদ্যুৎ-দাম-সম-প্রভাম্‌ মৃগ-পতি-স্কন্ধ-স্থিতাম্‌ ভীষণাম্‌ কন্যাভিঃ করবাল-খেট-বিলসৎ হস্তাভিঃ আসেবিতাম্‌।

হস্তৈঃ চক্র-ধরালি-খেট-বিশিখান্‌-চাপম্‌-গুণম্‌-তর্জনীম্‌ বিভ্রাণাম্‌ অনল-আত্মিকাম্‌-শশিধরাম্‌ দুর্গাম্‌ ত্রিনেত্রাম্‌ ভজে।।]

যিনি বিদ্যুতমালার মতো প্রভাময়ী, সিংহারোহণা এবং হাতে ভয়ংকর করবাল ও খেট শোভিতা মাতৃকাগণ যাঁর সেবা করেন, বহু হাতে যিনি চক্র, ধরালি, খেট, বিশিখসমূহ, ধনু, গুণ, তর্জনীমুদ্রাধারিণী, জ্যোতির্ময়ী, শশিধরা ও ত্রিনেত্রা, সেই দেবী দুর্গার ভজনা করি।

[করবাল – খড়্গ বা অসি ; খেট – ঢাল; ধরালি – শাণিত; বিশিখ – তির বা বাণ; গুণ – ধনুকের ছিলা বা জ্যা।]

 

 

উত্তর চরিত

দ্বাদশ অধ্যায় – ভগবতী বাক্য 

দেব্যুবাচ।

এভিঃ স্তবৈশ্চ মাং নিত্যং স্তোষ্যতে যঃ সমাহিতঃ।

তস্যাহং সকলাং বাধাং নাশয়িষ্যাম্যসংশয়ম্‌।। ১

মধুকৈটভনাশঞ্চ মহিষাসুরঘাতনম্‌।

কীর্তয়িষ্যন্তি যে তদ্‌বদ্‌ বধং শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ।। ২

অষ্টম্যাঞ্চ চতুর্দশ্যাং নবম্যাঞ্চৈকচেতসঃ।

শ্রোষ্যন্তি চৈব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যমুত্তমম্‌।। ৩

ন তেষাং দুষ্কৃতং কিঞ্চিৎ দুষ্কৃতোত্থা ন চাপদঃ।

ভবিষ্যতি ন দারিদ্র্যং ন চৈবেষ্টবিয়োজনম্‌।। ৪

[দেবী উবাচ। এভিঃ স্তবৈঃ চ মাম্‌ নিত্যম্‌ স্তোষ্যতে যঃ সমাহিতঃ। তস্য অহম্‌ সকলাম্‌ বাধাম্‌ নাশয়িষ্যামি অসংশয়ম্‌।। ১

মধু-কৈটভ-নাশম্‌ চ মহিষাসুর-ঘাতনম্‌। কীর্তয়িষ্যন্তি যে তদ্‌বদ্‌ বধম্‌ শুম্ভ-নিশুম্ভয়োঃ।। ২

অষ্টম্যাম্‌ চ চতুর্দশ্যাম্‌ নবম্যাম্‌ চ এক-চেতসঃ। শ্রোষ্যন্তি চ এব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যম্‌ উত্তমম্‌।। ৩

ন তেষাম্‌ দুষ্কৃতম্‌ কিম্‌-চিৎ দুষ্কৃত-উত্থা ন চ আপদঃ। ভবিষ্যতি ন দারিদ্র্যম্‌ ন চ এব ইষ্ট-বিয়োজনম্‌।। ৪]

দেবী বললেন, নিবিষ্ট চিত্তে যে এই স্তবে আমার নিত্য স্তুতি করে, নিঃসন্দেহে তার সকল বিঘ্ন আমি নাশ করে থাকি। যারা একাগ্র চিত্তে অষ্টমী, নবমী ও চতুর্দশী তিথিতে, আমার মধু-কৈটভ বিনাশ ও মহিষাসুরবধ এবং একইভাবে শুম্ভ-নিশুম্ভবধের শ্রেষ্ঠকীর্তিগুলির মহিমা বর্ণনা করে অথবা শ্রবণ করে, সেই ভক্তদের কোন পাপ থাকে না, পাপজনিত কোন বিপদ-আপদও ঘটে না। তাদের দারিদ্র্য থাকে না, প্রিয়জন বিয়োগ ঘটে না। 

শত্রুতো ন ভয়ং তস্য দস্যুতো বা ন রাজতঃ।

ন শস্ত্রানলতোয়ৌঘাৎ কদাচিৎ সম্ভবিষ্যতি।। ৫

তস্মান্মমৈতন্মাহাত্ম্যং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।

শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্ত্যা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ।। ৬

উপসর্গানশেষাংস্তু মহামারীসমুদ্ভবান্‌।

তথা ত্রিবিধমুৎপাতং মাহাত্ম্যং শময়েন্মম।। ৭

[শত্রুতঃ ন ভয়ম্‌ তস্য দস্যুতঃ বা ন রাজতঃ। ন শস্ত্র–অনল-তোয়-ওঘাৎ কদাচিৎ সম্ভবিষ্যতি।। ৫

তস্মাৎ মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ পঠিতব্যম্‌ সমাহিতৈঃ। শ্রোতব্যম্‌ চ সদা ভক্ত্যা পরম্‌ স্বস্ত্যয়নম্‌ হি তৎ।। ৬

উপসর্গান্‌ অশেষান্‌ তু মহামারী-সমুদ্ভবান্‌। তথা ত্রিবিধম্‌ উৎপাতম্‌ মাহাত্ম্যম্‌ শময়েৎ মম।। ৭]

আমার মহিমা কীর্তনে শত্রু, দস্যু বা রাজার থেকে এবং অস্ত্রের আঘাত, অগ্নি বা জলস্রোত থেকে কখনও ভয়ের সম্ভাবনা থাকে না। সেই কারণে আমার এই মাহাত্ম্য–বর্ণনা সমাহিত চিত্তে ভক্তদের সর্বদা পাঠ করা এবং শোনা কর্তব্য, কারণ এটাই পরম মঙ্গলজনক। আমার এই মহিমা-কীর্তনে মহামারীজনিত অসংখ্য উপসর্গ এবং তিন ধরনের উৎপাতের উপশম হয়। [তিনধরনের উৎপাত হল আধ্যাত্মিক - শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি ও বিকার; আধিভৌতিক – হিংস্র পশু, সাপ, বিছের দংশন; আধিদৈবিক – ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।] 

যত্রৈতৎ পঠ্যতে সম্যঙ্‌ নিত্যমায়তনে মম।

সদা ন তদ্‌বিমোক্ষ্যামি সান্নিধ্যং তত্র মে স্থিতম্‌।। ৮

বলিপ্রদানে পূজায়ামগ্নিকার্যে মহোৎসবে।

সর্বং মমৈতচ্চরিতমুচ্চার্যং শ্রাব্যমেব চ ।। ৯

[যত্র এতৎ পঠ্যতে সম্যক্‌ নিত্যম্‌ আয়তনে মম। সদা ন তৎ বিমোক্ষ্যামি সান্নিধ্যম্‌ তত্র মে স্থিতম্‌।। ৮

বলি-প্রদানে পূজায়াম্‌ অগ্নি-কার্যে মহা-উৎসবে। সর্বম্‌ মম এতৎ চরিতম্‌ উচ্চার্যম্‌ শ্রাব্যম্‌ এব চ ।। ৯]

যে গৃহে আমার এই মাহাত্ম্য–কথা নিত্য সম্যক্‌ভাবে পঠিত হয়, সেই গৃহ আমি কখনো ত্যাগ করি না, বরং সর্বদা সেখানে অধিষ্ঠিতা হই। বলিদানে, পূজায়, যজ্ঞে কিংবা মহোৎসবে, সর্বত্রই আমার এই চরিত-কথা পাঠ এবং শ্রবণ করা উচিৎ। 

জানতাজানতা বাপি বলিপূজাং তথা কৃতাম্‌।

প্রতীচ্ছিষ্যাম্যহং প্রীত্যা বহ্নিহোমং তথা কৃতম্‌।। ১০

শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।

তস্যাং মমৈতন্মাহাত্ম্যং শ্রুত্বা ভক্তিসমন্বিতঃ।। ১১

সর্বাবাধাবিনির্মুক্তো ধনধান্যসুতান্বিতঃ।

মনুষ্যো মৎপ্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ।। ১২

[জানতা-অজানতা বা আপি বলিপূজাম্‌ তথা কৃতাম্‌। প্রতীচ্ছিষ্যামি অহম্‌ প্রীত্যা বহ্নি-হোমম্‌ তথা কৃতম্‌।। ১০

শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী। তস্যাম্‌ মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ শ্রুত্বা ভক্তি-সমন্বিতঃ।। ১১

সর্ব-আবাধা-বিনির্মুক্তঃ ধন-ধান্য-সুত-অন্বিতঃ। মনুষ্যঃ মৎ-প্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ।। ১২]

বিধি-নিয়ম জেনে বা না জেনেও যে বলিপূজা এবং হোমযজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়, তাও আমি প্রীতিপূর্বক গ্রহণ করি, যদি সেখানে আমার মাহাত্ম্য পাঠ করা হয়। প্রতি বৎসর শরৎকালে আমার যে মহাপূজা করা হয়, সেই অনুষ্ঠানে ভক্তি ভরে আমার এই মাহাত্ম্য–কথা শুনলে, আমার প্রসাদে মানুষ সকল বাধা-বিঘ্ন থেকে মুক্ত হয় এবং ধন-ধান্য ও পুত্রাদিতে সম্পন্ন হয়, এতে সন্দেহ নেই[শরতের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত নবরাত্রি পূজাই দেবীর মহাপূজা। বসন্তেও একই ভাবে নবরাত্রি পূজা করা হয়ে থাকে।]  

শ্রুত্বা মমৈতন্মাহাত্ম্যং তথা চোৎপত্তয়ঃ শুভা।

পরাক্রমঞ্চ যুদ্ধেষু জায়তে নির্ভয়ঃ পুমান্‌।। ১৩

রিপবঃ সংক্ষয়ং যান্তি কল্যাণঞ্চোপপদ্যতে।

নন্দতে চ কুলং পুংসাং মাহাত্ম্যং মম শৃণ্বতাম্‌।। ১৪

শান্তিকর্মণি সর্বত্র তথা দুঃস্বপ্নদর্শনে।

গ্রহপীড়াসু চোগ্রাসু মাহাত্ম্যং শৃণুয়াণ্মম।। ১৫

উপসর্গাঃ শমং যান্তি গ্রহপীড়াশ্চ দারুণাঃ।

দুঃস্বপ্নঞ্চ নৃভির্দৃষ্টং সুস্বপ্নমুপজায়তে।। ১৬

[শ্রুত্বা মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ তথা চ উৎপত্তয়ঃ শুভা। পরাক্রমম্‌ চ যুদ্ধেষু জায়তে নির্ভয়ঃ পুমান্‌।। ১৩

রিপবঃ সংক্ষয়ম্‌ যান্তি কল্যাণম্‌ চ উপপদ্যতে। নন্দতে চ কুলম্‌ পুংসাম্‌ মাহাত্ম্যম্‌ মম শৃণ্বতাম্‌।। ১৪

শান্তি-কর্মণি সর্বত্র তথা দুঃস্বপ্ন-দর্শনে। গ্রহপীড়াসু চ উগ্রাসু মাহাত্ম্যম্‌ শৃণুয়াৎ মম।। ১৫

উপসর্গাঃ শমম্‌ যান্তি গ্রহপীড়াঃ চ দারুণাঃ। দুঃস্বপ্নম্‌ চ নৃভিঃ দৃষ্টম্‌ সুস্বপ্নম্‌ উপজায়তে।। ১৬

আমার এই মাহাত্ম্য, আমার শুভ-আবির্ভাব এবং সকল যুদ্ধে আমার পরাক্রমের বর্ণনা শুনে মানুষ নির্ভয় হয়ে ওঠে। আমার মাহাত্ম্য শুনলে শত্রুবিনাশ হয়, মঙ্গললাভ হয়, মানুষের বংশ-পরিবার আনন্দিত হয়। যে কোন শান্তি-কর্মে কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখলে, কিংবা ভয়ংকর গ্রহবৈগুণ্যে আমার মাহাত্ম্যকথাই শুনবে। আমার মাহাত্ম্য-কথা শুনলে যাবতীয় উপসর্গ ও দারুণ গ্রহবৈগুণ্যের উপশম হয়, মানুষের দেখা দুঃস্বপ্নও সুখস্বপ্ন হয়ে ওঠে।   

বালগ্রহাভিভূতানাং বালানাং শান্তিকারকম্‌।

সংঘাতভেদে চ নৃণাং মৈত্রীকরণমুত্তমম্‌।। ১৭

দুর্বৃত্তানামশেষাণাং বলহানিকরং পরম্‌

রক্ষোভূতপিশাচানাং পঠনাদেব নাশনম্‌।। ১৮

সর্বং মমৈতন্মাহাত্ম্যং মম সন্নিধিকারকম্‌।

পশুপুষ্পার্ঘ্যধূপৈশ্চ গন্ধদীপৈস্তথোত্তমৈঃ।। ১৯

বিপ্রাণাং ভোজনৈর্হোমৈঃ প্রোক্ষণীয়ৈরহর্নিশম্‌।

অন্যৈশ্চ বিবিধৈর্ভোগৈঃ প্রদানৈর্বৎসরেণ যা।। ২০

প্রীতিমে ক্রিয়তে সাস্মিন্‌ সকৃৎ সুচরিতে শ্রুতে।

শ্রুতং হরতি পাপানি তথারোগ্যং প্রযচ্ছতি।। ২১

[বালগ্রহ অভিভূতানাম্‌ বালানাম্‌ শান্তিকারকম্‌। সংঘাতভেদে চ নৃণাম্‌ মৈত্রীকরণম্‌ উত্তমম্‌।। ১৭

দুর্বৃত্তানাম্‌ অশেষাণাম্‌ বলহানিকরম্‌ পরম্‌। রক্ষঃ ভূত-পিশাচানাম্‌ পঠনাৎ এব নাশনম্‌।। ১৮

সর্বম্‌ মম এতৎ মাহাত্ম্যম্‌ মম সন্নিধিকারকম্‌। পশু-পুষ্প-অর্ঘ্য-ধূপৈঃ চ গন্ধ-দীপৈঃ তথা উত্তমৈঃ।। ১৯

বিপ্রাণাম্‌ ভোজনৈঃ হোমৈঃ প্রোক্ষণীয়ৈঃ অহঃ-নিশম্‌। অন্যৈঃ চ বিবিধৈঃ ভোগৈঃ প্রদানৈঃ বৎসরেণ যা।। ২০

প্রীতিমে ক্রিয়তে সা অস্মিন্‌ সকৃৎ সুচরিতে শ্রুতে। শ্রুতম্‌ হরতি পাপানি তথারোগ্যম্‌ প্রযচ্ছতি।। ২১]

আমার মাহাত্ম্য–কথা পাঠ বালগ্রহে আক্রান্ত শিশুদের শান্তিকারক এবং মানুষের নানান সংঘাতে শুভ মৈত্রীবন্ধন স্থাপনা করে। [ডাকিনী বা রাক্ষসীরা শিশু বা বালকদের উদ্ব্যস্ত করলে তাকে বালগ্রহ বলে, যেমন শিশুকৃষ্ণকে পূতনা প্রভৃতি রাক্ষসী ছলনা করে বধ করতে গিয়েছিল।] এই পাঠে যে কোন দুর্বৃত্তের শক্তিক্ষয় হয়, রাক্ষস, ভূত, পিশাচদের বিনাশ হয়। আমার এই মাহাত্ম্য সম্পূর্ণ পাঠ করলে, সেই পাঠক আমার সান্নিধ্য লাভ করে। আমার সন্তুষ্টির জন্যে, সম্বৎসর পশুবলি, পুষ্প-অর্ঘ্য, ধূপ, চন্দনাদি গন্ধ বা দীপ জ্বালানো উত্তম পূজায়, কিংবা ব্রাহ্মণ-ভোজন করানো, অথবা দিবারাত্র নানান ভোগ-উপচারের যজ্ঞ-হোমে যত অনুষ্ঠান করা হয়, তার থেকে আমার এই সুচরিত-কথা একবার পাঠেই আমি বেশি সন্তুষ্ট হই। এই পাঠ শুনলেও আমি পাপ হরণ করি এবং আরোগ্য প্রদান করি।

রক্ষাং করোতি ভূতেভ্যো জন্মনাং কীর্তনং মম।

যুদ্ধেষু চরিতং যন্মে দুষ্টদৈত্যনিবর্হণম্‌

তস্মিন্‌ শ্রুতে বৈরিকৃতং ভয়ং পুংসাং ন জায়তে।২২

যুষ্মাভিঃ স্তুতয়ো যাশ্চ যাশ্চ ব্রহ্মর্ষিভিঃ কৃতাঃ।

ব্রহ্মণা চ কৃতাস্তান্তু প্রযচ্ছন্তি শুভাং মতিম্‌।। ২৩

[রক্ষাম্‌ করোতি ভূতেভ্যো জন্মনাম্‌ কীর্তনম্‌ মম। যুদ্ধেষু চরিতম্‌ যৎ মে দুষ্ট-দৈত্য-নিবর্হণম্‌।। তস্মিন্‌ শ্রুতে বৈরিকৃতম্‌ ভয়ম্‌ পুংসাম্‌ ন জায়তে।২২

যুষ্মাভিঃ স্তুতয়ঃ যাঃ চ যাঃ চ ব্রহ্ম-ঋষিভিঃ কৃতাঃ। ব্রহ্মণা চ কৃতাঃ তান্‌ তু প্রযচ্ছন্তি শুভাম্‌ মতিম্‌।। ২৩]

আমার নানান অবতার-জন্মের এবং যুদ্ধে দুরাত্মা দৈত্যবধের কথা কীর্তনে আমি ভূত-প্রেত থেকে সকলকে রক্ষা করি। সে কথা শুনলে মানুষের শত্রুভয় থাকে না। তোমরা, ব্রহ্মর্ষিরা এবং স্বয়ং ব্রহ্মা আমার যে যে স্তব করেছেন, তার থেকে শুভবুদ্ধির উদয় হয়।    

   অরণ্যে প্রান্তরে বাপি দাবাগ্নিপরিবারিতঃ।

দস্যুভির্বা বৃতঃ শূণ্যে গৃহীতো বাপি শত্রুভিঃ।। ২৪

সিংহব্যাঘ্রানুযাতো বা বনে বা বনহস্তিভিঃ।

রাজ্ঞা ক্রুদ্ধেন বাজ্ঞপ্তো বধ্যো বন্ধগতোঽপি বা। ২৫

আঘূর্ণিতো বা বাতেন স্থিতঃ পোতে মহার্ণবে।

পতৎসু বাপি শস্ত্রেষু সংগ্রামে ভৃশদারুণে।। ২৬

সর্বাবাধাসু ঘোরাসু বেদনাভ্যর্দিতোঽপি বা।

স্মরন্‌ মমৈতচ্চরিতং নরো মুচ্যেত সঙ্কটাৎ।। ২৭

মম প্রভাবাৎ সিংহাদ্যা দস্যবো বৈরিণস্তথা।

দূরাদেব পলায়ন্তে স্মরতশ্চরিতং মম।। ২৮

[অরণ্যে প্রান্তরে বা অপি দাব-অগ্নি-পরিবারিতঃ। দস্যুভিঃ বা বৃতঃ শূণ্যে গৃহীতঃ বা অপি শত্রুভিঃ।। ২৪

সিংহ-ব্যাঘ্র-অনুযাতঃ বা বনে বা বন-হস্তিভিঃ। রাজ্ঞা ক্রুদ্ধেন বা আজ্ঞপ্তঃ বধ্যঃ বন্ধ-গতঃ অপি বা। ২৫

আঘূর্ণিতঃ বা বাতেন স্থিতঃ পোতে মহার্ণবে। পতৎসু বা অপি শস্ত্রেষু সংগ্রামে ভৃশ-দারুণে।। ২৬

সর্ব-আবাধাসু ঘোরাসু বেদনা-অভ্যর্দিতঃ অপি বা। স্মরন্‌ মম এতৎ চরিতং নরঃ মুচ্যেত সঙ্কটাৎ।। ২৭

মম প্রভাবাৎ সিংহ-আদ্যা দস্যবঃ বৈরিণঃ তথা দূরাৎ এব পলায়ন্তে স্মরতঃ চরিতম্‌ মম।। ২৮]

অরণ্যে, প্রান্তরে অথবা দাবানলের মধ্যে, নির্জনে দস্যু বা শত্রুদের কবলে পড়লে, সিংহ, বাঘ বা বন্যহাতি ধাওয়া করলে, রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে বধ করার বা বন্দী করার আদেশ দিলে, ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে মহাসমুদ্রের মধ্যে জাহাজে, ভয়ংকর যুদ্ধে অস্ত্র আঘাতে উদ্যত হলে, এমনই সকল বিঘ্ন-বিপদে এবং ঘোর যন্ত্রণার পীড়ায়, আমার এই চরিতকথা স্মরণ করলে, মানুষ সকল সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়। আমার চরিত-কথা স্মরণ করলে, আমার প্রভাবে সিংহাদি পশু, দস্যুগণ এবং শত্রুরাও দূরে পালিয়ে যায়।

ঋষিরুবাচ।

ইত্যুক্ত্বা সা ভগবতী চণ্ডিকা চণ্ডবিক্রমা।

পশ্যতামেব দেবানাং তত্রৈবান্তরধীয়ত।। ২৯

তেঽপি দেবা নিরাতঙ্কাঃ স্বাধিকারান্‌ যথা পুরা।

যজ্ঞভাগভুজঃ সর্বে চক্রুর্বিনিহতারয়ঃ।। ৩০

দৈত্যাশ্চ দেব্যা নিহতে শুম্ভে দেবরিপৌ যুধি।

জগদ্‌বিধ্বংসিনি তস্মিন্মহোগ্রেঽতুলবিক্রমে।। ৩১

নিশুম্ভে চ মহাবীর্যে শেষাঃ পাতালমাযযুঃ।। ৩২

 

[ঋষিঃ উবাচ। ইতি উক্ত্বা সা ভগবতী চণ্ডিকা চণ্ড-বিক্রমা। পশ্যতাম্‌ এব দেবানাম্‌ তত্র এব অন্তঃ-অধীয়তঃ।। ২৯

তে অপি দেবা নিরাতঙ্কাঃ স্ব-অধিকারান্‌ যথা পুরা। যজ্ঞ-ভাগ-ভুজঃ সর্বে চক্রুঃ বিনিহত অরয়ঃ।। ৩০

দৈত্যাঃ চ দেব্যা নিহতে শুম্ভে দেব-রিপৌ যুধি। জগৎ-বিধ্বংসিনি তস্মিন্‌ মহা-উগ্রে-অতুল-বিক্রমে।। ৩১

নিশুম্ভে চ মহাবীর্যে শেষাঃ পাতালম্‌ আযযুঃ।৩২]       

ঋষি বললেন, এই কথা বলে ভগবতী প্রবল-পরাক্রমশালিনী চণ্ডিকা, সেখানে দেবতাদের চোখের সামনেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সকল শত্রু নিহত হওয়ায়, দেবতারাও আগের মতো নির্ভয়ে নিজ অধিকারে যজ্ঞভাগ ভোগে প্রতিষ্ঠিত হলেন। মহা-উদ্ধত, অতুলনীয়-পরাক্রমী, জগৎ-বিধ্বংসী, দেব-শত্রু শুম্ভ এবং মহাবীর নিশুম্ভ দেবীর হাতে যুদ্ধে নিহত হওয়ায়, অবশিষ্ট দৈত্যরা পাতালে প্রবেশ করল।

এবং ভগবতী দেবী সা নিত্যাপি পুনঃ পুনঃ।

সম্ভূয় কুরুতে ভূপ জগতঃ পরিপালনম্‌।। ৩৩

তয়ৈতন্মোহ্যতে বিশ্বং সৈব বিশ্বং প্রসূয়তে।

সাঽযাচিতা চ বিজ্ঞানং তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছতি।। ৩৪

[এবম্‌ ভগবতী দেবী সা নিত্য অপি পুনঃ পুনঃ। সম্ভূয় কুরুতে ভূপ জগতঃ পরিপালনম্‌।। ৩৩

তয়া এতৎ মোহ্যতে বিশ্বম্‌ সা এব বিশ্বম্‌ প্রসূয়তে। সা অযাচিতা চ বিজ্ঞানম্‌ তুষ্টা ঋদ্ধিম্‌ প্রযচ্ছতি।। ৩৪]

হে রাজা (সুরথ), এভাবেই সেই সনাতনী দেবী বার বার আবির্ভূতা হয়ে, জগৎ পরিপালন করেন। তাঁর প্রভাবে জগৎ মোহগ্রস্ত হয় আবার তিনিই এই বিশ্বকে প্রসব করেন। তাঁর নিষ্কাম আরাধনায় ব্রহ্মজ্ঞান এবং সকাম আরাধনায় সমৃদ্ধি লাভ হয়।

ব্যাপ্তং তয়ৈতৎ সকলং ব্রহ্মাণ্ডং মনুজেশ্বর।

মহাকাল্যা মহাকালে মহামারীস্বরূপে।। ৩৫

সৈব কালে মহামারী সৈব সৃষ্টির্ভবত্যজা।

স্থিতিং করোতি ভূতানাং সৈবকালে সনাতনী।। ৩৬

ভবকালে নৃণাং সৈব লক্ষ্মীর্বৃদ্ধিপ্রদা গৃহে।

সৈবাভাবে তথালক্ষ্মীর্বিনাশায়োপজায়তে।। ৩৭

স্তুতা সংপূজিতা পুষ্পৈর্ধূপগন্ধাদিভিস্তথা।

দদতি বিত্তং পুত্রাংশ্চ মতিং ধর্মে গতিং শুভাম্‌।। ৩৮

[ব্যাপ্তম্‌ তয়া এতৎ সকলম্‌ ব্রহ্মাণ্ডম্‌ মনুজ-ঈশ্বর। মহাকাল্যা মহাকালে মহামারী-স্বরূপে।। ৩৫

সা এব কালে মহামারী সা এব সৃষ্টিঃ ভবতি অজা। স্থিতিম্‌ করোতি ভূতানাম্‌ সা এব কালে সনাতনী।। ৩৬

ভবকালে নৃণাম্‌ সা এব লক্ষ্মীঃ-বৃদ্ধি-প্রদা গৃহে। সা এব অভাবে তথা অলক্ষ্মীঃ বিনাশায় উপজায়তে।। ৩৭

স্তুতা সংপূজিতা পুষ্পৈঃ ধূপ-গন্ধাদিভিঃ তথা। দদতি বিত্তম্‌ পুত্রাম্‌ চ মতিম্‌ ধর্মে গতিম্‌ শুভাম্‌।। ৩৮]

হে মানবেশ্বর, এই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে তিনিই মহাকালী মহাকালে মহামারীস্বরূপে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। তিনিই মহাপ্রলয়ে মহাসংহারকারিণী, নিজে জন্মরহিত হয়েও তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই সনাতনী কাল এবং তিনিই সকল জীবের পালনকর্ত্রী। বৈভবকালে তিনিই মানুষের গৃহে লক্ষ্মীরূপা সমৃদ্ধিদাত্রী, আবার অভাবকালে তিনিই অলক্ষ্মী হয়ে বিনাশ করেন। পুষ্প-ধূপ-চন্দনাদি গন্ধে তিনি সম্যক-পূজিতা হলে, তিনিই সম্পদ, পুত্রাদি, ধর্ম-বুদ্ধি এবং মঙ্গলগতি প্রদান করেন।

 

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে

ফলস্তুতির্নাম দ্বাদশোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

ফলস্তুতি-নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার দ্বাদশ অধ্যায় সমাপ্ত

    

 

উত্তরচরিত

ত্রয়োদশ অধ্যায়

ধ্যান

বালার্কমণ্ডলাভাসং চতুর্বাহুং ত্রিলোচনাম্‌।

পাশাঙ্কুশবরাভীতীর্ধার‍য়ন্তীং শিবাং ভজে।।

[বাল-অর্ক-মণ্ডল-আভাসম্‌ চতুঃ-বাহুম্‌ ত্রিলোচনাম্‌। পাশ-অঙ্কুশ-বর-অভীতীঃ-ধার‍য়ন্তীম্‌ শিবাম্‌ ভজে।।]

সদ্য উদিত সূর্যমণ্ডলের মতো আভাময়ী, চতুর্ভুজা, ত্রিলোচনা। পাশ-অঙ্কুশধারিণী এবং বরদা ও অভয়মুদ্রা ধারিণী মঙ্গলময়ী দেবী শিবার ভজনা করি।

 

উত্তর চরিত্র

দ্বাদশ অধ্যায় – দেবীর বরপ্রদান

ঋষিরুবাচ।

এতৎ তে কথিতং ভূপ দেবীমাহাত্ম্যমুত্তমম্‌।

এবং প্রভাবা সা দেবী যয়েদং ধার্যতে জগৎ।। ১

বিদ্যা তথৈব ক্রিয়তে ভগবদ্‌বিষ্ণুমায়য়া।

তয়া ত্বমেষ বৈশ্যশ্চ তথৈবান্যে বিবেকিনঃ।। ২

মোহ্যন্তে মোহিতাশ্চৈব মোহমেষ্যন্তি চাপরে।

তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম্‌।। ৩

আরাধিতা সৈব নৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা।। ৪

[ঋষিঃ উবাচ। এতৎ তে কথিতম্‌ ভূপ দেবী-মাহাত্ম্যম্‌ উত্তমম্‌। এবম্‌ প্রভাবা সা দেবী যয়া ইদম্‌ ধার্যতে জগৎ।। ১

বিদ্যা তথা এব ক্রিয়তে ভগবৎ-বিষ্ণু-মায়য়া। তয়া ত্বম্‌ এষ বৈশ্যঃ চ তথা এব অন্যে বিবেকিনঃ।। ২

মোহ্যন্তে মোহিতাঃ চ এব মোহম্‌ এষ্যন্তি চ অপরে। তাম্‌ উপৈহি মহারাজ শরণম্‌ পরমেশ্বরীম্‌।। ৩

আরাধিতা সা এব নৃণাম্‌  ভোগ-স্বর্গ-অপবর্গ-দা।। ৪ ]

ঋষি বললেন, হে রাজন্‌, এই আপনাকে দেবীর মঙ্গল-মাহাত্ম্য-কথা বর্ণনা করলাম। সেই দেবীর এমনই প্রভাব, তিনিই এই জগতকে ধারণ করে আছেন। ভগবান বিষ্ণুর মায়াশক্তির ক্রিয়ায় এই তত্ত্বজ্ঞান হয় যে, তিনিই আপনাকে, এই বৈশ্যকে এবং অন্যান্য বিবেকী মানুষদেরও মোহগ্রস্ত করেছেন। তিনি এইভাবেই আপনাদের মতো সকলকে, এমনকি অপর-মানুষদেরও মোহগ্রস্ত করে থাকেন এবং করবেন। হে মহারাজ, আপনি সেই পরমেশ্বরীর শরণাগত হোন, ভক্তিতে পূজিতা হলে, তিনিই মানুষকে ভোগ-স্বর্গ এবং মুক্তি দান করেন।

মাকর্ণ্ডেয় উবাচ।

ইতি তস্য বচঃ শ্রুত্বা সুরথঃ স নরাধিপঃ।

প্রণিপত্য মহাভাগং তমৃষিং সংশিতব্রতম্‌।। ৫

নির্বিণ্ণোঽতিমমত্বেন রাজ্যাপহরণেন চ।

জগাম সদ্যস্তপসে স চ বৈশ্য মহামুনে।। ৬

সন্দর্শনার্থম্বায়া নদীপুলিনসংস্থিতঃ।

স চ বৈশ্যস্তপস্তেপে দেবীসূক্তং পরং জপন্‌।। ৭

 [মাকর্ণ্ডেয় উবাচ। ইতি তস্য বচঃ শ্রুত্বা সুরথঃ স নর-অধিপঃ। প্রণিপত্য মহাভাগম্‌ তম্‌ ঋষিম্‌ সংশিত-ব্রতম্‌।। ৫

নির্বিণ্ণঃ অতি-মমত্বেন রাজ্য-অপহরণেন চ। জগাম সদ্যঃ তপসে স চ বৈশ্য মহামুনে।। ৬

সন্দর্শন-অর্থ-অম্বায়া নদী-পুলিন-সংস্থিতঃ। সঃ চ বৈশ্যঃ তপঃ তেপে দেবী-সূক্তম্‌ পরম্‌ জপন্‌।। ৭]

মার্কণ্ডেয় বললেন, তাঁর এই কথা শুনে নৃপ সুরথ, মহাজ্ঞানী সেই ঋষিকে প্রণাম করে, কঠোর তপস্যার ব্রত গ্রহণ করলেন। অত্যধিক মমত্ব এবং রাজ্য-অপহরণের জন্যে বিষণ্ণ সেই রাজা ও বৈশ্য মহামুনির থেকে বিদায় নিয়ে তখনই তপস্যা করতে চলে গেলেন। দেবী অম্বিকার দর্শন লাভের জন্য সেই রাজা ও বৈশ্য নদীতীরে অবস্থান করে পরম-দেবীসূক্ত জপ করতে করতে তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন।               

তৌ তস্মিন্‌ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্যা মূর্তিং মহীময়ীম্‌।। ৮

অর্হণাঞ্চক্রতুস্তস্যাঃ পুষ্পধূপাগ্নিতর্পণৈঃ।

নিরাহারৌ যতাহারৌ তন্মনস্কৌ সমাহিতৌ।। ৯

দদতুস্তৌ বলিঞ্চৈব নিজগাত্রাসৃগুক্ষিতম্‌।

এবং সমারাধয়তোস্ত্রিভির্বর্ষৈর্যতাত্মনোঃ।। ১০

পরিতুষ্টা জগদ্ধাত্রী প্রত্যক্ষং প্রাহ চণ্ডিকা।। ১১

[তৌ তস্মিন্‌ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্যা মূর্তিম্‌ মহীময়ীম্‌।। ৮

অর্হণাম্‌ চক্রতুঃ তস্যাঃ পুষ্প-ধূপ-অগ্নিঃ তর্পণৈঃ। নিঃ-আহারৌ যত-আহারৌ তৎ-মনস্কৌ সমাহিতৌ।। ৯

দদতুঃ তৌ বলিম্‌ চ এব নিজ-গাত্র-অসৃক্‌-উক্ষিতম্‌। এবম্‌ সম-আরাধয়তোঃ ত্রিভিঃ বর্ষৈঃ যত-আত্মনোঃ।। ১০

পরিতুষ্টা জগদ্ধাত্রী প্রত্যক্ষম্‌ প্রাহ চণ্ডিকা।। ১১]

তাঁরা সেই নদীতীরে দেবীর এক মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পুষ্প, ধূপ ও অগ্নিতে তাঁর পূজা এবং কখনও অনাহারে, কখনও সংযত-আহারে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ ধ্যানে তর্পণ করতে লাগলেন। তাঁরা নিজ অঙ্গের রক্তে ভিজিয়ে নানান বলিও নিবেদন করলেন। এইভাবে তিন বছর আত্ম সংযমে তাঁদের সম্যক আরাধনায় দেবী জগদ্ধাত্রী চণ্ডিকা পরিতুষ্টা হয়ে দেখা দিলেন এবং বললেন,

দেব্যুবাচ।

যৎ প্রার্থ্যতে ত্বয়া ভূপ ত্বয়া চ কুলনন্দন।

মত্তস্তৎ প্রাপ্যতাং সর্বং পরিতুষ্টা দদামি তৎ।। ১২

[দেবী ঊবাচ। যৎ প্রার্থ্যতে ত্বয়া ভূপ ত্বয়া চ কুলনন্দন। মত্তঃ তৎ প্রাপ্যতাম্‌ সর্বম্‌ পরিতুষ্টা দদামি তৎ।। ১২

দেবী বললেন, হে রাজা এবং হে বৈশ্যকুলনন্দন, তোমরা আমার থেকে যা যা প্রার্থনা করেছ, আমি সন্তুষ্ট হয়ে সবই প্রদান করব।

মার্কণ্ডেয় উবাচ।

ততো বব্রে নৃপো রাজ্যমবিভ্রংশ্যন্যজন্মানি।

অত্র চৈব নিজং রাজ্যং হতশত্রুবলং বলাৎ।। ১৩

সোঽপি বৈশ্যস্ততো জ্ঞানং বব্রে নির্বিণ্ণমানসঃ।

মমেত্যহমিতি প্রাজ্ঞঃ সঙ্গবিচ্যুতিকারকম্‌।। ১৪

[মার্কণ্ডেয় উবাচ। ততঃ বব্রে নৃপঃ রাজ্যম্‌ অবিভ্রংশি অন্যজন্মানি। অত্র চ এব নিজম্‌ রাজ্যম্‌ হত-শত্রু-বলম্‌ বলাৎ।। ১৩

সঃ অপি বৈশ্যঃ ততঃ জ্ঞানম্‌ বব্রে নির্বিণ্ণ-মানসঃ। মম ইতি অহম্‌ ইতি প্রাজ্ঞঃ সঙ্গ-বিচ্যুতি-কারকম্‌।। ১৪]

মার্কণ্ডেয় বললেন, তখন রাজা অন্য জন্মে চিরস্থায়ী রাজ্যের এবং এই জন্মে শত্রুবিনাশ করে নিজ রাজ্য অধিকারের বর প্রার্থনা করলেন। সেই বিষণ্ণ বৈশ্যও তখন ঈশ্বর-সঙ্গ বিচ্যুতির কারণ “আমার” ও “আমি” থেকে মুক্তির প্রজ্ঞা ও পরম জ্ঞানের বর প্রার্থনা করলেন।

দেব্যুবাচ।

স্বল্পৈরহোভির্নৃপতে স্বরাজ্যং প্রাপ্স্যতে ভবান্‌। ১৫

হত্বা রিপূনস্খলিতং তব তত্র ভবিষ্যতি।। ১৬

মৃতশ্চ ভূয়ঃ সংপ্রাপ্য জন্ম দেবাদ্‌ বিবস্বতঃ।

সাবর্ণিকো নাম মনুর্ভবান্‌ ভুবি ভবিষ্যতি।। ১৭

বৈশ্যবর্য ত্বয়া যশ্চ বরোঽস্মত্তোঽভিবাঞ্ছিতঃ।

তং প্রযচ্ছামি সংসিদ্ধ্যৈ তব জ্ঞানং ভবিষ্যতি।। ১৮

[দেবী উবাচ। স্বল্পৈঃ অহোভিঃ নৃপতে স্বরাজ্যম্‌ প্রাপ্স্যতে ভবান্‌। হত্বা রিপূন্‌ অস্খলিতম্‌ তব তত্র ভবিষ্যতি।। ১৫

মৃতঃ চ ভূয়ঃ সংপ্রাপ্য জন্ম দেবাৎ বিবস্বতঃ। সাবর্ণিকঃ নাম মনুঃ ভবান্‌ ভুবি ভবিষ্যতি।। ১৬

বৈশ্য-বর্য ত্বয়া যঃ চ বরঃ অস্মত্তঃ অভিবাঞ্ছিতঃ। তম্‌ প্রযচ্ছামি সংসিদ্ধ্যৈ তব জ্ঞানম্‌ ভবিষ্যতি।। ১৭]

দেবী বললেন, হে রাজা, কিছুদিনের মধ্যেই শত্রুদের হত্যা করে তুমি নিজের রাজ্য স্থায়ীভাবে ফিরে পাবেমৃত্যুর পর তুমি আবার সূর্যদেবের থেকে জন্ম লাভ করে পৃথিবীতে সাবর্ণিক নামে মনু হবে। হে বৈশ্যশ্রেষ্ঠ, তুমি আমার থেকে যে বর প্রার্থনা করেছিলে, তোমাকে আমি তাই দান করলাম, মুক্তি-সিদ্ধির জন্য তোমার পরমজ্ঞান লাভ হবে।

মার্কণ্ডেয় উবাচ।

ইতি দত্ত্বা তয়োর্দেবী যথাভিলষিতং বরম্‌।

বভূবান্তর্হিতা সদ্যো ভক্ত্যা তাভ্যামভিষ্টুতা।। ১৮

এবং দেব্যা বরং লব্ধ্বা সুরথঃ ক্ষত্রিয়র্ষভঃ।

সূর্যাজ্জন্ম সমাসাদ্য সাবর্ণির্ভবিতা মনুঃ।। ১৯

সাবর্ণির্ভবিতা মনুঃ ক্লীং ওঁ।। ২০

[মার্কণ্ডেয় উবাচ। ইতি দত্ত্বা তয়োঃ দেবী যথা অভিলষিতম্‌ বরম্‌। বভূব অন্তর্হিতা সদ্যঃ ভক্ত্যা তাভ্যাম্‌ অভিষ্টুতা।। ১৮

এবম্‌ দেব্যা বরম্‌ লব্ধ্বা সুরথঃ ক্ষত্রিয়-ঋষভঃ। সূর্যাৎ জন্ম সমাসাদ্য সাবর্ণিঃ ভবিতা মনুঃ।। ১৯

সাবর্ণিঃ ভবিতা মনুঃ ক্লীং ওঁ।। ২০]

মার্কণ্ডেয় বললেন, তাঁদের অভিলষিত বর দান করে, ভক্তি নিরত তাঁদের সামনে দেবী তখনই অন্তর্হিতা হলেন। এইভাবেই দেবীর বর লাভ করে ক্ষত্রিয়-শ্রেষ্ঠ রাজা সুরথ, সূর্য থেকে পুনর্জন্ম লাভ করে সাবর্ণি মনু হবেন। সাবর্ণি মনু হবেন, ক্লীং ওঁ। 

    ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে

সুরথবৈশ্যয়োর্বর প্রদানং নাম ত্রয়োদশোঽধ্যায়ঃ।

শ্রীসপ্তশতী-দেবীমাহাত্ম্যং সমাপ্তম্‌।

 

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত সাবর্ণি মনুর অধিকার কালে

সুরথ-বৈশ্যকে বর প্রদান নামক দেবীমাহাত্ম্য কথার ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত

সাতশত শ্লোকে দেবীমাহাত্ম্য-কথা সমাপ্ত। 



গ্রন্থঋণঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় এবং শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার, দেবসাহিত্য কুটির  

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

নটি বয়

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


ছোটবেলায় আমরা মধ্য কলকাতার কলেজস্ট্রিট পাড়ায় একটি ভাড়ার বাসায় থাকতাম সেখান থেকে আমার স্কুল, দাদার কলেজ ছিল পায়ে হাঁটা রাস্তায়। তখন আমাদের স্কুলজীবন শুরুই হতো ক্লাস ওয়ান থেকে। আর ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত আমাদের স্কুল বসত সকাল বেলায়। বাবার হাত ধরে রোজ সকালে সাদা জামা, সাদা হাফপ্যাণ্ট পড়ে আমরা স্কুলে যেতাম। হাতে থাকত বই খাতা ভরা স্টিলের বা অ্যালুমিনিয়মের বাক্স

আমাদের স্কুলবাড়িটা কলেজস্কোয়ার বা গোলদীঘির উত্তর পশ্চিমদিকে। কাজেই সকাল বেলা স্কুল যাওয়ার পথে আমরা কলেজ স্কোয়ারের ভেতর দিয়েই যেতাম। তাতে রাস্তাটা কম হত, আর মজাও লাগত খুব। গোলদীঘির জলে সাঁতারু ছেলেদের ঝপাং ঝপাং ঝাঁপ মারা দেখতাম। দীঘির চারদিকের রাস্তার ধারের বেঞ্চে বসে থাকতেন হাতে লাঠিওয়ালা অনেক বুড়ো মানুষ। অনেক মোটাসোটা মানুষ আবার দীঘির চারদিক ধরে দৌড়ত। পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের নিশ্বাসের হোঁসফোঁস আওয়াজ পেতাম । অনেকে আবার আমাদের ড্রিল ক্লাসের – এক, দুই তিন, চারের নিয়মে হাত নাড়তে নাড়তে হেঁটে যেত পাশ দিয়ে। আমি হাঁ করে এইসব দেখতাম, আর স্কুল যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে, বকা খেতাম বাবার কাছে।

পনেরই আগষ্টে স্কুলের ছাদে পতাকা তুলতেন আমাদের হেডমাস্টারমশাই। ওই একদিনই আমাদের স্কুলের ছাদে যাওয়ার অনুমতি মিলত। বাকি সারাবছর তালা দেওয়া থাকত ছাদের দরজায়। স্কুলের ছাদে উঠে আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, চারদিকে হাজার হাজার বাড়ির ছাদ। আর পশ্চিমদিকে বেশ খানিকটা দূরে হাওড়া ব্রিজ। ছাদের আলসেতে বুক দিয়ে নিচেয় দেখতাম, কলেজস্ট্রিট ধরে গড়িয়ে চলা, ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি। ছাদ থেকে দেখে মনে হত যেন, সব ঝুলনের খেলনা। আমাদের পাড়ায় খুব বড়োলোক পল্টুরা বাড়িতে ঝুলন সাজাতো। রঙিন কাঠের গুঁড়ো দিয়ে, আর কাঠের ছোট্ট ছোট্ট রেলগাড়ি, বাস, নৌকো, নানান রকম পুতুল দিয়ে। পল্টুদের বনেদি বিশাল যৌথ পরিবারটি ছিল বৈষ্ণব, কৃষ্ণঠাকুরের যে কোন পুজোতেই ওদের বাড়িতে খুব ধুমধাম হতো।

পনেরই আগষ্টের একটু আগে বা পরে, কলেজ স্কোয়ারে পুজোর মণ্ডপ বানানোর কাজ শুরু হয়ে যেত। খুব অবাক লাগত। গতকাল সকালে যাবার সময় দেখলাম, কিচ্ছু নেই। আজ সকালে স্কুল যাবার সময় দেখলাম, মণ্ডপ বাঁধার জায়গায় বাঁশের পাহাড়, আর মোটামোটা শালের গুঁড়ি। আমি হয়তো বাবাকে জিগ্যেস করলাম, ‘এত বাঁশ এনেছে কেন, গো’? বাবা বলতেন, ‘পুজোর মন্ডপ বানাতে হবে না? এই তো, আর মাস দেড়েক পরেই পুজো। আর সময় কোথায়’? তারপরের দিন স্কুলে যাবার সময় দেখতাম, শালের গুঁড়ির অনেকগুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। দু একদিন পরে দেখতাম শালের খুঁটির সঙ্গে বাঁশের কাজও শুরু হয়ে গেছে। আরো কয়েকদিন পর বাঁশের খাঁচা বানানো হয়ে যেত, আর মোটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা পড়ে যেত সেই মস্ত খাঁচা। ত্রিপলে ঢাকার পর শুরু হত আসল কাজ। নানান রংয়ের কাপড়ের কুঁচি বানানো। এই কুঁচি দেওয়া রঙিন কাপড়ে, ধীরে ধীরে অদ্ভূত সুন্দর হয়ে উঠতে থাকত সেই মণ্ডপ।  

কলেজ স্কোয়ারের মণ্ডপে যত রং ধরত, আমার স্কুলে যাবার ইচ্ছের রং তত ফিকে হয়ে আসতো। সারাবছর অনায়াসে হেঁটে যাওয়া স্কুলের রাস্তাটাকে মনে হতো কি কষ্টকর! মণ্ডপের সেজে ওঠা দেখতে দেখতে আমার দুটো  পা পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠতো! বাবা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতেন স্কুলের দিকে, বলতেন, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা, হাঁ করা ছেলে। এরপর স্কুলের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আর ঢুকতে দেবে না’।

আমাদের মাথায় তখন শুধু কি কলেজ স্কোয়ারের পুজো মণ্ডপ ঢুকে থাকত? ঢুকে থাকত পুজোর নতুন জামা প্যান্ট। ঢুকে থাকত সেই নতুন জামা প্যান্টের গন্ধ। স্কুল থেকে ফিরে, দুপুরে ভাত খেয়ে, মায়ের কাছে নতুন জামা প্যান্ট দেখানোর জন্য রোজ একবার বায়না করতাম। হাত বুলোতাম জামার গায়ে, গন্ধ নিতাম। দেখে হেসে ফেলতেন মা, বলতেন, ‘দ্যাখো, পাগল ছেলের কাণ্ড দ্যাখো, রোজ রোজ কী শুঁকিস কি’? জামার বুকে আর হাফ প্যান্টের পায়ের কাছে সুতো দিয়ে সেলাই করা থাকতো দোকানের লেবেল। লেবেলগুলোতে কি সুন্দর লেখা থাকত ‘কমলালয় স্টোর্স’।

একবার মনে আছে, পুজোয় অনেক বন্ধুদের নতুন জুতো কেনা হয়ে গেছে, আমার হয়নি। বাবা বলেছিলেন, আমার জুতোজোড়া নাকি বেশ ভালোই আছে, এবারে আর জুতো কেনার দরকার নেই। ভীষণ রাগ হয়েছিল বাবার ওপর, আর আমার খারাপ না হওয়া বিশ্বাসঘাতক জুতোর ওপর। পরদিন থেকে স্কুল চলার পথে, শুরু হল জুতোর ওপর অমানুষিক অত্যাচার। ফুটপাথে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। পাথরে, ইঁটের টুকরোয় অনেকবার ঠোক্কর খেলাম। কিন্তু জুতোর কিচ্ছু হল না। স্কুলে গিয়ে ডাবের খোলা দিয়ে ফুটবল খেলার বুদ্ধি দিল কয়েকজন বন্ধু। এই উপায়ে আমার অনেক বন্ধুই নাকি সফল হয়েছে। স্কুল শুরু হওয়ার আগে আর টিফিনের সময় চলতে লাগল আমাদের অনলস ফুটবলচর্চা।

ডাব নিয়ে ফুটবল চর্চার দিন তিনেকের মাথায়, আমার জুতো হাল ছেড়ে দিল। আমার ডান পায়ের বিদ্ধস্ত জুতোর তলা থেকে, মস্ত জিভের মতো, সোল খুলে গেল। আমার নিষ্ঠুর হাত থেকে তাও সে পরিত্রাণ পেল না। মায়ের হাত ধরে স্কুল থেকে ফেরার পথে, আমি পা ঘষে ঘষে, বিবর্ণ, বিকৃত করে দিলাম, আমার জুতোর সেই মস্ত জিভ। মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, “জুতোর এই দশা কী করে হলো? কী করিস কি স্কুলে গিয়ে”? আমি ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম, “আমি তো বলেইছিলাম, এ জুতো আর চলবে না। তোমরা বললে ভালোই আছে” থমথমে মুখে মা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। সেদিন আমার সারাটা দিন কাটল চাপা আতঙ্কে। মা এখন কিছু বললেন না ঠিকই, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা বাবা অফিস থেকে ফিরলে? কী হবে? দিন যত গড়িয়ে চলল সন্ধের দিকে, আমার বুকের ভেতর ঢিব ঢিব ততই বাড়তে লাগল।

 

বাবা ফিরলেন, জল খাবারের পর মা আমার জুতোর করুণ অবস্থার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। বাবা উঠে গিয়ে নিজের চোখে দেখলেন আমার জুতোর দশা। ঘরে ফিরে কিছু বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে একবার দেখলেনও না। মাকে বললেন, “কালকেই আমি ও জুতোর ব্যবস্থা করছি, দাঁড়াও না”

সেই জুতোজোড়া সঙ্গে নিয়ে পরদিন বাবা অফিসে গেলেন, দিন সাতেক পর আবার অফিস থেকে ফেরার সময়েই জুতোজোড়া ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। মেঝেয় ফেলে দিয়ে মাকে বললেন, “কেমন সারিয়েছে, দেখো। একদম নতুন করে দিয়েছে

মা অবাক হয়ে হাসি মুখে বললেন, সত্যি তো, বোঝাই যাচ্ছে না। যা হাল করে নিয়ে এসেছিল, একদম নতুন হয়ে গেছে

“বাটার দোকানে দিয়েছিলাম, ওরাই সারিয়ে দিয়েছে। ওরা বলল, ‘এ জুতো আরো অন্ততঃ দু বছর চলে যাবে। কিছু হলে নিয়ে আসবেন, আবার সারিয়ে দেব। এ জুতোর নাম নটি বয়, খুব টেকসই’”


আমি হিংস্র চোখে তাকিয়ে রইলাম সেরে ওঠা চকচকে মজবুত জুতোজোড়ার দিকে। আমার পাদুটোকে গ্রাস করার জন্যে ওদুটো হাঁ করে হা হা হাসছিল। ওরা যদি নটি বয় না হবে তো, কে হবে, আমি?

--00--


শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

ব্যাটেবলে কারসাজি (ভৌতিক গল্প)

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


 আমি নানু, নয়ন পোল্লে। বিশালাক্ষীতলার মৃন্ময়ীদেবী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের স্কুলের ক্রিকেট টিমে আমিই গত দুবছরের ক্যাপ্টেন। আমার আগে আমাদের স্কুলটিমের ক্যাপ্টেন হত ক্লাস টেন-ইলেভেনের দাদারা। আমি স্কুলটিমে জায়গা পেয়েছিলাম যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। এবং ভালো খেলার দৌলতে ক্লাস এইটেই আমাকে টিমের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করা হয়। আমার মতো এত কম বয়েসে ক্যাপ্টেন এর আগে কেউ কোনদিন হয়নি। অতএব, খেলাধুলোটা যে আমার ভালই আসে, সেটা আমার স্কুল অন্ততঃ মেনে নিয়েছে।  

আমাদের স্কুলের খেলাধুলোর ব্যাপারে এই এলাকায় বেশ সুনাম আছে। আমাদের এলাকার চোদ্দটি স্কুল নিয়ে প্রত্যেক বছর যে ক্রিকেট লিগ হয় – তার চ্যাম্পিয়ান’স ট্রোফিটা এবার নিয়ে পরপর পাঁচবার আমরাই জিতে নিলাম। অর্থাৎ আমি ক্যাপ্টেন হবার আগেই আমাদের স্কুল পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল – আমি সেই ধারাটাকেই ধরে রেখেছি মাত্র।

কিন্তু এবারে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এবং আমিই এই লিগের বেস্ট ব্যাটার হওয়া সত্ত্বেও আমার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছে। এই ফাইন্যাল ম্যাচটা আমরা সত্যিই কি ভালো খেলে জিতলাম? নাকি কোন কারসাজিতে? ব্যাপারটা এতই গোপনীয়, বন্ধুদের সঙ্গেও আলোচনা করা সম্ভব নয়। এই রহস্যটা জানি আমরা মাত্র তিনজন – আমাদের স্কুলের গেম টিচার পার্বতীস্যার, বাংলা ও সংস্কৃতর মাস্টারমশাই - নিত্যানন্দস্যার আর ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি। অন্যান্য বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে যে অদ্ভূত আনন্দ পাই – এবার অন্ততঃ আমি সেই আনন্দ অনুভব করতে পারলাম না। যদিও আমাদের টিমের অন্য সবাই – যারা ভেতরের খবর জানে না – তারা প্রতিবারের মতোই আনন্দে মেতে উঠেছে।

আমার খটকার বিষয়টি তাহলে শুরুর থেকেই বলি।

     ফাইন্যালে এবার যে টিমের সঙ্গে আমরা খেললাম, সেটি হল ক্ষেমঙ্করী দেবী শিক্ষায়তনের টিম। তাদের গত দশ বছরে লিগ টেবিলে অবস্থান ছিল পাঁচ থেকে সাত নম্বরের মধ্যে। অর্থাৎ ক্রিকেট টিম হিসেবে ওরা বরাবরই মাঝারি মাপের। সেই টিম এবারে যখন তড়তড়িয়ে একেবারে ফাইন্যালে উঠে এল তাতে আমরা সকলেই অবাক হয়ে গেছিলাম। এমনও নয় যে ওদের টিমে নতুন ভালো ভালো প্লেয়ার এসেছে। বা নতুন কোন গেম টিচার এসেছেন। এবং খুব ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওদের সব প্লেয়ারই ক্ষেমঙ্করী শিক্ষায়তনেই পড়ে। আমাদের এই লিগে বাইরের কোন খেলোয়াড়কে ভাড়া করে এনে ‘খেপ’ খেলানো যায় না, সেটা বেআইনি। সেরকম কিছু করে ধরা পড়লে পাঁচ বছরের জন্য সেই স্কুলকে সাসপেণ্ড করে দেওয়ার নিয়মও আছে। তাছাড়া ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পাঠরত ছাত্রদের মধ্যে থেকে – পনেরজন ক্রিকেট খেলুড়ে ছাত্র যদি না পাওয়া যায় – তাহলে লিগ থেকে সেই স্কুলের নাম তুলে নেওয়াই ভাল।

সে যাই হোক, ওদের খেলার খটকাটা প্রথম চোখে পড়ল লিগের চার নম্বর খেলায়। আমাদের সঙ্গে ক্ষেমঙ্করী টিমের প্রথম খেলাতে। ওই খেলায় টসে জিতে আমরা ফিল্ডিং নিয়েছিলাম, ওদের পাঠিয়েছিলাম প্রথমে ব্যাট করতে। পাওয়ার প্লে রাউণ্ডে ওদের যখন পনের রানে তিন উইকেট পড়ে গেল, তখনই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, ক্ষেমঙ্করীর টিম আমাদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তার পরেই খেলাটা আশ্চর্যভাবে ঘুরে গেল। আমাদের টিমে যেন মিসফিল্ডের মহামারি লেগে গেল। ওদের ব্যাটাররা ফ্রন্টফুটে বা ব্যাকফুটে ডিফেন্সিভ খেলেও পরের পর বাউণ্ডারি পেয়ে যেতে লাগল। ব্যাপারটা আরেকটু খোলসা করে বলি। ধরা যাক আমি সিলি মিডঅফে ফিল্ডিং করছি, ব্যাটারের ডিফেন্স করা গড়ানে বল, আমার দিকে আসছে – সে বল হঠাৎ দিক বদল করে বিদ্যুৎগতিতে সীমানার বাইরে চলে গেল লং অফ দিয়ে! অথবা ব্যাটের কানায় লেগে লোপ্পা ক্যাচ হয়ে বলটা নেমে আসছে থার্ডম্যান ফিল্ডারের হাতে – কিন্তু না বলটা নিচেয় নামল না, উল্টে বলটা মাঝ আকাশে বাউন্স করে ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল বাউণ্ডারির বাইরে – ছক্কা! এরকম উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি।  

ওদের ইনিংস শেষে ওদের স্কোর হল আট উইকেটে পঁচানব্বই। খেলা শেষে হিসেব কষে দেখেছিলাম, আমাদের আজেবাজে ফিল্ডিংয়ের জন্যে মোটামুটি তিরিশ-পঁয়ত্রিশ রান ওদের আমরা উপহার দিয়েছিলাম। তা না হলে আমরা ওদের পঁয়ষট্টি – সত্তর রানেই বাণ্ডিল করে দিতে পারতাম। একথা ঠিক আমাদের মধ্যে কেউই ঝন্টি রোড্‌স্‌ বা রবীন্দ্র জাদেজার মতো ফিল্ডার নই – কিন্তু ওরকম বাজে ফিল্ডিংও আমরা কোনদিন করিনি। তা না হলে আমরা আগের লিগগুলিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম কী করে?

এরপর আমরা ছিয়ানব্বই রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নামলাম। ওপেনিং জুটিতে ছিলাম আমি আর পলাশ। প্রথম ওভারের তিনটে বল, আমরা দুজনেই সিঙ্গল রান নিয়ে, একটু দেখেশুনে খেললাম। তারপর ব্যাট চালাতে শুরু করলাম। পলু ওই ওভারের শেষ তিন বলে দুটো চার আর একটা ছক্কা হাঁকাল। তিনটে শটই অনবদ্য – উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। পরের দু ওভারেও আমরা ভালই রান তুললাম – প্রথম তিন ওভারে আমাদের রান গিয়ে দাঁড়াল কোন উইকেট না হারিয়ে বত্রিশ। আর তারপরেই শুরু হল অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার।  আমার এবং পলাশের একটা বলও আর বাউণ্ডারির ধারে কাছে পৌঁছতে পারল না।

কয়েকটা উদাহরণ দিই। চতুর্থ ওভারের প্রথম বলটা এল অফস্টাম্পের ওপর হাঁটুর লেভেলে ফুলটস, আমি নিখুঁত টাইমিংয়ে বলটা লফট করলাম – নিশ্চিত ছক্কা। এতটাই নিশ্চিত ছিলাম, আমি বা পলাশ কেউ রান নেওয়ার জন্যে দৌড়লাম না। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম – লং অফ বাউণ্ডারির দশ পনের ফুট ভেতরে বলটা সোজা নেমে এল। মনে হল মাঝ-শূণ্যে অদৃশ্য কোন দেওয়াল রয়েছে – সেই দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বলটা – গাছ থেকে পাকা আম পড়ার মতো - টুপ করে মাটিতে নেমে পড়ল। ছ রান তো দূরের কথা – দৌড়ইনি বলে একটা রানও পেলাম না। এরপরে আমাদের একটা বলও বাউণ্ডারি ছুঁতে পারল না। পলাশ এবং আমি যে পাশ দিয়েই মারি - সে মিডঅফ, মিডঅন, এক্সট্রা কভার, স্কোয়্যার লেগ – ব্যাট থেকে বিদ্যুৎ গতিতে বল বাউণ্ডারির দিকে ছুটছে – কিন্তু মাঠের মাঝখানে ধপ করে থেমে যাচ্ছে প্রত্যেকবার। ওখানে বলগুলো যেন কেউ খপ করে ধরে ফেলছে – যে ধরছে তাকে অবিশ্যি দেখা যাচ্ছে না।

এভাবেই লিগের ওই ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছিলাম, কুড়ি ওভারে আমাদের স্কোর হয়েছিল বিনা উইকেটে চুয়াত্তর। ব্যাটার হিসেবে পলু এবং আমার এই অঞ্চলে যে সুনাম ছিল, সে নাম একদম ধুলোয় মিশে গেল। ক্ষেমঙ্করীর টিম খেলা শেষে জয়ের আনন্দে যখন নাচানাচি করছে, আমাদের দুজনের তখন মুখ লুকোবার জায়গা কোথায়? মুখ কালো করে আমরা দুজন যখন আমাদের তাঁবুতে ফিরলাম, পার্বতীস্যার আমাদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, “ভাবিস না, একেই বলে ইন্দ্রপতন”। আগেই বলেছি, পার্বতীস্যার আমাদের গেম টিচার। আমাদের দুজনের চোখেই তখন জল। পলাশ বলল, “এমন কেন হল, স্যার? আমি না হয় পারিনি, নানুও কেন পারল না? এর থেকে, স্যার, আমরা যদি অল আউট হয়ে হেরে ফিরতাম, তাতেও সান্ত্বনা থাকত – খেলায় হারজিৎ তো আছেই! কিন্তু নানু এবং আমি দুজনেই পুরো কুড়ি ওভার খেলেও এই রান তুলতে পারলাম না?”

আমাদের অঙ্কের কুনালস্যার এবং নিত্যানন্দস্যার মাঠে এসেছিলেন খেলা দেখতে, বললেন, “তোরা দুজনেই আমাদের টিমের জুয়েল ব্যাটার – এভাবে ভেঙে পড়িস না। কালকে আমাদের কোন খেলা নেই। আজকের খেলা নিয়ে আগামীকাল টিফিনের পর আমাদের একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। নানু সেই মিটিংয়ে তুই থাকবি। এই খেলাটা মনে রাখিস স্বাভাবিক খেলা নয় – এই খেলার স্ট্র্যাটেজি অন্য রকম হবে”। 

 পরের দিন প্রথম দুটো ক্লাস শেষ হতেই আমার ডাক পড়ল হেডস্যারের ঘরে। মিটিংয়ের কথা শুনে গতকাল থেকেই আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এই মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে? এই স্কুলটিমের ক্যাপ্টেন হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই? আমাকে কি সরিয়ে দেওয়া হবে? নাকি আমাকে দু-তিনটে ম্যাচে বসিয়ে দেওয়া হবে? বলা হবে “নয়ন তোমার ওপর বেজায় চাপ যাচ্ছে, তুমি কয়েকটা ম্যাচ বিশ্রাম নাও”!

একতলায় হেডস্যারের ঘরের দরজা বন্ধ, দরজার বাইরে টুলে বসে ছিল প্রভাকরদা। প্রভাকরদা আমায় দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যারেরা সবাই চলে এসেছেন, তোমার জন্যেই সকলে অপেক্ষা করছেন। যাও, ভেতরে যাও। কালকের খেলাটা ভুলে যাও, নানু। অমন দু একদিন হয়। দেখবে পরের খেলায় আবার তুমি সবাইকে চমকে দেবে”। আমি মৃদু হাসলাম, মনে মনে ভাবলাম, পরের খেলায় সুযোগ যদি পাই তবেই না...। দরজা খুলে আমি ভেতরে ঢুকলাম, প্রভাকরদা আমার পিছনে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।

ঘরে ঢুকে দেখি, হেডস্যার নিজের চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে – পার্বতীস্যার, নিত্যানন্দস্যার, বিজ্ঞানের প্রদীপ্তস্যার, অঙ্কের কুনালস্যার, ভূগোলের প্রশান্তস্যার আর ইতিহাসের সন্দীপস্যার। আমি ঢুকতেই হেডস্যার বললেন, “এস নয়ন, এস, আমার সামনের এই চেয়ারটায় বস”। আমি ভীষণ সংকোচে আর ভয়ে ভয়ে স্যারেদের চেয়ার পার হয়ে, হেডস্যারের সামনের খালি চেয়ারটাতেই বসলাম। আমি বসতেই হেডস্যার বললেন, “কালকের খেলা দেখতে আমি মাঠে যেতে পারিনি। কিন্তু আপনাদের মুখে যা শুনলাম, তাতে আমি স্তম্ভিত। আমাদের নয়ন আর পলাশ নাকি একের পর এক ছক্কা মেরেছে, কিন্তু সেগুলি মাঠের ভেতরেই টুপ-টাপ করে ঝরে পড়েছে। ওরা অনেকবার বাউণ্ডারি মারারও চেষ্টা করেছে – কিন্তু সেগুলিও বাউণ্ডারির একটু আগেই থমকে গেছে। এসব কীভাবে সম্ভব? কুনালবাবু, সুদীপ্তবাবু আপনারা দুজনেই বিজ্ঞানের মানুষ – এর কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন?”

সুদীপ্তস্যার কুনালস্যারকে বললেন, “আপনি কাল খেলা দেখেছেন, আপনিই ভাল বোঝাতে পারবেন কুনালদা”।

কুনালস্যার তিন রঙের মার্কার পেন আর ডাস্টার নিয়ে চেয়ার ছেড়ে ঘরের কোণে রাখা হোয়াইট-বোর্ডের সামনে গেলেন। তারপর ইংরিজিতে খসখসিয়ে লিখলেন, Projectiles। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “নয়নরা যে ছক্কাগুলো মারে, মানে বলগুলোকে পিটিয়ে যেভাবে বাউণ্ডারির বাইরে ফেলে – সেই টেকনিকটাকে অংকের ভাষায় বলে প্রজেক্টাইলস”। এই বলে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বোর্ডে স্কেচ করতে শুরু করলেন, “এই হচ্ছে নয়ন – আর এই হচ্ছে বাউণ্ডারি। নয়নের ব্যাটের বাড়ি খেয়ে বলগুলো এই পথ ধরে বাউণ্ডারির বাইরে পড়ে। বলের এই উড়ে যাওয়ার পথটাকেই প্রজেক্টাইলস বলে। ব্যাটেবলে ঠিকঠাক কানেক্ট না হলে বাউণ্ডারির বাইরে না গিয়ে বল ভেতরেই পড়বে – এবং ফিল্ডার থাকলে সে ক্যাচ করে নেবে। কিন্তু সে বলও প্রজেক্টাইলস হয়েই পড়বে – অন্যভাবে নয়। কিন্তু গতকাল ওদের ছক্কার বলগুলো - এই যে এই লাল লাইনটা দেখুন, এভাবে আচমকা নীচেয় নেমে এসেছে। আমার অঙ্কের জ্ঞানে এ অসম্ভব। সুদীপ্তবাবু, আপনার ফিজিক্সে কী বলে?”

Projectiles 





                                    কুনাল স্যারের ডায়াগ্রাম 
   
  সুদীপ্তস্যার কিছু বলার আগেই, সন্দীপস্যার বললেন, “ইতিহাসও এই কথাই বলে কুনালবাবু। মহাবীর অর্জুন বা শ্রীরামচন্দ্র তির ছুঁড়ে যে দূরের লক্ষ্য ভেদ করতেন, তাঁদেরকেও এই অংকের হিসেব মানতে হত। কিন্তু সেকালের তিরন্দাজ বা একালের নয়নরা অংকের নিয়ম না জানলেও, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার বলেই এমন লক্ষ্যভেদ করতে পারেন”।

ফিজিক্সের সুদীপ্তস্যারও বললেন, “এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম কুনালবাবু। ক্রিকেটের বল, তির, জ্যাভেলিন বা শর্টপাট – সব কিছুতেই এই নিয়মই একমাত্র নিয়ম। অবশ্যই এই দক্ষতার সঙ্গে শক্তি থাকাটাও জরুরি। নয়নের ব্যাট কতটা শক্তি দিয়ে বলটা মারবে তার ওপরেও নির্ভর করবে বলটা কোথায় গিয়ে নামবে। কিন্তু লালরঙের যে পথটা আপনি আঁকলেন, সেভাবে কোন বস্তু নেমে আসতে পারে না – একমাত্র ব্যাডমিন্টনের শাটল-কক ছাড়া”।

হেডস্যার বললেন, “তাহলে, এই ঘটনার ব্যাখ্যা কি? আপনারাই বলছেন, গতকাল এমন ঘটনা একবার নয় বহুবার ঘটেছে – নয়ন এবং পলাশ দুজনের ক্ষেত্রেই!”

কুনালস্যার বোর্ডের সামনে থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন, মাথা নেড়ে বললেন, “আমার জানা নেই, স্যার”।

“সুদীপ্তবাবু?” হেডস্যার জিজ্ঞাসা করলেন।

“না স্যার। আমারও একই অবস্থা – কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছি না”। সুদীপ্তস্যার উত্তর দিলেন।

“তাহলে? পার্বতীবাবু, উপায় কি? আমাদের টিমকে নতুন কিছু প্র্যাক্টিস করাবেন নাকি? এভাবে হারতে থাকলে, আমাদের স্কুলের সম্মান কোথায় দাঁড়াবে?”

পার্বতীস্যার আমতা আমতা করে বললেন, “কী বলি বলুন তো স্যার? আমার ছেলেরা এর আগে তিনটে খেলায় দারুণ খেলে জিতল। আমি নিশ্চিত এর পরের খেলাতেও ওরা নিজেদের সুনাম অনুযায়ীই খেলবে। কিন্তু গতকাল... কী যে হচ্ছিল... কিছুই বুঝলাম না...”।

ঘরের মধ্যে সবাই চুপ করে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। সকলেই চিন্তিত, কোন সুরাহা মিলছে না। এমন সময়  নিত্যানন্দস্যার বললেন, “আমাকে যদি দুদিন ছুটি মঞ্জুর করেন স্যার, তাহলে আমি একটা উপায় দেখতে পারি”।

হেডস্যার অবাক হয়ে বললেন, “আপনি? কী উপায় দেখবেন? আপনি সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন কি?”

“বুঝেছি বৈ কি, স্যার, বিলক্ষণ বুঝেছি। ব্যাপারটা অলৌকিক। সমস্যাটা বিজ্ঞান দিয়ে কিংবা সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ সবই অশরীরীদের কারসাজি”। নিত্যানন্দ স্যার সংস্কৃতের পণ্ডিত, তবে এখন আর আমাদের স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হয় না বলে, আমাদের বাংলা পড়ান।

“তার মানে?” সব স্যারই একসঙ্গে চমকে উঠে বললেন। আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমরা গতকাল একদল ভূতের বিরুদ্ধে খেলেছি – কী সর্বনাশ!

নিত্যানন্দস্যারের কথায় অন্য স্যাররা হেসে ফেললেন, এমনকি হেডস্যারও। তারপর বললেন, “আর বিশ-তিরিশ বছরের মধ্যে আসানসোল-কলকাতার মতো, চাঁদ বা মঙ্গল থেকে মানুষ পৃথিবীতে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করার কথা ভাবছে, আর আপনি ক্রিকেট মাঠে ভূতের উপদ্রব দেখতে পাচ্ছেন?”

নিত্যানন্দস্যারও হাসলেন, “আলবাৎ স্যার। আপনারা বিশ্বাস না করতে পারেন। কিন্তু ওরা আছে। আমি বলি কি স্যার, কুনালবাবু, সুদীপ্তবাবু এই সমস্যা সমাধানের যখন কোন উপায় ভেবে বের করতে পারছেন না, তখন আমাকে একটা সুযোগ দিতে দোষ কি? গতকাল ওদের এবং আমাদের – দু পক্ষের ছেলেদের খেলাই আমি মন দিয়ে দেখেছি। নয়নদের অনেক ছক্কা এবং চৌকা যেমন অদ্ভূতভাবে পণ্ড হয়েছে, ওদের ছেলেদের অনেক বল যেগুলো চার-রান হবার নয়, সেগুলো চার হয়েছে। মাঠের ধারে যে বলগুলো আমাদের ছেলেরা অনায়াসে ক্যাচ করতে পারত, সেগুলো আশ্চর্যভাবে ছক্কা হয়েছে। নিজের চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। কি পার্বতীবাবু? কি রে নয়ন?” নিত্যানন্দবাবু আমাদের সাক্ষী মানলেন।

পার্বতীস্যার এবং আমি নিত্যানন্দবাবুকে সমর্থন করে বললাম, “হ্যাঁ স্যার, তাজ্জব হয়ে গেছি। ক্রিকেট বলের এমন আচরণ কোনদিন দেখিনি”!

কেউ কোন কথা বললেন না। হেডস্যারও কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ঠিক আছে। অন্য কোন রাস্তা যখন পাওয়া যাচ্ছে না, নিত্যানন্দবাবু আপনার কথা আমরা সকলে মেনে নিলাম। কিন্তু ক্ষেমঙ্করী স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের আর কোন খেলার সম্ভাবনা নেই, তাই না, পার্বতীবাবু?”

পার্বতীস্যার কিছু বলার আগেই নিত্যানন্দ স্যার বললেন, “আছে বৈকি, স্যার, ফাইন্যালে আবার দেখা হবে”।

পার্বতীস্যার খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ক্ষেমঙ্করীর দল ফাইন্যাল অব্দি উঠবে?”

নিত্যানন্দস্যার বললেন, “উঠবে পার্বতীবাবু। আমার ধারণা ক্ষেমঙ্করীর দল এই কারসাজি করেই ফাইন্যালে উঠবে। এবং শুধু উঠবে না – অন্য কোন টিমের কাছে না হেরে – আনডিফিটেড উঠবে। আমাদের দলও ফাইন্যালে উঠবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিরে নয়ন, পারবি না?” নিত্যানন্দস্যারের কথায় আমি খুব একটা জোর অনুভব করলাম, আমার মনে, সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “উঠবই স্যার”।

নিত্যানন্দবাবু আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ভেরি গুড। এই তো চাই। সত্যি বলতে, আমি নয়নদের অন্য খেলাগুলির জন্য চিন্তাই করছি না, ওগুলো ওরা নিজেরাই জিতে নিতে পারবে। কিন্তু ক্ষেমঙ্করীদের সঙ্গে খেলাটা একটু মুশকিল – ওটা জিততে হলে বাইরে থেকে আমাদেরও একটু খেলতে হবে...”।

স্যারেরা সকলেই নিত্যানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। হেডস্যারও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “বেশ আপনি দু দিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসুন, আর কী কী বন্দোবস্ত করবেন, সে সব সেরে ফেলুন। কিন্তু নয়ন, আমি কিন্তু এবারও আমাদের স্কুলকে চ্যাম্পিয়ন দেখতে চাই”।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে গভীর বিশ্বাসে বললাম, “ওই কাপ আমরাই আবার আনব, স্যার”।

“গুড। যাও, এখন ক্লাসে যাও”।  

 নিত্যানন্দস্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। গতবারের রানার্স মহারাজ ভূপতি চাটুজ্জে স্মৃতি বিদ্যামন্দিরের টিম সহ সকল টিমকে হারিয়ে ক্ষেমঙ্করীর টিম ফাইন্যালে উঠে গেল – এক পয়েন্টও না খুইয়ে! উল্টোদিকে আমরা ওদের টিম ছাড়া সব খেলাতেই জিতে লিগের পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় টিম হলাম। এলাকার সকলেই, এবং অন্য স্কুলের ছেলেরাও ধরে নিয়েছিল ক্ষেমঙ্করীই এবার চ্যাম্পিয়ন হবে। আমাদের দলের এবারে আর কোন আশাই নেই। মুখে স্বীকার না করলেও, মনে মনে সে আশঙ্কা আমাদেরও ছিল। নিত্যানন্দস্যার দুদিন বাইরে থেকে কোথায় কী করে এলেন – তাঁর ওপর কতটা ভরসা করা যায় কে জানে?

যাই হোক গতকাল ফাইন্যাল হল। একদম স্বাভাবিক খেলা। কোন অলৌকিক কারসাজির চিহ্নমাত্র ছিল না। আমরা টসে হেরেছিলাম, ক্ষেমঙ্করী আমাদের ব্যাটিং করতে পাঠাল। বিশ ওভারে আমরা স্কোর করলাম, তিন উইকেটে দুশো পঁয়তাল্লিশ। পলাশের রান বাইশ বলে চুয়ান্ন, আর আমি পঞ্চান্ন বলে একশ আট, পান্না বিয়াল্লিশ, তিমির সাতাশ, রমেশ ছয়, আর এক্সট্রা আট। ক্ষেমঙ্করীর টিম বিশ ওভার খেলে আট উইকেটে একশ সাতান্ন করেই থমকে গেল। অতএব এবারেও লিগের ট্রফি আমাদের স্কুলেই হেডস্যারের ঘরে এসে জমা হল। এই নিয়ে বারবার পাঁচবার।

নিত্যানন্দস্যার কী করে ক্ষেমঙ্করী টিমের কারসাজি বন্ধ করলেন, সে কথা উনি কাউকেই বলেননি। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, “সব কথা তো তোকে বলা যাবে না। বললে বিশ্বাসও করবি না। খুব ছোট্ট করে বলি, ওরা কোন একজন তান্ত্রিক সাধুকে ভাড়া করেছিল। এসব তাঁরই কুকীর্তি। তিনিই যোগ-বলে বেশ কয়েকজন ভূতকে সেদিন মাঠে নামিয়েছিলেন, তোদের বিরুদ্ধে। ভূতের টেকনিক্যাল নাম হচ্ছে অশরীরী আত্মা, জানিস তো? তান্ত্রিক সাধুরা তাঁদের চেলাদের ভূত-প্রেত, পেত্নী-শাঁকচুন্নি বলেন না, কাউকে বলতে শুনলে বেজায় রেগেও যান।

সে যাগ্‌গে, আমি তো ওই অশরীরীদের কাউকেই চোখে দেখতে পাইনি। কিন্তু তাও ব্যাপারটা বুঝতে আমি ভুল করিনি। তাই হেডস্যারের অনুমতি নিয়ে আমি গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে আমার এক কাকা আছেন, তিনি বিখ্যাত সাধক, সিদ্ধ যোগী। তাঁকে গিয়ে সব কথা খুলে বলতে খুব রেগে গেলেন। ওই তান্ত্রিক সাধুর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন, “ছেলেপুলেদের খেলার মধ্যে তোমরা অশরীরীদেরও মাঠে নামাচ্ছ? ছিছিছি ছিঃ। আমি কিন্তু এসব হতে দেব না”, বলেই উনি ফোন রেখে দিলেন।

তারপর আমাকে বললেন, “তুই ফিরে যা, একদম ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ তোদের ছেলেদের খেলায় আর কোন বিঘ্ন ঘটাবে না”। একটু চুপ করে থেকে নিত্যানন্দস্যার বললেন, “ওসব খুব গোপন আর ভজকট ব্যাপার, নানু। আমিও কী আর সবটা বুঝি? সব কথা তোর না শোনাই ভালো”। তারপর আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “তোর কাজ মন দিয়ে খেলা, তার বাইরে আর কোন চিন্তা নয় - তোকে শুধু বেঙ্গল টিমেই নয়, ইণ্ডিয়া টিমেও চান্স পেতে হবে, নানু। কথাটা মনে রাখিস – আমরা সবাই তোর পিছনে আছি”।  

সবই তো ভালোয় ভালোয় মিটল, কিন্তু আমার মনের খটকাটা রয়েই গেল – অশরীরীরা খেলাধুলোতেও নাক গলিয়ে এমন কারসাজি করতে পারে? ভূতেদের অসাধ্য কি কিছুই নেই?  

 --০০--

শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫

সুরক্ষিতা - পর্ব ১৮

 

[এই ব্লগের প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


[আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে "সুরক্ষিতা - পর্ব ১৭"]


১৮

অন্যদিনের থেকে বেশ একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এলেন শুভময়ীদেবী সাদা রঙের চেনা ছোট গাড়িটা ঢুকে এল কম্পাউন্ডে। শুভময়ীদেবী নামলেন গাড়ি থেকে, ওপরের বারান্দায় ছবির সঙ্গে চোখাচোখি হতে হাসলেন। উনি উঠে আসছেন ওপরে, ছবি দরজা খুলতে গেল। শুভময়ীদেবী ঘরে এসে সোফায় বসলেন বেশ আরাম করে। খুশির হাসি তাঁর মুখে। সোফায় বসে বললেন, “আজ বিট্টু বেশ ভাল আছে, জানিস ছবিসক্কলের সঙ্গে কি সুন্দর গল্প করছিল, তুই না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবি না। পরের রোববার তোকে নিয়ে যাব।”

ছবি ফ্রিজ থেকে কাঁচের গ্লাসে রাখা লেবু-মিছরির সরবৎ বের করে এনে, শুভময়ীদেবীর হাতে দিয়ে বলল, “তাই? অনেক বন্ধু পেয়ে গেছে না, এখানে বেচারা সারাটাদিন আমাদের সঙ্গে, খুব মনমরা থাকত সবসময়, বলো মামী”।

“একদম ঠিক। তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল জানিস তো? বাবা, তুই তো বেশ গিন্নি হয়ে উঠেছিস, রে – অ্যাঁ, ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সরবৎ, বাঃ”উজ্জ্বল হাসি শুভময়ীদেবীর মুখে, কতদিন তিনি এমন যত্নআত্তি পাননি কারোর কাছ থেকে। পাওয়ার কথা কোনদিন ভাবনাতেও ছিল না, নানান পরিস্থিতির চাপে। খুব তারিয়ে তারিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে তিনি সরবৎ খেলেন।

ছবি জিজ্ঞাসা করল, “আরেকটু দিই”?

“আছে? তাহলে দে, বেশ লাগল কিন্তু”। আরো এক গ্লাস ভরে দিল ছবি। শুভময়ীদেবী সরবৎ খালি করে গ্লাস ফেরত দিলেন ছবির হাতেগ্লাস নিয়ে ছবি রান্নাঘরে গেল, তাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন শুভময়ীদেবী।

ছবির পিছনে যেতে যেতে বললেন, “কি রান্না করেছিস রে”?

“যা, যা বলে গেছিলে সব”। রান্নাঘরে ঢুকে শুভময়ীদেবী ঢাকনা তুলে দেখতে লাগলেন সব বাটিগুলি। খুব খুশি হলেন সব কিছু দেখে। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, প্রত্যেকটি রান্না সযত্নে ঢাকা দেওয়া। তিনি হাসি মুখে ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, “দারুণ রেঁধেছিস মনে হচ্ছে? কেমন হয়েছে রে”?

“কেমন হয়েছে, তা তো জানিনা, তুমিই তো খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে”।

“এ বাবা, তুই চেখে দেখিস নি? একটু একটু চেখে দেখবি তো, নুন মিষ্টি ঠিক হল কিনা”?

“না, না। তুমি খাওয়ার আগে আমি খাবো? সে আমি কক্‌খনো পারব না”।

“পাগলি কোথাকার। তোর মা আর দিদুকে বলেছিলি তো? কখন আসবে?”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছবি বলল, “এসে যাবে এখনই। ততক্ষণ তুমি চানটা করে নাও না”।

“সেই ভাল – চট করে চানটা সেরে আসি।    

 

সকলের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর, শুভময়ীদেবী মালতীদের নিজের ঘরে ডাকলেন, বললেন, “মালতী তোমাদের সঙ্গে ছবির ব্যাপারে কিছু কথা আছে”। ওদের সঙ্গে ছবিও এসেছিল, শুভময়ীদেবী ছবিকে বললেন, “আমাদের বড়োদের কথার মধ্যে তোর তো থাকা চলবে না, ছবি। সকাল থেকে তোর অনেক খাটনি গেছে, তুই বরং, যা, একটু বিশ্রাম করে নে…”।

ছবির মোটেই ইচ্ছে হচ্ছিল না এঘর থেকে যাওয়ার, তবু মামীর আদেশ তাকে মানতেই হবে। বেরিয়ে গিয়ে শুভময়ীদেবীর ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বন্ধ দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিট্টুর ঘরে গেল। এ বাড়িতে কাজে ঢুকে থেকে, বিট্টুর বিছানার পাশের মেঝেতেই সে বিছানা পাতে। রাত্রে সেখানেই সে শোয় – মাঝে মাঝে দুপুরেও। বিট্টু “একান্ত সহায়”-এ চলে যাওয়ার পর – এ ঘর এখন শূণ্য, শূণ্য বিট্টুর বিছানাও। বিছানার পাশে একটা টুল নিয়ে খোলা জানালার সামনে বসল ছবি। এদিকের জানালা দিয়ে কমপ্লেক্সের ছোট্ট পার্কটা চোখে পড়ে। ওখানে স্লিপ আছে, আছে দোলনা, দুটো সি-স। আছে বেশ কিছু সিমেন্টের বেঞ্চি। আর পার্কের চারপাশ ঘিরে চওড়া বাঁধানো পায়ে চলার পথ আছে। সকাল সকাল বড়োরা ওই পথে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে…। বিকেলে বাচ্চারা আসে খেলতে। সন্ধের দিকে মহিলারা আসে বেঞ্চে বসে গল্প করতে। এই মধ্য দুপুরে পার্কটা নির্জন, কেউ নেই।

শূণ্য এই ঘরে বসে, শূণ্য ওই পার্কের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ছবির দুশ্চিন্তাটা আরও বাড়ল। তাকে আড়াল করে, তার মা আর দিদুকে কী বলতে ডাকল মামী? সে কথা এত গোপনই বা কেন? তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথাই যদি হয় – তার জন্যে এত ঢাকঢাক-গুড়গুড় কেন? কেনই বা এত আদর করে তার মা আর দিদুকে খাওয়ানোর আয়োজন? কথাটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না ছবি। মামী কী ভাবছে – এই বাড়ীর কাজ থেকে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে – একথা শুনলে সে ডুকরে কেঁদে উঠবে? ছবির প্রতি তার মামীর এতটাই সহানুভূতি? নাকি…

কথাটা হঠাৎ মনে আসতে ছবির শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল হিমেল স্রোত। তার মাথা ঘুরে গেল। জানালার বাইরে পার্কের সবুজ ঘাস, বাচ্চাদের খেলার সরঞ্জাম সবই কেমন ঝাপসা হয়ে এল তার চোখের সামনে। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল চুপ করে…। মামী কি কোন ভাবে জেনে গেছে মিঠুদিদির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা? যে সম্পর্ক সে নিজেই চুকিয়ে দিয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে? তার মা এবং দিদু এসব কথা শুনলে যে পাথর হয়ে যাবে। মামী কী করে জানল? আর যদি জেনেই থাকে তাকেই তো সরাসরি বলতে পারত। তা না করে মা আর দিদুকে ডেকে আনল এসব কথা বলার জন্যেই…! ভয়ে আর লজ্জায় তার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে এল।

মালতী খুব ধীরে ধীরে ছবির ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে এল। ভেবেছিল মেয়েটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথায় কি – জানালার ধারে চুপটি করে বসে আছে – দুহাতে মুখ ঢেকে…। খুব অবাক হল মালতী – ছবি এভাবে বসে আছে কেন? শরীর খারাপ নয় তো? নিঃশব্দে ছবির পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত রাখল মালতী, মমতামাখা গলায় বলল, “কী হয়েছে রে, মা? মাথা ধরেছে? শরীর খারাপ লাগছে?”

মাথায় হাতের স্পর্শে ছবি চমকে উঠেছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মা। ছবি মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মালতী অবাক হল খুব – ছবিকে এতটা অসহায় ভাবে কাঁদতে বহুদিন দেখেনি। সেই ওর বাবা মারা যাওয়ার সময় ছাড়া। ছবির মাথাটা বুকে চেপে ধরে, মালতী কান্নাধরা গলায় বলল, “কী হয়েছে মা? কীসের কষ্ট তোর? হঠাৎ এভাবে কাঁদছিস কেন - একা একা বসে?”

দুজনে দুজনকে ধরে চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ছবির কান্নার বেগ কিছুটা কমতে, মালতী ছবির মুখটা ধরে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “পাগল মেয়ে, কী হয়েছে বলবি তো? কাঁদছিস কেন? ওঘরে তোর মামী তোকে ডাকছে – চল – খুব ভালো খবর আছে…”।

নিজেকে সামলে নিয়ে ছবি কান্নাধরা গলায় বলল, “তোমাদের গোপন কথাবার্তা সব হয়ে গেল?”

মালতী এবার হেসে ফেলল, বলল, “অ…ও ঘর ছেড়ে তোকে চলে আসতে বলার জন্যে তোর অভিমান হয়েছে? তার জন্যে এত মনখারাপ – কান্না, পাগলি কোথাকার? চ ওঠ, মামী ডাকছে, অনেক কথা আছে…”।  

...আগামী সঙ্খ্যায় সমাপ্য...

বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫

গিরগিটি

 

[প্রত্যেকটি লেখা সরাসরি আপনার মেলে পেতে চাইলে, ডান দিকের কলমে "ফলো করুন" 👉 

বক্সটি ক্লিক করে নিজের নাম ও মেল আইডি রেজিস্টার করে নিন] 


[আরেকটি অণু গল্প পাশের সূত্রে পড়া যাবে "পুরানা বিক্রি"]


রাম দৌড়তে দৌড়তে এসে হাঁফিয়ে থামল, বলল, “ওগো বাবাগো, ঝোপ থেকে বেরিয়ে, এত্তো বড়ো কী একটা এসে আমার পায়ে কুটুস কামড়ে দিল”!

যদু বলল, “কী একটা কি রে? কী কামড়াল, তাকিয়ে দেখিসনি?”

“মাথাটা ঘুরে উঠতে, দেখতে আর পেলাম কই? তবে রঙটা যেন গেরুয়া...”

মধু বলল, “আমাকেও সেদিন ঘাড় নেড়ে নেড়ে মুখ ভেঙাচ্ছিল...তবে তার রঙ ছিল সবুজ”।

শ্যাম বলল, “উঁহু, লাল। গত মঙ্গলবার হাটে যাওয়ার সময়, সামনের রাস্তাটা কেটে দিয়ে পাশের ঝোপে ঢুকে পড়ল, আর আমিও ঘাসের ডগায় হোঁচট খেয়ে পড়লাম আর বাঁ-পায়ের গোড়ালি মচকালাম”।

যদু বলল, “ধুর ব্যাটা, ওটা তো গিরগিটি। আগে “বহুরূপী” বলে খুব নাম করেছিল। এখন আমাদের দেখে হিংসেয় জ্বলছে, রঙ বদলানোয় আমরা বেশ ক'বছর হল, ওদের হারিয়ে দিয়েছি যে!”

--০০--

     

নতুন পোস্টগুলি

বকের মৃত্যু

  [এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্রে 👉 " বাংলাদেশের হৃদয় হতে "]   শীতের এক ছুটির দুপুরে, পাড়ার গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় শেখরদা এ...