এর আগের অধ্যায় পড়া যাবে - এই সূত্রে ঃ- "উপভোগের ভোগান্তি"
ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে বাস্তুপুজো আদতে সাপের দেবী মা মনসার পুজো। বর্ষার বাদলে উপচে ওঠা নদীনালাখালবিল অধ্যুষিত গ্রাম বাংলায় সাপের বালাই বড়ো বালাই। মাঠে মাঠে চাষবাস শেষ। ক্ষেতে সজীব ধানের গোড়ায় জমে আছে হাঁটুভর জল। মাঠের সাপেরা গৃহহারা – তারা উদ্ব্যাস্ত উদ্বাস্তু হয়ে ঢুকে আসছে বসত বাড়ির আনাচে কানাচে। এদিকে শরৎ এসে গিয়েছে, বাতাসে হেমন্ত আর শীতের আগমনবার্তা। সাপেদের দীর্ঘ শীতঘুমের কাল আসন্ন। তাদের শরীরে চার-পাঁচমাসের উপযুক্ত ক্যালোরি সংগ্রহে রাখার জৈবিক তাগিদ। মানুষের সঙ্গে সাপেদের প্রত্যক্ষ শত্রুতা না থাকলেও ঘটে যেতে পারে ভুল বোঝাবুঝি – দংশন এনে দিতে পারে মানুষের অনভিপ্রেত মৃত্যু। আর সেই মারাত্মক বিপদ এড়াতেই এই পুজো। মা মনসার আরাধনা।
লৌকিক এবং আদিবাসী দেবতা হিসেবে মনসার পুজোর প্রচলন ছিল কয়েক হাজার বছর আগে থেকে। কিন্তু উচ্চবর্ণ হিন্দুসমাজে তাঁর পুজোর প্রচলন হয়েছিল মোটামুটি খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে। তবে লৌকিক দেবতার স্টেটাস থেকে হিন্দুর দেবীত্বে উত্তরণের জন্যে তাঁকে অবিশ্যি অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। যে কাহিনী ধরা আছে মনসা-মঙ্গলকাব্যে।
ঘটনার সূত্রপাত স্বর্গের দেবসমাজ থেকে। শিবের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও সৎমা চণ্ডীর কোপনজরে ছিলেন মনসা। কলহকালে চন্ডীর ক্রোধে মনসা হারান একটি চোখ আর মনসার বিষদৃষ্টিতে জ্ঞান হারান সৎমা চণ্ডী। তাঁদের কলহে অতিষ্ঠ শিব, কন্যা মনসাকে ত্যাগ করেন – যার ফলে মনসা পতিত হয়ে যান দেবসমাজ থেকে। কন্যার এই দুঃখে অসহায় শিবের অশ্রুপাত থেকে জন্ম হল মনসার নিত্য সহচরী নেতার। দেবসমাজ থেকে প্রত্যাখাতা হয়ে এই সময় মা মনসা মর্তে অবতীর্ণা হলেন ভক্ত সংগ্রহের আশায়। কারণ দেবসমাজে অন্তর্ভুক্তির অন্যতম শর্ত হল মানুষের পূজা। যে দেব অথবা দেবী মর্তে মানুষের নিয়মিত পুজো পান, তিনিই হতে পারবেন দেবসমাজের স্থায়ি মেম্বার। অর্থাৎ শুধুমাত্র শিবের কন্যা বলেই সেকালে দেবতার যোগ্যতা অর্শাত না, দেবতা হতে গেলে প্রমাণ করতে হত দেবত্ব! স্বজনপোষণের আধুনিক প্রথা দেব-সমাজে অন্তত তখনও চালু হয়নি!
নিজের দেবত্ব প্রমাণের জন্যে মা মনসা পৌঁছলেন বঙ্গে। বঙ্গে তখন মুসলিম শাসন। কোন রাজা নয়, কোন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নয়, তিনি অবহিত হলেন চম্পক নগরীর সমৃদ্ধ বণিক চাঁদের কথা। তৎকালীন হিন্দু উচ্চবর্ণে চাঁদ বণিকের এমনই প্রভাব, চাঁদ যদি মা মনসাকে পুজো করেন, তিনি উৎরে যাবেন দেবত্বে। কাজেই মা মনসা টার্গেট করলেন চাঁদসদাগরকে। কিন্তু চাঁদ শিব ও চণ্ডীর একান্ত ভক্ত, মনসার অনুরোধ তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন – বললেন – “যেই হাতে পুজি আমি শিব ও শিবানী, সেই হাতে না পুজিব চ্যাংমুড়ি কানী”। মা মনসার মাথা নাকি চ্যাং মাছের মতো এবং একটি চোখ তাঁর অন্ধ, তাই কানী।
শুধু তাই নয়, তিনি হাতে হেতাল গাছের ডাণ্ডা নিয়ে দিন রাত ঘুরতে লাগলেন মা মনসার খোঁজে। দেখা পেলে তিনি নাকি মা মনসার মাথা ভেঙে মেরেই ফেলবেন এবং আপদ বিদেয় করে তিনি সুখে সংসার করবেন।
“চম্পক নগরে ঘর চাঁদ সদাগর।
মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর।।
দেবীর কোপেতে তার ছয় পুত্র মরে।
তথাচ দেবতা বলি না মানে তাঁহারে।।
মনস্তাপ পায় তবু না নোয়ায় মাথা।
বলে “চেঙমুড়ি বেটি কিসের দেবতা”।।
হেতাল লইয়া হস্তে দিবা নিশি ফেরে।
মনসার অন্বেষণ করে ঘরে ঘরে।।
বলে “একবার যদি দেখা পাই তার।
মারিব মাথায় বাড়ি না বাঁচিবে আর।।
আপদ ঘুচিবে মম পাব অব্যাহতি।
পরম কৌতুকে হবে রাজ্যেতে বসতি”।।”
(কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বিরচিত “মনসামঙ্গল” থেকে উদ্ধৃত; কৃতজ্ঞতাঃ “প্রথম আলো” ব্লগ)
ক্রুদ্ধ মা মনসা এরপর উঠে পড়ে লাগলেন শিবের একান্ত ভক্ত কিন্তু অসম্ভব জিদ্দি চাঁদ বণিককে জব্দ করার জন্যে। চাঁদের ছয়টি পুত্রকে তিনি আগেই হত্যা করেছিলেন, তাতেও হার না মানা চাঁদ সাত-সাতটি বিশাল জাহাজ পূর্ণ বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে বের হলেন দক্ষিণদেশের উদ্দেশ্যে। কালীদহে পৌঁছে মা মনসার চক্রান্তে ডুবে গেল সবকটা তরী - লোকলস্কর মাঝিমাল্লা সমেত। কোনক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ঘরে ফিরলেন সর্বস্বান্ত চাঁদ।
নিঃস্ব চাঁদের ঘরে এল পুত্রসন্তান লক্ষ্মীন্দ্র, লখাই – বিয়ের বাসরঘরে সর্পদংশনে অকালমৃত্যুর ভাগ্য নিয়ে। লখাই বিবাহযোগ্য হলে বন্ধুকন্যা বেহুলার সঙ্গে লখাইয়ের বিয়ে ঠিক করলেন চাঁদ। আর লোহার নিশ্ছিদ্র বাসরঘর বানানোর নির্দেশ দিলেন বিশ্বকর্মাকে। কিন্তু সেখানেও বাদ সাধলেন মা মনসা, ভয় দেখিয়ে তিনি ছোট্ট ছিদ্রপথ রাখতে বাধ্য করলেন বিশ্বকর্মাকে, আর সেই ছিদ্র পথেই কালনাগিনী প্রবেশ করল লখাইয়ের লোহার বাসরঘরে। দংশনে মৃত্যু হল লখাইয়ের, সর্পদষ্টকে নদীবক্ষে ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার নিয়ম। ভেলায় ভেসে চলল লখাই, সঙ্গে রইল নাছোড় বেহুলা।
দীর্ঘ নদীযাত্রার পর নেতাধোবানির ঘাটে শেষ হল বেহুলার কঠিন তপস্যা, মা মনসার সহচরী নেতার মধ্যস্থতায় প্রাণ ফিরে পেল লখাই, শর্ত একটাই - যে করেই হোক চাঁদ বণিককে রাজি করাতে হবে মা মনসার পুজো দিতে। জীবন্ত স্বামীসহ গ্রামে ফেরা পুত্রবধূ বেহুলার সনির্বন্ধ অনুরোধ এবার আর ফেলতে পারলেন না, চাঁদ শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হলেন এবং বাঁ হাতে একটি ফুল দিয়ে সেরে ফেললেন মা মনসার পুজো। দিকে দিকে রটে গেল সেই বার্তা, শুরু হয়ে গেল মর্তে মা মনসার পুজো।
আমার দিদিমা ও বাড়ির অন্যান্য সবাইকে দেখেছিলাম নিশ্ছিদ্র শুদ্ধতায় ও নিষ্ঠায় এই পুজোর জোগাড় করতে। মনে হয়েছিল সেই শুদ্ধতার পিছনে যতটা না ভক্তি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ভয়। যেন পুজোর আচারে সামান্য ত্রুটি হলেই ঘটে যাবে অনর্থ – সংসারে মারাত্মক অকল্যাণ ঘটে যেতে পারে দেবীর কোপে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে দিদিমার কাছে শুনেছিলাম এই কাহিনী।
পঞ্চনাগের অলংকারে সজ্জিতা ছোট্ট মাতৃমূর্তি। তাঁর পূজো হল শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনে। নৈবেদ্যের প্রধান উপচার ছিল দুধ আর কলা। কিন্তু মনে হল এই শাস্ত্রীয় পুজোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল লোকাচার। ফণীমনসা গাছের কণ্টকিত পুরু চ্যাপ্টা সবুজ একটা ডালকে পুকুরে স্নান করানো হল। স্নানের পর সিঁদুর দিয়ে সেই ডালে এঁকে দেওয়া হল ত্রিনয়ন আর সিঁথির সিঁদুর। তারপর সেই ডালটিকে লালপাড় কোরা শাড়ীতে মুড়ে দেওয়া হল – ঠিক ঘোমটা দেওয়া কোন বধূর মুখের মতো। সেই সজ্জিত ফণীমনসার ডালটি অধিষ্ঠিতা হলেন বহুপ্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষের থানে। সেই থানে এসে যথাসাধ্য উপচারে গ্রামের মহিলারা ও কুমারী মেয়েরা গড় হয়ে প্রণাম করে যাচ্ছিল একে একে। জাত-পাত, উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র কোন ভেদাভেদ নেই – সেই প্রতীকী ফণীমনসা মূর্তির সামনে। উপস্থিত মহিলারা সমবেত উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ আর যৌথ ব্রত গানে ভরিয়ে তুললেন উন্মুক্ত প্রান্তর - প্রকৃতি। পিছনে বাজছিল ঢাকের বাদ্যি। সে বাদ্যির আওয়াজ দুর্গাপুজোয় যে সুর সেরকম নয়, একদম অন্যরকম - একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন।
পুজো অর্চনার শেষ পর্যায়ে আনা হল কালো কুচকুচে একটি পাঁঠা। খুঁতহীন সুন্দর শরীর। যৌবনের উন্মেষ বোঝা যায় তার মাথায় শিংয়ের আভাস থেকে। তিন-চারদিন আগে হাট থেকে তাকে বাড়িতে আনা হয়েছে নগদ মূল্যে। এই কটাদিন তার আপ্যায়ন হচ্ছিল সতেজ তৃণ আর সুস্বাদু কাঁঠাল পাতায়। তার আচরণে এতদিন কোন অস্বস্তি বা অসহযোগীতার লক্ষণ চোখে পড়েনি। কিন্তু আজ এই দেবস্থানে আসতে সে এত নারাজ কেন? সমবেত উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ, ঢাকের বাদ্যি আর এই জনসমাগম কি তার মনে এনে দিয়েছে ভয়? নিদারুণ মৃত্যু যে তার আসন্ন সে কি বুঝতে পারছে?
চারপাঁচজন মিলে সেই অজবালককে সামলাতে লাগল। আর পুরোহিত তার কপালে এঁকে দিলেন রক্তবর্ণ সিঁদুরের দীর্ঘ তিলক। গলায় পরিয়ে দিলেন রক্তজবার মালা। তাকে বিধিমতো পবিত্র করে নিলেন গঙ্গোদকে আর মন্ত্র উচ্চারণে, তাকে উৎসর্গ করে দেওয়া হল দেবীর চরণে। এরপর তার গ্রীবা বেঁধে দেওয়া হল অস্থায়ী হাড়িকাঠের আগড়ে। একজন তার সামনের দুই পা আরেক জন পিছনের দুইপা টেনে চেপে ধরে থাকল সেই অজ-বালকের। বিশাল খাঁড়া হাতে এক শীর্ণ চেহারার প্রৌঢ়বীর এতক্ষণ প্রস্তুত ছিলেন, তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন – “জয়, মা মনসার জয়”, সমবেত জনগণও সমস্বরে বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, “জয়, মা মনসার জয়”। অতি দ্রুত খাঁড়া নেমে এল - মুণ্ডহীন অজশরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগল রক্ত। সেই রক্তের টীকা শরীরে নেবার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল উপস্থিত জনগণের মধ্যে। ওই উন্মাদনায় আমি সামিল হতে পারলাম না। ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি প্রত্যক্ষ করতে থাকলাম বাংলার লোকধর্মের প্রাচীন পরম্পরা আর দেবতার থানে বিপন্ন আম-মানুষের ব্যাকুল আর্তি।
লোকাচারের মধ্যেই লুকিয়ে সাধারণ মানুষের ইতিহাস, ধন্যবাদ লেখককে সুপ্রাচীন এক লোকাচারের ইন্টারনেটে সুললিত চিরকালীন দলিল বানিয়ে দেবার জন্য।
উত্তরমুছুনএই লোকাচারের পিছনে আমার চিন্তা-ভাবনার কথা আমি বলেছি, তার মধ্যে ইতিহাস খুঁজো না, ভাই, ইতিহাসবিদ্রা রেগে যাবেন...
উত্তরমুছুন