মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ৩/৪

 



["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের তৃতীয় পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে "ধর্মাধর্ম - ৩/৩"


তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ পর্বাংশ

(৬০০ বিসিই থেকে ০ বিসিই)


৩.৩.৩ বৌদ্ধধর্মের প্রচার

বৌদ্ধধর্মের প্রতীক ধর্মচক্র। এই চাকা দেখতে রথের চাকার মতোই, কিন্তু প্রত্যেকটি অংশই অত্যন্ত অর্থপূর্ণ। ধর্মচক্রের ব্যাখ্যা যুগে যুগে বারবার বদলেছে এবং চক্রের আকারেও অনেক জটিলতা এসেছে। তবে প্রথমদিকের চক্রে, সাধারণতঃ আটটি অর (spokes) অষ্টাঙ্গিক মার্গ বোঝাতো। মধ্যের নাভি (hub) বোঝাতো অজ্ঞতা। আবার অনেক পণ্ডিতের মতে চাকার নাভি ও চাকার বেড় বা পরিধির (rim) তাৎপর্য যথাক্রমে শীল ও প্রজ্ঞা। কোন কোন ধর্মচক্রের নাভিতে তিনটি ঘূর্ণির (swirls) প্রতীকও দেখা যায়, এই তিন ঘূর্ণি – বুদ্ধ, ধর্ম এবং সঙ্ঘ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ধর্মচক্রের অর্থ হতে পারে – যে কোন অজ্ঞানী মানুষ, বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের সংস্পর্শে এসে, অষ্টাঙ্গিক মার্গের সাধনা করলে, পরমপ্রজ্ঞা লাভ করতে পারে।

ঋষিপত্তন থেকে বেরিয়ে ধীর পদব্রজে চলতে চলতে তিনি এলেন উরুবিল্ব গ্রামে। সেই নৈরঞ্জনা নদী, তার দুই পাড়, বোধিবৃক্ষ, সেই অরণ্য, সেখানকার দরিদ্র অথচ প্রাণবন্ত সরল ছেলেময়েদের সঙ্গে তাঁর কটা দিন বেশ আনন্দেই কাটল। ছেলেমেয়েদের থেকেই শুনলেন উরুবিল্ব কশ্যপ নামে কোন এক ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী কিছুদিন আগেই নৈরঞ্জনা নদীর ওপাড়ে কিছুদূরে তাঁর আশ্রম বসিয়েছেন। সেখানে প্রায় পাঁচশ সন্ন্যাসী আছেন। তাঁদের কেউই অবিশ্যি মুণ্ডিত মস্তক সন্ন্যাসী নন, বরং তাঁদের মাথায় চুলের জটা। কয়েকদিন উরুবিল্বে কাটিয়ে বুদ্ধদেব চলে গেলেন উরুবিল্ব কশ্যপের আশ্রমে। সেখানে উরুবিল্ব কশ্যপ এই যুবক সন্ন্যাসীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই বুঝতে পারলেন, এই সন্ন্যাসী অসাধারণ। তিনি নিজেকে বেদজ্ঞ মনে করতেন। কিন্তু বুদ্ধের সঙ্গে বেদ প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বুঝলেন, বেদের অনেক তত্ত্বই এতদিন তাঁর কাছে অস্পষ্ট ছিল, এই যুবক তাঁর মনের সেই ধোঁয়াশা দূর করে দিয়েছেন। তিনি বুদ্ধের ধর্মে আকৃষ্ট হলেন। তাঁর আশ্রমে নিত্য যজ্ঞ হত, সেই যজ্ঞে রোজই পশুবলি দেওয়া হত। বুদ্ধের উপদেশে তিনি পশুদের মুক্তি দিলেন, যজ্ঞ ত্যাগ করলেন। তারপর একদিন পাঁচশ শিষ্য সহ উরুবিল্ব কশ্যপ নৈরঞ্জনা নদীর ধারে মাথার জটা মুণ্ডন করে বুদ্ধদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।

নৈরঞ্জনা নদীর ভাটিতে তাঁর দুই ভাই – নন্দকশ্যপ এবং গয়াকশ্যপেরও আশ্রম ছিল। উরুবিল্ব কশ্যপ ও তাঁর শিষ্যরা বুদ্ধদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার কয়েকদিন পরে দুই ভাই দৌড়ে এলেন, দাদার খোঁজ নিতে। তাঁরা নদীর স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছেন অজস্র চুলের জটা। দাদা ও তাঁর আশ্রমের ভয়ংকর কোন বিপদের আশঙ্কায়, তাঁরা দৌড়ে এসেছেন। দাদার সঙ্গে এবং বুদ্ধদেবের সঙ্গে কথা বলে, তাঁরাও নিজেদের শিষ্যদের নিয়ে বুদ্ধদেবের কাছে সন্ন্যাসে দীক্ষা নিলেন। সব আশ্রমের শিষ্য নিয়ে, উরুবিল্ব কশ্যপের আশ্রমে এখন ন’শোর ওপর শিষ্য! স্থান সংকুলান হওয়া শক্ত। উরুবিল্ব কশ্যপ তাঁর নিজের কুটিরেই বুদ্ধদেবকে রাত্রিবাসের জন্যে অনুরোধ করলেন। বুদ্ধদেব যেহেতু রাত্রে ধ্যান করে থাকেন, তাই একলা ঘরের আশ্রয় চেয়ে বললেন, তিনি আশ্রমের অগ্নিহোত্র কুটিরে রাত্রে শোবেন, ওখানে তো কেউ শোয় না। উরুবিল্ব কশ্যপ বললেন, “ওখানে শোওয়া যেত, কিন্তু কয়েকদিন ধরেই ওই কুটিরে আশ্রয় নিয়েছে ভয়াল এক অজগর সাপ। তাকে কিছুতেই ওখান থেকে তাড়ানো যায়নি। হে বুদ্ধ, আপনার ওখানে রাত্রিবাস অসম্ভব। আমরা বেশ কিছুদিন ধরে ওই ঘরে ঢুকতেই পারছি না”।

বুদ্ধ নিরুদ্বিগ্ন স্মিতমুখে বললেন, “আমি ওই কুটিরেই রাত্রিবাস করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার কোন বিপদ হবে না”। বুদ্ধ জঙ্গলে বেশ কয়েক বছর তপস্যা করেছেন, রাত্রে তাঁর আশেপাশেই ঘুরে বেড়াত কত হিংস্র জন্তু, অজগর, বিষধর সাপ। তিনি কাউকেই ভয় পাননি এবং ভয় দেখাননি, তারাও কোনদিন তাঁর কোন ক্ষতি করেনি। বুদ্ধ সেই ঘরে ঢুকে দেখলেন, ঘরের মাঝখানে রয়েছে অগ্নিকুণ্ড, অন্যপাশে স্তূপ করা রয়েছে যজ্ঞের কাঠ। তিনি বুঝতে পারলেন ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে সেই ভয়ংকর সাপ। বুদ্ধ উল্টোদিকে বসলেন এবং ধ্যানস্থ হলেন। দীর্ঘ সময় নির্বিঘ্নে ধ্যান করার পর শেষ রাত্রে তিনি চোখ মেলে দেখলেন, বিশাল সেই সাপ এখন কুণ্ডলি পাকিয়ে বসে আছে ঘরের মাঝখানে এবং মুখ তুলে তাকিয়ে আছে, তাঁরই মুখের দিকে। বুদ্ধ স্মিত হেসে সাপটিকে বললেন, “তোমার এবং অন্য সকলের ভালোর জন্যেই বলছি - জঙ্গলে ফিরে যাও, বন্ধু”। সাপটি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, কোনদিন সে আর ফিরে আসেনি ওই আশ্রমে।

উরুবিল্ব থেকে বেরিয়ে রাজগৃহে যাওয়ার পথে ভগবান বুদ্ধ এবং তাঁর ন’শো শিষ্য তিনমাস রইলেন গয়াশীর্ষে। সেখানে তিনি নবীন সন্ন্যাসীদের ধর্মশিক্ষা দিলেন। ন’শো মানুষের জন্য রোজ সামান্য ভিক্ষান্ন যোগাড় করাও বড় সহজ কাজ নয়, ছোটখাটো গ্রাম বা জনপদের পক্ষে তো অসম্ভব। বুদ্ধদেব এবং উরুবিল্ব কশ্যপ ন’শো শিষ্যর সঙ্ঘকে প্রত্যেক দলে পঁচিশজন করে, ছত্রিশটি দলে ভাগ করে ফেললেন। প্রত্যেক দলের নেতৃত্বে রইল একজন অভিজ্ঞ ভিক্ষু। বহু দূর গ্রামে গ্রামে ছত্রিশটি দল ছড়িয়ে পড়ল এবং একই সঙ্গে এগোতে লাগল রাজগৃহের দিকে। বিস্তীর্ণ ওই অঞ্চলের অসংখ্য গ্রাম ও জনপদের বাসিন্দারাও জেনে গেল ভগবান বুদ্ধের কথা। মুণ্ডিত-মস্তক, শান্ত-সমাহিত, বিনীত বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের আচরণ তাদের কৌতূহলী এবং আগ্রহী করে তুলল বৌদ্ধধর্ম এবং ভগবান বুদ্ধ সম্পর্কে। ধর্মচক্রের রথ কোন আনুষ্ঠানিক প্রচার ছাড়াই জয় করতে করতে চলল মগধরাজ্যের বহু সাধারণ মানুষের মন। 

৩.৩.৪ রাজগৃহে গৌতমবুদ্ধ

রাজগৃহের মতো বড়ো শহরের পক্ষেও একসঙ্গে এত লোকের থাকা এবং নিত্যক্রিয়ার মতো জায়গার সংকুলান সম্ভব ছিল না। সেই চিন্তা করে রাজগৃহের অনতিদূরেই ভগবান বুদ্ধের অনুমতি নিয়ে, তালবনে রাতারাতি এক আশ্রম বানিয়ে তুললেন উরুবিল্ব কশ্যপ। পরদিন সকালে রাজগৃহের সমস্ত নগরবাসী চমকিত হল অভূতপূর্ব এক দৃশ্যে। কোন চিৎকার নেই, চেঁচামেচি নেই, পঁচিশজন ভিক্ষুর এক একটি দল নগরে বেরিয়েছে ভিক্ষা করতে। তাদের হাতে ভিক্ষাপাত্র, মুখে প্রশান্ত হাসি। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, রাজকর্মচারী, সেনাপতি, শ্রেষ্ঠী কিংবা চামার, মেথরে তারা কোন বাছবিচার করছে না। নিঃশব্দ স্মিতমুখে তারা গৃহস্থের দরজার সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছে। ভিক্ষা পাত্র পূর্ণ হলেই ভিক্ষা থেকে নিবৃত্ত হচ্ছে। ভিক্ষার ক্ষেত্রেও কোন বাছবিচার নেই, যে যা দেয় তাই গ্রহণ করে স্মিতমুখে। তবে উচ্ছিষ্ট খাদ্য তারা গ্রহণ করে না, অবিশ্যি এক পাষণ্ড ছাড়া আর কোন গৃহস্থ উচ্ছিষ্ট ভিক্ষা দেয়?

ভিক্ষাপাত্র পূর্ণ হলেই তারা ফিরে যায় তালবনে। সেখানেই সকলে একসঙ্গে নিঃশব্দ মনোযোগে খাবার খায়, আর বাকি সারা দিন নিজেদের মতো ধ্যান অভ্যাস করে। তারপর বিকেলের পর সবাই ধর্মতত্ত্ব শিখতে একত্র হয়। সেখানে শিক্ষা দেন অহর্ৎরা, শিক্ষা দেন ভগবান বুদ্ধ নিজে। প্রায় দিন পাঁচ-ছয় হয়ে গেল বুদ্ধদেব এবং তাঁর সঙ্ঘের ভিক্ষুরা রোজই নগরে যাচ্ছেন, কিন্তু তিনি নিজে রাজা বিম্বিসারের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন না।

দেখতে দেখতে সংবাদ পৌঁছে গেল রাজা বিম্বিসারের কানে। তিনি শুনলেন প্রত্যেকদিনই নগরে মুণ্ডিত-মস্তক, গৈরিকবসন ভিক্ষুদের অনেকগুলি দল ভিক্ষা পাত্র নিয়ে সকালে আসে, দুপুরের মধ্যেই তারা নগর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তাদের তালবনের আশ্রমে। তাদের আচরণ এতই প্রশান্ত এবং বিনীত – নগরে এতগুলি ভিক্ষুর উপস্থিতিতেও বিরক্তি আসে না। ভিক্ষা দিতেও কার্পণ্য আসে না। এই ভিক্ষুদের যিনি আচার্য তাঁর নাম গৌতমবুদ্ধ। তাঁর সৌম্যপ্রশান্ত চেহারা থেকে যেন জ্যোতি ঠিকরে বেরোয়। তিনি সামনে এসে দাঁড়ালে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, মনের মধ্যে অদ্ভূত এক আনন্দের অনুভূতি হয়। এতগুলি ভিক্ষুর আচার্য মানে, তিনি যে বৃদ্ধ, তাও নয়। শোনা যাচ্ছে তাঁর বয়স মাত্র ছত্রিশ। তাঁর শিষ্য অর্হৎদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা বয়সে বুদ্ধের থেকে অনেক বড়ো। সমস্ত বিবরণ শুনে রাজা বিম্বিসার অনুমান করলেন, ওই আচার্য বুদ্ধই তাঁর সেই বন্ধু সিদ্ধার্থ, যাঁর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল পাণ্ডব পাহাড়ে। সেই দিন বিকেলেই তিনি, রাণি এবং রাজকুমার অজাতশত্রুকে নিয়ে, নিজের রথে চড়ে বসলেন এবং সারথিকে আদেশ দিলেন তালবনে যাওয়ার। তাঁর নিমন্ত্রণে তাঁর অনুগামী হলেন প্রায় একশ’র উপর ব্রাহ্মণ আচার্য এবং শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত। তালবন তপোবনের সামনে তিনি, রাণি এবং অজাতশত্রু রথ থেকে নেমে এলেন। তারপর পদব্রজে চললেন তপোবনের ভেতরে। 


Bimbisara with his royal cortege issuing from the city of Rajagriha to visit the Buddha, Sanchi, East Face - South Pillar - East Gateway

৩.৪.১ বৌদ্ধধর্মের রাজস্বীকৃতি

শেষ অপরাহ্নে তালবন আশ্রমের ভিক্ষুরা তখন বুদ্ধদেব এবং উরুবিল্ব কশ্যপকে ঘিরে সবে মাটিতে আসন নিয়েছে ধর্মকথা শুনবে বলে। সেই সময় গৌতমবুদ্ধের কানে সংবাদ পৌঁছল - রাজা আসছেন। তিনি উরুবিল্ব কশ্যপকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলেন রাজপরিবারকে অভ্যর্থনা করতে। রাজা বিম্বিসার দেখলেন তাঁর অনুমান নির্ভুল, তাঁর বন্ধু সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থই এই গৌতমবুদ্ধ। তিনি বুদ্ধদেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর রাণি এবং পুত্রের। তারপর বিখ্যাত আচার্য এবং অভিজাত কয়েকজনের সঙ্গেও পরিচয় করালেন। বুদ্ধ এবং অর্হৎ কশ্যপ সকলের বসার ব্যবস্থা করলেন, রাজপরিবারের জন্যে কাঠের পীঠিকা আর অন্যদের জন্য মাটিতেই আসন বিছিয়ে দেওয়া হল।

রাজার অনুগামীদের মধ্যেই অনেকেই ছিলেন প্রখ্যাত বেদজ্ঞ আচার্য, দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত। তাঁদের অনেকেই উরুবিল্ব কশ্যপকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন, জানেন অথবা নাম শুনেছেন, কিন্তু তাঁদের কেউই গৌতমবুদ্ধের নাম কখনো শোনেননি। তাছাড়া কশ্যপের তুলনায় বয়সেও গৌতমবুদ্ধ অনেকটাই ছোট। তাঁরা সকলেই আশ্চর্য হলেন, উরুবিল্ব কশ্যপের মতো পণ্ডিত কী ভাবে অচেনা-অজানা এই গৌতমবুদ্ধর শিষ্য হয়ে গেলেন? নাকি তাঁরা ভুল বুঝছেন, আসলে গৌতমবুদ্ধই উরুবিল্ব কশ্যপের শিষ্য? কিন্তু তিনি যখনই কথা বলছেন, গৌতমবুদ্ধের প্রতি তাঁর বিনম্র শ্রদ্ধা দেখে উপস্থিত বিদ্দ্বজ্জনেরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের মনের এই দ্বিধা বুঝতে ভুল করলেন না উরুবিল্ব কশ্যপ। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, “হে গৌতমবুদ্ধ, হে বোধিসত্ত্ব, আপনিই আমার জীবনের সর্বোত্তম আচার্য। আপনাকে নতমস্তকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অনুরোধ করি উপস্থিত সকলকে এবং আমাকেও আপনি আত্ম-জাগরণের পথ নির্দেশ দিন”। এই বলে তিনি গৌতমবুদ্ধকে তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন।

গৌতমবুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে কশ্যপকে নিজের পাশে বসালেন, তারপর সকলের উদ্দেশে শুরু করলেন তাঁর ধর্ম কথা। ভোরের রৌদ্রের মতো উজ্জ্বল অথচ জ্যোস্নার মতো স্নিগ্ধ তাঁর শরীর। উদাত্ত অথচ শান্ত, প্রত্যয়ী স্বরে তিনি যখন তাঁর উপলব্ধির কথা শুরু করলেন, উপস্থিত মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল তাঁর মুখের দিকে। ন’শো ভিক্ষুসহ, সমবেত প্রায় এক হাজারের ওপর মানুষ সকলেই নিঃশব্দ, নিস্পন্দ। কেউ উচ্ছ্বসিত নিশ্বাস ফেলল না, সকলেই নিবাত-নিষ্কম্প দীপশিখার মতোই অচঞ্চল, নড়াচড়ায় যদি বস্ত্রের খস্‌খস্‌ আওয়াজ ওঠে!

গৌতমবুদ্ধের ধর্মকথা সমাপ্তির পর রাজা বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন, করজোড়ে নতমস্তকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বললেন, “হে প্রভু, ছোটবেলা থেকেই আমার পাঁচটি সঙ্কল্প ছিল। আজ এই মাত্র, আমার সব সঙ্কল্পই সম্পূর্ণ হল। প্রথম সঙ্কল্প ছিল রাজ্যাভিষেক এবং রাজা হওয়া। রাজা আমি হয়েছি। দ্বিতীয় সঙ্কল্প ছিল এই জীবনে একজন পরমপ্রজ্ঞাবান আচার্যের সাক্ষাৎ। সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি। তৃতীয় সঙ্কল্প ছিল সেই প্রজ্ঞাবান আচার্যকে আমি বন্দনা করবো। সে সুযোগ আমি পেয়ে গেছি। চতুর্থ সঙ্কল্প ছিল সেই আচার্য আমাকে সত্যের পথ দেখাবেন। আপনিই আমাকে সে পথ দেখিয়েছেন। পঞ্চম সঙ্কল্প ছিল আমার অন্তরে, আমার চেতনায় সেই সত্য যেন উপলব্ধি করতে পারি। আমার অন্তরে সেই আলোক আমি দেখতে পেয়েছি। হে আচার্য, আমাকে অনুগ্রহ করে, আপনার গৃহী-শিষ্য হবার অনুমতি দিন”।

 গৌতমবুদ্ধ স্মিতমুখে সম্মতি দিলেন। আনন্দিত বিম্বিসার তাঁকে, উরুবিল্ব কশ্যপকে এবং তাঁদের ন’শ ভিক্ষু সন্ন্যাসীকে আগামী পূর্ণিমায়, তাঁর প্রাসাদে ভিক্ষা গ্রহণের অনুরোধ করলেন। গৌতমবুদ্ধ রাজার সে প্রার্থনাও আনন্দের সঙ্গে মঞ্জুর করলেন। তারপর রাজা বিম্বিসার সপরিবার এবং সপারিষদ নগরে ফেরার জন্যে প্রস্তুত হলেন। গৌতমবুদ্ধ এবং উরুবিল্ব কশ্যপ তাঁদের এগিয়ে দিলেন তালবনের সীমানা ছাড়িয়ে রাজপথ পর্যন্ত।

এখন প্রতিদিনই সঙ্ঘে ভিক্ষুর সংখ্যা বাড়ছে, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আসছে তাঁর জ্ঞানের আলোকে মনের তমসা দূর করার প্রার্থনা নিয়ে। পূর্ণিমার দিন গৌতমবুদ্ধ হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে রাজগৃহ নগরে যখন ঢুকলেন, ন’শোর জায়গায় তাঁকে অনুসরণ করছিল বারোশ পঞ্চাশজন ভিক্ষু। তাদের প্রত্যেকের হাঁটার গতি ধীর কিন্তু প্রত্যয়ী, সকলের দৃষ্টি পথের দিকে, পথ চলাতেও তারা যেন ধ্যাননিবিষ্ট। তাদের সকলেই মুণ্ডিত মস্তক, পরনে গৈরিক বসন এবং হাতে ভিক্ষাপাত্র। রাজগৃহের নাগরিক পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে রইল সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে, নিজেদের অজ্ঞাতেই তাদের জোড়হাত উঠে এল বুকের কাছে।

 রাজা বিম্বিসার তাঁর প্রাসাদের সিংহদ্বারে অপেক্ষা করছিলেন প্রায় সহস্র অনুচর ও অতিথিদের সঙ্গে। বুদ্ধদেব এসে পৌঁছতেই তিনি সসম্মানে তাঁকে এবং সকল ভিক্ষুদের নিয়ে গেলেন প্রাসাদের প্রাঙ্গণে। অজস্র পুষ্পমাল্যে সাজানো, সুগন্ধী ধূপ ও গুগ্‌গুলের সৌরভে সুরভিত সেই প্রাঙ্গণের মাঝখানে রাজা বিম্বিসার বুদ্ধদেবকে বসালেন। রাজকুমার অজাতশত্রু নিজের হাতে জল এনে ভগবান বুদ্ধের হাত ও পা ধুয়ে দিলেন। অন্যান্য অনুচরেরা জল এনে অন্যান্য অর্হৎ এবং ভিক্ষুদের হাত-পা ধুয়ে দিলেন। তারপর নিরামিষ খাদ্যসম্ভার এনে সাজিয়ে রাখা হল। রাজা জানতেন অহিংস বুদ্ধদেব নিরামিষ খাদ্যই পছন্দ করেন। তিনি এবং মহারাণি নিজের হাতে খাবার তুলে দিলেন বুদ্ধদেবের ভিক্ষাপাত্রে। রাজ পরিবারের অন্য মহিলারা খাবার পরিবেশন করলেন ভিক্ষুদের। পরিবেশন শেষ হতে, বুদ্ধদেব এবং অন্য সকলে একসঙ্গে আহারে মন দিলেন। তাঁদের নিঃশব্দ, শান্ত এবং নিবিষ্ট আহার গ্রহণ দেখে উপস্থিত সকলেই অভিভূত হয়ে গেলেন। প্রতিটি খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধ সম্যক অনুভব করতে করতে, এভাবেও আহার করা যায়! আহার শেষে বুদ্ধদেব এবং সকল ভিক্ষুদের ভিক্ষাপাত্র ধুয়ে ফেরৎ দেওয়া হল, সকলেই হাতমুখ ধুয়ে এসে আবার নিজ নিজ আসনে বসলেন।

রাজা বিম্বিসার করজোড়ে একটি নীচু আসনে বসলেন ভগবান বুদ্ধের সামনে। গৌতমবুদ্ধ রাজার ইচ্ছা বুঝে ধর্ম কথা বলতে শুরু করলেন, “প্রথম ধর্ম সর্বদা অহিংস থাকা। এই ধর্ম থেকে আসে সহমর্মীতা। সকল জীবই মৃত্যুকে ভয় পায়। আমরা যেমন নিজেদের জীবন পোষণ করি, সকল প্রাণীও তাই করে থাকে। আমরা যে শুধু মানুষ হত্যা থেকেই বিরত থাকব তা নয়, আমরা অন্য সকল প্রাণী হত্যা থেকেও বিরত থাকার চেষ্টা করব। আমরা সকল মানুষ, প্রাণী এমনকি উদ্ভিদের সঙ্গেও মিলেমিশে থাকব। আমরা যখন প্রত্যেকটি প্রাণের মূল্য বুঝতে শিখব, দেশে অশান্তি থাকবে না। অন্য রাজ্য জয়ের জন্য শক্তির বৃথা অপচয় নয়, বরং আমাদের সেনাবাহিনী ব্যস্ত থাকুক রাজ্যের রাস্তাঘাট, সেচব্যবস্থা, চিকিৎসালয় গড়ে তুলতে।

দ্বিতীয় ধর্ম হল অচৌর্য বৃত্তি। পরিশ্রমে সঞ্চয় করা একজনের সম্পদের ওপর অন্য মানুষের কোন অধিকার থাকতে পারে না। নিজের ক্ষমতা এবং প্রভাব খাটিয়ে সেই সম্পদ থেকে তাকে বঞ্চিত করা আরো বেশি অপরাধ। শ্রমিকের শ্রম ও স্বেদের বিনিময়ে প্রভূত সম্পদ অর্জন করাও এক ধরনের চুরিই। দেশের সকলেই যখন এই ধর্ম পালন করবে, দেশ থেকে হিংসা দূর হয়ে যাবে। সকল মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে সামাজিক সাম্যতা।

তৃতীয় ধর্ম হল কখনো যৌন দুরাচার না করা। বিবাহিত দাম্পত্য ছাড়া কখনো যৌনাচার করো না। এই ধর্মাচরণে সমাজে আসবে বিশ্বাস এবং সুখ, দূর হবে ভুল বোঝাবুঝি এবং পারিবারিক দুঃখ। উপপত্নীদের থেকে নিজেকে দূরে রাখলে, পরিবার ও সমাজের মানুষকে সুখী এবং সাহায্য করার অনেক বেশি সময় মিলবে।

চতুর্থ ধর্ম হল কখনও মিথ্যা না বলা। এমন কথা কখনও না বলা, যার থেকে হিংসা এবং বিভেদ সৃষ্টি হয়। তোমাদের বক্তব্য যেন সত্য অনুসারী হয়। কথার মধ্যে বিশ্বাস এবং সুখ সৃষ্টি করার শক্তি থাকতে হবে। এমন কোন কথাই বলবে না যা থেকে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে বিদ্বেষ বা ঘৃণা, কলহ-বিবাদ এমনকি যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি কথা বলার আগে বক্তব্য বিষয় নিয়ে বারবার চিন্তা করবে – তোমার বক্তব্য যে শুনছে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

পঞ্চম ধর্ম কোন নেশাতেই আকৃষ্ট না হওয়া, সে মদই হোক বা অন্য কিছু। নেশার জিনিষ মনকে আচ্ছন্ন করে। নেশাগ্রস্ত মানুষ তার পরিবার, সমাজ এবং নিজের অবর্ণনীয় দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে। এই ধর্ম প্রত্যেকের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে সর্বদা পালনীয়।

দেশের রাজা এবং রাজ্যের সমস্ত আধিকারিক যদি এই পাঁচটি ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে, তাহলে রাজ্যের সমৃদ্ধি অবধারিত। হে রাজন্‌, রাজা রাজ্যের কর্ণধার। রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে এবং কেন ঘটছে সে সম্বন্ধে সর্বদাই অবহিত এবং সচেতন থাকাটা রাজার কাছে জরুরি। আপনি এবং রাজকার্যের নানান দায়িত্বে থাকা সকলেই এই পাঁচটি ধর্ম যদি সম্যক পালন করেন, আমি বলছি, মগধ রাজ্য খুব দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে”।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য গৌতমবুদ্ধের এই ধর্ম-পরামর্শগুলি সাধারণের জন্যে হলেও বিশেষতঃ রাজা বিম্বিসারকেই উদ্দেশ  করেই যেন বললেন। রাজা বিম্বিসারের উপপত্নী সম্ভোগ। রাজা বিম্বিসারের বিলাস, ব্যসন ও ভোগবাসনা। সিদ্ধার্থের মতো স্বল্প পরিচিত তরুণ এক সন্ন্যাসীকে হঠাৎ অর্ধেক রাজত্ব দানের প্রস্তাব দিয়ে, নিজেকে অসহায় ধর্মপ্রাণ প্রমাণের চেষ্টা। এই সবকিছুই গৌতমবুদ্ধের কাছে তাঁর অব্যবস্থিত মানসিকতাকেই প্রকট করেছিল।       

রাজা বিম্বিসার শ্রদ্ধায় নতমস্তকে প্রণাম করলেন ভগবান বুদ্ধকে। মহারাণি বিদেহী পুত্র অজাতশত্রুর হাত ধরে সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি জোড়হাতে শ্রদ্ধা জানালেন, বালক পুত্রকেও শেখালেন কীভাবে জোড়হাতে পদ্মমুদ্রায় শ্রদ্ধা জানাতে হয়। তারপর মহারাণি বললেন, “হে প্রভু, আজ এখানে অজাতশত্রুর মতোই প্রায় চারশ বালক-বালিকা উপস্থিত রয়েছে। আপনি তাদের শিক্ষণীয় কিছু উপদেশ দিন”।

ভগবান বুদ্ধ বালক অজাতশত্রুকে কাছে টেনে নিলেন, তার একটি হাত নিজের হাতে ধরে রেখে তিনি সকল বালকদের উদ্দেশ্যে স্মিতমুখে বললেন, “ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের কোন উপদেশ দেব না বরং একটি গল্প শোনাবো। এই মানব জন্মের আগে, আমি এই পৃথিবীতে পাথর, মাটি, গাছপালা, পাখি বা অন্য নানান প্রাণী হয়ে বহুবার জন্ম নিয়েছিলাম। তোমরাও, আগের আগের জন্মে তেমনই ছিলে! তোমাদের সঙ্গে আমার আগের কোন না কোন জন্মে, হয়তো কোন সম্পর্ক ছিল, যার জন্যেই আমরা এই জন্মে আবার একত্র হয়েছি। কে জানে, হয়তো বিগত জন্মগুলিতে আমরা বারবার পরষ্পরের সুখ-দুঃখের কারণ হয়েছিলাম।

আজ যে ঘটনার কথা তোমাদের বলব, আমার কয়েক হাজার জন্ম আগে সে ঘটনা ঘটেছিল। এক কাঁক, এক কাঁকড়া, একটি চাঁপাগাছ, আর অনেক চিংড়ি এবং মাছদের নিয়ে এই কাহিনী। এই গল্পে আমি ছিলাম চাঁপাগাছ, আর তোমাদের মধ্যে কেউ হয়তো ছিলে সেই কাঁক[1], কাঁকড়া, চিংড়ি কিংবা মাছ। এই কাহিনীতে কাঁকই ছিল ভয়ংকর এক চরিত্র, যে অন্য সকলের অশেষ দুঃখের কারণ হয়েছিল, এমনকি আমার মতো গাছেরও।

সে জন্মে সুন্দর স্বচ্ছ এক পদ্মদীঘির পাড়ে আমি চাঁপা গাছ হয়ে বেড়ে উঠেছিলাম। আর সেই সরোবরের কিছুটা দূরেই ছিল ছোট্ট একটি ডোবা। সেই ডোবার অগভীর জলে বাস করত অনেক চিংড়ি, মাছ এবং কাঁকড়া। একদিন এক কাঁক উড়তে উড়তে তাদের সকলকে দেখে ফেলল। ছোট্ট ডোবার সীমিত জলে এতগুলি লোভনীয় শিকারকে একসঙ্গে দেখে, সে তখনই সেই ডোবার পাড়ে নামল। তারপর একপায়ে দাঁড়িয়ে শিকারের মতলব আঁটতে গভীর চিন্তায় ডুব দিল।

মাছ এবং চিংড়ির দল পাড়ের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “হে কঙ্ক, আপনি এত গভীর ভাবে কী চিন্তা করছেন?” গভীর শ্বাস ছেড়ে কাঁক উত্তর দিল, “আমি তোদের কথাই চিন্তা করছি, রে। এই ঘোলা কাদামাখা জলে তোরা এতজন রয়েছিস কী করে? তোদের শ্বাস নিতে কিংবা সকলের খাবার পেতে অসুবিধে হচ্ছে না? তোদের কষ্টের কথা চিন্তা করে, আমার খুবই দুঃখ হচ্ছে, রে!”

কথাটা ঠিকই, কিন্তু আপনি কী আমাদের কোনভাবে সাহায্য করতে পারেন?”

পারি না আবার? একশবার পারি। এই কাছেই একটা পদ্মদীঘি আছে। আমি তোদের প্রত্যেককে সেই দীঘির স্বচ্ছ শীতল জলে ছেড়ে দিতে পারি। সেখানে প্রচুর জল, প্রচুর খাবার পেয়ে যাবি”।

আমরা কোনদিন শুনিনি, কাঁক পাখি কোন মাছ বা চিংড়িকে সাহায্য করেছে। আপনাকে ভরসা করতে ভয় লাগে। আমাদের শিকার করে খাবার, এ হয়তো আপনার নতুন কোন চাল”।

য্যাঃ, তোরা বড্ডো সন্দেহবাতিক। আমি তোদের বড়ো কাকার মতো। আমি তোদের ঠকাতে যাবো কী করতে? এই কাছেই সত্যিই খুব সুন্দর বড়ো একটা পদ্মদীঘি আছে, তার জল যেমন স্বচ্ছ তেমনি ঠাণ্ডা। বিশ্বাস না হলে, তোদের একজন কেউ আমার সঙ্গে চল, আমি দেখিয়ে নিয়ে আসছি। তারপর না হয় তোরা সবাই মিলে, কী করবি, ঠিক করিস!”

মাছ এবং চিংড়ির ঝাঁক নিজেদের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ শলাপরামর্শ করল, তারপর তারা ঠিক করল একজন বয়স্ক মাছ যাবে, কাঁকের কথা সত্যি কিনা, পরখ করতে। বয়স্ক সেই মাছটি বেশ বড়সড়ো, শক্তপোক্ত, তার গায়ের আঁশগুলোও খুব মোটা আর শক্ত। কাঁক তাকে মুখে করে নিয়ে গেল সেই সরোবরে, তারপর তাকে ছেড়ে দিল সরোবরের জলে। বয়স্ক সেই মাছ সরোবরের জলে অনেকক্ষণ ঘুরল, ফিরল, দেখল। সত্যিই, সরোবরের জল স্বচ্ছ, শীতল। অনেক মাছ এবং চিংড়ি থাকার পক্ষে বিস্তর জায়গা এবং খাবারেরও কোন অভাব নেই। সে কাঁকের মুখেই আবার ফিরে এল সেই ডোবায়। সে যা দেখেছে, মাছ এবং চিংড়িদের কাছে সব খুলে বলল।

কাঁকের সদিচ্ছায় মাছ এবং চিংড়িদের এবার ভরসা হল। এক এক করে তাদের ওই পদ্মদীঘিতে ছেড়ে আসতে, তারা কাঁককে অনুরোধ করল। ধূর্ত কাঁক এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। সে একটি মাছকে জল থেকে তুলে, ঠোঁটে করে নিয়ে, উড়ে এসে বসল সরোবরের পাড়ের সেই চাঁপাগাছের ডালে। গাছের শাখার খাঁজে মাছটিকে রেখে, কাঁকটা ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলল মাছের মাস। মাছের কাঁটাগুলো ফেলে দিল গাছের গোড়ায়। তারপর আবার উড়ে গেল আরেকটি মাছ তুলে আনতে।

আমিই সেই চাঁপাগাছ, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম এই সব ঘটনা। আমার কষ্ট হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল খুব। কিন্তু আমি যে গাছ, কিছুই করতে পারছিলাম না, কাঁককে আটকানোর কোন ক্ষমতা তো আমার ছিল না। একটা চাঁপাগাছ, ডালপালা ছড়াতে পারে, ফুল ফোটাতে পারে। কিন্তু সে তো দৌড়ে কোথাও যেতে পারে না। সে চিৎকার করে মাছ এবং চিংড়িদের সাবধান করতে পারে না। দিনের পর দিন সেই কাঁক অজস্র মাছ এবং চিংড়িদের ধরে এনে, আমারই ডালে বসে খেতে লাগল। আর তাদের কাঁটা আর শল্ক ফেলে ফেলে ছোটখাটো পাহাড় বানিয়ে তুলল আমার গোড়ায়। আমিই শুধু সেই ভয়ংকর দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম। আতঙ্ক, ভয় এবং দুঃখে আমি দিনের পর দিন শুকিয়ে উঠতে লাগলাম।

সেই ডোবার মাছ এবং চিংড়িরা এক দিন শেষ হয়ে এল। কিন্তু কাঁকের লোভ তখনও মেটেনি। ডোবার জলে থাকা কাঁকড়াদের বলল, “ভাইপোরা, সেই পদ্মদীঘির জলে মাছ আর চিংড়ির ঝাঁক তো দিব্যি আরামে আছে, এখন তোদের কী ইচ্ছে? তোরা কী এখানেই থাকবি, নাকি পদ্মদীঘিতে যাবি?”

কাঁকড়ার দল জিজ্ঞাসা করল, “আমাদের কীভাবে নিয়ে যাবেন?”

কেন? ঠোঁটে করে? যেভাবে এতগুলো মাছ আর চিংড়িদের এতদিন ধরে নিয়ে গেলাম?”

ওরে বাবা, না না। আপনার ঠোঁট ফস্কে একবার মাটিতে পড়লে আর দেখতে হবে না, খোলস ফেটে আমরা অক্কা পাবো”।

আরে ধূর, ঘাবড়াস না, আমি বেশ যত্ন করেই তোদের নিয়ে যাবো”।

কাঁকড়ার দল নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা করল। হতে পারে কাঁক হয়তো সব মাছ এবং চিংড়িদের সত্যিই পদ্মদীঘিতে নিয়ে গেছে। কিন্তু তা যদি না হয়? কাঁকটা যদি তাদের সবাইকে খেয়ে ফেলে থাকে? কাঁকড়ার দল পরামর্শ করে, একটা নিরাপদ উপায় চিন্তা করল। তারপর কাঁককে বলল, “কাকা কঙ্ক, আমাদের ভয় হচ্ছে, আপনি আপনার ঠোঁটে আমাদের নিরাপদে ধরে রাখতে পারবেন না। তার থেকে আমরা যদি আপনার গলাটি দাঁড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরি? আমাদের মনে হয় সেটা অনেক নিরাপদ।”

কাঁক রাজি হয়ে গেল, সে গলা বাড়িয়ে দিল এবং তার গলা আঁকড়ে ঝুলে পড়ল বড়ো একটি কাঁকড়া। কাঁকড়াকে গলায় নিয়ে কাঁক উড়ে এসে বসল আমারই গাছের ডালে। কাঁকড়া বলল, “কাকা কঙ্ক, আপনি নিচেয় পদ্মদীঘির কাছে না গিয়ে, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন?”

কাঁক ক্রূর হেসে বলল, “আমি কি এতই মূর্খ? যে অকারণে মাছ আর চিংড়িদের পদ্মদীঘিতে বয়ে বয়ে আনব? কাঁক এত পরোপকারী নয়, ভাইপো! গাছের নিচে তাকিয়ে দেখ, মাছের কাঁটা আর শল্কর কেমন স্তূপ জমে উঠেছে। সব কটাকে খেয়েছি, এখন তোকেও খাবো। তোর খোলাও পড়ে থাকবে ওই স্তূপের মধ্যে”।

কাকা, মাছ এবং চিংড়িদের সহজেই ঠকাতে পেরেছ বলে, আমাদেরও ঠকাতে পারবে ভেবেছ? আমাকে এখনই ওই পদ্মদীঘির ধারে নিয়ে চল, তা না হলে আমার দুই দাঁড়ায় তোমার গলা আমি ছিঁড়ে ফেলব”।

 কাঁকড়া তার দুই দাঁড়া দিয়ে কাঁকের গলা চেপে ধরতেই, কাঁক তার বিপদ বুঝতে পারল, যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে, ছেড়ে দে। আমি তোকে এখনই নীচেয় নিয়ে যাচ্ছি। তোকে আমি খাবো না”। কাঁক তাকে নিয়ে পদ্মদীঘির জলের ধারে নিয়ে গেল, কিন্তু কাঁকড়া তাকে ছাড়ল না। মাছ এবং চিংড়িদের সঙ্গে ওই কাঁকের নিষ্ঠুর বঞ্চনার কথা মনে করে, সে তার দুই দাঁড়ার প্রচণ্ড চাপে ছিঁড়ে ফেলল কাঁকের গলা। কাঁক মারা গেল, আর কাঁকড়া হেঁটে গিয়ে নেমে পড়ল জলে।

 ছেলেমেয়েরা, আমিই ওই চাঁপাগাছ ছিলাম বলে, সমস্ত ঘটনা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। তখনই আমি শিখেছিলাম, আমরা যদি কারও সঙ্গে সহৃদয় আচরণ করি, সেও আমার সঙ্গে তাই করবে। আর যদি নিষ্ঠুর হিংস্র আচরণ করি, আমাদের ভাগ্যেও তাই জুটবে। সে সময় আমার কিছু করার সাধ্য না থাকলেও, আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি যদি পরের জন্মে কোন প্রাণী হয়ে জন্মাই, তাহলে আমি অবশ্যই দুর্বল এবং অসহায় প্রাণীদের রক্ষা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করব। হয়তো তোমাদের মধ্যে অনেকেই সেই জন্মে ছিলে, চিংড়ি, মাছ অথবা কাঁকড়া।”

ছেলেমেয়েরা খুব মন দিয়ে এই কাহিনী শুনছিল। তারা সকলেই অনুভব করল চাঁপাগাছের অসহায় দুঃখ। অসহায় মাছ এবং চিংড়িদের কথা ভেবেও তারা ভীষণ কষ্ট পেল। কাঁকের প্রতি বিতৃষ্ণায় তাদের মনে ভরে উঠল। আর স্বস্তি পেল কাঁকড়ার উপস্থিত বুদ্ধি আর বীরত্বে।

রাজা বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন। জোড়হাতে নতমস্তকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি ভগবান বুদ্ধকে বললেন, “হে আচার্য, আপনার এই কাহিনী শুধু ছোটদের নয়, আমাদের মতো বড়দের কাছেও সমান শিক্ষণীয়। আমি নিশ্চিত, পুত্র অজাতশত্রু এবং অন্য সব ছেলেমেয়েরা, এই শিক্ষা সারাজীবন মনে রাখবে। আমাদের রাজ্য আজ আপনার উপস্থিতিতে অলংকৃত হয়ে উঠল। এবার অনুগ্রহ করে আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে খুব সামান্য কিছু উপহার দেওয়ার অনুমতি দিন”।

গৌতমবুদ্ধ কোন উত্তর দিলেন না, স্মিতমুখে তাকিয়ে রইলেন রাজা বিম্বিসারের মুখের দিকে। রাজা বিম্বিসার বললেন, “রাজগৃহের উত্তরে অর্ধক্রোশ দূরে খুব সুন্দর একটি বড়ো উপবন আছে। সেখানে আছে স্বচ্ছ জলের সরোবর। হিংস্র-শ্বাপদহীন সে বনে শুধু হরিণ আর কাঠবেড়ালি ঘুরে বেড়ায়। ওই উপবনের নাম বেণুবন। আমি ওই বেণুবন আপনাকে এবং আপনার সঙ্ঘকে দান করতে চাই। সেই সঙ্গে বানিয়ে দিতে চাই আপনাদের সবার বাসযোগ্য অনেক কুটির। সহস্রাধিক ভিক্ষু এবং আমাদের মতো গৃহীশিষ্যদের বসার জন্যে বানিয়ে দিতে চাই স্থায়ী বাঁধানো মণ্ডপ। যেখানে স্বয়ং আপনি এবং অহর্ৎগণ আমাদের প্রত্যহ ধর্মশিক্ষা দিতে পারবেন। হে প্রজ্ঞাবান, আপনি অনুগ্রহ করে আমার অন্তরের এই বিনীত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন”।

ভগবান বুদ্ধ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতমুখে সম্মতি দিলেন রাজাকে। রাজা বিম্বিসার তখনই সোনার কলসে পবিত্র জল আনালেন, তারপর সেই কলসের জল ভগবান বুদ্ধের করকমলে ঢালতে ঢালতে বললেন, “হে প্রভু, যেভাবে এই কলসের জল আপনার করপদ্মে নিবেদন করলাম, সেইভাবেই বেণুবন সমর্পণ করলাম আপনাকে এবং আপনার সঙ্ঘকে”।

বুদ্ধদেব এবং তাঁর সঙ্ঘ সেই প্রথম নিজস্ব একটি জমির অধিকার লাভ করলেন। যেখানে ভিক্ষুরা নিশ্চিন্তে বাস করবেন এবং ধর্মচর্চা করবেন। প্রতিকূল বর্ষার সময়েও তাঁরা পেয়ে যাবেন নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়। রাজগৃহের বেণুবন বৌদ্ধধর্মে নিয়ে এল বৌদ্ধবিহারের প্রথম ধারণা। গড়ে উঠতে লাগল বৌদ্ধবিহার কেন্দ্রিক সুশৃঙ্খল এক ধর্মীয় সংগঠন।

সেদিন রাজা বিম্বিসারের অতিথিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের রক্ষক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। তাঁরা প্রকাশ না করলেও, মনে মনে তীব্র ঈর্ষায় বিরূপ হলেন রাজার ওপর এবং গৌতমবুদ্ধ নামের ওই ছোকরা লোকটির ওপর।

এরপর গৌতমবুদ্ধ আমৃত্যু (৪৮৩ বি.সি.ই) সর্বদাই পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, প্রধানতঃ এখনকার উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বিভিন্ন নগরে, জনপদে এবং গ্রামে। তাঁর শিষ্য এবং অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন, রাজা থেকে ক্রীতদাস, বণিক থেকে বারাঙ্গনা। বয়োবৃদ্ধ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ থেকে নিজের পুত্র বালক রাহুল। বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থে বিখ্যাত যত অর্হৎ ও সন্ন্যাসীদের নাম পাওয়া যায়, তাঁদের কয়েকজনের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।

অহর্ৎ কঙ্খা রেবত – শ্রাবস্তীর অতি ধনী পরিবারে পুত্র। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের অন্যতম স্তম্ভ। 

অনাথপিণ্ডিক (অনাথপিণ্ডদ নামেও পরিচিত) – অন্যতম বিখ্যাত গৃহীশিষ্য। শ্রাবস্তীর সফলতম বণিক। তাঁর সম্বন্ধে আশ্চর্য এক কাহিনী শোনা যায়। গৌতমবুদ্ধকে একটি বিহার নির্মাণ করে দেবেন মনস্থ করে, অনাথপিণ্ডিক বেশ বড়ো একটি ভূখণ্ড পছন্দ করেছিলেন। সেই ভূমির অধিকারী ছিলেন কোশলরাজ প্রসেনজিতের পুত্র রাজকুমার জেত। তিনি কিছুতেই জমিটি হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। অনেক অনুরোধে তিনি নাকি অসম্ভব এক প্রস্তাব দিয়েছিলেন - সম্পূর্ণ জমিটি ঢাকতে যতগুলি স্বর্ণমুদ্রা প্রয়োজন, তার বিনিময়েই তিনি জমিটি হস্তান্তর করতে পারেন। অনাথপিণ্ডিক নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলেন এবং গোশকটে কার্ষাপণ বা নিষ্ক (স্বর্ণমুদ্রা) বহন করে এনে জমিতে বিছোতে শুরু করলেন।

 

অনাথপিণ্ডিকের এই আশ্চর্য সংকল্পে মুগ্ধ হয়ে শেষ অব্দি রাজকুমার জেত জমিটি দান করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর শর্ত ছিল এই বিহারের নাম তাঁর নামেই রাখতে হবে। সেই কারণেই এই বিহারের নাম জেতবন বিহার। শিল্পীরা এই কাহিনীকে অমর করে রেখে গেছেন সাঁচী এবং ভারহুত স্তূপের প্রাচীরের গায়ে (ওপরের চিত্র)। জমিটি বিনামূল্যে পেয়ে গেলেও, জেতবন বিহারের সমস্ত নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় অনাথপিণ্ডিক আজীবন বহন করেছিলেন। 

অর্হৎ সুভূতি – অনাথপিণ্ডিকের আত্মীয় – ভাইপো, মতান্তরে শালা।

ভিক্ষু পুন্নমন্তালিপুত্ত – বিখ্যাত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত।

অর্হৎ দাসক – অনাথপিণ্ডিকের ক্রীতদাস।

গৃহীশিষ্য রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রু – মগধের রাজা।

গৃহীশিষ্য রাজা প্রসেনজিৎ - কোশলের রাজা।

গৃহীশিষ্য রাজা চণ্ডপ্রদ্যোত – উজ্জয়িনীর রাজা।

গৃহীশিষ্য রাজা উদয়ন – বৎসদেশের রাজা।

অর্হৎ অভয় -  রাজা বিম্বিসারের পুত্র।

অহর্ৎ সুপ্রিয় – শূদ্র কুলে জন্ম।

অর্হৎ বিমল কোণ্ড – রাজা বিম্বিসারের রক্ষিতা অম্বাপালীর পুত্র।

অহর্ৎ ছন্ন – রাজা শুদ্ধোদনের ক্রীতদাস।

অর্হৎ তিস্র – রাজা বিম্বিসারের মিত্র।

ভিক্ষু বৎসগোত্র -  ধনী ব্রাহ্মণ পুত্র।

অহর্ৎ যশ – বারাণসীর বণিক পুত্র।

অর্হৎ পিণ্ডোল ভারদ্বাজ – কৌশাম্বীর রাজপুরোহিত।

অর্হৎ সারিপুত্র – অহর্ৎ তিস্রর পুত্র। তিনি প্রায় দ্বিতীয় বুদ্ধের মতো সম্মানীয় ছিলেন।

অহর্ৎ মৌদ্গলায়ন - অর্হৎ সারিপুত্রর আবাল্য বন্ধু। তিনিও সারিপুত্রের মতোই সম্মানীয় ছিলেন।

অহর্ৎ ধনিয় – কুম্ভকার ছিলেন।

অহর্ৎ উপালি – নাপিত – ত্রিপিটক গ্রন্থের অন্যতম সংকলক।

অর্হৎ উরুবিল্ব কশ্যপ – বেদজ্ঞ প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্রাহ্মণ। এঁর কথা আগেই বলেছি।

অর্হৎ কৌণ্ডিল্য, বপ্র, ভদ্রিক, অশ্বজিৎ এবং মহানামা – এঁদের কথা আগেই বলেছি।

অহর্ৎ মহাকাত্যায়ন – উজ্জয়িনীর রাজা চণ্ডপ্রদ্যোতের পুরোহিত।

অর্হৎ আনন্দ -  গৌতমবুদ্ধের খুড়তুতো ভাই, ত্রিপিটক গ্রন্থের অন্যতম সংকলক।

অহর্ৎ অনুরুদ্ধ – গৌতমবুদ্ধের খুড়তুতো ভাই।

অহর্ৎ রাহুল – গৌতমবুদ্ধের পুত্র।

 

গৌতমবুদ্ধের বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে জীবক কুমারভৃত্যও একটি উজ্জ্বল নাম। ভারতীয় চিকিৎসাচর্চায় তিনিই যে পথিকৃৎ সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। জীবকের মা ছিলেন রাজগৃহের বিখ্যাত বারবনিতা শাল্বতী বা শালবতী। শোনা যায় পরিত্যক্ত শিশু জীবককে আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন রাজা বিম্বিসারের পুত্র কুমার অভয়, তারপর রাজা বিম্বিসারই তাঁকে প্রতিপালন করেন। ছোটবেলা থেকেই  মেধাবী জীবক উদ্ভিদ ও ভেষজ চর্চায় অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি তক্ষশীলা[2] মহাবিদ্যালয়ে সাত বছর আয়ুর্বেদ এবং ভেষজশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তক্ষশিলায় তাঁর গুরু ছিলেন বিখ্যাত ঋষি আত্রেয় পুর্ণবসু।

শোনা যায়, জীবকের পাঠ সমাপ্তির দিন গুরু আত্রেয় শিষ্যের পরীক্ষা নিতে বলেছিলেন, “বৎস এই মহাবিদ্যালয়ের পিছনে যে বনভূমি রয়েছে, সেখানে সারাদিন সন্ধান করে আমার জন্যে ওষধিগুণহীন অন্ততঃ তিনটি গাছ, তৃণ, গুল্ম বা উদ্ভিদ এনে দাও”। সারাদিন নিবিড় সন্ধানে নিরত জীবক এমন উদ্ভিদ একটিও যোগাড় করতে পারলেন না। সন্ধ্যায় বিষণ্ণ মুখে এসে দাঁড়ালেন গুরু আত্রেয়র সামনে এবং নিজের ব্যর্থতার কথা নিজমুখে স্বীকার করলেন। গুরু আত্রেয় উজ্জ্বল সহাস্য মুখে শিষ্যকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, “কোন না কোন ওষধিগুণ ছাড়া জগতে একটিও উদ্ভিদ নেই, বৎস। তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ ও সার্থক”।            

তক্ষশিলার পাঠ শেষে তিনি রাজগৃহে ফিরে আসেন। শোনা যায় তিনি রাজা বিম্বিসারের দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়েছিলেন, উজ্জয়িনীর রাজা প্রদ্যোত এবং বেশ কয়েকবার ভগবান বুদ্ধেরও চিকিৎসা করেছিলেন।

তিনি সরাসরি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সংঘে যোগ দিয়েছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া না গেলেও, গৌতমবুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে তাঁর আজীবন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, পিতৃহত্যার পর অজাতশত্রু যখন অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন, এবং গৌতমবুদ্ধের সামনে যেতে ভয় করছিলেন, তখন জীবকের মধ্যস্থতায় তিনি বিরক্ত বুদ্ধদেবের ক্ষমা লাভ করেছিলেন।

জীবকের এবং ভারতীয় আয়ুর্বেদ ও চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব, তবে এখানে এটুকু বলে রাখি, গৌতমবুদ্ধের নির্দেশে এবং জীবকের প্রভাবেই বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অর্হৎ এবং ভিক্ষুদের মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রচলন হয়েছিল। যার ফলে পরবর্তীকালে, সাধারণ মানুষের শুধুমাত্র চৈতন্য বোধনের জন্যেই নয়, শারীরিক চিকিৎসার জন্যেও, বৌদ্ধ অর্হৎ ও ভিক্ষুরা দেশে-বিদেশে সর্বত্র সম্মানীয় এবং জনপ্রিয় হয়েছিলেন।               

গৌতমবুদ্ধের বিখ্যাত মহিলা ভক্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। প্রথমদিকের আশ্রম এবং বিহারগুলিতে মহিলাদের থাকার উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় তিনি ভিক্ষু হতে ইচ্ছুক মহিলাদের অনুমতি দিতেন না। মহিলাদের গৃহীশিষ্যা হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত। এরকমই কিছু নাম পাওয়া যায়, রাজগৃহের বিখ্যাত বারাঙ্গনা অম্বাপালী, সিরিমা এবং বারাণসীর অড্‌ঢকাশী। তাছাড়া আরও ছিলেন, কৌশাম্বীর মহারাণী শ্যামাবতীর ক্রীতদাসী খুজ্জুত্তরা। এছাড়াও (কোশলরাজার বোন) সুমনা, ভদ্রা, সুপ্রিয়া, ক্ষেমা, সুজাতা (উরুবিল্বের সেই বালিকা), মুত্তা এবং বড্ঢ মাতার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বুদ্ধদেবের বিমাতা ও মাসি, কপিলাবস্তুর রাণি গৌতমী, তাঁর শিষ্যা হয়েছিলেন এবং প্রধানতঃ তাঁর উদ্যোগেই বৌদ্ধবিহারে ভিক্ষুণীদেরও থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। অতঃপর বিখ্যাত তিয়াত্তর জন ভিক্ষুণীর নাম পাওয়া যায়, “থেরীগাথা” নামের বৌদ্ধদের এক ধর্মগ্রন্থে। গ্রন্থটির সমস্ত শ্লোকই থেরী অর্থাৎ সন্ন্যাসিনীদের রচিত। “থের” শব্দের উৎপত্তি “স্থবির” থেকে, বয়স্ক প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসীদের থের বলা হত, সন্ন্যাসিনীদের থেরী। পরবর্তী কালে বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখার নাম হয়ে উঠেছিল “থেরবাদ” অর্থাৎ প্রাচীনপন্থী মত। সে প্রসঙ্গ আসবে পরে।

শেষ পর্যটনে গৌতমবুদ্ধ রাজগৃহ থেকে মল্লরাজ্যের কুশীনারায় গিয়েছিলেন। সেখানে এক কর্মকারের গৃহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অহর্ৎ আনন্দ, তিনি মল্লরাজের সহায়তায় গৌতমবুদ্ধের অন্ত্যেষ্টি সৎকার করেছিলেন। গৌতমবুদ্ধের পুণ্য অস্থি ও ভস্ম ভাগ করে নিয়েছিলেন তখনকার অনেক রাজা এবং গণরাজ্যগুলি, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কুশীনারার মল্লরাজ, মগধ রাজ্যের অজাতশত্রু, বৈশালীর লিচ্ছবি, কপিলাবস্তুর শাক্য, কোলিয় রাজ্য এবং পিপ্পলি গণরাজ্যের মোরিয়রা। এঁরা সকলেই নিজ নিজ রাজধানীতে গৌতমবুদ্ধের অস্থি-অবশেষের ওপর স্তূপ নির্মাণ করিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।

গৌতমবুদ্ধের মহানির্বার্ণের একবছর পর রাজগৃহে প্রথম ধর্ম সম্মেলন হয়েছিল, সেখানেই “ত্রিপিটক” গ্রন্থ সংকলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বোধিলাভের পর প্রায় চুয়াল্লিশ বছর ধরে গৌতমবুদ্ধ যত ধর্মকথা এবং উপদেশ দিয়েছিলেন, সেগুলি তিনটি প্রধান বিভাগে সংকলিত হয়েছিল - বিনয়, সূত্র এবং অভিধর্ম। এই ত্রিপিটক বৌদ্ধধর্মের প্রধানতম এবং প্রথম ধর্মগ্রন্থ। একই সঙ্গে সঙ্কলিত হয়েছিল, গৌতমবুদ্ধের নিজের মুখে বলা পূর্বজন্মের কাহিনীগুলি – যার নাম ছিল “জাতক”। 


চলবে...



[1] কাঁক বা কঙ্ক -একধরনের বড়ো পাখি, সম্ভবতঃ হাড়গিলে [শব্দকোষ]।

[2] তক্ষশিলা – গান্ধার রাজ্যের রাজধানী – এই সময় পারস্য অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্যের একটি অঙ্গ রাজ্য ছিল। এই তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন ঋষি আত্রেয় পূর্ণবসু – অতএব ভারতীয় বিদ্দ্বজ্জনের সঙ্গে অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠতা ছিল – একথা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়।  

  চিত্রঋণঃ https://commons.wikimedia.org


সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫

এক যে ছিলেন রাজা - ৩য় পর্ব

 

[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে পড়া যায়, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাভক্ত ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগর ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। ভাগবৎ-পুরাণে মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়  (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়গুলিতে), তার বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ  করাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য।]


এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্র থেকে - "এক যে ছিলেন রাজা - ২য় পর্ব


 ভোজনের পর তিনজনে এসে বসলেন ঘরের দাওয়াতে। চারুকান্তি ঘর থেকে তিনটি উপাধান এনে দিয়ে গেল তিনজনকে। নিকোনো পরিচ্ছন্ন দাওয়ায় উপাধানে ভর দিয়ে আধশোয়া হলেন আচার্য যজ্ঞশীল। তাঁর বয়সে ভোজনের পর শরীর একটু বিশ্রাম চায়। আরামে তিনি চোখ বুজে রইলেন। বেদব্রত উপাধান নিয়ে আনমনে দেখতে লাগলেন অঙ্গনে একজোড়া কপোত-কপোতীর দাম্পত্য।

অনেকক্ষণ পর, আচার্য ধর্মধর খুব চাপাস্বরে বললেন, “গুরুদেব কি তন্দ্রার্ত?”

আচার্য যজ্ঞশীল উত্তর দিলেন, “না, না। ধর্মধর, বলো”।

“সমালোচনা করা উচিৎ নয়, কিন্তু তাও বলি, আজকের এই পরিস্থিতির জন্যে আমরাই কি দায়ী নই, গুরুদেব”?

“ঠিক কী কারণে, এমন বলছো, বলো তো, ধর্মধর?”

“মহারাজ অঙ্গ অপুত্রক ছিলেন, সে বরং ভালো ছিল। কিন্তু তাঁর এই নরাধম পুত্রের জন্যেই তো, আজ আমাদের এই অবস্থা, গুরুদেব। আর সেই পুত্রের জন্মের জন্যে দায়ী তো আমরাই”।

“সেই পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কথা বলছো, ধর্মধর? সেই যজ্ঞের পরমান্ন খেয়ে মহারাণি সুনীথা, বেণের মতো এক কুলাঙ্গার পুত্রের জন্ম দেবেন, এটা বুঝবো কী করে বলো দেখি! এই বেণকে দেখলে কেউ বলবে, যে এর পিতা মহারাজ অঙ্গ কী অসাধারণ রাজা ছিলেন! রাজ্য পরিচালনায়, প্রশাসনে, প্রজাদের মঙ্গলের জন্যে তিনি সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতেন! তোমরা তখন বালকমাত্র, তোমরা তো সেই সোনার দিনগুলি দেখনি। এমন আদর্শ রাজার মৃত্যুর পর, কোন অযোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতে চলে যাবে এই রাজ্যের শাসনভার, অথবা বিদেশী শত্রুদের আক্রমণে চুরমার হয়ে যাবে আমাদের সুন্দর এই জীবনযাত্রা, সেটা আমরা চাইনি। রাজা অপুত্রক, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হতোই, মহর্ষি ভৃগু একদিন সিদ্ধান্ত করলেন, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন”।       

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আচার্য যজ্ঞশীল যেন মনের মধ্যে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন, বছর কুড়ি আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাগুলি। তারপর আবার বললেন, “মহর্ষি ভৃগুকে মহারাজ অঙ্গ অগ্রজের মতোই শ্রদ্ধা করতেন আবার ভালোও বাসতেন। গুরুদেব ভৃগুর সঙ্গে পরামর্শ না করে কোন কাজই করতেন না। কিন্তু এই বংশরক্ষার ব্যাপারে মহারাজ অঙ্গ গুরুদেবের সম্পূর্ণ অবাধ্য ছিলেন। একান্ত বৈঠকে বহুবার গুরুদেব মহারাজ অঙ্গকে বোঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। মহারাজের একই কথা, এই জীবনে তিনি আর কোন মায়ার বন্ধনে জড়াতে চান না। অগত্যা রাজবৈদ্য বসুমিত্রর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হল, মহারাজ অঙ্গ ও রাণি সুনীথাকে যৌবনসঞ্জীবনী ওষধি প্রয়োগ করা হবে। এই ওষধি একই সঙ্গে স্বামীস্ত্রী উভয়েরই সেবন করা উচিৎ, অন্যথায় হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু কীভাবে এই প্রয়োগ সম্ভব? গুরুদেব ভৃগু তার উপায় ঠিক করলেন।

রাজা অঙ্গ ছিলেন স্বভাবতঃই ধর্মপ্রাণ, অতএব তাঁর কাছে পৌর্ণমাসী যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করলে তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যাবেন। রাণি সুনীথা অধর্মের পৌত্রী এবং মৃত্যুর কন্যা - কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে, যে কোন নারীর কাছে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সম্মান হচ্ছে মাতৃত্ব, গুরুদেব ভৃগু এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। রাণি সুনীথার উপস্থিতিতে গুরুদেব ভৃগু এই পৌর্ণমাসী যজ্ঞকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করলেন”।

হাসতে হাসতে আচার্য বেদব্রত বললেন, “এর পরের ঘটনা আমরা জানি, গুরুদেব। কারণ আমরাও সেই যজ্ঞে আপনার ও মহর্ষির সহকারী ছিলাম। যজ্ঞের অগ্নিতে ঘৃতাহুতির সময় আমাদের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতায় আপনার কপট তিরষ্কারের কথা মনে পড়লে আজও বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, গুরুদেব”।

আচার্য যজ্ঞশীল উচ্চ হাস্য করতে করতে উঠে বসলেন, বললেন, “গুরুদেবের নিয়ন্ত্রণে সেদিন অমোঘ নিয়তির মতোই পরিকল্পনা মতো সব কিছু কী সুন্দর ঘটে গেল। ভাবলে আজও অবাক লাগে। তোমাদের ইচ্ছাকৃত ভুলের আশ্চর্য ব্যাখা করলেন গুরুদেব। বললেন, মহারাজ এই যজ্ঞের মুখস্বরূপ অগ্নিদেব আপনার ঘৃতাহুতি অস্বীকার করছেন। কারণ আপনি অপুত্রক! হে মহারাজ, আপনি স্বয়ং তত্ত্বজ্ঞানী ধার্মিক, আপনি জ্ঞাত আছেন, অপুত্রক ব্যক্তির পিতৃঋণ শোধ হয় না। আপনি এই পৌর্ণমাসী যজ্ঞের আয়োজনে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন। হে মহারাণি, আপনাদের অপত্যলাভ হলেই আপনারা পিতৃঋণ মুক্ত হয়ে সার্থকজন্মা হয়ে উঠবেন”!

আচার্য ধর্মধর কিছুটা অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, “তখনকার মতো সব সুন্দর ঘটে গেল ঠিকই, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ঐ দুর্ঘটনা না ঘটলেই ভালো হত”।

“না, না। ধর্মধর। ঘটনার কুড়ি বছর পরে, আজ তার ফলাফল দেখে, আমাদের সেই কাজের দোষ গুণ বিচার করলে, তুমি ভুল করবে। আমি যদি বলি, এ সমস্তই পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য, আমরা সকলে নিমিত্তমাত্র। কী উত্তর দেবে, তুমি? সেদিন কেন রাজা অঙ্গ রাণির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অনুমতি দিয়েছিলেন? পুত্রেষ্টি যজ্ঞের পরমান্ন তাঁর হাতে আমরা তুলে দিলাম, তিনি তো সেই পরমান্ন সেবা নাও করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। মহারাজ অঙ্গের বংশরক্ষাও হয়েছিল। কিন্তু ধর্মের ঔরসে অধর্মের গর্ভজাত সন্তানের মধ্যে, অধর্মভাব এত প্রবল হবে, কারও পক্ষে এই অনুমান করা সম্ভব ছিল কি? দোষ আরোপ করে নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় এখন নয়, আমাদের এখন সমাধানের সূত্র খুঁজতে হবে!”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, আচার্য যজ্ঞশীল কিছুটা আত্মস্থভাবে আবার বললেন, “আমাদের হাতেই যেন তৈরি, মহারাজ অঙ্গের সেই শিশুপুত্র বেণ দিন দিন বড়ো হতে লাগল আমাদের সকলের চোখের সামনে। বাল্যকাল থেকেই সে হয়ে উঠল দুর্ধর্ষ দুরাচারী। তার এক একটা কীর্তির কথা আমরা শুনতাম আর শিউরে উঠতাম। খেলায় পরাজিত হলে সে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তার প্রতিপক্ষ সাথীকে। আতঙ্কিত সঙ্গী বালকরা তার সঙ্গে খেলায় সম্মত না হলে, জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। কতো অসহায় প্রজা উৎখাত হয়ে চলে গেছে দূর প্রদেশে, অন্য রাজ্যে! মৃগয়ায় নিষিদ্ধ জেনেও, বয়স্ক মৃগ ছেড়ে নিষ্ঠুরভাবে আহত করেছে মৃগশিশুকেভয়-ব্যাকুল বিকলাঙ্গ মৃগশিশুদের অকারণ দৌড় করিয়ে সে হেসেছে হা হা করে। সমস্ত নিষিদ্ধ খাদ্যেই তার ছিল আশ্চর্য অভিরুচি। নির্দিষ্ট ধর্ম অনুষ্ঠানে অনাচার করাই ছিল একমাত্র কর্তব্য। ধর্মভীরু প্রজাদের আতঙ্কে সে অট্টহাস্যে হেসেছে। এক কথায় সকল প্রকার অনৈতিক অনাচারেই তার আগ্রহ চিরকাল!

এইভাবেই সে বড়ো হয়ে উঠল। তার চারপাশে জড়ো হতে লাগল পাষণ্ড স্তাবকের দল। সকলেই সমান অনাচারী ও অত্যাচারী পিশাচআর আমাদের ধার্মিক রাজা, যাঁর সুবিচারে আমরা সবাই বিশ্বস্ত ছিলাম, আশ্বস্ত ছিলাম, গর্বিত ছিলাম। তিনি অন্ধ হয়ে রইলেন পুত্রের প্রতি। পুত্রের অত্যাচারে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাদের অর্থ দিয়ে ক্ষতিপূরণ করলেনকিন্তু পুত্রকে শাসন কিংবা তার শাস্তিবিধানের কোন চেষ্টাই করলেন না কোনদিন। নিজের এই দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। মাতা সুনীথার অন্ধ স্নেহে পুত্র বেণ ও তার দুরাচারী মিত্রদের প্রতাপ যত বাড়তে লাগল, রাজকার্যে মহারাজ অঙ্গ ততই নিস্পৃহ হয়ে উঠলেন। রাজকার্য থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সর্বদাই মগ্ন হয়ে রইলেন দেবপূজায়।

এরপর ধীরে ধীরে এসেই গেল সেই সংকটের দিন মহারাজ অঙ্গ কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ চলে গেলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। সে কী আত্মধিক্কারে, অনুশোচনায়? কোথায় গেলেন তিনি, বাণপ্রস্থে? এতদিনেও কেউ তাঁকে দেখতে পেল না কেন? নাকি এ রাজ-অন্তঃপুরেরই কোন অভাবনীয় মর্মান্তিক চক্রান্ত? মহারাজ অঙ্গের মতো মানুষের এমন রহস্যময় অন্তর্ধান! চিন্তা করা যায় না, ধর্মধর।

মহারাজা অঙ্গের অকস্মাৎ এই অন্তর্ধানে, যুবরাজ বেণের সিংহাসনে অভিষেক ছাড়া, সে সময় আর কোন উপায় রইল না। বেণ রাজা হলে সাধারণ রাজ্যবাসীর সমূহ সর্বনাশ জেনেও, আমাদের মেনে নিতেই হল সেই অভিষেক। আজ যে ঘোষণার ফলে আমরা সকলে বিচলিত, রাজা বেণের পক্ষে এই ঘোষণা এতটুকুও আশ্চর্যের নয়। মহারাজ অঙ্গের পুত্র রাজা বেণ আবাল্য দেবপূজা, যজ্ঞ-পার্বণ ও সনাতন-ধর্ম আচরণের বিরুদ্ধে।

প্রায় দেড় বছর হতে চলল রাজা বেণ সিংহাসন লাভ করেছে। মহারাজ অঙ্গের সমস্ত নির্দেশ, আদেশ, রীতিনীতি ভেঙে সে ক্রমাগত রাজ্যশাসন পদ্ধতির পরিবর্তন করে চলেছে। যতদিন যাবে, সে মুছে দেবে এই রাজ্যের সমস্ত সনাতন রাজধর্ম। অত্যাচার, অবিচার, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি হবে এই রাজধর্মের সমার্থক। হত্যার আতঙ্কে রুদ্ধ হতে থাকবে প্রতিবাদের স্বর, সমালোচনার কণ্ঠ। রাজ্য জুড়ে দেখা দেবে মাৎস্যন্যায়। রাজার স্নেহধন্য ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা মুখ বুজে সহ্য করতে হবে সাধারণ প্রজাদের”

বেশ কিছুক্ষণ পর আচার্য ধর্মধর অস্ফুটস্বরে বললেন, “এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের কী কোন উপায় নেই, গুরুদেব”? 

আচার্য যজ্ঞশীল পূর্ণ প্রত্যয় নিয়ে উত্তর দিলেন, “উপায় বের করতেই হবে, বৎস ধর্ম। নিশ্চেষ্ট ঘরে বসে হা হুতাশ করব, ভাগ্যের অজুহাতে মেনে নেব এই অন্যায়, এ হতেই পারে না। সফল হই কিংবা ব্যর্থ, চেষ্টা করতেই হবে। এই রাজার পতন চাই, এ ছাড়া অন্য আর কোন পন্থা নেই”। 

আচার্য বেদব্রত অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কীভাবে, গুরুদেব”? 

আচার্য যজ্ঞশীল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় নাড়লেন, তারপর বললেন, “জানি না, বেদআগামীকাল আমরা সকলেই মহর্ষি ভৃগুর আশ্রমে যাবো, তিনি কী চিন্তা করছেন দেখা যাক। ওই অসাধারণ মানুষটির মুখের দিকেই এখন মানুষ তাকিয়ে আছে। কিন্তু আজ আর বিলম্ব করো নাকথায় কথায় বেলা গড়িয়ে বৈকাল সমাগত। তোমরা ঘরে ফিরে যাও। দিনকাল ভালো নয়।  কাল মহর্ষির আশ্রমেই আমাদের আবার দেখা হবে। ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা করুন”।

আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত গুরুদেব যজ্ঞশীলের চরণ স্পর্শ করে যখন বিদায় নিলেন, রিক্ত-তেজ সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে।

 

 

সঙ্গীতের তুলনায় নৃত্যেই মহারাজা বেণের অত্যন্ত আসক্তি। নৃত্যের অনুষঙ্গে নারীর উপস্থিতি অনিবার্য। অতএব নৃত্য পটিয়সী নিত্যনূতন নারীতেও তাঁর অত্যন্ত অভিরুচি। নগরবিলাসিনী এই রূপসী নারীরা শুধু যে নৃত্যকলায় দক্ষ, তা নয়। আলাপ-আলোচনায় বিদূষী ও বিদগ্ধা, আচার-আচরণে অত্যন্ত সম্ভ্রান্তা, অথচ নম্র এবং বিনীতা। সাধারণ গৃহরমণীর মধ্যে এই গুণবত্তা একান্তই বিরল। তাঁর পরিচিত রাজকুমারীদের মধ্যে অনেকেই সুন্দরী, অনেকেই উচ্চশিক্ষিতা এবং আচরণে অত্যন্ত সম্ভ্রান্তা, কিন্তু তাঁরা সকলেই অত্যন্ত অহংকারী ও দুর্বিনীতা। অন্যদিকে সাধারণ নারী সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা, দেবদ্বিজে অত্যন্ত ভক্তিপ্রাণা এবং মাত্রাতিরিক্ত বিনয়ী। তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা, বিড়ম্বনার নামান্তর। মহারাজা বেণ একজন রূপসী নগরনটী ভিন্ন সমস্তগুণের এমন সুসমঞ্জস সমাহার, অন্য কোন নারীর মধ্যেই খুঁজে পান না। রহস্যময়ী এই নারীদের সঙ্গ তাঁকে অত্যন্ত তৃপ্ত করে।

নটী বিদ্যুল্লতা ভিন্ন রাজ্যের অধিবাসিনী হলেও, তাঁর রূপ ও গুণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। মহারাজ বেণের কানেও সে খ্যাতির সংবাদ পৌঁছে গেছে বহুদিন আগেই। এতদিন সাক্ষাৎ হয়নি, কারণ নটী বিদ্যুল্লতা জানতেন, এই রাজ্যের রাজা অঙ্গ অত্যন্ত ধার্মিক ও ঈশ্বর পরায়ণ। খুব স্বাভাবিক কারণেই, ঈশ্বরপরায়ণ প্রৌঢ় রাজার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহ, নটী বিদ্যুল্লতা অনুভব করেননি। অধুনা তিনি জানতে পেরেছেন, সেই পরমধার্মিক মহারাজা অঙ্গ রহস্যজনক বাণপ্রস্থে গিয়েছেন। এখন এই রাজ্যের সিংহাসনে বসেছেন তাঁর পুত্র যুবরাজ বেণ। এও শুনেছেন মহারাজ বেণ নৃত্যের পূজারী, কিন্তু কোন ধর্মের কিংবা দেবতার পূজায় বিশ্বাস করেন না।

কয়েকদিন আগে, অত্যন্ত গোপন এক আমন্ত্রণ পেয়ে, নটী বিদ্যুল্লতা এ রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁর গন্তব্য ছিল অন্যত্র। অন্যদিকে এই রাজ্যে তাঁর প্রবেশের সংবাদ পেয়ে, মহারাজ বেণ রাজদূত পাঠিয়েছিলেন। মহারাজ বেণ যে নটী বিদ্যুল্লতার সাক্ষাৎপ্রার্থী, সে কথা রাজদূতের মুখে শুনে, তিনি গন্তব্য পরিবর্তন করেছেন। গতকাল অপরাহ্নে তিনি রাজধানীতে এসে পৌঁছেছেন। রাজাবেণের প্রাসাদের সর্বোত্তম অতিথিশালায় আতিথ্য স্বীকারের জন্য, রাজা বেণ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন নটী বিদ্যুল্লতাকে। নটী বিদ্যুল্লতা তার প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিলেন, তিনিও রাজা বেণের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য অত্যন্ত উদ্গ্রীব! স্থির হয়েছে, আজ সন্ধ্যায় প্রাসাদের প্রমোদভবনে, মহারাজা বেণের সঙ্গে রূপসী নটী বিদ্যুল্লতার সাক্ষাৎ পরিচয় হবে। মহারাজ বেণ অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন, কেমন হবে নটী বিদ্যুল্লতার সঙ্গে তাঁর এই প্রথম সাক্ষাৎ!

মহারাজা বেণ আজও সকালে তাঁর উদ্যানবাটিকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। রাজ পথ নির্মাণের কাজ চলছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। উপনগরপাল শক্তিধর অত্যন্ত দক্ষতায় বাড়ি ভাঙার কাজ ও সেখান থেকে উপাদান সরবরাহের কাজ পরিচালনা করছেন। বাড়ি ভাঙার কাজে লিপ্ত আছে দেড়শতাধিক কর্মী এবং উপাদান সরবরাহ করে চলেছে শতাধিক শকট। কাজের প্রগতিতে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। আজ পরিদর্শন থেকে ফেরার পথে তাঁর মনে হল, এই উদ্যানবাটিকার উদ্বোধন নটী বিদ্যুল্লতার করকমলে হলে কেমন হয়? করকমল এবং চরণকমলও! এই উদ্যানবাটিকার নৃত্যশালায়, প্রথম নৃত্যের অনুষ্ঠান হবে নটী বিদ্যুল্লতার – এর চেয়ে ভালো শুভারম্ভ আর কী হতে পারে? এই ভাবনার কথা তিনি অন্য কাউকে বলেননি, তিনি আজ নিজেই নটী বিদ্যুল্লতাকে এই আমন্ত্রণ জানাতে চান

আসন্ন সাক্ষাতের রোমাঞ্চে তিনি এখন নিমগ্ন। নিজেকে রাজসিক সম্ভ্রান্তিতে সাজিয়ে তোলাই, এখন তাঁর কাছে সব থেকে জরুরি বিষয়। রাজসিক আচার আচরণে, নৃত্যকলার সূক্ষ্ম বিচারে, রসালাপে, তিনি বিস্মিত করে দিতে চান নটী বিদ্যুল্লতাকে। এই ভারতের বহু রাজার প্রশংসায় ধন্যা, নটী বিদ্যুল্লতার মুগ্ধ নয়নের ভাষায় তিনি পড়ে নিতে চান, সেই আকাঙ্ক্ষিত বার্তাটি - মহারাজা বেণ রাজা হিসাবে, ভূভারতে অনন্য।

ইষদুষ্ণ সুগন্ধী জলে স্নান করে এসে, তাঁর খাস ভৃত্যেরা তখন তাঁর গায়ে চন্দন তেল ও অগুরু চর্চা করছিল। অর্ধ শায়িত আরামে তিনি উপভোগ করছিলেন নিজ অঙ্গের সুবাস ও দক্ষ ভৃত্যদের অঙ্গ সংবাহন। তিনি নিমীলিত চোখে চিন্তা করছিলেন আসন্ন সন্ধ্যার অভূতপূর্ব রমণীয়তা। এমন সময়ে ধীর পায়ে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলেন রাজমাতা সুনীথা, তাঁর সঙ্গে এলেন তাঁর নিজস্ব দাসী পদ্মবালা। এই দাসী মহারাজা বেণের ধাত্রীমাতাও, আশৈশব বেণকে তিনিই মানুষ করে তুলেছেনমহারাজা বেণের ভৃত্যের দল নত হয়ে প্রণাম করল রাজমাতাকে এবং সরে দাঁড়াল কক্ষের অন্য প্রান্তে। নটী বিদ্যুল্লতার চিন্তায় মগ্ন মহারাজা বেণ, শরীরে ভৃত্যদের করস্পর্শ না পেয়ে, চোখ মেলে তাকালেন, আর তখনই দেখতে পেলেন মাতাকে।

অত্যন্ত অসময়ে নিজের কক্ষে মাতাকে দেখে প্রসন্ন হলেন না মহারাজা বেণ, তিনি উঠে বসে বললেন, “প্রণাম, মাতঃ এই অসময়ে তুমি আমার কক্ষে? আমাকে ডেকে পাঠালেই পারতে!”

“মঙ্গল হোক বৎস, কিছুক্ষণ আগে কিছু অদ্ভূত সংবাদ শুনে স্থির থাকতে পারলাম না। জানি আজ প্রমোদ কাননে তোমার বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে, তাও আসতে বাধ্য হলাম”।

“কী এমন সংবাদ, মাতঃ, যার জন্যে তুমি এমন বিচলিতা হলে?”

“তুমি নাকি কিছুদিন আগে শ্রীবিষ্ণুমন্দিরের পুরোহিত বৃদ্ধ বিষ্ণুদাসকে কষাঘাতে জর্জরিত করে, রাজপথের স্তম্ভে বেঁধে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলে? তাঁর অপরাধ তিনি তাঁর ধর্ষিতা কন্যার জন্য বিচার চাইতে এসেছিলেন! এবং অভিযোগ সেই ধর্ষণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিল তোমার বাল্যবন্ধু শক্তিধর, যে এখন তোমার প্রসাদে এই রাজ্যের উপনগরপাল?”

“এ সংবাদ সত্য। কিন্তু শক্তিধর এই ঘটনায় লিপ্ত নয়”।

“কী ভাবে জানলে, পুত্র বেণ? তুমি কি অনুসন্ধান করেছিলে?”

“না, অনুসন্ধান করার প্রয়োজন অনুভব করিনি। কারণ শক্তিধর অত্যন্ত বিশ্বস্ত। আর যদি শক্তিধর অপরাধী হয়েও থাকে, সামান্যা এক দুশ্চরিত্রা রমণীর জন্যে শক্তিধরকে ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শক্তিধর আমার প্রশাসনের স্তম্ভ”।

“অনুসন্ধান ছাড়াই তুমি কী করে বুঝতে পারলে, বৎস, যে ওই কন্যা দুশ্চরিত্রা? আজ সন্ধ্যায় যার সঙ্গে মিলনের জন্যে তুমি উন্মুখ হয়ে আছো, সেও কি দুশ্চরিত্রা নয়? নটী বিদ্যুল্লতাকে যদি তোমার প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অনেকে মিলে ধর্ষণ করে, তুমি কি তাদেরও কোন বিচার করবে না, পুত্র?”

রাজমাতার এই প্রশ্নে তীব্র জ্বালা অনুভব করলেন মহারাজা বেণ, ক্রোধে অগ্নিস্রোত বইতে লাগল শিরায় শিরায়। ক্রোধ সংবরণ করে, তিনি তীব্র চোখে মাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নটী বিদ্যুল্লতার সঙ্গে আমি এমন ঘটতে দেব না, মাতঃ। আর ঘটলেও অপরাধীদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করবো, সে যেই হোক না কেন!”

“অতএব, তোমার বিচার আসলে নিজের স্বার্থরক্ষাতুমি দুর্বলের উপর অত্যাচারী এবং সবলের অনুগত। তুমি বিলক্ষণ জানো নটী বিদ্যুল্লতা যে রাজার পালিতা কন্যা ও যে রাজ্যের নাগরিকা, তার কিছু হলে, তাঁরা তোমার রাজত্ব বিপন্ন করে তুলবেন। আর সেই কারণেই তুমি এই দুশ্চরিত্রা নটীকে রক্ষা করবে, আর দুশ্চরিত্রা নয় বুঝেও তুমি দুর্বল ব্রাহ্মণকন্যার কোন বিচার করবে না”।

ক্রুদ্ধস্বরে মহারাজা বেণ প্রশ্ন করলেন, “সেই বৃদ্ধ এখন মৃত, মৃতা সেই নারীও। এতদিন পরে তুমিই বা কী করে জানলে, যে ওই ব্রাহ্মণকন্যা অসতী নয়?”

মহারাজা বেণের এই কথার উত্তর না দিয়ে রাজমাতা সুনীথা নিজের মনেই বললেন, “আমার পিতার নাম মৃত্যু। আমার পিতামহ অধর্ম। শুনেছি, ভগবান বিষ্ণুর প্রজাসৃষ্টির আদেশে স্বয়ং ব্রহ্মার পিঠ থেকে আমাদের বংশের সৃষ্টিপূজা-পার্বণ-ব্রত-যজ্ঞ পালনের যে ধর্ম, সে ধর্ম আমরা মানি না। সেই কারণে সমাজের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় আমাদের অধর্ম বলে থাকেন। কিন্তু তাঁরা কদাচ আমাদের অনাচারী, অত্যাচারী, দুরাচারী বলেননি। কিন্তু এখন থেকে বলবেন! পুত্র, তোমার এই বীভৎস দুরাচারে স্বয়ং অধর্মও শিউরে উঠবে।

আরো শুনলাম, তোমার প্রমোদবাটিকা যাবার পথের সংস্কারের জন্য তুমি অজস্র গৃহস্থকে গৃহহারা করেছ? তাদের ভাঙা বাড়ির পাথর ও ভাঙা ইঁটের টুকরো বিছিয়ে বানিয়ে তোলা মসৃণ পথে তোমার বিলাসের রথ দৌড়বে! মহারাজ অঙ্গের পুত্র হয়ে তুমি এমন কদর্য অত্যাচারের কথা কী করে ভাবতে পারলে, পুত্র? ওই গৃহহারা মানুষগুলির পুনর্বাসনের কথা কিছু চিন্তা করেছ?”

ক্রুদ্ধ বিরক্ত মহারাজা বেণ উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, “তুচ্ছ এই সব ঘটনার কথা কে তোমার কানে তুলছে, মাতঃ। এ রাজকার্য, এ রাজ-সিদ্ধান্ত। তুমি অন্তঃপুরিকা নারী,  রাজকাজে হস্তক্ষেপ অথবা সে সম্পর্কে অনভিপ্রেত মন্তব্য আমার সহ্য হয় না, মাতঃ। এ আমার বিরুদ্ধাচরণ, এ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! একজন রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অর্থাৎ রাজদ্রোহিতাঅত্যন্ত আপনজন হলেও রাজদ্রোহিতা আমি কোনভাবেই সহ্য করবো না”

পুত্র মহারাজা বেণের এই সতর্কবার্তায়, রাজমাতা সুনীথা বিষণ্ণ হাসলেন, বললেন, “তোমার পিতাকে আমি তিরিশ বছরের অধিক রাজত্ব করতে দেখেছি, পুত্র। একদিনের জন্যেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন নিন্দাবাক্য শুনিনি। তুমি মাত্র দেড় বছর, তাঁর সিংহাসনে বসেছ, তোমার নামে নিত্য নতুন অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি! কিছুদিন আগেও অসহায় প্রজারা আমার কাছে আসত সুবিচারের আশায়, সুবিচার না পেলেও, অন্ততঃ একটু সহানুভূতির আশায়! বেশ কিছুদিন হল, তারা আর আসে না। হয়তো তারা মনে করে আমি প্রত্যক্ষভাবে নাহলেও পরোক্ষে তোমাকেই সমর্থন করি”।

অত্যন্ত ক্রুর চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে মহারাজা বেণ বললেন, “তার মানে তুমি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোন ভাবেই আমাকে সমর্থন করো না! আমাকে পুত্র হিসাবে তুমি সমর্থন করলে কিংবা না করলে তাতে খুব ইতর বিশেষ হয় না! কিন্তু মহারাজ বেণের প্রতি তোমার সমর্থন নেই এবং সে কথাটা স্বীকার করতেও তোমার ভয় করলো না, এটা ভয়ংকরএ নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব, মাতঃ, এখন আর সময় নেই, তুমি এখন আসতে পারো। এক বিশেষ অতিথির সঙ্গে আজ সন্ধ্যায় আমার সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট আছে”।

“সেই বিশেষ অতিথি তো সুন্দরী সতী বিদ্যুল্লতা, না”? রাজমাতা সুনীথার কণ্ঠে তীব্র শ্লেষ।

আচমকা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মহারাজা বেণ, তীব্র হুংকারে বলে উঠলেন, “চুপ করো দুর্বিনীতা রমণী। মনে কোর না, শুধু মাত্র রাজমাতা বলেই তুমি যা খুশি বলে যাবে, আর আমিও নিশ্চেষ্ট বসে থাকব! মহারাজা বেণ বিরুদ্ধাচরণ এবং অযাচিত উপদেশ কোনটাই সহ্য করে নি, করবেও না। সে মহারাজ অঙ্গই হোক কিংবা তুমি !”

মহারাজ বেণের এই কথায় শিউরে উঠলেন রাজমাতা সুনীথা। বিস্ফারিত নেত্রে পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে কী তুই পিতা মহারাজ অঙ্গকে হত্যা করে, এই সিংহাসন অধিকার করেছিস?”

এতক্ষণ রাজমাতা ও মহারাজা বেণের আলাপে, দাসী পদ্মবালা কোন কথাই বলে নি, এখন ব্যাকুল হয়ে বলল, “মহারাণি, তোমরা দুজনেই এখন অত্যন্ত উত্তেজিত। উত্তেজনার বশে মানুষ স্বাভাবিক বিবেচনা হারায়। এই কক্ষের মধ্যে অনেক দাসদাসী রয়েছে, তারা সকলেই এই আলোচনা শুনছে। আমাদের উচিৎ এই মূহুর্তে এই কক্ষ ত্যাগ করে চলে যাওয়া। উত্তেজনার প্রশমন হলে, শান্তভাবে এই আলোচনা পরে কোনোদিন আবার করা যাবে”!

মহারাজা বেণ দাসী পদ্মবালার কথায় কিছুটা শান্ত হলেন, তিনি ওঁদের দুজনের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজমাতাকে বিদায় প্রণাম জানানোর কথা তাঁর মনেও এলো না। রাজমাতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পুত্রের চওড়া বলিষ্ঠ কাঁধের দিকে, তারপর কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন। তাঁর দু চোখে তখন অশ্রুর ধারা। 

 

 

বিস্তৃত এই মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই চোখ জুড়িয়ে যায়, অন্তরে প্রশান্তির অনুভব আসেগাছপালা, লতাগুল্ম, ফুলের গন্ধ, ভ্রমরের গুঞ্জন সব কিছু মিলিয়ে উপবনের পরিবেশ। গাছের ছায়াঘন এই উপবনের মধ্যেই শিষ্যদের পাঠঘর, গ্রন্থাগার, শিষ্য ও শিষ্যাদের আলাদা আবাস। আচার্য ও অন্যান্য অধ্যক্ষদের আবাসও আছে এই মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। সেখানে তাঁরা অনেকেই সপরিবারে থাকেন। তাঁদের পুত্রকন্যারা এই মহাবিদ্যালয়ের আশেপাশের অন্য পাঠশালায় পড়তে যায়। ভিন্ন রাজ্য থেকে অথবা এই রাজ্যেরই দূরাগত অতিথিদের জন্যেও অনেকগুলি আবাস আছেতবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যখন একই সঙ্গে অনেক সম্মানীয় মানুষজনের সমাগম ঘটে, তখন তাঁদের জন্য আলাদা করে অস্থায়ী শিবির বানিয়ে দিতে হয়। এই উপবনের মধ্যে সে জায়গাও আলাদা করে রাখা আছে। কোন সময়ে, কোন কারণেই এই মহাবিদ্যালয়ে শৃঙ্খলার কোন বিচ্যুতি ঘটে না।

শিষ্যদের আবাসের পিছনে আছে পাকশালা। সেখানে আবাসিক ছাত্র, ছাত্রীদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা। আবাসিক অধ্যক্ষদের যাঁরা সপরিবারে বাস করেন না, তাঁরাও এই যৌথ পাকশালার রন্ধনই আহার করেন। দূরাগত অতিথিদের জন্যও এই পাকশালা থেকেই আহারের বন্দোবস্ত হয়ে থাকে। এই মহাবিদ্যালয়ের মহাপাকশালায় অহোরাত্র যে অদ্ভূত কর্মযজ্ঞ চলে, তা অত্যন্ত আশ্চর্যের!

পাকশালার বামদিকে সারি সারি গোলায় এই আশ্রমের শস্যভাণ্ডার। সেইসব গোলায় সঞ্চয় করা থাকে গোধূম, ব্রীহি, নানান ধরনের ডাল, মটর, চণক, তিল, সরিষা, এরণ্ড ইত্যাদি শস্য। সূর্যোদয় থেকেই বলদে টানা সারিসারি যাঁতাকলে ঘরঘর শব্দে শস্য চূর্ণ হয়, কাষ্ঠ-ঘানিতে প্রস্তুত হয় তেল। সারি সারি ঢেঁকির একটানা ছন্দে ব্রীহি থেকে বের হয়ে আসে তণ্ডুল দানা। মহিলা কর্মীদের কুলোর একটানা সপ-সপ শব্দে, ডালের ভূষি, ধানের তুষ ঝেড়ে বের হয়ে আসে পরিচ্ছন্ন খাদ্য শস্য। তিল ও সরষে থেকে উৎপন্ন তেল প্রধানতঃ ব্যবহার হয় রান্নার জন্যে এবং প্রসাধনের জন্যে। রেড়ি থেকে উৎপন্ন তেলে সন্ধের পর দীপ জ্বালানো হয়। গমের চূর্ণে জল দিয়ে কাঠের বিশাল পাত্রে মণ্ড বানায় কিছু লোক। কিছু লোক মণ্ড থেকে কাঠের চাকি বেলুনে পুরোডাশ বেলেই চলেছে সারাটাদিন। কিছুলোক আগুনের চুল্লিতে সেই পুরোডাশ নিরলস সেঁকে চলেছে। অন্যদিকে লোহার কিংবা তামার বড় বড় পাত্রে, রান্না হচ্ছে ডাল, ভাত, সবজি। রুটি সবজি ডাল সাধারণের জন্যে। ভাতের পরিমাণ অল্প, সম্মানীয় অতিথি কিংবা অসুস্থ আবাসিকের পথ্যের জন্য।

পাকশালা থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণদিকে রয়েছে বিশাল গোশালা। বহুবছর আগে মহারাজ অঙ্গ আটশটি গরু ও মহিষ এই আশ্রমকে দান করেছিলেন। এই আশ্রমে প্রতিপালিত হতে হতে তাদের সংখ্যা এখন দুই সহস্রেরও অধিক। এই গাভীদের পরিচর্যা করে দক্ষ গোপজন। প্রত্যেকদিন সকালে, বিকালে যে দুধ উৎপন্ন হয়, তার অনেকটাই আহারের জন্যে ব্যয় হয়। বাকি দুধ থেকে তৈরি হয়, ঘি, মাখন ও দধি। আশ্রমে উৎপন্ন শস্যের ভূষি, খোল, ভাতের ফ্যান, আনাজের খোসা, কিছুই ফেলা যায় না, গবাদির খাদ্যে ব্যবহৃত হয়।

এই বিশাল আয়োজনের অধিকাংশ উপাদানই আসে আশেপাশের দুইশত গ্রাম থেকে। মহারাজা অঙ্গ এই গ্রামগুলি আশ্রমকে নিষ্কর দান করেছিলেন। সেই সকল গ্রামে উৎপন্ন যাবতীয় শস্য ও পণ্যের এক পঞ্চমাংশের অধিকারী এই আশ্রম। ওই সমস্ত গ্রাম থেকে যেমন খাদ্য শস্য আসে, তেমনই আসে জ্বালানি কাঠ, গবাদি পশুর খাদ্য বিচালি খড়, কুমোরের তৈরি মাটির তৈজসপত্র, কামারের তৈরি নানান সরঞ্জাম। সূত্রধরের তৈরি কাঠের আসবাব, তাঁতির তৈরি বস্ত্র, উড়নি, গামছা। আশ্রমের সদর প্রবেশ পথ ছাড়াও আরো একটি প্রবেশ পথ আছে। সে পথ সাধারণের জন্যে নয়। সে পথে সারাদিন গোশকট ও অশ্ব-শকটের জটলা। আশ্রমের প্রয়োজন অনুযায়ী, দূর দূর গ্রাম থেকে তারা বয়ে আনে শস্য, সব্জি, কিংবা নানান পণ্য। সে প্রবেশ পথের দায়িত্বে থাকেন আশ্রমের দক্ষ করণিকগণ। তাঁরা হিসাব রাখেন, কোন গ্রাম থেকে কোন ব্যক্তি কী কী সম্ভার পাঠালো। এই আশ্রমের আয় ও ব্যয়ের যাবতীয় হিসাব রাখতে তাঁরা সর্বদা তৎপরএই দক্ষ করণিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছেন, যাঁরা সারা বছরই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ান উৎপন্ন শস্য ও পণ্যের পরিমাণ গণনা করতে। আশ্রমের প্রাপ্য অংশের আদায় এবং অনাদায়ী শস্য ও পণ্যের পরিমাণ ও অনাদায়ের কারণ বুঝতে।

বিপুল এই মহাবিদ্যলয়ের কর্মকাণ্ড সম্যক না জানলে, এর ব্যাপ্তি বুঝে ওঠা যায় না। প্রত্যেকটি বিভাগের জন্যেই একজন করে অধ্যক্ষ ও সহ-অধ্যক্ষ নিযুক্ত আছেন এবং সবার উপরে আছেন মহর্ষি ভৃগু। প্রত্যকটি বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের তিনি স্বাধীন কাজ করার প্রশ্রয় দেন, অথচ সকলের উপরেই থাকে তাঁর ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণবিভিন্ন সূত্র থেকে তিনি গোপনে নানান তথ্য সংগ্রহ করেন। এই আশ্রমের প্রাঙ্গণে, বাইরের দুইশত গ্রামে, এমনকি সমস্ত রাজ্যের প্রত্যেক প্রান্ত থেকেই তিনি গোপনে নিয়মিত তথ্য ও বার্তা পেয়ে থাকেন তাঁর অনুগত শিষ্যদের থেকে। তাঁর গোপনে পাওয়া এই তথ্যের সঙ্গে তিনি মিলিয়ে নেন তাঁর আশ্রম-করণিকদের তথ্যসমূহ। খরা, বন্যা কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের থেকে তিনি আশ্রমশুল্ক আদায়ের নিয়ম শিথিল করেন। কোন কোন দুর্নীতিগ্রস্ত করণিক উৎকোচ গ্রহণ করে, অথবা ভয় দেখিয়ে অতিরিক্ত শুল্ক আদায় করে। কিংবা আদায় হওয়া শুল্ক নিজেই আত্মসাৎ করে কোন কোন করণিক। সে তথ্যও তাঁর কাছে চলে আসে নিয়মিত প্রয়োজন মতো দোষী করণিকের কঠোর শাস্তিবিধান তিনিই করেন।

এই মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনা এক অর্থে ছোট একটি রাজ্য পরিচালনার মতোই জটিল। আর এই জটিল কর্মকাণ্ডটি ঘটে চলেছে মহর্ষি ভৃগুর বিচক্ষণ পরিচালনায়। সেই কারণেই এই মহাবিদ্যালয়ের এতো সুনাম ও সাফল্য।

 

 

পরের দিন সকালে আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত যখন মহর্ষি ভৃগুর গৃহদ্বারে এসে দাঁড়ালেন, মহর্ষি ভৃগু তখন কক্ষেই ছিলেন, কিন্তু তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসেননি। তাঁর আসনের সামনে তিনি পদচারণা করছিলেনপিছনের দিকে একহাতে অন্য হাতটি ধরে তিনি কোন আলোচনায় ব্যস্ত। আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত দরজায় অপেক্ষমাণ রইলেন, মহর্ষিকে বিরক্ত করলেন না। কক্ষের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পদচারণার পর, মহর্ষি যখন ঘুরে দাঁড়ালেন, দেখতে পেলেন ওঁদের দুজনকে। হাসিমুখে বললেন, “আরেঃ, ধর্মধর, বেদব্রত, কতক্ষণ এসেছ? দ্বারে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসে বসো”।

তাঁরা মহর্ষির চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলেন, স্মিত মুখে মহর্ষি আশীর্বাদ করে বললেন, “তোমরা দীর্ঘজীবি হও। গৃহের সব সংবাদ কুশল তো?”

আচার্য বেদব্রত বললেন, “আজ্ঞে হ্যাঁ, গুরুদেব”।

“বেশ, বেশ। যাও, আসনে বস। তোমাদের গুরু যজ্ঞশীল তো আগেই এসে পড়েছেন”।

 

অনেকের মধ্যে জায়গা বের করে আচার্য ধর্মধর ও বেদব্রত আসনে বসলেন। মহর্ষি ভৃগু স্মিতমুখে তাঁদের আসনে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। কক্ষে উপস্থিত সকলে তাঁর কথা শোনার জন্যে উন্মুখ।

সকলের মুখের দিকে একবার দেখে, মহর্ষি বললেন, “রাজার আদেশে তোমরা সকলে বিচলিত, আমি জানিআমিও বিচলিত। আমি কিন্তু কোন হঠকারি সিদ্ধান্তের পক্ষপাতী নই। আমি চাই না, আমার একজনও শিষ্য কারার অন্তরালে তার জীবন অতিবাহিত করুক অথবা আমার কোন শিষ্যের প্রাণদণ্ড হোকএখানে উপস্থিত এবং অনুপস্থিত সকল শিষ্যই আমার অত্যন্ত প্রিয়, আমার সন্তানের মতো। এমন কী আমার শিষ্য নয়, কিন্তু এই রাজ্যের অধিবাসী সাধারণ মানুষও রাজার কোপ-দৃষ্টিতে পড়ে অত্যাচারিত হোক, এ আমি চাই না”।

কিছুক্ষণ নির্বাক পদচারণার পর, মহর্ষি আবার বললেন, “প্রজা হিসাবে, রাজার আদেশ পালন করা আমাদের সকলেরই অবশ্য কর্তব্য। না হলে প্রজাদের সমূহ সর্বনাশের সম্ভাবনা। প্রজাদের অকল্যাণে রাজারও ক্ষতি, এই বোধ আমাদের বর্তমান রাজার নেই। অতএব, আমাদের রাজার আদেশ মান্য করা ছাড়া আপাততঃ অন্য কোন উপায় নেই। এ আমাদের দুঃসময়। ঘোরতর দুঃসময়। কিন্তু ধৈর্য ধরে অনুকূল সময়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যতদিন সেই অনুকূল সময় না আসে, আমাদের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধির বিরুদ্ধে হলেও, রাজার আদেশ আমাদের পালন করতেই হবে। আমাদের সনাতন সংস্কারের বিরুদ্ধে হলেও রাজার অনাচারেই সায় দিতে হবে”।

“মার্জনা করবেন, গুরুদেব। কবে সেই অনুকূল সময় আসবে, সেই আশায় আমাদের ইষ্ট দেবতার পুজা বন্ধ করে, পুজার বেদিতে বসাব দুরাচারী এক রাজার প্রতিমা? অগ্নিদেব নন, নিজ নিজ গৃহের গৃহদেবতারা নন, আচার্য যজ্ঞশীলের কন্যার পুণ্যবিবাহ হবে সেই দুর্মতি রাজাকে সাক্ষী মেনে? এ আমার পক্ষে মান্য করা সম্ভব নয়, গুরুদেব”। আচার্য রণধীর মহর্ষির বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেন, কিছুটা উদ্ধত স্বরেই! “একটি কুমারী কন্যার বিবাহের মতো অত্যন্ত পুণ্য অনুষ্ঠানের এমন বীভৎস পরিবর্তন, সঠিক অর্থেই অনাচার – মহাপাপ, গুরুদেব। এই মহাপাপের ভাগী হওয়ার থেকে প্রতিকারের চেষ্টায় মৃত্যুবরণ করাও আমার মতে অনেক বেশী মঙ্গলদায়ক”

আচার্য রণধীর, এই আশ্রমেই সমরবিদ্যা বিভাগের অধ্যক্ষ। তাঁর সফল অধ্যাপনায় বহু কৃতী ছাত্র, এই রাজ্যের এবং এই ভারতভূমির অন্যান্য রাজ্যেরও সেনাধ্যক্ষ, সহ-সেনাধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করছেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করে, সম্মুখ সমরে এই অত্যাচারি রাজার পতন ছাড়া অন্য কোন সহজ উপায় নেই, আচার্য রণধীরের এটাই অভিমত। তাঁর ডাকে ও প্ররোচনায় তাঁর অনেক শিষ্য সেনাধ্যক্ষ নিজ নিজ সেনাদল নিয়ে রাজধানীতে উপস্থিত হতেই পারেন।

আচার্য রণধীরের কথার উত্তরে আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “ভাই, রণধীর, আমার মনে হয় সঠিক সময় আর উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া যে কোন যুদ্ধেই অকারণ সম্পদ ক্ষয় ও প্রাণনাশ হয়। এমনকি যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্যও অনেক সময় ফলপ্রসূ হয় না। এই সংকট কালে আমাদের উচিৎ মাথা ঠাণ্ডা রেখে সঠিক পরিকল্পনা। যদিও এই অপশাসনের পরিবর্তন ছাড়া অন্য উপায় নেই। তবুও সব দিক ভেবে চিন্তে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়াটাই বিবেচনার কাজ হবে। এ কথা ভুললে চলবে না যে, এই নির্দেশের ফলে রাজ্যে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা রাজাও নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছেন তিনি যে সেই বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের জন্যে, লোকচক্ষুর আড়ালে প্রস্তুতি নিচ্ছেন না, কে বলতে পারে? রাজশক্তি প্রতিবাদী কণ্ঠের থেকে সর্বদাই সবল হয়ে থাকে, রণধীর”।  

আচার্য রণধীরের মতো, আচার্য সুনীতিকুমার এই আশ্রমের রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ। তাঁর বিদ্যা ও মেধার সুখ্যাতি ভারতবর্ষের শিক্ষিত মহলে সুবিদিত। তাঁর অনেক সফল শিষ্য এই দেশের অনেক রাজার মুখ্য উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োজিত। এই রাজ্যের মুখ্য উপদেষ্টাও ছিলেন, তাঁর এক অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। নতুন রাজা সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তিনি এখন প্রতিবেশী মিত্র রাজ্যের মুখ্য উপদেষ্টা।

মহর্ষি এতক্ষণ স্মিতমুখে তাঁর দুই প্রিয় শিষ্যের কথা শুনছিলেন। তিনি জানেন রাজা বেণের এই অদ্ভূত নির্দেশিকায় প্রত্যেকটি মানুষই বিপন্ন। পিতৃ-পিতামহের থেকে বংশ পরম্পরায় অর্জন করা, বিশ্বাস ও সংস্কারে আঘাত লাগলে এমনই হয়। তিনি বাধা দিচ্ছেন না, তিনি নিজের অভিমত চাপিয়ে দিতে চাইছেন না। সকলের মনের আবেগ ও ক্ষোভের কথা তিনি শুনতে চাইছেন। বিভিন্ন মানুষের ক্ষোভ আর আবেগের মিলিত শক্তি থেকেই তিনি গড়ে তুলবেন এই রাজাকে সিংহাসন থেকে অপসারণের নির্দিষ্ট অভিমুখ।

দুজনের বক্তব্য শেষ হয়ে যাবার পর, আরেকবার সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “এখানে উপস্থিত তোমরা সকলেই অত্যন্ত মেধাবী বিদ্বান ব্যক্তিত্ব। তোমরা সকলেই অসাধারণ। কখনো কি ভেবে দেখেছ, সাধারণ মানুষের কথা? যারা জমিতে ফসল ফলায়, গ্রামে গ্রামে যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গড়ে তোলে নানান সামগ্রী। দুর্গম দূর দেশে দেশে ঘুরে যারা বাণিজ্য ক’রে, বাঁচিয়ে রাখে আমাদের অর্থনীতি? তারা সকলেই আজ বিহ্বল, দিশাহারা। এর মধ্যে আমরা, এই বিদ্বানেরা যদি এখনই একটা গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে তুলি, তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আচার্য রণধীর, আমি স্থির বিশ্বাস করি, তোমার ইশারাতে আমাদের এই রাজ্যের সেনাবাহিনীর অনেকাংশ এবং প্রতিবেশী রাজ্যের সেনাবাহিনীরা আমাদের সমর্থনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

কিন্তু রাজ্যের প্রত্যেকটি অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা, রাজার অন্নে প্রতিপালিত সেনাবাহিনীরা ঝাঁপিয়ে পড়বে এই সাধারণ মানুষের ওপর। আমরা রাজধানী অবরোধ করে, রাজাকে হয়তো সরিয়ে ফেলব। কিন্তু রাজার অনুগত সেনারা তাদের আক্রোশ মেটাবে, গ্রামের সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করে, হত্যা করেতারা ছারখার করে দেবে আমাদের গ্রামীণ সমাজকে, ভেঙে দেবে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিকে। বাইরের রাজ্য থেকে সাহায্য করতে আসা সেনাবাহিনী, যুদ্ধজয়ের বিনিময়ে কি চাইবে আমাদের থেকে? আমাদের নিরঙ্কুশ বশ্যতা! অথবা তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য, দাবি করবে, বিশাল অর্থ। সে অর্থ পূরণ করতেই, আমাদের রাজকোষ হয়তো শূণ্য হয়ে যাবে একমাত্র সূর্য, চন্দ্র, মেঘ, বায়ু এবং সবার উপরে পরমেশ্বর ছাড়া জগতে কোন সাহায্যই নিঃস্বার্থ হতে পারে না। সেই শূণ্য রাজকোষ ভরে তুলতে, সাধারণ প্রজাদের উপর নতুন কর চাপাতে হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সাধারণ মানুষের কাছে, সেটাও হয়ে উঠবে আরেক অসহ্য অত্যাচার।”

“গুরুদেব, আপনার অনুমান নির্ভুল, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আপনি নিশ্চয়ই কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছেন। দয়া করে আপনি পরামর্শ দিন। আমরা এই রাজাকে সিংহাসন থেকে টেনে নামাতে চাই, গুরুদেব। সে যে কোন পন্থাই হোক”। আচার্য রণধীর দৃঢ় প্রত্যয়ের স্বরে বললেন।

সকলেই তাঁর কথায় সমর্থন করে বলে উঠল, “আপনি আমাদের পথ দেখান, গুরুদেব। আমরা আপনার নির্দেশে যে কোন কাজের জন্যে প্রস্তুত”।

 

প্রসন্ন মুখে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “ধৈর্য ধরো। আমার বিশ্বাস আছে তোমাদের প্রজ্ঞায়। আমার প্রতি তোমাদের অখণ্ড আস্থাতেও আমার বিশ্বাস আছে। যেদিন বিশ্বপ্রভ হাট থেকে ফিরে প্রথম আমাকে এই রাজ আদেশের কথা শোনালো, তার অনেক আগে থেকেই আমার পরিকল্পনার শুরু হয়ে গেছে চোখের আড়ালে কিছু কিছু কাজ শুরুও হয়ে গেছে। প্রিয় বেদব্রত, তুমিও ওইদিন সেই হাটে উপস্থিত ছিলে শুনেছি, বিশ্বপ্রভ ফিরে এসে তোমার কুশল সংবাদ দিয়েছিল”।                                           

“হ্যাঁ, গুরুদেব”। আচার্য বেদব্রত বললেন।

“আমার পরিকল্পনা, একটু জটিল। সম্পূর্ণ হতে তিন থেকে চার মাসাধিক অথবা তারও অধিক সময় লাগতে পারে। প্রিয় রণধীর, তোমার যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করতেও ওইরকমই সময় লাগার কথা। আজ থেকে মাস দেড়-দুই পরেই আমাদের রাজ্যে পূর্ণ বর্ষার কাল, সে সময় যুদ্ধঘোষণা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত হবে না। অর্থাৎ শরৎ কিংবা হেমন্তের আগে আমাদের যুদ্ধ শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, তাই তো, বৎস রণধীর?”

“আপনার বিশ্লেষণ অভ্রান্ত, গুরুদেব”। আচার্য রণধীর মেনে নিলেন মহর্ষির কথা।

“তার অর্থ, বৎস রণধীর, আমি তোমার থেকে খুব একটা বেশি সময় চাইছি না। আমার এই পরিকল্পনার মধ্যে, প্রিয় শিষ্যগণ, কোন বীরত্ব নেই। বরং তাত্ত্বিকভাবে যারা নীতিনিষ্ঠ তাদের কাছে এই পরিকল্পনাকে এক ধরনের শঠতা বলেই মনে হবে। সে হোক। আমি আবার বলছি, সে হোক। শঠতা দিয়ে আমরা যদি রক্ষা করতে পারি শতশত প্রাণ, শঠতা দিয়ে যদি রক্ষা করতে পারি অসংখ্য সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। সে শঠতায় কোন অন্যায় নেইপ্রিয় সুনীতিকুমার আমাকে নিশ্চয়ই সমর্থন করবে যে, রাজনীতিতে শাঠ্যও একটি স্বীকৃত নীতি”।

মহর্ষি আচার্য সুনীতিকুমারের দিকে তাকালেন। আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “রাষ্ট্রনীতির পাঠ আমি আপনার থেকেই শিখেছি, গুরুদেবউপরন্তু দীর্ঘদিন রাষ্ট্রনীতির চর্চা করে এটুকু উপলব্ধি করেছি, গুরুদেব, যে কোন যুদ্ধেই বিবাদী দুই পক্ষেরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়। যারা পরাজিত হয় তাদের তো বটেই, যারা জয়ী হয়, তাদেরও ক্ষতি হয় সমপরিমাণেই। অতএব দণ্ড অর্থাৎ প্রত্যক্ষ যুদ্ধের আগে, সাম, দান অথবা ভেদনীতিতে যদি উদ্দেশ্য সফল হয়, তার থেকে শুভ আর কিছু হতে পারে না।”

“সে কথা সত্য। কিন্তু অধীত বিদ্যাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া অনেক সময়, সহজ নাও হতে পারে, সুনীতিকুমার। ভেদনীতির মধ্যে শাঠ্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। সে যাই হোক, শঠতার কথায় আমি পরে আসছি। প্রথমেই আমার প্রশ্ন বর্তমান রাজাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে কে হবেন আমাদের ভবিষ্যতের রাজা? কার হাতে আমরা তুলে দেব, আমাদের এই রাজ্যের শাসনভার? রাজা হয়ে তিনিও যে বর্তমান রাজার মতো দুরাচারী হবেন না, কে দেবে সেই আস্থা? তোমরা কেউ ভেবেছ?”

উপস্থিত আচার্যরা সকলেই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। কিন্তু সবাই নিরুত্তর রইলেন। এই রাজাকে সিংহাসন থেকে সরানোর কথা সকলেই ভেবেছেন। কিন্তু কেউই ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি। মহর্ষি কিছুটা সময় দিলেন সকলকে, তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার এই পরিকল্পনায় আমাদের সর্বপ্রথম প্রয়োজন এক সর্বগুণসম্পন্ন তরুণ, যিনি হবেন এই রাজ্যের রাজা। আমার আরও প্রয়োজন সর্বকল্যাণময়ী এক তরুণী। যিনি হবেন এই রাজ্যের রাজমহিষী। এই রাজদম্পতির থেকে এই রাজ্য পাবে এক সুস্থ রাজ বংশ সে তরুণ কোন রাজবংশের বিলাসী রাজকুমার নাও হতে পারেন। সে তরুণী নাও হতে পারেন কোন রাজার দুলালী”।

“তিনি কে, গুরুদেব?” আচার্য সুনীতিকুমার জিজ্ঞাসা করলেন।

মহর্ষি উত্তর দিলেন, “জানি না, প্রিয় সুনীতিকুমারএখনও জানি না। এই রাজ্যে কোথাও না কোথাও আছেন সেই ভবিষ্যতের রাজা, তাঁকে খুঁজতে হবে। আর সেটাই হবে আমাদের প্রথম কর্তব্য। আর এই দায়িত্ব আমি দিতে চাই এখানে উপস্থিত ...

মহর্ষির কথায় বাধা পড়ল, দ্বারে দাঁড়ানো বিশ্বপ্রভর নিবেদনে, “গুরুদেব, বহির্দ্বারে তিনজন শ্রেষ্ঠী উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইছেন”।

“তিনজন শ্রেষ্ঠী? কোথা থেকে এসেছেন কিছু বললেন?” মহর্ষি বিশ্বপ্রভকে জিজ্ঞাসা করলেন।

“তা কিছু বললেন না। তবে বেশভূষা, আচার আচরণে সম্ভ্রান্ত বলেই মনে হল। তাঁরা এসেছেন সুসজ্জিত দুই অশ্বের সুন্দর একটি রথে। আশ্রম দ্বারের বাইরে অপেক্ষা করছেন। আলাপে আমাদের রাজ্যের অধিবাসী নয় বলেই মনে হল”।

“অতি উত্তম। তুমি নিজে গিয়ে তাঁদের এখানে নিয়ে এসো, বিশ্বপ্রভ। দেখো কোনভাবেই যেন তাঁদের অসম্মান না হয়। আর শোনো, এখন মধ্যাহ্নকাল, তুমি নিজে ওই তিন শ্রেষ্ঠীর আহারের ব্যবস্থা করবে। ওঁনাদের কোন সারথি আছে কি? যদি থাকে, তারও ভোজনের সুব্যবস্থা করতে ভুলো না, বৎস”।

“যথা আজ্ঞা, গুরুদেব”।

বিশ্বপ্রভ চলে যেতে মহর্ষি তাঁর সমবেত শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমাদের আলোচনা, এত সংক্ষেপে সম্পূর্ণ হবার নয়এখন মধ্যহ্নকাল, তোমরা সকলে এই অবসরে আহার করে নাও। আর তোমাদের অনেকেই পথশ্রমে ক্লান্ত, ভোজনের পর কিঞ্চিৎ বিশ্রামও নিয়ে নাও। আমরা আবার বিকেলে একত্র হবো। আরও একটা কথা, তোমরা যারা আশ্রমের আবাসিক নও, তারা আজ এই আশ্রমেই রাত্রিযাপন করলে, আমাদের পরিকল্পনার আলোচনা হয়তো সম্পূর্ণ হবে। একান্ত অসম্ভব না হলে, তোমরা সেই ভাবেই প্রস্তুত হও তোমরা সকলেই অত্যন্ত বিচক্ষণ, এ কথা বলা বাহুল্য যে, আমাদের এই আলোচনার কথা এই কক্ষের বাইরে কেউ না জানলেই ভাল”।   

মহর্ষির কথা শেষ হওয়ার আগেই, মহর্ষির গৃহের বাইরে অশ্বশকট থামার আওয়াজ পাওয়া গেল। আচার্যরা সকলেই কক্ষের অন্য দ্বার দিয়ে আশ্রমের আবাসের দিকে বেরিয়ে গেলেন। 

চলবে...


নতুন পোস্টগুলি

গীতা - ৮ম পর্ব

  এর আগের সপ্তম অধ্যায়ঃ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে " গীতা - ৭ম পর্ব " অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রহ্মযোগ ১ ...