মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

ধর্মাধর্ম - ৩/৬

 



["ধর্মাধর্ম"-এর তৃতীয় পর্বের পঞ্চম পর্বাংশ পড়ে নিতে পারেন এই সূত্র থেকে "ধর্মাধর্ম - ৩/৫"]


তৃতীয় পর্ব - ষষ্ঠ পর্বাংশ

(৬০০ বিসিই থেকে ০ বিসিই)


৩.৫.২ সম্রাট অশোকের শিলা-নির্দেশ

সম্রাট অশোকের শিলা-নির্দেশের (Rock Edict) গুরুত্ব ভারতীয় ইতিহাসে অনন্য। বিস্তীর্ণ মৌর্য সাম্রাজ্য জুড়ে এখনো পর্যন্ত যত শিলা-নির্দেশ পাওয়া গেছে, সেগুলিকে বিশেষজ্ঞরা তিন ভাগে ভাগ করেছেনঃ-

ক. পাথরের ওপরে বা পাথরের স্ল্যাবে – তিনটি গৌণ (Minor) শিলা; চোদ্দটি প্রধান (Major) শিলা; দুটি কলিঙ্গ শিলা; বৈরাত বা ভাবরু শিলা।

খ. স্তম্ভের গায়ে – লুম্বিনি স্তম্ভ; নিগালিসাগর স্তম্ভ; বিক্ষিপ্ত কিছু স্তম্ভ; এলাহাবাদ রাণির স্তম্ভ - মোট সাতটি স্তম্ভ।

গ. গুহার দেওয়ালে – বারাবর গুহার দুটি (অথবা তিনটি) নির্দেশ।

ভারতের যে যে অঞ্চলে এই নির্দেশগুলির এক বা একাধিক নমুনা পাওয়া গেছে, সেগুলি হল, কৌশাম্বি (এলাহাবাদ), বৈরাত (রাজস্থান), বারাবর (বিহার), ব্রহ্মগিরি (কর্ণাটক), মীরাট (দিল্লি), টোপরা (দিল্লি), ধৌলি (উড়িষ্যা), গাভীমঠ (কর্ণাটক), গিরনার (গুজরাট), গুজারা (মধ্যপ্রদেশ), জাটিঙ্গা-রামেশ্বর (কর্ণাটক), জৌগাড়া (গঞ্জাম, উড়িষ্যা), কালসি (দেরাদুন, উত্তরাখণ্ড), লৌড়িয়া-আরারাজ এবং নন্দনগড় (চম্পারণ, বিহার), লুম্বিনি (নেপাল), মানসেরা (খাইবার পাখতুনখাওয়া, পাকিস্তান), মাসকি (রায়চুর, কর্ণাটক), নিগালিসাগর (নেপাল), পাল্কিগুণ্ডু (কর্ণাটক), রাজুলা-মন্দাগিরি (অন্ধ্রপ্রদেশ), রামপূর্বা (চম্পারণ, বিহার), সাসারাম (বিহার), সাঁচি (মধ্যপ্রদেশ), সারনাথ (উত্তরপ্রদেশ), শাহ্‌বাজগাঢ়্‌হি (খাইবার পাখতুনখাওয়া , পাকিস্তান), সিদ্দাপুরা ও ইয়েরাগুড়ি (কর্ণাটক), মহাস্থানগড় (বোগরা, বাংলাদেশ)।

undefined

A major pillar edict of Ashoka, in Lauria Araraj, Bihar, India.

৩.৫.২.১ নির্দেশের লিপি

মানেসারা এবং শাহ্‌বাজগাঢ়্‌হির নির্দেশগুলি খরোষ্ঠি লিপিতে লেখা, এ ছাড়া বাকি সবগুলি নির্দেশেরই লিপি ব্রাহ্মী। সম্রাট অশোক যে এই শিলা-নির্দেশের ধারণা পারস্যের রাজা দারিয়ুসের নিদর্শন থেকে গ্রহণ করেছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। পারস্যের অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্যের সঙ্গে উত্তরপশ্চিম ভারতের আগে থেকেই নিবিড় যোগাযোগ ছিল এবং সেই যোগাযোগ সূত্রেই ওই অঞ্চলে খরোষ্ঠি লিপির প্রচলন হয়েছিল। খরোষ্ঠি কথাটির উদ্ভব হিব্রু ভাষার “খরোসেথ” থেকে  – যার অর্থ লিখন। খরোষ্ঠি লিপি ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখা হত।

সম্রাট অশোকের সময় ভারতবর্ষে পাথর খোদাই করে লেখার মতো দক্ষ লিপিকারের সম্ভবতঃ অভাব ছিল। কারণ বেশ কয়েকটি শিলা-নির্দেশ ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা হলেও, তার শেষে খরোষ্ঠি লিপিতে শিল্পীর নাম খোদাই করা দেখা যায়। সম্ভবতঃ ওই শিল্পীরা উত্তর-পশ্চিমের লোক ছিল। অনেকে বলেন এই ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব সেমিটিক[1] লিপি থেকে, অনেকে বলেন হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর চিত্রলিপি থেকে, যার পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি।

কালসি, সাসারাম এবং মাস্কি নির্দেশাবলী ছাড়া, কোন লেখাতেই যতিচিহ্ন[2]-র কোন বালাই ছিল না। অতএব কোথায় বাক্যের শেষ, কোথায় অধ্যায়ের শেষ পুরোটাই অনুমান নির্ভর। যার ফলে, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের পাঠেও সামান্য ঊনিশ-বিশ হয়ে যায়। দেশের সর্বত্র একই নিয়মে স্বরবর্ণের চিহ্ন, যেমন ই-কার, ঈ-কার কিংবা যুক্তাক্ষর ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়াও অজস্র ভুল ভ্রান্তি তো ছিলই।

বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে হয়তো সম্রাট নিজেই নির্দেশের বয়ান (draft) তৈরি করে দিতেন। সেই পাণ্ডুলিপি পাঠানো হত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক প্রশাসকদের (Viceroy) কাছে, প্রশাসক তাঁর দপ্তরের কোন স্থানীয় কর্মচারীকে দিয়ে সেই পাণ্ডুলিপির স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করিয়ে নিতেন। তারপর অনূদিত লেখাটি পাথরের খোদাইকর শিল্পীদের হাতে তুলে দেওয়া হত, পাথরে লেখার জন্যে। কাজেই এই পদ্ধতিতে ভুল-ভ্রান্তির যথেষ্ট সুযোগ ছিল। তারওপর শিল্পীদের অনেকেই ছিল নিরক্ষর অর্থাৎ ব্রাহ্মীলিপি পড়তে পারত না, তারা অনূদিত লেখার অক্ষরগুলি ছবি আঁকার মতো সাজিয়ে তুলত পাথরের গায়ে, তার জন্যেই বিভিন্ন অঞ্চলের লিপিতে এত বেশি পার্থক্য দেখা যায়।

আজও আমাদের প্রত্যেকের হাতের লেখার টান আলাদা হয় - ই-কার, ঈ-কার কিংবা ঋ-ফলা, য-ফলারও ধরনধারণ আলাদা হয়। বাংলা লিপি পড়তে জানে না যে শিল্পী[3], তার কাজ লিপি দেখে পাথরে ছবি খোদাই করা, অতএব ভুল হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাছাড়া অমনোযোগে একই শব্দ দুবার লিখে ফেলা কিংবা কোন শব্দ লিখতে ভুলে যাওয়ার ঘটনাও বিস্তর ঘটেছিল। পরবর্তী কালের নির্দেশগুলিতে এই ধরনের ভুলভ্রান্তি অনেকটাই কম। হয়তো এই সব ভুলের কথা রাজা অশোকের কানে গিয়েছিল এবং তিনি হয়তো তাঁর কর্মচারীদের কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন অথবা প্রথম থেকে শেষ অব্দি কাজটার তত্ত্বাবধানে কোন বিশেষ লোককে নিযুক্ত রেখেছিলেন। 

৩.৫.২.২ নির্দেশের ভাষা

অঞ্চল ভেদে সামান্য পার্থক্য থাকলেও অশোকের বেশির ভাগ নির্দেশের ভাষাই প্রাকৃত। সমসময়ে জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারে যে প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করা হত, তার থেকে অশোকের প্রাকৃত সামান্য অন্যরকম। সেই কারণে এই নির্দেশাবলীর প্রাকৃতকে, বিশেষজ্ঞরা “অশোকীয় প্রাকৃত” বলেন। অশোকীয় প্রাকৃতের সঙ্গে মাগধী প্রাকৃতের সবথেকে বেশি মিল দেখা যায়। অনুমান করা যায় অশোকের সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা ছিল মাগধী প্রাকৃত। গিরনারের শিলা-নির্দেশের ভাষা ছিল পালি। খরোষ্ঠি লিপির নির্দেশগুলি ছিল দ্বিভাষী - গ্রীক ও আরামায়িক[4]

৩.৫.২.৩ নির্দেশাবলীর বয়ান

পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক যখন প্রজাদের মধ্যে “ধম্ম”[5] প্রচারের ব্রত নিয়েছিলেন, তিনি ভারতীয় সমাজে প্রচলিত প্রাচীন পথেই হেঁটেছিলেন। অর্থাৎ জনবহুল এলাকায় – শহরের বাজারে এবং গ্রামে বা জনপদের হাটে – প্রচার কর্মীরা সম্রাটের নির্দেশ পাঠ করে শোনাত। অবশ্যই তাদের সঙ্গে থাকত বাদ্যকরের দল, নির্দেশ পড়ার আগে যারা ঢাক বাজিয়ে (ঢেঁড়া পিটিয়ে) সমবেত জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। এই পদ্ধতি সম্রাট অশোকের তেমন মনঃপূত হয়নি। যে লোকেরা নির্দেশ পড়তে যাবে, তারা কী বলবে, মানুষকে কী বোঝাবে তার ঠিক কী? যেহেতু তিনি তক্ষশিলায় বেশ কিছুদিন ছিলেন এবং উত্তরপশ্চিমের পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালই পরিচয় হয়েছিল, তিনি দারায়ুসের শিলা-নির্দেশের সঙ্গেও নিশ্চয়ই পরিচিত ছিলেন। অতএব সেই নিদর্শন অনুসরণ করে, তার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে, তিনি নিজের উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজন মতো ভারতে শিলা-নির্দেশগুলির প্রচলন করেছিলেন।

দারিয়ুসের নির্দেশের শুরুর বয়ানটি হত, “মহান রাজা দারিয়ুস বলেন[6]। একই ভাবে অশোক তাঁর বেশির ভাগ নির্দেশ শুরু করেছেন “দেবানাম্পিয়, রাজা পিয়দশী বলেন” বাক্যবন্ধনী দিয়ে । তবে অশোক একটা বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, পারস্য সাম্রাজ্যের নির্দেশগুলির উদ্দেশ্য এবং তাঁর নির্দেশের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। দারিয়ুসের নির্দেশের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্য জয়ের বিবরণ এবং নিজের অতিরঞ্জিত মহিমা প্রচার। সেখানে অশোকের উদ্দেশ্য নিজেকে যথা সম্ভব বিনীত রেখে জনগণকে “ধম্ম” পালনে উৎসাহিত করা। অতএব নিজেকে মহান না বলে, তিনি বললেন “দেবতাদের প্রিয়” অথবা “রাজা প্রিয়দর্শী”, অথবা দুটোই একসঙ্গে।

প্রথম দিকে আবিষ্কৃত শিলা-নির্দেশগুলিতে শুধু এই দুটি নামেরই বারবার উল্লেখ থাকায়, বিশেষজ্ঞরা দ্বিধায় ছিলেন, এই দেবতাদের প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী আদৌ অশোক কিনা। পরবর্তী কালে গুজারা এবং মাসকি শিলা-নির্দেশ আবিষ্কার হওয়ার পর সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই দুটি নির্দেশে “দেবতাদের প্রিয়, প্রিয়দর্শী রাজা অশোক” এবং “দেবতাদের প্রিয় অশোক” নামেই তিনি নির্দেশ জারি করেছিলেন।

স্পষ্টতঃ “দেবতাদের প্রিয়” এবং “প্রিয়দর্শী” দুটি শব্দই রাজা অশোকের নাম নয়, উপাধি। “প্রিয়দর্শী” শব্দের অর্থ যিনি সকলকেই প্রিয় দেখেন, অথবা যাঁকে সকলে প্রিয় চোখে দেখে। এটা লক্ষ্য করার বিষয় দারিয়ুস নিজেকে বড়ো বড়ো উপাধিতে অলংকৃত করতেন, অথবা অশোক পরবর্তী ভারতীয় রাজারাও “মহারাজাধিরাজ”, “মহারাজচক্রবর্তী” ইত্যাদি জমকালো উপাধিতে নিজেদের নাম সাজাতেন। অথচ এতবড়ো সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও তিনি নিজের নামের আগে “রাজা” শব্দই সর্বদা ব্যবহার করেছেন, কখনো “মহারাজ”ও বলেননি।

এই “দেবতাদের প্রিয়” – যার সংস্কৃত “দেবানাম্প্রিয়”- (অলুক) সমাস-বদ্ধ শব্দটির পতঞ্জলি (১৫০ বি.সি.ই) অর্থ করেছেন দেবতাদের প্রিয় - একটি সাম্মানিক শব্দ। কিন্তু অশোকের সমসাময়িক বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কাত্যায়ন (২৫০-২০০ বি.সি.ই) পাণিনি সূত্র থেকে এই শব্দের আরেকটি অর্থ নির্দেশ করেছিলেন, যেটি মোটেই সাম্মানিক নয় বরং গালাগাল। এবং আরও পরবর্তী সময়ে দ্বাদশ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত বৈয়াকরণিকরা, এই শব্দটির সঙ্গে সম্মানের লেশমাত্র না রেখে, একটিই স্পষ্ট অর্থ করেছেন, “নির্বোধ” বা “মূর্খ”! “দেবতাদের প্রিয়” সহজ এই শব্দটির অর্থ অশোকের সমসাময়িক কাল থেকেই কীভাবে “নির্বোধ” হতে শুরু করল, সেটা বুঝতে পারলে, জন সাধারণের চরিত্র বুঝতে অসুবিধে হয় না। এই অধ্যায়ের পরেই আমরা আলোচনা করব, দেবানাম্প্রিয়-র অর্থ কী করে “মূর্খ” হয়ে যায়।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত জৈনধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং জৈন আদর্শে দেহত্যাগ করেছিলেন, জীবনের শেষদিকে। তিনি জৈনধর্মের প্রচারেও যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু অশোকের তুলনায় তার পরিমাণ নগণ্য। কিন্তু অশোক বৌদ্ধ মতে “ধম্ম” প্রচার শুরু করলেন পূর্ণ যৌবনে, সিংহাসনে বসার মাত্র ন’বছর পরে - কলিঙ্গ যুদ্ধ জয়ের পরের বছর থেকেই। তার পরের বছরেই অর্থাৎ দশম বছরে তিনি বৌদ্ধ হয়ে বৌদ্ধতীর্থ বোধগয়া পরিক্রমায় গেলেন। অতএব তাঁর সাঁইত্রিশ বছরের রাজত্বকালের মধ্যে প্রায় আঠাশ বা ঊণত্রিশ বছর ধরে তিনি শুধু “ধম্ম” প্রচার করলেন এবং প্রজাদের মঙ্গলের জন্যে নানাবিধ কাজ করলেন। জনগণের জন্যে বিস্তীর্ণ সেচ ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, তার মধ্যে তক্ষশিলা থেকে পাটলিপুত্র হয়ে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত রাজপথে[7]-র আমূল সংস্কার। রাজপথের ধারে ধারে পান্থশালা নির্মাণ এবং পথিককে ছায়া দেওয়ার জন্যে অজস্র বট, আম-জাম ফলের গাছ রোপণ, নির্দিষ্ট দূরত্বে তাদের জন্যে জলসত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। সারা সাম্রাজ্য জুড়ে মানুষ এবং পশুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। শোনা যায় তিনি নাকি সাম্রাজ্যের বহু অঞ্চলেই চিকিৎসার সুবিধের জন্যে ওষধি গাছপালার চাষেও স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহিত করেছিলেন। এই প্রয়োজনীয় ভাবনাটি তাঁর মনে উদয় হয়েছিল, হয়তো বৌদ্ধ বিহারগুলির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা থেকে।       

আবার তাঁর শিলা নির্দেশ প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। কোন যুবক সম্রাট এমন কথা জনসমক্ষে লিখিত বলতে পারেন, চিন্তা করলে অবাক হতেই হয়ঃ-

দেবানাম্প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী বলছেন যে - অতীতে (রাজাদের কাছে) সর্বদা (জনগণের) সমস্যা শোনার অথবা সংবাদ নেবার মতো সময় থাকত না। কিন্তু এখন আমি নির্দেশ দিচ্ছি যে, যে কোন সময়, (হয়তো) আমার খাবার সময়, (অথবা আমি) অন্দরমহলে রয়েছি, (অথবা) শোবার ঘরে, অথবা রথে, অথবা পাল্কিতে, অথবা উদ্যানে, সর্বত্র সংবাদবাহকরা নিযুক্ত হয়েছে (তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে) – “আমাকে জনগণের যে কোন সমস্যার সংবাদ দেবে” এবং যে কোন স্থানেই আমি জনগণের সমস্যা মিটিয়ে ফেলে থাকি”। (শিলা-নির্দেশ ৬-এর অংশবিশেষ – গিরনার, গুজরাট - সিংহাসনে আরোহণের ত্রয়োদশ বর্ষ – ২৫৫ বিসিই. – ইংরিজি অনুবাদ ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন, বাংলা অনুবাদ – লেখক।)

অথবা কোন যুবক সম্রাট তাঁর অধীনস্থ আধিকারিককে এমন লিখিত নির্দেশ দিতে পারেন, -

তোসালির নগর বিচারক মহামাত্রকে দেবানাম্প্রিয়র যে কথা বলার ছিল, সে কথা হল,

(মঙ্গলের জন্যে) আমি যা কিছু চিন্তা করি, আমি সঙ্কল্প করি আমি যেন সেই কাজগুলি করে উঠতে পারি এবং (যে কোন) উপায়ে সুসম্পন্ন করতে পারি।

এবং আমার ধারণা এই লক্ষ্য (পূরণের)-এর  মুখ্য উপায়, তোমাদের নির্দেশ দেওয়া।

তোমরা নিঃসন্দেহে সহস্র-সহস্র মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছ (এই লক্ষ্য নিয়ে যে,) “আমরা যেন সকল মানুষের প্রীতি অর্জন করতে পারি”।

সকল মানুষই আমার সন্তান। (আমার নিজের) সন্তানদের জন্যে আমার যেমন ইচ্ছে হয়, তাদের ইহলোকের এবং পরলোকেরও সকল কল্যাণ এবং সুখের সংস্থান করতে, আমি সকল মানুষের জন্যেও তেমনই ইচ্ছা করি।

কিন্তু তোমরা (আমার) লক্ষ্যের গভীরতা বুঝতে পারছ না। (তোমাদের মধ্যে) কেউ যদি বুঝেও থাকে, তারাও আংশিক (বুঝতে পেরেছ), (এবং এর) পুরোটা নয়”। (কলিঙ্গ শিলা-নির্দেশ ১ (ধৌলি)-র অংশ বিশেষ – ত্রয়োদশ রাজত্ব বর্ষ – ২৫৫ বি.সি.ই - ইংরিজি অনুবাদ ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন, বাংলা অনুবাদ – লেখক।) 

৩.৫.২.৪ বিরূপ মনোভাব

অশোকের মতো সম্রাট পৃথিবীতে কোনদিন আর কেউ এসেছিলেন কিনা জানা যায় না, অথচ তাঁর বহুল ব্যবহৃত উপাধি “দেবানাম্প্রিয়”-র এমন অর্থ বিকার কী করে হল, কেনই বা হল?

সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত ভারতীয় নাগরিক সমাজে বৌদ্ধদের যতটা প্রভাব ছিল, জৈন এবং আজীবিকদের সঙ্গে প্রায় তুল্যমূল্য। কারণ অশোকের পিতামহ নিজেই জৈনধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং পিতা বিন্দুসার আজীবিক মতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অশোক বৌদ্ধ ধর্মগ্রহণ করে রীতিমতো ধর্মাশোক হয়ে উঠলেন এবং তাঁর পরবর্তী রাজত্ব বর্ষগুলিতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার এবং “ধম্ম” আচরণই তাঁর একমাত্র কর্তব্য হয়ে উঠেছিল।

এইখানেই বিরূপতার সূত্রপাত হল। অন্যান্য সকল বিরোধী গোষ্ঠী – ব্রাহ্মণ্য, জৈন এবং আজীবিকরাও - বৌদ্ধদের এই হঠাৎ সৌভাগ্যে মনে মনে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতে লাগল। তারা চণ্ডাশোকের ভয়ে বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারল না, কিন্তু আড়ালে বিদ্রূপ আর বদনাম করতে লাগল প্রতিনিয়ত।

অশোকের যতগুলি শিলা-নির্দেশ এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক শিলা-নির্দেশ যে পরবর্তী যুগে ধ্বংস করা হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। অতএব যত জায়গায় তিনি শিলানির্দেশ স্থাপনা করেছেন, বিরোধী ব্রাহ্মণ এবং জৈনরা সাধারণ মানুষের মনে বপন করেছেন একের পর এক বিরূপ মনোভাবের বীজ। রাজধানীতে বসে অশোক যতই নির্দেশ ঘোষণা করুন, প্রজারা তাঁর সন্তান, তাদের মঙ্গলের জন্যে তিনি সদা জাগ্রত। সে কথায় কান দিতে গ্রাম-জনপদের নিরক্ষর সাধারণ মানুষের বয়েই গেছিল।

অশোকের পরোক্ষ ঘোষণার থেকে অনেক বেশি মূল্যবান গ্রাম বা জনপদ-প্রধানের প্রত্যক্ষ কথা। দায়-দৈবে, দুঃখ-বিপদে তারা সহায় না হলে, গ্রামের মানুষ কী প্রতিকারের আশায় মহাস্থান, অথবা গিরনার, কিংবা ধৌলি থেকে পাটলিপুত্রে যাবে? কোন অবৌদ্ধ গ্রাম-প্রধান তার গ্রামের সাধারণ মানুষদের যদি বলে, “এবার যে অবর্ষায় তোদের ধান এত কম হল, কই তোদের রাজা, যে নাকি তোদের নিজের সন্তানের মতো দেখে, তোদের কর কমিয়েছে? বলেছে এক-ষষ্ঠাংশ না দিয়ে, এক-দশমাংশ কর দাও। তোদের রাজা ওই যে পাথর বসাচ্ছে, তাতে হিজিবিজি লিখছে, এ সবের খরচ নেই? সে টাকা আসে কোথা থেকে, তোর-আমার রাজস্বের টাকা থেকেই তো! এসব না করে তোদের যদি রাজস্ব কমাত, বুঝতাম তোরা সব রাজার ছেলে-মেয়েই বটে। সে সব নেই শুধু উপদেশের পাথর বসাচ্ছে। তোদের ওই রাজাটি “দেবানাম্প্রিয়” না ছাই, আসলে একটি বুদ্ধু আর মাথামোটা – তার মাথায় হাত বুলিয়ে নেড়ামাথা বৌদ্ধগুলো নিজেদের আখের গোছাচ্ছে!”

অথবা অশোক যখন রাজকোষের বিপুল অর্থ ব্যয় করে বৌদ্ধবিহার বানাচ্ছেন, স্তূপ বানাচ্ছেন, দেশে-বিদেশে ধর্ম প্রচারের জন্যে বৌদ্ধদের দল পাঠাচ্ছেন, তাতে সর্বস্তরের সব রাজকর্মচারীরা আনন্দে উদ্বেল হচ্ছিলেন এমন ভাবনার কোন অবকাশই নেই। বরং তাঁরা নিজেদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে আলোচনা করতেন, “রাজা এসব কী করছেন বল দেখি? যেভাবে বৌদ্ধদের পেছনে জলের মতো নিষ্ক ঢালছেন, রাজকোষ শূণ্য হতে কতক্ষণ? আমরা যে এত কষ্ট করে, মাঠেঘাটে, জলে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কর আদায় করে আনছি, আমাদের মাইনে-পত্তর ঠিকঠাক মিলবে তো? শেষ অব্দি ছেলেপুলে পরিবার-সংসার নিয়ে গাছতলায় দাঁড়াতে হবে না তো, ভায়া? বৌদ্ধরা কী করে যে এমন বশ করে ফেলল আমাদের রাজাকে, উঠতে বললে উঠছেন, বসতে বললে বসছেন”। “বৌদ্ধদের দোষ দিয়ে আর কী হবে, ভায়া, আমাদের “দেবানাম্প্রিয়” রাজাটিই আসলে নির্বোধ আর মূর্খ - নিজে তো ডুবছেনই, আমাদেরও ডোবাবেন”।

কিংবা অশোক তাঁর দ্বাদশ রাজত্ব বর্ষে যখন ঘোষণা করলেন, “দেবানাম্প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শীর এই ধম্ম-অনুশাসন লেখার কারণ, এখানে (আমার সাম্রাজ্যে) কোন জীব হত্যা এবং যজ্ঞের বলিদান করা যাবে না। কোন সমাজ উৎসবেও সমবেত হওয়া যাবে না। প্রিয়দর্শী সমাজ[8]গুলিতে অনেক অনাচার হতে দেখেছেন। অবিশ্যি অন্য ধরনের কিছু উৎসব আছে, যেগুলি দেবানাম্প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী অনুমোদন করছেন। আগে প্রিয়দর্শীর রন্ধনশালায় মাংস রান্নার জন্যে প্রত্যেকদিন শত-সহস্র প্রাণী হত্যা করা হত। কিন্তু এই ধম্ম-অনুশাসন (যখন) লেখা হচ্ছে, তখন মাংস রান্নার জন্যে (প্রত্যেকদিন) মাত্র তিনটি জীব হত্যা করা হয় – দুটি ময়ুর এবং একটি হরিণ (এবং) একটি হরিণও সর্বদা নয়। ভবিষ্যতে এই তিনটি জীবহত্যাও আর (করা) হবে না”। (শিলা-নির্দেশ ১, গিরনার, দ্বাদশ রাজত্ব বর্ষ – ২৫৬ বি.সি.ই - ইংরিজি অনুবাদ ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন, বাংলা অনুবাদ – লেখক।), তখন আগুনে যেন ঘি পড়ল।

এই নির্দেশের ফলে, যজ্ঞে নানান প্রাণীর বলি দিয়ে ব্রাহ্মণ্য সমাজের রসনা তৃপ্তিতে বাধা পড়ল। এ তো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, একজন মানুষ রুচি অনুসারে যা খুশি খেতে পারে, সেখানে দেশের রাজা কী করে ঠিক করে দেন, কে কী খাবে, বা খাবে না? জৈনরা হয়তো খুশি হয়েছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষও বিগড়ে গেল এই নির্দেশে। তারাও হাজার হাজার বছর ধরে নানান প্রাণীর মাংস খেতে অভ্যস্ত এবং নিত্য ডাল-ভাত-রুটির সঙ্গে মাঝে মধ্যে মাংসাহার না হলে, তাদের জীবনে আর রইল কী? তাছাড়া সারাবছর ক্ষেতখামারে, খনিতে, কামারশাল কিংবা কুমোরশালায়, তাঁতঘরে হাড়-ভাঙা পরিশ্রমের পর সমাজ-উৎসবে কটা সপ্তাহের বিনোদনে, রাজার এ আবার কেমন ব্যাগড়া? অতএব ব্রাহ্মণদের ধর্মাচরণে এবং সাধারণ খেটে খাওয়া শূদ্রদের জীবনাচরণে বাধা পড়ল একই সঙ্গে। অবৌদ্ধ মানুষরা – ব্রাহ্মণ্যসমাজ এবং সমাজের অনার্য ও পতিত শূদ্ররাও এখন অনেকটা কাছাকাছি চলে এল। ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ-ধর্মে এতদিন যে শূদ্রদের অনধিকার ছিল (এবং এর পরেও থাকবে!), সে কথাও আপাততঃ ভুলে গেল শূদ্র এবং ব্রাহ্মণরা। এই বিরূপতার প্রভাব ভারতের পরবর্তী ইতিহাসকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিল সে কথা আসবে পরে। সাধারণ মানুষকে রাজার নির্বুদ্ধিতা এবং খ্যাপামি বোঝাতে ব্রাহ্মণ্য গোষ্ঠীকে খুব একটা বেগ পেতে হল না। অতএব আপামর অবৌদ্ধ জনগণের কাছে, এখন “দেবানাম্প্রিয়” উপাধিটি অন্যতম গাত্রদাহের কারণ, এই শব্দটি নির্বোধ, মূর্খের সমার্থক হয়ে উঠল। একইভাবে হয়তো বুদ্ধও হয়ে উঠেছিলেন “বুদ্ধু”। “বুদ্ধু” – শব্দের অর্থও বোকা, বাস্তববোধহীন।

সম্রাট অশোকের প্রতি বিরূপ মনোভাব আজও দেখা যায় কোন কোন কলিঙ্গবাসীর মনে। দুই সহস্রাধিক বছর পরেও তাঁরা ভুলতে পারেননি অশোকের কলিঙ্গ জয়ের নিষ্ঠুরতা। অশোক যতই না কেন তাঁর নিষ্ঠুরতার জন্য অনুতাপ ও সমবেদনার কথা খোদাই করে রেখে যান চিরস্থায়ী পাথরে।   


চলবে...



[1] সেমিটিক ভাষা এবং লিপির উদ্ভব হয়েছিল মধ্য প্রাচ্যে, পরবর্তী কালে উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়াতেও এই ভাষার প্রচলন হয়েছিল।  

[2] ভারতীয় লিপিতে একটি দাঁড়ি বা যুগ্ম দাঁড়ি ছাড়া যতিচিহ্নের প্রচলন কোনদিনই ছিল না। বিবিধ যতিচিহ্ন – যেমন কমা, কোলন, সেমি কোলন, প্রশ্ন-চিহ্ন, বিস্ময়-চিহ্ন ইত্যাদির প্রচলন শুরু হয়েছে বৃটিশ রাজত্ব তথা ইংরিজির প্রভাবে।

[3] ঊড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ইউপির যে তীর্থ বা পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে বাঙালী পর্যটকের বহুল যাতায়াত, সেখানকার সস্তার ভাতের হোটেল বা দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা লিপির “চিত্রাঙ্কন”-গুলি লক্ষ্য করলে ব্যাপারটা স্পষ্ট বোঝা যাবে।

[4] আরামায়িক (Aramaic) ভাষা উত্তরপশ্চিমের সেমিটিক গোষ্ঠীর ভাষা, যে ভাষা উত্তর আফ্রিকা, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় বহুল প্রচলিত ছিল।

[5] ধম্ম” শব্দটি সংস্কৃত ধর্মের প্রাকৃত রূপ। বৌদ্ধ ধর্মের মুখ্য তিন স্তম্ভ - বুদ্ধ, ধম্ম এবং সঙ্ঘ। অশোকের “ধম্ম” বুদ্ধদেবের “ধম্ম”-র থেকে বেশ কিছুটা আলাদা, সেই কারণেই অশোকের “ধম্ম” কথাটি দুইয়ের প্রভেদ বোঝাতে ব্যবহার করেছি। এ বিষয়ে পরে বিশদে আলোচনা করা যাবে।   

[6] রাজা দারিয়ুস নির্দেশগুলি এভাবে শুরু করতেন - ইংরিজিতে “Says Darius, the King”. ইংরিজিতে “the” এবং “King”-এর capital “K” দিয়ে যা বোঝানো যায়, বাংলাতে “মহান” ছাড়া আর কোন প্রতিশব্দ খুঁজে পেলাম না।

[7] আমাদের সাধারণ ধারণা হল এই রাজপথ বানিয়েছিলেন শের শাহ। কিন্তু বাস্তবে এই রাস্তাটি মানুষের অজস্র গোষ্ঠী আদিম কাল থেকেই ব্যবহার করে আসছে। সম্রাট অশোক এবং পরবর্তীকালে শেরশাহ এই রাস্তাটির সংস্কার ও উন্নয়ন করেছিলেন মাত্র। পরবর্তীকালে বৃটিশরাও এই রাস্তার উন্নতি ঘটিয়ে এবং হাওড়া/কলকাতার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নাম দিয়েছিল গ্র্যাণ্ড ট্রাংক রোড।

[8] একধরনের উৎসব যাকে সে সময় “সমাজ” বলা হত। সম্রাট অশোকের আপত্তিকর এই মেলাগুলিতে ঘোড়া বা বলদের দৌড়, কুস্তি, জুয়া, নাচ, গান, নৃত্য-বাদ্য, ভেল্কিবাজি, ভানুমতীর খেল সবই থাকত এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে চলত। ওই সব মেলায় মাংস খাওয়া, মদ্যপান এবং পতিতা নারীদের সঙ্গে অবাধ যৌনাচারও চলত। সম্রাট অশোক এগুলিকেই নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি এই শিলালিপিতেই অন্যান্য নিরীহ মেলার স্পষ্ট অনুমতি দিয়েছিলেন।      


সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

এক যে ছিলেন রাজা - ৫ম পর্ব

 


[শ্রীমদ্ভাগবৎ পুরাণে পড়া যায়, শ্রীবিষ্ণুর দর্শন-ধন্য মহাভক্ত ধ্রুবর বংশধর অঙ্গ ছিলেন প্রজারঞ্জক ও অত্যন্ত ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাঁর পুত্র বেণ ছিলেন ঈশ্বর ও বেদ বিরোধী দুর্দান্ত অত্যাচারী রাজা। ব্রাহ্মণদের ক্রোধে ও অভিশাপে তাঁর পতন হওয়ার পর বেণের নিস্তেজ শরীর ওষধি এবং তেলে সম্পৃক্ত করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তারপর রাজ্যের স্বার্থে ঋষিরা রাজা বেণের দুই বাহু মন্থন করায় জন্ম হয় অলৌকিক এক পুত্র ও এক কন্যার – পৃথু ও অর্চি। এই পৃথুই হয়েছিলেন সসাগর ইহলোকের রাজা, তাঁর নামানুসারেই যাকে আমরা পৃথিবী বলি। ভাগবৎ-পুরাণে মহারাজ পৃথুর সেই অপার্থিব আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়  (৪র্থ স্কন্ধের, ১৩শ থেকে ১৬শ অধ্যায়গুলিতে), তার বাস্তবভিত্তিক পুনর্নির্মাণ  করাই এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য।]

এই উপন্যাসের চতুর্থ পর্ব পড়া যাবে পাশের সূত্র থেকে - "এক যে ছিলেন রাজা - ৪র্থ পর্ব


১১

 

মহর্ষি ভৃগুর কক্ষের দুইকোণে অষ্টদীপের আলোয় ঘরটি যথেষ্ট আলোকিত। দুই বিপরীত কোণায় প্রদীপের অবস্থানের জন্যে ছায়ার উপদ্রব অনেকটাই কম। আচার্য বসে আছেন নিজের আসনে। আচার্য বেদব্রত ও অন্যান্য আচার্যরা ঘরে প্রবেশের পর দেখলেন আরও পাঁচজন আচার্য বসে রয়েছেন আসনে। সকলেই পূর্বপরিচিতআচার্য রত্নশীল বাণিজ্য ও অর্থনীতির আচার্য। আচার্য বিশ্ববন্ধু আয়ুর্বেদ ও বৈদ্যাচার্য। আচার্য সুনন্দ সুর-সঙ্গীতাচার্য। আচার্য বিকচ ও আচার্য নিলয় দুজনেই এই আশ্রমের উপাধ্যক্ষ, গুরুদেব ভৃগুর দুই হাত। গুরুদেবের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে এই দুজনই আশ্রম পরিচালনা করেন। সব দিক বিচার করে, যে কোন কর্ম সুসমাধা করতে এঁদের অন্য জুড়ি নেই।

সকলে আসন গ্রহণ করার পর, নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করলেন। তারপর সকলে গুরুদেব ভৃগুর মুখের দিকে তাকালেন। গুরুদেব স্মিতমুখে অপেক্ষা করছিলেন। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সকলে প্রস্তুত, সুদীর্ঘ আলোচনার জন্যে?” সমবেত কণ্ঠে সকলে বললেন, “হ্যাঁ গুরুদেব, আমরা প্রস্তুত”।

“উত্তম। বিশ্বপ্রভ কক্ষের দরজা রুদ্ধ করে তুই এসে আমার পাশে বসে পড়। আমাদের এই আলোচনা অত্যন্ত গোপন। রুদ্ধদ্বারের বাইরে কাউকে রেখেছিস তো”?

“হ্যাঁ গুরুদেব। দুইজন অতি বিশ্বস্ত রক্ষী নিয়োগ করেছি। অনভিপ্রেত কেউ কক্ষের কাছাকাছি এলেই আমাকে সংকেত দেবে”।

“খুব ভালো। বৎস সুনীতিকুমার, রণধীর, তোমরা পাঁচজন আমাদের আশ্রমের অত্যন্ত সম্মানীয় অতিথি। তোমাদের দ্বিপ্রাহরিক আহার ও বিশ্রামের কোন ত্রুটি হয় নি তো”?

আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “কি বলছেন, গুরুদেব? এই আশ্রম কি আমাদেরও আশ্রম নয়? আর আপনার সান্নিধ্যের মতো আরাম আমরা আর কোথায় পেতে পারি? আমরা নিজেদের গৃহের থেকেও তৃপ্তিতে আহার করেছি ও শান্তিতে বিশ্রাম নিয়েছি”।

আচার্য সুনীতিকুমারের এই কথায় মহর্ষি ভৃগু উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন, তারপর বললেন, “সাবধান, বৎস সুনীতিকুমার, ঘরে ফিরে গৃহিণীকে এই কথা ঘুণাক্ষরেও বোল না যেন গৃহযুদ্ধর সমূহ সম্ভাবনা

মহর্ষি ভৃগুর এই কথায় সকলেই হেসে ফেললেন, আচার্য সুনীতিকুমারও সলজ্জ হাসলেন।  

হাসির রেশ কমে আসতে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “এবার আমরা কাজের কথায় আসি। কী পরিস্থিতিতে আমরা এখানে জড়ো হয়েছি, সে কথা সকলেরই জানা আছে। সে কথার পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন দেখি না। আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে আসছি”।  মহর্ষি ভৃগু সকলের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বর্তমান রাজার অপসারণ। দেশের সকলের মঙ্গলের জন্যে এছাড়া আর কোন উপায় আমি দেখছি না, বৎস তোমাদের কি অন্য কোন উপায় জানা আছে?”।

“না গুরুদেব, অন্য উপায় নেই”।

“উত্তম। এই উদ্দেশ্যপূরণের প্রথম ধাপ, পরবর্তী রাজার সন্ধান। ধরা যাক আমরা রাজাকে সরিয়ে ফেললাম, কিন্তু নতুন রাজা কে হবেন? আমার মত, আমরা এই রাজ্যের সর্বত্র ঘুরে খুঁজে আনব সকল গুণসম্পন্ন এক তরুণকে। অনভিজ্ঞ সেই তরুণকে যোগ্য রাজা বানিয়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তোমাদের কোন বক্তব্য আছে, বৎসগণ?”

“আছে গুরুদেব। একজন সাধারণ তরুণ, তার পক্ষে কি রাজ্যপরিচালনা করা সম্ভব, গুরুদেব?” আচার্য সুনীতিকুমার বললেন।

তাঁর কথার সমর্থন করে আচার্য রত্নশীল বললেন, “আমারও একই অভিমত, গুরুদেবরাজ্য রাজনীতির জটিল সিদ্ধান্ত, সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এক তরুণের পক্ষে কিভাবে আয়ত্ত্ব করা সম্ভব! রাজ্যের রাজনীতি ছেড়েই দিলাম, গুরুদেব, রাজপ্রাসাদের যে কুটিল রাজনীতি - তারই বা কী জানবে, সেই তরুণ? রাজবংশের জাতক, আশৈশব এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে বড়ো হতে থাকেঅন্তঃপুরে তার একান্ত সহায়ক থাকেন পরামর্শদাতা রাজপিতা ও রাণিমাতা। অন্যদিকে সাধারণ গৃহস্থের নিরিবিলি সংসারে বড়ো হয়ে ওঠা এই তরুণ, হঠাৎ এক সকালে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করবে, রাজসিংহাসনে বসে আছে! না, না, গুরুদেব, সে এক দিশাহারা অবস্থা হবে তার”।

খুব মন দিয়ে মহর্ষি তাঁর দুই প্রিয় শিষ্যের বক্তব্য শুনলেন, তারপর স্মিতমুখে বললেন, “তোমাদের এই আশঙ্কা একান্তই বাস্তব এবং পরমসত্য। কিন্তু মহারাজ অঙ্গ বংশ ছাড়া আমাদের রাজ্যে অন্য কোন রাজপুত্র বা রাজবংশের কথা তোমাদের জানা আছে কি? ভিন্ন রাজ্যের যুবরাজকে আমরা নিশ্চয়ই এই রাজ্যের সিংহাসন উপহার দিতে পারি না?”

আচার্যগণ নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন, তারপর আচার্য রত্নশীল বললেন, “না, গুরুদেব, আমাদের হাতে এই মূহুর্তে বিকল্প কোন রাজবংশের যুবক, প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধও নেই!”

“বৎসগণ, তাহলে তোমাদের মনে এত দ্বিধা কেন? আমাদের কাছে বিদ্যাশিক্ষা করতে যারা আসে, তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সরল বালককোনো একদিন তোমরাও সকলেই তাই ছিলে কিন্তু, আজ তোমরা নিজেরাই এক একটি প্রতিষ্ঠান। তোমরা সকলেই নিজ নিজ বিদ্যায় বুদ্ধিতে অত্যন্ত সফল এবং ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সেক্ষেত্রে একজন সুস্থ, সবল, বুদ্ধিমান তরুণকে একজন রাজা বানিয়ে তোলা কেন তোমাদের অসম্ভব মনে হচ্ছে?” সামান্য বিরতি দিয়ে সকলের মুখভাব তিনি লক্ষ্য করলেন, তারপর আবার বললেন, “এ কথা সত্য রাজবাড়িতে কিংবা রাজবংশের জাতক, আজন্ম একটা রাজকীয় পরিবেশে বড় হয়, সেটা তার বাড়তি সুবিধা। তেমনি সেটা বিশেষ ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণও হতে পারে। মহারাজ অঙ্গের মতো একজন ধার্মিক প্রজাপিতা রাজার পুত্র হয়েও, যেমন হয়েছে বর্তমান রাজা বেণের ক্ষেত্রে।  উদ্ধত, স্বৈরাচারী, দুরাচারী, দাম্ভিক। যাঁর রাজ্য পরিচালনা থেকে আমরা সকলেই মুক্তি পেতে চাইছি”।

আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “এ কথা সত্য, গুরুদেব। কিন্তু তাও –”

আচার্য সুনীতিকুমারের কথায় হাসলেন মহর্ষি ভৃগু, “কোন কিন্তু নেই, বৎস, সুনীতিকুমার। এই তরুণ কোন রাজবংশে লালিত হয়নি, ঠিকই। কিন্তু সে বড়ো হয়েছে গ্রাম্য পরিবেশে। সনাতন ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী এক সাধারণ পরিবারে। তার নিজস্ব মূল্যবোধ, জীবনবোধ; তার আচরণ, তার স্বাভাবিক বিনয় আমাদের কাজটা অনেক সহজ করে দেবে। আমাদের দেওয়া শিক্ষা গ্রহণ করতে তার কোন দ্বিধা হবে না। আমাদের পরামর্শ তার কাছে অসহ্য মনে হবে না, কারণ তার বেড়ে ওঠা মাটির খুব কাছাকাছি জীবনের পথ ধরে। রাজবাড়িতে পালিত কোন রাজপুত্রের মতো সে কখনো দাম্ভিক হবে না”।

“অর্থাৎ, আমাদের সকলেরই দায়িত্ব, তাকে রাজার মতো রাজা করে তোলা”। আচার্য নিলয় মহর্ষি ভৃগুর দিকে তাকিয়ে বললেন। 

উত্তরে মহর্ষি উজ্জ্বল মুখে বললেন, “ঠিক তাই। বংশানুক্রমে আমরা রাজা পেয়ে যাই বলেই, আমার এই প্রস্তাব তোমাদের মেনে নিতে দ্বিধা হচ্ছেকিন্তু ইতিহাস চিন্তা করে দেখ, যে কোন রাজবংশের যিনি প্রতিষ্ঠাতা রাজা, তিনি আদিতে সাধারণ মানুষই ছিলেন। তাঁর মধ্যে বিশেষ কিছু গুণের জন্যে সকলে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল, তাই তিনি রাজা হয়েছিলেন। তারপর তাঁর অবর্তমানে তাঁর সন্তান-সন্ততিদেরই আমরা মেনে নিই। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই সব গুণ থাকলে ভালো, এমনকি না থাকলেও!”

মহর্ষি ভৃগু কিছুক্ষণের জন্যে বিরতি দিলেন, সকলে তাঁর কথা যেন যথার্থ উপলব্ধি করতে পারে, তারপর আবার বললেন, “প্রিয় শিষ্যগণ, আমরা আজ এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের কাছে দুটো মাত্র পথ খোলা আছে। এক, চুপচাপ বর্তমান রাজাকে মেনে নিয়ে, তাঁর সকল দুরাচার ও অত্যাচার মাথা নত করে সহ্য করা। অথবা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন এক জনদরদী রাজা তৈরি করা। কে বলতে পারে, আমাদের আজকের এই সিদ্ধান্ত, আমাদের এই মিলিত প্রচেষ্টা; আমাদের এই দেশের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবে না?

আমরা ব্যর্থও হতে পারি। যে কোন প্রচেষ্টা সর্বদা সফল হবেই এমন হয় না, বৎসগণ।  এর আগে অন্য এক প্রচেষ্টায় আমি মহারাজ অঙ্গের বংশরক্ষার এক আয়োজন করেছিলাম। আমার সঙ্গী ছিলে তোমাদের মধ্যেই অত্যন্ত স্নেহের তিনজন; যজ্ঞশীল, বেদব্রত আর ধর্মধর। সে প্রচেষ্টায় আমরা সফল হয়েছিলাম, রাজা অঙ্গ পুত্রসন্তান লাভ করেছিলেন। কিন্তু সহকার বৃক্ষে তীব্র হলাহলময় বিষফল উৎপন্ন হবে, এটা ভাবতে পারিনি। সেখানে আমার ব্যর্থতা ঘটে গেছে।

এই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই আমি বলছি। আমার এই প্রস্তাব এবং প্রচেষ্টায় তোমাদের সকলের আন্তরিক সহমত একান্ত জরুরি। তোমাদের সকলের সম্যক সমর্থন না পেলে, এ আলোচনা সম্পূর্ণ অর্থহীন। সময়ের অকারণ অপচয়। অতএব তোমাদের উপর নির্ভর করছে, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ”।

মহর্ষি ভৃগু তাঁর বক্তব্য শেষ করে, উপস্থিত শিষ্যদের মতামতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 

বিশ্বপ্রভ তার আসন থেকে উঠে, মহর্ষি ভৃগুর কাছে গেল, নত হয়ে অত্যন্ত নীচু স্বরে বলল, “গুরুদেব, কিঞ্চিৎ জলযোগের ব্যবস্থা নিয়ে দ্বারে ধরণী অপেক্ষা করছে, আপনার অনুমতি পেলে –”

মহর্ষি ভৃগু হাসতে হাসতে বললেন, “ওদের আসতে বল, বিশ্বপ্রভ। গুরুগম্ভীর আলোচনায়, সকলেই ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। জলখাবার গ্রহণের ব্যাপারে সহমত না পাওয়ার কোন কারণ দেখছি না। কি বল, বৎস বিকচ? তুমি কোন কথাই বলছো না, বিকচ। তোমার অন্তরের কথা ফুলের মতোই বিকচিত হয়ে উঠুক। আমাদের মনের মধ্যে ভরে উঠুক সৌরভ”।

আচার্য বিকচ একটু নড়েচড়ে বসলেন, তারপর সামান্যে কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন, “আমি আপনার সঙ্গে একমত, গুরুদেব”।

মহর্ষি ভৃগু মুচকি হেসে বললেন, “কোন ব্যাপারে, বৎস বিকচ, জলখাবার গ্রহণের ব্যাপারে?”

মহর্ষি ভৃগুর কথায় উপস্থিত সকলেই হেসে উঠলেন। গুরুদেবের এই লঘু-আলাপে আচার্য বিকচ একটুও অপ্রস্তুত হলেন না, দীর্ঘদিন গুরুদেবের সঙ্গী হিসেবে, তিনি অত্যন্ত অভ্যস্ত। তিনি জানেন মহর্ষি ভৃগু গম্ভীর আলোচনার মধ্যেও পরিহাস করতে ভালোবাসেনতাতে পরিবেশ হালকা হয় না, হালকা হয় মানসিক উদ্বেগ, চিন্তায় স্বচ্ছতা আসে।

আচার্য বিকচ হাসতে হাসতে বললেন, “আমার পিতৃদেব, বিকচ নাম রেখেছিলেন, হয়তো ফুলের ফুটে ওঠা দেখেই। কিন্তু সেই নামকে আমি আরো সার্থক করে তুলতে, খাওয়ার সুযোগ পেলেই কচমচিয়ে খেতে আরম্ভ করি। গুরুদেব, আমাকে এখন বিকচমচ বললেও আমার কোন আপত্তি নেই”।

মহর্ষি ভৃগু ও অন্যান্য সকলেই, আচার্য বিকচর কথায় আরও একবার হেসে উঠলেন, আর সেই অবসরে ধরণী, কলাপাতা বিছিয়ে পরিবেশন করে দিতে লাগল জলখাবার। শসার ফালি দুটুকরো, দুফালি নারকেল, হালকা লবণের স্পর্শ লাগা তেলে ভাজা বাদাম। আশ্রমে প্রস্তুত ননীর একটি মণ্ড। পরিবেশন শেষ করে, ধরণী ও তার দুই সহকারি শালকু আর হানো কক্ষ ছেড়ে চলে যাবার পর, বিশ্বপ্রভ কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিল।

মহর্ষি ভৃগু স্মিতমুখে বললেন, “এখন তাহলে আলোচনার বিরতি। বিশ্বপ্রভ আর ধরণীর উদ্যোগে পাওয়া এই জলখাবারের জন্যে ওদের সাধুবাদ দিয়ে, আমরা শুরু করি স্বল্পাহার। আর এই অবসরে, তোমরাও সকলে তোমাদের ভাবনা চিন্তাগুলি একটু গুছিয়ে নাও”।  

১২

 

বিশ্বপ্রভর ব্যবস্থাপনার কোন জুড়ি মেলা ভার। আহারের পর, আচার্যরা যখন চিন্তা করছেন, হাত কোথায় ধোয়া যায় এবং উচ্ছিষ্ট কলাপাতাটি কোথায় ফেলা যায়, বিশ্বপ্রভ বলল, “আচার্যগণ, দ্বারের বাইরে একটি ঝুড়ি ও মাটির জালায় হাত ধোয়ার জল রাখা আছে। ঝুড়িতে উচ্ছিষ্ট পাতাগুলি ফেলে দেবেন, তারপর হাত ধুয়ে নেবেন”।

বিশ্বপ্রভর ব্যবস্থায় আচার্যদের সকলেই সন্তুষ্ট হলেন এবং হাতধুয়ে এসে সকলেই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। মহর্ষি ভৃগুও হাত ধুয়ে এসে বসলেন তাঁর আসনে।

সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা আবার আলোচনায় ফিরতে পারি। কারণ আমাদের অনেক কিছু আলোচনার বিষয় আছে, আর সময় সীমিত। আমরা আটকে ছিলাম, সকলের আন্তরিক সহমতের জায়গায়, বৎস বিকচ তার অভিমত জানিয়ে দিয়েছে, এখন অপেক্ষা বাকি সকলের”।

মহর্ষি ভৃগুর কথা শেষ হবার আগেই আচার্য সুনীতিকুমার ছাড়া সকলেই একবাক্যে সহমত হলেন, বললেন, “আমরা আপনার প্রচেষ্টায় সর্বশক্তি দিয়ে সামিল হতে চাই, গুরুদেব”। 

আচার্য সুনীতিকুমার বললেন, “আমিও আমার সহমত জানাচ্ছি, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। গুরুদেব, আপনার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব শোনার পর আমি আমার নিঃশর্ত অভিমত জানাবো”।

মহর্ষি ভৃগু স্মিতমুখে বললেন, “অতি উত্তম। এবার আমি তাহলে মুখবন্ধ ছেড়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে আসি। আমি আগেই বলেছিলাম সর্বগুণসম্পন্ন এক তরুণ আর সর্বশ্রীযুক্তা এক তরুণী খুঁজে আনতে হবে। যারা হবে আমাদের রাজ্যের রাজা ও রাণী। এই কাজের দায়িত্ব আমি সমর্পণ করতে চাই বেদব্রত ও ধর্মধরের উপর। এই কাজে অনেক ঘোরাঘুরি করতে হবে এবং থাকার ও আহারের অনেক অনিয়ম হবে। এই পরিশ্রম ও অনিয়ম সহ্য করা ওদের পক্ষে সহজসাধ্য হবে, কারণ ওদের বয়স আমাদের থেকে অনেকটাই কম, ওরা মধ্য যুবক। তোমরা এই দায়িত্ব গ্রহণে রাজি আছো, বৎস বেদব্রত ও ধর্মধর?”

“সানন্দে এবং সাগ্রহে রাজি, গুরুদেব। কবে রওনা হতে হবে, আদেশ করুন”।

আচার্য বেদ ও ধর্মধরের উত্তরে, খুশি হয়ে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “যদি বলি কালই প্রত্যূষে?”

“তাই হবে, গুরুদেব”। আচার্য ধর্মধর ও আচার্য বেদব্রত নির্দ্বিধায় বললেন।

স্মিতমুখে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “আমি নিশ্চিন্ত হলাম, বৎস। কিন্তু এত দ্রুত রওনা হওয়া সম্ভব হবে না। তোমরা বরং আগামীকাল প্রত্যূষে নিজ নিজ গৃহে ফিরে যাও। তোমাদের মাতা-পিতা, তোমাদের পত্নীদের থেকে সুস্থভাবে বিদায় নিয়ে, পরশুদিন প্রত্যূষে রওনা হও। তোমাদের উদ্দেশ্যর কথা অতি প্রিয়জনের কাছেও গোপন রাখতে হবে একথা বলাই বাহুল্য। তোমাদের কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে প্রশ্ন করতে পারো, বৎস”

আচার্য বেদব্রত বললেন, “আমাদের এই যাত্রার ব্যয় কি আমাদেরই বহন করতে হবে, গুরুদেব?”

আচার্য বেদব্রতর এই প্রশ্নে অনেকেই বিরক্ত হলেন, আচার্য যজ্ঞশীল বলেই ফেললেন, “বেদব্রত, এই কী তোমার বাচালতার উপযুক্ত সময়? তোমাদের এই যাত্রায় কি এমন ব্যয় হতে পারে, যা তোমাদের পক্ষে বহন করা কষ্টকর হবে? এই রাজ্যের গৃহস্থগণ গুরুদেব ভৃগুর শিষ্যদের আতিথ্যদানে সর্বদা প্রস্তুত, তুমি জানো না? তাহলে আর কিসের ব্যয়?”

মহর্ষি ভৃগু আচার্য যজ্ঞশীলকে হাত তুলে নিরস্ত করলেন, বললেন, “বৎস যজ্ঞশীল, অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই বেদব্রত তার প্রশ্ন তুলেছে। আমাদের এই কর্মে গোপনীয়তা এত জরুরি, সর্বদা গৃহস্থের বাড়িতে রাত্রিবাস সমীচিন নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে পান্থশালায় বাস করাই উচিৎ হবেআমাদের প্রচেষ্টার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সময়। আমরা যত দ্রুত ওই তরুণ ও তরুণীকে খুঁজে বার করতে পারবো, তাদের প্রস্তুত করে তুলতে আমরা তত বেশি সময় পাবো। সর্বত্র পদব্রজে চলাফেরাও অনেক সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে অশ্ব কিংবা গোশকটেও যাতায়াত করতে হতে পারে। এ সমস্তই যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং ব্যক্তিগত ব্যয়ের কোন স্থান নেই। অর্থের সংস্থান হবে, বেদব্রত”।

মহর্ষি ভৃগুর কথায় আচার্য রত্নশীল বললেন, “এই অর্থের সংস্থান আশ্রম করতে পারে, গুরুদেব। কারণ আশ্রমের স্বার্থেই আমাদের একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রজাপালক নৃপতির দরকার”।

আচার্য রত্নশীলের দিকে তাকিয়ে অনুমোদনের সম্মতি দিলেন মহর্ষি ভৃগু, বললেন, “অবশ্যই, আশ্রমেরও প্রত্যক্ষ স্বার্থ আছে। কিন্তু আমি এখনই আশ্রমকে এই প্রচেষ্টার মধ্যে জড়াতে চাইছি না। তোমরা জানো আজ মধ্যাহ্নে আমার কাছে তিন সম্ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠী এসেছিলেন। তাঁরা আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের বণিক সমিতির সম্মানীয় প্রতিনিধি। প্রসঙ্গতঃ তাঁরাও এই স্বৈরাচারী রাজশাসনের অবসান চান এবং সেই উদ্দেশ্যে আমাদের সাহায্যের প্রত্যাশায় তাঁরা এসেছিলেন। ওই বাণিজ্য সমিতিকে আমাদের এই প্রচেষ্টার কথা কিছুই বলিনি, তাও তাঁদের বিশ্বাস আমরা কোন একটা উপায় বের করতে পারবোই। সেই বিশ্বাসে, তারা কিছু অর্থ আমাকে দিয়ে গেছে, ভবিষ্যতে প্রয়োজন মতো আরো অর্থ সাহায্য করতে কার্পণ্য করবে না, সে প্রতিশ্রুতিও দিয়ে গেছে। অতএব ও নিয়ে আমাদের কোন চিন্তার কারণ দেখি না”।

মহর্ষি ভৃগু সকলের মুখভাব একবার পর্যালোচনা করলেন, তারপর স্মিতমুখে বললেন, “এবার তোমাদের কিঞ্চিৎ পরীক্ষা নেবো, বৎস বেদব্রত ও ধর্মধর। চিন্তা করো না, আমার এ প্রশ্ন তোমাদের অধীত বিদ্যা থেকেই!”

“আদেশ করুন, গুরুদেব”। আচার্য বেদব্রত বিনীত শিষ্যের মতোই উন্মুখ চেয়ে রইলেন মহর্ষি ভৃগুর মুখের দিকে।

“সর্বগুণসম্পন্ন রাজপুরুষের লক্ষণ কী কী?” মহর্ষি ভৃগু প্রশ্ন করলেন।

বিনা চিন্তায় আচার্য বেদব্রত উত্তর দিলেন, “লপ্রমুপ্র, বাদীবৃস্ক, শিউ, বুধীস্থি”।

আচার্য যজ্ঞশীল, আবার বিরক্ত হলেন, বললেন, “বেদব্রত কী সব আবোল তাবোল বকছ? তোমার ওই প্রলাপের অর্থ কি?”

মহর্ষি ভৃগু উচ্চস্বরে হাসলেন, বললেন, “বৎস যজ্ঞশীল, বেদব্রতের ওই শব্দগুলির সংকেত তুমি বিস্মৃত হয়েছো? ছাত্রকালে মুখস্থ রাখার সহজ পদ্ধতিটি আমরা আশ্রম থেকে কাউকে শেখাই না, অন্য শিষ্যদের থেকে তারা ঠিক শিখে নেয়। বৎস বেদ, তুমি লক্ষণগুলি সবিস্তারে বর্ণনা করো, তোমার গুরু যজ্ঞশীলের উদ্বেগ শান্ত করো”।

আচার্য বেদব্রত বিনীত স্বরে বললেন, “যথা আজ্ঞা, গুরুদেব। লপ্র মানে প্রশস্ত ললাট, মুপ্র মানে প্রসন্নমুখ, বাদী হল দীর্ঘবাহু, বৃস্ক মানে বৃষস্কন্ধ, শিউ হল উন্নত শির এবং বুদ্ধিমান, ধীর, স্থির হচ্ছে বুধীস্থি”।

“খুব ভালো, আর, শ্রীময়ীর কী লক্ষণ, বৎস বেদ?” মহর্ষি ভৃগু আবার প্রশ্ন করলেন আচার্য বেদব্রতকে।

“আজ্ঞে, গুরুদেব, গুনি, পীনি, আয়না, শোভা, প্রসবান্তা, সুলা সুভা। অর্থাৎ কিনা গুরুনিতম্বিনী, পীনস্তনী, আয়তনয়না, শোভনদন্তা, প্রসন্নবদনা, শান্তা, সুশীলা, সুভাষিনী”।

অত্যন্ত সন্তুষ্ট মহর্ষি ভৃগু হাসিমুখে বললেন, “অতি উত্তমএমন কোনো তরুণ তরুণীর কথা কি তোমাদের জানা আছে, বৎসগণ?”

“ধৃষ্টতা যদি মার্জনা করেন, একটা কথা বলি, গুরুদেব?”

“বলো, বৎস, বেদব্রত”।

“আজ্ঞে গুরুদেব, বিবাহের পূর্বে সুন্দরী নারীরা মোটামুটি এই সমস্ত লক্ষণেই অলংকৃতা থাকেন, কিন্তু বিবাহের পর তাঁরা নিজ স্বামীর প্রতি প্রায়শঃই প্রসন্নবদনা, শান্ত, সুশীলা ও সুভাষিনী থাকেন না”

আচার্য বেদব্রতর এই কথায় সকল আচার্য, মহর্ষি ভৃগু, এমনকি বিশ্বপ্রভও উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন। হাসির প্রকোপ কমতে মহর্ষি ভৃগু বললেন, “এ অভিজ্ঞতা কি তোমার নিজের ব্রাহ্মণীর অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছ, বৎস?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ, গুরুদেব”।

“এই অভিজ্ঞতার কথা আর কারো কাছে প্রকাশ করে মূঢ়তার পরিচয় দিয়েছ কি?

“আজ্ঞে না, গুরুদেব”

“এ অভিজ্ঞতা তোমার একার নয়, বৎস। আমাদের সকলের। কি বল হে, তোমরা সবাই?” সকলেই আবার হেসে উঠলেন। গম্ভীর আলোচনার মানসিক ভার নিমেষে হালকা হয়ে গেল সকলের মন থেকে।

আচার্য রণধীর বললেন, “আজ্ঞে গুরুদেব, সে কথা বলাই বাহুল্য”। 

মহর্ষি ভৃগু বললেন, “আমরা আবার এখন কাজের কথায় আসি। এই তরুণ তরুণীর নামও আমি ঠিক করে ফেলেছি। তরুণের নাম হবে পৃথু, এবং ওই তরুণী কন্যার নাম অর্চ্চি। পৃথুর জন্ম ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অংশে এবং অর্চ্চির জন্ম সনাতনী কমলার অংশে”। 

“এ কথা কি সত্য, গুরুদেব?” আচার্য ধর্মধর জিজ্ঞাসা করলেন। 

মহর্ষি ভৃগু স্মিতমুখে বললেন, “সত্য মিথ্যায় কিছু এসে যায় না, ধর্মধর। রাজনীতিতে সত্য-মিথ্যা খুবই আপেক্ষিক এবং দুটির মধ্যে সূক্ষ্ম সুতোর পার্থক্যসমাজের সার্বিক মঙ্গলের জন্যেই ধর্ম, কারণ ধর্ম আমাদের সমাজকে ধরে থাকে। আমরা যে প্রচেষ্টা নিয়েছি, সে এই সমাজের মঙ্গলের জন্যেই। অতএব বুদ্ধিজীবি হিসেবে আমরা ধর্মপালন করছি মাত্র। এই আপৎকালে ধর্মনীতি ও রাজনীতির মধ্যে কোন প্রভেদ নেই, ধর্মধর। আমাদের উদ্দেশ্য রাজ্যলাভের স্বার্থসিদ্ধি নয়, আমাদের উদ্দেশ্য অকল্যাণের বিনাশ ও সাধারণ জনগণের মঙ্গল। আমরা শ্রীবিষ্ণুর দেখানো পথেই তো চলেছি, ধর্মধর, তোমার মনে কি কোন দ্বিধা রয়েছে?” কেউ কোন উত্তর দিলেন না, সকলেই মহর্ষির মুখের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন।

সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে মহর্ষি ভৃগু আবার বললেন, “বৎস, বেদব্রত ও ধর্মধর, তোমরা বিশ্বপ্রভর থেকে পাঁচটি নিষ্ক নিয়ে নিও। ফিরে এসে তোমাদের ব্যয়সংক্রান্ত গণনা বিশ্বপ্রভকে দিয়ে দেবে। আচার্য রত্নশীল ও আমি, বিশ্বপ্রভর থেকে সে গণনা বুঝে নেব। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক, সফল হোক। আর একটা কথা বলি, শাস্ত্রে সব কথা থাকে না। সর্বলক্ষণ মিলিয়ে দেখার পরেও, তোমাদের বিচক্ষণ বিচারশক্তির অত্যন্ত প্রয়োজন, সে কথা ভুলে যেও না। আর সেই বিচার করবে মস্তিষ্ক দিয়ে, হৃদয় দিয়ে নয়সবশেষে বলি, নির্বাচনের পর এক দিনও বিলম্ব করবে না, যত দ্রুত সম্ভব গোপনে এই আশ্রমে ওদের নিয়ে আসবে। এখন যাও, যাত্রার প্রস্তুতি করো। আমরা নৈশ ভোজনের কালে আবার একত্র হবো। শুভমস্তু”।

আচার্য বেদব্রত ও ধর্মধর মহর্ষি ভৃগুকে প্রণাম করলেন, প্রণাম করলেন উপস্থিত সকল আচার্যকে। তারপর বিশ্বপ্রভর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন কক্ষ থেকে। বিশ্বপ্রভ কক্ষের দরজাটা চেপে বন্ধ করে এগিয়ে গেল ডানদিকে, যেদিকে মহর্ষি ভৃগুর আবাস-কক্ষ।

চলবে...




রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

অজুহাতের রক্তপাত

 



এর আগের অধ্যায় পড়া যাবে - এই সূত্রে ঃ-   "উপভোগের ভোগান্তি"



 ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে বাস্তুপুজো আদতে সাপের দেবী মা মনসার পুজো। বর্ষার বাদলে উপচে ওঠা নদীনালাখালবিল অধ্যুষিত গ্রাম বাংলায় সাপের বালাই বড়ো বালাই। মাঠে মাঠে চাষবাস শেষ। ক্ষেতে সজীব ধানের গোড়ায় জমে আছে হাঁটুভর জল। মাঠের সাপেরা গৃহহারা – তারা উদ্ব্যাস্ত উদ্বাস্তু হয়ে ঢুকে আসছে বসত বাড়ির আনাচে কানাচে। এদিকে শরৎ এসে গিয়েছে, বাতাসে হেমন্ত আর শীতের আগমনবার্তা। সাপেদের দীর্ঘ শীতঘুমের কাল আসন্ন। তাদের শরীরে চার-পাঁচমাসের উপযুক্ত ক্যালোরি সংগ্রহে রাখার জৈবিক তাগিদ। মানুষের সঙ্গে সাপেদের প্রত্যক্ষ শত্রুতা না থাকলেও ঘটে যেতে পারে ভুল বোঝাবুঝি – দংশন এনে দিতে পারে মানুষের অনভিপ্রেত মৃত্যু। আর সেই মারাত্মক বিপদ এড়াতেই এই পুজো। মা মনসার আরাধনা। 

লৌকিক এবং আদিবাসী দেবতা হিসেবে মনসার পুজোর প্রচলন ছিল কয়েক হাজার বছর আগে থেকে। কিন্তু উচ্চবর্ণ হিন্দুসমাজে তাঁর পুজোর প্রচলন হয়েছিল মোটামুটি খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। তবে লৌকিক দেবতার স্টেটাস থেকে হিন্দুর দেবীত্বে উত্তরণের জন্যে তাঁকে অবিশ্যি অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। যে কাহিনী ধরা আছে মনসা-মঙ্গলকাব্যে।

ঘটনার সূত্রপাত স্বর্গের দেবসমাজ থেকে। শিবের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও সৎমা চণ্ডীর কোপনজরে ছিলেন মনসা। কলহকালে চন্ডীর ক্রোধে মনসা হারান একটি চোখ আর মনসার বিষদৃষ্টিতে জ্ঞান হারান সৎমা চণ্ডী। তাঁদের কলহে অতিষ্ঠ শিব, কন্যা মনসাকে ত্যাগ করেন – যার ফলে মনসা পতিত হয়ে যান দেবসমাজ থেকে। কন্যার এই দুঃখে অসহায় শিবের অশ্রুপাত থেকে জন্ম হল মনসার নিত্য সহচরী নেতার। দেবসমাজ থেকে প্রত্যাখাতা হয়ে এই সময় মা মনসা মর্তে অবতীর্ণা হলেন ভক্ত সংগ্রহের আশায়। কারণ দেবসমাজে অন্তর্ভুক্তির অন্যতম শর্ত হল মানুষের পূজা। যে দেব অথবা দেবী মর্তে মানুষের নিয়মিত পুজো পান, তিনিই হতে পারবেন দেবসমাজের স্থায়ি মেম্বারঅর্থাৎ শুধুমাত্র শিবের কন্যা বলেই সেকালে দেবতার যোগ্যতা অর্শাত না, দেবতা হতে গেলে প্রমাণ করতে হত দেবত্ব! স্বজনপোষণের আধুনিক প্রথা দেব-সমাজে অন্তত তখনও চালু হয়নি!   

নিজের দেবত্ব প্রমাণের জন্যে মা মনসা পৌঁছলেন বঙ্গে। বঙ্গে তখন মুসলিম শাসন। কোন রাজা নয়, কোন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নয়, তিনি অবহিত হলেন চম্পক নগরীর সমৃদ্ধ বণিক চাঁদের কথা। তৎকালীন হিন্দু উচ্চবর্ণে চাঁদ বণিকের এমনই প্রভাব, চাঁদ যদি মা মনসাকে পুজো করেন, তিনি উৎরে যাবেন দেবত্বে। কাজেই মা মনসা টার্গেট করলেন চাঁদসদাগরকে। কিন্তু চাঁদ শিব ও চণ্ডীর একান্ত ভক্ত, মনসার অনুরোধ তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন – বললেন – “যেই হাতে পুজি আমি শিব ও শিবানী, সেই হাতে না পুজিব চ্যাংমুড়ি কানী”। মা মনসার মাথা নাকি চ্যাং মাছের মতো এবং একটি চোখ তাঁর অন্ধ, তাই কানী।

শুধু তাই নয়, তিনি হাতে হেতাল গাছের ডাণ্ডা নিয়ে দিন রাত ঘুরতে লাগলেন মা মনসার খোঁজে। দেখা পেলে তিনি নাকি মা মনসার মাথা ভেঙে মেরেই ফেলবেন এবং আপদ বিদেয় করে তিনি সুখে সংসার করবেন। 

“চম্পক নগরে ঘর চাঁদ সদাগর।

মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর।।

দেবীর কোপেতে তার ছয় পুত্র মরে।

তথাচ দেবতা বলি না মানে তাঁহারে।।

মনস্তাপ পায় তবু না নোয়ায় মাথা।

বলে “চেঙমুড়ি বেটি কিসের দেবতা”।।

হেতাল লইয়া হস্তে দিবা নিশি ফেরে।

মনসার অন্বেষণ করে ঘরে ঘরে।।

বলে “একবার যদি দেখা পাই তার।

মারিব মাথায় বাড়ি না বাঁচিবে আর।।

আপদ ঘুচিবে মম পাব অব্যাহতি।

পরম কৌতুকে হবে রাজ্যেতে বসতি”।।”

(কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বিরচিত “মনসামঙ্গল” থেকে উদ্ধৃত; কৃতজ্ঞতাঃ “প্রথম আলো” ব্লগ)

ক্রুদ্ধ মা মনসা এরপর উঠে পড়ে লাগলেন শিবের একান্ত ভক্ত কিন্তু অসম্ভব জিদ্দি চাঁদ বণিককে জব্দ করার জন্যে। চাঁদের ছয়টি পুত্রকে তিনি আগেই হত্যা করেছিলেন, তাতেও হার না মানা চাঁদ সাত-সাতটি বিশাল জাহাজ পূর্ণ বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে বের হলেন দক্ষিণদেশের উদ্দেশ্যে কালীদহে পৌঁছে মা মনসার চক্রান্তে ডুবে গেল সবকটা তরী - লোকলস্কর মাঝিমাল্লা সমেত। কোনক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ঘরে ফিরলেন সর্বস্বান্ত চাঁদ।

নিঃস্ব চাঁদের ঘরে এল পুত্রসন্তান লক্ষ্মীন্দ্র, লখাই – বিয়ের বাসরঘরে সর্পদংশনে অকালমৃত্যুর ভাগ্য নিয়ে। লখাই বিবাহযোগ্য হলে বন্ধুকন্যা বেহুলার সঙ্গে লখাইয়ের বিয়ে ঠিক করলেন চাঁদ। আর লোহার নিশ্ছিদ্র বাসরঘর বানানোর নির্দেশ দিলেন বিশ্বকর্মাকে। কিন্তু সেখানেও বাদ সাধলেন মা মনসা, ভয় দেখিয়ে তিনি ছোট্ট ছিদ্রপথ রাখতে বাধ্য করলেন বিশ্বকর্মাকে, আর সেই ছিদ্র পথেই কালনাগিনী প্রবেশ করল লখাইয়ের লোহার বাসরঘরে। দংশনে মৃত্যু হল লখাইয়ের, সর্পদষ্টকে নদীবক্ষে ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার নিয়মভেলায় ভেসে চলল লখাই, সঙ্গে রইল নাছোড় বেহুলা।

দীর্ঘ নদীযাত্রার পর নেতাধোবানির ঘাটে শেষ হল বেহুলার কঠিন তপস্যা, মা মনসার সহচরী নেতার মধ্যস্থতায় প্রাণ ফিরে পেল লখাই, শর্ত একটাই - যে করেই হোক চাঁদ বণিককে রাজি করাতে হবে মা মনসার পুজো দিতে। জীবন্ত স্বামীসহ গ্রামে ফেরা পুত্রবধূ বেহুলার সনির্বন্ধ অনুরোধ এবার আর ফেলতে পারলেন না, চাঁদ শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হলেন এবং বাঁ হাতে একটি ফুল দিয়ে সেরে ফেললেন মা মনসার পুজো। দিকে দিকে রটে গেল সেই বার্তা, শুরু হয়ে গেল মর্তে মা মনসার পুজো।

আমার দিদিমা ও বাড়ির অন্যান্য সবাইকে দেখেছিলাম নিশ্ছিদ্র শুদ্ধতায় ও নিষ্ঠায় এই পুজোর জোগাড় করতে। মনে হয়েছিল সেই শুদ্ধতার পিছনে যতটা না ভক্তি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ভয়। যেন পুজোর আচারে সামান্য ত্রুটি হলেই ঘটে যাবে অনর্থ – সংসারে মারাত্মক অকল্যাণ ঘটে যেতে পারে দেবীর কোপে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে দিদিমার কাছে শুনেছিলাম এই কাহিনী।

পঞ্চনাগের অলংকারে সজ্জিতা ছোট্ট মাতৃমূর্তি। তাঁর পূজো হল শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনে। নৈবেদ্যের প্রধান উপচার ছিল দুধ আর কলা। কিন্তু মনে হল এই শাস্ত্রীয় পুজোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল লোকাচার। ফণীমনসা গাছের কণ্টকিত পুরু চ্যাপ্টা সবুজ একটা ডালকে পুকুরে স্নান করানো হল। স্নানের পর সিঁদুর দিয়ে সেই ডালে এঁকে দেওয়া হল ত্রিনয়ন আর সিঁথির সিঁদুর। তারপর সেই ডালটিকে লালপাড় কোরা শাড়ীতে মুড়ে দেওয়া হল – ঠিক ঘোমটা দেওয়া কোন বধূর মুখের মতো। সেই সজ্জিত ফণীমনসার ডালটি অধিষ্ঠিতা হলেন বহুপ্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষের থানে। সেই থানে এসে যথাসাধ্য উপচারে গ্রামের মহিলারা ও কুমারী মেয়েরা গড় হয়ে প্রণাম করে যাচ্ছিল একে একে। জাত-পাত, উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র কোন ভেদাভেদ নেই – সেই প্রতীকী ফণীমনসা মূর্তির সামনে। উপস্থিত মহিলারা সমবেত উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ আর যৌথ ব্রত গানে ভরিয়ে তুললেন উন্মুক্ত প্রান্তর - প্রকৃতিপিছনে বাজছিল ঢাকের বাদ্যি। সে বাদ্যির আওয়াজ দুর্গাপুজোয় যে সুর সেরকম নয়, একদম অন্যরকম - একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন। 

পুজো অর্চনার শেষ পর্যায়ে আনা হল কালো কুচকুচে একটি পাঁঠা। খুঁতহীন সুন্দর শরীর। যৌবনের উন্মেষ বোঝা যায় তার মাথায় শিংয়ের আভাস থেকে তিন-চারদিন আগে হাট থেকে তাকে বাড়িতে আনা হয়েছে নগদ মূল্যে। এই কটাদিন তার আপ্যায়ন হচ্ছিল সতেজ তৃণ আর সুস্বাদু কাঁঠাল পাতায়। তার আচরণে এতদিন কোন অস্বস্তি বা অসহযোগীতার লক্ষণ চোখে পড়েনি। কিন্তু আজ এই দেবস্থানে আসতে সে এত নারাজ কেন? সমবেত উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ, ঢাকের বাদ্যি আর এই জনসমাগম কি তার মনে এনে দিয়েছে ভয়? নিদারুণ মৃত্যু যে তার আসন্ন সে কি বুঝতে পারছে? 

চারপাঁচজন মিলে সেই অজবালককে সামলাতে লাগল। আর পুরোহিত তার কপালে এঁকে দিলেন রক্তবর্ণ সিঁদুরের দীর্ঘ তিলক। গলায় পরিয়ে দিলেন রক্তজবার মালা। তাকে বিধিমতো পবিত্র করে নিলেন গঙ্গোদকে আর মন্ত্র উচ্চারণে, তাকে উৎসর্গ করে দেওয়া হল দেবীর চরণে। এরপর তার গ্রীবা বেঁধে দেওয়া হল অস্থায়ী হাড়িকাঠের আগড়ে। একজন তার সামনের দুই পা আরেক জন পিছনের দুইপা টেনে চেপে ধরে থাকল সেই অজ-বালকেরবিশাল খাঁড়া হাতে এক শীর্ণ চেহারার প্রৌঢ়বীর এতক্ষণ প্রস্তুত ছিলেন, তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন – “জয়, মা মনসার জয়”, সমবেত জনগণও সমস্বরে বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, “জয়, মা মনসার জয়”। অতি দ্রুত খাঁড়া নেমে এল - মুণ্ডহীন অজশরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগল রক্ত। সেই রক্তের টীকা শরীরে নেবার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল উপস্থিত জনগণের মধ্যে। ওই উন্মাদনায় আমি সামিল হতে পারলাম না। ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি প্রত্যক্ষ করতে থাকলাম বাংলার লোকধর্মের প্রাচীন পরম্পরা আর দেবতার থানে বিপন্ন আম-মানুষের ব্যাকুল আর্তি।


সেই অজবালকের অকালমৃত্যু ও রক্তপাত কি সত্যি সত্যি এনে দিল দেবতার সন্তুষ্টি? ফলতঃ উপস্থিত এতগুলি মানুষের বুকের খাঁচাগুলোও কি ভরে উঠল নিশ্চিন্তে বাঁচার আশ্বাসে! নাকি কোন এক প্রাচীন কালে কতিপয় ধর্মধারী তাঁদের রসনাতৃপ্তির জন্যে বানিয়ে তুলেছিলেন এমন একটি অজুহাত? যা পরে পরিণত হয়েছে ধর্মীয় সংস্কারে! ওই অজবালকের শরীর অধিকার অনুযায়ী বিভাজিত হয়ে যাবে কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিবারে। পেঁয়াজ ও রশুনের স্পর্শরহিত কচি পাঁঠার “নিরামিষ” ধার্মিক ঝোল রান্না হয়ে সিক্ত করবে তাঁদের তৃপ্তির অজমাংস-ভোগ! এই রক্তপাত কি রসনার স্বাদবদলের অজুহাত? 

-00-

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫

টুপুরের পেট

 

 


ঘরে ঢোকামাত্র টুপুর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘ও মা, মামা এসেচে, ও মা, মামা এসেচে’। টুপুরের ঠাকুমার হাঁটুতে ব্যথা, চলতে গেলে একটু দুলে দুলে হাঁটেন, আমাকে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে এলেন, বললেন, ‘টুপুরসোনা, মামাকে বিরক্ত করো না, মামাকে আগে বসতে দাও। বাড়ির সব খবর ভালো তো? বেয়াই বেয়ান সবাই ভালো আছেন?’ শেষের কথাগুলো, টুপুরের ঠাকুমা আমাকে বললেন।

আমি নীচু  হয়ে প্রণাম করে বললাম, ‘হ্যাঁ মাসীমা সবাই ভালো আছেন, আপনার শরীর ভালো তো?’

‘ওই চলে যাচ্ছে কোন রকমে। হাঁটুদুটো নিয়েই বড্ডো জ্বলছি। হাঁটুর ব্যথা যে কী ব্যথা বাবা, শত্তুরেরও যেন না হয়’

আমি টুপুরের হাত ধরে সোফায় গিয়ে বসতেই, টুপুর আমার কোলের কাছে এসে, দু হাতে আমার দু গাল টেনে ধরল, বলল, ‘ও মামা, আমায় একটা পেট কিনে দাও না’।

‘সে কী তোর পেট নেই? কই দেখি? ভগবান তোকে বানানোর সময় পেট বানাতে ভুলে গেছেন নাকি?’

‘আরেঃ, এ পেট সে পেট নাকি? তুমি না বড্ডো বাজে বকো। আমি বলছি পেট, পে-এ-ট, মানে পোষার জন্যে কিছু’। টুপুরের মা চুমকি ঘরে এসে ঢুকল, বলল, ‘ঢোকা মাত্র ভাগ্নীর খপ্পরে পড়ে গেছিস, দাদা? চা খাবি না কফি?’

বোনকে বললাম, ‘এখন চা দে, পেট ঠিক হলে কফি। কী পেট নিবি ডগি, না কাবলি বেড়াল? খরগোশ না গিনিপিগ? টিয়াপাখি না মুনিয়া? সাদা ইঁদুর না রঙিন মাছ?’ শেষের কথাগুলো বললাম টুপুরকে।

‘ধ্যাৎ, ওসব তো আমাদের বন্ধুদের সবার আছে! তুমি এমন কিছু বলো যা অন্য কারো নেই’।

‘বলিস কী? তোর বন্ধুদের পেটে পেটে এত? নতুন কিছু, নতুন কিছু...আইডিয়া...একটা মোরগ নিলে কেমন হয়? বেশ লাল ঝুমকো ঝুঁটিওয়ালা, ধপধপে সাদা। তোদের বারান্দাতে লম্বালম্বা পায়ে ঘুরে বেড়াবে। আর ভোরবেলা, পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙিয়ে ডাকবে কঁ ককর কঁ’।

টুপুর মন দিয়ে শুনল, তারপর বলল, ‘কোলে নিয়ে আদর করা যাবে? সেলফি তুলে ফেসবুকে ছবি আপলোড করা যাবে?’

এদিকটা আমি চিন্তা করিনি, বললাম, ‘তা হয়তো করা যাবে। কিন্তু মোরগ রেগে গেলে ঠুকরে দেয়, নখ দিয়ে খিমচেও দেয়’!

টুপুর গম্ভীরগলায় বলল, ‘নাঃ চলবে না। অন্য কিছু বলো’।

‘মোরগ চলবে না? তাহলে...ছোট্ট একটা ছাগল ছানা। বেশ কালো কুচকুচে রঙ। মাথায় ছোট্ট ছোট্ট শিং। ডাকেও মন্দ না। তুই যেমন মাকে ডাকিস, সেও তোর মাকে ডাকবে, ম্যা...। পায়ে পায়ে সারাদিন ঘুরবে। গলায় সুন্দর একটা দড়ি বেঁধে পার্কে নিয়ে ঘুরবি। ঘাসপাতা খাবে। ছাগল কাঁঠালপাতা খুব ভালোবাসে। তোদের পার্কে কোন কাঁঠাল গাছ নেই?’

‘ধ্যাৎ, তুমি যতো পচা পচা আইডিয়া দিচ্ছো’।

‘ছাগলের আইডিয়াটাও তোর পছন্দ হল না? তাহলে একদিন চিড়িয়াখানায় চল। ওখানে অনেক ধরনের জীবজন্তু আছে। ধর একটা জিরাফ নিলি! রোজ সন্ধেবেলা তোদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে, আর লম্বা গলা তুলে দেখবে, তোর বাবা অফিস থেকে বেরোলেন কিনা! বর্ষাকালে রাস্তায় হাঁটুজল, তোর বন্ধুরা জুতো হাতে জল ভেঙে হাঁটছে আর নাকাল হচ্ছে! পাশ দিয়ে তুই জিরাফ চেপে বেরিয়ে যাবি, ফিটফাট স্কুলড্রেস, পায়ে জুতো পরে, পিঠে বইয়ের বোঁচকা নিয়ে। সব্বার আগে স্কুলে পৌঁছে আন্টিকে বলবি, গুডমর্নিং ম্যাম। আন্টি তখন শাড়িটাড়ি ভিজিয়ে হাতে চটি নিয়ে সবে স্কুলে পৌঁছেছেন’।

চুমকি আমাকে চা দিল, সঙ্গে দুটো বিস্কিট, চুমকি বলল, ‘দুজনে কী আরম্ভ করেছিস বলতো? তুই ওর মাথায় ওইসব আইডিয়া ঢোকাচ্ছিস তো, দাদা, তুই চলে যাবার পর আমাদের সক্কলের মাথা খাবে’

টুপুর খুব সিরিয়াস, মায়ের কথায় কান দিল না, বলল, ‘জিরাফটা ভালোই বলেছো। কিন্তু বর্ষার জমা জলে হাঁটতে আমার দারুণ মজা লাগে। জিরাফের পিঠে চাপলে সে মজা কী করে হবে?’

‘না, তা হবে না। তাছাড়া বর্ষার দিনে জিরাফকে বের না করাই ভালো। বৃষ্টির ঝাপটাতে জিরাফের রঙ উঠে যেতে পারে’।

টুপুর খুব অবাক হল, বড়ো বড়ো চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এঃম্মা, জিরাফের রঙ উঠে যায় নাকি?’

‘যায় না আবার? আকচার যায়। বিশেষ করে, সস্তার জিরাফ হলে তো কথাই নেই। কেনবার সময় দোকানদার বলেই দেবে, “রঙের কোন গ্যারান্টি নেই, দিদি”!

এ কথায় টুপুর খুব মজা পেল, খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, ‘“রঙের কোন গ্যারান্টি নেই, দিদি”। আমাকে দিদি বলবে? তুমি না, মামা, কী যে বলো?’

‘বলবে না? তোকে দিদি বলবে না? তুই কী আর ছোটটি আছিস নাকি? ক্লাস ফোর! চাট্টিখানি কথা! বাপরে। আর ক্লাস ফোরের ছেলেমেয়েদের ভয় করে না, এমন দোকানদার কেউ আছে’?

টুপুর এখন আবার গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, ‘তোমার সেই পচা ট্যাগলাইনটা বলবে তো? “ক্লাস ফোর, জুতো চোর”!’ আমি একটু দমে গেলাম, টুপুরসোনাকে বোকা বানানো আমার উচিৎ কাজ হয়নি।

কথা ঘোরাতে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। সে কথা বলছি না। কিন্তু ধর বর্ষায় ভিজে জিরাফের ঠাণ্ডা লেগে গেলে, কী হবে? আমাদের ঠাণ্ডা লাগলে খক খক করে কাশি। আমাদের ছোট্ট গলার কাশির আওয়াজেই কান পাতা যায় না। আর জিরাফের অত্তো লম্বা গলার কাশি? বাপরে সে একেবারে সাংঘাতিক হয়’।

‘তাহলে বর্ষার দিনে জিরাফ বের করা যাবে না?’

‘না বের করা যাবে, তার অন্য উপায়! জিরাফের জন্যে যদি একটা রেনকোট কিনে দেওয়া যায়, তাহলেই জিরাফ আর ভিজবে না!’ টুপুরের ঠাকুমা সামনে বসেছিলেন, তিনি খুব হাসতে লাগলেন।

আর চুমকি বলল, ‘তোর মাথাতে আসেও, দাদা। টুপুরসোনা, তুমি ছোট্ট বলে, তোমার রেনকোট আমি পরাতে পারি, কিন্তু জিরাফের লম্বা গলায় আমি রেনকোট পরাতে পারবো না। তোমার মামাকে বলো, বৃষ্টি হলেই আমাদের বাড়ি চলে আসবে, আর জিরাফের গায়ে রেনকোট পরিয়ে দেবে। তারপর বাড়ি ফিরলে জিরাফের গা থেকে রেনকোট খুলে, ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে দিয়ে যাবে’।

টুপুর কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, ‘তুমি কী পারবে? মনে হয় না। তুমি তো আমার জন্মদিনে আসবে বলেও আসতে পারলে না। তোমার ওপর ভরসা করে জিরাফ নেওয়া, ঠিক হবে না। অন্য কিছু ভাবো’।

‘হুঁ। জিরাফটা একটু বড়ো হয়ে যাচ্ছে। ছোটখাটো কিছু নিলে কেমন হয়? কচ্ছপ চলবে? কচ্ছোপের  গায়েও সুন্দর ছোপ ছোপ থাকে। আর ওদের গায়ের রঙ খুব টেঁকসই হয়। ওরা জলেও থাকে, ডাঙাতেও থাকে, কিন্তু রঙ ওঠে না রাখার কোন অসুবিধে নেই। এখন তো তুই অ-নে-ক বড়ো হয়ে গেছিস, তোর খুব ছোট্টবেলায় চানের জন্যে একটা প্লাস্টিকের গামলা ছিল, মনে আছে? সেটায় জল ঢেলে রেখে দিলেই চলবে। কোলে নিয়ে আদর করতে পারবি। সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে পারবি’।

টুপুরের মা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘তোর প্রোফাইল ইমেজেও দিতে পারিস, ভারি মানাবে। কচ্ছপও তোর মতোই সব ব্যাপারে খুব স্লো’।

এ ব্যাপারটা টুপুরর পছন্দ হল না, মুখটা একটু গোমড়া করে তুলল। তাই দেখে আমি বললাম, ‘একটু স্লো হতে পারে। কিন্তু খরগোশকে হারিয়ে দিয়েছিল, সেটা ভুলে যাস না চুমকি!’

‘কচ্ছপ খরগোশকে হারিয়ে দিয়েছিল? কিসে? কবে? কী করে?’ টুপুর খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল এই খবরে।

‘সে কী? “স্লো বাট স্টেডি উইন্‌স্‌ দা রেস্‌” গল্পটা পড়িস নি?’

‘ও সেই টরটয়েজ আর হেয়ারের স্টোরিটা? সেটা তো জানি! তুমি যে বললে কচ্ছপ আর খরগোশ’?

‘ও বাবা, তুই টরটয়েজ মানে কচ্ছপ আর হেয়ার মানে খরগোশ জানিস না বুঝি?’ টুপুর একটু লজ্জা পেল, ফ্রকের একটা ফিঁতে মুখে নিয়ে চিবুতে লাগল, মুখ নীচু  করে। টুপুরের মা, চোখ বড়ো বড়ো করে খড়খড়ে গলায় বলল,  ‘টুপুর, টর্টয়েজ মানে কচ্ছপ আর হেয়ার মানে খরগোশ তোমাকে বলিনি? বাংলায় কত পেয়েছে জা্নিস, দাদা? সাঁইত্রিশ’।

‘একশতে?’

‘না পঞ্চাশে’।

‘খারাপ কী পেয়েছে? চুয়াত্তর পারসেন্ট? বাংলায় তুই কত পেতিস, চুমকি?’

‘তুমি বড়ো বাজে বকো, দাদা। আমাদের সময় পরীক্ষাগুলো খুব টাফ হতো। ওদের ক্লাসে বাংলায় হায়েস্ট কত জানো? ঊণপঞ্চাশ!’

‘আমি হলে তো পঞ্চাশ নিতাম। এক নম্বরও ছেড়ে দেব! এত বোকা আমি! যাগ্‌গে, তাহলে কী হল, টুপুরসোনা? কচ্ছপই ফাইন্যাল তো?’

টুপুর খুব গম্ভীর হয়ে বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে, তার মা আর মামার কথা শুনছিল। এখন মেঝের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না, শুধু ঘাড় নাড়ল। না, কচ্ছপ মোটেই ফাইন্যাল নয়। আমি বললাম, ‘যাঃ কচ্ছপটাও পছন্দ হল না? ট্রাই করে দেখতে পারতিস। তোর যে বন্ধুর কাছে হেয়ার আছে, তাকে বলতে পারতিস, মে বি স্লো, বাট কচ্ছপ ইজ দা উইনার’।

টুপুর মোটেই রাজি নয়, বলল, ‘না, টর্টয়েজ পচা’।

‘তাহলে একটা কথা বলবো?’ টুপুর আমার দিকে তাকালো। ‘মাথা থেকে ওই সব পেটের ব্যাপারটা সরিয়ে ফেল। আমার কতো পেট আছে জানিস? পনেরটা পায়রা, তেরটা কাক, সাতটা শালিক, চারটে চড়ুই। অবাক হচ্ছিস? আরো আছে, একটা জবা, একটা রঙ্গন, একটা নয়নতারা’। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল টুপুর

‘রোজ সক্কাল সক্কাল আমি যখন ছাদে যাই, পায়রা আর কাকগুলো উড়ে এসে বসতে থাকে ছাদের আলসেতে। কাকগুলো বলে, কয় কয় কয়, বলে, কাঃ কাঃ কাও! পায়রাগুলোও বলে, তবে তাদের বকবক কম। শালিকগুলো তো রীতিমতো ঝগড়া করে, আর চড়ুইগুলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়ে আর চিলিক চিলিক ডাকে। মুঠো করে ছাদে ছড়িয়ে দিই, চালের দানা, গমের দানা, চিনা ঘাসের দানা। আলসে থেকে তারা নেমে আসে, খুঁটে খুঁটে সব্বাই দানা খায়। পায়রাগুলো খায় আর ঘুরে ঘুরে বলে,  থ্যাংকিউকিউ থ্যাংকিউকিউ।

ওরা যখন খায়, ততক্ষণে আমি ছোট্ট মগে জল নিয়ে, জল ঢালি ফুলগাছের টবে। সকালের হাওয়ায় তারা খুব দুলতে থাকে। জবাগাছ রোজ অন্ততঃ দুটো ফুল ফো-টা-বে-ই। আমি যখন জবাগাছের পাতায় পাতায় জলের ছিটে দিই, তার ফুলের লম্বা কেশর দুলিয়ে আমার হাতে সুড়সুড়ি দে-বে-ই। এত দুষ্টু!  রঙ্গনও কম যায় না, টুকটুকে লাল ফুলের থোকা সাজিয়ে হাসতে থাকে রোজ! ওর আবার রোজ রোজ নতুন ফুল ফোটানোর স্বভাব নয়। কয়েকদিন খুব খেটেখুটে এক থোকা ফুল বানিয়ে তোলে। সে ফুলের গোছা অনেকদিন থাকে। কিছুদিন পর রঙ্গনের পাতা ঢাকা পড়ে যায়, ছোট্টছোট্ট লালফুলের থোকার আড়ালে। আমি জল দিতে গেলে, পাতারা ফুলের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বলে, “টুকি, টুকি, আমরা কেমন সবুজ পাতা দেখতে পেলে না”বলে আর হাসে, খুব হাসে। তবে সব থেকে মজার গাছ নয়নতারারোজ নতুন নতুন ফুলে সাজিয়ে তুলবে নিজেকে, উজ্জ্বল বাসন্তী রঙের ফুল। আর রোজ একবার আমাকে তার জিগ্যেস করা চাইই চাই – “আমাকে কেমন লাগছে গো”?  তার গায়ে ঝুলতে থাকা একআধটা হলদে পাতা আমি ছিঁড়ে দিই, তাতে নয়নতারা খুশি হয় খুব। জিগ্যেস করে “কাল আসবে তো”?’

এতক্ষণ ধরে বকবক করলাম, টুপুর একটুও অধৈর্য হল না! মন দিয়ে আমার কথা শুনতে লাগল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার বলা শেষ হলে, সে হাঁটু মুড়ে উঠে বসল সোফায়। আমার দু গালে হাত রেখে বলল, ‘তোমার পেটগুলো আমাকে দাও না, মামা?’

‘তুই নিয়ে নিবি? সব নিয়ে নিবি? বা রে, তাহলে আমি কী নিয়ে থাকবো?’

ঝুমকো ঝুমকো চুলে ঝাঁকি দিয়ে, টুপুরসোনা বেশ জোর গলায় বলল, ‘সে আমি জানিনা, তোমার পেটগুলো আমাকে দেবে কী না বলো? বলো না, মামা, বলো না’।

‘আচ্ছা, আচ্ছা দেবো। পাঠিয়ে দেবো। সক্কাল সক্কাল মাকে নিয়ে তোদের ছাদে উঠিস। যেমন বললাম, সেরকম চাল আর গমের দানা নিয়ে। প্রথম প্রথম বেশি আসবে না। তোকে চেনে না তো?  কয়েকদিন সময় নেবে। তুই কাছে গেলেই উড়ে পালিয়ে যাবে। তোকে কিন্তু রোজ যেতে হবে। রোজ। তাহলেই তোকে চিনে নেবে। তারপর থেকে দেখবি অনেকে আসবে। তুই ছাদে উঠলেই এসে হাজির হবে। তুই কাছে গেলেও ভয় পাবে না’।

‘সত্যি’?

‘একদম সত্যি! তা বলে, ওদের  ধরার চেষ্টাও করিস না। তাহলেই কিন্তু খুব ভয় পাবে’।

‘না, না, ধরবো না’।

‘ধরে রাখলে, ওরা খুব কষ্ট পায়। খোলা আকাশে ওরা উড়বে। আর যখনই তোকে ছাদে দেখবে কাছাকাছি নেমে আসবে। সে বেশ মজার হবে না? তখন সেলফি তুলে, ফেসবুকে আপলোড করে দিবি! দেখবি বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে যাবে।’

হাততালি দিয়ে উঠল টুপুররাণি, বলল, ‘মা, মা, স্কুল যাবার আগে, কাল সকালেই আমরা যাবো। ঠাম্মা, তুমিও যাবে কিন্তু। বাপিকেও নিয়ে যাবো’। তারপর আমার দিকে ফিরে আবার বলল, ‘আর তোমার ফুলগাছ দেবে না?’

‘না, সোনা। ফুলগাছ এখন নয়, তুমি আরো বড়ো হও তখন দেব’।

‘কেন?’

‘ফুলগাছ তো পাখি নয় সোনা! রোজ জল দিতে হয়, মাঝে মাঝে সার দিতে হয়। তোমরা যখন দারজিলিং, পুরী, গোয়া, বেড়াতে যাও সাত-দশ দিনের জন্যে। তখন কে জল দেবে? পাখিদের তুমি খাবার না দিলেও, তারা উড়ে উড়ে অন্য কোথাও খাবার যোগাড় করে নিতে পারে। কিন্তু গাছ তো পারে না! তারা সাত-দিন জল না পেলে শুকিয়ে যাবে। গরমের দিন হলে তো কথাই নেই!’

‘শুকিয়ে যাবে?’

‘যাবে বৈকি, মা। বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আমাদের কত মজা হয়, বল? এদিকে গাছেরা ভীষণ কষ্ট পেয়ে শুকিয়ে যাবে? গাছ কথা বলতে পারে না, ছটফট করতে পারে না, তাই আমরা তাদের কষ্টের কথা বুঝতেই পারি না। যেদিন বুঝতে শিখবি, সেদিন বাড়িতে গাছ এনে পেট করিস’।

টুপুর আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আর কিছু বলল না। কিছু চিন্তা করতে লাগল। আমিও কথা বাড়ালাম না। চুমকিকে বললাম, ‘কফি খাওয়া’।

চুমকি হাসিমুখে বলল, ‘পেট ঠিক হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে, না দাদা? বাঁচালি আমায়, কদিন ধরে যা জ্বালাচ্ছিল’!

‘কাল ভোর থেকে উঠে ছাদে যাওয়ার জন্যে জ্বালাবে!’

‘ধুর, তুইও যেমন। সাতটায় স্কুল যাবার জন্যে সাড়ে ছটায় যাকে ডেকে তুলতে আমার ঘাম ছুটে যায় রোজ! সে রোজ উঠেবে ছটায়? দ্যাখ না, দু একদিন উৎসাহ থাকবে, তারপর নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যাবে। তুই আসবি বলে, ফিশচপ বানিয়েছিলাম, নিয়ে আসি। তারপর কফি দিচ্ছি’।

 

* *

 

সকালে ছাদে ঘুরছিলাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। এত সকালে কে আবার ফোন করল? একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলে দেখলাম, চুমকি ফোন করেছে। ফোন কানেক্ট করে বললাম, ‘গুডমর্নিং। কী ব্যাপার? এত সকাল সকাল ফোন?’

‘দাদা, তুই যে কী জ্বালাস না, বুঝি না! তুই যেদিন এলি, তার পরদিন থেকে রোজ, আজ এই রবিবারেও, ভোর থেকে উঠে টুপুর ছাদে যাচ্ছে, পাখিদের দানা দিতে! কী নেশা বাধিয়ে দিলি বল তো! স্কুল থেকে ফিরে, বিকেলেও গেম খেলে না, টিভি দেখে না। দৌড়ে চলে যায় ছাদে’। আমি খুব হাসলাম।

‘টুপুররাণিকে আমার অনেক আদর দিস’

‘আর আমাকে? আমিও তো নেশায় পড়ে গেছি! রোজ দুবেলা আধঘণ্টা করে ছাদে না উঠলে ভাল লাগে না’।

আমি হাসতে লাগলাম। খুব হাসতে লাগলাম। তাকিয়ে রইলাম, আমার ছাদে দানা খুঁটে খাওয়া পায়রা আর চড়ুইগুলির দিকে। হাসি থামিয়ে অস্ফুটস্বরে বললাম, ‘ভালো থাকিস, ব্যস্‌ভালো থাকিস’ 

--০০--

 

-

                              

 

নতুন পোস্টগুলি

গীতা - ৮ম পর্ব

  এর আগের সপ্তম অধ্যায়ঃ জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ পড়া যাবে পাশের সূত্রে " গীতা - ৭ম পর্ব " অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রহ্মযোগ ১ ...