সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

এক যে ছিলেন রাজা - ৪র্থ পর্ব

 

[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে পড়া যায়, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাভক্ত ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগর ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। ভাগবৎ-পুরাণে মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়  (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়গুলিতে), তার বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ  করাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য।]


এই উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্র থেকে - "এক যে ছিলেন রাজা - ৩য় পর্ব



আশ্রমের সরোবরে হাতপামুখ ধুয়ে এসে আচার্যরা সকলেই ভোজন ঘরে এসে আসন গ্রহণ করলেন। তালপাতায় বোনা আসনগুলি আসে পূর্বের রাজ্য বঙ্গ কিংবা কলিঙ্গ থেকে।  চরকায় কাটা মোটা সুতোয় বোনা আসনগুলি আরামদায়ক ও দৃষ্টি নন্দন হয় ঠিকই, কিন্তু আশ্রমে বহুল ব্যবহারের পক্ষে অসুবিধেজনকসে তুলনায় তালপাতায় বোনা আসন ভাঁজ হয়ে যায় না, সহজেই পরিষ্কার করা যায়, আশ্রমের পক্ষে সুবিধাজনক।

আসনে উপবেশনের পর আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “গুরুদেব কি করতে চাইছেন, বলতো? যজ্ঞশীল তোমার কী মনে হচ্ছে?”

“গুরুদেব, এখনো তেমন কিছুই তো বলেননি, সবে মাত্র ভূমিকা করলেন”। আচার্য যজ্ঞশীল বললেন।

তার উত্তরে আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “তা ঠিক, কিন্তু রাজ্যের কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের রাজা ও রাণি? কোন্‌ শ্রেষ্ঠীপুত্র, কিংবা কোন্‌ গ্রামের কোন্‌ সম্পন্ন কৃষক-পুত্র, অথবা তন্তুকার-পুত্র? গুরুদেবের এই প্রস্তাবটা আমার ঠিক মনঃপূত হল না। রাজা হওয়া কি চাট্টিখানি কথা হে?”

এই সময় ভোজন ঘরে ঢুকল ধরণী, আর সঙ্গে বড়ো বড়ো মাটির পাত্র নিয়ে তার দুই সহকারী শালকু আর হানো  ধরণী ঢুকেই সকলকে নীচু হয়ে নমস্কার করল, বলল, “একটু দেরি হয়ে গেল, আর্যগণ। আপনাদের নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়ে গেছে! শালকু, আর হানো, ওগুলো একধারে রাখ। তারপর তোরা যা, বাকি পাত্রগুলো সব নিয়ে আয়, আমি এদিকটা ততক্ষণ সামলাচ্ছি”।

ধরণী দ্রুত হাতে সকল আচার্যের সামনে সবুজ শালপাতার থালা বিছিয়ে দিল, প্রত্যেকের জন্যে মাটির জলপাত্র। আচার্য বেদব্রত আসন ছেড়ে উঠে, লবণ, লেবুর টুকরো আর কাঁচা লংকা রাখা কাঠের থালাটি বামহাতে তুলে নিলেন। দক্ষহাতে সকলের পাতে পরিবেশন শুরু করলেন লবণ, লংকা ও লেবু।

ধরণী হই হই করে উঠল, “করেন কী, করেন কী, আচার্য বেদব্রত! আপনি বসুন দয়া করে, আমি দিচ্ছি তো”!

“আঃ ধরণী, আর বিলম্ব করো না, ভাই। কী খাওয়াবে আজ, অন্ন না পুরোডাশ? পরিবেশন শুরু করো”।

“আজ্ঞে, আজ দুপুরে সকলের জন্যে অন্ন হয়েছে, রাত্রে হবে পুরোডাশ”।

“অতি উত্তম, পরিবেশন শুরু করো। ক্ষুধায় উদরে অগ্নি জ্বলে উঠেছে ভাই”।

ধরণী কাঠের পাত্রে অন্ন এনে সকলের পাতে, কাঠের হাতায় অন্ন পরিবেশন শুরু করল। লেবু-লবণ-লংকা দেবার পর আচার্য বেদব্রত অন্য কাঠের পাত্র থেকে সব্জি দেওয়া শুরু করলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কিসের ব্যঞ্জন হে, ধরণিভাই? এর গন্ধেই ভয়ংকার ক্ষুধার উদ্রেক হচ্ছে”।

“আজ্ঞে ওটা পাঁচমিশেলি ব্যঞ্জনবেগুন আছে, দুরকমের কন্দ আছে, আর আছে অলাবু”।

“আহা, আশ্রমের এই ভোজন কতদিন পরে খাচ্ছি বলো তো, ধরণীভাই”।

“আজ্ঞে, তা হবে মাস ছয়েক। আপনি তো সেই সমাবর্তনের সময় শেষ এসেছিলেন”?

“আরে দূর দূর, সে তো সমাবর্তনের সমবেত ভোজ। বাইরের অস্থায়ী সূপকারের রান্নাতে কি আর আশ্রমের রান্নার স্বাদ আসে”?

সকলের পাতে অন্ন ও সব্জি পরিবেশন হয়ে যেতে, ধরণী বলল, “আর লজ্জা দেবেন না, আচার্য, এবার আপনি আসন গ্রহণ করুন। আমি ডাল দিয়ে দিই, খাওয়া শুরু করুন”।

আচার্য বেদব্রত ধরণীর পিঠে হালকা চাপড় মেরে হাসতে হাসতে বললেন, “হ্যাঁ। এইবার বসে যাই। ক্ষুধার সময় অন্ন সাজিয়ে বসে থাকা কোন কাজের কথা নয়। আর ওই যে, তোমার দুই সহকারীও চলে এসেছে। ওরা আবার অত কী নিয়ে এল, ধরণি”? আচার্য বেদব্রত আসনে বসতে বসতে বললেন।

“আশ্রমের স্বল্প আয়োজনে আর কি হতে পারে, আচার্য? ছানার তরকারি আছে, আর শেষপাতে দই”

গণ্ডূষে অন্ন ও জল দান করে সকলে আহার শুরু করলেন, আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “এই তোমার স্বল্প আয়োজন, ধরণি? এ তো প্রায় রাজসূয় যজ্ঞ, হে। প্রবল প্রতাপশালী রাজাদের রাজসূয় যজ্ঞতেও এর থেকে বেশি আর কী আহার করায়? কি বল, যজ্ঞশীল?”

উত্তরে আচার্য যজ্ঞশীল বললেন, “যা বলেছেন, এর সঙ্গে খুব জোর দু একটা মিষ্টান্ন থাকে। আবার কী? আরেকটু ডাল দাও তো ধরণি”

ধরণীর আন্তরিক পরিবেশনে সকলেই খুব আনন্দে ভোজন সমাধা করলেন। তারপর ভোজনগৃহের বাইরে, মাটির কলসি থেকে শালকু তাঁদের হাতে জল ঢেলে দিল হাত ধোয়ার জন্যে। হাত ধুয়ে এসে ধরণীর থেকে এক খণ্ড করে সাদা বস্ত্র পেলেন হাত মোছার জন্যে। তৃপ্ত আচার্যগণের হাতে ধরণী তুলে দিল লবণে জারিত আমলকির টুকরো, এক একটি টুকরো মুখে ফেলে, আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “বড়ো ভাল খেলাম, হে ধরণি  বড় তৃপ্ত হলাম তোমার যত্নে”  

ধরণী বিনীতভাবে বলল, “এই সবই আপনাদের আশীর্বাদ আর শিক্ষা। আপনাদের সেবা করতে পেরে আমিও কৃতার্থ হলাম, আচার্য। রাত্রে সকলের জন্যে পুরোডাশের আয়োজন হলে আপত্তি নেই তো, আচার্য; সঙ্গে থাকবে করেলাভজ্জি আর অজমাংস?”

“আমার আপত্তি নেই। বাকি সকলের...”। আচার্য সুনীতিকুমার সকলের মুখের দিকে তাকালেন, সকলেই সানন্দে সম্মতি দিলেন ধরণীর এই প্রস্তাবে। “তোমার প্রস্তাবনায় আমরা সকলেই সম্মত, ধরণিকিন্তু, তোমার তো এখনও দ্বিপ্রহরের ভোজনই হল না, যাও, যাও বিলম্ব করো না, ভোজন করে নাও। তারপর রাত্রের আহারের চিন্তা করবে”।

“এই বার যাবো, আচার্য, আপনাদের বিশ্রামের কক্ষগুলি দেখিয়ে দিই, তারপর আমরা আহারে বসব। ওদিকে বিশ্বপ্রভ গুরুদেব ও অতিথি শ্রেষ্ঠীদের আপ্যায়ন করছে। বিশ্বপ্রভর সঙ্গেই আহার করবো আমি। আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আসুন আপনাদের বিশ্রামকক্ষে নিয়ে যাই”।

ভোজন গৃহ থেকে বের হয়ে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ পেরিয়ে তাঁরা প্রবেশ করলেন, একটি মনোরম উদ্যানে। ফুল ও ফলের গাছে জায়গাটি নিবিড় ও শীতল। এই উদ্যানে পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গৃহ রয়েছে, এগুলি আশ্রমের অতিথি নিবাস। এই নিবাসে তাঁরা এর আগেও বহুবার থেকেছেন। নির্দিষ্ট গৃহের দ্বার উন্মুক্ত করে ধরণী আচার্যদের বিশ্রামের ব্যবস্থা দেখিয়ে দিল। পাশাপাশি তিনটি কক্ষ, প্রত্যেক ঘরে তিনটি করে শয্যা। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি কাঠের চৌকিতে হালকা তুলোর গদি। টান টান সাদা চাদর বিছানো, একটি করে উপাধান প্রত্যেক শয্যায়।

বিশ্রামের ব্যবস্থায়, আচার্যদের সকলেই স্বস্তি ও আনন্দ অনুভব করলেন। আচার্য রণধীর বললেন, “অতি উত্তম ব্যবস্থা, ধরণীএই বার তুমি যাও, ওদিকটা সামলাও। আমরা আরামের ব্যবস্থাটুকু সব বুঝে নেব”।

ধরণী বিনীত হেসে উত্তর দিল, “সব শয্যার পাশেই একটি করে পেটিকা আছেপেটিকাতে পরিষ্কার ধুতি, চাদর, উড়নি রাখা আছেআর আছে মাটির কুঁজোয় ভরা পানীয় জল ও জল পানের পাত্র। এই গৃহের দ্বারের বাইরে, একজন সেবাদাস সর্বদা অপেক্ষারত থাকবে। এই গৃহের সেবাদাসের নাম বান্টু। কোন প্রযোজনে ডাক দিলেই সে উপস্থিত হবে। আর কোনরকম অসুবিধা হলে আমাকে ডেকে পাঠাতে দ্বিধা করবেন না। আমাকে এবার তাহলে যাবার অনুমতি দিন, আচার্য ?”

“তুমি যাও, ধরণীতুমি যতক্ষণ এখানে থাকবে আমাদের বিশ্রামের বিলম্ব হবে, আর বিলম্ব হবে তোমার আহারের। তোমার আতিথেয়তা দেখে এটুকু বলতে পারি, তোমার ঘরণী যিনি হবেন, তিনি খুব সুখী হবেন, ধরণী! তাঁর অর্ধেক কাজ তুমিই নিপুণ সমাধা করে দেবে।” হাসতে হাসতে বললেন আচার্য বেদব্রত। আচার্য বেদব্রতর প্রশংসায় আপ্লুত ধরণী, নীচু হয়ে সকলকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেল, ভেজিয়ে দিয়ে গেল কক্ষের দ্বার।

বয়স অনুপাতে সুবিধামতো তিনটি কক্ষের শয্যা অধিকার করলেন আচার্যরা। আচার্য বেদব্রত ও আচার্য ধর্মধর রইলেন, একই কক্ষে। শয্যায় দেহ ফেলে দিয়ে বেদব্রত গবাক্ষপথে বাইরে তাকালেন। গাছের নিবিড় পাতায় স্নিগ্ধ শ্যামল পরিবেশ। পাতার আড়ালে থাকা একটি ঘুঘু কোথাও ডেকে চলেছে একটানা। পাখির ওই ডাক আরো নিশ্চিন্ত নিরিবিলি করে তুলেছে পরিবেশ। কক্ষের মধ্যে হালকা ধুপের গন্ধটিও বড়ো মনোরম। শয্যায় শুয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, আচার্য ধর্মধর কুঁজো থেকে পানীয় পাত্রে জল ঢেলে জল পান করছেন।

আচার্য ধর্মধর এক পাত্র জল পানের পর বড়ো তৃপ্তির আওয়াজ করলেন, “আআআঃ”। তারপর বললেন, “পানীয় জলের মধ্যে কিঞ্চিৎ কর্পূর, জলের স্বাদটাকেই পাল্টে দেয়, তাই না, বেদব্রত? গুরুদেবের অদ্ভূত নিয়ন্ত্রণ, একথা স্বীকার না করে উপায় নেই। আহার, আবাস, আপ্যায়ন কোন কিছুতেই এতটুকু ত্রুটি তোমার চোখে পড়বে না”।

“হুঁ”। আচার্য বেদব্রত সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন।

আচার্য ধর্মধর আবার বললেন, “অত্যন্ত ক্ষুধার উদ্রেক হলে, ভোজনটা একটু বেশিই হয়ে যায়। তার ওপর আবার এমন সুস্বাদু আহার পেলে তো আর কথাই নেই। আমার তো নিদ্রায় চোখ ভারি হয়ে আসছে, বেদব্রত। একটু না ঘুমোলেই নয়, কি বলো?”

“হুঁ”।

“কি তখন থেকে শুধু হুঁ হুঁ করে চলেছ? কথা বলবে না, নাকি আরামে কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছ? হা হা হা হা। বুঝেছি, তুমিও আরামের নিদ্রায় ডুবতে চলেছ?”

“হুঁ”। আচার্য বেদব্রত একইভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিলেন। তাঁর এই উত্তরে আচার্য ধর্মধর একটু বিরক্ত হলেন। তিনি আর কোন কথা না বলে, শয্যায় শুয়ে পড়লেন, তারপর অচিরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। বাইরের ঘুঘুর ডাকের সঙ্গে মিশে গেল তাঁর হালকা নাসিকা ধ্বনি। আচার্য বেদব্রত একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে দেখলেন। তাঁর ঠোঁটে হাল্কা হাসির রেশ।  তাঁর ক্লান্তি আছে, কিন্তু তাঁর ঘুম আসছে না। তিনি মাথার তলায় দুহাত রেখে তাকিয়ে রইলেন ছাদের দিকে। কাঠের কাঠামোর উপর ঘন খড়ের চাল। তাঁর নজরে এলো একটি কাঠের বাটামে ঘুণ ধরেছে। সেই বাটামের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট ছিদ্র। আর সেই ছিদ্র পথে বেরিয়ে আসছে মিহিন কাঠের গুঁড়ো। এখন নানান আওয়াজে কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নিঃশব্দ রাত্রে নিশ্চয়ই শোনা যাবে, ঘুণপোকার কাঠ কাটার আওয়াজ। চোখে দেখতে না পাওয়া এই কীটের অদ্ভূত ক্ষমতায় বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এখনই ব্যবস্থা না নিলে, ওই কীটের দৌরাত্ম্যে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে এই কাঠামো। শাল কাঠের এই মজবুত কাঠামোও হঠাৎ একদিন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তেই পারে!

গুরুদেব ভৃগুর দক্ষ পরিচালনায় গড়ে ওঠা এই আশ্রমের মজবুত পরিকাঠামোতেও এখন কীটের আক্রমণ। সেই কীট প্রবল পরাক্রান্ত। রাজা অঙ্গের বদান্যতায় দুইশত গ্রামের রাজস্ব থেকে এই আশ্রমের সমস্ত ব্যয় সংকুলান হয়। কিন্তু রাজা বেণের যদি সনাতন শিক্ষায় আস্থা না থাকে? তাঁর মনে হতেই পারে, এই আশ্রমে মানুষকে শিক্ষিত করে রাজ্যের কী লাভ?  দুরাচারী রাজার কাছে শিক্ষিত মানুষের থেকে, সাধারণ জনসমাজ অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত। তিনি চাইবেন না, তাঁর বদান্যতায় রাজ্যে এমন একটি শিক্ষিত শ্রেণী তৈরি হোক, যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পায়। তিনি অচিরেই এই আশ্রমকে দান করা গ্রামগুলির রাজস্ব, নিজের হাতে আবার ফিরিয়ে নিতেই পারেন। সেক্ষেত্রে এই আশ্রমের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠবে। এই সুন্দর সুনিয়ন্ত্রিত আশ্রমের ব্যবস্থাপনায় ধ্বস নামতে পারে যে কোনদিনআর সেই কারণেই গুরুদেব ভৃগু এত উদ্বিগ্ন। নিজের হাতে গড়া এমন প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও রাজার সঙ্গে তাঁর লড়াই। এ লড়াই জিততেই হবে। এই লড়াই সনাতন বিশ্বাসের লড়াই। এ লড়াই সনাতন শিক্ষার লড়াই। এই লড়াই পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সনাতন শিক্ষা তুলে দেবার লড়াই। গুরুদেব ভৃগুর উপর পূর্ণ আস্থা আছে আচার্য বেদব্রতর। গুরুদেব, আজ সন্ধ্যে এবং হয়তো সারারাত্রিব্যাপী যে গোপন পরামর্শ সভার আয়োজন করেছেন, সেই আলোচনাতেই হয়তো ফুটে উঠবে আসন্ন এই লড়াইয়ের রূপরেখা। গুরুদেব কিভাবে এবং ঠিক কী করতে চলেছেন, সেটা এখনো আদৌ স্পষ্ট নয়। আচার্য বেদব্রত এই বিষয়ে ভাবতে ভাবতেই একসময় চোখ বন্ধ করলেন এবং ঘুমিয়েও পড়লেন এক সময়।

 

১০

 

বিশ্রামের পর অতিথি আবাস থেকে পাঁচ আচার্য যখন বের হলেন, সন্ধ্যে হতে আর বেশি দেরি নেই। আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “গুরু আহারের পর দিবানিদ্রা শরীরকে শ্লথ আর ভারি করে তোলেবৈকালিক স্নিগ্ধ পরিবেশে কিছুক্ষণ পায়চারি করলে, কিছুটা হাল্কা অনুভব হবে, গুরুদেবের কক্ষে যাবার আগে, চলো একটু পায়চারি করে আসি”।

সকলেই সহমত হলেন, এবং বিকালের ম্লান আলোয়, নীড়ে ফেরা পাখিদের কলকাকলি পূর্ণ, মনোরম পরিবেশে অলস পদচারণা উপভোগ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ পদচারণার পর আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “রণধীর, গুরুদেবের ওই কথাটা কিন্তু আমার ঠিক মনঃপূত হলো না”।

“কোন কথাটা, সুনীতি?” আচার্য রণধীর জিজ্ঞাসা করলেন।

তিনি ও আচার্য সুনীতি কুমার প্রায় সমবয়সী, সখাস্থানীয়। আচার্য যজ্ঞশীল তাঁদের তুলনায় অনেকটাই ছোট, আর আচার্য বেদব্রত ও ধর্মধর তো পরবর্তী প্রজন্মের। সকলেই এই আশ্রমের প্রাক্তনী হলেও বয়সের কারণে সহজাত এক দূরত্ব থেকেই যায়। আচার্য সুনীতি কুমার ও আচার্য রণধীর একটু এগিয়ে হাঁটছিলেন, অন্য তিনজন ছিলেন একটু পিছনে। আচার্য পিছন ফিরে তাকিয়ে দুরত্বটা অনুমান করে, চাপা স্বরে বললেন, “আঃহা, রণধীর, গুরুদেব ওই যে কথাটা বললেন না, রাজ্যের সর্বত্র খুঁজে এক রাজার সন্ধান করতে হবে, এক সর্বগুণসম্পন্ন তরুণ। এই কথাটা আমার কিছুতেই মনে ধরছে না, ভাই। উটকো একটা অনভিজ্ঞ লোককে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেই সে একদম গড়গড়িয়ে রাজ্য শাসন করতে লেগে যাবে, এ কী সম্ভব?”

“আদৌ সম্ভব নয়, কিন্তু এছাড়া অন্য উপায়ই বা কী? আমরা সকলেই রাজার বদল চাইছি। কিন্তু কে হবে, নতুন রাজা? তুমি হবে, সুনীতি? এ রাজ্যে তোমার চেয়ে অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনীতির আচার্য কেউ নেই। আমার মনে হয় তোমার মতো যোগ্য লোক কেউ হতেই পারে না”।

“তুমি কি পাগল হয়েছ, রণধীর? আমি হবো রাজা? আমার ঊর্ধ্বতন চৌদ্দ পুরুষে কেউ রাজা ছিলেন না। দয়া করে তুমি আবার গুরুদেবের কানে একথা তুলে দিও না যেন। বেশ আছি ভাই, অধ্যাপনা করি, স্ত্রীপুত্র কন্যা নিয়ে দিব্য সুখে আছি। সুখে থাকতে প্রেতের মুষ্ট্যাঘাত ভক্ষণের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।”

“ভয় নেই, সুনীতি, নিশ্চিন্ত থাকো। রাজাসনে তোমাকে বসাবার প্রস্তাব আমি গুরুদেবের কাছে কখনোই বলব না। আর বললেও গুরুদেব সেই প্রস্তাব মেনে নেবেন, এমন স্বপ্নেও ভেব না। গুরুদেব খুব ভালো করেই জানেন, আমরা – শিক্ষিতজনেরা সমালোচনায় যতটা দক্ষ, প্রত্যক্ষ দায়িত্ব পালনে, ততটাই উদাসীন”। এই কথা বলে, আচার্য রণধীর আচার্য সুনীতির মুখের দিকে তাকালেন, বুঝতে পারলেন না, তাঁর এই কথায় আচার্য সুনীতি ক্ষুণ্ণ হলেন কিনা। দীর্ঘদিনের সঙ্গী প্রিয়সখাকে আঘাত করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।

তিনি খুব আন্তরিক স্বরে আবার বললেন, “গুরুদেব ভৃগু আমাদের সকলের গুরু, আমাদের থেকে অনেকবেশী বাস্তববোধসম্পন্ন ও দূরদর্শী। ধৈর্য ধরে দেখাই যাক না, গুরুদেব কি পরিকল্পনা করেছেন। আলোচনা ও পর্যালোচনার জন্যেই তো তিনি আমাদের সকলকে ডেকেছেন এবং সন্ধের পর থেকে সারারাত্রি সময়ও নিয়েছেন”।

কথা বলতে বলতে তাঁরা উপস্থিত হলেন, আশ্রমের মন্দিরের সামনে। ছোট্ট কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন দেবালয়। সন্ধে নামার মুহূর্তে সেখানে আরতির আয়োজন চলছে। মন্দিরের পুরোহিত আপনমনে দেবসেবায় নিযুক্ত ছিলেন। আচার্যদের পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে পিছন ফিরে তাকালেন, তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখেচোখে গভীর আতঙ্ক। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা এই অসময়ে কোথা থেকে আসছেন, মহাজন?”

আচার্য রণধীর বললেন, “আমরা সকলেই আচার্য, এই আশ্রমের প্রাক্তনী। আজ আশ্রমের অতিথি নিবাসে আমরা রয়েছি। সন্ধ্যায় পদাচারণা করতে করতে আপনার এই সুচারু মন্দিরে উপস্থিত হয়ে খুব ভালো লাগল, তাই আপনার পূজন দেখতে এলাম। কিন্তু আমাদের দেখে আপনি এমন তটস্থ হয়ে উঠলেন কেন, পুরোহিতঠাকুর?”

পুরোহিতমশাই জোড়হাতে সকলকে নমস্কার করলেন, আচার্য রণধীরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, উদ্বিগ্নস্বরে বললেন, “আপনারা এই আশ্রমে কোন কাজে এসেছেন নিশ্চয়ই? পরমাচার্য মহর্ষি ভৃগু নিশ্চয়ই অবগত আছেন?”

“অবশ্যই অবগত আছেন। এবং আমাদের কাজও গুরুদেব মহর্ষি ভৃগুর সঙ্গেই”?

পুরোহিতঠাকুরকে এবার অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে হল, তিনি বললেন, “যাক, আপনারা মহারাজ বেণের পাঠানো কোন দূত নন। মহারাজ বেণের সেই ভয়ঙ্কর ঘোষণার কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। সেইদিন থেকে এই মন্দিরের পূজনে শঙ্খ-ঘন্টা বাদন নিষেধ করে দিয়েছেন মহর্ষি ভৃগু। অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে, গোপনে পূজন ও দেব সেবার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দেবতার পূজা তো কোন পাপাচার নয়, তাও গোপনে করতে হবে! কি অদ্ভূত দুঃসময়ের মধ্যে আমরা প্রবেশ করছি, একমাত্র ঈশ্বরই জানেন! দেবসেবা করতে বসেও সর্বদা শঙ্কিত থাকি। কবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি হবে, কে জানে!”

আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “অযথা শংকিত হবেন না, পুরোহিতঠাকুরমহর্ষি ভৃগুর নির্দেশ মতোই দেবতার আরাধনা করুন, চিন্তা করবেন না। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সকলেই অবহিত, সকলেই চিন্তিত”।

দেবতার আরতি দেখার ইচ্ছে থাকলেও, পুরোহিতের উদ্বেগ ও গোপনে পূজা নিবেদনের সংবাদ তাঁদের মনে অস্বস্তি এনে দিল। এতদিন মানুষ দেবপূজা করে এসেছে, মনের শান্তির জন্যে। এখন তারা দেবতার পূজা করতে গিয়ে কী অশান্তি ডেকে আনছে? ডেকে আনছে অনভিপ্রেত বিপদ? আচার্যরা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দুই দেবতাকেই প্রণাম করে, ফেরার পথ ধরলেনফেরার সময় কেউ কোন কথা বললেন না। সকলেই নিজেদের মতো করে গভীর চিন্তায় মগ্ন। চারিদিকে সন্ধ্যে নেমে আসছে। বড়ো বড়ো গাছের পাতা থেকে অন্ধকার যেন ঝরে পড়ছেজমাট বেঁধে ওঠা সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আচার্যরা আনমনে হাঁটতে লাগলেন  

বিশ্বপ্রভ দ্রুতবেগে হেঁটে আসছিল, তাঁদের দেখে কাছাকাছি এসে বলল, “হে আচার্যগণ, মহর্ষি আপনাদের জন্যে নিজ কক্ষে অপেক্ষা করছেন। আমাকে পাঠালেন আপনাদের সংবাদ দিতে”। বিশ্বপ্রভর এই কথায় সকলেই চলার গতি বাড়ালেন। বিশ্বপ্রভ ওঁদের সঙ্গী হয়ে একসঙ্গে হাঁটতে লাগল।

আচার্য বেদব্রত বিশ্বপ্রভর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমাদের আশ্রমের মন্দিরটা দেখতে গিয়েছিলাম, বিশ্বদেবতাকে প্রণাম করে এলাম। তাই বিলম্ব হল” 

বিশ্বপ্রভ ম্লান হেসে বলল, “আজকাল গুরুদেব মন্দিরের পূজায় ঘন্টা – শঙ্খ বাদন নিষেধ করে দিয়েছেন। পূজণ হয় নিঃশব্দে। আমরা আশ্রমবাসীরা নানান কাজে ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যায় ঘণ্টা বা শঙ্খের আওয়াজ পেলে, মনটা পূজার দিকে চলে যেত। মন্দিরে উপস্থিত না থাকতে পারলেও দেবতাকে প্রণাম নিবেদনে ভুল হতো না। আজকাল প্রায়ই ভুল হয়ে যায়, শৃগালের ডাকে মনে পড়ে রাত্রি প্রথম প্রহর তখন মনে পড়ে আজ সন্ধ্যায় দেবতাকে প্রণাম করা হয়নি  অসময়ে দেবতার স্মরণে কেমন যেন অস্বস্তি হয়, আচার্য”।

আচার্য বেদব্রত বললেন, “বিশ্ব, মানুষের জীবনে অনেক ধরনের দুঃখ উপস্থিত হতে পারে। এই দুঃখের মধ্যে দিয়েই জীবনের উত্তরণ হয়দেবতার সময়ের অন্ত নেই, কিন্তু সীমা আছে মানুষের জীবনকালের। যখনই তোমার সময় হবে, দেবতাকে স্মরণ করো। দেবতা কক্ষনো অসন্তুষ্ট হন না। এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়”।

উত্তরে বিশ্বপ্রভ কিছু বলতে যাচ্ছিল, আচার্য বেদব্রত থামিয়ে দিলেন, বললেন,  “চুপ, আর কথা নয়। আমরা গুরুদেবের কক্ষের সামনে চলে এসেছি। উনি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন!”

চলবে...

রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

উপভোগের ভোগান্তি

 



এর আগের পর্ব পড়া যাবে এই সূত্র থেকে - ""চিনি"লে না..


এরকমই এক সময়ে বড়মামা বাবাকে চিঠি লিখলেন,

“পরম কল্যাণীয় নারায়ণ,

শ্রী মঙ্গলময়ের কৃপায় তোমরা সকলে কুশলে আছ আশা করি। শ্রীমান পান্নার পরীক্ষার ফল শুনিয়া আমরা সকলে অশেষ প্রীতি লাভ করিয়াছি জানিবে। এমনই সফলতার সহিত শ্রীমান পান্না ভবিষ্যতেও পিতৃকুল ও মাতৃকুলের মুখ উজ্জ্বল করিবে সন্দেহ নাই।

এক্ষণে, তোমাদিগের নিকট আমাদের সকলের বিশেষ অনুরোধ, শ্রীমান পান্না কয়েক দিবসের জন্য যেন আমাদের এখানে আসে। আমাদের তো বটেই, শ্রীমান পান্নার মাতামহীরও বড়ো সাধ একবার সে আসিয়া দেখা করিয়া যায়। উপরন্তু, এই বৎসর বাস্তুপুজোর পালা আমাদের ভাগে পড়িয়াছে, কাজেই শ্রীমান পান্না আসিলে সে অন্যরকম এক পুজোর আয়োজনও প্রত্যক্ষ করিতে পারিবে – যাহা সচরাচর কলিকাতায় দেখা সম্ভব নহে। পান্নার প্রতি আমাদিগের স্নেহাধিক্যের কথা তোমরা অবগত রহিয়াছ, কাজেই আমরা সকলে পান্নার প্রতীক্ষায় রহিলাম জানিবে।

পত্রপাঠ উত্তর দিবে ও তোমরা সকলে আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করিবে। ইতি।

আঃ বড়দাদা।”

[আমার সমবয়স্ক যাঁরা, তাঁরা অবগত আছেন, কিন্তু অর্বাচীন ছোকরা সম্প্রদায়ের জন্য বলি, "আঃ" শব্দটি কোন বিরক্তিসূচক ধন্ব্যাত্মক শব্দ নয় - এটি "আশীর্বাদক"-এর সংক্ষিপ্তসার।] 

চিঠি পাওয়া মাত্র আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং মাকে তিতিবিরক্ত করে ফেললাম কবে যাবো জানিয়ে বড়োমামাকে চিঠির উত্তর দিতে। অফিস থেকে ফেরার পর বাবাকে জল খাবার দিতে দিতে মা বড়োমামার চিঠিটি বাবাকে দিলেন। বাবা পড়লেন কিছু বললেন না, নিশ্চিন্তে মুড়ি খেতে লাগলেন – মা জলের গ্লাস দিতে দিতে বাবাকে জিগ্যেস করলেন, ‘পড়লে’?

-‘হুঁ’

-‘তুমি কি এই রবিবার পান্নাকে ছেড়ে দিয়ে আসতে পারবে’?

-‘না, না কাল বাদ পরশু, এই শুক্রবার আমায় পুরুলিয়া যেতে হবে – অন্ততঃ দিন চার পাঁচেকের টুর’

-‘তাহলে, পরের রোববার’?

-‘ততদিনে তো বাস্তুপুজো শেষ হয়ে যাবে’

-‘সে না হয় যাবে, কিন্তু দেখা তো করে আসতে পারবে। এরপর তো আবার ইলেভেনের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, তখন আবার কবে যাওয়া হবে, না হবে...’।

-‘না, না। তা কেন? পান্না একলা যেতে পারবি না’? বাবা আমায় জিগ্যেস করলেন

-‘না পারার কি আছে? মা শুধুশুধু ভয় পাচ্ছে, বলছে একলা পারব না। ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে...আমি বললাম। 

মা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘কখন বললাম ছেলে ধরায় নিয়ে যাবে? বলছিলাম এতটা দূরের পথ, ট্রেন, বাস...পারবে কি’? মায়ের গলায় দ্বিধার সুর। বাবা হাসলেন। 

মাকে বললেন ‘ঠিক পারবে। বড়ো হচ্ছে। একলা চলতে হবে না? তোমার ঘুনুকে আমি বোকাসোকা ভাবতাম বলে আমাকে খুব কথা শোনাতে! দেখলে তো মাধ্যমিকের রেজাল্টটা - যতটা বোকা ভাবতাম ততটা তো নয়। ও ঠিক পেরে যাবে। চিন্তা করো না...’। 

বাবার আশ্বাসবাক্যেই হোক বা বাবার মুখে আমার প্রশংসা শুনেই হোক মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হলো, বললেন, ‘কবে যাবে বলো, রোববারে’?

-‘না, না, রোববারে ট্রেন কম থাকে, রেগুলার চলেও না। আর শনিবারের ট্রেনে খুব ভিড় হয়, কাজেই শুক্রবারেই ও চলে যাক, হাল্কা ভিড়ে অসুবিধে হবে না উঠতে, নামতে’।

-‘সেই ভাল, তাহলে ও চিঠির আর জবাব দিয়ে কাজ নেই, একেবারে হাজির হয়ে যাবি, দেখ পারবি তো’? শেষ কথাগুলো মা আমাকে বললেন। 

একটু চিন্তা করে বাবা বললেন, ‘মাঝে শুধু কালকের দিনটা - বৌবাজারে খুব ভালো ফুলকপি উঠেছে দেখছিলাম, কাল সকালে ভাল দেখে গোটা ছয়েক নিয়ে আসবি। নাঃ থাক, আমিই এনে দেব যা যা আনার’।

 শুক্রবারদিন ভোর বেলা আমি বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রথম অ্যাডভেঞ্চারে। জীবনে প্রথম একলা এতদূর যাবো। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব। আমার সঙ্গে ছিল একটা সাইড ব্যাগ তাতে আমার জামাকাপড়, দিদিমার থান, মামীমা, মাসিমা আর বন্নিদিদির জন্যে শাড়ি, আর একটি বেশ বড়ো থলি। থলিতে বেশ নধর সাইজের ছটি ফুলকপি, তিন রকমের চানাচুর, ডালমুট – বড়োমামার খুব প্রিয়, দিলীপের জর্দার একটা বড়ো কৌটো সঙ্গে মতিহারি দোক্তা পাতা – দিদিমার জন্যে, টুক-টাক আরো অনেক কিছু, বিস্কুট আর কড়াপাকের সন্দেশ সকলের জন্যে। ভার নেহাত কম হয়নি, বাবা বলেছিলেন একটা রিকশ নিয়ে ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত যাবার জন্যে, নিলাম না – পয়সাও তো বাঁচাতে হবে!

কোন বিপদ ঘটল না, কোন ছেলে ধরা ফিরেও তাকালো না, নির্বিঘ্নে হাওড়া স্টেশন পৌঁছলাম, মেমারির টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে পড়লাম। জানালার ধারে একটা নিশ্চিন্ত সিট দখল করে সিটের নীচেয় রাখলাম ব্যাগটা আর থলি দুটো। তারপর আরাম করে বসে সদ্য কেনা চারমিনারের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরালাম সদ্য কেনা টেক্কা দেশলাই দিয়ে। এক বুক ধোঁয়া নিয়ে উপলব্ধি করলাম বড়ো হয়ে ওঠার ঝাঁজালো আমেজ। এইটুকুর জন্যেই রিকশা না করে পয়সার সাশ্রয় করেছিলাম আসার সময়। কাজেই বড় হয়ে ওঠার বাড়াবাড়িটা তারিয়ে উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম মেমারি।

মেমারিতে বাসে উঠতে গিয়ে বিড়ম্বনা, কোন সিট খালি নেই, পরের বাস একঘণ্টা পর। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এতটা পথ দাঁড়িয়ে যাওয়া আদৌ সুখপ্রদ নয়। কাজেই উঠতে গেলাম বাসের ছাদে। বাসের কণ্ডাকটার আমাকে উঠতে দেবে না – আমি নাকি বাচ্চাগম্ভীরভাবে যখন তার সামনে এক ভাঁড় চা খেয়ে একটা চারমিনার ধরালাম, সে আর আপত্তি করল না, বরং সে আমাকে সাহায্য করল বাসের ছাদে আমার ভারি থলিটা তুলে নিতে।

গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে যখন নামলাম, সকাল সাড়ে দশটাএকটানা রোদ, তীব্র হাওয়া আর প্রচণ্ড ধুলোয় মাথার চুল থেকে ভুরু অব্দি কিচকিচ করছিল, মুখের মধ্যেও ধুলোর অনুভূতি। মাথার চুলগুলো শক্ত হয়ে খাড়া। আমার কৈশোরের কিশলয়সম গোঁফদাড়িও তথৈবচ। মামাবাড়িতে এইরূপে একলা একলা আবির্ভাব বেশ আলোড়ন তুলবে নিঃসন্দেহে।

বাসস্ট্যাণ্ডে মামাতো বড়দার এক বন্ধু ক্ষিতীশদার সঙ্গে দেখা, স্ট্যাণ্ডে তার সাইকেল ছিল, সাইকেল বের করতে করতে সে বলল, ‘কিরে, একা-একা? পিসীমা ছাড়ল’?

-‘তবে? বাচ্চাই থাকব নাকি চিরটাকাল’?

-‘উঁ - বাব্বা, খুব পেকে গিয়েছিস দেখছি!  নে’ নে’ থলেটা হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে দে, আর তুই পেছনে বসে পড়’। তাই করলাম, আমি ব্যাগ নিয়ে চেপে পড়লাম ক্যারিয়ারেযদিও মনে হচ্ছিল এমন আন্তরিক লিফ্‌টটা নিষ্কণ্টক হবে না। হলও তাই, সাইকেল চালু করেই বলল, ‘আমি তো সাতগেছে থেকে উঠলাম, তোকে বাসের ভেতর তো দেখলাম না, ছাদে চেপেছিলি নাকি’?

-‘কি করব মেমারিতে সিট পেলাম না যে’।

-‘তাই বলে ছাদে? দাঁড়া বিষ্ণুকা’কে বলছি, খুব পেকে গেছিস, না’? বিষ্ণুকা’ মানে আমার বড়োমামা। গ্রামের দিকে কাকাকে সংক্ষেপে কা’ বলে, ছোটকা, মেজকা...।

-‘অনেকেই তো ছিল, আমি কি একলা নাকি? আর এ কথা মামাকে বলার কি দরকার’?

-‘অনেকে মানে? ওরা সব গাঁয়ের চাষাভুষো লোক, ওরা আর তুই? কিছু একটা হয়ে গেলে’?

-‘ঠিক আছে। কিছু হয় তো নি, ছেড়ে দাও না, ক্ষিদ্দা’

-‘পাগল হয়েছিস, এই তিন চারদিন আগেই বিষ্ণুকা’ আমাদের বাড়ি এসেছিল, কথায় কথায় তোর কথাও উঠল। বলছিল তুই খুব ভাল রেজাল্ট করেছিস। আমি জেনেশুনে একথা চেপে যাবো, আর পরে জানতে পারলে বিষ্ণুকা’ আমাকে ছেড়ে দেবে’? চুপ করে রইলাম। এবড়ো খেবড়ো মেঠো রাস্তার ঝাঁকুনি পশ্চাতে সহ্য করতে করতে ভাবতে লাগলাম, এরপর সব শুনে বড়োমামা কি রকম ঝাঁকুনি দেন কে জানে।

বাড়ি পৌঁছে ক্ষিদ্দা কিন্তু ওই প্রসঙ্গ তুলল না, বড়মামা ছিলেন না, মামীমাকে গিয়ে বলল, ‘কাকিমা, তোমাদের বাড়ি কাকে নিয়ে এলাম দেখ, একদম জুয়েল, নামেও, কাজেও – পান্না’। মামীমা সত্যি আমাকে দেখে খুব অবাক হলেন। 

আমি প্রণাম করতে আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বললেন, ‘কি করে এলি? একা একা! কলকাতা থেকে? বাসরে কতো বড় হয়ে গেছিস। বোস বোস, ক্ষিতু তুই ও বোস। তুই ঠিক বলেছিস একদম জুয়েল’! আমি ক্ষিদ্দার সাইকেলের থেকে থলিটা নামিয়ে পিঁড়েয় রাখলামমা বলে দিয়েছিলেন থলি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফুলকপিগুলোকে হাওয়ায় বের করে রাখার জন্যে, আমি থলি থেকে বার করতে লাগলাম সব জিনিষপত্র। মামীমা সরবৎ বানিয়ে নিয়ে এলেন চটপট - দুজনের জন্যে দু গেলাস, হাতে নারকেলের নাড়ু। 

আমাকে থলি খালি করতে দেখে মামীমা বললেন, ‘ওই থলেটা তুই এনেছিস, আমি ভেবেছিলাম ওটা ক্ষিতুর...তোর বাবা-মায়ের কি আক্কেল রে, পান্না। এতবড়ো একটা বস্তা তোকে দিয়ে পাঠালো...নে, ওসব এখন রাখ, অনেক করেছিস, একটু জল খেয়ে জিরো দেখি’। 

নারকেলের নাড়ু আর সরবৎটা খেয়ে খুব তৃপ্তি হল, কিন্তু মামীমার মুখটা বেশ রাগ রাগ, একটু ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আরেকটু জল দেবে, মামীমা’? 

আমার বলার ভঙ্গীতে মামীমা ফিক করে হেসে ফেললেন, বললেন, ‘ঠিক তো, তোর বাবার ওপর রাগ, তোর ওপর দেখাচ্ছি কেন? দাঁড়া আনছি’।

নাড়ু আর সরবৎ খেয়ে ক্ষিদ্দা কেটে পড়ল, এদিকে দিদিমা ফিরলেন পুকুরঘাট থেকে স্নান সেরে শিবতলায় জল দিয়ে, সঙ্গে ছোটমাসিমা, বন্নিদিদি। আমাকে দেখে সকলেই তাজ্জব। কখন এলি, কার সঙ্গে এলি, কী করে এলি, এতো মালপত্র কী করে আনলি, উত্তর দিতে দিতে জেরবার। বিশ্বাসই করল না যে আমি একলা এসেছি। মামীমা বলাতে বিশ্বাস করল।


এবার দিন তিনেক থাকার পর ঠিক আগের অনুভূতিটা আর মিলল না। গতবারে গ্রামে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্কের যে সুর বাঁধা হয়েছিল, মনে হল সে সুরটা কেটে গেছে! কথাবার্তার মধ্যে বারবার চলে আসছিল আমার ভাল রেজাল্ট অথবা হতে পারে আমারই মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল অকারণ অহং। দুইয়ে মিলে তৈরি হয়ে উঠেছিল আমাদের দূরত্ব। কাজেই একঘেয়ে লাগছিল দিনগুলো, মনে হচ্ছিল কলকাতায় আমার বন্ধুদের কথা। 

এরকম সময়েই একদিন সক্কাল সক্কাল ছোটমাসিমা আর বন্নিদিদি চুপিচুপি আমার কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এল, ‘সিনেমা দেখতে যাবি’?

-‘কি বই? কোথায়? মেমারি, বর্ধমান গিয়ে সিনেমা দেখা আমার পোষাবে না’।

-‘না রে, এই তো সাতগেছেতে, নতুন হল হয়েছে মাস কয়েক হল। এখন “সপ্তপদী” লেগেছে – উত্তম-সুচিত্রার’।

-‘এর আগে কোনদিন যাও নি’?

-‘পাগল নাকি? বড়দা ছাড়বে নাকি একা একা’? ছোটমাসিমা বললেন। ‘আমরা মেয়ে না’?

-‘বড়োমামা আমার সঙ্গে তোমাদের ছাড়বেন কি করে জানলে’?

-‘ছাড়বে, বাবা তোকে একদম অন্যচোখে দেখে’। বন্নিদিদি বলল।

-‘গ্যাস খাওয়াচ্ছিস না তো’? আমি বন্নিদিদিকে বললাম।

-‘কি সব ভাষা শিখছিস, গ্যাস খাওয়ানো আবার কি রে’? ছোটমাসিমা বিরক্ত হলেন।

-‘হুম। কবে যাবে’?

-‘আজই’।

-‘শো কটার সময় শুরু’?

-‘দুটোয়’

-‘তার মানে বারোটার বাস ধরতেই হবে’।

-‘হ্যাঁ’

-‘বড়োমামা কোথায়’?

-‘জলখাবার খাচ্ছে, একটু পরেই বেরোবে’। বলে ছোটমাসিমা আর বন্নিদিদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সাগ্রহে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে পিছু ফিরতে পারলাম না। যতই হোক ছেলে তো – মানে পুরুষ! 

বড়ো মামা নীচের দাওয়ায় বসেছিলেন, আমাকে দেখে ডাকলেন, ‘পান্না। এদিকে আয়, বোস। পরশু থেকে বাস্তুপুজো। আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। এবারে আমাদের ভাগে পুজো, আমাদের পাঁঠা মানত আছে, বলি হবেসেই পাঁঠা দিয়ে নিরিমিষ মাংস রান্না হবে মায়ের ভোগের জন্যে - কোন দিন খাসনি এমন’

-‘মাংস আবার নিরামিষ হয় নাকি’?

-‘মানে ওই আর কি। মায়ের এই ভোগ রান্নায় পেঁয়াজ, রসুন দেওয়ার নিয়ম নেই কিনা, শুধু আদা আর ধনে জিরে, তাই নিরিমিষ বলে লোকে...দেখিস কেমন অন্য রকম স্বাদ’। মামীমা জলখাবারের থালা নিয়ে এসেছিলেন। পরোটা আর আলু ছেঁচকি। 

খেতে খেতে জিগ্যেস করলাম, ‘মামা, সাতগেছেতে নাকি সিনেমা হল খুলেছে, সিনেমা দেখতে যাবো’? বড়োমামা খুব একচোট হাসলেন হা হা করে, তারপর হাসি থামিয়ে মামীমাকে ডেকে বললেন, ‘শুনছ? পান্নার কথা শুনে যাও। কলকাতার গ্লোব, মেট্রো ছেড়ে, পান্না সাতগেছে যাবে সিনেমা দেখতে...’। 

মামীমা আরো পরোটা দিতে দিতে বললেন, ‘তাতে কি? সে রাজধানী শহর, আর এ হচ্ছে গ্রাম, যেখানে যেমন। যাক না ঘুরে আসুক, এখানকার সিনেমা হল কেমন হয় দেখে আসুকতোর সঙ্গে, পান্না, মেয়েগুলোকেও নিয়ে যা। বেচারারা বই দেখতে পায় না, মুখ শুকিয়ে ঘোরে...’। বুঝলাম বড়োমামীমাও, মাসিমা আর বন্নিদিদির পরামর্শে সামিল। কিন্তু বড়োমামা অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না। চুপ করে খেতে লাগলেন। মামীমা আর আমি সামনে বসে, আর আড়ালে ছোটমাসিমা আর বন্নিদিদির টেনসানের পারদ চড়তে লাগল। 

কিছুক্ষণ পরে বড়োমামা জিগ্যেস করলেন, ‘কি বই’?

-‘“সপ্তপদী” – উত্তম-সুচিত্রার’। আমি উত্তর দিলাম।

-‘অ। এই পথ যদি না শেষ হয়...’ বড়োমামার মুখে হাল্কা হাসি। খাওয়া শেষ করে এক গেলাস জল খেয়ে তৃপ্তির শব্দ করে বললেন, ‘আআআঃ, যা, দেখে আয় – ওদেরও নিয়ে যা, তুই যাচ্ছিস যখন ওরাও দেখে আসুক তোর সঙ্গে...’। রান্নাঘর থেকে ছোটমাসিমা বড়োমামার জন্যে চা আনছিলেন, তাঁর হাত কেঁপে উঠল বড়োমামার এই কথায় – আনন্দে একটু চা চলকে পড়ল প্লেটে।

 

মুশুরির ডালসেদ্দ, আলুসেদ্দ আর ডিমসেদ্দ আর ঘরে বানানো গব্য ঘি মেখে এক পেট গরম ভাত খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সাড়ে এগারোটা নাগাদ, বারোটার বাস ধরে আমরা সাতগেছে পৌঁছে গেলাম পৌনে একটায়। করোগেটেড টিনের শেড আর ইঁটের দেওয়াল দেওয়া বিশাল গুদামঘরে সিনেমা হল। কোলাপ্সিব্‌ল্‌ গেটের ওপাশে চটের পর্দা। দেয়ালে বড়ো বড়ো পোস্টারে সুচিত্রা আর উত্তমের মোহময় ছবি। পরের সপ্তাহের বই উত্তম-তনুজার “অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি”! দেড়টার থেকে টিকিট দেবে বলে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা, বন্ধ কাউন্টারের সামনে। আমার পাশে দাঁড়ানো বন্নিদিদি আমার হাত ধরে বলল, ‘নেক্সট উইকেও তুই থাকছিস তো’? 

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, ‘শুধু নেক্সট উইক না, ভাবছি এরপরে সারাজীবনটাই থাকবো’। 

অবাক হয়ে বন্নিদিদি বলল, ‘তার মানে’?

-‘এ হপ্তায় “সপ্তপদী”, পরের সপ্তায় “অ্যান্টনী ফিরিঙ্গী”, তার পরের সপ্তাহে...এ সব ছেড়ে কলকাতা গিয়ে কী করবো’? আমার কথার ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে বন্নিদিদি আর ছোটমাসিমা দুজনেই রেগে গেল, ছোটমাসিমা বললেন, ‘ছাড় তো ওর কথা। খুব বেড়ে গেছে, পান্নাটা। ন’দিদিকে বলতে হবে...’ন’দিদি মানে আমার মা।

ভাদ্র মাসের তীব্ররোদ আর গুমোট ঘামে আমাদের অস্থির অবস্থার মধ্যে প্রায় পৌনে দুটোর সময় টিকিট দেওয়া শুরু হল। বেশ ধাক্কাধাক্কির মধ্যে তিনটে টিকিট যোগাড় করে বীরের মতো যখন বের হলাম, তখন পশ্চিম আকাশে ঘন শ্যামল মেঘ উঁকি দিচ্ছে। আমরা টিকিট নিয়ে হলে ঢুকলাম। টিনের চাল দেওয়া বদ্ধ ঘরের ভেতর অসহ্য গরম, আমাদের পেটের সেদ্ধ-ভাতের সঙ্গে আমরাও সেদ্ধ হতে হতে চেয়ারে বসলাম। কাঠের ঠকঠকে শক্ত চেয়ার।

হলের মাঝখানে প্রজেক্টার বসানো, তার পাশে থরে থরে টিনের গোল বাক্সে ফিল্মের রোল। কয়েক বার আমাদের স্কুলে আর পাড়ায় সাদা পর্দা খাটিয়ে দেশভক্তির সিনেমা দেখা ছিল বলে, ওগুলো চিনতে অসুবিধে হল না। দুটো দশ নাগাদ দুটো দরজায় চটের পর্দা নেমে এল, সারা হলে গোটা চারেক বাল্ব জ্বলছিল, সেগুলোও নিভে গেল। মাথার ওপর টিনের চালে অজস্র ছোট ছোট ফুটো দিয়ে ঢুকে আসছিল রোদ্দুর, আধো অন্ধকারে খড়খড় আওয়াজ তুলে চালু হয়ে গেল প্রজেক্টরের মোটর। বর্ষার জলে ভেজা, ছোপ ধরা সাদা পর্দায় নড়ে চড়ে বেড়াতে লাগল ছবি – চলচ্চিত্র!

স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের পরম উন্নতির জন্য, আমাদের সরকার কতটা দায়বদ্ধ সেই প্রচার-সংবাদ প্রথমে দেখতেই হল। সাদাকালো গমের গোছা হাতে পাঞ্জাবী চাষীর হাসিভরা মুখ পর্দায় প্রকট হচ্ছিল বারবার। সেই সংবাদ শেষ হতে, শুরু হল ‘সপ্তপদী’। মোটামুটি আধঘন্টা অন্তর ফিল্মের রিল পাল্টানোর জন্যে সিনেমা থেমে যাচ্ছিল বার বার, প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আমরা সিনেমার গল্পে যখন ডুবে রয়েছি, উত্তমকুমার যখন বেসুরে বেতালায় এবার কালী তোমায় খাব গান ধরেছে্‌ন, সুচিত্রার ফিরিঙ্গী গানের প্রতিবাদে, সেই সময়ে নামল তুমুল বৃষ্টি। টিনের চালে্র ওপর সেই বৃষ্টির তোড়ে অশ্রুত রয়ে গেল উত্তমসুচিত্রার অস্ফুট রোমান্টিক ডায়লগের বহুলাংশ। তার ওপর টিনের চালের ছিদ্রপথে ঝরতে থাকা জলের বিন্দু আমাদের শীতল করে দিল, আমাদের এতক্ষণের সহ্য করা ভ্যাপসা উৎকট গরম। তাও এতটুকু ক্ষেদ হয়নি মনে, এমনই আকর্ষণ সেই ছায়াছবির।

সিনেমা শেষ হতে আমরা বাইরে এসে দেখলাম তখনও বৃষ্টি পড়ছে – তবে টিপ টাপ। আমরা বড়োরাস্তায় বাসস্টপে যখন দাঁড়ালাম, তখন আমার হাতঘড়িতে বাজে সাড়ে পাঁচটা। বাসস্টপে অপেক্ষারত অনেক লোকজন দেখে আর তাদের আচরণ দেখে আমার কেমন সন্দেহ হল, আশেপাশে জিগ্যেস করে জানলাম, বাস চলছে নাবৃষ্টি বাদল হলেই নাকি এমন হয়, বাসচালকেরা বাস চালাতে চায় না, রুট থেকে বাস তুলে নেয় আচমকা!

মেঘলা আকাশের জন্যে সেই অকাল সন্ধ্যেয় মাসিমাকে যখন একথাটা বললাম, মাসিমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমিও খুব নিশ্চিন্ত রইলাম না। জীবনে প্রথম এমন একটা দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পারব না? আমার ভরসায় আসা সঙ্গী দুই নারীকে নিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছতে পারব না – এমনই বীরপুরুষ আমি? আমি পায়ে পায়ে সরে গেলাম বাসস্টপের ভিড় থেকে, একটু দূরে একটা ছোট ট্রাক দাঁড়িয়েছিল, ড্রাইভার চালকের আসনে বসেই চা খাচ্ছিল। জিগ্যেস করতে জানা গেল, চা খেয়েই সে রওনা দেবে, মাঝের গাঁ দিয়ে সোজা বেরিয়ে যাবে এই ট্রাক, আমাদের গন্তব্য মাঝের গাঁ থেকে বাঁদিকে মোড় নিয়ে। তবু অনেকটাই রাস্তা পার হয়ে যাওয়া যাবে। আমি রিকোয়েস্ট করতে ড্রাইভার রাজি হয়ে গেল কুড়িটি টাকার শর্তে। আমি দৌড়ে গিয়ে মাসিমা আর বন্নিদিদিকে নিয়ে এলাম, বন্নিদিদি চটপট উঠে পড়ল ট্রাকে, মাসিমা প্রথমে একটু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে তিনিও উঠে পড়লেন, পিছনে আমি। আমাদের এই উদ্যোগ দেখে বাসস্টপের অনেক লোক দৌড়ে আসছিল, কিন্তু ততক্ষণে ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে জোরে। 

সাড়ে ছটা নাগাদ মাঝের গাঁয়ের মোড়ে আমাদের নামিয়ে, টাকা নিয়ে চলে গেল সেই পরিত্রাতা ট্রাকওয়ালা। ঘটনার মধ্যে হল, ট্রাক থেকে নামতে গিয়ে লোহার হুকে লেগে ছিঁড়ে গেল মাসিমার শাড়ীর আঁচলের অনেকটা। তার জন্যে একটুও দুঃখ না পেয়ে তিনি বললেন, ‘দাদা, আজকে আমাকে কেটেই ফেলবে’। 

তাঁর কণ্ঠে অপরিসীম উদ্বেগ। মাঝের গাঁ থেকে আমাদের মামাবাড়ির গ্রাম মাইল চারেক হবে। আমি বললাম অপেক্ষায় সময় নষ্ট করে লাভ নেই, চলো হাঁটা লাগাই, মাঝ রাস্তায় বাস-টাস পেলে না হয় উঠে পড়া যাবে। মাসিমাও রাজি হয়ে গেলেন, মাসিমা আর কোন মতেই ট্রাকে চড়বেন না, সে ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই ছিলেন, কাজেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আসার সময় পথে একটাও বাস কিংবা কোন যান-বাহনই আমরা দেখতে পেলাম না। বাড়ি এসে পৌঁছলাম আটটা নাগাদবড়োমামা সদরে দাঁড়িয়ে ছিলেন চরম উদ্বেগ নিয়ে, আমাদের দেখে বললেন, ‘এসে গিয়েছিস, কী করে এলি? শুনলাম বাস-টাস কিছু চলছে না’?

-‘মাঝের গাঁ থেকে হেঁটে’। মাসিমা বললেন।

-‘আর মাঝের গাঁ অব্দি? ওদিকে বাস চলছিল বুঝি’?

-‘না, মানে, বাস তো ছিল না, তাই ট্রাকে’এবারে বলল বন্নিদিদি।

-‘ট্রাকে’? কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছিলাম, মামাতো ভাই ও দাদারা পড়তে বসে গিয়েছিল, আর পড়া ফেলে উন্মুখ হয়েছিল বড়োমামার হাতে আমাদের ঠিক কী ধরনের দুর্গতি হয় - সেটা চাক্ষুষ করার জন্যে। বড়োমামা আমাদের দিকে অবাক নেত্রে এমন দেখতে লাগলেন যেন আমরা ভিন্ন গ্রহের জীববিশেষ।

-‘এটা কার মাথায় এসেছিল’? বড়োমামা তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন। এবারে আমার পৌরুষ জেগে উঠল, আর না - এই অবলা নারীদের আমি ছাড়া কে এই সময় ত্রাণ করবে? আমি বললাম, ‘আমার। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বাস না পেয়ে আমিই ট্রাকটা যোগাড় করেছিলাম’। বড়োমামীমা ধীরে ধীরে এসে পিছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, কিছু বললেন না।

বড়োমামাও বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ছোটমাসিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এবারে বুঝলি, কেন তোদেরকে একা ছাড়ি না, আর পান্না একবার বলাতে কেন তোদেরকে ছাড়লাম? পান্না না থাকলে তোদের এই বুদ্ধি মাথায় আসত? যা এখন ঘরে যা, মুখ হাত ধুয়ে কিছু মুখে দে...’

এইভাবে ফুল মার্কস নিয়ে পাশ করে যাওয়াতে আমাদের ধড়ে প্রাণ এল, আর মামাতো ভাইয়েরা খুবই হতাশ হল কিছু না ঘটায়। জামা প্যান্ট ছেড়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে, দিদিমার হাতের ঘি আর গুড় মাখানো বাটিভর্তি মুড়ি খেতে খেতে আমার মনে হল – কলকাতার সাজানো স্টুডিওতে নায়ক-নায়িকারা কত পরিশ্রম করে থাকেন একটা ফিল্ম তৈরির জন্যে, কিন্তু শহরের বাইরে গণ্ডগ্রামে থাকা তাঁদের বিপুল সংখ্যক ভক্তও কম কষ্ট করেন না - তাঁদের সেই সিনেমা উপভোগ করার জন্যে। আজই যেমন, মাত্র আড়াই ঘন্টার বিনোদনের জন্যে আমাদের প্রায় ছয় ঘণ্টার ধকল অনায়াসে সহ্য হয়ে গেল! একটা সিনেমা উপভোগের জন্যে এটুকু ভোগান্তিকে যৎসামান্যই বলা যায়। 

 

কাজেই পরের দিন সকালেই জলখাবারের সময় সাব্যস্ত হয়ে গেল, বাস্তুপুজোর হাঙ্গামা সেরে, পরের বুধবার “অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি” যাওয়া হবে – আর এবার আমাদের সঙ্গী হবেন বড়োমামীমাও! তিনি অলরেডি বড়োমামাকে বলে দিয়েছেন সারা জীবনইতো তিনি সংসারের জোয়াল টেনে চলেছেন, পান্না এসেছে, এই সুযোগে কিঞ্চিৎ মনোরঞ্জন তাঁরও দরকার। বড়োমামাও গৃহযুদ্ধে উৎসাহী না হয়ে মত দিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আমরা আবার প্রস্তুত হতে থাকলাম পরবর্তী বিনোদনের জন্যে!

চলবে...

শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

প্রসাদী ফুল

 



আমরা বলি সতুদা, কিন্তু তাঁর নাম সইত্যব্রত চট্টরাজ, এমএসসি পাশ। শুনেছি তাঁর প্যাশান ছিল স্কুলের শিক্ষকতা। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক তাঁর শিক্ষকের চাকরির শিকে ছেঁড়েনি। অতএব তিনি চাকরি করেন না। ভাগ্যিস করেন না, করলে আজ হয়তো তাঁকে দাগি অথবা নির্দাগি-শিক্ষক হয়ে, কলকাতার পথেঘাটে ধর্ণা মঞ্চে বিরাজ করতে দেখা যেত - বছরের পর বছর। তবে একটা কথা মানতেই হবে – ছোটবেলা থেকে আমরা দাগি চোরের কথা বিস্তর শুনেছি – কিন্ত দাগি শিক্ষক নৈব নৈব চ। এদিক থেকে দেখলে আমাদের উন্নয়ন পথের ধারেই বসে আছে – নির্দাগি শিক্ষকরূপে! এ কি কম উন্নয়ন?    

চাকরি না করলেও সইত্যদা নিজের বাড়িতেই কোচিং ক্লাস খুলে ছেলে মেয়েদের ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর ম্যাথস পড়ান। তাঁর ক্লাসঘরের বাইরে সকাল ছটা থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত সাইকেল আর খোলা চটির সংগ্রহ দেখলেই তাঁর হাতযশের আঁচ পাওয়া যায়। পিতৃদত্ত নাম সত্যব্রত হলেও, তিনি ইদানীং নিজের পরিচয় দেন এবং সই করেন সইত্যব্রতই নামেই। এর পিছনে গূঢ় রহস্য আছে। সেটা হল বিখ্যাত এক নিউমেরোলজিস্ট সতুদাকে বলেছিল, “খাঁটি সত্য বলে তো আজকাল কিছু হয় না, ভেজাল মেশাতে হয়”। তারপর সমাধান দিয়েছিলেন “SAITYA বা সইত্য নামটাই আপনাকে সুট করবে, আপনার জীবন পাল্টে দেবে”।       

সেই সতুদাই আমাদের পাড়ার পুজোকমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আর আমাদের জন্যে প্রত্যেকবার চোখ ধাঁধানো চাঁদাও একদম বাঁধা থাকে। কবছর আগে খবরের কাগজে পড়ে আইডিয়াটা সতুদার মাথায় এসেছিল এবং গতবার সতুদা প্রস্তাব দিয়েছিল - এবার আমাদের পুজোর থিম হবে জ্যান্ত ঠাকুর। নো কাঠ-খড়-মাটির বানানো পুতুল বিজনেস। টানা তিনদিন তর্কবিতর্কের পর ফাইন্যাল সিদ্ধান্ত হল।

ঠিক হল আমাদের গলির মোড়ে “মধুমাখা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের” মালিক বোঁদে কাকুর ভাইপো হবে গণেশ। কমবয়সী ছেলে – কাকুর দোকানে বছর দুয়েক বসছে, এর মধ্যেই ঈর্ষা জাগানো সুন্দর একটা ভুঁড়ি বাগিয়ে নিয়েছে। কাজেই গণেশ হিসেবে তার থেকে উপযুক্ত আর কেউ হতেই পারে না। এখানে বলে রাখি বোঁদে কাকুর আসল নাম বৈদ্যনাথ – কিন্তু বোঁদে বানানোয় হাত পাকিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন বোঁদে নামে।   

বলিউডের স্বপ্নে বিভোর, দিনে দুবার জিম করা নিমাইকে দেওয়া হল কার্তিকের ভূমিকা।

আমাদের পাড়ার উঠতি ছোকরাদের চিরস্থায়ী দীর্ঘশ্বাসের উৎস কদমাদির বোন মিছরি হবে সরস্বতী। স্বপ্না কাকিমা হবেন, মা দুর্গা। তিনি দেখতেও যেমন ভারিক্কি, তেমনি তাঁর মুখে চোখে বেশ একটা ইয়ে আছে – মানে মা, মা ভাব। লতিকা বৌদি বিয়ে করে আমাদের পাড়ায় এসেছেন বছর খানেক হল – তাঁকে মা লক্ষ্মীর ভূমিকায় সাব্যস্ত করা হল।    

মহিষাসুরের জন্যে কমিটি প্রথমে সাব্যস্ত করেছিল আমাদের পাড়ার তোলাবাজ ও মাস্তান ঠোঁটকাটা পটলদাকে।  ঠোঁটকাটা অর্থে পটলদা কিন্তু মোটেই স্পষ্টবক্তা নয়। আসলে তাঁর ঠোঁটের বাঁদিকে বেশ গভীর একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। শোনা যায় বেশ বড় একটা ছোরার ধারালো ফলা ঠোঁটে চেপে পটলদা আগে খুব তোলাবাজি করত। ঠোঁটে ধরা ওই ছোরার ফলা দেখিয়েই পটলদা ধরাকে সরা জ্ঞান করত। একদিন কোন এক নিরীহ চিকেন-ব্যাপারী – প্রতিহপ্তায় হপ্তার টাকা গুনতে গুনতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে আচমকা এক ঘুঁষি চালিয়েছিল তোলাবাজ পটলদার মুখে। ব্যস, পটলদার ঠোঁট কেটে প্রবল রক্তারক্তি – প্রায় দেড়মাস চিকিৎসার পর ঠোঁট সেরে উঠলেও নামের সঙ্গে জুড়ে গেল ঘটনাটা।

ঠোঁটকাটা পটলদার বেশ হাট্টাকাট্টা জবরদস্ত চেহারা – গায়ের রং, মাথার চুলও অনেকটা মহিষাসুরের মতোই। কিন্তু পটলদা কিছুতেই রাজি হল না। বলল, “পাগল নাকি, আমি ভোলেভালা সাতেপাঁচে না থাকা মানুষ...আমায় কখনো মইষাসুর মানায়?” শেষমেষ “বাঙালি খাসির” দোকানের হেল্পার সুকুলদা রাজি হওয়াতে জ্যান্ত প্রতিমার ঝামেলাটা মিটল।  

প্রথমে প্ল্যান হয়েছিল, বাহনরাও সবাই জ্যান্ত হবে। কিন্তু জ্যান্ত ইঁদুর-পেঁচা-রাজহাঁস যোগাড় হলেও, ময়ূর-কাটামোষ-সিংহ যোগাড় করার বাড়াবাড়িটা কোনভাবেই সামলানো গেল না। অতএব মাটির পুতুল দিয়েই বাহনের কাজ সারতে হল।

পুজোর কটা দিন বেশ নির্বিঘ্নে আর আনন্দেই সম্পন্ন হল। আজ বিসর্জন। আমাদের ভাসান দেওয়ার প্ল্যানটাও খুব কুলমাদুগ্‌গা সপরিবার উইথ মহিষাসুর যাবেন স্করপিওতে। তাঁরা গঙ্গাঘাটে স্নান সেরে, ঠাকুরের সাজসজ্জা ছেড়ে পুনর্মনিষ্যি হবেন। আমরা মেটাডোরে গিয়ে গঙ্গাতে বিসর্জন দেব ঘট আর মাটির বাহনগুলো

বিকেলে শুরু হল সিঁদুরখেলা, বিদায়বরণ সমস্যাটা এল অন্যদিকে। প্রত্যেকবার আমরা যারা গোবর মাথা, লরিতে তোলার আগে মাসরস্বতীর চরণে মাথা ঠুকতাম আর প্রসাদীফুল রাখতাম পকেটে। এবারে মিছরি হয়েছে সরস্বতী। তার চরণতলে ফুলের পাহাড়! কিন্ত কে তাকে প্রণাম করবে, তার চরণের ফুল কুড়োবে? যে করবে তার নামটা তো মিছরির বয়ফ্রেণ্ড লিস্ট থেকে কাটা পড়বে! কিন্তু অন্যদিকে মা সরস্বতীর চরণ না ছুঁলে পরীক্ষা পাস করব কী করে? আমাদের সকলের তখন একটাই চিন্তা - পরীক্ষা আগে না, প্রেস্টিজ আগে? পরীক্ষায় একবার ফেল করলেও পরেরবার উৎরোনো যায়। কিন্তু প্রেস্টিজ কি সাইকেলের টায়ার, পাংচার হলেও, সারানো যাবে?

আজ মিছরিকে ব্যাপক দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে পরি, শুধু ডানাদুটো নেই, ডানাজোড়া কেচে যেন ছাদের দড়িতে শুকোতে দিয়ে এসেছে! পায়ের ওপর পা, হাতে বীণা, ঘ্যাম পোজ মেরেছে, চোখ ফেরানো দায় হয়ে উঠেছেনিখিল আর বাচ্চু ভেজাগলায় আমাকে বলল, ‘কিছু একটা কর, ভল্টু’

কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, “ভাবিস না, উপায় বের করেছি। আমার ঘরের সরস্বতীমূর্তিটা, চুপচাপ নিয়ে আয়, তারপর আমি দেখছি’

ওরা সরে যেতে আমি মিছরিকে গিয়ে বললাম, ‘মিছিমিছি বসে সময় নষ্ট করছিস কেন, মিছরি? এই সময় গিয়ে “এই সময়”টা দেখে আয়। আজকের এপিসোডটা শুরু হল বলে”।  “এই সময়” সিরিয়ালের হিরো সমীর মহাপাত্র, মিছরি সমীরের হেব্বি ফ্যান।

মিছরি চমকে উঠে বলল, ‘এম্মা, তাইতো, ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু এসময় কেটে পড়লে কেলো হবে না’?

‘আধঘন্টার ব্যাপার, মিছরি কোন চাপ নিস না, তুই আলতো করে পাতলা হয়ে যা, আমি এদিকটা সামলাচ্ছি’

বীণা রেখে প্যান্ডেলের পিছন দিয়ে মিছরি সরে পড়ল। আর প্রায় তখনই বাচ্চুরাও পৌঁছে গেল আমার ঘরের সরস্বতীপ্রতিমা নিয়ে। প্রতিমাটিকে বেদিতে বসিয়ে চটপট সেরে নিলাম প্রণামপর্ব, প্রসাদীফুল কুড়োনোর পর্ব। আমরা দশবারোজন ছোকরা মা সরস্বতীর বেদিটাকে ঘিরে রেখে, ‘সরস্বতীমায়িকি, জয়’ রব তুলতে লাগলামবরণ করতে এসেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে আমার মাও ছিলেন, খুব খুশি হলেন আমাদের মতিগতি দেখে। মাদুগ্‌গা সাজা স্বপ্নাকাকিমা বলেই ফেললেন, ‘ছোঁড়াগুলো দুগ্‌গাপুজোর সময়েও মাসরস্বতীর ভক্তিতে কি সুন্দর মেতে আছে। দ্যাখ দ্যাখ, পরীক্ষার ভয় দেখিয়ে মিছরি কেমন ছোঁড়াগুলোর ঘাড় ধরে প্রণাম আদায় করছে”!

আমার চোখ ছিল ঘড়ির দিকে, আধঘন্টা হতেই বাচ্চুরা চুপিচুপি মাসরস্বতীর প্রতিমা আবার আমার ঘরে রেখে এল মিছরিও ফিরে এসে, বীণাহাতে বসে পড়ল বেদিতে। আমার দিকে ডাগর চোখের কটাক্ষ হেনে মিছরি ফিসফিস করে বলল, “থ্যাংকু, ভল্টুদা। আজ না গেলে বিচ্ছিরি মিস করতাম। আজ সমীরের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে হঠাৎ এসে উপস্থিত হল সমীরের প্রথম পক্ষের বউ – তার কোলে একটা মেয়ে...”।

আমি হাসলাম, বললাম, “ভল্টু ছাড়াও আমার নাম তিমির, জানিস তো? সমীরের থেকে চোখ ফিরিয়ে, তোর আঁখির টর্চ এদিকে ফেললে, মাইরি বলছি, আমার তিমিরত্ব সবটুকু ঘুঁচে যেত রে, মিছরি”!

আঁখিপাখির ডানা ঝাপটে মিছরি উত্তর দিল, “য্‌য্যাঃ। ভল্টুদা তুমি না একটা Zআআতা। এমন ফচকেমি করো না...”।    

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি বুকে হাত রাখলাম, মা সরস্বতীর আশীর্বাদী ফুল রয়েছে আমাদের পকেটে।

 

-০০-


শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

ঝিঙের জগৎ

 


 



বাবার চাকরি সূত্রে তোয়া অনেক শহরে থেকেছে, কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি, পুণে..এখন থাকে হায়দ্রাবাদে। তার থাকা ব্যাপারটা যেন ভূগোল গোলা বইয়ের পাতা। আবার ভূগোলের বাইরেও - এই যেমন এখন সে আছে পরশপুর গ্রামে। এই গ্রামের কথা কোন ভূগোল বইয়ে খুঁজেও পাবে না। এই গ্রামে তার দাদুন থাকেন, দিম্মা থাকেন। এখানে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে কয়েকদিনের জন্যে।

এই গ্রামে সে যেন আগেও এসেছে। এমনই মনে হয় তার। কিন্তু কবে? উঁহু সে তার মনেই পড়ে না, শুনেছে খুব ছোট্টবেলায়, যখন তার কথাও ফোটেনিতার মনে থাকার কথা নয়, অথচ তার যেন দাদুনের বাড়ির সব কটা ঘর চেনা। কোনটা দাদুন-দিম্মার ঘর। এই বাড়ির বারান্দা, ছাদ। আসলে কোন জায়গা ভালো লেগে গেলে, এমনই মনে হয়, মনে হয় যেন খুব চেনা। এ বাড়ির পেছনের দিকে, পাঁচিলের বাইরের ওই পুকুর। পুকুরের চার পাড়ে অনেক গাছ, নিম, তেঁতুল, নারকেল, খেজুর। একটা নারকেল গাছ তো আবার হেলে পড়েছে জলের দিকে। ওই গাছটা বেশ মজার, গাছের গা বেয়ে জলের ওপরে চলে যাওয়া যায় অনেকটা। তারপর পা ঝুলিয়ে বস্‌সে, পা দোলাতে দোলাআতে বিটনুন আর কারেন্ট নুন ছিটোনো বনকুল খাও আর ঠোঁট জড়ো করে ফু করে ছুঁড়ে দাও বনকুলের বীজ। জলের মধ্যে টুপুস শব্দ করে তারা পড়বে। আর জলের মধ্যে গোল গোল ছোট্ট থেকে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠে একটু পরেই মিলিয়ে যাবে। গোল গোল ওই ঢেউ গুলোকে সার্ক্‌ল্‌ বলে। আর যেখানে কুলের বীজটা টুপুস করে পড়ে, সেটা হল সার্ক্‌লের সেন্টার।

ঝিঙে অবিশ্যি তা বলে না। ও কী সব আজেবাজে বলে। গোল গোল ঢেউগুলোকে বলে বৃত্ত। আর সেণ্টারটাকে বলে কেন্দ্র। তোয়া যত বলে, ওটা বৃত্ত নয় রে পাগল, ওঠা সার্কল্‌। আর ওটা মোটেও কেন্দ্র নয়, ওটা সেন্টার। কিছুতেই মানবে না। জিদ করে বলবে, উঁহু, ওটা বৃত্ত আর ওটা কেন্দ্রই!

ঝিঙের কথা তো বলাই হয়নি। ঝিঙে এই গ্রামেই থাকে। এই গ্রাম ছেড়ে সে কোনদিন কোত্থাও যায়নি। অনেকদিন আগে একবার জামালপুরের রথের মেলায় গিয়েছিল। সে এখান থেকে দুক্রোশ হবে। ক্রোশ মানে? ক্রোশ মানে ক্রোশ আর এক ক্রোশে দুমাইল! ব্যস্‌, তার দৌড় ওই অব্দিই। তোয়ার মুখে সে কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি, পুণে আর হায়দ্রাবাদের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলচারটে বনকুল মুখের মধ্যে নিয়ে, চিবোতে চিবোতে বলেছিল, ওসব জায়গায় যাওয়া যায় বুঝি? ওসব জায়গা তো ভূগোলের পড়া মুখস্থ করার জন্যে, আর পরীক্ষার খাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখার জন্যে। নয়তো ভারতের ফাঁকা মানচিত্রে শহরগুলোকে গোলগোল চিহ্ন দিয়ে এঁকে দেওয়ার জন্যে। সে জানে, কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। মুম্বাই মহারাষ্ট্রের, দিল্লি ভারতের। পুনে শহরের নামটাও সে পড়েছে। তবে সেটা কোন রাজধানী নয়।

ঝিঙে গ্রামের যে স্কুলে পড়ে, সেখানে টিফিন আর ছুটির সময় স্কুলের গেটের সামনে বসে হজমিওয়ালাসে বুনোকুলও নিয়ে আসে। স্কুল ছুটি হওয়ার সময় বিটনুন আর কারেন্ট নুন দেওয়া চারটাকার বুনোকুল কিনে, সে তোয়াদের বাড়ি চলে আসে। তারপর দুজনে নারকেল গাছে চড়ে পা ঝুলিয়ে বসে, আর বুনো কুল খায়। বুনোকুলের কাগজের ঠোঙাটা দেখেও অবাক হয় তোয়াদিদি। ঠিক যেন সানাইয়ের মতো, ওপরটা চওড়া আর তলার দিকটা সরু। কুল খাওয়ার পর ঠোঙাটা খুলে সে দেখেছে, কাগজটা আসলে পুরোনো খাতার ছেঁড়া পাতা। তাতে পেন্সিলে লেখা গোটা গোটা বাংলা অক্ষর! তোয়া বাংলা বলতে পারে, কিন্তু লিখতে বা পড়তে পারে না। সে ছেঁড়া খাতার পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে, ইস্‌ সে যদি বাংলা পড়তে পারত! এবার হায়দ্রাবাদ ফিরে মাকে বলবে, বাংলা লেখাটা শেখাতে।        

ঝিঙেদের বাড়ি গ্রামের এদিকে না। গ্রামের অন্যদিকে পুকুরপাড়ে রাস্তা ধরে, হুই বাঁদিকে কিছুটা গিয়ে শিবের থান আছে, তার সামনে বিশাল ঝাঁকড়া মাথা বকুল গাছ। বর্ষার সময় সে গাছে ছোট্ট ছোট্ট মাকড়সার মতো ফুল হয়। সে ফুল গাছের তলার মাটিতে যেন চাদর বিছিয়ে দেয়। দু হাতের আঁজলা ভরে সে ফুল তুলে নিয়ে নাকের কাছে আনলেই – আআআঃ সুবাসে মনটা হালকা হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায় শিমূল তুলোর মতো। এসব কথা ঝিঙে বলেছে, আর তোয়া অবাক হয়ে শুনেছে! সেই শিবের থান ছাড়িয়ে ডানদিকে গেলেই একটা বড়ো বাঁশঝাড়।

সে বাঁশঝাড়ে রাতের দিকে শেয়ালের পাল এসে লুকিয়ে থাকে। গেরস্তের বাড়ি থেকে হাঁস মুরগি শিকার করে এনে, ওরা ওখানেই ভোজ সারে। ওদের ছেড়ে যাওয়া রক্তমাখা পাখনাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে, সকালের হালকা হাওয়ায় উড়তে থাকে কিছু পালক। আবার বিকেলে ওই বাঁশঝাড়ের মাথায় এসে বসে রাজ্যের বক, ওখানেই ওদের বাসা। তখন দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বাঁশঝাড়ের মাথায় ফুটে আছে থোপা থোপা সাদা ফুল। আর বর্ষার ঝড়ো হাওয়ায় বাঁশে বাঁশে যখন ঠোকাঠুকি লাগে, আওয়াজ ওঠে ক্যাচর ক্যাচর, কটর কটর। রাতে ঘুম ভেঙে ওই শব্দ শুনলে বুকের ভেতরটা কেমন ভয় ভয় করে ওঠে। মনে হয় কারা যেন ঝগড়া করছে, কিন্তু যারা ঝগড়া করছে তারা কেউ আমাদের মতো মানুষ নয় কিংবা কুকুর, বেড়াল, শেয়ালের মতো জন্তুও নয়, তবে তারা কারা...? সে সময় মায়ের বুক ঘেঁষটে চোখ বুজে শুলে একটু সাহস মেলেএসব কথাও তোয়াকে ঝিঙে বলেছে।

ওই বাঁশ-ঝাড়ের ঠিক পেছনেই তাদের বাড়ি। বাড়ির দিকের রাস্তা দিয়ে তারা যখন যায়, সামনে কিংবা পেছনে কুকুরও হাঁটে, ল্যাং ল্যাং করে, বেঁকা লেজ তুলে। কিছু বলে না? কী আবার বলবে? বদমাশ ছেলেরা ঢিল মারলে বলে, কেঁই কেঁই। হারুকাকার চায়ের দোকানে কিছু লোক বসে চা খায়, তারা লেড়ো বিস্কুটের টুকরো ছুঁড়ে দিলে বলে, ভৌ ভৌ, ভুক। এছাড়া আর কী বলবে? ও হ্যাঁ। মাঝে মাঝে সদর থেকে একজন বুড়ো আসে, কাঁধে ঝোলানো বাঁকের দুদিকে ঝাঁকা নিয়ে। সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে, যত রাজ্যের পুরোনো ভাঙ্গাচোরা থালা-ঘটি-বাটি, লোহার জিনিষ কেনে। তার বদলে সে মেয়েদের দেয় কাচের চুড়ি, পায়ে পরার আলতা, কপালের সিঁদুর। তাকে দেখলে কুকুরগুলো হয় খুব ভয় পায় কিংবা খুব রেগে যায়। তখন খুব ঘেউ ঘেউ করে, আর সহজে তার পিছু ছাড়ে না শীতের রাত্রে কুকুরগুলো ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গুটিসুটি শুয়ে থাকেআর হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে, কিছুই দেখা যায় না, বোঝাও যায় না, অথচ কিসের দিকে দৌড়ে যায় খুব ব্যস্ত হয়ে...কিছুটা দূরে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকে ঘৌউউউউউউ। সে ডাক শুনতে তোমার একটুও  ভালো লাগবে না, তোয়াদিদি!

ওই রাস্তা দিয়ে সকাল সকাল হাঁসেরাও হাঁটে। পাশাপাশি বাড়ি থেকে ছোট ছোট হাঁসের দল বেরিয়ে রাস্তায় আসে। তারপর সক্কলে মিলে বেশ বড়ো একদল হাঁস হয়ে, হেলে দুলে থপর থপর পা ফেলে হাঁটতে থাকে, নিজেদের মধ্যে কথা বলে প্যাঁক প্যাঁক। এগুলো পাতি হাঁস। এরা পুকুরের কাছে এসে ঝপাস ঝপাস জলে নেমে পড়ে। জলের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে সাঁতরে বেড়ায় পুকুরে। কিছুক্ষণ পরে, জল থেকে উঠে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পাখা ঝাড়ে, লেজ ঝাড়ে আর আরামে ডাকাডাকি করে প্যাঁয়াক –প্যাঁয়াক। পাড়ের ধারে ধারে পা ডুবিয়ে তারা মাঝে মাঝে গুগলিগেঁড়ি খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, আর চোখে পড়লেই টকাস করে তুলে নেয় চ্যাপ্টা ঠোঁট দিয়ে! সারাদিন পর এই হাঁসগুলোই আবার বিকেলবেলা ঘরে ফিরে যায়। নিজে নিজেই ফিরে যায়? নিজে নিজেই যায় তো। তবে টুকলিদিদি, নোনামাসি পুকুরের ধারে এসে, একবার দুবার ডাক দিয়ে যায়, বলে, আয় আয় চৈ চৈ। সেই ডাক শুনে হাঁসেরা দল বেঁধে ওই রাস্তা ধরে যে যার ঘরে ফিরে যায়তখন তারা সকলেই গলা ছেড়ে হাঁকাহাঁকি করে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আবডালে বিকেলের হেরে যাওয়া আলো গায়ে মেখে তারা ঠিকঠাক পথ চিনে তাড়াতাড়ি নিজেদের ঘরে ফিরে যায়।  

সার্কল্‌ আর সেন্টার নিয়ে ঝিঙের সঙ্গে তার মতের অমিল হলেও তোয়া অবাক হয়ে শোনে ঝিঙের কথা। মাঝে মাঝে জিগ্যেস করে নানান কথা। এখন যেমন জিগ্যেস করল, “হেরে যাওয়া আলো মানে? আলো আবার হেরে যায় নাকি? কী যে বলিস, তুই ঝিঙে?”

ঝিঙে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে বলল, “ও বাবা, তুমি এটাও জানোনা তোয়াদিদি। আলো আর অন্ধকারের মধ্যে নাগাড়ে লড়াই চলছে তো! সে লড়াইতে সব সময় কী আর আলো জিততে পারে? যখন জিততে পারে তখন হয় দিন। আর যখন বিচ্ছিরি রকম হেরে যায়, তখন হয়ে যায় রাত। আবার মেঘলা দিনে আকাশ জুড়ে যখন মেঘেরা তাদের ঘোলাটে পুরু শতরঞ্চিটা মেলে ধরে বসে থাকে, দমবন্ধ করে থাকে চারপাশ, তখন আলোটা খুব লড়তে থাকে, তবে দুজনের কেউই খুব একটা সুবিধে করতে পারে নাসেদিন ছায়াতে আলোতে মিশে থাকে সারাটাদিন। অথবা আলোর সঙ্গে ছায়া মিশে থাকে! দেখনি? আর যেদিন ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে পশ্চিম আকাশ থেকে রেগে মেগে দৌড়ে আসে ঘন কালো মেঘের দল, সেদিন? সেদিন তো আলো হেরে ভূত হয়ে যায় এক্কেবারে। ভর দুপুরেও মনে হয় যেন সন্ধে নেমে এল, তখন?”

“সে মেঘ খুব কালো?”

“হ্যাঁ গো, দিদি তোমার ওই চুলের মতো ঘন কালো। আর তার সঙ্গে কী হাওয়া, বাপরে! মস্তো মস্তো গাছের ডালপালা নুয়ে পড়ে যেন মাটি ছুঁয়ে ফেলে। আম গাছের ডাল ভরা আমের গুটি ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে মাটিতে। মালা ছিঁড়ে যেমন পুঁতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মেঝেয়। সে সময় আমাদের স্কুলের টিনের চালেও ভীষণ আওয়াজ ওঠে। মনে হয় বিশাল এক দত্তি, যেন তার শক্ত দুই হাতে উপড়ে ফেলতে চাইছে ঘরের চালটা। কোন কোনদিন যখন শিল পড়ে, টিনের চালে আওয়াজ ওঠে চড়বড় চড়বড়। ঠিক যেন একশ ঢাকী তাদের ঢাকে কাঠি পিটিয়ে ঢাক বাজাচ্ছে! বুকের ভেতরটাও কেমন গুরগুর করতে থাকে। তখনই  হয়তো আমরা রবিঠাকুরের কবিতা পড়ছিলাম, “কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি”, কিংবা নামতা মুখস্থ করছিলাম “তিন তিরিক্ষে নয়, তিন চারে বারো, তিন পাঁচে পনের...”। পড়া বন্ধ করে চুপ করে মাথার ওপরে তাকিয়ে বসে থাকি। মাস্টারমশাই আমাদের বলেন, “হল্লা করিসনি, ধরিত্রি মা আজ খুব ক্ষেপে উঠেছেন”।

“ধরিত্রি মা কে?”

“ধরিত্রি মা? আমিও ঠিক জানিনা গো। আমি তো ছোট, সব কথা বড়োরা কী আর আমাদের খুলে বলেন? বলেন না। তাঁরা বলেন, বড়ো হ, সব জানতে পারবি”।

গায়ে ময়লা হাফহাতা জামা, আর পরনে কালো হাফপ্যাণ্ট, সেই ঝিঙে বারবার অবাক করে দিচ্ছিল তোয়াকে। সে যেন অন্য এক পৃথিবীর কেউ। যে পৃথিবীটা তোয়ার একদম অচেনা, অজানা। অনেক বড়ো বড়ো শহরে সে থেকেছে। তার বাবা মস্তো বড়ো অফিসে কাজ করেন। এই বয়সেই কত যে শহর, কত ট্রেন, কত উড়ান সে চড়ে ফেলেছে। ঘরে বাইরে সর্বদাই কম্পিউটার, স্মার্টফোন! সেই পৃথিবীটা তার খুব চেনা, কিন্তু ঝিঙের জগৎটা তার থেকে অনেক অনেক দূরে। অথচ এখন এই শেষ বিকেলবেলায়, ঝিঙে স্কুল থেকে ফিরে বসে আছে তার ঠিক পাশটিতে। তোয়া ঠিক করল কাল সে ঝিঙের সঙ্গে একবার গ্রামটা ঘুরে আসবে। হেঁটে আসবে ওই পথে, যে পথে তার সামনে ও পেছনে কুকুর হাঁটবে সে দু একবার ডাকবে ঘৌ ঘৌ, কিন্তু কিচ্‌ছু করবে না। যে পথে সকাল-বিকেল হেঁটে বেড়ায় হাঁসের পাল

 

ঝিঙে বনকুল শেষ করে, কাগজের ঠোঙাটা দুমড়ে হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “তোয়াদিদি, বাড়ি চলো, সন্ধে নামতে খুব দেরি নেই আর। ওই দেখ আকাশে কেমন মরা আলো। আর পুকুরের জলও দেখ কেমন কালচে হয়ে উঠছে, গাছের ছায়ায়। একটু পরেই ঘরে ঘরে শাঁখ বাজবে। বাড়ির নাচদোরে পিদিম দেখিয়ে, সে পিদিম তুলসীতলায় নামিয়ে রাখবে, তারপর তুলসী মন্দিরে পেন্নাম করবে মায়েরা - দিদিরাএসময় বাচ্চাদের বাড়ির বাইরে থাকতে নেই”

নারকেল গাছের গা বেয়ে বসে বসে নেমে আসতে আসতে তোয়াদিদি ঝিঙেকে জিগ্যেস করল, “নাচদোর মানে? সে দরজার সামনে সবাই নাচে নাকি?”

ঝিঙে হিহি হিহি হেসে ফেলল, তারপর বলল, “নাচতে যাবে কী দুঃখে? মানে কী জানিনা তোয়াদিদি, সবাই বলে তাই শুনেছি। সব বাড়িতেই দুটো দরজা থাকে, নাচদোর আর পাছদোর। একটা সামনের দিকে আর আরেকটা পিছনের দিকে”।  তোয়াদিদি আর ঝিঙে এখন তাদের বাড়ির পাছদোর দিয়ে বাড়িতে ঢুকল। বাড়ির সামনের দিকে দালানের সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে দেখল, শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা, পিদিম নিয়ে চলেছেন সদর দরজার দিকে। সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে পড়ল তোয়াদিদি, আর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ওই মহিলা তো তার মা! তার মা খুব সুন্দর দেখতে, কিন্তু এমন সুন্দর? আগে তো কোনদিন দেখেনি, তোয়াদিদি!

সদরে প্রদীপ দেখিয়ে, তার মা ফিরে এলেন বাড়ির উঠোনে। একধারে সিমেন্ট বাঁধানো তুলসী মন্দির, তার ওপরে প্রদীপ রেখে শাঁখ বাজালেন। তারপর মাটিতে উবু হয়ে বসে প্রণাম করলেন তুলসী মন্দিরের সামনে। দালানের সিঁড়ির দিকে আসতে আসতে মা ওদের দুজনকে দেখে জিগ্যেস করলেন, “কী দেখছিস, অমন হাঁ করে? এতক্ষণ ছিলি কোথায়? আয় ঘরে আয়”।

 

মায়ের সঙ্গে মস্তো বসার ঘরে ঢুকতেই ইজি চেয়ারে বসে থাকা দাদুন বলে উঠলেন, “এতক্ষণ কোথায় ছিলে দিদিভাই? এ গ্রামের কাউকেই চেন না, জানো না, একা একা ঘুরতে ভালো লাগল?” তোয়া বলল, “একা কেন হবে দাদুন, আমার সঙ্গে ঝিঙে ছিল তো। ও কত কী দেখাল, কত কী শেখাল”!

দাদুন ভারি অবাক হয়ে গেলেন, বললেন, “বলো কী? ঝিঙে তোমায় শেখাল? কী শেখাল”? তোয়াদিদি বড় বড়ো চোখ করে, ঝিঙের সঙ্গে এতক্ষণ যা যা কথা হয়েছে দাদুনকে সব বলল। অন্ধকারের কাছে আলোর হেরে যাওয়ার গল্প। হাঁসেদের ঘরে ফেরার গল্প। ঝিঙেদের স্কুলের চালে, একশ ঢাকের আওয়াজ তোলা শিল পড়ার গল্প। বৃত্ত আর কেন্দ্র, নাচদোর এবং পাছদোর... সঅঅব। বাবা আর মা সোফায় বসে বসে এতক্ষণ মেয়ের কথা শুনছিলেন।

তোয়ার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠলেন, “বাঃ। ভেরি গুড!”

তোয়ার মা বললেন, “ঠিক বলেছ! বড়ো বড়ো শহরে কত ছেলেমেয়ে, নামিদামি স্কুলে পড়ে। কত কোচিং পায়। তাও কেমন ভ্যাবলা হয়ে থাকে! আর এই ছেলেটি সে সবের কিচ্‌ছুই পায় না, অথচ বেশ সুন্দর কথা বলে তো! সরলা, তোমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাও তো?”

তোয়ার মা শেষ কথাটা বললেন, কাজের মাসি সরলাকে। সরলামাসি এই ঘরেরই অন্য দিকে মেঝেয় বসে কুটনো কাটছিল। তার সামনে ডিভানে বসে আছেন, তোয়ার দিদিমা। তিনি বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না, তাই তিনি যেমন যেমন বলছেন, সরলা সেই মতো কাজ করছিল। এত লোকের সামনে নিজের এবং তার ছেলের বিষয়ে কথা বলতে, সরলা খুব লজ্জায় পড়ে গেল। দিদিমার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল, “যায় দিদিমণি। তবে মাঝে মাঝে কামাই হয় বৈকি! ওই চাষবাসের সময় আর ধানকাটার সময় যেতে পারে না! বাবার সঙ্গে মাঠে যায়, ওর বাবার একটু সাহায্য হয়!”

সরলামাসির কথায় তোয়াদিদি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে, চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “ঝিঙে মাঠে যায় চাষ করতে? ও চাষ করতে জানে?”

সরলামাসি মাথা নিচু করে ম্লান হাসল, বলল, “যেতে হবে না? না গেলে শিখবে কী করে? তা নইলে আমাদের চলবে কী করে, বলো তো মা? সম্বচ্ছর খাবো কী?”

ইংরিজিতে লেখাপড়া শিখে বড়ো বড়ো পরীক্ষা পাশ করা। তারপর দেশে কিংবা বিদেশে ভালো ভালো চাকরি করা, এটাই তো ছেলেমেয়েদের কাজ। অথচ এই ঝিঙে বাংলায় লেখাপড়া করে, জলে কাদায় নেমে তার বাবার সঙ্গে চাষের কাজ শেখে! এই জগৎটার কথা তার কোন বইয়ে কোনদিন পড়েনি তোয়া, শোনেওনি কোনদিন। তোয়া চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। ঝিঙের জন্যে মনখারাপ করবে কিনা, সেটাও সে বুঝতে পারছিল না। কারণ ঝিঙে তো কোন দুঃখের কথা বলেনি, কোন কষ্টের কথা বলেনি। যা বলেছে সে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও অনুভবের গল্প। 

মেয়েকে গালে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে, তোয়ার বাবা বললেন, “ঝিঙে যে তোর সার্ক্‌লকে বৃত্ত আর সেন্টারকে কেন্দ্র বলেছে, কিচ্ছু ভুল বলেনি, তোয়া! ওরা বাংলায় পড়ে তো, তাই বাংলায় বলেছে”! 

তোয়া ঝিঙের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাই?”

তোয়ার বাবা মৃদু হেসে আরো বললেন, “হ্যাঁ। আর ওই যে নাচদোর আর পাছদোর – ওগুলো দ্বার, মানে দরজা, তুমি যাকে ইংরিজিতে বলো ডোর! নাচদোর মানে ফ্রন্টডোর, যে দরজা দিয়ে সরাসরি রাস্তায় বেরোন যায়। আর পাছদুয়ার মানে ব্যাকডোর, পিছনের দরজা একটা জিনিষ লক্ষ্য করো, তোয়া, তোমার ইংরিজির ডোর, আর শ্রীমান ঝিঙের দোর, উচ্চারণে প্রায় একই”!

তোয়াদিদি খুব মজা পেয়ে বলল, “তাই তো! দোর আর ডোর...। এমন আরো আছে না কী বাবা?”!

তোয়াদিদির বাবা হাসতে হাসতে বললেন, “আছে বৈকি! প্রচুর আছে। একদিন সময় করে তোমাকে বলবো। তবে তার আগে তোমাকে বাংলাটা ভালো করে শিখতে হবে যে!” ঘরের সব্বাই কিছুক্ষণ চুপ করে ওদের কথা শুনছিলেন

তোয়ার মা ঝিঙেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই কোন ক্লাসে পড়িস, ঝিঙে”?  

ঝিঙে ঘরের সকলের এবং তোয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “ক্লাস ফাইভ”।

“লেখাপড়া করতে ভালো লাগে?” ঝিঙে কথা বলল না, মস্ত ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।

তোয়াদিদির মা সরলামাসিকে ডেকে বললেন, “সরলা, তোমার এই ছেলের লেখাপড়া যেন কখনো বন্ধ না হয়। আমি বলছি দেখ, ও খুব ভালো রেজাল্ট করবে, বড়ো হয়ে ও তোমাদের, এই গ্রামের, আমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করবে। যদি কোনদিন কোন কিছুর অসুবিধে হয়, আমাদের বলতে লজ্জা করো না, সরলা”। শেষ কথাগুলো বলতে বলতে, তোয়ার মায়ের গলা আবেগে কেঁপে উঠল

ঘরের সবাই চুপ করে শুনলেন তোয়ার মায়ের কথাগুলো। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বললেন না। বেশ কিছুক্ষণ পরে সরলামাসি খুব নিচু অথচ স্পষ্ট স্বরে বলল, “আপদে-বিপদে তোমরাই তো আমাদের ভরসা দিদি। তোমাদের মুখ চেয়েই তো নিশ্চিন্তে থাকি। কিন্তু ঝিঙে আমার যেমন বড়ো হচ্ছে, তেমনই হোক দিদি। চাকরি নিয়ে শহরে থাকা সুখী জীবনের লোভ ওকে দেখিও না। এই গ্রাম, মাঠ-ঘাট, পাখ-পাখালি, পুকুর-মন্দির, জল-মাটির মধ্যেই ও বড়ো হোক, মানুষ হোক। এর বেশি কিচ্ছু চাই না গো, দিদি, কিচ্ছু না”।

সরলামাসির কথার উত্তরে কেউ আর কিছু বলতে পারলেন নাতোয়ার দাদুন ও দিম্মা স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন, সরলার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পরে দাদুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিকই বলেছ, সরলা, এতেই আমাদের সবার মঙ্গল, আমাদের - সব্বার”।

 

..০০..


"কিশোর ভারতী" পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত এবং "এককুড়ি কিশোর" গ্রন্থে সংকলিত।  বইটি এই লিংক থেকে "এক কুড়ি কিশোর " কিনলে বাড়িতে বসেই পেয়ে যাবেন।  

   

 

নতুন পোস্টগুলি

গীতা - ৮ম পর্ব

  এর আগের সপ্তম অধ্যায়ঃ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে " গীতা - ৭ম পর্ব " অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রহ্মযোগ ১ ...